৩০. ডারউইন
… একটি জাহাজ যা জিন-এর কার্গো নিয়ে ভেসে চলেছে জীবনের ভেতর দিয়ে..
রোববার সকালে জোরে একটা ধপাস শব্দে ঘুম ভেঙে গেল হিল্ডার। রিং বাইন্ডারটা মেঝেতে পড়ে গেছে। বিছানায় শুয়ে মার্ক্স সম্পর্কে সোফি আর অ্যালবার্টোর আলাপ-এর কথা পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছিল সে। বিছানার পাশের রিডিং ল্যাম্পটা সারা রাত ধরেই জ্বলা ছিল।
তার ডেস্কের ওপর রাখা অ্যালার্ম ঘড়ির জ্বলজ্বলে সবুজ আলো বলছে ৮:৫৯।
বিশাল বিশাল সব কারখানা আর দূষিত শহরের স্বপ্ন দেখছিল সে এতোক্ষণ; রাস্তার এক কোণে বসে ছোট্ট একটি মেয়ে দেশলাই বিক্রি করছে, লম্বা লম্বা কোট পরা সুবেশী লোকজন পাশ দিয়ে চলে যাওয়ার সময় ফিরেও তাকাচ্ছে না তার দিকে।
বিছানায় উঠে বসতে সেই আইন প্রণেতাদের কথা মনে পড়ে গেল হিল্ডার যারা তাদেরই গড়া একটা সমাজে জেগে উঠেছিলেন। হিল্ডা অবশ্য বিয়ার্কলেতে জেগে উঠতে পেরেই খুশি হলো।
নরওয়ের কোথায় সে জেগে উঠবে সে-কথা না জেনে নরওয়েতে জেগে ওঠার সাহস হতো তার?
তবে এটা শুধু কোথায় সে জেগে উঠবে সে-প্রশ্ন নয়। ঠিক অমনই অনায়াসে সে কি অন্য যুগেও জেগে উঠতে পারতো না? এই যেমন মধ্য যুগে অথবা বিশ হাজার বছর আগেকার প্রস্তর যুগে? হিল্ডা কল্পনা করার চেষ্টা করল সে একটা গুহার প্রবেশমুখে বসে আছে, হয়ত একটা পশুর চামড়া পরিষ্কার করছে।
যখন সংস্কৃতি বলে কিছু তৈরিই হয়নি এমন একটা সময়ে পনেরো বছর বয়েসী একটি মেয়ে হওয়াটা কেমন হতো? কীভাবে চিন্তা-ভাবনা করতো সে? তার কি আদৌ কোনো চিন্তা-ভাবনা থাকতো?
একটা সোয়েটার টেনে নিল সে, রিং বাইন্ডারটা তুলল কষ্ট করে, তারপর স্থির হয়ে বসল পরের চ্যাপ্টারটা পড়ার জন্যে।
অ্যালবার্টো সবে মাত্র বলেছে পরের চ্যাপ্টার এমন সময় মেজরের কেবিনের দরজায় টোকা দিল কেউ।
আমাদের কোনো উপায় নেই, আছে? সফি জিগ্যেস করল।
না, আমার মনে হয় নেই। অ্যালবার্টো বললেন।
বাইরের সিঁড়িতে লম্বা সাদা চুল আর দাড়িঅলা এক অতি বৃদ্ধ লোক দাঁড়িয়ে। তার এক হাতে একটা লাঠি অন্য হাতে একটা বোর্ড, তাতে একটা নৌকোর ছবি আঁকা। নৌকোটা সব ধরনের জীব-জন্তুতে ভর্তি।
তা এই বয়স্ক ভদ্রলোক কে? জিগ্যেস করলেন অ্যালবার্টো।
আমার নাম নোয়া।
সে-রকমই আন্দাজ করেছিলাম।
তোমাদের প্রাচীনতম পূর্ব পুরুষ আমি, বাবা। তবে পূর্ব-পুরুষদের পরিচয় স্বীকার করার রেওয়াজ বোধহয় এখন আর নেই।
আপনার হাতে ওটা কী? সোফি জিগ্যেস করল।
এটা হচ্ছে প্লাবনের হাত থেকে যত প্রাণী বেঁচে গিয়েছিল সেগুলোর ছবি। এই যে, মা, এটা তোমার জন্যে।
হাত বাড়িয়ে বড় বোর্ডটা নিল সোফি।
আমি বরং বাড়ি যাই, আঙুরলতাগুলোর দেখভাল করি গে, বৃদ্ধ লোকটি বললেন, তারপর ছোট্ট একটা লাফ দিয়ে তিনি শূন্যে তার গোড়ালিদুটো এক করে এখনকার বা তখনকার যে-কোনো যুগেরই অতি বৃদ্ধ লোকের পক্ষে অদ্ভুত ধরনে আনন্দে লাফাতে লাফাতে বনের মধ্যে হারিয়ে গেলেন।
সোফি আর অ্যালবার্টো ভেতরে গিয়ে বসল আবার। ছবিটা দেখতে লাগল সোফি। কিন্তু সেটা সে ভালো করে দেখার সুযোগই পেল না, তার আগেই কর্তৃত্বপরায়ণ একটা থাবায় ওর হাত থেকে সেটা কেড়ে নিলেন অ্যালবার্টো।
ব্রড আউট লাইনগুলোর ওপর মনোযোগ দেবো আমরা প্রথমে।
ঠিক আছে, ঠিক আছে।
আমি বলতে ভুলে গেছি যে মার্ক্স তাঁর জীবনের শেষ ৩৪ বছর লন্ডনে কাটিয়েছিলেন। ১৮৪৯-এ সেখানে গিয়েছিলেন তিনি আর মারা গিয়েছিলেন ১৮৮৩-তে। এই গোটা সময় জুড়েই লন্ডনের একটু বাইরেই বাস করতেন চালর্স ডারউইন (Charles Darwin)। তিনি মারা যান ১৮৮২ সালে। মহা জাকজমক আর আনুষ্ঠানিকতার সঙ্গে ওয়েস্টমিন্সটার অ্যাবেতে কবর দেয়া হয় তাকে। অর্থাৎ মার্ক্স এবং ডারউইনের পথ পরস্পরের সঙ্গে মিশেছিল, যদিও কেবল কাল আর স্থান এই দুটি ক্ষেত্রে নয়। মার্ক্স তাঁর সবচেয়ে বড় কাজ ক্যাপিটাল এর ইংরেজি সংস্করণ ডারউইনের নামে উৎসর্গ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ডারউইন সে-সম্মান গ্রহণ করতে রাজি হননি। ডারউইনের মৃত্যুর পরের বছর মার্ক্স মারা গেলে তাঁর বন্ধু এঙ্গেলস মন্তব্য করেন: ডারউইন যেমন জৈব বিবর্তনের তত্ত্ব আবিষ্কার করেছেন, তেমনি মাও মানবজাতির ঐতিহাসিক বিবর্তনের তত্ত্ব আবিষ্কার করেছেন।
আচ্ছা।
আরেকজন বড় চিন্তাবিদ যিনি নিজের কাজকে ডারউইনের সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন তিনি হচ্ছেন মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েড। তিনিও লন্ডনেই কাটিয়েছেন তাঁর শেষ জীবন। ফ্রয়েড বলেছেন ডারউইনের বিবর্তনবাদ আর তার নিজের মনোসমীক্ষণ, এই দুই-ই মানুষের সরল অহংবাদের প্রতি একটা প্রতিবাদ হিসেবে দেখা দিয়েছে।
এক সঙ্গে অনেক নাম হয়ে গেলো তো। আমরা কি মার্ক্স, ডারউইন না ফ্রয়েড সম্পর্কে আলাপ করছি?
এক বৃহত্তর অর্থে আমরা উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে একেবারে আমাদের সময় পর্যন্ত একটা প্রাকৃতিক ধারার কথা বলতে পারি। প্রাকৃতিক বলতে আমরা এমন এক বাস্তব বোধের কথা বোঝাচ্ছি যা প্রকৃতি আর ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ ছাড়া অন্য কোনো বাস্তবতা গ্রহণ করে না। একজন প্রকৃতিবাদী অতএব তিনিই যিনি মানবজাতিকে প্রকৃতিরই অংশ বলে মনে করেন। একজন প্রকৃতিবাদী দার্শনিক প্রাকৃতিক ব্যাপার-স্যাপারের ওপরই পুরোপুরি নির্ভর করবেন, বুদ্ধিবৃত্তির অনুমানের ওপরও নয় বা কোনো ধরনের স্বর্গীয় রহস্যোদঘাটনের ওপরেও নয়।
মার্ক্স, ডারউইন আর ফ্রয়েড-এর বেলাতে বুঝি এ-কথা প্রযোজ্য?
পুরোপুরি। গত শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হিসেবে শোনা যাচ্ছিল প্রকৃতি, পরিবেশ, ইতিহাস, বিবর্তন আর ক্রমবিকাশ, এই শব্দগুলো। মার্ক্স আগেই দেখিয়ে গিয়েছিলেন যে মানব আদর্শগুলো সমাজের ভিত্তিরই সৃষ্টি। ডারউইন দেখালেন যে মানবজাতি একটি ধীর জীববিজ্ঞানসংক্রান্ত বিবর্তনের ফল আর মনের নির্জন স্তর সম্পর্কে ফ্রয়েডের পর্যবেক্ষণ জানালো যে মানুষের কাজ-কর্ম প্রায়শই জান্তব উদ্দীপনা বা সহজাত প্রবৃত্তির ফল।
প্রাকৃতিক বলতে আপনি কী বোঝাতে চাইছেন আমি তা মোটামুটি বুঝতে পারছি। কিন্তু একবারে একজনকে নিয়ে বললেই সবচেয়ে ভালো হতো না?
আমরা ডারউইনের কথা আলাপ করবো, সোফি। তোমার হয়ত মনে পড়বে যে সক্রেটিস-পূর্ব দার্শনিকেরা প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াগুলোর প্রাকৃতিক ব্যাখ্যার অনুসন্ধান করেছিলেন। ঠিক যেভাবে তাদেরকে প্রাচীন পৌরাণিক ব্যাখ্যাগুলো থেকে নিজেদের সরিয়ে আনতে হয়েছিল, ঠিক সেভাবে ডারউইনকেও মানুষ এবং জীব-জন্তু সৃষ্টি সম্পর্কে গির্জার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে হয়েছিল।
কিন্তু তাকে কি একজন প্রকৃত দার্শনিক বলা যায়?
ডারউইন ছিলেন একজন জীববিজ্ঞানী এবং একজন প্রকৃতিবাদী বিজ্ঞানী। কিন্তু সেই সঙ্গে তিনি সাম্প্রতিক সময়ের একজন বিজ্ঞানী যিনি একেবারে খোলাখুলিভাবে সৃষ্টির জগতে মানুষের অবস্থান সম্পর্কে বাইবেলের দৃষ্টিভঙ্গিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন।
কাজেই ডারউইনের বিবর্তনবাদ সম্পর্কে কিছু বলতে হচ্ছে আপনাকে।
মানুষ ডারউইনকে দিয়েই শুরু করা যাক। ১৮০৯ সালে ছোট্ট শহর সবেরিতে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তাঁর বাবা ডা. রবার্ট ডারউইন ছিলেন একজন বিখ্যাত স্থানীয় চিকিৎসক আর সন্তানের লালন-পালনের ব্যাপারে খুবই কড়া। চার্লস যখন স্থানীয় গ্রামার স্কুলের ছাত্র, সেখানকার হেডমাস্টার তাকে বর্ণনা করেছিলেন সারাক্ষণ হেথায়-হোথায় ঘুরে বেড়ানো কেজো-অকেজো নানান জিনিস নিয়ে খেলে বেড়ানো, কিন্তু কাজে লাগে এমন সামান্য জিনিসও না-করা একটা ছেলে হিসেবে। কাজে লাগে এমন জিনিস বলতে হেডমাস্টার সাহেব বুঝিয়েছিলেন গ্রীক আর ল্যাটিন ক্রিয়াপদ মুখস্ত করা। ঘুরে বেড়ানো বলতে তিনি অন্যান্য জিনিসের মধ্যে এই বিষয়টিকে বুঝিয়েছিলেন যে চার্লস বিচিত্র সব গুবরে পোকা সংগ্রহ করে বেড়াতেন সম্ভব অসম্ভব নানান জায়গায় টু মেরে।
বাজি ধরে বলতে পারি কথাগুলো বলেছিলেন বলে পরে আফসোেস হয়েছিল তার।
শেষ পর্যন্ত যখন ঈশ্বরতত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা শুরু করলেন তখনো কিন্তু পাখি পর্যবেক্ষণ আর পোকা-মাকড় সংগ্রহেই বেশি উৎসাহ ডারউনেরর। ফলে ঈশ্বরতত্ত্বে বেশি ভালো গ্রেড পেলেন না তিনি। তবে কলেজের ছাত্র থাকাকালীনই একজন প্রাকৃতিক বিজ্ঞানী হিসেবে সুনাম অর্জন করে ফেলেন তিনি, বিশেষ করে ভূতত্ত্ব সম্পর্কে তার উৎসাহের কারণে আর ভূতত্ত্ব ছিল সম্ভবত সে-সময়কার সবচেয়ে বিকাশমান বিজ্ঞান। ১৮৩১ সালের এপ্রিল মাসে ঈশ্বরতত্ত্বে স্নাতক হওয়ার পর পাথরের গঠন নিয়ে পড়াশোনা করতে আর ফসিল খুঁজতে নর্থ ওয়েলস্ যান তিনি। সেই বছরেরই অগাস্ট মাসে, তাঁর বয়স যখন সবে বাইশ, একটা চিঠি পেলেন তিনি। সেই চিঠিই নির্দিষ্ট করে দিল তাঁর গোটা জীবনের গতিপথ…
কী লেখা ছিল চিঠিটাতে?
চিঠিটা লিখেছিলেন তার বন্ধু এবং শিক্ষক জন স্টিভেন হেনস্লো। তিনি লিখেছিলেন: আমাকে অনুরোধ করা হয়েছে … আমি যেন ক্যাপ্টেন ফিটসরয়, যিনি সরকার কর্তৃক দক্ষিণ আমেরিকার দক্ষিণ উপকূল জরিপ করার জন্যে সরকারীভাবে নিযুক্ত হয়েছেন, তাঁর সফর সঙ্গী হিসেবে একজন প্রকৃতিবিদকে সুপারিশ করি। আমি বলেছি এ-রকম দায়িত্বভার গ্রহণ করার মতো আমার চেনা সবচেয়ে উপযুক্ত মানুষ হিসেবে আমি তোমাকেই মনে করি। কাজটার অর্থ-কড়ি সংক্রান্ত ব্যাপারে আমার কিছু বলবার নেই। অভিযানটি দুবছর স্থায়ী হওয়ার কথা…?
এতো কথা আপনি মনে রাখেন কীভাবে?
তুচ্ছ ব্যাপার, সোফি।
তো, উত্তরে ডারউইন কী বললেন?
তিনি তো সুযোগটা একেবারে লুফে নিতে চাইছিলেন, কিন্তু সে-সময়ে কমবয়েসী ছেলেরা বাবা-মার অনুমতি ছাড়া কিছু করতো না। অনেক কাকুতি মিনতির পর শেষ পর্যন্ত তাঁর বাবা রাজি হলেন। এবং ছেলের অভিযাত্রার জন্যে তিনিই টাকা দিলেন। অর্থ-কড়ির ব্যাপারটা কী হবে সেটা পরিষ্কার বোঝা গিয়েছিল সেটার অনুপস্থিতি থেকেই।
আহা।
জাহাজটা ছিল নৌবাহিনীর এইচএমএস বীল (Beagle)। ১৮৩১ সালের ২৭শে ডিসেম্বর প্রাইমাউথ থেকে যাত্রা শুরু করেছিল সেটা দক্ষিণ আমেরিকার উদ্দেশে এবং ১৮৩৬ সালের অক্টোবর-এর আগে সেটা ফিরে আসেনি। দুবছরের অভিযান গিয়ে দাঁড়াল পাঁচ বছরে আর দক্ষিণ আমেরিকা ভ্রমণ হয়ে দাঁড়াল গোটা দুনিয়া পরিভ্রমণ। আবিষ্কারের সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভ্রমণগুলোর একটির কথা বলছি আমার এখন।
সারা দুনিয়া পরিভ্রমণ করেছিলেন তারা?
হা। প্রায় আক্ষরিক অর্থেই। দক্ষিণ আমেরিকা থেকে প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকা গেলেন তারা। তারপর দক্ষিণ আমেরিকায় ফিরে এসে যাত্রা করলেন ইংল্যান্ডের উদ্দেশে। ডারউইন লিখেছেন বীগল জাহাজে করে যে-ভ্রমণ তিনি করেছিলেন তা নিঃসন্দেহে তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।
সমুদ্রের মধ্যে প্রকৃতিবিদের কাজটা খুব একটা সহজ হয়নি নিশ্চয়ই।
গোড়ার দিকে কয়েক বছর বগল দক্ষিণ আমেরিকার উপকূল বরাবর এ-মাথা ও-মাথা ঘুরে বেড়িয়েছে। তাতে করে ডারউইন মহাদেশটার সঙ্গে আর স্থলভূমির সঙ্গেও, পরিচিত হওয়ার যথেষ্ট সুযোগ পেয়েছেন। অভিযানের সময় দক্ষিণ আমেরিকার প্রশান্ত মহাসাগরীয় পশ্চিমে গ্যালাপেগস দ্বীপগুলোতে বেশ কয়েকবার চুঁ মারাটাও যুগান্তকারী ভূমিকা রেখেছিল। বেশ কিছু জিনিস সংগ্রহ করে ইংল্যান্ডে পাঠাতে পেরেছিলেন তিনি। তবে, প্রকৃতি আর প্রাণের বিবর্তন সম্পর্কে নিজের চিন্তা–ভাবনা তিনি কারো কাছে প্রকাশ করলেন না। সাতাশ বছর বয়েসে বাড়ি ফিরে দেখলেন বিজ্ঞানী হিসেবে বিখ্যাত হয়ে গেছেন। একসময় যা তার বিবর্তনবাদ বলে পরিচিতি লাভ করবে সে-সম্পর্কে সে-সময়ে তার মনের মধ্যে একটা পরিষ্কার চিত্র ছিল। কিন্তু ফিরে আসার অনেক পরে সেটা প্রকাশ করেন তিনি, কারণ ডারউইন ছিলেন সতর্ক মানুষ, একজন বিজ্ঞানীর ঠিক যেমনটি হওয়া উচিত।
তা, তাঁর প্রধান কাজ কী?
সত্যি বলতে কী, অনেক। কিন্তু ইংল্যান্ডে যে-বইটি সবচেয়ে উত্তপ্ত বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল সেটা হচ্ছে ১৮৫৯ সালে প্রকাশিত দি অরিজিন অভ স্পীশীজ। বইটার পুরো নাম হচ্ছে অন দি অরিজিন অত্ স্পীশীজ বাই মিনস অ ন্যাচরাল সিলেকশন, অর দ্য প্রিজার্ভেশন অভ ফেভার রেইসেজ ইন দ্য স্ট্রাগল ফর লাইফ। লম্বা নামটা আসলে ডারউইনের তত্ত্বের একটা পূর্ণ সার-সংক্ষেপ।
একটা নামের মধ্যে আসলে অনেক কিছু পুরে দিয়েছিলেন তিনি।
তবে সবটা একবারে না দেখে নামটার একেকটা অংশের দিকে নজর দেয়া যাক। প্রথমত, তিনি প্রস্তাব করলেন যে সব ধরনের উদ্ভিদ এবং প্রাণী উদ্ভূত হয়েছে পূর্বতন আরো আদিম নমুনাগুলো থেকে বায়োলজিকাল বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে। দ্বিতীয়ত, তিনি বললেন, বিবর্তনটি প্রাকৃতিক নির্বাচন-এর ফল।
দ্য সারভাইভাল অভ দ্য ফিটেস্ট, ঠিক না?
সেটা ঠিক, তবে গোড়াতেই বিবর্তনের ধারণাটার ওপর একটু নজর দেয়া যাক। এটা কিন্তু একেবারে মৌলিক কোনো ধারণা নয়। জীববিজ্ঞানসংক্রান্ত বিবর্তনের ধারণা কোনো কোনো পরিমণ্ডলে বেশ সাদরেই গৃহীত হচ্ছিল সেই ১৮০০ সাল থেকে। এই ধারণাটির নেতৃত্বস্থানীয় মুখপাত্র ছিলেন ফরাসী প্রাণীবিজ্ঞানী লামার্ক (Lamarck)। এমনকী তারও আগে ডারউনের-ই দাদা ইরাজমাস ডারউইন (Erasmus Darwin) এ-রকম একটি কথা বলেছিলেন যে উদ্ভিদ এবং প্রাণীর উদ্ভব ঘটেছিল কিছু আদিম প্রজাতি থেকে। কিন্তু এই বিবর্তন কীভাবে হয়েছিল সে ব্যাপারে এঁদের কেউই গ্রহণযোগ্য কোনো ব্যাখ্যা দিতে এগিয়ে আসেননি। কাজেই পাদ্রীরা তাদেরকে বড় কোনো হুমকি বলে গণ্য করেনি।
কিন্তু ডারউইন তাদের জন্যে হুমকি ছিলেন বুঝি?
হ্যাঁ, তাই এবং সেটা বিনা কারণে নয়। যাজকীয় এবং বৈজ্ঞানিক মহলে উদ্ভিদ এবং প্রাণী জগতের সমস্ত প্রজাতির অপরিবর্তনীয়তার বাইবেলিয় মতই মানা হতো। প্রত্যেকটি প্রাণী জীবন আলাদা আলাদাভাবে একবারই এবং শেষবারের মতো তৈরি করা হয়েছে। খ্রিস্টিয় এই দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্য প্লেটো আর অ্যারিস্টটলের মতবাদের সঙ্গেও সঙ্গতিপূর্ণ।
কীভাবে?
প্লেটোর ভাবতত্ত্বে ধরেই নেয়া হয়েছে যে সমস্ত প্রাণী প্রজাতি অপরিবর্তনীয়, কারণ সেগুলো তৈরি হয়েছে শাশ্বত ভাব বা আকারের ছবি বা নকশা অনুযায়ী। প্রাণী প্রজাতির অপরিবর্তনীয়তা অ্যারিস্টটলের দর্শনেরও একটি প্রধান স্তম্ভ। কিন্তু ডারউইনের সময় বেশ কিছু পর্যবেক্ষণ এবং আবিষ্কার প্রথাগত ধ্যান-ধারণাগুলোকে পরীক্ষার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিচ্ছিল।
কোন ধরনের পর্যবেক্ষণ আর আবিষ্কার?
এই যেমন, প্রথমত, দিন দিন আগের চেয়ে বেশি পরিমাণে ফসিল খুঁড়ে তোলা হচ্ছিল। কিছু সামুদ্রিক প্রাণীর চিহ্ন স্থলভূমির অনেক ভেতরে আবিষ্কার করে ডারউইন নিজেও যারপরনাই অবাক হয়েছিলেন। দক্ষিণ আমেরিকাতেও তিনি একই ধরনের ব্যাপার আবিষ্কার করেছিলেন আন্দিজ পর্বতমালার অনেক উঁচু স্থানে। সামুদ্রিক প্রাণী আন্দিজে কী করে, সোফি, বলতে পারো আমাকে?
না।
কেউ কেউ বিশ্বাস করতেন যে ওগুলোকে মানুষ বা কোনো প্রাণী ওখানে ছুঁড়ে ফেলেছে। অন্যরা বিশ্বাস করতেন যে অধার্মিকদের পথভ্রষ্ট করার জন্যে ঈশ্বরই এ সব সামুদ্রিক প্রাণীগুলোর এ-সব ফসিল আর নানান চিহ্ন তৈরি করেছেন।
কিন্তু বিজ্ঞানীরা কী বিশ্বাস করতেন?
বেশির ভাগ ভূতত্ত্ববিদেরই একটা মহাবিপর্যয় তত্ত্ব-তে প্রবল বিশ্বাস ছিল। আর সেই তত্ত্ব অনুযায়ী, পৃথিবী বেশ কিছু বন্যা, ভূমিকম্প এবং অন্যান্য মহাবিপর্যয়ের শিকার হয়েছিল যা সব ধরনের জীবন ধ্বংস করে ফেলেছিল। বাইবেলে এ-সবেরই একটির কথা পড়ি আমরা, মহাপ্লাবন আর নোয়ার নৌকা। প্রত্যেক বিপর্যয়ের পর ঈশ্বর পৃথিবীতে নতুন এবং আরো নিখুঁত উদ্ভিদ আর প্রাণী নতুন করে সৃষ্টি করেছেন।
তারমানে, ফসিলগুলো হচ্ছে এ-সব মহাবিপর্যয়ের পর আগেকার যে-সব প্রাণী। বিলুপ্ত হয়ে গেছে সেগুলোর রেখে যাওয়া চিহ্ন?
ঠিক তাই। যেমন ধরো, এ-রকমটা মনে করা হতো যে যে-সব প্রাণী নৌকোয় উঠতে পারেনি সেগুলোরই চিহ্ন হচ্ছে এই ফসিলগুলো। কিন্তু ডারউইন যখন বীগল নামের জাহাজে চেপে যাত্রা করলেন তখন তার সঙ্গে ছিল ইংরেজ জীব বিজ্ঞানী স্যার চার্লস লিয়েল-এর (Sir Charles Lyell) প্রিন্সিপলস অভ জিওলজি। লিয়েল মনে করতেন পাহাড়-পর্বত আর উপত্যকা সহ পৃথিবীর এই বর্তমান ভূতাত্ত্বিক অবস্থা এক অন্তহীন রকমের দীর্ঘ আর ধীর বিবর্তনের ফসল। তাঁর বক্তব্য ছিল, এ-পর্যন্ত কত শত যুগ কেটে গেছে সে-কথা বিবেচনায় রেখে বলা যায় যে এমনকী নিতান্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরিবর্তনও বিশাল ভূতাত্ত্বিক পরিবর্তন ঘটাতে পারে।
কোন ধরনের পরিবর্তনের কথা বলেছিলেন তিনি?
যে-ধরনের শক্তি আজো আমরা দেখতে পাই সেগুলোর কথাই বলছিলেন তিনি। বাতাস আর আবহাওয়া, গলতে থাকা বরফ, ভূমিকম্প এবং ভূমিস্তরের বৃদ্ধিপ্রাপ্তি। তুমি হয়ত এক ফোঁটা পানির পাথর ক্ষয়ে ফেলার কথা শুনে থাকবে, তবে সেটা জান্তব কোনো শক্তির সাহায্যে নয় অনবরত ফোঁটায় ফোঁটায় পড়ে পড়ে। লিয়েল বিশ্বাস করতেন যে বহু বছর ধরে ঘটা এ-ধরনের ছোট এবং ধীর পরিবর্তনগুলো প্রকৃতির রূপ পুরোপুরি পাল্টে দিতে পারে। তবে কেবল এই তত্ত্বটি দিয়ে এ-কথা ব্যাখ্যা করা গেল না যে ডারউইন সামুদ্রিক প্রাণীর দেহাবশেষ আন্দিজ পর্বতমালার অনেক উঁচুতে আবিষ্কার করেছিলেন কেন। কিন্তু ডারউইন এটা সব সময়ই মনে রেখেছিলেন যে সেই সব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরিবর্তন নাটকীয় পরিবর্তন আনতে পারে যদি সেগুলোকে যথেষ্ট সময় দেয়া যায়।
আমার মনে হয় প্রাণীর বিবর্তনের ক্ষেত্রেও একই ব্যাখ্যা দেয়া যেতে পারে।
হা। তিনিও সে-রকমই ভেবেছিলেন। আমি আগেই বলেছি ডারউইন ছিলেন খুবই সতর্ক মানুষ। উত্তর দেবার চেষ্টা করার অনেক আগেই প্রশ্নগুলো করেছিলেন তিনি। সে-অর্থে তিনি সমস্ত প্রকৃত দার্শনিকের পদ্ধতি-ই ব্যবহার করেছিলেন: প্রশ্ন করা জরুরি, কিন্তু সেটার উত্তর দেবার জন্যে তাড়াহুড়ো করার কোনো প্রয়োজন নেই।
হ্যাঁ, বুঝতে পেরেছি।
লিয়েল-এর তত্ত্বের একটি যুগান্তকারী ব্যাপার ছিল পৃথিবীর বয়স। ডারউইনের সময় অনেকেই বিশ্বাস করত যে ঈশ্বর পৃথিবী তৈরি করার পর প্রায় ৬,০০০ বছর পার হয়ে গেছে। অ্যাডাম আর ঈ-এর পরের প্রজন্মগুলো হিসাব করে এই অংকটা বের করেছিল তারা।
কী বোকা!
ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর জ্ঞানী হওয়া কিন্তু খুব সহজ। ডারউইন-এর হিসেব মতে পৃথিবীর বয়স ৩০ কোটি বছর। কারণ, অন্তত একটা ব্যাপার স্পষ্ট ছিল খুব: লিয়েল-এর ধীর ভূতাত্ত্বিক বিবর্তন বা ডারউইনের নিজস্ব বিবর্তনের তত্ত্ব, কোনোটিই ধোপে টেকে না যদি না অসম্ভব রকমের লম্বা সময়কে হিসেবের মধ্যে ধরা হয়।
পৃথিবীর বয়স কত?
আজ আমরা জানি যে পৃথিবীর বয়স ৪.৬ বিলিয়ন বছর।
ওরেব্বাবা!
এ-পর্যন্ত আমরা জীববিজ্ঞানসংক্রান্ত বিবর্তনের পক্ষে ডারউইনের যুক্তিগুলোর একটির দিকে নজর দিয়েছি যা হলো পাথরের বিভিন্ন স্তরে ফসিলের স্তরীভূত সঞ্চয়। আরেকটি যুক্তি হলো জীবম্ভ প্রজাতিগুলোর ভৌগোলিক বণ্টন। আর এই জায়গাটিতেই ডারউইনের বৈজ্ঞানিক অভিযাত্রা নতুন আর অত্যন্ত ব্যাপক উপাত্ত যোগাতে পেরেছিল। তিনি তাঁর নিজের চোখে দেখেছেন যে একই এলাকায় একটি প্রজাতির বিভিন্ন প্রাণীর মধ্যে খুবই সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম তফাৎ থাকতে পারে। বিশেষ করে ইকুয়েডর-এর পশ্চিমে গ্যালাপেগস দ্বীপগুলোতে খুবই মজার কিছু ব্যাপার লক্ষ করেন তিনি।
বলুন না সেগুলোর কথা।
গ্যালাপেগস দ্বীপগুলো কিছু নিবিড় আগ্নেয় দ্বীপের একটা দল। কাজেই সেখানকার উদ্ভিদ এবং প্রাণীগুলোর মধ্যে তেমন কোনো বড় পার্থক্য নেই। কিন্তু ডারউইন আগ্রহী ছিলেন ছোট ছোট পার্থক্যের ব্যাপারে। তো, সব কটি দ্বীপেই তিনি দৈত্যাকার কিছু কচ্ছপের দেখা পেলেন যেগুলো দ্বীপভেদে সামান্য হলেও অন্যরকম। তাহলে কি একেক দ্বীপের জন্যে ঈশ্বর ভিন্ন প্রজাতির কচ্ছপ তৈরি করেছিলেন?
সে-ব্যাপারে সন্দেহ আছে।
গ্যালাপেগসের পাখিদের জীবনধারা সম্পর্কে ডারউইনের পর্যবেক্ষণ তো আরো আকর্ষণীয়। গ্যালাপেগস ফিশ নামের পাখিগুলো এক দ্বীপ থেকে অন্য দ্বীপে স্পষ্টতই অন্যরকম, বিশেষ করে ঠোঁটের গড়নের দিক দিয়ে। ডারউইন দেখালেন যে এই বিভিন্নতা নানান দ্বীপে ফিনৃশগুলো যেভাবে তাদের খাবার সংগ্রহ করে তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত। গির্জার চূড়ার মতো সরু পাশওয়ালা মেঠো ফিনশের প্রধান খাদ্য পাইন গাছের মোচাকৃতি ফলের বীজ, ছোট ছোট ওয়াবলার ফিশ বাঁচে পোকামাকড় খেয়ে আর গেছো ফিশ গাছের বাকল ও ডালপালা খুঁটে বের-করা উঁইপোকা খেয়ে…। প্রজাতিগুলোর প্রত্যেকটি পাখিরই রয়েছে সেটার গ্রহণ-করা খাদ্যের সঙ্গে পুরোপুরি মানানসই ঠোঁট। এই সব ফিশ কি একটিই মাত্র প্রজাতি থেকে এসেছে? এবং সেই ফিশগুলো কি যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন দ্বীপে তাদের পরিবেশের সঙ্গে এমনভাবে নিজেদের মানিয়ে নিয়েছে যাতে করে নতুন প্রজাতির ফি-এর উদ্ভব ঘটতে পারে?
ডারউইন নিশ্চয়ই সেই সিদ্ধান্তেই পৌঁছেছিলেন, তাই না?
হা। সম্ভবত ওখানেই-গ্যালাপেগস দ্বীপপুঞ্জেইডারউইন ডারউইনবাদী হয়ে উঠেছিলেন। তিনি আরো লক্ষ করেছিলেন যে ওখানকার প্রাণীকূলের সঙ্গে দক্ষিণ আমেরিকায় তাঁর দেখা নানান প্রজাতির সঙ্গে অসম্ভব মিল রয়েছে। সত্যি সত্যিই কি ঈশ্বর এ-সমস্ত প্রাণীকে পরস্পরের থেকে খানিকটা ভিন্ন হিসেবে একবারেই তৈরি করেছিলেন, নাকি কোনো বিবর্তন ঘটেছিল? সব প্রজাতিই অপরিবর্তনীয় এ-ব্যাপারে ক্রমেই সন্দেহ বাড়তে থাকে ডারউইনের। কিন্তু এ-ধরনের একটা বিবর্তন কী করে ঘটল সে-বিষয়ে তখনও তার কাছে সে-রকম গ্রহণযোগ্য কোনো ব্যাখ্যা ছিল না। তবে পৃথিবীর সমস্ত প্রাণীর মধ্যেই যে একটা সম্পর্ক রয়েছে সে-রকম ইঙ্গিত দেয়ার মতো আরেকটা বিষয় রয়েছে।
কী সেটা?
স্তন্যপায়ী প্রাণীদের ভ্রূণের বিকাশ। যদি তুমি কুকুর, বাদুড়, খরখোশ আর মানব জ্বণের প্রাথমিক অবস্থায় সেগুলোর মধ্যে তুলনা কর তাহলে দেখবে দেখতে সেগুলো এতোটাই একরকম যে কোনটা কিসের ভ্রূণ সেটা বলা শক্ত। বেশ পরিণত অবস্থার আগ পর্যন্ত তুমি বলতে পারবে না কোনটা মানব ভ্রূণ আর কোনটা খরগোশের। এর থেকেই কি এটা বোঝা যায় না যে আমরা দূরবর্তী স্বজন?
কিন্তু এই বিবর্তনটা কী করে ঘটল সেটার ব্যাখ্যা কি তখনো তার কাছে ছিল?
দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে সূক্ষ্ম সক্ষ্ম পরিবর্তন বড়সড় পার্থক্য ঘটাতে পারে এই মর্মে লিয়েল যে-তত্ত্ব দিয়েছিলেন সেটা নিয়ে ক্রমাগত ভেবে যাচ্ছিলেন ডারউইন। কিন্তু সাধারণ একটা নীতি বা নিয়ম হিসেবে কাজ করবে এ-রকম কোনো ব্যাখ্যা বের করতে পারছিলেন না তিনি। ফরাসী প্রাণীবিদ লামার্ক-এর তত্ত্বের কথা জানা ছিল তার আর এই তত্ত্ব অনুযায়ী, বিভিন্ন প্রজাতি তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের বিকাশ ঘটিয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, জিরাফ লম্বা গলার বিকাশ ঘটিয়েছে কারণ প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তারা গাছের পাতা খাওয়ার জন্যে গলা বাড়িয়ে দিয়েছে। লামার্ক মনে করতেন যে প্রতিটি প্রাণী নিজের চেষ্টায় যে-সব বৈশিষ্ট্য অর্জন করে সেগুলো পরবর্তী প্রজন্মে চারিয়ে যায়। কিন্তু বংশগতি-র এই অর্জিত বৈশিষ্ট্যের সূত্র ডারউইন প্রত্যাখ্যান করলেন, কারণ এতো বড় একটা দাবির পক্ষে লামার্ক কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেননি। অবশ্য ডারউইন আরেকটি আরো বেশি সুস্পষ্ট একটি চিন্তাধারা ধরে এগোতে শুরু করেছিলেন। এক হিসেবে তুমি বলতে পারো যে বিভিন্ন প্রজাতির বিবর্তনের আসল মেকানিজমটা একেবারে তার নাকের ডগাতেই দাঁড়িয়ে ছিল।
তা, কী সেটা?
আমি বরং চাই তুমি নিজেই সেটা বের কর। সেজন্যেই আমি তোমাকে জিগ্যেস করছিঃ ধরো তোমার তিনটে গরু আছে, কিন্তু দুটোর বেশি গরুকে খাওয়ানোর মতো পশুখাদ্য নেই, এ-অবস্থায় তুমি কী করবে?
আমার মনে হয় তখন একটা গরুকে জবাই করে ফেলতে হবে আমাকে।
বেশ…কিন্তু কোনটাকে জবাই করবে তুমি?
মনে হয়, যেটা সবচেয়ে কম দুধ দেয় সেটাকে।
তাই?
হ্যাঁ, সেটাই তো যুক্তিযুক্ত, তাই না?
ঠিক এই কাজটাই হাজার হাজার বছর ধরে করে এসেছে মানুষ। তবে তোমার ঐ দুই গরুর কাহিনী এখনো শেষ হয়নি। ধরো, তোমার ইচ্ছে হলো এই দুটো গরুর মধ্যে একটার বাছুর হওয়ানো দরকার। কোনটাকে বেছে নিতে তুমি?
যেটা সবচেয়ে বেশি দুধ দেয়। তাতে করে সেটার বাছুরও হয়ত বেশি দুধ দিতো।
তার মানে, যেটা বেশি দুধ দেয় সেটাই তোমার বেশি পছন্দের গরু। এবার আরো একটা প্রশ্ন। তুমি যদি একজন শিকারী হতে আর তোমার দুটো গানডগ থাকতো, তাহলে সেই দুটোর মধ্যে একটাকে অন্য কাউকে দিয়ে দিতে হলে নিজের জন্যে কোন কুকুরটা রাখতে তুমি?
আমি যে-ধরনের প্রাণী শিকার করি সেগুলো খুঁজে আনায় যেটা সেরা সেটাই নিশ্চয়ই রেখে দিতাম।
ঠিক তাই, দুটো গানডগের মধ্যে যেটা ভালো সেটার প্রতিই পক্ষপাত দেখাতে তুমি। ঠিক এভাবেই দশ হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে লোকে গৃহপালিত জীব জম্ভর বংশবৃদ্ধি ঘটিয়েছে, সোফি। মুরগি চিরকাল সপ্তাহে পাঁচ দিন ডিম দেয়নি, ভেড়া সব সময় এতো উল দিতো না আর ঘোড়া আজ যেমন শক্তিশালী ও দ্রুতগামী তেমনটা সে সব সময় ছিল না। ব্রিডাররা একটা কৃত্রিম নির্বাচন করেছে। উদ্ভিদ রাজ্যের বেলাতেও একই কথা প্রযোজ্য। ভালো আলু বীজ থাকতে খারাপ আলু কেউ রোপণ করে না এবং যে-গম গাছে শস্যদানা নেই সেটা কেটে সময়ও নষ্ট করে না কেউ। ডারউইন বললেন দুটো গরু, গমের দুটো ছড়া, দুটো কুকুর এবং দুটো ফিশ পাখি কখনোই পুরোপুরি একরকম হতে পারে না। প্রকৃতিই এক বিপুল বৈচিত্র্যের বিস্তার তৈরি করে। এমনকী একই প্রজাতির দুই সদস্য কখনো পুরোপুরি এক নয়। সম্ভবত তুমি নিজেও সেটা বুঝতে পেরেছে যখন নীল তরলটা খেলে তখন।
ঠিক।
তো, ডারউইন এবার নিজেকেই প্রশ্ন করলেন প্রকৃতিতেও কি তাহলে একই পদ্ধতি কাজ করছে? এটা কি সম্ভব যে কোন সদস্য বাঁচবে সেটা ঠিক করতে প্রকৃতি একটা প্রাকৃতিক নির্বাচন করে? আর, বহুদিন ব্যাপী এ-ধরনের একটি নির্বাচন কি নতুন প্রজাতির উদ্ভিদ এবং প্রাণী সৃষ্টি করতে পারে?
আমার মনে হয় প্রশ্নটার উত্তর হচ্ছে হ্যা।
ডারউইন তখনো ভেবে উঠতে পারেননি এ-রকম একটা প্রাকৃতিক নির্বাচন ঠিক কীভাবে ঘটতে পারে। কিন্তু ১৮৩৮-এর অক্টোবরে, বীগল জাহাজে ফেরার ঠিক দুই বছর পর, ঘটনাক্রমে, জনসংখ্যা বিষয়ক বিদ্যায় বিশেষজ্ঞ টমাস ম্যালথাসএর (Thomas Malthus) একটা ছোট্ট বই তাঁর নজরে আসে। বইটার নাম অ্যান এসে অন দ্য প্রিন্সিপাল অত্ পপিউলেশন। রচনাটির আইডিয়া ম্যালথাস পেয়েছিলেন বেঞ্জামিন ফ্র্যাংকলিন-এর (Benjamin Franklin) কাছ থেকে। সেই আমেরিকান ভদ্রলোকের কাছ থেকে যিনি অন্যান্য অনেক জিনিসের সঙ্গে লাইটনিং কন্ডাক্টর-ও আবিষ্কার করেছিলেন। ফ্র্যাংকলিন মন্তব্য করেছিলেন যে প্রকৃতিতে যদি নিয়ন্ত্রক কোনো উপাদান (limiting factor) না থাকতো তাহলে উদ্ভিদ বা প্রাণীর একটি প্রজাতিই ছড়িয়ে পড়তে গোটা বিশ্বে। কিন্তু অনেক প্রজাতি থাকায় সেগুলো একটি আরেকটির ভারসাম্য বজায় রাখে।
সেটা বুঝতে পারি।
ম্যালথাস এই ধারণাটিরই বিকাশ ঘটিয়ে সেটাকে জনসংখ্যার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে সন্তান উৎপাদনের ক্ষমতা মানুষের এতো বেশি যে যত শিশু বেঁচে থাকতে পারে, সব সময় তার চেয়ে বেশি শিশু জন্মগ্রহণ করে। খাদ্য উৎপাদন যেহেতু কখনোই জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে পারে না, তাই তিনি মনে করতেন যে অসংখ্য শিশু যে মৃত্যুমুখে পতিত হবে সেটাই নিয়তি নির্দিষ্ট। যারা বড় হওয়ার জন্যে বেঁচে রয়েছিল-এবং সেই সঙ্গে জাতিটিকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করেছিল-তারাই অতএব অস্তিত্বের লড়াইয়ে সবার সেরা।
এটাই তো যুক্তিযুক্ত শোনাচ্ছে।
আসলে কিন্তু এটাই ছিল সেই সার্বজনীন মেকানিজম ডারউইন যার খোঁজ করছিলেন। বিবর্তন কীভাবে ঘটে তার ব্যাখ্যা ছিল এখানেই। আর সেটা হলো এই যে, বিবর্তনটা ঘটেছিল জীবন রক্ষার সংগ্রামে প্রাকৃতিক নির্বাচনের কারণে, যে সম্রামে তারাই বেঁচে থাকবে এবং নিজেদের জাতিকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবে যারা তাদের পরিপার্শ্বের সঙ্গে সবচেয়ে ভালোভাবে খাপ খাওয়াতে পারবে। এটা ছিল দি অরিজিন অত্ স্পীশীজ-এ উপস্থাপন করা তাঁর দ্বিতীয় তত্ত্ব। তিনি লেখেন: পরিচিত সমস্ত প্রাণীর মধ্যে হাতিকেই সবচেয়ে ধীরগতি সম্পন্ন বংশবৃদ্ধিকারী হিসেবে গণ্য করা হয়, কিন্তু এটার যদি দুটো শাবক থাকে এবং সেগুলো একশো বছর বাঁচে তাহলে ৭৪০ থেকে ৭৫০ বছর পরে প্রথম জোড়া থেকে জন্ম নেয়া জীবিত হাতির সংখ্যা গিয়ে দাঁড়াবে প্রায় এক কোটি নব্বই লাখ।
একটা কডমাছের হাজার হাজার ডিমের কথা তো বলাই বাহুল্য।
ডারউইন এরপর যে-প্রস্তাবনাটা উপস্থাপন করলেন তা হলো, যে-প্রজাতির সদস্যরা দেখতে সবচেয়ে একরকম তাদের পক্ষে এই টিকে থাকার সংগ্রামটা প্রায়শই সবচেয়ে কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। একই খাদ্যের জন্যে যুদ্ধ করতে হয় তাদের। সেখানে সামান্যতম সুবিধাও, এই যেমন সূক্ষাতিসূক্ষ্ম তফাৎ, সেটার পুরো প্রাপ্য পায়। বেঁচে থাকার সংগ্রাম যত তীব্র হবে, নতুন প্রজাতির বিবর্তন ততো তাড়াতাড়ি হবে। আর তাতে করে, সবচেয়ে ভালোভাবে খাপ খাইয়ে নিতে পেরেছে যে সে-ই টিকে যাবে, বাকিরা যাবে বিলুপ্ত হয়ে।
খাবার যত কম থাকবে আর প্রজাতিটি যত বড় হবে ততো তাড়াতাড়ি বিবর্তন ঘটবে?
হ্যাঁ। কিন্তু এটা শুধু খাবারের প্রশ্ন নয়। অন্য প্রাণীর খাদ্যে পরিণত না হওয়াটাও ঠিক একই রকমের গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। এই যেমন ধরো, সুরক্ষা বা নিরাপত্তামূলক ছদ্মাবরণ থাকা, দ্রুত দৌড়াতে পারা, শক্ত প্রাণী চিনতে পারা কিংবা, শেষ পর্যন্ত চরম খারাপ অবস্থাটা যদি এসেই পড়ে, নিজের একটা অরুচিকর স্বাদ থাকা। শিকারী প্রাণীদের মেরে ফেলতে পারে এমন বিষ থাকাটাও বেশ কাজের কিন্তু। এই জন্যেই অসংখ্য ক্যাকটাস বিষাক্ত, বুঝলে সোফি। বস্তুত মরুভূমিতে প্রায় কিছুই জন্মাতে পারে না, তাই বিশেষত এই প্রজাতিটি উদ্ভিদভোজী প্রাণীর কাছে বেশ অসহায়।
বেশিরভাগ ক্যাকটাসেরই অবশ্য কাঁটাও আছে।
স্পষ্টতই, বংশবৃদ্ধি করার ক্ষমতাটাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উদ্ভিদের পরাগায়নের উদ্ভাবনী দক্ষতার ব্যাপারটিও ডারউইন বেশ বিস্তারিতভাবে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। যে-সব পোকা-মাকড় পরাগায়নের জন্যে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় সেগুলোকে আকৃষ্ট করার জন্যে ফুল উজ্জ্বল রঙ নিয়ে জ্বলজ্বল করে আর মতিচ্ছন্নকারী সুবাস ছড়ায়। নিজের প্রজাতিকে দীর্ঘস্থায়ী করতে পাখি সুরেলা কণ্ঠে ডাকে। গাভীর প্রতি কোনো আকর্ষণহীন শান্ত-শিষ্ট বা বিষ কোনো ষাড়ের যে বংশতালিকা সম্পর্কেও আগ্রহ থাকবে না সে তো বলাই যায়, কারণ এ-রকম বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হলে সেটার বংশ হঠাৎ করে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। যাঁড়ের জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে যৌন পরিপক্কতা অর্জন করা এবং নিজের প্রজাতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে বংশবৃদ্ধি করে চলা। এটা একটা রিলে রেসের মতো ব্যাপার। যারা কোনো না কোনো কারণে তাদের জিন চারিয়ে দিতে পারে না তারা ক্রমাগতভাবে বাদ পড়তে থাকে আর এভাবেই প্রজাতিটি পরিশুদ্ধ হতে থাকে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যের একটি যা টিকে থাকা ভিন্নরূপটির মধ্যে ক্রমাগতভাবে জমা হতে থাকে, সংরক্ষিত হতে থাকে।
তার মানে সব কিছুই আরো ভালো হতে থাকে?
এই নিরন্তর নির্বাচনের ফল হচ্ছে এই যে যারা একটি বিশেষ পরিবেশের বা বিশেষ ইকলজিকাল স্থানের সঙ্গে সবচেয়ে ভালোভাবে খাপ খাইয়ে নিতে পারবে তারাই দীর্ঘমেয়াদে সেই পরিবেশে নিজেদের প্রজাতিকে টিকিয়ে রাখতে পারবে।
কিন্তু এক পরিবেশে যা সুবিধা অন্য পরিবেশে তা না-ও হতে পারে। কিছু কিছু গ্যালাপেগস ফিনৃ-এর জন্যে উড়তে পারাটা ছিল খুবই জরুরি। কিন্তু খাবার যদি মাটির ভেতর থেকে খুঁড়ে খেতে হয় এবং কোনো শিকারী প্রাণী না থাকে তাহলে ওড়ার ব্যাপারে ভালো হওয়াটা তেমন একটা দরকারী ব্যাপার নয়। এই দীর্ঘ সময়ে কেন এতোগুলো বিভিন্ন প্রাণী প্রজাতির উদ্ভব ঘটেছে তার ঠিক ঠিক কারণ হচ্ছে। প্রাকৃতিক পরিবেশের এই অসংখ্য একান্ত নি।
কিন্তু তারপরেও, মানব জাতি কিন্তু একটাই।
তার কারণ হলো জীবনের নানা পরিবেশে মানিয়ে নেয়ার একটা অনন্যসাধারণ গুণ আছে মানুষের। ডারউইনকে যে-সব ব্যাপার সবচেয়ে অবাক করেছিল তার মধ্যে একটা হচ্ছে টিয়ের ডেল ফিউগো-তে ইন্ডিয়ানরে এতো ভয়ংকর আবহাওয়ার মধ্যেও বেঁচে থাকাটা। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে সব মানুষই এক রকম। যারা বিষুবরেখার কাছাকাছি ব স করে তাদের চামড়ার রঙ উত্তরাঞ্চলের মানুষের চেয়ে কালো, তার কারণ কালো৷ামড়া তাদেরকে সূর্যের তাপ থেকে রক্ষা করে। যে-সব শ্বেতাঙ্গ দীর্ঘ সময়ের জন্যে সূর্যালোকে থাকে তাদের ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
উত্তরের দেশগুলোতে থাকলে সাদা চামড়ায় কি একই সুবিধা পাওয়া যায়?
হ্যাঁ, নইলে দুনিয়ার সবার গায়ের চামড়াই কালো হতো। সাদা চামড়া খুব তাড়াতাড়ি সান ভিটামিন তৈরি করে এবং যেখানে সূর্য প্রায় দেখাই যায় না সেখানে এই ব্যাপারটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে ইদানিং আর ব্যাপারটা অতটা গুরুত্বপূর্ণ নেই, তার কারণ আমাদের খাদ্যের ভেতরেই যাতে সান ভিটামিন থাকে সে-ব্যাপারটা আমরা নিশ্চিত করতে পারি। কিন্তু প্রকৃতির কোনো কিছুই আকস্মিক নয়। প্রতিটি জিনিস-ই অগুনতি প্রজন্ম ধরে ঘটা অসংখ্য পরিবর্তনের ফল।
ব্যাপারটা চিন্তা করলে সত্যিই খুব আশ্চর্য লাগে।
সত্যিই তাই। তো, এবার আমরা কয়েকটা কথায় ডারউইনের তত্ত্বের একটা সার সংক্ষেপ দাঁড় করাতে পারি।
বলে যান।
আমরা বলতে পারি যে পৃথিবীতে প্রাণের বিবর্তনের পেছনে কাঁচামাল বা রসদ ছিল একই প্রজাতির ভেতর প্রাণী বিশেষ-এর নিরন্তর বৈচিত্র্য আর সেই সঙ্গে বহুসংখ্যক বংশধর, যার অর্থ হচ্ছে এদের ভগ্নাংশমাত্রের বেঁচে থাকা বা টিকে থাকা। বিবর্তনের পেছনের প্রকৃত মেকানিজম বা অনুপ্রেরণা তাই বেঁচে থাকার সংগ্রামে প্রাকৃতিক নির্বাচন। এই নির্বাচনই এটা নিশ্চিত করেছে যে সবচেয়ে শক্তিশালী বা যোগ্যতম-ই টিকে থেকেছে।
ব্যাপারটা অংকের মতোই লজিকাল। তা, অরিজিন অত্ দ্য স্পীশীজ বইটাকে লোকে কীভাবে নিয়েছিল?
তিক্ত বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল বইটা। চার্চ-তো প্রচণ্ডভাবে প্রতিবাদ জানিয়েছিল আর বিজ্ঞান জগৎ-ও বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল পরিষ্কার দুটো শিবিরে। সেটা অবশ্য আশ্চর্যের কিছু নয়। শত হলেও, সৃষ্টির ব্যাপারটা থেকে ঈশ্বরকে অনেকটা দূরে সরিয়ে এনেছিলেন ডারউইন, অবশ্য কিছু কিছু লোক এ-কথা স্বীকার করেছিলেন যে একটা নির্দিষ্ট সত্তা তৈরি করার চেয়ে নিজস্ব সহজাত বিবর্তনমূলক সম্ভাবনাসম্পন্ন কিছু তৈরি করাটা নিশ্চয়ই আরো বেশি মহৎ বা বড় কাজ।
হঠাৎ চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠল সোফি।
ঐ যে দেখুন। চেঁচিয়ে উঠল সে।
জানলার বাইরের দিকে আঙুল তুলে দেখাল সে। লেকের পাশে একটি পুরুষ আর একটি নারী হাত ধরাধরি করে হাঁটছে। একেবারে নগ্ন তারা।
ওরা হচ্ছে অ্যাডাম আর ঈ অ্যালবার্টো বললেন। ওরা-ও ধীরে ধীরে বাধ্য হয়েছে ছোট্ট রেডরাইডিংহুড আর এলিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ডের সঙ্গে নিজেদের ভাগ্যকে জড়াতে। সেজন্যেই এখানে দেখা যাচ্ছে ওদের।
ওরা কী করে তা দেখার জন্যে জানলার কাছে চলে এলো সোফি, কিন্তু শিগগিরই গাছগুলোর ভেতরে হারিয়ে গেল তারা।
তার কারণ কি এই যে জীব-জম্ভ থেকেই মানুষের উদ্ভব হয়েছে বলে ডারউইন বিশ্বাস করতেন?
১৮৭১-এ প্রকাশিত হয় ডারউইনের দ্য ডিসেন্ট অ্যু ম্যান। এই বইটিতে তিনি মানুষ আর জীব-জন্তুর মধ্যে প্রবল সাদৃশ্যের দিকে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। প্রচার করেন এই তত্ত্ব যে মানুষ আর নরাকার বানর নিশ্চয়ই কোনো এক সময় একই পূর্ব-পুরুষ থেকে উদ্ভূত হয়েছিল। এরই কাছাকাছি সময়ে, বিলুপ্ত এক ধরনের মানুষের ফসিলে পরিণত হওয়া খুলি প্রথমবারের মতো পাওয়া গেল, প্রথমে রক অভ জিব্রাল্টারে আর তার কিছুদিন পর জার্মানীর নিয়ান্ডারথাল-এ। অবাক করা ব্যাপার হলো ১৮৫৯-এ ডারউইন যখন দি অরিজিন অত্ স্পীশীজ প্রকাশ করেছিলেন তখন প্রতিবাদের যে-রকম ঢেউ উঠেছিল তার চাইতে ১৮৭৯-এ কিন্তু প্রতিবাদ অনেক কম শোনা গেল। অথচ জীব-জন্তু থেকে মানুষের উদ্ভূত হওয়ার ব্যাপারটি কিন্তু প্রথম বইতেও প্রচ্ছন্নভাবে বলা ছিল। আর, আমি তো আগেই বলেছি, ১৮৮২-তে ডারউইন যখন মারা যান তখন বিজ্ঞানের একজন পথিকৃতের যথাযযাগ্য মর্যাদায় তাকে সমাহিত করা হয়।
তো, শেষ পর্যন্ত তাহলে সম্মান এবং মর্যাদা পেয়েছিলেন তিনি?
হ্যাঁ, শেষ পর্যন্ত। কিন্তু তার আগে তাঁকে অবশ্য ইংল্যান্ডের সব চেয়ে বিপজ্জনক মানুষ বলেও বর্ণনা করা হয়েছিল।
বলেন কী!
আশা করা যাক ব্যাপারটা সত্যি নয়, উচ্চবিত্ত শ্রেণীর এক মহিলা লিখছেন। তবে যদি সত্যি হয় তাহলে আশা করা যাক কথাটা সাধারণ মানুষ জানবে না। বিশিষ্ট একজন বিজ্ঞানীও একই রকম মত প্রকাশ করলেন, একটা বিব্রতকর আবিষ্কার, এটা সম্পর্কে যত কম বলা যায় ততোই মঙ্গল।
মানুষ যে উট পাখির স্বীয় সেটাই তো প্রায় প্রমাণ হয়ে যাচ্ছে এই ঘটনায়।
ভালো বলেছ। তবে আমাদের পক্ষে এ-সব কথা এখন বলা খুব সহজ। অথচ তখন কিন্তু হঠাৎ করেই লোকজনকে বুক অত্ জেনেসিস সম্পর্কে তাদের ধারণা পাল্টাতে বলা হলো। তরুণ লেখক জন রাসকিন ব্যাপারটাকে এভাবে উপস্থাপন। করলেনঃ শুধু যদি ভূ-তত্ত্ববিদরা আমাকে একা থাকতে দিতো। বাইবেলের প্রতিটি চরণের পরেই আমি তাদের হাতুড়ির আঘাতের শব্দ শুনতে পাই।
আর সেই হাতুড়ির বাড়ির শব্দের মানে ছিল ঈশ্বরের বাণীর ব্যাপারেই তাঁর সন্দেহ, তাই না?
খুব সম্ভব সেটাই বুঝিয়েছিলেন তিনি। কারণ শুধু যে সৃষ্টির আক্ষরিক ব্যাখ্যাই ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছিল তা নয়। ডারউইনের তত্ত্বের সারবস্তু ছিল এই যে পুরোপুরি এলোপাথাড়ি বৈচিত্র্য-ই শেষ পর্যন্ত মানুষ সৃষ্টি করেছিল। আর তাছাড়া, ডারউইন মানুষকে অস্তিত্বের জন্যে লড়াই-এর মতো অনুভূতিহীন একটা কিছুর সৃষ্টি বলে প্রতিপন্ন করেছিলেন।
এ-রকম এলোপাথাড়ি বৈচিত্র্যগুলোর উদ্ভব কীভাবে হলো সে-সম্পর্কে ডারউইন কিছু বলেছেন?
তত্ত্বটার সবচেয়ে দুর্বল জায়গায় হাত দিয়েছো তুমি। বংশগতি সম্পর্কে ডারউইনের ধারণা ছিল নেহাতই আবছা ধরনের। সংকর উৎপাদনের সময় একটা কিছু ঘটে। একজন বাবা আর একজন মা কখনো একেবারে তাদের মতো দুটো সন্তান পান না। সামান্য তফাৎ সব সময়ই থাকে। অন্য দিকে, এইভাবে আসলেই নতুন কিছু তৈরি করা কিন্তু বেশ কঠিন। তাছাড়া, কিছু কিছু উদ্ভিদ এবং প্রাণী রয়েছে যারা পরাগায়ন অথবা স্রেফ কোষ বিভাজনের মাধ্যমে বংশবৃদ্ধি করে। বিভিন্নতা বা বৈচিত্র্য কীভাবে ঘটে সে-ব্যাপারে ডারউইনের তত্ত্বকে প্রতিস্থাপিত করেছে তথাকথিত নব্য-ডারউইনবাদ।
সেটা আবার কী?
সমস্ত জীবন আর বংশবৃদ্ধিই মূলত কোষ বিভাজনের ব্যাপার। একটি কোষ যখন দুটি কোষে বিভক্ত হয় তখন ঠিক একই বংশগত উপাদান নিয়ে তৈরি হয় হুবহু একই রকমের দুটো কোষ। তার মানে, কোষ বিভাজন প্রক্রিয়ায় একটি কোষ নিজেরই প্রতিরূপ তৈরি করে।
আচ্ছা?
কিন্তু মাঝে মধ্যে এই প্রক্রিয়াতে ঘটে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অগুনতি ভুল। তাতে করে অনুরূপ কোষটি মূল কোষটির অবিকল প্রতিরূপ হতে পারে না। আধুনিক জীববিজ্ঞানের ভাষায় একে বলে মিউটেশন বা পরিব্যক্তি। হয় মিউটেশনগুলো পুরোপুরি অবান্তর আর নয়ত সেগুলো ব্যক্তি বিশেষের আচার-ব্যবহারের লক্ষণীয় পরিবর্তন ঘটাতে পারে। একেবাবে ক্ষতিকরও হতে পারে তা আর তাছাড়া এই মিউট্যান্টগুলো বড় বড় বংশধরদের মধ্যে থেকে ক্রমাগতভাবে বাদ পড়তে থাকবে। অনেক অসুখেরই কারণ আসলে মিউটেশন। তবে মাঝে মাঝে একটা মিউটেশন বিশেষ কোনো প্রজাতির বিশেষ একটি সদস্যকে ঠিক সেই বাড়তি ইতিবাচক বৈশিষ্ট্যটি দান করতে পারে যা বেঁচে থাকার সম্রামে নিজের বৈশিষ্ট্যকে টিকিয়ে রাখার জন্যে জরুরি।
এই যেমন অপেক্ষাকৃত বড় একটা গলা, তাই না?
জিরাফের গলা লম্বা কেন সে-সম্পর্কে মার্কের ব্যাখ্যা ছিল এই যে জিরাফকে সব সময়ই ওপরের দিকে গলা বাড়াতে হয়েছে। কিন্তু ডারউইনের মতবাদ অনুযায়ী এ-ধরনের কোনো বৈশিষ্ট্য উত্তরাধিকার সূত্রে পরের প্রজন্ম পাবে না। ডারউইন বিশ্বাস করতেন যে জিরাফের লম্বা গলা একটা ভিন্নতা বা বৈচিত্র্যর ফল। নব্য ডারউইনবাদ এই বিশ্বাসটির ত্রুটি দূর করল ঠিক ঐ বিশেষ ভিন্নতার একটা পরিষ্কার কারণ দেখিয়ে দিয়ে।
মিউটেশন?
হ্যাঁ।
বংশগত উপাদানগুলোতে পুরোপুরি এলোপাথাড়ি কিছু পরিবর্তন জিরাফের কোনো এক পূর্বপুরুষকে গড়পড়তা গলার চেয়ে সামান্য লম্বা একটা গলা দিয়েছিল। খাদ্য যখন সীমিত তখন এটা একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়াতে পারে। যে-জিরাফ গাছের সবচেয়ে উঁচু অংশে পৌঁছুতে পেরেছিল সেটাই সবচেয়ে ভালোভাবে টিকতে পেরেছিল। আমরা আরো কল্পনা করতে পারি কীভাবে এ ধরনের আদিম জিরাফ মাটি খুঁড়ে খাবার খুঁজে বের করবার ক্ষমতা অর্জন করেছিল। দীর্ঘদিন আগে বিলুপ্ত হয়ে গেছে এ-রকম একটি প্রাণী প্রজাতি লম্বা একটা সময়ের ব্যবধানে দুটো প্রজাতিতে পরিণত হতে পারে। প্রাকৃতিক নির্বাচন কীভাবে কাজ করতে পারে সে-ব্যাপারে আরো সাম্প্রতিক কিছু উদাহরণের দিকে আমরা নজর দিতে পারি।
ইয়েস প্লিজ।
ব্রিটেনে পেপ্যারড মথ নামে বিশেষ এক ধরনের প্রজাপতি আছে, রূপালী বার্চ গাছের গুঁড়ি খেয়ে জীবনধারণ করে এরা। অষ্টাদশ শতকে বেশির ভাগ পেপ্যার মথেরই গায়ের রঙ ছিল রূপালী ধূসর। কারণ কী, আন্দাজ করতে পারো, সোফি?
যাতে করে ক্ষুধার্ত পাখিরা সহজে ওদের চিনতে না পারে।
কিন্তু মাঝে মাঝেই, হঠাৎ হঠাৎ ঘটে যাওয়া কিছু মিউটেশনের জন্যে, অপেক্ষাকৃত কালো কিছু পেপ্যারড় মথ জন্মাতো। সেই অপেক্ষাকৃত কালো প্রজাপতিগুলোর বরাতে কী ঘটেছিল বলতে পারো?
অন্যগুলোর তুলনায় সহজেই দেখা যেতো ওগুলোকে, ফলে আরো সহজে ওগুলোকে ছোঁ মেরে তুলে নিতো ক্ষুধার্ত পাখিগুলো।
হ্যাঁ, কারণ সেই পরিবেশে, যেখানে বাচগাছের গুঁড়িগুলো ছিল রূপালী রঙের, অপেক্ষাকৃত কালো রঙটা সুবিধাজনক বৈশিষ্ট্য ছিল না। কাজেই সব সময় অপেক্ষাকৃত হালকা রঙের পেপ্যারড় মথের সংখ্যাই বেশি থাকতো। কিন্তু তারপর হঠাৎ একটা ঘটনা ঘটল সেই পরিবেশে। বেশ কিছু জায়গায় রূপালী গুঁড়িগুলো কল কারখানার কালি-ঝুলির কারণে কালো হয়ে যেতে থাকল। সেই পেপ্যার মথগুলোর তখন কী হলো বলে মনে হয় তোমার?
অপেক্ষাকৃত কালোগুলোর পোয়া বারো হলো।
হ্যাঁ, কাজেই সংখ্যায় বাড়তে খুব বেশি সময় লাগল না এদের। ১৮৪৮ থেকে ১৯৪৮-এর মধ্যে, কিছু কিছু জায়গায়, কালো পেপ্যারড় মথের অনুপাত ১ থেকে বেড়ে ৯৯-এ গিয়ে ঠেকল। পরিবেশ বদলে গিয়েছিল, ফলে হালকা রঙের হওয়াটা সুবিধাজনক ব্যাপার রইল না আর। তার উল্টোটাই হলো বরং। বিজিত সাদা প্রজাতিগুলো বার্চ গাছের গুঁড়ির ওপর এসে বসতে না বসতেই পাখিগুলোর কৃপায় উজাড় হয়ে গেল। কিন্তু এই সময় আবারো একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ঘটল। কয়লার ব্যবহার হ্রাস আর কলকারখানায় আগের চেয়ে ভালো ফিল্টারিং সরঞ্জামের ব্যবহার তুলনামূলকভাবে পরিষ্কার পরিবেশ সৃষ্টি করল।
কাজেই এবার বার্চগুলো আবার রূপালী হয়ে উঠল?
আর তাই পেপ্যারড মথগুলো তাদের রূপালী রঙে ফিরে যেতে শুরু করল। এটাকেই আমরা বলি মানিয়ে নেয়া (adaptation)। এটা একটা প্রাকৃতিক নিয়ম।
হ্যাঁ, বুঝতে পারছি।
কিন্তু মানুষ কীভাবে পরিবেশের ভেতর বাগড়া দেয় তারও ভুরি ভুরি উদাহরণ আছে।
যেমন?
এই যেমন, বিভিন্ন ধরনের কীটনাশক পদার্থ দিয়ে মানুষ নানান কীট-পতঙ্গ ধ্বংস করার চেষ্টা করেছে। প্রথম প্রথম এতে চমৎকার ফল পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু একটা মাঠে বা একটা আপেল-বাগানে তুমি যখন কীটনাশক পদার্থ স্প্রে করো তখন কিন্তু আসলে যে-সব কীট-পতঙ্গ তুমি ধ্বংস করতে চাইছে সেগুলোর ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র অর্থে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটাও। নিরন্তর মিউটেশনের কারণে এমন এক ধরনের কীট-পতঙ্গের উদ্ভব হয় যার মধ্যে যে-কীটনাশক ব্যবহৃত হচ্ছে সেই কীটনাশক প্রতিরোধক একটা ক্ষমতা জন্মায়। এবার এই বিজেতারা একটা স্বরাজ পেয়ে যায়, কাজেই বিশেষ কিছু কীট-পতঙ্গ প্রতিরোধ করা দিনে দিনে স্রেফ এই কারণে আরো বেশি কঠিন হয়ে পড়ে যে মানুষ সেগুলোকে ধ্বংস করে দিতে চেয়েছে। শেষ পর্যন্ত যারা টিকে থাকে তাদের মধ্যেই যে প্রতিরোধ ক্ষমতা সবচেয়ে বেশি থাকে সে-কথা বলাই বাহুল্য।
এটাতো রীতিমত ভয়ের ব্যাপার।
ব্যাপারটার মধ্যে যে চিন্তার খোরাক আছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ব্যাকটেরিয়ার আকারে আমাদের শরীরে যে-সব পরজীবি আছে সেগুলোকেও আমরা ধ্বংস করার চেষ্টা করি।
পেনিসিলিন বা অন্য ধরনের নানান অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করি আমরা।
হ্যাঁ আর পেনিসিলিন-ও এইসব ক্ষুদে শয়তানগুলোর ক্ষেত্রে একটা পরিবেশ বিপর্যয়। সে যাই হোক, আমরা যখন পেনিসিলিন ব্যবহার করতে থাকি, তখন আসলে আমরা কিছু কিছু ব্যাকটেরিয়াকে পেনিসিলিন প্রতিরোধী করে ফেলি, ফলে এমন একদল ব্যাকটেরিয়ার জন্ম দিতে থাকি যেগুলোকে দমন করা আগেরগুলোর চেয়েও কঠিন। ফলে আমরা দেখি দিন দিন আগের চেয়ে শক্তিশালী অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করতে হচ্ছে আমাদের, যদ্দিন পর্যন্ত না…।
শেষ অব্দি ওরা হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে আসে আমাদের মুখের ভেতর থেকে? আমাদের কি তাহলে ওগুলোকে গুলি করা উচিত?
সেটা অবশ্য একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। কিন্তু এই ব্যাপারটা এখন পরিষ্কার যে আধুনিক ওষুধ-পত্ৰ একটা ভীষণ উভয় সংকট তৈরি করেছে। সমস্যা কিন্তু এটা নয় যে বিশেষ একটি ব্যাকটেরিয়াম হঠাৎ খুবই ক্ষতিকারক হয়ে উঠেছে। অতীতে বহু শিশু মারা যেতো; নানান অসুখ বিসুখে মারা যেতো তারা। বাঁচতো খুবই অল্প। কিন্তু আধুনিক ওষুধ-পত্ৰ এক অর্থে প্রাকৃতিক নির্বাচনকে মুলতুবি রেখেছে। যে-জিনিসটা ব্যক্তি বিশেষকে কঠিন একটা রোগ থেকে বাঁচতে সাহায্য করছে, কালে একদিন সেটাই বিশেষ কিছু অসুখের ব্যাপারে গোটা মানব জাতির প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দিতে সাহায্য করতে পারে। যাকে বলে বংশগত স্বাস্থ্যবিধি সে-ব্যাপারে যদি আমরা কোনো মনোযোগই না দেই তাহলে একদিন হয়ত মানব জাতির অবক্ষয়ের মুখোমুখি হবো আমরা। মান্ত্রক অসুখ প্রতিরোধ করার ব্যাপারে মানুষের বংশগত। ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়বে।
কী ভয়ংকর ভবিষ্যৎ।
কিন্তু একজন প্রকৃত দার্শনিক ভয়ংকর কোনো কিছু দেখিয়ে দেয়া থেকে কোনোভাবেই নিজেকে বিরত থাকতে পারেন না, যদি তিনি সেটাকে সত্যি বলে মনে করেন। কাজেই এবার আরেকটা সার-সংক্ষেপ করা যাক।
ঠিক আছে।
এক হিসেবে তুমি বলতে পারো যে জীবন হচ্ছে বিরাট একটা লটারি যেখানে যে-নম্বরগুলো জিতেছে সেগুলোই কেবল দেখা যায়।
কী বলতে চান বলুন তো।
বেঁচে থাকার সংগ্রামে যারা হেরে গিয়েছে তারা অদৃশ্য হয়ে গেছে। পৃথিবীর বুকের উদ্ভিদ এবং প্রাণী জগতের প্রতিটি প্রজাতির বিজেতা নম্বরগুলো নির্বাচন করতে লক্ষ লক্ষ বছর লেগে যায়। আর বিজিত নম্বরগুলোইয়ে, সেগুলো মাত্র একবারই দেখা দেয়। কাজেই প্রাণী এবং উদ্ভিদ-এর যত প্রজাতি এখন টিকে আছে সেগুলোর মধ্যে এমন একটিও নেই যেটি জীবনের বিরাট লটারিতে বিজয়ী নম্বর নয়।
কারণ শ্রেষ্ঠই কেবল টিকতে পেরেছে।
হ্যাঁ, ঘুরিয়ে বললে কথাটা সেটাই দাঁড়ায়। তো, এবার তুমি যদি দয়া করে ওই লোকটার, সেই জু-কীপারের দেয়া ছবিটা আমার কাছে এগিয়ে দাও…
ছবিটা তাঁর হাতে দিল সোফি। সেটার এক পাশ জুড়ে আছে নোয়ার জাহাজটা। অন্য পাশে বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর একটা ট্রি ডায়াগ্রাম। এই দিকটাই সোফিকে এখন দেখাচ্ছেন অ্যালবার্টো।
আমাদের ডারউইনবাদী নোয়া এই স্কেচটাও নিয়ে এসেছেন, যেখানে বিভিন্ন উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রজাতির নানান বিভাগ দেখা যাচ্ছে। দেখতেই পাচ্ছ বিভিন্ন প্রজাতি কীভাবে বিভিন্ন দল, শ্রেণী এবং উপশ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে আছে।
হ্যাঁ।
বানরদের নিয়ে মানুষ রয়েছে তথাকথিত প্রাইমেট শ্রেণীতে। প্রাইমেট হলো স্তন্যপায়ী আর সব স্তন্যপায়ী-ই মেরুদণ্ডী প্রাণীর অন্তর্ভুক্ত, যা কিনা আবার বহুঁকোষী প্রাণীর দলভুক্ত।
প্রায় অ্যারিস্টটলের মতো এটা।
হ্যাঁ, তা ঠিক। কিন্তু স্কেচটা কেবল এখনকার বিভিন্ন প্রজাতির নানান ভাগ-ই বোঝাচ্ছে না। এটা বিবর্তনের ইতিহাসও বলছে খানিকটা। তুমি দেখতে পাবে পাখি এক সময় সরীসৃপ-এর কাছ থেকে ভাগ হয়ে গেছে, সরীসৃপ এক সময় ভাগ হয়ে গেছে উভচরদের কাছ থেকে আর উভচরেরা ভাগ হয়ে গেছে মাছ-এর কাছ থেকে।
হ্যাঁ, সেটা অবশ্য স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।
যখনই কোনো প্রজাতি দুই ভাগ হয়ে যায় তখন তার কারণ হচ্ছে মিউটেশনের কারণে একটা নতুন প্রজাতির জন্ম হয়। এভাবেই যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন শ্রেণী আর উপশ্রেণীর প্রাণীর উদ্ভব হয়েছে। সত্যি বলতে কি, বর্তমান দুনিয়ায় দশ লক্ষেরও বেশি প্রাণী প্রজাতি রয়েছে। আর এই দশ লক্ষ হচ্ছে এই পৃথিবীর বুকে কোনো না কোনো সময় বাস করে যাওয়া প্রজাতিগুলোর একটা ভগ্নাংশ মাত্র। উদাহরণ স্বরূপ, তুমি দেখবে, ট্রায়ালোবিটা নামের প্রাণীর দলটি পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
আর একেবারে নিচের দিকে রয়েছে এককোষী প্রাণী।
এদের মধ্যে কিছু হয়ত দুই বিলিয়ন বছরেও বদলায়নি। তুমি আরো দেখতে পাবে যে এই এককোষী প্রাণীগুলো থেকে একটা লাইন চলে গেছে উদ্ভিদ রাজ্যের দিকে। কারণ, খুব সম্ভবত উদ্ভিদ এসেছে প্রাণীরূপী কোনো আদিম কোষ থেকে।
হ্যাঁ, তা দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু একটা ব্যাপার একেবারে হতবাক করে দিচ্ছে আমাকে।
কী সেটা?
এই আদিম কোষটা কোত্থেকে এলো? এ-প্রশ্নের কি কোনো উত্তর ছিল ডারউইনের কাছে?
আমি তো বলেইছি, বলি নি যে ডারউইন খুব সাবধানী লোক ছিলেন? কিন্তু সেই প্রশ্নের প্রসঙ্গে তিনি নিজে সেটাই প্রস্তাব করেছেন লোকে হয়ত যেটাকে বলবে যথার্থ অনুমান। তিনি লিখেছেন:
যদি (আর হ্যাঁ, কী বিশাল এক যদি!) আমরা ছোট্ট একটা উত্তপ্ত জলাশয়ের কথা চিন্তা করতে পারি যেখানে অ্যামোনিয়া আর ফসফরাসের সব ধরনের লবণ, আলো, উত্তাপ, বিদ্যুৎ এবং এ-রকম আরো কিছু উপস্থিত আর সেখানে যদি একটি প্রোটিন যৌগ রাসায়নিকভাবে তৈরি হওয়ার কথা থাকতো যা কিনা আরো অনেক বেশি জটিল পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যাওয়ার জন্যে প্রস্তুত…
তাহলে কী হতো?
ডারউইন আসলে এখানে যে-ব্যাপারটি দার্শনিকভাবে বিচার করছিলেন তা হলো অজৈব পদার্থ বা বস্ত থেকে কীভাবে প্রথম জীবন্ত কোষ সৃষ্টি হয়ে থাকতে পারে সেটা। এবং আবারো তিনি একেবারে মোক্ষম জায়গাটিতেই হাত দিয়েছিলেন। এখনকার বৈজ্ঞানিকেরা মনে করেন জীবনের আদিমতম রূপটি ঠিক সেই ধরনেরই ছোট্ট একটা উত্তপ্ত জলাশয়ের মধ্যে উদ্ভূত হয়েছিল যে-রকমটি ডারউইন চিন্তা করেছিলেন।
বলে যান।
এটুকুতেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে তোমাকে, কারণ ডারউইনের কাছ থেকে বিদায় নেবো আমরা এখন। পৃথিবীতে প্রাণের উৎস সম্পর্কে একেবারে সাম্প্রতিক আবিষ্কারগুলোর কাছে চলে আসবো আমরা এখন সামনের দিকে লাফ দিয়ে।
আমার কিন্তু খানিকটা সন্দেহ আছে। জীবন কীভাবে শুরু হয়েছিল সেটা কি আসলেই কেউ জানে
তা হয়ত জানে না, কিন্তু সেটা কীভাবে শুরু হয়ে থাকতে পারে সে-ব্যাপারে যে-রহস্য তা ক্রমেই খোলাসা হয়ে আসছে।
কীরকম?
প্রথমেই একটা বিষয় সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে নেয়া যাক-পৃথিবীতে উদ্ভিদ এবং প্রাণীজ সমস্ত প্রাণ-ই ঠিক একই বস্তু দিয়ে তৈরি। জীবনের বা প্রাণের সরলতম সংজ্ঞা হচ্ছে এটা এমন একটি বস্তু যা একটা পুষ্টিদায়ী দ্রবনে (nutrient solution) নিজেকে একেবারে একই রকম দুটো অংশে বিভক্ত করে ফেলতে পারে। এই প্রক্রিয়াটিকে যা নিয়ন্ত্রণ করে তাকে আমরা বলি ডিএনএ (DNA)। ডিএনএ বলতে আমরা ক্রোমোজম বা বংশগত কাঠামোকে বুঝাই যা কিনা সব জীব কোষেই পাওয়া যায়। আমরা অবশ্য ডিএনএ অণু কথাটিও ব্যবহার করি কারণ ডিএনএ আসলে একটা জটিল অণু বা বৃহৎ অণু। কিন্তু এরপরের প্রশ্ন হলো প্রথম অণুটার সৃষ্টি কী করে হলো।
হ্যাঁ?
৪.৬ বিলিয়ন বছর আগে যখন সৌরজগৎ সৃষ্টি হয়েছিল তখন পৃথিবী গঠিত হয়। এটার শুরুটা হয়েছিল একটা উজ্জ্বল পিণ্ড হিসেবে, যা ধীরে ধীরে ঠাণ্ডা হয়ে পড়েছিল। আধুনিক বিজ্ঞান মনে করে, তিন থেকে চার বিলিয়ন বছর আগে ঠিক এখানেই প্রাণের সূত্রপাত ঘটেছিল।
পুরোপুরি অসম্ভব শোনাচ্ছে ব্যাপারটা।
বাকিটা শোনার আগে ও-কথা বোলো না। প্রথম কথা হচ্ছে, আজকে যেমন দেখাচ্ছে তার চেয়ে একেবারে অন্য রকম ছিল আমাদের গ্রহটা। যেহেতু প্রাণের কোনো অস্তিত্ব ছিল না, বায়ুমণ্ডলে তাই কোনো অক্সিজেন ছিল না। উদ্ভিদের সালোক সংশ্লেষণের সাহায্যেই প্রথমে তৈরি হয়েছিল মুক্ত অক্সিজেন। এবং, কোনো অক্সিজেন না-থাকার ব্যাপারটা কিন্তু বেশ গুরুত্বপূর্ণ। যে-বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেন রয়েছে সেখানে প্রাণ কোষ যা কিনা আবার ডিএনএ গঠন করতে পারে, তার উদ্ভব হওয়ার সম্ভাবনা কম।
কেন?
কারণ অক্সিজেন অত্যন্ত রিঅ্যাক্টিভ। ডিএনএ-র মতো জটিল অণু তৈরি হওয়ার অনেক আগেই ডিএনএ-র আণবিক কোষগুলো অক্সিডাইজড হয়ে যেতো।
বটে।
একভাবেই আমরা নিশ্চিতভাবে জানি যে এখন আর নতুন কোনো প্রাণের উদ্ভব ঘটে না, এমনকী কোনো ব্যাকটেরিয়াম বা কোনো ভাইরাস হিসেবেও নয়। পৃথিবীতে যত প্রাণ রয়েছে তার সবগুলোর বয়স অবশ্যই একই সমান হবে। একটা হাতির বংশতালিকা ঠিক ততোটাই লম্বা যা লম্বা ক্ষুদ্রতম ব্যাকটেরিয়ামের বংশতালিকা। তুমি একরকম বলতেই পারে যে একটা হাতি বা একজন মানুষ আসলে এককোষী প্রাণীর একটি একক সঙ্গতিপূর্ণ উপনিবেশ। কারণ আমাদের শরীরের প্রতিটি কোষ একই বংশগত উপাদান বয়ে বেড়ায়। আমরা কে বা কী তার পুরো বর্ণনা প্রতিটি ক্ষুদ্র কোষের ভেতর লুকিয়ে রয়েছ।
এটা কিন্তু একটা অদ্ভুত ধারণা।
জীবনের অন্যতম বড় রহস্য হচ্ছে এই যে একটি বহুঁকোষী প্রাণীর কোষগুলো তাদের কাজকর্মে বিশিষ্ট হয়ে উঠতে পারে, যদিও সব কোষের ভেতরের বিভিন্ন বংশগত বৈশিষ্ট্যের সবগুলোই সক্রিয় অবস্থায় থাকে না। এই বৈশিষ্ট্যগুলোর বা জিন-এর কিছু সক্রিয় হয়ে ওঠে, অন্যগুলো নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। একটি যকৃত কোষ কখনোই একটি স্নায়ু কোষ বা ত্বক কোষ যে-প্রোটিন তৈরি করে ঠিক সেই প্রোটিন তৈরি করে না। কিন্তু এই তিন ধরনের কোষেরই রয়েছে একই ডিএনএ অণু যার মধ্যে বিশেষ সেই প্রাণীর সমস্ত বর্ণনা পুরে দেয়া আছে।
বায়ুমণ্ডলে যেহেতু কোনো অক্সিজেন ছিল না, পৃথিবীর চারপাশে তাই সুরক্ষামূলক কোনো ওজোন স্তর-ও ছিল না। তার অর্থ, মহাজগৎ থেকে আসা বিকিরণ ঠেকানোর মতো ছিল না কিছুই। এই ব্যাপারটাও এ-কারণে গুরুত্বপূর্ণ যে এই বিকিরণ সম্ভবত প্রথম জটিল অণু গঠনের বেলাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল। পৃথিবীর বিভিন্ন রাসায়নিক বস্তুকে জটিল বিরাট অণুতে পরিণত হওয়ার জন্যে একত্রিত হতে শুরু করার ক্ষেত্রে এ-ধরনের মহাজাগতিক বিকিরণই ছিল প্রকৃত শক্তি।
আচ্ছা।
ব্যাপারটা সংক্ষেপে বলছি আবার সব প্রাণের মধ্যে যে-ধরনের জটিল অণু থাকে সেগুলো তৈরি হওয়ার আগে অন্তত দুটো শর্ত পূরণ হতে হবে: পরিবেশে কোনো অক্সিজেন থাকবে না এবং মহাজাগতিক বিকিরণ-এর প্রবেশাধিকার থাকতেই হবে।
বুঝতে পারছি।
এই ছোট্ট, উত্তপ্ত জলাশয় বা, আধুনিক বিজ্ঞানীরা যাকে প্রায়ই বলেন আদিম স্যুপ সেখানে একবার জন্ম নিল ভীষণরকমের জটিল এক বিরাট অণু যেটার ছিল নিজেকে হুবহু একই রকম দুই অংশে বিভক্ত করার এক আশ্চর্য ক্ষমতা। আর তাই শুরু হলো দীর্ঘ বিবর্তন প্রক্রিয়া, সোফি। ব্যাপারটাকে খানিকটা সরলীকরণ করলে আমরা বলতে পারি যে আমরা এখন প্রথম বংশগত উপাদান, প্রথম ডিএনএ বা প্রথম জীবন্ত কোষটির কথা বলছি। নিজেকে সেটা বিভক্ত করেই চলল, তবে একেবারে প্রথম পর্যায় থেকেই কিন্তু ট্রান্সমিউটেশন ঘটে চলছিল। এর বহু যুগ পর এই এককোষী প্রাণীগুলোর একটি যুক্ত হলো আরো জটিল একটি বহুঁকোষী প্রাণীর সঙ্গে। এভাবে সালোকসংশ্লেষণও শুরু হলো আর এভাবেই বায়ুমণ্ডলে উপস্থিত হলে অক্সিজেন। এর ফল হলো দুটো: প্রথমত, পরিবেশ এমন সব প্রাণীর বিবর্তনের অনুমতি দিল যারা ফুসফুসের সাহায্যে শ্বাস-প্রশ্বাসের কাজ চালাতে পারে। দ্বিতীয়ত, বায়ুমণ্ডল প্রাণ-কে ক্ষতিকর মহাজাগতিক বিকিরণ থেকে রক্ষা করল। ব্যাপারটা খুবই আশ্চর্যের যে এই বিকিরণ যা কিনা প্রথম কোষ গঠনের ক্ষেত্রে সম্ভবত একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ফুলিঙ্গ-র কাজ করেছিল, সেটাই কিন্তু সব ধরনের প্রাণের জন্যে ক্ষতিকারক।
কিন্তু বায়ুমণ্ডল নিশ্চয়ই রাতারাতি তৈরি হয়নি। একেবারে গোড়ার দিককার প্রাণগুলো টিকে থাকল কী করে?
জীবনের সৃষ্টি হয়েছিল আদিম সব সাগরে-আদিম স্যুপ বলতে সেগুলোর কথাই বোঝাই আমরা। সেখানেই তা ক্ষতিকর রশ্মির হাত থেকে সুরক্ষিত অবস্থায় বাঁচতে পেরেছিল। অনেক দিন পর যখন মহাসমুদ্রের প্রাণ একটা বায়ুমণ্ডল সৃষ্টি করল, কেবল তখনই প্রথম উভচরেরা হামাগুড়ি দিয়ে উঠে এসেছিল ডাঙায়। এরপর যা ঘটল তা নিয়ে এরিমধ্যে আলাপ করেছি আমরা। আর এখন এইখানে বসে আছি দুজনে, বনের মধ্যে একটা কুঁড়েঘরে, ফিরে তাকাচ্ছি এমন একটা প্রক্রিয়ার দিকে যা তিন থেকে চার বিলিয়ন বছর সময় নিয়েছে। আর আমাদের ভেতরেই এই দীর্ঘ প্রক্রিয়াটা শেষ পর্যন্ত সচেতন হয়ে উঠল নিজের সম্পর্কে।
এবং তারপরেও আপনি মনে করেন না যে এর সবই ঘটেছে নেহাত আকস্মিকভাবে?
সেকথা কখনো বলিনি আমি। এই বোর্ডের ছবিটা দেখিয়ে দিচ্ছে যে বিবর্তনের একটা লক্ষ্য ছিল। যুগ যুগ ধরে ক্রমেই আরো বেশি জটিল হয়ে ওঠা নার্ভ সিস্টেম আর বড় হয়ে ওঠা মস্তিষ্ক নিয়ে বিবর্তিত হয়েছে প্রাণীগুলো। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, ব্যাপারটা নেহাত আকস্মিক হতে পরে না। তোমার কী মনে হয়?
একেবারে হঠাৎ করে মানুষের চোখ তৈরি হতে পারে না। আপনার কি মনে হয় না যে আমরা যে আমাদের চারপাশের জগন্টা দেখতে পাচ্ছি তার একটা অর্থ আছে?
মজার ব্যাপার হলো, চোখের বিকাশটা ডারউইনকেও একেবারে তাজ্জব করে দিয়েছিল। চোখের মতো এ-রকম সূক্ষ্ম এবং সংবেদনশীল একটা জিনিস পুরোপুরি প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে এই ব্যাপারটা ডারউইন আসলে মেনে নিতে পারেননি।
অ্যালবার্টোর মুখের দিকে তাকিয়ে বসে রইল সোফি। সে ভাবছে ব্যাপারটা কী অদ্ভুত যে এই মুহূর্তে বেঁচে আছে সে এবং সে মাত্র এই একবারের জন্যেই বাঁচছে এবং আর কখনোই এই জীবনে ফিরে আসবে না। হঠাৎ সে বলে উঠল:
What matters our creative endless toil,
When, at a snatch, oblivion ends the coil?
ভুরু কুঁচকে সোফির দিকে তাকালেন অ্যালবার্টো।
ওভাবে বলতে হয় না,মেয়ে। ওগুলো শয়তানের কথা।
শয়তান?
বা মেফিস্টোফেলিস, গ্যেটের ফাউস্ট-এর। Was soll uns denn das ew ge Schaffen! Geschaffenes zu nichts hinwegzuraffen!!
কিন্তু কথাগুলোর মানেটা ঠিক কী?
মারা যাওয়ার সময় ফাউস্ট নিজের জীবনের দিকে ফিরে তাকিয়ে বিজয়োল্লাসের সঙ্গে বলে ওঠেন:
Then to moment could I say:
Linger you now, you are so fair!
Now records of my earthly day
No flights of aeons can impair
Foreknowledge comes, and fills me with such bliss,
I take my joy, my highest moment this.
দারুণ কাব্যিক তো।
কিন্তু এরপর শয়তানের পালা। ফাউস্ট মারা যেতেই সে বলে ওঠে:
A foolish word, bygone.
How so then, gone?
Gone, to sheer Nothing, past with null made one!
What matters our creative endless toil,
When, at a snatch, oblivion ends the coil?
ÒIt is bygoneÑHow shall this riddle run?
As good as if things never had begun,
Yet circle back, existence to possess:
Id rather have Enternal Emptiness.
এটা কিন্তু হতাশাভরা কথা হলো। প্রথম প্যাসেজটাই বরং বেশি পছন্দ হয়েছে আমার। যে-সব চিহ্ন তিনি রেখে যাবেন সে-সবের মধ্যে খানিকটা অর্থ দেখতে পেয়েছিলেন ফাউস্ট জীবনের একেবারে শেষ মুহূর্তে দাঁড়িয়েও।
আর, আমরা যে সর্বব্যাপী একটা কিছুর অংশ যেখানে প্রতিটি ক্ষুদ্র প্রাণেরই একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে সেই বিশাল ছবিটাতে, সেটা কি ডারউইনের তত্ত্বেরই একটা ফলস্বরূপ নয়? আমরাই হচ্ছি জীবন্ত গ্রহ, সোফি! আমরা হচ্ছি সেই বিরাট জাহাজ যা মহাবিশ্বে এক জ্বলন্ত সূর্যের চারদিকে ভেসে বেড়াচ্ছে। কিন্তু আমাদের প্রত্যেকেই আবার একটি জাহাজ যা জিন-এর কার্গো নিয়ে ভেসে চলেছে জীবনের ভেতর দিয়ে। এই কার্গো নিরাপদে আরেক পোতাশ্রয়ে নিয়ে যেতে পারলে তবেই আমাদের জীবন সার্থক। টমাস হার্ডি তার কবিতা Transformations-এ ঠিক এই ভাবটি-ই ব্যক্ত করেছেন:
Portion of this yew
Is a man my grandsire knew
Bossomed here at its foot:
This branch may be his wife,
A ruddy human life
Now turned to a green shoot.
These grasses must be made
Of her who often prayed
Last century, for repose;
And the fair girl long ago
Whom I often tried to know
May be entering this rose.
So, they are not underground,
But as nerves and veins abound
In the growths of upper air,
And they feel the sun and rain,
And the energy again
That made then what they were!
বাহু, কী সুন্দর!
কিন্তু আর কোনো কথা নয়। আমি শুধু বলছি, পরের চ্যাপ্টার!
আহ্, বন্ধ করুন তো আপনার এ-সব আয়রনি!
আমি বলেছি, নতুন চ্যাপ্টার! আমার কথা শুনতে হবে।