প্রাণ নিয়ে খেলা

প্রাণ নিয়ে খেলা

এমন বিপজ্জনক পেশা ধরলেন কেন আপনি? দুনিয়াতে করে খাওয়ার জন্য আর কোনো পথ কি আপনার চোখে পড়ল না?

প্রশ্নটি করেছিলেন রাশিয়ার বিখ্যাত বৈমানিক ভ্যালেরি শোলোকভ।

প্রশ্নের উত্তরে উদ্দিষ্ট ব্যক্তি বললেন, আপনার পেশাটি আরও বেশি বিপজ্জনক।

 আজ্ঞে না মশাই, শোলোকভ হেসে উঠেছিলেন, আপনার সঙ্গে জায়গা বদল করতে আমি রাজি নই।

হ্যাঁ, বৈমানিকের পেশা অত্যন্ত বিপজ্জনক বটে, কিন্তু একদল সিংহের মাঝখানে দাঁড়িয়ে খেলা দেখানোর কাজটা আরও বিপজ্জনক আর ভয়াবহ বলে মনে হয়েছিল সেইজন্যেই সার্কাসের ক্রীড়ামঞ্চে বরিস অ্যাডারের খেলা দেখে উপযুক্ত মন্তব্য করেছিলেন রুশ বৈমানিক ভ্যালেরি শোলোকভ।

বরিস অ্যাডার!

সোভিয়েট রাশিয়াতে সার্কাসের ইতিহাসে একটি নাম।

রুশ জাতি চিরকালই সার্কাসের খেলায় অত্যন্ত দক্ষ। ট্রাপিজ, রিং, বার এবং বিভিন্ন ধরনের জিমনাস্টিক্স প্রদর্শনীতে তারা অসামান্য কৃতিত্ব দেখিয়েছে, কিন্তু ১৯৩৫ সালের আগে সার্কাসের আসরে বন্য পশুর খেলায় বিশেষ সাফল্য অর্জন করতে পারেনি রাশিয়ার মানুষ। রাশিয়ার সার্কাসে হিংস্র জানোয়ার নিয়ে বরাবরই খেলা দেখিয়েছে জার্মান খেলোয়াড়। ১৯৩২ সালে রাশিয়ার ভরোনেজ শহরে জনৈক অসাধু জার্মান খেলোয়াড়ের লোভ আর অন্যান্য দাবির ফলে বন্য পশুর ক্রীড়ামঞ্চে একটি স্থানীয় মানুষের আবির্ভাব ঘটল, নাম তার বরিস অ্যাডার।

ঘটনার সূত্রপাত কী করে ঘটল, সে-কথাই বলছি।

সোভিয়েট রাশিয়ার সার্কাস বোর্ড জনৈক মালিকের কাছ থেকে একদল সিংহ কিনে নিয়েছিল। পূর্বোক্ত সিংহদের নিয়ে যে-লোকটি খেলা দেখাত, সেও ছিল জার্মান নাম কার্ল জেমেবাচ। কার্লের বদ্ধমূল ধারণা ছিল সে ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তি ওই সিংহদের নিয়ে খেলা দেখাতে পারবে না।

অতএব পারিশ্রমিক অর্থের জন্য তার দাবি বাড়তে লাগল অন্যায়ভাবে এবং দাবি পূরণ না-করলে সে যে দেশে ফিরে যেতে পারে সেই চমৎকার সম্ভাবনার কথাটিও বোর্ড-কে জানিয়ে দিতে ভুলল না।

কার্লের অন্যায় ব্যবহারে বিরক্ত হয়ে বোর্ড স্থির করল সিংহের খেলা দেখানোর জন্য অন্য খেলোয়াড় নিযুক্ত করা হবে। কিন্তু ব্যাপারটা সহজ নয়। রাশিয়ার খেলোয়াড় বিভিন্ন ধরনের সার্কাসের খেলায় দক্ষতা অর্জন করলেও বন্য পশু নিয়ে খেলা দেখাতে অভ্যস্ত নয়। সেই সময় বরিস অ্যাডার নামক জিমনাস্টিসের খেলোয়াড়টি ঠিক করলেন তিনি নিজেই সিংহের খেলা দেখাবেন।

বোর্ড প্রথমে আপত্তি তুলল–বুনো জানোয়ার নিয়ে খেলা দেখানো ভীষণ বিপজ্জনক, বিশেষ করে পশুরাজ সিংহকে নিয়ে হাতে খড়ি করতে গেলে অনভিজ্ঞ মানুষের প্রাণহানি ঘটতে পারে যেকোনো মুহূর্তে।

বরিস অ্যাডার একেবারে নাছোড়বান্দা

বিদেশিরা অন্যায়ভাবে জুলুম করে টাকা আদায় করবে আর আমরা তাদের অন্যায় ব্যবহার সহ্য করব? রাশিয়াতে কি মানুষ নেই?

অনেক তর্কবিতর্কের পর বোর্ড বরিস অ্যাডারকে সিংহের খেলা দেখাতে অনুমতি দিল। জিমনাস্টিকসের খেলায় ইস্তফা দিয়ে বরিস এলেন হিংস্র পশুদের নিয়ে খেলা দেখাতে। অ্যানিম্যাল ট্রেনার বা পশুশিক্ষক হিসাবে তাঁর শিক্ষানবিশি শুরু হল পশুরাজ সিংহের ভয়াবহ সাহচর্যে।… মস্কো থেকে খেলা দেখানোর অনুমতি পেয়েই অদূর ভবিষ্যতের জন্য অপেক্ষমাণ চতুম্পদ ছাত্রদের দর্শন করতে এলেন বরিস অ্যাডার। প্রথম দর্শনের অনুভূতি যে খুব উৎসাহজনক হয়নি সে-কথা স্বীকার করতে তাঁর দ্বিধা নেই–অ্যাডার সাহেব সোজাসুজি বলেছেন যে, খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে বিপুলবপু মরুচারী রাজন্যবর্গর দেহসৌষ্ঠব নিরীক্ষণ করতে করতে তার সর্বাঙ্গে জেগে উঠেছিল আতঙ্কের শীতল শিহরন মনে হয়েছিল, এই ভয়ংকর জানোয়ারগুলোকে তিনি কি বশ করতে পারবেন? এদের নিয়ে খেলা দেখানো কি সম্ভব হবে তার মতো অনভিজ্ঞ মানুষের পক্ষে?

প্রথম যেদিন সিংহের খাঁচায় প্রবেশ করলেন বরিস অ্যাডার, সেইদিনই জন্তুগুলোর ভয়ংকর স্বভাবের পরিচয় পেলেন তিনি। খাঁচায় ঢোকার সঙ্গেসঙ্গেই তিন-তিনটি সিংহ তাকে লক্ষ করে তেড়ে এল। আক্রমণোদ্যত সিংহের রুদ্র মূর্তির সামনে বরিস সাহেবের অনভ্যস্ত স্নায়ু বিদ্রোহ ঘোষণা করল–দ্রুতবেগে পিছিয়ে এসে তিনি তাড়াতাড়ি খাঁচার দরজা বন্ধ করে দিলেন, ক্রুদ্ধ সিংহের মুখোমুখি মোকাবেলা করার সাহস সেদিন তাঁর হয়নি।

কার্ল জেমবাচ তখন একগাল হেসেছিল বটে, কিন্তু পরের দিন যখন বরিস আবার সিংহের খাঁচায় প্রবেশ করলেন এবং দু-দুটো ক্রব্ধ সিঙ্ঘের আক্রমণ এড়িয়ে তাদের নিয়ে খেলা দেখাতে শুরু করলেন, তখন তার মুখের হাসি মুখেই রয়ে গেল।

কয়েকদিনের মধ্যেই সিংহদের স্বভাবচরিত্র সম্পর্কে অ্যাডার সাহেব সচেতন হয়ে উঠলেন। সব মানুষের স্বভাব একরকম হয় না, সিংহদের সম্পর্কেও একই নিয়ম প্রযোজ্য মানুষের মতো তাদের চরিত্রেও বিভিন্ন দোষগুণের পরিচয় পাওয়া যায়। সার্কাসের দলে প্রাইমাস, রিফি এবং মুরাদ নামে তিনটি সিংহ ছিল অতিশয় ভয়ংকর ও কোপনস্বভাব, বিন্দুমাত্র সুযোগ পেলেই তারা ঝাঁপিয়ে পড়ত খেলোয়াড়ের ওপর আবার আলি নামে সিংহটি ছিল খুবই শান্ত ও ভদ্র। ওই আলির সঙ্গে বরিস অ্যাডারের বন্ধুত্বের বন্ধন গড়ে উঠেছিল। আলি ছাড়া ক্রিম নামক আর একটি সিংহও অ্যাডার সাহেবকে বন্ধুত্বের মর্যাদা দিয়েছিল। একটি ঘটনার উল্লেখ করলেই বোঝা যাবে পশুরাজ সিংহও মানুষের ভালোবাসার দাম দিতে জানে।

একদিন বরিস যখন সিংহদের নিয়ে খেলা দেখাচ্ছেন সেইসময় অতর্কিতে দুটি সিংহ তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে মাটির ওপর পেড়ে ফেলল; কিন্তু নখদন্তের প্রহারে মানবদেহটি ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়ার আগেই আততায়ীদের ওপর বিনা মেঘে বজ্রাঘাতের মতোই অবতীর্ণ হল বন্ধুবর ক্রিম। ক্রিমের আক্রমণে আততায়ীরা বরিস সাহেবের দেহের উপর থেকে সরে যেতে বাধ্য হল এবং তিনিও সেই সুযোগে উঠে দাঁড়িয়ে চটপট খাঁচার বাইরে এসে আত্মরক্ষা করলেন। বরিস অ্যাডার বুঝলেন, অরণ্যচারী সিংহও বন্ধুত্বের মর্যাদা রক্ষা করতে জানে।

সিংহের খেলা দেখাতে গিয়ে বরিস অ্যাডারের জীবন বিপন্ন হয়েছে বারংবার। প্রাইমাস আর রিফি নামের সিংহ দুটি বার বার অ্যাডার সাহেবকে আক্রমণ করেছে। তারা ছিল দুই সহোদর। বরিস অ্যাডার তাদের নামকরণ করেছিলেন দুই দস্যু ভাই।

সহোদর ভাইদের মতোই দুই দস্যুর মধ্যে ছিল নিবিড় একতা ও বন্ধুত্বের বন্ধন। ওদের মধ্যে একজনের সঙ্গে বরিস অ্যাডারের লড়াই শুরু হলেই অপরজন তৎক্ষণাৎ অকুস্থলে এসে উপস্থিত হত। ভাইকে সাহায্য করার জন্য। ফলে একটির পরিবর্তে দুটি সিংহকে নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লেন বরিস অ্যাডার।

একটি ঘটনার উল্লেখ করছি।

সার্কাসে খেলা দেখানোর পর লোহার গরাদে ঘেরা সরু পথ দিয়ে খাঁচায় ঢোকার সময়ে হঠাৎ রিফি বরিস অ্যাডারকে আক্রমণ করল। ফাঁকা রিভলভার দিয়ে আওয়াজ করে তিনি জন্তুটাকে ভয় দেখাতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু রিভলভারটা ঠান্ডায় অকেজো হয়ে গিয়েছিল, শব্দ হল না রিফি তৎক্ষণাৎ বরিসের রিভলভারসুদ্ধ ডান হাতটা কামড়ে ধরল। পরক্ষণেই অকুস্থলে রিফির ভাই প্রাইমাস-এর আবির্ভাব; এক মুহূর্ত বিলম্ব না-করে প্রাইমাস কামড় বসাল বরিস সাহেবের বাঁ-হাতের উপর–তারপর দুই ভাই মিলে টানাটানি করে শিকারকে খাঁচার ভিতর নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে লাগল।

সিংহ-চরিত্রে অভিজ্ঞ অ্যাডার বুঝলেন তারা যদি তাকে একবার গরাদে ঘেরা গলিপথের ভিতর থেকে নিজস্ব খাঁচার ভিতর নিয়ে যেতে পারে তাহলে আর রক্ষা নেই–দুই ভাই মিলে তার শরীরটাকে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়বে। বরিস চটপট তার দুই পা লোহার গরাদের ভিতর ঢুকিয়ে দিয়ে পায়ের সাহায্যে গরাদ আঁকড়ে ধরলেন, শুরু হল টাগ-অব-ওয়ার। আশেপাশে যারা ছিল তারা ভয়ে হতবুদ্ধি, দু-দুটি সিংহের কবল থেকে মানুষটাকে ছাড়িয়ে আনার সাহস বা ক্ষমতা কারুর নেই। হঠাৎ গরাদের সামনে এগিয়ে এল সার্কাসের এক খেলোয়াড়। সামনেই ছিল এক বালতি জল খেলোয়াড়টি বালতি তুলে গরাদের ফাঁক দিয়ে জল ঢেল দিল সিংহদের গায়ে। মরুভূমির সিংহ রাশিয়ার তীব্র শীতল আবহাওয়াতে অভ্যস্ত নয়–হাড় কাঁপানো শীতের মধ্যে কনকনে ঠান্ডা জলের আক্রমণ বিখ্যাত সিংহ-বিক্রমকে কাবু করে দিল–ঘেঁয়াওৎ শব্দে প্রতিবাদ জানিয়ে সিংহ দুটি শিকার ছেড়ে ছিটকে সরে গেল দূরে।

বরিস এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করলেন না, এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে লৌহবেষ্টনীর বাইরে এসে চটপট লোহার দরজা বন্ধ করে দিলেন। সিংহেরা অবশ্য তৎক্ষণাৎ সগর্জনে ছুটে এসেছিল, কিন্তু বরিস তখন নাগালের বাইরে।

সার্কাসের এক অখ্যাত খেলোয়াড়ের উপস্থিত বুদ্ধির জন্যই সেবার নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে গেলেন বরিস অ্যাডার।

বরিসের ঘটনাবহুল জীবনে তিনি বহুবার মৃত্যুর সম্মুখীন হয়েছেন। শুধু সিংহ নয়–বাঘ, লেপার্ড, ভাল্লুক প্রভৃতি বিভিন্ন ধরনের হিংস্র জানোয়ার নিয়ে তিনি খেলা দেখিয়েছেন। পরবর্তীকালে যে সুন্দরী মহিলাটির তিনি পাণিগ্রহণ করেছিলেন সেই মহিলাটিও সার্কাসের রঙ্গমঞ্চে হিংস্র পশুর খেলা দেখিয়েছেন সাফল্যের সঙ্গে এবং স্বামীর মতোই অগণিত দর্শকের প্রশংসা অর্জন করেছেন মিসেস টামারা অ্যাডার।

বরিস অ্যাডারের কথা বলতে গিয়ে তার জীবনসঙ্গিনী সম্পর্কে কয়েকটি কথা বলা বোধ হয় অপ্রাসঙ্গিক হবে না।

আগেই বলেছি স্বামীর মতোই ওই মহিলাটিও বিভিন্ন হিংস্র পশুর খেলা দেখিয়ে দর্শকদের মনোরঞ্জন করেছেন। সার্কাসের রঙ্গমঞ্চে খেলা দেখাতে গিয়ে একটি অতিশয় হিংস্র জীবের সঙ্গে টামারার বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল।

পূর্বোক্ত জীবটির নাম ছিল হ্যারি। উসুরি অঞ্চলের একটি বাঘ ও আফ্রিকার এক সিংহীর সংমিশ্রণে জাত হ্যারি নামের টাইগ্রন ছিল যেমন বিশাল দেহ ও প্রচণ্ড শক্তির অধিকারী, তার স্বভাবও ছিল তেমনই ভয়ংকর। ওই অতিকায় অতি-ভয়ংকর টাইগ্রন ভীষণ ভয় করত সার্কাসের একটি ছোটোখাটো বাঘকে। ছোটোখাটো বাঘটির নাম ছিল রাজা। রাজা সুন্দরবনের জানোয়ার, বাঘের দলে সে ছিল সবচেয়ে ছোটো। রাজার স্বভাবচরিত্র বেশ ভালোই, কিন্তু হ্যারিকে দেখলেই তার মেজাজ হত খাপ্পা নখদন্ত বিস্তার করে সে হ্যারিকে তাড়া করত আর ক্ষুদ্রকায় শত্রুর আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার চেষ্টায় শশব্যস্ত হয়ে পড়ত বিপুলবপু হ্যারি। বাঘদের নিয়ে খেলা দেখাতে গিয়ে রাজা আর হ্যারিকে নিয়ে এমন বিব্রত হয়ে পড়তেন বরিস যে, ভালো করে খেলার দিকে মন দেবার সুযোগ তার হত না। অতএব বরিসের নির্দেশে রঙ্গমঞ্চের লৌহবেষ্টনীর পাশে দাঁড়িয়ে থাকতেন টামারা, তার হাতে থাকত সুদীর্ঘ পিচফর্ক (লম্বা লাঠির মুখে সাঁড়াশির মতো দুটি শানিত ফলক বসানো। পিচফক খড় তোলার কাজে ব্যবহৃত হয়, কিন্তু সার্কাসের খেলোয়াড়ের হাতে ওই বস্তুটি মারাত্মক অস্ত্র)।

হ্যারিকে রাজা আক্রমণ করলেই খাঁচার ফাঁক দিয়ে পিচফর্কের সাহায্যে রাজাকে খোঁচা মারতেন টামারা এবং হ্যারিকে ছেড়ে নিজের জায়গায় গিয়ে খেলা দেখাতে বাধ্য হত রাজা। বারকয়েক খোঁচা খেয়েই রাজা বুঝল হ্যারিকে আক্রমণ করলেই টামারার পিচফর্ক তার দেহ বিদ্ধ করবে, অতএব সে শান্তভাবে হ্যারির সঙ্গে সহাবস্থান মেনে নিয়ে খেলা দেখাতে শুরু করল।

একদিন বাঘগুলোকে তাদের নিজস্ব খাঁচার ভিতর থেকে রঙ্গমঞ্চের লৌহবেষ্টনীর মধ্যে এনে বরিস যখন খেলা দেখানোর উদ্যোগ করছেন, সেই সময়ে দৈবক্রমে টামারা আছেন কি নেই তা খেয়াল করেননি বরিস, কিন্তু টামারার অনুপস্থিতির সুযোগ গ্রহণ করল রাজা তৎক্ষণাৎ সগর্জনে সে তেড়ে গেল হ্যারির দিকে। হাঁকডাক! গর্জন! মহাকায় হ্যারি ছুটছে লৌহবেষ্টনীর ভিতর, পিছনে তার ক্ষুদ্রকায় রাজা।

গোলমাল শুনে টামারা তাড়াতাড়ি এসে পড়লেন অকুস্থলে, হাতে তাঁর পিচফর্ক। হ্যারি চটপট লোহার গরাদের ধারে টামারার কাছে এসে দাঁড়াল, আর রাজাও হ্যারিকে ছেড়ে ফিরে গিয়ে বরিসের নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল সুবোধ বালকের মতো টামারাকে দেখেই রাজার সুবুদ্ধির উদয় হয়েছে, পিচফর্কের ধারালো অভ্যর্থনা তার ভালো লাগে না একটুও।

গোলমাল মিটে যেতে হ্যারিও শান্তভাবে তার নিজের জায়গায় এসে বসল খেলা দেখাতে। কিন্তু খেলা শুরু করার আগে সে হঠাৎ টামারার দিকে ফিরে এক প্রচণ্ড হুংকার ছাড়ল—বোধ হয় বাঘের ভাষায় বলল, ছিলে কোথায় কতক্ষণ? আর একটু হলেই গুণ্ডাটা যে আমায় শেষ করে দিত!

খাঁচার ফাঁক দিয়ে হ্যারির ঘাড়ে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করতেন টামারা এবং হ্যারিও সেই আদর উপভোগ করত শান্তভাবে। কিন্তু টামারাকে ভালোবাসলেও বরিস সম্পর্কে হ্যারির মনোভাব ছিল অত্যন্ত ভয়ংকর সুযোগ পেলেই সে সগর্জনে ঝাঁপিয়ে পড়ে নখদন্তের আলিঙ্গনে বরিসকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলার চেষ্টা করত। সার্কাসে খেলা দেখানোর আগে বন্য পশুকে নিয়ে খেলোয়াড় রিহার্সাল বা তালিম দিয়ে থাকেন। প্রথম প্রথম ওই রিহার্সালের সময় এমন উগ্রমূর্তি ধারণ করত হ্যারি যে, খেলা দেখানো তো দূরের কথা নিজের প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টায় অস্থির হয়ে পড়তেন বরিস সাহেব।

জানোয়ার যদি সবসময়েই খেলোয়াড়কে আক্রমণ করার চেষ্টা করে, তাকে দিয়ে খেলা দেখানো অসম্ভব। অতএব হ্যারিকে জব্দ করার একটা উপায় স্থির করলেন। কয়েকটা সোডার বোতল ভরতি বাক্স নিয়ে একদিন তিনি ঢুকলেন হ্যারির খাঁচায়। হ্যারি তাকে লক্ষ করে তেড়ে আসতেই একটা বাক্স তিনি ছুঁড়ে দিলেন জন্তুটার দিকে। শূন্যপথেই দাঁতে নখে লুফে নিয়ে বাক্সটাকে ভেঙে ফেলল হ্যারি, সঙ্গেসঙ্গে–ফটাস! প্রচণ্ড শব্দে সোডার বোতলের বিস্ফোরণ। হ্যারির পিলে গেল চমকে, এক লাফে সে পিছিয়ে গেল। কয়েকটি মিনিট সে হতভম্ব হয়ে ছিল, তারপর আবার নূতন উদ্যমে সে বরিসকে আক্রমণ করল। বরিস তৈরি ছিলেন, সোডার বোতল ভরতি দ্বিতীয় বাক্স তার হাত থেকে ছুটে গেল হ্যারির দিকে এবং প্রথমটির মতো দ্বিতীয় বাক্সটিও হ্যারির নখদন্তের আপ্যায়নে বিদীর্ণ হল প্রচণ্ড শব্দে। হ্যারি এবার কাবু হল, ক্রুদ্ধ ব্যাঘ্রের গর্জিত কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দিল বাক্সের গর্জন! আক্রমণের চেষ্টা ছেড়ে হ্যারি খেলোয়াড়ের নির্দেশ মানতে সচেষ্ট হল।

হ্যারি ছাড়া আর একটি প্রাণী বরিসকে বিব্রত করে তুলেছিল। যে বাঘের দলটাকে নিয়ে বরিস খেলা দেখাতেন, সেই দলে জ্যাক নামে একটি মানুষখেকো বাঘ ছিল। নরখাদক শ্বাপদ নিয়ে কোনো খেলোয়াড় সচরাচর খেলা দেখায় না, কিন্তু বরিস ওই ভয়ংকর জন্তুটাকে নিয়েও খেলা দেখিয়েছেন। জ্যাকের আক্রমণে বরিসের জীবন বিপন্ন হয়েছে একাধিকবার কিন্তু সদয় ব্যবহার, অসীম ধৈর্য ও অনুশীলনের ফলে মানুষখেকো বাঘও শেষ পর্যন্ত মানুষের বশীভূত হয়েছিল। বরিস বলেন, সদয় ব্যবহার দিয়েই তিনি জ্যাকের মন জয় করতে সমর্থ হয়েছিলেন। হিংস্র শ্বাপদও তাহলে ভালোবাসার প্রতিদান দিতে জানে!

তবে বুনো জানোয়ারকে সবসময় বিশ্বাস করা চলে না। পাপা নামে একটি সিংহীকে শিশুকাল থেকেই পুষেছিলেন বরিস। পাপা সার্কাসের খাঁচায় থাকত না, থাকত বরিসের সঙ্গে একই বাড়িতে। কিন্তু পাপা যখন বড়ো হয়ে উঠল তখন বরিসের বাড়িওয়ালা বরিসকে জানিয়ে দিলেন তাঁর বাড়িটা তিনি বরিসকে ভাড়া দিয়েছেন বটে, কিন্তু একটা ধুমসো সিংহী নিয়ে সেখানে বসবাস করার অধিকার বরিসের নেই। অগত্যা বরিস পাপাকে সার্কাসের ভিতর একটা খাঁচায় রাখার ব্যবস্থা করলেন।

পাপার স্বভাবচরিত্র ছিল চমৎকার। লাফঝপ করে বেড়ালেও তার ব্যবহারে শ্বাপদসুলভ হিংস্র উগ্রতার চিহ্ন ছিল না একটুও। কিন্তু সার্কাসের খাঁচায় যাওয়ার পর থেকেই তার স্বভাবের পরিবর্তন ঘটল। যারা সার্কাসে জন্তুদের দেখাশুনা করে সেই পশুরক্ষকদের দেখলেই সে হিংস্র হয়ে উঠত, ক্রুদ্ধ গর্জনে বিরক্তি জানাত বারংবার বোধ হয় তার ধারণা হয়েছিল ওই লোকগুলোই তাকে বরিসের কাছ থেকে সরিয়ে এনে খাঁচায় আটকে রেখেছে। বরিস তার মনোভাব বুঝতেন, কিন্তু সার্কাসের খেলা নিয়ে এতই ব্যস্ত থাকতেন যে, পাপার সঙ্গে যখনতখন দেখাসাক্ষাৎ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। নিঃসঙ্গ অবস্থায় পাপার চরিত্রে আমূল পরিবর্তন ঘটল, সে হয়ে উঠল ভয়ংকরী।

একদিন চরম বিপর্যয় ঘটল। বরিস এসেছেন অনেক দিন পরে, পাপাকে আদর করে বিদায় নেবার উদ্যোগ করছেন–অকস্মাৎ তাঁর কণ্ঠদেশ লক্ষ করে কামড় বসাল পাপা। তাড়াতাড়ি হাত তুলে বরিস গলা বাঁচালেন বটে, কিন্তু সিংহীর ধারালো দাঁতের আঘাতে তার হাতের অবস্থা হল শোচনীয়। কোনোরকমে আত্মরক্ষা করে বরিস পাপাকে তার খাঁচার ভিতর ঠেলে দিলেন। পাপা এক কোণে গিয়ে বসে রইল চুপ করে। রক্তাক্ত হাতটা তুলে ধরলেন বরিস পাপার দিকে, বললেন, দেখ কী করেছ! তোমার লজ্জা করে না? তোমাকে আমি এত ভালোবাসি, এই তার প্রতিদান?

মাথা নীচু করে পাপা এগিয়ে এল। ধীরে ধীরে মুখ তুলে রক্তাক্ত হাতটা চাটতে শুরু করল। স্পষ্টই বোঝা গেল তার ব্যবহারে সে লজ্জিত। হঠাৎ খেপে গিয়ে একটা বিশ্রী কাণ্ড সে করে ফেলেছে বটে, কিন্তু বরিসকে হত্যা করার ইচ্ছা তার ছিল না।

যাই হোক, বরিস বুঝলেন তাঁদের আগেকার সম্পর্ক আর ফিরে আসবে না; কারণ পাপা যেভাবে তার কাছ থেকে সেবা-যত্ন পেতে অভ্যস্ত, সেইভাবে তাকে দেখাশুনা করার সময় এখন বরিসের নেই। অতএব আবার দুর্ঘটনা ঘটার আগেই সাবধান হওয়া ভালো পাপাকে পাঠিয়ে দেওয়া হল চিড়িয়াখানায়।

বরিস অ্যাডার জীবনে বিভিন্ন ধরনের হিংস্র পশুর বন্ধুত্ব লাভ করেছেন এবং তার আদরের চতুষ্পদ বন্ধুদের আক্রমণে তার প্রাণ বিপন্ন হয়েছে বারংবার–তবু সার্কাসের রঙ্গমঞ্চে বরিসের আকর্ষণ কমেনি একটুও।

বরিস অ্যাডার বলেছেন, ওরা দু-একসময় ভীষণ দুষ্টুমি করে বটে, কিন্তু ছেলে-মেয়ে দুষ্ট হলে বাপ কি কখনো সন্তান ত্যাগ করে? আমি ওদের ভালোবাসি; হোক না দুষ্ট, ওরা আমার গর্বের বস্তু।