অগ্নি পরীক্ষা

অগ্নি পরীক্ষা

১৯৪২ সাল, ৭ নভেম্বর।

পূর্বোক্ত তারিখে মধ্য আফ্রিকার নগানচু নামে এক ফরাসি উপনিবেশকে কেন্দ্র করে শুরু হচ্ছে আমাদের কাহিনি।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের নরমেধ যজ্ঞ চলছে দেশে দেশে। ইউরোপ, আমেরিকা ও এশিয়ার সর্বত্র প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ছড়িয়ে পড়ছে সেই আগুন সর্বগ্রাসী দাবানলের মতো। কাফ্রিদের দেশ আফ্রিকাও রণদেবতার কৃপাদৃষ্টি থেকে বঞ্চিত হল না।

আফ্রিকার বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডের ওপর ফ্যাসিস্ট জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হল দুই মিত্রপক্ষ ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ড। জার্মানির ফ্যাসিস্ট বাহিনি তখন ফ্রান্সে পদার্পণ করেছে, কিন্তু আফ্রিকার বুকে ছোটো ছোটো ফরাসি সৈন্যদল যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে প্রচণ্ড উৎসাহে। ইংরেজ ও ফরাসির আর এক বন্ধু আমেরিকা যানবাহন ও কলকবজার বিষয়ে বিশেষজ্ঞ কিছু লোজন পাঠিয়ে যুধ্যমান মিত্রপক্ষকে সাহায্য করেছিল।

যাদের দেশের ওপর এই ভয়াবহ তাণ্ডব চলছিল, সেই নিগ্রো নামধারী কালো মানুষরা কিন্তু কোনো পক্ষেই যোগ দেয়নি। যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন দেশের সাদা মানুষরা শোষণ করেছে আর উৎপীড়ন চালিয়েছে হতভাগ্য নিগ্রোদের ওপর, আজ তারা বুঝেছে সাদা মানুষ মাত্রেই কালো চামড়ার শত্রু

অতএব আত্মকলহে দুর্বল সাদা চামড়ার মানুষগুলোকে ঘায়েল করার এই হচ্ছে উপযুক্ত সময়।

নিগ্রোরা ঝাঁপিয়ে পড়ল শ্বেতাঙ্গদের ওপর।

ইংরেজ, ফরাসি, জার্মান প্রভৃতি কোনো শ্বেতকায় জাতিকেই তারা নিষ্কৃতি দিল না। বিভিন্ন শ্বেতাঙ্গ জাতির ওপর হানা দিয়ে ফিরতে লাগল বিভিন্ন গোষ্ঠীর নিগ্রো যোদ্ধার দল।

রক্ত আর আগুনের সেই ভয়ংকর পটভূমিকায় ১৯৪২ সালের ৭ নভেম্বর মধ্য আফ্রিকার ফরাসি উপনিবেশ নগানচু নামক স্থানে উত্তোলন করলাম বিস্মৃত ইতিহাসের যবনিকা।

নগানচুতে একটি ফাঁকা মাঠের ওপর যেখানে ফরাসিদের সারি সারি শিবির পড়েছে, সেইখানে খুব সকালেই শিবিরের বাসিন্দাদের মধ্যে বেশ চাঞ্চল্য দেখা গেল!

চাঞ্চল্যের কারণ ছিল—

চারজন ফরাসি সৈনিক একটি বন্দিকে নিয়ে এগিয়ে চলেছে নিকটবর্তী অরণ্যের দিকে!

সেনাবাহিনীর এলাকা ছাড়িয়ে একটি গাছের কাছে তারা স্থির হয়ে দাঁড়াল।

 বন্দি জার্মান নয়, স্থানীয় অধিবাসী কৃষ্ণকায় নিগ্রো।

 বন্দির অপরাধ গুরুতর; বিগত রাত্রে সেনানিবাসের এক প্রহরীকে সে আক্রমণ করেছিল।

 আক্রমণ সফল হয়নি। লোকটি ধরা পড়েছে।

 সারারাত্রি সে ছিল বন্দি শিবিরে আজ সকালে তার বিচার।

খুব তাড়াতাড়ি শেষ হল বিচার-পর্ব।

বন্দির দু-খানা হাত কবজি থেকে কেটে ফেলে ফরাসিরা তাকে মুক্তি দিলে। অবশ্য ক্ষতস্থানে ঔষধ প্রয়োগ করে তার রক্তপাত বন্ধ করা হয়েছিল–অতিরিক্ত রক্তপাতে লোকটি যাতে মারা না যায় সেইজন্যই এই ব্যবস্থা।

আহত নিগ্রোর কণ্ঠ ভেদ করে নির্গত হল অবরুদ্ধ ক্রন্দনধ্বনি।

স্খলিত-চরণে সে পদচালনা করলে বনের দিকে, কিছুক্ষণের মধ্যেই অরণ্যের অন্তরালে অদৃশ্য হল তার দেহ।

বন্দির হস্তছেদন করেছিলেন মেজর জুভেনাক স্বহস্তে।

রক্তাক্ত তরবারি খাপে ঢুকিয়ে তিনি স্থান ত্যাগ করার উপক্রম করলেন, কিন্তু হঠাৎ অদূরে দণ্ডায়মান তিনটি শ্বেতাঙ্গ সৈনিকের দিকে আকৃষ্ট হল তার দৃষ্টি।

ওই তিনটি মানুষের মুখের রেখায় রেখায় ফুটে উঠেছে ক্রোধ ও ঘৃণার অভিব্যক্তি!

মেজরের বিচার তাদের পছন্দ হয়নি!

মেজর জুভেনাক ভ্রূকুঞ্চিত করলেন, তোমরা আমেরিকার মানুষ; নিগ্রোদের সম্বন্ধে তোমাদের কোনো ধারণা নেই। লোকটিকে প্রাণদণ্ড দিলে স্থানীয় বাসিন্দারা এই ঘটনা খুব তাড়াতাড়ি ভুলে যেত। কিন্তু হাতকাটা জাতভাই-এর অবস্থা দেখে ওরা ভয় পাবে, ভবিষ্যতে ফরাসিদের আক্রমণ করতে ওরা সাহস করবে না।

জুভেনাক চলে গেলেন।

নিজের ব্যবহারের জন্য কৈফিয়ত দেওয়ার অভ্যাস মেজরের ছিল না। জুভেনাক অতিশয় দাম্ভিক মানুষ। কিন্তু ওই তিন ব্যক্তি ফরাসি গভর্নমেন্টের বেতনভোগী সৈনিক নয়, ওরা আমেরিকার নৌ-সেনা। নিকটস্থ নদীর ওপর মোটর বোট এবং ছোটো ছোটো জলযানগুলি পরিদর্শন করার মতো উপযুক্ত ইঞ্জিনিয়ার বা কলাকুশলী নগানচু অঞ্চলে ফরাসিদের মধ্যে ছিল না। । তারা আমেরিকার সাহায্য চেয়েছিল।

তাই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আদেশে জলযানগুলির তত্ত্বাবধান করতে এসেছিল আমেরিকার নৌ-বিভাগের তিনটি সৈনিক।

নৌ-বিভাগের অন্তর্গত তিন ব্যক্তির নাম–মাইক স্টার্ন, ম্যাক কার্থি এবং হ্যারিস।

পূর্ববর্ণিত রক্তাক্ত দৃশ্যের অবতারণা যেখানে হল সেখানে নীরব দর্শকের ভূমিকা নিয়েছিল ওই তিনজন নৌ-সেনা। মেজর প্রস্থান করতেই হ্যারিস বন্ধুদের জানিয়ে দিলে জুভেনাকের নিষ্ঠুর আচরণ তার ভালো লাগেনি।

হ্যারিসের অপর দুই বন্ধুও তাকে সমর্থন জানিয়ে বললে যে উক্ত ফরাসি মেজরের সান্নিধ্য তারা পছন্দ করছে না।

তিন বন্ধুর ভাগ্যদেবতা অলক্ষ্যে হাসলেন।

তাদের মনস্কামনা শীঘ্রই পূর্ণ হল বটে কিন্তু জুভেনাকের সান্নিধ্য থেকে মুক্তি পেয়ে তাদের মনের ভাব হয়েছিল–

যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই।
যাহা পাই তাহা চাই না..

হস্তছেদন ঘটিত ভয়াবহ ঘটনার পর একটা দিন কেটে গেল নির্বিবাদে। দ্বিতীয় দিন সকাল বেলা তিন বন্ধু দেখল, ফরাসিরা সাজসরঞ্জাম গুটিয়ে স্থান ত্যাগ করার উপক্রম করছে।

তিন বন্ধু ছুটল মেজরের কাছে ব্যাপারটা কী?

 মেজর জুভেনাক জানালেন, তাঁরা এই জায়গা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন।

তিন বন্ধুর জিজ্ঞাস্য, তাদের কী হবে?

জুভেনাক রূঢ়স্বরে জানিয়ে দিলেন, আমেরিকানদের তিনি ব্যক্তিগতভাবে আসতে বলেননি, অতএব তারা কী করবে-না-করবে সে-বিষয়ে চিন্তা করে মস্তিষ্ককে ঘর্মাক্ত করতে তিনি রাজি নন–তারা যা খুশি তাই করতে পারে।

এই প্রয়োজনীয় তথ্য পরিবেশন করে জুভেনাক সসৈন্যে প্রস্থান করলেন। তিন বন্ধু নিজেদের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় করলে তাদের অবস্থা মোটেই আনন্দজনক নয়।

মাইক বললে, আমরা ফাঁদে পড়েছি। নদীর বিপরীত দিকে ঘাঁটি নিয়েছে জার্মান সৈন্য আর জঙ্গলের ভিতর ওত পেতে বসে আছে নিগ্রোরা। রক্তপিপাসু ফরাসি মেজর আর শান্তিপ্রিয় আমেরিকার মানুষের মধ্যে নিগ্রো যোদ্ধারা তফাত খোঁজার চেষ্টা করবে না সুযোগ পেলেই ওরা আমাদের হত্যা করবে। অতএব আমাদের খুব সতর্ক থাকতে হবে, যেকোনো সময়েই নিগ্রোরা আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে।

ফরাসিদের পরিত্যক্ত শিবিরগুলো পর্যবেক্ষণ করে তারা জানতে পারল যে খাদ্য ও পানীয়ের অভাব তাদের হবে না। প্রচুর পরিমাণে শুকনো খাদ্য জমানো রয়েছে বায়ুশূন্য টিনের পাত্রে।

আর আছে বীয়ার জাতীয় সুরার অসংখ্য বোতল।

অস্ত্রশস্ত্রের অবস্থাও খুব নৈরাশ্যজনক নয়।

 কলের কামান প্রভৃতি ভারি অস্ত্র না-থাকলেও রাইফেল ছিল। গুলি ফুরিয়ে যাওয়ার ভয় নেই–অজস্র টোটা রেখে গেছে ফরাসি সৈন্য। তা ছাড়া আছে পিস্তল, রিভলভার ও অনেকগুলো গ্রেনেড বা হাতবোমা।

যে-ঘরটায় খাদ্য ও পানীয় ছিল সেই ঘরে তারা তালা লাগিয়ে দিলে। সন্ধ্যার পর পানাহার শেষ করে তারা আশ্রয় গ্রহণ করলে একটা ঘরের মধ্যে।

বর্তমানে ওই ঘরটাই হল তিন বন্ধুর দুর্গ।

একটা রাত্রি ভালোভাবেই কাটল। কিন্তু পরের দিন সকালেই হানা দিল নিগ্রো যোদ্ধার দল। তিন বন্ধুর রাইফেল সশব্দে অগ্নি-উগার করলে, কয়েকটি নিগ্রোর হত ও আহত দেহ লুটিয়ে পড়ল মাটির ওপর।

নিগ্রোরা পিছিয়ে গেল। একটু পরে ফিরে এসে আহত সঙ্গীদের তুলে নিয়ে আবার আত্মগোপন করল সবুজ অরণ্যের অন্তরালে। মৃত সঙ্গীদের তারা ছুঁড়ে ফেলে দিল নদীর জলে।

গভীর রাত্রে আবার আক্রমণ করলে নিগ্রোরা। সারারাত্রি ধরে বার বার হানা দিল নিগ্রো বাহিনী, ঘরের ভিতর থেকে অনবরত গুলি চালিয়ে আর হাতবোমা ছুঁড়ে অতি কষ্টে তিন বন্ধু তাদের ঠেকিয়ে রাখল।

পূর্বদিকের আকাশে জাগল অস্পষ্ট আলোর আভাস। নিগ্রোরা আবার গা-ঢাকা দিল বনের আড়ালে। এল প্রভাত।

প্রভাতের শীতল বায়ু তপ্ত হয়ে উঠল ধীরে ধীরে, মাথার ওপর জ্বলে উঠল মধ্যাহ্নের প্রখর সূর্য।

একটা ঘরের মধ্যে বড়ো বড়ো টিনের পাত্রে জল জমিয়ে রেখেছিল ফরাসিরা। ওই জলে তিন বন্ধু স্নান করলে, তারপর আহারপর্ব শেষ করে ফেলল চটপট। গতরাত্রে কেউ ঘুমাতে পারেনি। রাত্রি জাগরণ এবং উত্তেজনার ফলে তারা হয়ে পড়েছিল অবসন্ন। মাইককে পাহারায় রেখে হ্যারিস ও ম্যাক কার্থি শয্যা গ্রহণ করলে এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল গভীর নিদ্রায়।

ওঠ! ওঠ! তাড়াতাড়ি!

চিৎকার করে উঠল মাইক স্টার্ন।

দুই বন্ধু বিছানা ছেড়ে লাফিয়ে উঠল, তারপর মাইকের নির্দেশ অনুযায়ী দৃষ্টি সঞ্চালন করতেই তাদের চোখের সামনে ফুটে উঠল এক অপ্রত্যাশিত দৃশ্য।

বাঁকের মুখে নদীর ধারে নোঙর করেছে একটি নৌকা এবং সেই নৌকা থেকে নেমে আসছে দুজন জার্মান সৈনিক!

তিন বন্ধু অবাক হয়ে দেখল একজন জার্মান সৈন্যের হাতে রয়েছে শ্বেত পতাকা! সন্ধির সংকেত!

হতভম্ব হয়ে পড়ল তিন বন্ধু–দুরন্ত জার্মান সৈন্যরা হঠাৎ এমন শান্তিপ্রিয় হয়ে পড়ল কেন, এ-কথাটা তারা বুঝতে পারল না।

মাইক জার্মান ভাষা জানত। সঙ্গীদের ঘরের মধ্যে রেখে সে পিস্তল হাতে এসে দাঁড়াল জার্মানদের সামনে, কিন্তু তার জার্মান ভাষায় কথা বলার প্রয়োজন হল না।

চোস্ত ইংরেজিতে একজন জার্মান আত্মপরিচয় দিল, আমার নাম অটো গ্যটমেয়ার। আমি জার্মান সৈন্যদলের এক লেফটেন্যান্ট।

তারপর অটো যা বললে তার সারমর্ম হচ্ছে এই :

ম্যাঙ্গবেটু জাতীয় নিগ্রোরা এখন আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গদের নির্বিচারে আক্রমণ করছে–জার্মান, ফরাসি, ইংরেজ, আমেরিকান প্রভৃতি শ্বেতাঙ্গ জাতি তাদের শত্রু এবং অবশ্য বধ্য; অতএব জার্মানি এবং আমেরিকা বৃহত্তর পৃথিবীতে পরস্পরের শত্রু হলেও এই মুহূর্তে সেই শত্রুতা ভুলে এই দুটি ছোটো দল যদি এখানে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে নিগ্রোদের বিরুদ্ধে রুখে না-দাঁড়ায়, তাহলে খুব শীঘ্রই নিগ্রোদের আক্রমণে উভয়পক্ষই হবে নিশ্চিহ্ন–জার্মান বা আমেরিকানদের মধ্যে একটি লোকও নিগ্রোদের রোষ থেকে রেহাই পাবে না। তাই নিতান্ত সাময়িকভাবে জার্মানিদের পক্ষ থেকে অটো সন্ধির প্রস্তাব এনেছে। তার দলের আরও চারজন সৈন্য জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে, আমেরিকানরা যদি সন্ধি করতে রাজি হয় তাহলে লেফটেন্যান্টের সঙ্গী তাদের নিয়ে আসবে।

মাইক তার বন্ধুদের সঙ্গে পরামর্শ করে বুঝল যে, জার্মান সেনানায়কের প্রস্তাব মেনে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।

সন্ধি হল। লেফটেন্যান্টের সঙ্গী দূর অরণ্যের গোপন স্থান থেকে চারজন জার্মান সেনাকে নিয়ে এল আমেরিকানদের আস্তানায়। আপাতত এই জায়গাটাই উভয়পক্ষের মিলিত শিবির হল।

সন্ধির একটি বিশেষ শর্ত ছিল এই যে, কোনো কারণে যদি অবস্থার পরিবর্তন ঘটে, তাহলেও একপক্ষ অপর পক্ষকে যুদ্ধবন্দি হিসাবে গণ্য করতে পারবে না।

শর্তটা উভয়পক্ষেরই মনঃপূত হয়েছিল।

সাময়িকভাবে নিজেদের শত্রুতা ভুলে দুই পক্ষ এইবার মিলিতভাবে নিগ্রোদের সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার জন্য প্রস্তুত হতে লাগল।

বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। সন্ধ্যার আগেই শুরু হল আক্রমণ। নয়টি রাইফেল ঘনঘন গর্জন করে অনেকগুলো কৃষ্ণাঙ্গ যোদ্ধার হত ও আহত দেহ শুইয়ে দিল মাটির ওপর।

নিগ্রোরা পিছিয়ে গেল… আবার আক্রমণ করলে… শ্বেতাঙ্গদের আস্তানার উপর এসে পড়ল ঝাঁকে ঝাঁকে বল্লম… রাইফেলের অগ্নিবৃষ্টিও বুঝি আর নিগ্রোদের ঠেকিয়ে রাখতে পারে না…

শ্বেতাঙ্গরা এইবার গ্রেনেড (হাতবোমা) ব্যবহার করলে। নিগ্রো যোদ্ধাদের উপর ছিটকে পড়ল কয়েকটা হাতবোমা, আগুনের ঝলকে ঝলকে ধূম এবং মৃত্যু পরিবেশিত হল চতুর্দিকে, হতাহত সঙ্গীদের ফেলে সভয়ে পলায়ন করলে বর্শাধারী কালো মানুষগুলো বিজ্ঞানের মহিমায় স্তব্ধ হয়ে গেল অরণ্যের বন্য বিক্রম!

কেটে গেল কয়েকটি দিন আর কয়েকটি হাত। এর মধ্যে আবার আক্রমণ করেছে ম্যাঙ্গবেটু নিগ্রোরা, কিন্তু শ্বেতাঙ্গদের রাইফেলের অগ্নিবৃষ্টির মুখে ব্যর্থ হয়েছে তাদের আক্রমণ। একজন জার্মান সেনা প্রাণ হারিয়েছে বর্শার আঘাতে। চারদিকে হাতবোমার সাহায্যে মাইন পেতে আত্মরক্ষা করতে লাগল জার্মান ও আমেরিকান সৈন্যরা।

সেদিন প্রকাশ্যে দিবালোকে দুজন নিগ্রো জঙ্গলের ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে ফাঁকা জায়গায় দাঁড়াল। তাদের মধ্যে একজনের অঙ্গসজ্জা দেখে শ্বেতাঙ্গরা অনুমান করল লোকটি ম্যাঙ্গবেটুদের মধ্যে প্রভাবশালী সর্দার-শ্রেণির মানুষ; অপর ব্যক্তির একহাতে শিকলে বাঁধা পাঁচটি কুকুর, অন্যহাতে একটা চামড়ার থলি। কুকুরগুলো সাগ্রহে চামড়ার থলিটা বার বার শুঁকছে। সর্দারের হাতে একটা লাঠির আগায় সাদা কাপড় বাঁধা–সন্ধির চিহ্ন সাদা নিশান!

অটো তৎক্ষণাৎ তাদের গুলি করতে চাইল, কিন্তু মাইক বলল, দাঁড়াও, আগে ওদের বক্তব্যটা শুনি। পরে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করা যাবে।

মাইনের মৃত্যুফাঁদ থেকে যে পথটা মুক্ত, সেই সরু রাস্তাটার দিকে অঙ্গুলি-নির্দেশ করে মাইক ম্যাঙ্গবেটুদের কাছে আসতে ইঙ্গিত করল।

সর্দারের মুখে ফুটল ধূর্ত হাসির রেখা, নিশানটা সজোরে মাটির ওপরে বসিয়ে দিয়ে সঙ্গীর থলি থেকে কয়েকটা রক্তাক্ত মাংসের টুকরো বার করে সে ছুঁড়ে দিল সাদা মানুষদের দিকে। সঙ্গীও শিকলের বাঁধন থেকে কুকুরগুলোকে মুক্তি দিল তৎক্ষণাৎ।

জার্মান ও আমেরিকান সৈন্যরা মাটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে শয্যাগ্রহণ করল উপুড় হয়ে। প্রায় সঙ্গেসঙ্গে হাতবোমার তারে ধাবমান কুকুরের পা লাগল। একটা প্রচণ্ড বিস্ফোরণ–মুহূর্ত পরেই আরও চারটি বোমা ফাটল ভীষণ শব্দে!

শ্বেতাঙ্গরা সম্মুখে দৃষ্টিপাত করল। কুকুরগুলোর মৃতদেহ চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। নিগ্রো দুজন মাইকের নির্দিষ্ট নিরাপদ পথ ধরে সতর্ক চরণে এগিয়ে আসছে।

শ্বেতাঙ্গদের সামনে এসে হোমরাচোমরা গোছের লোকটি তার সঙ্গীকে কথা কইতে নির্দেশ দিল।

ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে নিগ্রোটি জানাল তার সঙ্গে এসেছে মহামান্য মবংগো! মবংগো ওই গ্রামের জাদুকর। তার ক্ষমতা অসীম। মবংগো বলছে, সাদা মানুষরা যদি এই ঘাঁটি এখনই ছেড়ে দিতে রাজি থাকে, তাহলে তাদের নিরাপদে যেতে দেওয়া হবে। কথা না-শুনলে মবংগোর আদেশে ম্যাঙ্গবেটুরা সাদা মানুষদের হত্যা করবে। মাটির ওপর ফেটে যাওয়া জিনিসগুলোকে তারা ভয় করে না, ওগুলোকে ফাঁকি দেওয়ার রাস্তা তারা দেখে নিয়েছে।

অটো মাইকের দিকে চাইল, কী বল? ওদের প্রস্তাবে রাজি হব?

অসম্ভব, মাইক বলল, ওরা সুযোগ পেলেই আমাদের খুন করবে। বরং এখানে দাঁড়িয়ে আমরা লড়তে পারব। ঘাঁটি ছেড়ে গেলে আমাদের মৃত্যু নিশ্চিত।

অটো মাইকের যুক্তি মেনে নিল। তারপর নিগ্রো দোভাষীর দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার কর্তাকে বলো আমরা এই জায়গাতেই থাকব। কোথাও যাব না।  

দোভাষীর মুখ থেকে শ্বেতাঙ্গদের বক্তব্য শুনে দারুণ ক্রোধে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল জাদুকর মবংগো। সে থুথু ছিটিয়ে দিল অটোর মুখে!

মুহূর্তের মধ্যে খাপ থেকে পিস্তল টেনে নিয়ে পর পর দু-বার গুলি ছুড়ল অটো। গুলি লাগল জাদুকরের পেটে। সঙ্গীটি দারুণ আতঙ্কে হাঁ করে চেয়ে রইল সাদা মানুষদের দিকে। তার দিকে তাকিয়ে হিংস্রভাবে দাঁত বার করে গর্জে উঠল অটো, যাও, এই হতভাগাকে জঙ্গলের মধ্যে নিয়ে যাও।

মরণাপন্ন জাদুকরকে নিয়ে নিগ্রোটি জঙ্গলের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল…

 কয়েকটা দিন নিরুপদ্রবে কাটল। কিন্তু শ্বেতাঙ্গরা তাদের পাহারা শিথিল করল না। তারা জানত ম্যাঙ্গবেটুরা সুযোগ খুঁজছে, একটু অসতর্ক হলে আর রক্ষা নেই। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জার্মান আর আমেরিকানরা তাদের শত্রুতা ভুলে গেল। অলস মধ্যাহ্নে তারা তাস খেলে মুখোমুখি বসে, রাতের অন্ধকারে পাহারা দেয় বিনিদ্র নেত্রে।

ছোটোখাটো তুচ্ছ বিষয় থেকে অনেক সময় হয় মারাত্মক বিপদের সূত্রপাত ।

মাইক যদি জানত তার পরিচয়পত্রটি অত বড়ো বিপদ ডেকে আনবে, তাহলে বোধ হয় সে যত্ন করে ওই জিনিসটিকে মালার সঙ্গে আটকে বুকের ওপর ঝুলিয়ে রাখত না।

ওই পরিচয়পত্রের দিকে আকৃষ্ট হল কোহন নামক জনৈক জার্মান সৈনিকের দৃষ্টি।

কোহন জিনিসটা দেখতে চাইল। মালা থেকে পরিচয়পত্রটি খুলে মাইক সেটাকে কোহনের হাতে দিল। কোহনের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল আর একজন জার্মান নাম তার হহেনস্টিন। সঙ্গীর হাত থেকে পরিচয়পত্র নিয়ে নিবিষ্ট চিত্তে জিনিসটাকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল সে, তার দুই চোখে ফুটে উঠল তীব্র ঘৃণা ও বিদ্বেষের আভাস!

হহেনস্টিন ক্রুদ্ধস্বরে বললে, আরে, এই লোকটা দেখছি ইহুদি! ওহে কোহন–এই নোংরা শুয়োরটা ইহুদি! ছি! ছি!

(ইহুদিদের প্রতি তীব্র ঘৃণা পোষণ করত জার্মান জাতি। হিটলারের নির্দেশে এই সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ও আক্রোশ ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল জার্মান জাতির মধ্যে।)

গালাগালি শুনে চুপ করে থাকার মতো সুবোধ ছেলে নয় মাইক স্টার্ন–সে বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল হহেনস্টিনের ওপর!

চোখের পলক ফেলার আগেই শুরু হয়ে গেল মারামারি!

গোলমাল শুনে সেখানে ছুটে এল জার্মান লেফটেন্যান্ট অটো। তার সঙ্গে সঙ্গে এল অন্যান্য জার্মান সৈনিক এবং মাইকের দুই বন্ধু।

মাইককে ছেড়ে দিয়ে অটোর দিকে এগিয়ে এল হহেনস্টিন, স্যার! এই শুয়োরটা ইহুদি! আমি এইমাত্র জেনেছি!

ক্রুদ্ধকণ্ঠে গর্জে উঠল মাইক, হ্যাঁ, আমি ইহুদি তাতে কী হয়েছে?

অটো বিস্মিত স্বরে বললে, তুমি ইহুদি? আশ্চর্য! তোমাকে দেখে তো মনে হয় না যে তুমি ইহুদি!

মাইক রোষরুদ্ধ স্বরে বললে, ইহুদিরা কেমন দেখতে হয়? তারা কি মানুষ নয়? তোমার মতো আমারও দুটো হাত আর দুটো পা আছে।

অটো বললে, তা ঠিক। তবে আমরা শুনেছি ইহুদিরা ভালো লোক নয়।

ভুল শুনেছ, জবাব দিল ম্যাক কার্থি, শয়তান হিটলার তোমাদের যা বুঝিয়েছে তোমরা তাই বুঝেছ। কিন্তু অটো, তোমার তো বেশ বুদ্ধি আছে–তুমি নিশ্চয় বুঝতে পারছ যে,ওই হিটলারটা হচ্ছে পয়লা নম্বরের মিথ্যুক!

এক মুহূর্তে সমস্ত পরিবেশ হয়ে উঠল ভয়ংকর।

জার্মানরা এসে দাঁড়াল অটোর পাশে, তাদের চোখের দৃষ্টি থেকে মুছে গেছে বন্ধুত্বের স্বাক্ষর, চোয়ালের রেখায় রেখায় পাথরের কাঠিন্য।

একজন জার্মান গম্ভীর স্বরে বললে, লেফটেন্যান্ট! হুকুম দাও!

মাইকের দুই পাশে ছড়িয়ে পড়ল দুই বন্ধু।

 ম্যাক কার্থি খাপ থেকে পিস্তল টেনে নিল।

রাইফেলের বাঁটের ওপর চেপে বসেছে জার্মান সৈনিকের কঠিন মুষ্টি, ট্রিগারের ওপর সরে এসেছে আঙুল—

আবার প্রশ্ন এল জার্মান ভাষায়, কী হুকুম? লেফটেন্যান্ট?

কিন্তু অটো মুর্খ নয়।

শান্তভাবে চারদিকে চোখ বুলিয়ে সে বললে, লড়াই করার মতো উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে বটে, কিন্তু। আমি লড়াই-এর হুকুম দেব না। ইহুদিরাও মানুষ, হহেনস্টিন অন্যায়। করেছে।

লেফটেন্যান্টের আদেশে হহেনস্টিন ক্ষমা চাইতে বাধ্য হল।দুইপক্ষই আবার। অস্ত্র নামিয়ে নিল।

মেঘ সরে গিয়েছে, ঝড় আর উঠবে না।

অটোর ব্যবস্থা অনুযায়ী প্রতি রাত্রে পালা করে একজন পাহারা দেয়। আজ জার্মান সান্ত্রি বনামিয়েরের পালা! বনামিয়ের তার হাতঘড়ির দিকে তাকাল–এগারোটা বেজে তিরিশ মিনিট হয়েছে।

একটা গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে সে আরাম করতে লাগল…

হঠাৎ কার পায়ের তলায় সশব্দে ভেঙে গেল একটা শুকনো গাছের ডাল। চমকে উঠল জার্মান প্রহরী বনামিয়ের।

আবার সেই শব্দ! শুকনো গাছের ডালগুলো ভেঙে যাচ্ছে কাদের পায়ের তলায়?

 দুই চোখ পাকিয়ে শব্দ লক্ষ করে দৃষ্টি সঞ্চালিত করতেই, বনামিয়ের দেখল তার চারপাশে অন্ধকারের বুকে ভেসে উঠেছে অনেকগুলো চলমান মনুষ্যদেহ নিগ্রো যোদ্ধার দল!

দারুণ আতঙ্কে জার্মান প্রহরীর বুদ্ধিভ্রংশ হল, রাইফেলটাকে শক্ত মুঠিতে চেপে ধরে সে দাঁড়িয়ে রইল নিশ্চল পাথরের মূর্তির মতো… কিছুক্ষণ পরে ভয়ের ধাক্কাটা কাটিয়ে নিয়ে বনামিয়ের তার কর্তব্য স্থির করে ফেলল। খুব ধীরে ধীরে সে মাটির উপর বসে পড়ল–অন্ধকারের মধ্যে তার দেহটা এখনও নিগ্রোদের দৃষ্টিগোচর হয়নি।

মাটি থেকে একটা শুকনো গাছের ডাল তুলে নিয়ে বনামিয়ের দূরে ছুঁড়ে দিল। ডালটা সশব্দে মাটির ওপর পড়ল–সঙ্গেসঙ্গে শব্দ লক্ষ করে ছুটে এল চারটে ভূতুড়ে ছায়া গাছের আড়াল থেকে!

বনামিয়ের গুলি ছুড়ল। তারপর পিছন ফিরে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটল আস্তানার দিকে। তার ধাবমান দেহের এপাশ দিয়ে ওপাশ দিয়ে সাঁ সাঁ করে উড়ে গেল অনেকগুলো বর্শা। বনামিয়ের একটা ঘরের খুব কাছাকাছি এসে পড়ল আর একটু গেলেই সে দেয়ালের আড়ালে দাঁড়িয়ে আত্মরক্ষা করতে পারবে। কিন্তু বেচারার উদ্দেশ্য সফল হল না, তার বাম ঊরুর ওপর বিদ্ধ হল একটি বর্শা বনামিয়ের মাটির ওপর ছিটকে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেল।

ইতিমধ্যে রাইফেলের শব্দে আমেরিকান আর জার্মান সৈন্যদের ঘুম গেছে ভেঙে, চটপট রাইফেল নিয়ে তারা ছুটে এসেছে অকুস্থলে নিকটবর্তী অরণ্যের ভিতর দিয়ে ঝোপঝাড় ভেদ করে আঙুলের চাপে চাপে রাইফেলের মুখ থেকে ছিটকে পড়েছে তপ্ত বুলেট বৃষ্টিধারার মতো!

সেই দারুণ অগ্নিবৃষ্টির মুখে লুটিয়ে পড়ল কয়েকজন কৃষ্ণাঙ্গ যোদ্ধা, বাকি সবাই তাড়াতাড়ি জঙ্গলের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। শ্বেতাঙ্গরা এবার অদৃশ্য শত্রুদের লক্ষ করে হাতবোমা ছুড়ল ঘন জঙ্গল আর ঝোপঝাড়ের ভিতর প্রচণ্ড শব্দে ফাটাতে লাগল বোমাগুলো।

নিগ্রো যোদ্ধারা পিছিয়ে গেল। অন্ধকার অরণ্যের ভিতর তাদের দেহগুলো শ্বেতাঙ্গদের চোখে পড়ল না, কিন্তু দ্রুত ধাবমান পদশব্দ তাদের জানিয়ে দিলে শত্রু এখন প্রাণ নিয়ে সরে পড়ছে।

আহত জার্মান সৈন্যের দেহটাকে ধরাধরি করে তারা একটা ঘরের ভিতর নিয়ে এল। বনামিয়েরের পায়ের হাড় ভেঙে গিয়েছিল, তার ক্ষতস্থানে ওষুধ লাগিয়ে বেঁধে দেওয়া হল। বনামিয়ের তখন দারুণ যাতনায় আর্তনাদ করছে, তাকে একটা মরফিয়া ইঞ্জেকশন দিতেই সে ঘুমিয়ে পড়ল–অন্তত কয়েক ঘণ্টার জন্য আঘাতের যন্ত্রণা থেকে সে মুক্তি পেল।

এক সপ্তাহ পরের কথা। রাত জেগে পাহারা দিচ্ছে স্টার্ন মাইক।

হঠাৎ পায়ের ওপর সে অনুভব করলে তীব্র দংশন!

অস্ফুট স্বরে আফ্রিকার যাবতীয় কীটপতঙ্গকে অভিশাপ দিতে দিতে মাইক তার আহত পায়ের শুশ্রূষা করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিল আর সঙ্গেসঙ্গে সে বুঝতে পারল তার হাতের ওপর উঠে পড়েছে অনেকগুলো পতঙ্গ জাতীয় জীব!

মাইক অনুভব করলে তার দুই পায়ের উপরেই কামড় বসাচ্ছে অনেকগুলো পোকা–কিছুক্ষণের মধ্যেই তার হাতের পোকাগুলোও তাকে কামড়াতে লাগল।

তাড়াতাড়ি রাইফেলের বাঁটের ওপর হাতটাকে সজোরে ঘর্ষণ করে মাইক তার হাতটাকে পোকার কবল থেকে মুক্ত করে নিল। আর ঠিক সেই মুহূর্তে মেঘের আড়াল থেকে উঁকি দিল চাঁদ।

ম্লান জ্যোৎস্নার আলোকধারার মধ্যে মাইকের দৃষ্টিপথে ভেসে উঠল এক অদ্ভুত দৃশ্য!

বনের ভিতর থেকে ফাঁকা মাঠের ওপর বেরিয়ে এসেছে একদল পিঁপড়ে! সেই বিপুল পিপীলিকা বাহিনীর সংখ্যা অনুমান করা অসম্ভব কারণ মাইকের সামনে যে পিঁপড়ের সারিটা এগিয়ে এসেছে তার পিছন দিকটা এখনও অদৃশ্য রয়েছে অরণ্যের অন্তরালে।

কয়েকটা অগ্রবর্তী দলছাড়া পিঁপড়ে ইতিমধ্যেই তার পায়ের ওপর উঠে কামড় বসিয়েছে। মাইকের প্রায় দশ গজ দূরে এসে পড়েছে আসল দলটা!

মাইক তাদের মিলিটারি ব্যারাকের আস্তানা লক্ষ করে ছুটল। মাঝে মাঝে নীচু হয়ে সে পা থেকে পিঁপড়েগুলোকে ছাড়িয়ে নিচ্ছিল। হাত দিয়ে ঘষে ওই মারাত্মক পোকাগুলোর কবল থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব ছিল না–দু-আঙুলে টিপে ধরে মাইক পিঁপড়েগুলোকে টেনে আনছিল তার পায়ের ওপর থেকে!

জীবজগৎ সম্বন্ধে মাইক যদি কিছু খবর রাখত তাহলে সে জানত যে ওই পিঁপড়েগুলো হচ্ছে। আফ্রিকার মারাত্মক ড্রাইভার অ্যান্ট।

এরা যেখান দিয়ে যায় সেখানে পড়ে থাকে অসংখ্য জানোয়ারের কঙ্কাল সিংহ, লেপার্ড প্রভৃতি হিংস্র পশুও এদের মিলিত আক্রমণের মুখে অসহায়ভাবে প্রাণ বিসর্জন দিতে বাধ্য হয়।

মাইক তার হাতের রাইফেল আওয়াজ করে নিদ্রিত সঙ্গীদের জাগিয়ে দিলে। সকলে ছুটে এসে দেখল, তাদের আস্তানা আর জঙ্গলের মাঝখানে অবস্থিত ফাঁকা জায়গাটার ওপর দিয়ে এগিয়ে আসছে অসংখ্য পিপীলিকার শ্রেণিবদ্ধ বাহিনী!

শ্বেতাঙ্গরা তাড়াতাড়ি পিঁপড়েগুলোর সামনে গ্যাসোলিন ছড়িয়ে আগুন জ্বালিয়ে দিলে। পিঁপড়েরা নাছোড়বান্দা তারা জ্বলন্ত আগুনের পাশ কাটিয়ে এগিয়ে আসার চেষ্টা করতে লাগল। সৈন্যরা এবার পিঁপড়ের দলের ওপর গ্যাসোলিন ছড়িয়ে অগ্নিসংযোগ করলে। অনেকগুলো পিঁপড়ে অগ্নিগর্ভে প্রাণ বিসর্জন দিলে অন্যগুলো এদিক-ওদিক সরে গেল।

আচম্বিতে নিকটবর্তী শিবিরগুলোর একটি ঘর থেকে ভেসে এল এক করুণ আর্তনাদ।

 সকলেই বুঝল, ওই কণ্ঠস্বরের মালিক হচ্ছে বনামিয়ের।

কারণ সে ছাড়া ওই সময়ে ঘরের মধ্যে কেউ ছিল না। বনামিয়ের যে ঘরে শুয়েছিল সেই ঘরের দিকে সবাই ছুটল…

বীভৎস দৃশ্য!

খাটের ওপর শুয়ে ছটফট করছে আহত বনামিয়ের, তাকে আক্রমণ করেছে পিঁপড়ের দল। জীবন্ত অবস্থায় তার দেহের মাংস ছিঁড়ে খাচ্ছে ওই ভয়ংকর কীটগুলি, ইতিমধ্যেই পিপীলিকার দংশনে তার চক্ষু হয়েছে অন্ধ–চক্ষুহীন রক্তাক্ত অক্ষিকোটরের ভিতর ঘুরে বেড়াচ্ছে শুধু পিঁপড়ে আর পিঁপড়ে!

সকলেই বুঝল, বনামিয়ের আর বাঁচবে না–হিংস্র কীটগুলো তার দেহটাকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাবে, তিলে তিলে নরকযন্ত্রণা ভোগ করতে করতে তার মৃত্যু হবে ধীরে ধীরে।

সৈনিক মাত্রেই মরতে এবং মারতে প্রস্তুত থাকে, মৃত্যু তাদের কাছে অতি সহজ, অতি স্বাভাবিক। কিন্তু ওই বীভৎস দৃশ্য সহ্য করা যায় না।

লেফটেন্যান্ট অটো কোহনের দিকে তাকাল, কিছু একটা করো! লোকটা এভাবে মরবে?

–কী করব! কিছু করার নেই।

–কিছু করার নেই?

না।

অটো রিভলভারটা বনামিয়েরের মাথা লক্ষ করে তুলে ধরলে।

মাইক মুখ ঘুরিয়ে নিলে অন্যদিকে।

গর্জে উঠল অটোর রিভলভার–গুলি বনামিয়েরের মস্তিষ্ক ভেদ করে তাকে অসহ্য যাতনা থেকে নিষ্কৃতি দিল মুহূর্তের মধ্যে।

সকালের আলো ফুটে ওঠার সঙ্গেসঙ্গে পিপীলিকা বাহিনী সৈন্যদের আস্তানা ছেড়ে জঙ্গলের ভিতর অদৃশ্য হয়ে গেল জীবন্ত দুঃস্বপ্নের মতো। সবাই দেখল, পিঁপড়েরা শুধু বনামিয়েরের দেহের মাংস খেয়েই সন্তুষ্ট হয়নি, তার জুতো, রিভলভারের খাপ প্রভৃতি সব কিছুই উদরসাৎ করেছে খুদে রাক্ষসের দল।

বনামিয়েরের মাংসহীন রক্তাক্ত কঙ্কালটাকে সবাই মিলে কবরস্থ করলে।

অটো বললে, এইভাবে আমরা বেশিদিন আত্মরক্ষা করতে পারব না। যদি বাঁচতে হয় তাহলে আমাদের আক্রমণকারী ভূমিকা নিতে হবে।

মাইক বললে, তুমি কী করতে চাও?

অটোর অভিমত হচ্ছে এই যে তারা যদি ম্যাঙ্গবেটু নিগ্রোদের একটি গ্রাম অধিকার করতে পারে তবে স্থানীয় বাসিন্দারা ভীত হয়ে পড়বে, খুব সম্ভব তারা আর লড়াই করতে চাইবে না।

অটোর প্রস্তাবে সম্মত হল মাইক।

একদিন খুব ভোরে ঘন জঙ্গল ভেদ করে জার্মান ও আমেরিকানদের মিলিত বাহিনী নিকটবর্তী নিগ্রো পল্লিতে হানা দিল। এমন অতর্কিত আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিল না গ্রামবাসী।

রাইফেলের ঘন ঘন গর্জন ও হাতবোমার প্রচণ্ড বিস্ফোরণ আতঙ্কের সঞ্চার করল নিগ্রো পল্লির বুকে। ভয়ার্ত নরনারী গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে আশ্রয় নিল শ্বাপদসংকুল অরণ্যের অন্তঃপুরে।

শ্বেতাঙ্গদের মিলিত বাহিনী প্রবেশ করল নির্জন গ্রামের মধ্যে।

দু-দিন পরেই সন্ধির প্রস্তাব নিয়ে শ্বেতাঙ্গদের সামনে এসে দাঁড়াল ম্যাঙ্গবেটুদের কয়েকজন প্রতিনিধি–তারা শান্তিতে বাস করতে চায়, লড়াই করার আগ্রহ তাদের আর নেই।

শ্বেতাঙ্গরা সম্মত হল। ম্যাঙ্গবেটুদের গ্রামের মধ্যে নিগ্রোদের পাশাপাশি বাস করতে লাগল জার্মান আর আমেরিকান সৈন্যদল! শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থানের জ্বলন্ত নিদর্শন।

কয়েকদিন পরে এই নাটকীয় বন্ধুত্বের রঙ্গমঞ্চে নেমে এল সমাপ্তির যবনিকা। ম্যাঙ্গবেটুদের গ্রামের কাছে নদীর বুকে আবির্ভূত হল একটি আমেরিকান সী-প্লেন বা উভচর বিমান।

মার্কিন পাইলট জার্মান এবং আমেরিকানদের শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান দেখে বিস্মিত হয়েছিল। মাইকের অনুরোধে বিমানচালক জার্মানদের নিরাপদ অঞ্চলে পৌঁছে দিতে সম্মত হল। স্প্যানিশ গায়নার সীমান্তে একটি নদীর ধারে দাঁড়িয়ে দুই পক্ষ পরস্পরের কাছে বিদায় গ্রহণ করলে। বিদায়ের আগে মাইকের হাত চেপে ধরেছিল অটো গ্যটমেয়ার–ঘটনাচক্রে দুই শত্রুর মধ্যে গড়ে উঠেছিল বন্ধুত্বের বন্ধন, ভাগ্য তাদের সেই বন্ধুত্ব যাচাই করে নিয়েছিল অগ্নিপরীক্ষার ভিতর দিয়ে।

বিমানযোগে তিন বন্ধু নিরাপদে ফিরে এল মিত্রপক্ষের আস্তানায়। অটো গ্যটমেয়ার এবং অন্যান্য জার্মানদের সঙ্গে আর কোনোদিন তাদের সাক্ষাৎ হয়নি।

[ফাল্গুন ১৩৭৬]