২৩. বিয়ার্কলে
…এক জিপসি রমণীর কাছ থেকে দাদীর মায়ের কেনা একটা পুরনো জাদুর আয়না..
লিলেস্যান্ডের বাইরে বুড়ো ক্যাপ্টেনের বাড়ির চিলেকোঠায় ঘুম থেকে জেগে উঠল হিল্ডা মোলার ন্যাগ। ঘড়ির দিকে তাকাল সে। মাত্র ছটা বাজে, কিন্তু এরিমধ্যে আলোয় ভরে গেছে চারদিক। ভোরের সূর্যের উজ্জ্বল আলোয় ফরসা হয়ে গেছে ঘরটা।
বিছানা থেকে নেমে জানলার পাশে গিয়ে দাঁড়াল সে। মাঝপথে ডেস্কটার পাশে থেমে ক্যালেন্ডারের একটা পাতা ছিঁড়ল। বৃহস্পতিবার ১৪ই জুন, ১৯৯০। পাতাটা দলা-মোচড়া করে ছুঁড়ে দিল বাজে কাগজের ঝুড়িতে।
ক্যালেন্ডারটা এখন ঝকমক করে তার দিকে তাকিয়ে জানাচ্ছে আজ শুক্রবার, ১৫ই জুন, ১৯৯০। সেই কবে জানুয়ারীতে এই পৃষ্ঠাটার ওপর সে লিখে রেখেছিল পঞ্চদশ জন্মদিন। পনেরো তারিখে পনেরোয় পা দেয়াটায় খানিকটা বাড়তি বিশেষত্ব আছে বলে বোধ হলো তার। আর কখনো এমনটা হবে না।
পনেরো! আজই কি তার প্রাপ্তবয়স্ক জীবনের প্রথম দিন নয়? বিছানায় তখুনি আর ফিরে যেতে পারল না সে। তাছাড়া, গরমের ছুটির আগে আজই শেষ স্কুল। ছাত্র-ছাত্রীদের একটার সময় গির্জায় হাজির হতে হবে শুধু। তারচেয়ে বড় কথা, এক হপ্তার মধ্যেই লেবানন থেকে ফিরছেন বাবা। তিনি কথা দিয়েছেন মিডসামার ঈ এর জন্যে বাড়ি আসবেন।
জানলার পাশে দাঁড়িয়ে বাগানের ওপর দিয়ে দৃষ্টি ছড়িয়ে দিল সে ছোট্ট লাল বোটহাউসটার পেছনে নিচের ডকটার দিকে। গরমের সময় যে-মোটবোটটা বের করা হয় সেটা এখনো বের করা হয়নি, কিন্তু পুরনো দাঁড়টানা নৌকোটা ডকে বাধা আছে। গতকাল রাতের প্রবল বৃষ্টির পর এখন হিল্ডাকে ওটার পানি সেচে ফেলবার কথা মনে রাখতে হবে।
ছোট্ট একটা উপসাগরের মতো জায়গাটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার মনে পড়ে গেল তার বয়স যখন ছবছর তখন সে একবার নৌকোটায় চড়ে বসে একা একাই বৈঠা চালিয়ে চলে গিয়েছিল ওখানটায়। হঠাৎ নৌকোটা উল্টে যায়, তখন সে অনেক কষ্টে সাঁতরে তীরে উঠে আসে। ভেজা চুপচুপে অবস্থায় ঘন ঝোপের বেড়া ঠেলে হেঁটে এসেছিল সে। বাগানে পৌঁছে সে যখন বাড়ির দিকে তাকিয়ে ছিল তখন তার মা দৌড়ে এসেছিলেন তার দিকে। পরিত্যক্ত অবস্থায় নৌকো আর দুটো বৈঠাই ভাসছিল তখন সেই উপসাগরটায়। এখনো সে মাঝে মাঝে সেই নৌকোটার স্বপ্ন দেখে, নিজে নিজেই ভেসে বেড়াচ্ছে সেটা পরিত্যক্ত অবস্থায়। বিব্রতকর একটা অভিজ্ঞতা ছিল সেটা। বাগানটায় গাছ-গাছালির খুব যে একটা বাড়-বাড়ন্ত তা নয়, তাছাড়া ভালো করে দেখাশোনাও করা হয় না সেটার। তবে বাগানটা বিশাল আর সেটা হিল্ডার। প্রবীণ একটা আপেল গাছ আর কিছু কার্যত নিষ্ফলা ফলের গাছের ঝোঁপ কোনোমতে টিকে গেছে শীতের প্রবল ঝড়ের হাত থেকে। গ্যানিট পাথরগুলো আর ঝোপের মধ্যেখানে দাঁড়িয়ে আছে পুরনো গ্লাইডারটা। ভোরের উজ্জ্বল আলোয় বেজায় স্নান আর অসহায় লাগছে সেটাকে। আরো বেশি লাগছে এই কারণে যে ওটার গদি খুলে ফেলা হয়েছে। সম্ভবত মা গতকাল শেষরাতে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে এসে ওগুলোকে বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা করেছেন।
তাছাড়া আছে বার্চ গাছ– bigrketreer– বিশাল বাগানটার চারপাশ ঘিরে। তাতে সবচেয়ে খারাপ ঝড়-ঝাঁপটার হাত থেকে অন্তত খানিকটা সুরক্ষা পায় বাগানটা। এই গাছগুলোর কারণেই একশো বছরেরও বেশি আগে বিয়ার্কলে নাম রাখা হয়েছিল বাড়িটার।
নতুন শতাব্দী শুরুর কয়েক বছর আগে হিল্ডার পিতামহের পিতা তৈরি করেছিলেন বাড়িটা। শেষ দিককার লম্বা পালতোলা জাহাজগুলোর একটার ক্যাপ্টেন ছিলেন তিনি। অনেকেই তাই এটাকে ক্যাপ্টেনের বাড়ি বলতে শুরু করে।
গতকাল সন্ধ্যার শেষ দিকে হঠাৎ করে শুরু হওয়া প্রবল বৃষ্টির চিহ্ন আজ সকালেও বাগানে দিব্যি দেখা যাচ্ছে। বজ্রপাতের আওয়াজে মাঝে মাঝেই ঘুম ভেঙে জেগে উঠছিল হিল্ডা। কিন্তু আজ আকাশে মেঘের চিহ্নটুকু নেই।
এমন একটা গ্রীষ্মকালীন ঝড়ের পর সব কিছু একেবারে নতুনের মতো লাগছে। কয়েক হপ্তা ধরে আবহাওয়াটা বেশ গরম আর শুকনো ছিল, বার্চ গাছের পাতার ডগা হলুদ হতে শুরু করেছিল। এখন মনে হচ্ছে যেন গোটা জগত্তাই নতুন করে ধোয়া হয়েছে। মনে হচ্ছে, এমনকী তার শৈশবও যেন ধুয়ে মুছে নিয়ে গেছে ঝড়টা।
বসন্তের মুকুল যখন ফোটে, সত্যি, ব্যথা আছে তাতে… এক সুইডিশ কবি এরকম একটা কথা বলেছিলেন না? নাকি মহিলা ফিনিশ?
দাদী-র পুরনো ড্রেসারটার ওপর ঝুলিয়ে রাখা ঝুলে থাকা ভারি, পেতলের আয়নাটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল হিল্ডা।
সে কি সুন্দরী? আর যাই হোক, কুৎসিত নয় সে। সম্ভবত সে মাঝামাঝি কিছু একটা…
লম্বা উজ্জ্বলবর্ণ চুল তার। হিল্ডা সব সময়ই চেয়েছে তার চুল যেন আরো খানিকটা উজ্জ্বল বা আরো একটু কালো হয়। এই মাঝামাঝি রঙটা কোনো কাজের না। অন্যদিকে ভালো যে দিক তা হলো তার চুলের এই নরম-সরম কোঁকড়া ব্যাপারটা। তার বন্ধুদের অনেকেই তাদের চুল একটু কোঁকড়া করার জন্যে কী প্রাণপাত চেষ্টাটাই না করে, কিন্তু হিল্ডার চুল প্রকৃতিগতভাবেই কোঁকড়া। আরেকটা ভালো দিক হচ্ছে, তার মনে হলো, তার গভীর সবুজ চোখ দুটো। হিল্ডার চাচা চাচীরা তাকে দেখার জন্যে ঝুঁকে পড়ে প্রায়ই বলতেন, চোখ দুটো কি আসলেই সবুজ
সোফি ভাবতে লাগল যে-ছবিটা সে খুঁটিয়ে দেখছে সেটা কি কোনো বালিকার না কোনো তরুণী রমণীর। তার মনে হলো কারোরই না। দেহটা হয়ত বেশ নারীসুলভ। কিন্তু মুখটা তাকে মনে করিয়ে দিল একটা কাঁচা আপেলের কথা।
পুরনো এই আয়নাটায় এমন একটা কিছু আছে যা তাকে তার বাবার কথা মনে করিয়ে দেয়। একসময় ওটা স্টুডিওতে ঝোলানো থাকত। বোটহাউসের ওপরে স্টুডিওটা ছিল তার বাবার একাধারে লাইব্রেরী, লেখা-জোকা বিষয়ক ওয়ার্কশপ আর বিশ্রামের স্থান। অ্যালবার্ট– বাবা বাড়ি থাকলে তাকে হিল্ডা এই নামেই ডাকে– সব সময়ই চেয়েছেন গুরুত্বপূর্ণ কিছু একটা লিখতে। একবার তিনি একটা উপন্যাস লেখার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সেটা আর শেষ করা হয়ে ওঠেনি। মাঝে মধ্যে একটা জাতীয় সাময়িকীতে তার কিছু কবিতা আর দ্বীপপুঞ্জটার কিছু স্কেচ ছাপা হয়। ওগুলো ছাপা হলে প্রতিবারই খুব গর্ব হয় হিল্ডার। অ্যালবার্ট ন্যাগ। লিলেস্যান্ড ভাষায় এর কী যেন একটা অর্থ আছে। তার দাদার বাবার নামও ছিল অ্যালবার্ট।
আয়নাটা। বেশ কয়েক বছর আগে তার বাবা একবার এই নিয়ে ঠাট্টা করেছিলেন যে পেতলের এই আয়নাটা ছাড়া অন্য কোনো আয়নার সামনে কেউ নিজের প্রতিবিম্বটাকে একই সঙ্গে দুই চোখে চোখ টিপতে পারে না। এটা একটা ব্যতিক্ৰম কারণ এটা এক জিপসি রমণীর কাছ থেকে দাদীর মায়ের কেনা একটা জাদুর আয়না, তার বিয়ের ঠিক আগে কিনেছিলেন তিনি ওটা।
বহুদিন চেষ্টা করেছে হিল্ডা, কিন্তু দুই চোখ দিয়ে নিজেকে চোখ টেপার ব্যাপারটা যেন নিজের ছায়ার কাছ থেকে পালাবার মতোই অসম্ভব। শেষ অব্দি, পারিবারিক পুরনো তাঁটা তাকে দেয়া হয়েছিল রাখার জন্যে। এই এতো বছর ধরে মাঝে মাঝেই সে চেষ্টা করে আসছে অসম্ভব ঐ কৌশলটা শেখার।
এটা আশ্চর্যের কিছু নয় যে আজ সে একটু চিন্তিত। আর এটাতেও অস্বাভাবিক কিছু নেই যে সে আজ নিজের মধ্যেই মগ্ন। পনেরো বছর বয়স…
হঠাৎ বিছানার পাশে রাখা টেবিলটার দিকে তাকাল সে। বড়সড় একটা প্যাকেট দেখা যাচ্ছে সেখানে। সুন্দর নীল একটা মোড়ক দিয়ে প্যাকেটটা ঢাকা, লাল রেশমি ফিতে দিয়ে বাঁধা। নিশ্চয়ই জন্মদিনের উপহার ওটা।
এটাই কি তাহলে সেই উপহারটা? বাবার তরফ থেকে সেই বিশাল বড় উপহার যা নিয়ে এতো গোপনীয়তা? লেবানন থেকে পাঠানো তার কার্ডগুলোতে এ-ব্যাপারে কত রহস্যময় ইঙ্গিতই না দিয়েছেন তিনি। কিন্তু নিজের ওপর কড়া সেন্সরশীপ আরোপ করেছিলেন তিনি।
তিনি লিখেছিলেন উপহারটা এমন যা দিনে দিনে আরো বড় হয়ে ওঠে। এরপর তিনি সেই মেয়েটার কথা লিখেছিলেন যার সঙ্গে শিগগিরই দেখা হবে হিল্ডার। আরো লিখেছিলেন যে তিনি হিল্ডাকে পাঠানো সব কার্ডের কপি পাঠিয়েছেন সেই মেয়েটাকে। রহস্যটার জট খুলতে কিছু সূত্রের জন্যে বেশ কয়েকবার মাকেও চেপে ধরেছিল সে, কিন্তু তার মা-ও কিছুই জানতেন না এ ব্যাপারে।
সবচেয়ে খাপছাড়া সূত্রটা ছিল এই যে, উপহারটা অন্য লোকজনের সঙ্গে ভাগ করে নেয়া যাবে। খামোখাই কি তিনি জাতিসংঘে চাকরি করছেন। তার বাবার মাথায় যদি একটা পোকা-ও থেকে– তার মাথায় আসলে অনেক পোকা– তাহলে সেটা হচ্ছে জাতিসংঘ কাজ করবে একটা বিশ্ব সরকার হিসেবে। তার কার্ডে তিনি একবার এই ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন যে জাতিসংঘ যেন একদিন সত্যি সত্যিই গোটা মানবজাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারে।
তার মা প্যাস্ট্রি আর নরওয়ের একটা পতাকা নিয়ে ওপরে উঠে এসে তার উদ্দেশে হ্যাপি বার্থ ডে টু ইয়ু গানটা গাওয়ার আগে প্যাকেটটা ভোলা কি উচিত, হবে? নিশ্চয়ই ঠিক সেজন্যেই রাখা হয়েছে ওটা?
ধীর পায়ে কামরাটা পেরিয়ে হেঁটে গিয়ে প্যাকেটটা তুলল সে। বেশ ভারি তো! ট্যাগটা খুঁজে পেল সে হিল্ডার পঞ্চদশ জন্মদিন উপলক্ষে, বাবা।
বিছানায় বসে সাবধানে খুলে ফেলল সে লাল রেশমি ফিতাটা। তারপর খুলল নীল মোড়কটা।
বিশাল একটা রিং বাইন্ডার।
এটাই কি তার উপহার? এটাই কি পঞ্চদশ-জন্মদিনের সেই উপহার যেটা নিয়ে এতো ব্যাপার হয়ে গেল? যে-উপহার দিন দিন বড় হয় আর লোকজনের সঙ্গে ভাগ করে নেয়া যায়?
চট করে নজর বুলাতে দেখা গেল রিং বাইন্ডারটা টাইপ করা পৃষ্ঠায় ভর্তি। হিল্ডা চিনতে পারল, লেখাগুলো তার বাবার টাইপরাইটারেরই, যেটা তিনি সঙ্গে করে লেবানন নিয়ে গেছেন।
তিনি কি তার জন্যে পুরো একটা বই লিখেছেন তাহলে?
প্রথম পৃষ্ঠায় বড় বড় করে হাতে লেখা নামটা, সোফির জগৎ। সেই পৃষ্ঠারই বেশ খানিকটা নিচে একটা কবিতার দুটো লাইন টাইপ করা:
মাটির কাছে সূর্যের আলো যেমন,
সত্যিকারের আলোকসম্পাত-ও মানুষের কাছে তেমন।
-এন.এফ.এস, গুডভিগ
পরের পৃষ্ঠায়, প্রথম অধ্যায়ের শুরুতে চলে এলো হিল্ডা। অধ্যায়টার নাম দেয়া হচ্ছে নন্দনকানন। বিছানায় উঠে আরাম করে বসল হিল্ডা, তারপর রিং বাইন্ডারকে হাঁটুর ওপর রেখে শুরু করল পড়তে।
.
স্কুল থেকে বাসায় ফিরছে সোফি অ্যামুন্ডসেন। প্রথমে, খানিকটা পথ, জোয়ানার সঙ্গে হাঁটছিল সে। রোবট নিয়ে কথা বলছিল ওরা। জোয়ানার ধারণা, মানব-মস্তিষ্ক উন্নত একটা কম্পিউটারের মতো। সোফি ঠিক সায় দিতে পারছিল না ওর কথায়। মানুষ নিশ্চয়ই স্রেফ টুকরো হার্ডওয়্যার নয়?
সব কিছু ভুলে পড়ে চলল হিল্ডা, সে এমনকী এ-কথাও ভুলে গেল যে আজ তার জন্মদিন। পড়ার ফাঁকে ছোট ছোট দুএকটা চিন্তা ঢুকে পড়তে থাকল লাইনগুলোর মধ্যে: বাবা কি একটা বই লিখে ফেলেছে? শেষ পর্যন্ত কি বাবা সেই গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাসটা লেবাননে বসে শুরু করে শেষও করে ফেলেছে? বাবা প্রায়ই অভিযোগ করত দুনিয়ার ওই প্রান্তে সময় যেন ফুরোতেই চায় না।
সোফির বাবাও বাড়ি থেকে অনেক দূরে থাকেন। সম্ভবত সোফিই সেই মেয়ে যার সঙ্গে ধীরে ধীরে পরিচয় হবে তার…
একদিন যে সে মারা যাবে এই বিষয়ে মনের মধ্যে একটা তীব্র অনুভূতি সৃষ্টি করার মাধ্যমেই কেবল সে উপলব্ধি করতে পারল বেঁচে থাকাটা কী অসাধারণ রকমের একটা ব্যাপার।…এই পৃথিবী কোথা থেকে এলো?…কোনো একটা পর্যায়ে কোনো একটা কিছু নিশ্চয়ই শূন্য থেকে সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু সেটা কি সম্ভব? সেটা কি ওই ব্যাপারটার মতোই অসম্ভব নয় যে আগাগোড়াই পৃথিবীর অস্তিত্ব ছিল?
পড়তেই থাকল সোফি। লেবানন থেকে সোফি অ্যামুন্ডসেন একটা কার্ড পেয়েছে পড়ে হতবাক হয়ে গেল সে: হিল্ডা মোলার ন্যাগ। প্রযত্নে, সোফি অ্যামুন্ডসেন, ৩ ক্লোভার ক্লোজ।…
প্রিয় হিল্ডা, শুভ ১৫শ জন্মদিন। আশা করি তুই বুঝতে পারবি আমি তোকে এমন একটা উপহার দিতে চাই যা তোকে বড় হয়ে উঠতে সাহায্য করবে। সোফির প্রযত্নে কার্ডটা পাঠানোর জন্যে দুঃখিত। কিন্তু এটাই ছিল সবচেয়ে সহজ পথ। বাবার শুভেচ্ছা রইল।
জোকার! হিল্ডা জানে তার বাবা বরাবরই একটু চালাক-চতুর, কিন্তু আজকে তিনি সত্যিই একেবারে অবাক করে দিয়েছেন তাকে। কার্ডটা প্যাকেটের সঙ্গে জুড়ে দেবার বদলে তিনি সেটা বইটাতে লিখে দিয়েছেন।
জন্মদিনের একটা কার্ড একজন বাবা সোফির নামে পাঠাবেন কেন, যখন সেটা নিশ্চিতভাবেই অন্য জায়গায় যাওয়ার কথা? এ আবার কেমনতর বাবা যিনি তার নিজের মেয়েকে ধোকা দেন তার জন্মদিনের কার্ডটা ইচ্ছে করে ভুল ঠিকানায় পাঠিয়ে দিয়ে? এটা কী করে সবচেয়ে সহজ পথ হয়? আর সবচেয়ে বড় কথা, সে কী করে খুঁজে পাবে হিল্ডা নামের এই মেয়েটাকে?
তাইতো, কী করে পাবে?
কয়েকটা পাতা উল্টে দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পড়তে শুরু করল সে। টপ হ্যাট। শিগগিরই সে সোফিকে এক রহস্যময় লোকের লেখা লম্বা চিঠিটাতে চলে এলো।
আমরা কেন পৃথিবীতে রয়েছি তা জানার ব্যাপারে উৎসাহী হওয়াটা ডাকটিকেট সংগ্রহের মতো কোনো খেয়ালি বিষয় নয়। যারা এ-প্রশ্ন করছেন তারা এমন এক বিতর্কে অংশ নিচ্ছেন যে-বিতর্ক মানুষ এই গ্রহে বসবাস শুরু করার পর থেকেই চলে আসছে।
সোফি একেবারে অবসন্ন হয়ে পড়ে। হিল্ডারও সেই একই অবস্থা। বাবা যে শুধু তার পঞ্চদশ জন্মদিনের জন্য একটা বই লিখেছেন তা নয়, তিনি একটা অদ্ভুত আর সুন্দর বই লিখেছেন।
তো, সংক্ষেপে ব্যাপারটা হচ্ছে: একটা টপ হ্যাঁটের ভেতর থেকে সাদা একটা খরগোশ বের করা হয়েছে। খরগোশটা যেহেতু বিশাল বড় তাই খেলাটা খেলতে বেশ কয়েক বিলিয়ন বছর লেগেছে। খরগোশটার মিহি মসৃণ রোমের ডগায় জন্ম নিয়েছে সমস্ত মানুষ আর সেখানে বসে তারা ভাবছে কী করে অসম্ভব চাতুর্যপূর্ণ এই কাজটি সম্ভব হলো। কিন্তু তাদের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা সেই রোমের আরো গভীরে ঢুকে যেতে থাকে। তারপর সেখানেই থাকে তারা….
খরগোশের লোমের গহীন ভেতরে নিজের জন্যে একটা আরামদায়ক জায়গা খুঁজে নেবার পর্যায়ে এসে পড়ার অনুভূতি যে কেবল সোফিরই হয়েছে তাই নয়। আজ হিল্ডার পঞ্চদশ জন্মদিন এবং তার মনে হলো কোন দিকে সে হামাগুড়ি দেবে সে-ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় এসে গেছে।
গ্রীক প্রকৃতিবাদী দার্শনিকদের কথা পড়ল সে। হিল্ডা জানে তার বাবা দর্শন সম্পর্কে আগ্রহী। দর্শনকে স্কুলের একটা নিয়মিত বিষয় করে নেয়া উচিত এই প্রস্তাব করে পত্রিকার একটা লেখা-ও লিখেছিলেন তিনি। লেখাটার শিরোনাম ছিল, দর্শন কেন স্কুলের পাঠ্যসূচীর অন্তর্ভূক্ত হওয়া উচিত? প্রসঙ্গটা তিনি এমনকী হিল্ডার ক্লাসের পিটিএ মিটিং-এও তুলেছিলেন। তাই নিয়ে হিল্ডা কী যে অস্বস্তিতে পড়েছিল।
ঘড়ির দিকে তাকাল সে। সাড়ে সাতটা বাজে। সম্ভবত আধ ঘণ্টার মধ্যেই সকালের নাশতার ট্রে-টা নিয়ে হাজির হবেন তার মা, ভাগ্যিস, কারণ এই মুহূর্তে সে সোফি আর রাজ্যের সব দার্শনিক প্রশ্নের মধ্যে ডুবে আছে। ডেমোক্রিটাস শিরোনামের পরিচ্ছেদটায় চলে এসেছে সে। গোড়াতেই, চিন্তা করার জন্যে একটা প্রশ্ন দেয়া হয়েছে সোফিকে: লেগো কেন পৃথিবীর সবচাইতে অসাধারণ খেলনা? এরপর, ডাকবাক্সের ভেতর বড়সড় একটা খাম পেল সে।
ডেমোক্রিটাস তাঁর পূর্বসূরীদের সঙ্গে এই মর্মে একমত প্রকাশ করেছিলেন যে কোনো কিছু আসলেই বদলে যাওয়ার কারণে প্রকৃতির পরিবর্তনগুলো ঘটে না। কাজেই তিনি অনুমান করলেন যে সবকিছুই ক্ষুদে ক্ষুদে অদৃশ্য ব্লক দিয়ে তৈরি আর এই ব্লকগুলোর প্রত্যেকটিই শাশ্বত ও অপরিবর্তনীয়। ক্ষুদ্রতম এই এককগুলোকে ডেমোক্রিটাস বললেন পরমাণু (atom)।
সোফি যখন তার বিছানার নিচে লাল রেশমি স্কার্ফটা পেল তখন চটে উঠল হিল্ডা। আচ্ছা, তাহলে ওখানে ছিল ওটা! কিন্তু একটা স্কার্ফ কী করে গল্পের মধ্যে হারিয়ে যেতে পারে? হারাতে হলে একটা জায়গাতো থাকতে হবে…।
সক্রেটিসকে নিয়ে লেখা পরিচ্ছেদটা শুরু হয়েছে খবরের কাগজে সোফির লেবাননে জাতিসংঘের নওয়েজিয় ব্যাটেলিয়ন সম্পর্কে কিছু একটা পড়ার কথা দিয়ে। একেবারে আদি ও অকৃত্রিম বাবা! নরওয়ের লোকেরা যে জাতিসংঘ বাহিনীর শান্তিরক্ষামূলক কাজ-কর্মে যথেষ্ট উৎসাহী নয় এ-নিয়ে বাবার চিন্তার অন্ত নেই। কিন্তু কেউ যদি উৎসাহী না হয়, তাহলে অন্তত সোফিকে তা হতেই হবে। তাহলেই তিনি সে-কথা তাঁর গল্পে লিখতে পারবেন, ফলে মিডিয়ার খানিকটা মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারবেন।
সোফির কাছে লেখা দর্শন শিক্ষকের চিঠিতে পুনঃপুনশ্চ অংশটা পড়ে মুচকি না হেসে পারল না হিল্ডা।
কোথাও যদি একটা লাল রেশমি স্কার্ফ পাও, দয়া করে সেটা যত্নের সঙ্গে রেখো। মাঝে মধ্যে মানুষের ব্যক্তিগত জিনিস-পত্ৰ অদল-বদল হয়ে যায়। বিশেষ করে স্কুলে বা সে-রকম জায়গায় আর এটা দর্শনের একটা স্কুল তো। বটেই।
সিঁড়িতে মায়ের পায়ের আওয়াজ শুনতে পেল হিল্ডা। তিনি দরজায় টোকা দেবার আগেই এথেন্সের ভিডিওটা সোফি তার গোপন ডেরায় আবিষ্কার করার অংশটা পড়তে শুরু করে দিয়েছে হিল্ডা।
হ্যাপি বার্থ ডে…তার মা মাঝ সিঁড়িতেই গাইতে শুরু করেছেন।
ভেতরে এসো, বলে উঠল হিল্ডা, যে-প্যাসেজটায় দর্শন শিক্ষক অ্যাক্রোপলিস থেকে সরাসরি সোফির সঙ্গে কথা বলছেন তার মাঝখানে রয়েছে সে তখন। কালো সযত্নে ছাঁটা দাড়ি আর একটা নীল বেরে-তে তাকে অবিকল হিল্ডার বাবার মতো লাগছে।
হ্যাপি বার্থ ডে, হিল্ডা!
উম্।
হিল্ডা?
ওখানে রেখে যাও না।
তুই কি…?
দেখতেই তো পারছ আমি পড়ছি।
ভেবে দেখ, পনেরোয় পড়েছিস তুই।
তুমি কখনো এথেন্সে গিয়েছে, মা?
না, কেন বলছিস?
পুরনো সেই দালানগুলো আজো দাঁড়িয়ে আছে, ব্যাপারটা কি আশ্চর্য না! সত্যি বলতে কি ২৫০০ বছরের পুরনো ওগুলো। ভালো কথা সবচেয়ে বড়টার নাম ভার্জিনস প্লেস।
তুই তোর বাবার প্রেজেন্টটা খুলেছিস নাকি?
কোন প্রেজেন্ট?
তুই মুখ তুলে একবার তাকাবি, হিল্ডা? পুরোপুরি ঘোরের মধ্যে আছিস তুই।
বিশাল রিং বাইন্ডারটা কোলের ওপর ছেড়ে দিল হিল্ডা।
ট্রে-টা হাতে নিয়ে বিছানার ওপর ঝুঁকে আছেন তার মা। সেটার ওপর কয়েকটা জ্বলন্ত মোমবাতি, মাখন দেয়া রোল শ্রিম্প আর সালাদসহ মাখন লাগানো রোল আর সোডা। সেই সঙ্গে ছোট্ট একটা প্যাকেটও রয়েছে। এক বাহুর নিচে একটা পতাকা নিয়ে দুই হাতে ট্রে-টা ধরে অপ্রস্তুতভাবে দাঁড়িয়ে আছেন তার মা।
ও, মা, অনেক ধন্যবাদ তোমাকে। এ-সব এনে খুব ভালো করেছ, কিন্তু আমি সত্যি-ই ব্যস্ত।
তাহলে আর স্কুলে গিয়ে কাজ নেই তোর, একটা পর্যন্ত এখানেই বসে থাক।
কেবল তখনই হিল্ডার মনে পড়ল সে কোথায় রয়েছে। ততক্ষণে তার মা ট্রে-টা নামিয়ে রেখেছেন বেডসাইড টেবিলের ওপর।
দুঃখিত, মা। পুরোপুরি ডুবে গিয়েছিলাম আমি এটার মধ্যে।
ও কী লিখেছে রে, হিল্ডা? তোর মতোই অবাক হয়ে গেছি আমি। বেশ কয়েক মাস ধরে তো তোর বাবার কাছ থেকে সহজ কোনো কথাবার্তা আশা করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
কোনো একটা কারণে অস্বস্তির একটা বোধ হলো সোফির। ও, এটা, তেমন কিছু না, স্রেফ গল্প একটা।
গল্প?
হ্যাঁ, গল্প আর সেই সঙ্গে দর্শনের ইতিহাস বা সে-রকম একটা কিছু।
আমার প্যাকেটটা বুঝি খুলবি না তুই?
অশোভনতা দেখাতে চাইল না হিল্ডা, কাজেই তক্ষুণি মায়ের উপহারটা খুলল সে। দেখা গেল সেটা একটা সোনার ব্রেসলেট।
দারুণ সুন্দর তো, মা। অনেক অনেক ধন্যবাদ।
বিছানা থেকে নেমে এসে মাকে জড়িয়ে ধরল হিল্ডা।
মা-মেয়েতে বসে গল্প করল তারা খানিকক্ষণ।
তারপর সোফি বলল, বইটাতে আবার ফিরে যেতে হচ্ছে, মা। এই মুহূর্তে সে ঠিক অ্যাক্রোপলিসের ওপর দাঁড়িয়ে আছে?
কে?
আমার কোনো ধারণা নেই। সোফির-ও নেই। এটাই আসল কথা।
ঠিক আছে, আমাকেও কাজে যেতে হচ্ছে। কিছু খেয়ে নিতে ভুলিস না। তোর কাপড়-চোপড় নিচে একটা হ্যাঁঙ্গারের ওপর আছে।
শেষ পর্যন্ত তার মা সিঁড়ি বেয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। সোফির দর্শন শিক্ষকও তাই করলেন অ্যাক্রোপলিস থেকে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলেন তিনি, তারপর এথেন্সের পুরনো স্কোয়্যারের ওখানটায় হাজির হওয়ার খানিক আগে দাঁড়ালেন গিয়ে অ্যারিওপেগস পাহাড়টার ওপর।
পুরনো ভবনগুলো হঠাৎ ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে দাঁড়িয়ে যেতে গা কেঁপে উঠল হিল্ডার। তার বাবার প্রিয় চিন্তাগুলোর একটা ছিল জাতিসংঘের সমস্ত দেশ মিলে এথেন্সের স্কোয়্যারটার একটা অবিকল প্রতিরূপ তৈরিতে সাহায্য করা। সেটাই হবে দর্শন আর নিরস্ত্রীকরণ সংক্রান্ত আলাপ-আলোচনার একটা ফোরাম। তিনি মনে করতেন যে এ-রকম বিশাল একটা প্রজেক্ট-ই বিশ্ব ঐক্য সৃষ্টি করবে। যে যাই বলুক, আমরা একই সঙ্গে অয়েল রিগ আর চাঁদে যাওয়ার রকেট দুটোই তৈরি করতে পেরেছি।
এরপর পড়ল সে প্লেটোর কথা। স্যা এক তীব্র আকুলতা অনুভব করে ভালোবাসার ডানায় ভর করে ভাব-জগতে তার নিজের আবাসে ফিরে যাওয়ার জন্যে। দেহের শেকল থেকে মুক্তি পাবার জন্যে আঁকুপাঁকু করতে থাকে সে…
বেড়ার ভেতর দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে এসে হার্মেসের পিছু নিয়েছিল সোফি। কিন্তু হামেস তাকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। প্লেটো সম্পর্কে পড়ার পর সোফি বনের আরো ভেতরে ঢুকে ছোট্ট লেকটার পাশে লাল কেবিনটার কাছে চলে গিয়েছিল। ভেতরে বিয়ার্কলের একটা ছবি ঝুলছিল। বর্ণনা থেকে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে এটা হিল্ডাদেরই বিয়ার্কলে। তবে সেই সঙ্গে ওখানে বার্কলে নামের একটা লোকের প্রতিকৃতিও ছিল। কী অদ্ভুত!
ভারি রিং বাইন্ডারটা বিছানায় এক পাশে সরিয়ে রেখে বুক শেলফটার কাছে গিয়ে চতুর্দশ জন্মদিনে উপহার পাওয়া তিন ভলমের বিশ্বকোষটায় লোকটির খোঁজ করল হিল্ডা। এই তো পাওয়া গেছে-বার্কলে!
বার্কলে, জর্জ, ১৬৮৫-১৭৫৩, ইংলিশ দার্শনিক, ক্লয়ন-এর বিশপ। মানব মনের বাইরে কোনো বস্তুজগতের অস্তিত্ব অস্বীকার করেন। আমাদের ইন্দ্রিয়গত প্রত্যক্ষণ ঈশ্বর এর কাছ থেকে আসে। প্রধান রচনাঃ আ ট্রীটিজ কনসানিং দ্য প্রিন্সিপল অভ হিউম্যান নলেজ(১৭১০)।
.
ঠিকই, বিষয়টা আসলেই অদ্ভুত। বিছানায় তার সেই রিং বাইভারটার কাছে ফিরে যাওয়ার আগে দাঁড়িয়ে কয়েক মুহূর্ত ভাবল হিল্ডা।
এক অর্থে তার বাবাই ছবি দুটো দেয়ালে টাঙিয়েছেন। দুটো নামের মধ্যে মিল ছাড়া এদের মধ্যে অন্য আর কোনো সাদৃশ্য আছে?
বার্কলে ছিলেন একজন দার্শনিক যিনি মানব মনের বাইরে কোনো বস্তুজতের অস্তিত্ব অস্বীকার করেছিলেন। মানতেই হবে, কথাটা রীতিমত অদ্ভুত। কিন্তু সেই সঙ্গে এটাও ঠিক যে এ-ধরনের দাবি খুব সহজে উড়িয়ে দেয়া যায় না। অন্তত সোফির প্রসঙ্গে তো কথাটা খুবই প্রযোজ্য। শত হলেও, হিল্ডার বাবা-ই তার ইন্দ্রিয়গত প্রত্যক্ষণের জন্যে দায়ী।
যাই হোক, আরো পড়লে আরো জানা যাবে। যেখানটায় সোফি সেই মেয়েটাকে আবিষ্কার করে যে দুই চোখ দিয়েই চোখ টেপে সেখানটায় এসে হিল্ডা রিং বাইন্ডার থেকে মুখ তুলে মুচকি হাসল। অন্য মেয়েটা যেন এই কথা বলতে সোফিকে চোখ টিপল যে আমি তোমাকে দেখতে পাচ্ছি, সোফি। আমি এখানে, অন্য দিকটাতে।
কেবিনে সোফি সবুজ ওয়ালেটটাও পেল– টাকা-পয়সা আর অন্যান্য সব কিছু শুদ্ধ! ওটা কী করে ওখানে গেল?
অবাস্তব! দুই এক সেকেন্ডের জন্য হিল্ডা সত্যিই বিশ্বাস করে ফেলল যে সোফি সত্যিই পেয়েছে ওয়ালেটটা। কিন্তু তারপর সে ভাবতে শুরু করল পুরো ব্যাপারটা সোফির কাছে কী রকম ঠেকেছিল। নিশ্চয়ই রীতিমত রহস্যময় আর ভৌতিক।
এই প্রথমবারের মতো সোফির মুখোমুখি হওয়ার একটা প্রবল ইচ্ছা অনুভব করল হিল্ডা। পুরো ব্যাপারটার সব কথা তাকে খুলে বলার ইচ্ছে হলো তার।
কিন্তু সোফিকে এখন হাতেনাতে ধরা পড়া এড়াতে বেরিয়ে আসতে হবে কেবিনটা থেকে। লেকের নৌকোটা অবশ্য ভেসে ভেসে অনেক দূরে চলে গেছে। (হিল্ডার বাবা কী আর হিল্ডাকে পুরনো সেই গল্পটা মনে না করিয়ে দিয়ে পারেন)
এক মুঠো সোডা মুখে পুরে দিয়ে রোলটাতে একটা কামড় বসাল হিল্ডা অতি যত্নশীল অ্যারিস্টটলের কথা লেখা চিঠিটা পড়তে পড়তে, যিনি প্লেটোর তত্ত্বগুলোর সমালোচনা করেছিলেন।
অ্যারিস্টটল এই বলে মন্তব্য করেছিলেন যে চেতনায় এমন কোনো কিছু নেই যা পঞ্চ ইন্দ্রিয় প্রথমে প্রত্যক্ষ করেনি। প্লেটো হলে বলতেন প্রাকৃতিক জগতে এমন কিছু নেই যা প্রথমে ভাব-জগতে ছিল না। অ্যারিস্টটল মনে করতেন এভাবে প্লেটো আসলে জিনিস-পত্রের সংখ্যা দ্বিগুণ করে ফেলেছিলেন।
হিল্ডার জানা ছিল না যে অ্যারিস্টটলই আবিষ্কার করেছিলেন প্রাণী, উদ্ভিদ বা খনিজ-এর খেলা।
প্রকৃতির ঘরের সব কিছু গুছিয়ে ফেলতে চেয়েছিলেন অ্যারিস্টটল। তিনি দেখাতে চেয়েছিলেন যে প্রকৃতির সব কিছুই বিভিন্ন শ্রেণী বা উপশ্রেণীর অন্তর্ভূক্ত।
নারী সম্পর্কে অ্যারিস্টটলের দৃষ্টিভঙ্গির কথা পড়ে একই সঙ্গে বিরক্ত আর হতাশ হলো সে। ভাবো একবার, এতো অসাধারণ এক দার্শনিক অথচ কী রাম গর্দভ।
নিজের ঘর পরিষ্কার করায় সোফিকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন অ্যারিস্টটল। আর সেখানে, অন্যান্য জিনিসের মধ্যে সে হিল্ডার ক্লজেট থেকে মাস খানেক আগে হারিয়ে যাওয়া সাদা মোজাটা পেয়েছিল! অ্যালবার্টোর কাছ থেকে আসা সব কটা পাতা একটা রিং বাইরে রেখেছিল সোফি। সব মিলিয়ে ওখানে পঞ্চাশ পাতা হবে। অন্যদিকে হিল্ডা নিজে পৌঁছেছে ১২৪ পৃষ্ঠা পর্যন্ত। অবশ্য অ্যালবার্টো নক্স এর সব চিঠি ছাড়াও তার কাছে রয়েছে সোফির গল্পটাও। পরের পরিচ্ছদটার নাম হেলেনিজম। প্রথমে জাতিসংঘের একটা জিপের ছবিসহ একটা পোস্টকার্ড পায় সোফি। তাতে সীলমোহর দেয়া আছে জাতিসংঘ বাহিনী, ১৫ই জুন। এটা হচ্ছে ডাকে না পাঠিয়ে গল্পের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া হিল্ডাকে পাঠানো বাবার আরেকটা কার্ড
প্রিয় হিল্ডা, আন্দাজ করছি এখনো তুই তোর জন্মদিন পালন করে চলেছিস। নাকি তার পরের দিনের সকাল এখন? কিন্তু সে যাই হোক, তাতে তোর উপাহারের কেননা তারতম্য হচ্ছে না। এক অর্থে, ওটা সারা জীবনই তোর কাজে লাগবে। তবে আমি তোকে আরো একবার তোর জন্মদিনের শুভেচ্ছা। জানাতে চাই। এখন তুই নিশ্চয়ই বুঝতে পারছিস কেন আমি সোফির কাছে কার্ডগুলো পাঠাই। আমি জানি ওগুলো সে ঠিকই তোর কাছে পৌঁছে দেবে।
পুনশ্চ: মা বলল তুই তোর ওয়ালেটটা হারিয়ে ফেলেছিস। ঠিক আছে, আমি কথা দিচ্ছি, তোর হারানো ১৫০ ক্রাউন আমি দিয়ে দেব। আর, স্কুলের আরেকটা পরিচয় পত্র পেতে সম্ভবত তোর অসুবিধে হবে না, গ্রীষ্মের ছুটির আগে। ভালোবাসা নিস, বাবা।
খারাপ নয়। আগের চেয়ে ১৫০ ক্রাউন বেশি বড়লোক হয়ে গেল সে। বাবা সম্ভবত ভেবেছেন কেবল ঘরে তৈরি একটা উপহারই যথেষ্ট নয়।
তাহলে দেখা যাচ্ছে ১৫ই জুন সোফিরও জন্মদিন। কিন্তু সোফির ক্যালেন্ডার কেবল মে-র মাঝখান পর্যন্ত গড়িয়েছে। নিশ্চয়ই সেই সময়ই এই পরিচ্ছেদটা লিখেছিল বাবা এবং আগে ভাগেই বার্থ ডে কার্ডটা পাঠিয়ে দিয়েছিলেন হিল্ডাকে। কিন্তু বেচারা সোফি, জোয়ানার সঙ্গে দেখা করার জন্যে দৌড়ে যাচ্ছে।
কে এই হিল্ডা? তার বাবা কী করে এটা ধরেই নিলেন যে সোফি তাকে খুঁজে পাবে? সে যাই হোক, কার্ডগুলো সরাসরি নিজের মেয়ের কাছে না পাঠিয়ে সোফির কাছে পাঠিয়ে তিনি কোনো কাজের কাজ করেননি।
প্লটিনাস সম্পর্কে পড়ার সময় সোফির মতো হিল্ডাও স্বর্গীয় স্তরে উঠে গেল।
আমি আসলে বলতে চাইছি যে, যা কিছু অস্তিত্বশীল তার মধ্যেই স্বর্গীয় রহস্যের খানিকটা বর্তমান। একটি সূর্যমুখী বা পপি ফুলেও আমরা তা ঝকমক করতে দেখি। এই অতল রহস্যের আরো বেশ খানিকটা আমরা উপলব্ধি করতে পারি গাছের ডালে ডানা ঝাঁপটাতে থাকা একটা প্রজাপতি বা কোনো পাত্রে সাঁতার কাটতে থাকা গোল্ডফিশ দেখে। তবে আমাদের আত্মার ভেতরই আমরা ঈশ্বরের সবচেয়ে কাছাকাছি। একমাত্র এখানেই আমরা জীবনের বিশাল রহস্যের সঙ্গে এক হয়ে যেতে পারি। সত্যি কথা বলতে কী, কিছু কিছু খুবই বিরল মুহূর্তে-ই আমাদের এই অভিজ্ঞতা হয়, বা মনে হয় আমরা নিজেরাই বুঝি সেই স্বর্গীয় রহস্য।
এ-পর্যন্ত হিল্ডা যতটুকু পড়েছে তার মধ্যে এটাই তার মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছে সবচেয়ে বেশি। তবে এটাই আবার সবচেয়ে সরল সন্দেহ নেই। প্রতিটি জিনিস-ই এক আর এই এক-ই হচ্ছে এক স্বর্গীয় রহস্য, প্রত্যেকেই যে-রহস্যের ভাগীদার।
এ-সব অবশ্য আসলে এমন কিছু নয় যা বিশ্বাস করতেই হবে। এটা স্রেফ এরকম, ভাবল হিল্ডা। কাজেই স্বর্গীয় শব্দটার জায়গায় যে কেউ ইচ্ছামতো একটা অর্থ বসিয়ে দিতে পারে।
জলদি পরের পরিচ্ছেদ-এ এলো সে। ১৭ই মে জাতীয় ছুটির দিনের আগের রাতে ক্যাম্পিং-এ যাচ্ছে সোফি আর জোয়ানা। মেজরের কেবিনে ঢুকে পড়ে তারা…
অল্প কয়েকটা পাতা পড়েই রাগে বিছানার চাদর টাদর ছুঁড়ে ফেলল হিল্ডা, খাট থেকে নেমে রিং বাইন্ডারটা দুই হাতে আঁকড়ে ধরে পায়চারী শুরু করল ঘরের এমাথা-ওমাথা।
এমন নির্লজ্জ চালাকির কথা আগে কোনোদিন শেনেনি হিল্ডা। মে-র প্রথম দুই হপ্তায় তার বাবা হিল্ডাকে যে-সব কার্ড পাঠিয়েছিলেন তার সবগুলোর কপি তিনি বনের ভেতরে সেই ছোট্ট কুঁড়েঘরটাতে এই ছোট্ট মেয়ে দুটোর হাতে তুলে দেবার ব্যবস্থা করেছেন। আর কপিগুলো আসল-ই একেবারে। একই কথাগুলো সে যে কতবার পড়েছে। প্রত্যেকটা শব্দ চিনতে পারল সে।
প্রিয় হিল্ডা, তোর জন্মদিনের এ-সব গোপন ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে ভেতরে ভেতরে আমি এখন এমন টগবগ করে ফুটছি যে খানিক পর পরই নিজেকে আমার সামলে নিতে হচ্ছে বাড়িতে ফোন করে সব কিছু ফাঁস করে দেয়া থেকে। জিনিসটা এমন যে দিনে দিনে সেটা বেড়ে চলেছে। আর তুই তো জানিস যে কোনো কিছু যদি ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে তখন সেটাকে নিজের মধ্যে চেপে রাখা মুশকিল…
অ্যালবার্টোর কাছ থেকে সোফি একটা নতুন পাঠ পায়। ইহুদি, গ্রীক আর দুই মহান সংস্কৃতি নিয়ে লেখা। ইতিহাসের এই ব্যাপক বার্ডস-আই ভিউটা পছন্দ হলো হিল্ডার। এ-রকম কোনো কিছু স্কুলে শেখেনি তারা। ওরা খালি তোমাকে বেশি বেশি করে খুঁটিনাটি নানান কিছু দিয়ে যাবে। যীশু আর খ্রিস্টধর্মকে সে এখন একটা নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখতে পাচ্ছে।
গ্যেটের উদ্ধৃতিটা পছন্দ হলো তার তিন হাজার বছর যে কাজে লাগাতে পারে না তার জীবন অর্থহীন।
এর পরের পরিচ্ছেদটা শুরু হয়েছে সোফিদের রান্নাঘরের জানলায় সেঁটে থাকা একটা কার্ডের কথা দিয়ে। হিল্ডার কাছে পাঠানো নতুন একটা বার্থ ডে কার্ড ওটা, বলাই বাহুল্য।
প্রিয় হিল্ডা, কার্ডটা যখন তুই পড়বি তখনো তোর জন্মদিন থাকবে কিনা জানি না। আশা করছি থাকবে; অন্তত বেশ কিছু দিন পার হয়ে যাবে না। সোফির এক হপ্তা যে আমাদেরও এক হপ্তা হবে সে-রকম কোনো কথা নেই। আমি মিডসামার ঈতে বাড়ি আসছি, তখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা গ্লাইডারে বসে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারব, হিল্ডা। মেলা কথা জমা হয়েছে আমাদের…
এরপর অ্যালবার্টো সোফিকে ফোন করেন আর তখনই সে প্রথমবারের মতো তার কণ্ঠ শোনে।
আপনার কথায় একটা যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব।
ব্যাপারটাকে আমি বরং ইচ্ছাশক্তির যুদ্ধ বলবো। আমাদেরকে হিল্ডার নজর কাড়তে হবে, তারপর তার বাবা লিলেস্যান্ডে আসার আগেই ওকে আমাদের দলে ভেড়াতে হবে।
তারপর দ্বাদশ শতকের পাথরের তৈরি একটা গির্জায় মধ্যযুগীয় এক সন্ন্যাসীর ছদ্মবেশ নিয়ে থাকা অ্যালবার্টো নক্সের সঙ্গে দেখা করে সোফি।
এই যাহ, গির্জা! সময় দেখল হিল্ডা। সোয়া একটা…সময় জ্ঞান একেবারেই লোপ পেয়েছিল ওর।
জন্মদিনে স্কুল কামাই করলে এমন কিছু মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না। কিন্তু তার অর্থ দাঁড়াবে এই যে তার ক্লাসের বন্ধুরা তার সঙ্গে উপলক্ষটা উদযাপন করতে পারবে না। শত হলেও,তার প্রচুর শুভার্থী আছে।
খানিক পরেই দেখা গেল লম্বা একটা সারমন হাজির হয়েছে তার জন্যে। মধ্যযুগীয় পাদ্রীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে কোনো অসুবিধেই হলো না অ্যালবার্টোর।
হিল্ডেগার্ডের দিব্যদৃষ্টিতে সোফিয়া-র দেখা দেয়ার বর্ণনা পড়ে আরেকবার বিশ্বকোষ ঘাটতে হলো হিল্ডাকে। কিন্তু এবার দুজনের একজনের সম্পর্কেও কোননা তথ্য পেল না সে। ব্যাপারটা খুবই স্বাভাবিক নয় কি! নারী সংক্রান্ত কোনো প্রসঙ্গ বা তথ্যের বিষয় হলেই বিশ্বকোষ একেবারে চন্দ্রগুহার মতো নীরব। পুরো বিশ্বকোষটা কি পুরুষরক্ষা সমিতি সেন্সর করেছিল?
বিজেন-এর হিল্ডেগার্ড ছিলেন প্রীচার, লেখক, ডাক্তার, উদ্ভিদবিজ্ঞানী আর জীববিজ্ঞানী। সম্ভবত মধ্য যুগে যে নারীরা প্রায়ই অনেক বেশি বাস্তববাদী এমনকী বিজ্ঞানমনস্ক হতো তারই একটি উদাহরণ ছিলেন তিনি।
অথচ বিশ্বকোষে তার সম্পর্কে একটা কথাও নেই। কী কেলেংকারি!
হিল্ডা কখনো শোনেনি যে ঈশ্বরের কোনো নারীত্বসূচক দিক বা মাতৃ-প্রকৃতি আছে। খুব সম্ভব সেই দিকটার নাম সোফিয়া, কিন্তু সেই সঙ্গে সম্ভবত তিনি ছাপার কালির যোগ্যও ছিলেন না।
সবচেয়ে কাছাকাছি যা সে বিশ্বকোষে পেল তা হচ্ছে কন্সটান্টিনোপল-এ (বর্তমান ইস্তাম্বুল) সান্তা সোফিয়া গির্জা-র ওপর একটা এন্ট্রি, নাম হেজিয়া সোফিয়া, যার অর্থ পবিত্র জ্ঞান। কিন্তু সেটার নারী চরিত্রের ব্যাপারে কিছুই লেখা নেই। এটা নিশ্চয়ই সেন্সরশীপ, তাই না?
অন্যদিকে অবশ্য এ-কথা সত্যি যে হিল্ডার কাছে সোফি নিজেকে প্রকাশ করেছে। হিল্ডা মেয়েটাকে সোজা চুলের একটা মেয়ে হিসেবেই কল্পনা করছে সব সময়…
সেন্ট মেরিজ চার্চে সকালের বেশির ভাগ সময় কাটিয়ে বাড়িতে ফিরে এসে, বনের ভেতরের কেবিন থেকে সে যে পেতলের আয়নাটা নিয়ে এসেছিল সেটার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় সোফি।
নিজের পাণ্ডুর মুখটার তীক্ষ্ণ দেহরেখাগুলো খুঁটিয়ে দেখল সে, মুখটাকে ঘিরে আছে তার বেখাপ্পা চুল, যে-চুল প্রকৃতির একান্তই নিজস্ব স্টাইল ছাড়া অন্য কোনো স্টাইলের আওতায় পড়ে না। কিন্তু সেই মুখটার পেছনে আরেকটি মেয়ের অপছায়া দেখা দিয়েছে।
হঠাৎ করেই সেই অন্য মেয়েটি দুই চোখ দিয়েই চোখ টিপতে লাগল উন্মত্তের মতো, যেন সে বোঝাতে চাইছে সত্যি-ই সে আছে আয়নার ভেতরের ওই দিকটায়। কয়েক সেকেন্ড মাত্র দেখা গেল অপছায়াটিকে। তারপরই নেই হয়ে গেল সেটা।
আয়নাটার পেছনে যেন সে অন্য আরেকজনকে খুঁজছে এমনিভাবে কতবার সেটার সামনে দাঁড়িয়েছে হিল্ডা? কিন্তু সে-কথা তার বাবা জানলেন কী করে? হিল্ডা কী সেই সঙ্গে কালো চুলের এক রমণীকেও খোঁজেনি? এক জিপসি রমণীর কাছ থেকে আয়নাটা কিনেছিলেন দাদীর মা, তাই না? হিল্ডার মনে হলো বইটা ধরে থাকা হাত দুটো কাঁপছে তার। মনে হলো অন্য দিকটায় সত্যি-ই আছে সোফি।
সোফি এবার হিল্ডা আর বিয়ার্কলেকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছে। হিল্ডা তাকে দেখতেও পাচ্ছে না, তার কথা শুনতে পাচ্ছে না, কিন্তু তারপর ডকের ওপর সোফি হিল্ডার সোনার তৈরি যীশুর ক্রুশবিদ্ধ মূর্তিটা পায়। তারপর, সোফি স্বপ্নটা দেখে জেগে ওঠবার পর দেখা যায় ক্রুশবিদ্ধ যীশুর মূর্তিটা –হিল্ডার নামের আদ্যক্ষর ইত্যাদি সহ– পড়ে রয়েছে সোফির বিছানার ওপর।
ভালো করে চিন্তা করার চেষ্টা করল হিল্ডা। তার ক্রুশবিদ্ধ যীশুর মূর্তিটাও হারায়নি নিশ্চয়ই? ড্রেসারের কাছে গিয়ে নিজের জুয়েলারী কেসটা বার করল হিল্ডা। তার নাম রাখার সময় দাদীর কাছ থেকে পাওয়া উপহার যীশুর সেই ক্রুশবিদ্ধ মূর্তিটা নেই ওখানে।
ওটা তাহলে আসলেই হারিয়ে ফেলেছে সে। কিন্তু যেখানে ব্যাপারটা সে নিজেই জানে না সেখানে কথাটা বাবা জানলেন কী করে? তাছাড়া, আরেকটা কথা: দৃশ্যত সোফি স্বপ্ন দেখেছিল যে হিল্ডার বাবা লেবানন থেকে বাড়ি ফিরছেন। কিন্তু সেটা তো ঘটনাটার এক হপ্তা আগে। তাহলে কি সোফির স্বপ্নটা ভবিষ্যদ্বাণীসূচক? তার বাবা কি এটাই বোঝাতে চেয়েছেন যে যখন তিনি বাড়ি আসবেন তখন কোনো না কোনো ভাবে সোফিও থাকবে সেখানে তিনি লিখেছিলেন যে হিল্ডা নতুন একজন বন্ধু পাবে…
একটা ক্ষণিক দিব্যদৃষ্টিতে পরিপূর্ণ স্বচ্ছতার সঙ্গে হিল্ডা জেনে গেল সোফি স্রেফ কাগজ-কলমের অতিরিক্ত একটা কিছু। সত্যিই সোফির অস্তিত্ব আছে।