২৯. মার্ক্স

২৯. মার্ক্স

… ইউরোপকে একটা ভূত তাড়া করে ফিরছে..

বিছানা থেকে নেমে উপসাগরটার দিকে মুখ করা জানলাটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল হিল্ডা। এই শনিবার যখন সে পড়তে শুরু করেছিল তখনও সোফির পঞ্চদশ জন্মদিন ছিল। তার আগের দিন ছিল হিল্ডার নিজের জন্মদিন।

তার বাবা যদি ভেবে থাকেন যে গতকালই সে সোফির জন্মদিন পর্যন্ত পৌঁছে যাবে তাহলে তিনি নিশ্চয়ই বাস্তববোধের পরিচয় দেননি। সারাদিন সে পড়া ছাড়া আর কিছু করেনি। তবে তিনি এই কথাটা ঠিকই বলেছেন যে আর মাত্র একবার জন্মদিনের শুভেচ্ছা পাওয়া যাবে। এই সময়টাতেই অ্যালবার্টো আর সোফি তার উদ্দেশে শুভ জন্মদিনের গান গেয়ে উঠেছিল। খুবই অস্বস্তিকর ব্যাপার, ভাবল হিল্ডা।

আর এখন সোফি ঠিক সেই দিনই একটা দার্শনিক গার্ডেন পার্টি হবে বলে লোকজনকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে যেদিন তার বাবার ফেরার কথা লেবানন থেকে। হিল্ডা ঠিক বুঝতে পারছে সেদিন এমন একটা কিছু ঘটবে যে-ব্যাপারে সে বা তার বাবা কেউই ঠিক নিশ্চিত নয়।

তবে একটা ব্যাপার ঠিক: বিয়ার্কলে-তে পৌঁছানোর আগেই একটা চমক অপেক্ষা করবে তার বাবার জন্যে। সোফি আর অ্যালবার্টোর জন্যে এটুকু অন্তত সে করতে পারবে, বিশেষ করে তাদের সেই সাহায্যের আবেদনের পর…

তার মা তখনো নিচে, বোটহাউসে। হিল্ডা দৌড়ে নিচের তলায় নেমে এলো টেলিফোনটার কাছে। অ্যানি আর ওলে-র কোপেনহেগেন-এর নাম্বারটা পেয়ে সে ফোন করল।

অ্যানি ভ্যামসডাল।

হাই, আমি হিল্ডা বলছি।

তাই, কেমন আছো? কেমন চলছে তোমাদের লিললস্যান্ড-এ?

ফাইন, ভ্যাকেশন আর সব কিছু মিলিয়ে। তাছাড়া বাবা এক হপ্তার মধ্যেই লেবানন থেকে ফিরছে।

দারুণ হবে, তাই না হিল্ডা?

হ্যাঁ, আমার তো তরই সইছে না। আর ঠিক সেই জন্যেই আমি ফোনটা করলাম।

তাই?

আমার ধারণা ২৩ তারিখ শনিবার বিকেল ৫টার দিকে কাট্রাপে ল্যান্ড করছে বাবা। তুমি কি তখন কোপেনহেগেন-এ থাকবে?

আই থিংক সো।

আমি ভাবছিলাম তুমি একটা উপকার করতে পারবে কিনা আমার।

কেন নয়, আলবাৎ পারবো।

এটা একটা বিশেষ ধরনের উপকার। আমি এমনকী ঠিক শিওর-ও না ব্যাপারটা সম্ভব কিনা।

তুমি তো এবার আমার কৌতূহল বাড়িয়ে দিলে…

হিল্ডা তার প্ল্যানটা বর্ণনা করতে শুরু করল। অ্যানিকে সে রিং বাইন্ডার, সোফি আর অ্যালবার্টো এবং বাকি সব কথা খুলে বলল। মাঝে মাঝেই পেছন থেকে শুরু করতে হচ্ছিল হিল্ডাকে, তার কারণ সে আর অ্যানি দুজনেই হাসছিল বেদম। কিন্তু হিল্ডা ফোন রেখে দেয়ার পর থেকেই তার পরিকল্পনামাফিক কাজ এগুতে লাগল।

 এবার তার নিজস্ব কিছু প্রস্তুতি সারতে হবে। তবে হাতে এখনো যথেষ্ট সময় আছে।

বিকেলের বাকি সময়টা আর সন্ধ্যাটা সে তার মায়ের সঙ্গেই কাটাল। শেষ পর্যন্ত ওরা গাড়ি করে ক্রিস্টিয়ানস্যান্ডে গিয়ে মুভি দেখে এলো। ওদের মনে হলো আগের দিন যেহেতু বিশেষ কিছু তারা করেনি আজ সেটা পুষিয়ে নিতে হবে। কিয়েভিক এয়ারপোর্টের এক্সিট-এর পাশ দিয়ে যখন গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিল ওরা তখন হিল্ডা যে-জিগজঅ পাজল তৈরি করছিল তার আরো কয়েকটা টুকরো খাপে খাপে বসে গেল।

বিছানায় যেতে সে-রাতে বেশ দেরি হলো তার। কিন্তু তারপরেও রিং বাইন্ডারটা নিয়ে পড়তে শুরু করল সে।

.

সোফি যখন বেড়ার ভেতর দিয়ে গুহা থেকে বেরিয়ে এলো তখন প্রায় আটটা বাজে। সোফি যখন উদয় হলো তার মা তখন সদর দরজার পাশের ফ্লাওয়ার বেডগুলোর আগাছা বাছছেন।

কোত্থেকে উদয় হলি তুই?

বেড়ার ভেতর থেকে।

বেড়ার ভেতর থেকে?

তুমি জানতে না অন্য দিকটায় একটা পথ আছে?

কিন্তু তুই কোথায় ছিলি, সোফি? এই নিয়ে দুবার হলো তুই কোনো কিছু না জানিয়ে হাওয়া হয়ে গেছিস।

আই অ্যাম সরি, মাম, দিনটা এতো সুন্দর, আমি একটু হাঁটতে গিয়েছিলাম।

তার মা আগাছার স্তূপ থেকে উঠে কঠোর একটা দৃষ্টি হানলেন সোফির দিকে।

 সেই দার্শনিক লোকটার সঙ্গে ছিলি না তো আবার?

সত্যি বলতে কী, তাই ছিলাম। তোমাকে তো বলেইছি, ভদ্রলোক অনেক দূরে হাঁটতে যেতে পছন্দ করেন।

কিন্তু গার্ডেন পার্টিতে তো আসছে সে তাই না?

হ্যাঁ, তা তো বটেই। উনি তো আশা করছেন আসবেন।

 আমিও। আমি সেই দিনই গুনছি।

সোফির মায়ের গলায় কি একটু ঝঝের আভাস পাওয়া গেল? ব্যাপারটা সামাল দেয়ার জন্যে সোফি বলল:

ভাগ্যিস জোয়ানার মা-বাবাকে দাওয়াত দিয়েছিলাম। নইলে ব্যাপারটা খুব এমব্যারাসিং হতো।

তা আমি জানি না…কিন্তু যা-ই হোক না কেন অ্যালবার্টোর সঙ্গে আমি কথা বলব, বড়রা যেভাবে বড়দের সঙ্গে কথা বলে সেভাবে।

ইচ্ছে হলে আমার ঘরটা ব্যবহার করতে পারো তুমি। তবে আমি ঠিক জানি তুমি ওঁকে পছন্দ করবে।

ও, আরেকটা কথা। একটা চিঠি আছে তোর।

তাই?

জাতিসংঘ বাহিনীর স্ট্যাম্প লাগানো।

তাহলে ওটা নিশ্চয়ই অ্যালবার্টোর ভাই লিখেছে।

ব্যাপারটা আর চলতে দেয়া যায় না সোফি।

সোফির মাথা বাড়তি খাটুনি খেটেছে। কিন্তু তারপরেও, বিশ্বাসযোগ্য একটা উত্তর খেলে গেল তার মাথায় একেবারে বিদ্যুচ্চমকের মতো। ব্যাপারটা যেন কোনো সাহায্যকারী স্পিরিট-এর কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পাচ্ছিল সে।

অ্যালবার্টোকে বলেছিলাম আমি রেয়ার পোষ্টমার্ক কালেক্ট করি।

মনে হলো সোফির মা আশ্বস্ত হলেন।

ফ্রিজে ডিনার রাখা আছে, আগের চেয়ে আন্তরিক সুরে বললেন তিনি।

চিঠিটা কোথায়?

ফ্রিজের ওপর।

দৌড়ে ভেতরে গেল সোফি। খামটাতে তারিখ দেয়া আছে ১৫ই জুন ১৯৯০। খামটা খুলে ভেতর থেকে একটা চিরকুট বের করল সে:

হোয়াট ম্যাটারস্ আওয়ার ক্রিয়েটিভ এন্ডলেস টয়েল,
হোয়েন অ্যাট আ ম্যাচ, অবলিভিয়ন এন্ড দ্য কয়েল?

এ-প্রশ্নের উত্তর সোফির আসলেই জানা নেই। খাওয়ার আগে চিরকুটটা সে ক্লজেটে রেখে দিল, গত কয়েক হপ্তায় যে-সব জিনিস সে সগ্রহ করেছে সেগুলোর। সঙ্গে। শিগগিরই সে জানতে পারবে প্রশ্নটা কেন করা হয়েছে।

.

পরদিন সকালে জোয়ানা এসে হাজির। এক গেম ব্যাডমিন্টন খেলার পর দার্শনিক গার্ডেন পার্টি নিয়ে শলা-পরামর্শ করতে বসল ওরা। পার্টিটা যদি হঠাৎ কোথাও এসে ঝুলে যায় সেজন্য হাতে কিছু চমক লাগানো ব্যাপার-স্যাপার রাখতে হবে।

সোফির মা যখন কাজ থেকে বাড়ি ফিরে এলেন তখনো তারা এ-নিয়ে কথা বলে যাচ্ছে। সোফির মা বারবার করে বললেন: টাকা-পয়সা নিয়ে চিন্তা কোরো। না। অথচ তার গলায় শ্লেষের লেশমাত্র নেই!

হয়ত তার মনে হয়েছে বেশ কয়েক সপ্তাহের নিবিড় দর্শনচর্চার পর সোফিকে বাস্তবতায় ফিরিয়ে আনতে ঠিক দার্শনিক গার্ডেন পার্টি-র মতোই একটা কিছু দরকার।

সন্ধ্যে পেরিয়ে যাওয়ার আগেই প্রত্যেকটা ব্যাপারে মতৈক্য পৌঁছাল ওরা। কাগজের লণ্ঠন থেকে শুরু করে একটা উপহারসহ দার্শনিক কুইজ পর্যন্ত। উপহারটা অবশ্য তরুণদের জন্যে লেখা দর্শনের কোনো বই হলেই ভালো হয়। অবশ্য সে রকম কিছু যদি থেকে থাকে। সোফি ঠিক নিশ্চিত নয়।

মিডসামার ঈভ-এর দুদিন আগে ২১শে জুন বৃহস্পতিবার অ্যালবার্টো আবার ফোন করলেন সোফিকে।

সোফি।

অ্যালবার্টো।

ও, হাই! কেমন আছেন?

সত্যিই খুব ভালো। ধন্যবাদ। আমার মনে হয় আমি একটা দুর্দান্ত পথ বের করতে পেরেছি।

কীসের পথ?

 তুমি তো জানোই কীসের। দীর্ঘদিন আমরা যে মানসিক বন্দিত্বের ভেতর বাস করে আসছি তা থেকে বেরোবার পথ।

ও, সেটার কথা বলছেন?

কিন্তু কাজ শুরু করার আগে একটা কথাও বলতে পারছি না আমি সে ব্যাপারে।

ততক্ষণে বড্ড দেরি হয়ে যাবে না? কোন ব্যাপারে জড়িয়ে আছি সেটা আমার জানা দরকার।

এবার কিন্তু ছেলেমানুষী করছ তুমি? আমাদের সব কথা আড়িপেতে শোেনা হচ্ছে। কোনো কিছু না বলাটাই হবে সবচেয়ে উচিত কাজ।

ব্যাপারটা কি এতোই বাজে অবস্থায় গিয়ে ঠেকেছে?

ন্যাচারালি, মাই চাইল্ড। আমরা যখন কথা বলছি না তখনই ঘটতে হবে সবচেয়ে জরুরি ঘটনাটা।

ও।

লম্বা একটা কাহিনীর শব্দগুলোর নেপথ্যে অবস্থিত একটা কাল্পনিক বাস্তবতায় আমাদের জীবনযাপন করছি আমরা। মেজর একটা পুরনো পোর্টেবল টাইপ রাইটারে লিখে যাচ্ছে প্রতিটা শব্দ। কাজেই ছাপা কোনো কিছুই তার নজর এড়াতে পারবে না।

না, সেটা আমি বুঝি। কিন্তু তার কাছ থেকে আমরা কীভাবে পালাবো?

শ শ শ।

কী?

লাইনগুলোর মাঝখানেও কিছু একটা ঘটে চলেছে। ঠিক ওই জায়গাটাতেই কৌশল খাটাতে চাইছি আমি আমার তূণে যত জারিজুরি আছে তার সব ব্যবহার করে।

বুঝতে পারছি।

 কিন্তু আমাদেরকে অবশ্যই আজ আর কালকের সময়টার পুরোপুরি সদ্ব্যবহার করতে হবে, শনিবারে ব্যাপারটা শুরু হবে। তুমি কি এক্ষুণি একবার আসতে পারো?

আমি রওনা হয়ে গেছি।

.

পাখি আর মাছগুলোকে খাওয়াল সোফি, গোবিন্দর জন্যে বের করে রাখল বড়সড় একটা লেটুস পাতা। শিয়াকানের জন্যে বেড়ালের খাবারের একটা কৌটো খুলে কিছু খাবার বের করে একটার গামলায় ঢেলে সেটা সিঁড়ির ওপরে রেখে বেরিয়ে পড়ল সে।

বেড়ার ভেতর দিয়ে গলে বেরিয়ে এলো সে দূরের দিকের পথটায়। খানিকটা পথ যেতেই হঠাৎ তার নজরে পড়ল লতা-গুল্মের ভেতর বড়সড় একটা ডেস্ক দাঁড়িয়ে আছে। বয়স্ক একজন লোক বসে আছে সেই ডেস্কের পাশে, দেখে মনে হলো কিছু একটা হিসাব করছে। তার কাছে গিয়ে সোফি তার নাম জিগ্যেস করল।

এবেনেজার স্ক্রুজ, বলল সে, তারপর আবার ব্যস্ত হয়ে পড়ল তার জমা-খরচের খাতা নিয়ে।

আমার নাম সোফি। মনে হচ্ছে, আপনি একজন ব্যবসায়ী।

 মাথা ঝাঁকাল লোকটা। আর ধনীও খুব। একটা পেনিও অপচয় হতে পারবে না। সেজন্যেই আমার হিসাবের দিকে মন দিতে হবে আমায়।

বেশ তো।

সোফি হাত নেড়ে বিদায় জানিয়ে এগিয়ে চলল। কিন্তু অল্প কয়েক গজ যেতে না যেতেই সে দেখতে পেল ছোট্ট একটি মেয়ে লম্বা গাছগুলোর নিচে একেবারে একা বসে আছে। তার পরনের জামা-কাপড় টুটোফাটা, চেহারা মলিন, রোগা রোগা। সোফি তার পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় মেয়েটা ছোট্ট একটা ব্যাগ-এর ভেতর হাত ঢুকিয়ে দিয়ে দেশলাইয়ের একটা বাক্স বের করল।

সেটা সে সোফির দিকে বাড়িয়ে ধরে জিগ্যেস করল, তুমি কয়েকটা দেশলাই কিনবে? সোফি নিজের পকেট হাতড়ে দেখল তার কাছে কোনো টাকা পয়সা আছে কিনা। আছে, একটা ক্রাউন পেল সে।

কত দাম তোমার দেশলাইয়ের?

এক ক্রাউন।

মেয়েটাকে পয়সাটা দিয়ে দেশলাইয়ের বাক্সটা নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল সোফি।

একশ বছরে তুমিই প্রথম যে কোনো কিছু কিনল আমার কাছ থেকে। মাঝে মাঝে না খেয়ে মরেই যাই আমি। অন্য সময় বরফ আমাকে শেষ করে দেয়।

সোফির মনে হলো, এই বনের মধ্যে দেশলাই সে-রকম বিক্রি না হওয়াটা সম্ভবত খুব একটা আশ্চর্যের নয়। কিন্তু এরপরই তার মনে পড়ে গেল একটু আগে পিছে ফেলে আসা ব্যবসায়ী লোকটার কথা। লোকটার এতো টাকা-কড়ি থাকার পরেও ছোট্ট এই দেশলাই বালিকার অনাহারে মরার কোনো মানে হয় না।

এদিকে এসো, বলল সোফি।

 মেয়েটার হাত ধরে তাকে নিয়ে হেঁটে ফিরে গেল সে ধনী লোকটার কাছে।

এই মেয়েটা যাতে আরো ভালো একটা জীবনযাপন করতে পারে সেটা কিন্তু আপনাকে দেখতেই হবে, সোফি বলল লোকটাকে।

লোকটি তার কাগজ-পত্র থেকে মুখ তুলে তাকিয়ে বলল, এ-সমস্ত ব্যাপারে টাকা লাগে আর আমি তো বলেইছি যে একটা পয়সাও বাজে খরচ করা চলবে না।

কিন্তু আপনি এতো ধনী অথচ মেয়েটা এতো গরীব, এটা তো হতে পারে না, সোফি জেদী সুরে বলল। এটা অন্যায়!

ফুঃ! ফেরেব্বাজি! সমান সমান না হলে আবার ন্যায়ের কথা আসে কী করে?

কী বলতে চান?

ওপরে উঠতে খাটতে হয়েছে আমাকে আর সেটাই কাজে দিয়েছে। লোকে একেই বলে উন্নতি।

আপনি যদি আমাকে সাহায্য না করেন তাহলে আমি মরে যাবো, গরীব মেয়েটি বলল।

ব্যবসায়ী লোকটি তার জমা-খরচের খাতা থেকে মুখ তুলে তাকালো আবার। তারপর সে তার পালকের কলমটা অধৈর্যভরে ছুঁড়ে ফেলল টেবিলটার ওপর।

আমার হিসাব-নিকাশের ভেতর তোমার নাম নেই। কাজেই মানে মানে কেটে পড়, গরীবশালায় যাও।

আপনি আমাকে সাহায্য না করলে বনে আগুন ধরিয়ে দেবো আমি, মেয়েটা নাছোড়বান্দা।

এই কথা শুনে তড়াক করে লাফিয়ে উঠল লোকটা, কিন্তু ততক্ষণে দেশলাইয়ের একটা কাঠি ধরিয়ে ফেলেছে মেয়েটা। কাঠিটা এক গোছা শুকনো ঘাসের কাছে ধরতেই আগুন ধরে উঠল সেটায়।

 লোকটা দুই হাত ছুঁড়ে চিৎকার করে বলে উঠল, ঈশ্বর রক্ষা করুন! লাল মোরগ ডাক দিয়েছে।

কৌতুকপূর্ণ একটা হাসি হেসে লোকটার দিকে তাকিয়ে মেয়েটা বলল, আমি যে কম্যুনিস্ট সেটা আপনি জানতেন না, তাই না?

এর পরের মুহূর্তেই সেই মেয়েটা, ব্যবসায়ী লোকটা আর ডেস্কটা উধাও হয়ে গেল। আগুনের শিখা সেই শুকনো ঘাস-এর গোছাটাকে আরো উদগ্রভাবে গ্রাস করে নিতে থাকল আর সোফি ফের একা দাঁড়িয়ে রইল। আগুনটা পা-চাপা দিয়ে নেভাতে খানিকটা সময় লাগল তার।

যাক বাবা! পোড়া ঘাসটুকুর দিকে তাকাল সোফি। তার হাতে দেশলাইয়ের একটা বাক্স।

তার নিজের পক্ষে আগুনটা ধরানো সম্ভব হতো না, হতো কি?

.

অ্যালবার্টোর সঙ্গে কেবিনের বাইরে দেখা হতে সোফি তাঁকে বলল যা যা ঘটেছে।

ক্রুজ হচ্ছে চার্লস ডিকেন্সের লেখা এ ক্রিসমাস ক্যারল-এর সেই কৃপণ পুঁজিবাদী। আর, হ্যাঁন্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসেনের গল্পের সেই দেশলাই বিক্রি করা মেয়েটার কথা নিশ্চয়ই মনে আছে তোমার।

এই বনের ভেতর ওদের দেখা পাবো সেটা ভাবিনি।

না পাওয়ার কী আছে? এটা তো আর সাধারণ কোনো বন নয়। আর তাছাড়া, এখন আমরা আলোচনা করতে যাচ্ছি কার্ল মার্ক্স-এর (Karl Marx) কথা। এটা খুবই কাজের কাজ হয়েছে যে তুমি উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ের তীব্র শ্রেণী সংগ্রামের একটা উদাহরণ দেখতে পেয়েছে। তবে এখন চলল, ভেতরে যাই। মেজরের হস্তক্ষেপ থেকে আরো খানিকটা বেশি সুরক্ষা পাওয়া যাবে ওখানে।

লেকটার দিকে মুখ করা জানলাটার পাশে ছোট টেবিলটা ঘিরে আবারো বসলেন দুজনে। নীল বোতলটা থেকে খানিকটা জুস খাওয়ার পর ছোট্ট লেকটা সম্পর্কে তার কী অভিজ্ঞতা হয়েছিল সোফি সেটা এখনো তার সারা শরীর জুড়ে অনুভব করতে পারল।

দুটো বোতলই ম্যান্টেলপীসের ওপর দাঁড়িয়ে আছে, আজ। টেবিলের ওপর রয়েছে গ্রীক একটা মন্দিরের একটা মিনিয়েচার মডেল।

ওটা কী? জিগ্যেস করল সোফি।

সবই বলব সময়মতো, মাই ডিয়ার।

অ্যালবার্টো বলতে শুরু করলেন: ১৮৪১ সালে কিয়ের্কেগার্ড যখন বার্লিন গিয়েছিলেন তখন হয়ত তিনি শেলিং-এর বক্তৃতা শোনার জন্যে কার্ল মার্ক্সের পাশেই বসেছিলেন। কিয়ের্কেগার্ড তার এমএ থিসিস লিখেছিলেন সক্রেটিসের ওপর। সেই একই সময় মা তার ডক্টরাল থিসিস লেখেন ডেমোক্রিটাস আর এপিকিউরাসের ওপর, অন্য কথায় বলতে গেলে, প্রাচীন কালের বস্তুবাদ-এর ওপর। তো, এভাবেই তারা তাদের যার যার দর্শনের গতিপথ নির্ধারণ করে নিয়েছিলেন।

কারণ কিয়ের্কেগার্ড হয়েছিলেন একজন অস্তিত্ববাদী, অন্যদিকে মার্ক্স হয়েছিলেন বস্তুবাদী।

মার্ক্স আসলে হয়েছিলেন যাকে বলা হয় একজন ঐতিহাসিক বস্তুবাদী। তবে সে প্রসঙ্গে পরে আসা যাবে খন।

বলে যান।

কিয়ের্কেগার্ড এবং মার্ক্স দুজনেই নিজের মতো করে হেগেলের দর্শন থেকেই যাত্রা শুরু করেছেন। হেগেলের চিন্তার ধরন দুজনকেই প্রভাবিত করলেও দুজনেই কিন্তু তার বিশ্ব চিদাত্মা বা তাঁর ভাববাদকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।

ব্যাপারটা নিশ্চয়ই তাদের কাছে খুবই আড়ম্বরভা কিছু একটা বলে মনে হয়েছিল।

তা নিশ্চয়ই। সাধারণভাবে আমরা সচরাচর বলি যে হেগেল-এর সঙ্গে সঙ্গেই মহৎ দার্শনিক পদ্ধতির যুগের অবসান ঘটেছিল। হেগেলের পর দর্শন একটা নতুন। দিকে মোড় নেয়। মহৎ চিন্তাশীল পদ্ধতির বদলে আমরা পেলাম, যাকে বলা হয়, অস্তিত্ববাদী দর্শন বা একটা কর্ম দর্শন। মার্ক্স যখন মন্তব্য করেছিলেন যে এতো দিন পর্যন্ত দার্শনিকেরা জগৎকে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যাই করেছেন শুধু; আসল কথা হচ্ছে এটাকে পরিবর্তন করা, তখন তিনি ঠিক এটাকেই বুঝিয়েছিলেন। এই কথাগুলো দর্শনের ইতিহাসে একটা গুরুত্বপূর্ণ ক্রান্তিকালের সূচনা করে।

স্ক্রুজ আর সেই দেশলাই ফেরি করা মেয়েটার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর আমার আর বুঝতে বাকি নেই মার্ক্স কী বুঝিয়েছিলেন।

মার্ক্স-এর চিন্তার একটা ব্যবহারিক বা রাজনীতিক উদ্দেশ্য ছিল। তিনি কেবল দার্শনিকই ছিলেন না; তিনি ছিলেন ইতিহাসবিদ, সমাজবিজ্ঞানী এবং অর্থনীতিবিদ।

তিনি কি এই সবগুলো ক্ষেত্রেই অগ্রদূত ছিলেন?

ব্যবহারিক রাজনীতির ক্ষেত্রে যে আর কোনো দার্শনিক এতো বেশি প্রভাব বিস্তার করতে পারেননি সেটা নিশ্চিত করে বলা যায়। অন্যদিকে আবার, নিজেকে মার্ক্সবাদী বলে দাবি করে এমন সব কিছুকেই মার্ক্স-এর নিজস্ব চিন্তা-ধারার সঙ্গে মিলিয়ে নেবার ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। মার্ক্স সম্পর্কে বলা হয় যে তিনি নিজেই মার্ক্সবাদী হয়েছিলেন ১৮৪০-এর দশকের মাঝামাঝি নাগাদ, কিন্তু তারপরেও মাঝেমধ্যে তিনি এ-কথা ঘোষণা করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতেন যে তিনি মার্ক্সবাদী নন।

যীশু কি খ্রিস্টান ছিলেন?

সেটা নিয়েও অবশ্য বিতর্ক উঠতে পারে।

বলে যান।

পরবর্তীকালে যা মার্ক্সবাদ বলে পরিচিতি লাভ করবে সেক্ষেত্রে একেবারে গোড়া থেকেই মার্ক্স-এর বন্ধু এবং সহকর্মী ফ্রিডরীখ এঙ্গেলস (Friedrich Engels) অবদান রাখতে থাকেন। আমাদের শতাব্দীতে লেনিন, স্ট্যালিন, মাও এবং আরো অনেকেই মার্ক্সবাদ বা মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদের ক্ষেত্রে যার যার অবদান রেখেছেন।

আমি বলব, আমরা বরং মার্ক্সবাদেই স্থির থাকি। আপনি বললেন না যে তিনি ঐতিহাসিক বস্তুবাদী ছিলেন?

প্রাচীনকালের পরমাণুবাদীদের মতো দার্শনিক বস্তুবাদী ছিলেন না তিনি, আবার, সপ্তদশ আর অষ্টাদশ শতকের যান্ত্রিক বস্তুবাদও তিনি প্রচার করেন নি। কিন্তু তিনি মনে করতেন, আমরা যেভাবে চিন্তা-ভাবনা করি তার অনেকখানি-ই নির্ধারণ করে সমাজের বস্তুগত উপাদানগুলো। ঐতিহাসিক বিকাশের ক্ষেত্রে এ-ধরনের বস্তুগত উপাদান নিশ্চিতভাবেই যুগান্তকারী ভূমিকা রেখেছে।

এটা তো হেগেলের বিশ্ব চিদাত্মা থেকে একেবারেই ভিন্ন একটা ব্যাপার দেখছি।

হেগেল মন্তব্য করেছিলেন যে ঐতিহাসিক বিকাশ সাধিত হয় বিপরীতের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব থেকে, যা পরিণতি পায় হঠাৎ করে আসা একটা পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে। এই ধারণাটিরই আরো বিকাশ সাধন করেন মার্ক্স। কিন্তু মার্ক্স বলছেন যে হেগেল তার মাথার ওপর দাঁড়িয়ে ছিলেন।

সব সময় নয়, আশা করি।

যে-শক্তিটা ইতিহাসকে সামনের দিতে তাড়িয়ে নিয়ে যায় তাকে হেগেল বলেছিলেন বিশ্ব চিদাত্মা বা বিশ্ব প্রজ্ঞা। মার্ক্স দাবি করেছেন ব্যাপারটা আসলে ঠিক উল্টো। তিনি দেখাতে চেয়েছেন যে বস্তুগত পরিবর্তনই ইতিহাসকে প্রভাবিত করছে। আধ্যাক সম্পর্ক বস্তুগত পরিবর্তন আনে না, বরং এর উল্টোটাই সত্যি। মার্ক্স বিশেষ করে এই ব্যাপারে গুরুত্ব আরোপ করেছেন যে সমাজের অর্থনৈতিক শক্তিগুলোই পরিবর্তন এনেছে এবং এভাবেই তা ইতিহাসকে সামনে নিয়ে গেছে।

একটা উদাহরণ দিতে পারেন?

প্রাচীন যুগের দর্শন এবং বিজ্ঞান উদ্দেশ্যগত দিক থেকে ছিল পুরোপুরি তত্ত্বগত। নিত্য নুতন আবিষ্কারকে কাজে লাগানোর ব্যাপারে কারো কোনো উৎসাহ ই ছিল না।

তাই বুঝি?

সেটার কারণ হচ্ছে সমাজের অর্থনৈতিক জীবন যেভাবে বিন্যস্ত ছিল সেটা। উৎপাদন ছিল মুখ্যত দাস শ্রম-নির্ভর, কাজেই ব্যবহারিক কোনো উদ্ভাবনের সাহায্যে উৎপাদন বাড়ানোর কোনো দরকার ছিল না নাগরিকদের। বস্তুগত সম্পর্ক কী করে সমাজের দার্শনিক চিন্তা-ভাবনাকে প্রভাবিত করতে সাহায্য করে এটা তার একটা উদাহরণ।

হ্যাঁ, বুঝতে পারছি।

এই বস্তুগত, অর্থনীতিক এবং সামাজিক সম্পর্কগুলোকেই সমাজের ভিত্তি বলে বর্ণনা করেছেন মার্ক্স। একটা সমাজ যেভাবে চিন্তা-ভাবনা করে, সেখানে কোন কোন ধরনের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে, কোন কোন আইন রয়েছে আর এটাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয় যে সেখানে ধর্ম, নৈতিকতা, শিল্প, দর্শন এবং বিজ্ঞান কী অবস্থায় রয়েছে, এই সব কিছুকে মার্ক্স বলেছেন সমাজের উপরিকাঠামো।

ভিত্তি আর উপরিকাঠামো, ঠিক আছে।

এবার তুমি লক্ষ্মী মেয়ের মতো গ্রীক মন্দিরটা আমার হাতে দাও দেখি।

সোফি তাই করল।

এটা হচ্ছে অ্যাক্রোপলিসের ওপর গড়া সেই পার্থেনন-এর মডেল। এটা তুমি অবশ্য বাস্তবেও দেখেছে।

মানে বলতে চাইছেন, ভিডিও-তে।

লক্ষ করলে দেখবে ভবনটার ছাদটা খুবই সুরুচিপূর্ণ এবং জাকাল। সম্ভবত সামনের গেইল (gable) সহ ছাদটাই সবার নজর কাড়ে প্রথম। এটাকেই আমরা বলি উপরিকাঠামো।

কিন্তু ছাদটা তো আর নিছক বাতসে ভেসে থাকতে পারে না।

সেটার ভর রক্ষা করে স্তম্ভগুলো।

দালানটা খুবই শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে আর সেই ভিত্তি গোটা ভবনটার ভর রক্ষা করছে। ঠিক একই ভাবে, মার্ক্স বিশ্বাস করতেন যে, বস্তুগত সম্পর্কগুলোও সমাজে চিন্তা-ভাবনা আর ধারণা হিসেবে যা কিছু আছে, বলতে গেলে সেগুলোর সব কিছুর ভর রক্ষা করে। একটি সমাজের উপরিকাঠামো আসলে সেই সমাজের ভিত্তিগুলোরই প্রতিফলন।

তার মানে আপনি বলছেন প্লেটোর ভাববাদ ফুলদানী আর মদ উৎপাদনের প্রতিফলন?

না, ব্যাপারটা অতো সরল নয়, মার্ক্স সেটা স্পষ্ট করে বলেও দিয়েছেন। এটা হচ্ছে সমাজের উপরিকাঠামোর সঙ্গে সেটার ভিত্তির মিথস্ক্রিয়ার প্রভাব। এই মিথস্ক্রিয়ার কথা অস্বীকার করলে মার্ক্স হতেন এক যান্ত্রিক বস্তুবাদী (mechanical materialist)। কিন্তু তিনি যেহেতু উপলব্ধি করেছিলেন যে ভিত্তি আর উপরিকাঠামোর ভেতরে একটা মিথস্ক্রিয় বা দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক রয়েছে, সে-কারণে আমরা বলি তিনি একজন দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী। আর, ভালো কথা, একটা কথা মনে রেখো যে প্লেটো কিন্তু কুমোরও ছিলেন না মদ্য উৎপাদনকারীও ছিলেন না।

 ঠিক আছে। তা, মন্দিরটা সম্পর্কে আর কিছু বলার আছে আপনার?

 হ্যাঁ, সামান্য। মন্দিরটার গোড়ার দিকটার একটু বর্ণনা দিতে পারবে?

স্তম্ভগুলো যে-ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে সেটা তিন স্তর বা ধাপ বিশিষ্ট।

ঠিক একইভাবে সমাজের ভিত্তিতেও তিনটে স্তর সনাক্ত করতে পারবো আমরা। সবচেয়ে মৌলিক বা প্রাথমিক স্তরকে আমরা বলতে পারি সমাজের উৎপাদনের শর্তাবলী। অন্য কথায় বলতে গেলে, সমাজে বিদ্যমান প্রাকৃতিক অবস্থা বা সম্পদ। যে-কোনো সমাজে এগুলোই হচ্ছে বুনিয়াদ এবং এই বুনিয়াদ-ই পরিষ্কারভাবে নির্ধারণ করে দেয় সমাজে উৎপাদনের ধরন এবং একইভাবে, সেই সমাজের প্রকৃতি আর সাধারণ অর্থে, সেটার সংস্কৃতি।

সাহারায় আপনি হেরিং মাছের ব্যবসা করতে পারবেন না বা নরওয়ে যেতে পারবেন না খেজুর ফলাতে।

ঠিকই বুঝেছো তুমি। একটা যাযাবর সংস্কৃতিতে লোকে যেভাবে চিন্তা-ভাবনা করে তা উত্তর নরওয়ের একটা জেলে পল্লীর লোকের চিন্তা-ভাবনা থেকে খুবই আলাদা। তো, এর পরের স্তরটা হচ্ছে সমাজে উৎপাদনের উপায়। শব্দ দুটোর সাহায্যে মার্ক্স বিভিন্ন ধরনের সাজ-সরঞ্জাম, হাতিয়ার আর যন্ত্রপাতি, সেই সঙ্গে কাঁচামালের কথা বুঝিয়েছেন।

আগেকার দিনে লোকে নৌকো বেয়ে মাছ ধরতে যেতো। এখন জেলেরা যায় বিশাল বিশাল সব ট্রলারে করে।

হ্যাঁ আর এখন তুমি বলছ সমাজের ভিত্তির পরের স্তরটির কথা, অর্থাৎ তাদের কথা যারা এই উৎপাদনের হাতিয়ারের মালিক। এই শ্রম বিভাজন বা কাজ এবং মালিকানার এই বণ্টনকেই মার্ক্স বলেছেন সমাজের উৎপাদন সম্পর্ক।

আচ্ছা।

আপাতত আমরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে পারি যে একটি সমাজে কোন ধরনের রাজনৈতিক এবং আদর্শগত অবস্থা বিরাজমান তা নির্ধারণ করে এই উৎপাদনের ধরন। আমরা যে সাবেক সামন্ততান্ত্রিক সমাজ থেকে খানিকটা ভিন্নভাবে চিন্তা ভাবনা করি এবং আমাদের নৈতিক মানদণ্ড (moral codex) যে খানিকটা ভিন্ন, সেটা এমনি এমনি নয়।

তার মানে মার্ক্স চিরন্তনভাবে প্রযোজ্য কোনো প্রাকৃতিক ন্যায়ে বিশ্বাস করতেন না।

না; নৈতিকভাবে কোনটি ঠিক তা মার্ক্সের মতে সমাজের ভিত্তির-ই সৃষ্ট একটা জিনিস। যেমন ধরো, আগেকার কৃষক সমাজে বাবা-মা-যে ঠিক করে দিতেন সন্তান কাকে বিয়ে করবে সেটা এমনি এমনি নয়। উত্তরাধিকারসূত্রে খামারটা কে লাভ করবে সেই প্রশ্ন জড়িত ছিল এর সঙ্গে। একটি আধুনিক সমাজে সামাজিক সম্পর্কগুলো ভিন্ন রকমের। এখন কোনো পার্টি বা ডিস্কোতে তোমার সঙ্গে তোমার ভাবি বরের দেখা হয়ে যেতে পারে আর সে-রকম গভীর প্রেমে পড়লে থাকবার একটা না একটা জায়গা তুমি ঠিকই পেয়ে যাবে।

আমি কাকে বিয়ে করব সেটা আমার মা-বাবা ঠিক করে দেবে এটা আমি কক্ষণো সহ্য করতে পারব না।

পারবে না তার কারণ তুমি তোমার সময়ের সন্তান। মার্ক্স জোর দিয়ে আরো বলেছেন যে সমাজের শাসক শ্রেণীই মূলত ঠিক করে ন্যায়-অন্যায়ের মাপকাঠিগুলো। কারণ আজ পর্যন্ত যত সমাজ দেখা গেছে সেগুলোর সব কটির ইতিহাস শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাস। অন্য কথায় বলতে গেলে উৎপাদনের হাতিয়ার কার মালিকানায় থাকবে ইতিহাস হচ্ছে মুখ্যত তাই।

মানুষের চিন্তা এবং ধারণাগুলো কি তাহলে ইতিহাসের পরিবর্তন ঘটাতে সাহায্য করে না?

হ্যাঁ এবং না। মা বুঝতে পেরেছিলেন যে সমাজের উপরিকাঠামোর অবস্থা সমাজের ভিত্তির ওপর একটা মিথস্ক্রিয় প্রভাব ফেলে, কিন্তু সমাজের উপরিকাঠামোর কোনো স্বাধীন ইতিহাস আছে বলে তিনি স্বীকার করেননি। ঐতিহাসিক বিকাশকে প্রাচীন যুগের দাস সমাজ থেকে আজকের শিল্পভিত্তিক সমাজে যা নিয়ে এসেছে তা মূলত নির্ধারিত হয়েছে সমাজের ভিত্তিস্তরে ঘটা পরিবর্তনগুলোর মাধ্যমে।

আচ্ছা।

মার্ক্স বিশ্বাস করতেন যে ইতিহাসের সমস্ত পর্বেই সমাজের দুটো প্রধান শ্রেণীর মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব বিরাজ করেছে। প্রাচীন যুগের দাস সমাজ-এ দ্বন্দ্বটা ছিল স্বাধীন নাগরিক আর দাসদের মধ্যে। মধ্য যুগের সামন্ততান্ত্রিক সমাজে সামন্তপ্রভু আর ভূমিদাসদের মধ্যে; পরে, অভিজাত শ্ৰেণী আর সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে। কিন্তু মার্ক্সের নিজের সময়ে, তিনি যাকে বলেছেন বুর্জোয়া বা পুঁজিবাদী সমাজ সেখানে দ্বন্দ্বটা ছিল প্রথমত এবং প্রধানত পুঁজিপতি আর শ্রমিক বা প্রোলেতারিয়েতদের মধ্যে। অর্থাৎ, দ্বন্দ্বটা ছিল যাদের হাতে উৎপাদনের হাতিয়ার আর যাদের হাতে তা নেই এই দুই দলের মধ্যে। আর যেহেতু উচ্চতর শ্ৰেণীগুলো স্বেচ্ছায় তাদের ক্ষমতা ছাড়ে না তাই কেবল বিপ্লবের মধ্যে দিয়েই পরিবর্তন আসতে পারে।

আর কম্যুনিস্ট সমাজের ব্যাপারটা কী?

মার্ক্স বিশেষভাবে উৎসাহী ছিলেন পুঁজিবাদী সমাজ থেকে কম্যুনিস্ট সমাজে রূপান্তরের ব্যাপারে। পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণও করেছিলেন তিনি। তবে সেদিকে নজর দেয়ার আগে আমাদেরকে অবশ্যই মানুষের শ্রম সম্পর্কে মার্ক্স-এর দৃষ্টিভঙ্গির কথা বলতে হবে।

বলে যান।

কম্যুনিস্ট হওয়ার আগে তরুণ মার্ক্স ব্যস্ত ছিলেন কাজ করার সময় মানুষের মধ্যে কী ঘটে এই বিষয়টি পর্যবেক্ষণে। হেগেলও বিষয়টি বিশ্লেষণ করেছিলেন। হেগেল বিশ্বাস করতেন মানুষ এবং প্রকৃতির মধ্যে একটা মিথস্ক্রিয় অথবা দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক রয়েছে। মানুষ যখন প্রাকৃতিকে পরিবর্তন করে তখন সে নিজেই বদলে যায়। অথবা ব্যাপারটাকে খানিকটা অন্যভাবে বললে বলা যায় যে, মানুষ যখন কাজ করে তখন প্রকৃতির সঙ্গে সে মিথস্ক্রিয়ায় অংশ নেয় এবং সেটাকে পরিবর্তন করে। কিন্তু সেই প্রক্রিয়ায় প্রকৃতিও মানুষের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ায় রত হয় এবং তার চেতনাকে পরিবর্তন করে।

তুমি কী করো আমাকে বলল, আমি বলে দেব তুমি কে।

 সংক্ষেপে, এটাই হচ্ছে মার্ক্স-এর বক্তব্য। আমরা কীভাবে কাজ করি সেটা আমাদের চেতনার ওপর প্রভাব ফেলে, কিন্তু সেই সঙ্গে, আমরা যেভাবে কাজ করি তার ওপর আমাদের চেতনাও প্রভাব ফেলে। তুমি বলতে পারো, হাত আর চেতনার ভেতর এটা একটা মিথস্ক্রিয়ামূলক সম্পর্ক। এভাবেই, তুমি কীভাবে চিন্তা করো তার সঙ্গে তুমি যে-কাজ করো সেটা খুবই ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত।

তার মানে, বেকার থাকাটা নিশ্চয়ই খুবই হতাশজনক ব্যাপার।

হ্যাঁ। একজন বেকার লোক এক অর্থে শূন্য লোক। গোড়া থেকেই এই বিষয়ে সচেতন ছিলেন হেগেল। হেগেল এবং মার্ক্স দুজনের কাছেই কাজ ছিল একটা ইতিবাচক জিনিস এবং তা মানবজাতির নির্যাসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত।

তার মানে শ্রমিক হওয়া নিশ্চয়ই ইতিবাচক একটা ব্যাপার।

হ্যাঁ, মূলত তাই। কিন্তু পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার ঠিক এই জায়গাটি লক্ষ করেই তার আক্রমণ শানিয়েছেন মার্ক্স।

সেটা কীরকম?

পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় শ্রমিক পরিশ্রম করে অন্যের জন্যে। তার শ্রম তাই তার বাইরের জিনিস বা এমন একটা কিছু যা তার নিজের নয়। শ্রমিক তার নিজের শ্রমের কাছেই অচেনা হয়ে পড়ে, কিন্তু সেই সঙ্গে সে তার নিজের কাছেও অচেনা হয়ে পড়ে। নিজের বাস্তবতার সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটে যায় তার। হেগেলিয় একটা বাঙ্গি ব্যবহার করে মার্ক্স বলেছেন, শ্রমিক হয়ে পড়ে বিচ্ছিন্ন (alienated)।

আমার এক চাচী আছেন, বিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে একটা ফ্যাক্টরিতে ক্যান্ডি প্যাকেজিং করছেন তিনি, ফলে আমি সহজেই বুঝতে পারছি আপনি কী বোঝাতে চাইছেন। প্রত্যেকদিন সকালবেলা উনি বলেন কাজে যেতে ঘেন্না করেন তিনি।

কিন্তু তিনি যদি তার কাজকে ঘৃণা করেন তাহলে এক অর্থে তিনি নিজেকেও ঘৃণা করেন।

তিনি যে ক্যান্ডি ঘেন্না করেন সেটা নিশ্চিত।

একটি পুঁজিবাদী সমাজে এমনভাবে শ্রমকে সংগঠিত করা হয় যাতে শ্রমিক আরেকটা সামাজিক শ্রেণীর দাসত্ব করে। এভাবে একজন শ্রমিক তার শ্রম আর সেই সঙ্গে তার সমগ্র জীবন বুর্জোয়াদের কাছে হস্তান্তর করে।

ব্যাপারটা কি এতোই খারাপ?

আমরা মার্ক্সের কথা আলোচনা করছি, কাজেই আমাদেরকে অবশ্যই শুরু করতে হবে গত শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ের সামাজিক অবস্থা থেকে। কাজেই তোমার প্রশ্নের উত্তরটা হবে একটা জোরাল হ্যাঁ। বরফ-ঠাণ্ডা একটা উৎপাদন কক্ষে শ্রমিকদের দৈনিক ১২ ঘণ্টাও খাটতে হতো। মজুরি এতোই কম ছিল যে শিশু এবং গর্ভবতী মায়েদেরও কাজ করতে হতো প্রায়ই। এর ফলে সৃষ্টি হলো অবর্ণনীয় সামাজিক অবস্থা। অনেক জায়গাতেই বেতনের একটা অংশ দেয়া হতো সস্তা মদ হিসেবে আর মেয়েদেরকে বাড়তি আয়ের জন্যে করতে হতো পতিতাবৃত্তি। তাদের খদ্দেররা ছিল শহরের গণ্যমান্য লোকজন। সংক্ষেপে, ঠিক যে-পরিস্থিতিটা হওয়ার কথা ছিল মানবজাতির সম্মানজনক উত্তৰ্ষসূচক চিহ্ন, অর্থাৎ কিনা কাজ, ঠিক সেখানেই শ্রমিক পরিণত হলো একটা ভারবাহী পশুতে।

আমার ভীষণ রাগ হচ্ছে।

মার্ক্স-এরও তাই হয়েছিল। আর এসব ব্যাপার যখন চলছিল তখন বুর্জোয়াদের ছেলেমেয়েরা শ্রান্তিহর গোসলের পর উষ্ণ, প্রশস্ত বসবার ঘরে বসে বেহালা বাজাতো। কিংবা চার কোর্সের ডিনারের জন্যে অপেক্ষা করতে করতে পিয়ানো বাজাতো। ঘোড়ার পিঠে দীর্ঘ সময়ের একটা ভ্রমণ থেকে ফেরার পর বেহালা আর পিয়ানোবাদন একটা অবসর বিনোদনের কাজ করতো।

ইশ! কী অন্যায়!

মার্ক্স-ও তোমার সঙ্গে একমত হতেন। এঙ্গেলস্-এর সঙ্গে যৌথভাবে ১৮৪৮ সালে প্রকাশ করেন তিনি একটি কম্যুনিস্ট ইশতেহার। সেই ইশতেহারের প্রথম বাক্য হচ্ছে ইউরোপকে একটা ভূত তাড়া করে ফিরছে-কম্যুনিজমের ভূত।

শুনে তো ভয় লাগছে।

বুর্জোয়াদেরও ভয় লেগেছিল। কারণ এবার প্রোলেতারিয়েতরাও বিদ্রোহ করতে শুরু করেছিল। ইশতেহারের শেষটা শুনতে চাও?

হ্যাঁ, বলুন না।

কম্যুনিস্টরা তাদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং লক্ষ্য গোপন রাখতে ঘৃণা বোধ করে। তারা খোলাখুলিভাবেই ঘোষণা করে যে তাদের লক্ষ্য অর্জিত হতে পারে শুধু সমস্ত প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার সবল উচ্ছেদের মাধ্যমে। কম্যুনিস্ট বিপ্লবের আতংকে শাসকশ্রেণীরা কাঁপুক। শৃঙ্খল ছাড়া হারাবার কিছু নেই প্রোলেতারিয়েতের। জয় করবার জন্যে রয়েছে গোটা জগৎ। দুনিয়ার মজদুর এক হও!

আপনি যতটা বলছেন, পরিস্থিতি ততটাই খারাপ হয়ে থাকলে আমার মনে হয় আমি সেই ইশতেহারে সই করতাম। কিন্তু আজকে নিশ্চয়ই অবস্থা অনেক ভিন্ন?

নরওয়েতে ভিন্ন ঠিকই, কিন্তু সব জায়গায় নয়। বহু মানুষ এখনো মানবেতর জীবনযাপন করছে, অথচ তারা এমন সব পণ্য উৎপাদন করে যাচ্ছে যা পুঁজিবাদীদের আরো ধনী করছে, মার্ক্স একে বলেছেন শোষণ।

শব্দটা একটু ব্যাখ্যা করবেন দয়া করে?

কোনো শ্রমিক একটা পণ্য উৎপাদন করলে সেটার নিশ্চয়ই একটা বিনিময় মূল্য থাকবে?

হ্যাঁ।

শ্রমিকের বেতন আর পণ্যটির উৎপাদন খরচ সেই বিনিময় মূল্য থেকে বাদ দিলে সব সময়ই কিছু টাকা উদ্বৃত্ত থেকে যাবে। ঠিক এটাকেই মার্ক্স বলেছেন লাভ। অন্যভাবে বলতে গেলে, পুঁজিপতি এমন একটা মূল্য বা অংক পকেটস্থ করছে যা আসলে সেই শ্রমিকের তৈরি। এটাকেই বলে শোষণ।

আচ্ছা।

তো এবার পুঁজিপতিটি তার খানিকটা লাভ নতুন পুঁজিতে খাটায়, এই যেমন ধরো তার প্রোডাকশন প্ল্যানটার আধুনিকায়নে, এই আশাতে যে আরো সস্তায় সে তার পণ্য উৎপাদন করতে পারবে আর তাতে করে ভবিষ্যতে তার লাভ আরো বেড়ে যাবে।

এটাতো যৌক্তিকই শোনাচ্ছে।

 তা ঠিক, কথাটা যৌক্তিক শোনাতে পারে। কিন্তু এক্ষেত্রে এবং অন্যান্য ক্ষেত্রের কোনো দিকেই ব্যাপারটা কিন্তু শেষ পর্যন্ত পুঁজিপতিটি যেমনটি ভেবেছিল ঠিক তেমনটি ঘটবে না।

ঠিক কী বলতে চাইছেন?

মার্ক্স মনে করতেন, পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার ভেতর বেশ কিছু সহজাত স্ববিরোধ রয়েছে। পুঁজিবাদ এমন একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যা সুবিধ্বংসী, কারণ এতে বিচারবুদ্ধি সংক্রান্ত নিয়ন্ত্রণের অভাব রয়েছে।

সেটাতে নির্যাতিতদের জন্য ভালো, তাই না?

হ্যাঁ। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা অন্তর্নিহিতভাবেই তার নিজের ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সেই অর্থে পুঁজিবাদ প্রগতিশীল তার কারণ এটা কম্যুনিজমের পথে একটা ধাপ।

পুঁজিবাদ যে সুবিধ্বংসী সে-ব্যাপারে একটা উদাহরণ দিতে পারেন?

আমরা বলেছি পুঁজিপতির প্রচুর উদ্বৃত্ত অর্থ রয়েছে এবং সে সেটার খানিকটা তার কারখানার আধুনিকায়নে ব্যয় করে। কিন্তু সেই সঙ্গে সে বেহালাবাদন শেখার জন্যেও অর্থ ব্যয় করে। তাছাড়া তার স্ত্রী একটা বিলাসী জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে।

কোনো সন্দেহ নেই।

আর নতুন যন্ত্রপাতি কেনার ফলে তার কারখানায় আর আগের মতো এতো শ্রমিকের দরকার নেই। এবং কাজটা তাকে করতে হয়েছে নিজের প্রতিযোগিতামূলক ক্ষমতা বাড়াবার জন্যে।

বুঝতে পেরেছি।

কিন্তু সে-ই যে শুধু এ-রকম চিন্তা করছে তা নয় আর তার মানে হচ্ছে মোটের ওপর উৎপাদন ক্রমেই আরো বেশি কার্যকর হচ্ছে। কারখানা বড় থেকে আরো বড় হচ্ছে। আর ধীরে ধীরে সেগুলো মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। তো, এর পর কী ঘটবে, সোফি?

ইয়ে, মানে…

আগের চেয়ে কম শ্রমিক দরকার হবে, তার মানে বেকার লোকের সংখ্যা বেড়ে যাবে। তার মানে সামাজিক সমস্যা বাড়বে। আর এ-ধরনের পুঁজিবাদ যে ক্রমেই তার নিজের ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এ-রকম সমস্যাগুলো তারই একটা সংকেত। তবে পুঁজিবাদের আরো অনেক বিশ্বাসী উপাদান রয়েছে। যখনই উৎপাদনের উপায়ে বিনিয়োগ করার জন্যে লাভের টাকাটা আটকে পড়ে অথচ প্রতিযোগিতামূলক দামে উৎপাদন চালিয়ে যাওয়ার মতো যথেষ্ট পরিমাণ উদ্বৃত্ত অর্থ হাতে থাকে না,…

হ্যাঁ?

…পুঁজিপতি তখন কী করেন বলতে পারো?

উঁহু, পারছি না।

মনে করো, তুমি একটা কারখানার মালিক। টাকা-পয়সার টানাটানি যাচ্ছে মোর। উৎপাদন চালিয়ে যাওয়ার জন্যে যে-কাঁচামাল তোমার দরকার তা তুমি কিনতে পারছে না। দেউলিয়া হওয়ার মতো অবস্থা তোমার। তো, এখন আমার প্রশ্ন হচ্ছে খরচ কমানোর জন্যে তুমি কী করতে পারো?

ধরুন গিয়ে, বেতন কমিয়ে দিতে পারি। দারুণ। হ্যাঁ, সবচেয়ে কাজের কাজ যেটা তুমি করতে পারো তা এটাই। কিন্তু সব পুঁজিপতিই যদি তোমার মতো চালাক হয়– অবশ্য আসলেই তারা তাই– তাহলে শ্রমিকেরা এতোই গরিব হয়ে পড়বে যে জিনিস-পত্র কেনার আর সামর্থ থাকবে না তাদের। এই পরিস্থিতিতে আমরা বলবো যে ক্রয়-ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। এবার কিন্তু আমার সত্যিই একটা দুষ্ট চক্রের মধ্যে পড়ে গেছি। মার্ক্স হলে বলতেন, পুঁজিপতির ব্যক্তিগত সম্পদের মৃত্যু-ঘণ্টা বেজে গেছে। দ্রুত একটা বিপ্লক পরিস্থিতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা।

হ্যাঁ, বুঝতে পারছি।

অল্প কথায় বলতে গেলে, শেষ পযর্ন্ত প্রোলেতারিয়েতরা জেগে উঠে উৎপাদনের উপায়ের দখল নিয়ে নেবে।

তারপর?

কিছুদিনের জন্যে আমরা একটা নতুন শ্রেণী সমাজ পাই যেখানে প্রোলেতারিয়েতো জোর করে দাবিয়ে রাখে বুর্জোয়াদের। মার্ক্স একে বলেছেন প্রোলেতারিয়েতের একনায়কত্ব। কিন্তু একটা ক্রান্তিকালের পর প্রোলেতারিয়েতের একনায়কত্বের জায়গা নেয় একটি শ্রেণীহীন সমাজ যেখানে উৎপাদনের উপায় থাকে সবার হাতে, অর্থাৎ, জনসাধারণের নিজের হাতে। এ-ধরনের সমাজে নীতিটি হলো যার যার ক্ষমতা অনুযায়ী প্রত্যেকের কাছ থেকে যার যার প্রয়োজন অনুযায়ী প্রত্যেকের কাছে। তাছাড়া শ্ৰম এখন শ্রমিকদের নিজেদের জিনিসে পরিণত হয়েছে আর সমাপ্তি ঘটেছে পুঁজিবাদের বিচ্ছিন্নতার।

সব কিছুই তো খুব চমৎকার শোনাচ্ছে, কিন্তু আসলে কী ঘটেছিল? কোনো বিপ্লব কি ঘটেছিল?

হ্যাঁ আবার না। আজ অর্থনীতিবিদরা দেখাতে পারবেন যে বেশ কয়েকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইস্যর ব্যাপারে ভুল হয়েছিল মার্ক্সের। বিশেষ করে পুঁজিবাদের সংকট সম্পর্কে তার বিশ্লেষণের ভেতরেই। তাছাড়া, যেটার ভয়াবহ পরিণতি আমরা আজ দেখতে পাচ্ছি সেই প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংসের বিষয়টির দিকে তিনি যথেষ্ট পরিমাণ নজর দেননি। তারপরেও…

তারপরেও?

মার্ক্সবাদের যথেষ্ট উত্থান ঘটেছিল। এ-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে একটি অমানবিক সমাজের সঙ্গে যুদ্ধে অনেকটাই সাফল্য অর্জন করেছে সমাজবাদ। সে যাই হোক না কেন, ইউরোপে আমরা এমন এক সমাজে বাস করি যেখানে মার্ক্স যে-সমাজে ছিলেন তার চেয়ে ন্যায় বিচার বেশি, সেই সঙ্গে সংহতি একতাও। মার্ক্স-এর নিজের এবং গোটা সমাজবাদী আন্দোলনের যে এ-ব্যাপারে বিশেষ ভূমিকা আছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

কী ঘটেছিল?

 মার্ক্সের পর সমাজবাদী আন্দোলন প্রধান দুটো ভাগে ভাগ হয়ে যায়– স্যোশাল ডেমোক্রেসি আর লেনিনবাদ। স্যোশাল ডেমোক্রেসি যা কি না সমাজবাদের দিকে একটি ধীর এবং শান্তিপূর্ণ পথের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে সেটাই ছিল পশ্চিম ইউরোপের পথ। একে আমরা বলতে পারি ধীর বিপ্লব। লেনিনবাদ, যা মার্ক্স-এর এই বিশ্বাসের ওপর আস্থা রেখেই চলছিল যে পুরনো শ্রেণীভিত্তিক সমাজের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হলে বিপুবই হচ্ছে একমাত্র পথ, তা একটা বিরাট প্রভাব ফেলেছিল পূর্ব ইউরোপ, এশিয়া এবং আফ্রিকার ওপর। যার যার নিজস্ব ধরনে এই মতবাদই দুঃখ কষ্ট এবং নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে।

কিন্তু এটাই কি আবার নতুন ধরনের একটা নিপীড়নের সৃষ্টি করেনি? যেমন ধরুন, রাশিয়ায় আর পূর্ব ইউরোপে?

নিঃসন্দেহে আর এখানেই আমরা আবার দেখতে পাই যে মানুষ যা কিছু স্পর্শ করে সেটাই ভালো আর মন্দের একটা মিশ্রণ হয়ে দাঁড়ায়। অন্যদিকে আবার মার্ক্সের মৃত্যুর পঞ্চাশ বা একশো বছর পর তথাকথিত সমাজবাদী দেশগুলোর নেতিবাচক দিকগুলোর জন্যে তাঁকে দোষারোপ করাটাও যুক্তিসঙ্গত হবে না। তবে কম্যুনিস্ট সমাজে যারা প্রশাসক হবে তাদের ব্যাপারে সম্ভবত তিনি খুবই অল্প নজর দিয়েছিলেন। একটা প্রমিজ ল্যান্ড হয়ত কোনোদিনই পাওয়া যাবে না। মানুষ সব সময়ই নিত্য নতুন সমস্যা তৈরি করে যাবে আর তারপর সেগুলো দূর করার সগ্রাম করবে।

আমি নিশ্চিত, তাই-ই ঘটবে।

আর এখানেই মার্ক্স-এর ওপর যবনিকা টানব আমরা, সোফি।

দাঁড়ান, দাঁড়ান। সমান সমান যারা কেবল তাদের মধ্যেই ন্যায় বিচার থাকে, এরকম একটা কথা বলেছিলেন না আপনি?

না, আমি না, কথাটা আসলে বলেছিল স্ক্রুজ।

সে কী বলেছিল তা আপনি কী করে জানলেন?

ইয়ে, দেখো, আমাদের দুজনের লেখকই তো একজন। সত্যি বলতে কী, একজন সাধারণ লোকের কাছে যতটা মনে হবে তার চেয়ে কিন্তু বেশি ঘনিষ্ঠ আমরা দুজন।

আবারো আপনার সেই জঘন্য আয়রনি!

ডাবল, সোফি, এটা হচ্ছে ডাবল আয়রনি।

সেই ন্যায় বিচার প্রসঙ্গে ফিরে আসি। আপনি বলেছিলেন মার্ক্স মনে করতেন পুঁজিবাদ একটি অন্যায় বা অসঙ্গত সমাজ ব্যবস্থা। একটি ন্যায়পরায়ণ সমাজকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন আপনি?

জন রঅলস (John Rawls) নামের এক মোরাল ফিলসফার একটা উদাহরণ দিয়ে এ-ব্যাপারে কিছু বলার চেষ্টা করেছিলেন: মনে করুন আপনি এমন একটি বিশিষ্ট পরিষদের সদস্য যার কাজ হচ্ছে ভবিষ্যতের সমাজের জন্যে সমস্ত আইন প্রণয়ন করা।

এ-রকম একটা পরিষদের সদস্য হতে আমি একটুও আপত্তি করব না।

তো, তাদেরকে প্রতিটি খুঁটিনাটি মাথায় রাখতে হবে কারণ তারা একটা ঐকমত্যে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে এবং প্রত্যেক আইন-এ সই করার পরই মারা যাবেন।

আহ্…।

কিন্তু যে-সমাজের জন্যে তারা আইন প্রণয়ন করলেন সে-সমাজের সদস্য হিসেবে সঙ্গে সঙ্গেই প্রাণ ফিরে পাবেন তারা। তবে কথা হচ্ছে সেই সমাজে তাদের অবস্থান কী হবে সে-সম্পর্কে আগে থেকে কোনো ধারণা থাকবে না তাদের।

ও, আচ্ছা।

সেই সমাজ-ই হবে একটা ন্যায়পরায়ণ সমাজ। সেটার উদ্ভব হবে সমমর্যাদা সম্পন্ন মানুষ নিয়ে।

পুরুষ মানুষ এবং মেয়েমানুষ।

সেটাতো বলাই বাহুল্য। ওঁদের কেউ-ই জানতেন না তারা কি পুরুষ হয়ে জেগে উঠবেন, না নারী হয়ে। সম্ভাবনা যেহেতু আধাআধি, সমাজটা নারী আর পুরুষ দুয়ের জন্যে একই রকম আকর্ষণীয় হবে।

শুনে আশা জাগছে।

তো, এখন বলল, কার্ল মার্ক্সের ইউরোপ কি সে-রকম একটা সমাজ ছিল?

অবশ্যই না!

কিন্তু সে-রকম কোনো সমাজ এ-যুগেও আছে বলে কি জানা আছে তোমার?

হুম…এটা একটা ভালো প্রশ্ন।

চিন্তা করো ব্যাপারটা নিয়ে। তো, আপাতত মার্ক্স সম্পর্কে এটুকুই।

কী বললেন?

পরের চ্যাপ্টার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *