০৮. এথেন্স
…সেই ধ্বংসস্তূপের মধ্যে বেশ কিছু উঁচু দালানকোঠা দাঁড়িয়ে গেল…
সেদিন সন্ধ্যের পরপরই সোফির মা তার এক বন্ধুর বাসায় বেড়াতে গেলেন। তিনি বাড়ির বাইরে যেতেই সোফি বাগানে নেমে এসে তার ডেরায় গিয়ে হাজির হলো। সেখানে বিস্কিটের বড় টিনটার পাশে মোটাসোটা একটা প্যাকেট দেখতে পেল সে। মুখটা ছিঁড়ে সেটা খুলল সোফি। বের হলো একটা ভিডিও ক্যাসেট।
দৌড়ে বাড়িতে ফিরে এলো সোফি। ভিডিও টেপ! দার্শনিক ভদ্রলোক কী করে জানলেন ওদের বাসায় ভিসিআর আছে? আর ক্যাসেটটাই বা কীসের?
রেকর্ডারে ক্যাসেটটা ঢোকাল সোফি। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা একটা শহরের ছবি ফুটে উঠল টিভি স্ক্রিনে। অ্যাক্রোপলিসের ওপর ক্যামেরা যুম করতে সোফি বুঝতে পারল শহরটা নিশ্চয়ই এথেন্স। এখানকার প্রাচীন ধ্বংসাবশেষের ছবি প্রায়ই চোখে পড়েছে তার।
শটটা লাইভ। গ্রীষ্মকালীন পোশাক পরা ট্যুরিস্টরা কাঁধে ক্যামেরা ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে সেই ধ্বংসাবশেষের মধ্যে। এদের মধ্যে একজনকে দেখে মনে হলো সে একটা নোটিশ নিয়ে ঘুরছে। ঐ তো আবার দেখা গেল নোটিশটা। হিল্ডা লেখা না ওটাতে?
দুএক মিনিট পর মধ্যবয়স্ক এক পুরুষের কোজ-আপ ছবি দেখা গেল। দেখতে লোকটি ছোটখাটো, মুখে কালো, সুন্দর করে ছাঁটা দাড়ি, মাথায় একটা নীল বেরে টুপি। সরাসরি ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে তিনি বলে উঠলেন: এথেন্সে তোমাকে স্বাগতম, সোফি। সম্ভবত তুমি অনুমান করতে পারছ, আমি অ্যালবার্টো নক্স। যদি না পেরে থাকো তাহলে আমাকে ফের বলতে হচ্ছে যে পেল্লায় খরগোশটাকে মহাবিশ্বের টপ হ্যাঁটের ভেতর থেকে এখনো টেনে বের করা হচ্ছে।
আমরা দাঁড়িয়ে আছি অ্যাক্রোপলিসে। শব্দটার অর্থ দুর্গ, বা আরো ঠিক করে বললে, পাহাড়ের ওপরের শহর। মানুষ সেই প্রস্তর যুগ থেকে বাস করে আসছে এখানে। তার কারণ অবশ্যই শহরটার অসাধারণ অবস্থান। উঁচু এই মালভূমিটিকে লুটেরাদের হাত থেকে রক্ষা করাটা সহজ ছিল। সেই সঙ্গে, অ্যাক্রোপলিস থেকে। নিচে ভূমধ্যসাগরের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পোতাশ্রয়ের চমৎকার একটি দৃশ্যও দেখতে পাওয়া যেতো। মালভূমির নিচে সমভূমিতে যখন গোড়ার দিককার এথেন্সের বিস্তার হচ্ছে অ্যাক্রোপলিস তখন একটি দুর্গ এবং পবিত্র মন্দির হিসেবে ব্যবহৃত হতো।…পঞ্চম খ্রিস্ট পূর্বাব্দে পারসিকদের সঙ্গে এক প্রবল যুদ্ধ শুরু হয় এবং ৪৮০ তে পারস্যদেশের রাজা জেরেক্সেস এথেন্সে লুটতরাজ চালিয়ে অ্যাক্রোপলিসের সমস্ত পুরনো কাঠের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেন। এক বছর পর পারসিকরা পরাজয় স্বীকার করে নেয় আর তখন থেকেই এথেন্সের স্বর্ণযুগের শুরু। নতুন করে তৈরি করা হয় অ্যাক্রোপলিস, আগের যে-কোনো সময়ের চেয়ে গৌরবান্বিত আর জাকজমকপূর্ণভাবে এবং এবার পুরোপুরি একটি পবিত্র মন্দির হিসেবে।
এই সেই সময় যখন সক্রেটিস এথেন্সবাসীদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে রাস্তা বা নগর-চত্বরের ভেতর দিয়ে হেঁটে বেড়াতেন। কাজেই অ্যাক্রোপলিসের পুনর্জন্মের দৃশ্য তিনি হয়ত দেখে থাকবেন, দেখে থাকবেন আমাদের চারপাশের এইসব গৌরবদীপ্ত দালান-কোঠা নির্মাণের দৃশ্য। আর সে কী এক নির্মাণস্থলই না ছিল জায়গাটা। আমার পেছনে তুমি দেখতে পাচ্ছে সবচেয়ে বড় মন্দির পার্থেনন (Parthenon), যার অর্থ কুমারীর বাসভবন। এথেন্সের অধিষ্ঠাত্রী দেবী এথেনার সম্মানে তৈরি করা হয়েছিল মন্দিরটি। মার্বেল পাথরের বিশাল কাঠামোতে একটিও সরলরেখা নেই; চারটি পাশের সব কাঠই খানিকটা বাঁকা করে তৈরি করা হয়েছে যাতে ভবনটিকে অপেক্ষাকৃত কম ভারি বলে বোধ হয়। ভবনটির আকৃতি বিশাল হলেও দেখতে সেটাকে ততটা গুরুভার মনে হয় না। অন্য কথায়, ভবনটির দিকে তাকালে দৃষ্টিবিভ্রম ঘটে। স্তম্ভগুলো ভেতরের দিকে ঝুঁকে আছে খানিকটা আর সেগুলোকে যদি ওপরের দিকে বাড়তে দেয়া হতো তাহলে সেগুলো মন্দিরের ১৫০০ মিটার উঁচুতে একটি বিন্দুতে মিলিত হয়ে একটি পিরামিড তৈরি করত। মন্দিরটিতে এথেনার একটি বারো মিটার উঁচু মূর্তি ছাড়া আর কিছুই ছিল না। সাদা মার্বেল পাথরগুলো এখানে নিয়ে আসা হয়েছিল ষোল কিলোমিটার দূরবর্তী একটি পাহাড় থেকে আর সেই পাথরগুলোকে সে-সময়ে নানান রঙে রাঙান হয়েছিল।
সোফির বুকটা ভীষণ ধড়ফড় করছিল। সত্যিই কি সেই দার্শনিক তার সঙ্গে কথা বলছেন? অন্ধকারে কেবল তাঁর মুখের একটা পাশ দেখেছিল সে একবার। তিনিই কি সেই মানুষ যিনি এখন এথেন্সের অ্যাক্রোপলিসে দাঁড়িয়ে আছেন?
এবার তিনি মন্দিরের দৈর্ঘ্য বরাবর হাঁটতে শুরু করলেন, ক্যামেরা তাঁকে অনুসরণ করল। চত্বরের একেবারে প্রান্ত পর্যন্ত হেঁটে গেলেন তিনি, তারপর সামনের ভূ-দৃশ্যের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন। ক্যামেরা একটি পুরনো থিয়েটারের ওপর ফোকাস করল। থিয়েটারটা অ্যাক্রোপলিস মালভূমির ঠিক নিচেই।
বেরে পরা মানুষটি বলে চললেন, এবার তুমি দেখতে পাচ্ছো ডায়োনিসাস থিয়েটার। এটাই সম্ভবত ইউরোপের সবচেয়ে পুরনো থিয়েটার। সক্রেটিসের সময় এখানেই ইস্কিলাস আর ইউরিপিদিসের বিখ্যাত ট্র্যাজেডিগুলো অভিনীত হতো। হতভাগ্য রাজা ঈডিপাসের কথা তোমাকে আগেই বলেছি। তাঁর জীবন নিয়ে লেখা সফোক্লিসের ট্র্যাজিডিটি এখানেই প্রথম অভিনীত হয়েছিল। অবশ্য এখানে কমেডিও অভিনীত হতো। আর কমেডির সেরা লেখক ছিলেন অ্যারিস্টোফেনিস; সক্রেটিসকে এথেন্সের ভাড় হিসেবে দেখিয়ে একটি আক্রোশপূর্ণ কমেডি রচনা করেছিলেন তিনি। ঠিক পেছনেই তুমি যে পাথুরে দেয়াল দেখতে পাচ্ছো সেটাকে অভিনেতারা ব্যাকড্রপ বা পশ্চাদপট হিসেবে ব্যবহার করতেন। এটাকে বলা হতো স্কিনি (skene) আর এই শব্দটিই সীন (scene) বা দৃশ্য শব্দটির উৎস। ঘটনাক্রমে থিয়েটার শব্দটি এসেছে একটি প্রাচীন গ্রীক শব্দ থেকে যার অর্থ দেখা। তবে আমাদেরকে দার্শনিকদের কাছে ফিরে যেতে হচ্ছে, সোফি। আমরা পার্থেননের চারপাশটা একটু ঘুরে ফিরে দেখবো, হাঁটবো গোটা প্রবেশপথটা ধরে…।
ছোট্ট মানুষটি বিশাল মন্দিরটি ঘুরেফিরে দেখতে লাগলেন, ডান দিকের কয়েকটি ছোট ছোট মন্দির পেরিয়ে এলেন। এরপর তিনি কয়েকটি উঁচু স্তম্ভের মাঝখানের একটা সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে লাগলেন। অ্যাক্রোপলিসের পাদদেশে নেমে এসে ছোট্ট একটা পাহাড়ের ওপর গিয়ে দাঁড়ালেন তিনি, তারপর অঙ্গুলি নির্দেশ করলেন এথেন্সের দিকে। যে-পাহাড়ের ওপর আমি এখন দাঁড়িয়ে আছি তার নাম অ্যারিওপেগস (Areopagos)। এখানেই এথেন্সের হাইকোর্ট হত্যা মামলার বিচার করত। বেশ কয়েক শ বছর পর যীশু শিষ্য সেন্ট পল এখানে দাঁড়িয়ে এথেন্সবাসীদের উদ্দেশ্যে যীশু এবং খ্রিস্টধর্ম সম্পর্কে বক্তব্য রেখেছিলেন। তিনি কী বলেছিলেন তা আমরা পরে এক সময় আলোচনা করবো। নিচেই বাম। দিকে তুমি যা দেখছ তা হচ্ছে এথেন্সের পুরনো নগর-চত্বর অ্যাগোরা-র ধ্বংসাবশেষ। কামার এবং ধাতুকর্মকারদের দেবতা হেফাস্টাসের বিরাট মন্দিরটি বাদ দিলে মার্বেল পাথরের কয়েকটা বড় বড় টুকরোই কেবল সংরক্ষিত আছে। এখন। এবার চলল, নিচে নামা যাক…
এরপরই তাকে দেখা গেল প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ-এর মধ্যে। খোলা আকাশের। নিচে অনেক উঁচুতে– সোফির স্ক্রীনের একেবারে ওপরে– মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে এথেনার মন্দির, অ্যাক্রোপলিসের ওপরে। তার দর্শন শিক্ষক মার্বেল পাথরের একটা বড়সড় টুকরোর ওপর বসে পড়েছেন। ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে তিনি বলে উঠলেন: আমরা এখন বসে আছি এথেন্সের প্রাচীন অ্যাগোরা-য়। খুবই দুঃখজনক দৃশ্য, তাই না? মানে, আমি আজকের কথা বলছি। কিন্তু একদিন এখানে ছিল দুর্দান্ত সব মন্দির, আদালত, অন্যান্য সরকারী অফিস, দোকানপাট, একটি কনসার্ট হল আর এমনকী একটা শরীরচর্চা কেন্দ্র। এর সব কিছুই ছিল চত্বরটাকে ঘিরে, একটি বিশাল ভোলা জায়গাকে কেন্দ্র করে …। গোটা ইউরোপিয় সভ্যতার ভিত্তি রচিত হয়েছিল এই সাধারণ এলাকাটিতে।
রাজনীতি ও গণতন্ত্র, অর্থনীতি ও ইতিহাস, জীববিজ্ঞান ও পদার্থ বিজ্ঞান, গণিতশাস্ত্র ও যুক্তিবিদ্যা, ঈশ্বরতত্ত্ব ও দর্শন, নীতিবিদ্যা এবং মনোবিজ্ঞান, তত্ত্ব ও পদ্ধতি, আইডিয়া ও শৃঙ্খলা, ইত্যাদি শব্দ এই ছোট্ট জনগোষ্ঠীর কাছ থেকেই গাওয়া আর সেই জনগোষ্ঠীর দৈনন্দিন জীবন আবর্তিত হতো এই চত্বরকে ঘিরে। এখানেই সক্রেটিস তার জীবনের অনেকটা সময় কাটিয়েছেন লোকজনের সঙ্গে কথা বলে। হয়তো তিনি জলপাই তেলের পাত্র নিয়ে হেঁটে যেতে থাকা কোনো দাসের পথ আটকে হতভাগ্য লোকটাকে দর্শনের কোনো প্রশ্ন জিগ্যেস করলেন, কারণ সক্রেটিস মনে করতেন একজন দাস আর একজন সম্ভ্রান্ত মানুষ একই পরিমাণ কাণ্ডজ্ঞানে অধিকারী। কখনো আবার হয়তো তিনি কোনো নাগরিকের সঙ্গে তুমুল বিবাদে জড়িয়ে পড়তেন, অথবা নিম স্বরে তার তরুণ ছাত্র প্লেটোর সঙ্গে সেরে নিতেন। কোনো আলাপ। কথাটা ভাবতে কী অসাধারণই না লাগে। আমরা এখনো সক্রেটিস বা প্লেটোর দর্শনের কথা বলি, কিন্তু সত্যিকার অর্থে প্লেটো বা সক্রেটিস হওয়া একেবারে ভিন্ন ব্যাপার।
সোফির কাছে সত্যিই মনে হলো যে ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করতে অসাধারণ লাগছে। কিন্তু বাগানে তার নিজের গোপন ডেরায় একটা রহস্যময় কুকুরের নিয়ে আসা ভিডিওতে দার্শনিক ভদ্রলোক যেভাবে তার সঙ্গে কথা বলছেন সেটাও ঠিক একই রকমের অসাধারণ একটি ব্যাপার বলে মনে হলো তার কাছে।
মার্বেল পাথরের যে-টুকরোর ওপর দার্শনিক বসে ছিলেন সেটা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। তারপর শান্তভাবে বললেন, আমি আসলে এখানেই শেষ করতে চেয়েছিলাম সোফি। আমি চেয়েছিলাম যেন তুমি এথেন্সের অ্যাক্রোপলিস আর অ্যাগোরার প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ দেখ। কিন্তু আমি এখনো ঠিক নিশ্চিত নই যে একসময় এই এলাকাটা কতটা অসাধারণ ছিল সেটা তুমি বুঝতে পেরেছো কিনা…কাজেই আরেকটু আগে বাড়ার লোভটা সামলাতে পারছি না। ব্যাপারটা যদিও একটু খাপছাড়া, কিন্তু আমি জানি এটা যে শুধু তোমার আর আমার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে সে ব্যাপারে আমি তোমার ওপর ভরসা রাখতে পারি। তাছাড়া, দৃশ্যটা কয়েক মুহূর্তের শুধু, তার বেশি দরকার হবে না…
আর কোনো কথা বললেন না তিনি, তবে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলেন বেশ কিছুক্ষণ। আর তাঁর অপেক্ষার মুহূর্তটিতে সেই ধ্বংসস্তৃপের মধ্যে বেশ কিছু উঁচু দালানকোঠা দাঁড়িয়ে গেল। যেন কোনো জাদুবলে পুরনো ভবনগুলো সব দাঁড়িয়ে পড়েছে আবার। দিগন্তের ওপর এখনো অ্যাক্রোপলিস দেখতে পাচ্ছে সোফি, কিন্তু সেটা আর নিচের চত্বরের সব কটা দালান এখন ঝকঝকে নতুন হয়ে গেছে। সেগুলো এখন সোনায় মোড়া আর জমকালো রঙে ছোপানে।
রঙচঙে পোষাক পরা লোকজন চত্বরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কারো কারো সঙ্গে তরবারি, কারো কারো মাথায় মাটির পাত্র, আবার এদের একজনের বাহুর নিচে এক রোল প্যাপিরাস।
হঠাৎ করেই সোফি তার দর্শন শিক্ষককে চিনতে পারল। মাথায় তার এখনো নীল বেরে-টা থাকলেও এখন তিনি বাকি সবার মতোই হলুদ একটা টিউনিক পরে আছেন। সোফির দিকে এগিয়ে এসে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে তিনি বলে উঠলেন
এইবার ভালো হয়েছে। আমরা এখন প্রাচীন এথেন্সে দাঁড়িয়ে রয়েছি, সোফি। আমি চেয়েছিলাম তুমি নিজেই এখানে চলে আসো। যাই হোক, আমরা এখন রয়েছি ৪০২ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে, সক্রেটিসের মৃত্যুর মাত্র তিন বছর আগে। আশা করছি এই বিশেষ প্রমণপর্বটি তুমি উপভোগ করবে, কারণ একটা ভিডিও ক্যামেরা জোগাড় করাটা সহজ কাজ ছিল না…
মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল সোফির। অদ্ভুত এই লোকটি হঠাৎ করে কীভাবে ২,৪০০ বছর আগেকার এথেন্সে গিয়ে হাজির হলেন? কীভাবে একেবারে ভিন্ন যুগের একটি ভিডিও ফিল্ম দেখছে সে? প্রাচীনকালে তো কোনো ভিডিও ছিল না…তাহলে কি এটা কোনো মুভি?
কিন্তু মার্বেল পাথরের দালানকোঠাগুলোকে তো একেবারে বাস্তব বলে মনে হচ্ছে। স্রেফ একটা ফিল্মের জন্যে যদি ওরা এথেন্সের প্রাচীন নগর-চত্বর আর অ্যাক্রোপলিসকে নতুন করে তৈরি করে থাকে তাহলে তো সেটের জন্যে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচা হয়েছে। স্রেফ সোফিকে এথেন্স সম্পর্কে জ্ঞান দান করবার জন্যে খরচটা বড় বাড়াবাড়ি রকমের হয়ে গেছে।
বেরে-পরা মানুষটি আবার তাকালেন সোফির দিকে।
ওই ওখানে কলোনেডের নিচে দুজন লোককে দেখতে পাচ্ছো?
কোঁচকানো টিউনিক পরা একজন বয়স্ক লোক। তার মুখে অযত্নচর্চিত লম্বা দাড়ি, নাকটা থ্যাবড়া, চোখ দুটো তুরপুনের মতো, গাল দুটো ফোলা ফোলা। তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে সুদর্শন এক যুবক।
এঁরা হচ্ছেন সক্রেটিস আর তার তরুণ ছাত্র প্লেটো। এক্ষুণি তোমার সঙ্গে আলাপ হবে তাদের।
দার্শনিক এগিয়ে গেলেন তাঁদের দিকে, মাথা থেকে বেরে-টা খুলে নিলেন, তারপর কী যেন বললেন সোফি তা বুঝতে পারল না। নিশ্চয়ই গ্রীক ভাষায় কথা বলেছেন তিনি। এরপর ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে তিনি বলে উঠলেন। আমি ওঁদেরকে বলেছি তুমি নরওয়ের একটি মেয়ে, ওঁদের সঙ্গে পরিচিত হতে পারলে খুব খুশি হবে। কাজেই প্লেটো এবার তোমাকে কয়েকটা প্রশ্ন দেবেন সেগুলো নিয়ে চিন্তা করবার জন্যে। অবশ্য কাজটা খুব তাড়াতাড়ি করতে হবে, রক্ষীরা আমাদেরকে দেখে ফেলবার আগেই। তরুণ লোকটি এগিয়ে এসে ক্যামেরার দিকে তাকাতে সোফি অনুভব করল তার নিজের কপালের দুপাশে দ দ করছে।
এথেন্সে তোমাকে স্বাগত জানাচ্ছি, সোফি, শান্ত কণ্ঠে বললেন তিনি। তার গলায় বিশেষ একটা টান রয়েছে। আমার নাম প্লেটো, আমি তোমাকে চারটে কাজ দিচ্ছি। প্রথমে ভেবে বের করে একজন রুটিওয়ালা কী করে একেবারে একই রকম দেখতে পঞ্চাশটা বিস্কিট তৈরি করে। এরপর ভেবে দেখতে পারো সব ঘোড়াই কেন একই রকম। এরপর তোমাকে বলতে হবে মানুষের আত্মা অমর কিনা। আর সবশেষে তোমাকে বলতে হবে পুরুষ এবং নারী একই রকমের সুবুদ্ধিসম্পন্ন কিনা। পারবে আশা করি।
এরপরই টিভি-পর্দার ছবিটা নেই হয়ে গেল। সোফি টেপটা বারবার সামনে পিছে নিয়ে চালিয়ে দেখল কিন্তু সেই দৃশ্যটা আর খুঁজে পেল না।
পুরো ব্যাপারটা ভালো করে ভেবে দেখার চেষ্টা করল সোফি। কিন্তু একটা বিষয় নিয়ে ভাববার চেষ্টা করতেই সেটার পিছু পিছু আরেকটা ভাবনা এসে হাজির হলো, অথচ প্রথম বিষয়টা নিয়েই তখনো পুরোপুরি ভেবে উঠতে পারেনি সে।
গোড়া থেকেই সে বুঝতে পেরেছিল তার দর্শন শিক্ষক একটু খেয়ালি ধরনের। কিন্তু তাঁর শিক্ষাদানের পদ্ধতি প্রাকৃতিক নিয়ম-কানুনের পরোয়া করছে না দেখে সোফির মনে হলো তিনি একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলছেন।
সত্যিই কি সে সক্রেটিস আর প্লেটোকে টিভির পর্দায় দেখেছে? নিশ্চয়ই নয়, সেটা সম্ভব নয়। কিন্তু ওটা যে কার্টুনও ছিল না সেটাও তো সত্যি।
ভিডিও রেকর্ডারের ভেতর থেকে ক্যাসেটটা বের করে নিল সে। তারপর সিঁড়ি বেয়ে দৌড়ে উঠে গেল নিজের ঘরে। লেগো ব্লকগুলোর সঙ্গে সবচেয়ে ওপরের তাকেই রেখে দিল সে ওটা। তারপর কান্ত-শ্রান্ত অবস্থায় বিছানার কোলে আশ্রয় নিল এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়ল। ঘণ্টা কয়েক পর তার মা এসে ঢুকলেন ঘরটায়। আস্তে করে সোফির গায়ে ঠেলা দিয়ে তিনি বললেন:
কী ব্যাপার, সোফি?
উম?
কাপড়-চোপড় না বদলেই ঘুমিয়ে পড়েছিস যে?
নিদ্রাজড়িত চোখে পিটপিট করে তাকাল সোফি।
আমি এথেন্সে গিয়েছিলাম, বিড়বিড় করে বলল সে। পাশ ফিরে ফের ঘুমিয়ে পড়ার আগে এটুকুই শুধু বলতে পারল সে।