২৫. কান্ট

২৫. কান্ট

…আমার ওপরের তারা আকাশ আর আমার ভেতরের নৈতিক নিয়ম…

হিল্ডাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে প্রায় মাঝরাতে বাড়িতে ফোন করলেন মেজর অ্যালবার্টো ন্যাগ। হিল্ডার মা ধরলেন ফোনটা।

তোর ফোন, হিল্ডা!

হ্যালো?

 বাবা বলছি।

তোমার কি মাথা খারাপ। এখন প্রায় মাঝরাত।

আমি স্রেফ তোকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে চেয়েছিলাম।

তা তো তুমি দিনই করছ।

…কিন্তু আমি ঠিক দিন শেষ হওয়ার আগে ফোন করতে চাইনি।

 কেন?

তুই আমার উপহারটা পাসনি?

হ্যাঁ, পেয়েছি তো। অনেক ধন্যবাদ তোমাকে, বাবা।

 ওটা তোর কেমন লাগল জানার জন্যে অস্থির হয়ে আছি আমি।

 দারুণ। এত্তো এক্সসাইটিং যে আজ সারাদিন আমি কিছু খাইনি বললেই চলে।

তুই কদ্দূর গেছিস সেটা জানতে হবে আমাকে।

একটা সামুদ্রিক সাপ দিয়ে তুমি ওদের জ্বালাতন করাতে ওরা এই মাত্র মেজরের কেবিনে ঢুকে পড়ল।

আলোকপ্রাপ্তি।

আর অলিম্পে ডি গগস্।

তার মানে পুরোপুরি ভুল হয়নি।

কীসের ভুল?

 আমার মনে হয় জন্মদিনের আরো একটা শুভেচ্ছা এখনো বাকি আছে। তবে সেটা সঙ্গীত সহযোগে।

ঘুমোত যাওয়ার আগে আমি বরং আরেকটু পড়ে নিই।

তুই তাহলে পড়ছিস এখনো।

এই একদিনে যা শিখেছি তা এতোদিনে শিখিনি আমি। আমার এখনো বিশ্বাসই হচ্ছে না যে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে সোফি প্রথম খামটা পাওয়ার পর চব্বিশ ঘণ্টাও পেরোয়নি।

ব্যাপারটা খুব অদ্ভুত যে পড়তে কত কম সময় লাগে।

তবে আমার কিন্তু খুব দুঃখ হচ্ছে বেচারীর জন্যে।

কার জন্যে? তোর মা-র?

না, না, সোফির জন্যে।

কেন বলতো?

বেচারী একেবারে কনফিউজড হয়ে পড়েছে।

 কিন্তু ও তো স্রেফ…

কল্পনা, এই তো বলবে?

 হ্যাঁ, ও-রকমই তো খানিকটা।

আমার কী মনে হয় জানো, সোফি আর অ্যালবার্টো দুজনই বাস্তব।

 আমি বাড়ি ফিরি, তখন এ-নিয়ে আরো কথা হবে।

ঠিক আছে।

হ্যাভ আ নাইস ডে।

কী?

আই মিন, গুড নাইট।

গুড নাইট।

আধ ঘণ্টা পর হিল্ডা যখন বিছানায় গেল তখন এতো আলো চারদিকে যে বাগান আর ছোট্ট উপসাগরটা দিব্যি দেখতে পাচ্ছিল সে। বছরের এই সময়টাতে আসলে কখনোই পুরোপুরি অন্ধকার হয় না।

বনের ভেতরের ছোট্ট কেবিনের দেয়ালে ঝুলে থাকা ছবির ভেতর রয়েছে সে, এই চিন্তাটা খানিকক্ষ খেলে বেড়াল হিল্ডার মনে। সে ভাবল ছবির ভেতর থেকে মাথা বাড়িয়ে উঁকি মেরে সেটার চারদিকে কী আছে তা দেখে নেয়া যায় কিনা।

ঘুমিয়ে পড়ার আগে বিশাল রিং বাইন্ডারটার আরো কিছু পাতা পড়ে ফেলল সে।

.

হিল্ডার বাবার চিঠিটা আবার ম্যান্টেল-এর ওপর রেখে দিল সোফি।

জাতিসংঘ সম্পর্কে সে যা বলেছে সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয় তা বলছি না, অ্যালবার্টো বললেন। তবে আমার উপস্থাপনার মধ্যে তার নাক গলানোটা পছন্দ নয় আমার।

আমার মনে হয় এ নিয়ে আপনার বেশি চিন্তা করা উচিত হবে না।

তারপরেও, এখন থেকে আমি এ-সব সামুদ্রিক সাপ বা এ-রকম অন্য কোনো ঘটনা গ্রাহ্যের মধ্যে আনব না বলে ঠিক করেছি। চলো, এই জানলার পাশে বসে আমরা কান্টের কথা আলাপ করি।

সোফি খেয়াল করল দুই আর্ম চেয়ারের মাঝখানের ছোট্ট টেবিলটার ওপর এক জোড়া চশমা রাখা আছে। সে আরো খেয়াল করল, ওটার লেন্স লাল রঙের।

হয়ত খুব শক্তিশালী চশমা…

 প্রায় দুটো বাজে এখন। পাঁচটার মধ্যে বাড়ি ফিরতে হবে আমাকে। আমার জন্মদিন নিয়ে মায়ের বোধকরি কিছু প্ল্যান আছে।

তার মানে হাতে তিন ঘণ্টা সময় আছে আমাদের।

তাহলে শুরু করা যাক।

ইমানুয়েল কান্ট-এর (Immanuel Kant) জন্ম ১৭২৮ খ্রিস্টাব্দে, পূর্ব প্রুশিয়া-র ছোট্ট শহর কনিসবার্গ-এ। তাঁর বাবা ছিলেন ঘোড়র জিন প্রস্তুতকারী হিসেবে খুবই দক্ষ। আশি বছর বয়েসে মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত কান্ট কনিসবার্গ শহরেই বাস করেছেন প্রায় সারা জীবন। অত্যন্ত ধার্মিক ছিলেন তাঁর পরিবারের লোকজন আর কান্টের নিজের ধর্মীয় বিশ্বাস তার দর্শনের ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল। বার্কলের মতো তিনিও খ্রিস্টিয় বিশ্বাসের ভিত্তিমূল সংরক্ষণ করাকে অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করতেন।

বার্কলে সম্পর্কে মেলা কথা শুনেছি আমি, ধন্যবাদ।

বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন পড়িয়েছেন এ-রকম যে-কজন দার্শনিকের কথা আমরা জানি, কান্ট তাঁদের মধ্যে প্রথম দর্শনের অধ্যাপক ছিলেন তিনি।

অধ্যাপক?

জগতে দুধরনের দার্শনিক আছেন। প্রথমত আছেন তারা যারা তাদের নিজেদের দর্শনগত প্রশ্নের নিজস্ব উত্তর খোঁজেন আর অন্যদিকে আরেক ধরনের দার্শনিক আছেন যারা দর্শনের ইতিহাস সম্পর্কে পণ্ডিত হলেও আবশ্যিকভাবে নিজের কোনো দর্শন সৃষ্টি করেন না।

তা, কান্ট কোন দলের ছিলেন?

কান্ট ছিলেন দুদলেরই। তিনি যদি কেবল একজন তুখোড় অধ্যাপক আর অন্যান্য দার্শনিকের দর্শন সম্পর্কে পণ্ডিত হতেন তাহলে তিনি কখনোই দর্শনের ইতিহাসে নিজের জায়গা করে নিতে পারতেন না। তবে এ-কথাটা মনে রাখা জরুরি যে অতীতের দার্শনিক ঐতিহ্য সম্পর্কে অত্যন্ত শক্ত একটা ভিতের অধিকারী ছিলেন কান্ট। দেকার্ত আর স্পিনোজার বুদ্ধিবাদ, অন্যদিকে লক, বার্কলে আর হিউমের অভিজ্ঞতাবাদ, এই দুই সম্পর্কেই ভালোভাবে ওয়াকিবহাল ছিলেন তিনি।

বার্কলের কথা বার বার বলতে মানা করেছি আমি আপনাকে।

এ-কথাটা মনে রাখবে যে বুদ্ধিবাদীরা বিশ্বাস করতেন মানুষের সমস্ত জ্ঞানের ভিত্তি হচ্ছে মনের মধ্যে। আর অভিজ্ঞতাবাদীরা মনে করতেন জাগতিক সমস্ত জ্ঞান আসে ইন্দ্রিয়গুলো থেকে। তাছাড়া, হিউম দেখিয়েছেন যে আমাদের ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষণের সাহায্যে আমরা কোন কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে পারি সে-ব্যাপারে স্পষ্ট সীমারেখা রয়েছে।

তা, কান্ট কাদের সঙ্গে একমত প্রকাশ করেছেন?

তাঁর ধারণা, দুটো দৃষ্টিভঙ্গিই আংশিক সঠিক, কিন্তু সেই সঙ্গে তিনি এ-ও মনে করতেন যে দুদলই কিছুটা ভুল করেছেন। প্রত্যেকেই যে-প্রশ্নটি নিয়ে চিন্তিত ছিলেন তা হচ্ছে জগতের কী কী জিনিস আমরা জানতে পারি। দেকার্তের পর থেকে সমস্ত দার্শনিকই ব্যস্ত ছিলেন এই দার্শনিক প্রকল্পটি নিয়ে। দুটো প্রধান সম্ভাবনার কথা ভাবা হলো: হয় জগতটা ঠিক সে-রকমই যেভাবে আমরা সেটাকে প্রত্যক্ষ করি আর নয়ত আমাদের প্রজ্ঞার কাছে সেটাকে যেমন বলে বোধ হয় সেটা ঠিক তেমন।

আর কান্ট কী মনে করতেন?

কান্ট মনে করতেন জগৎ সম্পর্কে আমাদের ধারণায় প্রত্যক্ষণ (sensing) আর প্রজ্ঞা দুটোরই ভূমিকা আছে। কিন্তু তিনি মনে করতেন এ-ব্যাপারে প্রজ্ঞা কতটুকু অবদান রাখতে পারে সে-সম্পর্কে বুদ্ধিবাদীরা বড্ড বেশি উচ্চ ধারণা পোষণ করতেন। আবার, সেই সঙ্গে তিনি এ-ও মনে করতেন যে, অভিজ্ঞতাবাদীরা ইন্দ্রিয়গত অভিজ্ঞতার ওপর বড্ড বেশি গুরুত্ব আরোপ করে ফেলেছেন।

শিগগিরই একটা উদাহরণ না দিলে এগুলো স্রেফ কথার ফুলঝুরি হয়েই থাকবে আমার কাছে।

গোড়াতে কান্ট হিউম আর অভিজ্ঞতাবাদীদের সঙ্গে একমত প্রকাশ করেছেন যে জগত সম্পর্কে আমাদের যাবতীয় জ্ঞানের উৎস হচ্ছে আমাদের ইন্দ্রিয় সংবেদন। কিন্তু– আর এইখানে এসে কান্ট তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন বুদ্ধিবাদীদের দিকে– আমাদের প্রজ্ঞাতে কিছু নিস্পত্তিমূলক উপাদান-ও (decisive factor) রয়েছে যা নির্ধারণ করে দেয় আমরা আমাদের চারপাশের জগষ্টাকে কীভাবে প্রত্যক্ষ করবো। অন্য কথায় বলতে গেলে, মানুষের মনে বিশেষ কিছু প্রতিবেশ (condition) রয়েছে যা জগৎ সম্পর্কে আমাদের ধারণা তৈরি হতে সাহায্য করে।

এটাকে আপনি উদাহরণ বলছেন?

চলো, ছোট্ট একটা পরীক্ষা করা যাক। টেবিলের ওপর থেকে ঐ চশমা জোড়া নিয়ে আসবে একটু? ধন্যবাদ। এবার পরো ওটা।

চশমাটা পরল সোফি, তার চারপাশের সমস্ত কিছু লাল হয়ে উঠল। পাণ্ডুর রঙগুলো গোলাপী হয়ে গেল আর গাঢ় রঙগুলো হয়ে গেল টকটকে লাল।

কী দেখতে পাচ্ছ?

আগে যা দেখছিলাম ঠিক তাই-ই, তবে তফাক্টা হচ্ছে এখন সব কিছুই লাল হয়ে গেছে।

তার কারণ হচ্ছে, যেভাবে তুমি বাস্তবকে প্রত্যক্ষ করো সেটাকে ঐ চশমাটা সীমাবদ্ধ করে দিচ্ছে। যা কিছু দেখছ তার সবই তোমার চারপাশের জগন্টারই অংশ, কিন্তু সেটাকে তুমি কীভাবে দেখছ সেটা নির্ধারণ করে দিচ্ছে তুমি যে-চশমাটা। পরে আছো সেটা। কাজেই, যদিও জগষ্টাকে তুমি লাল হিসেবে দেখতে পাচ্ছ, তারপরেও তুমি এ-কথা বলতে পারো না যে তা লাল।

তা তো বটেই।

বনের মধ্যে যদি এখন তুমি হাঁটতে যেতে বা ক্যাপ্টেনের বাঁকে তোমাদের বাড়িতে যেতে তাহলে সব কিছু তুমি সে-রকমই দেখতে পেতে যেমনটা সব সময় স্বাভাবিকভাবে দেখো। কিন্তু যা-কিছু দেখতে তার সবই লাল দেখতে পেতে।

যতক্ষণ না চশমাটা খুলে নিতাম, হ্যাঁ, তা ঠিক।

কান্ট যখন বলেছিলেন যে মনের ক্রিয়াকলাপের ওপর খবরদারি করার বিশেষ কিছু প্রতিবেশ রয়েছে তখন তিনি ঠিক এ-কথাই বুঝিয়েছিলেন।

কোন ধরনের প্রতিবেশ?

যা কিছুই আমরা দেখি তা প্রথমত এবং প্রধানত সময় আর স্থানগত ঘটনা (phenomena) হিসেবে প্রত্যক্ষ করা হবে। সময় আর স্থান-কে কান্ট আমাদের স্বজ্ঞার দুই আকার বা ধরন বলে অভিহিত করেছেন। এবং তিনি জোর দিয়ে বলেছেন যে, এই দুই আকার বা ধরন প্রতিটি অভিজ্ঞতার পূর্ববর্তী হিসেবে থাকে। অন্য কথায় বলতে গেলে, কোনো অভিজ্ঞতা হওয়ার আগেই আমরা এটা ধরে নিতে পারি যে সেগুলোকে আমরা সময় আর স্থানগত ঘটনা হিসেবে প্রত্যক্ষ করবো। কারণ, প্রজ্ঞার চশমা আমরা খুলে নিতে অক্ষম।

তার মানে তিনি মনে করতেন ঘটনাকে সময় আর স্থানগতভাবে প্রত্যক্ষ করার ব্যাপারটি মানুষের সহজাত?

হ্যাঁ, এক অর্থে তাই। আমরা কী দেখছি তা আমরা ভারত না গ্রীনল্যান্ডে বড় হয়েছি তার ওপর হয়ত নির্ভর করতে পারে, তবে আমরা যেখানেই থাকি না কেন জগৎকে আমরা সময় আর স্থানের ভেতর ধারাবাহিক কিছু প্রক্রিয়া হিসেবেই প্রত্যক্ষ করি। এই কথাটা অন্তত আগেভাগেই বলে দিতে পারি আমরা।

কিন্তু সময় আর স্থানের অস্তিত্বনিশ্চয়ই আমাদের ওপর নির্ভরশীল নয়?

ভুল। কান্ট মনে করতেন সময় আর স্থান মানুষের অবস্থার ওপর নির্ভরশীল। সময় আর স্থান প্রত্যক্ষণের প্রথম আর প্রধান উপায়, বাস্তব জগতের কোনো গুণ বা বৈশিষ্ট্য নয়।

এটা অবশ্য একেবারে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি।

কারণ, মানুষের মন কেবল নিষ্ক্রিয় মোম নয় যা শুধু বাইরের সংবেদন গ্রহণ করে। জগত্তাকে আমরা যেভাবে উপলব্ধি করি তার ওপর মন একটা ছাপ ফেলে যায়। কাঁচের একটা পাত্রে যখন তুমি পানি ঢাল তখন যা ঘটে, তার সঙ্গে তুলনা করতে পারো তুমি ব্যাপারটাকে। পানি পাত্রটার আকার ধারণ করে। ঠিক একইভাবে আমাদের প্রত্যক্ষণও স্বজ্ঞার আকারের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়।

সম্ভবত বুঝতে পারছি কী বলতে চাইছেন।

কান্টের দাবি, শুধু মন-ই ঘটনার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয় না, আমাদের প্রত্যক্ষণ-ও মনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়। মানুষের জ্ঞানের সমস্যার ক্ষেত্রে একে কান্ট বলেছেন কোপার্নিকান বিপ্লব।

এ-কথার সাহায্যে তিনি এটাই বোঝাতে চেয়েছেন যে পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে, সূর্য পৃথিবীর চারদিকে নয়, কোপার্নিকাসের এই দাবি আগের চিন্তা-ভাবনার তুলনায় যতটা নতুন আর মূলগতভাবে ভিন্ন ছিল এই ব্যাপারটাও ঠিক তাই।

এখন বুঝতে পারছি কেন তিনি ভাবতেন বুদ্ধিবাদী আর অভিজ্ঞতাবাদীরা একটা বিশেষ পর্যায় পর্যন্ত ঠিক বলেছেন। অভিজ্ঞতার গুরুত্বের কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলেন বুদ্ধিবাদীরা, আবার আমরা যেভাবে জগত্তাকে দেখি সেটাকে আমাদের মন কীভাবে প্রভাবিত করে সেদিকে অভিজ্ঞতাবাদীরা চোখ বন্ধ করে ছিলেন।

এমনকী, কার্য-কারণ সূত্র, (law of causaly) যা কিনা মানুষ প্রত্যক্ষ করতে পারে না বলে হিউম দাবি করেছিলেন, তা-ও, কান্টের মত অনুযায়ী, মানুষের মনের অধীন।

বুঝিয়ে বলুন, প্লীজ।

 তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে যে হিউম কীভাবে এই দাবি করেছিলেন যে অভ্যাসের জোরেই আমরা সমস্ত প্রাকৃতিক ঘটনার মধ্যে একটা কার্য-কারণজনিত সম্পর্ক দেখতে বাধ্য হই? হিউমের বক্তব্য অনুযায়ী, কালো বিলিয়ার্ড বলটাকে সাদা বিলিয়ার্ড বলটার গতির কারণ হিসেবে আমরা প্রত্যক্ষ করতে পারি না। কাজেই এ কথা আমরা প্রমাণ করতে পারি না যে কালো বলটা সব সময়-ই সাদা বলটাতে গতির সঞ্চার করবে।

হ্যাঁ, মনে আছে।

কিন্তু যে-জিনিসটাকে আমরা প্রমাণ করতে পারি না বলে হিউম দাবি করছেন, ঠিক সেটাকেই কান্ট মানুষের প্রজ্ঞার একটা বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। কার্য-কারণ সূত্র স্রেফ এই কারণে শাশ্বত আর পরম যে যা-ঘটে তার সবকিছুকেই মানুষের প্রজ্ঞা কারণ আর ফল সংক্রান্ত বিষয় হিসেবেই প্রত্যক্ষ করে।

তারপরেও, আমি মনে করি কার্য-কারণ সূত্র বাস্তব জগতেরই অন্তর্ভুক্ত, আমাদের মনের নয়।

কান্টের দর্শন অনুযায়ী, এটা মানুষের মধ্যে সহজভাবেই আছে। এ-ব্যাপারে তিনি হিউমের সঙ্গে একমত যে জগতের স্বরূপ আমরা নিশ্চিতভাবে কখনোই জানতে পারবো না। আমরা কেবল এটুকু জানতে পারি জগন্টা আমার কাছে বা অন্য সবার কাছে কেমন। দর্শন-এর ক্ষেত্রে কান্টের সবচেয়ে বড় অবদান হচ্ছে বস্তুর স্বরূপ-das Ding an sich-আর আমাদের কাছে মনে হওয়া রূপের মধ্যে তাঁর টানা বিভাজন রেখা।

জার্মান আমি খুব একটা জানি না।

বস্তুর স্বরূপ আর আমার কাছে মনে হওয়া রূপ-এর মধ্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য নিরূপণ করেছেন কান্ট। বস্তুর স্বরূপ আমরা নিশ্চিতভাবে কখনোই জানতে পারবো না। আমরা শুধু এটুকুই জানতে পারি সেটা আমাদের কাছে কেমন প্রতীয়মান হচ্ছে। অন্য দিকে, কোনো অভিজ্ঞতা হওয়ার আগেই, মানুষের মন কীভাবে ঘটনাগুলো প্রত্যক্ষ করবে সে-বিষয়ে আমরা আগাম কিছু বলতে পারি।

পারি বুঝি?

সকালবেলা বাইরে বের হওয়ার আগেই তুমি জানতে পারো না তুমি কী দেখবে বা সেদিন তোমার কী কী অভিজ্ঞতা হবে। কিন্তু তুমি এটা জানতে পারো যে যা কিছু তুমি দেখবে বা যে-সব অভিজ্ঞতা তোমার হবে তার সবই সময় আর স্থানে প্রত্যক্ষ করা হবে। তাছাড়া তুমি এ-বিষয়েও নিশ্চিত থাকতে পারো যে কার্য-কারণ সূত্র সেখানে কাজ করবে এবং তা স্রেফ এই কারণে যে তোমার চেতনার অংশ হিসেবে সেটা তুমি তোমার সঙ্গেই বহন করবে।

কিন্তু আপনি বলতে চাইছেন আমাদেরকে অন্যভাবেও তৈরি করা যেতো?

হ্যাঁ, ভিন্ন এক ধরনের সাংবেদনিক সরঞ্জাম থাকতে পারত আমাদের। ফলে ভিন্ন ধরনের সময়জ্ঞান আর স্থান সম্বন্ধে ভিন্ন ধরনের অনুভূতি থাকতে পারত আমাদের। আমাদেরকে এমনভাবে তৈরি করা যেতো যাতে আমাদের চারপাশে যা ঘটছে সে-সবের কারণ খুঁজে বেড়াতাম না আমরা!

ঠিক কী বোঝাতে চাইছেন?

মনে করো, বসবার ঘরের মেঝেতে একটা বেড়াল শুয়ে আছে। একটা বল গড়িয়ে দেয়া হলো ঘরটাতে, তো এরকম অবস্থায় বেড়ালটা কী করে সাধারণত?

এটা আমি অনেকবার করে দেখেছি। বেড়ালটা বলটার পিছু পিছু ছোটে।

ঠিক আছে। এবার মনে করো সেই একই ঘরে তুমি বসে আছে। হঠাৎ যদি দেখ একটা বল গড়িয়ে ভেতরে ঢুকছে তখন কি তুমি ওটার পেছন পেছন ছুটতে শুরু করবে?

প্রথমে আমি ঘুরে তাকাব বলটা কোত্থেকে এলো তা দেখার জন্যে।

ঠিক, কারণ তুমি মানুষ, প্রতিটি ঘটনার কারণ তুমি অবশ্যই খুঁজবে, তার কারণ, কার্য-কারণ সূত্র তোমার গঠনের অংশ।

কান্ট সে-কথাই বলছেন।

হিউম দেখিয়েছিলেন যে প্রাকৃতিক নিয়মগুলো আমরা প্রত্যক্ষ-ও করতে পারি না, প্রমাণ-ও করতে পারি না। এই বিষয়টা অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছিল কান্টকে। কিন্তু তাঁর এই বিশ্বাস ছিল যে, আমরা যে আসলে মানবজ্ঞানের সূত্র (laws of human cognition) নিয়ে কথা বলছি এটা দেখিয়ে দিয়ে তিনি প্রাকৃতিক সেই নিয়মগুলোর পরম যাথার্থ্য প্রমাণ করতে পারবেন।

বলটা কোত্থেকে এলো তা দেখার জন্য একটা শিশুও কি ঘুরে তাকাবে?

সম্ভবত না। কিন্তু কান্ট মন্তব্য করেছেন যে কিছু সাংবেদনিক বস্তুর সঙ্গে পরিচিত হওয়ার আগ পর্যন্ত শিশুর প্রজ্ঞা পুরোপুরি বিকাশ লাভ করে না। ফাঁকা বা শূন্য মনের কথা বলা একেবারেই অর্থহীন।

তা ঠিক, সে-রকম মন খুবই অদ্ভুত মন হতো।

বেশ, এবার তাহলে পুরো ব্যাপারটার একটা সার-সংক্ষেপ তৈরি করা যাক। কান্টের বক্তব্য অনুযায়ী, জগৎ সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান তৈরি হয় দুটো উপাদানের বদৌলতে। একটি হচ্ছে বাহ্যিক পরিস্থিতি, যেটার ব্যাপারে আমরা কিছুই জানতে পারি না, ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে সেটাকে প্রত্যক্ষ করার আগে। এটাকে আমরা বলতে পারি জ্ঞানের উপাদান। আরেকটি হচ্ছে, খোদ মানুষের মধ্যেকার অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি– এই যেমন, সময় আর স্থানে এবং অলঙ্ঘনীয় কার্য-কারণ সূত্রের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ প্রক্রিয়া হিসেবে ঘটতে থাকা নানান ঘটনার প্রত্যক্ষণ। একে আমরা বলতে পারি জ্ঞানের আকার।

জানলার বাইরে দৃষ্টি মেলে কিছুক্ষণ বসে রইলেন অ্যালবার্টো আর সোফি। হঠাৎ লেকের অপর পাড়ে গাছগুলোর ভেতর ছোট্ট একটা মেয়েকে দেখতে পেল সোফি।

দেখুন! বলে উঠল সোফি! ও কে?

 ওকে যে আমি চিনি না সে-ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।

 মাত্র কয়েক সেকেন্ডের জন্যে দেখা গেল মেয়েটাকে, তারপরই নেই হয়ে গেল সে। সোফি খেয়াল করল, এক ধরনের লাল টুপি পরে ছিল মেয়েটা।

কোনো পরিস্থিতিতেই আমাদের মনোযোগ বিচ্ছিন্ন হতে দেয়া যাবে না।

ঠিক আছে, বলে যান তাহলে।

কান্ট বিশ্বাস করতেন আমরা কী জানতে পারি তার একটা স্পষ্ট সীমারেখা আছে। কথাটা তুমি হয়ত এভাবে বলতে পারো যে মনের চশমা সেই সীমা নির্দিষ্ট করে দেয়।

কীভাবে? তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে যে কান্টের পূর্ববর্তী দার্শনিকেরা কিছু প্রকৃত বড় প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করে গেছেন-এই যেমন মানুষের ভ্রা অমর কিনা, ঈশ্বর আছেন কি নেই, প্রকৃতি ছোট ছোট অবিভাজ্য কণা দিয়ে গঠিত কিনা বা মহাবিশ্ব কি অসীম না সসীম, এ-সব।

হ্যাঁ, মনে আছে।

কান্ট বিশ্বাস করতেন যে এই ধরনের প্রশ্নের ব্যাপারে নিশ্চিত কোনো কিছু জানা সম্ভব নয়। এ-ধরনের যুক্তি-তর্ক যে তিনি বাতিল করে দিয়েছিলেন তা নয়। বরং তার উল্টো। এ-সব প্রশ্ন যদি তিনি একপাশে সরিয়ে রাখতেন তাহলে তাকে দার্শনিক বলা যেতো কিনা সন্দেহ।

তিনি কী করলেন?

ধৈর্য ধরো। এ-ধরনের মহৎ দার্শনিক প্রশ্নের ক্ষেত্রে কান্ট বিশ্বাস করতেন যে, আমরা মানুষেরা যা বুঝতে পারি তার বাইরেও প্রজ্ঞা কাজ করে। ঠিক সেই সঙ্গে আমাদের স্বভাবের মধ্যেই রয়েছে এই একই প্রশ্নগুলো তুলে ধরার একটা মৌলিক বাসনা। কিন্তু যখন আমরা প্রশ্ন করি এই মহাবিশ্ব সসীম না অসীম তখন আমরা এমন এক সমগ্রতার বিষয়ে প্রশ্ন করি যার অতি ক্ষুদ্র একটা অংশ আমরা। কাজেই আমাদের পক্ষে এই সমগ্রতাকে পুরোপুরি জানা কখনোই সম্ভব নয়।

কেন?

 তুমি যখন সেই লাল চশমা পরেছিলে তখন আমরা দেখিয়ে দিয়েছিলাম যে, কান্টের বক্তব্য অনুযায়ী, দুটো উপাদান রয়েছে যেগুলো জগৎ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানলাভে অবদান রাখে।

ইন্দ্রিয় সংবেদন (sensory perception) আর প্রজ্ঞা।

হ্যাঁ, আমাদের জ্ঞানের উপাদান আমাদের কাছে আসে আমাদের ইন্দ্রিয়গুলোর সাহায্যে, কিন্তু এই উপাদানকে অবশ্যই আমাদের প্রজ্ঞার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হতে হবে। যেমন ধরো, প্রজ্ঞার একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ঘটনার কারণ খোঁজা।

মেঝেতে বলের গড়িয়ে যাওয়ার মতো কোনো ঘটনা।

তা বলতে পারো। কিন্তু যখন আমরা ভাবি দুনিয়াটা কোত্থেকে এলো আর তারপর সম্ভাব্য উত্তরগুলো নিয়ে আলাপ করি তখন এক অর্থে প্রজ্ঞাকে স্থগিত রাখা হয়। কারণ প্রজ্ঞার এমন কোনো সাংবেদনিক উপাদান নেই যা সে প্রক্রিয়াজাত করতে পারে, কোনো অভিজ্ঞতা নেই যা সে কাজে লাগাতে পারে, কারণ যে বিশাল বাস্তবতার আমরা এক ক্ষুদ্র অংশ তার পুরোটা আমাদের অভিজ্ঞতায় নেই।

এক অর্থে, যে-বলটা মেঝেতে গড়িয়ে আসে সেই বলটার একটা ছোট্ট অংশ আমরা। কাজেই ওটা কোত্থেকে এলো সেটা আমরা জানতে পারি না।

কিন্তু বলটা কোত্থেকে আসছে সেটা জিগ্যেস করাটা সব সময়ই মানুষের প্রজ্ঞার একটা বৈশিষ্ট্য হিসেবে থাকবে। সেই কারণেই আমরা প্রশ্ন করেই যাই, গভীরতম সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়ার জন্যে নিজেদের সব উজাড় করে দিই। তবে কামড় বসানোর মতোন শক্ত কোনো কিছু আমরা পাই না; সন্তোষজনক একটা উত্তর আমরা কখনোই পাই না, কারণ প্রজ্ঞা নিজে থেকে তার লক্ষ্য খুঁজে নিতে পারে না।

আমি জানি এই অনুভূতিটা ঠিক কেমন, ধন্যবাদ।

বাস্তবতার স্বরূপের মতো ভারি প্রশ্নের ক্ষেত্রে কান্ট দেখিয়েছেন যে সব সময়ই এমন দুটো বিপরীতধর্মী দৃষ্টিভঙ্গি থাকে যেগুলোর সম্ভবপরতা একই সমান আর তা নির্ভর করে প্রজ্ঞা আমাদের কী বলে তার ওপর।

উদাহরণ, প্লীজ।

সময়ের দিক থেকে জগতের একটা শুরু ছিল এ-কথাটা যেমন অর্থপূর্ণ, তেমনি সে-ধরনের কোনো শুরু ছিল না এ-কথা বলাটাও ঠিক একই রকম অর্থপূর্ণ। প্রজ্ঞা বা যুক্তির সাহায্যে দুটোর মধ্যে একটা বেছে নেয়া সম্ভব নয়। আমরা দাবি করতে পারি বরাবরই এই জগতের অস্তিত্ব ছিল, কিন্তু কখনো শুরু না থাকলে কোনো কিছু কি সব সময়ের জন্যে থাকতে পারে। কাজেই এবার আমরা বাধ্য হচ্ছি উল্টো মতটা গ্রহণ করতে।

আমরা তাহলে বলছি যে নিশ্চয়ই নির্দিষ্ট একটা সময় থেকে জগতের শুরু ছিল আর আমরা যদি এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় পরিবর্তনের কথাটা গণ্য না করি তাহলে বলতে হয় জগত্তা নিশ্চয়ই তখন শূন্য থেকে সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু শূন্য থেকে কি কোনো কিছুর সৃষ্টি হতে পারে, সোফি?

না, দুটো সম্ভাবনাতেই একই রকম সমস্যা। তারপরেও এটা মনে হয় যে এর একটা নিশ্চয়ই ঠিক, অন্যটা ভুল।

 বোধকরি তোমার মনে আছে ডেমোক্রিটাস আর জড়বাদীরা বলেছিলেন যে, প্রতিটা জিনিস যা দিয়ে তৈরি তারই সবচেয়ে ক্ষুদ্র অংশ দিয়ে এই প্রকৃতি তৈরি। অন্যরা, দেকার্তের মতোই, এ-কথা বিশ্বাস করতেন যে বাহ্যিক বাস্তবতাকে ক্রমেই ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর অংশে অন্তহীনভাবে বিভক্ত করা সব সময়ই সম্ভব। কিন্তু এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এদের মধ্যে কার কথা ঠিক?

দুদলেরই। আবার কারোরই না।

আবার, অনেক দার্শনিকই মানুষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মূল্যবোধ হিসেবে স্বাধীনতার কথা বলেছেন। একই সঙ্গে আমরা স্টোয়িকদের এবং স্পিনোজার মতো দার্শনিকের কথাও শুনেছি যারা বলেছেন সব কিছুই ঘটে প্রাকৃতিক নিয়মের প্রয়োজনের কারণে। কান্টের বক্তব্য অনুযায়ী, স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর ব্যাপারে মানব-প্রজ্ঞার ব্যর্থতার আরেকটি উদাহরণ এটা।

দুটো দৃষ্টিভঙ্গি-ই একই রকম যৌক্তিক, একই রকম অযৌক্তিক।

সবশেষে, প্রজ্ঞার সাহায্যে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে গেলে ব্যর্থতা অবশ্যম্ভাবী। দেকার্তের মতো যুক্তিবাদীরা প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে নিশ্চিতভাবেই ঈশ্বর রয়েছেন আর তা স্রেফ এই কারণে যে আমাদের মধ্যে পরম সত্তা সম্পর্কিত ধারণা বর্তমান। অন্যরা, এই যেমন অ্যারিস্টটল এবং টমাস অ্যাকুইনাস, এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন যে প্রতিটি জিনিসেরই যেহেতু একটি প্রথম বা আদি কারণ রয়েছে সুতরাং ঈশ্বর অবশ্যই আছেন।

কান্ট কী মনে করতেন?

ঈশ্বরের অস্তিত্বের এই দুই প্রমাণ-ই খারিজ করে দিয়েছেন তিনি। ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষে দাবি জানানোর জন্যে প্রজ্ঞা বা অভিজ্ঞতা কোনোটিই নিশ্চিত কোনো ভিত্তি নয়। ঈশ্বর-এর অস্তিত্ব বা অনস্তিত্ব দুটোই প্রজ্ঞার কাছে সমান সম্ভবপরতার বিষয়।

কিন্তু গোড়াতে আপনি বলেছিলেন যে খ্রিস্টিয় বিশ্বাসের ভিত্তিভূমি কান্ট রক্ষা করতে চেয়েছিলেন।

হ্যাঁ, এক ধর্মীয় মাত্রা খুলে দিয়েছিলেন কান্ট। প্রজ্ঞা আর অভিজ্ঞতা, দুটোই যখন ব্যর্থ হয় তখন একটা শূন্যস্থান সৃষ্টি হয় যা পূরণ করা যায় বিশ্বাস (faith) দিয়ে।

এভাবেই খ্রিস্ট ধর্মকে রক্ষা করলেন তিনি?

তা তুমি যা বলল। তো, এখন এই ব্যাপরটা খেয়াল রাখা দরকার যে কান্ট ছিলেন প্রোটেস্ট্যান্ট। সেই রিফর্মেশনের সময় থেকেই বিশ্বাসের ওপর গুরুত্ব আরোপের জন্যে প্রোটেস্ট্যান্টবাদ বিশিষ্ট হয়ে আছে। অন্যদিকে, ক্যাথলিক চার্চ মধ্য যুগ থেকেই বিশ্বাসের একটি স্তম্ভ হিসেবে প্রজ্ঞার ওপরেই বেশি আস্থা রেখে এসেছে।

কিন্তু, এই সব ওজনদার প্রশ্ন ব্যক্তির বিশ্বাসের ওপর ছেড়ে দেয়া উচিত, স্রেফ এই বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত করার চাইতেও বেশি কিছু করেছিলেন কান্ট। তিনি বিশ্বাস করতেন যে নৈতিকতার কারণে এটা আগে থেকেই ভেবে নেয়া অত্যন্ত জরুরি যে মানুষ অমর ভার অধিকারী, ঈশ্বর আছেন আর মানুষ স্বাধীন ইচ্ছার অধিকারী।

তার মানে দেকার্ত যা করেছিলেন তিনিও তাই করলেন। প্রথমে তিনি আমাদের বোধগম্য সব কিছু সম্পর্কেই সমালোচনা মুখর হয়ে উঠেছেন, তারপর এক সময় পেছন দরজা দিয়ে স্মাগল করে নিয়ে এলেন ঈশ্বরকে।

কিন্তু তিনি বিশেষ করে এই বিষয়টির ওপর বিশেষ জোর দিয়েছেন যে-দেকার্ত যা করেননি-ঈশ্বরকে এই পর্যায়ে এনেছে বিশ্বাস, প্রজ্ঞা নয়। আর অমরত্ব, ঈশ্বরের অস্তিত্ব এবং মানুষের স্বাধীন ইচ্ছায় বিশ্বাসকে তিনি নিজে বলেছেন ব্যবহারিক স্বতঃসিদ্ধ (practical postulates)।

তার অর্থ?

কোনো কিছু postulate করার অর্থ হচ্ছে যা প্রমাণ করা যাবে না তা ধরে নেয়া বা স্বীকার করে নেয়া। ব্যবহারিক স্বতঃসিদ্ধ কথাটি দিয়ে কান্ট এমন একটি জিনিসকে বুঝিয়েছেন যেটাকে প্রচলিত প্রথা (praxis) বা অভ্যাস-এর (practice) স্বার্থে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে তার মানে, মানুষের নৈতিকতার স্বার্থে। তিনি বলছেন, ঈশ্বরের অস্তিত্বকে স্বীকার করে নেয়া একটি নৈতিক প্রয়োজন।

হঠাৎ দরজায় ঠক ঠক আওয়াজ হলো। সোফি উঠে দাঁড়াল, কিন্তু অ্যালবার্টোর মধ্যে সে-রকম কোনো লক্ষণ দেখতে না পেয়ে সোফি বলে উঠল, কে এলো সেটা দেখতে হবে না?

শ্রাগ করে, নিমরাজি ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালেন অ্যালবার্টো। দুজনে খুলে দিলেন দরজাটা, দেখা গেল সাদা একটা গ্রীষ্মের পোষাক আর একটা লাল বনেট পরা ছোট্ট একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই মেয়েটিকেই দেখেছিলেন তারা লেকের অপর পাড়ে। তার একটা বাহুর সঙ্গে খাবারের একটা ঝুড়ি ঝোলানো।

হাই, সোফি বলে উঠল। কে তুমি?

 দেখতে পাচ্ছো না, আমি রেড রাইডিংহুড?

সোফি অ্যালবার্টোর দিকে তাকাল, অ্যালবার্টো মাথা ঝাঁকালেন।

শুনলেই তো মেয়েটা কী বলল।

আমি আমার দাদীর বাড়ি খুঁজছি, মেয়েটা বলল। বেচারীর অনেক বয়েস, তাছাড়া তার অসুখ, অবশ্য তাঁর জন্যে আমি কিছু খাবার নিয়ে যাচ্ছি।

এটা সেই বাড়ি নয়, অ্যালবার্টো বললেন, কাজেই তুমি বরং নিজের পথে যাও।

তিনি এমন একটা ভঙ্গি করলেন যা দেখে সোফির মাছি তাড়ানোর কথা মনে : পড়ে গেল।

কিন্তু আমার যে একটা চিঠি দেয়ার কথা তাকে, লাল বনেটের মেয়েটি বলল।

কথাটা বলেই ছোট্ট একটা খাম বের করে সোফির হাতে ধরিয়ে দিল সে। তারপরই লাফাতে লাফাতে চলে গেল সে।

নেকড়ে থেকে সাবধান! পেছন থেকে বলে উঠল সোফি।

অ্যালবার্টো এরিমধ্যে বসবার ঘরের দিকে পা বাড়িয়েছেন।

 ভাবুন একবার। ও সেই ছোট্ট রেড রাইডিংহুড। সোফি বলল।

ওকে সাবধান করে কোনো লাভ নেই। ও ঠিকই ওর দাদীর বাড়ি যাবে আর তারপর নেকড়ে ওকে খাবে। ওর কখনোই শিক্ষা হবে না। সময়ের শেষ পর্যন্ত বারবার ঘটতে থাকবে এই ঘটনা।

কিন্তু ওর দাদীর বাসা খুঁজে পাওয়ার আগে সে কখনো অন্য কোনো বাড়ির দরজায় গিয়ে টোকা মেরেছে বলে কোনোদিন শুনিনি আমি।

নেহাতই তুচ্ছ ব্যাপার, সোফি।

তাকে দেয়া খামটার দিকে তাকাল এবার সোফি। তাতে লেখা, প্রতি, হিল্ডা। খামটা খুলে জোরে জোরে পড়ল সে।

প্রিয় হিল্ডা, মানব মস্তিষ্ক যদি আমাদের বুঝবার মতো সরলও হতো তারপরেও আমরা ওটাকে না বুঝবার মতোই নির্বোধ থেকে যেতাম। ভালোবাসা নিস, বাবা।

মাথা ঝাঁকালেন অ্যালবার্টো। বড্ড খাঁটি কথা। আমার ধারণা এ-ধরনের একটা কথা কান্ট বলেছিলেন। আমরা কী তা বোঝার আশা আমরা করতে পারি না। একটা ফুল বা একটা পোকাকে হয়ত আমরা হৃদয়ঙ্গম করতে পারি, কিন্তু নিজেদেরকে আমরা কখনোই বুঝতে বা জানতে পারি না। মহাবিশ্বের কথা তো ছেড়েই দেয়া গেল।

হিল্ডার কাছে লেখা রহস্যময় বাক্যটা আরো বেশ কবার পড়ল সোফি; অ্যালবার্টো এরপর বলে চললেন: সামুদ্রিক সাপ বা ও-রকম জিনিস যেন আমাদের মনোযোগে বিঘ্ন ঘটাতে না পারে। আজকের মতো শেষ করার আগে কান্টের নীতিবিদ্যা সম্পর্কে কিছু কথা বলব তোমাকে।

প্লীজ, তাড়াতাড়ি করুন। শিগগির বাড়ি যেতে হবে আমাকে।

প্রজ্ঞা আর ইন্দ্রিয় আমাদেরকে কতটুকু বলতে পারে সে-ব্যাপারে হিউম-এর সংশয়বাদ জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন নিয়ে চিন্তা করতে বাধ্য করেছে কান্টকে। নীতিবিদ্যা সেসবের মধ্যে অন্যতম।

হিউম বলেছিলেন না যে কোনটা ন্যায় কোনটা অন্যায় তা কখনোই প্রমাণ করা যায় না? হ্যাঁ বা না-বাক্য থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে ঔচিত্যবোধক বাক্যে পৌঁছানো যায় না।

হিউমের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, আমাদের প্রজ্ঞা বা আমাদের অভিজ্ঞতা কোনোটিই ন্যায়-অন্যায়ের ভেতরে পার্থক্য নিরূপণ করতে পারে না। পারে স্রেফ আমাদের ভাবাবেগ। কান্ট-এর জন্যে এ-রকম একটা ভিত্তি গ্রহণযোগ্য ছিল না।

সেটা কল্পনা করে নিতে পারি।

কান্ট সব সময়ই মনে করেছেন যে ন্যায়-অন্যায়ের মধ্যে পার্থক্যটা প্রজ্ঞা সংক্রান্ত ব্যাপার, ভাবাবেগ সংক্রান্ত নয়। এদিক দিয়ে তিনি বুদ্ধিবাদীদের অনুসারী, যাঁরা বলতেন ন্যায়-অন্যায়ের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করার শক্তি মানব প্রজ্ঞার সহজাত। কোনটা ন্যায় কোনটা অন্যায় সবাই যে সেটা জানে সেটা এ-কারণে নয়। যে ব্যাপারটা আমরা শিখেছি, বরং এই কারণে যে বিষয়টার জন্ম আমাদের মনে। কান্টের মত অনুযায়ী সবারই বাহ্যিক প্রজ্ঞা রয়েছে, অর্থাৎ যে-বুদ্ধি আমাদেরকে প্রতিটি ক্ষেত্রে কোনটি ন্যায় কোনটি অন্যায় সে-ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা দেয় সেই বুদ্ধি আছে।

এবং এটা সহজাত?

প্রজ্ঞার অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের মতো ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য করার ব্যাপারটিও সহজাত। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আমরা সবাই যেহেতু বুদ্ধিমান প্রাণী, প্রতিটি জিনিসকেই একটি কার্য-কারণজনিত সম্পর্কসূত্রে প্রত্যক্ষ করার মধ্যে দিয়ে আমরা একই সার্বজনীন নৈতিক সূত্রুতে (moral laws) প্রবেশাধিকার পাই।

ভৌত সূত্রগুলোর (physical laws) মতো এই নৈতিক সূত্রেরও পরম যাথার্থ (absolute validity) রয়েছে। প্রতিটি জিনিসেরই একটা কারণ রয়েছে বা সাত আর পাঁচ বারো হয়, এ-সব কথা যেমন আমাদের বুদ্ধির ক্ষেত্রে মৌলিক ব্যাপার, ঠিক তেমনি এই নৈতিক সূত্র বা নিয়মও আমাদের নৈতিকতার ক্ষেত্রে একেবারে মৌলিক বিষয়।

তা এই নৈতিক নিয়ম কী বলে?

যেহেতু সব অভিজ্ঞতার আগেই থাকে এটা, সেজন্যে এটা আকারগত, অর্থাৎ বিশেষ কোনো নৈতিক পছন্দের সঙ্গে বাঁধা নয়। কারণ এটা সব সময়ের সব সমাজের সব মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। অর্থাৎ এটা এ-রকম কিছু বলে না যে এমন বা অমন পরিস্থিতিতে পড়লে তুমি এটা বা ওটা করবে। বরং বলে, সব পরিস্থিতিতে তোমাকে কেমন আচরণ করতে হবে।

কিন্তু বিশেষ কোনো পরিস্থিতিতে কী করতে হবে তা যদি এটা না-ই বলে তাহলে একটা নৈতিক নিয়ম নিজের মধ্যে ঢুকিয়ে লাভটা কী?

নৈতিক নিয়মকে কান্ট দেখেছেন একটা শর্তহীন আদেশ (categorical imperative) হিসেবে। এর সাহায্যে তিনি বোঝাচ্ছেন যে নৈতিক নিয়ম পরম বা শর্তহীন এটা সব পরিস্থিতিতে প্রযোজ্য। তাছাড়া, এটা আদেশমূলক (imperative), তার অর্থ, এটা নিয়ন্ত্রণকামী, কাজেই পুরোপুরি কর্তৃত্বপরায়ণ।

বুঝতে পেরেছি।

কান্ট এই শর্তহীন আদেশ তৈরি করেছেন বিভিন্নভাবে। প্রথমে তিনি বলছেন: শুধু সেই নীতির ওপর কাজ করো যার মাধ্যমে সেই সঙ্গে তুমি এই ইচ্ছা পোষণ করতে পারো যে সেটা একটা সার্বজনীন নিয়মে পরিণত হবে।

অর্থাৎ যখন আমি কিছু করবো তখন আমাকে এই ব্যাপারে নিশ্চিত হতে হবে। যে আমি চাই অন্যরা এই একই পরিস্থিতিতে ঠিক একই কাজ করবে।

ঠিক তাই। কেবলমাত্র তখনই তুমি তোমার ভেতরকার নৈতিক আইন অনুযায়ী কাজ করবে। কান্ট তার শর্তহীন আদেশটিকে এভাবেও তৈরি করেছেন: এমন ভাবে কাজ করো যাতে সব সময়ই মনুষ্যত্বকে তুমি কখনোই নিছক উপায় হিসেবে নয় বরং সেই সঙ্গে সব সময় একটি উদ্দেশ্য হিসেবে ব্যবহার করবে তা সে তোমার ক্ষেত্রেই হোক বা অন্যের ক্ষেত্রে।

অর্থাৎ অন্য লোকজনকে আমরা যেন কখনোই আমাদের নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার না করি।

ঠিক, তার কারণ প্রত্যেক মানুষই নিজে একটা উদ্দেশ্য। কিন্তু সেটা কেবল অন্যদের বেলাতেই প্রযোজ্য নয়। তোমার নিজের বেলাতেও প্রযোজ্য। তুমিও নিজেকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করবে না।

কথাটা শুনে আমার সেই গোল্ডেন রুলটা মনে পড়ছে: অন্যের সঙ্গে এমন আচরণ করো…।

হ্যাঁ, সেটাও আচরণের একটা আকারগত নীতি যা আসলে সমস্ত নৈতিক পছন্দের বা বিচারের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তুমি বলতে পারো যে সেই গোল্ডেন রুলটা কান্টের সার্বজনীন নৈতিক নিয়মের মতো একই কথা বলে।

কিন্তু নিশ্চয়ই ওটা নিছক একটা দাবি। হিউম সম্ভবত ঠিকই বলেছিলেন যে প্রজ্ঞা দিয়ে ঠিক করা যায় না কোনটা ন্যায়, কোনটা অন্যায়।

কান্টের বক্তব্য অনুযায়ী, নৈতিকতার নিয়ম কার্য-কারণ সূত্রের মতোই পরম এবং সার্বজনীন। সেটাও প্রজ্ঞা দিয়ে প্রমাণ করা যায় না, কিন্তু তারপরেও সেটা পরম আর অপরিবর্তনীয়। কেউ-ই সে-কথা অস্বীকার করবে না।

আমার মনে হচ্ছে আমরা আসলে বিবেক-এর কথা বলছি। কারণ সবারই বিবেক আছে, তাই না?

 হ্যাঁ। নৈতিকতার নিয়ম বর্ণনা করার সময় কান্ট আসলে মানুষের বিবেকের কথাই বলেন। আমাদের বিবেক আমাদেরকে কী বলে আমরা তা প্রমাণ করতে না পারলেও আমরা জানি তা কী বলে।

মাঝে মাঝে অন্যের প্রতি আমি সদয় হই, তাদের সাহায্য করি এই জন্যে যে এ-কাজের একটা প্রতিদান পাওয়া যায়। জনপ্রিয় হওয়ার একটা উপায়, এটা।

কিন্তু তুমি যদি শুধু জনপ্রিয় হওয়ার জন্যে অন্যের কষ্টের ভাগিদার হও তাহলে কিন্তু তুমি নৈতিক নিয়ম-এর প্রতি শ্রদ্ধাবশত কাজটা করছ না। হয়ত তুমি নৈতিক নিয়ম অনুযায়ী-ই কাজ করছ আর হয়ত সেটাই যথেষ্ট ভালো, কিন্তু ব্যাপারটা নৈতিক কাজ তখনই হবে যখন তুমি নিজেকে জয় করেছ। একেবারেই কর্তব্য জ্ঞান করে যখন তুমি কোনো কাজ করো কেবল তখনই সেটাকে একটি নৈতিক কাজ বলা যেতে পারে। কান্টের নীতিবিদ্যাকে তাই মাঝে মাঝে কর্তব্যজনিত নীতিবিদ্যা বলা হয়।

রেড ক্রস বা গির্জার বাজারের জন্যে টাকা সংগ্রহ করাকে আমি আমার কর্তব্য মনে করতে পারি।

ঠিক। আর জরুরি বিষয় হচ্ছে কাজটা তুমি করছ কারণ তুমি জানো কাজটা অন্যায় নয়। তোমার জোগাড় করা টাকাটা যদি রাস্তায় হারিয়ে যায় বা যাদের মুখের অন্ন যোগানোর জন্যে ওটা জোগাড় করা হয়েছিল তাদের জন্যে যদি টাকাটা যথেষ্ট–ও হয় তারপরেও কিন্তু তুমি নৈতিক নিয়ম মান্য করেছে। সদিচ্ছা নিয়ে কাজ করেছো তুমি আর কান্ট-এর বক্তব্য অনুযায়ী, এই সদিচ্ছাই নির্ধারণ করে কাজটি নৈতিকভাবে ঠিক ছিল কিনা, কাজটির পরিণতি বা ফলাফল নয়। সে-কারণেই কান্ট-এর নীতিবিদ্যাকে সদিচ্ছার নীতিবিদ্যাও বলা হয়ে থাকে।

একজন মানুষ কখন নৈতিক নিয়ম-এর প্রতি শ্রদ্ধাবশত কাজ করছে সে-কথা জানাটা তার জন্যে এতো জরুরি ছিল কেন? সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিশ্চয়ই আমরা যা করছি তা আসলেই মানুষের কাজে লাগছে কিনা।

সেটাই আসলে ঠিক, কান্টও অবশ্যই এ-ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করতেন না। কিন্তু আমরা যখন ভেতরে ভেতরে জানি যে নৈতিক নিয়মের প্রতি শ্রদ্ধাবশতই আমরা কাজ করছি তখনই কেবল আমরা স্বাধীনভাবে কাজ করি।

যখন একটা নিয়ম মেনে চলি তখনই আমরা স্বাধীনভাবে কাজ করি? এটা কি একটু অদ্ভুত হয়ে গেল না?

কান্ট বলছেন, তা নয়। বোধকরি তোমার মনে আছে যে তাকে ধরে নিতে বা postulate করতে হয়েছিল যে মানুষ স্বাধীন ইচ্ছার অধিকারী। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, কারণ কান্ট আরো বলেছিলেন যে সব কিছুই কার্য-কারণ সূত্র মেনে চলে। তাহলে আর কী করে স্বাধীন ইচ্ছা থাকতে পারে আমাদের?

আমি কী করে বলব?

এইখানে কান্ট মানুষকে এমনভাবে দুভাগে ভাগ করছেন যা দেকার্ত যখন দাবি করেছিলেন যে মানুষ একটি দ্বৈত প্রাণী তার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। মানুষ হচ্ছে দেহ ও মন এই দুইয়েরই অধিকারী। কান্ট বলছেন বস্তুগত প্রাণী হিসেবে আমরা সম্পূর্ণভাবে কার্য-কারণের অলঙ্ঘনীয় নিয়মের অধীন। আমরা যা প্রত্যক্ষ করি তা আমরা নির্ধারণ করি না, প্রয়োজনের মাধ্যমেই প্রত্যক্ষণ আসে আমাদের কাছে আর তা আমাদেরকে প্রভাবিত করে, ব্যাপারটা আমাদের পছন্দ হোক বা না হোক। কিন্তু আমরা কেবল বস্তুগত প্রাণীই নই, আমরা প্রজ্ঞাবিশিষ্ট প্রাণীও বটে।

বস্তুগত প্রাণী হিসেবে আমরা পুরোপুরি প্রাকৃতিক জগতের অংশ বিশেষ। কাজেই আমরা কার্য-কারণজনিত সম্পর্কের অধীন। সে হিসেবে আমাদের কোনো স্বাধীন ইচ্ছে নেই। কিন্তু বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন প্রাণী হিসেবে আমরা সেটার একটা অংশ কান্ট যাকে বলছেন das Ding an sich, অর্থাৎ আমাদের ইন্দ্রিয় সংবেদন নিরপেক্ষ, অনন্য সাপেক্ষ জগৎ। যখন আমরা আমাদের ব্যবহারিক প্রজ্ঞা (practical reason), যা আমাদেরকে নৈতিক বাছ-বিচার করতে বাধ্য করে, কেবল তখনই আমরা আমাদের স্বাধীন ইচ্ছা প্রয়োগ করি, কারণ যখন আমরা নৈতিক নিয়ম মেনে চলি বা তার বশ্যতা মেনে নেই তখন আমরাই সেই নিয়ম তৈরি করি যে-নিয়ম আমরা পালন করছি।

হ্যাঁ, এক হিসেবে কথাটা সত্যি। আমি-ই বা আমার ভেতরের একটা কিছুই আমাকে বলে অন্যের সঙ্গে দুর্ব্যবহার না করতে।

কাজেই যখন তুমি সেটা না করাটাই পছন্দ করছ, তখন ব্যাপারটা হয়ত তোমার স্বার্থের বিপক্ষে যাচ্ছে, কিন্তু তারপরেও তুমি স্বাধীনভাবে কাজ করছ।

যে কোন ক্ষেত্রেই, যা ইচ্ছে তা করার মানেই যে কেউ মুক্ত বা স্বাধীন তা নয়।

মানুষ সব ধরনের জিনিসের দাস হয়ে উঠতে পারে। এমনকী মানুষ তার নিজের অহমিকতারও দাস হয়ে উঠতে পারে। কামনা-বাসনা আর অনৈতিকতার ওপরে ওঠবার জন্যেই স্বাধীনতা বা মুক্তি দরকার।

কিন্তু জন্তু-জানোয়ারদের বেলায়? আমার মনে হয় ওরা স্রেফ ওদের প্রবণতা আর প্রয়োজন অনুযায়ী-ই চলে। ওদের নিশ্চয়ই নৈতিক নিয়ম মেনে চলার স্বাধীনতা নেই, না কি আছে?

না আর সেটাই ওদের সঙ্গে মানুষের পার্থক্য।

বুঝতে পেরেছি।

আর সবশেষে আমরা বলতে পারি যে বুদ্ধিবাদ আর অভিজ্ঞতাবাদের মধ্যেকার সংগ্রামের ফলে দর্শন যে কানা গলিতে পৌঁছেছিল কান্ট সেটা থেকে বেরোবার রাস্তা দেখিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। কাজেই কান্টের সঙ্গেই দর্শনের ইতিহাসে একটি যুগের সমাপ্তি ঘটল। তিনি মারা যান ১৮০৪-এ; আমরা যে সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে রোমান্টিসিজম বলি তখন তা তুঙ্গে। কনিসবার্গে কান্টের সমাধিফলকে খোদাই করা আছে তার সবচেয়ে বেশি উদ্ধৃত কথাটাঃ যতো বেশি সময় ধরে আর তীব্রভাবে আমি দুটো বিষয়ের কথা ভাবি, ততোই ক্রমবর্ধমান বিস্ময় আর সশ্রদ্ধ ভীতিতে সেগুলো আমার মনকে ভরে দেয়: আমার ওপরের তারারা আকাশ আর আমার ভেতরের নৈতিক নিয়ম।

চেয়ারে পিঠ ঠেস দিয়ে বসলেন অ্যালবার্টো। ব্যস, এই পর্যন্ত। বললেন তিনি। আমার ধারণা, কান্ট সম্পর্কে সবচেয়ে জরুরি কথাগুলো তোমাকে বলে ফেলেছি আমি।

যাই হোক, সোয়া চারটা বাজে এখন।

অবশ্য একটা ব্যাপার এখনো বাকি আছে। স্রেফ এক মিনিট সময় দাও আমাকে।

টিচার তাঁর কথা শেষ করার আগে কখনো ক্লাসরুম ছেড়ে বাইরে যাই না আমি।

আমি কি বলেছিলাম যে নিছক ইন্দ্রিয়পরায়ণ জীব হিসেবে জীবন যাপন করলে আমাদের কোনো স্বাধীনতা থাকে না?

হ্যাঁ, এ-রকমই একটা কথা বলেছিলেন আপনি।

কিন্তু সার্বজনীন প্রজ্ঞা ব্যবহার করলে আমরা মুক্ত ও স্বাধীন। এ-কথাও কি বলেছি?

হ্যাঁ। কিন্তু এ-সব আবার বলছেন কেন?

সোফির দিকে ঝুঁকে এলেন অ্যালবার্টো, গভীর দৃষ্টিতে তাকালেন তার চোখের দিকে, তারপর ফিসফিস করে বললেন: যা দেখো তাই-ই বিশ্বাস কোরো না, সোফি।

আপনি ঠিক কী বোঝাতে চাইছেন?

একবার শুধু ও-দিকটায় তাকিয়ে দেখো।

দেখুন, আমি কিন্তু আপনার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না।

লোকে সাধারণত বলে দেখলে তবেই বিশ্বাস করতো। তুমি কিন্তু দেখলেও কোরো না।

এর আগেও এ-রকম একটা কথা বলেছিলেন আপনি।

হ্যাঁ, পার্মেনিদেস সম্পর্কে।

কিন্তু এখনো বুঝতে পারছি না আপনি কী বোঝাতে চাইছেন।

দেখো, বাইরে আমরা সিঁড়িতে বসে কথা বলছিলাম, তখন সেই তথাকথিত সামুদ্রিক সাপটা পানির মধ্যে দাপাদাপি শুরু করল।

দারুণ ছিল না ওটা?

মোটেই না। তো, এরপর রেড রাইডিংহুড এলো দরজার কাছে। আমি আমার দাদীর বাড়ি খুঁজছি। বালখিল্য সব ব্যাপার। এগুলো মেজরেরই ট্রিক, সোফি। সেই কলার খোসার ভেতরে দেয়া মেসেজ আর সেই মূর্খামি ঝড়বৃষ্টিটা।

আপনার কি মনে হয়…?

কিন্তু আমি বলেছি আমার একটা প্ল্যান আছে। যতক্ষণ আমরা আমাদের প্রজ্ঞার সঙ্গে রয়েছি সে আমাদের সঙ্গে কোনো জারিজুরি খাটাতে পারবে না। কারণ এক অর্থে আমরা স্বাধীন। সে আমাদেরকে সব ধরনের জিনিসকে প্রত্যক্ষ করতে দিতে পারে; কিছুই আমাকে অবাক করবে না। সে যদি আকাশ অন্ধকার করে দেয় বা হাতিকে আকাশে ওড়ায় আমি স্রেফ মুচকি হাসবো। কিন্তু সাত আর পাঁচ যোগ করলে বারো হবে। এটা এমন একটা সত্য যা তার সমস্ত কমিক স্ট্রিপ মার্কা ঘটনার পরেও টিকে থাকবে। দর্শন রূপকথার ঠিক বিপরীত।

কয়েক মুহূর্ত অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকল সোফি।

এখন তাহলে তোমার ছুটি, শেষ পর্যন্ত অ্যালবার্টো বললেন।

রোমান্টিসিজম-এর ওপর একটা বৈঠকের জন্যে ডাকবো আমি তোমাকে পরে। হেগেল আর কিয়ের্কেগার্ডে-র কথাও শোনার দরকার আছে তোমার। কিন্তু কিয়েভিক এয়ারপোর্টে মেজর এসে পৌঁছানোর আর এক হপ্তা বাকি মোটে। তার আগেই লোকটার আঠাল ফ্যান্টাসি থেকে মুক্তি পেতে হবে আমাদেরকে। আজ এ পর্যন্তই সোফি। তবে শেষ করার আগে শুধু এটুকু শুনে রাখো যে আমাদের দুজনকে নিয়ে চমৎকার একটা পরিকল্পনা করছি আমি।

আমি তাহলে আসি।

দাঁড়াও, সম্ভবত সবচেয়ে জরুরি জিনিসটির কথাই ভুলে গেছি আমরা।

সেটা কী?

জন্মদিনের গান, সোফি। হিল্ডার বয়স আজ পনেরো হলো।

আমারও।

হ্যাঁ, তোমারও। তাহলে গাওয়া যাক।

 দুজনেই উঠে দাঁড়িয়ে গাইতে শুরু করল।

হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ।

সাড়ে চারটা বাজে। লেকের প্রান্ত পর্যন্ত দৌড়ে গেল সোফি, তারপর নৌকো বেয়ে পৌঁছে গেল অপর পাড়ে। নৌকোটা নলখাগড়ার ঝোঁপ পর্যন্ত টেনে রাখল সে, তারপর পা চালাল বনের ভেতর দিয়ে।

রাস্তায় পৌঁছানোর পর হঠাৎ লক্ষ করল কী যেন নড়ছে গাছগুলোর মধ্যে। ছোট্ট রেড রাইভিংহুড বনের মধ্যে একা তার দাদীর বাড়ি খুঁজে বেড়াচ্ছে হয়ত, ভাবল সোফি, কিন্তু গাছের সেই মূর্তিটা আরো অনেক ছোট।

 কাছে এগোল সে। একটা পুতুলের চেয়ে বড় হবে না ওটা। বাদামি রঙের, পরনে একটা সোয়েটার।

ওটা যে একটা টেডি বিয়ার সে-কথা বুঝতে পেরে হাঁটা থামিয়ে একেবারে স্থির হয়ে গেল সোফি।

বনের মধ্যে কেউ একটা টেডি বিয়ার ফেলে রেখে যেতে পারে, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু এই টেডি বিয়ারটা জ্যান্ত আর তাছাড়া মনে হচ্ছে ভয়ানক ব্যস্ত।

হাই, সোফি বলে উঠল।

আমার নাম উইনি-দ্য-পুহ্, টেডি বিয়ারটা বলল। কিন্তু কপাল খারাপ, বনের মধ্যে পথ হারিয়ে ফেলেছি, নইলে এমনিতে দিনটা মন্দ ছিল না। কিন্তু তোমাকে তো আগে কখনো দেখিনি?

হয়ত আমি এখানে কখনো আসিনি, সোফি বলল। কিন্তু তারপরেও একশ একর জঙ্গলে তুমি তোমার বাড়িতে ফিরে যেতে পারো।

না, ঐ অংকটা খুব কঠিন। ভুলে যেয়ো না আমি ছোট্ট একটা ভালুক মাত্র, তাছাড়া খুব চালাকও নই।

তোমার কথা শুনেছি আমি।

আমার মনে হয় তুমি এলিস। ক্রিস্টোফার রবিন একদিন বলেছিল তোমার কথা। আমার ধারণা সেভাবেই সাক্ষাৎ হয়েছিল আমাদের। একটা বোতল থেকে তুমি এতো বেশি খেয়েছিলে যে ছোট হতেই থাকলে। কিন্তু তারপর অরেকটা বোতল থেকে খেলে তুমি, তখন আবার বড় হতে শুরু করলে। কী খাচ্ছ না খাচ্ছ সে-ব্যাপারে সাবধান থাকতে হয়। একবার আমি এতো বেশি খেয়ে ফেলেছিলাম যে আটকা পড়ে গিয়েছিলাম একটা খরগোশের গর্তে।

আমি এলিস না।

তুমি কে তাতে কিসসু এসে যায় না। জরুরি ব্যাপারটা হচ্ছে আমরা একটা কিছু। পেঁচা সে-কথাই বলেছিল, বেশ জ্ঞান-গম্যি ওর। একদিন সাদামাটা একটা রোদেলা দিনে সে বলেছিল সাত আর চারে বারো হয়। আইওর আর আমার দুজনেরই বড় বোকা বোকা লেগেছিল, কারণ অংক করা খুব কঠিন। তারচেয়ে বরং আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেয়া সহজ।

আমার নাম সোফি।

তোমার সঙ্গে পরিচিত হয়ে ভালো লাগল, সোফি। তা, যা বলছিলাম, তুমি নিশ্চয়ই এ-দিকটায় নতুন এসেছে। কিন্তু এবার তো এই ক্ষুদে ভালুককে যেতে হয়, কারণ পিগলেটকে খুঁজে বের হবে আমার। খরগোশ আর তার বন্ধুদের জন্যে দেয়া বিশাল একটা গার্ডেন পার্টিতে যাচ্ছি আমরা।

একটা থাবা নেড়ে বিদায় জানাল সে। এবার সোফি দেখতে পেল ভালুকটা তার অন্য থাবায় ছোট্ট একটা ভাজ করা কাগজ ধরে আছে।

ওটা কী? সোফি জিগ্যেস করল।

উইনি-দ্য-পুহ কাগজটা দেখিয়ে বলল: এটার জন্যেই তো পথ হারালাম আমি।

কিন্তু এটা তো নেহাতই এক টুকরো কাগজ।

না, এটা শুধু এক টুকরো কাগজ নয়, এটা হিল্ডা-থ্র-দ্য-লুকিং-গ্লাসের কাছে লেখা একটা চিঠি।

ও, তাহলে ওটা আমি নিতে পারি।

 তুমি কি সেই আয়নার মেয়েটা?

না, কিন্তু…

যার চিঠি সব সময়ই সেটা তার কাছে দিতে হয়। এই তো মাত্র কালই ক্রিস্টোফার রবিন সেটা শেখাতে বাধ্য হলো আমাকে।

কিন্তু হিল্ডাকে আমি চিনি।

তাতে কিছু আসে যায় না। কারো সঙ্গে যতই পরিচয় থাক তারপরেও তার চিঠি পড়া উচিত নয়।

আমি বলতে চাইছি যে চিঠিটা আমি হিল্ডাকে দিতে পারি।

সেটা অবশ্য একেবারে ভিন্ন ব্যাপার। এই নাও, সোফি। এই চিঠিটার হাত থেকে নিষ্কৃতি পেলে সম্ভবত আমি পিগলেটকেও পাবো। হিল্ডা-থু-দ্য-লুকিং-গ্লাসকে খুঁজে পেতে হলে প্রথমে তোমাকে বড়সড় একটা আয়না জোগাড় করতে হবে। কিন্তু সেটা খুব একটা সহজ কাজ নয় এখানে।

এই কথা বলে ছোট্ট ভালুকটা ভাঁজ-করা কাগজটা সফির হাতে ধরিয়ে দিয়ে ছোট্ট ছোট্ট পা ফেলে বনের ভেতর রওনা হয়ে গেল। সে দৃষ্টির আড়ালে চলে যেতে সোফি কাগজের টুকরোটার ভাজ খুলে সেটা পড়তে শুরু করল

প্রিয় হিল্ডা, এটা খুবই দুঃখজনক যে অ্যালবার্টো সোফিকে আরেকটা কথা বলেননি যে কান্ট একটি জাতিপুঞ্জ গঠনের পক্ষে জোর মত প্রকাশ করেছিলেন। তিনি তাঁর প্রবন্ধ চিরন্তন শাতি-তে লিখেছিলেন যে সব কটি দেশের একটি জাতিপুঞ্জের ছত্রছায়ায় একতাবদ্ধ হওয়া উচিত। ১৭৯৫ সালে প্রবন্ধটি প্রকাশিত হওয়ার ১২৫ বছর পর, প্রথম মহাযুদ্ধ শেষে গঠিত হয়েছিল জাতিপুঞ্জ। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর জাতিসংঘ সেটাকে প্রতিস্থাপিত করে। কাজেই এক অর্থে তুই বলতে পারিস যে কান্ট-ই ছিলেন জাতিসংঘের ধারণার জনক। কান্টের যুক্তি ছিল এই যে, মানুষের ব্যবহারিক প্রজ্ঞা-র দাবি হচ্ছে জাতিগুলো তাদের বুনো প্রকৃতি থেকে বেরিয়ে আসুক –যে বুনো প্রকৃতির কারণেই যুদ্ধ বিগ্রহ ঘটে– এবং শান্তি রক্ষায় চুক্তিবদ্ধ হোক। যদিও একটি জাতিপুঞ্জ প্রতিষ্ঠার পথ বিপ্নসংকুল, তারপরেও শান্তির সার্বজনীন ও দীর্ঘস্থায়ী সংরক্ষণ-এর জন্যে কাজ করা আমাদের কর্তব্য। এ-ধরনের একটি সংঘ প্রতিষ্ঠা ছিল কান্টের জন্যে একটি অতি দূরবর্তী লক্ষ্য। তুই অনেকটা বলতে পারিস যে ওটা ছিল দর্শনের পরম লক্ষ্য। এই মুহূর্তে আমি লেবাননে আছি। ভালোবাসা নিস, বাবা।

চিরকুটটা সোফি তার পকেটে পুরে বাড়ির দিকে চলতে থাকে। অ্যালবার্টো তাকে বনের মধ্যে এ-ধরনের দেখা-সাক্ষাতের ব্যাপারেই সতর্ক করে দিয়েছিলেন। কিন্তু সে তো আর সেই ছোট্ট টেডিটাকে হিল্ডা-গ্রু-দ্য-লুকিং-গ্লাসের পেছনে বনের ভেতর এক অন্তহীন সন্ধান চালিয়ে যেতে দিতে পারে না, তাই না?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *