১৬. রেনেসাঁ

১৬. রেনেসাঁ

…মানুষের ছদ্মবেশ নিয়ে থাকা হে স্বর্গীয় বংশ…

দৌড়ে আসার কারণে হাঁপাতে হাঁপাতে সোফি যখন জোয়ানাদের বাসার সদর দরজার সামনে পৌঁছল তখন ঠিক বারোটা বাজে। জোয়ানা তাদের হলুদ বাড়িটার সামনের আঙিনায় দাঁড়িয়ে।

পাঁচ ঘণ্টা হলো বেরিয়েছিস তুই? তীক্ষ্ণ স্বরে বলে উঠল জোয়ানা।

মাথা নাড়ল সোফি।

না, আমি গিয়েছি এক হাজার বছর হয়েছে।

 কোথায় গিয়েছিলি তুই বল তো! তোর আসলে মাথা খারাপ। আধ ঘন্টা আগে তোর মা ফোন করেছিলেন।

তুই কী বলেছিস তাকে?

আমি বলেছি তুই ওষুধের দোকানে গিয়েছিল। তুই ফিরলে ফোন করতে বলেছেন। কিন্তু আজ সকাল দশটায় গরম চকলেট আর রোল নিয়ে মা আর বাবা যখন আমার ঘরে এসেছিলেন তখন তুই যদি দেখতি তাঁদের…খা খা করছিল তোর বিছানাটা।

তাদেরকে কী বললি তুই?

একেবারে অস্বস্তিতে পড়ে গিয়েছিলাম। শেষে বললাম আমদের মধ্যে ভীষণ ঝগড়া হওয়াতে বাড়ি চলে গেছিস তুই।

 কাজেই তাড়াতাড়ি আমাদের বন্ধু বনে যেতে হবে আবার। তাছাড়া আরেকটা ব্যাপার দেখতে হবে যে সামনের কয়েকটা দিন যেন আমার মায়ের সঙ্গে ওঁদের কোনো আলাপ হতে না পারে। ব্যবস্থাটা করা যাবে না? তুই কি বলিস?

জোয়ানা শ্রাগ করল। ঠিক তখনই একটা হুইলব্যারো ঠেলতে ঠেলতে এক কোনায় উদয় হলেন তার বাবা। তার পরনে দুটো কাভারঅল, গত বছরের গাছের পাতা আর ডালপালা পরিষ্কার করায় ব্যস্ত তিনি।

আচ্ছা, তোমাদের মধ্যে আবার ভাব হয়ে গিয়েছে দেখছি। সে যাই হোক, বেসমেন্টের সিঁড়িতে এখন একটা পাতাও দেখতে পাবে না তোমরা।

চমৎকার, সোফি বলে উঠল। তাহলে বিছানার বদলে ওখানেই গরম চকলেট খাওয়া যাবে খন।

জোর করে একটা হাসি হাসলেন জোয়ানার বাবা, কিন্তু জোয়ানা ঢোক গিলল। কথা চালাচালিটা অর্থনৈতিক উপদেষ্টা জনাব ইঙ্গারব্রিগস্টেন আর তাঁর স্ত্রীর অনেক বেশি সচ্ছল পরিবারের চাইতে সোফিদের পরিবারেই বেশি প্রচলিত।

দুঃখিত, জোয়ানা, কিন্তু আমি মনে করলাম এই লুকোছাপার খেলায় আমারও খানিকটা অংশ নেয়া দরকার।

তুই আমাকে বলবি না ঘটনাটা?

অবশ্যই, যদি তুই আমার সঙ্গে হেঁটে বাড়ি যাস। কারণ এগুলো অর্থনৈতিক উপদেষ্টা বা বেঢপ সাইজের বার্বি ডলদের জন্যে নয়।

কথার কী ছিরি! তোর বোধকরি ধারণা যে যে-ঝোড়ো বিয়ের কারণে একজন আরেকজনকে ফেলে সমুদ্রে চলে যায় সেটা এর চেয়ে ভালো কিছু।

তা হয়ত নয়। তবে গত রাতে আমি প্রায় ঘুমোইনি বললেই চলে। আরেকটা কথা, আমার কেন যেন মনে হতে শুরু করেছে আমরা যা-ই করছি হিল্ডা তার সবই দেখতে পাচ্ছে।

ক্লোভার ক্লোজ-এর দিকে হাঁটতে শুরু করল দুজনে।

তার মানে তুই বলতে চাচ্ছিস ওর সেকেন্ড সাইট আছে?

হয়ত। হয়ত না।

স্পষ্টতই, জোয়ানা এ-সব ঢাক ঢাক গুড় গুড়-এর ব্যাপারে অতটা উৎসাহ বোধ করছিল না।

কিন্তু তাতে করে তো এ-ব্যাপারটা পরিষ্কার হচ্ছে না যে তার বাবা কেন বনের ভেতরের একটা খালি কেবিনে একগাদা মাথামুণ্ডহীন পোস্টকার্ড পাঠিয়েছিলেন।

স্বীকার করছি এটা একটা দুর্বল জায়গা।

তুই কি বলবি তুই কোথায় ছিলি?

অতএব সোফি বলে ফেলল। সব কিছু বলল সে। রহস্যময় দর্শন কোর্সটার কথাও। জোয়ানাকে দিয়ে সে শপথ করিয়ে নিল সবকিছু গোপন রাখবে সে।

অনেকটা হাঁটল তারা কোনো কথা না বলে। ক্লোভার কোজের কাছাকাছি এসে জোয়ানা বলে উঠল, ব্যাপারটা পছন্দ হচ্ছে না আমার।

 সোফিদের গেটের সামনে এসে থামল সে, তারপর ঘুরে দাঁড়াল বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্যে।

কেউই তোকে এটা পছন্দ করতে বলছে না। কিন্তু দর্শন নেহাতই নির্দোষ কোনো পার্টি গেম না। আমরা কে, কোথা থেকে এসেছি, এ-সব নিয়েই দর্শন। তোর কি ধারণা স্কুলে এ-সব কথা আমাদের ঢের শেখানো হয়?

যাই বলিস, এ-সব প্রশ্নের উত্তর কেউ-ই দিতে পারে না।

তা ঠিক, কিন্তু আমরা তো সে-সব জিগ্যেস করতেওশিখি না।

সোফি যখন রান্নাঘরে ঢুকল তখন টেবিলের ওপর লাঞ্চ সাজানো হয়ে গেছে। জোয়ানাদের বাসা থেকে ফোন না করার জন্যে তাকে কোনো জবাবদিহি করতে বলা হলো না।

লাঞ্চের পর সোফি ঘোষণা করল সে একটু ঘুমোতে যাচ্ছে। সে স্বীকার করল জোয়ানার বাড়িতে সে ঘুমোয়নি বললেই চলে; সেটা অবশ্য বাড়ির বাইরে এ-রকম ঘুমানোর সময় অস্বাভাবিক কিছু নয়।

বিছানায় যাওয়ার আগে সে তার ঘরের দেয়ালে ঝুলে থাকা পেতলের বিশাল আয়নাটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। প্রথমে সে তার নিজের সাদা বিধ্বস্ত মুখটা দেখতে পেল। কিন্তু তারপর তার নিজের মুখটার পেছনে আরেকটা মুখের খুবই আবছা একটা আভাস ফুটে উঠল বলে যেন মনে হলো তার। দুয়েকটা গভীর শ্বাস নিল সোফি। কাল্পনিক জিনিস দেখাটা কোনো কাজের কাজ নয়।

নিজের পাণ্ডুর মুখটার তীক্ষ্ণ দেহরেখাগুলো খুঁটিয়ে দেখল সে, মুখটাকে ঘিরে আছে তার বেখাপ্পা চুল, যে-চুল প্রকৃতির একান্তই নিজস্ব স্টাইল ছাড়া অন্য কোনো স্টাইলের আওতায় পড়ে না। কিন্তু সেই মুখটার পেছনে আরেকটি মেয়ের অপছায়া দেখা দিয়েছে। হঠাৎ করেই সেই অন্য মেয়েটি দুই চোখ দিয়েই চোখ টিপতে লাগল উন্মত্তের মতো, যেন সে বোঝাতে চাইছে সত্যি-ই সে আছে আয়নার ভেতরের ওই দিকটায়। কয়েক সেকেন্ড মাত্র দেখা গেল অপছায়াটিকে। তারপরই নেই হয়ে গেল সেটা।

বিছানার প্রান্তে বসে পড়ল সোফি। তার মনে কোনো সন্দেহই নেই যে আয়নায় সে হিল্ডাকেই দেখেছে। মেজরের কেবিনে একটা স্কুলের পরিচয়পত্রে মেয়েটার ছবি দেখেছিল সে মুহূর্তের জন্যে।

ব্যাপারটা কি অদ্ভুত নয় যে যখনই সে ভীষণ ক্লান্ত থাকে তখনই এ-ধরনের রহস্যময় সব অভিজ্ঞতা হচ্ছে তার? আর তার ফলে পরে নিজেকেই তার জিগ্যেস করতে হয় ব্যাপারটা সত্যি সত্যিই ঘটেছিল কিনা।

সোফি তার কাপড়-চোপড় চেয়ারের ওপর রেখে হামাগুড়ি দিয়ে উঠে পড়ল বিছানায়। সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ল সে, দেখল ছবির মতো স্পষ্ট অদ্ভুত এক স্বপ্ন।

দেখল বিশাল একটা বাগানের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে সে, বাগানটা ঢালু হয়ে নেমে গেছে লাল একটা বোট হাউসের দিকে। সেটার পেছনের ডকে সোনালী চুলের কমবয়েসী একটা মেয়ে বসে আছে পানির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে। সোফি সেদিকে হেঁটে গিয়ে মেয়েটার পাশে বসে পড়ল। কিন্তু মনে হলো মেয়েটা তাকে খেয়ালই করল না। নিজের পরিচয় দিল সে, আমি সোফি। কিন্তু মনে হলো মেয়েটা তাকে দেখছেও না, তার কথা শুনতে পাচ্ছে না। হঠাৎ সোফি শুনল কে যেন ডেকে উঠল, হিল্ডা! সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটা যেখানে বসে ছিল সেখান থেকে লাফিয়ে উঠল, তারপর একছুটে চলে গেল বাড়িটার দিকে। আর যাই হোক মেয়েটা বধির বা অন্ধ নয়। মধ্যবয়স্ক একজন লোক বড় বড় পা ফেলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে

এলেন মেয়েটার দিকে। লোকটির পরনে খাকি ইউনিফর্ম আর একটা নীল বেরে। মেয়েটা দুহাত বাড়িয়ে তার গলা জড়িয়ে ধরল আর লোকটি তাকে ধরে নিজের চারদিকে বার কয়েক পাক খাওয়ালেন। মেয়েটা যেখানে বসেছিল সেখানে ডকের। ওপর একটা হার পড়ে আছে, তাতে ছোট, সোনার একটা ক্রুশবিদ্ধ যীশুমূর্তি লাগানো রয়েছে। সেটা তুলে নিল সোফি, ধরে রাখল হাতে, তারপরেই ঘুম ভেঙে গেল তার। ঘড়ির দিকে তাকাল সোফি, দুই ঘণ্টা ঘুমিয়েছে সে। বিছানায় উঠে বসল সে, ভাবছে অদ্ভুত স্বপ্নটার কথা। এতোই বাস্তব মনে হচ্ছিল স্বপ্নটা যেন সত্যি সত্যিই অভিজ্ঞতাটা হয়েছে তার। এ-ব্যাপারেও তার মনে কোনো সন্দেহ রইল না যে সেই বাড়ি আর ডকটা বাস্তবে কোথাও না কোথাও নিশ্চয়ই আছে। মেজরের কেবিনে সে যে-ছবিটা দেয়ালে ঝুলতে দেখেছিল সেটার সঙ্গে মিল রয়েছে না দৃশ্যটার? সে যাই হোক, এ-ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে স্বপ্নের মেয়েটিই হিল্ডা মোলার ন্যাগ আর পুরুষটি তার বাবা, বাড়ি ফিরে এসেছেন তিনি লেবানন থেকে। স্বপ্নের মধ্যে তাঁকে দেখতে অ্যালবার্টো নক্সের মতো লেগেছিল খানিকটা…।

খাট থেকে নেমে সে যখন বিছানা গোছাচ্ছে, তার বালিশের নিচে একটা হারের সঙ্গে সোনার একটা ক্রুশবিদ্ধ যীশুমূর্তি পেল সে। সেটার পেছনে তিনটে অক্ষর ক্ষোদাই করা: এইচএমকে।

ধন-রত্ন পাওয়ার স্বপ্ন এবারই যে সোফি প্রথম দেখল তা নয়। কিন্তু এবারই প্রথম সে তা স্বপ্ন থেকে বাস্তবে নিয়ে এলো।

যত্তোসব। চিৎকার করে বলে উঠল সে।

এমনই মেজাজ খারাপ হলে তার যে ক্লজেটের দরজাটা খুলে চমৎকার ক্রুশবিদ্ধ যীশুমূর্তিটাকে সে রেশমি স্কার্ফ, সাদা মোজা আর লেবানন থেকে আসা পোস্টকার্ডগুলোর সঙ্গে সবচেয়ে ওপরের তাকটায় ছুঁড়ে ফেলল।

.

পরদিন সকালে সে ঘুম থেকে উঠে দেখে নাস্তার টেবিলে হট রোল, কমলার রস, ডিম আর ভেজিটেবল স্যালাডের এক এলাহী আয়োজন। রোববার সকালে সোফির মা মেয়ের আগে বড় একটা ঘুম থেকে ওঠেন না। কিন্তু যেদিন ওঠেন সেদিন তিনি সোফির জন্যে জম্পেশ একটা ব্রেকফাস্টের আয়োজন করতে পছন্দ করেন।

তারা যখন খাচ্ছে, মা তখন বললেন, বাগানে অদ্ভুত একটা কুকুর দেখতে পেলাম। সারা সকাল ধরে পুরনো বেড়ার কাছটায় ঘুর ঘুর করছে। বুঝতে পারছি না কী চায় ওটা ওখানে, তুই কিছু বলতে পারিস?

পারিই তো, খুশিতে ফেটে পড়ল সোফি, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারল বড্ড ভুল হয়ে গেছে।

এর আগেও ওটা এখানে এসেছিল নাকি?

এরিমধ্যে সোফি টেবিল ছেড়ে লিভিং রুমে চলে গিয়েছে বিশাল বাগানের সামনের জানলা দিয়ে বাইরেটা দেখার জন্যে। ঠিক যা ভেবেছিল।

হার্মেস সোফির গুহায় ঢোকার গোপন প্রবেশপথের সামনেই শুয়ে আছে।

কী বলবে সে? কোনো কিছু সে ভেবে উঠবার আগেই তার মা এসে তার পাশে দাঁড়ালেন।

এর আগেও ওটা এখানে এসেছিল কিনা বললি না?

আমার মনে হয় এখানে কোনো হাড় লুকিয়ে রেখেছিল ওটা, এখন এসেছে ওর গুপ্তধন খুঁড়ে বের করতে। কুকুরের স্মৃতিশক্তি থাকে…

তোর কথাই হয়ত ঠিক, সোফি। তুই তো আবার এ-বাড়ির পশু মনোবিজ্ঞানী।

 উথাল-পাথাল চিন্তা বয়ে যাচ্ছে সোফির মনে।

আমি ওটাকে বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছি, সে বলল।

তুই তাহলে জানিস ওটা কোথায় থাকে?

সোফি কাঁধ ঝাঁকাল।

ওটার কলারে ঠিকানা লেখা থাকতে পারে।

মিনিট কয়েক পরেই দেখা গেল সোফি নেমে যাচ্ছে বাগানের দিকে। তাকে দেখেই হার্মেস লাফাতে লাফাতে আর লেজ নাড়তে নাড়তে ছুটে এলো তার দিকে।

গুড বয়, হার্মেস! বলে উঠল সোফি।

সে জানে তার মা জানলা দিয়ে তাকিয়ে আছেন তার দিকে। সোফি মনে মনে প্রার্থনা করল কুকুরটা যেন বেড়ার ভেতর দিয়ে রওনা না দেয়। কিন্তু তার বদলে কুকুরটা বাড়ির সামনের নুড়ি-বিছানো পথের দিকে ছুট দিল, আড়াআড়িভাবে পার হয়ে গেল সামনের আঙিনাটা, তারপর লাফিয়ে উঠল গেট বরাবর।

গেটটা ওরা বন্ধ করে দেবার পর হার্মেস সোফির কয়েক গজ সামনে দৌড়ে চলল। মেলা দূরের পথ। রোববার সকালের ভ্রমণে সোফি আর হার্মেস-ই একা নয়। অনেকেই পুরো পরিবার নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে সারা দিনের জন্যে। ঈর্ষার একটা খোঁচা অনুভব করল সোফি।

একটু পর পরই হার্মেস সামনে ছুটে যাচ্ছে, তারপর অন্য কোনো কুকুর বা কোনো বাগানের বেড়ার পাশে আকর্ষণীয় কোনো জিনিসের কাছে গিয়ে গন্ধ শুঁকছে, কিন্তু সোফি এ্যাই যে, এখানে বলে উঠতেই তার কাছে ফিরে আসছে সঙ্গে সঙ্গে।

পুরনো একটা পশুচারণভূমি, বিরাট একটা খেলার মাঠ পেরিয়ে লোক চলাচল অপেক্ষাকৃত বেশি এমন একটা এলাকায় বেরিয়ে এলো ওরা। খোয়া দিয়ে বাঁধানো আর স্ট্রিটকার চলাচলকারী চওড়া একটা রাস্তা ধরে শহরের কেন্দ্রের দিকে এগিয়ে চলল ওরা। পথ দেখিয়ে টাউন স্কোয়্যার আর চার্চস্ট্রিট পেরিয়ে এলো হার্মেস। একসময় এসে পড়ল পুরনো শহরে, এই শতকের গোড়ার দিককার রাশভারি টাউন হাউসগুলো রয়েছে সেখানে। প্রায় দেড়টা বাজে এখন।

শহরের অন্য প্রান্তে এসে পড়ল ওরা। এদিকটায় খুব বেশি আসা পড়েনি সোফির। তার মনে পড়ল, একবার সে যখন ছোট তখন এখানকার কোনো একটা স্ট্রিটে তার এক বৃদ্ধা আন্টকে দেখতে নিয়ে আসা হয়েছিল তাকে।

শেষ পর্যন্ত বেশ কিছু পুরনো বাড়ির মধ্যেখানে ছোট্ট একটা ফাঁকা চত্বরে এসে পৌঁছল তারা। জায়গাটার নাম নিউ স্কোয়্যার, যদিও দেখতে সেটা খুবই পুরনো। অবশ্য পুরো শহরটাই তো পুরনো; সেই মধ্য যুগে পত্তন হয়েছিল শহরটার।

১৪ নং বাড়িটার দিকে এগোল হার্মেস, তারপর সেখানে দাঁড়িয়ে পড়ল স্থির হয়ে, অপেক্ষা করল সোফি দরজা খোলার জন্য। সোফির হৃৎপিণ্ডের গতি বেড়ে গেল।

সামনের দরজার ভেতরে একটা প্যানেলের সঙ্গে আটকে রাখা হয়েছে বেশ কিছু। নীল-রঙা ডাকবাক্স। সামনের সারির ডাকবাক্সগুলোর একটা থেকে একটা পোস্টকার্ড ঝুলে রয়েছে দেখতে পেল সোফি।

 সেটার প্রাপক হিল্ডা মোলার ন্যাগ, ১৪ নিউ স্কোয়্যার। ডাকঘরের সীলমোহর দেয়া আছে জুন ১৫। এখনো দুই হপ্তা বাকি সে-তারিখ আসতে। কিন্তু ডাকপিয়ন নিশ্চয়ই তা খেয়াল করেনি।

কার্ডটা টেনে নিয়ে পড়ল সোফি।

.

প্রিয় হিল্ডা, সোফি এবার দার্শনিকের বাড়িতে আসছে। শিগগিরই পনেরোয় পা দেবে মেয়েটা আর তুই তো গতকালই পনেরোয় পড়েছিস। নাকি আজকে পড়বি, হিল্ডা? যদি আজ হয় তাহলে নিশ্চয়ই দেরি হয়ে গেছে। আমাদের ঘড়িগুলো সারাক্ষণ এক সময় দেয় না। এক প্রজন্ম বুড়িয়ে যায়, ওদিকে অন্য প্রজন্মের আবির্ভাব ঘটে। এর মধ্যে ইতিহাস তার গতিপথ ঠিক করে নেয়। কখনো কি তোর মনে হয়েছে যে ইউরোপের ইতিহাস একজন মানুষের জীবনের মতো? প্রাচীন যুগ হচ্ছে ইউরোপের শৈশব। এরপর এলো অন্তহীন মধ্য যুগ-ইউরোপের স্কুল জীবন। শেষে আসে রেনেসাঁ, শেষ হয় দীর্ঘ স্কুল জীবন। প্রাণ-প্রাচুর্যের বিস্ফোরণ আর একটা জীবন তৃষ্ণার ভেতর দিয়ে সাবালকত্ব প্রাপ্তি ঘটে ইউরোপের। আমরা বলতে পারি, রেনেসাঁ হলো ইউরোপের ১৫শ জন্মদিন! এখন মধ্য জুন, মা আমার আর কথা কী জনিস, বেঁচে থাকাটা বড্ড চমৎকার একটা ব্যাপার।

পুনশ্চ: তুই তোর সোনার ক্রুশবিদ্ধ যীশুমূর্তিটা হারিয়ে ফেলেছিস শুনে খারাপ লাগছে। আরেকটু ভালো করে নিজের জিনিসের যত্ন নেয়াটা শিখতে হবে তোকে। ভালোবাসা নিস, বাবা; লোকটা তোর কাছে-পিঠেই আছে।

***

হার্মেস এরিমধ্যে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে শুরু করেছে। পোস্টকার্ডটা নিয়ে সোফি তাকে অনুসরণ করল। হার্মেসের সঙ্গে পাল্লা দিতে তাকেও দৌড় দিতে হলো। মহানন্দে লেজ নাড়ছে হার্মেস। দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং চতুর্থ তলা পেরিয়ে এলো ওরা। এরপর বাকি রইল কেবল চিলেকোঠায় যাওয়ার সিঁড়িটা। ওরা কি ছাদে যাচ্ছে নাকি? আছড়ে পাছড়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে সরু একটা দরজার সামনে এসে থামল হার্মেস। থাবা দিয়ে আঁচড়াতে লাগল সেটার গায়ে।

সোফি শুনতে পেল ভেতর থেকে পায়ের শব্দ এগিয়ে আসছে। দরজা খুলে গেল, দেখা গেল অ্যালবার্টো নক্স দাঁড়িয়ে আছেন সেখানে। তার আগের পোষাক ছেড়ে নতুন পোষাক পরেছেন তিনি। সাদা হোস, লাল নী-ব্রিচেস আর কাঁধের কাছে প্যাড লাগানো একটা হলুদ জ্যাকেট। অ্যালবার্টোকে দেখে তাসের প্যাকেটের জোকারের কথা মনে পড়ে গেল সোফির। তার যদি বিশেষ কোনো ভুল না হয়ে থাকে তাহলে তাঁর পোশাকটা একান্তভাবেই রেনেসাঁ যুগের।

এ যে দেখছি রীতিমত এক ক্লাউন! মন্তব্য করল সোফি। তারপর ঘরের ভেতরে ঢোকার জন্যে তার গায়ে ছোট্ট একটা ঠেলা দিল।

আরো একবার সে তার দর্শন শিক্ষক সম্পর্কে ভয় আর লজ্জা জয় করল। নিচে, হলওয়েতে পাওয়া পোস্টকার্ডটার কারণে তার মাথায় ঝড় বয়ে যাচ্ছে।

শান্ত হও, বৎস, অ্যালবার্টো বললেন। তারপর বন্ধ করে দিলেন দরজাটা।

এই যে, চিঠি এসেছে, বলে পোস্টকার্ডটা সোফি ধরিয়ে দিল তার হাতে, যেন ওটার জন্যে সে তাকেই দায়ী ভাবছে।

কার্ডটা পড়ে মাথা ঝাঁকালেন অ্যালবার্টো।

 দিনে দিনে ঔদ্ধত্য বেড়েই চলেছে লোকটার। আমাদের দুজনকে সে তার মেয়ের জন্মদিনের একটা আমোদর বস্তু হিসেবে ভেবে থাকলে অবাক হবো না।

এই বলে তিনি পোস্টকার্ডটা টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ওয়েস্টপেপার বাস্কেটে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন।

কার্ডটায় লেখা আছে হিল্ডা ওর ক্রুশবিদ্ধ যীশুর মূর্তিটা হারিয়ে ফেলেছে।

হ্যাঁ, তাই তো দেখলাম।

আর ঠিক ওটাই আমি পেয়েছি বাড়িতে আমার বালিশের নিচে। ওটা কী করে ওখানে গেল আপনি বুঝতে পারছেন কিছু?

গম্ভীর মুখে সোফির চোখের দিকে তাকালেন অ্যালবার্টো।

এমনিতে হয়ত ব্যাপারটা খুব রহস্যময় মনে হচ্ছে। কিন্তু আসলে ওটা একটা সস্তা কৌশল, যে-জন্যে লোকটাকে তেমন কোনো কষ্টই করতে হয়নি। আমরা বরং মহাবিশ্বের টপ হ্যাঁটের ভেতর থেকে বের করে আনা বিশাল, সাদা খরগোশটার দিকে মনোযোগ দিই, চলো।

বসার ঘরে গিয়ে উপস্থিত হলো দুজন। এমন অদ্ভুত ঘর আগে কখনো দেখেনি সোফি। ঢালু দেয়ালবিশিষ্ট প্রশস্ত একটা চিলেকোঠায় থাকেন অ্যালবার্টো। দেয়ালগুলোর একটাতে বসানো একটা স্কাইলাইট ঘরটাকে ঠিক ওপর থেকে আসা উজ্জ্বল আলোয় ভাসিয়ে দিচ্ছে। অবশ্য ঘরে আরেকটা জানলা আছে শহরের দিকে।– সেই জানলা দিয়ে পুরনো শহরটার সব কটা ছাদ দেখতে পাচ্ছিল সোফি। কিন্তু সোফিকে যা সবচেয়ে অবাক করল তা হলো যে-সব জিনিস দিয়ে ঘরটা ভর্তি করে রাখা হয়েছে সেগুলো– বিভিন্ন ঐতিহাসিক সময়ের আসবাব আর জিনিসপত্র। রয়েছে তিরিশের দশকের সোফা, এই শতাব্দীর গোড়ার দিকের পুরনো একটা ডেস্ক আর একটা চেয়ার, একশো বছরের কম হবে না সেটার বয়স। কিন্তু কেবল আসবাবই নয়। কেজো অথবা গৃহসজ্জার বহু পুরনো জিনিস-পত্ৰ শেলফ আর কাবার্ড-এ গাদাগাদি করে রাখা। আছে পুরনো ঘড়ি আর ফুলদানি, হামানদিস্তা আর বকযন্ত্র, ছুরি আর পুতুল, পালকের কলম আর বই-ঠেকা দিয়ে রাখার বুকএন্ড, অকট্যান্ট আর সেক্সট্যান্ট, কম্পাস আর ব্যারোমিটার। একটা দেয়ালের পুরোটাই ঢাকা পড়ে গেছে বই-এ, কিন্তু বইয়ের দোকানগুলোতে যে-ধরনের বই পাওয়া যায় সে-ধরনের বই ত নয়। বইয়ের এই সংগ্রহটাই বেশ কয়েক শ বছরের সৃষ্টির একটা প্রতিনিধিত্বমূলক নমুনা। অন্যান্য দেয়ালে ঝুলছে নানান ড্রইং, পেইন্টিং, সেগুলোর কোনোটা হয়ত সাম্প্রতিক সময়ের, কিন্তু বেশির ভাগই খুব পুরনো। দেয়ালে আরো রয়েছে বেশ কিছু পুরনো চার্ট আর ম্যাপ, অবশ্য সেগুলোর যে-সব নরওয়ে সংক্রান্ত সে-সব যে খুব একটা নিখুঁত তা নয়।

বেশ কিছুক্ষণ কোনো কথা না বলে দাঁড়িয়ে রইল সোফি, মনের মধ্যে গেঁথে নিচ্ছে সব কিছু।

রাজ্যের সব আজেবাজে জিনিস জমিয়েছেন দেখছি আপনি, অবশেষে মন্তব্য করল সে।

বটে। একবার শুধু ভেবে দেখো তো কত শতাব্দীর ইতিহাস আমি প্রিজার্ভ করেছি এই ঘরটাতে। এগুলোকে ঠিক আজেবাজে জিনিস বলব না আমি।

আপনার কি কোনো অ্যান্টিক শপ বা সে-রকম কিছু আছে নাকি?

অ্যালবার্টোকে ব্যথিতই দেখালো একরকম।

আমরা সবাই যদি ইতিহাসের স্রোতে ভেসে যাই তা হলে কী করে হবে, সোফি? কাউকে না কাউকে তো নদী তীরে রয়ে যাওয়া জিনিস-পত্ৰ কুড়িয়ে নেবার জন্যে থামতেই হবে কিছুক্ষণের জন্যে!

কী অদ্ভুত কথা!

তা ঠিক, কিন্তু সত্যি-ও বটে। আমরা কেবল আমাদের সময়েই জীবনযাপন করি না; আমরা আমাদের ভেতরে আমাদের ইতিহাসকে বয়ে নিয়ে বেড়াই। একটা কথা ভুলো না যেন যে, এই ঘরে যা কিছু আছে তার সবই একসময় আনকোরা নতুন ছিল। ষোড়শ শতাব্দীর এই পুরনো কাঠের পুতুলটা হয়ত কোনো পাঁচ বছর বয়েসী ছোট্ট মেয়ের জন্যে তৈরি করা হয়েছিল। হয়ত তার দাদা-ই বানিয়েছিল…তো, তারপর মেয়েটা টিন এজে পৌঁছল, তারপর আরো বড় হলো, বিয়ে করল। হয়ত এরপর তার নিজেরই একটা মেয়ে হলো আর তখন সে পুতুলটা তাকে দিল। দিনে দিনে সে বুড়ো হলো, একদিন মারা গেল। যদিও সে অনেকদিন বেঁচেছিল, কিন্তু একদিন সে মরে গিয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। আর কখনোই ফিরে আসবে না সে। সত্যি বলতে কী, এখানে সে এসেছিল অল্প কিছুক্ষণের জন্যে বেড়াতে। কিন্তু তার পুতুলটা-ওই তো, শেলফ-এর ওপর পড়ে আছে।

 আপনি যখন এভাবে কথা বলেন তখন সব কিছুই কি যে বিষণ্ণ আর গুরু গম্ভীর মনে হয়।

জীবন একই সঙ্গে বিষণ্ণ আর গুরুগম্ভীর। আমাদেরকে এক চমৎকার পৃথিবীতে আসতে দেয়া হয়েছে, এখানে একে অন্যের সঙ্গে দেখা হয় আমাদের, পরস্পর কুশল বিনিময় করি, সম্ভাষণ জানাই, ঘুরে ফিরে বেড়াই এক সঙ্গে কিছুক্ষণের জন্যে। তারপর, হঠাৎ করে, কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়াই একদিন যেমন এসেছিলাম আমরা, তেমনিভাবেই অদৃশ্য হয়ে যাই।

একটা কথা জিগ্যেস করতে পারি?

আমরা তো এখন আর লুকোচুরি খেলছি না।

আপনি মেজরের কেবিনে থাকতে গিয়েছিলেন কেন?

আমরা যখন শুধু চিঠির মাধ্যমে কথা বলছিলাম তখন যাতে কাছাকাছি থাকি দুজনে সেজন্যে।

সেজন্যেই স্রেফ ওখানে থাকতে চলে গেলেন আপনি?

ঠিক। সেজন্যেই চলে গেলাম ওখানে।

তাহলে হয়ত আপনি এর-ও একটা ব্যাখ্যা দিতে পারবেন যে হিল্ডার বাবা কী করে জানলেন যে আপনি ছিলেন।

আমার যদি ভুল না হয়ে থাকে, বাস্তবিক অর্থে তিনি সব কিছুই জানেন।

কিন্তু তারপরেও আমি বুঝতে পারছি না বনের মধ্যে চিঠি পৌঁছে দেবার মতো ডাকপিয়ন উনি কোথায় পেলেন!

বাঁকা একটা হাসি হাসলেন অ্যালবার্টো।

এমনকী ও-ধরনের ব্যাপারও হিল্ডার বাবার জন্য নেহাতই নস্যি। সস্তা ভোজবাজি। সাদামাটা হাত-সাফাই। আমরা সম্ভবত যাকে বলে জগতের সবচেয়ে কড়া নজরদারির মধ্যে বাস করছি।

সোফি বুঝতে পারছিল ভেতরে ভেতরে রেগে যাচ্ছে সে।

তার সঙ্গে যদি কখনো দেখা হয় আমার তাহলে আমি তার চোখ দুটো খামচে তুলে নেবো।

অ্যালবার্টো হেঁটে গিয়ে সোফায় বসে পড়লেন। সোফি তাকে অনুসরণ করে গভীর একটা আর্মচেয়ারে নিজেকে ডুবিয়ে দিল।

দর্শন-ই কেবল হিল্ডার বাবার আরো কাছাকাছি নিয়ে যেতে পারে আমাদেরকে, অ্যালবার্টো বললেন এক সময়। আজকে আমি তোমাকে বলব রেনেসাঁ-র কথা।

শুরু করুন।

সেন্ট অগাস্টিনের মৃত্যুর কিছুদিনের মধ্যেই খ্রিস্টধর্মের সমন্বিত সংস্কৃতির মধ্যে ফাটল দেখা দিতে শুরু করল। দর্শন আর বিজ্ঞান গির্জার ঈশ্বরতত্ত্বের কাছ থেকে ক্রমেই দূরে সরে যেতে থাকল, তাতে করে ধর্মীয় জীবনের পক্ষে যুক্তি-বিশ্লেষণের সঙ্গে আরো স্বচ্ছন্দ আর সাবলীল একটা সম্পর্ক তৈরি করা সম্ভব হলো। আরো বেশি লোকজন উপলব্ধি করতে লাগল যে বুদ্ধিবাদের সাহায্যে ঈশ্বরের কাছে। পৌঁছুতে পারবো না আমরা, কারণ ঈশর সবদিক থেকেই অজ্ঞেয়। স্বর্গীয় রহস্য বোঝাটা মানুষের জন্য জরুরি নয়, জরুরি বিষয় হচ্ছে ঈশ্বরের ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণ করা।

 ধর্ম আর বিজ্ঞান যেহেতু এখন আগের চেয়ে আরো সাবলীলভাবে পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত হতে পারছিল ফলে নতুন নতুন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি আর একটা নতুন ধর্মীয় উদ্দীপনার সম্ভাবনা বা দরজা খুলে গেল। এভাবেই ভিত্তি তৈরি হলো পঞ্চদশ আর ষোড়শ শতাব্দীর দুটো শক্তিশালী আন্দোলনের, রেনেসাঁ (Renaissance) আর রিফর্মেশনএর (Reformation)।

 একটা একটা করে এগোলে হোতো না?

রেনেসাঁ বলতে আমরা অত্যন্ত সমৃদ্ধ সেই সাংস্কৃতিক বিকাশকে বুঝি যার সূত্রপাত ঘটেছিল চতুর্দশ শতাব্দীর শেষের দিকে। এর শুরুটা হয়েছিল উত্তর ইতালিতে আর খুব তাড়াতাড়ি তা ছড়িয়ে পড়েছিল উত্তর দিকে, পঞ্চদশ আর ঘোড়শ শতাব্দীতে।

আপনি আমাকে বলেছিলেন না যে রেনেসাঁ অর্থ পুনর্জন্ম?

বলেছিলাম বৈকি। আর যে-জিনিসটির পুনর্জন্ম হচ্ছিল তা হলো প্রাচীন যুগের শিল্প আর সংস্কৃতি। আমরা রেনেসাঁর মানবতাবাদের কথাও বলি, তার কারণ দীর্ঘ অন্ধকার যুগের পর, যে-সময়ে প্রতিটি জিনিসই স্বর্গীয় আলোর সাহায্যে দেখা হতো, সব কিছুই আবার মানুষকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হতে শুরু করল। এই সময়ের মূলমন্ত্র ছিল উৎসের দিকে যাও, আর সে-কথার প্রথম এবং প্রধান অর্থ প্রাচীন যুগের মানবতাবাদ।

 প্রাচীন সব ভাস্কর্য আর স্কুল খুঁজে খুঁজে আবিস্কার করা যেন একটা জনপ্রিয় অবসর বিনোদন হয়ে দাঁড়াল, ঠিক যেমন ফ্যাশন হয়ে উঠল গ্রীক ভাষা শেখা। গ্রীক মানবতাবাদ চর্চার একটা শিক্ষা সংক্রান্ত দিকও ছিল। মানবতাবাদী বিষয়গুলো একটা ধ্রুপদী শিক্ষায় শিক্ষিত করত লোকজনকে এবং তাদের মধ্যে বিকশিত করতো যাকে বলা যেতে পারে মানবীয় গুণাবলী। বলা হতো, ঘোড়ার জন্ম হয়, কিন্তু মানুষের জন্ম হয় না, তাকে গঠন করা হয়।

মানুষ হতে হলে কি তাহলে শিক্ষিত হতে হবে আমাদের?

হ্যাঁ, সে-রকমটাই ভাবা হতো। কিন্তু রেনেসাঁর মানবতাবাদের ধারণাগুলোর দিকে তাকাবার আগে রেনেসাঁর রাজনৈতিক আর সাংস্কৃতিক পটভূমির ব্যাপারে কিছু কথা বলে নেয়া খুব জরুরি।

সোফা থেকে উঠে ঘরময় ঘুরে বেড়াতে শুরু করলেন অ্যালবার্টো। খানিক পর থামলেন তিনি, তাকগুলোর একটার ওপর রাখা একটা প্রাচীন যন্ত্রের দিকে তর্জনী নির্দেশ করলেন।

কী ওটা? জিগ্যেস করলেন তিনি।

দেখে মনে হচ্ছে সাবেক কালের একটা কম্পাস।

একদম ঠিক।

এরপর তিনি সোফার ওপরে দেয়াল থেকে ঝুলে থাকা প্রাচীন একটা আগ্নেয়াস্ত্রের দিকে আঙুল তুললেন।

আর ওটা?

 একটা সেকেলে রাইফেল।

ঠিক বলেছ-আর এটা?

বই-এর শেলফ থেকে বড়সড় একটা বই টেনে বার করলেন অ্যালবার্টো।

এটা একটা পুরনো বই।

একদম ঠিক করে বললে, এটা হচ্ছে একটা ইনকিউনাবুলাম (incunabulum)

ইনকিউনাবুলাম?

আসলে কথাটার অর্থ দোলনা। শব্দটা ব্যবহার করা হয় প্রিন্টিং-এর একেবারে গোড়ার দিনগুলোর বই-এর প্রসঙ্গে। তার মানে, ১৫০০ খ্রিস্টাব্দের আগের বইগুলো সম্পর্কে।

বইটা কি আসলেই এতো পুরনো?

এতোই পুরনো, হ্যাঁ। আর এই তিনটে আবিষ্কার-কম্পাস, আগ্নেয়াস্ত্র আর প্রিন্টিং প্রেস-এগুলোই ছিল আমরা যাকে রেনেসাঁ বলি তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্ত।

ব্যাপারটা আরেকটু পরিষ্কার করে বলতে হবে আমাকে।

কম্পাসের কারণে নৌ-চালনা আগের চেয়ে সহজ হয়ে এলো। অন্যভাবে বললে বলতে হয়, নতুন নতুন দেশ আবিষ্কারের বড় বড় যে-সব অভিযান হয়েছিল তখন তা সম্ভব হয়েছিল মূলত এই কম্পাসের কারণেই। এক অর্থে, আগ্নেয়াস্ত্রর কারণেও বটে। নতুন অস্ত্রগুলোর কারণে ইউরোপিয় সামরিক বাহিনী আমেরিকা আর এশিয়ার সংস্কৃতির ওপর আধিপত বিস্তারে সক্ষম হয়। অবশ্য ইউরোপেও আগ্নেয়াস্ত্রগুলো একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা •ালন করেছিল। আর রেনেসাঁ মানবতাবাদীদের নতুন ধারণাগুলো ছড়িয়ে দেবার ক্ষেত্রে একটা বড় ভূমিকা পালন করেছিল প্রিন্টিং। জ্ঞানের একমাত্র প্রচারকারী হিসেবে গির্জার প্রাক্তন ভূমিকার অবসান ঘটাতে যে-সব কারণ অবদান রেখেছিল এই মুদ্রণশিল্প তার একটি। নতুন নতুন আবিষ্কার আর যন্ত্রপাতি দেখা দিতে থাকে একের পর এক। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, এ-রকম একটা গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার ছিল টেলিস্কোপ, জ্যোতির্বিদ্যাকে যা এক পুরোপুরি নতুন ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল।

এবং সবশেষে এলো রকেট আর স্পেস প্রোব।

এবার কিন্তু তুমি বড় তাড়াতাড়ি এগোলে। তবে তুমি এ-কথা বলতে পারো যে রেনেসাঁর সময়েই একটা প্রক্রিয়া তৈরি হয়েছিল যা শেষ পর্যন্ত মানুষকে চাঁদে পৌঁছে দেয়। বা এক অর্থে হিরোশিমা আর চেরনোবিলে। সে যাই হোক, এর সবই শুরু হয়েছিল সাংস্কৃতিক আর অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পরিবর্তনের সূত্র ধরে। একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো বিদ্যমান অর্থনীতি থেকে অর্থ-ভিত্তিক অর্থনীতিতে রূপান্তর। মধ্য যুগের শেষের দিকে নানান শহর গড়ে উঠেছিল, সেই সঙ্গে গড়ে উঠেছিল কার্যকর ব্যবসা-বাণিজ্য আর নিত্য নতুন পণ্যের এক চমৎকার বেচাকেনা, সেই সঙ্গে অর্থ-নির্ভর অর্থনীতি ও ব্যাংকিং। উদ্ভব হলো মধ্যবিত্ত শ্রেণীর, যে-শ্রেণী জীবনযাপনের মৌলিক শর্ত বা অবস্থার খানিকটা উদারনৈতিক পরিবর্তন আনতে সফল হলো। এমন একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো যেখানে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র অর্থের বদলে কিনতে পাওয়া গেল। এর সবই মানুষের পরিশ্রম, কল্পনাশক্তি আর উদ্ভাবনশক্তির পুরস্কার। আর এ-সবের ফলে ব্যক্তিমানুষের ওপর নিত্য নতুন প্রত্যাশা বা দাবি সৃষ্টি হলো।

দুই হাজার বছর আগে গ্রীক শহরগুলো যেভাবে সৃষ্টি হয়েছিল ব্যাপারটা তো দেখছি খানিকটা সে-রকম।

একেবারে মিথ্যে বলনি। গ্রীক দর্শন কীভাবে গ্রামীণ সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত পৌরাণিক বিশ্ব চিত্র থেকে বেরিয়ে এসেছিল সে-কথা আমি তোমাকে বলেছি। ঠিক একইভাবে, বেঁনেসা-র সময়কার মধ্যবিত্ত শ্রেণীও সামন্ত প্রভু আর গির্জার ক্ষমতাবলয় থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করে। এই যখন অবস্থা তখন গ্রীক। সংস্কৃতিও নতুন করে আবিষ্কৃত হচ্ছিল স্পেনে আরবদের আর পুবে বাইজেন্টিয় সংস্কৃতির সঙ্গে আগের চেয়েও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের ফলে।

প্রাচীন যুগের তিন শাখা বিশিষ্ট জলধারা ফের মিলিত হয়ে তৈরি করল একটি বিশাল নদী।

মনোযোগী ছাত্রী তুমি। যাই হোক, একটা ব্যাকগ্রাউন্ড পেলে তুমি তাহলে রেনেসা-র। এবার আমি তোমাকে নতুন ধারণাগুলোর কথা বলছি।

ঠিক আছে, কিন্তু আমাকে বাড়ি ফিরতে হবে, খেতে হবে।

আবার সোফায় বসে পড়লেন অ্যালবার্টো। তাকালেন সোফির দিকে।

সব কিছু ছাপিয়ে রেনেসাঁ-র সময়ে দেখা দিয়েছিল মানবজাতি সম্পর্কে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি। মানুষের পাপপূর্ণ চরিত্রের ওপর জোর-দেয়া মধ্যযুগীয় একদেশদর্শী দৃষ্টিভঙ্গির একেবারে বিপরীতে রেনেসা-প্রসূত মানবতাবাদ মানুষ এবং মানুষের মূল্য সম্পর্কে এক নতুন বিশ্বাস নিয়ে উপস্থিত হয়। মানুষকে এবার থেকে দেখা হতে থাকে সীমাহীন রকমের বিরাট আর মূল্যবান হিসেবে। রেনেসাঁ-র অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব ছিলেন মার্সিলিও ফিসিনো (Marsilio Ficino), যিনি বলেছিলেন, মানুষের ছদ্মবেশধারী হে স্বর্গীয় বংশ, নিজেকে জানো! আরেকজন কেন্দ্রীয় ব্যক্তি ছিলেন পিকা দেলা মিরান্দালা (Pica della Mirandola)। তিনি লিখেছিলেন মানুষের সম্মান সংক্রান্ত বক্তৃতা, যা ছিল মধ্যযুগে একটি অভাবিত বিষয়।

পুরো মধ্য যুগ জুড়েই প্রধান আলোচ্য বিষয় ছিল ঈশ্বর। রেনেস-র মানবতাবাদীরা তাঁদের আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে এলেন মানুষকে।

কিন্তু গ্রীক দার্শনিকেরাও তো তাই করেছিলেন?

ঠিক এজন্যেই তো একে আমরা বলছি প্রাচীন যুগের মানবতাবাদের পুনর্জন্ম। তবে রেনেসাঁ-র মানবতাবাদ আরো অনেক বেশি বিশিষ্ট হয়ে আছে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদের (individualism) জন্যে। আমরা কেবল মানুষই না, আমরা অসাধারণ স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব। এই ধারণাটি অতঃপর সম্প্রসারিত হলে প্রতিভার এক লাগামছাড়া বন্দনায়। আমরা যাকে বলি রেনেসাঁ মানব তা-ই হয়ে উঠল আদর্শ, যে কিনা জীবন, শিল্প আর বিজ্ঞানের সমস্ত দিকস্পর্শী এক সার্বজনীন প্রতিভাসম্পন্ন মানুষ। মানুষ সম্পর্কিত নতুন দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ ঘটল মানুষের শরীরবিদ্যার ব্যাপারে সৃষ্টি হওয়া একটি নতুন আগ্রহের মধ্যে দিয়ে। প্রাচীনকালের মতো লোকে আবারো শব ব্যবচ্ছেদ শুরু করল মানুষের শরীরের গঠন দেখার জন্যে। চিকিৎসা বিজ্ঞান আর শিল্পকলা, এই দুইয়ের বেলাতেই বাধ্যতামূলকভাবে করা হতো কাজটি। নগ্ন শরীর আঁকা শিল্পের ক্ষেত্রে আবারো স্বাভাবিক বিষয় হিসেবে পরিগণিত হল। এক হাজার বছরের শালীনতার ভানের পর মানুষ তার স্বরূপে ফেরার মতো সাহসী হলো। এমন কিছুই রইল না তার যার জন্যে তাকে লজ্জিত হতে হয়।

কেমন যেন নেশা ধরিয়ে দিচ্ছে আপনার কথাগুলো, বলে উঠল সোফি, তার আর দার্শনিকের মাঝখানে রাখা ছোট্ট টেবিলটার ওপর হাতের ভর রেখে।

তা ধরানোরই কথা। মানুষের প্রতি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি সমস্ত কিছুর ব্যাপারেই। একটা নতুন দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম দিল। মানুষ কেবল ঈশ্বরের জন্যেই বাঁচে না। ইহজগতের এবং বর্তমানের জীবন নিয়ে আনন্দিত হওয়ার অনেক কিছু রয়েছে মানুষের। সেই সঙ্গে বেড়ে উঠবার, উন্নতি করবার এই স্বাধীনতার কারণে সম্ভাবনার দিগন্ত-ও হয়ে গেল অনন্ত। এবারের লক্ষ্য হলো সমস্ত সীমা অতিক্রম করা। গ্রীক মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এটাও একটা নতুন ধারণা; কারণ প্রাচীন যুগের মানবতাবাদীরা গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন প্রশান্ততা, পরিমিতি আর সংযমের ওপর।

তাহলে কি রেনেসাঁ যুগের মানবতাবাদীরা তাদের সংযম হারিয়ে ফেলেছিলেন?

তারা বিশেষ করে মোটেই পরিমিতিসম্পন্ন ছিলেন না। তারা এমন আচরণ করেছিলেন যেন গোটা জগত্তা নতুন করে জেগে উঠেছে। নিজেদের যুগ বা কাল সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন হয়ে উঠেছিলেন তাঁরা, সে-কারণেই প্রাচীন যুগ আর তাদের নিজেদের সময়ের মধ্যবর্তী শতাব্দীগুলোর কথা বোঝাতে তারা প্রচলন করলেন মধ্য যুগ কথাটি। জীবনের সব ক্ষেত্রে সূচিত হলো এক অতুলনীয় উন্নতি। শিল্পকলা ও স্থাপত্যবিদ্যা, সাহিত্য, সঙ্গীত, দর্শন এবং বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এমন বিকাশ ঘটল যা এর আগে কখনো হয়নি। আমি কেবল একটি বাস্তব উদাহরণ দিচ্ছি। এর আগে আমরা নগরগুলোর নগর আর মহাবিশ্বের কেন্দ্র নামে এক সময়ে খ্যাত প্রাচীন রোম-এর কথা বলেছি। অথচ মধ্য যুগে নগরটি অবক্ষয়ের মুখে পতিত হয় আর ১৪১৭ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ প্রাচীন এই নগরটির জনসংখ্য এসে দাঁড়ায় ১৭,০০০-এ।

হিল্ডা যেখানে থাকে সেই লিলেস্যান্ডের চেয়ে খুব বেশি নয়।

রোমের অবস্থা ফিরিয়ে আনাটাকে রেনেসাঁ যুগের মানবতাবাদীরা তাঁদের সাংস্কৃতিক কর্তব্য হিসেবে গণ্য করেছিলেন: তাই সবার আগে তারা হাতে নিলেন অ্যাপোসল পিটারের সমাধির ওপর বিশালকায় সেন্ট পিটারের গির্জা নির্মাণের কাজ। এবং, সেন্ট পিটারের গির্জার খ্যাতি কিন্তু আর যাই হোক পরিমিতি বা সংযমের জন্যে নয় মোটেই। রেনেসাঁ যুগের অনেক বড় বড় শিল্পী জগতের সবচেয়ে বড় এই নির্মাণকাজে অংশ নিয়েছিলেন। কাজটি শুরু হয় ১৫০৬-এ, চলে একশো বছর ধরে এবং বিশাল সেন্ট পিটার্স স্কোয়্যার হতে সময় নেয় আরো পঞ্চাশ বছর।

গির্জাটা নিশ্চয়ই আকারে খুবই বিশাল হবে!

লম্বায় ২০০ মিটারেরও বেশি, উঁচু ১৩০ মিটার আর গির্জাটা দাঁড়িয়ে আছে ১৬,০০০ বর্গফুটেরও বেশি জায়গা দখল করে। সে যাই হোক, রেনেসাঁ যুগের মানুষদের শৌর্য-বীর্যের কথা অনেক হলো। তবে আরেকটা ব্যাপারও লক্ষণীয় যে, প্রকৃতি সম্বন্ধেও একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম দিয়েছিল রেনেসা। মানুষ যে পৃথিবীতে বেশ স্বচ্ছন্দ বোধ করল, জীবনকে স্রেফ পরলোকের প্রস্তুতিমূলক সময় হিসেবে গণ্য করল না, এই ব্যাপারটি প্রাকৃতিক জগৎ সম্পর্কে একেবারে নতুন একটি দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম দিল। প্রকৃতিকে এখন থেকে একটি ইতিবাচক বিষয় বলে ভাবা হতে থাকল। অনেকেই এই মতে বিশ্বাস করতে লাগলেন যে ঈশ্বর নিজেও তাঁর সৃষ্টির মধ্যে উপস্থিত থাকেন। তিনি যদি সত্যিই অসীম হয়ে থাকেন তাহলে তিনি নিশ্চয়ই সব কিছুতেই বিদ্যমান। এই বিশ্বাস বা ধারণাটিকে বলে সর্বেশ্বরবাদ। মধ্য যুগের দার্শনিকেরা এ-কথা জোর দিয়ে বলেছেন যে ঈশ্বর আর তাঁর সৃষ্টির মধ্যে দুরতিক্রম্য একটি বাধা আছে। কিন্তু এখন এ-কথা বলা গেল যে প্রকৃতি স্বর্গীয়, এমনকী এ কথাও যে, প্রকৃতি হচ্ছে ঈশ্বরের ফুটে ওঠা।

কিন্তু এ-ধরনের বিশ্বাস বা ধারণা গির্জা সব সময় খুব একটা সহানুভূতির দৃষ্টিতে দেখত না। জিওর্দানো ব্রুনো (Giordano Bruno)-র নিয়তি তারই একটি প্রকৃষ্ট আর নাটকীয় উদাহরণ। তিনি যে কেবল এটাই দাবি করেছিলেন যে ঈশ্বর প্রকৃতিতে বিদ্যমান তাই নয়, তিনি একথাও বিশ্বাস করতেন যে মহাবিশ্ব সম্ভাবনার দিক দিয়ে অসীম। তাঁর এই বিশ্বাসের জন্যে ভীষণ শাস্তিভোগ করেছিলেন তিনি।

কী রকম?।

১৬০০ খ্রিস্টাব্দে রোমের পুস্প বাজারে তাকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হয়।

কী নৃশংস…. কী নির্বোধ। আর একে আপনি মানবতাবাদ বলছেন?

না, না, মোটেই তা নয়। ব্রুনো-ই ছিলেন মানবতাবাদতী, তাকে যারা পুড়িয়ে মেরেছিল তারা নয়। আমরা যাকে বলি মানবতাবিরোধী কার্যকলাপ তারও প্রসার ঘটেছিল রেনেসাঁর সময়ে। অর্থাৎ আমি বলতে চাইছি, রাষ্ট্র আর গির্জার কর্তৃত্ববাদী শক্তির কথা। রেনেসাঁর সময়ে ডাইনিদের বিচার করা, ধর্মবিরোধীদের পুড়িয়ে মারা, জাদু আর কুসংস্কার, রক্তাক্ত ধর্মীয় যুদ্ধ, এ-সবের মোচ্ছব পড়ে যায় রীতিমত, তাছাড়া, পাশবিক আমেরিকা বিজয়-এর কথাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। তবে মানবতাবাদের একটা ছায়া-ঢাকা অংশ সব সময়ই রয়ে গেছে। আসলে কোনো যুগই পুরোপুরি ভালো বা পুরোপুরি মন্দ নয়। ভালো আর মন্দ হচ্ছে প্রায় একই রকমের দুটো সুতো যা মানব ইতিহাসের ভেতর দিয়ে চলে গেছে। আর, প্রায়ই এই সুতো দুটো একে অন্যের সঙ্গে জড়িয়ে যায়। এই ব্যাপারটি আমাদের পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ নতুন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি-র বেলাতে নেহাত কম সত্য নয়। এবার আমি রেনেসাঁ-র এই দ্বিতীয় আবিষ্কার সম্পর্কেই কিছু কথা বলব।

এই সময়-ই কি গোড়ার দিককার কল-কারখানাগুলো তৈরি করেছিল মানুষ?

না, তখনো না। কিন্তু রেনেসাঁ-র পরে যে-সব প্রযুক্তিগত উন্নতি হয় তার পূর্বশর্ত ছিল এই নতুন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি। এই কথাটির সাহায্যে আমি আসলে বলতে চাইছি বিজ্ঞান সম্পর্কে পুরোপুরি নতুন একটি দৃষ্টিভঙ্গির কথা। এই পদ্ধতির প্রায়োগিক যা কিছু ফলাফল তা ভালো করে বোঝা যায় বেশ পরেই কেবল।

তা এই নতুন পদ্ধতিটি কী?

মূলত এটা হলো আমাদের ইন্দ্রিয়গুলোর সাহায্যে প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করার একটি প্রক্রিয়া। চতুর্দশ শতাব্দী থেকেই সেই সব চিন্তাবিদের সংখ্যা বেড়ে চলছিল যারা প্রাচীন শাস্ত্রের প্রতি অন্ধ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে সতর্কবাণী উচ্চারণ করে যাচ্ছিলেন, তা সেটা ধর্মীয় মতবাদই হোক বা অ্যারিস্টটলের প্রকৃতিবাদী দর্শনই হোক। স্রেফ চিন্তা-ভাবনার সাহায্যেই কোনো সমস্যার সমাধান করে ফেলা সম্ভব, এ-রকম বিশ্বাসের বিরুদ্ধেও সতর্কবাণী উচ্চারণ করা হচ্ছিল। পুরো মধ্য যুগ জুড়েই আসলে প্রজ্ঞার গুরুত্বের ওপর বাড়াবাড়ি রকমের ভরসার ব্যাপারটি প্রশ্রয় পেয়ে এসেছিল। কিন্তু এখন বলা হতে লাগল যে প্রাকৃতিক ঘটনাবলী সংক্রান্ত যে-কোনো অনুসন্ধান অবশ্যই পর্যবেক্ষণ, অভিজ্ঞতা আর পরীক্ষা-নিরীক্ষা নির্ভর হতে হবে। এই ব্যাপারটিকে আমরা বলি অভিজ্ঞতাভিত্তিক পদ্ধতি (empirical method)।

তার মানে?

স্রেফ এই যে কারো জ্ঞানের ভিত্তি কেবল তার নিজের অভিজ্ঞতা-নির্ভর। কল্পনার ধূলিধূসর কাগজ-পত্র বা মিথ্যা সাজানো ঘটনা-নির্ভর নয়। অভিজ্ঞতা-নির্ভর বিজ্ঞান প্রাচীন যুগে অপরিচিত ছিল না, কিন্তু নিয়মানুগ পরীক্ষা-নিরীক্ষার এই ব্যাপারটি ছিল একেবারেই নতুন।

আমাদের কাছে এখন যে-সব টেকনিক্যাল অ্যাপারেটাস রয়েছে তা নিশ্চয়ই ছিল না তাদের?

ক্যালকুলেটর বা ইলেক্ট্রনিক তুলাযন্ত্র অবশ্য তাঁদের ছিল না। তবে তাঁরা অংকশাস্ত্র জানতেন, নানান তুলাযন্ত্র-ও ছিল তাদের। আর তাছাড়া, বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণগুলোকে যথাযথ গাণিতিক ভাষায় প্রকাশ করার ব্যাপারটি এ-সময় মোটের ওপর বাধ্যতামূলক হয়েও দাঁড়িয়েছিল। যা মাপা যায় তা মাপো আর যা মাপা যায় না তা মাপার যোগ্য করে তোলো, বললেন সপ্তদশ শতকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞানী গ্যালিলিও গ্যালিলি। তিনি আরো বলেছিলেন যে, প্রকৃতির গ্রন্থ লেখা হয়েছে গণিতের ভাষায়।

তাহলে এ-সমস্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর মাপজোক-ই নতুন নতুন আবিষ্কারকে সম্ভব করে তুলেছিল।

নতুন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিটি ছিল এ-সবের প্রথম পর্ব। এর কারণেই সম্ভব হয়েছিল প্রযুক্তিগত বিপ্লব আর এই প্রযুক্তিগত সাফল্যই এরপরের প্রতিটি আবিষ্কারের পথ খুলে দেয়। তুমি বলতে পারো, মানুষ তার প্রাকৃতিক সীমাবদ্ধতা ভেঙে বেরিয়ে আসতে শুরু করল। প্রকৃতির নিছকই একটা অংশ হয়ে রইল না আর মানুষ। জ্ঞানই শক্তি, এই কথাটি বলে ইংরেজ দার্শনিক ফ্রান্সিস বেকন (Francis Bacon) জ্ঞানের ব্যবহারিক মূল্যের ওপর জোর দিলেন আর এ-ব্যাপারটি কিন্তু ছিল সত্যি-ই নতুন। সত্যি সত্যিই মানুষ প্রাকৃতিক কাজ-কর্মে হস্তক্ষেপ শুরু করে দিয়েছিল। শুরু করেছিল প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে।

কিন্তু শুধু নিশ্চয়ই ভালো অর্থে নয়?

না আর এই কথাটি-ই খানিক আগে বোঝাতে চেয়ছিলাম আমি যখন বলেছিলাম যে আমরা যা-ই করি তার মধ্যেই ভালো আর মন্দের সুতো জড়াজড়ি করে থাকে সর্বক্ষণ। রেনেসাঁর সময়ে শুরু হওয়া প্রযুক্তিগত বিপ্লবই স্পিনিং জেনি (কলের চাকা) আর বেকারত্বের সূচনা ঘটায়, সূচনা ঘটায় ওষুধ-পত্র আর নতুন নতুন রোগের, কৃষিকাজে উন্নত দক্ষতা আর প্রকৃতি-পরিবেশের সর্বনাশের, ব্যবহার্য যন্ত্রপাতি, যেমন ওয়াশিং মেশিন ও রিফ্রিজারেটর আর সেই সঙ্গে দূষণ ও শিল্পবর্জ্যের। আজ আমরা ভয়াবহ যে পরিবেশগত হুমকির মুখোমুখি হয়েছি তা অনেককে খোদ প্রযুক্তিগত বিপ্লবকেই প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে একটি বিপজ্জনক রকমের বেমানান জিনিস হিসেবে দেখতে বাধ্য করছে। বলা হচ্ছে যে, আমরা এমন একটি জিনিস শুরু করেছি যা আমরা আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না। আরো আশাবাদী যারা তারা অবশ্য মনে করেন যে আমরা এখনো প্রযুক্তির শৈশব দশার মধ্যে বাস করছি, তাছাড়া, বৈজ্ঞানিক যুগের গোড়ার দিকে নিশ্চিতভাইে কিছু সমস্যার মুখোমুখি হলেও ধীরে ধীরে আমরা প্রকৃতিকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে শিখব যাতে একই সঙ্গে সেটার আর আমাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে না পড়ে।

আপনার কী ধারণা?

আমি মনে করি এই দুই মতের ভেতরেই সম্ভবত সত্য আছে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রকৃতির ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করা বন্ধ করতে হবে আমাদের, কিন্তু আবার অন্যান্য কিছু ক্ষেত্রে আমরা সফল হতে পারব। একটা বিষয় নিশ্চিত, মধ্য যুগে ফিরে যাওয়ার কোনো অবকাশ নেই। রেনেসাঁর সময় থেকেই মানুষ সৃষ্টির স্রেফ একটা অংশের অতিরিক্ত হয়ে পড়েছে। প্রকৃতির কাজ-কর্মে মানুষ হস্তক্ষেপ করতে শুরু করেছে, প্রকৃতিকে গড়ে তুলেছে তার নিজের প্রতিমূর্তির অনুকরণে। সত্যিই হোয়াট আ পিস্ অত্ ওয়ার্ক ইজ ম্যান! 

এরিমধ্যে আমরা চাঁদে পা রেখেছি। মধ্য যুগের কোনো লোক কি বিশ্বাস করত কাজটা সম্ভব?

তা যে করত না সে-কথা নিশ্চিত করেই বলা যায়। আর এই সূত্র ধরেই আমরা চলে এসেছি জগৎ সম্পর্কিত নতুন ধারণায়। পুরো মধ্য যুগ ধরে লোকে আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে ওপরের সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্র আর গ্রহ-র দিকে তাকিয়ে থেকেছে। কিন্তু পৃথিবী যে মহাবিশ্বের কেন্দ্র এ-বিষয় নিয়ে কারো মনে কোনো সংশয় সৃষ্টি হয়নি। কোনো পর্যবেক্ষণই মানুষের মনে এ-ব্যাপারে কোনো সন্দেহ সৃষ্টি করেনি যে পৃথিবী স্থির আর গ্রহ-নক্ষত্রগুলো তাদের নিজ নিজ অক্ষে থেকে পৃথিবীর চারপাশে ঘুরছে। একে আমরা বলি ভূ-কেন্দ্রিক বিশ্বচিত্র, অন্য কথায় যার অর্থ হচ্ছে এই বিশ্বাস যে সব কিছুই পৃথিবীকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। উঁচু থেকে, সমস্ত গ্রহ নক্ষত্রের ওপর থেকে ঈশ্বর শাসন করে যাচ্ছেন, খ্রিস্টিয় এই বিশ্বাস-ও এই বিশ্বচিত্রটিকে বজায় রাখতে সাহায্য করেছে।

ব্যাপারটা যদি এতোই সোজা হতো, তাহলে ভালোই হতো!

কিন্তু ১৫৪৩ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হলো একটি ছোট্ট বই, অন দ্য রেভলিউশনস অভ দ্য সেলেশিয়াল স্কিয়ারজ। বইটি লিখলেন পোল্যান্ডের জ্যোতির্বিদ নিকোলাউস কোপার্নিকাস (Nicolaus Copernicus)। বইটি যেদিন প্রকাশিত হয় সেদিনই কোপার্নিকাস মারা যান। তিনি দাবি করলেন যে, সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে না, ব্যাপারটি ঠিক উল্টো। তিনি ভাবতেন, জগতে যে-সব গ্রহ-নক্ষত্র রয়েছে সেসব পর্যবেক্ষণ করলেই বোঝা যায় যে ব্যাপারটি খুবই সম্ভব। তিনি বললেন, লোকে যে সব সময় বিশ্বাস করে এসেছে যে সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে তার কারণ পৃথিবী তার নিজের অক্ষের ওপর ঘুরে চলেছে। তিনি বললেন, গ্রহ-নক্ষত্রের সমস্ত পর্যবেক্ষণ বুঝতে পারা অনেক অনেক সহজ হয়ে পড়ে যদি কেউ এ-কথা ধরে নেয় যে পৃথিবী এবং অন্যান্য গ্রহ সূর্যের চারদিকে ঘোরে। একে আমরা বলি সূর্যকেন্দ্রিক বিশ্বচিত্র।

আর এই বিশ্বচিত্রটি-ই ঠিক ছিল?

পুরোপুরি নয়। তাঁর মূল বক্তব্য, অর্থাৎ পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে, সেটা অবশ্য সঠিক। কিন্তু তিনি দাবি করেছিলেন যে, সূর্য-ই হচ্ছে মহাবিশ্বের কেন্দ্র। আজ আমরা জানি যে সূর্য অসীম সংখ্যক নক্ষত্রের একটি মাত্র। আর আমাদের চারপাশের অগুনতি নক্ষত্র দিয়ে বেশ কয়েক বিলিয়ন গ্যালাক্সির মাত্র একটি তৈরি হয়েছে। কোপার্নিকাস আরো বিশ্বাস করতেন যে, পৃথিবী এবং অন্যান্য সব গ্রহ বৃত্তাকার কক্ষপথ ধরে সূর্যের চারপাশে ঘোরে।

আসলে তা নয়?

না। গোলাকার কক্ষপথ-এর ব্যাপারে তাঁর বিশ্বাসের একমাত্র ভিত্তি ছিল সুপ্রাচীন এই ধারণাটি যে স্বর্গীয় বস্তুগুলো অর্থাৎ গ্রহ-নক্ষত্রসমূহ গোলাকার আর তারা গোলাকার পথে আবর্তন করে, স্রেফ এই কারণে যে সেগুলো স্বর্গীয়। প্লেটোর সময় থেকেই গোলক আর বৃত্তকে সবচেয়ে নিখুঁত জ্যামিতিক আকার হিসেবে ধরে নেয়া হচ্ছিল। কিন্তু সপ্তদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে জার্মানির জ্যোতির্বিদ জোহানেস কেপলার (Johannes Keplar) ব্যাপক পর্যবেক্ষণের ফলাফল উপস্থিত করেন এবং এতে দেখা যায় যে, গ্রহগুলো উপবৃত্তাকার কক্ষপথে একটি ফোকাস থেকে সূর্যকে আবর্তন করে। তিনি আরো দেখান যে একটি গ্রহ যখন সূর্যের সবচেয়ে কাছে থাকে তখনই সেটার গতিবেগ সবচেয়ে বেশি হয়। আর যতই তা সূর্যের কাছ থেকে দূরে সরে যায় ততোই সেটার গতি ধীর হয়ে পড়ে। আসলে কেপলারের সময়-এর আগে এ-কথা বলা হয়নি যে পৃথিবী ঠিক অন্যান্য গ্রহের মতোই একটা গ্রহ। কেপলার জোর দিয়ে আরো বলেন যে সারা মহাবিশ্ব জুড়েই একই প্রাকৃতিক নিয়ম কার্যকর।

তিনি কী করে জানলেন সে-কথা?

জানলেন কারণ তিনি প্রাচীন কুসংস্কারগুলোর ওপর অন্ধভাবে বিশ্বাস স্থাপন না করে নিজের ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে গ্রহগুলোর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। গ্যালিলিও গ্যালিলি, (Galileo Galilei), যিনি কেপলারের কিছুদিনের সমসাময়িক ছিলেন, তিনিও গ্রহ-নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করার জন্যে দূরবীক্ষণ যন্ত্র ব্যবহার করেছিলেন। চাঁদের বিভিন্ন জ্বালামুখ পর্যবেক্ষণ করে তিনি বলেছিলেন চাঁদেও পৃথিবীর মতো পাহাড় এবং উপত্যকা রয়েছে। এছাড়াও তিনি আবিষ্কার করেছিলেন যে বৃহস্পতি গ্রহের চারটে চাঁদ বা উপগ্রহ রয়েছে। কাজেই, শুধু যে পৃথিবীরই চাঁদ রয়েছে তা নয়। কিন্তু গ্যালিলিওর সবচেয়ে বড় গুরুত্ব এইখানে যে তিনিই প্রথম তথাকথিত জড়তার সূত্র(Laws of Inertia) গঠন করেন।

সেটা কী?

গ্যালিলিও-র বয়ান অনুযায়ী বিষয়টি এ-রকম: স্থিতিশীল বা গতিশীল কোনো বস্তুকে বাইরের কোনো শক্তি বাধ্য না করলে সেটা তার পূর্বাবস্থাতেই থাকে।

আপনি যা বলেন।

তবে এটা কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা পর্যবেক্ষণ। পৃথিবী যে তার নিজের অক্ষের ওপর ঘুরছে এই বক্তব্যের বিরুদ্ধে প্রাচীন কাল থেকেই যে-সব যুক্তি শানানো হতো তার একটি প্রধান যুক্তি ছিল এই যে সেক্ষেত্রে পৃথিবী এতো জোরে ঘুরতো যে ঠিক ওপরের দিকে ছুঁড়ে দেয়া একটা ঢিল সেটাকে যেখান থেকে ছুঁড়ে দেয়া হয়েছে তার থেকে কয়েক গজ দূরে পড়তো।

তা, কেন সেটা হয় না?

তুমি যদি ট্রেনে বসে নিচে একটা আপেল ফেলে দাও, ট্রেনটা চলছে বলে কিন্তু সেটা পেছনে পড়ে না। সেটা সোজা নিচের দিকে পড়ে যায়। এটা ঘটে জড়তার সূত্রের কারণে। আপেলটা পড়ার আগে সেটার ভেতর যে-গতি ছিল সেই গতিটা কিন্তু তুমি যখন সেটা ছেড়ে দাও তখনো সেটার ভেতর থেকেই যায়।

মনে হচ্ছে বুঝতে পারছি।

তো, গ্যালিলিওর সময়ে তো আর ট্রেন ছিল না। কিন্তু মেঝেতে একটা বল গড়াতে গড়াতে…হঠাৎ যদি সেটা ছেড়ে দাও…

…ওটা চলতেই থাকে…

…কারণ তুমি ছেড়ে দেয়ার পরেও ওটার ভেতর আগের সেই গতি থেকে যায়।

কিন্তু ঘরটা যদি যথেষ্ট লম্বা হয় তাহলে বলটা তো শেষ পর্যন্ত এক সময় থেমে যাবে।

তার কারণ হচ্ছে অন্যান্য শক্তি ওটার গতি ধীর করে ফেলে। প্রথমত, মেঝে, বিশেষ করে সেটা যদি অমসৃণ কাঠের মেঝে হয়। তাছাড়া, মাধ্যাকর্ষণ শক্তি ওটাকে আগে হোক পরে তোক থামিয়ে দেবেই। কিন্তু দাঁড়াও, একটা জিনিস দেখাচ্ছি তোমাকে।

উঠে পড়লেন অ্যালবার্টো নক্স, গিয়ে দাঁড়ালেন পুরনো ডেস্কটার কাছে। কিছু একটা বের করলেন তিনি একটা দেরাজ থেকে। নিজের জায়গায় ফিরে এসে তিনি কফি টেবিলের ওপর রাখলেন সেটা। দেখা গেল সেটা নিছকই কাঠের বোর্ড একটা, এক দিকে কয়েক মিলিমিটার পুরু, অন্য দিকে পাতলা। প্রায় পুরো টেবিল জুড়ে বসা বোর্ডটার পাশে সবুজ একটা মার্বেল রাখলেন তিনি।

বললেন, এটা হলো একটা আনত তল, এবার যদি আমি এই মার্বেলটাকে এখানে, মানে, বোর্ডটা যেখানে সবচেয়ে পুরো সেখানে নিয়ে ছেড়ে দেই তাহলে কী ঘটবে বলতে পারো?

হাল-ছাড়া একটা ভঙ্গি করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল সোফি।

দশ ক্রাউন বাজি ধরে বলতে পারি মার্বেলটা গড়িয়ে প্রথমে টেবিলের ওপর পড়বে, তারপর মেঝেতে।

দেখা যাক।

অ্যালবার্টো মার্বেলটা ছেড়ে দিলেন আর সোফি যা বলেছিল ঠিক তাই করল সেটা। গড়িয়ে গিয়ে টেবিলের ওপর পড়ল, তারপর টেবিলের ওপর থেকে মেঝেতে পড়ল ছোট্ট ভোতা একটা শব্দ করে, তারপর শেষমেষ গিয়ে ধাক্কা খেল একটা দেয়ালের সঙ্গে।

দারুণ! বলে উঠল সোফি।

হ্যাঁ, দারুণ-ই! গ্যালিলিও ঠিক এ-ধরনেরই পরীক্ষা করেছিলেন, বুঝলে।

তিনি কি অতোটাই নির্বোধ ছিলেন?

ধীরে ধীরে। সবকিছু নিজের ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে পরীক্ষা করে দেখতে চেয়েছিলেন তিনি আর আমরাও তাই শুরু করেছি এইমাত্র। এবার আমাকে বলল, মার্বেলটা কেন ঢালু তল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল।

ওটা ওজনে ভারি বলেই গড়িয়ে পড়েছিল।

এটা কোনো প্রশ্ন হলো?

তুমি উত্তর দিতে পারছে না বলেই এটা প্রশ্ন হিসেবে খারিজ হয়ে যায় না। মার্বেলটা গড়িয়ে মেঝেতে পড়ে গেল কেন?

অভিকর্ষ বলের জন্য।

ঠিক, অথবা মাধ্যাকর্ষণ শক্তির জন্যে। ওজনের সঙ্গে অভিকর্ষের একটা সম্পর্ক আছে। ওটার কারণেই মার্বেলটার মধ্যে গতির সঞ্চার হয়েছিল।

ততক্ষণে অ্যালবার্টো মেঝে থেকে তুলে নিয়েছেন মার্বেলটী। সেটা হাতে নিয়ে আবার তিনি আনত তলটার ওপর ঝুঁকে দাঁড়িয়ে রইলেন।

এবার আমি মার্বেলটাকে তল বরাবর আড়াআড়ি গড়িয়ে দেবার চেষ্টা করব, তিনি বললেন ভালো করে লক্ষ করো ওটা কীভাবে চলে।

সোফি দেখল মার্বেলটার গতিপথ ধীরে ধীরে বেঁকে গেল আর শেষে মার্বেলটা ঢাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল।

কী হল? অ্যালবার্টো জিগ্যেস করলেন।

মার্বেলটা বাঁকা পথে গড়িয়ে পড়ল কারণ বোর্ডটা বাঁকা।

এবার আমি মার্বেলটাকে কালো রং করে দিচ্ছি…হয়ত এরপরই আমরা পরীক্ষা করে দেখতে পাবো বাঁকা বলতে তুমি কী বোঝাচ্ছ।

কালির ভেতর চোবানো একটা তুলি তুলে নিয়ে পুরো মার্বেলটাকে কালো রঙ করে দিলেন তিনি। তারপর সেটাকে আবার গড়িয়ে দিলেন। এবার সোফি দেখতে পেল ঠিক কোন পথ ধরে গড়িয়ে পড়ল মার্বেলটা, কারণ, বোর্ডের ওপর একটা কালো দাগ রেখে গেল সেটা।

মার্বেলের গতিপথটাকে কীভাবে বর্ণনা করবে তুমি?

পথটা বাঁকা…দেখতে বৃত্তের একটা অংশের মতো।

 একদম ঠিক বলেছো। অ্যা

লবার্টো সোফির দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে ভুরু নাচালেন।

 অবশ্য ওটা ঠিক বৃত্ত নয়। এ-রকম ফিগারকে বলে অধিবৃত্ত।

তা বেশ।

কিন্তু মার্বেলটা ঠিক ওভাবে গড়িয়ে গেল কেন?

মন দিয়ে খানিকক্ষণ চিন্তা করল সোফি। তারপর বলল, তার কারণ, বোর্ডটা বাঁকা আর মার্বেলটাকে অভিকর্ষ বল মেঝের দিকে টানছিল।

ঠিক! ভাবো দেখি একবার ব্যাপারটা! পনেরোয়-ও পড়েনি এমন এক বালিকাকে আমি আমার চিলেকোঠায় ডেকে এনেছি আর সে একটা পরীক্ষার পরেই ঠিক তাই বুঝে গেছে যা গ্যালিলিও-ও বুঝতে পেরেছিলেন!

হাত তালি দিয়ে উঠলেন তিনি। মুহূর্তের জন্যে সোফির ভয় হলো অ্যালবার্টো পাগল হয়ে গেলেন কিনা। তিনি বলে চললেন: একই বস্তুর ওপর দুটো শক্তি একই সঙ্গে কাজ করলে কী হয় ঠিক তাই দেখেছ তুমি। গ্যালিলিও আবিষ্কার করেছিলেন যে একই ঘটনা, এই যেমন ধরো কামানের গোলার ব্যাপারেও প্রযোজ্য। ওটাকে শূন্যে ছুঁড়ে দেয়া হলো, মাটির ওপর দিকে উড়ে চলল সেটা, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটা মাটিতেই নেমে আসবে। আনত তলের আড়াআড়ি পথ বরাবর মার্বেলটার পথের প্রতিতুলনায় এটা হচ্ছে কামানের গোলার ট্রাজেক্টরি বা আবক্র পথ। আর গ্যালিলিও-র সময় এটা ছিল একেবারে নতুন একটা আবিষ্কার। অ্যারিস্টটল মনে করতেন কোনো কিছুকে বাঁকাভাবে শূন্যে ছেড়ে দিলে সেটা একটা সামান্য বক্ররেখা তৈরি করবে, তারপর উল্লম্বভাবে মাটিতে পড়ে যাবে। আসলে তা হয় না, কিন্তু হাতে-কলমে ব্যাপারটা দেখিয়ে দেয়ার আগ পর্যন্ত কেউই জানত না যে অ্যারিস্টটল ভুল বলেছিলেন।

এ-সব কি তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু?

গুরুত্বপূর্ণ কিছু মানে? অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, চোখ বুজে বাজি ধরতে পারো তুমি। বিষয়টার মহাবৈশ্বিক গুরুত্ব রয়েছে। মানব ইতিহাসের সমস্ত বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারগুলোর মধ্যে এটাই নিঃসন্দেহে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

আমি ঠিক জানি আপনি আমাকে বুঝিয়ে বলবেন, কেন।

এরপর এলেন ইংরেজ পদার্থবিদ আইজাক নিউটন (Isaac Newton), তাঁর জন্ম ১৬৪২ খ্রিস্টাব্দে, মৃত্যু ১৭২৭-এ। সৌরজগৎ আর গ্রহমণ্ডলীর কক্ষপথ সংক্রান্ত বিষয়ে শেষ বর্ণনাটি যোগ করলেন নিউটন। গ্রহগুলো সূর্যের চারপাশে কীভাবে ঘোরে সেটাই যে কেবল তিনি ব্যাখ্য করতে পেরেছিলেন তা নয়, গ্রহগুলো কাজটা কেন করে সেটাও বুঝিয়ে বলতে পেরেছিলেন তিনি। কাজটা তিনি করতে পেরেছিলেন, আমরা যাকে গ্যালিলিওর গতিবিদ্যা বলি, অংশত সেটার সাহায্য নিয়ে।

গ্রহগুলো কি তাহলে একটা আনত তলের ওপর রাখা মার্বেল?

খানিকটা তাই। কিন্তু, একটু দাঁড়াও, সোফি।

তাছাড়া আমার আর কী-ই বা করার আছে?

কেপলার এর আগেই মন্তব্য করেছিলেন যে গ্রহ-নক্ষত্র বা স্বর্গীয় বস্তুগুলোর পরস্পরকে আকর্ষণের পেছনে একটা শক্তি নিশ্চয়ই কাজ করছে। যেমন ধরো, গ্রহগুলোকে তাদের কক্ষপথে আটকে রাখার জন্যে নিশ্চয়ই কোনো সৌরশক্তি কাজ করছে। তাছাড়া, সূর্যের কাছ থেকে গ্রহগুলো যতই দূরে যেতে থাকে, ততোই তাদের গতি কেন ধীর হয়ে আসে এই ব্যাপারটির ব্যাখ্যাও পাওয়া যায় এই সৌরশক্তির সাহায্যে। কেপলার আরো বিশ্বাস করতেন, স্রোতের বাড়া কমা, সমুদ্রপৃষ্ঠের ওঠা নামা নিশ্চয়ই একটা চান্দ্রশক্তির কারণে ঘটে।

কথাটা তো সত্যি।

হ্যাঁ, সত্যি। কিন্তু গ্যালিলিও আবার এই তত্ত্বটাকে নাকচ করে দিয়েছিলেন। চাঁদ পানিকে শাসন করে বলে কেপলার মনে করেছেন, এই কথা ভেবে গ্যালিলিও উপহাস করেছেন তাঁকে। গ্যালিলিও যে কেপলারের এই তত্ত্বটিকে নাকচ করেছিলেন তার কারণ গ্যালিলিও এ-কথা বিশ্বাস করতেন না যে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি অনেক দূর থেকে কাজ করতে পারে, সেই সঙ্গে গ্রহ-নক্ষত্রগুলোর মধ্যেও কাজ করতে পারে।

তিনি তাহলে এইখানটায় ভুল করেছিলেন।

হ্যাঁ। এই একটা বিশেষ ক্ষেত্রে ভুল করেছিলেন তিনি। ব্যাপারটা কিন্তু বেশ মজার আসলে, তার কারণ পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তি আর পড়ন্ত বস্তুই ছিল তাঁর ধ্যান-জ্ঞান। তিনি এমনকী এটাও দেখিয়ে দিয়েছিলেন বর্ধিত শক্তি কী করে কোনো বস্তুর গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।

কিন্তু আপনি তো নিউটনের কথা বলছিলেন।

হ্যাঁ, এরপরই এলেন নিউটন। তিনি তৈরি করলেন আমরা যাকে বলি সার্বজনীন মাধ্যাকর্ষণ সূত্র। এই সূত্র অনুযায়ী, প্রতিটি বস্তু অন্য প্রতিটি বস্তুকে এমন এক শক্তি দিয়ে আকর্ষণ করে যে-শক্তি বস্তুগুলোর আকার অনুপাতে বাড়ে, আবার সেগুলোর মধ্যেকার দূরত্বের অনুপাতে কমে।

আমার মনে হয় আমি বুঝতে পারছি। যেমন ধরুন, দুটো ইঁদুরের মধ্যে যে আকর্ষণ তার চেয়ে দুটো হাতির মধ্যেকার আকর্ষণ বেশি। অন্যদিকে আবার, একই চিড়িয়াখানায় থাকা দুটো হাতির মধ্যেকার আকর্ষণ ভারতে একটা ভারতীয় হাতী আর আফ্রিকায় একটা আফ্রিকান হাতির মধ্যেকার আকর্ষণের চেয়ে বেশি।

 বোঝা গেল ব্যাপারটা তুমি ধরতে পেরেছ। তো, এবার আসছে আসল ব্যাপারটা। নিউটন প্রমাণ করলেন যে এই আকর্ষণ-বা মাধ্যাকর্ষণ-সার্বজনীন, যার অর্থ এটা সব জায়গাতেই ক্রিয়াশীল, মহাশূন্যে গ্রহ-নক্ষত্রগুলোর মধ্যেও। বলা হয়ে থাকে যে, তিনি এই ধারণাটি পেয়েছিলেন একটা আপেল গাছের নিচে বসে থাকা অবস্থায়। একটি আপেলকে গাছ থেকে পড়তে দেখে তিনি ভাবলেন চাঁদকেও পৃথিবী একই শক্তিতে আকর্ষণ করে কিনা এবং এই কারণেই চাঁদ চিরকাল পৃথিবীর চারপাশ দিয়ে ঘুরে চলেছে কিনা।

দারুণ। কিন্তু ততটা দারুণ নয় আসলে।

 কেন নয়, সোফি?

যে-শক্তির কারণে আপেলটা মাটিতে পড়ে সেই শক্তি দিয়ে যদি পৃথিবী চাঁদকে আকর্ষণ করে তাহলে সারা জীবন পৃথিবীর চারপাশে ঘোরার বদলে একদিন সেটা নিশ্চয়ই পৃথিবীর ওপর আছাড় খেয়ে পড়বে।

এইখানেই আসছে গ্রহ-উপগ্রহের কক্ষপথ সংক্রান্ত নিউটনীয় সূত্রের কথা। সেটা কী করে চাঁদকে আকর্ষণ করে সে-ব্যাপারে তোমার কথা শতকরা পঞ্চাশভাগ সঠিক, পঞ্চাশভাগ ভুল। চাঁদ কেন পৃথিবীর গায়ের ওপর পড়ে যায় না? পৃথিবীর যে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি চাঁদকে আকর্ষণ করছে সেটা তো আসলেই প্রচণ্ড। স্রেফ একবার চিন্তা করে দেখো সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা জোয়ারের সময় এক থেকে দুই মিটার বাড়াবার জন্যে কত শক্তি দরকার।

বুঝতে পারছি বলে মনে হচ্ছে না।  

গ্যালিলিও-র সেই আনত তলের কথা মনে করো। আড়াআড়িভাবে ওটার ওপর মার্বেলটা গড়িয়ে দেয়ার পর কী ঘটেছিল?

চাঁদের ওপরেও কি দুটো ভিন্ন শক্তি কাজ করছে?

 ঠিক তাই। সৌরজগৎ-এর যখন জন্ম বা সৃষ্টি হয়েছিল তখন চাঁদ পৃথিবী থেকে বাইরের দিকে প্রচণ্ড শক্তিতে ছিটকে পড়েছিল। এই শক্তিটি চিরকালই কার্যকর থাকবে তার কারণ চাঁদটা বাধাশূন্য একটা ভোলা জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছে…

কিন্তু পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির জন্যে তো চাঁদটা পৃথিবীর দিকেও টান অনুভব করে, তাই না?

ঠিক তাই। দুটো শক্তিই নিত্য আর দুটোই ঠিক একই সঙ্গে কাজ করে। কাজেই চাঁদ পৃথিবীর চারপাশে আবর্তন করেই যাবে।

ব্যাপারটা কি এতোই সরল?

এতোই সরল আর বিশেষ করে এই সরলতা-ই ছিল নিউটনের সার কথা। তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন যে অল্প কিছু প্রাকৃতিক নিয়ম গোটা মহাবিশ্বেই ক্রিয়াশীল। গ্রহগুলোর কক্ষপথ সংক্রান্ত হিসেব নিকেশের সময় তিনি স্রেফ দুটো প্রাকৃতিক নিয়ম-এর সাহায্য নিয়েছেন যে-নিয়ম দুটি তার আগেই গ্যালিলিও প্রস্তাব করে গিয়েছিলেন। তার একটা হচ্ছে জড়তার সূত্র আর সেটাকে নিউটন বর্ণনা করলেন এভাবে: একটি বস্তুর ওপর কোনো বল বা শক্তি প্রয়োগ করা না হলে সেটা স্থির থাকে অথবা সরলরেখা বরাবর চলতে থাকে। অন্য সূত্রটি গ্যালিলিও একটি আনত তলের ওপর পরীক্ষা করে দেখিয়ে গিয়েছিলেন: যখন দুটো শক্তি বা বল একটি বস্তুর ওপর একই সঙ্গে কাজ করে তখন সেটি একটি উপবৃত্তাকার পথে চলে।

তাহলে এভাবেই নিউটন ব্যাখ্যা করতে পারলেন কেন গ্রহগুলো সূর্যের চারপাশে ঘোরে।

হ্যাঁ। সব কটি গ্রহ সূর্যের চারপাশে উপবৃত্তাকার পথে ঘোরে দুটো অসম গতির কারণে: প্রথমত, সৌরজগৎ যখন গঠিত হয়েছিল তখন পাওয়া ওদের সরলরৈখিক গতি আর দ্বিতীয়ত, মাধ্যাকর্ষণজনিত কারণে সূর্যের দিকের গতি।

দারুণ।

নিউটন দেখিয়ে দিলেন যে গোটা মহাবিশ্বেই চলন্ত বস্তুর একই সূত্র প্রযোজ্য। কাজেই, মধ্যযুগীয় যে-বিশ্বাস ছিল যে স্বর্গের জন্য এক সেট সূত্র রয়েছে ওদিকে পৃথিবীর জন্যে রয়েছে আরেক সেট, সেটার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করলেন তিনি। বিশ্ব সম্পর্কে সূর্যকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি এভাবে তার চরম নিশ্চিতি লাভ করল, পেল তার চরম ব্যাখ্যা।

অ্যালবার্টো উঠে আনত তলটা সরিয়ে রাখলেন। তারপর মার্বেলটা নিয়ে সেটাকে রাখলেন তাদের দুজনের মধ্যেকার টেবিলের ওপর।

সোফি ভাবল, স্রেফ একটা বাঁকা কাঠের খণ্ড আর মার্বেল থেকে তারা কত কিছুই না বের করে আনল। এখনো কালি লেগে থাকা সবুজ মার্বেলটার দিকে তাকিয়ে সে পৃথিবী নামক গোলকটার কথা চিন্তা না করে পারল না। সে বলল, তাহলে মানুষকে এ-কথা মেনে নিতে হলো যে তারা মহাশূন্যের কোথাও আর দশটা গ্রহের মতো একটা গ্রহে বাস করছে?

হ্যাঁ। তবে নতুন এই বিশ্বচিত্রটা অনেক দিক থেকেই একটা সমস্যা হয়ে দেখা দিল। মানব জাতির উদ্ভব হয়েছে জীব-জন্তু থেকে, ডারউইন যখন এ-কথা প্রমাণ। করেছিলেন তখন যে-ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল এই পরিস্থিতিটাও অনেকটা সে-রকম হয়ে দাঁড়াল। সৃষ্টির জগতে মানুষের যে একটা বিশেষ মর্যাদা ছিল এই দুই ক্ষেত্রেই তার খানিকটা ক্ষুণ্ণ হলো। আর, এই দুই ক্ষেত্রেই প্রবল বাধা এলো খ্রিস্টিয় গির্জার কাছ থেকে।

সেটা আমি বেশ ভালোই বুঝতে পারছি। কারণ, এ-সবের মধ্যে আর ঈশ্বরের। ভূমিকাটা রইল কোথায়? পৃথিবী যখন কেন্দ্রে ছিল, ঈশ্বর আর গ্রহগুলো স্বর্গে বা ওপরে, তখনই ব্যাপারটা এখনকার চেয়ে সহজ-সরল ছিল।

কিন্তু সেটাই কিন্তু সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল না। নিউটন যখন প্রমাণ করলেন যে মহাবিশ্বের সব জায়গাতেই একই প্রাকৃতিক নিয়ম বা সূত্র কাজ করে তখন যে কারো পক্ষে এ-কথা ভাবা সম্ভব ছিল যে এতে করে তিনি ঈশ্বরের সর্বশক্তিমানতায় মানুষের বিশ্বাসকে খর্ব করছেন। কিন্তু নিউটনের নিজের বিশ্বাস কিন্তু এতটুকু ধাক্কা খায়নি। প্রাকৃতিক নিয়ম বা সূত্রগুলোকে তিনি সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ হিসেবেই ধরে নিয়েছিলেন। তবে এটা হতে পারে যে মানুষ নিজেকে যে চোখে দেখতো সেখানে একটা গণ্ডগোল ঘটে গিয়েছিল।

ঠিক কীভাবে?

রেনেসাঁ-র সময় থেকেই একটা বিশাল গ্যালাক্সির আর দশটা গ্রহের মতো একটা গ্রহের বাসিন্দা হিসেবে নিজেদেরকে গণ্য করায় অভ্যস্ত হয়ে উঠতে হয়েছিল মানুষকে। আমি ঠিক নিশ্চিত নই এখনো আমরা সবাই ব্যাপারটা মেনে নিতে পেরেছি কিনা। তবে সেই রেনেস-র সময়েই কিন্তু কিছু লোক বলেছিল যে এই নতুন দৃষ্টিভঙ্গির ফলে প্রতিটি মানুষই আগের চেয়ে আরো বেশি করে কেন্দ্রীয় অবস্থানে চলে এসেছে।

ঠিক বুঝলাম না।

আগে পৃথিবী-ই ছিল জগতের কেন্দ্র। কিন্তু জ্যোতির্বিদরা এবার যে-ই বললেন যে মহাবিশ্বের পরম কোনো কেন্দ্র নেই, লোকে ভাবতে লাগল যে তাহলে যত জন। মানুষ ততগুলোই কেন্দ্র। প্রতিটি মানুষই তাহলে মহাবিশ্বের কেন্দ্র হতে পারে।

ও, বুঝেছি।

রেনেসা জন্ম দিল এক নতুন ধর্মর্ভাব (new religiosity)-এর। দর্শন এবং বিজ্ঞান ধীরে ধীরে ঈশ্বরতত্ত্ব থেকে দূরে সরে যেতে এক নতুন খ্রিস্টিয় ধার্মিকতা তৈরি হয়েছিল। এরপর রেনেসাঁ এলো মানুষ সম্পর্কে তার নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। এর প্রভাব পড়ল গিয়ে জীবনের ওপর। ঈশ্বরের সঙ্গে একজন মানুষের ব্যক্তিগত সম্পর্ক এখন অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল মানুষের সঙ্গে একটি সংগঠন হিসেবে গির্জার সম্পর্কের চাইতে।

এই যেমন রাতের বেলা প্রার্থনা করা, তাই না?

হ্যাঁ, সেটাও। মধ্যযুগীয় ক্যাথলিক চার্চে লাতিন ভাষায় লেখা গির্জার প্রার্থনা বিধি আর গির্জার শাস্ত্রীয় আচার মাফিক প্রার্থনা-ই ছিল ধর্মোপাসনা অনুষ্ঠানের মেরুদণ্ড। পাদ্রী আর সন্ন্যাসীরাই কেবল বাইবেল পড়তেন, তার কারণ লাতিন ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় লেখা বাইবেলের অস্তিত্ব ছিল না। কিন্তু রেনেসাঁ-র সময় হিব্রু আর গ্রীক ভাষা থেকে বিভিন্ন জাতীয় ভাষায় বাইবেল অনূদিত হয়। আমরা যাকে রিফর্মেশনবলি তার মূল ব্যাপারটি ছিল এই…

মার্টিন লুথার…

হ্যাঁ, মার্টিন লুথারও (Martin Luther) গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু তিনিই একমাত্র সংস্কারক ছিলেন না। যাজকীয় কিছু সংস্কারকও ছিলেন যাঁরা রোমান ক্যাথলিক চার্চের সঙ্গেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তাঁদের একজন হলেন STTALIONI 17670717 (Erasmus of Rotterdam) i

ইভালজেন্স কিনতে রাজি ছিলেন না বলে ক্যাথলিক চার্চ থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন লুথার, ঠিক বলিনি?

হ্যাঁ, সেটা ছিল অনেক কারণের একটা কারণ। কিন্তু তারচেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ একটা কারণ ছিল। লুথারের মতে, ঈশ্বরের ক্ষমা পাওয়ার জন্যে গির্জা কিংবা গির্জার পাদ্রীদের মধ্যস্থতা মানুষের দরকার নেই। তাছাড়া গির্জা থেকে ইন্ডালজেন্স (idulgence) কেনার ওপরেও ঈশ্বরের ক্ষমা পাওয়া নির্ভর করে না। যোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকেই এ-সব ইন্ডালজেন্স কেনা-বেচা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ক্যাথলিক চার্চ।

ঈশ্বর নিশ্চয়ই তাতে খুশি হয়েছিলেন।

মোটের ওপর, মধ্য যুগের যাজকীয় ইতিহাস-নির্ভর বেশ কিছু ধর্মীয় প্রথা ও রীতি নীতি থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে এনেছিলেন লুথার। তিনি ফিরে যেতে চেয়েছিলেন আদি খ্রিস্টধর্মে, নিউ টেস্টামেন্টে যেমনটা লেখা আছে তাতে। তিনি বললেন, শুধু বাইবেল-ই যথেষ্ট। এই শ্লোগানের সাহায্যে তিনি খ্রিস্টধর্মের উৎসে ফিরে যেতে চাইছিলেন। ঠিক যেমন রেনেসাঁর মানবতাবাদীরা ফিরে যেতে চাইছিলেন শিল্পকলা এবং সংস্কৃতির প্রাচীন উৎসে। লুথার জার্মান ভাষায় বাইবেল অনুবাদ করলেন এবং এর মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠিত হলো জার্মান লেখ্য ভাষা। তিনি বিশ্বাস করতেন, প্রতিটি মানুষেরই বাইবেল পড়তে পারা উচিত, যাতে করে প্রত্যেকেই নিজের নিজের পাদ্রী হতে পারে।

নিজের পাত্রী? ব্যাপারটা একটু বেশী হয়ে গেল না?

তিনি যা বোঝাতে চেয়েছিলেন তা হলো ঈশ্বর-সম্পৃক্ত ব্যাপারে পাদ্রীদের সে রকম কোনো সুবিধেজনক অবস্থান নেই। লুথারান ধর্মসভায় পাদ্রীরা কেবল ব্যবহারিক কাজ-কর্ম করার জন্যে নিয়োজিত হতেন, যেমন ধর্মসভা পরিচালনা করা বা দৈনন্দিন করণিক কাজগুলো সম্পাদন করা। কিন্তু গির্জায় ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করে কেউ ঈশ্বরের ক্ষমা লাভ করে বা পাপমুক্ত হয় সে-কথা লুথার বিশ্বাস করতেন না। তিনি বলতেন, মানুষ নিঃশর্ত ক্ষমা বা মোক্ষ লাভ করে কেবল বিশ্বাসের মাধ্যমে। আর এই বিশ্বাসে তিনি উপনীত হয়েছিলেন বাইবেল পড়ে।

লুথার তাহলে আদর্শ রেনেসাঁ মানব ছিলেন?

হ্যাঁ এবং না। ব্যক্তি আর ব্যক্তির সঙ্গে ঈশ্বরের ব্যক্তিগত সম্পর্কের ওপর গুরুত্ব প্রদান তার একটি রেনেসাঁ বৈশিষ্ট্যসূচক দিক। সেজন্যে তিনি পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে গ্রীকভাষা শিখে প্রাচীন গ্রীক ভাষায় লেখা বাইবেল জার্মান ভাষায় অনুবাদ করার পরিশ্রমসাধ্য কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। যার যার মাতৃভাষাকে লাতিনের ওপর অগ্রাধিকার দেয়ার বিষয়টিও রেনেসাঁর একটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ দিক। কিন্তু লুথার ঠিক ফিসিনো বা লিওনার্দো দা ভিঞ্চির (Leonardo da Vinci) মতো মানবতাবাদী ছিলেন না। রটারডামের ইরাজমাসের মতো মানবতাবাদীরা লুথারের বিরুদ্ধাচারণ করেছিলেন, তার কারণ তাঁরা মনে করতেন মানুষ সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি অনেক নেতিবাচক; লুথার ঘোষণা করেছিলেন যে মোক্ষলাভের অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার পর (Fall from Grace) থেকে মানবজাতি পুরোপুরি নীতিভ্রষ্ট হয়ে পড়েছে। তিনি বিশ্বাস করতেন, কেবলমাত্র ঈশ্বরের অনুগ্রহের মাধ্যমেই মানবজাতি তার আগের রূপে ফিরে আসতে পারে। কারণ পাপের প্রাপ্য হচ্ছে মৃত্যু।

এটাতো কেমন মন-খারাপ-করা কথা হয়ে গেল।

উঠে দাঁড়ালেন অ্যালবার্টো নক্স। ছোট, সবুজ-কালো মার্বেলটা তুলে নিয়ে সেটা নিজের টপ পকেটে রাখলেন তিনি।

চারটার বেশি বাজে আতংকিত স্বরে বলে উঠল সোফি।

মানুষের ইতিহাসে এরপরের বড় যুগটা হলো বারোক (Baroque) যুগ। কিন্তু সেটা অন্য কোনো দিনের জন্যে তোলা থাকল, প্রিয় হিল্ডা আমার।

কী বললেন আপনি যে-চেয়ারে বসে ছিল সে সেখান থেকে তড়াক করে লাফিয়ে উঠল সোফি। আপনি আমাকে হিল্ডা বলে ডেকেছেন!

ওটা একটা মারাত্মক স্লিপ অভ দ্যা টাং!

স্লিপ অভ দ্যা টাং কিন্তু কখনোই একেবারে অকারণে হয় না!

হয়ত তোমার কথাই ঠিক। খেয়াল করেছ নিশ্চয়ই যে হিল্ডার বাবা আমাদের মুখে কথা বসিয়ে দিতে শুরু করেছে। আমার মনে হয় আমরা যে খুব উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছি আর আমাদেরকে রক্ষা করার তেমন একটা চেষ্টা করছি না, সে এই ব্যাপারটিরই সুযোগ নিচ্ছে।

আপনি একবার বলেছিলেন আপনি হিল্ডার বাবা নন। কথাটা কি আসলেই সত্যি?

 অ্যালবার্টো মাথা ঝাঁকালেন।

কিন্তু আমি কি হিল্ডা?

আমি ক্লান্ত বোধ করছি, সোফি। তোমাকে সেটা বুঝতে হবে। দুই ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে এখানে বসে রয়েছি আমরা। আর কথাবার্তার বেশির ভাগটা বলছি আমি-ই। তুমি বাসায় যাবে না, খাবে না?  

সোফির মনে হলো অ্যালবার্টো তাকে এক রকম তাড়িয়েই দিচ্ছেন। ছোট্ট হলঘরটায় ঢোকার পর সে খুব করে ভাবল উনি কেন ওই ভুলটা করলেন। অ্যালবার্টো-ও সোফির পিছু পিছু বেরিয়ে এলেন।

ছোট্ট এক সারি খুঁটার ওপর অদ্ভুত কিছু কাপড়-চোপড় ঝুলছে, দেখতে সেগুলো অনেকটা থিয়েটারি পোশাক-এর মতো; তো, সেই খুঁটাগুলোর নিচে গভীর ঘুমে মগ্ন হার্মেস। কুকুরটার দিকে মাথা ঝাঁকিয়ে অ্যালবার্টো বললেন,

ও গিয়ে তোমাকে নিয়ে আসবে।

আমার আজকের পড়াটার জন্য ধন্যবাদ, সোফি বলল।

আন্তরিকভাবে আলিঙ্গন করল সে অ্যালবার্টোকে। আমার দর্শন শিক্ষকদের মধ্যে আপনিই সবচেয়ে ভালো আর সবচেয়ে সহানুভূতিশীল। বলল সে।

এই কথা বলে সিঁড়ির দরজা মেলে ধরল সে। দরজা বন্ধ হতে হতে সে শুনতে পেলো অ্যালবার্টো বলে উঠেছেন, শিগগিরই আবার দেখা হবে আমাদের, হিল্ডা।

ওই কথাগুলো নিয়েই চলে এলো সোফি।

আরেকটা স্লিপ অভ দ্য টাং। পাজী! একবার তার খুব ইচ্ছে হলো ঘুরে দাঁড়িয়ে দড়াম দড়াম করে ঘা লাগায় দরজায়, কিন্তু কী একটা যেন কাজটা থেকে নিবৃত্ত করল তাকে।

রাস্তায় পৌঁছে তার খেয়াল হলো পকেটে তার একটা পয়সাও নেই। পুরো পথটা এখন হেঁটে যেতে হবে তাকে। কী বিরক্তিকর! ছটার মধ্যে পৌঁছাতে না পারলে তার মা তো নির্ঘাত রেগে যাবেনই, চিন্তাও করবেন।

কয়েক গজও যেতে পারেনি সে এমন সময় সাইডওয়াকের ওপর হঠাৎ একটা পয়সা পড়ে থাকতে দেখল সে। দশ ক্রাউনের পয়সা বাসের টিকেট কিনতে ঠিক দশ ক্রাউনই লাগবে।

বাস স্টপের দিকে পা চালাল সোফি, তারপর মেইন স্কোয়্যারের বাসের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। ওখান থেকে একই টিকেট দেখিয়ে সে আরেকটা বাসে চড়ে প্রায় তাদের বাড়ির দরজা পর্যন্ত পৌঁছে যেতে পারবে।

মেইন স্কোয়্যারে দাঁড়িয়ে দ্বিতীয় বাসটার জন্যে অপেক্ষা করার আগ পর্যন্ত তার মাথায় এই চিন্তাটা এলো না যে তার যে-পয়সাটা দরকার ছিল ঠিক সেটাই সে কেন পেয়ে গেল বরাত জোরে।

তাহলে কি হিল্ডার বাবাই পয়সাটা রেখে গিয়েছিলেন পথের ওপর? সবচেয়ে সুবিধেজনক জায়গায় জিনিস-পত্র রেখে দেয়ার ব্যাপারে অবশ্য লোকটা একটা প্রতিভা।

কিন্তু তিনি যদি লেবাননে থাকেন তাহলে কাজটা তাঁর পক্ষে কী করে সম্ভব?

তাছাড়া, অ্যালবার্টো-ই বা ওই ভুলটা করলেন কেন? একবার না, দুবার।

কেঁপে উঠল সোফি। মনে হলো, শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত নিচে নেমে গেল তার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *