০৩. পুরাণ

০৩. পুরাণ

…শুভ ও অশুভ শক্তির মধ্যে এক বিপজ্জনক ভারসাম্য…

পরদিন সকালে কোনো চিঠি এলো না সোফির জন্যে। শেষ না হতে চাওয়া দিনটার পুরোটা সময় জুড়ে একঘেয়েমিতে হাঁপিয়ে উঠল সে। ক্লাস-ব্রেকগুলোর সময় খেয়াল রাখল জোয়ানার সঙ্গে যেন একটু ভালো ব্যবহার করা হয়। বাড়ি ফেরার পথে দুজনের মধ্যে আলাপ হলো বনটা যথেষ্ট রকম শুকনো হয়ে উঠলেই ক্যাম্পিং এ যাওয়া নিয়ে।

 অনন্তকাল মনে হওয়া সময়টার পর আরেকবার ডাকবাক্সের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। সে। প্রথমে খুলল মেক্সিকোর পোস্টমার্ক দেয়া একটা চিঠি। ওর বাবা পাঠিয়েছেন। বাড়ি ফেরার জন্যে কেমন উন্মুখ হয়ে আছেন আর কেমন করে চীফ অফিসারকে প্রথমবারের মতো দাবায় হারাতে পেরেছেন তাই লিখেছেন তিনি। আরো লিখেছেন, শীতের ছুটির শেষে যে একগাদা বই সঙ্গে নিয়েছিলেন তা প্রায় শেষ করে এনেছেন। আর তারপরেই, সোফির নাম লেখা বাদামি রঙের একটা খাম!

স্কুল ব্যাগ আর বাকি চিঠিগুলো বাড়িতে রেখে নিজের আস্তানার দিকে ছুট লাগাল সোফি। টাইপ করা নতুন পৃষ্ঠাগুলো বের করে নিয়ে শুরু করল পড়তে:

পৌরাণিক বিশ্বচিত্র

এই যে, সোফি! অনেক কাজ পড়ে রয়েছে আমাদের। কাজেই দেরি না করে শুরু করে দিচ্ছি আমরা।

দর্শন বলতে আমরা চিন্তার একেবারে সেই নতুন পদ্ধতিটির কথা বুঝি যার উদ্ভব হয়েছিল খ্রিস্টের জন্মের প্রায় ছশ বছর আগে। সেই সময়ের আগ পর্যন্ত লোজন তাদের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেত বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে। এই ধর্মীয় ব্যাখ্যাগুলো পুরাণ-এর রূপ ধরে এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মের কাছে পৌঁছেছে। আর পুরাণ হলো বিভিন্ন দেব-দেবীর গল্প, যে-গল্পগুলো ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে যে, যে জীবনকে আমরা দেখি তা এমন কেন।

দার্শনিক প্রশ্নের অযুত পৌরাণিক ব্যাখ্যা শত সহস্র বছর ধরে পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে। গ্রীসের দার্শনিকেরা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন যে এ-সব ব্যাখ্যায় আর বিশ্বাস করা যায় না।

প্রথমদিককার দার্শনিকদের চিন্তা-ভাবনা কেমন ছিল তা বুঝতে হলে আমাদেরকে বুঝতে হবে বিশ্বের একটি পৌরাণিক চিত্র মনের মধ্যে থাকার অর্থ কী। উদাহরণ হিসেবে আমরা কয়েকটি নর্ডিক পুরাণের কথা বলতে পারি। তেলে মাথায় তেল দিয়ে তো আর লাভ নেই।)।

তুমি হয়ত থর আর তার হাতুড়ির কথা শুনে থাকবে। নরওয়েতে খ্রিস্টধর্ম আসার আগে লোকে বিশ্বাস করত দুই ছাগলে টানা একটি রথে চড়ে আকাশের এ প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত আসা-যাওয়া করেন থর। তিনি হাতুড়ি দোলালে বজ্র আর বিদ্যুচ্চমকের সৃষ্টি হয়। নরওয়েজীয় ভাষায় বস্ত্র– Thordon– মানে হলো থরের গর্জন। সুইডিশ ভাষায় বস্ত্র বোঝাতে ব্যবহৃত হয় aska শব্দটি, যার মূল as-aka, এবং অর্থ হলো স্বর্গের ওপর দিয়ে ঈশ্বরের ভ্রমণ।

 বজ্র আর বিদ্যুতের সঙ্গে বৃষ্টিও থাকে আর এই বৃষ্টি ভাইকিং চাষীদের জন্যে ছিল খুব জরুরি। কাজেই থরকে পূজা করা হতো উর্বরতার দেবতা হিসেবে।

সুতরাং বৃষ্টির পৌরাণিক ব্যাখ্যাটি ছিল এই যে থর তার হাতুড়ি দোলাচ্ছেন। আর বৃষ্টি হলেই শস্য গজিয়ে উঠত আর ক্ষেত ভরে ফেলত।

ক্ষেতে কীভাবে উদ্ভিদ জন্মায় আর তা থেকে ফসল ফলে সেটা কেউই বুঝত না। কিন্তু এর সঙ্গে যে বৃষ্টির সম্পর্ক আছে সেটা যেন কী করে পরিষ্কার বুঝে যেত সবাই। আর সবাই যেহেতু বিশ্বাস করত থরের সঙ্গে বৃষ্টির একটা যোগাযোগ আছে তাই নরওয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দেবতাদের অন্যতম ছিলেন থর।

থরকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করার আরেকটা কারণ ছিল, এমন একটা কারণ যার সঙ্গে একটা সম্পর্ক রয়েছে সমগ্র বিশ্ব পরিস্থিতির।

ভাইকিংরা বিশ্বাস করত যে পৃথিবীর যে-অংশে মানুষ বাস করে সে-অংশটি এমন একটি দ্বীপ যার ওপর বাইরের শত্রুর আক্রমণের সার্বক্ষণিক হুমকি রয়েছে। এই অংশটিকে বলত তারা মিডগার্ড, যার অর্থ মাঝখানের রাজ্য। মিডগার্ডের ভেতরেই আসগার্ড রাজ্য, দেবতাদের বাসস্থান।

মিডগার্ডের বাইরে উটগার্ড রাজ্য, বিশ্বাসঘাতক দৈত্যদের বাসস্থান; বিশ্বকে শাস্তি দিতে আর ধ্বংস করতে এই দৈত্যরা সব ধরনের ধূর্ততার আশ্রয় নিত। এ ধরনের দুষ্ট দানবদের সাধারণত নৈরাজ্যের শক্তি বলা হয়। দেখা গেছে, শুধু নরওয়ের পুরাণেই নয়, সব সংস্কৃতিতেই শুভ আর অশুভ শক্তির মধ্যে একটা বিপজ্জনক ভারসাম্য বজায় থাকে।

মিডগার্ড ধ্বংস করার অনেক উপায়ের একটি হলো উর্বরতার দেবী ফ্রেইয়াকে অপহরণ করা। এ-কাজটি করা গেলে ক্ষেতে কিছুই ফলবে না, মেয়েদেরও আর সন্ত নি হবে না। কাজেই এই দৈত্যদের বাধা দেয়া খুব জরুরি হয়ে পড়ে।

 দৈত্যদের সঙ্গে যুদ্ধে থর একটি প্রধান চরিত্র। বৃষ্টি নামানো ছাড়াও তাঁর হাতুড়ি অন্য কিছু কাজ করতে পারত; নৈরাজ্যের বিপজ্জনক শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ওটা ছিল একটা প্রধান অস্ত্র। সেই অস্ত্রটি তাকে প্রায় সীমাহীন শক্তির অধিকারী করে তুলেছিল। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, এটা ছুঁড়ে তিনি দৈত্যগুলোকে হত্যা করতে পারতেন। অস্ত্রটা হারিয়ে ফেলা নিয়ে তাকে চিন্তা করতে হতো না, তার কারণ বুমেরাঙের মতো অস্ত্রটা সব সময় তার কাছে ফিরে আসত।

 প্রকৃতির ভারসাম্য কীভাবে বজায় থাকত আর শুভ ও অশুরে মধ্যে কেন সব সময় যুদ্ধ চলত এটা তার একটা পৌরাণিক ব্যাখ্যা এবং দার্শনিকেরা ঠিক এ-ধরনের ব্যাখ্যাই বাতিল করে দিলেন।

কিন্তু এটা কেবল একটা কিছু ব্যাখ্যার ব্যাপার ছিল না।

খরা আর প্লেগের মতোন বিপর্যয় আসন্ন হলে মানুষ স্রেফ হাত-পা গুটিয়ে এই আশায় বসে থাকত না যে দেবতারা এ-সবের প্রতিকার করে দেবেন। অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে তাদের নিজেদেরই উদ্যোগ নিতে হতো। এ-কাজটা তারা করত বিভিন্ন ধরনের ধর্মীয় অনুষ্ঠান বা আচারএর মাধ্যমে।

নরওয়ের ইতিহাসের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ধর্মীয় অনুষ্ঠান ছিল নৈবেদ্যদান। কোনো দেবতার উদ্দেশে কোনো নৈবেদ্য দেয়ার মানে ছিল সেই দেবতার শক্তি বৃদ্ধি করা। যেমন ধরো, মানুষকে দেবতাদের উদ্দেশে এই কারণে নৈবেদ্য দিতে হতো যেন তারা নৈরাজ্যের শক্তিগুলোকে জয় করার ক্ষমতা অর্জন করেন। কাজটা তারা করত দেবতাদের উদ্দেশে কোনো জন্তু বলি দিয়ে। থরের উদ্দেশে সাধারণত কোনো ছাগল বলি দেয়া হতো। ওদিন-এর (odin) উদ্দেশে কখনো কখনো নরবলির মাধ্যমে নৈবেদ্য দেয়া হতো।

নর্ডিক দেশগুলোর সবচেয়ে পুরনো পুরাণটি পাওয়া যাবে এডিক কবিতা খ্রম এর গাথা-য় সেই গাথা অনুযায়ী, একদিন থর ঘুম থেকে উঠে দেখতে পান তার হাতুড়িটা চুরি হয়ে গেছে। এ-ঘটনায় তিনি এতটাই রেগে গেলেন যে তার হাত দুটো কাঁপতে লাগল, দাড়ি নড়তে শুরু করল। তখন তিনি তাঁর অনুচর লোকিকে সঙ্গে নিয়ে ফ্রেইয়ার কাছে গেলেন তার ডানা দুটো ধার নিতে, যাতে করে, যারা তাঁর হাতুড়িটা চুরি করেছে লোকি তাদের তত্ত্ব-তালাশ করতে পারে দৈত্যদের দেশ জোটুনহেইমে গিয়ে।

জোটুনহেইমে দৈত্যদের রাজা থ্রমের সঙ্গে দেখা হলো লোকির আর তাকে দেখেই দৈত্যরাজ বড় গলায় বলতে লাগল হাতুড়িটা সে মাটির সাত লীগ গভীরে লুকিয়ে রেখেছে। সে এ-ও বলল যে ফ্রেইয়াকে তার বৌ হিসেবে তার হাতে তুলে দেয়া না হলে দেবতারা হাতুড়িটা ফেরত পাবে না।

অবস্থাটা তুমি বুঝতে পারছ নিশ্চয়ই, সোফি? হঠাৎ করেই দেবতারা দেখতে পেলেন তারা পুরোপুরি একটা পণবন্দি ধরনের ঘটনায় জড়িয়ে পড়েছেন। দেবতাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষামূলক অস্ত্রটি জবরদখল করে ফেলেছে দৈত্যরা। এটা তো কোনো অবস্থাতেই মেনে নেয়া যায় না। থরের হাতুড়ি যতক্ষণ দৈত্যগুলোর কজায় থাকবে, ততক্ষণ দেবতা আর মানুষদের পৃথিবী তারাই নিয়ন্ত্রণ করবে। হাতুড়ির বদলে তারা ফ্রেইয়াকে দাবি করছে। কিন্তু এটাও ঠিক একই রকম অসম্ভব একটা ব্যাপার। যিনি সব ধরনের জীবন রক্ষা করেন সেই উর্বরতার দেবীকে যদি দেবতাদের ত্যাগ করতেই হয় তাহলে তো মাঠ থেকে সব ঘাস উধাও হয়ে যাবে, মরে যাবে দেবতা আর মানুষ সবাই। একটা অচলাবস্থার চুড়ান্ত আর কী।

পুরাণের ভাষ্য অনুযায়ী, লোকি এরপর আসগার্ডে ফিরে এসে ফ্রেইয়াকে বিয়ের পোশাক-আশাক পরে নিতে বলল, কারণ দৈত্যরাজকে বিয়ে করতে হবে তাঁর (হায় কপাল!)। ফ্রেইয়া তো সে-কথা শুনে মহা ক্ষাপ্পা; একটা দৈত্যকে বিয়ে করতে রাজি হলে লোকে বলবে না যে তিনি পুরুষ মানুষের জন্যে পাগল?

দেবতা হেইমদালের মাথায় তখন একটা বুদ্ধি আসে। খোদ থরকে কনে সাজার পরামর্শ দেন তিনি। তাঁর চুলটা উঁচু করে বেঁধে নিলে আর পোষাকের নিচে দুটো পাথর রাখলে তাকে ঠিক মেয়েমানুষের মতোই দেখাবে। বোঝাই যায়, থর খুব একটা খুশি হলেন না পরামর্শটা শুনে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি বুঝতে পারলেন যে একমাত্র এভাবেই তিনি তাঁর হাতুড়িটা ফেরত পেতে পারেন।

 কাজেই শেষমেষ থর নিজেকে কনে সাজানোর অনুমতি দিলেন। তাঁর সখী হিসেবে থাকবে লোকি।

হাল আমলের ভাষায় বলতে গেলে, থর আর লোকি হলো দেবতাদের সন্ত্রাসবিরোধী বাহিনী। তাদের লক্ষ্য হচ্ছে নারীর ছদ্মবেশে দৈত্যদের ডেরায় ফাটল ধরানো আর থরের হাতুড়িটা উদ্ধার করা।

দেবতারা জোটুনহেইমে পৌঁছাতে দৈত্যরা বিয়ের ভোজ তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু ভোজের সময় বর বাবাজী –অর্থাৎ থর –একাই গোটা একটা ষড় আর আটটা স্যামন মাছ সাবড়ে দিলেন। সেই সঙ্গে উদরস্থ করলেন তিন ব্যারেল বিয়ারও। থ্রীম তো একেবারে তাজ্জব। কমান্ডোদের আসল পরিচয় বেরিয়ে যায় আর কী। কিন্তু লোকি চটপট এই বলে ব্যাপারটা সামলে নিল যে জোটুনহেইমে আসার জন্যে ফ্রেইয়া এমনই উদগ্রীব ছিলেন যে এক হপ্তা তিনি কিছুই মুখে তোলেননি।

কনেকে চুমো খেতে ঘোমটা তুলতেই থ্রীম আঁৎকে উঠে দেখতে পায় সে থরের জ্বলন্ত চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে আছে। এবারো লোকি-ই এই বলে পরিস্থিতি সামাল দিল যে কনে বিয়ের চিন্তায় এতোই উত্তেজিত হয়ে ছিলেন যে এক হপ্তা তার ঘুমই হয়নি। তো, থ্রীম এবার হুকুম দিল হাতুড়িটা আনার জন্যে, বিয়ের অনুষ্ঠানের সময় সেটা কনের কোলের ওপর থাকবে।

হাতুড়িটা তাঁকে দেয়া হতেই থর একটা অট্টহাসি হেসে উঠলেন। প্রথমে তিনি সেটা দিয়ে থ্রমকে হত্যা করলেন, তারপর নিকেশ করলেন সমস্ত দৈত্য আর তাদের আত্মীয়-স্বজনদের। আর এভাবেই ভয়ংকর পণবন্দি ঘটনাটার একটা সুখের পরিসমাপ্তি ঘটল। থর –দেবতদের ব্যাটম্যান বা জেমস বন্ড –আবারো পরজিত করলেন দুষ্ট শক্তিকে।

নিছক পুরাণের ব্যাপারটার এখানেই ইতি টানছি, সোফি। কিন্তু এর পেছনের আসল মানেটা কী? স্রেফ বিনোদনের জন্যে এটা তৈরি করা হয়নি। পুরাণ সেই সঙ্গে কিছু একটা ব্যাখ্যা করারও চেষ্টা করে। একটা সম্ভাব্য ব্যাখ্যা এখানে দেয়া হলো:

খরার সময় লোকে বৃষ্টি না হওয়ার একটা কারণ বের করার চেষ্টা করত। তারা ভাবত, দৈত্যরা থরের হাতুড়ি চুরি করে নিল না তো?

হয়ত পুরাণটা বছরের পরিবর্তনশীল ঋতুগুলোকে ব্যাখ্যা করারই একটা চেষ্টা শীতে যে প্রকৃতি মরে যায় তার কারণ হচ্ছে হাতুড়িটা তখন জোটুনহেইমে। কিন্তু বসন্তে তিনি সেটা আবার জিতে নিয়ে আসতে সক্ষম হন। অর্থাৎ, পুরাণ চেষ্টা করত লোকে যা বুঝতে পারত না তার একটা ব্যাখ্যা তাদেরকে দেবার।

কিন্তু পুরাণ যে কেবল একটা ব্যাখ্যাই ছিল তা কিন্তু নয়। লোকে সেই পুরাণের সঙ্গে সম্পর্কিত ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানগুলোও পালন করত। পুরাণের ঘটনাগুলোকে নাটকে রূপ দেবার সময় খরা বা ফসলহানির সময় লোকের প্রতিক্রিয়া কী হতো তা আমরা কল্পনা করে নিতে পারি। হয়ত গ্রামের একটা লোক কনে সাজত –বুকে পাথরের স্তন লাগিয়ে –দৈত্যদের কাছ থেকে হাতুড়িটা আবার চুরি করে নিয়ে আসার জন্যে। এই কাজটির মাধ্যমে লোকে আসলে তাদের মাঠে যাতে ফসল ফলে সেজন্যে বৃষ্টি ঝরানোর একটা পদক্ষেপ নিত। পৃথিবীর অন্যান্য অংশেও এ-রকম অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে যে লোকে ঋতু সংক্রান্ত পুরাণগুলোকে নাট্যরূপ দিচ্ছে যাতে প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াগুলোকে ত্বরান্বিত করা যায়।

এতোক্ষণ আমরা নর্স পুরাণের দিকে সংক্ষিপ্ত দৃষ্টিপাত করলাম মাত্র। কিন্তু থর আর ওদিন, ফ্রেইর আর ফ্রেইয়া, হোডার ও বল্ডার এবং আরো অসংখ্য দেবতা নিয়ে অনেক পুরাণ রয়েছে। এ-ধরনের পৌরাণিক ধারণা সারা বিশ্ব জুড়ে প্রসার লাভ করেছিল। দার্শনিকেরা এসে সেগুলোর অঙ্গবিচ্যুতি ঘটাতে শুরু করলেন।

গ্রীসে প্রথমদিককার দর্শন যখন বিকশিত হচ্ছিল তখন কিন্তু সেখানে পৌরাণিক বিশ্বচিত্র-ও বর্তমান ছিল। গ্রীক দেবতাদের গল্প প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলে আসছিল। গ্রীসের অসংখ্য দেব-দেবীর মধ্যে অল্প কয়েকজনের নাম বলছি তোমাকে, এঁরা হলেন জিউস ও অ্যাপোলো, হেরা ও অ্যাথেনা, ডায়োনিসাস ও অ্যাসক্লেপিয়াস, হেরাক্লেস ও হেফাস্টাস।

গ্রীক পুরাণের বেশিরভাগই হোমার আর হেসিওড লিখে ফেলেছিলেন ৭০০ খ্রিট পূর্বাব্দের দিকে। এটা একটা পুরোপুরি নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি করল। পুরাণের লিখিত রূপ পাওয়া যাওয়াতে তা নিয়ে আলোচনা করা সম্ভব হলো।

একেবারে গোড়ার দিককার দার্শনিকেরা এই কারণে হোমারের পুরাণের সমালোচনা করেছিলেন যে তার দেব-দেবীদের সঙ্গে মানুষের মিল খুব বিেশ এবং তারা মানুষের মতোই অহংসম্পন্ন ও বিশ্বাসঘাতক। এই প্রথমবারে মতো এ-কথা বলা গেল যে পুরাণ মানুষেরই মতামত ছাড়া কিছু নয়।

 এই দৃষ্টিভঙ্গির একজন প্রবক্তা হলেন জেনোফেনেস, যার জন্ম প্রায় ৫৭০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে। তিনি বললেন, মানুষ ঈশ্বরকে তার নিজের প্রতিরূপ হিসেবে সৃষ্টি করেছে। তারা বিশ্বাস করে দেবতারা জন্মগ্রহণ করে এবং তাদের আমাদের মতোই দেহ, কাপড়চোপড় এবং ভাষা রয়েছে। ইথিওপিয়রা বিশ্বাস করে দেবতারা কালো এবং চ্যাপ্টা নাকবিশিষ্ট। থেসিয়দের বিশ্বাস দেবতারা নীল চোখ আর সুন্দর চুলের অধিকারী। ষাঁড়, ঘোড়া আর সিংহরা যদি আঁকতে পারত তাহলে তাদের দেবতারাও ষাঁড়, ঘোড়া আর সিংহের মতোই হতো!

 সেই সময়ে গ্রীকরা গ্রীস এবং গ্রীসের উপনিবেশ দক্ষিণ ইতালি ও এশিয়া মাইনরে বেশ কিছু নগর-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে, সেখানে সমস্ত কায়িক পরিশ্রম করত দাসরা, তাতে করে নাগরিকেরা তাদের সময় ব্যয় করতে পারত রাজনীতি আর সংস্কৃতি নিয়ে।

এই নাগরিক পরিবেশে লোকে পুরোপুরি নতুনভাবে চিন্তা করতে শুরু করল। সমাজ কীভাবে বিন্যস্ত হবে তা নিয়ে পুরোপুরি নিজ দায়িত্বে একজন কে প্রশ্ন তুলতে পারতো। আর এভাবে একজন ব্যক্তি প্রাচীন পুরাণের সাহায্য না নিয়েই জিগ্যেস করতে পারতো নানান সব দার্শনিক প্রশ্ন।

একে আমরা বলি পৌরাণিক ধরনের চিন্তাধারা থেকে অভিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞাভিত্তিক চিন্তাধারার বিকাশ। প্রথমদিককার গ্রীক দার্শনিকদের উদ্দেশ্য ছিল প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াগুলোর প্রাকৃতিক ব্যাখ্যা খুঁজে বের করা, অতিপ্রাকৃত ব্যাখ্যা নয়।

***

গুহা থেকে বেরিয়ে এসে বিশাল বাগানটায় ঘুরে বেড়াতে লাগল সোফি। স্কুলে, বিশেষ করে বিজ্ঞান ক্লাসে সে যা শিখেছে তা ভুলে যাওয়ার চেষ্ট করল।

প্রকৃতি সম্পর্কে আদৌ কিছু না শিখে যদি সে এ-বাগানে বড় হয়ে থাকে তাহলে বসন্তকাল সম্পর্কে তার অনুভূতি কী হবে?।

হঠাৎ করে একদিন কেন বৃষ্টি পড়তে শুরু করল তার একটা ব্যাখ্যা আবিষ্কার করার চেষ্টা করবে নাকি সে? তুষারগুলো কোথায় গেল বা সকালে সূর্য কেন উঠল তার একটা কাল্পনিক ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর চেষ্টা করে দেখবে সে?

হ্যাঁ, আলবাৎ করবে সে। গল্পটা বানাতে শুরু করল সে:

দুষ্ট মুরিয়াট সুন্দরী রাজকন্যা সিকিতাকে ঠাণ্ডা একটা কারাগৃহে বন্দি করে রেখেছিল বলে শীত পৃথিবীকে তার বরফশীতল মুঠোয় ধরে রাখে। কিন্তু একদিন সকালে সাহসী রাজপুত্র ব্র্যাভাটো এসে উদ্ধার করে রাজকন্যাকে। সিকিতা এত খুশি হয় যে অন্ধকার কারাকক্ষে রচনা করা একটা গান গাইতে গাইতে নাচতে শুরু করে তৃণভূমির ওপর। ধরণী এবং গাছেরা সে-গান শুনে এতই অভিভূত হয়ে যায় যে সমস্ত তুষার পরিণত হয় অশ্রুতে। কিন্তু তখনই সূর্য বেরিয়ে এসে সব অশ্রু শুকিয়ে ফেলে। পাখিরা সিকিতার গানটা অনুকরণ করে এবং সুন্দরী রাজকন্যা যখন তার সোনালী চুলের গুচ্ছ মেলে দেয় তখন কয়েকটি অলকচূর্ণ মাটিতে পড়ে রূপান্তরিত হয় মাঠের লিলি ফুলে…।

নিজের সুন্দর গল্পটা বেশ পছন্দ হলো সোফির। পরিবর্তনশীল ঋতুগুলোর ব্যাপারে অন্য আর কোনো ব্যাখ্যা যদি তার মনে না-ও থাকে তাহলে শেষ পর্যন্ত সে যে তার নিজের গল্পটাকেই বিশ্বাস করবে এ-ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে গেল সে।

সোফি উপলব্ধি করল প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াগুলো ব্যাখ্যা করার একটা প্রয়োজনীয়তা মানুষ সব সময়ই অনুভব করেছে। হতে পারে, এ-ধরনের ব্যাখ্যা ছাড়া তারা বাঁচতেই পারতো না। আর তারা এ-সব পুরাণ এমন সময় তৈরি করেছিল যখন বিজ্ঞান নামের কোনো কিছুই ছিল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *