১৩. পোস্ট কার্ড

১৩. পোস্ট কার্ড

…নিজের ওপর আমি এক কঠোর সেন্সরশীপ আরোপ করছি..

বেশ কিছু দিন কেটে গেল, দর্শন শিক্ষকের কাছ থেকে একটি অক্ষরও এসে পৌঁছুল না। আগামীকাল বৃহস্পতিবার ১৭ই মে, নরওয়ের জাতীয় দিবস। স্কুল ১৮ তারিখেও বন্ধ থাকবে। স্কুল শেষে ওরা হেঁটে বাড়ি ফেরার সময় হঠাই জোয়ানা বলে উঠল, চল না, ক্যাম্পিং–এ যাই।

 সোফির প্রথমেই যে-কথাটা মনে হলো তা হচ্ছে বাড়ি ছেড়ে বেশিদিন থাকা। চলবে না। তারপরেও সে বলল, বেশ তো, চল।

ঘণ্টা দুই পর বড়সড় একটা ব্যাকপ্যাক নিয়ে জোয়ানা হাজির হলো সোফির ঘরের দরজায়। সোফিও ততক্ষণে নিজের জিনিস গুছিয়ে নিয়েছে। তাছাড়া, তার একটা তবুও আছে। ওরা দুজনেই বেডরোল, সোয়েটার, গ্রাউন্ডশীট আর ফ্ল্যাশলাইট, বড় সাইজের থার্মোস বাতল আর সেই সঙ্গে যথেষ্ট পরিমাণে পছন্দসই খাবার-দাবার সঙ্গে নিয়েছে।

সোফির মা ওদেরকে কী করতে হবে না হবে তাই নিয়ে কিছু উপদেশ দিলেন পাঁচটার সময় বাড়ি ফিরে। তিনি এ-ও জানতে চাইলেন ক্যাম্পটা ওরা কোথায় বসাবে।

ওরা তাকে বলল গ্রাউস টপ-এ যাওয়ার ইচ্ছে ওদের। ভাগ্য ভালো হলে আগামীকাল সকালে ওরা জংলী হাঁসের মেটিং কলও শুনতে পারে। বিশেষ করে এই জায়গাটা বেছে নেবার পেছনে অবশ্য সোফির অন্য একটা উদ্দেশ্য আছে। গ্রাউস টপ-টা মেজরের কেবিনের বেশ কাছে বলেই সে জানে। ওখানে ফিরে যাওয়ার জন্যে একটা তাড়া অনুভব করছে সে, কিন্তু একা যেতে সাহস হচ্ছিল না তার।

 সোফিদের বাগানের গেটটার ঠিক পরেই কানাগলিটা থেকে যে পথটা বেরিয়ে গেছে সেটা ধরে হেঁটে চলল মেয়ে দুটি। এটা-ওটা নিয়ে আলাপ করছিল দুজনে আর দর্শন সম্পর্কিত সমস্ত কিছুর হাত থেকে কিছু সময়ের জন্যে একটা ছুটি পেয়ে সোফিরও বেশ ভাল লাগছিল।

আটটার মধ্যেই ওরা গ্রাউস টপের একটা ফাঁকা জায়গায় তাঁবু বসিয়ে ফেলল। রাতের জন্যে প্রস্তুতি নিয়ে ফেলল ওরা। বিছিয়ে ফেলল বেডরোলগুলো। ওরা যখন স্যান্ডউইচ খাওয়া শেষ করেছে এমন সময় সোফি জিগ্যেস করল, তুই মেজরের কেবিনের কথা শুনেছিস কখনো?

মেজরের কেবিন? ‘এখান থেকে কাছেই একটা জায়গায় কুঁড়েঘর আছে একটা…ছোট্ট একটা লেকের পাশে। অদ্ভুত একটা লোক, এক মেজর থাকত সেখানে, সেজন্যেই নাম। মেজরের কেবিন।

এখন কি কেউ থাকে ওখানে?

গিয়ে দেখবি নাকি?

কোথায় ওটা?

গাছগুলোর দিকে তর্জনী তাক করল সোফি।

জোয়ানার খুব একটা উৎসাহ নেই, কিন্তু শেষ পর্যন্ত রওনা হলো দুজনে। আকাশে সূর্য তখন অনেকটা নেমে এসেছে।

প্রথমে উঁচু উঁচু পাইন গাছের ভেতর দিয়ে এগোলেও কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা গেল ঘন ঝোঁপ-ঝাড়-এর ভেতর দিয়ে পথ করে হেঁটে চলেছে ওরা। শেষ পর্যন্ত একটা পথ ধরে চলতে লাগল দুজন। এটাই কি সেই পথ রোববার যেটা ধরে গিয়েছিল সোফি?

নিশ্চয়ই তাই প্রায় সেই মুহূর্তেই পথটার ডান দিকে গাছগুলোর ভেতর দিয়ে চকচকে একটা জিনিস দেখতে পেল সে।

ওখানেই ওটা, সে বলল।

একটু পরেই দুজনে ছোট্ট লেকটার পাশে এসে দাঁড়াল। লেকের ওপারে কেবিনটার দিকে তাকিয়ে রইল সোফি। সব কটা জানলা বন্ধ এখন। লাল বাড়িটার মতো এমন নির্জন জায়গা সে বহুদিন দেখেনি।

সোফির দিকে তাকাল জোয়ানা। পানির ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে হবে নাকি আমাদের?

কী যে বলিস। নৌকা বেয়ে ওপারে যাবো আমরা।

 নলখাগড়ার ঝোপের দিকে দেখাল সোফি। নৌকোটা ওখানেই আছে ঠিক আগের মতো।

আগে কখনো ওখানে গিয়েছিস নাকি?

মাথা নাড়ল সোফি। তার আগের সফরটার কথা ব্যাখ্যা করে বোঝানো সহজ হবে না। এবং তখন তার বান্ধবীকে অ্যালবার্টো নক্স আর দর্শন কোর্সটার কথাও বলে দিতে হবে।

 নৌকো বেয়ে ওপারে যেতে যেতে হাসি ঠাট্টায় মেতে উঠল দুজনে। ওপারে পৌঁছে সোফি নৌকাটাকে পুরোপুরি ডাঙায় টেনে তুলতে ভুল করল না।

সামনের দরজাটার কাছে পৌঁছল দুজনে। যখন পরিষ্কার বোঝা গেল ভেতরে কেউ নেই, জোয়ানা হাতলটা ঘোরাবার চেষ্টা করল।

তালা মারা … তুই নিশ্চয়ই ভাবিসনি খোলা থাকবে ওটা?

হয়ত চাবি-টাবি কিছু একটা পেয়ে যাবো, সোফি বলল।

পাথরের ফাউন্ডেশনটার ফাঁক-ফোকরে খুঁজে দেখতে শুরু করল সে।

তারচেয়ে বরং চল তাঁবুতেই ফিরে যাই, কয়েক মিনিট পর জোয়ানা বলল।

কিন্তু ঠিক তখনই চেঁচিয়ে উঠল সোফি। এই যে! পেয়েছি।

বিজয়ীর ভঙ্গিতে চাবিটা উঁচু করে ধরল সে। তারপর ওটা তালার ফুটোতে ঢোকাল, দরজা খুলে গেল।

দুই বন্ধু এমনভাবে চুপিসারে ঘরের ভেতর ঢুকল যেন কোনো মন্দ উদ্দেশ্য আছে ওদের। কেবিনের ভেতরটা ঠাণ্ডা, অন্ধকার।

কিছুই তো দেখতে পাচ্ছি না রে! জোয়ানা বলে উঠল।

কিন্তু সোফি সে-কথা ভেবে রেখেছিল। পকেট থেকে সে দেশলাইয়ের বাক্স বের করে একটা কাঠি ধরাল। কাঠিটা নিভে যাওয়ার আগে ওরা কেবল এইটুকু দেখতে পেল যে কেবিনটা ফাঁকা। আরেকটা কাঠি ধরাল সোফি, এবার সে দেখতে পেল স্টোভের ওপর রট আয়রনের একটা মোমদানির ওপর একটা মোমবাতির অবশিষ্টাংশ দাঁড়িয়ে আছে। তৃতীয় কাঠিটা দিয়ে ওটা ধরাল সে, তাতে চারদিকে দেখতে পাওয়ার মতো যথেষ্ট আলোকিত হয়ে উঠল ছোট্ট ঘরটা।

ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত না যে এতো ছোট্ট একটা মোমবাতি এতোখানি অন্ধকার দূর করতে পারে? সোফি বলে উঠল।

মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিল তার বন্ধু।

কিন্তু একটা জায়গায় গিয়ে আলোটা অন্ধকারে হারিয়ে যায়, বলে চলে সোফি। আসলে অন্ধকারের নিজের কোনো অস্তিত্ব নেই। আলোর অভাবই হলো অন্ধকার।

কেঁপে উঠল জোয়ানা। আমার গা শিরশির করছে, চল, চলে যাই।

তার আগে আয়নাটায় একবার তাকাতে হবে।

 পেতলের ফ্রেমের আয়নাটা চেস্ট অভ ড্রয়ার্স-এর ওপর আগের মতোই ঝুলছে।

খুব সুন্দর তো! জোয়ানা বলে উঠল।

এটা কিন্তু জাদুর আয়না।

মিরর মিরর অন দ্য ওয়াল, হু ইজ দ্য ফেয়ারেস্ট অভ দেম অল?

 আমি ঠাট্টা করছি না, জোয়ানা। আয়নাটায় তাকালে তুই নিজেই দেখতে পাবি।

সত্যি করে বলতো, আসলেই কি তুই আগে আসিসনি এখানে? তাছাড়া সব সময় আমাকে ভয় দেখিয়ে কী মজা পাস বলতো?

এবার কোনো জবাব দিতে পারল না সোফি।

 সরি।

এরপর হঠাৎ করে জোয়ানা-ই আবিষ্কার করল ঘরের এক কোণায় কী যেন পড়ে আছে মেঝেতে। জিনিসটা একটা ছোট্ট বাক্স। জোয়ানা সেটা হাতে তুলে নিল।

পোস্টকার্ড সব। বলল সে।

 মুখটা হাঁ হয়ে গেল সোফির।

ধরিস না ওগুলো! শুনতে পাচ্ছিস-ধরিস না যেন তুই ওগুলো?

লাফ দিয়ে উঠল জোয়ানা। এমনভাবে বাক্সটা ফেলে দিল সে যেন আগুনের ছ্যাকা লেগেছে তার হাতে। পোস্টকার্ডগুলো ছড়িয়ে পড়ল সারা মেঝে জুড়ে। পরের মুহূর্তেই হাসতে শুরু করল সে।

নেহাতই পোস্টকার্ড এগুলো।

মেঝেতে বসে পড়ে সেগুলো তুলে ফেলতে লাগল জোয়ানা। খানিক পর সোফি ও এসে বসল তার পাশে।

লেবানন… লেবানন… সবগুলোতেই দেখছি লেবাননের পোস্টমার্ক দেয়া, জোয়ানা আবিষ্কার করল।

আমি জানি, বলল সোফি।

নিমেষে শিরদাঁড়া সোজা করে বসে সরাসরি সোফির চোখের দিকে তাকাল জোয়ানা।

তাহলে এর আগেও এসেছিস তুই এখানে!

হ্যাঁ, এসেছি।

হঠাৎ করেই তার মনে হলো সে যদি আগেই স্বীকার করতে যে এর আগেও সে এখানে এসেছে তাতেই বরং ব্যাপারটা অনেক সহজ হতো। গত কিছুদিন ধরে সে যে-সব রহস্যময় অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে সে-কথা তার বন্ধুকে বললে নিশ্চয়ই মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেতো না।

এখানে আসার আগে আসলে কথাটা বলতে চাইনি তোকে।

 কার্ডগুলো পড়তে শুরু করল জোয়ানা।

সবগুলোই হিল্ডা মোলার ন্যাগ নামের কাউকে লেখা।

কার্ডগুলো এখনো ছোয়নি সোফি।

ঠিকানা কী লেখা?

জোয়ানা পড়ে শোনাল: হিল্ডা মোলার ন্যাগ, প্রযত্নে অ্যালবার্টো নক্স, লিলেস্যান্ড, নরওয়ে।

স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস ফেলল সোফি। সে ভয় পেয়েছিল ওগুলোতে প্রযত্নে সোফি অ্যামুন্ডসেন লেখা থাকবে।

আরো ভালো করে কার্ডগুলো পরীক্ষা করতে শুরু করল সে।

২৮ শে এপ্রিল…৪ঠা মে…৬ই মে…৯ই মে…কয়েকদিন আগের পোস্টমার্ক।

 কিন্তু এ-ছাড়াও আরেকটা জিনিস আছে। সব কটা পোস্টমার্কই নরওয়ের! এই দ্যাখ…ইউএন ব্যাটেলিয়ন…ডাকটিকেটগুলোও নরওয়ের।

আমার মনে হয় এটাই ওদের রীতি। এক ধরনের নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে হয় ওদেরকে, কাজেই ওদের সঙ্গেই নরওয়ের পোস্ট অফিস রেখেছে ওরা।

কিন্তু চিঠিগুলো ওরা বাড়ি পাঠায় কী করে?

এয়ার ফোর্সের মাধ্যমে, সম্ভবত।

মোমদানিটা মেঝের ওপর রাখল সোফি, তারপর দুই বন্ধু মিলে পড়তে শুরু করল কার্ডগুলো। জোয়ানা সেগুলোকে তারিখ অনুযায়ী সাজাল, তারপর পড়তে লাগল প্রথম কার্ডটা:

প্রিয় হিল্ডা, লিলেস্যান্ড ফেরার জন্যে আমি আর অপেক্ষা করতে পারছি না। আশা করছি মিডসামার ঈ-এর দিন খুব সকালে কিয়েভিক-এ ল্যান্ড করবো। তোর ১৫শ জন্মদিন উপলক্ষে আমি ঠিক সময় মতোই পৌঁছুতে পারতাম, কিন্তু বুঝিসই তো, আমি সামরিক বাহিনীর অধীনে আছি। তবে ক্ষতিপূরণ হিসেবে, তুই যাতে তোর জন্মদিন উপলক্ষে একগাদা উপহার পাস সেদিকে আমার সমস্ত সহে মনোযোগ থাকবে।

ভালোবাসা নিস আর জানবি তোর ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি সব সময়ই ভাবি।

পুনশ্চঃ এই কার্ডের একটা কপি এমন একজনের কাছে পাঠাচ্ছি যে আমাদের দুজনেরই বন্ধু। আমার ধারণা, ব্যাপার তুই বুঝতে পারবি, হিল্ডা। এই মুহূর্তে আমাকে খুব গোপনীয়তা বজায় রাখতে হচ্ছে। আশা করি কারণটা তুই বুঝতে পারবি।

পরের কার্ডটা তুলে নিল সোফি:

প্রিয় হিল্ডা, এখানে আমরা একদিন করে এগোই। লেবাননে কাটানো আমার এই দিনগুলোর যে-স্মৃতিটা আমার মনে থেকে যাবে তা হলো এই অপেক্ষার ব্যাপারটা। আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করছি যাতে তোর ১৫শ জন্মদিনটা তুই যদূর সম্ভব ভালোভাবে পালন করতে পারিস। আপাতত এর চেয়ে বেশি কিছু আর বলা সম্ভব হচ্ছে না আমার পক্ষে। নিজের ওপর আমি এক কঠোর সেন্সরশীপ আরোপ করছি। ভালোবাসা নিস, বাবা।

উত্তেজনায় দুই বন্ধুর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো। দুজনের কারো মুখেই কোনো কথা নেই, তারা শুধু পড়ে যাচ্ছে কার্ডগুলোতে কী লেখা আছে:

মা-মণি আমার, এখন আমার ভীষণ ইচ্ছে হচ্ছে নিজের গোপন চিন্তাগুলো একটা সাদা ঘুঘু পাখিকে দিয়ে তোর কাছে পাঠিয়ে দিতে। কিন্তু লেবাননে এখন সাদা ঘুঘুর খুব অভাব। এই যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশে এখন যদি কোনো কিছুর প্রয়োজন থাকে তা এই সাদা ঘুঘু পাখির। আশা করি, কোনো একদিন জাতিসংঘ পৃথিবীতে সত্যি সত্যিই শান্তি আনতে পারবে।

তোর জন্মদিনের উপহারটা আশা করি তুই অন্যদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারবি। আমি বাড়ি ফিরলে পর এ-নিয়ে কথা বলা যাবে। কিন্তু তুই নিশ্চয়ই এখনো বুঝতে পারিসনি আমি কী নিয়ে কথা বলছি, ঠিক কি না? ভালোবাসা নিস, এ-কথা জানিস যে আমাদের দুজনের কথা ভাববার যথেষ্ট অবসর আছে আমার।

ছয়টা কার্ড পড়ার পর আর একটা বাকি রইল।

প্রিয় হিল্ডা, তোর জন্মদিনের এ-সব গোপন ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে ভেতরে ভেতরে আমি এখন এমন টগবগ করে ফুটছি যে খানিক পর পরই নিজেকে আমার সামলে নিতে হচ্ছে বাড়িতে ফোন করে সব কিছু ফাঁস করে দেয়া থেকে। জিনিসটা এমন যে দিনে দিনে সেটা বেড়ে চলেছে। আর তুই তো জানিস যে কোনো কিছু যদি ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে তখন সেটাকে নিজের মধ্যে চেপে রাখা মুশকিল। বাবার ভালোবাসা নিস।

পুনশ্চ: সোফি নামের একটা মেয়ের সঙ্গে একদিন দেখা হবে তোর। তার আগে তোরা যাতে একে অন্যকে আরো ভালোভাবে জানতে পারিস সেজন্যে তোকে পাঠানো সব কটা কার্ডের একটা কপি আমি ওকেও পাঠাতে শুরু করেছি। আশা করছি শিগগিরই মেয়েটা সব বুঝে উঠতে পারবে। আপাতত সে তোর চেয়ে বেশি কিছু জানে না। মেয়েটার এক বন্ধু আছে, জোয়ানা নাম। সে কি কোনো সাহায্য করতে পারবে?

শেষ কার্ডটা পড়া হয়ে যাওয়ার পর জোয়ানা আর সোফি ছানাবড়া চোখে একে অন্যের দিকে তাকিয়ে স্থির হয়ে বসে রইল। শক্ত মুঠিতে সোফির কব্জিটা ধরে থাকল জোয়ানা।

আমার ভয় লাগছে, সে বলল।

আমারও।

শেষ কার্ডটায় কত তারিখের পোস্টমার্ক দেয়া?

ফের কার্ডটার দিকে তাকাল সোফি।

 ষোলই মে, বলল সে, তার মানে আজকে।

হতেই পারে না। একরকম রেগেই চেঁচিয়ে উঠল জোয়ানা।

ভালো করে ডাকঘরের সীলমোহরটা পরীক্ষা করে দেখল দুজনে, কিন্তু কোনো ভুল ধরা পড়ল না…১৬.০৫.৯০।

এ-অসম্ভব, জোর গলায় বলল জোয়ানা। তাছাড়া আমি ভাবতেও পারছি না কে এমন চিঠি লিখতে পারে। নিশ্চয়ই এমন কেউ যে আমাদের দুজনকেই চেনে। কিন্তু সে কী করে জানল যে আজকেই আমরা এখানে আসবো?

দুজনের মধ্যে জোয়ানাই ভয় পেয়েছে অনেক বেশি। হিল্ডা আর তার বাবার মধ্যেকার এই ব্যাপার-স্যাপার সোফির কাছে নতুন কিছু নয়।

আমার মনে হয় পেতলের আয়নাটার কোনো সম্পর্ক রয়েছে এর সঙ্গে।

আবারো লাফ দিয়ে উঠল জোয়ানা।

তুই নিশ্চয়ই এ-কথা ভাবছিস না যে কার্ডগুলোতে লেবাননে সীলমোহর মারার সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো আয়নাটা থেকে ঝরে পড়েছে?

তোর কাছে কি এর চেয়ে ভালো কোনো ব্যাখ্যা আছে?

তা অবশ্য নেই।

সোফি উঠে দাঁড়িয়ে দেয়ালে টাঙানো পোর্ট্রেট দুটোর সামনে গিয়ে ধরল মোমবাতিটা। জোয়ানাও এসে দাঁড়াল তার পাশে, তাকাল ছবি দুটোর দিকে।

বার্কলে আর বিয়ার্কলে। এর অর্থ কী?

আমার কোনো ধারণা নেই।

মোমবাতিটা পুড়ে পুড়ে প্রায় শেষ হয়ে এসেছে।

চল যাই, বলে উঠল জোয়ানা, আয় না!

আয়নাটা নিতে হবে আমাদের সঙ্গে।

সোফি হাত বাড়িয়ে দিয়ে পেতলের ফ্রেমে বাঁধানো আয়নাটা চেস্ট অভ ডুয়ার্সের ওপর থেকে খুলে নিল। জোয়ানা ওকে থামানোর চেষ্টা করল, কিন্ত সোফিকে রোখা গেল না।

ওরা যখন বেরিয়ে এলো বাইরে তখন অন্ধকার, মে-মাসের রাতগুলো যে-রকম অন্ধকার হয়। আকাশে তখনো যতটুকু আলো তাতে ঝোঁপ-ঝাড় আর গাছগুলোর কাঠামোটা দেখা যাচ্ছে। ছোট্ট লেকটাকে দেখে মনে হচ্ছে ওপরের আকাশটারই। প্রতিবিম্ব। মেয়ে দুটো গম্ভীর মুখে বৈঠা বেয়ে অপর পারে চলে এলো।

তাবুতে ফেরার পথে দুজনের কেউই কথা বলল না খুব একটা। যদিও প্রত্যেকেই বুঝতে পারছিল যে যা ঘটে গেছে তা নিয়ে অন্যজনের মনে চিন্তার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। থেকে থেকেই শোনা যাচ্ছে ভয়ার্ত কোনো পাখির চিৎকার, তাছাড়া বার দুয়েক ওরা পেঁচার ডাকও শুনতে পেল।

তাঁবুতে পৌঁছেই যার যার বেডরোলের ভেতর ঢুকে পড়ল দুজন। আয়নাটা ভেতরে ঢোকাতে দেয়নি জোয়ানা। ঘুমিয়ে পড়ার আগে ওরা দুজনেই এ-ব্যাপারে একমত হলো যে আয়নাটা যে তাঁবুর ফ্ল্যাপের বাইরে পড়ে আছে সেটা জানা-ই বুকে কাঁপন ধরানোর জন্য যথেষ্ট। সোফি অবশ্য পোস্টকার্ডগুলো-ও নিয়ে তার ব্যাকপ্যাকের একটা পকেটে ভরে রেখেছিল।

পরদিন খুব সকালে ঘুম ভাঙল ওদের। সোফি-ই উঠল প্রথম। বুটজোড়া পরে তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে এলো সে। বিরাট আয়নাটা ঘাসের ওপর পড়ে আছে শিশিরস্নাত হয়ে।

 সোফি নিজের সোয়েটারটা দিয়ে শিশিরকণাগুলো মুছে নিচু হয়ে নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকাল। ব্যাপারটা যেন সে একই সঙ্গে নিচে এবং ওপর দিকে তার নিজের দিকেই তাকিয়ে আছে। ওর সৌভাগ্যই বলতে হবে, এই ভোরবেলাতে লেবানন থেকে আসা কোনো পোস্টকার্ড দেখতে পেল না সে।

 তাঁবুর পেছনের পরিষ্কার ফাঁকা জায়গাটায় ভোরবেলার ছেঁড়াফাড়া কুয়াশা ছোট ছোট তুলোর দলামতন হয়ে ধীরে ধীরে ভেসে বেড়াচ্ছে। ছোট ছোট পাখির তীব্র কিচিরমিচির শোনা যাচ্ছে, কিন্তু সোফি কোনো জংলী হাঁসের দেখাও পেল না, ডাকও শুনতে পেল না।

মেয়ে দুটো বাড়তি একটা সোয়েটার চাপিয়ে নিল গায়ে। তারপর তাঁবুর বাইরে বসে ব্রেকফাস্ট সারল। কিছুক্ষণের মধ্যেই মেজরের কেবিন আর রহস্যময় কার্ড-এর দিকে মোড় নিল তাদের আলাপ।

ব্রেকফাস্টের পর তাঁবুটা গুটিয়ে নিয়ে বাড়ির দিকে রওয়ানা হলো ওরা। বিশাল আয়নাটা সোফি তার বাহুর নিচে চেপে ধরে হেঁটে চলল। একটু পর পরই জিরিয়ে নিতে হচ্ছিল তাকে, জোয়ানা আয়নাটা ছুঁতেই চাইল না।

শহরের প্রান্তসীমানায় পৌঁছাতে বিক্ষিপ্ত গুলির শব্দ কানে এলো ওদের। যুদ্ধ বিধ্বস্ত লেবানন সম্পর্কে হিল্ডার বাবা কী লিখেছেন সে-কথা মনে পড়ে গেল সোফির। এবং একটা শান্তিপূর্ণ দেশে জন্ম নেয়ার জন্যে নিজেকে ভীষণ সৌভাগ্যবান মনে হলো তার। ওরা যে গুলি-র শব্দ শুনেছে সেটা জাতীয় দিবস উদযাপনের জন্যে নির্দোষ আতশবাজির।

 সোফি এক কাপ গরম চকোলেট খেয়ে যেতে আমন্ত্রণ জানাল জোয়ানাকে।

আয়নাটা ওরা কোথায় পেল তা জানার জন্যে ভীষণ কৌতূহলী হয়ে উঠলেন সোফির মা। সোফি তাকে বলল মেজরের কেবিনের বাইরে ওটা পেয়েছে ওরা। বহু বছর ধরে যে ওখানে কেউ থাকে না সে-গল্পটা তখন ওদেরকে ফের বললেন সোফির মা।

জোয়ানা চলে যাওয়ার পর সোফি লাল একটা পোশাক পরল। নরওয়ের জাতীয় দিবসের বাকি সময়টা স্বাভাবিকভাবেই কেটে গেল। লেবাননে জাতিসংঘের নরওয়েজিয় বাহিনী কী করে দিনটি পালন করল তাই নিয়ে সন্ধ্যায় টিভির খবরে একটা ফিচার দেখাল। সোফির চোখ আঠার মতো সেঁটে রইল টিভির পর্দায়। যাদেরকে সে দেখতে পাচ্ছে তাদের মধ্যে কোনো একজন হয়ত হিল্ডার বাবা।

১৭ই মে সোফি শেষ যে-কাজটা করল তা হলো বিশাল আয়নাটা সে তার ঘরের দেয়ালে টাঙিয়ে দিল। পরদিন সকালে নতুন একটা বাদামি খাম পেল সে গুহায়। সঙ্গে সঙ্গে সেটার মুখ ছিঁড়ে পড়তে শুরু করল সে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *