৩২. আমাদের নিজেদের কাল
…মানুষ মুক্ত হওয়ার সাজাপ্রাপ্ত..
অ্যালার্ম ঘড়িতে রাত ১১টা বেজে ৫৫ মিনিট। সিলিং-এর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে শুয়ে আছে হিল্ডা। সে তার অনুষঙ্গগুলোকে স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াতে দিল। প্রতিবার চিন্তার একটা মালা গাঁথা শেষ হলে পর সে নিজেকে জিগ্যেস করার চেষ্টা করল কেন এমনটা হলো।
সে কি তাহলে কিছু একটা দমন করার চেষ্টা করছে?
শুধু যদি সব ধরনের সেন্সরশীপ সে একপাশে সরিয়ে রাখতে পারতো, তাহলে হয়ত সুড়ুৎ করে চলে যেতে পারতো সে একটা দিবাস্বপ্নের ভেতর। ব্যাপারটা একটু ভুতুড়ে, ভাবল সে।
যতোই সে শরীরটা শিথিল করে দিয়ে নিজেকে এলোপাথাড়ি চিন্তা-ভাবনার হাতে ছেড়ে দিল ততোই তার মনে হলো সে যেন বনের ধারে মেজরের ছোট্ট কেবিনটার মধ্যে রয়েছে।
অ্যালবার্টো কী ফন্দি আঁটতে পারে? অবশ্য এ-কথা ঠিক যে আসলে হিল্ডার বাবাই ফন্দি আঁটছেন যে অ্যালবার্টো কিছু একটার ফন্দি আঁটছে। অ্যালবার্টো কী করবে তা কি তিনি এরিমধ্যে জেনে গিয়েছিলেন? সম্ভবত তিনি নিজেকে বাড়তি স্বাধীনতা দেয়ার চেষ্টা করছিলেন যাতে শেষে যাই ঘটুক সেটা তার জন্যে বিস্ময় হয়ে দেখা দেয়।
খুব বেশি পৃষ্ঠা আর বাকি নেই এখন। শেষ পৃষ্ঠায় একটি উঁকি মেরে দেখে নেবে নাকি সে? না, সেটা চুরির সামিল হয়ে যাবে। আর তাছাড়া, হিল্ডা এ-ব্যাপারে নিশ্চিত যে শেষ পৃষ্ঠায় কী ঘটবে তা আগে থেকে ঠিক করে রাখা হয়নি মোটেও।
চিন্তাটা কেমন অদ্ভুত না? রিং বাইন্ডারটা ঠিক এখানেই আছে আর তার বাবাও সম্ভবত বাড়তি কিছু যোগ করার জন্যে সময়মতো চলে আসবে না এখানে। অন্তত অ্যালবার্টো নিজে কিছু করার আগ পর্যন্ত নয়। একটা বিস্ময়…।
অবশ্য বিস্ময় হিল্ডার নিজের কাছেও মজুদ আছে অল্প বিস্তর। তার বাবা তাকে নিয়ন্ত্রণ করেননি। কিন্তু নিজের নিয়ন্ত্রণেও কি সে রয়েছে পুরোপুরি?
চেতনা কী? এটাই কি মহাবিশ্বের সবচেয়ে বড় ধাঁধা নয়? স্মৃতি কী? আমরা যা দেখেছি, যে-সব অভিজ্ঞতা আমাদের হয়েছে সে-সব আমাদের মনে থাকে কী করে?
কোন ধরনের মেকানিজম রাতের পর রাত দুর্দান্ত সব স্বপ্ন তৈরি করায় আমাদের দিয়ে?
একটু পর পর চোখ বন্ধ করল সে। তারপর আবার চোখ মেলে ফের তাকিয়ে রইল সীলিং-এর দিকে। এক সময় ভুলে গেল সে চোখ মেলার কথা।
ঘুমিয়ে পড়ল সে।
একটা গাঙচিলের কর্কশ ডাক তার ঘুম ভাঙতে বিছানা ছেড়ে নেমে এলো হিল্ডা। বরাবরের মতো ঘর পেরিয়ে জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়াল সে, তাকিয়ে রইল উপসাগরটার দিকে। গ্রীষ্মে-শীতে, এটা একটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে তার।
সে যখন ওখানে দাঁড়িয়ে আছে হঠাৎ তার মনে হলো তার মাথার ভেতর একরাশ আলোর বিস্ফোরণ ঘটছে। কী স্বপ্ন দেখেছে সেটা মনে পড়ে গেল তার। কিন্তু সেটার সুস্পষ্ট রং আর আকৃতির কারণে সেটাকে তার আর দশটা সাধারণ স্বপ্ন থেকে আলাদা বলে মনে হলো…
সে স্বপ্ন দেখেছে যে তার বাবা লেবানন থেকে বাড়ি ফিরেছেন আর এই গোটা স্বপ্নটাই ডকের ওপর সোনার তৈরি যীশুর ক্রশবিদ্ধমূর্তি পাওয়ার যে-স্বপ্ন সোফি দেখেছিল সেটারই একটা সম্প্রসারণ।
একদম সোফির স্বপ্নটার মতোই ডকের কিনারায় বসে ছিল হিল্ডা। হঠাৎ করেই সে শুনতে পেল অত্যন্ত নরম একটা গলায় কে যেন ফিসফিস করে বলছে, আমার নাম সোফি। যেখানে ছিল সেখানেই বসে রইল হিল্ডা, একেবারে স্থির হয়ে, কথাটা কোত্থেকে আসছে সেটা বোঝার জন্যে। চলতেই থাকল ব্যাপারটা, শোনা যায় কি যায় না এমন একটা খসখস শব্দ, যেন একটা পোকা কথা বলছে তার সঙ্গে, তুমি নিশ্চয়ই অন্ধ আর কালা! ঠিক সেই মুহূর্তে তার বাবা জাতিসংঘের ইউনিফর্ম পরে বাগানে ঢুকলেন। হিল্ডা! চেঁচিয়ে ডেকে উঠলেন তিনি। এক ছুটে তার কাছে গিয়ে বাবার গলা জড়িয়ে ধরল হিল্ডা। তখনই শেষ হয়ে গেল স্বপ্নটা।
আরনা ওভারল্যান্ড-এর (Arnulf Overland) একটা কবিতার কয়েকটা চরণ মনে পড়ে গেল তার।
অদ্ভুত এক স্বপ্ন দেখে আর যেন
আমার সঙ্গে বহু দূরের এক অন্তঃসলিলা জলধারার
মতো কথা-বলা একটা কণ্ঠস্বর শুনে এক রাতে জেগে উঠে
আমি শুধালাম: কী চাও তুমি আমার কাছে?
তার মা যখন ঘরে ঢুকলেন তখনো সে জানলার কাছে দাঁড়িয়ে।
কী রে! জেগে গেছিস এরিমধ্যে?
ঠিক জানি না…
বরাবরের মতো চারটার দিকে বাড়ি ফিরব।
ঠিক আছে, মা।
ছুটির দিনটা ভালো কাটুক তোর, মা।
তোমার-ও যেন দিনটা ভালো কাটে, মা।
সদর দরজাটা মা সশব্দে বন্ধ করে দিয়েছেন শুনতে পেয়ে রিং বাইন্ডারটা নিয়ে সুড়ৎ করে আবার বিছানায় গিয়ে উঠল সে।
মেজরের অবচেতন মনে ডুব দিতে যাচ্ছি আমি। ফের আমাদের দেখা হওয়ার আগ পর্যন্ত ওখানেই থাকবো আমি।
ওখানেই, হ্যাঁ। ফের পড়তে শুরু করলো হিল্ডা। সে অনুভব করতে পারল তার ডান হাতের তর্জনীর নিচে মাত্র অল্প কটা পৃষ্ঠা বাকি আছে আর।
.
সোফি যখন মেজরের কেবিন থেকে বেরিয়ে এলো তখনো পানির ধারে কয়েকটা ডিজনী চরিত্র নজরে পড়ল তার, কিন্তু তাদের দিকে সে এগিয়ে যেতেই সেগুলো যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।
নৌকো চালানোর সময় ভেংচি কাটতে লাগল সে, তারপর সেটা অপর পাড়ে নলখাগড়ার ভেতর টেনে তুলে রেখে দুই হাত চারদিকে ছুঁড়তে লাগল। কেবিনে যাতে অ্যালবার্টো নির্বিঘ্নে থাকতে পারেন সেজন্যে মেজরের মনোযোগ কাড়তে মারিয়া হয়ে কাজ করে যাচ্ছিল সোফি।
কখনো এক পায়ে লাফিয়ে, কখনো থেমে থেমে, নাচতে নাচতে পথ চলতে লাগল সোফি। কলের পুতুলের মতো হাঁটার চেষ্টা করল সে। মেজরের মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্যে গান গাইতেও শুরু করে দিল সে। এক সময় সে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল, ভাবতে লাগল অ্যালবার্টোর ফন্দিটা কী হতে পারে। খানিক পর একটা গাছ বেয়ে উঠতে শুরু করল সে।
যতটুকু পারল ততটুকু উঁচুতে উঠে এলো সোফি। যখন প্রায় আগায় পৌঁছে গেছে, তখন সে বুঝতে পারল নিচে নামতে পারছে না সে। আরেকবার চেষ্টা করার আগে একটু অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিল সে। কিন্তু এই সময়টা স্রেফ চুপচাপ বসে থাকতে পারল না সে। তাহলে তো তার দিকে নজর রেখে ক্লান্ত হয়ে গিয়ে অ্যালবার্টো কী করছেন সেদিকে মনোযোগ দিয়ে ফেলবে মেজর।
হাত দুটো নাড়তে লাগল সোফি, বার কয়েক চেষ্টা চালাল মোরগের মতো ডাকার তারপর শেষ পর্যন্ত ইউ (yodle) গাইতে শুরু করল সে। সোফি তার পনেরো বছরের জীবনে এই প্রথমবারের মতো ইউ গাইল। সব কিছু বিবেচনা করে ফলাফলটা বেশ সন্তুষ্ট করল তাকে।
আবারো চেষ্টা করল সে নিচে নামার, কিন্তু আসেলেই সে আটকে গেছে। হঠাৎ বিশাল একটা হাঁসী এসে বসলো সোফি যে-ডাল আঁকড়ে ঝুলে আছে সেটার ওপর। সদ্য একদল ডিজনী চরিত্র দেখার পর সোফি মোটেই অবাক হলো না যখন সে দেখল হাঁসীটা কথা বলে উঠল।
আমার নাম মর্টেন, হাঁসীটা বলল। আসলে আমি পোষা হাঁসী। কিন্তু বিশেষ এই উপলক্ষে আমি সেই লেবানন থেকে উড়ে এসেছি বুনো হাঁসের সঙ্গে। তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে এই গাছ থেকে নামার জন্যে খানিকটা সাহায্য দরকার তোমার।
তুমি তো পিচ্চি, আমাকে সাহায্য করবে কী?
তুমি কিন্তু হুট করে সিদ্ধান্তে পৌঁছতে যাচ্ছ, ইয়াং লেডি। তুমিই বরং বড্ড বেশি বড়।
একই কথা হলো, তাই না?
তোমাকে জানাতে ইচ্ছে করছে যে ঠিক তোমার বয়সী এক চাষী ছেলেকে গোটা সুইডেনের ওপর দিয়ে বয়ে বেড়িয়েছি আমি। তার নাম ছিল নিস হোলগারসন।
আমার বয়স পনেরো।
নিসের ছিল চৌদ্দ। এক বছরের কম-বেশিতে ফ্রেইট-এর ক্ষেত্রে তেমন কোনো ইতর বিশেষ হয় না।
ওকে তুললে কী করে তুমি?
ছোট্ট একটা থাপ্পড় মেরেছিলাম ওকে, ও অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। জ্ঞান হওয়ার পর বুড়ো আঙুলের চেয়ে ছোট্ট হয়ে ছিয়েছিল ও।
তাহলে তুমি বোধকরি আমাকেও ছোট্ট একটা থাপ্পড় মারতে পারো, কারণ আমি তো আর চিরকাল ওপরে বসে থাকতে পারি না। তাছাড়া শনিবার আবার একটা দার্শনিক গার্ডেন পার্টি দিচ্ছি আমি।
মজার তো। আন্দাজ করছি, এটা তাহলে একটা দর্শনের বই। নিস্ হোলগারসনকে নিয়ে আমি যখন সুইডেনের ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছিলাম তখন আমরা ভার্মল্যান্ডের মার্বাকায় নেমেছিলাম, সেখানে এক বৃদ্ধা মহিলার সঙ্গে দেখা হয়েছিল নিলস্-এর, যিনি স্কুলের বাচ্চাদের জন্যে সুইডেনের ওপর একটা বই লেখার পরিকল্পনা করছিলেন। তিনি বলেছিলেন বইটাকে একই সঙ্গে নির্দেশনামূলক আর সত্যি হতে হবে। নিসের অ্যাডভেঞ্চারের কথা শুনে তিনি ঠিক করেছিলেন হাঁসের পিঠে বসে নি যে-সব জিনিস দেখেছিল সে-সব নিয়ে একটা বই লিখবেন তিনি।
খুব অদ্ভুত তো।
সত্যি কথা বলতে কী, ব্যাপারটা খানিকটা আয়রনিকই ছিল বটে, তার কারণ তার আগেই আমরা ঐ বইটাতে ছিলাম।
হঠাৎ সোফির মনে হলো কী যেন থাপ্পড় বসালো তার গালে আর পর মুহূর্তেই একটা বুড়ো আঙুলের চেয়েও ছোট হয়ে গেল সে। গাছটা হয়ে গেল গোটা একটা বনের মতো আর হাঁসীটা হয়ে গেল একটা ঘোড়ার মতোই বিরাট।
এসো, তাহলে, বলে উঠল হাসীটা।
ডালটা ধরে হেঁটে গিয়ে হাঁসীটার পিঠে চড়ে বসল সোফি। ওটার পালকগুলো যদিও নরম, কিন্তু সে এতো ছোট হয়ে পড়ায় সেগুলো এখন তাকে সুড়সুড়ি দেয়ার বদলে খোঁচা দিতে লাগল।
সে আরাম করে বসতেই উড়াল দিল হাঁসীটা। গাছগাছালির মাথার ওপর দিয়ে উড়ে চলল তারা। নিচে লেক আর মেজরের কেবিনটার দিকে তাকাল সোফি। ভেতরে বসে আছেন অ্যালবার্টো, আঁটছেন তাঁর ক্রুর ফন্দি।
বার বার ডানা ঝাঁপটাতে ঝাঁপটাতে হাঁসীটা বলল, ছোট্ট একটা সাইটসিয়ীং টুর-ই যথেষ্ট হবে আজকের জন্যে।
এই কথা বলেই, সোফি খানিক আগেই যে-গাছটাতে চড়তে শুরু করেছিল সেটার গোড়ায় নামার জন্যে প্রস্তুতি নিল সেটা। হাঁসীটা মাটি ছুঁতেই নিচে গড়িয়ে পড়ল সোফি। লতাগুল্মের ভেতর বার কয়েক ওলট-পালট খাওয়ার পর উঠে বসল সে। অবাক হয়ে সে দেখল নিজের আগের আকার ফিরে পেয়েছে সে।
হেলে দুলে তার চারপাশে বার কয়েক হেঁটে বেড়াল হাঁসীটা।
তোমার সাহায্যের জন্যে অনেক ধন্যবাদ, সোফি বলল।
নেহাতই সামান্য ব্যাপার ওটা। তুমি বললে না এটা একটা দর্শনের বই?
না, কথাটা তুমি বলেছ।
ওই একই হলো। ব্যাপারটা যদি আমার হাতে থাকতো তাহলে নিলস হোলগারসনকে আমি যেভাবে সুইডেনের ভেতর দিয়ে উড়িয়ে নিয়ে গেছি তোমাকেও দর্শনের ইতিহাসের ভেতর দিয়ে উড়িয়ে নিয়ে যেতাম। মিলেটাস আর এথেন্স, জেরুজালেম আর আলেকজান্দ্রিয়া, রোম আর ফ্লোরেন্স, লন্ডন আর প্যারিস, জেনা আর হাইডেলবার্গ, বার্লিন আর কোপেনহেগেন-এর ওপর দিয়ে উড়ে বেড়াতে পারতাম আমরা।
ধন্যবাদ, এটুকুই যথেষ্ট।
অবশ্য, খুব আয়রনিক একটা হাঁসীর পক্ষেও শতাব্দীর পর শতাব্দীর ভেতর দিয়ে উড়ে বেড়ানো বড় ওজনদার একটা ব্যাপার হতো। সুইডিশ প্রদেশগুলো পাড়ি দেয়াই বরং অনেক সহজ হতো।
এই কথা বলে হাঁসীটা কয়েক পা দৌড়ে, ডানা ঝাঁপটে শূন্যে উড়ে চলে।
ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল সোফি; কিন্তু একটু পর গুহা থেকে হামাগুড়ি দিয়ে বাগানে চলে এসে সে ভাবল তার এই সব চিত্ত-বিক্ষেপ ঘটানো কাজ-কর্মে অ্যালবার্টোর যথেষ্ট খুশি হওয়ার কথা। গত এক ঘণ্টায় মেজর নিশ্চয়ই খুব বেশি কিছু চিন্তা করতে পারেনি অ্যালবার্টোকে নিয়ে। যদি পেরে থাকে সেক্ষেত্রে তাকে খুবই প্রবল দুই বিরুদ্ধ-সত্তা বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের অধিকারী হতে হয়েছে।
সোফি সবে সদর দরজার কাছে গিয়ে পৌঁছেছে এমন সময় তার মা কাজ থেকে বাড়ি ফিরলেন। তাতে করে লম্বা একটা গাছ থেকে পোষা একটা হাঁসী তাকে কী করে উদ্ধার করল সে-গল্প মাকে বলা থেকে বেঁচে গেল সে।
ডিনারের পর গার্ডেন পার্টির জন্যে সব কিছু ঠিকঠাক করতে শুরু করল তারা দুজন। চিলেকোঠা থেকে চার মিটার লম্বা একটা টেবিল-টপ আর অস্থায়ী পায়া নামিয়ে বাগানে নিয়ে গেল তারা।
ফলের গাছগুলোর নিচে লম্বা টেবিলটা বসাবে বলে আগেই ঠিক করে রেখেছিল ওরা। শেষ যে-বার অস্থায়ী পায়ার ওপর বসানো টেবিলটা ব্যবহার করা হয়েছিল সেটা ছিল সোফির বাবা-মায়ের বিয়ের দশম বার্ষিকী। মাত্র আট বছর বয়স তখন। সোফির, কিন্তু ওদের সমস্ত বন্ধু-বান্ধব আর আত্মীয়-স্বজনের অংশ নেয়া বিশাল পার্টিটার কথা দিব্যি মনে পড়ে সোফির।
আবহাওয়ার পূর্বাভাস যার পর নাই ভালো। সোফির জন্মদিনের আগের দিনের সেই ভয়ংকর ঝড়-জলের পর থেকে এক ফোঁটা বৃষ্টিও হয়নি। তারপরেও টেবিল বসানো আর সাজসজ্জার আসল কাজটা শনিবার সকালের জন্যে রেখে দেয়ারই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তারা।
পরে সেদিন সন্ধ্যায় ভিন্ন দুই ধরনের রুটি বেক্ করল ওরা! চিকেন আর সালাদ সার্ভ করা হবে। আর সোডা। তার ক্লাসের কয়েকটা ছেলে বিয়ার নিয়ে আসবে শুনে সোফি চিন্তিত। সে যদি একটা জিনিসকেও ভয় করে থাকে তা হলো সমস্যা।
সোফি যখন বিছানায় যাচ্ছে তখন তার মা আরো একবার জানতে চাইলেন অ্যালবার্টো পার্টিতে আসছেন কিনা।
আলবাৎ আসবেন। উনি এমনকী একটা ফিলসফিকাল ট্রিক দেখাবেন বলেও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
ফিলসফিকাল ট্রিক? সেটা আবার কী ধরনের ট্রিক?
কোনো ধারণা নেই…উনি জাদুকর হলে নিশ্চয়ই জাদুর ট্রিক দেখাতেন। হয়ত একটা টুপির ভেতর থেকে বের করে আনতেন সাদা একটা খারগোশ…।
কী, আবার?
কিন্তু তিনি যেহেতু দার্শনিক তাই তার বদলে তিনি একটা ফিলসফিকাল ট্রিক দেখাবেন। শত হলেও, এটা একটা ফিলসফিকাল গার্ডেন পার্টি। তুমিও কি কিছু করার কথা ভাবছো?
সত্যি বলতে কী, ভাবছি।
বক্তৃতা জাতীয় কিছু?
সেটা বলছি না। গুড নাইট, সোফি!
পরদিন বেশ সকালে সোফিকে ঘুম থেকে ডেকে তুললেন তার মা, কাজে যাওয়ার আগে তাকে বিদায় জানাতে এসেছিলেন তিনি। গার্ডেন পার্টির জন্যে শেষ মুহূর্তের কিছু কেনাকাটার একটা তালিকা ধরিয়ে দিলেন তিনি সোফির হাতে।
তার মা বাড়ি থেকে বেরুতেই বেজে উঠল ফোনটা। অ্যালবার্টোর ফোন। নিশ্চয়ই তিনি জানতে পেরেছেন ঠিক কখন সোফি বাসায় একলা থাকবে।
আপনার গোপন ব্যাপার-স্যাপার-এর কী অবস্থা?
শশ! একটা কথাও নয়। লোকটাকে এ-নিয়ে চিন্তা পর্যন্ত করতে দিও না।
আমার মনে হয় গতকাল আমি ওর মনোযোগ ধরে রাখতে পেরেছিলাম।
গুড।
দর্শন কোর্স কি শেষ?
সেজন্যেই ফোন করলাম তোমাকে। এরিমধ্যে আমরা আমাদের শতাব্দীতে চলে এসেছি। এখন থেকে নিজেকে নিজেই চালাতে পারা উচিত তোমার। ভিত্তিটাই ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তারপরেও, আমাদের নিজেদের কাল সম্পর্কে ছোট্ট একটা আলোচনার জন্যে বসতেই হবে আমাদের।
কিন্তু আমাকে তো শহরে যেতেই হবে…
দ্যাটস এক্সেলেন্ট। আমি বলেছিলাম আমাদের নিজেদের কাল নিয়ে কথা বলার ছিল আমাদের।
তাই?
মানে বলতে চাইছি, সেজন্যেই শহরে দেখা করাটা সবচেয়ে কাজের হবে।
আমি কি আপনার ওখানে যাবো।
না, না, এখানে না। সব কিছু ওলট-পালট হয়ে আছে। লুকোনো মাইক্রোফোন খুঁজে মরছি আমি।
আহা!
মেইন স্কোয়্যারে সদ্য একটা ক্যাফে খোলা হয়েছে। ক্যাফে পিয়ের। চেনো তুমি ওটা?
হা। কখন যাবো ওখানে?
বারোটার সময় দেখা করি আমরা? ঠিক আছে। বাই।
বারোটা বাজার মিনিট কয়েক পরে ক্যাফে পিয়ের-এ ঢুকল সোফি। ছোট ছোট গোল টেবিল আর কালো চেয়ার, ডিসপেন্সারে উল্টো করে রাখা ভামুথ বোতল আর স্যান্ডউইচ নিয়ে নতুন নতুন যে-সব কেতাদুরস্ত জায়গা তৈরি হয়েছে এটা তারই একটা।
ঘরটা ছোট এবং প্রথমেই সোফির যেটা নজরে পড়ল তা হচ্ছে অ্যালবার্টো ওখানে নেই। গোল টেবিলগুলোতে অনেকেই বসে আছে, কিন্তু সোফি কেবল দেখল যে তাদের মধ্যে অ্যালবার্টো নেই।
একা একা ক্যাফেতে যাওয়ার অভ্যেস নেই সোফির। সে কি স্রেফ উল্টে ঘুরে চলে যাবে, পরে এসে দেখবে উনি এসেছেন কিনা?
মার্বেল পাথরের বার-এ গিয়ে এক কাপ লেবু চা-র অর্ডার দিল সে, তারপর বসে পড়ল ফাঁকা একটা টেবিলে। দরজার দিকে তাকিয়ে রইল সে। সারাক্ষণই লোকজন আসছে যাচ্ছে, কিন্তু এখনো অ্যালবার্টোর দেখা নেই।
একটা খবরের কাগজও যদি থাকত তার কাছে।
খানিকটা সময় যেতে চারদিকে তাকাতে শুরু করল সোফি। জবাবে কয়েকটা চকিত দৃষ্টি ফেরত পেল সে। মুহূর্তের জন্যে নিজেকে একজন তরুণী নারী বলে মনে হলো সোফির। বয়স মাত্র পনেরো তার, কিন্তু সতেরো হিসেবেও বেশ চালিয়ে দেয়া যেতে পারে তাকে নিদেন পক্ষে সাড়ে সোল।
বেঁচে থাকা নিয়ে এই লোকগুলো সবাই কী মনে করে ভাবল সোফি। তাদের দেখে মনে হচ্ছে স্রেফ এসে পড়েছে তারা এখানে, যেন নেহাৎ দৈব বলে এখানে এসে বসে পড়েছে তারা। কথার তুবড়ি ফোঁটাচ্ছে সবাই, হাত-পা-শরীর নাচাচ্ছে বেজায় রকম, কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে না যে তেমন গুরুত্বপূর্ণ কোনো ব্যাপারে কথা বলছে তারা।
হঠাৎ করেই কিয়ের্কেগার্ডের কথা মনে পড়ে গেল তার, যিনি বলেছিলেন একটা ভিড়কে সবচেয়ে বেশি বৈশিষ্ট্য দান করে সেটার অলস বকবকানি। এই লোকগুলো কি সবাই ভোগী স্তরে আছে? নাকি এমন কিছু আছে যা অস্তিত্বগতভাবে তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ?
সোফিকে লেখা চিঠিগুলোর গোড়ার দিকের একটায় শিশু আর দার্শনিকের মধ্যে মিলের কথা বলেছিলেন অ্যালবার্টে। সোফি আবারো উপলব্ধি করল যে বড় হওয়ার ব্যাপারে একটা ভয় আছে তার। মহাবিশ্বের টপ হ্যাঁটের ভেতর থেকে বের করে আনা সাদা খরগোশটার রোমের ভেতর হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে পড়ার পরিণতিটা যদি তারও হয়!
দরজার ওপর নজর ছিল তার। হঠাৎ-ই ভেতরে ঢুকলেন অ্যালবার্টো। যদিও এখন মধ্যগ্রীষ্ম কিন্তু একটা কালো বেরে আর হেরিংবোন টুইড-এর ধূসর, নিতম্ব অব্দি পৌঁছানো একটা কোট পরে আছেন তিনি। ত্বরিত পায়ে সোফির কাছে চলে এলেন তিনি। লোকজনের মধ্যে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে অদ্ভুত একটা অনুভূতি হলো সোফির।
সোয়া বারোটা বাজে এখন।
এটাকে বলে কোনো ঘণ্টার অ্যাকাডেমিক কোয়ার্টার। একটা স্ন্যাক নেবে?
বসে পড়লেন তিনি, তাকালেন সোফির চোখের দিকে। শ্রাগ করল সোফি।
নিশ্চয়ই। এই…একটা স্যান্ডউইচ।
উঠে কাউন্টারে গেলেন অ্যালবার্টো। শিগগিরই এক কাপ কফি আর দুটো স্যান্ডউইচ সঙ্গে চিজ আর হ্যাম নিয়ে ফিরে এলেন তিনি।
খুব দামি বুঝি?
সামান্য ব্যাপার, সোফি।
দেরি করার কোনো কারণ দেখাতে পারেন আপনি?
না। কাজটা ইচ্ছে করেই করেছি আমি। কেন সেটা একটু পরেই বলছি।
তাঁর বিরাট স্যান্ডউইচটায় বার কয়েক কামড় বসালেন তিনি। তারপর বললেন:
এবার আমাদের শতাব্দী নিয়ে কথা বলা যাক।
দর্শনগতভাবে কৌতূহলকর কিছু ঘটেছে?
অনেক…নানান ধরনের আন্দোলনের খই ফুটছে চারদিকে। খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা দিক দিয়ে শুরু করবো আমি আর সেটা হলো অস্তিত্ববাদ (existentialism)। অগুনতি যে-সব দার্শনিক স্রোতধারা মানুষের অস্তিত্বগত অবস্থা থেকে যাত্রা শুরু করেছে সেগুলোরই দলবদ্ধ নাম এটা। সাধারণভাবে আমরা বিংশ শতাব্দীর অস্তিত্ববাদীদের কথাই বলে থাকি। এ-সব অস্তিত্ববাদী দার্শনিক বা অস্তিত্ববাদীর অনেকেই শুধু যে কিয়ের্কেগার্ডের ওপর ভিত্তি করেই তাঁদের ধ্যান-ধারণাগুলো তৈরি করেছিলেন তা নয়, করেছিলেন হেগেল আর মার্ক্সের ওপর ভিত্তি করেও।
আচ্ছা।
বিংশ শতাব্দীর ওপর যে আরেকজন দার্শনিক প্রবল প্রভাব বিস্তার করেছিলেন তিনি জার্মান ফ্রিডরিখ নিশে (Friedrich Nietzsche)। জন্ম ১৮৪৪ সালে, মৃত্যু ১৯০০-তে। তিনিও হেগেলের দর্শন এবং জার্মান হিস্টরিসিজম-এর বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন। ইতিহাস বিষয়ে যৎসামান্য আগ্রহ আর যাকে তিনি বলেছিলেন খ্রিস্টিয় দাস নৈতিকতা-এই দুইয়ের পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে খোদ জীবনকেই দাঁড় করিয়েছিলেন তিনি। সমস্ত মূল্যবোধেরই পুনর্মূল্যায়ন করতে চেয়েছিলেন তিনি, যাতে করে সবচেয়ে শক্তিমানের জীবনীশক্তিকে দুর্বল কেউ ক্ষতিগ্রস্ত না করতে পারে। নিশের বক্তব্য অনুযায়ী, খ্রিস্টধর্ম আর সনাতন দর্শন, দুই-ই বাস্তব জগতের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, তাকিয়ে আছে স্বর্গ বা ভাবজগতের দিকে। তবে এতোদিন যেটাকে বাস্তব জগৎ বলে মনে করা হয়েছে। সেটা ছিল আসলে একটা ছদ্ম জগৎ। তিনি বলতেন, জগতের প্রতি সৎ হও। তাদের কথায় কান দিও না যারা তোমাদের অতিপ্রাকৃত প্রত্যাশার লোভ দেখায়।?
তো?
কিয়ের্কেগার্ড আর নিটশে দুজনই যাকে প্রভাবিত করেছিলেন তিনি হলেন জার্মান অস্তিত্ববাদী দার্শনিক মার্টিন হাইডেগার (Martin Heideggar)। তবে আমরা মনোযোগ দিতে যাচ্ছি ফরাসি অস্তিত্ববাদী জাঁ-পল সার্তের (Jean-Paul Sartre) ওপর। তাঁর জন্ম ১৯০৫ সালে, মৃত্যু ১৯৮০তে। অস্তিত্ববাদীদের মধ্যে তিনিই ছিলেন সবচেয়ে উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা, অন্তত বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে। বিশেষ করে চল্লিশের দশকে যুদ্ধের পর পরই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল তার অস্তিত্ববাদ। পরবর্তীতে তিনি ফ্রান্সের মার্ক্সবাদী আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়েছিলেন, তবে কখনোই কোনো দলের সদস্য হননি।
সেজন্যেই কি আমরা একটা ফরাসী ক্যাফেতে দেখা করেছি?
স্বীকার করছি, ব্যাপারটা ঠিক আকস্মিক নয়। সার্তে জীবনের অনেকটা সময় বিভিন্ন ক্যাফেতে অতিবাহিত করেছিলেন। তাঁর আজীবনের সঙ্গী সিমন দ্য বুতোয়া র (Simon de Beauvoir) সঙ্গেও একটা ক্যাফেতেই প্রথম দেখা হয়েছিল তাঁর। তিনিও ছিলেন একজন অস্তিত্ববাদী দার্শনিক।
নারী দার্শনিক?
ঠিক বসেছ।
ব্যাপারটা কী স্বস্তিদায়ক, তাই না, যে মানব জাতি শেষ পর্যন্ত সভ্য হচ্ছে।
তারপরেও কিন্তু অনেক সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে আমাদের সময়ে।
অস্তিত্ববাদ নিয়ে কথা বলতে চেয়েছিলেন আপনি।
সার্ত্রে বলেছিলেন, অস্তিত্ববাদ হলো মানবতাবাদ। কথাটা দিয়ে তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন যে অস্তিত্ববাদীরা খোদ মানবতা থেকেই যাত্রা শুরু করেন, অন্য কিছু থেকে নয়। আমি হয়ত এটুকু যোগ করতে পারি যে, যে-মানবতার কথা তিনি বলছিলেন সেটা বেঁনেসা-র সময়কার যে-মানবতাবাদের সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়েছিল তার চেয়ে অনেক হতাশাজনক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছিল মানুষের অবস্থা সম্পর্কে।
কেন?
কিয়ের্কেগার্ড এবং এই শতাব্দীর অস্তিত্ববাদী দার্শনিকদের মধ্যে কয়েকজন ছিলেন খ্রিস্টান। কিন্তু সার্জের আনুগত্যটা ছিল আমরা যাকে বলতে পারি নাস্তিকতামূলক অস্তিত্ববাদ তার প্রতি। তাঁর দর্শনকে দেখা যেতে পারে যখন ঈশ্বর মৃত সেই অবস্থায় মানুষের অবস্থার এক নিষ্ঠুর বিশ্লেষণ হিসেবে। ঈশ্বর মৃত, এই কথাটা অবশ্য বলেছিলেন নিশে।
বলে যান।
কিয়ের্কেগার্ডের মতো সাত্রের দর্শনের-ও মূল কথা হচ্ছে অস্তিত্ব। কিন্তু অস্তিত্ব আর বেঁচে থাকা ঠিক এক নয়। উদ্ভিদ এবং প্রাণীও বেঁচে থাকে, তাদেরও অস্তিত্ব আছে, কিন্তু তার মানে কী সেটা নিয়ে চিন্তা করতে হয় না তাদের। মানুষই হলো একমাত্র প্রাণী যে তার নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন। সাত্রে বলেছেন একটি বস্তুগত জিনিস স্রেফ স্বীয় কৃতিগত (in itself), অন্যদিকে মানুষ নিজের জন্য (for itself)। মানব সত্তা আর বস্তু সত্তা তাই এক নয়।
এ-ব্যাপারে তো দ্বিমত করা যায় না।
সার্ত্রে বলেছেন মানুষের অস্তিত্ব তার অন্য আর সব কিছুর চেয়ে অগ্রাধিকার পাবে। আমি যে অস্তিত্বশীল এই বিষয়টি আমি যাতার আগে গুরুত্ব পাবে। অস্তিত্বের অধিকার, নির্যাসের (essence) আগে।
এটা কিন্তু বড্ড জটিল কথা।
নির্যাস বলতে আমরা বুঝি সেই সব জিনিস যা দিয়ে কোনো কিছু তৈরি-কোনোকিছুর প্রকৃতি বা সত্তা। কিন্তু সাত্রের মতে মানুষের এ-ধরনের কোনো সহজাত প্রকৃতি নেই। মানুষকে তাই অবশ্যই নিজেকে তৈরি করে নিতে হবে। তাকে অবশ্যই তার নিজস্ব প্রকৃতি বা নির্যাস তৈরি করে নিতে হবে, কারণ সেটা আগে থেকেই নির্ধারিত হয়ে নেই।
আমার মনে হয় আমি বুঝতে পারছি আপনি কী বোঝাতে চাইছেন।
দর্শনের গোটা ইতিহাস জুড়ে দার্শনিকেরা আবিষ্কার করতে চেয়েছেন মানুষ কী বা মানব প্রকৃতি কী। কিন্তু সাত্রে বিশ্বাস করতেন যে মানুষের এ-ধরনের কোনো শাশ্বত প্রকৃতি নেই যার ওপর ভরসা করা যেতে পারে। কাজেই সাধারণভাবে জীবনের মানে খোঁজার চেষ্টা অর্থহীন। উপস্থিতমতো উদ্ভাবন করার শাস্তিপ্রাপ্ত আমরা। আমরা যেন সেই সব অভিনেতার মতো যাদেরকে মঞ্চে টেনে নিয়ে আসা হয়েছে অথচ তারা তাদের সংলাপ মুখস্ত করেনি, তাদের কাছে কোনো চিত্রনাট্য নেই বা ফিসফিসিয়ে মঞ্চ নির্দেশনা জানিয়ে দেয়ার মতো প্রম্পটারও নেই। কীভাবে বাঁচতে হবে সে-সিদ্ধান্ত অবশ্যই আমাদেরকেই নিতে হবে।
আসলে সেটাই সত্যি। লোকে যদি বাইবেল বা কোনো দর্শনের বই দেখতে পারতো কীকরে বাঁচতে হবে তা বের করার জন্যে সেটা খুবই প্র্যাকটিকাল হতো।
ঠিকই বুঝতে পেরেছো তুমি। সাত্রে বলেছেন যে মানুষ যখন উপলব্ধি করে যে সে বেঁচে আছে, একদিন সে মারা যাবে-এবং আঁকড়ে ধরার মতো কোনো কোনো অর্থ নেই-তখন সে উদ্বেগ (angst) বোধ করে। তুমি হয়ত মনে করতে পারবে যে অস্তিত্বশীল অবস্থায় থাকা একজন মানুষের যে-বর্ণনা কিয়ের্কেগার্ড দিয়েছিলেন তারও বৈশিষ্ট্য সেই উদ্বেগ, ভয়ের একটা অনুভূতি।
হ্যাঁ।
সার্ত্রে বলেছেন যে, অর্থহীন একটা জগতে মানুষ বিচ্ছিন্ন বোধ করে। মানুষের বিচ্ছিন্নতা-র বর্ণনা দেয়ার সময় তিনি কিন্তু হেগেল এবং মার্ক্স-এর মূল চিন্তারই প্রতিধ্বনি করছেন। জগতে মানুষের বিচ্ছিন্নতাবোধ হতাশা, একঘেয়েমী, বিবমিষা আর অবাস্তবতার একটা অনুভূতি তৈরি করে।
বিষণ্ণ বোধ করা বা সব কিছুই খুব একঘেয়ে এ-রকম একটা অনুভূতি হওয়া খুবই স্বাভাবিক।
হ্যাঁ, তাই। সার্জে আসলে বিংশ শতাব্দীর নগরবাসীর বর্ণনা দিচ্ছিলেন। তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে যে বেঁনেসা-র সময়কার মানবতাবাদীরা প্রায় জয়োল্লাসের সঙ্গে মানুষের মুক্তি এবং স্বাধীনতার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন সবার? মানুষের স্বাধীনতাকে সাত্রে একটা অভিশাপ হিসেবে দেখেছেন। তিনি বলেছেন, মানুষ মুক্ত হওয়ার সাজাপ্রাপ্ত। সাজাপ্রাপ্ত তার কারণ সে নিজেকে তৈরি করেনি, কিন্তু তারপরেও মুক্ত। কারণ এ-জগতে একবার চলে আসার পরে সে তার প্রতিটি কৃতকর্মের জন্যে দায়ী।
কিন্তু মুক্ত মানুষ হিসেবে আমাদেরকে সৃষ্টি করতে তো বলিনি আমরা।
সার্ত্রে ঠিক এটাই বলতে চেয়েছেন। তারপরেও আমরা মুক্ত মানুষ এবং এই স্বাধীনতা আমাদেরকে সারা জীবন ধরেই অনবরত বেছে নেবার শাস্তি দিয়েছে। এমন কোনো শাশ্বত মূল্যবোধ নেই বা রীতি নেই যা আমরা আঁকড়ে ধরে থাকতে। পারি, যা আমাদের পছন্দ-কে বেশি অর্থবহ করে। কারণ আমরা যা করি তার জন্যে আমরাই পুরোপুরি দায়ী। সার্জে এই কথাটির ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। যে মানুষ যেন কখনো তার কৃতকর্মের দায়-দায়িত্ব অস্বীকার না করে। ওদিকে আবার আমরা এই অজুহাতেও আমাদের বেছে নেবার দায়-দায়িত্ব অস্বীকার করতে পারি না যে আমাদেরকে কাজে যেতেই হচ্ছে বা কীভাবে আমরা জীবন যাপন করবো সে-ব্যাপারে আমাদেরকে অবশ্যই কিছু মধ্যবিত্তসূলভ প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ করতে হবে। এভাবে যারা অজ্ঞাতপরিচয় জনসাধারণের দলে ঢুকে পড়ে তারা নিজেদের কাছ থেকে পালিয়ে আত্মপ্রবঞ্চনার মধ্যে আশ্রয় নিয়ে কখনোই নৈর্ব্যক্তিক একটা দলের সদস্য হওয়া ছাড়া অন্য কিছু হতে পারবে না। অন্য দিকে, আমাদের স্বাধীনতা আমদেরকে বাধ্য করে আমাদের নিজেদেরকে কাজে লাগিয়ে কিছু একটা সৃষ্টি করতে, বিশুদ্ধভাবে বা সত্যিকার অর্থে বাঁচতে।
হ্যাঁ, বুঝতে পারছি
আমাদের নৈতিক পছন্দের বেলাতেও কিন্তু কথাটা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। মানব প্রকৃতি বা মানবিক দুর্বলতা বা সে-রকম কোনো কিছুর ওপরও আমরা দোষ চাপাতে পারি না। প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ প্রায়ই শুয়োরের মতো ব্যবহার করার পর দোষ চাপায় বুড়ো আদমের ওপর। কিন্তু বুড়ো আদম বলে কেউ নেই। উনি স্রেফ একটা চরিত্র মাত্র, আমাদের কৃতকর্মের দায়-দায়িত্ব এড়াতে যাকে আমরা আঁকড়ে ধরি।
তবে মানুষকে কিসের জন্যে দোষ দেয়া যেতে পারে তার একটা সীমা কিন্তু থাকা দরকার।
সার্ত্রে যদিও দাবি করেছেন যে জীবনের কোনো সহজাত অর্থ নেই, তাই বলে তিনি কিন্তু বলেননি যে কোনো কিছুরই কোনো অর্থ নেই। আমরা যাকে বলি নাস্তিত্ববাদী (nihilist), তিনি কিন্তু তা ছিলেন না।
সেটা কী?
নাস্তিত্ববাদী তিনি যিনি মনে করেন কোনো কিছুরই কোনো অর্থ নেই এবং সব কিছুই বৈধ। সাত্রে মনে করতেন যে জীবনের অর্থ থাকতেই হবে। এটা একটাএকান্তই প্রয়োজনীয় বিষয়। কিন্তু আমাদের জীবনে এই অর্থ তৈরি করতে হবে। আমাদের নিজেদেরকেই। অস্তিত্বশীল থাকার অর্থ তোমার নিজের জীবনকে নিজেই তৈরি করা।
কথাটা একটু খুলে বলবেন?
সার্ত্রে প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যে কোনো কিছু প্রত্যক্ষ করার আগ পর্যন্ত চেতনার নিজস্ব কোনো মানে বা অস্তিত্ব নেই। কারণ চেতনা সব সময়ই কোনো না কোনো কিছু সম্পর্কে সচেতন। আর এই কোনো কিছু যেমন আমাদের নিজেদের কাছ থেকে আসে, তেমনি তা আসে আমাদের পরিপার্শ্ব থেকে। আমাদের জন্যে কোন জিনিসটি গুরুত্বপূর্ণ সেটা নির্বাচন করার মধ্যে দিয়ে আমরা যা প্রত্যক্ষ করি সে-বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে আমাদের নিজেদের খানিকটা সহায়ক ভূমিকা রয়েছে।
একটা উদাহরণ দিতে পারবেন?
একই কামরায় দুজন মানুষ থাকতে পারেন, তারপরেও দুজনেই একেবারে ভিন্নভাবে দেখতে পারেন সেটাকে। তার কারণ আমাদের পরিপার্শ্ব প্রত্যক্ষ করার সময় আমরা আমাদের নিজস্ব মানে বা আমাদের নিজস্ব স্বার্থ তাতে যোগ করি। একজন গর্ভবতী মহিলা হয়ত মনে করতে পারেন যে তিনি যেদিকেই তাকান সেদিকেই গর্ভবতী মহিলাদের দেখতে পান। তার অর্থ এই নয় যে আগে কোন গর্ভবতী মহিলা ছিলেন না, কিন্তু এখন যেহেতু তিনি নিজে গর্ভবতী জগৎটাকে তিনি ভিন্ন চোখ দিয়ে দেখছেন। জেল পালানো আসামী হয়ত চারদিকেই পুলিশ দেখতে পায়…
হুম, বুঝতে পারছি।
ঘরের জিনিসগুলোকে আমরা যেভাবে প্রত্যক্ষ করি সেটাকে প্রভাবিত করে আমাদের নিজেদের জীবন। কোনো কিছুর প্রতি আমার কোনো আগ্রহ না থাকলে সেটা আমার নজরে পড়ে না। কাজেই এখন হয়ত আমি খুলে বলতে পারি কেন আজ দেরি হয়েছে আমার।
কাজটা ইচ্ছাকৃত, ঠিক?
আগে বলো এখানে এসেই কী দেখতে পেয়েছিলে তুমি?
প্রথমেই যেটা দেখলাম তা হলো আপনি নেই।
ব্যাপারটা অদ্ভুত না যে প্রথম যে-জিনিসটা তুমি লক্ষ করলে সেটা হলো একটা কিছুর অনুপস্থিতি?
হতে পারে, কিন্তু আপনার সঙ্গেই দেখা হওয়ার কথা ছিল আমার।
আমাদের কাছে যা অপ্রাসঙ্গিক তা আমরা কী করে নিশ্চিহ্ন করে দিই তা দেখাতে ঠিক এ-ধরনেরই একটি ক্যাফে ভিজিট-এর সাহায্যে নিয়েছেন সার্ত্রে।
স্রেফ এই ব্যাপারটা দেখাবার জন্যেই আপনি দেরি করে এসেছেন আজ?
হ্যাঁ, সার্ত্রের দর্শনের এই মূল বিষয়টি তুমি যাতে বুঝতে পারো সেজন্যে। একটা এক্সসারসাইজ বলতে পারো একে।
বেরিয়ে যান এখান থেকে!
তুমি যদি প্রেমে পড়তে আর বসে থাকতে কখন তোমার ভালোবাসার মানুষটি তোমাকে ফোন করবে তাহলে হয়ত তুমি শুনতে পেতে যে সারা সন্ধ্যা সে তোমাকে ফোন করেনি। ঠিক হলো ট্রেনে দেখা করবে তুমি তার সঙ্গে; অগুনতি মানুষ প্ল্যাটফর্মে ঘোরাফেরা করছে, কিন্তু তাকে তুমি দেখতে পাচ্ছেনা কোথাও। তারা সবাই তোমার কাছে উটকো ঝামেলাস্বরূপ, অপ্রয়োজনীয়। এমনকী তাদেরকে তোমার বিরক্তিকর বা অপ্রীতিকরও মনে হতে পারে। শুধু যে জিনিসটা তোমার নজরে পড়ছে তা হলো সে এখানে নেই।
কী মন খারাপ করা ব্যাপার।
সিমন দ্য বুভোয়া অস্তিত্ববাদকে নারীবাদে প্রয়োগ করার চেষ্টা করেছিলেন। তার আগেই সার্তে বলেছিলেন যে মানুষের কোনো মৌল প্রকৃতি নেই যার ওপর ভরসা করা যেতে পারে। আমরা নিজেদেরকে সৃষ্টি করি।
তাই?
নারী-পুরুষকে আমরা যেভাবে দেখি তার বেলাতেও কিন্তু কথাটা প্রযোজ্য। কোনো মৌলিক নারী প্রকৃতি-র অস্তিত্ব অস্বীকার করেছিলেন সিমন দ্য বুভোয়া। যেমন ধরো, দাবি করা হয়ে থাকে যে পুরুষ হচ্ছে সব কিছু অতিক্রম করে যাওয়া বা অর্জনকারী স্বভাবের। কাজেই বাইরের দিকেই অর্থ আর নির্দেশনা খুঁজবে সে। বলা হয়ে থাকে নারীর দর্শন এর বিপরীত। সে অন্তর্বাসী, যার মানে সে যেখানে আছে সেখানেই থাকতে চায়। কাজেই সে তার পরিবারের পরিচর্যা করবে। পরিবেশের এবং আরো সাদামাটা জিনিসের যত্ন নেবে। ইদানীং আমরা হয়ত বলতে পারি যে নারীরা নারীজাতির মূল্যবোধ নিয়ে পুরুষদের চেয়ে বেশি চিন্তিত।
তিনি কি সত্যিই সে-কথা বিশ্বাস করতেন?
আমার কথা শুনছিলে না তুমি। সিমন দ্য বুড়োয়া আসলে এ-ধরনের কোনো নারী প্রকৃতি বা পুরুষ প্রকৃতি-র অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেন না। উল্টো তিনি বিশ্বাস করতেন যে নারী এবং পুরুষকে অবশ্যই নিজেদেরকে তাদের ভেতরে জন্ম নেয়া এ-ধরনের প্রেজুডিস বা আদর্শ (ideal) থেকে মুক্ত করতে হবে।
আমি একমত।
১৯৪৯ সালে প্রকাশিত তাঁর প্রধান কাজটির নাম দ্য সেকেন্ড সেক্স।
কী বোঝাতে চেয়েছিলেন তিনি কথাটা দিয়ে?
নারীদের কথা বলছিলেন তিনি। আমাদের সংস্কৃতিতে নারীদেরকে দ্বিতীয় লিঙ্গ হিসেবে দেখা হয়ে থাকে। পুরুষেরা এমন আচরণ করে যেন তারাই হচ্ছে উদ্দেশ্য আর নারীদের ব্যবহার করে তারা তাদের বিধেয় হিসেবে, ফলে নারীদের বঞ্চিত করে তারা নারীদের নিজেদের জীবনের দায়-দায়িত্ব নেয়া থেকে।
তার মানে তিনি বলতে চেয়েছিলেন আমরা নারীরা ঠিক ততোটাই মুক্ত আর স্বাধীন যতটা আমাদের ইচ্ছা?
হা। এভাবেও বলতে পারো তুমি। চল্লিশের দশক থেকে বর্তমান সময়কার সাহিত্য, বিশেষ করে নাটকের ওপরও, একটা বিশাল প্রভাব ফেলেছে অস্তিত্ববাদ। সাত্রে নিজে নাটক ও উপন্যাস দুই-ই লিখেছেন। অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ লেখকেরা হলেন ফরাসী আলবেয়ার কামু (Albert Camus), আইরিশ স্যামুয়েল বেকেট (Samuel Becket), রুমানিয়ার ইউজিন আয়োনেস্কো (Eugene Ionesco) আর পোল্যান্ডের উইটোল্ড গমব্রোউইচ (witold Gombrowicz)। তাদের এবং অন্যান্য– আরো অনেক আধুনিক লেখকের রচনার বৈশিষ্ট্যমূলক শৈলীকেই আমরা অবাস্তববাদ (absurdism) বলি। কথাটা বিশেষভাবে বলা হয়ে থাকে থিয়েটার অত্ দ্য অ্যাবসার্ড-এর ক্ষেত্রে।
ও।
অ্যাবসার্ড বলতে কী বোঝায় জানো?
এমন কিছু যা অর্থহীন বা অযৌক্তিক, তাই না?
ঠিক তাই। থিয়েটার অভ দ্য অ্যাবসার্ড বাস্তবধর্মী থিয়েটারের একটার প্রতিতুলনা হিসেবে দেখা দিল। এর উদ্দেশ্য ছিল জীবনে অর্থময়তার অভাবটা দেখানো যাতে করে দর্শক দ্বিমত পোষণ করতে পারে। অর্থহীনতার চর্চা করা কিন্তু এর উদ্দেশ্য ছিল না। বরং তার উল্টোটাই। গাধা দৈনন্দিন জীবনের উদ্ভটত্ব দেখিয়ে দিয়ে, সবার সামনে উন্মুক্ত করে দিয়ে দর্শকদের বাধ্য করা হলো তাদের নিজেদের জন্যে আরো বেশি সত্য এবং আরো অপরিহার্য একটা জীবনের সন্ধান করতে।
ব্যাপারটা বেশ ইন্টারেস্টিং শোনাচ্ছে।
থিয়েটার অভ দ্য অ্যাবসার্ড প্রায়ই এমন কিছু অবস্থার ছবি তুলে ধরে যা নিতান্তই তুচ্ছ। কাজেই এটাকে বলা যেতে পারে এক ধরনের অতিবাস্তবতা (hyperrealism)। মানুষ যেমন ঠিক তেমনভাবেই তুলে ধরা হয় তাকে। কিন্তু পুরোপুরি সাধারণ একটা বাড়িতে পুরোপুরি সাধারণ এক সকালে গোসলখানায় যা ঘটে ঠিক তাই যদি তুমি মঞ্চে দেখাও, দর্শকরা হাসবে। তাদের এই হাসিকে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে নিজেদেরকে হাস্যস্পদ হিসেবে দেখতে পাওয়ার বিরুদ্ধে একটা ডিফেন্স মেকানিজম বা প্রতিরোধমূলক কাজ হিসেবে।
হ্যাঁ, ঠিক তাই।
অ্যাবসার্ড থিয়েটারের কিছু পরাবাস্তববাদী বৈশিষ্ট্য-ও থাকতে পারে। এর চরিত্ররা প্রায়ই নিজেদের আবিষ্কার করে অত্যন্ত অবাস্তব এবং স্বপ্নসদৃশ পরিস্থিতিতে। সেটাকে যখন তারা বিস্মিত না হয়ে মেনে নেয় তখন দর্শক-ই অবাক হয় চরিত্রগুলোর এই বিস্ময়হীনতা দেখে। চার্লি চ্যাপলিন (Charlie Chaplin) তাঁর নির্বাক ছবিগুলোতে এভাবেই কাজ করেছিলেন। চ্যাপলিন যে তাঁর জীবনে ঘটা উদ্ভট সব ব্যাপার নিরুচ্চারে মেনে নিচ্ছেন এই ব্যাপারটিই ছিল এ-সব নির্বাক চলচ্চিত্রের কমিক উপাদান। এতে করে দর্শকরা বাধ্য হতো তাদের জীবনে আরো খাঁটি আরো সত্য কিছু খুঁজে বের করার জন্যে নিজেদের দিকে ফিরে তাকাতে।
মানুষ যে কত কিছু বিনা প্রতিবাদে মেনে নেয় তা সত্যিই আশ্চর্যের।
মাঝে মাঝে এমন একটা অনুভূতি হওয়া সঙ্গত যে এই অবস্থা থেকে আমাকে পালাতেই হবে যদিও কোথায় সে-ব্যাপারে কোনো ধারণাই নেই আমার।
বাড়িতে আগুন লাগলে আপনাকে স্রেফ সেখান থেকে বেরিয়ে যেতে হবে, এর পর কোথায় থাকবেন সেটা জানা না থাকলেও।
ঠিক। আরেক কাপ চা খাবে? বা একটা কোক?
ঠিক আছে। কিন্তু আমি তারপরেও মনে করি দেরি করে আপনি বালখিল্য একটা কাজ করেছেন।
সেটা মানতে আমার কোনো আপত্তি নেই।
এক কাপ এক্সপ্রেসো আর একটা কোক নিয়ে ফিরে এলেন অ্যালবার্টো। এরি মধ্যে এই ক্যাফের পরিবেশটা ভালো লাগতে শুরু করেছে সোফির। সে আরো ভাবতে শুরু করেছে যে অন্য টেবিলগুলোর কথাবার্তাও সে যতটা ভেবেছিল ততটা তুচ্ছ হয়ত না-ও হতে পারে।
কোকের বোতলটা বেশ সশব্দেই টেবিলের ওপর রাখলেন অ্যালবার্টো। অন্যান্য টেবিলে বসে থাকা অনেকেই চমকে মুখ তুলে তাকালেন।
তো, এই সঙ্গে পথের শেষ প্রান্তে চলে এলাম আমরা, বললেন তিনি।
তার মানে আপনি বলতে চাইছেন সাত্রে আর অস্তিত্ববাদের সঙ্গেই দর্শনের ইতিহাস শেষ হয়ে যাচ্ছে?
না, সে-কথা বললে বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। সারা পৃথিবী জুড়ে অসংখ্য লোকের কাছে অস্তিত্ববাদী দর্শনের একটা মৌলিক গুরুত্ব রয়েছে। আমরা দেখেছি এর শেকড় প্রোথিত রয়েছে ইতিহাসের অনেক পেছনে, কিয়ের্কেগার্ড হয়ে সক্রেটিস পর্যন্ত। তাছাড়া অন্য যে-সব দার্শনিক স্রোতধারার কথা আমরা আলোচনা করেছি সেগুলোরও একটা বিকাশ আর পুনর্জন্মলাভের ঘটনা দেখতে পাই আমরা বিংশ শতাব্দীতে।
যেমন?
যেমন, এ-ধরনের একটি স্রোতধারা হচ্ছে নিও-টমিজম (Neo-Thomism), তার মানে সেই সব ধারণা টমাস অ্যাকুইনাসের চিন্তাধারার অনুসারী। আরেকটি হচ্ছে বিশ্লেষণাত্মক দর্শন (analytical philosophy) বা যৌক্তিক অভিজ্ঞতাবাদ (logical empiricism) যার শেকড় চলে গেছে হিউম আর ব্রিটিশ অভিজ্ঞতাবাদ পর্যন্ত, এমনকী অ্যারিস্টটলের যুক্তিবিদ্যা অব্দি। ছাড়াও বিংশ শতাব্দীকে স্বাভাবিকভাবেই আরো প্রভাবিত করেছে আমরা যাকে বলতে পারি নব্য-মার্ক্সবাদ (Neo-Marxism), সেটার নানান ধরনের অগুনতি প্রবণতাসহ। আর এরিমধ্যে আমরা কথা বলেছি নব্য-ডারউইনবাদ (Neo-Darwinism) এবং মনোসমীক্ষণ-এর গুরুত্ব নিয়েও।
হ্যাঁ।
আমরা কেবল শেষ আরেকটা স্রোতধারা নিয়ে আলাপ করবো, যার নাম বস্তুবাদ (materialism) এবং এটারও ঐতিহাসিক ভিত্তি রয়েছে। বর্তমান কালের বিজ্ঞানের একটা বড় অংশেরই মূল খুঁজে পাওয়া যাবে প্রাক-সক্রেটিস দার্শনিকদের প্রচেষ্টার মধ্যে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে সব বস্তু যে অবিভাজ্য মৌলিক কণা দিয়ে তৈরি তার অনুসন্ধানের কথা। বস্তু কী সে-সম্পর্কে সন্তোষজনক কোনো ব্যাখ্যা আজ পর্যন্ত কেউ দিতে পারেনি। নিউক্লিয়ার ফিজিক্স আর বায়োকেমিস্ট্রির মতো আধুনিক বিজ্ঞান এই সমস্যাটি নিয়ে এমনই মশগুল হয়ে আছে যে বেশ কিছু মানুষের জীবনের দর্শনের এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ।
নতুন আর পুরনো মিলিয়ে সব গোল পাকিয়ে গেছে…।
হ্যাঁ। ঠিক যে-সব প্রশ্ন দিয়ে আমরা আমাদের কোর্স শুরু করেছিলাম সেগুলোর উত্তর আজো অজানা রয়ে গেছে। সাত্রের এই মন্তব্যটি গুরুত্বপূর্ণ যে অস্তিত্ববাদী প্রশ্নগুলোর উত্তর চূড়ান্তভাবে দেয়া যায় না। সংজ্ঞাগত দিক দিয়ে, একটি দার্শনিক প্রশ্ন হচ্ছে এমন একটা জিনিস যা প্রতিটি প্রজন্ম, এমনকী প্রতিটি ব্যক্তিকে বার বার জিগ্যেস করতে হয়।
বিষণ্ণ একটা চিন্তা।
ঠিক জানি না আমি একমত কিনা। এ-কথা নিশ্চিত করেই বলা যাযে এ ধরনের প্রশ্ন করেই আমরা জানতে পারি যে আমরা বেঁচে আছি। আর তাছাড়া, সব সময়ই দেখা গেছে যে মানুষ যখন পরম প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজেছে তখনই তারা অন্য অনেক সমস্যার স্পষ্ট এবং চূড়ান্ত সমাধান আবিষ্কার করেছ। বিজ্ঞান, গবেষণা আর প্রযুক্তি, সবই আমাদের দার্শনিক চিন্তা-ভাবনারই বাই-প্রোডাক্ট। জীবন সম্পর্কে আমাদের বিস্ময়ই কি শেষ পর্যন্ত মানুষকে চাদে নিয়ে যায়নি?
হ্যাঁ, তা ঠিক।
নীল আর্মস্ট্রং (Neil Armstrong) চাঁদে পা দিয়ে বলেছিলেন ব্যক্তির জন্যে একটি ছোট্ট পদক্ষেপ, মানবজাতির জন্যে একটি বিরাট লাফ। প্রথম মানুষ হিসেবে চাঁদে পা রাখার অনুভূতিরই সংক্ষিপ্ত প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন তিনি এই কথাগুলো দিয়ে, নিজের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়েছিলেন তাঁর আগে পৃথিবীতে বাস করে যাওয়া সমস্ত মানুষকে। নিশ্চয়ই এ শুধু তাঁর কৃতিত্ব ছিল না।
আমাদের নিজেদের কালে আমাদেরকেও একেবারে নতুন কিছু সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর হচ্ছে পরিবেশ সংক্রান্ত সমস্যা। কাজেই বিংশ শতাব্দীতে দর্শনের একটি কেন্দ্রীয় অভিমুখ হচ্ছে পরিবেশ-দর্শন (ecophilosophy) বা সেটার অন্যতম স্থপতি নরওয়েজিয় দার্শনিক আর্নে নেস-এর (Arne Naess) ভাষায় ইকোসফি (ecosophy)। পশ্চিমা বিশ্বের অনেক পরিবেশ দার্শনিকই এই বলে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন যে সার্বিকভাবে পাশ্চাত্য সভ্যতা মূলত ভুল পথে এগোচ্ছে, আমাদের গ্রহটার সহ্যসীমার সঙ্গে একটা মুখোমুখি সংঘর্ষের দিকে ছুটে যাচ্ছে। দূষণ এবং পরিবেশ ধ্বংসের সুস্পষ্ট ফলাফল যতদূর পৌঁছেছে তার চেয়েও গভীরে গিয়ে পরিস্থিতিটা বুঝতে চেয়েছেন তারা। তারা দাবি করছেন যে পশ্চিমা চিন্তা-ভাবনায় মৌলিক কিছু গলদ রয়েছে।
আমার মনে হয় ঠিকই বলেছেন তারা।
যেমন ধরো, মানুষই সবার ওপরে, যেন আমরাই প্রকৃতির প্রভু, বিবর্তনবাদের এই ধারণাটির ব্যাপারেই প্রশ্ন তুলেছে পরিবেশ-দর্শন। গোটা এই সজীব গ্রহটির জন্যে এ-ধরনের চিন্তা-ভাবনা অত্যন্ত মারাত্মক হতে পারে।
এ-নিয়ে চিন্তা করলে পাগল হয়ে যাই আমি।
এই ধারণাটার সমালোচনা করতে গিয়ে অনেক পরিবেশ-দার্শনিকই অন্য সংস্কৃতি যেমন ভারত-সংস্কৃতির চিন্তা-ভাবনা ও ধারণার দিকে তাকিয়েছেন। যে-সব জিনিস আমরা হারিয়ে ফেলেছি সেগুলো ফিরে পাবার জন্যে তারা তথাকথিত আদিম জনগোষ্ঠী বা আদিবাসী জনগোষ্ঠী যেমন আদিবাসী আমেরিকানদের চিন্তাধারা ও রীতিনীতিও অধ্যয়ন করেছেন।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বৈজ্ঞানিক মহলে এ-কথা বলা হয়েছে যে আমাদের বৈজ্ঞানিক চিন্তার ধরন-ধারন একটা দৃষ্টান্ত বদল-এর (paradigm shift) মুখোমুখি হচ্ছে। তার মানে বিজ্ঞানীরা যেভাবে চিন্তা-ভাবনা করে থাকেন সেই ধরনটাতে একটা মৌলিক পরিবর্তন ঘটছে। অনেক ক্ষেত্রেই এতে করে ফল হয়েছে। সম্পূর্ণবাদ (holism) আর একটা নতুন জীবনধারার কথা প্রচার করা অসংখ্য তথাকথিত বিকল্প আন্দোলন আমরা দেখেছি।
গ্রেট।
সে যাই হোক, একটা বিষয়ের সঙ্গে যখন অনেক মানুষ জড়িত থাকে তখন ভালো মন্দের ফারাক নির্ণয় করাটা একান্ত জরুরি হয়ে দাঁড়ায়। কেউ কেউ দাবি করছেন একটা নতুন যুগে প্রবেশ করছি আমরা। কিন্তু তাই বলে নতুন সব কিছুই যে ভালো তা নয়, আবার পুরনো সব কিছুই ছুঁড়ে ফেলা উচিত নয়। তোমাকে এই দর্শন কোর্সটা উপহার দেয়ার কারণগুলোর মধ্যে এটা একটা কারণ। ঐতিহাসিক পটভূমিটার কথা জানা থাকল তোমার, এবার তুমি নিজেই নিজের পথ খুঁজে নিতে পারবে জীবনে।
ধন্যবাদ।
আমার মনে হয় নতুন যুগ-এর নামে যা চলছে তার বেশির ভাগই যে ধোকাবাজি তুমি তা বুঝতে পারবে। এমনকী তথাকথিত নব্য-ধর্ম, নব্য গূঢ়তাবাদ (Neo Occultism) এবং সব ধরনের আধুনিক কুসংস্কার সাম্প্রতিক দশকগুলোতে পশ্চিমা জগতকে প্রভাবিত করেছে। ব্যাপারটা একটা ইন্ডাস্ট্রিতে পরিণত হয়েছে। খ্রিস্টধর্মের ক্ষীয়মান সমর্থনের পিছু পিছু দর্শনের বাজারে ব্যাঙের ছাতার মতো কিছু বিকল্প প্রস্তাব গজিয়ে গেছে।
কোন ধরনের প্রস্তাব?
তালিকাটা এতোই লম্বা যে শুরু করার সাহস পাচ্ছি না। আর তাছাড়া, কারো পক্ষে তার নিজের সময়ের বর্ণনা দেয়া সহজ নয়। কিন্তু সে যাই হোক, শহরের ভেতর দিয়ে একটু হেঁটে এলে কেমন হয়? তোমাকে একটা জিনিস দেখাতে চাই।
বেশি সময় নেই আমার হাতে। কালকের গার্ডেন পার্টির কথা ভুলে যাননি আশা করি?
না। তখনই তো চমৎকার একটা ব্যাপার ঘটছে। প্রথমে হিল্ডার দর্শন কোর্সটার ইতি টানতে হবে। মেজর কিন্তু তার বেশি কিছু ভাবেনি, বুঝলে। কাজেই আমাদের ওপর তার খবরদারির খানিকটা সুযোগ হারাবে সে।
আবারো কোকের বোতলটা তুললেন তিনি-এখন খালি সেটা-তারপর সশব্দে নামিয়ে আনলেন সেটা টেবিলের ওপর।
রাস্তায় বেরিয়ে এলেন তারা, সেখানে কর্মোদ্যমে রা ইঁদুরের মতো ছুটোছুটি করছে লোকজন। সোফি ভাবতে লগল অ্যালবার্টো তাকে কী দেখাতে চান।
বড় একটা দোকানের পাশ দিয়ে হেঁটে গেল তারা; যোগাযোগ প্রযুক্তির সব কিছু বিক্রি হচ্ছে সেখানে-টেলিভিশন, ভিসিআর এবং স্যাটেলাইট ডিশ থেকে মোবাইল ফোন কম্পিউটার আর ফ্যাক্স মেশিন সব।
উইন্ডো ডিসপ্লেটার দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে অ্যালবার্টো বললেন: ওই যে, ওখানেই বিংশ শতাব্দীকে পেয়ে যাবে তুমি, সোফি। বলতে গেলে রেনেস-র সময়েই পৃথিবীটা বিস্ফোরিত হতে শুরু করে। আবিষ্কারের জন্য বড় বড় সব অভিযান দিয়ে শুরু করে ইউরোপিয়রা সারা দুনিয়া ছুঁড়ে বেড়াতে আরম্ভ করেছিল। আজ ঘটনাটা তার ঠিক উল্টো। এটাকে আমরা বলতে পারি একটা উল্টো ধরনের বিস্ফোরণ।
কোন অর্থে?
এই অর্থে যে দুনিয়াটা বিশাল একটা কমিউনিকেশন নেটওয়ার্কের ভেতর সংকুচিত হয়ে পড়ছে। এই কিছু দিন আগেও দার্শনিকদেরকে গাড়ি চেপে দিনের পর দিন ভ্রমণ করতে হতো দুনিয়াটাকে নিয়ে তত্ত্ব-তালাশ করতে বা অন্য দার্শনিকদের সঙ্গে দেখা করতে। আর আজকে আমরা গ্রহটার যে-কোনো জায়গায় বসে মানব অভিজ্ঞতার সবটুকুই পেয়ে যেতে পারি কম্পিউটার স্ক্রীনের ওপর।
এটা একটা ফ্যান্টাস্টিক চিন্তা। খানিকটা ভীতিকরও বটে।
কথা হচ্ছে ইতিহাস কি শেষ হয়ে যাচ্ছে নাকি তার বদলে আমরা পুরোপুরি নতুন একটা যুগের দোরগোড়ায় এসে পৌঁছেছি। আমরা এখন আর স্রেফ একটা শহরের নাগরিক বা একটা দেশের-নাগরিক নই। আমরা এখন বাস করছি একটা প্ল্যানেটারি সভ্যতায়।
তা ঠিক।
গত তিরিশ-চল্লিশ বছরে, বিশেষ করে যোগাযোগের ক্ষেত্রে যে নাটকীয় উন্নতি হয়েছে তা গোটা ইতিহাসের সমস্ত উন্নতির চাইতেও ঢের বেশি। আর তারপরেও আমরা সম্ভবত কেবল শুরুটাই প্রত্যক্ষ করেছি…।
আপনি কি এটাই দেখাতে চেয়েছিলেন আমাকে?
না, সেটা আছে ওই গির্জাটার অন্য দিকে।
ওরা যখন ওখান থেকে চলে যাবে সেই সময়ই একটা টিভির পর্দায় জাতিসংঘের কিছু সৈন্যের ছবি ভেসে উঠল।
দেখুন! বলে উঠল সোফি।
জাতিসংঘের একজন সৈন্যের ওপর জুম করল ক্যামেরাটা। প্রায় অ্যালবার্টোর মতোই কালো দাড়ি তার। হঠাৎ একটা কার্ড তুলে ধরল সে, তাতে লেখা শিগগিরই ফিরে আসছি, হিল্ডা। তারপর হাত নেড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল সে।
হাতুড়ে কোথাকার! অ্যালবার্টো বলে উঠল।
সেই মেজর নাকি?
প্রশ্নটার জবাবও দেবো না আমি।
পার্ক পেরিয়ে গির্জাটার সামনে চলে এলো তারা, তারপর উঠল আরেকটা মেইন স্ট্রিটে। অ্যালবার্টোকে খানিকটা বিরক্ত দেখাচ্ছে। শহরের সবচেয়ে বড় বইয়ের দোকান লিব্রিস-এর সামনে গিয়ে দাঁড়াল তারা।
চলো, ভেতরে যাই, অ্যালবার্টো বললেন। ভেতরে গিয়ে সবচেয়ে দীর্ঘ দেয়ালটার দিকে আঙুল তাক করলেন তিনি। তিনটে ভাগে ভাগ করা সেটা, নতুন যুগ বিকল্প জীবনধারা আর মরমীবাদ।
প্রত্যেকটা বইয়ের নামই আকর্ষণীয়; মৃত্যুর পরে জীবন? স্পিরিটিজম-এর রহস্য, টারট, ইডএফও সংক্রান্ত ঘটনা, উপশম, দেবতাদের প্রত্যাবর্তন, আগেও আপনি এখানে ছিলেন, জ্যোতিষবিদ্যা কী? শয়ে শয়ে বই। শেলফগুলোর নিচে আরো অনেক বই উঁই করে রাখা।
এটাও বিংশ শতাব্দী, সোফি। এ হচ্ছে আমাদের কালের মন্দির।
এসবের কোনো কিছুতেই আপনি বিশ্বাস করেন না, তাই না?
এ-সবের বেশিরভাগই ধোকাবাজি। কিন্তু পর্নোগ্রাফির মতোই বিকোয় এ-সব। এ-সবের অনেকটাই এক ধরনের পর্নোগ্রাফি। তরুণরা এখানে এসে যা তাদের। সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করে তাই কিনে নিয়ে যায়। কিন্তু সত্যিকারের দর্শন আর এই সব বইয়ের মধ্যে পার্থক্যটা কমবেশি সত্যিকারের ভালোবাসা আর পর্নোগ্রাফির মধ্যেকার পার্থক্যের মতোই।
আপনি কি একটু রূঢ় হয়ে যাচ্ছেন না?
চলো পার্কে গিয়ে বসি খানিকক্ষণ।
দোকানটা থেকে বেরিয়ে গির্জার সামনে খালি একটা বেঞ্চি পেল ওরা। গাছের নিচে সদর্পে ঘুরে বেড়াচ্ছে কিছু কবুতর, তাদের মাঝে বেমানান কিছু অতি উৎসাহী চড়ুই লাফিয়ে বেড়াচ্ছে।
একে বলে ইএসপি বা প্যারাসাইকোলজি, অ্যালবার্টো বললেন। অথবা টেলিপ্যাথি, ক্লেয়ারভয়েন্স আর সাইকোকাইনেটিকস। একে বলে স্পিরিটিজম, অ্যাস্ট্রলজি আর ইউফোলজি।
কিন্তু সত্যি করে বলুন তো, আপনি কি আসলেই মনে করেন এগুলো সবই ধোঁকাবাজি?
অবশ্যই একজন সত্যিকারের দার্শনিকের পক্ষে এ-কথা বলা খুব উচিত হবে না যে এগুলো সবই খারাপ। তবে এ-কথা বলতে আমার আপত্তি নেই যে এই সমস্ত বিষয় সম্ভবত এমন একটা রাজ্যের একটা বিস্তারিত মানচিত্র নির্দেশ করে যে রাজ্যের অস্তিত্বই নেই। তাছাড়া এখানে এমন কিছু কল্পনার তৈরি মিথ্যে জিনিস রয়েছে হিউম যেগুলোকে হয়ত আগুনের ভেতর ছুঁড়ে ফেলতেন। এ-সব বইয়ের অনেকগুলোর মধ্যেই সত্যিকারের অভিজ্ঞতার ছিটেফোঁটাও নেই।
তা, এ-ধরনের বিষয়ের ওপর এমন অবিশ্বাস্য সংখ্যায় বই বেরোয় কেন?
এ-ধরনের বই প্রকাশ করা একটা বড় বাণিজ্যিক উদ্যোগ। বেশিরভাগ লোক এ-সবই চায়।
কেন বলুন তো?
তারা নিশ্চয়ই প্রতিদিনকার শুষ্ক একঘেয়েমি কাটানোর জন্যে খানিকটা গুপ্তরহস্যমূলক, খানিকটা ভিন্ন কিছু চায়। কিন্তু ব্যাপারটা তেলে মাথায় তেল দেয়ার মতোই।
তার মানে?
এই যে আমরা এখানে একটা চমৎকার অভিযানে ঘুরে বেড়াচ্ছি। সৃষ্টির একটা কাজ একেবারে আমাদের চোখের সামনে বিকাশ লাভ করছে। একেবারে প্রকাশ্য দিবালোকে, সোফি। দারুণ না ব্যাপারটা!
আমারও তো তাই মনে হয়।
তাহলে ভবিষ্যদ্বক্তার তাঁবুতে বা পণ্ডিতদের পেছন আঙিনায় ঢুঁ মারার দরকারটা কী আমাদের?
আপনি কি বলতে চাইছেন এ-সব বই যারা লেখে তারা সব শঠ আর মিথ্যেবাদী?
না, আমি তা বলছি না। কিন্তু এখানেও আমরা একটা ডারউইনিয় পদ্ধতির কথা বলছি।
ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলতে হচ্ছে আপনাকে।
একটা দিনে নানান ধরনের কত সব ঘটনা ঘটতে পারে সে-কথা চিন্তা করো। অবশ্য তুমি তোমার জীবনের একটা দিনের কথাও ভাবতে পারো। যা দেখো যা ঘটে সে-সবের কথা চিন্তা করো।
হ্যাঁ?
মাঝে মধ্যেই অদ্ভুত একটা কাকতালীয় ব্যাপার ঘটে। হয়ত একটা দোকানে গিয়ে ২৮ ক্রাউন দিয়ে কিছু কিনলে তুমি। সেদিনই পরে জোয়ানা এসে তুমি ওর কাছে যে ২৮ ক্রাউন পেতে তাই দিয়ে দিল। দুজনেই ঠিক করলে সিনেমা দেখতে যাবে-আর গিয়ে দেখলে তোমার সিট নম্বর ২৮।
হ্যাঁ, অদ্ভুত একটা কাকতালীয় ব্যাপার হবে সেটা।
কাকতালীয় ব্যাপার যে হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এখন কথা হচ্ছে, লোকে এই ধরনের কাকতালীয় ঘটনার কথা সংগ্রহ করে। অদ্ভুত বা ব্যাখ্যা করা যায় না এমন সব ঘটনা সংগ্রহ করে তারা। যখন কোটি কোটি লোকের জীবন থেকে নেয়া এ-ধরনের অভিজ্ঞতা বইয়ে সংকলিত হয় তখন ব্যাপারটা খাঁটি ডেটার মতোই দেখায়। আর এর সংখ্যা সব সময়ই বাড়তে থাকে। কিন্তু এবারও আমরা এমন একটা লটারির কথা বলছি যেখানে কেবল সেইসব নম্বরই দৃশ্যমান যেগুলো জয়ী হয়েছে।
কিন্তু প্রতিনিয়তই এ-ধরনের অভিজ্ঞতা অর্জন করছে এ-রকম ক্লেয়ারভয়ান্ট আর মিডিয়াম-ও তো রয়েছে, তাই না?
তা আছে; আর আমরা যদি শঠগুলোর কথা বাদ দিই তাহলে এ-সব তথাকথিত রহস্যময় অভিজ্ঞতার অন্য আরেকটি ব্যাখ্যা পাই আমরা।
আর সেটা হচ্ছে?
তোমার মনে আছে ফ্রয়েড-এর নির্জন মনের তত্ত্বের কথা আলাপ করেছিলাম আমরা…
অবশ্যই।
ফ্রয়েড দেখিয়েছিলেন যে প্রায়ই আমরা আমাদের নিজেদের নির্জন মনের মিডিয়াম হিসেবে কাজ করতে পারি। হঠাৎ আমরা হয়ত দেখলাম আমরা কিছু চিন্তা করছি বা কোনো কাজ করছি। কেন করছি সেটা না জেনেই। এর কারণ হলো আমাদের মধ্যে এমন সব অভিজ্ঞতা, চিন্তা-ভাবনা আর স্মৃতি রয়েছে যার সম্পর্কে আমরা সচেতন নই।
তো?
মানুষ মাঝে মধ্যে ঘুমের মধ্যে কথা বলে বা হাঁটাহাটি করে। এটাকে আমরা একটা মানসিক স্বয়ংক্রিয়তা (mental automatism) বলি। আর সম্মোহিত অবস্থায় লোকে এমন সব কথা বলতে পারে এমন সব কাজ করতে পারে যা তাদের করার কথা নয়। পরাবাস্তববাদীদের কথা-ও খেয়াল রেখো যারা তথাকথিত স্বয়ংক্রিয় লেখা লিখতে চেয়েছিলেন। তাঁরা স্রেফ তাদের নিজেদের নির্জন মনের মিডিয়াম হিসেবে কাজ করতে চেয়েছিলেন।
মনে আছে।
এই শতাব্দীতে মাঝে মধ্যেই আমরা যাকে বলি আধ্যাত্মবাদী পুনর্জন্ম সেটা ঘটেছে। তার পেছনে এই আইডিয়াটা কাজ করেছে যে একটি মিডিয়াম একটি মৃত ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে। হয় মৃতের গলায় কথা বলে, নয় স্বয়ংক্রিয় লেখা ব্যবহার করে মিডিয়াম এমন একজনের কাছ থেকে একটা বার্তা পেতো যিনি হয়ত পাঁচ বা পঞ্চাশ বা কয়েকশো বছর আগে জীবিত ছিলেন। মৃত্যুর পরে জীবন আছে বা আমরা আসলে বহু জীবন যাপন করি, এই দুটোর যে কোনোটির প্রমাণ হিসেবে ব্যাপারটাকে গ্রহণ করা হয়েছে।
হ্যাঁ, আমি জানি।
আমি বলছি না যে সব মিডিয়ামই ভুয়া ছিল। তাদের কেউ কেউ নিশ্চয়ই সরল বিশ্বাসী ছিল। তারা ছিল আসলেই মিডিয়াম, তবে তারা ছিল স্রেফ তাদের নিজেদের নির্জন মনের মিডিয়াম। ভাব-সমাধিতে (trance) থাকা অনেক মিডিয়ামকেই খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে তারা এমন কিছু জ্ঞান এবং শক্তির অধিকারী যা তারা কীভাবে অর্জন করল সে-কথা তারা নিজেরা বা অন্য কেউ বলতে পারে না। একবার এক মহিলা হিব্রু ভাষায় সংবাদ আদান-প্রদান করলেন, অথচ ভাষাটি তিনি আদৌ জানতেন না। কাজেই নিশ্চয়ই অন্য কোনো জন্মে জীবন কাটিয়ে গিয়েছিলেন তিনি অথবা কোনো মৃত আত্মার সঙ্গে যোগাযোগ ঘটেছিল তাঁর।
আসলে কোনটা বলে মনে হয় আপনার।
দেখা গেল তিনি যখন ছোট ছিলেন তখন তাঁর এক ইহুদী আয়া ছিল।
ও।
হতাশ হলে? ঘটনাটা স্রেফ এটাই প্রমাণ করে কিছু মানুষ তাদের নির্জন মনে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে রাখার কী অবিশ্বাস্য ক্ষমতা রাখে।
বুঝতে পারছি আপনি কী বলতে চাইছেন।
ফ্রয়েডের নির্জন মনের তত্ত্ব দিয়ে দৈনন্দিন জীবনের প্রচুর অদ্ভুত ঘটনা ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। হঠাৎ করেই আমি এমন এক বন্ধুর কাছ থেকে একটা টেলিফোন কল পেতে পারি যার সঙ্গে বহু বছর ধরে আমার কোনো যোগাযোগ নেই এবং একটু আগেই তার টেলিফোন নম্বর খুঁজতে শুরু করেছিলাম আমি।
আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।
কিন্তু এর ব্যাখ্যাটা এ-রকম হতে পারে যে দুজনেই আমরা একটু আগে এমন একটা পুরনো গান রেডিওতে শুনেছি যেটা আমরা শুনেছিলাম শেষ যে-বার আমরা একসঙ্গে ছিলাম তখন। ব্যাপারটা হচ্ছে যে অন্তরালের সম্পর্কটার ব্যাপারে আমরা সচেতন নই।
কাজেই এটা হয় ধোঁকাবাজি অথবা সেই বিজয়ী নম্বর-এর ব্যাপার আর নয় নিজ্ঞান মন। ঠিক?
ইয়ে, সে যাই হোক, শোভন মাত্রার সংশয়বাদ নিয়ে এ-সব বই-এর কাছে ভেড়াটাই বেশি স্বাস্থ্যকর। আর কেউ যদি দার্শনিক হয় তা হলে তো কথাই নেই। ইংল্যান্ডে সংশয়বাদীদের একটা সমিতি আছে। বহু বছর আগে তারা ঘোষণা করেছিল যে, প্রথম যে-লোক অতিপ্রাকৃত কোনো ঘটনার সামান্যতম প্রমাণও দিতে পারবে তাকে বিশাল অংকের পুরস্কার দেয়া হবে। বড় কোনো অলৌকিক ঘটনা নয়, টেলিপ্যাথির ছোট্ট একটা ঘটনা হলেও চলবে। আজ পর্যন্ত কেউই সে-রকম কোনো দাবি নিয়ে এগিয়ে আসেনি।
হুম্।
অন্য দিকে, এমন অনেক কিছু রয়েছে যা আমরা মানুষেরা বুঝতে পারি না। হয়ত প্রকৃতির নিয়ম-কানুনও বুঝতে পারি না। গত শতাব্দীতে অনেক লোকই মনে করত ম্যাগনেটিজম এবং ইলেক্ট্রিসিটির মতো ব্যাপারগুলো এক ধরনের জাদু। বাজি ধরে বলতে পারি আমার নিজের দাদীর মাকে আমি টিভি বা কম্পিউটারের কথা বললে ওঁর চোখ ছানাবড়া হয়ে যেতো।
তার মানে অতি প্রাকৃত কোনো কিছুতে আপনি বিশ্বাস করেন না।
এ-নিয়ে এরিমধ্যে কথা বলেছি আমরা। এমনকী অতিপ্রাকৃত কথাটাও কিন্তু অদ্ভুত। না, আমার ধারণা, একটিমাত্র প্রকৃতিতেই বিশ্বাস করি আমি। কিন্তু অন্যদিকে সেটাও রীতিমত আশ্চর্যের।
কিন্তু আপনি যে-সব বই এইমাত্র আমাকে দেখালেন সেগুলোতে লেখা রহস্যময় ব্যাপারগুলো?
সত্যিকারের সব দার্শনিকেরই উচিত চোখ খোলা রাখা। সাদা কাক যদিও কখনো দেখিনি আমরা কিন্তু তাই বলে সেটা খোঁজা কখনো বন্ধ করা উচিত হবে না। এবং একদিন এমনকী আমার মতো এক সংশয়বাদীও হয়ত এমন একটা ব্যাপার বিশ্বাস করতে বাধ্য হতে পারে যা আমি আগে কখনো বিশ্বাস করতাম না। এই সম্ভাবনার দরজা যদি আমি ভোলা না রাখতাম তাহলে আমি হতাম গোড়াপন্থী, সত্যিকারের দার্শনিক নয়।
কোনো কথা না বলে বেঞ্চিতে বসে রইলেন অ্যালবার্টো আর সোফি। কবুতরগুলো গলা বাড়িয়ে বকম বকম করে যাচ্ছে, মাঝে মাঝেই চমকে উঠছে বাইসেকেল বা হঠাৎ কোনো চলাচলের শব্দে।
শেষ পর্যন্ত সোফি বলে উঠল, আমাকে বাড়ি যেতে হবে, পার্টির যোগাড়-যন্তর করতে হবে।
তবে বিদায় নেবার আগে একটা সাদা কাক দেখাবো তোমাকে। তুমি দেখবে, যতটা দূরে বলে মনে করি আমরা তার চেয়ে কাছেই রয়েছে ওটা।
অ্যালবার্টো উঠে দাঁড়িয়ে ফের বইয়ের দোকানটায় নিয়ে গেলেন সোফিকে। এইবার তারা অতিপ্রাকৃত ব্যাপার-স্যাপারের ওপর লেখা সবগুলো বইয়ের পাশ দিয়ে হেঁটে দোকানের একেবারে শেষ মাথায় হালকা-পাতলা একটা শেলফের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। শেলফের ওপরে খুব ছোট্ট একটা কার্ড ঝুলছে। তাতে লেখা দর্শন।
বিশেষ একটা বইয়ের দিকে আঙুল তুলে দেখালেন অ্যালবার্টো, সেটার নামটা পড়ে মুখ হাঁ হয়ে গেল সোফির: সোফির জগৎ।
তুমি কি চাও বইটা তোমাকে কিনে দিই আমি?
অতটা সাহস আমার হবে বলে মনে হয় না।
খানিক পর এক হাতে বইটা অন্যটায় গার্ডেন পার্টির জিনিস-পত্ৰভরা ছোেট্ট একটা ব্যাগ নিয়ে বাড়ির পথে রওনা হয়ে গেল সে।