০৭. সক্রেটিস
…যে জানে যে সে কিছুই জানে না সে-ই সবচেয়ে জ্ঞানী..
একটা সামার ড্রেস পরে দ্রুত রান্নাঘরে নেমে এলো সোফি। সেখানে টেবিলটার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন তার মা। সোফি ঠিক করে রেশমি স্কাটা নিয়ে কোনো কথা বলবে না সে।
তুমি কি খবরের কাগজটা নিয়ে এসেছিলে? সোফি জিগ্যেস করে।
আমাকে একটু এনে দিবি তুই?
এক ছুটে দরজা দিয়ে বেরিয়ে যায় সোফি, নুড়ি-বিছানো পথ ধরে পৌঁছে যায় ডাকবাক্সের কাছে।
শুধুই খবরের কাগজটা। এতো তাড়াতাড়ি জবাব আশা করতে পারে না সে, তার মনে হলো। খবরের কাগজের সামনের পাতায় লেবাননে নরওয়েজিও জাতিসংঘ বাহিনী সম্পর্কে কিছু একটা পড়ল সে।
জাতিসংঘ বাহিনী … হিল্ডার বাবার কাছ থেকে আসা কার্ডগুলোতে এই পোস্ট মার্ক-ই ছিল না? ডাকটিকেটটা অবশ্য নরওয়ের। হতে পারে জাতিসংঘ বাহিনীর নরওয়েজিও সৈন্যদের নিজস্ব একটা ডাকঘর আছে ওখানে।
খবরের কাগজের ব্যাপারে তুই বেশ আগ্রহী হয়ে উঠেছিস? সোফি রান্নাঘরে ফিরে আসতে শুকনো কণ্ঠে বললেন তার মা।
ভাগ্য ভালো তিনি নাশতার সময় বা পরে ডাকবাক্স এবং চিঠিপত্র নিয়ে আর কিছু বললেন না। তিনি কেনাকাটা করতে বেরোলে পর সোফি নিয়তি নিয়ে লেখা তার চিঠিটা সঙ্গে করে গুহায় চলে গেল।
দার্শনিকের কাছ থেকে আসা অন্যান্য চিঠি রাখা বিস্কিটের টিনটার পাশে ছোট্ট একটা সাদা খাম দেখে অবাক হলো সে। সোফি নিশ্চিত খামটা সে রাখেনি ওখানে।
এটারও প্রান্তের দিকটা ভেজা। তাছাড়া এটার গায়েও ঠিক কালকে পাওয়া খামটার মতোই দুটো গভীর গর্ত রয়েছে।
দার্শনিক কি এসেছিলেন এখানে? তিনি কি তার লুকানোর গোপন জায়গাটার কথা জানেন? খামটা ভেজা কেন?
এতো সব প্রশ্ন তার মাথাটা ঘুরিয়ে দিল। চিঠিটা খুলে নোটটা পড়ল সে:
প্রিয় সোফি, প্রবল আগ্রহ নিয়ে তোমার চিঠিটা পড়লাম, খানিকটা দুঃখ-ও যে হলো না তা নয়। দুর্ভাগ্যক্রমে, আমন্ত্রণের ব্যাপারে তোমাকে হতাশ করতেই হচ্ছে। দেখা আমাদের হবে একদিন, তবে ক্যাপ্টেনের বাঁকে আমার সশরীরে আসতে এখনো সম্ভবত বেশ কিছু দিন দেরি হবে।
সেই সঙ্গে একটা কথা যোগ করতে হচ্ছে যে এখন থেকে আমার পক্ষে আর নিজে গিয়ে চিঠি দিয়ে আসা সম্ভব হবে না। পরিণামে ব্যাপারটা বড্ড বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়বে। ভবিষ্যতে আমার ক্ষুদে বার্তাবাহক গিয়ে চিঠি দিয়ে আসবে। তাছাড়া সেগুলো সরাসরি বাগানের গোপন জায়গাতে দিয়ে আসা হবে।
দরকার মনে করলে যে-কোনো সময় যোগাযোগ করতে পারো তুমি আমার সঙ্গে। যখনই করো, একটা গোলাপী খামে একটা বিস্কিট বা এক মুঠো চিনি-ও ভরে দিও। বার্তাবাহক ওটা পেলে সোজা আমার কাছে নিয়ে আসবে।
পুনশ্চ: কোনো তরুণীর কফির আমন্ত্রণ ফিরিয়ে দেয়াটা শোভন নয়, তবে মাঝে মধ্যে তা করতে হয় প্রয়োজনের খাতিরে।
পুনঃ পুনশ্চ: কোথাও যদি একটা লাল রেশমি স্কার্ফ পাও, দয়া করে সেটা যত্ন করে রেখো। মাঝে মাঝে মানুষের ব্যক্তিগত জিনিস-পত্র অদল বদল হয়ে যায়। বিশেষ করে স্কুলে এবং এ-ধরনের জায়গায় আর এটা দর্শনের একটা স্কুল তো বটেই।
তোমার, আ্যালবার্টো নক্স
.
সোফির বয়স প্রায় পনেরো বছর আর তার এই তরুণ জীবনে এ-অবধি সে বেশ কিছু চিঠি পেয়েছে, বিশেষ করে বড় দিন আর জন্মদিনে। কিন্তু এই চিঠিটার মতো এতো অদ্ভুত চিঠি সে কোনোদিন পায়নি।
কোনো ডাকটিকেট নেই এটার গায়ে। এমনকী, এটা কোনো ডাকবাক্সেও ফেলা হয়নি। পুরনো বেড়ার মধ্যে সোফির একান্ত গোপন লুকানোর জায়গাতে সরাসরি নিয়ে আসা হয়েছে চিঠিটা। তাছাড়া, বসন্তের এই শুকনো আবহাওয়াতে চিঠিটা যে ভেজা অবস্থায় পাওয়া গেছে সেটাও খুব রহস্যজনক।
অবশ্য সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে রেশমি স্কাফটা। দার্শনিকের নিশ্চয়ই আরেকজন ছাত্রী আছে। ঠিক তাই। আর এই ছাত্রীটি লাল একটা রেশমি স্কার্ফ হারিয়ে ফেলেছে। ঠিক। কিন্তু সেটা সে সোফির বিছানায় হারাল কী করে?
আর তাছাড়া, অ্যালবার্টো নক্স … এটা আবার কী ধরনের নাম?
একটা ব্যাপার নিশ্চিত-দার্শনিক আর হিল্ডা মোলার ন্যাগের মধ্যেকার সম্পর্ক। কিন্তু হিল্ডার নিজের বাবা তাঁদের ঠিকানা গুলিয়ে ফেলছেন, এটা একবারেই বোঝা যাচ্ছে না।
হিল্ডা আর তার নিজের মধ্যে সম্ভাব্য কী সম্পর্ক থাকতে পারে বসে বসে সে কথা ভাবতে লাগল সোফি অনেকক্ষণ ধরে। শেষমেষ হাল ছেড়ে দিল সে। দার্শনিক লিখেছেন একদিন ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা হবে তার। হয়ত হিল্ডার সঙ্গেও দেখা হবে তার।
চিঠিটা ওল্টাল সে। এবার সে দেখল ওটার উল্টো দিকেও কিছু কথা লেখা রয়েছে:
স্বাভাবিক শালীনতা বলে কি কিছু আছে?
যে জানে যে সে কিছুই জানে না সে-ই সবচেয়ে জ্ঞানী..
সত্যিকারের উপলব্ধি ভেতর থেকেই আসে।
যে জানে কোন কাজটি সঠিক সে ঠিক কাজটিই করবে।
সোফি জানে সাদা খামে ছোট ছোট বাক্য আসে তাকে পরের বড় খামটার জন্যে প্রস্তুত করার জন্যে এবং সে-খামটা খানিক পরেই এসে পৌঁছুবে। হঠাৎই একটা বুদ্ধি এলো সোফির মাথায়। বার্তাবাহক যদি একটা বাদামি খাম দিতে গুহায় আসে তাহলে তো সে স্রেফ এখানেই বসে থাকতে পারে লোকটার জন্যে। সে কি পুরুষ স্ত্রীলোক? তা সেই পুরুষ বা স্ত্রীলোকটি তাকে দার্শনিক সম্পর্কে আরো কিছু জানাতে পারে কিনা তা দেখার জন্যে সে আলবাৎ বসে থাকবে। চিঠিতে বলা হয়েছে বার্তাবাহক ছোট্ট। তাহলে সে কি কোনো শিশু?
স্বাভাবিক শালীনতা বলে কি কিছু আছে?
সোফি জানে শালীনতা লজ্জাশীলতা শব্দটারই সেকেলে রূপ, এই যেমন নগ্ন অবস্থায় কেউ দেখে ফেলবার লজ্জা। কিন্তু এ-ব্যাপারে অস্বস্তি বোধ করাটা কি আসলেই স্বাভাবিক? কোনো কিছু যদি স্বাভাবিকই হয় তাহলে তো তা সবার জন্যেই একই হওয়ার কথা। পৃথিবীর অনেক জায়গাতেই, নগ্ন থাকাটা একবারে স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। তার মানে, নিশ্চয়ই সমাজ-ই ঠিক করে আমরা কী করতে পারি আর পারি না। দাদীর যখন তরুণ বয়স তখন নিশ্চয়ই লোকে টপলেস হয়ে সানবাথ করতে পারতো না। কিন্তু এখন বেশির ভাগ লোকই এটাকে স্বাভাবিক বলেই মনে করে, যদিও অনেক দেশেই কাজটা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। সোফি ভাবল, এটা কি দর্শন?
পরের বাক্যটা হলো: যে জানে যে সে কিছুই জানে না সে-ই সবচেয়ে জ্ঞানী।
কার চেয়ে বেশি জ্ঞানী? দার্শনিক যদি এ-কথা বুঝিয়ে থাকেন যে, যে-মানুষটি উপলব্ধি করে যে সে জগতের সব কিছু জানে না সে অন্য একজন যে সামান্য কিছু জানার পরেও অনেক কিছু জানে বলে মনে করে তার চেয়ে বেশি জ্ঞানী তাহলে সে কথার সঙ্গে একমত হওয়া এমন কোনো কঠিন বিষয় নয়। ব্যাপারটা সোফি আগে ভেবে দেখেনি কখনো। কিন্তু এখন যতই ভাবল ততই পরিষ্কারভাবে সে উপলব্ধি করল যে কেউ যদি জানে সে কী জানে না তাহলে সেটাও এক ধরনের জ্ঞানই হলো। ওর জানামতে সবচেয়ে নির্বোধের মতো কাজ হলো কোনো ব্যাপারে কোনো কিছুই না জেনে সে-ব্যাপারেই জানার ভান করা।
পরের বাক্যটা ভেতর থেকে প্রকৃত অন্তদৃষ্টি আসার বিষয়ে। কিন্তু লোকের মাথায় জ্ঞান তো আসে বাইরে থেকেই, তাই না? অন্য দিকে আবার সোফির এমন সব ঘটনার কথা মনে পড়ল যখন তার মা বা স্কুলে তার শিক্ষকরা তাকে এমন কিছু শেখাতে চেয়েছেন যা শেখার মতো উৎসাহ ছিল না তার। সত্যিই যখন কোনো কিছু সে শিখেছে সেটা হয়েছে এই জন্যে যে তখন কোনো না কোনোভাবে সে নিজে তাতে অংশ নিয়েছে। তারপরেও, মাঝে মধ্যেই, হঠাৎ করে সে এমন কিছু বুঝে ফেলে যে-ব্যাপারে আগে একবারেই অন্ধকারে ছিল সে। সম্ভবত অন্তদৃষ্টি বলতে লোকে এটাকেই বুঝিয়ে থাকে।
এ-পর্যন্ত ভালোই এগিয়েছে সে। সোফির মনে হলো প্রথম তিনটে প্রশ্ন সে মোটামুটিমুটি ভালোভাবেই সামাল দিয়েছে। কিন্তু এর পরের বক্তব্যটা এতোই অদ্ভুত যে না হেসে পারল না সে: যে জানে কোন কাজটি সঠিক সে ঠিক কাজটিই করবে।
এর মানে কি এই যে একজন ব্যাংক ডাকাত অন্য কোনো ভালো কাজের কথা না জানার কারণেই ব্যাংক ডাকাতি করে? সোফির তা মনে হয় না।
বরং তার মনে হলো যে, বাচ্চা এবং বড়রা খারাপ কাজ করার পর যে অনুশোচনা করে তার কারণ ঠিক এই যে তারা তাদের শ্রেয়তর বিবেচনার বিরুদ্ধে গিয়েই কাজগুলো করেছিল।
সে যখন এ-সব ভাবছে বসে বসে, তার কানে এলো বনের একেবারে ধারের বেড়ার ওপাশে শুকনো ঝোঁপঝাড়ের ভেতর খসখস একটা আওয়াজ হচ্ছে। সেই বার্তাবাহক নাকি? হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল সোফির। শব্দটা শুনে মনে হচ্ছে কোন জন্তু আসছে বুঝি হাঁপাতে হাঁপাতে।
আর ঠিক সেই মুহূর্তেই একটা ল্যাব্রাডর এসে ঢুকল গুহার ভেতর।
সেটার মুখে বড়সড় একটা বাদামি খাম, সোফির পায়ের কাছে সেটা ফেলল কুকুরটা। ব্যাপারটা এতো তাড়াতাড়ি ঘটে গেল যে কিছু করারই সুযোগ পেল না সোফি। এক সেকেন্ড পর দেখা গেল হাতে বাদামি খামটা নিয়ে বসে পড়েছে সে, ওদিকে সোনালী ল্যাব্রাডরটা এক ছুটে হারিয়ে গেছে বনের ভেতর।
সব কিছু ঘটে যাওয়ার পরেই কেবল প্রতিক্রিয়া দেখা গেল সোফির মধ্যে। কাঁদতে শুরু করল সে।
কিছুক্ষণ ওভাবেই বসে রইল সে, সময় সম্পর্কে কোনো বোধই রইল না।
তারপর হঠাৎ করে মুখ তুলে তাকাল সে।
তাহলে এই হচ্ছে সেই বিখ্যাত বার্তাবাহক! স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস ফেলল সোফি। এজন্যেই সাদা খামগুলোর প্রান্তের দিকটা ভেজা থাকত, ফুটো থাকত গায়ে। ব্যাপারটা তার মাথায় এলো না কেন? দার্শনিককে সে চিঠি লিখলে খামের ভেতর বিস্কিট বা চিনির ডেলা রাখার ব্যাপারটা বোঝা যাচ্ছে এখন।
যতোটা চালাক সে হয়ে উঠতে চায় ততটা চালাক হয়ত সব সময় সে হয়ে উঠতে পারে না। কিন্তু বার্তাবাহক যে একটা ট্রেইন্ড কুকুর হবে সে-কথা কে ভেবেছিল! কম করে বললে বলতে হয়, ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত! অ্যালবার্টো নক্সের খোঁজ-খবর নেয়ার জন্যে বার্তাবাহককে জোর করার কথা এখন সে ভুলে যেতে পারে।
বড় খামটা খুলে পড়তে শুরু করল সোফি।
.
এথেন্স– এর দর্শন
প্রিয় সোফি, এই লেখা যখন তুমি পড়বে তার আগেই হয়ত হার্মেস-এর সঙ্গে পরিচয় হয়ে গিয়ে থাকবে তোমার। ঘটনাক্রমে যদি তা না হয়ে থাকে সেজন্যে বলে রাখছি হামেস একটা কুকুর। তবে ঘাবড়াবার কিছু নেই। ও খুব শান্ত-শিষ্ট, তাছাড়া, অনেক মানুষের চেয়েই বেশি বুদ্ধি ধরে। ও যতটা চালাক তার চেয়ে চালাক বলে নিজেকে জাহির করার চেষ্টা হামেস করে না কখনোই।
আরকটা বিষয় হয়ত লক্ষ করে থাকবে তুমি যে ওর নামটা কিন্তু সাধারণ কোনো নাম নয়।
গ্রীক পুরাণ অনুযায়ী হামেস হচ্ছেন দেবতাদের বার্তাবাহক। তিনি অবশ্যি সমুদ্রচারীদেরও দেবতা ছিলেন, কিন্তু তা নিয়ে আমাদের মাথা না ঘামালেও চলবে, অন্তত উপস্থিত সময়ের জন্যে। এর থেকে ঢের গুরুত্বপূর্ণ কথাটা হলো হার্মেসের নাম থেকেই হার্মেটিক (hermetic) কথাটা এসেছে, যার অর্থ গুপ্ত বা অগম্য– হার্মেস যেভাবে তোমাকে আর আমাকে পরস্পরের কাছ থেকে আড়াল করে রাখার ব্যাপারে ভূমিকা রাখছে সেদিক থেকে বিবেচনা করলে নামটা যে উপযুক্ত নয় তা বলা যবে না।
তো, এই হলো গিয়ে বার্তাবাহকের পরিচয়। স্বভাবতই, নাম ধরে ডাকলে ও সাড়া দেয়, তাছাড়া, মোটের ওপর বেশ ভদ্র ও।
যাই হোক, দর্শন প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক। এরিমধ্যে আমরা কোর্সের প্রথম অংশটা শেষ করে ফেলেছি। মানে, প্রকৃতিবাদী দার্শনিক আর পৌরাণিক বিশ্ব থেকে তাদের যুগান্তকারী বিচ্ছেদের কথা বলছি। এবার আমরা তিন জন মহান ধ্রুপদী দার্শনিক সক্রেটিস, প্লেটো আর অ্যারিস্টটল-এর কাছে যাবো। এই তিন জনের প্রত্যেকেই যার যার নিজের মতো করে সমস্ত ইউরোপিয় সভ্যতাকে প্রভাবিত করেছেন।
প্রকৃতিবাদী দার্শনিকদের সক্রেটিস-পূর্ব দার্শনিকও বলা হয় তার কারণ তারা সক্রেটিসের আগে জন্মেছিলেন। ডেমোক্রিটাস যদিও সক্রেটিসের মুত্যুর কয়েক বছর পরে মারা যান কিন্তু তাঁর সমস্ত ধারণাই সক্রেটিস-পূর্ব দার্শনিকদের প্রকৃতিবাদী দর্শনের অন্তর্ভুক্ত। সক্রেটিস একটি নতুন যুগের প্রতিনিধি, ভৌগোলিকভাবে যেমন, কালগতভাবেও তাই। এথেন্সের মহান দার্শনিকদের মধ্যে তিনিই প্রথম জন্মেছিলেন সেখানে। তিনি এবং তাঁর দুই উত্তরসূরী এই এথেন্সেই জন্মগ্রহণ করেন, এথেন্সেই অতিবাহিত করেন তাদের কর্মজীবন। তোমার মনে পড়তে পারে, অ্যানাক্সাগোরাস কিছুদিন এথেন্সে কাটিয়েছিলেন, কিন্তু সূর্যকে একটা লোহিত-তপ্ত পাথর বলে অভিহিত করায় তাকে সেখান থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়। (সক্রেটিসের বরাতেও এর চেয়ে ভালো কিছু জোটেনি!)
সক্রেটিসের সময় থেকেই এথেন্স গ্রীক সংস্কৃতির কেন্দ্রস্থল। তাছাড়া খোদ দর্শনগত প্রকল্পের চরিত্র বদলের দিকেও আমাদের নজর রাখা জরুরি যে তা প্রকৃতিবাদী দর্শন থেকে সক্রেটিসের দিকে এগোচ্ছে। তবে সক্রেটিসের সঙ্গে সাক্ষাতের আগে চলো তথাকথিত সোফিস্টদের কথা শোনা যাক একটু। সক্রেটিসের সময় ওঁরাই নিয়ন্ত্রণ করতেন এথেনিয় দৃশ্যপট।
যবনিকা উঠছে সোফি! ধারণার ইতিহাস বহু অংকে বিভক্ত একটি নাটকের মতো।
.
কেন্দ্রস্থিত মানুষ
মোটামুটি খ্রিস্ট পূর্ব ৪৫০ অব্দের পর এথেন্সই ছিল গ্রীক বিশ্বের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। এই সময় থেকেই এক নতুন দিকে মোড় নেয় দর্শন।
প্রকৃতিনির্ভর দার্শনিকেরা মূলত প্রাকৃতিক জগতের স্বরূপ খোঁজায় ব্যস্ত ছিলেন। তার ফলে বিজ্ঞানের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করেন তাঁরা। তো, এথেন্সে এবার মনোযোগটা পড়ল ব্যক্তি মানুষের ওপর, সমাজে ব্যক্তিমানুষের অবস্থানের ওপর। ধীরে ধীরে উদ্ভব হলে গণতন্ত্রের, সঙ্গে এলো গণ-পরিষদ আর আইন আদালত।
গণতন্ত্র যাতে কার্যকর হতে পারে সেজন্যে আসলে জনগণকে যথেষ্ট শিক্ষিত হতে হয়, যাতে করে তারা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারে। আমরা আমাদের সময়ে দেখেছি কীভাবে একটি অপরিণত গণতন্ত্রের গণজাগরণের দরকার হয়। এথেনীয়দের জন্যে সর্বপ্রথমেই দরকার হয়েছিল বাগ্মিতাবিদ্যা অর্থাৎ বক্তব্যকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার বিদ্যা শেখার।
গ্রীসের উপনিবেশ থেকে ভ্রাম্যমাণ একদল শিক্ষক এবং দার্শনিক এথেন্সে চলে এসেছিলেন। নিজেদেরকে তারা সোফিস্ট (Sophist) বলতেন। সোফিস্ট শব্দটার মানে হচ্ছে জ্ঞানী এবং ওয়াকিবহাল মানুষ। এথেন্সে এই সোফিস্ট নাগরিকদেরকে অর্থের বিনিময়ে শিক্ষা দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন।
প্রকৃতিবাদী দার্শনিকদের সঙ্গে একটি জায়গায় চরিত্রগত মিল ছিল সোফিস্টদের: তাঁরাও ছিলেন সনাতন পুরাণের সমালোচক। তবে সেই সঙ্গে তারা দর্শনগত চিন্তা ভাবনাকে অসার বলে বাতিলও করে দিতেন। তাঁরা বলতেন দর্শনগত প্রশ্নের উত্তর হয়ত খুঁজলে পাওয়া সম্ভব, কিন্তু মানুষ প্রকৃতি এবং মহাবিশ্ব সংক্রান্ত ধাঁধাগুলোর জবাব কোনোদিন জানতে পারবে না। দর্শনের পরিভাষায় এ-ধরনের দৃষ্টিভঙ্গির নাম সংশয়বাদ (skepticism)।
প্রকৃতির সব হেঁয়ালির জবাব না হয় না-ই দেয়া গেল, কিন্তু একটা কথা আমরা জানি যে কী করে সবার সঙ্গে বাস করতে হয় সেটা মানুষকে শিখতে হয়। তো, মানুষ এবং সমাজে মানুষের অবস্থানকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হলো সোফিস্টদের চিন্তা-ভাবনা।
প্রোটাগোরাস (Protagoras, ৪৮৫-৪১০ খ্রি. পূ.) নামের এক সোফিস্ট বলেছিলেন, মানুষই সব কিছু বিচারের মাপকাঠি। তিনি আসলে বলতে চেয়েছিলেন যে একটি জিনিস ন্যায় না অন্যায়, ভালো না মন্দ তা সব সময়ই মানুষের প্রয়োজনের নিরিখে বিচার করতে হবে। গ্রীসের দেবতাদের অস্তিত্বে তিনি বিশ্বাসী কিনা এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, প্রশ্নটা জটিল, কিন্তু জীবনটা ছোট। যিনি স্পষ্টভাবে বলতে পারেন না ঈশ্বর বা দেবতার অস্তিত্ব আছে কি নেই তাঁকে বলা হয় অজ্ঞাবাদী (agnostic)।
সাধারণত নানান জায়গায় ঘুরে বেড়াতেন সোফিস্টা, ফলে বিভিন্ন ধরনের সরকার নজরে পড়েছিল তাঁদের। নগর-রাষ্ট্রগুলোতে চিরাচরিত রীতিনীতি আর স্থানীয় আইন-কানুনের নানান রকমফের প্রচলিত ছিল। তাতে করে, এ-সবের কোনগুলো স্বাভাবিক আর কোনগুলো সামাজিকভাবে আরোপিত এই নিয়ে প্রশ্ন তোলেন সোফিস্টরা। এবং তার ফলে তারা এথেন্স নগর-রাষ্ট্রে সামাজিক সমালোচনা (social criticism)-র পথ সুগম করেন।
এই যেমন তারা এ-কথা বলতে পারতেন যে স্বাভাবিক শালীনতা সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কারণ শালীন হওয়া যদি স্বাভাবিক হয়ে থাকে তাহলে নিশ্চয়ই এই গুণটি নিয়েই আমাদের জন্ম হয়েছে। অর্থাৎ এটা আমাদের সহজাত। কিন্তু সোফি, সত্যি কি এটা সহজাত না সামাজিকভাবে আরোপিত? যিনি সারা পৃথিবী ভ্রমণ করেছেন তাঁর কাছে উত্তরটা খুব সহজ। নিজেকে নগ্নভাবে মানুষের সামনে হাজির করাটা স্বাভাবিক-ও নয়, সহজাত-ও নয়। লাজুক হওয়া বা না হওয়া পুরোটাই মুখ্যত এবং প্রধানত একটা সামাজিক প্রথা।
বুঝতেই পারছো যে ভ্রাম্যমাণ সোফিস্টরা এই কথা বলে এথেন্সে একেবারে তুলকালাম কাণ্ড বাঁধিয়ে দিয়েছিলেন যে কোনটি ন্যায় আর কোনটি অন্যায় এ ব্যাপারে কোনো পরম মানদণ্ড নেই।
অন্যদিকে সক্রেটিস দেখাতে চেয়েছিলেন যে কিছু কিছু রীতিনীতি আছে যেগুলো পরম এবং বিশ্বজনীনভাবে প্রযোজ্য।
.
সক্রেটিস কে ছিলেন?
সমস্ত দর্শনের ইতিহাসে সক্রেটিস-ই (Socrates, ৪৭০-৩৯৯ খ্রি. পূ.) সম্ভবত সবচেয়ে রহস্যময় ব্যক্তি। একটি বাক্য-ও লেখেননি তিনি। তারপরেও, ইউরোপিয় চিন্তা-ভাবনার ক্ষেত্রে তার চেয়ে বড় প্রভাব আর কেউ ফেলতে পারেননি। তাঁর মৃত্যুর ঘটনাও এর জন্যে কম দায়ী নয়।
আমরা জানি, তার জন্ম এথেন্সে এবং তিনি তাঁর জীবনের বেশিরভাগ সময়ই শহরের নানান চত্বরে চত্বরে আর বাজারে বাজারে ঘুরে বেড়িয়েছেন সেখানকার লোকজনের সঙ্গে কথা বলে বলে। তিনি বলতেন, গ্রামের গাছগুলো আমাকে কিছুই শেখাতে পারবে না। মাঝে মাঝে তিনি চিন্তায় বিভোর হয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা একঠায় দাঁড়িয়ে থাকতেন।
তার জীবদ্দশাতেও লোকজন তাকে একটু রহস্যময়, একটু ক্ষ্যাপাটে বলেই জানতো আর তার মৃত্যুর পরপরই বিভিন্ন মত ও পথের দার্শনিকেরা তাঁকে তাঁরা যে যে দার্শনিক মতবাদে বিশ্বাসী সেই মতবাদের জনক বলে ঘোষণা করলেন। সক্রেটিস যেহেতু খুবই রহস্যময় এবং দ্ব্যর্থবোধক চরিত্রের অধিকারী ছিলেন, সেজন্যেই এতো বিন্নি মত ও পথের অনুসারীরা তাঁকে তাঁদের লোক বলে দাবি করেছিল।
একটা কথা আমরা খুব ভালো করে জানি যে দেখতে তিনি মোটেই সুদর্শন। ছিলেন না। তাঁর পেটটা ছিল ঘটির মতো, চোখ দুটো যেন বেরিয়ে আসতে চাইতো কোটর ছেড়ে, নাকটা ছিল চ্যাপ্টা, কিন্তু তার ভেতরটা, অর্থাৎ মনটা ছিল নিতান্তই নির্মল। তাঁর সম্পর্কে আরো বলা হয় যে, অতীত বর্তমান কোনো কালেই তার মতো কাউকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু তারপরেও তাঁর দর্শনসংক্রান্ত ক্রিয়াকর্মের জন্যে তাঁকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছিল।
সক্রেটিসের জীবন সম্পর্কে যা কিছু জানা যায় তা মূলত তার অন্যতম শিষ্য প্লেটোর রচনা থেকে, সেই শিষ্য যিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ দার্শনিকদের অন্যতম বলে বিবেচিত। প্লেটো বেশ কিছু ডায়ালগ, বা দর্শনসংক্রান্তআলাপ আলোচনা নাটকের সংলাপের মতো করে লিখে রেখে গেছেন। সেখানে সক্রেটিসকে তিনি তার প্রধান চরিত্র এবং মুখপাত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন।
প্লেটো যেহেতু তাঁর নিজের দর্শন সক্রেটিসের মুখে বসাচ্ছেন তাই আমরা ঠিক নিশ্চিত হতে পারি না সক্রেটিস যে-সব কথা আওড়াচ্ছেন সে-সব কথা তিনি আদৌ বলেছিলেন কিনা। কাজেই সক্রেটিসের শিক্ষা আর প্লেটোর দর্শনের মধ্যে ফারাক বের করা খুব মুশকিল। যে-সব ঐতিহাসিক ব্যক্তি লিখিত কিছু রেখে যাননি তাঁদের বেলাতেও ঠিক এই সমস্যা দেখা দেয়। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ অবশ্যই যীশু। ম্যাথু এবং লুক যে-সব কথা তাঁর বলে প্রচার করেছেন ইতিহাসের যীশু সে-সব সত্যিই বলেছিলেন কিনা সে-ব্যাপারে আমাদের নিশ্চিত হওয়ার জো নেই। ঠিক একইভাবে, ইতিহাসের সক্রেটিস ঠিক কী কী বলেছিলেন সেটা চিরকাল রহস্যের চাদরেই মোড়া থাকবে।
তবে সক্রেটিস আসলেই কে ছিলেন সে-কথাটা কিন্তু তত গুরুত্বপূর্ণ নয়। প্লেটোর আঁকা সক্রেটিসের ছবি-ই গত প্রায় ২,৫০০ বছর ধরে পশ্চিমা জগতে চিন্তা বিদদের প্রেরণা যুগিয়েছে, উৎসাহ দিয়েছে।
.
কথোপকথনের কলাকৌশল
সক্রেটিসের কেশলের মূল ব্যাপারটা ছিল এই যে তিনি যে লোকজনকে কিছু শেখাতে চাইছেন সেটা তাদের বুঝতে দিতেন না। উল্টো, যাদের সঙ্গে তিনি কথা বলতেন তাদের তিনি এমন একটা ধারণা দিতেন যে আসলে তিনি তাদের কাছ থেকে শিখতে চাইছেন। কাজেই, চিরাচরিত এক স্কুল শিক্ষকের মতো লেকচার দেয়ার বদলে তিনি তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় মত্ত হতেন।
স্পষ্টতই, তিনি যদি কেবল অন্যের কথা শুনেই যেতেন তাহলে আর বিখ্যাত দার্শনিক হতে পারতেন না এবং মৃত্যুদণ্ডেও দণ্ডিত হতেন না। বরং তিনি শুধু প্রশ্ন করে যেতেন, বিশেষ কোনো একটা আলোচনার সূত্রপাত ঘটাতে, যেন তিনি বিষয়টা সম্পর্কে কিছুই জানেন না। আলোচনার এক পর্যায়ে তিনি তার প্রতিপক্ষকে তার যুক্তির দুর্বলতা বা অসারতা বুঝিয়ে দিতেন আর তখন কোণঠাসা হয়ে পড়ে তারা উপলব্ধি করতে সক্ষম হতো কোনটি ন্যায় আর কোনটি অন্যায়।
সক্রেটিসের মা ছিলেন ধাত্রী এবং সক্রেটিস প্রায়ই বলতেন যে তার কৌশলটা হলো একজন ধাত্রীর কৌশল। ধাত্রী নিজে বাচ্চার জন্ম দেন না, জন্মের সময় তিনি থাকেন প্রসবে সাহায্য করার জন্যে। ঠিক একইভাবে, সক্রেটিস নিজের কাজটাকে দেখতেন সঠিক অন্তদৃষ্টি প্রসব করানোর ব্যাপারে লোকজনকে সাহায্য করার কাজ হিসেবে। কারণ, সত্যিকারের উপলব্ধি নিশ্চয়ই ভেতর থেকেই আসবে। এটা অন্য কেউ দিতে পারবে না। আর যে-উপলব্ধি ভেতর থেকে আসে কেবল সেটাই। আমাদেরকে সত্যিকারের অন্তদৃষ্টির কাছে নিয়ে যেতে পারে।
আরো স্পষ্টভাবে বলছিঃ জন্ম দিতে পারা বা প্রসব করতে পারা একটা প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য। ঠিক একইভাবে, দর্শনগত সত্যগুলো প্রত্যেকেই বুঝতে পারে স্রেফ যদি তারা তাদের সহজাত যুক্তি ব্যবহার করে। সহজাত যুক্তি ব্যবহার করার অর্থ হচ্ছে নিজের মনের গভীরে পৌঁছে সেখানে যা আছে তা ব্যবহার করা।
নিজে অজ্ঞ সেজে সক্রেটিস লোকজনকে তাদের কাণ্ডজ্ঞান ব্যবহার করতে বাধ্য করতেন। সক্রেটিস অজ্ঞতার ভান করতেন বা তিনি প্রকৃত পক্ষে যতটা অজ্ঞ তার চেয়ে বেশি অজ্ঞ বলে নিজেকে উপস্থাপন করতেন। এটাকেই আমরা বলি সক্রেটিক আয়রনি। এটাই তাঁকে অনবরত লোকজনের চিন্তা-ভাবনার দুর্বলতা দেখিয়ে দিতে সাহায্য করতো। কাজটা তিনি এমনকী নগর-চত্বরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে করতেও ইতস্তত করতেন না। কাজেই সক্রেটিসের মুখোমুখি হওয়ার মানে মাঝে মাঝে হয়ে দাঁড়তি জনসমক্ষে নির্বোধ প্রতিপন্ন হওয়া।
কাজেই, এটাই খুব স্বাভাবিক যে যতই দিন যেতে লাগল ততই আরো বেশি লোক ক্ষেপে যেতে থাকল তার ওপর, বিশেষ করে সেই সব লোক সমাজে যাদের একটা সম্মানজনক অবস্থান ছিল। একটা কথা তিনি প্রায়ই বলতেন বলে প্রচলিত আছে আর তা হলো, এথেন্স একটা আলসে ঘোড়া আর আমি হলাম গিয়ে সেই মাছি যে ওটাকে স্বাভাবিক জীবনে নিয়ে আসার চেষ্টা করছে।
(এ-ধরনের মাছির সঙ্গে আমরা কেমন ব্যবহার করি, সোফি?)
.
একটি স্বর্গীয় কণ্ঠ
সক্রেটিস তার আশেপাশের মানুষকে যন্ত্রণা দেবার জন্যে খোঁচাতেন না। তাঁর ভেতরের কিছু একটা তাঁকে এ-কাজে বাধ্য করতো। তিনি প্রায়ই বলতেন তাঁর ভেতর একটা স্বর্গীয় কণ্ঠ রয়েছে। এই যেমন ধরো, মানুষকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করার মতো কোনো কাজে কোনোরকম ভূমিকা রাখার বিরোধী ছিলেন তিনি। নিজের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে চাইতেন না তিনি। শেষ পর্যন্ত এজন্যেই তাকে জীবন দিতে হয়েছিল।
নতুন দেব-দেবীর প্রচলন এবং যুব সমাজকে বিপথগামী করার অভিযোগ আনা হয় তার বিরুদ্ধে ৩৯৯ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে, সেই সঙ্গে এই অভিযোগও আনা হয় যে প্রচলিত দেবতাদের প্রতি তার আস্থা নেই। পাঁচশ ব্যক্তির একটি জুরি খুবই সামান্য সংখ্যাধিক্যের জোরে তাকে দোষী সাব্যস্ত করে।
এটা ধরে নেয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে তিনি ক্ষমাপ্রার্থনা করতে পারতেন। অন্তত এথেন্স ত্যাগ করে চলে যাওয়ার অঙ্গীকার করে তিনি নিজের জীবন বাঁচাতে পারতেন। কিন্তু তা করলে তিনি আর সক্রেটিস হতেন না। জীবনের চেয়ে তিনি তার বিবেক এবং সত্যকে বেশি মূল্য দিয়েছেন। জুরিকে তিনি এ-কথা দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন যে রাষ্ট্রের সর্বোত্তম মঙ্গলের জন্যেই কেবল কাজ করেছেন তিনি। তারপরেও তাঁকে হেমলক পানের শাস্তি দেয়া হলো। এর কিছু সময় পরেই তিনি তাঁর প্রিয়জনদের সামনে বিষ পান করে মারা গেলেন।
কেন সোফি? কেন মরতে হয়েছিল সক্রেটিসকে? ২,৪০০ বছর ধরে এই প্রশ্ন করে যাচ্ছে মানুষ। অবশ্য ইতিহাসে তিনিই একমাত্র মানুষ নন যিনি নানান তিক্ত অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে গিয়ে শেষ পর্যন্ত নিজের বিশ্বাসের কারণে মৃত্যুবরণ করেছেন।
ইতিমধ্যেই আমি যীশুর কথা বলেছি তোমাকে। আর সত্যি বলতে কী, যীশু এবং সক্রেটিসের জীবনে আশ্চর্য রকমের মিল দেখতে পাওয়া যায়।
যীশু এবং সক্রেটিস দুজনেই ছিলেন রহস্যময় চরিত্রের অধিকারী, এমনকী তাদের সমসাময়িক লোকজনের কাছেও রহস্যময় ছিলেন তাঁরা। এঁদের কেউই তাঁদের মতবাদ বা উপদেশ লিখে রেখে যাননি। কাজেই শিষ্যরা তাঁদের সম্পর্কে যে-চিত্র তুলে ধরেছেন তার ওপরই নির্ভর করতে বাধ্য হয়েছি আমরা। তবে আমরা। একটা কথা জানি যে এঁরা দুজনেই ছিলেন কথোপকথনের কৌশলে সিদ্ধহস্ত। তাঁরা দুজনেই এমন বিশেষ এক আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কথা বলতেন যে শ্রোতাদেরকে তা। একই সঙ্গে মুগ্ধ এবং বিরক্ত করতো। আর সবচেয়ে যেটা গুরুত্বপূর্ণ, তারা দুজনেই বিশ্বাস করতেন যে তারা তাদের চেয়ে বৃহত্তর কোনো কিছুর হয়ে কথা বলছেন। সমাজের শক্তিকে তাঁরা চ্যালেঞ্জ করতেন সব ধরনের অন্যায়-অবিচার আর দুর্নীতির সমালোচনা করার মধ্যে দিয়ে। শেষ পর্যন্ত, তাঁদের কৃতকর্মের জন্যে তাদেরকে জীবন দিতে হয়েছিল।
যীশু এবং সক্রেটিসের বিচারের মধ্যেও প্রচুর মিল রয়েছে। তারা দুজনেই যে ক্ষমা ভিক্ষা করে প্রাণে বেঁচে যেতে পারতেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু তারা দুজনেই এ-কথা উপলব্ধি করেছিলেন যে তাঁদের একটি ব্রত আছে এবং সেই ব্রত ব্যর্থ হয়ে যাবে যদি তারা কষ্টকর শেষ মুহূর্তটিতে তাদের বিশ্বাসে স্থির থাকতে না পারেন। এবং এ-রকম সাহসিকতার সঙ্গে মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়ার ফলে বিরাট একটি অনুগত গোষ্ঠীর সৃষ্টি হয় তাদের, এমনকী তাঁদের মৃত্যুর পরেও।
এ-কথা আমি বলতে চাই না যে যীশু এবং সক্রেটিস ঠিক একই রকম ছিলেন। আমি কেবল এই বিষয়টির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছি যে তাদের দুজনেরই একটি বক্তব্য ছিল যে-বক্তব্য তাঁদের ব্যক্তিগত সাহসের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে ছিল।
.
এথেন্সের এক জোকার
সোফি, সক্রেটিস সম্পর্কে আলোচনা কিন্তু এখনো শেষ হয়নি আমাদের। আমরা তাঁর কাজের পদ্ধতি নিয়ে আলাপ করেছি। কিন্তু তাঁর দর্শনগত প্ৰকল্প কী ছিল?
সোফিস্টদের সমসাময়িক ছিলেন সক্রেটিস। তাঁদের মতো তিনিও প্রাকৃতিক শক্তিগুলোর চেয়ে মানুষ এবং সমাজে মানুষের অবস্থান নিয়েই বেশি চিন্তা-ভাবনা করেছেন। ঠিক যেমন এক রোমান দার্শনিক সিসেরো কয়েক শ বছর পরে তাঁর সম্পর্কে এই মন্তব্য করেছিলেন যে, সক্রেটিস দর্শনকে আকাশ থেকে মাটিতে টেনে। নামিয়ে শহরে শহরে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছিলেন, পরিচিত করিয়ে দিয়েছিলেন বাড়ি বাড়ি এবং দর্শনকে বাধ্য করেছিলেন জীবন, নীতি, ভালো এবং মন্দ নিয়ে সুলুক সন্ধান করতে।
তবে একটা বিশেষ দিক দিয়ে সোফিস্টদের সঙ্গে একটা পার্থক্য ছিল সক্রেটিসের। নিজেকে তিনি একজন সোফিস্ট অর্থাৎ শিক্ষিত বা জ্ঞানী ব্যক্তি বলে ভাবতেন না, সোফিস্টদের মতো তিনি পয়সার বিনিময়ে শিক্ষা দিতেন না। না, সক্রেটিস নিজেকে দার্শনিক বলতেন এবং বলতেন শব্দটির সত্যিকার অর্থে। দার্শনিক শব্দের অর্থ এমন একজন ব্যক্তি যিনি বিজ্ঞতাকে ভালোবাসেন।
তোমার কোনো অসুবিধে হচ্ছে না তো, সোফি? তার কারণ একজন সোফিস্ট এবং একজন দার্শনিকের মধ্যেকার তফাৎটা ভাল করে বুঝতে পারাটা আমাদের কোর্সের বাকি অংশের জন্যে খুব জরুরি। সোফিস্টরা তাঁদের কম-বেশি চুলচেরা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের বিনিময়ে অর্থগ্রহণ করতেন আর এ-ধরনের সোফিস্টরা স্মরণাতীতকাল থেকেই এসেছেন আবার চলেও গেছেন। আমি সেই সব স্কুল শিক্ষক এবং নিজের মতে অটল সবজান্তার কথা বলছি যারা তাদের স্বল্প জ্ঞান নিয়েই সম্ভষ্ট বা যারা কোনো একটা বিষয় সম্পর্কে বিন্দুমাত্র না জেনেই সে-সম্পর্কে সব জানে বলে বড়াই করে বেড়ায়। সম্ভবত তুমি তোমার এই অল্প বয়েসেই এ-রকম কিছু সোফিস্ট-এর দেখা পেয়েছে। একজন খাঁটি দার্শনিক, বুঝলে সোফি, একেবারে ভিন্ন প্রজাতির মাছ, সত্যি বলতে কী, একেবারে বিপরীত। একজন দার্শনিক জানেন যে আসলে তিনি খুব অল্পই জানেন। সেজন্যেই তিনি অনবরত চেষ্টা করে যান সত্যিকারের অন্তদৃষ্টি লাভ করার জন্যে। সক্রেটিস ছিলেন এ-ধরনের বিরল লোকদের একজন। তিনি জানতেন যে জীবন এবং জগৎ সম্পর্কে তিনি কিছুই জানেন না। আর এর পরেই আসছে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটি: তিনি যে এতো অল্প জানতেন এই ব্যাপারটি তাকে কষ্ট দিত।
কাজেই একজন দার্শনিক হলেন সেই ব্যক্তি যিনি জানেন যে এমন অনেক কিছু। আছে যা তিনি বোঝেন না এবং এই না বোঝার কারণে কষ্ট পান। এদিক দিয়ে দেখতে গেলে তিনি তাদের চেয়ে ঢের জ্ঞানী যারা কোনো একটা কিছু সম্পর্কে কিছু না জেনেই তা জানে বলে বড়াই করে বেড়ায়। আগেই বলেছি, যে জানে যে সে। কিছুই জানে না সে-ই সবচেয়ে জ্ঞানী। আর সক্রেটিস নিজে বলতেন, আমি কেবল একটা কথাই জানি আর সেটা হলো আমি কিছুই জানি না।
এই কথাটি মনে রেখো, তার কারণ এমন একটি স্বীকারোক্তি এমনকী দার্শনিকদের মধ্যেও বিরা। তাছাড়া, এ-কথাটা জনসমক্ষে বলা এতোই বিপজ্জনক যে এর জন্যে তোমার প্রাণ চলে যেতে পারে। সবচেয়ে বিধ্বংসী বা ক্ষতিকারক লোকজন তারাই যারা প্রশ্ন করে; উত্তর দেয়াটা ঠিক ততটা বিপজ্জনক নয়। হাজারটা উত্তরের চেয়েও একটা প্রশ্ন অনেক বেশি বিস্ফোরক হতে পারে।
রাজার নতুন জামার গল্পটা মনে আছে নিশ্চয়ই? রাজার গায়ে সুতোটি পর্যন্ত না। থাকার পরেও কেউ-ই সে-কথা বলতে সাহস পায়নি। হঠাৎ একটি শিশু বলে উঠল, রাজার গায়ে তো দেখছি কোনো কাপড়ই নেই! সেই শিশুটি কিন্তু খুব সাহসী, সোফি। ঠিক সক্রেটিসের মতো, যিনি লোকজনকে এ-কথা বলার সাহস করতেন যে মানুষের জানার পরিধি কতই না ছোট। শিশু আর দার্শনিকের মধ্যে মিলের ব্যাপারে আমরা এরিমধ্যে আলোকপাত করেছি।
মোদ্দা কথা: মানবজাতির সামনে এমন কিছু কঠিন প্রশ্ন রয়েছে যার কোনো সন্তোষজনক উত্তর আমাদের জানা নেই। কাজেই দুটো সম্ভাবনা তখন সামনে এসে দাঁড়ায়: হয় আমরা যা জানার তা জানি বলে ভান করে নিজেদের এবং বাকি পৃথিবীকে বোকা বানাতে পারি আর নয়ত মূল বিষয়গুলো সম্পর্কে একেবারে চোখ বুজে থেকে সামনে এগোনোর কথা ভুলে যেতে পারি। এ-ব্যাপারে মানবজাতি দুভাগে বিভক্ত। সাধারণভাবে বললে মানুষ হয় একেবারে নিশ্চিত আর নয় পুরোপুরি উদাসীন। (এই দুই প্রজাতিই খরগোশের রোমের গহীন ভেতরে হামাগুড়ি দিয়ে বেড়াচ্ছে।)
ব্যাপারটা অনেকটা এক তাড়া তাসকে দুভাগে ভাগ করার মতো, সোফি। একদিকে তুমি কালো তাসগুলোকে রাখছো, অন্যদিকে রাখছো লাল তাসগুলো। কিন্তু মাঝে মধ্যেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে একটা জোকার বা ভাড়, যে কিনা হরতনও নয় চিড়িতনও নয়, রুহিতনও নয় ইশকাবনও নয়। সক্রেটিস ছিলেন এথেন্সের জোকার। তিনি নিশ্চিতও ছিলেন না, উদাসীনও ছিলেন না। তিনি কেবল এই জিনিসটিই জানতেন যে তিনি কিছুই জানতেন না –আর এই ব্যাপারটি তাঁকে কষ্ট দিত। কাজেই তিনি হয়ে উঠলেন একজন দার্শনিক– এমন একজন মানুষ যিনি হাল ছাড়েন না, বরং ক্লান্তিহীনভাবে তাঁর সত্যানুসন্ধান চালিয়ে যান।
দেলফি-র ওরাকলকে এক এথেন্সবাসী নাকি জিগ্যেস করেছিল এথেন্সের সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তি কে। ওরাকল জবাব দিয়েছিল যে, মানুষের মধ্যে সক্রেটিসই সবচেয়ে জ্ঞানী। কথাটা সক্রেটিসের কানে যাওয়ার পর তিনি হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছিলেন বললেও কম বলা হয়। (সোফি, তিনি নিশ্চয়ই খুব একচোট হেসেছিলেন!) যাই হোক, এরপর তিনি সোজা সেই লোকটির কাছে গেলেন যাকে তিনি এবং অন্য অনেকেও খুব জ্ঞানী বলে জানত। কিন্তু যখন দেখা গেল লোকটি সক্রেটিসকে তার প্রশ্নের সন্তোষজনক জবাব দিতে পারছেন না তখন সক্রেটিস উপলব্ধি করলেন যে ওরাকল এর কথাই সত্যি।
সক্রেটিস বুঝেছিলেন যে আমাদের জ্ঞান-গম্যির একটা মজবুত ভিত্তি তৈরি করা প্রয়োজন। তিনি বিশ্বাস করতেন এই ভিত্তি রয়েছে মানুষের বিচারশক্তির ভেতর। মানুষের বিচারশক্তির ওপর তার এই অটল আস্থার কারণে তাকে নিশ্চিতভাবে একজন বুদ্ধিবাদী বলা যেতে পারে।
.
সঠিক অন্তদৃষ্টি থেকে সঠিক কর্ম
আগেই বলেছি, সক্রেটিস দাবি করতেন তার ভেতরের একটি স্বর্গীয় কণ্ঠস্বর তাঁকে পরিচালিত করে আর এই বিবেকই তাকে বলে দেয় কোনটি ঠিক, কোনটি বেঠিক। তিনি বলতেন, যে জানে কোনটি ভালো সে ভালো কাজটিই করবে।
এই কথাটি দিয়ে তিনি বোঝাতে চাইতেন যে সঠিক অন্তদৃষ্টি মানুষকে সঠিক কাজের দিকে নিয়ে যায়। আর যিনি ঠিক কাজটি করেন কেবল তিনিই পুণ্যবান মানুষ হতে পারেন। আমরা যখন অন্যায় কাজ করি তখন সেটা এই জন্যে করি যে কোনটি ন্যায় তা আমরা জানি না। সেজন্যেই, অনবরত শিখে যাওয়াটা এতো জরুরি। ন্যায় এবং অন্যায়ের স্পষ্ট ও বিশ্বজনীনভাবে প্রযোজ্য সংজ্ঞা খুঁজে পেতে চেয়েছিলেন সক্রেটিস। তিনি বিশ্বাস করতেন ন্যায় এবং অন্যায়ের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করার ক্ষমতা নিহিত রয়েছে মানুষের বিচারশক্তির ভেতর, সমাজের মধ্যে নয়; সোফিস্টরা এ-কথা বিশ্বাস করতেন না।
এই শেষ অংশটা তোমার কাছে খানিকটা দুর্বোধ্য ঠেকতে পারে, সোফি। কাজেই ব্যাপারটা এভাবে বলছি আমি: সক্রেটিস মনে করতেন যে নিজের শুভবুদ্ধির বিরুদ্ধে গিয়ে মানুষ সম্ভবত সুখী হতে পারবে না। আর যে জানে কীভাবে সুখী হতে হয় সে তার শুভবুদ্ধি অনুযায়ীই কাজ করবে। কাজেই যে জানে কোনটি ন্যায় বা সঠিক সে ঠিক কাজটিই করবে। কারণ, শখ করে কেন লোকে অসুখী হতে চাইবে?
তোমার কী মনে হয়, সোফি? যে-সব কাজ অন্যায় বলে তুমি মনে মনে জানো সে-সব কাজ যদি তুমি অনবরত করো তাহলে কি তুমি একটি সুখী জীবনযাপন করতে পারবে? এমন অনেক মানুষ আছে যারা মিথ্যে কথা বলে, অন্যকে ঠকায়, পরনিন্দা করে। তারা কি এ-ব্যাপারে সচেতন যে কাজগুলো ঠিক বা সঙ্গত নয়? তোমার কি মনে হয় এই লোকগুলো সুখী?
সক্রেটিস তা মনে করতেন না।
.
চিঠিটা পড়া শেষ হতে সোফি তাড়াতাড়ি সেটা বিস্কিটের টিনের ভেতর রেখে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে এলো বাগানে। তার মা কেনাকাটা সেরে ফিরে আসার আগেই ঘরে ঢুকে পড়তে চাইছিল যে, যাতে সে এতোক্ষণ কোথায় ছিল এই প্রশ্নটা এড়ানো যায়। তাছাড়া সে কথা দিয়েছিল বাসন-কোসন ধুয়ে রাখবে।
সিংকটা সে পানি দিয়ে সবে ভরিয়েছে মাত্র এই সময় দুটো ঢাউস শপিং ব্যাগ হাতে টলমল পায়ে ভেতরে ঢুকলেন তার মা। সম্ভবত সেজন্যেই তিনি বলে উঠলেন, ইদানিং তুই বড় ব্যস্ত দেখছি, সোফি।
সোফি ঠিক বুঝল না কেন মা কথাটা বললেন; কিন্তু উত্তরটা টুপ করে তার মুখ থেকে বেরিয়ে গেল: সক্রেটিসও তাই ছিলেন।
সক্রেটিস?
বড় বড় চোখ করে সোফির দিকে তাকালেন তার মা।
সোফি চিন্তিত স্বরে বলে চলল, ব্যাপারটা খুব দুঃখজনক যে সে-কারণে তাঁকে মরতে হয়েছিল।
মাই গুডনেস। সোফি! আমার যে কী করা উচিত কিছুই বুঝতে পারছি না।
সক্রেটিসও পারেননি। তিনি কেবল এই কথাটাই জানতেন যে তিনি কিছুই জানতেন না। কিন্তু তারপরেও, তিনি ছিলেন এথেন্সের সবচেয়ে বুদ্ধিমান মানুষ।
সোফির মা-র মুখ দিয়ে কোনো কথা সরল না।
অবশেষে তিনি বললেন, এ-সব কি তুই স্কুলে শিখেছিস?
প্রবলভাবে মাথা নাড়ল সোফি।
ওখানে আমরা কিছুই শিখি না। স্কুল-টিচার আর দার্শনিকদের মধ্যে তফাৎ হচ্ছে স্কুল-টিচাররা মনে করেন তাঁরা মেলা কিছু জানেন আর সেগুলোই তাঁরা আমাদের গলার ভেতর দিয়ে ঢুকিয়ে দিতে চেষ্টা করেন। দার্শনিকেরা তাদের ছাত্র ছাত্রীদের নিয়ে সমস্যার সমাধান বের করার চেষ্টা করেন।
ফের সেই সাদা খরগোশের কথা! তোর সেই বয়ফ্রেন্ডটা কে তা তোকে সত্যি করে বলতেই হবে আমাকে। নইলে আমি মনে করবো ছেলেটা একটু ক্ষ্যাপাটে।
বাসন-কোসনগুলোর দিকে পিঠ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে সোফি বাসন মোছার কাপড়টা তাক করল মায়ের দিকে।
সে ক্ষ্যাপাটে নয়। তবে সে অন্যদের ক্ষ্যাপাতে চায়– ক্ষেপিয়ে বের করে আনতে চায় তাদেরকে গর্ত থেকে।
যথেষ্ট হয়েছে। আমার মনে হচ্ছে ছেলেটার কথাবার্তা একটু খাপছাড়া ধরনের।
সে খাপছাড়াও নয়, আবার শান্ত-সুবোধও নয়, সোফি জবাব দিল। তবে সে নিখাদ জ্ঞানের খোঁজে ব্যস্ত। একটা খাঁটি জোকার আর প্যাকেটের অন্য সব তাসের মধ্যে আসল পার্থক্য এটাই।
কী বললি তুই, জোকার?
ওপর নিচে মাথা ঝকাল সোফি। তুমি কি কখনো ভেবে দেখেছো এক প্যাকেট তাসের মধ্যে মেলা হার্ট আর ডায়মন্ড আছে? আছে অনেকগুলো স্পেড আর ক্লাব। কিন্তু জোকার আছে মাত্র একটাই।
ঈশ্বর! কীভাবে মুখে মুখে কথা বলছিস তুই, সোফি!
কীভাবে তুমি আমাকে বাধ্য করছ?
তার মা মুদির দোকান থেকে আনা জিনিস-পত্ৰ এরিমধ্যে সরিয়ে রেখেছিলেন। তিনি এবার খবরের কাগজটা নিয়ে বসার ঘরে চলে গেলেন। সোফির মনে হলো দরজাটা তিনি স্বাভাবিকের চাইতে একটু বেশি জোরেই বন্ধ করলেন।
বাসন-কোসন ধোওয়া শেষ হতে ওপরের তলায় নিজের ঘরে চলে এলো। সোফি। লাল রেশমি স্কার্ফটা সে লেগো ব্লকগুলোর সঙ্গে ক্লজেটের সবচেয়ে ওপরের। তাকেই রেখেছিল। ওটা নামিয়ে এনে ভালো করে পরীক্ষা করল সে।