৩৪. কাউন্টার পয়েন্ট

৩৪. কাউন্টাপয়েন্ট

…দুই বা ততোধিক সুরের মিশ্রণ…

বিছানায় উঠে বসল হিল্ডা। সোফি আর অ্যালবার্টোর গল্পের ওখানেই শেষ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আসলে কী ঘটেছিল?

শেষ চ্যাপ্টারটা তার বাবা কেন লিখলেন? সোফির জগতের ওপর তার ক্ষমতা প্রদর্শন করার জন্যে?

গভীর চিন্তামগ্ন অবস্থাতেই গোসল সেরে কাপড়চোপড় পরে নিল সে। তাড়াতাড়ি সকালের নাশতা সেরে বাগানে হেঁটে বেড়াল কিছুক্ষণ, তারপর বসল গিয়ে গ্লাইডারে।

 অ্যালবার্টোর সঙ্গে সে একমত যে গার্ডেন পার্টিতে ঘটা একমাত্র বিচক্ষণ ব্যাপার ছিল তার বক্তৃতাটা। তার বাবা নিশ্চয়ই এটা মনে করেননি যে হিল্ডার জগত্তা সোফির গার্ডেন পার্টির মতোই কোলাহলপূর্ণ? বা শেষ পর্যন্ত তার জগত্তাও উবে যাবে?

তারপর আবার সোফি আর অ্যালবার্টোর ব্যাপারটাও আছে। সেই গোপন পরিকল্পনাটার কী হলো?

গল্পটা চালিয়ে যাওয়ার ভার কি স্বয়ং হিল্ডার উপরই? নাকি ওরা আসলেই সেটা থেকে সরে পড়ার ব্যবস্থা করতে পেরেছে?

তাছাড়া, ওরা কোথায় এখন?

হঠাৎ করেই একটা চিন্তা মাথায় এলো তার। অ্যালবার্টো আর সোফি যদি সত্যি সত্যিই গল্পটা থেকে সরে পড়ে থাকে তাহলে রিং বাইন্ডারে সে-সম্পর্কে আর কিছু লেখা থাকবে না। ওখানে যা কিছু আছে দুর্ভাগ্যবশত তার সব কিছুই তার বাবার কাছে একেবারে পরিষ্কার।

তাহলে কি এমন কিছু আছে যা সরাসরি বলা হয়নি? সে-ব্যাপারে কিন্তু যথেষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে। হিল্ডা উপলব্ধি করল পুরো কাহিনীটা তাকে আরো দুয়েকবার পড়তে হবে।

সাদা মার্সিডিজটা বাগানের ভেতর ঢুকে পড়তেই অ্যালবার্টো সোফিকে টেনে নিয়ে গুহার মধ্যে ঢুকলেন। তারপর তারা মেজরের কেবিনের উদ্দেশে বনের ভেতর দিয়ে ছুট দিলেন।

জলদি! চেঁচিয়ে উঠলেন অ্যালবার্টো। ও আমাদের খোঁজ করার আগেই ঘটতে হবে ব্যাপারটা।

আমরা কি এখন মেজরের নাগালের বাইরে?

 আমরা সীমান্ত অঞ্চলে রয়েছি।

নৌকো বেয়ে পানি পেরিয়ে দৌড়ে কেবিনে গিয়ে ঢুকল ওরা। মেঝেতে একটা চোরা দরজা খুললেন অ্যালবার্টো। ঠেলে সোফিকে নিচে সেলারে পাঠালেন তিনি। এরপর সব কিছু অন্ধকার হয়ে গেল।

.

পরের দিনগুলোতে হিল্ডা তার পরিকল্পনাটা নিয়ে ব্যস্ত রইল। বেশ কয়েকটা চিঠি পাঠাল সে কোপেনহেগেন-এ, অ্যানি ভ্যামসডালের কাছে, বার দুয়েক তাকে ফোন করল সে। বন্ধু এবং পরিচিতদের সাহায্য নিল সে, সেই সঙ্গে স্কুলে তার ক্লাসের আদ্ধেক ছেলেমেয়েকে নিযুক্ত করল নানান কাজে।

এরই ফাঁকে সোফির জগৎ পড়ল সে। একবার পড়েই রেখে দেয়ার মতো কোনো কাহিনী এটা নয়। সোফি আর অ্যালবার্টো গার্ডেন পার্টি থেকে চলে যাওয়ার পরে তাদের কী হলো সে-সম্পর্কে সারাক্ষণই নিত্য নতুন চিন্তা আসছে তার মাথায়।

২৩শে জুন শনিবার নটার দিকে চমকে জেগে উঠল সে ঘুম থেকে। সে জানে তার বাবা এরিমধ্যে লেবাননের ক্যাম্প ত্যাগ করেছেন। এবার শুধু অপেক্ষার পালা। তার দিনের শেষ অংশটা একেবারে খুঁটিনাটি সহ পরিকল্পনা করা।

সকালে পরে সে তার মায়ের সঙ্গে মিডসামার ঈভে প্রস্তুতি নিল। হিল্ডা না ভেবে পারল না সোফি আর তার মা কী করে তাদের মিডসামার ঈভের আয়োজন করতে পারে। কিন্তু সেটা তো এমন একটা ব্যাপার যা তারা করে ফেলেছে। ব্যাপারটা শেষ, চুকেবুকে গেছে। কিন্তু আসলেই কি তাই? ওরা কি এই মুহূর্তে ঘুরে ঘুরে সব জায়গা সাজিয়ে বেড়াচ্ছে?

.

সোফি আর অ্যালবার্টো একটা লনে এসে বসল, সেটার সামনে কুৎসিতদর্শন বাতাস নির্গমন পথ আর বাইরের দিকে ভেন্টিলেশন ক্যানেলসহ দুটো দালান। একটা দালানের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো তরুণ একটা জুটি। ছেলেটার হাতে বাদামি রঙের ব্রিফকেস আর মেয়েটার কাঁধ থেকে ঝুলছে লাল একটা হ্যান্ডব্যাগ। পেছন থেকে, সরু একটা রাস্তা ধরে একটা গাড়ি এগিয়ে এলো।

কী হলো? সোফি শুধালো।

পেরেছি আমরা।

কিন্তু কোথায় আমরা?

এটা হচ্ছে অসলো।

আপনি ঠিক জানেন?

ঠিক জানি। এই দালান দুটোর একটির নাম শ্যাতত নিউফ, মানে নতুন প্রসাদ। লোকে সঙ্গীত নিয়ে পড়াশোনা করে ওখানে। অন্যটা কনগ্রিগেশন ফ্যাকাল্টি। থিওলজির স্কুল। পাহাড়ের আরো ওপরে বিজ্ঞান নিয়ে পড়ে লোকে আর একেবারে চুড়োয় সাহিত্য আর দর্শন।

আমরা কি হিল্ডার বই আর মেজরের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে এসেছি?

হ্যাঁ, দুটোরই বাইরে। আমাদের আর কখনো খুঁজে পাবে না সে এখানে।

 কিন্তু বনের ভেতর দিয়ে দৌড়ানোর সময় কোথায় ছিলাম আমরা?

 অর্থনীতিক উপদেষ্টার গাড়িটা আপেল গাছের গায়ে আছড়ে ফেলার কাজে মেজর যখন ব্যস্ত সেই অবসরে গুহার ভেতর লুকিয়ে পড়েছি আমরা। তখন ছিলাম আমরা জ্বণ-এর স্তরে। একই সঙ্গে পুরনো আর নতুন যুগের ছিলাম আমরা। কিন্তু ওখানে আমাদের লুকানোর ব্যাপারটা সম্ভবত মেজর কল্পনা করতে পারেনি।

কেন?

আমাদেরকে এতো সহজে পার পেয়ে যেতে দিতে চায়নি সে। ব্যাপারটা ছিল যেন স্বপ্নের মতো। অবশ্য এই সম্ভাবনাটা থেকেই যে যাচ্ছে যে সে নিজেই ব্যস্ত ছিল এ-সব নিয়ে।

কী বলতে চান?

সাদা মার্সিডিজটা সে-ই চালু করেছিল। আমাদের হারিয়ে ফেলার জন্যে সে হয়ত নিজেকে পুরোপুরি ব্যস্ত রেখেছিল। যে-সব ঘটনা ঘটছিল তাতে হয়ত সে একেবারে ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে পড়েছিল…

তরুণ জুটিটা এর মধ্যে মাত্র কয়েক গজের মধ্যে এসে পড়েছে। নিজের চেয়ে এতো বেশি বয়েসী একটি লোকের সঙ্গে ঘাসের ওপর বসে থাকায় খানিকটা অস্বস্তি বোধ করল সোফি। তাছাড়া, সে চাইছিল অ্যালবার্টো যা বলছেন তা কাউকে দিয়ে নিশ্চিত করাতে।

সে উঠে দাঁড়িয়ে ওদের কাছে গেল।

কিছু মনে করবেন না, এই রাস্তাটার নামটা দয়া করে বলবেন?

কিন্তু ওরা তাকে কোনোরকম গ্রাহ্যই করল না।

সোফি এতোটাই বিরক্ত হলো যে সে আবারো জিগ্যেস করল তাদেরঃ

কারো প্রশ্নের জবাব দেয়াটাই তো রীতি, তাই না?

তরুণ লোকটি তার সঙ্গীকে কী যেন বোঝাতে ব্যস্ত:

কন্ট্রাপান্টাল ফর্মটা দুটো মাত্রায় কাজ করে, আনুভূমিকভাবে বা সাঙ্গীতিকভাবে আর উল্লম্বভাবে বা ঐকতানিকভাবে। সব সময়েই দুই বা ততোধিক সুর একসঙ্গে বাজবে…

বাধা দেয়ার জন্যে দুঃখিত, কিন্তু…

সুরগুলো এমনভাবে যুক্ত হয় যে সেগুলোর স্বরূপ যথাসম্ভব বেরিয়ে আসে, একটার বিপরীতে অন্যটি কেমন শোনাচ্ছে সেটার অপেক্ষা না করেই। তবে সুরগুলোকে অবশ্যই সমম্বিত হতে হবে। আসলে এটা হচ্ছে একটা নোট-এর বিপরীতে বা পিঠে আরেকটা নোট।

কী অভদ্র! ওরা বধিরও নয় অন্ধও নয়। তৃতীয়বারের মতো চেষ্টা করল সোফি, সামনে গিয়ে ওদের পথ আটকে দিয়ে।

স্রেফ একপাশে সরিয়ে দেয়া হলো তাকে।

ছুটে গেল সোফি অ্যালবার্টোর কাছে।

আমার কথা শুনতে পাচ্ছে না ওরা! একরাশ হতাশা নিয়ে বলল সে আর ঠিক তখনই হিল্ডা আর তার ক্রুশবিদ্ধ যীশুমূর্তিকে নিয়ে দেখা নিজের স্বপ্নের কথা মনে পড়ে গেল তার।

এই মূল্যটুকু আমাদের দিতেই হবে। যদিও আমরা একটা বই থেকে চুপিচুপি বেরিয়ে গেছি, তাই বলে সেটার লেখকের সমান মর্যাদা আমরা দাবি করতে পারি না। তবে আমরা কিন্তু সত্যিই এখানে আছি। সেই ফিলসফিকাল গার্ডেন পার্টি থেকে চলে আসার সময় আমাদের বয়স যত ছিল তার চেয়ে এক দিনও বয়স বাড়বে না আমাদের এখন থেকে।

তার মানে কি এই যে আমাদের চারপাশের মানুষজনের সঙ্গে আর কখনো সত্যিকার অর্থে কোনো সম্পর্ক থাকবে না আমাদের?

সত্যিকারের একজন দার্শনিক কখনোই আর কখনোই না বলেন না। কটা বাজে?

আটটা।

ক্যাপ্টেনের বাঁক ছেড়ে যখন চলে আসি তখনকার সময়ই এটা ঠিকই আছে।

আজই তো হিল্ডার বাবা লেবানন থেকে ফিরছে।

সেজন্যেই তাড়াতাড়ি করতে হবে আমাদের।

কেন-কী বলতে চাইছেন?

মেজর বিয়ার্কলেতে তার বাড়িতে ফিরে এলে কী হবে তা জানতে ইচ্ছে করছে না তোমার?

স্বভাবতই, কিন্তু…

এসো তাহলে?

শহরের দিকে হাঁটতে শুরু করল দুজন। মেলা লোকজন তাদের পাশ কাটিয়ে গেল কিন্তু তারা সবাই ঠিক এমনভাবে হেঁটে গেল যেন সোফি আর অ্যালবার্টো অদৃশ্য।

 সারা রাস্তায় কাসাইড-এ গাড়ি পার্ক করা। হুড খোলা ছোট্ট একটা লাল কনভার্টিবল-এর সামনে এসে দাঁড়ালেন অ্যালবার্টো।

এটাতেই চলবে, বললেন তিনি। তবে গাড়িটা যে আমাদেরই সে-ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে নিতে হবে।

কী বলছেন বুঝতে পারছি না।

তাহলে খুলে বলাই ভালো। সাধারণ কোনো গাড়ি, যেটার মালিক এই শহরের কেউ। স্রেফ সে-রকম একটা নিলেই কিন্তু চলবে না আমাদের! চালক ছাড়া একটা গাড়ি চলতে দেখলে কী ঘটবে বলে মনে করো তুমি? আর তাছাড়া আমরা হয়ত সেটা চালু করতে পারবো না।

তাহলে এই কনভার্টিবলটা কেন?

মনে হয় পুরনো কোনো মুভিতে আমি দেখেছি এটা।

দেখুন, আমি দুঃখিত, কিন্তু এ-সব রহস্যময় মন্তব্য শুনে শুনে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি আমি।

এটা একটা মেক-বিলীভ গাড়ি, সোফি। ঠিক আমাদের মতো। লোকে শুধু একটা খালি জায়গা দেখতে পাচ্ছে এখানে। যাত্রা শুরু করার আগে এই ব্যাপারটাই নিশ্চিত করতে হবে।

 গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় রইলেন তারা। খানিক পর সাইডওয়াক ধরে সাইকেল চালিয়ে এলো একটি ছেলে। হঠাৎ করেই ঘুরে সাইকেলটা সে সোজা লাল গাড়িটার ভেতর দিয়ে চালিয়ে রাস্তায় নেমে গেল।

এই যে, দেখলে? গাড়িটা আমাদের।

যাত্রী আসনের দরজাটা মেলে ধরলেন অ্যালবার্টো।

বি মাই গেস্ট! বললেন তিনি। সোফি ঢুকে পড়ল।

চালকের আসনে গিয়ে বসলেন অ্যালবার্টো। চাবিটা ইগনিশনেই ছিল, সেটা যোরালেন তিনি, চালু হয়ে গেল এঞ্জিন।

লাইসেকার, স্যান্ডভিকা, ড্রামেন পেরিয়ে শহরের বাইরে দক্ষিণ দিকে ছুটে চললেন তারা, এগোলেন লিলেস্যান্ড-এর দিকে। চলতে চলতে ক্রমেই বেশি করে মিডসামার বনফায়ার দেখতে পাচ্ছিলেন তারা, বিশেষ করে ড্রামেন পেরনোর পর।

এখন মিডসামার, সোফি। দেখো, দারুণ না?

সেটা ছাড়াও, এ-রকম একটা ভোলা গাড়িতে চড়াতে চমৎকার একটা টাটকা বাতাস গায়ে লাগছে। আচ্ছা, আসলেই কি কেউ দেখতে পাচ্ছে না আমাদের?

শুধু আমাদের মতো লোকজন ছাড়া। অবশ্য সে-রকম কারো সঙ্গে দেখা হয়েও যেতে পারে আমাদের। কটা বাজে?

সাড়ে আটটা।

 শর্টকাট দুয়েকটা পথ ধরতে আমাদের। এই ট্রেইলারের পেছন পেছন গেলে চলবে না।

বাঁক নিয়ে বিরাট একটা গমের ক্ষেতের ভেতর ঢুকে পড়লেন তাঁরা। পেছন ফিরে তাকিয়ে সোফি দেখল সমান হয়ে নুয়ে পড়া উঁটিগুলোর চওড়া একটা পথরেখা পেছনে ফেলে যাচ্ছে তারা।

কাল সবাই বলবে ক্ষেতের ওপর দিয়ে হাওয়ার একটা ঝাঁপটা বয়ে গেছে, অ্যালবার্টো বললেন।

কোপেনহেগেন-এর বাইরে অবস্থিত কাস্ট্রাপ এয়ারপোর্টে এইমাত্র নামলেন মেজর অ্যালবার্ট ন্যাগ। ২৩শে জুন শনিবার, সাড়ে চারটায়। দিনটা আজ এমনিতেই বেশ দীর্ঘ ছিল। শেষ ল্যাপের আগের এই ল্যাপটা ছিল রোম থেকে প্লেনে।

জাতিসংঘের ইউনিফর্ম পরেই পাসপোর্ট কন্ট্রোল পেরোলেন তিনি। পোশাকটা পরতে গর্ব বোধ করেন তিনি। শুধু নিজের আর তার দেশেরই প্রতিনিধিত্ব করেন না তিনি। অ্যালবার্ট ন্যাগ প্রতিনিধিত্ব করেন এক আন্তর্জাতিক আইনগত পদ্ধতির-এক শতাব্দী বয়েসী একটি ঐতিহ্যের, যে-ঐতিহ্য আজ ছড়িয়ে পড়েছে গোটা এই গ্রহটা জুড়ে।

কেবল একটা ফ্লাইট ব্যাগ সঙ্গে তাঁর। রোম থেকেই তাঁর বাকি ব্যাগেজ চেক করিয়ে এনেছেন তিনি। এখন শুধু তাঁর লাল পাসপোর্টটা উঁচু করে ধরলেই হবে।

ডিক্লেয়ার করার মতো কিছু নেই।

ক্রিস্টিয়ানস্যান্ডের উদ্দেশে তাঁর প্লেন যাত্রা করার আগে প্রায় তিন ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হচ্ছে মেজর অ্যালবার্ট ন্যাগকে। পরিবারের সদস্যদের জন্যে কিছু উপহার কেনা যাবে এই সময়টাতে। অবশ্য দুই হপ্তা আগেই তিনি তাঁর জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান উপহারটা পাঠিয়ে দিয়েছেন হিল্ডাকে। জন্মদিনের দিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই সে যাতে ওটা দেখতে পায় সেজন্যে মেজরের স্ত্রী মারিট সেটা হিল্ডার বেডসাইড টেবিলের ওপর রেখে দিয়েছিলেন। গভীর রাতে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানানোর পর থেকে হিল্ডার সঙ্গে আর কোনো কথা হয়নি তাঁর।

গোটা দুয়েক নরওয়েজিয় খবরের কাগজ কিনে বারে একটা ফাঁকা টেবিল বেছে। নিয়ে কফির অর্ডার দিলেন অ্যালবার্ট। শিরোনামগুলোর ওপর তিনি নজর বোলাতে পেরেছেন কি পারেননি এমন সময় লাউডস্পিকারে দেয়া একটা ঘোষণা কানে গেল তাঁর: অ্যালবার্ট ন্যাগের জন্যে একটি ব্যক্তিগত টেলিফোন। অ্যালবার্ট ন্যাগকে এসএএস তথ্যকেন্দ্রে যোগাযোগ করতে বলা হচ্ছে।

কী হলো আবার? শিরদাঁড়া বেয়ে ঠাণ্ডা শিরশিরে একটা স্রোত বয়ে গেল তার। নিশ্চয়ই লেবাননে ফিরে যাওয়ার আদেশ আসেনি তার। বাড়িতে কোনো সমস্যা হলো?

দ্রুত এসএএস তথ্যকেন্দ্র পৌঁছে গেলেন তিনি।

আমি অ্যালবার্ট ন্যাগ।

আপনার জন্যে একটি মেসেজ আছে। জরুরি মেসেজ।

সেই মুহূর্তেই খামটা খুললেন তিনি। ভেতরে আরো ছোট একটা খাম। তাতে ঠিকানা লেখা মেজর অ্যালবার্ট ন্যাগ, প্রযত্নে এসএএস তথ্যকেন্দ্র, কাট্রাপ বিমানবন্দর, কোপেনহেগেন।

নার্ভাসভাবে ছোট্ট খামটা খুললেন অ্যালবার্ট। তাতে ছোট্ট একটা চিরকুট

প্রিয় বাবা, লেবানন থেকে বাড়ি ফিরে আসা উপলক্ষে শুভেচ্ছা। বুঝতেই পারো তোমার বাড়ি পৌঁছানো পর্যন্ত তর সইছে না আমার। লাউডস্পীকারে ঘোষণা দিয়ে তোমাকে মেসেজ দেয়ার জন্যে আমাকে ক্ষমা করো। তবে ওটাই ছিল সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি।

পুনশ্চ: দুর্ভাগ্যক্রমে, চুরি যাওয়া এবং বিধ্বস্ত একটা মার্সিডিজ-এর ব্যাপারে ক্ষতিপূরণ চেয়ে অর্থনীতিক উপদেষ্টা ইঙ্গেব্রিগস্টেন-এর কাছ থেকে একটা চিঠি এসেছে।

পুনঃ পুনশ্চ: তুমি যখন এখানে পৌঁছুবে আমি হয়ত তখন বাগানে বসে থাকবে। তবে তার আগেও হয়ত তোমার সঙ্গে যোগাযোগ হবে আমার।

 পুনঃ পুনঃ পুনশ্চ: বাগানে বেশিক্ষণ বসে থাকতে ভয় করে আমার। এ-সব জায়গায় মাটির ভেতর দেবে যাওয়াটা খুব সহজ। হিল্ডার ভালোবাসা নিও, তোমার বাড়ি আসা উদযাপনের প্রস্তুতির জন্যে প্রচুর সময় পেয়েছে সে।

.

মেজর অ্যালবার্ট ন্যাগের প্রথম প্রতিক্রিয়াটা হলো এই যে তিনি মুচকি হাসলেন। কিন্তু তাকে নিয়ে কেউ এভাবে খেলুক এ-ব্যাপারটা তার বিশেষ পছন্দ হলো না। নিজের জীবনের দায়িত্ব নিজের ওপর নেয়াটাই বরাবরের পছন্দ তার। কিন্তু এখন লিলেস্যান্ডের এই ছোট্ট বদমেজাজী মেয়েটা কাস্ট্রাপ এয়ারপোর্টে তার গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করছে! কী করে এসবের ব্যবস্থা করল সে?

খামটা বুক পকেটে রেখে ছোট্ট শপিং মলটার দিকে ধীর পায়ে হাঁটতে শুরু করলেন তিনি। ডেনিশ তৈরি-খাবারের ছোট একটা দোকানে তিনি ঢুকতে যাবেন প্রায় এই সময়ে দোকানের জানলায় টেপ দিয়ে লাগানো একটা ছোট খাম দেখতে পেলেন তিনি। মোটা একটা মার্কার পেন দিয়ে মেজর ন্যাগ লেখা সেটায়। অ্যালবার্ট সেটা নামিয়ে নিয়ে খুললেন:

ব্যক্তিগত মেসেজ। যার জন্য মেজর অ্যালবার্ট ন্যাগ, প্রযত্নে, ডেনিশ ফুড, কাস্ট্রাপ, কোপেনহেগেন। প্রিয় বাবা, প্লিজ বড়সড় একটা ডেনিশ সালামি কিনে এনো, দুপাউন্ডের হলে ভালো হয়। আর, একটা কনিয়াক সসেজ সম্ভবত মা-র অপছন্দ হবে না। পুনশ্চ: ডেনিশ ক্যাভিয়ারও খারাপ না। ভালোবাসা নিও, হিল্ডা।

ঘুরে দাঁড়ালেন অ্যালবার্ট। হিল্ডা এখানে নেই, তাই নয় কি? নাকি মারিট ওকে নিয়ে কোপেনহেগেন বেড়াতে এসেছে, যাতে সে এখানে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে পারে? হাতের লেখাটা তো হিল্ডার…

হঠাৎ করেই জাতিসংঘের পর্যবেক্ষকের মনে হলো তাকে চোখে চোখে রাখা হচ্ছে। মনে হচ্ছে দূর থেকে তাঁর প্রতিটি কাজকর্ম নিয়ন্ত্রণ করছে কেউ। একটি শিশুর হাতের পুতুল বলে মনে হলো তাঁর নিজেকে।

দোকানে ঢুকে দুই পাউন্ডের একটা সাল্যামি, একটা কনিয়াক সসেজ আর তিন জার ডেনিশ ক্যাভিয়ার কিনলেন তিনি। এরপর আবার দোকানগুলোর সারি ধরে হাঁটতে লাগলেন তিনি। হিল্ডার জন্যে একটা সত্যিকারের উপহার কিনবেন বলে ঠিক করেছেন তিনি। একটা ক্যালকুলেটর হলে কেমন হয়? অথবা একটা ছোট্ট রেডিও-হ্যাঁ, তাই কিনবেন তিনি।

বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি বিক্রি করে এ-রকম একটা দোকানে পৌঁছে তিনি দেখলেন সেটার জানলাতেও ছোট্ট একটা খাম আঁটা আছে টেপ দিয়ে। এটাতে ঠিকানা লেখা: মেজর অ্যালবার্ট ন্যাগ, প্রযত্নে, কাস্ট্রাপের সবচেয়ে মজার দোকান। ভেতরে আছে নিচের লেখাটা:

প্রিয় বাবা, সোফি তার জন্মদিন উপলক্ষে তার অতি উদার বাবার কাছ থেকে যে কম্বাইন্ড মিনি-টিভি আর এফএম রেডিও পেয়েছে সেজন্যে সে তার শুভেচ্ছা আর ধন্যবাদ জানাচ্ছে। জিনিসটা অসাধারণ, আবার নেহাত মামুলিও বটে। অবশ্য আমাকে স্বীকার করতেই হবে যে এ-সব মামুলি ব্যাপারের প্রতি সোফির মতো আমিও দুর্বল। পুনশ্চ: তুমি যদি এখনো এখানে পৌঁছে না থাকো তাহলে ডেনিশ ফুড স্টোর আর মদ ও তামাক বিক্রি হয় যেখানে সেই বড় ট্যাক্স ফ্রি দোকান দুটোতে পরবর্তী নির্দেশ দেয়া আছে। পুনঃ পুনশ্চ: আমার জন্মদিন উপলক্ষে কিছু টাকা পেয়েছি আমি, কাজেই মিনি টিভিতে ৩৫০ ক্রাউন দান করতে পারি আমি। হিল্ডার ভালোবাসা নিও। এরিমধ্যে সে টার্কিটা স্টাফড় করেছে আর ওয়াল্ড সালাদ তৈরি করে ফেলেছে।

একটা মিনি-টিভির দাম ৯৮৫ ডেনিশ ক্রাউন। কন্যার খামখেয়ালি কৌশলের কারণে একবার এদিক আরেকবার সেদিক দৌড়তে বাধ্য হয়ে অ্যালবার্ট ন্যাগের যে মানসিক অবস্থা সেই তুলনায় অবশ্য দামটা নেহাতই মামুলি ব্যাপার। হিল্ডা কি এখানে আছে-না নেই?

এরপর থেকে যে-কোনো জায়গায় গিয়েই প্রতিনিয়ত সতর্ক রইলেন তিনি। নিজেকে তার একজন সিক্রেট এজেন্ট আর একটা নাচের পুতুল-এর সংমিশ্রণ বলে মনে হলো। মৌলিক মানবাধিকার থেকে কি বঞ্চিত করা হচ্ছে না তাঁকে?

শুল্ক মুক্ত দোকানটাতেও যাওয়ার তাড়া অনুভব করলেন তিনি। তাঁর নাম লেখা নতুন একটা খাম ঝুলছে সেখানে। তাঁকে কার্সর করে গোটা এয়ারপোের্টটাই একটা কম্পিউটার গেম হয়ে উঠছে। মেসেজটা পড়লেন তিনি

মেজর ন্যাগ, প্রযত্নে কাস্ট্রাপের শুল্কমুক্ত দোকান। এখান থেকে আমার বা দরকার তা হলো এক ব্যাগ গামড্রপ আর কিছু মার্জিপান (marzipan) বার। মনে রেখো, নরওয়েতে কিন্তু এগুলোর দাম খুব বেশি। বাড়ি ফেরার সময় সারাটা পথ পঞ্চইন্দ্রিয় অবশ্যই সজাগ রাখবে কিন্তু। জরুরি কোনো মেসেজ মিস হোক সেটা নিশ্চয়ই চাও না তুমি, তাই না? ভালোবাসা নিও, তোমার একান্তই শিক্ষানুরাগী কন্যা, হিল্ডা।

হতাশ ভঙ্গিতে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন অ্যালবার্ট, অবশ্য দোকানে গিয়ে ফরমায়েশমতো কেনাকাটা তিনি ঠিকই করলেন। তিনটে প্লাস্টিক ক্যারিয়ার আর তাঁর ফ্লাইট ব্যাগটা নিয়ে ২৮ নং গেট-এর দিকে এগোলেন তিনি তাঁর ফ্লাইটের জন্যে অপেক্ষা করতে। আর যদি কোনো মেসেজ থেকে থাকে তাহলে সেগুলোকে ওখানেই অপেক্ষা করতে হবে।

অবশ্য ২৮ নং গেট-এ আরেকটা সাদা খাম নজরে পড়ল তার, একটা পিলারের সঙ্গে টেপ দিয়ে আটকানো সেটা। প্রতি, মেজর ন্যাগ, প্রযত্নে ২৮ নং গেট, কাট্রাপ বিমানবন্দর। এটাও হিল্ডারই লেখা; তবে গেট নম্বরটা মনে হলো অন্য কেউ লিখেছে। অবশ্য সেটা বিচার করা সহজ নয় তার কারণ ওটার সঙ্গে তুলনা করার মতো অন্য কোনো লেখা নেই। কেবল বড় হাতের অক্ষর আর সংখ্যা। খামটা নামিয়ে নিলেন তিনি। সেটাতে শুধু লেখা: আর বেশি দেরি নেই।

দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে একটা চেয়ারে বসে পড়লেন তিনি। শপিং ব্যাগগুলো হাঁটুর ওপরই রাখলেন তিনি। তো, এভাবেই শক্ত হয়ে বসে রইলেন মেজর, চোখের দৃষ্টি একেবারে সামনে, যেন এই প্রথমবারের মতো একা একা ভ্রমণে বেরিয়েছে একটি ছোট্ট শিশু। হিল্ডা যদি এখানে থেকে থাকে তাহলে তাকে প্রথমে আবিষ্কার করার তৃপ্তিটা যে সে পাচ্ছে না তা নিশ্চিত;

 যে যাত্রীই আসছে তার দিকেই উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে তাকাতে থাকলেন তিনি। কিছুক্ষণের জন্যে নিজেকে তাঁর কড়া নজরদারিতে থাকা এক রাষ্ট্রদ্রোহী বলে মনে হলো। শেষ পর্যন্ত যাত্রীদেরকে যখন প্লেনে চড়ার অনুমতি দেয়া হলো, স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস ফেললেন তিনি। সবার শেষে প্লেনে চড়লেন তিনি। তাঁর বোর্ডিং পাসটা হস্তান্তর করার আগে চেক-ইন ডেস্কের সঙ্গে টেপ দিয়ে আটকানো আরো একটা সাদা খাম পেলেন তিনি।

ব্রেভিক অতিক্রম করলেন সোফি আর অ্যালবার্টো, তার খানিক পর ক্রাগেরো-র শেষ সীমানা।

আপনি কিন্তু ভীষণ জোরে চালাচ্ছেন, সোফি বলল।

প্রায় নটা বাজে। শিগগিরই কিয়েভিকে ল্যান্ড করবে সে। তবে দ্রুতবেগে গাড়ি চালাবার জন্যে কেউ আমাদের থামতে বলবে না।

ধরুন যদি আরেকটা গাড়ির সঙ্গে সংঘর্ষ হয় আমাদের?

সেটা যদি সাধারণ কোনো গাড়ি হয় তাহলে কিছুই হবে না। তবে সেটা যদি আমাদেরটার মতোই একটা হয়…

তাহলে কী হবে?

সেক্ষেত্রে আমাদেরকে সাবধান হতে হবে। খেয়াল করোনি, ব্যাট মোবিলকে পাশ কাটিয়ে গেলাম আমরা?

না।

ভেস্টফোল্ড-এর উত্তরে কোথাও পার্ক করা ছিল ওটা।

এই ট্যুরিস্ট বাসটাকে পাস কাটানো সহজ হবে না। রাস্তার দুই পাশেই ঘন জঙ্গল।

তাতে কিছু আসে যায় না সোফি। এই কথাটা মাথায় ঢুকছে না তোমার?

এই বলে বনের ভেতর গাড়ি ঘোরালেন তিনি, তারপর সোজা চালাতে লাগলেন গাছগুলোর ভেতর দিয়ে।

স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস ফেলল সোফি।

 আপনি ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন আমাকে।

ইটের দেয়ালের ভেতর দিয়ে চালিয়ে দিলেও কিছু টের পাবো না আমরা।

তার অর্থ স্রেফ এই যে আমাদের চারপাশের তুলনায় আমরা বাতাসের তৈরি স্পিরিট।

না, না, এবার কিন্তু তুমি ঘোড়ার আগে গাড়ি জুতছ। আমাদের চার পাশের বাস্তবতাটাই বরং আমাদের কাছে বায়বীয় অ্যাডভেঞ্চার বলে মনে হচ্ছে।

বুঝলাম না।

তাহলে মন দিয়ে শোনো: বহুল প্রচারিত একটু ভুল ধারণা আছে যে স্পিরিট হচ্ছে বাস্পের চেয়েও বেশি বায়বীয় একটা জিনিস। বরং স্পিরিট-ই বরফের চেয়েও কঠিন।

সে-রকম তো কখনো মনে হয়নি আমার কাছে।

এবার একটা গল্প শোনাবো তোমাকে। এক সময় একটা লোক ছিল যে পরীর অস্তিত্বে বিশ্বাস করতো না। একদিন সে যখন বাইরে বনের মধ্যে কাজ করছিল তখন একটা পরী তার কাছে আসে।

তারপর?

দুজনে তারা একসঙ্গে হাঁটল কিছুক্ষণ। তারপর লোকটা পরীটির দিকে তাকিয়ে বলল, ঠিক আছে, এবার আমি স্বীকার করলাম পরী আছে। কিন্তু তুমি আমাদের মতো বাস্তবে বসবাস করো না। কী বলতে চাও তুমি? পরী জিগ্যেস করল। লোকটা তখন জবাব দিল, আমরা যখন বড় পাথরটার কাছে পৌঁছালাম তখন ওটার পাশ দিয়ে ঘুরে যেতে হয়েছিল আমাকে। কিন্তু খেয়াল করেছি তুমি ওটার ভেতর দিয়ে ভেসে চলে এলে। আর যখন আমরা পথের ওপর পড়ে থাকা বিশাল কাঠের গুঁড়িটার কাছে পৌঁছুলাম তখন আমাকে ওটা বেয়ে ওপরে উঠে অন্য ধারে যেতে হলেও তুমি স্রেফ ওটার ভেতর দিয়ে হেঁটে গিয়েছিলে। পরীটি খুব অবাক হলো। সে বলল কিন্তু সেই সঙ্গে কি তুমি এটা খেয়াল করেনি যে জলাভূমির ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া একটা পথ ধরে হেঁটে গিয়েছিলাম আমি? আমরা দুজনেই কুয়াশার ভেতর দিয়ে হেঁটে গিয়েছিলাম। তার কারণ হলো আমরা সেই কুয়াশার চেয়েও কঠিন।

বাহ।

আমাদের বেলাতেও ব্যাপারটা তাই, সোফি। ইস্পাতের দরজার ভেতর দিয়েও ঢুকে যেতে পারে স্পিরিট। স্পিরিটকে ভাঙতে পারে এমন কোনো ট্যাংক না বোমারু বিমান নেই।

সেটা একটা স্বস্তির কথা।

 শিগগিরই রিসঅর অতিক্রম করবো আমরা। মেজরের কেবিন থেকে বেরনোর পর এক ঘণ্টা হয়ে গেছে। এখন সত্যি সত্যিই এক কাপ কফির সদ্ব্যবহার করতে পারি আমি।

ওঁরা যখন ফিয়ান পৌঁছুলেন, সনডেলেড-এর ঠিক আগে, রাস্তার বাম পাশে একটা ক্যাফেটেরিয়া পেরিয়ে এলেন ওরা। ওটার নাম সিন্ডেরেলা। অ্যালবার্টো গাড়িটা ঘুরিয়ে ফেলে ক্যাফেটেরিয়ার সামনে ঘাসের ওপর দাঁড় করালেন সেটা।

ভেতরে গিয়ে কুলার থেকে কোকের একটা বোতল নেয়ার চেষ্টা করল সোফি, কিন্তু বোতলটা তুলতে পারল না সে। মনে হলো আটকে গেছে ওটা। ওদিকে গাড়িতে পাওয়া কাগজের একটা কাপে কফি ঢালার চেষ্টা করছিলেন অ্যালবার্টো আরো ভেতরের কাউন্টারে গিয়ে। কেবল একটা লিভারে চাপ দিলেই কাজটা হওয়ার কথা, কিন্তু তিনি তাঁর সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করেও নিচে নামাতে পারলেন না সেটাকে।

 তাতে তার এমনই রোখ চেপে গেল যে ক্যাফেটেরিয়ার খদ্দেরদের দিকে ফিরলেন তিনি সাহায্যের জন্যে। কেউ-ই তার আহ্বানে সাড়া না দেয়ায় এতো জোরে চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি যে দুহাতে কান ঢাকতে হলো সোফিকে: কফি চাই আমি।

শিগগিরই রাগটা উবে গেল তাঁর, হাসতে হাসতে সামনের দিকে বাঁকা হয়ে গেলেন তিনি। এক বৃদ্ধা মহিলা তাঁর চেয়ার ছেড়ে উঠে এগিয়ে এলেন ওদের দিকে।

তার পরনে একটা ঝলমলে লাল স্কার্ট, বরফ নীল কার্ডিগান আর মাথায় পেঁচানো সাদা একটা রুমাল। ছোট্ট সেই ক্যাফেটেরিয়ার অন্য যে-কোনো কিছুর চেয়ে তাকে বেশি স্পষ্ট আর বাস্তব বলে মনে হচ্ছে।

অ্যালবার্টোর কাছে গিয়ে তিনি বললেন, ওরেব্বাপ, কী চেঁচাতেই না তুমি পারো, বাছা!

মাফ করবেন।

কফি খেতে চাও বলছিলে না?

হ্যাঁ, কিন্তু…

কাছেই ছোট্ট একটা দোকান আছে আমাদের।

সেই মহিলাকে অনুসরণ করে ক্যাফেটেরিয়া থেকে বেরিয়ে সেটার পেছনের একটা রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগলেন তাঁরা। হাঁটতে হাঁটতে বৃদ্ধা জিগ্যেস করলেন, এখানে নতুন বুঝি তোমরা?

সেটা স্বীকার করাটাই ভালো, অ্যালবার্টো জবাব দিলেন।

ঠিক। অনন্তে স্বাগতম জানাই তাহলে তোমাদের, বাছারা।

কিন্তু আপনার পরিচয়?

আমি গ্রিম ভাইদের একটা রূপকথা থেকে বেরিয়ে আসা একজন। সে প্রায় দুশো বছর আগের কথা। তা, তোমরা কোত্থেকে আসছ?

দর্শনের ওপর লেখা একটা বই থেকে। আমি হচ্ছি দর্শন-এর শিক্ষক আর এ আমার ছাত্রী সোফি?

হি, হি! এটা তো দেখছি একটা নতুন বই।

বৃক্ষরাজির ভেতর দিয়ে হেঁটে ছোট্ট একটা ফাঁকা জায়গায় এসে পড়লেন তাঁরা। বেশ কিছু চমৎকার দেখতে বাদামী কটেজ রয়েছে সেখানে। কটেজগুলোর মাঝে একটা আঙিনায় বড় সড় একটা মিডসামার বনফায়ার জ্বলছে। সেই বনফায়ারটাকে ঘিরে নাচছে বহুবর্ণ কিছু চরিত্রের একটা দঙ্গল। তাদের অনেককেই চিনতে পারলো সোফি। স্নো হোয়াইট আর বামনদের কয়েকজন রয়েছে সেখানে, রয়েছে মেরি পপিনস আর শার্লক হোমস, পিটার প্যান আর পিপি লংস্টকিংস, লিটল রেডরাইডিংহুড আর সিন্ডেরেলা। এছাড়াও, নামহীন কিছু পরিচিত চরিত্র-ও জড়ো হয়েছে বনফায়ার-এর চারপাশে-বেঁটে বামন ভূত-প্রেত, জ্বীন আর পরী, ডাইনি বুড়ি আর দৈত্য দাননা। সত্যিকারের একটা জলজ্যান্ত ট্রল-ও দেখতে পেল সোফি।

কী ভীষণ শোরগোলা বলে উঠলেন অ্যালবার্টো।

তার কারণ এখন মিডসামার, বৃদ্ধা মহিলা ব্যাখ্যা করলেন। ভালবৰ্গস ঈভের পর এতো বড়ো জমায়েত আর পাইনি আমরা। সেটা অবশ্য হয়েছিল আমরা জার্মানীতে থাকার সময়। অল্প কদিনের জন্যে এখানে বেড়াতে এসেছি মাত্র। তা, কফি চাইছিলে না তুমি?

জ্বী। দয়া করে যদি…

এতোক্ষণে সোফি খেয়াল করল যে সব কটা দালান জিঞ্জারব্রেড আর চিনি বরফের আস্তর দিয়ে তৈরি। চরিত্রগুলোর অনেকেই একেবারে সরাসরি বাড়িগুলোর সামনের অংশটায় কামড় বসিয়ে দিয়েছে। একজন রুটিঅলা ঘুরে ঘুরে ক্ষতিগ্রস্ত অংশগুলো সঙ্গে সঙ্গে সারিয়ে দিচ্ছে। এক কোনায় ছোট্ট একটা কামড় বসালো সোফি। এর আগে এতো মিষ্টি আর এতো ভালো কোনো জিনিস সে খায়নি বলে মনে হলো তার।

একটু পরেই এক কাপ কফি নিয়ে হাজির হলেন বৃদ্ধা।

সত্যিই অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।

তা অতিথিরা এই কফির দাম দিচ্ছে কীভাবে?

দাম দেবো?

আমরা সাধারণত কোনো গল্প বলে দাম চুকোই। কফির জন্যে একটা ওল্ড ওয়াইভস টেল হলেই চলবে।

আমরা মানবতার গোটা অবিশ্বাস্য কাহিনীটাই বলতে পারতাম, অ্যালবার্টো বললেন, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে একটু তাড়া আছে আমাদের। ফিরে এসে অন্য একদিন দামটা দিই।

অবশ্যই। তা, তোমাদের তাড়াটা কীসের?

অ্যালবার্টো তাদের যাত্রার উদ্দেশ্য বর্ণনা করলেন, তাই শুনে বৃদ্ধা মহিলা মন্তব্য করলেন: তাহলে তো বলতেই হচ্ছে যে তোমরা নেহাতই অর্বাচনীয় এখনো, কাজেই, তোমরা বরং তাড়াতাড়ি করো, তোমাদের মানব জন্মদাতার সঙ্গে যে নাড়ির বাঁধনে তোমরা বাঁধা আছে সেটা ছিঁড়ে ফেলল। ওদের জগতের আর দরকার নেই। আমাদের। আমাদের বাস অদৃশ্য মানুষের জগতে।

তাড়াতাড়ি করে সিন্ডেরেলা ক্যাফেটেরিয়া এবং লাল কনভার্টিবল-এর কাছে ফিরে এলেন অ্যালবার্টো আর সোফি। গাড়িটার একেবারে পাশেই ব্যস্ত এক মা তার ছোট্ট ছেলেটাকে হিসি করতে সাহায্য করছেন।

তীরবেগে ছুটে আর শর্ট কাট পথ ধরে শিগগিরই লিলেস্যান্ড-এ পৌঁছে গেলেন তারা।

.

 কোপেনহেগেন থেকে আসা এসকে ৮৭৬ যথাসময়ে রাত ৯ট ৩৫-এ কিয়েভিক বিমানবন্দরে অবতরণ করল। প্লেনটা যখন কোপেনহেগেন-এ রানওয়েতে নিয়ে আসা হয়েছিল তখন চেক-ইন ডেস্ক থেকে ঝুলতে থাকা খামটা খুলেছিলেন মেজর। ভেতরের চিরকুটটায় লেখা ছিল:

প্রতি, মেজর ন্যাগ, যখন তিনি ১৯৯০ সালের মিডসামার ঈ-এ কাষ্ট্ৰীপ বিমান বন্দরে তাঁর বোর্ডিং পাস হস্তান্তর করছেন। প্রিয় বাবা, তুমি হয়ত ভেবেছিলে আমি কোপেনহেগেনে উদয় হবো। কিন্তু তোমার চলাফেরার ওপর আমার নিয়ন্ত্রণটা তার থেকেও আরো অনেক বেশি উদ্ভাবনী ক্ষমতাসম্পন্ন। বাবা, তুমি যেখানেই গিয়েছে আমি তোমাকে দেখতে পেয়েছি। আসল কথাটা হচ্ছে, খুবই বিখ্যাত একটা জিপসি পরিবারে বেড়াতে গিয়েছিলাম আমি যে-পরিবারটি অনেক অনেক দিন আগে দাদী-র মায়ের কাছে জাদুর একটা পেতলের আয়না বিক্রি করেছিল। একটা ক্রিস্টিাল বল-ও জোগাড় করেছি আমি। ঠিক এই মুহূর্তে আমি দেখতে পাচ্ছি তুমি এই মাত্র তোমার সীটে বসলে। সীট বেল্ট বাঁধার আর সীট বেল্ট বাঁধুন লেখা সাইন নিভে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তোমার আসনের পেছনটা উঁচু করে রাখার কথাটা ভুলো না যেন। প্লেনটা শূন্যে উড়াল দেয়ার পর আসনের পেছনটা নিচু করে দিয়ে তুমি বিশ্রাম নিতে পারো, সেটা রীতিমত পাওনা হয়েছে তোমার। বাড়ি পৌঁছেও বিশ্রাম নেয়া দরকার হবে তোমার। লিলেস্যান্ড-এর আবহাওয়া একদম নিখুঁত এখন, তবে তাপমাত্রাটা লেবাননের চেয়ে কয়েক ডিগ্রি কম। তোমার বিমান-ভ্রমণ আনন্দদায়ক হোক। ভালোবাসা নিও, তোমার নিজের দস্যি মেয়ে, আয়নার রানী আর আয়রনির সবচেয়ে বড় হেফাজতকারী।

অ্যালবার্টো ঠিক বুঝতে পারলেন না তিনি কি কুদ্ধ নাকি স্রেফ ক্লান্ত এবং পরাস্ত। তারপরেই হাসতে শুরু করলেন তিনি। এতো জোরে জোরে হাসতে লাগলেন তিনি যে তার সহযাত্রীরা ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। এরপরেই উড়াল দিল প্লেনটা।

ঢিল মেরে এখন পাটকেল খেয়েছেন তিনি। অবশ্য বিশেষ একটা তফাৎ আছে। তার ঢিলটা লেগেছিল প্রথম এবং প্রধানত সোফি আর অ্যালবার্টোর গায়ে। আর তারা তো– ইয়ে, তারা তো নেহাতই কাল্পনিক মানুষ।

হিল্ডার পরামর্শমতো কাজ করলেন তিনি। আসনের পেছনটা নিচু করে দিয়ে চোখ বন্ধ করলেন। পাসপোর্ট কন্ট্রোল পার হয়ে কিয়েভিক বিমানবন্দরের অ্যারাইভাল হল-এ দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করার আগে পর্যন্ত পুরোপুরি সজাগ হলেন না তিনি। সেখানে একটা মিছিল তাঁকে স্বাগত জানানোর জন্যে অপেক্ষা করছিল।

প্রায় হিল্ডার বয়েসী আট থেকে দশজন কিশোর-কিশোরী। তারা সবাই বাড়িতে তোমাকে স্বাগত জানাই, বাবা– হিল্ডা বাগানে অপেক্ষা করছে– আয়রনি বহাল তবিয়তে টিকে আছে লেখা সাইন উঁচু করে ধরে আছে।

সবচেয়ে বাজে ব্যাপার হলো হুট করে একটা ট্যাক্সিতে চড়ে বসতে পারছেন না তিনি, তার ব্যাগেজের জন্যে অপেক্ষা করতে হচ্ছে তাকে। এই অবসরে হিল্ডার ক্লাসমেটরা তাকে ঘিরে ধরেছে, তাকে বাধ্য করছে সাইনগুলো বার বার পড়ার জন্যে। এক সময় মেয়েদের মধ্যে একজন এসে তাকে এক তোড়া গোলাপ দিতে তিনি একেবারে গলে গেলেন। তিনি তার শপিং ব্যাগগুলোর একটার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে মিছিলকারী প্রত্যেককে একটা করে মার্জিপান বার উপহার দিলেন। হিল্ডার জন্যে আর মাত্র দুটো বাকি থাকল। তিনি যখন তার ব্যাগেজ ফিরে পেলেন এক তরুণ সামনে এগিয়ে এসে জানাল সে আয়নার রানীর আজ্ঞাবহ, তাকে বলা আছে সে যেন মেজরকে গাড়ি চালিয়ে বিয়ার্কলে-তে নিয়ে যায়। অন্যান্য মিছিলকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে মিশে গেল ভিড়ের মধ্যে।

ই-১৮তে বেরিয়ে এলেন তারা। যে-সব সেতু আর টানেল ওঁরা পার হলেন সেগুলোর প্রতিটি বাড়িতে স্বাগতম! টার্কি প্রস্তুত। আমি তোমাকে দেখতে পাচ্ছি, বাবা এ-সব লেখা ব্যানারে মোড়া।

বিয়ার্কলের গেটের বাইরে তাঁকে যখন নামিয়ে দেয়া হলো স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস ফেললেন অ্যালবার্টো ন্যাগ, তারপর ড্রাইভারকে ধন্যবাদসহ একশো ক্রাউনের একটা নোট আর কার্লসবার্গ এলিফ্যান্ট বিয়ারের তিনটে ক্যান দিলেন।

 বাড়ির বাইরে তাঁর স্ত্রী অপেক্ষা করছিলেন তাঁর জন্যে। একটা দীর্ঘ আলিঙ্গনের পর তিনি শুধোলেন: ও কোথায়?

ডকে বসে আছে, অ্যালবার্টে।

.

হোটেল নর্গের বাইরে লিলেস্যান্ডের স্কোয়্যারে লাল কনভার্টিবলটা থামালেন অ্যালবার্টো আর সোফি। সোয়া দশটা বাজে। বাইরে আর্কিপেলাগোতে বড় সড় একটা বনফায়ার দেখতে পেলেন তারা।

বিয়ার্কলে কী করে খুঁজে পাবো আমরা? জিগ্যেস করল সোফি।

রীতিমত খুঁজে পেতে বের করতে হবে ওটাকে। মেজরের কেবিনের সেই পেইন্টিংটার কথা মনে আছে নিশ্চয়ই তোমার।

 তাড়াতাড়ি করতে হবে আমাদের। সে পৌঁছানোর আগেই ওখানে যেতে চাই। আমি।

 মেইন রোডগুলো ধরে, তারপর পাহাড়ি ঢিবি আর ঢালগুলোর ওপর দিয়ে চলতে লাগল ওদের গাড়ি। একটা দরকরি সূত্র হচ্ছে বিয়ার্কলের পাশে পানি রয়েছে।

আচমকা চেঁচিয়ে উঠল সোফি। ওই যে বাড়িটা পেয়ে গেছি আমরা।

আমার বিশ্বাস ঠিকই বলেছ তুমি, কিন্তু এতো জোরে চেঁচিও না।

কেন? কেউ তো শুনতে পাচ্ছে না আমাদের কথা।

মাই ডিয়ার সোফি, দর্শনের একটা গোটা কোর্স-এর পরে এখনো তুমি হুট করে সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাচ্ছে দেখে খুবই হতাশ হলাম আমি।

ঠিকই বলেছেন, কিন্তু…।

নিশ্চয়ই তুমি এ-কথা বিশ্বাস করো না যে জায়গাটায় ট্রল, পিক্সি, বনপরী বা ভালো পরীরা একেবারেই নেই?

বুঝেছি, আমাকে মাফ করবেন।

 গেটের ভেতর দিয়ে ঢুকে নুড়ি বিছানো পথ ধরে বাড়িটার কাছে চলে এলো তারা। লনে, গ্লাইডারের পাশে গাড়িটা পার্ক করলেন অ্যালবার্টো। বাগানেই খানিকটা দূরে একটা টেবিলে তিন জনের বসার ব্যবস্থা করা আছে।

দেখতে পাচ্ছি আমি ওকে, ফিসফিসিয়ে বলল সোফি। ডকের ওপর বসে আছে হিল্ডা, ঠিক যেমন স্বপ্নে দেখেছিলাম।

বাগানটা যে দেখতে কতটা ক্লোভার ক্লোজে তোমার নিজের বাগানটার মতো, সেটা খেয়াল করেছো?

করেছি, মিল আছে। গ্লাইডার-টাইডার আর সব কিছুই এক। আমি একটু ওর কাছে যাই?

কেন নয়? আমি এখানেই আছি।

ছুটে ডকে নেমে গেল সোফি। আরেকটু হলেই হোঁচট খেয়ে হিল্ডার গায়ের ওপর পড়ত সে। যাই হোক, শেষে দ্রভাবে তার পাশে গিয়ে বসল সে।

যে-লাইনটার সাহায্যে রো-বোটটার গতিবৃদ্ধি করা হয় সেটা নিয়ে আনমনে খেলা করছে হিল্ডা। তার বাম হাতে এক টুকরো কাগজ। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে সে অপেক্ষা করছে। বেশ কয়েকবার সে তার ঘড়ির দিকে তাকাল।

 সোফির মনে হল হিল্ডা বেশ সুন্দরী। উজ্জ্বলবর্ণ, কোঁকড়া তার চুল, চোখদুটো সবুজ। হলুদ একটা গ্রীষ্মকালীন পোশাক তার পরনে। জোয়ানার সঙ্গে বেশ মিল আছে তার।

কাজ হবে না জেনেও তার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করল সোফি।

হিল্ডা, আমি সোফি!

শুনতে পেয়েছে সে-রকম কোনো লক্ষণ নেই হিল্ডার মধ্যে।

সোফি হিল্ডার হাঁটুর ওপর চড়ে তার কানের কাছে চিৎকার করার চেষ্টা করল।

তুমি শুনতে পাচ্ছো আমার কথা, হিল্ডা? নাকি তুমি কানে শোনো না, চোখেও দেখো না?

হিল্ডার চোখটা আগের চেয়ে খানিকটা বেশি প্রসারিত হলো কি? কিছু একটা সে শুনতে পেয়েছে– তা সে যতই আবছাভাবে হোক না কেন– সে-রকম একটা হালকা ভাব ফুটে উঠল যেন তার মধ্যে?

ঘুরে তাকাল সে চারদিকে। তারপর ঝট করে মাথা ঘুরিয়ে সরাসরি সোফির চোখের দিকে তাকাল। ঠিক ভালো করে তাকাল না সে তার দিকে। তার দৃষ্টি যেন সোফির দৃষ্টি ভেদ করে গেল একেবারে।

এতো জোরে না, সোফি। ওপরে গাড়ির ভেতর থেকে উঠলেন অ্যালবার্টো। বাগানটা মারমেইডে ভরে উঠুক তা চাই না।

স্থির হয়ে বসে আছে এখন সোফি। স্রেফ হিল্ডার কাছাকাছি থাকতে পেরেই ভালো লাগছে তার। এমন সময় একজন পুরুষের গম্ভীর কণ্ঠ শুনতে পেলো সে হিল্ডা।

সেই মেজর, পরনে ইউনিফর্ম, মাথায় নীল বেরে টুপি। বাগানের একেবারে ওপরের অংশে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি।

লাফ দিয়ে উঠে ছুটে গেল হিল্ডা তাঁর কাছে। গ্লাইডার আর লাল কনভার্টিবলের মাঝামাঝি জায়গায় মিলিত হলো দুজন। মেজর তাকে শূন্যে তুলে ঘোরাতে লাগলেন নিজের চারদিকে।

***

ডকে বসে বাবার জন্যে অপেক্ষা করছে হিল্ডা। কাস্ট্রাপে তিনি নামার পর প্রতি পনেরো মিনিট অন্তর তার কথা মনে করেছে সে, কল্পনা করার চেষ্টা করেছে এই মুহূর্তে তিনি কোথায়, ব্যাপারটাকে তিনি কীভাবে নিচ্ছেন। বাবার কথা মনে করার প্রতিটি সময় টুকে নিয়েছে সে এক টুকরো কাগজে, নিজের সঙ্গেই রেখেছে সেটা সারাটা দিন।

আচ্ছা, বাবা যদি এ-সব দেখেশুনে রেগে যান? কিন্তু তিনি নিশ্চয়ই এটা আশা করতে পারেন না যে তিনি হিল্ডার জন্যে একটা রহস্যোপন্যাস লিখবেন অথচ তারপরেও সবকিছুই আগের মতো থেকে যাবে?

আবারো নিজের ঘড়ির দিকে তাকালো সে। সোয়া দশটা বাজে এখন, যে কোনো সময়ে পৌঁছে যাবেন বাবা।

কিন্তু ওটা কী? তার মনে হলো কোনো কিছুর হালকা একটা নিঃশ্বাস-এর শব্দ শুনলো সে, সোফিকে নিয়ে দেখা সেই স্বপ্নের মতো অবিকল।

দ্রুত চারদিকে তাকাল সে। সে নিশ্চিত, কিছু একটা আছে এখানে, কিন্তু কী?

হতে পারে নেহাতই গ্রীষ্মের রাত এটা।

কয়েক মুহূর্তের জন্যে তার মনে হলো কী যেন শুনলো সে।

হিল্ডা!

এবার অন্যদিকে ঘুরল সে। বাবা! বাগানের একেবারে ওপরের অংশে দাঁড়িয়ে তিনি।

লাফ দিয়ে উঠে ছুটে গেল সে তার দিকে। গ্লাইডারের কাছে মিলিত হলো দুজন। তিনি শূন্যে তুলে নিলেন তাকে, তারপর তাকে ঘোরাতে লাগলেন নিজের চারপাশে।

কাঁদছে হিল্ডা, তার বাবাকেও চেপে রাখতে হলে অশ্রু।

তুই তো দেখছি রীতিমতো বড়ো হয়ে গেছিস, হিল্ডা!

আর তুমি রাইটার হয়ে গেছে, রিয়েল রাইটার।

 চোখের জল মুছে নিল হিল্ডা।

 শোধবোধ, ঠিক আছে? জিগ্যেস করল সে।

 ঠিক আছে, শোধবোধ।

টেবিল সামনে নিয়ে বসলেন দুজন। প্রথমেই, কাস্ট্রাপে আর বাড়ি ফেরার পথে কী কী ঘটেছিল তার একটা পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা শোনাতে হলো হিল্ডাকে। দুজনেই তখন হাসিতে ফেটে পড়লেন।

ক্যাফেটেরিয়ার খামটা দেখোনি তুমি?

একটু বসে কিছু যে খাবো তার সময় ছিল না। দস্যি কোথাকার। এখন আমার রাক্ষসের মতো খিদে পেয়েছে।

বেচারা বাবা।

টার্কির কথাটা তাহলে পুরোটা গুল, তাই না?

অবশ্যই না। সব তৈরি করে রেখেছি আমি। পরিবেশনের দায়িত্বটা মা-র।

দুজনে এরপর রিং বাইন্ডারটাকে নিয়ে পড়ল। সোফি আর অ্যালবার্টোর গল্পটা এ মাথা থেকে ও-মাথা পর্যন্ত শেষ করল, আগা থেকে গোড়া, গোড়া থেকে আগা পর্যন্ত।

মা টার্কি আর ওয়াল্ড সালাদ, রোজ ওয়াইন আর হিল্ডার ঘরে-তৈরি রুটি নিয়ে এলেন।

হিল্ডার বাবা প্লেটো সম্পর্কে কী যেন বলছিলেন এমন সময় হঠাৎ তাঁকে বাধা দিল সে: শশশ!

কী ব্যাপার?

তুমি শুনতে পাওনি? চি চি একটা শব্দ হলো?

না তো।

আমি নিশ্চিত একটা শব্দ শুনেছি আমি। মনে হয় মেঠো ইঁদুর-টিদুর হবে।

তার মা আরেক বোতল ওয়াইন আনতে গেলে তার বাবা বললেন, তবে দর্শন কোর্স কিন্তু শেষ হয়নি এখনো।

হয়নি বুঝি?

আজ রাতে আমি মহাবিশ্ব সম্পর্কে কিছু কথা বলব তোকে।

সবাই খাওয়া শুরু করার আগে তিনি তাঁর স্ত্রীকে বললেন, হিল্ডার এখন আর আমার হাঁটুর ওপর বসার বয়স নেই। কিন্তু তোমার আছে।

এই বলে কোমরের কাছে ধরে মারিটকে তিনি তার কোলের ওপর বসিয়ে নিলেন। কিছু মুখে দেয়ার অবসরই পেলেন না হিল্ডার মা বেশ কিছুক্ষণ।

ভাবো দেখি, কিছু দিন পরেই চল্লিশে পড়বে তোমরা…

.

লাফ দিয়ে উঠে হিল্ডা যখন তার বাবার কাছে ছুট দিল, সোফি অনুভব করল তার চোখ পানিতে ভরে উঠছে। কোনোদিনই হিল্ডার কাছে পৌঁছাতে পারবে না সে…

হিল্ডাকে রক্ত-মাংসের একজন সত্যিকার মানুষ হিসেবে তৈরি করা হয়েছে বলে তার ওপর ঈর্ষা হলো সোফির।

হিল্ডা আর মেজর টেবিলে বসতে অ্যালবার্টো গাড়ির হর্ন বাজালেন।

মুখ তুলে তাকাল সোফি। হিল্ডাও ঠিক তাই করল না?

দৌড়ে অ্যালবার্টোর কাছে এসে লাফ দিয়ে তার পাশের সিটটায় বসে পড়ল সে।

 খানিকক্ষণ বসে দেখবো আমরা কী ঘটে, অ্যালবার্টো বললেন।

মাথা ঝাঁকাল সোফি।

তুমি কাঁদছ?

আবারো ওপর নিচ মাথা নাড়ল সোফি।

কেন?

ওর কী ভাগ্য, সত্যিকারের একজন মানুষ ও। এখন ও বড় হবে, সত্যিকারের একজন নারী হবে। আমি ঠিক জানি, সত্যিকারের বাচ্চাকাচ্চাও হবে ওর…

নাতি-নাতনিও হবে, সোফি। তবে সব জিনিসেরই দুটো দিক আছে। আর ঠিক সেটাই তোমাকে শেখাতে চেয়েছিলাম আমি এই কোর্সটার গোড়ার দিকে।

কী বলতে চান?

হিল্ডা ভাগ্যবান, স্বীকার করছি। কিন্তু যে জীবনের স্বাদ পেয়েছে তাকে মৃত্যুরও স্বাদ পেতে হবে, কারণ মৃত্যুই জীবনের নিয়তি।

কিন্তু তারপরেও, সত্যিকার অর্থে কখনোই না বাঁচার চেয়ে একটা জীবন থাকা কি বেশি ভালো না?

হিল্ডার মতো জীবনযাপন আমরা করতে পারবো না-অথবা, সেই অর্থে মেজরের মতো; অন্য দিকে, আমাদের মৃত্যু নেই। বনের মধ্যে সেই বৃদ্ধা মহিলা কী বলেছিলেন মনে নেই তোমার? আমরা হচ্ছি অদৃশ্য। তিনি বলেছিলেন তাঁর বয়স দুশো বছর। আর তাদের মিডসামার পার্টিতে আমি এমন কিছু প্রাণীকেও দেখেছি যাদের বয়স তিন হাজার বছরেরও বেশি…

সম্ভবত হিল্ডার যে-ব্যাপারটা আমি সবচেয়ে হিংসা করি তা হচ্ছে…ওর পারিবারিক জীবনটা।

কিন্তু তোমার নিজেরও তো একটা পরিবার আছে। তাছাড়াও একটা বেড়াল আছে, দুটো পাখি আছে, আছে একটা কচ্ছপ।

কিন্তু সেসব তো আমরা পেছনে ফেলে এসেছি, তাই না?

মোটেই না। মেজরই কেবল পেছনে ফেলে এসেছে সেটাকে। সে তার বইয়ের শেষ শব্দটা লিখে ফেলেছে, মাই ডিয়ার। সে আর কক্ষণো খুঁজে পাবে না আমাদের।

তার মানে কি এই যে আমরা ফিরে যেতে পারবো?

সে আমাদের যখন ইচ্ছে তখনই। কিন্তু বনের ভেতর সিন্ডেরেলা ক্যাফেটেরিয়ার পেছনে আমরা নতুন বন্ধুও পাবো অনেক।

ন্যাগ পরিবার তাদের ভোজন পর্ব শুরু করেছে। মুহূর্তের জন্যে সোফি এই ভেবে ভয় পেল যে ক্লোভার ক্লোজের গার্ডেন পার্টির মতো করে না শেষ হয় খাওয়া দাওয়ার পাটটা। একটা সময় মনে হলো মেজর বুঝি মারিটকে টেবিলের ওপর শুইয়ে দিতে চাইলেন। কিন্তু না, তার বদলে তিনি তাঁকে নিজের হাঁটুর ওপর টেনে নিলেন।

পরিবারটা যেখানে বসে খাচ্ছে সেখান থেকে বেশ খানিকটা দূরে পার্ক করা হয়েছে গাড়িটা। মাঝে মধ্যে শোনা যাচ্ছে তাদের কথাবার্তা। সোফি আর অ্যালবার্টো বাগানের দিকে তাকিয়ে রইলেন। গার্ডেন পার্টির সব খুঁটিনাটি আর দুঃখজনক পরিসমাপ্তিটা নিয়ে চিন্তা করার যথেষ্ট সময় আছে তাদের হাতে।

পরিবারটা টেবিল ছাড়তে ছাড়তে মাঝরাত হয়ে গেল প্রায়। হিল্ডা আর মেজর হালকা পায়ে গ্লাইডারের দিকে এগোতে থাকল। সাদা-রঙা বাড়িটার কাছে মারিট হেঁটে আসতে তারা হাত নাড়ল তার উদ্দেশে।

মা, তুমি বরং শুয়ে পড়ো। আমাদের এখনো অনেক কথা বাকি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *