২৪. আলোকপ্রাপ্তি

২৪. আলোকপ্রাপ্তি

… সুচ বানাবার উপায় থেকে কামান তৈরির পদ্ধতি পর্যন্ত..

রেনেসাঁ-র ওপর লেখা পরিচ্ছেদটা হিল্ডা পড়তে শুরু করেছে কেবল এমন সময় সদর দরজা দিয়ে মায়ের ভেতরে ঢোকার আওয়াজ পেল সে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল বিকেল চারটা বাজে।

তার মা ছুটে ওপরে এসে হিল্ডার ঘরের দরজা খুললেন।

তুই গির্জায় যাসনি?

হ্যাঁ, গিয়েছিলাম তো?

কিন্তু…কী পরে গিয়েছিলি?

এখন যা পরে আছি তাই পরে।

নাইটগাউন?

 ওটা মধ্য যুগে বানানো একটা পাথুরে গির্জা।

হিল্ডা!

রিং বাইন্ডারটা কোলের ওপর ছেড়ে দিয়ে মুখ তুলে মায়ের দিকে তাকাল সে। সময়ের দিকে খেয়াল-ই ছিল না, মা। মাফ করে দাও, তবে আমি কিন্তু খুব এক্সাইটিং একটা বই পড়ছি।

ওর মা না হেসে পারলেন না।

এটা একটা জাদুর বই, যোগ করল হিল্ডা।

ঠিক আছে বুঝলাম। হ্যাপি বার্থ ডে ওয়ান্স এগেইন, হিল্ডা! ভালো কথা, আমি এখন কিছুক্ষণ জিরোব, তারপর জম্পেশ একটা ডিনারের ব্যবস্থা করব। কিছু স্ট্রবেরি জোগাড় করেছি।

ঠিক আছে। আমি তাহলে আরেকটু পড়ি।

তার মা চলে গেলেন, হিল্ডা পড়তে থাকল।

শহরের ভেতর দিয়ে হার্মেসের পিছু পিছু চলছে সোফি। লেবানন থেকে পাঠানো আরেকটা কার্ড পায় সে অ্যালবার্টোর হলঘরে। এটার তারিখ দেয়া আছে ১৫ই জুন। তারিখগুলোর মধ্যে একটা পদ্ধতি আবিষ্কার করতে শুরু করেছে হিল্ডা। ১৫ই জুনের আগের তারিখ দেয়া কার্ডগুলো বাবার কাছ থেকে হিল্ডার আগেই পাওয়া কার্ডগুলোরই কপি। কিন্তু আজকের তারিখ দেয়া কার্ডগুলো রিং বাইন্ডারের মাধ্যমে আজই প্রথমবারের মতো পৌঁছাচ্ছে তার কাছে।

প্রিয় হিল্ডা, সোফি এবার দার্শনিকের বাড়িতে আসছে। শিগগিরই পনেরোয় পা দেবে মেয়েটা আর তুই তো গতকালই পনেরোয় পড়েছিস। নাকি আজাক পড়বি, হিল্ডা? যদি আজ হয় তাহলে নিশ্চয়ই দেরি হয়ে গেছে। আমাদের ঘড়িগুলো সারাক্ষণ এক সময় দেয় না।

হিল্ডা পড়তে থাকল অ্যালবার্টো কীভাবে সোফিকে রেনেসাঁ আর নতুন বিজ্ঞান, সপ্তদশ শতাব্দী আর ব্রিটিশ অভিজ্ঞতাবাদ সম্পর্কে অনেক কথা বললেন। গল্পের মধ্যে বাবার সেঁটে দেয়া প্রত্যেকটা কার্ড দেখে লাফিয়ে উঠল সে। তিনি এমন ব্যবস্থা করেছেন যাতে সেগুলো এক্সারসাইজ খাতার ভেতর থেকে পড়ে যায়, কলার খোসার ভেতর উদয় হয় অথবা কোনো কম্পিউটার প্রোগ্রামের ভেতর লুকিয়ে থাকে। একেবারে অনায়াসে তিনি অ্যালবার্টোর মুখ ফসকে দিয়ে তাকে দিয়ে সোফিকে হিল্ডা বলাতে পারেন। আর সবচেয়ে বড় কথা, হার্মেসকে দিয়ে তিনি হ্যাপি বার্থ ডে, হিল্ডা! বলাতে পারেন।

 অ্যালবার্টোর সঙ্গে সে এই ব্যাপারে একমত হলো যে নিজেকে ঈশ্বরের সঙ্গে তুলনা করে বাবা একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছেন। কিন্তু সে ঠিক কার সঙ্গে একমত হচ্ছে। তার বাবাই কি ঐ ভর্ৎসনাসূচক বা ভৎর্সনাসূচক শব্দগুলো অ্যালবার্টোর মুখে বসিয়ে দেননি? এবার তার মনে হলো ঈশ্বরের সঙ্গে তুলনাটা অতোটা ক্ষ্যাপাটে ছিল না। সোফির জগতে তার বাবা সত্যি-ই সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের মতোই। অ্যালবার্টো যখন বার্কলে-তে পৌঁছালেন, তখন সোফি যেমন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল ঠিক সে-রকমই হয়ে পড়ল হিল্ডা। এবার কী হবে? নানান সব ইঙ্গিতে এ-কথা বলা হয়েছে যে ওরা এই দার্শনিক পর্যন্ত পৌঁছালেই বিশেষ একটা কিছু ঘটবে, এমন এক দার্শনিক যিনি মানব চেতনার বাইরে কোনো বস্তুগত জগতের অস্তিত্ব স্বীকার করেননি।

পরিচ্ছেদটার শুরুতে অ্যালবার্টো আর সোফি জানলার সামনে দাঁড়িয়ে ছোট্ট প্লেনটার পেছনে পতপত করে উড়তে থাকা হ্যাপি বার্থ ডে লেখা লম্বা স্ট্রিমারটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সেই সময়ই শহরের ওপরে জমতে শুরু করেছে কালো মেঘ।

কাজেই, টু বি অর নট টু বি-তেই প্রশ্নের শেষ নয়। প্রশ্ন এটাও যে আমরা কে। আমরা কি আসলেই রক্ত-মাংসের মানুষ– নাকি আমাদের চারপাশ ঘিরে আছে মন?

সোফির নখ কামড়াতে শুরু করার ঘটনায় অবাক হওয়ার কিছু নেই। নখ কামড়ানোর বদ-অভ্যাস হিল্ডার কখনোই ছিল না ঠিকই, কিন্তু এই মুহূর্তে তার খুব একটা ভালো বোধ হচ্ছে না। তো, এরপর শেষ পর্যন্ত প্রকাশ হয়ে পড়ল সব কিছু আমাদের কাছে– তোমার আর আমার কাছে– এই ইচ্ছা বা চিদাত্মা যা কিনা প্রতিটি জিনিসের মধ্যেকার প্রতিটি জিনিসের কারণ তা হিল্ডার বাবাও হতে পারে।

আপনি কি বলতে চাইছেন আমাদের জন্যে তিনি একরকম ঈশ্বরের মতো?

একেবারে খোলাখুলিভাবে বললে বলতে হয় হ্যাঁ। নিজের জন্যে লজ্জা হওয়া উচিত লোকটার।

আর হিল্ডা, সে কী?

হিল্ডা একটা পরী।

পরী?

হিল্ডা-ই হচ্ছে সে যার মুখাপেক্ষী হয়ে থাকে এই চিদাত্মা।

এরপরই সোফি অ্যালবার্টোকে ফেলে দৌড়ে বেরিয়ে আসে ঝড়ের মধ্যে। সোফি শহরের ভেতর দিয়ে ছুটে যাবার কয়েক ঘন্টা পর বিয়ার্কলের ওপর দিয়ে কালরাতে যে-ঝড় বয়ে গেছে এটা কি সেই একই ঝড়?

দৌড়ানোর সময় একটা চিন্তাই কেবল খেলে বেড়াতে লাগল তার মধ্যে: কাল আমার জন্মদিনা কিন্তু পঞ্চদশ জন্মদিনের আগের দিনই যদি কেউ উপলব্ধি করে যে জীবনটা নেহাতই একটা স্বপ্ন তাহলে সেটা কি একটু বেশি তিক্ত হয়ে যায় না? ব্যাপারটা অনেকটা ১০ লাখ টাকা জিতে সেটা পাওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে ঘুম ভেঙে যাওয়ার মতো।

প্যাঁচপ্যাঁচে ভেজা খেলার মাঠটা পেরিয়ে এলো সোফি। কয়েক মিনিট পরেই সে দেখল কে একজন দৌড়ে আসছে তার দিকে। দেখা গেল, তিনি আর কেউ নন, তার মা। বিদ্যুচ্চমকের ক্রুদ্ধ বর্শায় আকাশ বারবার চিরে ফালা ফালা হয়ে যাচ্ছে।

দুজনে পরস্পরের কাছে পৌঁছানোর পর সোফির মা হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলেন তাকে।

কী ঘটছে রে এ-সব আমাদের জীবনে, মা আমার?

আমি জানি না, ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল সোফি।

ব্যাপারটা একটা দুঃস্বপ্নের মতো।

.

হিল্ডা অনুভব করল অশ্রু গড়াতে শুরু করেছে তার চোখ বেয়ে। টু বি অর নট টু বিদ্যাট ইজ দ্য কোশ্চেন। বিছানার শেষ মাথায় রিং বাইন্ডারটা ছুঁড়ে ফেলে উঠে দাঁড়াল হিল্ডা। একবার এদিক আরেকবার ওদিক পায়চারি করতে থাকল সে মেঝেতে। শেষে, থেমে দাঁড়াল পেতলের আয়নাটার সামনে, তারপর ওর মা এসে ডিনার তৈরি হওয়ার কথা জানানো পর্যন্ত ওখানেই দাঁড়িয়ে রইল সে। দরজায় টোকার শব্দটা তার কানে পৌঁছানোর সময় তার কোনো ধারণাই ছিল না কতক্ষণ সে ওভাবে দাঁড়িয়ে ছিল।

কিন্তু সে নিশ্চিত, পুরোপুরি নিশ্চিত যে তার প্রতিবিম্বটা দুই চোখ দিয়েই চোখ টিপেছিল।

ডিনারের পুরো সময়টা কৃতজ্ঞ এক জন্মদিন-কন্যা হয়ে থাকার চেষ্টা করে গেল হিল্ডা। তবে সারাক্ষণই তার মন পড়ে রইল সোফি আর অ্যালবার্টোর কাছে।

হিল্ডার বাবাই সব কিছু নির্ধারণ করেন এ-কথা জানার পর এবার ওদের দিনকাল কেমন কাটবে? অবশ্য জানা বললে সম্ভবত অতিশয়োক্তি হয়ে যায়। ওরা যে আদৌ কিছু জানে এটা ভাববারই তো কোনো মানে হয় না। তারা যেটুকু জানছে। সেটা তো হিল্ডার বাবাই তাদের জানতে দিচ্ছেন বলে তারা জানছে, তাই না?

 তারপরেও, যেদিক দিয়েই তাকানো যাক না, কেন সমস্যাটা একই রয়ে গেছে। সোফি আর অ্যালবার্টো পুরো ব্যাপারটার স্বরূপ জেনে যাওয়ার পর তাদের জন্যে অবস্থাটা হয়ে পড়েছে রাস্তার শেষ মাথায় এসে দাঁড়ানোর মতো।

একই সমস্যাটা যে সম্ভবত তার নিজের জগতের বেলাতেও প্রযোজ্য সে-কথাটা হঠাৎ উপলব্ধি করল সে আর তখন মুখভর্তি খাবার নিয়ে আরেকটু হলেই বিষম খেতে যাচ্ছিল সে। প্রাকৃতিক নিয়ম-কানুন সম্পর্কে মানুষের বোধ-বুদ্ধি ধীরে ধীরে বেড়েছে। দর্শন আর বিজ্ঞানের জিগজপাজ-টার শেষ খণ্ডটা জায়গামতো বসে গেলেই কি ইতিহাস অনন্তকালের দিকে চলতে শুরু করবে? একদিকে ধ্যান-ধারণা আর বিজ্ঞানের উন্নতি এবং অন্যদিকে গ্রীনহাউস এফেক্ট আর বৃক্ষশূন্যতা, এই দুই এর মধ্যে নিশ্চয়ই একটা সম্পর্ক আছে? সেজন্যেই মানুষের জ্ঞানতৃষ্ণাকে নীতিভ্রষ্টতা বলাটা হয়ত ততটা পাগলামি নয়।

প্রশ্নটা এতোই বড় আর ভয়ংকর যে আবার ওটা ভুলে থাকার চেষ্টা করল হিল্ডা। বাবার পাঠানো জন্মদিনের বইটার আরো খানিকটা পড়লে সম্ভবত আরো অনেক বেশি জিনিস জানতে পারবে সে। দুজনে আইসক্রিম আর ইতালিয় স্ট্রবেরি শেষ করার পর হিল্ডার মা আবার গেয়ে উঠলেন, হ্যাপি বার্থ ডে টু ঝু… তারপর বললেন, এবার তোর যা পছন্দ তাই করবো আমরা।

জানি কথাটা বেশ বেখাপ্পা শোনাবে, কিন্তু সত্যি কথা হচ্ছে বাবার উপহার দেয়া বইটাই পড়তে চাই আমি এখন।

বেশ তো পড়, যতক্ষণ পর্যন্ত না ও তোকে পুরোপুরি পাগল বানিয়ে ছাড়ে।

নো ওয়ে।

একটা পিৎজা খেতে খেতে টিভিতে এই মিস্ট্রিটা দেখা যেতে পারে।

ঠিক আছে, তুমি যখন বলছ।

সোফি কীভাবে তার মায়ের সঙ্গে কথা বলেছিল সে-কথা হঠাৎ মনে পড়ে গেল হিল্ডার। আশা করা যায় হিল্ডার মায়ের কোনো কিছু বাবা অন্যের মায়ের চরিত্রে ঢোকাননি। স্রেফ সে-সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্যেই সে সিদ্ধান্ত নিল টপ হ্যাঁটের ভেতর থেকে বের করে আনতে থাকা সাদা খরগোশের কথা উল্লেখ না করার। অন্তত আজ নয়।

ভালো কথা, টেবিল ছেড়ে ওঠার সময় বলে উঠল সে।

কী?

আমার সেই সোনার কুসিফিক্সটা পাচ্ছি না কোথাও।

হেঁয়ালিভরা একটা অভিব্যক্তি নিয়ে হিল্ডার দিকে তাকালেন তার মা। কয়েক হপ্তা আগে ডকের পাশে পেয়েছিলাম আমি ওটা। তুই নিশ্চয়ই হারিয়ে ফেলেছিলি ওটা, অগোছালো পাজী মেয়ে কোথাকার।

বাবাকে সে-কথা বলেছিলে বুঝি তুমি?

দাঁড়া, মনে করি…হ্যাঁ, বলেইছিলাম খুব সম্ভব।

তাহলে কোথায় ওটা?

তার মা উঠে দাঁড়িয়ে নিজের অলংকারের বাক্সটা আনতে গেলেন। শোবার ঘর। থেকে ভেসে আসা আশ্চর্যসূচক একটা ধ্বনি শুনতে পেল হিল্ডা। দ্রুত লিভিং রুমে ফিরে এলেন তিনি।

এই মুহূর্তে তো ওটা পাচ্ছি না দেখছি।

আমিও তাই ভেবেছিলাম।

মাকে একটা আলিঙ্গন করে ওপরে তার নিজের ঘরে চলে গেল হিল্ডা দৌড়ে। অবশেষে এবার সে সোফি আর অ্যালবার্টোর কথা পড়তে পারবে। আগের মতোই। রিং বাইন্ডারটা হাঁটুর ওপর নিয়ে বিছানায় বসে পড়তে শুরু করল সে পরের পরিচ্ছেদটা।

.

পরের দিন তার মা এক ট্রে-ভর্তি জন্মদিনের উপহার নিয়ে ঘরে ঢুকতে ঘুম থেকে উঠল সোফি। খালি একটা সোড়ার বোতলে একটা পতাকা লাগিয়ে এনেছেন তিনি।

হ্যাপি বার্থ ডে, সোফি!

দুহাতে চোখ ঘষে ঘুম তাড়াল সোফি। আগের রাতে কী ঘটেছে মনে করার চেষ্টা করল সে। কিন্তু সব যেন একটা জিগজঅ পাজ-এর এলোমেলো টুকরোর মতো ঠেকল তার কাছে। একটা টুকরো হলো অ্যালবার্টো, আরেকটা হচ্ছে হিল্ডা আর সেই মেজর। তৃতীয়টা হলো বার্কলে, চতুর্থটা বিয়ার্কলে। সবচেয়ে কালো টুকরোটা হলো গতরাতের ভয়ংকর ঝড়টা। আসলেই একটা ধাক্কা খেয়েছিল সে। একটা তোয়ালে দিয়ে তার শরীরটা মুছে দিয়েছিলেন তার মা তারপর এক কাপ গরম দুধ খাইয়ে স্রেফ শুইয়ে দিয়েছিলেন বিছানায়। সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়েছিল সে।

আমি নিশ্চয়ই বেঁচে আছি এখনো? দুর্বল গলায় বলল সে।

আলবাৎ বেঁচে আছিস তুই। আর আজ তোর বয়স পনেরো হলো।

তুমি ঠিক বলছ তো?

তা নয় তো কী? মা জানবে না তার মেয়ের জন্ম কবে? ১৫ই জুন, ১৯৭৫…দেড়টার সময়। ওটা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে সুখের মুহূর্ত।

তুমি ঠিক জানো এগুলো সব নিছক স্বপ্ন নয়?

ঘুম থেকে জেগে উঠে রোল আর সোডা আর জন্মদিনের উপহার পাওয়াটা নিশ্চয়ই একটা ভালো স্বপ্ন।

একটা চেয়ারের ওপর উপহারগুলো রেখে এক মুহূর্তের জন্যে বাইরে গেলেন তিনি। যখন ফিরে এলেন, তার হাতে তখন রোল আর সোডাসহ আর একটা ট্রে। ওটা তিনি বিছানার শেষ মাথায় রাখলেন।

এটা হচ্ছে গতানুগতিক জন্মদিনের সকালের আচার-অনুষ্ঠান শুরুর একটা সংকেত। এরপরই উপহারগুলো ভোলা হবে, তার মা ভাবাবেগ-এর সঙ্গে স্মরণ করবেন পনেরো বছর আগে ওঠা তার প্রথম ব্যথার কথা। সোফির মা উপহার দিয়েছেন একটা টেনিস র‍্যাকেট। সোফি কখনো টেনিস খেলেনি, তবে ক্লোভার ক্লোজ থেকে কয়েক মিনিটের হাঁটা-পথের দূরত্বেই রয়েছে কয়েকটা ভোলা কোর্ট। তার বাবা সোফির জন্যে পাঠিয়েছেন একটা মিনি টিভি আর এফ এম রেডিও। স্ক্রীনটা সাধারণ একটা ছবির চেয়ে বড় হবে না। বয়স্কা ফুপু-খালা আর পারিবারিক বন্ধুরাও উপহার পাঠিয়েছেন।

হঠাৎ তার মা বললেন, তুই কি বলিস? আজ না হয় কাজে না-ই গেলাম?

না, তা কেন করবে?

 কাল বড্ড আপসেট ছিলি তুই। এ-রকম চললে বোধকরি একজন সাইকিয়াট্রিস্ট-এর সঙ্গে দেখা করার জন্যে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করতে হবে।

তার দরকার হবে না।

কারণটা কী, ঝড় নাকি অ্যালবার্টো? আর তোমার কী হয়েছিল? তুমি বলেছিলে: কী ঘটছে রে এ-সব আমাদের জীবনে, মা আমার?

শহরময় দৌড়ে বেড়াচ্ছিস তুই একটা রহস্যময় লোকের সঙ্গে দেখা করার জন্যে, এ-সব নিয়ে ভাবছিলাম আমি।…হয়ত দোষটা আমারই।

আমি যে আমার অবসর সময়ে দর্শনের একটা কোর্স করছি এটা কারো দোষ না। তুমি কাজে চলে যাও তো। দশটার আগে স্কুল শুরু হবে না, তাছাড়া আমরা তো আজ স্রেফ গ্রেড পাবো আর বসে থাকবো।

জানিস নাকি কী পাবি?

অন্তত গত সিমেস্টারে যা পেয়েছিলাম তার চেয়ে বেশি।

.

তার মা চলে যাওয়ার পর খানিকক্ষণ যেতে না যেতেই ফোনটা বেজে উঠল।

সোফি অ্যামুন্ডসেন।

অ্যালবার্টো বলছি।

 ও।

কাল কোনো অস্ত্র-ই বাকি রাখেনি মেজর।

কী বলতে চাইছেন?

ঝড়-বৃষ্টি, সোফি।

কিছুই ভেবে উঠতে পারছি না।

 এরচেয়ে ভাল গুণ আর হয় না একজন দার্শনিকের। এতো অল্প সময়ে তুমি এতোটা শিখেছো বলে গর্ব হচ্ছে আমার তোমাকে নিয়ে।

কিন্তু আমার ভয় হচ্ছে এসবের কোনো কিছুই বাস্তব নয়।

এটাকে বলে অস্তিত্ববাদী উৎকণ্ঠা (angst) বা ভয়। আর, সাধারণত নতুন চেতনা অর্জনের পথে এটা একটা ধাপ মাত্র।

আমার মনে হয় এই কোর্স-এ একটা ব্রেক দরকার আমার।

বাগানে কি এই মুহূর্তে এতোগুলোই ব্যাঙ রয়েছে?

হাসতে শুরু করল সোফি। অ্যালবার্টো বলে চললেন: আমার মনে হয় লেগে থাকাটাই বরং আরো ভালো হবে। ও ভালো কথা, হ্যাপি বার্থ ডে। মিডসামার ঈ এর মধ্যে কোর্সটা শেষ করতেই হবে আমাদের। এটাই আমাদের শেষ সুযোগ।

কীসের শেষ সুযোগ আমাদের?

তুমি আরাম করে বসেছ তো? এই বিষয়ে খানিকটা সময় দিতে হবে আমাদের বুঝলে।

আমি বসছি।

 দেকার্তের কথা মনে আছে তো?

আমি চিন্তাকরি, তাই আমি অস্তিত্বশীল?

আমাদের নিজস্ব পদ্ধতিগত সন্দেহের কারণে এই মুহূর্ত থেকে আমরা একেবারে গোড়া থেকে শুরু করছি। আমরা এমনকী এটাও জানি না যে আমরা চিন্তা করি কিনা। এমনও দেখা যেতে পারে যে আমরা আসলে কিছু চিন্তা আর সেটা কিন্তু চিন্তা করার থেকে একেবারে ভিন্ন একটা জিনিস। এ-কথা বিশ্বাস করবার সঙ্গত কারণ রয়েছে আমাদের যে আমরা স্রেফ হিল্ডার বাবার আবিষ্কার এবং আমাদেরকে সে আবিষ্কার করেছে লিলেস্যান্ডে অবস্থানরত মেজরের মেয়ের জন্মদিনের আমোদ হিসেবে। বুঝতে পারছো তো তুমি?

পারছি…

কিন্তু এইখানটায় আবার একটা অন্তর্নিহিত স্ববিরোধ আছে। আমরা কাল্পনিক হয়ে থাকলে কোনো কিছু বিশ্বাস করার আদৌ কোনো অধিকার নেই আমাদের। সেক্ষেত্রে এই টেলিফোন সংলাপের পুরোটাই নিখাদ কাল্পনিক।

তাহলে তো আমাদের একরত্তিও স্বাধীন ইচ্ছা নেই, তার কারণ আমরা যা বলি আর করি তার সব কিছুই মেজরের পরিকল্পনা মতো ঘটছে। কাজেই আমরা এখন অনায়াসে ফোন রেখে দিতে পারি।

না, না, এবার কিন্তু তুমি ব্যাপারগুলো অতিসরলীকরণ করছে।

 ঠিক আছে, তাহলে ব্যাখ্যা করুন ব্যাপারটা।

তুমি কি এ-রকম দাবি করতে পারো যে লোকে যা স্বপ্ন দেখে তার সবই পরিকল্পনামাফিক দেখে? হতে পারে আমরা যা করি তার সবই হিল্ডার বাবা জানে। হতে পারে যে নিজের ছায়ার কাছ থেকে পালিয়ে বেড়ানো যতটা কঠিন, তার সর্বজ্ঞতা থেকে পালানো-ও ঠিক ততটাই কঠিন। সে যাই হোক আর এই জায়গাটাতেই আমি একটা ফন্দি আঁটতে শুরু করেছি-এটা কিন্তু নিশ্চিত নয় যে যা কিছু ঘটবে তার সবই মেজর এরই মধ্যে ভেবে রেখেছে। একেবারে শেষ মুহূর্তের আগে অর্থাৎ সৃষ্টির সময়ের আগে হয়ত সে সিদ্ধান্ত নেয় না। ঠিক এই ধরনের মুহূর্তগুলোতেই আমরা হয়ত নিজেরাই একটা উদ্যোগ নিতে পারি যা ঠিক করবে আমরা কী বলব আর করব। স্বভাবতই, এ-ধরনের উদ্যোগ মেজরের ভারি কামানগুলোর তুলনায় খুবই দুর্বল অভিঘাত তৈরি করবে। কথা-বলা কুকুর, কলার ভেতরে থাকা মেসেজ আর আগে থেকেই বুক করা বজ্রবৃষ্টির মতো অনুপ্রবেশমূলক বাহ্যিক শক্তির বিরুদ্ধে আমরা খুব সম্ভবত অসহায়। কিন্তু তাই বলে আমরা আমাদের একগুঁয়েমিটাকে বাতিল করে দিতে পারি না, তা সেটা যতই দুর্বল হোক না কেন।

তা কী করে সম্ভব?

আমাদের ছোট্ট পৃথিবীর সব কিছুই স্বভাবত মেজর জানে, কিন্তু তার মানে এই নয় যে সে সর্বশক্তিমান। অন্তত আমাদেরকে অবশ্যই এমনভাবে বাঁচার চেষ্টা করতে হবে যেন সে তা নয়।

আমার মনে হয় আমি বুঝতে পারছি আপনি কী বলতে চাইছেন।

কৌশলটা হবে পুরোপুরি আমাদের নিজেদের চেষ্টায় কিছু করা যায় কিনা তা দেখা-এমন কিছু যা মেজর টের পাবে না।

আমাদের যদি স্রেফ অস্তিত্বটুকুও না থাকে তাহলে তা কেমন করে করব আমরা?

কে বলেছে আমাদের অস্তিত্ব নেই? আমরা আছি কি না সেটা প্রশ্ন নয়, প্রশ্ন হচ্ছে আমরা কী আর আমরা কে। এমনকী যদি দেখা যায় যে মেজরের দ্বৈত সত্তায় আমরা স্রেফ কিছু অভিঘাত ছাড়া কিছু নয় তাতেও আমাদের এই ক্ষুদ্র অস্তিত্ব আমাদের কাছ থেকে বিলীন হয়ে যায় না।

অথবা আমাদের স্বাধীন ইচ্ছা?

আমি তো সেটা নিয়েই কাজ করছি, সোফি।

কিন্তু হিল্ডার বাবার নিশ্চয়ই এটা মোটেই অজানা নয় যে আমরা এটা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি?

তা তো বটেই। কিন্তু আসল পরিকল্পনাটা যে কী সেটা সে জানে না, একটা আর্কিমিডিয়ান পয়েন্ট খুঁজে বের করা যায় কিনা সেই চেষ্টা করছি আমি।

আর্কিমিডিয়ান পয়েন্ট?

আর্কিমিডিস ছিলেন এক গ্রীক বৈজ্ঞানিক, তিনি বলেছিলেন: দাঁড়াবার মতো একটা শক্ত জায়গা শুধু দাও আমাকে, পৃথিবীটাকে নাড়িয়ে দিচ্ছি আমি। মেজরের ভেতরের মহাবিশ্ব থেকে আমাদের নিজেদেরকে সরিয়ে নেবার জন্য ঠিক ওই রকমের একটা জায়গা খুঁজে বের করতেই হবে আমাদের।

সেটা একটা কাজের কাজ হবে কিন্তু।

কিন্তু দর্শনের কোর্সটা শেষ হওয়ার আগে আমরা সরে পড়তে পারছি না। যতক্ষণ সেটা চলছে ততক্ষণ আমাদের ওপর তার বজ্র আঁটুনী থেকেই যাবে। স্পষ্টতই, সে ঠিক করেছে যে শতাব্দীর পর শতাব্দীর ভেতর দিয়ে একেবারে আমাদের সময় পর্যন্ত তোমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে হবে আমাকে। কিন্তু মধ্য প্রাচ্যের কোনো এক জায়গা থেকে প্লেনে চড়ার খুব বেশিদিন আর বাকি নেই তার। সে বিয়ার্কলেতে পা দেবার আগেই যদি তার আঠাল কল্পনার কাছ থেকে নিজেদেরকে ছাড়িয়ে নিতে না পারি আমরা তো আমাদের কম্ম কাবার হয়ে যাবে।

আপনি ভয় পাইয়ে দিচ্ছেন আমাকে।

প্রথমেই ফরাসী আলোকপ্রাপ্তি (French Enlightenment) সম্পর্কে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলো দেবো তোমাকে। এরপর নজর দেবো সংক্ষেপে কান্ট-এর দর্শনের প্রধান প্রধান বিষয়গুলোর দিকে, যাতে করে রোমান্টিসিজমে যেতে পারি আমরা। এসবের মধ্যে হেগেল-ও একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে যোগ দেবেন। আর তাঁর সম্পর্কে আলাপ করতে গিয়ে অবশ্যম্ভাবীভাবে যা চলে আসবে তা হলো হেগেলিয় দর্শনের সঙ্গে কিয়ের্কেগার্ড-এর ক্রুদ্ধ এবং ভর্ৎসনামূলক সংঘর্ষের বিষয়টা। তারপর সংক্ষেপে আলাপ করব আমরা মাক্স, ডারউইন আর ফ্রয়েডের কথা। তারপর সাত্রে আর অস্তিত্ববাদ সম্পর্কে শেষে কিছু মন্তব্য করতে পরলেই আমাদের পরিকল্পনাটা নিয়ে মাঠে নেমে পড়তে পারব আমরা।

এক সপ্তাহের জন্যে বড্ড বেশি হয়ে গেল।

সেজন্যেই এক্ষুণি শুরু করতে হবে আমাদের। এখনই চলে আসতে পারবে তুমি?

কিন্তু আমাকে যে স্কুলে যেতে হবে। আমাদের ক্লাসের একটা গেট-টুগেদার আছে আজ, তারপর আমাদের গ্রেড দেয়া হবে।

বাদ দাও। আমরা যদি নিছক অলীক-ই হয়ে থাকি তাহলে ক্যান্ডি আর সোডার মজাটা নিখাদ কল্পনা ছাড়া অন্য কিছু নয়।

 কিন্তু আমার গ্রেড…

সোফি, হয় তুমি বেশ কয়েকশ বিলিয়ন গ্যালাক্সির একটি গ্যালাক্সির ছোট্ট একটা গ্রহের এক আশ্চর্য বিশ্বে বাস করছ আর নয়ত তুমি মেজরের মনে গুটিকতেক ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক অভিঘাতের ফল মাত্র। অথচ তুমি কিনা বলছ গ্রেডের কথা! নিজের ওপর লজ্জা হওয়া উচিত তোমার।

দুঃখিত।

ঠিক আছে, আমাদের দেখা হওয়ার আগে তুমি বরং স্কুল থেকে ঘুরেই এসো। তোমার শেষ স্কুল-দিবসটায় তুমি যদি না যাও তাহলে সেটা হিল্ডার ওপর একটা খারাপ প্রভাব ফেলতে পারে। সম্ভবত ও তার জন্মদিনের দিনও স্কুলে যায়। তুমি তো জানোই, ও একটা পরী।

আমি তাহলে স্কুল থেকে সোজা চলে যাব।

 মেজরের কেবিনে দেখা করতে পারি আমরা।

মেজরের কেবিন?

…ক্লিক।

.

রিং বাইন্ডারটা নিজের কোলের ওপর গড়িয়ে পড়তে দিল হিল্ডা। বাবা ওর বিবেকে একটা খোঁচা দিয়েছেন এইখানটায়-সে তার স্কুলের শেষ দিনটা কামাই করেছে। বড্ড পচা হয়েছে বাবাটা।

অ্যালবার্টো কী ফন্দি আঁটছে তাই ভাবল সে খানিকক্ষণ বসে বসে, চট করে শেষ পাতাটায় একটা উঁকি মেরে দেখে নেবে নাকি? না, সেটা চুরি করা হয়ে যাবে। তারচেয়ে বরং তাড়াতাড়ি শেষ পর্যন্ত পড়াটাই ভালো হবে।

তবে সে নিশ্চিত যে গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়ে অ্যালবার্টো একদম ঠিক কথা বলেছেন। সোফি আর অ্যালবার্টোর বরাতে কী ঘটবে সে-সম্পর্কে তার বাবার একটা সার্বিক ধারনা আছে সে-কথা ঠিক। কিন্তু লেখার সময়, সম্ভবত, যা কিছু ঘটবে তার সব কিছু তার জানা থাকে না। তাড়াহুড়োর সময় তিনি হয়ত কিছু একটা ভুলে যান, সেটা তার মনে পড়ে লেখার অনেক পরে। এরকম একটা পরিস্থিতিতে সোফি আর অ্যালবার্টোর খানিকটা অবসর জুটবে।

আরো একবার হিল্ডার প্রায় দৃঢ় বিশ্বাস জন্মাল যে সোফি আর অ্যালবার্টো সত্যিই আছে। স্টিল ওয়াটারস রান ডিপ, মনে মনে ভাবল হিল্ডা।

কথাটা মনে হলো কেন তার?

এ-ধরনের চিন্তা যে-কোনো সময় হয় না।

.

স্কুলে অনেক খাতির পে সোফি আজ তার জন্মদিন বলে। গ্রীষ্মের বন্ধ, গ্রেড আর সোডার চিন্তায় স্কুলের শেষ দিনে সোফির ক্লাসের বন্ধুরা আজ এমনিতেই মহা উত্তেজিত ছিল। বন্ধের জন্যে শুভকামনা জানিয়ে শিক্ষক ছুটি দিয়ে দিতেই দৌড়ে বাড়ি চলে এলো সোফি। জোয়ানা ওকে থামাতে চেয়েছিল কিন্তু সোফি ঘাড় ফিরিয়ে জানিয়ে দিল একটা কাজ আছে তার যা না করলেই নয়।

ডাকবাক্সে লেবানন থেকে আসা দুটো কার্ড পেল সে। দুটোই বার্থডে কার্ড: শুভ জন্মদিন-১৫ বছর। একটা কার্ড এসেছে হিল্ডা মোলার ন্যাগ, প্রযত্নে সোফি অ্যামুন্ডনের… এর কাছে। অন্যটা সোফির কাছে। দুটো কার্ডেই সীলমোহর দেয়া রয়েছে জাতিসংঘ বাহিনী-১৫ই জুন।

তার নিজের কার্ডটা আগে পড়ল সোফি:

প্রিয় সোফি অ্যামুন্ডসেন, আজ তুমিও একটা কার্ড পাচ্ছো। শুভ জন্মদিন সোফি আর তাছাড়া, হিল্ডার জন্যে তুমি যা কিছু করেছ সেজন্যে অনেক ধন্যবাদ তোমাকে। বেস্ট রিগার্ডস, মেজর অ্যালবার্ট ন্যাগ।

হিল্ডার বাবা শেষ পর্যন্ত তার কাছেও চিঠি লিখেছেন, এতে সোফি ঠিক বুঝতে পারল না তার নিজের প্রতিক্রিয়াটা কী হবে।

হিল্ডার কার্ডে লেখা:

প্রিয় হিল্ডা, লিলেস্যান্ডে এই মুহূর্তে কী বার বা কোন সময় সে বিষয়ে কোনো ধারণাই নেই আমার। তবে, আগেই তো বলেছি, তাতে খুব একটা কিছু আসে যায় না। আমি যদি তোকে চিনে থাকি তাহলে এখান থেকে তোকে শেষবারের মতো বা শেষবারের আগের বারের মতো শুভেচ্ছা জানাতে খুব দেরি করে ফেলিনি আমি। তবে খুব বেশি রাত জাগিস না কিন্তু! অ্যালবার্টো খুব শিগগিরই তোকে ফরাসী আলোকপ্রাপ্তি সম্পর্কে বলতে শুরু করবে। সাতটী পয়েন্ট-এর ওপর জোর দেবে সে। সেগুলো হচ্ছে:

১.কর্তৃপক্ষের বিরোধিতা। ২. বুদ্ধিবাদ। ৩. আলোকপ্রাপ্তি আন্দোলন। ৪. সাংস্কৃতিক আশাবাদ। ৫. প্রকৃতির কাছে প্রত্যাবর্তন। ৬. প্রাকৃতিক ধর্ম। ৭. মানবাধিকার।

মেজর যে এখনো তাদের ওপর নজর রাখছেন সেটা পরিষ্কার।

বাড়ির ভেতর ঢুকে সব এ পাওয়া রিপোর্ট কার্ডটা রান্নাঘরের টেবিলের ওপর রেখে দিল সোফি, তারপর বেড়াটা গলে বেরিয়ে এসে ছুট লাগাল বনের ভেতর।

শিগগিরই নৌকো বেয়ে ছোট্ট লেকটা পাড়ি দিতে দেখা গেল তাকে।

কেবিনে পৌঁছে সে দেখল দোরগোড়ায় বসে আছেন অ্যালবার্টো। তাকে পাশে বসার আমন্ত্রণ জানালেন তিনি। লেকটা থেকে ভেজা টাটকা বাতাসের হালকা একটা কুয়াশা যদিও ভেসে আসছে তারপরেও আবহাওয়াটা চমৎকারই বলতে হবে। যেন ঝড়টার প্রভাব এখনো পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি সেটা।

চলো শুরু করা যাক, দেরি না করে, অ্যালবার্টো বললেন।

 হিউম-উত্তর পরবর্তী মহান দার্শনিক হলেন জার্মান ইমানুয়েল কান্ট। অবশ্য অষ্টাদশ শতকে ফ্রান্সেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ চিন্তাবিদ ছিলেন। আমরা বলতে পারি, অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে ইউরোপের দার্শনিক ভরকেন্দ্র ছিল ইংল্যান্ডে, মাঝামাঝি সময়ে ফ্রান্সে আর শেষের দিকে জার্মানীতে।

অন্য কথায় বলতে গেলে, পশ্চিম থেকে পূর্বে স্থানান্তর।

ঠিক বলেছ। তো এখন, ফরাসী আলোকপ্রাপ্তির সময়কার দার্শনিকেরা যে-সব ধারণা পোষণ করতেন সেগুলো সংক্ষেপে বলে নিই তোমাকে। গুরুত্বপূর্ণ নামগুলো হলো মতে, ভলতেয়ার (Voltaire) আর রুশো (Rousseau), অবশ্য এছাড়া আরো অনেকেই রয়েছেন। আমি এখন সাতটা পয়েন্ট-এর ওপর আলোকপাত করছি।

ধন্যবাদ, জানি আমি ওগুলোর কথা, যদিও খুব সুখের সঙ্গে নয়। হিল্ডার বাবার পাঠানো কার্ডটা তার হাতে ধরিয়ে দিল সোফি। গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন অ্যালবার্টো। কষ্টটা সে না করলেও পারতো; সে যাই হোক, তাহলে প্রথম জরুরি প্রসঙ্গটি হলো কর্তৃপক্ষের বিরোধিতা। ফরাসী আলোকপ্রাপ্তি যুগের অনেক দার্শনিকই ইংল্যান্ড ভ্রমণ করেছিলেন, অনেক দিক থেকেই দেশটা তাদের মাতৃভূমির চেয়ে উদার ছিল। তো, সেই সফরে গিয়ে তারা ইংলিশ প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, বিশেষ করে নিউটন আর তার বৈশ্বিক পদার্থবিদ্যার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। কিন্তু সেই সঙ্গে তারা ব্রিটিশ দর্শনের প্রতি আকৃষ্ট হন। বিশেষ করে লক আর তাঁর রাজনৈতিক দর্শনের প্রতি। ফ্রান্সে ফিরে গিয়ে ক্রমেই তারা আরো বেশি বিরুদ্ধাচারণ করতে থাকেন কর্তৃপক্ষের। তারা মনে করলেন, উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া সত্যগুলোর ব্যাপারে সন্দেহপ্রবণ থাকাটা নিতান্তই জরুরি আর এর পেছনে যে ধারণাটা ছিল তা হচ্ছে একজন মানুষকে অবশ্য তার প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর নিজেকেই খুঁজে নিতে হবে। এক্ষেত্রে দেকার্তের ঐতিহ্যটা ছিল খুবই অনুপ্রেরণামূলক।

তার কারণ তিনি সব কিছু একেবারে গোড়া থেকে শুরু করেছিলেন।

 ঠিক তাই। কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধাচারণের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল যাজক, রাজা আর অভিজাতবংশীয়দের ক্ষমতা। অষ্টাদশ শতাব্দীতে এই প্রতিষ্ঠানগুলো ইংল্যান্ডের চেয়ে ফ্রান্সে অনেক বেশি ক্ষমতাশালী ছিল।

এরপর এলো ফরাসী বিপ্লব।

হ্যাঁ, ১৭৮৯-তে। কিন্তু বিপ্লবী ধারণাগুলোর উদ্ভব হয়েছিল কিন্তু আরো অনেক আগে। তো, এরপরের জরুরি প্রসঙ্গটি হচ্ছে বুদ্ধিবাদ।

আমি তো ভেবেছিলাম হিউম-ই সেটার ইতি টেনে দিয়েছিলেন।

হিউম-ই তো বেঁচে ছিলেন ১৭৭৬ পর্যন্ত। তার মানে, সঁতেঙ্কুর, মৃত্যুর বিশ বছর পর আর ভলতেয়ার ও রুশোর মৃত্যুর দুই বছর আগে পর্যন্ত। কিন্তু এরা তিনজনেই ইংল্যান্ড ভ্রমণ করেছিলেন, তিন জনই পরিচিত ছিলেন লকের দর্শন-এর সঙ্গে। তোমার হয়ত মনে পড়বে লক তার অভিজ্ঞতাবাদ-এ পুরোপুরি স্থির ছিলেন না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, তিনি বিশ্বাস করতেন ঈশ্বর-এ বিশ্বাস এবং বিশেষ কিছু নৈতিক মানদণ্ড মানুষের প্রজ্ঞায় অন্তর্নিহিত থাকে। এই ধারণাটি-ও ফরাসী আলোক প্রাপ্তির মূলে রয়েছে।

আপনি এ-কথাও বলেছিলেন যে ফরাসীরা বরাবরই ব্রিটিশদের চেয়ে বেশি বুদ্ধিবাদী।

হ্যাঁ আর এই পার্থক্যটা তুমি সেই মধ্য যুগ থেকেই দেখতে পাবে। ব্রিটিশরা বলে কাণ্ডজ্ঞান-এর কথা, ওদিকে ফরাসীরা সাধারণত বলে সুস্পষ্টতা-র কথা। ইংলিশ অভিব্যক্তিটার অর্থ যা প্রত্যেকে জানে, ফরাসীটার, কারো যুক্তি বা প্রজ্ঞার কাছে যা সুস্পষ্ট তাই।

বুঝতে পেরেছি।

সক্রেটিস আর স্টোয়িকদের মতো প্রাচীনকালের মানবতাবাদীরা যেমন, ঠিক তেমনি আলোকপ্রাপ্তির বেশিরভাগ দার্শনিকই ছিলেন মানুষের প্রজ্ঞার ওপর প্রবল আস্থাবান। বিষয়টি এতোই বৈশিষ্ট্যপূর্ণ যে ফরাসী আলোকপ্রাপ্তিকে প্রায়ই প্রজ্ঞার যুগ (Age of Reason)-ও বলা হয়ে থাকে। নব্য প্রাকৃতিক বিজ্ঞানও এটা দেখিয়ে দিয়েছিল যে প্রকৃতি প্রজ্ঞার অধীন। এবার আলোকপ্রাপ্তি যুগের দার্শনিকেরা মানুষের অপরিবর্তনীয় প্রজ্ঞা অনুযায়ী নীতি, ধর্ম আর নীতিশাস্ত্রের ভিত্তিমূল রচনা করাকে তাদের কর্তব্য জ্ঞান করলেন। এরই ফলে সৃষ্টি হলো আলোকপ্রাপ্তি আন্দোলন।

তৃতীয় প্রসঙ্গটা।

সেটাই ছিল জনসাধারণকে আলোকপ্রাপ্ত করার প্রারম্ভিক সময়। আরো ভালো একটা সমাজ তৈরির ভিত্তি হবে সেটাই। মানুষ মনে করতো দারিদ্র্য আর উৎপীড়ন অজ্ঞতা আর কুসংস্কারের কুফল। তাই শিশু এবং জনসাধারণের শিক্ষার ওপর মনোযোগ দেয়া হলো বেশি করে। আলোকপ্রাপ্তির সময়ই যে শিক্ষা বিজ্ঞান (pedagogy)-এর সূত্রপাত ঘটেছিল এটা নেহাত কাকতালীয় ঘটনা নয়।

তার মানে স্কুলের শুরু মধ্য যুগে আর শিক্ষা বিজ্ঞান আলোকপ্রাপ্তির সময়।

তা তুমি বলতে পারো। আলোকপ্রাপ্তি আন্দোলনের সবচেয়ে বড় স্মারক তাই অতি স্বভাবতই এক বিশাল বিশ্বকোষ। ১৭৫১ থেকে ১৭৭২-এর মধ্যে প্রকাশিত ২৮ অমের বিশ্বকোষের কথা বলছি আমি। বড় বড় সমস্ত দার্শনিক আর বিদ্বান ব্যক্তি মিলে রচনা করেছিলেন বিশ্বকোষটা। বলা হলো, সব কিছুই পাওয়া যাবে ওখানে, সুচ বানাবার উপায় থেকে কামান তৈরির পদ্ধতি পর্যন্ত।

এর পরের পয়েন্টটা হলো সাংস্কৃতিক আশাবাদ সোফি বলল।

 আমরা কথা বলার সময় কার্ডটা দয়া করে সরিয়ে রাখলে উপকৃত হতাম।

দুঃখিত।

আলোকপ্রাপ্তি যুগের দার্শনিকেরা ভেবেছিলেন প্রজ্ঞা আর জ্ঞান বিপুলভাবে বিস্তার লাভ করলে মানবজাতির শনৈ শনৈ উন্নতি ঘটবে। অ-বুদ্ধিবাদ আর অজ্ঞতা অপসারিত হয়ে এক আলোকপ্রাপ্ত মানবজাতির উদ্ভব হওয়াটা নেহাতই সময়ের ব্যাপার। এই গত কয়েক দশক আগ পর্যন্ত-ও এটাই ছিল পশ্চিম ইউরোপে সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী চিন্তা। ইদানিং আমরা আর অতোটা নিশ্চিত নই যে সব উন্নতি-ই ভালোর জন্যে।

কিন্তু সভ্যতার এই সমালোচনা এরিমধ্যে আলোকপ্রাপ্তি যুগের দার্শনিকদের মুখে শোনা গিয়েছিল।

তাদের কথা শোনাই হয়ত ভালো ছিল আমাদের।

কারো কারো কাছে সার্বক্ষণিক বুলি হয়ে দাঁড়ায় ফিরে চলো প্রকৃতির কাছে। কিন্তু আলোকপ্রাপ্তি যুগের দার্শনিকদের কাছে প্রকৃতি আর প্রজ্ঞা ছিল প্রায় সমার্থক, কারণ, মানুষের প্রজ্ঞা প্রকৃতিরই দান, ধর্ম বা সভ্যতার নয়। মন্তব্য করা হলো যে তথাকথিত আদিম মানুষেরা ইউরোপিয়দের চেয়ে স্বাস্থ্যবান আর সুখী। হয় প্রায়ই আর তার কারণ হচ্ছে, বলা হলো, তারা সভ্য হয়নি। রুশো-ই চালু করলেন কথাটা, প্রকৃতির কাছে ফিরে যাওয়া উচিত আমাদের। কারণ প্রকৃতি ভালো আর মানুষ প্রকৃতিগতভাবে ভাল; সভ্যতাই মানুষকে ধ্বংস করে। রুশো আরো বিশ্বাস করতেন যে যদ্দিন সম্ভব তদ্দিন একটি শিশুকে তার প্রকৃতিগত সরল অবস্থায় থাকতে দেয়া উচিত। এ-কথা বললে ভুল বলা হবে না যে শৈশবের স্বকীয় (intrinsic) মূল্যের বিষয়টি গুরুত্ব পেতে শুরু করেছে আলোকপ্রাপ্তির সময় থেকেই। তার আগে শৈশবকে দেখা হতো স্রেফ বয়ঃপ্রাপ্ত অবস্থার প্রস্তুতি হিসেবে। কিন্তু আমরা সবাই-ই মানুষ আর পৃথিবীতে আমরা আমাদের জীবন কাটাই, তা আমরা যখন শিশু তখনও।

আমরাও তো ঐ একই মত।

 তারা মনে করতেন ধর্ম-কেও প্রাকৃতিক হতে হবে।

ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছিলেন তারা?

তারা বোঝাতে চেয়েছিলেন যে ধর্মকেও প্রাকৃতিক প্রজ্ঞার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করতে হবে। যাকে বলা যেতে পারে প্রাকৃতিক ধর্ম সেই জিনিসটির জন্যে অনেকেই সংগ্রাম করেছেন আর ওটাই আমাদের তালিকার ছনম্বর প্রসঙ্গ। অসংখ্য ঘোর বস্তুবাদী ছিলেন তখন যারা ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন না; নাস্তিক্যবাদের প্রবক্তা ছিলেন তাঁরা। কিন্তু আলোকপ্রাপ্তি যুগের দার্শনিকদের বেশিরভাগই ঈশ্বরহীন জগতের কল্পনাকে অযৌক্তিক বলে মনে করতেন। ঈশ্বরহীন জগৎ যুক্তির পক্ষে বড্ড বেশি হয়ে যায়। নিউটনের মতও ছিল তাই। আর অমরত্বে বিশ্বাস করাকেও যৌক্তিক বলেই মনে করা হতো। মানুষ অমর ভার অধিকারী কিনা সে-প্রশ্নকে বিশ্বাস-এর চাইতে প্রজ্ঞা-সংক্রান্ত বলেই মনে করা হতো বেশি, ঠিক যেমন দেকার্ত মনে করতেন।

এটা অবশ্য আমার কাছে অদ্ভুত বলে মনে হচ্ছে। আমার ধারণা, এটা একান্তই বিশ্বাস-সংক্রান্ত, মোটেই প্রজ্ঞা-সংক্রান্ত নয়।

তার কারণ তুমি অষ্টাদশ শতাব্দীর বাসিন্দা নও। আলোকপ্রাপ্তি যুগের দার্শনিকদের মতে ধর্মের যা দরকার ছিল তা হচ্ছে যীশু সহজ সরল শিক্ষার সঙ্গে যাজকীয় ইতিহাসের গতিপথে যে-সব অযৌক্তিক ধর্মগত বা মতবাদ যুক্ত হয়ে গিয়েছিল সে-সব থেকে ধর্মকে মুক্ত করা।

বুঝেছি।

ফলে অনেকেই হয়ে উঠলেন যাকে বলে ঈশ্বরবাদ-এর (Deism) প্রবক্তা।

সেটা কী?

ঈশ্বরবাদ বলতে এই বিশ্বাস বোঝায় যে ঈশ্বর বহু যুগ আগে এই জগৎ সৃষ্টি করেছেন বটে কিন্তু কখনোই নিজের প্রকাশ ঘটাননি সেটার কাছে। এভাবে ঈশ্বর সংকুচিত হয়ে পড়েছেন এক পরম সত্তা-য় (Supreme Being), যে-সত্তা প্রকৃতি আর প্রাকৃতিক নিয়মের মধ্যে দিয়েই নিজের প্রকাশ ঘটায় মানুষের কাছে। কোনো অতিপ্রাকৃত পদ্ধতিতে নয়। একই রকম এক দার্শনিক ঈশ্বর-কে পাই আমরা অ্যারিস্টটলের লেখায়। তাঁর কাছে ঈশ্বর ছিলেন আকারগত কারণ (formal cause) বা আদি চালক (first mover)।

তাহলে বাকি থাকছে আর মাত্র একটা প্রসঙ্গ, মানবাধিকার।

তারপরেও, সম্ভবত এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। মোটের ওপর তুমি এ-কথা বলতে পারো যে ফরাসী আলোকপ্রাপ্তি ইংরেজ দর্শনের চেয়ে বেশি বাস্তবপন্থী।

তার মানে আপনি বলতে চান তাঁরা তাঁদের দর্শন অনুযায়ী জীবনযাপন করতেন?

 হ্যাঁ, অনেকটা তাই। ফরাসী আলোকপ্রাপ্তি যুগের দার্শনিকেরা সমাজে মানুষের অবস্থানের স্রেফ তাত্ত্বিক দিকটি নিয়েই অতৃপ্ত থাকেননি। সক্রিয়ভাবে সংগ্রাম করেছেন তাঁরা, তাদের ভাষায়, নাগরিকদের প্রাকৃতিক অধিকার প্রতিষ্ঠায়। গোড়ার দিকে এটা রূপ নিয়েছিল সেন্সরশিপের বিরুদ্ধে– সংবাদমাধ্যমের পক্ষে– একটা আন্দোলনের। কিন্তু ধর্ম, নৈতিকতা আর রাজনীতির ক্ষেত্রেও ব্যক্তির চিন্তা এবং বাক-স্বাধীনতা রক্ষা করা জরুরি ছিল। তারা দাসত্ব বিলোপ আর অপরাধীদের প্রতি আরো মানবিক আচরণের জন্যেও সগ্রাম করেছিলেন।

আমি বোধকরি এসবের বেশির ভাগের সঙ্গেই একমত।

১৭৮৯ সালে ফরাসী জাতীয় সংসদে গৃহীত মানুষ এবং নাগরিকবৃন্দের অধিকারের ঘোষণা-য় ব্যক্তির অলঙ্ঘনীয়তার (inviolability of the individual) নীতিটি চূড়ান্ত রূপ পায়। এই মানবাধিকারের ঘোষণা-ই আমাদের নরওয়েজিয় সংবিধান ১৮১৪-র মূল ভিত্তি।

কিন্তু এখনো তো অনেক মানুষকে তাদের অধিকার আদায়ের জন্যে যুদ্ধ করতে হচ্ছে।

হ্যাঁ, দুঃখের সঙ্গে। কিন্তু আলোকপ্রাপ্তি যুগের দার্শনিকেরা এমন কিছু অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন প্রত্যেকেই যার অধিকারী হবে স্রেফ জন্মসূত্রেই। প্রাকৃতিক অধিকার বলতে সে-কথাই বুঝিয়েছিলেন তারা।

এখনো আমরা এমন কিছু প্রাকৃতিক অধিকারের কথা বলি যার সঙ্গে প্রায়ই কোনো না কোনো ভূখন্দ্রে আইন-এর দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। আর আমরা প্রায়ই দেখে থাকি যে ব্যক্তি বা এমনকী গোটা জাতিই নৈরাজ্য, পরাধীনতা আর উৎপীড়নের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার সময় তাদের প্রাকৃতিক অধিকার দাবি করছে।

আর নারী অধিকারের কী খবর?

১৭৮৭-র ফরাসী বিপ্লব সব নাগরিক-এর জন্যে বেশ কিছু অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিল। কিন্তু নাগরিক বলতে প্রায় সব সময়ই পুরুষকে বোঝাতো। তারপরেও ফরাসী বিপ্লবই আমাদেরকে নারীবাদের (feminism) প্রথম আভাস দিয়েছিল।

 সে-সময় প্রায় হয়ে এসেছিল!

১৭৮৭-র দিকেই আলোকপ্রাপ্তি যুগের দার্শনিক কন্ডসেট (Condorcet) নারী অধিকার সম্পর্কে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। সেই ভদ্রলোক মত প্রকাশ করেন যে নারীরও পুরুষের সমান প্রাকৃতিক অধিকার রয়েছে। ১৭৮৯-এর বিপ্লবের সময় পুরনো সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যুদ্ধে নারীরা অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, যে বিক্ষোভ মিছিলের কারণে রাজা তার ভার্সাই-এর প্রাসাদ ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন তাতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, নারীরাই। প্যারিসে গঠন করা হয়েছিল নারীদের দল বা সংগঠন। পুরুষের সমান রাজনৈতিক অধিকারের দাবির পাশাপাশি তারা বিবাহ আইন আর নারীর সামাজিক অবস্থা পরিবর্তনেরও দাবি জানিয়েছিলেন।

সমান অধিকার কি তারা পেয়েছিলেন?

না, পরবর্তী আরো অনেক ঘটনার মতো নারীর অধিকারের বিষয়টিকেও সংগ্রামের সেই উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে কাজে লাগানো হয়েছিল, কিন্তু নতুন সরকারের আমলে সব কিছু ফের ঠিকঠাক হয়ে গেলে পুরনো সেই পুরুষ শাসিত সমাজই চালু করা হলো আবার।

 বরাবরই যা হয় আর কী।

ফরাসী বিল্পবের সময় নারী অধিকারের প্রশ্নে যারা মরিয়া হয়ে লড়াই করেছিলেন তাঁদের একজন হলেন অলিম্পে ডি গগস (Olympe de Gouges)। ১৭৯১ সালে-বিপ্লবের দুবছর পর-নারী অধিকারের ওপর একটি ঘোষণা প্রকাশ করেন সেই মহিলা। নাগরিকদের অধিকারের ঘোষণায় নারীর প্রাকৃতিক অধিকার সম্পর্কে কোনো কথা-ই ছিল না। অলিম্পে ডি গগস্ এবার পুরুষের সমান অধিকারের দাবি তুললেন নারীর জন্যে।

কী ঘটল শেষে?

১৯৯৩-এ তার গর্দান নেয়া হলো। সেই সঙ্গে নারীর জন্যে নিষিদ্ধ ঘোষিত হলো সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড।

কী লজ্জাজনক।

 শুধু ফ্রান্সেই নয়, ইউরোপের বাকি সমস্ত অংশেই ঊনবিংশ শতাব্দীর আগ পর্যন্ত নারীবাদ বিকাশ লাভ করতে পারেনি। একটু একটু করে ফল দিতে শুরু করল এই সংগ্রাম। এই নরওয়েতেও ১৯১৩-র আগে মেয়েরা ভোটের অধিকার পায়নি। আর পৃথিবীর অনেক জায়গাতেই নারীদের এখনো অনেক কিছুর জন্যে সগ্রাম করতে হবে।

তারা আমার সমর্থনের জন্যে ভরসা করতে পারে।

লেকটার দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলেন অ্যালবার্টো। এক কী দুই মিনিট পর বলে উঠলেন: আলোকপ্রাপ্তি সম্পর্কে আমি যা বলতে চেয়েছিলাম তা মোটামুটি এই-ই।

মোটামুটি বলতে কী বোঝাতে চাইছেন?

 আমার মনে হচ্ছে আর কিছু বলার নেই।

কিন্তু তিনি কথাটা বলতে বলতে লেকের মাঝখানে কিছু একটা ঘটতে শুরু করল। পানির মধ্যে কীসের যেন বুদবুদ উঠতে লাগল। তারপর বিশাল আা কুৎসিত-দর্শন একটা প্রাণী মাথা তুলল ভেতর থেকে।

সামুদ্রিক সাপ! বলে চেঁচিয়ে উঠল সোফি।

কালো দানবটা শরীর আঁকিয়ে-বাঁকিয়ে বার কয়েক সামন-পেছন কা ফের মিলিয়ে গেল জলের অতলে। আগের মতোই শান্ত হয়ে এলো লেকের পানি।

অ্যালবার্টো এরিমধ্যে ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন।

 এবার ভেতরে যাবো আমরা, বললেন তিনি।

ছোট্ট কুঁড়েটার ভেতর ঢুকল দুজন।

বার্কলে আর বিয়ার্কলের ছবি দুটোর সামনে দাঁড়িয়ে ও-দুটোর দিকে তাকিয়ে রইল সোফি। বিয়ার্কলের ছবিটা দেখিয়ে সে বলে উঠল:

আমার মনে হয় ছবিটার ভেতরেই কোথাও থাকে হিল্ডা।

ছবি দুটোর মাঝখানে একটা সূচিশিল্পের নমুনা ঝুলছে এখন। তাতে লেখা: মুক্তি, সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব।

অ্যালবার্টোর দিকে ফিরল সোফি ওটা কি আপনি ঝুলিয়েছেন?

একেবারে হতাশ একটা ভঙ্গিতে স্রেফ মাথা ঝাঁকালেন তিনি। তখনই ম্যান্টেলপিসের ওপর একটা খাম আবিষ্কার করল সোফি। তাতে লেখা: প্রতি, হিল্ডা এবং সোফি। চিঠিটা কার কাছ থেকে এসেছে সে-কথা বুঝতে একটুও দেরি হলো না সোফির, তবে মেজর যে তাকেও ইদানীং হিসেবের মধ্যে ধরছে এটা একটা নতুন ঘটনা।

চিঠিটা খুলে জোরে জোরে পড়তে শুরু করল সে:

প্রিয় দুজন, যে আদর্শ এবং নীতিকে ভিত্তি করে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত তার ওপর ফরাসী আলোকপ্রাপ্তির ভূমিকা বা গুরুত্ব কতখানি সে-কথা সোফির দর্শন শিক্ষকের বুঝিয়ে বলা উচিত ছিল। মুক্তি সাম্য এবং ভ্রাতৃত্ব, এই শ্লোগান দুশো বছর আগে ফরাসী জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হতে সাহায্য করেছিল, আজ এই একই কথায় গোটা বিশ্বের মানুষের ঐক্যবদ্ধ হওয়া উচিত। মানুষের এক বিশাল পরিবার সৃষ্টি হওয়াটা আজ যতটা জরুরি এমনটা আর কখনোই ছিল না। আমাদের উত্তরসূরীরা আমাদেরই সন্তান সন্ততি। আমাদের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে কেমন বিশ্ব পাচ্ছে তারা? নিচতলা থেকে হিল্ডার মা চেঁচিয়ে বলছিলেন মিস্ট্রিটা দশ মিনিটের মধ্যেই শুরু হচ্ছে আর তিনি পিৎসাটা আ-এ দিয়েছেন। এতোক্ষণে এতো কিছু পড়ে রীতিমত ক্লান্ত হয়ে পড়েছে হিল্ডা। সেই সকাল ছটায় উঠেছে সে।

সে ঠিক করল সন্ধ্যার বাকি সময়টা সে তার মায়ের সঙ্গে নিজের জন্মদিন উদযাপন করে কাটাবে। কিন্তু তার আগে বিশ্বকোষে একটা জিনিস খুঁজে বের করতে হবে তাকে। Gouges…উঁহু, নেই। De Gouges? এবারো নেই। Olympe de Gotges? তা-ও কিছু নেই। যে-নারীর গর্দান গিয়েছে তাঁর রাজনৈতিক দায়বদ্ধতার কারণে, তাঁর সম্পর্কে এই বিশ্বকোষে এক অক্ষরও লেখা নেই। এটা কি ন্যাক্কারজনক নয়?

উনি নিশ্চয়ই এমন কেউ ছিলেন না, যাকে হিল্ডার বাবা মন থেকে গড়েছেন? নিচতলায় ছুটে এলো হিল্ডা আরো বড়ো একটা বিশ্বকোষের জন্য।

তার বিস্মিত মা-কে সে বলল, একটা জিনিস শুধু খুঁজে বের করতে হবে আমাকে।

বড়, পারিবারিক বিশ্বকোষটার এফআরভি থেকে জিপি ভল্যুমটা নিয়ে ফের নিজের ঘরে চলে এলো সে এক দৌড়ে।

Gouges… এই তো আছে।

[Gouges, Marie Olympe (১৭৪৮-১৭৯৩), ফরাসী লেখক। সামাজিক প্রসঙ্গে অসংখ্য ব্রোশিওর এবং নাটক লিখে ফরাসী বিপ্লবের সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। গুটি কতেক যে-কজন মানবাধিকারকে নারীর জন্যেও প্রযোজ্য করার প্রচারণায় নেমেছিলেন তাঁদের অন্যতম। ১৭৯১-এ প্রকাশ করেন তার নারী অধিকার বিষয়ক ঘোষণা। ষোড়শ লুই-কে সমর্থন এবং রোবসৃপীয়র-এর বিরোধিতা করার স্পর্ধার কারণে ১৭৯৩-এ তার গর্দান নেয়া হয় (লিট: এল. লেকার, লেস অরিজিনেস দু ফেমিনিজমে কন্টেম্পোরেইন, ১৯০০)]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *