১২. হেলেনিজম

১২. হেলেনিজম

…আগুনের একটা স্ফুলিঙ্গ..

দর্শন শিক্ষক যদিও তাঁর চিঠিগুলো সেই পুরনো বেড়ার ওখানে পাঠাতে শুরু করেছেন তারপরেও সোমবার সকালবেলা সোফি নেহাত অভ্যাসবশেই উঁকি দিল। ডাকবাক্সটায়।

সেটা খালি দেখে অবাক হলো না সোফি। ক্লোভার ক্লোজ ধরে হাঁটতে শুরু করল সে।

হঠাৎ করে, ফুটপাতের ওপর একটা ছবি পড়ে থাকতে দেখল সে। একটা সাদা জীপ আর ইউএন লেখা নীল একটা পাতাকার ছবি। ওটা জাতিসংঘের পতাকা না?

ছবিটা উল্টে সোফি দেখতে পেল ওটা একটা সাধারণ পোস্টকার্ড। প্রতি, হিল্ডা মোলার ন্যাগ, প্রযত্নে সোফি অ্যামুন্ডসেন… পোস্টকার্ডটার ওপর একটা নরওয়েজীয় ডাকটিকেট আর ইউএন ব্যাটালিয়ন শুক্রবার জুন ১৫, ১৯৯০ পোস্টমার্ক দেয়া আছে।

১৫ই জুন! সেটা তো সোফির জন্মদিন!

কার্ডটাতে লেখা:

প্রিয় হিল্ডা, আন্দাজ করছি এখনো তুই তোর জন্মদিন পালন করে চলেছিস। নাকি তার পরের দিনের সকাল এখন? সে যাই হোক, তাতে তোর উপহারের কোনো তারতম্য হচ্ছে না। এক অর্থে, ওটা সারা জীবনই তোর কাজে লাগবে। তবে আমি তোকে আরো একবার তোর জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে চাই। এখন হয়ত তুই বুঝতে পারছিস কেন আমি সোফির কাছে কার্ডগুলো পাঠাই। আমি জানি ওগুলো সে ঠিকই তোর কাছে পৌঁছে দেবে।

পুনশ্চ: মা বলল তুই তোর ওয়ালেটটা হারিয়ে ফেলেছিস। ঠিক আছে, কথা দিচ্ছি, তোর হারানো ১৫০ ক্রাউন আমি-ই দিয়ে দেবো। গ্রীষ্মের ছুটির আগে স্কুলের আরেকটা পরিচয় পত্র পেতে বোধকরি তোর অসুবিধা হবে না। ভালোবাসা নিস, বাবা।

নিজের জায়গায় একেবারে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সোফি। আগের কার্ডটায় কত তারিখের পোস্টমার্ক ছিল? তার যেন মনে হলো বীচ-এর সেই পোস্টকার্ডটাতেও জুন মাসের পোস্টমার্ক ছিল, যদিও জুন আসতে তখনো এক মাস দেরি। আসলে সে ঠিকমতো খেয়াল করেনি।

ঘড়ির দিকে একবার তাকাল সে, তারপর ছুটে চলে এলো নিজের ঘরে। হিল্ডাকে পাঠানো প্রথম পোস্টকার্ডটা লাল রেশমি স্কার্ফের নিচে পেল সে। ঠিক। এটাতেও জুন ১৫-রই পোস্টমার্ক দেয়া! যে-দিনটা সোফির জন্মদিন এবং তার গ্রীষ্মের ছুটির আগের দিন।

জোয়ানার সঙ্গে সুপারমার্কেটে দেখা করার জন্যে ছোটার সময় ঝড় বয়ে যাচ্ছিল তার মনে।

কে এই হিল্ডা? তার বাবা কী করে এটা ধরেই নিলেন যে সোফি তাকে খুঁজে পাবে? সে যাই হোক, কার্ডগুলো সরাসরি নিজের মেয়ের কাছে না পাঠিয়ে সোফির কাছে পাঠিয়ে তিনি কোনো কাজের কাজ করেননি। এর কারণ নিশ্চয়ই এই নয় যে তিনি তাঁর মেয়ের ঠিকানা জানেন না। এটা কি কোনো প্রাকটিকাল জোক? নাকি পুরোপুরি অপরিচিত একজনকে একই সঙ্গে গোয়েন্দা আর ডাকপিয়নের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দিয়ে তিনি তার মেয়েকে একটা সারপ্রাইজ দিতে চান? সেই জন্যেই কি এক মাসের একটা সুযোগ দেয়া হচ্ছে তাকে এবং তার মেয়েকে জন্মদিনের উপহার হিসেবে একটি নতুন বন্ধু দেবার জন্যে তিনি কি তাকে এক ধরনের মধ্যস্ত তাকারী হিসেবে ব্যবহার করছেন? সে কি এমন একটা উপহার হতে পারে যা সারাজীবন টিকবে?

এই জোকারটি যদি সত্যিই লেবাননে থেকে থাকে তাহলে সে কী করে তার ঠিকানা জোগাড় করল? হতে পারে, নিয়তিতে বিশ্বাস করা ততটা নির্বোধের কাজ নয়। তারপরেও, হুট করে কোনো সিদ্ধান্তে আসা উচিত হবে না; এর সব কিছুরই খুব স্বাভাবিক একটা ব্যাখ্যা থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তু হিল্ডা থাকে লিলেস্যান্ড এ, তার ওয়ালেট অ্যালবার্টো নক্স পেলেন কী করে? লিলেস্যান্ড-তো কয়েক শো মাইল দূরে। তাছাড়া, সোফি এই পোস্টকার্ডটা তার পথের ওপর পেল কেন? ডাকপিয়ন যখন সোফির ডাকবাক্সের দিকে যাচ্ছিল তখন কি সেটা তার থলে থেকে পড়ে গিয়েছিল? তাই যদি হয় তাহলে অন্য কোনোটা না হয়ে বিশেষ এই পোস্টকার্ডটা কেন?

তুই কি বদ্ধ পাগল হয়েছিস? শেষ পর্যন্ত যখন সোফি সুপার মার্কেটে পৌঁছল, সব শুনে একেবারে ফেটে পড়ল জোয়ানা।

দুঃখিত!

স্কুল শিক্ষকের মতো ভীষণ একটা কুটি করন জোয়ানা সোফির দিকে তাকিয়ে।

তুই বরং বিশ্বাসযোগ্য একটা ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা কর।

এর সঙ্গে জাতিসংঘের একটা সম্পর্ক আছে, সোফি বলল। লেবাননে একটা শত্রুদল আমাকে আটকে রেখেছিল।

বটে… তুই আসলে প্রেমে পড়েছিস।

যদ্দূর সম্ভব জোরে ছুটে স্কুলে পৌঁছে গেল দুজন।

ধর্মীয় জ্ঞান সম্পর্কিত যে-পরীক্ষাটার জন্যে সোফি প্রস্তুতি নেবার সুযোগ পায়নি সেটা হলো তৃতীয় পিরয়ডে। কাগজটায় লেখা:

জীবন এবং সহিষ্ণুতার দর্শন

১। যে-সব বিষয় সম্পর্কে আমরা জানতে পারি তার একটা তালিকা তৈরি কর। তারপর সে-সব বিষয়ের একটা তালিকা তৈরি কর যে-সব বিষয়ে আমরা কেবল বিশ্বাসই করতে পারি।
২। একজন মানুষের জীবনদর্শন তৈরিতে যে-সব বিষয় অবদান রাখে সেগুলো উল্লেখ কর। ৩। বিবেক বলতে কী বোঝায়? তুমি কি মনে করো সবার বিবেক একই রকম? ৪। মূল্যের অগ্রাধিকার (priority of values) বলতে কী বোঝায়?

লেখা শুরু করার আগে বসে বসে বেশ কিছুক্ষণ ভাবল সোফি। অ্যালবার্টো নক্স-এর কাছ থেকে শেখা কোনো কিছু এখানে ব্যবহার করা যায় না? তাই-ই করতে হবে তাকে, তার কারণ বেশ কিছুদিন হলো ধর্মীয় জ্ঞান-এর বইটা ভোলা হয়নি তার। লিখতে শুরু করার পর শব্দগুলো আপনা আপনিই বেরিয়ে আসতে লাগল তার কলম থেকে।

 সে লিখল, আমরা জানি চাঁদ পনির দিয়ে তৈরি নয় এবং চাঁদের অন্ধকার পৃষ্ঠে বড় বড় গর্ত রয়েছে, এটাও জানি যে সক্রেটিস এবং যীশু দুজনকেই মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছিল, আরো জানি যে প্রত্যেককেই মরতে হবে, আগে হোক আর। পরে হোক, সেই সঙ্গে এ-ও জানি যে অ্যাক্রোপলিসের বিশাল মন্দিরগুলো পঞ্চম। খ্রিস্ট পূর্বাব্দে পার্সিয়ান যুদ্ধের পর তৈরি করা হয়েছিল আর প্রাচীন গ্রীসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ওরাকলটি ছিল দেলফির ওরাকল। যে-সব জিনিস আমরা কেবল বিশ্বাস করতে পারি সে-সবের উদাহরণ দিতে গিয়ে সোফি লিখল অন্য গ্রহগুলোয় প্রাণ থাকা না থাকা, ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে কি নেই, মৃত্যুর পর জীবন আছে কি নেই এবং যীশু কি ঈশ্বরের পুত্র ছিলেন নাকি ছিলেন নিতান্তই একজন জ্ঞানী মানুষ, এ সবের কথা। তালিকাটা শেষ করে সে লিখল পৃথিবীটা কোথা থেকে এলো সেটা। আমরা নিশ্চয়ই জানি না। তবে মহাবিশ্বটাকে একটা টপ হ্যাঁটের ভেতর থেকে বের করা বিশাল একটা খরগোশের সঙ্গে তুলনা করা চলে। দার্শনিকেরা চেষ্টা করেন খরগোশের গায়ের একটা সূক্ষ্ম রোম বেয়ে ওপরে উঠে সরাসরি মহান জাদুকরের, চোখের দিকে তাকাতে। অবশ্য, সে-কাজে তারা কোনোদিন সফল হবেন কিনা সে প্রশ্নটা থেকেই যাচ্ছে। তারা যদি একে অন্যের পিঠের ওপর চড়ে বসতেন তাহলে তারা খরগোশের রোমটাকেও ছাড়িয়ে যেতেন এবং তখন, আমার বিশ্বাস, তাঁরা। একদিন সফল হলেও হতে পারতেন।

পুনশ্চ: বাইবেল-এ এমন একটা জিনিসের কথা বলা হয়েছে যেটা সেই খরগোশটা সূক্ষ্ম একটা রোমের মতো হতে পারতো। সেই রোমটার নাম টাওয়ার অভ ব্যাবেন বা ব্যাবেলের টাওয়ার। কিন্তু সেটাকে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছিল, তার। কারণ জাদুকরটি চাননি যে ক্ষুদে ক্ষুদে মানব পোকাগুলো ওটা বেয়ে তাঁর সদ্য তৈরি করা সাদা খরগোশটার অতো উঁচুতে উঠে যাক।

সোফি এরপর গেল পরের প্রশ্নে: একজন মানুষের জীবনদর্শন তৈরিতে যে-সব বিষয় অবদান রাখে সেগুলো উল্লেখ কর। লালন-পালন এবং পরিবেশ এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। প্লেটোর সময়কার মানুষ আর এখনকার মানুষের জীবনদর্শনের মধ্যে তফাৎ রয়েছে, তার কারণ তারা একটি ভিন্ন সময়ে ভিন্ন পরিবেশে জীবন যাপন করেছে। আরেকটি বিষয় হলো মানুষ যে-সমস্ত অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে নিজেকে নিয়ে যায় সেটা। কাণ্ডজ্ঞান অবশ্য পরিবেশের ওপর নির্ভর। করে না। সবারই তা থাকে। এক হিসেবে পরিবেশ আর সামাজিক অবস্থাকে প্লেটোর গুহায় বিরাজমান অবস্থার সঙ্গে তুলনা করা যায়। বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে ব্যক্তিমানুষ অন্ধকার থেকে নিজেকে বের করে নিয়ে আসার চেষ্টা করতে পারে। কিন্তু সে-কাজ করতে ব্যক্তিগত সাহসেরও প্রয়োজন। সমাজে বিরাজমান পরিস্থিতি থেকে নিজের বুদ্ধিবলে মুক্তিলাভ-করা মানুষের এক উজ্জ্বল উদাহরণ হলেন সক্রেটিস। শেষে সে লিখল: হাল আমলে নানান দেশ এবং সংস্কৃতির মানুষের মধ্যে মেলামেশা বেড়েই চলেছে। একই অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং-এ হয়ত খ্রিস্টান, মুসলিম এবং বৌদ্ধরা বাস করছে। এক্ষেত্রে সব মানুষ একই জিনিসে বিশ্বাসী নয় কেন সে-কথা জিগ্যেস করার চেয়ে একে অন্যের বিশ্বাসকে মেনে নেয়াটাই বেশি। জরুরি।

খারাপ না, ভাবল সোফি। সে তার দর্শন শিক্ষকের কাছ থেকে যা শিখেছে তার অনেক কিছুই সে এখানে ব্যবহার করতে পেরেছে বলে মনে হলো তার। সেই সঙ্গে তার নিজের কাণ্ডজ্ঞান আর এখানে-ওখানে সে যা পড়েছে বা শুনেছে সে-সবের খানিকটাও সে এটার সঙ্গে জুড়ে দিতে পারে সহজে।

তৃতীয় প্রশ্নের দিকে মন দিল সে: বিবেক বলতে কী বোঝায়? তুমি কি মনে করো সবার বিবেক একই রকম? এই ব্যাপারটা নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে ক্লাসে। সোফি লিখল: বিবেক হচ্ছে ন্যায়-অন্যায়ের ব্যাপারে মানুষের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার ক্ষমতা। আমার ব্যক্তিগত মতামত হচ্ছে প্রত্যেকেরই এই ক্ষমতা রয়েছে, কাজেই অন্য কথায় বলতে গেলে, বিবেক একটি সহজাত বা জন্মগত বিষয়। সক্রেটিসও, আমার ধারণা, একই মত প্রকাশ করতেন। তবে বিবেকের নির্দেশ ব্যক্তিভেদে একেবারে ভিন্ন রকম হতে পারে। এক্ষেত্রে অনেকেরই সোফিস্টদের কথা মনে হতে পারে। তারা মনে করতেন, কারো ন্যায়-অন্যায় বোধ নির্ভর করে মূলত সে কোন পরিবেশে বড় হয়েছে তার ওপর। অন্যদিকে সক্রেটিস

মনে করতেন সবার বিবেকই একই রকম বা সমান। সম্ভবত দুটো দৃষ্টিভঙ্গি-ই। সঠিক। যদিও সবাই হয়ত নগ্ন অবস্থায় জনসমক্ষে যেতে সংকোচ বোধ করবে না, কিন্তু কারো সঙ্গে নীচ ব্যবহার করার পর বেশিরভাগ মানুষই বিবেকের দংশনে ভুগবে। তারপরেও এ-কথাটা স্মরণ রাখতেই হবে যে বিবেক থাকা আর তা ব্যবহার করার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। মাঝে মধ্যে কিছু লোকের কাজ দেখে মনে হয় তারা বুঝি বিবেকবর্জিত, কিন্তু আমি বিশ্বাস করি তাদের মধ্যেও, মনের গভীরে কোথাও, এক ধরনের বিবেক আছে। ঠিক যেমন কখনো কখনো মনে হয় কোনো কোনো মানুষের কোনো বোধশক্তিই নেই আর তার কারণটা স্রেফ এই যে তারা সেটাকে ব্যবহার করছে না। পুনশ্চ: কাণ্ডজ্ঞান এবং বিবেক, এই দুটো জিনিসকেই পেশীর সঙ্গে তুলনা করা চলে। কেউ যদি তার কোনো পেশী ব্যবহার না করে তাহলে সেটা দিন দিন দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে পড়ে।

আর মাত্র একটা প্রশ্ন বাকি: মূল্যের অগ্রাধিকার বলতে কী বোঝায়? এই ব্যাপারটা নিয়েও সম্প্রতি অনেক আলোচনা করেছে তারা। একটি গাড়ি চালিয়ে খুব দ্রুত এক স্থান থেকে অন্য স্থানে চলে যাওয়াটা এক অর্থে খুবই মূল্যবান হতে পারে। কিন্তু এই গাড়ি চালনার ফল গিয়ে যদি দাঁড়ায় বৃক্ষশূন্যতা এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের দূষণ তাহলেই এসে যায় মূল্য বিচারের প্রসঙ্গ। সতর্ক বিবেচনার পর সোফির মনে হলো সে এই সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছেছে যে সমৃদ্ধ বনরাজি আর নিষ্কলুষ পরিবেশ তাড়াতাড়ি কাজ করার চেয়েও বেশি মূল্যবান। আরো অনেক উদাহরণ তুলে ধরল সে। সবশেষে সে লিখল: ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি ইংরেজি ব্যাকরণের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হচ্ছে দর্শন। কাজেই, টাইম টেবিল থেকে ইংরেজি পড়াগুলো খানিকটা হেঁটে দিয়ে সে-জায়গায় দর্শন অন্তর্ভুক্ত করা মূল্যের অগ্রাধিকার নিরূপণ করার ক্ষেত্রে বিচক্ষণ একটি কাজ বলেই গণ্য হবে।

শেষ ব্রেক এর সময় সোফির শিক্ষক তাকে এক পাশে ডেকে নিলেন।

তোমার ধর্ম পরীক্ষার খাতাটা এরিমধ্যে পড়ে ফেলেছি আমি, তিনি বললেন। খাতাগুলোর প্রায় ওপরের দিকেই ছিল ওটা।

আশা করি চিন্তার খানিকটা খোরাক পেয়েছেন ওটায়।

ঠিক এই ব্যাপারটা নিয়েই কথা বলতে চাই আমি তোমার সঙ্গে। অনেক দিক থেকেই লেখাটা বেশ পরিণত বলে মনে হয়েছে আমার কাছে। বেশ অবাক করার মতোই পরিণত। আর নিজের থেকে লেখা। কিন্তু তুমি কি তোমার হোমওয়ার্ক করেছিলে, সোফি?

একটু অস্থিরতা দেখা গেল সোফির মধ্যে।

ইয়ে, দেখুন, আপনি বলেছিলেন লেখার মধ্যে নিজস্ব একটা দৃষ্টিভঙ্গি থাকা জরুরি।

হ্যাঁ, তা বলেছিলাম … কিন্তু তার একটা সীমা আছে।

সোফি সরাসরি তার শিক্ষকের চোখের দিকে তাকাল। তার মনে হলো সম্প্রতি তার যে-সমস্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে তাতে সে নিজেকে এটুকু করার এক্তিয়ার দিতে পারে।

আমি দর্শন পড়া শুরু করেছি, সে বলল। ব্যক্তিগত মতামত তৈরির ক্ষেত্রে দর্শন একজন মানুষকে চমৎকার একটা ক্ষেত্র উপহার দিতে পারে।

 কিন্তু তাতে তোমার খাতা গ্রেডিং করার ব্যাপারে আমার সুবিধে হচ্ছে না। হয় সেটা ডি হবে নয়ত এ।

সেটা কি এইজন্যে যে আমি হয় একেবারে ঠিক বলেছি নয়ত পুরোপুরি ভুল? আপনি কি তাই বলতে চান?

ঠিক আছে এ-ই হলো, শিক্ষক বললেন। কিন্তু এরপর হোমওয়ার্ক করতে ভুলো না!

বিকালে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে স্কুলব্যাগটা সিঁড়ির ধাপে ছুঁড়ে দিয়ে দৌড়ে গুহায় চলে এলো সোফি। গ্রন্থিল শেকড়গুলোর ওপর বাদামি একটা খাম পড়ে আছে। খামটার প্রান্তের দিকটা বেশ শুকনো, তার অর্থ হার্মেস নিশ্চয়ই বেশ আগেই ওটা ফেলে রেখে গেছে।

খামটা নিয়ে সামনের দরজা দিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ল সে। জম্ভগুলোকে খাবার দিল তারপর দোতলায় তার নিজের ঘরে চলে এলো। বিছানায় শুয়ে অ্যালবার্টোর চিঠিটা খুলে পড়তে শুরু করল সে:

হেলেনিজম

এই যে, সোফি! আবার এক সঙ্গে হলাম আমরা। প্রকৃতিবাদী দার্শনিকবৃন্দ, সক্রেটিস, প্লেটো আর অ্যারিস্টটল সম্পর্কে পড়ার পর তুমি এখন ইউরোপিয় দর্শনের ভিত্তিমূলের সঙ্গে পরিচিত হয়ে গেছ। কাজেই এবার থেকে আমরা ভূমিকামূলক সেই প্রশ্নগুলো বাদ দেবো, যে-সব প্রশ্ন আগে একটা সাদা খামে পেতে তুমি। আমার ধারণা স্কুলেরও অনেক কাজ আর পরীক্ষা রয়েছে তোমার।

তো, এবার তোমাকে বলব আমি চতুর্থ খ্রিস্ট পূর্বাব্দের শেষের দিকে অ্যারিস্টটল থেকে ৪০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে মধ্য যুগের শুরু পর্যন্ত লম্বা সময়টার কথা। এই সময়টার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং রহস্যময় বিষয় ছিল খ্রিস্টধর্ম।

অ্যারিস্টটল মারা যান ৩২২ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে, এথেন্স তখন আগেকার সেই প্রভাব প্রতিপত্তি খুইয়ে বসেছে। আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট-এর (৩৫৬-৩২৩ খ্রি. পূ.) ১৪৮

সামরিক বিজয়গুলোর ফলে যে রাজনৈতিক পালাবদল ঘটেছিল সেটাও এর জন্যে কম দায়ী নয়।

আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট ছিলেন মেসিডোনিয়ার রাজা। অ্যারিস্টটলও মেসিডোনিয়ার লোক এবং কিছুদিন তিনি তরুণ আলেকজান্ডারের শিক্ষকও ছিলেন। সে যাই হোক, আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটই পারসিকদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় লাভ করেছিলেন। তাছাড়া, মিশর এবং প্রাচ্যের ভারত পর্যন্ত বিজয় করে একটি বিশাল ভূখণ্ড তিনি গ্রীক সভ্যতার সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন।

এর ফলে মানব ইতিহাসে এক নতুন যুগের সূচনা হয়। উদ্ভব ঘটে এক সভ্যতার যে-সভ্যতায় গ্রীক সংস্কৃতি আর গ্রীক ভাষা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রায় ৩০০ বছর স্থায়ী এই সময়টি হেলেনিজম (Hellenism) নামে পরিচিত। হেলেনিজম বলতে এই সময়টি তো বটেই, সেই সঙ্গে তিনটি হেলেনিস্টিক রাজ্য মেসিডোনিয়া, সিরিয়া এবং মিশরে গ্রীক প্রাধান্য বিশিষ্ট যে-সংস্কৃতি এই একই সময়ে বিরাজ করছিল সেটিকেও বোঝায়।

৫০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ থেকেই সামরিক এবং রাজনৈতিক ব্যাপারে রোমের কর্তৃত্ব সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। নতুন এই পরাশক্তি ধীরে ধীরে সব কটি হেলেনিস্টিক রাজ্য জয় করে ফেলে এবং এরপর থেকে পশ্চিমে স্পেন থেকে সুদূর এশিয়া পর্যন্ত রোমান সংস্কৃতি এবং লাতিন ভাষারই আধিপত্য সূচিত হয়। এটাই রোমান যুগের প্রারম্ভ এবং একেই আমরা বলে থাকি প্রাচীন লাতিন যুগ। তবে একটা কথা কিন্তু মনে রাখা দরকার আর তা হলো হেলেনিস্টিক জগৎ জয় করার আগে রোমানরা নিজেরাই ছিল গ্রীক সংস্কৃতির প্রভাব বলয়ের অন্তর্ভুক্ত। কাজেই এ-কথা বলাটা খুবই যুক্তিযুক্ত যে গ্রীসের রাজনৈতিক প্রভাব অতীতের গর্ভে হারিয়ে যাওয়ার পরেও গ্রীক সংস্কৃতি এবং গ্রীক দর্শন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে গিয়েছিল।

.

ধর্ম, দর্শন এবং বিজ্ঞান

হেলেনিজম-এর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই সময়টাতে বিভিন্ন দেশ এবং সংস্কৃতির সীমারেখা টুটে গেল। আগে গ্রীস, রোম, মিশর, ব্যাবিলনিয়া, সিরিয়া এবং পারস্যের মানুষেরা তাদের জাতীয় ধর্মের গণ্ডীর ভেতরেই তাদের নিজেদের দেবতাদের আরাধনা বা পূজা করেছে। এবার বিভিন্ন সংস্কৃতি ধর্মীয়, দার্শনিক এবং বৈজ্ঞানিক ধারণার এক বিশাল কড়াইয়ের ভেতর মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল।

কথাটা সম্ভবত এভাবে বলা যায় যে নগর-চত্বরের জায়গায় এলো বিশ্ব অঙ্গন। পুরনো নগর-চত্বরটিও অবশ্য গমগম করত নানান গলার আওয়াজে, কখনো হয়ত বিভিন্ন জিনিস-পত্র আসতো সেখানে, কখনো বা নানান চিন্তা বা ধ্যান-ধারণা। নতুন যে-ব্যাপারটি ঘটল তা হলো এবারে নগর-চত্বর ভরে যেতে থাকল সারা দুনিয়া, থেকে আসা পণ্যদ্রব্য আর ধারণাগুলোয়। আর মানুষের গলা গমগম করতে থাকল নানান ভাষার কলরবে।

এরিমধ্যে উল্লেখ করেছি যে গ্রীক জীবনদর্শন এই সময়টাতে আগের গ্রীক সাংস্কৃতিক বলয়ের চেয়ে অনেক বেশি জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। সময় যতই যেতে থাকল ততই ভূমধ্যসাগরীয় দেশের সবগুলোতে প্রাচ্যের দেবতারাও পূজিত হতে থাকলেন। নতুন ধর্মীয় সংগঠন গড়ে উঠতে থাকল বহু পুরনো দেশ ও জাতির দেবদেবী এবং বিশ্বাস-এর সমন্বয়ে। একে বলা হয় নানান ধর্মবিশ্বাসের সংমিশ্রণ (syncretism)।

এর আগে লোকজন তাদের জাতি আর নগর-রাষ্ট্রের প্রতি একটা শক্ত টান অনুভব করত। কিন্তু নানান দেশের মধ্যে সীমারেখা যতই মুছে যেতে থাকল ততই অসংখ্য মানুষ তাদের নিজেদের জীবন-দর্শন সম্পর্কে সংশয় এবং অনিশ্চয়তায় ভুগতে শুরু করল। প্রাচীন লাতিন যুগের শেষ অংশটি বিশিষ্ট হয়ে আছে ধর্ম সম্পর্কিত সংশয়, সাংস্কৃতিক সংমিশ্রণ আর দুঃখবাদ-এর জন্যে। তখন বলা হতো, পৃথিবীটা বুড়িয়ে গেছে।

মানবজাতি কী করে মৃত্যুর হাত থেকে পরিত্রাণ লাভ করতে পারবে সে-সম্পর্কে নানান উপদেশ প্রায়ই দেখা যেতো হেলেনিস্টিক নতুন নতুন ধর্মীয় সংগঠনগুলোর মধ্যে। এই উপদেশেগুলোকে প্রায়ই গোপনীয় বিষয় হিসেবে গণ্য করা হতো। এইসব উপদেশ গ্রহণ করে এবং বিশেষ কিছু আচার-অনুষ্ঠান পালনের মধ্য দিয়ে একজন বিশ্বাসী ব্যক্তি একটি অমর আত্মা ও শাশ্বত জীবনের অধিকারী হওয়ার আশা পোষণ করতো। আত্মার নির্বাণ বা মোক্ষলাভের জন্যে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের মতোই গুরুত্বপূর্ণ ছিল মহাবিশ্বের প্রকৃত স্বরূপ সম্পর্কে একটি বিশেষ অন্তদৃষ্টিলাভ করা।

তো, ধর্ম সম্পর্কে এ-পর্যন্তই, সোফি। ওদিকে দর্শনও কিন্তু ক্রমশই আরো বেশি করে নির্বাণ বা আর প্রশান্ত দশার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। ভাবা হচ্ছিল, দার্শনিক অন্তদৃষ্টি তার নিজস্ব উদ্দেশ্য সাধনের বাইরেও মানুষকে দুঃখবাদ আর মৃত্যুভয় থেকে মুক্তি দেবে। এভাবে ধর্ম আর দর্শনের মধ্যেকার সীমারেখাও মুছে যাচ্ছিল ধীরে ধীরে।

সার্বিক দৃষ্টিতে, হেলেনিজম-এর দর্শন সে-রকমভাবে চোখে পড়ার মতো নতুন বা মৌলিক কিছু নয়। নতুন কোনো প্লেটো বা অ্যারিস্টটল এ-সময়ে আবির্ভূত হননি। বরং কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি তোমাকে যে-সব দার্শনিক প্রবণতার কথা বলব সেগুলো এই তিন মহান এথেনীয় দার্শনিকের শিক্ষা থেকেই অনুপ্রেরণা লাভ করেছে।

হেলেনিস্টিক বিজ্ঞান-ও বিভিন্ন সংস্কৃতি থেকে পাওয়া জ্ঞানের সংমিশ্রণ। এক্ষেত্রে পুব এবং পশ্চিমের মিলনস্থল হিসেবে আলেকজান্দ্রিয়ার একটি মুখ্য ভূমিকা রয়েছে। প্লেটো এবং অ্যারিস্টটলের পর তখনো টিকে থাকা নানান দর্শনের অনুসারী কিছু দল নিয়ে এথেন্স রয়ে গিয়েছিল দর্শনচর্চার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে, অন্যদিকে আলেকজান্দ্রিয়া ছিল বিজ্ঞানচর্চার পীঠস্থান। এখানকার বিশাল গ্রন্থাগারটি নিয়ে আলেকজান্দ্রিয়া হয়ে উঠেছিল গণিতশাস্ত্র, জ্যোতির্বিদ্যা, জীববিদ্যা এবং চিকিৎসাবিদ্যার কেন্দ্রস্থল।

হেলেনিস্টিক সংস্কৃতিকে অনায়াসে আজকের পৃথিবীর সঙ্গে তুলনা করা চলে। বিংশ শতাব্দীও ক্রমশই উদার ও উন্মুক্ত হতে থাকা একটি সভ্যতার প্রভাবে প্রভাবান্বিত হয়েছে। আমাদের সময়েও এই উদারনৈতিক প্রক্রিয়া ধর্ম এবং দর্শনের ক্ষেত্রে রীতিমত বৈপ্লবিক পরিবর্তন সৃষ্টি করেছে। খ্রিস্টিয় যুগের গোড়ার দিকে রোমে যেমন যে-কেউ গ্রীক, মিশরীয় এবং প্রাচ্যের ধর্মগুলোর দেখা পেতে পারত, ঠিক তেমনি ত জ আমরা যখন বিংশ শতাব্দীর শেষ প্রান্তের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি তখন ছোট-বড় যে-কোনো ইউরোপিয় শহরে পৃথিবীর যে-কোনো অংশের ধর্মের সাক্ষাৎ পাবো। ইদানিং আমরা আরো দেখতে পাচ্ছি কী করে নতুন ও পুরনো ধর্ম, দর্শন এবং বিজ্ঞানের একটি সম্মিলিত পিণ্ড জীবন সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গি-র বাজারে নতুন নতুন পণ্যের আবির্ভাবের ভিত্তি রচনা করতে পারে। এই নতুন জ্ঞান-এর অনেকটাই পুরনো চিন্তা-ভাবনার ভাসমান খড়কুটো, যেগুলোর কিছু কিছু এমনকী সেই হেলেনিজম আমলের।

আগেই বলেছি, সক্রেটিস, প্লেটো এবং অ্যারিস্টটল যে-সব সমস্যার কথা উল্লেখ করে গেছেন হেলেনিস্টিক দর্শন সেগুলো নিয়েই কাজ করেছে। এই তিন দার্শনিকেরই একটি বিষয়ে মিল ছিল আর তা হলো মানবজাতি কী করে সবচেয়ে সুন্দরভাবে জীবনযাপন এবং মৃত্যুবরণ করতে পারে তা আবিষ্কার করা। তাদের চিন্ত রি মূল বিষয় ছিল নীতিবিদ্যা। নতুন সভ্যতায় এটাই হয়ে দাঁড়ায় মুখ্য দার্শনিক বিষয়। সত্যিকারের সুখ কী এবং কীভাবে তা অর্জন করা যায় সেটাই হয়ে দাঁড়ায় মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু। এই সব দার্শনিক প্রবণতার চারটির দিকে নজর দেব আমরা।

.

বিরাগীদের কথা (The Cynics)

একটি গল্প প্রচলিত আছে যে, সব ধরনের পণ্য বিক্রি করত এ-রকম একটা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন একবার সক্রেটিস। এবং শেষ পর্যন্ত তিনি বলে উঠেছিলেন, কত না জিনিস এখানে, অথচ এ-সবের একটাও আমার দরকার নেই।

এই মন্তব্যটাকেই বলা যেতে পারে বিরাগীদর্শনের মূলসূত্র। ৪০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে অ্যান্টিস্থেনিস (Antisthenes) নামে একজন এথেন্সে এই দর্শনের জন্ম দেন।

অ্যান্টিস্থেনিস সক্রেটিসের ছাত্র ছিলেন এবং তার মিতব্যয়িতা তাঁকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করেছিল।

বিরাগীরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন বাহ্যিক সুযোগ-সুবিধা, যেমন বস্তুগত বিলাসদ্রব্য, রাজনৈতিক ক্ষমতা বা সুস্বাস্থ্য, সত্যিকারের সুখ দিতে পারে না। এ ধরনের এলোপাথাড়ি এবং ক্ষণস্থায়ী জিনিসের ওপর সত্যিকারের সুখ নির্ভর করে না। এবং সুখ যেহেতু এ-ধরনের সুবিধা বা উপকারের ওপর নির্ভর করে না সুতরাং তা সবারই নাগালের মধ্যে। তারচেয়ে যেটা বড় কথা, একবার প্রকৃত সুখ অর্জন করা গেলে তা কখনোই হারাতে পারে না।

বিরাগীদের মধ্যে যিনি সবচেয়ে বিখ্যাত তার নাম ডায়োজেনিস (Diogenes), অ্যান্টিস্থেনিসের একজন ছাত্র। ডায়োজেনিস একটি পিপার মধ্যে থাকতেন এবং তাঁর কেবল একটি আলখাল্লা, একটি লাঠি আর রুটি রাখার একটি থলে ছিল বলে প্রসিদ্ধি আছে। (সুতরাং বুঝতেই পারছো, তাঁর সুখ কেড়ে নেয়া খুব সহজ ব্যাপার ছিল না। একবার তিনি যখন তার পিপার পাশে শুয়ে রোদ পোহাচ্ছিলেন তখন আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসেন। সম্রাট তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে জিগ্যেস করলেন তিনি তার জন্যে কিছু করতে পারেন কিনা। এমন কিছু কি আছে যা তিনি চান? ডায়োজেনিস উত্তরে বললেন, হ্যাঁ, চাই। এক পাশে সরে দাঁড়ান। আপনি রোদ আটকে দাঁড়িয়ে আছেন। এভাবেই ডায়োজেনিস বুঝিয়ে দিলেন যে। তার সামনে দাঁড়ানো বিখ্যাত মানুষটির চেয়ে তিনি কম সুখী বা সম্পদশালী নন। তিনি যা চান তার সবই তাঁর আছে।

বিরাগীরা বিশ্বাস করতেন নিজের স্বাস্থ্যের ব্যাপারে কারো উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ নেই। এমনকী কষ্টভোগ এবং মৃত্যুতেও বিচলিত হওয়া উচিত নয়। অন্য মানুষের দুঃখ-কষ্ট দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে নিজেকে যন্ত্রণা দেয়ার কোনো মানে হয় না।

 বর্তমানে সিনিকাল এবং সিনিসিজম শব্দ দুটির সাহায্যে মানুষের আন্তরিকতা সম্পর্কে একটি অবজ্ঞাসূচক মনোভাব ব্যক্ত করা হয় এবং সেই সঙ্গে মানুষের যন্ত্রণা, দুঃখ-কষ্ট ইত্যাদির ব্যাপারে উদাসীনতাও প্রকাশ করা হয়ে থাকে।

.

স্টোয়িকদের কথা (The Stoics)

৩০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে এথেন্সে স্টোয়িক দর্শনের উদ্ভবের পেছনে বিরাগীরা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। এই দর্শনের স্রষ্টা জেনো (Zeno); মূলত সাইপ্রাসের লোক হলেও একটা জাহাজডুবির পর এথেন্সে এসে বিরাগীদের সঙ্গে যোগ দেন তিনি। তাঁর অনুসারীদের তিনি একটা পোর্টিকো-র সামনে জড়ো করে তাদের সঙ্গে কথা বলতেন। পোর্টিকো-র গ্রীক শব্দ স্টোয়া (stoa) থেকেই স্টোয়িক শব্দটি এসেছে। স্টোয়িক দর্শন (Stoicism) পরবর্তীকালে রোমান সংস্কৃতির ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে।  

হেরাক্লিটাসের মতো স্টোয়িকরাও বিশ্বাস করতেন যে প্রত্যেকেই একই কাণ্ডজ্ঞান বা লোগোস (logos)-এর অংশ। তাঁরা মনে করতেন প্রতিটি মানুষই জগতের একটি ছোট্ট প্রতিলিপি বা একটি ক্ষুদ্র জগৎ, যা কিনা নিখিল বিশ্ব-রই একটি প্রতিবিম্ব।

এ-থেকেই একটি চিন্তার জন্ম হলো যে বিশ্বজনীন একটি ন্যায়পরায়ণতা বা তথাকথিত প্রাকৃতিক আইন (natural law) নামক একটি জিনিসের অস্তিত্ব রয়েছে। এবং যেহেতু এই প্রাকৃতিক আইন শাশ্বত মানব এবং বিশ্বজনীন প্রজ্ঞার ওপর ভিত্তি করে আছে তাই সময় এবং স্থানভেদে সেটার কোনো পরিবর্তন হয় না। কাজেই এদিক দিয়ে স্টোয়িকরা সোফিস্টদের মতানুসারী নয়, সক্রেটিসের।

প্রাকৃতিক আইন সমস্ত মানব জাতিকে, এমনকী দাসদেরও শাসন করে। স্টোয়িকরা রাষ্ট্রগুলোর সব বিধিবদ্ধ আইনকে প্রকৃতিতে বিদ্যমান আইন-এর অসম্পূর্ণ অনুকরণ বলে মনে করতেন।

ব্যক্তি এবং মহাবিশ্বের মধ্যে কোনো পার্থক্য যেমন স্টোয়িকরা স্বীকার করতেন না, ঠিক তেমনি তারা চিদাত্মা (spirit) এবং বস্তু-র (matter) মধ্যেকার বিরোধও স্বীকার করতেন না। তাঁরা বলতেন, রয়েছে কেবল প্রকৃতি। এই ধরনের চিন্তা বা ধারণাকে বলা হয় অদ্বৈতবাদ (monism) (যা প্লেটোর সুস্পষ্ট দ্বৈতবাদ (dualism) বা দুই স্তর বিশিষ্ট বাস্তবতার ঠিক বিপরীত)।

সোফিস্টরা, তাদের সময়ের যোগ্য সন্তান হিসেবেই, ছিলেন একেবারে কসমোপলিটান, পিপার দার্শনিকদের মতো অর্থাৎ বিরাগীদের মতো তারা সমসাময়িক সংস্কৃতি সম্পর্কে উদাসীন ছিলেন না বা তা গ্রহণ করতে অনিচ্ছুক ছিলেন না। মানুষে মানুষে সম্পর্কের ওপর জোর দিতেন তারা, রাজনীতি নিয়ে যথেষ্ট মাথা ঘামাতেন আর তাদের মধ্যে অনেকেই রাষ্ট্র পরিচালনার কাজে সক্রিয়ভাবে অংশ নিতেন; এ-প্রসঙ্গে রোমান সম্রাট মার্কাস অরেলিয়াস (Marcus Aurelius, ১২১-১৮০ খ্রিস্টাব্দ))-এর নাম অগ্রগণ্য। গ্রীক সংস্কৃতি এবং দর্শন চর্চায়ও উৎসাহ যোগাতেন তাঁরা রোমে; বাগী, দার্শনিক এবং রাজপুরুষ সিসেরো (Cicero, ১০৬-৪৩ খ্রি. পূ.) এই উৎসাহদাতাদের মধ্যে বিশিষ্ট একজন। তিনিই মানবতাবাদ (humanism) নামক ধারণাটির স্রষ্টা। মানবতাবাদ হচ্ছে জীবন সম্পর্কে এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গি যেখানে ব্যক্তি-ই সমস্ত মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু। বেশ কিছুদিন পর স্টোয়িক সেনেকা (Seneca, খ্রি. পূ. ৪-৬৫ খ্রিস্টাব্দ) বলেন, মানুষের কাছে মানুষই পবিত্র। এরপর থেকে এই কথাটিই মানবতাবাদের শ্লোগান হয়ে যায়।

স্টোয়িকরা আরো বলতেন সমস্ত প্রাকৃতিক ঘটনাই, যেমন অসুখ-বিসুখ এবং মৃত্যু, প্রকৃতির অলঙ্নীয় আইন অনুযায়ীই ঘটে। মানুষকে তাই তার নিয়তিকে মেনে নিবার শিক্ষাগ্রহণ করতে হবে। কোনো কিছু অপরিকল্পিতভাবে ঘটে না। কোনো না কোনো প্রয়োজনবশতই ঘটে সব কিছু। কাজেই নিয়তি যখন দরজায় এসে কড়া নাড়ে তখন অভিযোগ-অনুযোগ করে কোনো ফায়দা নেই। তারা ভাবতেন, সুখের ঘটনাগুলোকেও শান্তভাবেই গ্রহণ করা উচিত মানুষের। এই দিক থেকে স্টোয়িকদের একটা মিল লক্ষ করা যায় বিরাগীদের সঙ্গে, যাঁরা দাবি করতেন যে বাহ্যিক কোনো ঘটনাই গুরুত্বপূর্ণ নয়। এমনকী আজও আমরা দুঃখ-সুখে অবিচল কোনো মানুষের প্রসঙ্গে স্টোয়িসুলভ স্থিরতা-র কথা বলি।

.

এপিকিউরিয়দের কথা (The Epicureans)

আমরা দেখেছি, মানুষ কী করে একটি সুন্দর জীবনযাপন করতে পারে তাই নিয়ে সক্রেটিস উদ্বিগ্ন ছিলেন। বিরাগীরা এবং স্টোয়িকরা তাঁর দর্শনকে এইভাবে ব্যাখ্যা করেছেন যে বস্তুগত বিলাসিতা পরিত্যাগ করা মানুষের অবশ্যকর্তব্য। কিন্তু সক্রেটিসের আরেক ছাত্র ছিলেন, যার নাম এরিসটিপাস (Aristippus)। তিনি বিশ্বাস করতেন যে মানুষের জীবনের লক্ষ্য হচ্ছে যদূর সম্ভব ইন্দ্রিয়গত সুখ লাভ করা। তিনি বলতেন, আনন্দের চেয়ে ভালো আর কিছু নেই। অন্যদিকে সবচেয়ে অমঙ্গলকর জিনিস হচ্ছে ব্যথা-বেদনা। কাজেই তিনি জীবনযাপনের এমন একটি পদ্ধতি উদ্ভাবন করতে চাইলেন যার উদ্দেশ্য সব ধরনের যন্ত্রণা পরিহার করা। (বিরাগী আর স্টোয়িকরা সব ধরনের যন্ত্রণা সহ্য করায় বিশ্বাসী ছিলেন; যন্ত্রণা এড়িয়ে চলার চেষ্টার অর্থ ঠিক সেটা নয়।)

 ৩০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দের দিকে এপিকিউরাস (Epicurus ৩৪১-২৭০) এথেন্সে এক নতুন দর্শনের প্রবর্তন করেন। তাঁর অনুসারীরা এপিকিউরিয় নামে পরিচিত। এরিসটিপাস-এর আনন্দবাদ-এর কিছু সংস্কার করে এবং তার সঙ্গে ডেমোক্রিটাসের পরমাণু তত্ত্ব জুড়ে দিয়ে তিনি তাঁর দর্শন সৃষ্টি করেন।

জনশ্রুতি রয়েছে, এপিকিউরিয়রা একটি বাগানে বাস করতেন। সেই জন্যে তারা বাগানের দার্শনিক নামে পরিচিত হন। বাগানটির প্রবেশপথে টাঙানো একটি নোটিশে লেখা ছিল: আগন্তুক, এখানে তুমি সুন্দরভাবে জীবন কাটাতে পারবে। এখানে আনন্দই হচ্ছে পরম মঙ্গল।

কোনো কাজের আনন্দময় ফলকে সব সময় সেটার সম্ভাব্য পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ার বিপরীতে অবশ্যই বিচার করে দেখতে হবে বলে এপিকিউরাস দৃঢ় মত পোষণ করতেন। কখনো তোমার চকলেট খাওয়ার নেশা পেয়ে থাকলে এ-কথাটার অর্থ ভালোভাবে বুঝতে পারবে তুমি। আর যদি কখনো তা না পেয়ে থাকে তাহলে এই পরীক্ষাটা করে দেখো: তোমার জমানো হাত-খরচের টাকা থেকে দুশো ক্রাউনের চকলেট কিনে ফেলল। (ধরেই নেয়া হচ্ছে যে তুমি চকলেট খেতে পছন্দ করো।) তো, এখন, এই পরীক্ষাটি করার জন্য তোমাকে চকলেটগুলো অবশ্যই একসঙ্গে খেতে হবে, একটার পর একটা। প্রায় আধ ঘণ্টা পর যখন সবগুলো চকলেট খাওয়া হয়ে যাবে তখন-ই তুমি বুঝতে পারবে পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া বলতে এপিকিউরাস কী বলতে চেয়েছেন।

তিনি আরো বিশ্বাস করতেন যে অল্প সময় স্থায়ী কোনো আনন্দময় ঘটনাকে সম্ভাব্য আরো বড়, দীর্ঘসময়ব্যাপী আরো তীব্র আনন্দের বিপরীতে অবশ্যই বিচার করে দেখতে হবে। (যেমন ধরো, গোটা একটা বছর ধরে চকলেট খাওয়া বন্ধ রাখলে তুমি, কারণ হাত-খরচের সমস্ত টাকা জমিয়ে নতুন একটা বাইক কেনার বা বিদেশে একটা ব্যয়বহুল ভ্রমণে যাওয়ার কথা ভেবে রেখেছো মনে মনে।) আমরা আমাদের জীবন নিয়ে পরিকল্পনা করতে পারি, জীব-জন্তু তা পারে না। আমরা আমাদের আনন্দ নিয়ে হিসেব করতে পারি। চকলেট ভালো জিনিস, কিন্তু একটা নতুন বাইক বা ইংল্যান্ড-ভ্রমণ তার চেয়ে ভালো।

অবশ্য এপিকিউরাস এটাও দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে আনন্দ বলতে কেবল চকলেট খাওয়ার মতো ইন্দ্রিয় সুখই বোঝায় না। বন্ধুত্ব বা শিল্পরস বিচারের মতো বিষয়ও এর অন্তর্ভুক্ত। তাছাড়া জীবনকে উপভোগ করতে হলে আত্ম-সংযম, মিতাচার এবং প্রশান্ততার মতো প্রাচীন গ্রীক আদৰ্শগুলোরও প্রয়োজন রয়েছে। কামনাকে সংযত রাখতেই হবে এবং প্রশান্ততা আমাদের সাহায্য করবে যন্ত্রণা বা ব্যথা-বেদনা সহ্য করতে।

দেবতাদের ভয়ে অনেকেই এসে জড়ো হয়েছিল এপিকিউরাসের বাগানে। এই প্রসঙ্গে বলতে হয়, ধর্মীয় কুসংস্কার দূর করার ক্ষেত্রে ডেমোক্রিটাসের পরমাণু তত্ত্ব একটি কার্যকর ভূমিকা রেখেছিল। সুন্দর জীবনযাপন করার জন্যে মৃত্যুভয় জয় করাটা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। আর তা করতে গিয়ে এপিকিউরাস ডেমোক্রিটাস-এর আত্মা পরমাণু তত্ত্বকে কাজে লাগালেন। তোমার মনে থাকতে পারে যে ডেমোক্রিটাস বিশ্বাস করতেন যে মৃত্যুর পর কোনো জীবন নেই, কারণ আমরা যখন মারা যাই তখন আত্মা পরমাণুগুলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।

এপিকিউরাসের সহজ-সরল বক্তব্য ছিল এই মৃত্যু আমাদের বিচলিত করে না, তার কারণ যতক্ষণ আমরা জীবিত আছি ততক্ষণ মৃত্যুর কোনো অস্তিত্ব নেই। আর যখন তা আসে তখন আর আমাদের কোনো অস্তিত্ব থাকে না। (চিন্তা করে দেখো, এ-পর্যন্ত কেউই মারা যাওয়ার পর তা নিয়ে বিচলিত হয়নি।)

এপিকিউরাস তার এই মুক্তকারী দর্শনের সার কথা তুলে ধরেছেন, তাঁর ভাষায়, চারটে রোগহর লতার সাহায্যেঃ

দেবতাদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। মৃত্যু নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। মঙ্গল বা ভালো সহজেই অর্জন করা সম্ভব। ভয়ংকরকে সহজেই সহ্য করা যায়।

.

গ্রীক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে, দার্শনিক বিষয়বস্তুকে এভাবে চিকিৎসা বিজ্ঞানের নানান বিষয়ের সঙ্গে তুলনা করাটা নতুন কিছু নয়। উদ্দেশ্যটা ছিল নিছকই এই যাতে মানুষ এমন একটি দার্শনিক ওষুধ বাক্স-র অধিকারী হতে পারে যে-বাক্সে উল্লেখিত চারটি উপাদান থাকে।

রাজনীতি এবং সমাজ নিয়ে স্টোয়িকরা যথেষ্ট আগ্রহ দেখলেও, এপিকিউরিয়রা এ-দুটো বিষয় প্রায় উপেক্ষাই করে গেছেন। নির্জনে বাস করো! এটাই ছিল এপিকিউরাসের উপদেশ। তার বাগান-কে আমরা বর্তমান কালের কমিউন বা নানান সঙ্রে সঙ্গে তুলনা করতে পারি। আমাদের এই যুগেও অনেক মানুষ আছেন যারা একটু নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে নিয়েছেন, সমাজ থেকে দূরে।

 এপিকিউরাস-এর পর অনেক এপিকিউরিয়ই আত্ম-ইচ্ছাপূরণের ওপর মাত্রাতিরিক্ত মনোযোগ দেয়া শুরু করেন। তাঁদের মটো, ছিল বর্তমানের জন্যে বাঁচো! আমাদের যুগে এপিকিউরিয় শব্দটি নেতিবাচক অর্থে ব্যবহৃত হয় এবং তা এমন কাউকে বোঝায় যে শুধু আনন্দের জন্যে বাঁচে।

.

নব্যপ্লেটোবাদ (Neoplatonism)

তাহলে দেখলে যে বিরাগী, স্টোয়িক এবং এপিকিউরিয় এই তিনটি দর্শনের মূলেই নিহিত রয়েছে সক্রেটিসের শিক্ষা। অবশ্য হেরাক্লিটাস এবং ডেমোক্রিটাস-এর মতো সক্রেটিস-পূর্ব দার্শনিকের কাছেও এ-দর্শনগুলোর ঋণ রয়েছে।

তবে হেলেনিস্টিক সময়ের শেষ দিকে সবচেয়ে লক্ষণীয় দার্শনিক প্রবণতাটি মুখ্যত প্লেটোর দর্শন থেকেই অনুপ্রেরণা লাভ করেছিল। কাজেই সেটিকে বলা হয় নব্য-প্লেটোবাদ (Neoplatonism)।

নব্য প্লেটোবাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হচ্ছেন প্লটিনাস (Plotinus, ২০৫-২৭০ খ্রিস্টাব্দ)। তিনি দর্শন-শিক্ষা করেছিলেন আলেকজান্দ্রিয়ায়, কিন্তু থিতু হয়েছিলেন রোমে। লক্ষণীয় যে, তিনি আলেকজান্দ্রিয়ার মানুষ, যা ছিল কয়েক শতাব্দী ধরে গ্রীক সভ্যতা এবং প্রাচ্যদেশীয় মরমীবাদের মিলনস্থল। প্লটিনাস রোমে নিয়ে গিয়েছিলেন নির্বাণলাভের একটি তত্ত্ব; খ্রিস্ট ধর্ম যখন আবির্ভূত হয় তখন এই নির্বাণতত্ত্বটির সঙ্গে খ্রিস্টিয় মতবাদের জোর প্রতিযোগিতা হয়েছিল। খ্রিস্টিয় ধর্মতত্ত্বের ওপর অবশ্য নব-প্লেটোবাদেরও প্রবল প্রভাব পড়েছিল।

 প্লেটোর ভাববাদ এবং যেভাবে তিনি ভাবজগৎ আর ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের মধ্যে সীমারেখা টেনেছিলেন সে-কথা মনে করো, সোফি। সেটা ছিল দেহ এবং আত্মার মধ্যে একটি স্পষ্ট বিভাজন। এর ফলে মানুষ হয়ে পড়েছিল একটি দ্বৈত সত্তা: ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের অন্য সব কিছুর মতোই আমাদের দেহ ধূলি-মাটির তৈরি, তবে আমাদের একটি অমর আত্মাও আছে। প্লেটোর আগেও গ্রীসের অনেক মানুষ এ কথা বিশ্বাস করতো। প্লটিনাস-ও এশিয়াতে প্রচলিত এ-ধরনের ধারণার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন।

প্লটিনাস বিশ্বাস করতেন জগৎ দুটো মেরু বা প্রান্তের মধ্যে বিস্তৃত। এক প্রান্তে রয়েছে একটি স্বর্গীয় আলো যার নাম তিনি দিয়েছেন এক (one)। কখনো কখনো তিনি একে ঈশ্বর-ও বলেছেন। তো, অন্য প্রান্তে রয়েছে চরম অন্ধকার; এই প্রান্তে এক থেকে কোনো আলোই এসে পৌঁছায় না। কিন্তু প্লাটিনাস বলতে চান যে আসলে এই অন্ধকারের কোনো অস্থিত্ব নেই, এটা হচ্ছে স্রেফ আলোর অনুপস্থিতি অন্য কথায়, এটা হচ্ছে, না। যা কিছুর অস্তিত্ব আছে তা-ই হচ্ছে ঈশ্বর বা এক এবং আলোর একটি রশ্মি যেভাবে ধীরে ধীরে ম্লান হতে হতে শেষে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়, ঠিক সে-রকম, একটি স্থান রয়েছে যেখানে স্বর্গীয় দীপ্তি পৌঁছুতে পারে না।

প্লটিনাসের মতানুযায়ী, এক থেকে আসা আলোয় আত্ম উদ্ভাসিত হয়, অন্যদিকে বস্তু হচ্ছে অন্ধকার, যার কোনো অস্তিত্বই নেই আসলে। তবে প্রকৃতির আকারগুলো এক-এর একটা আবছা দীপ্তি পায়। মনে করো রাতের বেলা বিশাল একটি অগ্নিকুণ্ড তৈরি করা হয়েছে আর সেখান থেকে চারদিকে আগুনের স্ফুলিঙ্গ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। অগ্নিকুণ্ডটা থেকে আসা আলোর একটি বিশাল ব্যাসার্ধ দিনের মতো আলোকিত করে রেখেছে অগ্নিকুণ্ড সংলগ্ন এলাকাটি; তবে তা থেকে বের হওয়া আলোর দীপ্তি দেখা যাচ্ছে বেশ কয়েক মাইল দূর থেকেও। আমরা যদি আরো দূরে সরে যাই তাহলেও অন্ধকারের মধ্যে অনেক দূরের কোনো লণ্ঠন থেকে আসা ছোট্ট এক বিন্দু আলোর মতো একটু আলো দেখতে পাবো। এবং আমরা যদি এভাবে দূরে সরে যেতেই থাকি তাহলে একটা নির্দিষ্ট স্থানে যাওয়ার পর আলো আর পৌঁছাবে না আমাদের কাছে। একটা কোথাও গিয়ে আলোর রশ্মি রাতের অন্ধকারে হারিয়ে যায় এবং সম্পূর্ণ অন্ধকারে আমরা কিছুই দেখতে পাবো না। কোনো আকৃতিও না, কোনো ছায়াও না।

এখন মনে করো, বাস্তবতা হচ্ছে এ-রকম একটা অগ্নিকুণ্ড। যা পুড়ছে তা হলো ঈশ্বর আর দূরের অন্ধকার হচ্ছে সেই শীতল বস্তু যা দিয়ে মানুষ আর জীব-জন্তু তৈরি। ঈশ্বরের সবচেয়ে কাছেই রয়েছে শাশ্বত সব ধারণা যা সমস্ত প্রাণীর প্রাথমিক আকার। আর সবার ওপর মানবাত্মা হলো আগুনের একটা স্ফুলিঙ্গ। তারপরেও প্রকৃতির সবখানেই খানিকটা স্বর্গীয় আলো জ্বল জ্বল করছে। সে-আলো আমরা সমস্ত জীবন্ত প্রাণীর মধ্যে দেখতে পাই; এমনকী একটা গোলাপ বা রুবেল ফুলেও স্বর্গীয় দীপ্তি রয়েছে। সজীব ঈশ্বরের কাছ থেকে সবচেয়ে দূরে রয়েছে মাটি, পানি আর পাথর।

আমি আসলে বলতে চাইছি যে, যা কিছু অস্তিত্বশীল তার মধ্যেই স্বর্গীয় রহস্যের খানিকটা বর্তমান। একটি সূর্যমুখী বা পপি ফুলেও আমরা তা ঝকমক করতে দেখি। এই অতল রহস্যের আরো বেশ খানিকটা আমরা উপলব্ধি করতে পারি গাছের ডালে ডানা ঝাঁপটাতে থাকা একটা প্রজাপতি বা কোনো পাত্রে সাঁতার কাটতে থাকা গোল্ডফিশ দেখে। তবে আমাদের আত্মার ভেতরই আমরা ঈশ্বরের সবচেয়ে কাছাকাছি। একমাত্র এখানেই আমরা জীবনের বিশাল রহস্যের সঙ্গে এক হয়ে যেতেপারি। সত্যি কথা বলতে কী, কিছু কিছু খুবই বিরল মুহূর্তেই আমাদের এই অভিজ্ঞতা হয় বা মনে হয় আমরা নিজেরাই বুঝি সেই স্বর্গীয় রহস্য।

প্লটিনাসের উপমা বা রূপকটি খানিকটা বরং প্লেটোর গুহা-পুরাণের মতো। যতই আমরা গুহামুখটির কাছে যাই ততই আমরা সেই জিনিসটির নিকটবর্তী হই যা সমস্ত অস্তিত্বের উৎস। তবে প্লেটোর সুস্পষ্ট দ্বিস্তর বিশিষ্ট বাস্তবতার বিপরীতে পুটিনাসের মতবাদকে বিশিষ্টতা দান করেছে সম্পূর্ণতার একটি অভিজ্ঞতা। প্রতিটি জিনিস-ই এক, কারণ প্রতিটি জিনিসই ঈশ্বর। এমনকী প্লেটোর গুহার গহীন ভেতরেও এক এর একটি আবছা দীপ্তি রয়েছে।

জীবনের কয়েকটি অত্যন্ত বিরল মুহূর্তে নিজের আত্মার সঙ্গে ঈশ্বরের সম্মিলনের অভিজ্ঞতা হয়েছিল প্লটিনাসের। এই ব্যাপারটিকে আমরা বলি অতীন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা। এ-রকম অভিজ্ঞতা যে কেবল প্লটিনাসেরই হয়েছিল তা নয়। সর্বকালে সব সংস্কৃতির মানুষ এ-ধরনের অভিজ্ঞতার কথা বলেছে। সে-অভিজ্ঞতার বর্ণনা একেকজন একেকভাবে দিলেও মূল ব্যাপারগুলো একই। এবার তাহলে এ-সব কিছু ব্যাপারের দিকে নজর দেয়া যাক।

.

মরমীবাদ (Mysticism)

অতীন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা হচ্ছে ঈশ্বর বা বিশ্ব-চিদাত্মা-র (cosmic-spirit) সঙ্গে এক হয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা। ঈশ্বর এবং সৃষ্টির মধ্যে যোজন যোজন দূরত্বের কথা বলা হয়েছে অনেক ধর্মেই। কিন্তু অতীন্দ্রিয় অভিজ্ঞতাতে এ-ধরনের কোনো দূরত্ব নেই। নারী-পুরুষ উভয়ই ঈশ্বরের সঙ্গে এক হওয়ার বা তার সঙ্গে মিশে যাওয়ার অভিজ্ঞতা লাভ করেছে।

ধারণাটি এ-রকম যে, আমরা যাকে সাধারণত আমি বলি তা আসলে সত্যিকারের আমি নয়। বার কয়েকের ক্ষণিক দৃষ্টি-র ভেতর বৃহত্তর আমি-র সঙ্গে একাত্মবোধের অভিজ্ঞতা হতে পারে আমাদের। এই বৃহত্তর আমি-কে কোনো কোনো মরমীবাদী বলেছেন ঈশ্বর, কেউ কেউ বলেন বিশ্ব-চিদাত্মা, প্রকৃতি বা মহাবিশ্ব। যখন এই একীভবন (fusion) ঘটে তখন মরমীবাদী অনুভব করেন যে তিনি নিজেকে হারিয়ে ফেলছেন; তিনি ঈশ্বরের মধ্যে ঠিক এমনভাবে অদৃশ্য হয়ে যান বা হারিয়ে যান যেভাবে এক ফোঁটা পানি হারিয়ে যায় সাগরে গিয়ে মেশার পর। ভারতীয় এক মরমীবাদী একবার বিষয়টাকে এভাবে প্রকাশ করেছিলেন: যখন আমি ছিলাম তখন ঈশ্বর ছিল না। যখন ঈশ্বর আছে তখন আর আমি নেই। খ্রিস্টান মরমীবাদী অ্যাঞ্জেলাস সিলেসিয়াস (১৬২৪৭১৬৭৭) ব্যাপারটিকে বর্ণনা করেছিলেন আরেকভাবে প্রতিটি ফোঁটাই সমুদ্র হয়ে যায় যখন তা সমুদ্রের দিকে প্রবাহিত হয়, ঠিক যেমন আত্মা শেষ পর্যন্ত ওপরে উঠে ঈশ্বরে পরিণত হয়।

এখন, তোমার মনে হতে পারে যে নিজেকে হারিয়ে ফেলার ব্যাপারটি সে রকম আনন্দদায়ক কোনো বিষয় হতে পারে না। বুঝতে পারছি তুমি কী বলতে চাইছো। কিন্তু কথা হচ্ছে, তুমি যা পাচ্ছে তার তুলনায় তুমি যা হারিয়েছে তা নেহাতই সামান্য। হারানোর মুহূর্তে তুমি যে-অবস্থায় থাকো তুমি কেবল তা-ই হারাও, কিন্তু সেই সঙ্গে তুমি উপলব্ধি করো যে তুমি তার থেকেও আরো বড় হয়ে গেছো। তুমিই হয়ে পড়েছে মহাবিশ্ব। সত্যি কথা বলতে কী, সোফি, তুমিই বিশ্ব চিদাত্মা। তুমিই ঈশ্বর। সোফি অ্যামুন্ডসেন হিসেবে যদি নিজেকে তোমার হারাতে হয় তাহলে এই বিষয়টি স্মরণ করে বা জেনে তুমি স্বস্তি পেতে পারো যে এই নিত্যদিনকার আমি এমন একটা জিনিস যেটাকে একদিন না একদিন তোমাকে হারাতে হবেই। তোমার আসল আমি– যাকে তুমি কেবল তখনই উপলব্ধি করতে পারবে যখন তুমি নিজেকে হারাতে পারবে– মরমীবাদীদের মতে, এক রহস্যময় আগুনের মতো যা কিনা কোনো কালেও নেভে না, জ্বলতেই থাকে অনন্তকাল।

কিন্তু এ-ধরনের একটা অতীন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা সব সময় আপনা থেকে আসে না। কখনো কখনো মরমীবাদীকে বিশোধন আর আলোকপ্রাপ্তির পথ খুঁজে নিতে হয় ঈশ্বরের সাক্ষাৎ পেতে হলে। সহজ-সরল জীবন এবং ধ্যানের নানান কলা-কৌশলই হলো এই পথ। তারপর হঠাৎ করেই মরমীবাদী তার লক্ষ্য অর্জন করে ফেলেন এবং তখন তিনি দাবি করতে পারেন যে আমিই ঈশ্বর বা আমিই তুমি।

পৃথিবীর বড় বড় সব ধর্মেই মরমীবাদী প্রবণতা লক্ষ করা যায়। মরমীবাদীদের দেয়া অতীন্দ্রিয় অভিজ্ঞতার বর্ণনায় সমস্ত সাংস্কৃতিক সীমানা জুড়েই এক অসাধারণ সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়। অতীন্দ্রিয় অভিজ্ঞতাটির ধর্মীয় বা দার্শনিক ব্যাখ্যা দেবার প্রচেষ্টার মধ্যেই সেই মরমীবাদীর সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটটি আপনা আপনি বেরিয়ে আসে।

পাশ্চাত্য মরমীবাদ-এ, অর্থাৎ ইহুদী, খ্রিস্ট এবং ইসলাম ধর্মে, একজন মরমীবাদী এই কথাটির ওপর জোর দেন যে তার সাক্ষাৎটি ঘটে এক ব্যক্তিগত ঈশ্বরের সঙ্গে। ঈশ্বর যদিও প্রকৃতি এবং মানব আত্মা দুটোর মধ্যেই বর্তমান, কিন্তু সেই সঙ্গে তিনি জগতের অনেক ওপরে এবং দূরেও বটে। প্রাচ্য মরমীবাদ-এ, অর্থাৎ হিন্দু, বৌদ্ধ এবং চৈনিক ধর্মে, এটাই জোর দিয়ে বলা হয়ে থাকে সাধারণত যে মরমীবাদী ঈশ্বর বা বিশ্ব-চিদাত্মার সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে একীভূত হওয়ার অভিজ্ঞতা লাভ করেন।

মরমীবাদী বলতে পারেন আমি-ই বিশ্ব-চিদাত্মা বা আমি-ই ঈশ্বর। কারণ ঈশ্বর কেবল জগতেই বিরাজমান নন; আবার তাকে এর বাইরেও পাওয়া যাবে না।

বিশেষ করে ভারতে, প্লেটোর সময়েরও অনেক আগে থেকে, শক্তিশালী মরমীবাদী আন্দোলন হয়ে এসেছে। পশ্চিমা জগতে হিন্দু ধর্মের পরিচয় করিয়ে দেবার ক্ষেত্রে যার ভূমিকা প্রধান, স্বামী বিবেকানন্দ নামে সেই ভারতীয় বলেছিলেন, ঠিক যেমন কিছু পশ্চিমা ধর্ম বলে যে যে-সমস্ত মানুষ একজন ব্যক্তিগত ঈশ্বরে বিশ্বাসী নয় তারা নাস্তিক, তেমনি আমরাও বলি যে যে-মানুষটি তার নিজের প্রতি বিশ্বাসী নয় সে একজন নাস্তিক। নিজের আত্মার অসাধারণত্বে অবিশ্বাসকেই আমরা নাস্তিক্যবাদ বলি।

একটি অতীন্দ্রিয় বা মরমীয়া অভিজ্ঞতার নীতিগত গুরুত্ব-ও থাকতে পারে। ভারতের একজন সাবেক প্রেসিডেন্ট সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ একবার বলেছিলেন, প্রতিবেশীকে নিজের মতোই ভালোবাসো, তার কারণ তুমিই তোমার প্রতিবেশী। তোমার প্রতিবেশী তুমি ছাড়া অন্য কেউ এটা একটি বিভ্রান্তি ছাড়া কিছু নয়।

আমাদের সময়ে যে-সব মানুষ বিশেষ কোনো ধর্মের অনুসারী নয়, তাদের মধ্যেও কেউ কেউ নানান অতীন্দ্রিয় অভিজ্ঞতার কথা বলে থাকে। হঠাৎ করেই তাদের এমন একটি অভিজ্ঞতা হয়েছে যেটাকে তারা বর্ণনা করেছে বিশ্ব-চৈতন্য বলে বা মহাসামুদ্রিক অনুভূতি বলে। তাদের কাছে মনে হয়েছে তাদেরকে সময়ের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হয়েছে এবং তারা জগৎকে উপলব্ধি করেছে শাশ্বতের বা চিরন্তনের পরিপ্রেক্ষিত থেকে।

.

বিছানায় উঠে বসল সোফি। দেহ বলে সত্যিই তার কিছু আছে কিনা সে-কথাটা সে না ভেবে পারল না। তার মনে হচ্ছিল সে বুঝি ঘরের মধ্যে, জানলার বাইরে আর শহরের অনেক ওপর দিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে। সেখান থেকে সে নিচে স্কোয়্যারের সমস্ত লোকজনের দিকে তাকিয়েছে আর তারপর যেটা তার আবাসস্থল সেই পৃথিবীর ওপর দিয়ে ভেসেই চলেছে, উত্তর সাগর আর ইউরোপের ওপর দিয়ে, সাহারা মরুভূমিকে নিচে রেখে, আফ্রিকার দিগন্ত বিস্তৃত তৃণভূমি পেরিয়ে।

পুরো জগন্টাই যেন একটা জীবন্ত ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছে আর মনে হচ্ছে সেই ব্যক্তিটি সোফি নিজে। জগৎটাই আমি, ভাবল সোফি। ব্যাপক, বিশাল যে মহাবিশ্বকে তার প্রায়ই রহস্যময় আর ভয়ংকর বলে মনে হতো তা যেন তার নিজের আমি। মহাবিশ্বটা এখনো অবশ্য প্রকাণ্ড আর রাজকীয়ই আছে, কিন্তু এবার সে নিজেই অতোটা বড় হয়ে গেছে।

অসাধারণ সেই অনুভূতিটা ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে, কিন্তু সোফির মনে হলো অনুভূতিটা সে কখনোই ভুলতে পারবে না। মনে হচ্ছে তার ভেতরে যেন কিছু একটা বিস্ফোরিত হয়ে তার কপাল ফেটে বেরিয়ে গিয়ে অন্য সব কিছুর সঙ্গে মিলে মিশে এক হয়ে গেছে, ঠিক যেভাবে এক ফোঁটা রঙ এক জগ পানিকে রঙিন করে ফেলে।

ব্যাপারটা যখন শেষ হয়ে গেল তখন তার মনে হলো এটা যেন একটা চমৎকার স্বপ্ন দেখে মাথাব্যথা নিয়ে ঘুম থেকে জেগে ওঠার মতো। সামান্য বিভ্রান্তির সঙ্গে সোফি টের পেল তার একটা দেহ আছে যেটা বিছানায় উঠে বসার চেষ্টা করছে। উপুড় হয়ে অ্যালবার্টো নক্সের লেখা পড়তে পড়তে তার পিঠ ব্যথা হয়ে গেছে। তবে সেই সঙ্গে তার অবিস্মরণীয় একটা অভিজ্ঞতাও হয়েছে।

শেষ পর্যন্ত সে নিজের সমস্ত শক্তি এক করে উঠে দাঁড়াল। তারপর প্রথমেই যে কাজটা করল তা হলো পৃষ্ঠাগুলোতে ফুটো করে সেগুলোকে তার অন্যান্য লেসনের সঙ্গে রিং বাইন্ডারে ফাইল করে রাখল। তারপর চলে এলো বাগানে।

 পাখিরা এমন করে ডাকছে যেন জগন্টা সদ্য সৃষ্টি হয়েছে। খরগোশ রাখার পুরানো খাঁচাগুলোর পেছনে বাৰ্চগাছের আবছা সবুজে ভাবটা এমন তীব্র যে মনে হচ্ছে স্রষ্টা বুঝি রঙগুলো সব এখনো ভালো করে মেশানো শেষ করতে পারেন নি।

সত্যিই কি সে বিশ্বাস করবে যে প্রতিটি জিনিসই এক স্বর্গীয় আমি? সে কি বিশ্বাস করবে যে তার আত্মার ভেতর সে আগুনের একটা স্ফুলিঙ্গ বহন করছে? যদি তা সত্যি হয় তাহলে সে সত্যিই এক স্বর্গীয় প্রাণী।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *