২২. বার্কলে

২২. বার্কলে

…জ্বলন্ত এক সূর্যের চারপাশে ঘুরতে থাকা একটা গ্রহের মতো…

শহরের দিকে মুখ করা জানলাটার দিকে হেঁটে গেলেন অ্যালবার্টো। তাকে অনুসরণ করল সোফি। দুজনে যখন পুরনো বাড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে, এমন সময় বাড়িগুলোর ছাদের ওপর দিয়ে উড়ে এলো ছোট্ট একটা প্লেন। সেটার লেজের সঙ্গে ছোট্ট একটা ব্যানার আটকানো, সোফি অনুমান করল কোনো পণ্য বা স্থানীয় কোনো ঘটনার বিজ্ঞাপন প্রচার করছে ওটা, হয়তো কোনো রক কনসার্ট। কিন্তু সেটা এগিয়ে এসে ঘুরে যেতেই একটা ভিন্ন মেসেজ চোখে পড়ল তার: শুভ জন্মদিন, হিল্ডা!

অনাহুত, অ্যালবার্টোর সংক্ষিপ্ত মন্তব্য।

দক্ষিণের পাহাড়গুলোর দিক থেকে আসা ভারী মেঘগুলো শহরের ওপর জমা। হতে শুরু করেছে। সেই ধূসরতায় অদৃশ্য হয়ে গেল প্লেনটা।

ঝড় হতে পারে, অ্যালবার্টো বললেন।

 তাহলে আমি বাসে করে বাড়ি যাবো।

 আমি ভাবছি, এর পেছনেও মেজর আছে কিনা।

 সে নিশ্চয়ই সর্বশক্তিমান ঈশ্বর নয়, নাকি?

আলবার্টো কোনো জবাব দিলেন না। ঘর পেরিয়ে হেঁটে গিয়ে আবার বসে। পড়লেন কফি টেবিলটার পাশে।

বার্কলের কথা আলোচনা করতে হবে আমাদের, খানিক পর বললেন তিনি।

এরিমধ্যে সোফি আবার তার নিজের জায়গায় গিয়ে বসেছে। দাঁত দিয়ে নখ কাটছে সে।

জর্জ বার্কলে (George Berkeley) ছিলেন একজন আইরিশ বিশপ। জন্ম ১৬৮৫, মৃত্যু ১৭৫৩। শুরু করলেন অ্যালবার্টো। তারপর দীর্ঘ নীরবতা।

বার্কলে ছিলেন আইরিশ বিশপ… সোফি খেই ধরিয়ে দিল।

কিন্তু তিনি দার্শনিকও ছিলেন…

আচ্ছা?

তাঁর কাছে মনে হয়েছিল তকালীন দর্শন আর বিজ্ঞান খ্রিস্টিয় জীবন দর্শনের প্রতি হুমকি স্বরূপ। বিশেষ করে সর্বব্যাপী বস্তুবাদ স্রষ্টা এবং সমগ্র প্রকৃতির রক্ষাকর্তা হিসেবে ঈশ্বরের ওপর খ্রিস্টিয় বিশ্বাসের প্রতি হুমকি স্বরূপ।

তাই?

কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনিই ছিলেন অভিজ্ঞতাবাদীদের মধ্যে সবচেয়ে কনসিস্টেন্ট।

তিনি কি এ-কথা বিশ্বাস করতেন যে আমরা আমাদের ইন্দ্রিয়গুলো দিয়ে জগতের যা কিছু প্রত্যক্ষ করি তারচেয়ে বেশি কিছু এই জগৎ সম্পর্কে জানতে পারবো না?

শুধু তাই নয়, বার্কলে দাবি করেছিলেন যে জাগতিক জিনিসগুলো আসলে আমরা সেগুলোকে যেভাবে প্রত্যক্ষ করি সে-রকমই, তবে তারা জিনিস বা বস্তু নয়।

কথাটা আপনাকে ব্যাখ্যা করতে হবে।

তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে যে লক এই বিষয়ে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন যে বস্তুর গৌণ গুণ সম্পর্কে আমরা কোনো কিছু সত্য বলে ঘোষণা করতে পারি না। আমরা বলতে পারি না আপেল হচ্ছেসবুজ আর টক। আমরা শুধু এটুকু বলতে পারি যে জিনিসটাকে আমরা এভাবে প্রত্যক্ষ করি। কিন্তু লক এ-ও বলেছিলেন যে ঘনত্ব, অভিকর্ষ আর ওজনের মতো মুখ্য গুণগুলো আসলে আমাদের চারপাশের বাহ্যিক বাস্তবতার অংশ। প্রকৃতপক্ষে বাহ্যিক বাস্তবতার একটি বস্তুগত সারবস্তু আছে।

আমার মনে আছে, তাছাড়া আমি মনে করি যে বস্তু সম্পর্কে লকের এই বিভাজনটা গুরুত্বপূর্ণ।

তা ঠিক, সোফি, কিন্তু সেটাই শেষ কথা নয়।

বলে যান।

 ঠিক দেকার্ত আর স্পিনোজার মতো, লক বিশ্বাস করতেন যে বস্তুগত জগৎ একটা বাস্তবতা।

আচ্ছা?

ঠিক এই ব্যাপারেই প্রশ্ন তুললেন বার্কলে। আর তিনি সেটা করলেন অভিজ্ঞতাবাদের যুক্তি প্রয়োগ করে। তিনি বললেন, কেবল সেইসব জিনিসেরই অস্তিত্ব আছে যে-সব আমরা প্রত্যক্ষ করি। তবে আমরা উপাদান বা বস্তু প্রত্যক্ষ করি না। স্পর্শযোগ্য জিনিস হিসেবে আমরা কোনো বস্তুকে প্রত্যক্ষ করি না। আমরা যে সব জিনিস প্রত্যক্ষ করি সেগুলোর নিজস্ব ভিত্তিস্বরূপ সারবস্তু আছে বলে ধরে নেয়াটা হুট করে সিদ্ধান্তে পৌঁছানোরই নামান্তর। এ-ধরনের একটা দাবি করার মতো কোনো ধরনের অভিজ্ঞতা আমাদের একেবারেই নেই।

কী গাধার মতো কথা! এই দেখুন! বলে সোফি তার হাতের মুষ্টিটা দিয়ে সজোরে আঘাত করল টেবিলের ওপর। উফ বলে চেঁচিয়ে উঠল সে। এতেই কি প্রমাণ হয় না যে এই টেবিলটা একটা সত্যিকারের টেবিল, উপাদান আর বস্তু দুটো দিয়েই এটা তৈরি?

তা তুমি কী অনুভব করলে?

শক্ত একটা কিছু।

শক্ত একটা কিছুর সংবেদন হলো তোমার, কিন্তু টেবিলের আসল বস্তুটিকে তুমি অনুভব করনি। একইভাবে, তুমি স্বপ্নও দেখতে পারো যে শক্ত একটা কিছুকে আঘাত করছে, কিন্তু স্বপ্নে শক্ত কিছু থাকে না, নাকি থাকে?

না, স্বপ্নে থাকে না।

অন্য দিকে আবার একটা লোককে এমনভাবে সম্মোহিত করা যায় যাতে সে গরম, ঠাণ্ডা, আলিঙ্গন কিংবা একটা ঘুষি-র অনুভূতি পাবে।

কিন্তু টেবিলটা যদি শক্ত না-ই হবে তাহলে আমি সে-রকম অনুভব করলাম কেন?

বার্কলে একটা চিদাত্মা-য় (spirit) বিশ্বাস করতেন। তিনি মনে করতেন, আমাদের সব ভাবেরই (idea) আমাদের চেতনা বহির্ভূত কোনো কারণ রয়েছে, কিন্তু এই কারণ বস্তুগত নয়, আধ্যাকি।

সোফি আবার নখ কামড়াতে শুরু করল।

অ্যালবার্টো বলে চললেন: বার্কলের মত অনুযায়ী, আমার নিজের স্লা আমার নিজের ভাবের কারণ হতে পারে-আমি যখন স্বপ্ন দেখি সেই সময়ের মতো কিন্তু অন্য আরেকটি ইচ্ছা বা চিদাত্মা-ই কেবল সেই সব ভাবের কারণ হতে পারে যা দিয়ে এই জড় জগৎ তৈরি। তার মতে, সব কিছুরই কারণ সেই চিদাত্মা যা প্রতিটি জিনিসের ভেতরকার প্রতিটি জিনিসের কারণ আর যার মধ্যে সব কিছু থাকে।

কোন চিদাত্মা-র কথা বলেছিলেন তিনি?

নিঃসন্দেহে, বার্কলে ঈশ্বর-এর কথাই চিন্তা করছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আমরা এমনকী এ-ও দাবি করতে পারি যে মানুষের অস্তিত্ব যতটা পরিষ্কারভাবে প্রত্যক্ষ করা যায় ঈশ্বরের অস্তিত্ব তার চেয়েও অনেক বেশি স্পষ্টভাবে প্রত্যক্ষ করা যায়।

আমরা যে আছি বা আমাদের অস্তিত্ব কি তাহলে ততটা নিশ্চিত নয়?

উত্তরটা হা আর না দুটোই। বার্কলে বলছেন, যা কিছুই আমরা দেখি বা অনুভব করি তার সবই ঈশ্বরের শক্তির একটা প্রকাশ। কারণ, ঈশ্বর আমাদের চেতনায় খুবই প্রবলভাবে উপস্থিত আর প্রতিনিয়ত আমরা যে অসংখ্য ধারণা আর প্রত্যক্ষণের মুখোমুখি হচ্ছি সেগুলো সে-কারণেই অর্থাৎ আমাদের চেতনায় ঈশ্বরের প্রবল উপস্থিতির কারণেই সম্ভব হচ্ছে। আমাদের চারপাশের সমস্ত জগৎ আর আমাদের সমস্ত জীবন রয়েছে ঈশ্বরের ভেতরেই। যা কিছু অস্তিত্বশীল তার একমাত্র কারণ তিনি-ই। আমরা রয়েছি শুধু ঈশ্বরের মনের ভেতর।

কম করে বললেও বলতে হয়, রীতিমত তাজ্জব বনে গেছি আমি।

কাজেই, টু বি অর নট টু বি-তেই প্রশ্নের শেষ নয়। প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কে। আমরা কি আসলেই রক্ত-মাংসের মানুষ-নাকি আমাদের চারপাশ ঘিরে আছে মন?

সোফি দাঁত দিয়ে নখ কামড়ে চলেছে।

অ্যালবার্টো বলে চললেন: বার্কলে কেবল বস্তুগত বাস্তবতা নিয়েই প্রশ্ন তোলেননি। সময় আর স্থান (space)-এর পরম বা স্বাধীন অস্তিত্ব রয়েছে কিনা সে-প্রশ্নও তুলেছেন তিনি। সময় আর স্থান সম্পর্কে আমাদের নিজেদের প্রত্যক্ষণও স্রেফ মনের তৈরি করা একটা মিথ্যে ব্যাপার হতে পারে। আমাদের এক বা দুই হপ্তা যে ঈশ্বর-এরও এক বা দুই হপ্তা হবে এমন না-ও হতে পারে…

আপনি বলেছেন, যে-চিদাত্মায় সব কিছুর অস্তিত্ব নিহিত সেটাই হচ্ছে, বার্কলের মতে, খ্রিস্টিয় ঈশ্বর।

হ্যাঁ, হয়ত, বলেছি। কিন্তু আমাদের কাছে…

আমাদের?

আমাদের কাছে– তোমার আর আমার কাছে– এই ইচ্ছা বা চিদাত্মা যা কিনা প্রতিটি জিনিসের মধ্যেকার প্রতিটি জিনিসের কারণ তা হিল্ডার বাবাও হতে পারে।

অবিশ্বাসে চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল সোফির। কিন্তু তার পরেও একই সঙ্গে একটা উপলব্ধি-ও জেগে উঠতে থাকল তার মনের মধ্যে।

আপনার কি তাই ধারণা?

আর কোনো সম্ভাবনা তো দেখছি না আমি। যে-সব ঘটনার মুখোমুখি হয়েছি আমরা তার প্রতিটার একমাত্র সম্ভাব্য ব্যাখ্যা সম্ভবত ওটাই। এখানে ওখানে উদয় হওয়া সেই সব পোস্টকার্ড আর সাইন… হার্মেসের কথা বলতে শুরু করা… আমার কথায় অনিচ্ছাকৃত ভুল।

আমি…

ভেবে দেখো হিল্ডা, তোমাকে সোফি বলে ডেকে ওঠা! আমি সব সময়ই জানতাম তোমার নাম সোফি নয়।

কী বলছেন এসব? এবার কিন্তু আপনি আসলেই সব গুলিয়ে ফেলছেন।

ঠিকই বলেছ, মনটা আমার ঘুরপাক খেয়ে চলেছে। জ্বলন্ত এক সূর্যের চারপাশে ঘুরতে থাকা একটা গ্রহের মতো।

আর সেই সূর্যটা নিশ্চয়ই হিল্ডার বাবা?

তা বলতে পারো।

আপনি কি বলতে চাইছেন আমাদের জন্যে তিনি একরকম ঈশ্বরের মতো।

একেবারে খোলাখুলিভাবে বললে বলতে হয় হা। নিজের জন্যে লজ্জা হওয়া উচিত লোকটার!

আর হিল্ডা, সে কী?

হিল্ডা একটা পরী।

 পরী?

হিল্ডা-ই হচ্ছে সে যার মুখাপেক্ষি হয়ে থাকে এই চিদাত্মা।

আপনি কি বলছেন যে অ্যালবার্ট ন্যাগ হিল্ডাকে আমাদের কথা বলে?

অথবা লেখে আমাদের কথা। আমাদের বাস্তবতা যে কী দিয়ে তৈরি সেটা যে আমরা প্রত্যক্ষ করতে পারছি না সেটুকু আমাদের জানা হয়ে গেছে। আমাদের বাহ্যিক বাস্তবতা কি শব্দ-তরঙ্গ নাকি কাগজ আর লেখা দিয়ে তৈরি সেটাও আমরা জানতে পারছি না। বার্কলের কথা অনুযায়ী আমরা কেবল এটুকুই জানতে পারি যে আমরা সবাই-ই হচ্ছি চিদাত্মা।

আর হিল্ডা হচ্ছে পরী…।

হিল্ডা হচ্ছে পরী। হ্যাঁ, ঠিক বলেছো। সেটাই তাহলে শেষ কথা হোক। হিল্ডা, শুভ জন্মদিন।

হঠাৎ নীলচে একটা আলোয় ভরে উঠল কামরাটা। এর কয়েক সেকেন্ড পরেই বজের আওয়াজে কেঁপে উঠল গোটা বাড়িটা।

আমাকে যেতে হচ্ছে, বলে উঠল সোফি। আসন ছেড়ে উঠে সামনের দিকে দৌড়ে গেল সে। যখন সে বেরিয়ে এসেছে, হলওয়েতে হামেস তার নিদ্রা ছেড়ে জেগে উঠল। সোফির মনে হলো হার্মেস যেন বলে উঠল, দেখা হবে, হিল্ডা।

দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে নামল হিল্ডা, ছুটে বেরিয়ে এলো রাস্তায়। কেউ নেই সেখানে। আর তখনই বৃষ্টি নামল মুষলধারে।

একটা দুটো গাড়ি সেই প্রবল বৃষ্টির ভেতর দিয়েই ছুটে গেল, কিন্তু কোনো বাসের টিকিরও দেখা নেই। মেইন স্কোয়্যার পার হয়ে শহরের ভেতর দিয়ে ছুটতে লাগল সোফি। দৌড়ানোর সময় একটা চিন্তাই কেবল খেলে বেড়াতে লাগল তার মধ্যে: কাল আমার জন্মদিনা কিন্তু পঞ্চদশ জন্মদিনের আগের দিনই যদি কেউ উপলব্ধি করে যে জীবনটা নেহাতই একটা স্বপ্ন তাহলে সেটা কি একটু বেশি তিক্ত হয়ে যায় না? ব্যাপারটা অনেকটা ১০ লাখ টাকা জিতে সেটা পাওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে ঘুম ভেঙে যাওয়ার মতো।

প্যাঁচপ্যাঁচে ভেজা খেলার মাঠটা পেরিয়ে এলো সোফি। কয়েক মিনিট পরেই সে দেখল কে একজন দৌড়ে আসছে তার দিকে। দেখা গেল, তিনি আর কেউ নন, তার মা। বিদ্যুচ্চমকের কুদ্ধ বর্শায় আকাশ বারবার চিরে ফালা ফালা হয়ে যাচ্ছে।

দুজনে পরস্পরের কাছে পৌঁছানোর পর সোফির মা হাত দিয়ে বেড় দিয়ে ধরলেন তাকে।

কী ঘটছে রে এ-সব আমাদের জীবনে, মা আমার?

আমি জানি না, ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল সোফি।

ব্যাপারটা যেন একটা দুঃস্বপ্ন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *