৩১. ফ্রয়েড

৩১. ফ্রয়েড

… মেয়েটির মধ্যে যে ঘৃণ্য অহংভাবপূর্ণ আবেগের জন্ম নিয়েছিল…

বিশাল রিং বাইন্ডারটা নিয়ে বিছানা থেকে লাফ দিয়ে নেমে এলো হিল্ডা মোলার ন্যাগ। ধপাস করে ফেলল সেটা তার লেখার ডেস্কটার ওপর, জামা-কাপড় টেনে নিয়ে ঢুকে পড়ল গোসলখানায়। দুই মিনিট দাঁড়িয়ে থাকল ঝরনার নিচে, চটপট পোশাক পরে নিল, তারপর দৌড়ে নেমে এলো নিচতলায়।

ব্রেকফাস্ট তৈরি, হিল্ডা!

আগে আমাকে নৌকো বাইতে হবে।

কিন্তু হিল্ডা…!

দৌড়ে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে বাগান পেরিয়ে ছোট্ট ডকটায় চলে এলো সে। নৌকোটার দড়িদড়া খুলে দিয়ে লাফ দিয়ে সেটায় চড়ে বসল। তার মেজাজ শান্ত না হওয়া পর্যন্ত লেক জুড়ে ক্রুদ্ধ ছোট ছোট ঘাই মেরে নৌকো বেয়ে চলল সে।

আমরাই হচ্ছি জীবম্ভ গ্রহ, সোফি! আমরা হচ্ছি সেই বিরাট জাহাজ যা মহাবিশ্বে এক জ্বলন্ত সূর্যের চারদিকে ভেসে বেড়াচ্ছে। কিন্তু আমাদের প্রত্যেকেই আবার একটি জাহাজ যা জিন-এর কার্গো নিয়ে ভেসে চলেছে জীবনের ভেতর দিয়ে। এই কার্গো নিরাপদে আরেক পোতাশ্রয়ে নিয়ে যেতে পারলে তবেই আমাদের জীবন সার্থক…

প্যাসেজটা ওর মুখস্ত হয়ে গেছে। তার জন্যেই লেখা হয়েছে ওটা। সোফির জন্যে নয়, তার জন্যে। রিং বাইন্ডারটার প্রতিটি শব্দ বাবা হিল্ডার জন্যে লিখেছেন।

দাঁড় দুটোকে আটকে উঠিয়ে রাখে সে। পানির ওপর মৃদুমন্দভাবে দুলতে থাকে নৌকোটা, ছোট ছোট ঢেউগুলো আস্তে আস্তে চাপড় দিতে থাকে সেটার সামনের দিকে। লিলেস্যান্ডের উপসাগরে ছোট্ট নৌকোটা যেমন পানির ওপর ভেসে বেড়াচ্ছে। ঠিক সে-রকম জীবনের ওপর সে একটা ছোট্ট বাদামের খোসা।

 এই ছবির মধ্যে সোফি আর অ্যালবার্টো কোথায়? তাইতো, অ্যালবার্টো আর সোফি কোথায়?

সে এটা অনুধাবন করতে পারল না যে তারা আসলে তার বাবার মস্তিষ্কে বিদ্যুচ্চুম্বকীয় স্পন্দন ছাড়া আর কিছুই নয়। সে অনুধাবন করতে পারল না আর মেনে তো নিতে পারলই না যে, তারা তার বাবার বহনযোগ্য টাইপরাইটারের রিবন এর ছাপার কালি আর কাগজ ছাড়া কিছুই নয়। অবশ্য কেউ হয়ত এ-কথাও বলতে পারে যে সে নিজে স্রেফ এক ছোট্ট উত্তপ্ত জলাশয়ে হঠাৎ একদিন প্রাণ পেয়ে ওঠা প্রোটিন যৌগের একটা দলা ছাড়া কিছু নয়। কিন্তু সে আসলে সেটার চেয়েও বেশি কিছু। সে হচ্ছে হিল্ডা মোলার ন্যাগ।

তাকে স্বীকার করতেই হলো যে রিং বাইন্ডারটা একটা অসাধারণ উপহার আর তার বাবা তার ভেতরের শাশ্বতকিছু একটার মর্মস্থলে স্পর্শ করেছেন। কিন্তু সোফি আর অ্যালবার্টোর সঙ্গে তিনি যে-রকম ব্যবহার করছেন সেটা তার পছন্দ হয়নি।

 বাবা বাড়ি ফিরে আসার আগেই তাকে সে একটা শিক্ষা দেবেই দেবেই। হিল্ডার মনে হলো অ্যালবার্টো আর সোফি-র এই জিনিসটা পাওনা আছে তার কাছে। এরিমধ্যে কোপেনহগেন-এর কাস্ট্রাপ এয়ারপেৰ্টে তার বাবাকে কল্পনা করতে পারল সে। হিল্ডা দিব্যি দেখতে পেল পাগলের মতো ছুটোছুটি করছেন তিনি।

ফের নিজের সত্তায় ফিরে এলো হিল্ডা। নৌকো বেয়ে ডকে চলে এলো সে আবার এবং এবার সে চটপট কাজ সারতে ভুলল না। ব্রেকফাস্টের পর মায়ের সঙ্গে অনেকক্ষণ টেবিলে বসে রইল সে। ডিমটা নেহায়েত নগণ্য পরিমাণ বেশি নরম কিনা এ-রকম সাধারণ বিষয় নিয়ে কথা বলতে পেরে ভালো লাগলো তার।

সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত আর ফের পড়া শুরু করল না সে। খুব বেশি পৃষ্ঠা বাকি নেই। আর।

.

আবারো ঠক্ ঠক্ শব্দ শোনা গেল দরজায়।

কানে হাত চাপা দেই, চলো, অ্যালবার্টো বললেন, তাহলে হয়ত চলে যাবে ও।

না, আমি দেখতে চাই কে এলো।

সোফির পেছন পেছন দরজার কাছে এসে দাঁড়ালেন অ্যালবার্টো।

নগ্ন একজন পুরুষ দরজায় দাঁড়িয়ে। খুবই আনুষ্ঠানিক একটা ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে সে, যদিও মাথার মুকুটটা ছাড়া তার শরীরে কুটোটা পর্যন্ত নেই।

তো? সে বলে উঠল, সম্রাটের নতুন পোষাক সম্পর্কে তোমরা ভালোমানুষেরা কী বলে?

অ্যালবার্টো আর সোফির তো রীতিমত হতভম্ব দশা। তাই দেখে নগ্ন মানুষটি খানিকটা আহত বোধ করল।

কী ব্যাপার! কুর্নিশ করছে না যে তোমরা! চেঁচিয়ে উঠল সে।

 তা ঠিক, করছি না, অ্যালবার্টো বললেন। কিন্তু সম্রাট যে একেবারে ন্যাংটোপুটো।

নগ্ন লোকটি তার আনুষ্ঠানিক ভঙ্গিটি বজায় রাখলো। অ্যালবার্টো ঝুঁকে পড়ে সোফির কানে ফিসফিসিয়ে বললেন:

লোকটা ভাবছে তার সঙ্গে আমরা তমিজের সঙ্গে ব্যবহার করবো।

 এইবার লোকটা ভ্রূকুটি করে উঠল:

এখানে আবার কোনো ধরনের সেন্সরশীপ আরোপ করা হচ্ছে বুঝি? জিগ্যেস করল সে।

দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, হ্যাঁ, অ্যালবার্টো বললেন। এখানে আমরা দুজন খুবই সচেতন আর সব দিক থেকেই সুস্থ। কাজেই সম্রাটের এই লজ্জাকর অবস্থায় এই বাড়ির চৌকাঠ ডিঙোন তার জন্যে বারণ।

নগ্ন লোকটির হামবড়া ভাব সোফির কাছে এতোই অবাস্তব ঠেকল যে হাসিতে ফেটে পড়ল সে। যেন তার হাসিটা একটা পূর্বনির্ধারিত সংকেত, এমনিভাবে মাথায় মুকুটপরা লোকটি হঠাৎ করেই সচেতন হয়ে উঠল যে সে উলঙ্গ। দুই হাতে লজ্জাস্থান ঢেকে সবচেঘ্নে কাছের গাছের দঙ্গলের দিকে ছুট লাগাল সে, তারপর অদৃশ্য হয়ে গেল, সম্ভবত যোগ দিতে গেল সে অ্যাডাম আর ঈ, নোয়া, ছোট্ট রেড রাইডিংহুড আর উইলি-দ্য-গুহর সঙ্গে।

অ্যালবার্টো আর সোফি সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে হাসতে থাকলেন।

শেষ পর্যন্ত অ্যালবার্টো বলে উঠলেন, ভেতরে গেলে মন্দ হতো না। ফ্রয়েড আর তাঁর নির্জন মনের তত্ত্ব (theory of the unconscious) সম্পর্কে তোমাকে কিছু বলতে চাই আমি এখন।

ফের জানলার পাশে গিয়ে বসলেন দুজন। সোফি তার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে উঠল: আড়াইটা কিন্তু বেজে গেছে এর মধ্যে, গার্ডেন পার্টির অনেক কাজ বাকি আমার এখনো।

আমারো। সিগমুন্ড ফ্রয়েড (Sigmund Freud) সম্পর্কে দুচারটে কথা বলবো

তিনি কি দার্শনিক ছিলেন?

আমরা তাকে অন্ততপক্ষে সাংস্কৃতিক দার্শনিক তো বলতেই পারি। ফ্রয়েড-এর জন্ম ১৮৫৬ সালে, ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসা শাস্ত্র নিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন তিনি। ভিয়েনায় তিনি তাঁর জীবনের অপেক্ষাকৃত বড় অংশটা এমন এক সময় বাস করে গেছেন যখন শহরটির সাংস্কৃতিক জীবন বিকাশ লাভ করছিল। গোড়ার দিকে তিনি স্নায়ুতত্ত্ব সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠেন। গত শতাব্দীর শেষের দিকে এবং আমাদের এই শতাব্দীর অনেকদিন ধরে তিনি তার অবচেতন মনোপ্রকৃতির সমীক্ষণ (depth psychology) বা মনোসমীক্ষণ (psychoanalysis) তত্ত্ব দাঁড় করান।

আপনি নিশ্চয়ই এটা ব্যাখ্যা করবেন, তাই না?

মনোসমীক্ষণ হচ্ছে সাধারণভাবে মানবমনের একটি বর্ণনা এবং স্নায়বিক ও মানসিক অসুস্থতার চিকিৎসা (therapy)। ফ্রয়েড বা তাঁর কাজের সম্পূর্ণ চিত্র তোমার সামনে হাজির করার ইচ্ছে আমার নেই। তবে মানুষ কী তা বুঝতে গেলে ফ্রয়েডের নির্জন মনের তত্ত্বটি কাজে লাগবে।

আপনি আমার কৌতূহল বাড়িয়ে দিয়েছেন। বলে যান।

ফ্রয়েড মনে করতেন যে মানুষ আর তার চারপাশের মধ্যে একটা সার্বক্ষণিক দ্বন্দ্ব কাজ করে। নির্দিষ্ট করে বললে, এই দ্বন্দ্বটা তার নানান তাড়না (drives) ও প্রয়োজন আর সমাজের দাবির মধ্যে। এটা বললে বাড়াবাড়ি হবে না যে ফ্রয়েডই এই মানবিক তাড়নাগুলো আবিষ্কার করেছেন। আর সে-কারণেই ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে যে প্রকৃতিবাদী স্রোত বেশ প্রবল ছিল তার একজন গুরুত্বপূর্ণ মুখপাত্র বলে মনে করা হয় তাকে।

মানবিক তাড়না বলতে কী বোঝাচ্ছেন আপনি?

আমাদের কাজ-কর্ম যে সব সময় প্রজ্ঞা দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয় তা কিন্তু নয়। অষ্টাদশ শতকের বুদ্ধিবাদীরা যেমনটা মনে করতেন, মানুষ কিন্তু আসলে ততোটা বুদ্ধিবাদী প্রাণী নয়। আমরা যা ভাবি, যা স্বপ্ন দেখি আর যা করি তার অনেকটাই নির্ধারণ করে অযৌক্তিক আবেগ বা প্রেরণা। এ-ধরনের অযৌক্তিক আবেগ বা প্রেরণা কিন্তু মৌলিক তাড়না বা প্রয়োজনের একটা প্রকাশ হতে পারে। এই ধরো, মানুষের যৌন তাড়না ঠিক শিশুর স্তন্যপানের মতোই একটি মৌলিক প্রবৃত্তি।

তাই?

এটা অবশ্য নতুন কোনো আবিষ্কার ছিল না। কিন্তু ফ্রয়েড দেখালেন যে এই মৌলিক প্রয়োজনগুলোর ওপর একটা ছদ্মাবরণ পড়তে পারে বা সেগুলো উচ্চতর কোনো খাতে প্রবাহিত হতে পারে (sublimated), ফলে সেগুলো আমাদের কাজ কর্মকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে যা আমরা টেরই পাই না। তিনি আরো দেখালেন যে একেবারে শিশুদের এক ধরনের যৌনতা রয়েছে। শিশুর যৌনতা সম্পর্কে এই ইঙ্গিতের প্রতি ভিয়েনার মর্যাদাবান মধ্যবিত্ত শ্রেণী ঘৃণার সঙ্গে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিল এবং ফ্রয়েড হয়ে উঠেছিলেন ভীষণ অজনপ্রিয়।

 তাতে আমি অবাক হচ্ছি না।

যৌনতার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত সব কিছুই যখন নিষিদ্ধ ব্যাপার (taboo) হয়ে দাঁড়ায় তখন সেটাকে আমরা বলি ভিক্টোরিয়ানিজম। মনোচিকিৎসা (psychotherapy) চালানোর সময়ই শিশুদের যৌনতা সম্পর্কে ফ্রয়েড প্রথমবারের মতোন সচেতন হয়ে ওঠেন। কাজেই তাঁর দাবির একটা অভিজ্ঞতালব্ধ ভিত্তি ছিল। স্নায়বিক পীড়া (neurosis) অথবা মানসিক অসুখের কত অসংখ্য রকমফেরের উৎস যে শৈশবের নানান দ্বন্দ্ব-সংঘাত সেটাও দেখেছিলেন তিনি তখন। ধীরে ধীরে তিনি এমন একটি চিকিৎসার উদ্ভাবন করলেন যাকে আমরা বলতে পারি আত্মার প্রত্নতত্ত্ব।

তার মানে?

 সাংস্কৃতিক ইতিহাসের স্তরের পর স্তর খুঁড়ে দূর অতীতের নিশানা খুঁজে ফেরেন একজন প্রত্নতত্ত্ববিদ। হয়ত অষ্টাদশ শতকের একটা ছুরি খুঁজে পেলেন তিনি। মাটির আরো গভীরে তিনি হয়ত পেয়ে যেতে পারেন চতুর্দশ শতকের একটা চিরুনি। আর তার-ও গভীরে হয়ত খ্রিস্ট পূর্বাব্দ পঞ্চম শতকের একটা শবাধার।

তো?

একইভাবে, মনোবিশ্লেষকও রোগীর সহায়তায় তার মনের গহীন ভেতর খুঁড়ে এমন কিছু অভিজ্ঞতার কথা তুলে আনতে পারেন যা সেই রোগীর শারীরিক অসুস্থতার জন্যে দায়ী, তার কারণ ফ্রয়েড-এর মত অনুযায়ী, আমাদের সমস্ত অভিজ্ঞতার স্মৃতি আমরা আমাদের মনের গভীরে জমা করে রাখি।

বুঝতে পারছি।

 বিশ্লেষক হয়ত এমন একটি অসুখী ঘটনা আবিষ্কার করতে পারেন যেটা রোগীটি বহু বছর ধরে গোপন রাখার চেষ্টা করেছেন কিন্তু তারপরেও সেটা চাপা পড়ে থেকেছে, কুরে কুরে খেয়েছে রোগীটির অন্তরাত্মা। একটি যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতা-কে মনের সচেতন স্তরে নিয়ে এসে, অর্থাৎ বলতে গেলে সেটা রোগীর সামনে তুলে ধরে সেই বিশ্লেষক রোগীটিকে সেটা ঝেড়ে ফেলতে এবং আবার সুস্থ হয়ে উঠতে সাহায্য করতে পারেন।

কথাটা তো বেশ যৌক্তিকই শোনাচ্ছে।

অবশ্য আমি লাফ দিয়ে বড্ড বেশি সামনে চলে গেছিঃ প্রথমে চলো মানুষের মন সম্পর্কে ফ্রয়েডের বর্ণনাটার দিকে নজর দেয়া যাক। কখনো সদ্যোজাত কোনো শিশুকে দেখেছো?

আমার এক কাজিন আছে, চার বছর বয়স ওর।

আমরা যখন পৃথিবীতে আসি তখন আমরা আমাদের শারীরিক এবং মানসিক চাহিদার কথা সরাসরি এবং নির্লজ্জভাবে প্রকাশ করি। দুধ না পেলে অথবা যখন আমাদের ডায়াপারর ভিজে যায় তখন আমরা কেঁদে উঠি। শারীরিক সংস্পর্শ এবং দেহগত উষ্ণতা পাওয়ার ইচ্ছার কথাও আমরা সরাসরি প্রকাশ করি। আমাদের ভেতরকার এই ইন্দ্রিয় পরিতোষের নীতি-কে (pleasure principle) ফ্রয়েড বলছেন ইড (id)। সদ্যোজাত শিশু হিসেবে আমরা এই ইড ছাড়া আর কিছুই না।

বলে যান।

এই ইড বা ইন্দ্রিয় পরিতোষের নীতিকে আমরা আমাদের পরিণত বয়সে টেনে নিয়ে যাই এবং সারা জীবন-ই তা বহন করি। কিন্তু ধীরে ধীরে আমরা আমাদের কামনাগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে এবং চারপাশের সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিতে শিখি। ইন্দ্রিয় পরিতোষের নীতিকে আমরা বাস্তবিক নীতি (reality principle) অনুযায়ী নিয়ন্ত্রণ করতে শিখি। ফ্রয়েডের ভাষায়, আমাদের মধ্যে একটি অহং (ego) জন্ম নেয় যার মধ্যে এই নিয়ন্ত্রণকারী ক্ষমতা আছে। কোনো কিছু আমরা চাইলে বা আমাদের প্রয়োজন হলেও আমরা সেটা না পাওয়া পর্যন্ত স্রেফ শুয়ে শুয়ে সেটার জন্য চেঁচাতে পারি না।

তা তো বটেই।

আমরা হয়ত এমন কিছু চাইতে পারি যা বাইরের জগৎ অনুমোদন করবে না। সেক্ষেত্রে আমরা আমদের ইচ্ছে বা কামনাগুলোকে হয়ত দমিয়ে রাখতে পারি। তার। মানে আমরা সেগুলোকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে ব্যাপারটা ভুলে যেতে পারি।

আচ্ছা।  

যাই হোক, ফ্রয়েড মানবমনের তৃতীয় একটি উপাদানের কথা বললেন এবং সেটা নিয়ে কাজ করলেন। একেবারে ছোটবেলা থেকেই প্রতিনিয়ত আমরা আমাদের বাবা-মা অথবা সমাজের কিছু নৈতিক দাবির সম্মুখিন। অন্যায় কোনো কিছু করলেই আমাদের বাবা-মা বলে ওঠেন, ওটা কোরো না! বা এ্যাই দুষ্টু, এটা কিন্তু ভালো না! বড় হওয়ার পরেও এ-সব নৈতিক দাবি ও বিচারের প্রতিধ্বনি আমাদের মধ্যে রয়ে যায়। মনে হয়, জগতের নৈতিক প্রত্যাশাগুলো যেন আমাদের অংশ হয়ে গেছে। ফ্রয়েড একে বলেছেন অতি-অহম (superego)।

এটা কি বিবেকের প্রতিশব্দ?

 বিবেক অতি-অহমের একটা অংশ। ফ্রয়েড দাবি করেছেন যে অতি-অহম আমাদের বলে দেয় কখন আমাদের ইচ্ছেগুলো খারাপ বা অসঙ্গত হচ্ছে, বিশেষ করে যৌন ইচ্ছেগুলোর ব্যাপারে। আর আগেই বলেছি ফ্রয়েড দাবি করেছেন এ-সব অসঙ্গত ইচ্ছে শৈশবের একটা প্রাথমিক স্তরেই নিজেদের অস্তিত্ব জাহির করে বসে।

কীভাবে?

এখন আমরা জানি যে শিশুরা তাদের জননেন্দ্রিয় ছুঁতে পছন্দ করে। যে কোনো বীচে গেলেই সেটা দেখতে পাবো আমরা। ফ্রয়েডের সময় এ-ধরনের ঘটনার ফল হতে পারতো সেই দুই বা তিন বছরের শিশুটির আঙুলের ওপর একটা চড় আর সেই সঙ্গে হয়ত মায়ের বকুনী দুষ্ট কোথাকার বা ওটা কোরো না! বা হাত সরাও ওখান থেকে।

কী অসুস্থ মানসিকতা!

যৌনাঙ্গ আর যৌনতার সঙ্গে সম্পর্কিত সব কিছু সম্পর্কে অপরাধবোধের শুরুটা ওখান থেকেই। এই অপরাধবোধটি যেহেতু অতি-অহমে থাকে, তাই অনেক লোকই– ফ্রয়েডের মতে বেশির ভাগ লোকই– যৌন বিষয়ে একটা অপরাধবোধে ভোগে সারাজীবন। সেই সঙ্গে ফ্রয়েড এটাও দেখিয়েছেন যে যৌন কামনা এবং প্রয়োজন মানুষের জন্যে স্বাভাবিক এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। তো, এভাবেই, বুঝলে সোফি, কামনা আর অপরাধবোধের মধ্যেকার আজীবন দ্বন্দ্বের একটি ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়ে যায়।

আপনার কি মনে হয় না যে ফ্রয়েডের সময় থেকে সেই দ্বন্দ্বটা অনেকটাই কমে এসেছে?

অবশ্যই। কিন্তু ফ্রয়েডের অনেক রোগী এতো প্রবলভাবে সেই দ্বন্দ্বের মুখোমুখি হয়েছিলেন যে তাদের মধ্যে ফ্রয়েডের ভাষায় স্নায়বিক পীড়া জন্ম নিয়েছিল। যেমন ধরো, তার অনেক মহিলা রোগীর একজন গোপনে তার ভগ্নিপতির প্রেমে পড়েছিলেন। একটা অসুখে বোনটি মারা যাওয়ার পর সেই মহিলা ভাবলেন: এবার আর আমাকে বিয়ে করতে তার কোনো বাধা নেই! ফ্রয়েড বলছেন এই চিন্তাটির সঙ্গে মহিলার অতি-অহমের একটা মুখোমুখি সংঘর্ষ বাঁধার উপক্রম হলো এবং চিন্তাটি এমনই ভয়ংকর ছিল যে মহিলা তাৎক্ষণিকভাবে সেটা দমন করলেন। অন্য কথায় বলতে গেলে চিন্তাটিকে মহিলা তার নির্জন মনের গভীরে চাপা দিয়ে রাখলেন। ফ্রয়েড লিখছেন: তরুণী মেয়েটি অসুস্থ হয়ে পড়ল এবং তার মধ্যে ভয়াবহ মৃগীরোগজনিত উপসর্গ দেখা দিল। আমি যখন মেয়েটির চিকিৎসা শুরু করলাম তখন মনে হলো তার বোনের শয্যাপাশ্বের দৃশ্যটি এবং মেয়েটির মধ্যে যে ঘৃণ্য অহংভাবপূর্ণ আবেগের জন্ম নিয়েছিল সে-কথা সে পুরোপুরি ভুলে গেছে। কিন্তু মনোবিশ্লেষণের সময় সে-কথা তার মনে পড়ল এবং অত্যন্ত বিক্ষুব্ধ একটা দশায় সেই রোগসৃষ্টিকারী মুহূর্তটিকে সে মনের মধ্যে আবার ফিরিয়ে আনল এবং এই চিকিৎসার ফলে সেরে উঠল।

আত্মার প্রত্নতত্ত্ব বলতে আপনি কী বোঝাতে চেয়েছিলেন সেটা আরো ভালো করে বুঝতে পারছি এখন।

কাজেই মানুষের মনের একটা সাধারণ বর্ণনা এবার দিতে পারি আমরা। রোগীদের চিকিৎসায় বহু বছরের অভিজ্ঞতার পর ফ্রয়েড এই সিদ্ধান্তে পৌঁছুলেন যে চেতন মন (conscious) মানব মনের নেহাই একটা ক্ষুদ্র অংশ। চেতন মন হচ্ছে সমুদ্র পৃষ্ঠের ওপর জেগে থাকা আইসবার্গের ডগাটুকুমাত্র। সমুদ্রপৃষ্ঠের নিচে বা চেতনার ওপারে রয়েছে বা নির্জন মন (subconscious বা unconscious)।

তার মানে নির্জন মন হচ্ছে আমাদের ভেতর যা কিছু বিস্মৃত অবস্থায় রয়েছে এবং যা আমরা মনে করতে পারি না তাই, ঠিক না?

 আমরা আমাদের সমস্ত অভিজ্ঞতাকেই সব সময় আমাদের মনের মধ্যে সচেতনভাবে উপস্থিত থাকতে দেখি না। কিন্তু যে-ধরনের জিনিসের কথা আমরা ভেবেছি বা যা কিছু আমাদের জীবনে ঘটেছে এবং মনে করার চেষ্টা করলে যে সব কথা আমরা মনে করতে পারি তাকে ফ্রয়েড বলেছেন অবচেতন (preconscious)। নির্জন মন কথাটা তিনি উঠিয়ে রেখেছেন সেইসব জিনিস বোঝাতে যেগুলোকে আমরা দমিয়ে রেখেছি। তার মানে সেই ধরনের জিনিস যেগুলো ভোলার জন্যে আমরা এজন্যে চেষ্টা করেছিলাম যে সেগুলো হয় অপ্রীতিকর, অসঙ্গত অথবা নোংরা। আমাদের যদি এমন কোনো ইচ্ছা বা তাড়না থাকে যেগুলো চেতন মনের কাছে অসহনীয় বলে বোধ হয় তখন অতি-অহম সেগুলো নিচের তলায় পাঠিয়ে দেয়। বিদেয় হোক ওসব!

বুঝতে পেরেছি।

সমস্ত সুস্থ লোকের মধ্যেই এই মেকানিজমটি কাজ করে। কিন্তু অপ্রীতিকর বস্তু বা নিষিদ্ধ চিন্তাকে চেতনার কাছ থেকে দূরে রাখতে গিয়ে কিছু লোকের ওপর এমন প্রচণ্ড চাপ পড়ে যে তা মানসিক রোগের জন্ম দেয়। এভাবে কোনো কিছুকে চাপা দিলে তা নিজের চেষ্টায় আবার চেতনার মধ্যে প্রবেশ করার চেষ্টা করবে। কেননা কোনো লোকের পক্ষে এ-ধরনের আবেগকে চেতন মনের সমালোচনাপূর্ণ চোখের নিচে রাখাটা খুব কঠিন হয়ে পড়ে। ১৯০৯ সালে ফ্রয়েড যখন আমেরিকায় মনোসমীক্ষণ নিয়ে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন তখন একটি উদাহরণ দিয়েছিলেন কী করে এই দমন প্রক্রিয়া কাজ করে।

সেটা শোনার ইচ্ছে হচ্ছে আমার।

 তিনি বলেছিলেন: মনে করুন এই হলঘরে এই অডিয়েন্সের মধ্যে, যে অডিয়েন্সের অনুকরণীয় নিস্তব্ধতা এবং মনোযোগের যথেষ্ট প্রশংসা করা আমার সাধ্যাতীত, সেখানে এমন একজন ব্যক্তি রয়েছেন যিনি একটা ঝামেলা পাকাচ্ছেন এবং তিনি তাঁর অশিষ্ট হাসি, কথা এবং পা ঘষাটানির সাহায্যে আমার কাজ থেকে আমার মনোযোগ সরিয়ে দিচ্ছেন। আমি বুঝিয়ে বললাম যে এই পরিস্থিতিতে আমি আমার বক্তৃতা চালিয়ে যেতে পারবো না, ফলে আপনাদের মধ্যে থেকে কয়েকজন শক্ত-সমর্থ লোক উঠে গিয়ে খানিকটা ধ্বস্তাধ্বস্তির পর সেই শান্তিবিঘ্নকারীকে হলঘর থেকে বের করে দিলেন। তার মানে, তাকে এখন দমন করা হলো এবং আমি আমার বক্তৃতা চালিয়ে যেতে পারলাম। কিন্তু ঝামেলাটা আবার যাতে না হয়। সেজন্যে যে-লোকটিকে এই মাত্র বের করে দেয়া হলো তিনি যাতে জোর করে আবার ঘরে ঢুকতে না পারেন তাই যে-সব ভদ্রলোক আমার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে সে-অনুযায়ী কাজ করেছিলেন তাঁরা তাঁদের চেয়ার নিয়ে দরজায় গিয়ে বসলেন প্রতিরোধ হিসেবে, সেই দমন প্রক্রিয়াটি চালিয়ে যাওয়ার জন্যে। তো, এবার যদি এই দুটো জায়গাকে আপনারা মন-এ স্থানান্তরিত করেন এবং এটাকে চেতন মন বলে বাইরেরটাকে নির্জন মন (unconscious) বলেন তাহলেই মোটামুটি চলনসই একটা বর্ণনা পেয়ে যাচ্ছেন সেই দমন-প্রক্রিয়ার।

আমি একমত।

কিন্তু সোফি, সেই শান্তিবিঘ্নকারী তো বারবার চেষ্টা চালাচ্ছে আবার ভেতরে ঢোকার। অন্ততপক্ষে, দমিয়ে রাখা চিন্তা-ভাবনা এবং তাড়নাগুলো তাই করে। নির্জন মন থেকে উঠে আসার চেষ্টা করতে থাকা দমিয়ে রাখা চিন্তা-ভাবনাগুলোর নিরন্তর চাপের মধ্যে থাকি আমরা। সেই জন্যেই আমরা এমন কিছু কাজ করে বসি যা আমরা করতে চাইনি। অবচেতন প্রতিক্রিয়াগুলো এভাবেই আমাদের অনুভূতি এবং কাজকর্মকে উদ্বুদ্ধ করে।

একটা উদাহরণ দিতে পারেন?

এই মেকানিজমের বেশ কয়েকটি নিয়ে কাজ করেছেন ফ্রয়েড। তার মধ্যে একটা হচ্ছে আমরা যাকে বলি মুখ বা কলম ফসকে কিছু বলে বা লিখে ফেলা (parapraxes)। অন্য কথায় বলতে গেলে বলতে হয়, এক সময় আমরা যে ব্যাপারটা চেপে রাখতে গিয়েছিলাম সেটাই আমরা আকস্মিকভাবে বলে বা করে ফেলি। উদাহরণ দিতে গিয়ে ফ্রয়েড এক দোকানের এক ফোরম্যানের কথা বলেছেন যে তার বসের উদ্দেশে একটা টোস্ট করতে চাইছিল। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে সেই বস লোকটা ছিল ভীষণ রকমের অজনপ্রিয়। সাদা কথায় বলতে গেলে বসটি ছিল লোকে যাকে বলবে সোয়াইন (swine) বা শুয়োর।

তারপর? তো, ফোরম্যান উঠে দাঁড়াল, উঁচু করে ধরল নিজের গ্লাসটা, তারপর বলে উঠল, হিয়ার ইজ টু দ্য সোয়াইন!

কী সাংঘাতিক!

তা আর বলতে। তবে লোকটা আসলে ঠিক তাই বলেছিল যা সে সত্যি মনে করে। অবশ্য সেটা সে বলতে চায়নি। আরেকটা উদাহরণ শুনতে চাও?

ইয়েস, প্লিজ।

একবার, এক বিশপের চা খেতে আসার কথা স্থানীয় একজন ধর্মযাজকের বাড়িতে; সেই ধর্মযাজকের আবার বেশ কিছু ছোট ছোট্ট নম্র-ভদ্র মেয়ে নিয়ে একটা বিরাট পরিবার। এদিকে বিশপের নাকটা ছিল বেখাপ্পা রকমের বড় আকারের। ছোট্ট মেয়েগুলোকে পই পই করে বলে দেয়া হলো তারা যেন কোনো অবস্থাতেই বিশপের নাক নিয়ে কিছু না বলে, কারণ বাচ্চাদের মধ্যে অবদনমকারী মেকানিজম তখনও পুরোপুরি গড়ে না ওঠায় বড়দের সম্পর্কে অনেক সময় তারা মুখ ফসকে অনেক বেফাঁস কথা বলে বসে। যাই হোক, বিশপ এলেন, উল্লসিত কন্যারা প্রাণপণে নিজেদের সংযত করে রাখল তাঁর নাক নিয়ে কোনো মন্তব্য না করার জন্যে। চেষ্টা করল যেন নাকটার দিকে নজরই না পড়ে তাদের, চেষ্টা করল ওটার কথা ভুলে যেতে। কিন্তু তারপরেও সারাক্ষণই ওটার কথা মনে পড়তে লাগল ওদের। তো, এমন সময় একজনকে বলা হলো চিনিটা এগিয়ে দিতে। বিশিষ্ট বিশপের দিকে তাকিয়ে মেয়েটা তখন বলে উঠল, আপনি কি আপনার নাকে চিনি নেন?

কী ভয়ংকর।

 আরেকটা যে-কাজ আমরা করতে পারি তা হলো মুক্তিপ্রয়োগ করা (rationalise)। তার মানে হচ্ছে আমরা যা করছি তার আসল কারণটা আমরা নিজেদের বা অন্যের কাছে বলছি না, তার কারণ সেই আসল কারণটা অগ্রহণযোগ্য।

যেমন?

তোমাকে আমি সম্মোহিত করে একটা জানলা খোলাতে পারি। তুমি সম্মোহিত অবস্থায় থাকাকালীন তোমাকে বললাম যে টেবিলের ওপর আমি আঙুল দিয়ে তুড়ি বাজাতে শুরু করলেই তুমি উঠে গিয়ে জানলা খুলে দেবে। আমি তুড়ি বাজাতে শুরু করলাম আর তুমি জানলা খুলে দিলে। পরে আমি তোমাকে যখন জিগ্যেস করলাম কেন তুমি জানলাটা খুললে তখন তুমি বলতে পারো যে বড্ড গরম পড়েছে। সেজন্যে। অথচ সেটা কিন্তু আসল কারণ নয়। তুমি যে আমার সম্মাহক আদেশ পালন করতে গিয়ে কাজটা করেছে সেটা তুমি স্বীকার করতে চাইছে না। তাই তুমি একটা যুক্তি দেখাচ্ছো।

হ্যাঁ, বুঝতে পারছি।

এ-ধরনের ব্যাপার আমরা কার্যত প্রতিদিনই দেখে থাকি।

আমার এই চার-বছর বয়েসী কাজিনটা, আমার মনে হয় না যে ওর বেশি বন্ধু বান্ধব আছে, তাই আমি বেড়াতে গেলে সব সময়ই খুশি হয় ছেলেটা। একদিন আমি তাকে বললাম তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে যেতে হবে আমাকে মা-র কাছে। আপনি জানেন ও কী বলল?

কী বলল?

 বলল যে আমার মা একটা স্টুপিড।

হ্যাঁ, এটা আসলেই যুক্তিপ্রয়োগের একটা ঘটনা। ছেলেটা আসলে ঠিক ও-কথা বলতে চায়নি। সে বলতে চেয়েছে যে তোমাকে যে চলে যেতে হবে এই ব্যাপারটা স্টুপিড। কিন্তু ছেলেটা এতোই লাজুক যে কথাটা বলতে পারছিল না। অন্য আরেকটা যে-কাজ করি আমরা তা হলো অভিক্ষেপণ করা (project)।

সেটা আবার কী?

আমরা যখন অভিক্ষেপণ করি তখন আমরা আমাদের নিজেদের যে-সব বৈশিষ্ট্য চেপে রাখতে চাইছি সেগুলো অন্যের ওপর আরোপ করি। যেমন ধরো, যে-লোক হাড় কেপ্পন সে-লোক অন্যদেরকেও কঞ্জুস হিসেবে বর্ণনা করবে। আর যে-লোক স্বীকার করতে চায় না যে সে সব সময় যৌনতা তাড়িত থাকে, দেখা যাবে সে-ই অন্য কারো যৌন আসক্তির ব্যাপারে সবার আগে তেড়ে উঠছে।

হুম্

ফ্রয়েড দাবি করলেন যে, আমাদের দৈনন্দিন জীবন এ-ধরনের নির্জন (unconscious) মেকানিজমে পরিপূর্ণ। বিশেষ কোনো লোকের নাম ভুলে ভুলে যাই আমরা, কথা বলার সময় বেখেয়ালে নিজেদের গায়ের জামা-কাপড় ধরে টানি অথবা ঘরের মধ্যে অহেতুক এটা-ওটা জিনিস এদিক-সেদিক সরাই। এছাড়াও, আমরা কথা বলতে গিয়ে শব্দ হাতড়ে বেড়াই, মুখ বা কলম ফসকে এমন কথা বলে বা লিখে ফেলি যা দেখে মনে হতে পারে সেগুলো পুরোপুরি নির্দোষ। ফ্রয়েডের বক্তব্য হচ্ছে, এ-সব ভুল ততোটা আকস্মিক বা নির্দোষ মোটই নয় যতটা আমরা ভাবি। সত্যি বলতে কী, তালগোল পাকানো এ-সব কাজ অত্যন্ত গোপন কিছু কথা ফাঁস করে দিতে পারে।

এখন থেকে আমার সব কথা খুব সাবধানে খেয়াল করবো আমি।

তারপরেও তুমি তোমার অবচেতন তাড়না বা আবেগের কাছ থেকে পালাতে পারবে না। মোক্ষম কৌশলটা হচ্ছে অপ্রীতিকর ব্যাপার-স্যাপার অবচেতনের মধ্যে চাপা দেয়ার ব্যাপারে খুব বেশি চেষ্টা না করা। ব্যাপারটা জলহঁদুরের বাসার মুখ বন্ধের চেষ্টা করার মতো। এ-ব্যাপারে তুমি নিশ্চিত থাকতে পারো যে ইঁদুরটা বাগানের অন্য কোনো না কোনো জায়গা খুঁড়ে মাথা চাড়া দেবেই। চেতন আর অবচেতনের মধ্যেকার দরজাটা খোলা রাখাটাই আসলে স্বাস্থ্যের জন্যে ভালো খুব।

দরজাটা বন্ধ করে দিলে লোকে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে, ঠিক?

হ্যাঁ। একজন স্নায়বিক পীড়াগ্রস্ত (neurotic) মানুষ তিনিই যিনি তার চেতনাজগৎ থেকে অপ্রীতিকর জিনিসকে দূরে সরিয়ে রাখতে খুব বেশি শক্তি ব্যয় করেন। বিশেষ একটা অভিজ্ঞতাকে চাপা দিতে মরিয়া হয়ে চেষ্টা করেন তিনি বার বার। তারপরেও কিন্তু তিনি তার সেই গোপন যন্ত্রণার সূত্র খুঁজে পেতে ডাক্তারের সাহায্যের জন্যে উদগ্রীব হয়ে উঠতে পারেন।

ডাক্তার কাজটা কী করে করেন?

ফ্রয়েড একটা কৌশল আবিষ্কার করেছিলেন, যার নাম তিনি দিয়েছিলেন অবাধ অনুষঙ্গ (free association)। অন্য কথায় বলতে গেলে, রোগীকে তিনি আয়েশ করে শুতে দিয়ে তার মনে যা আসে-তা সে যতই অপ্রাসঙ্গিক, আকস্মিক, অপ্রীতিকর বা অস্বস্তিকর শোনাক না কেন-স্রেফ তাই-ই বলতে দিতেন। উদ্দেশ্যটা হলো সেই যন্ত্রণাগুলোর ওপর যে ঢাকনা পড়েছে বা নিয়ন্ত্রণ আরোপিত হয়েছে সেটা ভেঙে ফেলা, তার কারণ এ-সব যন্ত্রণাই রোগীকে অস্থির করে তুলছে। সব সময়ই সক্রিয় আছে সেগুলো, যদিও ঠিক সচেতনভাবে নয়।

কোনো জিনিস যতই ভুলে থাকার চেষ্টা করুন না কেন ততোই সেটা অবচেতনভাবে আরো বেশি করে মনে পড়ে যায়, এটাই তো?

ঠিক তাই। আর সেই কারণেই অবচেতন থেকে আসা ইঙ্গিতগুলো সম্পর্কে সচেতন থাকাটা এতো জরুরি। ফ্রয়েডের মত অনুযায়ী, নিজ্ঞান মনগামী রাজপথ হচ্ছে আমাদের স্বপ্নগুলো। তাঁর প্রধান কাজ দি ইন্টারপ্রিটেশন্স অত্ ড্রিমস এই বিষয়ের ওপরেই লেখা আর সেটা প্রকাশিত হয়েছিল ১৯০০ সালে। তাতে তিনি দেখিয়েছেন যে আমাদের স্বপ্নগুলো আকস্মিক কোনো ব্যাপার নয়। স্বপ্নের মাধ্যমেই আমাদের চেতন মনের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে আমাদের নির্জন মন।

বলে যান।

রোগীদের নিয়ে বহু বছরের গবেষণার পর এবং অবশ্যই তার নিজের স্বপ্নগুলো ব্যাখ্যা করে ফ্রয়েড এই দৃঢ় সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে আমাদের সব স্বপ্নই ইচ্ছাপূরণ সংক্রান্ত। তিনি বললেন, শিশুদের মধ্যে তা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান। আইসক্রিম আর চেরি ফলের স্বপ্ন দেখে তারা। কিন্তু বড়দের বেলায়, পূরণ হতে চাওয়া ইচ্ছেগুলো থাকে ছদ্মবেশে। তার কারণ হলো, নিজেদেরকে আমরা যেসব কাজ করতে দিতে চাই তার ওপর একটা সেন্সরশীপ এমনকী ঘুমিয়ে থাকার সময়ও চলতে থাকে। আর যদিও এই সেন্সরশীপ বা দমন প্রক্রিয়া আমাদের জাগ্রত অবস্থায় যতটা সক্রিয় থাকে তার চেয়ে অনেক দুর্বল হয়ে পড়ে ঘুমের সময়, তারপরেও সেটা আমাদের স্বপ্নগুলোর মধ্যে সেই সব ইচ্ছেকে এমনভাবে বিকৃত করে ফেলে যে সেগুলোকে আমরা চিনতে পারি না।

সেজন্যেই স্বপ্নের ব্যাখ্যা দেবার দরকার হয়।

ফ্রয়েড দেখিয়েছেন যে, সকালে উঠে আমরা যে-স্বপ্নটির কথা মনে করি সেই আসল স্বপ্ন আর স্বপ্নটার আসল অর্থের মধ্যেকার পার্থক্যের কথা যেন আমরা অবশ্যই বিবেচনায় রাখি। সত্যিকারের স্বপ্নের ছবিটিকে, অর্থাৎ যে ফিল্ম বা ভিডিও-টি আমরা স্বপ্নে দেখি, সেটার নাম দিয়েছেন ফ্রয়েড ব্যক্ত স্বপ্ন (manifest dream)। স্বপ্নের এই আপাত বিষয়বস্তু সব সময়ই সেটার উপাদান বা দৃশ্যপট সগ্রহ করে আগের দিন থেকে। কিন্তু স্বপ্নটার মধ্যে গভীরতর একটা অর্থও থাকে, যেটা চেতনার কাছ থেকে লুকানো থাকে। ফ্রয়েড একে বলছেন সুপ্ত স্বপ্ন চিন্তা (latent dream thoughts) আর এই সব গুপ্ত চিন্তা, যে-সব নিয়েই আসলে স্বপ্নটি, সেগুলো দূর অতীত এই যেমন একেবারে আদি শৈশব থেকেও উৎসারিত হতে পারে।

তার মানে একটা স্বপ্নকে বুঝতে হলে আগে সেটাকে বিশ্লেষণ করতে হবে।

হ্যাঁ আর মানসিকভাবে অসুস্থ রোগীর বেলায় সে-কাজটা করতে হবে থেরাপিস্ট-এর সঙ্গে। তবে ডাক্তার কিন্তু স্বপ্নটার ব্যাখ্যা করেন না। রোগীর সাহায্য নিয়েই কেবল কাজটা করা সম্ভব তার পক্ষে। এ-রকম পরিস্থিতিতে ডাক্তার স্রেফ এক সক্রেটিসিয় ধাত্রী-র ভূমিকা পালন করেন, সেই ব্যাখ্যার কাজে সাহায্যে করেন।

আচ্ছা।

সুপ্ত স্বপ্ন চিন্তাকে ব্যক্ত স্বপ্ন উপাদানে রূপান্তরিত করার সত্যিকারের প্রক্রিয়ার নাম দিয়েছিলেন ফ্রয়েড স্বকৃতি (dream work)। আমরা এটাকে বলতে পারি স্বপ্নটা যা নিয়ে তার ওপর আবরণ দেয়া বা সেটাকে সাংকেতিক রূপ দেয়া। স্বপ্নের ব্যাখ্যা দেয়ার সময় আমাদেরকে অবশ্যই এর উল্টো প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে হবে এবং স্বপ্নটার বিষয়বস্তুতে পৌঁছুতে উপাদা-এর (motif) আবরণ ঘুচিয়ে ফেলতে হবে বা সেটাকে ডিকোড করতে হবে।

একটা উদাহরণ দিতে পারেন?

ফ্রয়েডের বইয়ে উদাহরণের কোনো কমতি নেই। তবে আমরা নিজেরাই সহজ এবং একান্তই ফ্রয়েডীয় একটা উদাহরণ তৈরি করে নিতে পারি। ধরা যাক, একটি যুবক স্বপ্ন দেখল তার এক তুতো বোন তাকে দুটো বেলুন উপহার দিয়েছে…

তো?

তো, তুমি নিজেই স্বপ্নটার ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করো না।

হুম…এখানে একটা ব্যক্ত স্বপ্ন আছে, ঠিক যেমনটি আপনি বলেছিলেন: এক যুবক তার তুতো বোনের কাছ থেকে দুটো বেলুন পেল।

বলে যাও।

আপনি বলেছেন দৃশ্যপটটা আসে সব সময় আগের দিনটি থেকে। কাজেই আগের দিন সে নিশ্চয়ই মেলায় গিয়েছিল বা সে হয়ত বেলুনের ছবি দেখেছিল খবরের কাগজে।

সেটা অবশ্য সম্ভব। তবে তার কিন্তু বেলুন শব্দটা দেখলেই চলে বা এমন কিছু যা তাকে বেলুনের কথা মনে করিয়ে দিয়েছিল।

কিন্তু স্বপ্নটা আসলে যা নিয়ে সেই সুপ্ত চিন্তাগুলো কী?

 তুমিই বলল। তুমিই তো ব্যাখ্যা দেবে।

হয়ত সে স্রেফ কয়েকটা বেলুন চেয়েছিল।

না, এভাবে হবে না। তবে তুমি ঠিকই বলেছ যে স্বপ্ন হলো আসলে একটা ইচ্ছাপূরণ। কিন্তু কোনো যুবক এক জোড়া বেলুন খুব তীব্রভাবে চাইছে এমনটা খুব কমই ঘটে। আর চাইলেও সেটা নিয়ে স্বপ্ন দেখার দরকার পড়বে না তার।

আমার মনে হয় আমি বুঝতে পেরেছিঃ আসলে সে তার সেই তুতো বোনকে চায় আর বেলুন দুটো হলো মেয়েটার দুই স্তন।

 হ্যাঁ, এই ব্যাখ্যাটা অনেক বেশি যুক্তিযুক্ত। আর, এটা আগে থেকেই ধরে নেয়া যায় যে যুবকটির ইচ্ছেটা তার জন্যে অস্বস্তির একটা কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এক অর্থে তাহলে, আমাদের স্বপ্নগুলো অনেক ঘোরানোনা-প্যাচানো?

হ্যাঁ, ফ্রয়েড বিশ্বাস করতেন যে আমাদের স্বপ্ন হচ্ছে একটি অবদমিত ইচ্ছার ছদ্ম পরিপূর্ণতা লাভ। তবে আমরা ঠিক কী অবদমিত করেছি সেটা ফ্রয়েড যখন ভিয়েনায় ডাক্তার ছিলেন সে-সময় থেকে যথেষ্ট পরিমাণ বদলে যেতে পারে। অবশ্য স্বপ্নের ছদ্মবেশী বিষয়বস্তু-র মেকানিজমটা একই রয়ে যেতে পারে।

হ্যাঁ, বুঝতে পারছি।

১৯২০-এর দশকে ফ্রয়েডের মনোসমীক্ষণ ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে বিশেষ কিছু মনোরোগীর চিকিৎসার ক্ষেত্রে। শিল্প সাহিত্যের জন্যেও কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল তাঁর নির্জন মনের তত্ত্ব।

শিল্পীরাও মানুষের নিজ্ঞান মানবিক জীবন সম্পর্কে উৎসাহী হয়ে উঠেছিলেন বুঝি?

ঠিক তাই, অবশ্য ফ্রয়েডের মনোসমীক্ষণের কথা প্রচারিত হওয়ার আগেই, উনবিংশ শতাব্দির শেষ দশকের সাহিত্যে এই ব্যাপারটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। তার মানে স্রেফ এই যে বিশেষ সেই সময়ে ১৮৯০-এর দশকে, ফ্রয়েডের মনোসমীক্ষণের আবির্ভাব নেহাত কাকতালীয় ব্যাপার ছিল না।

তার মানে আপনি বলতে চান সেই সময়কার স্পিরিটের মধ্যেই ওটা ছিল?

অবদমন (repression), প্রতিরক্ষামূলক প্রক্রিয়া (defense mechanism) বা যুক্তি প্রয়োগ (rationalzing)-এর মতো ঘটনা তিনি আবিষ্কার করেছেন বলে ফ্রয়েড নিজে কখনো দাবি করেননি। এ-সব মানবীয় অভিজ্ঞতা তিনিই প্রথম মনোরোগবিদ্যায় প্রয়োগ করেছেন মাত্র। সাহিত্যিক উদাহরণ দিয়ে নিজের তত্ত্ব ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রেও ওস্তাদ ছিলেন তিনি। কিন্তু যেমনটি আমি আগেই বলেছি, ১৯২০-এর দশক থেকে ফ্রয়েড-এর মনোসমীক্ষণ শিল্প ও সাহিত্যের ওপর আরো প্রত্যক্ষ প্রভাব ফেলতে শুরু করে।

কোন অর্থে?

কবি এবং চিত্রকাররা, বিশেষ করে পরাবাস্তববাদীরা অবচেতন মনের শক্তির ব্যাপারটা কাজে লাগাতে চেষ্টা করেছেন তাঁদের কাজে।

পরাবাস্তববাদীরা কারা?

পরাবাস্তব (suerrealism) শব্দটা এসেছে ফরাসী ভাষা থেকে এবং এর অর্থ হচ্ছে অতি-বাস্তবতা (super realism)। ১৯২৪ সালে আঁদ্রে ব্রেতোঁ (André Breton) একটি পরাবাস্তববাদী ইশতেহার প্রকাশ করেন, তাতে তিনি দাবি করেন যে অবচেতন মন থেকেই শিল্পের জন্ম হওয়া উচিত। এভাবেই শিল্পী সম্ভাব্য সবচেয়ে স্বাধীন অনুপ্রেরণা লাভ করবেন তার স্বপ্নের প্রতিচ্ছবি থেকে এবং কঠোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবেন একটি অতি বাস্তবতা অর্জনের দিকে, যেখানে স্বপ্ন এবং বাস্তবতার মধ্যে সীমারেখা মুছে গেছে। সচেতন মনের সেন্সরশীপ ভাঙা এবং শব্দ ও ছবিকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয়াটা একজন শিল্পীর জন্যেও জরুরি হতে পারে।

সেটা বুঝতে পারছি।

এক অর্থে, ফ্রয়েড দেখিয়েছেন যে প্রত্যেকের মধ্যেই একজন শিল্পী রয়েছে। শত হলেও, একটি স্বপ্ন ছোট্ট একটি শিল্পকর্ম আর প্রতি দিনই নতুন নতুন স্বপ্ন দেখি আমরা। তার রোগীদের স্বপ্নের ব্যাখ্যা দেয়ার জন্যে ফ্রয়েডকে প্রায়ই প্রতীকের একটা নিবিড় দুর্বোধ্য ভাষার ভেতর দিয়ে পথ করে এগুতে হতো। একটা ছবি বা সাহিত্যিক কোনো রচনা আমরা যেভাবে ব্যাখ্যা করি সেভাবে নয়।

প্রত্যেক রাতেই কি আমরা স্বপ্ন দেখি?

সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে যে আমরা আমাদের ঘুমের সময়ের বিশ শতাংশ সময় অর্থাৎ প্রতি রাতের এক থেকে দুই ঘণ্টা সময় ধরে স্বপ্ন দেখি। ঘুমের সময় যদি আমাদের বিরক্ত করা হয় তখন আমরা নার্ভাস এবং বিরক্ত হয়ে পড়ি। এর অর্থ স্রেফ এই যে প্রত্যেকেরই তার অস্তিত্বসূচক অবস্থার শৈল্পিক অভিব্যক্তি প্রকাশ করার সহজাত একটা প্রবৃত্তি আছে। শত হলেও, আমরা তো আমাদেরকে নিয়েই স্বপ্ন দেখি। আমরাই পরিচালক, আমরাই দৃশ্যপট রচনা করি এবং বিভিন্ন ভূমিকায় অভিনয় করি। যে-লোক বলে সে শিল্প বোঝে না সে আসলে নিজেকে ভালোভাবে চেনে না।

সেটা বুঝতে পারছি।

মানব মনের নানান বিস্ময় সম্পর্কে সমীহ জানানো কিছু প্রমাণও ফ্রয়েড হাজির করেছেন। তার রোগীদের নিয়ে কাজ করে তিনি এই ব্যাপারে নিশ্চিত হন যে আমরা যা দেখেছি, যে-সব অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গিয়েছি তার সবই আমরা আমাদের চেতনার গভীরে কোনো এক জায়গায় জমা করে রাখি। এবং এই অতীতস্মৃতির সবকিছুকেই আবার আলোতে নিয়ে আসা যায়। আমরা যখন কোনো কিছু মনে করতে গিয়ে ব্যর্থ হই আর তার একটু পরেই সেটা আমাদের জিভের ডগায় এসে পড়ে এবং তারও খানিক পরে সেটা হঠাৎ করে মনে পড়ে যায়, তখন আমরা আসলে সেই বিষয়টার কথা বলি যা আমাদের নির্জন মনে রয়ে গেছে আর হঠাৎ করেই আধ-খোলা দরজা দিয়ে সুড়ুৎ করে ঢুকে পড়েছে চেতনায়।

কিন্তু কখনো কখনো ব্যাপারটা বেশ সময় নেয়।

সব শিল্পী-ই এ-ব্যাপারে সচেতন। কিন্তু হঠাৎ করেই যেন সব দরজা আর দেরাজ হাট হয়ে খুলে যায়। সব কিছুই নিজে নিজে গড়িয়ে পড়তে থাকে আর আমরা পেয়ে যাই আমাদের দরকরি সব শব্দ, সব ছবি। এটা ঘটে তখন যখন আমরা নির্জন মনের ঢাকনাটা তুলে ফেলি। সোফি, এ-ব্যাপারটাকে আমরা অনুপ্রেরণা (inspiration) বলতে পারি। মনে হয় যেন যা কিছু আমরা আঁকছি বা লিখছি তা যেন আসছে বাইরের কোনো উৎস থেকে।

অনুভূতিটা নিশ্চয়ই খুব চমঙ্কার।

কিন্তু তোমার নিজেরও নিশ্চয়ই এ-রকম অভিজ্ঞতা হয়েছে। অতিক্লান্ত হয়ে পড়া বাচ্চাদের মধ্যেও অনুপ্রেরণা জিনিসটাকে কাজ করতে দেখবে তুমি প্রায়ই। মাঝে মাঝে তারা এতোই ক্লান্ত হয়ে পড়ে যে তাদেরকে দেখে মনে হয় তারা একেবারে পুরোপুরি জেগে আছে। হঠাৎ করেই একটা গল্প বলতে শুরু করে তারা, যেন যে-সব শব্দ বা কথা কথা তারা এখনো শেখেনি সেগুলো কোথা থেকে পেয়ে যাচ্ছে তারা। আসলে অবশ্য সেগুলো তাদের জানা শব্দই; সেই শব্দ আর ধারণাগুলো তাদের চেতনায় সুপ্ত অবস্থায় রয়েছে, কিন্তু এখন যখন সব সাবধানতা আর সেন্সরশীপ উধাও হয়ে গেছে, বেরিয়ে আসছে সেগুলো। কম-বেশি অসচেতন কোনো অভিব্যক্তিকে যুক্তি আর গভীর চিন্তা দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হতে না দেয়াটাও একজন শিল্পীর জন্যে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। ব্যাপারটা বোঝানোর জন্যে ছোট্ট একটা গল্প বলি?

নিশ্চয়ই।

গল্পটা কিন্তু খুবই সিরিয়াস আর করুণ।

 ঠিক আছে।

কোনো এক সময় শত-পা-বিশিষ্ট একটা প্রাণী ছিল যে তার একশোটা পায়ের সব কটাই ব্যবহার করে দুর্দান্ত নাচ নাচতে পারতো। সে যখনই নাচতো, বনের সব প্রাণী এসে জড়ো হতো তার নাচ দেখার জন্যে। আর যথারীতি তারা সবাই মুগ্ধ হয়ে যেতো তার সেই চমৎকার নাচ দেখে। অবশ্য একজন ছাড়া। একটা কচ্ছপ কিছুতেই সহ্য করতে পারতো না শতপদী সেই প্রাণীটার নাচ।

সেটা সম্ভবত হিংসার কারণে।

কী করে শতপদীটির নাচ বন্ধ করা যায় এই শুধু চিন্তা কচ্ছপটার। সে তো আর গিয়ে সোজা-সাপ্টা বলতে পারে না যে তার নাচ তার পছন্দ নয়। আর সে নিজে যে ওটার চেয়ে ভালো নাচে সে-কথাও তো সে বলতে পারে না, কারণ সেটা হবে নেহাতই সত্যের অপলাপ মাত্র। কাজেই শয়তানী একটা বুদ্ধি আঁটলো সে।

কী সেটা, শোনা যাক।

শতপদী প্রাণীটির কাছে একটা চিঠি লিখতে বসে গেল সে। হে অতুলনীয় শতপদী, তোমার দুর্দান্ত নাচের আমি একজন একনিষ্ঠ ভক্ত। নাচের সময় তুমি কীভাবে পা ফেল আমার তা জানতেই হবে। তুমি কি তোমার ২৮ নম্বর বাম পা ওঠানোর পর ৩৯ নম্বর ডান পা ওঠাও? নাকি তুমি তোমার ৪৪ নম্বর বাম পা ওঠানোর আগে ১৭ নম্বর ডান পা উঠিয়ে নাচ শুরু করো? রূদ্ধশ্বাস প্রত্যাশা নিয়ে তোমার উত্তরের অপেক্ষায় রইলাম। তোমার বিশ্বস্ত, কচ্ছপ।

কী নীচ!

 চিঠিটা পড়ার পরই শতপদীটি ভাবতে বসে গেল নাচার সময় আসলেই সে কী করে তাই নিয়ে। কোন পা-টা আগে ওঠায় সে? এবং তার পর কোনটা? শেষ পর্যন্ত কী হলো বলো তো দেখি?

শতপদীটা নিশ্চয়ই আর কোনোদিন নাচতে পারল না, তাই না?

ঠিক তাই। কল্পনাকে যৌক্তিক চিন্তা-ভাবনা যখন গলা টিপে মারে তখন ঠিক এমনটাই ঘটে।

খুবই করুণ গল্পটা।

মুক্ত হতে পারাটা একজন শিল্পীর জন্যে গুরুত্বপূর্ণ। পরাবাস্তববাদীরা এটাকেই কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন এমন একটা অবস্থায় নিজেদের ফেলে দিয়ে যখন সবকিছুই আপনা-আপনি ঘটে যাচ্ছে। তাদের সামনে সাদা একটা কাগজ থাকতো এবং কী লিখছেন সে-ব্যাপারে কোনো চিন্তা-ভাবনা না করেই লিখতে শুরু করতেন তাঁরা। এটাকে বলতেন তাঁরা স্বয়ংক্রিয় লেখা (automatic writing)। কথাটা এসেছে আসলে আধ্যাত্মবাদ (spiritualism) থেকে। সেখানে একজন মাধ্যম (medium) থাকেন যিনি বিশ্বাস করেন যে একটি বিদেহী আত্মা তাঁর কলমকে গাইড করছে। কিন্তু আমি ভেবেছিলাম এ-নিয়ে কালকে আলাপ করবো আমরা।

ঠিক আছে।

এক অর্থে, একজন পরাবাস্তববাদী শিল্পীও একজন মাধ্যম, অর্থাৎ একটা উপায় বা সংযোগ। তিনি তাঁর নিজের অবচেতনের মাধ্যম। তবে সমস্ত সৃজনশীল প্রক্রিয়ার মধ্যেই সম্ভবত নির্জন মনের ব্যাপার আছে, কারণ, সৃজনশীলতা বলতে আসলে আমরা কী বোঝাই?

আমার কোনো ধারণা নেই। ব্যাপারটা কি কোনো কিছু সৃষ্টি করা নয়?

ভালোই বলেছো আর সেটা ঘটে কল্পনা ও যুক্তির মধ্যে একটা সূক্ষ্ম পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে। কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই দেখা যায়, যুক্তি কল্পনার টুটি চেপে ধরে আর সেটা কিন্তু ভয়ংকর একটা ব্যাপার, কারণ কল্পনা ছাড়া সত্যিকারের নতুন জিনিস কখনোই সৃষ্টি হবে না। আমার ধারণা, কল্পনা হচ্ছে একটা ডারউইনিয় পদ্ধতির মতো।

দুঃখিত, এটা ঠিক বুঝলাম না।

মানে, ডারউইনবাদ অনুযায়ী, প্রকৃতির মিউট্যান্টগুলো একটির পর একটি দেখা দিলেও তাদের মধ্যে অল্প কটিকেই কেবল ব্যবহার করা যায়। মাত্র অল্প কটিই বাঁচার অধিকার লাভ করে।

তো?

আমরা যখন কোনো অনুপ্রেরণা আর একরাশ নতুন ধারণা পাই তখনও ঠিক একই ব্যাপার ঘটে। চেতনার মধ্যে চিন্তা-মিউট্যান্টগুলো দেখা দিতে থাকে একের পর এক, অন্তত আমরা যদি নিজেদের ওপর বড্ড বেশি সেন্সরশীপ আরোপ না করি সেক্ষেত্রে। তো, এ-সব চিন্তার অল্প কটিকেই কেবল ব্যবহার করা চলে। এখানে যুক্তি আপনা আপনিই চলে আসে। এটারও কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ রয়েছে। দিনের সগ্রহগুলো টেবিলের ওপর বিছিয়ে রাখার পর সেগুলো থেকে ঝাড়াই-বাছাই করতে যেন ভুলে না যাই আমরা।

তুলনাটা নেহাত মন্দ না।

 একবার কল্পনা করে দেখো তো আমাদের মাথায় যা আসে তার সব কিছুকেই যদি উচ্চারণ করতে দেয়া হয় তাহলে কী হবে! ডেস্কের দেরাজের ভেতর থেকে আমাদের নোটপ্যাডগুলো লাফ দিয়ে বেরিয়ে আসার কথা তো বাদই দেয়া গেল। আকস্মিক আবেগের ভারে ডুবে যেতো গোটা জগৎ, কোনো ধরনের ঝাড়াই বাছাই-এর বালাই থাকতো না।

যুক্তিই তাহলে এ-সব আইডিয়ার ভেতর থেকে বেছে নেয়ার কাজটা করে?

হ্যাঁ, তোমারও কি তাই মনে হয় না? যে-জিনিসটা নতুন সেটা হয়ত কল্পনা-ই তৈরি করে কিন্তু আসল নির্বাচনের কাজটা কল্পনা করে না। কল্পনা সৃজন (compose) করে না। শিল্পের প্রতিটি কাজই আসলে যা সেই সৃজনকর্মটি ঘটে কল্পনা আর যুক্তি বা মন আর চিন্তা-ভাবনার ভেতর একটা আশ্চর্য পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে, কারণ, সৃজনশীল প্রক্রিয়ার ভেতর দৈব-র (chance) একটা ভূমিকা সব সময়ই থাকবে। মেষ চরাতে হলে আগে তো সেগুলো তোমাকে ছেড়ে দিতে হবে।

.

জানলার বাইরে তাকিয়ে একেবারে স্থির হয়ে বসে রইলেন অ্যালবার্টো। আর, তিনি যখন ওখানে বসে আছেন, সোফি হঠাৎ লেকের ধারে উজ্জ্বল বর্ণের কিছু ডিজনী চরিত্রের একটা জটলা লক্ষ করল।

ওই যে গুফি, বলে উঠল সোফি, আর ডোনাল্ড ডাক আর তার ভাস্তেরা ..দেখুন, অ্যালবার্টো। আছে মিকি মাউস আর…

সোফির দিকে ঘুরে তাকালেন তিনি। হ্যাঁ, ব্যাপারটা বেশ করুণ, বুঝলে।

তার মানে?

আমাদেরকে এখানে মেজরের ভেড়ার পালের অসহায় শিকার বানানো হচ্ছে। অবশ্য, দোষটা আমার নিজের। ভাব-এর অবাধ অনুসঙ্গের কথাটা আমিই তুলেছিলাম।

নিজেকে আপনার কোনোভাবেই দোষী সাব্যস্ত করার দরকার নেই…

আমি আসলে আমাদের মতো দার্শনিকদের কাছে কল্পনার গুরুত্বের ব্যাপারে কিছু বলতে যাচ্ছিলাম। নতুন চিন্তা-ভাবনা করার জন্যে নিজেদেরকে মুক্ত হতে দেয়ার মতো যথেষ্ট সাহসী আমাদেরকে হতেই হবে। তবে এই মুহূর্তে লোকটা একটু বাড়াবাড়ি করছে।

সে-নিয়ে চিন্তা করবেন না।

এক্ষুণি আমি অনুধ্যানের (reflection) গুরুত্বের কথা বলতে যাচ্ছিলাম, অথচ দেখো, আমাদের সামনে হাজির করা হলো এই বেদনাদায়ক মূর্খামি। নিজের কাজে নিজেরই লজ্জা হওয়া উচিত লোকটার।

আপনি বুঝি আয়রনিকভাবে বললেন কথাটা এখন।

আয়রনিক সে, আমি নই। তবে একটা ব্যাপারে স্বস্তিতে আছি আমি-আর সেটাই আমার পরিকল্পনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

এবার কিন্তু আমি আসলেই সব তালগোল পাকিয়ে ফেলছি।

স্বপ্ন নিয়ে কথা বলেছি আমরা। সেটাতেও আয়রনির ছোঁয়া আছে খানিকটা। কারণ, মেজরের স্বপ্নের প্রতিচ্ছবি ছাড়া আমরা আর কী, বলো?

ওহ।

কিন্তু তারপরেও, একটা জিনিস কিন্তু ভেবে দেখেনি সে।

কী সেটা?

 হতে পারে সে তার স্বপ্ন সম্পর্কে অস্বস্তিকরভাবে সচেতন। আমরা যা বলি আর করি তার সব কিছু সম্পর্কেই সচেতন সে, ঠিক যেমন যে মানুষটি স্বপ্ন দেখছে সে স্বপ্নের ব্যক্ত স্বপ্নের ব্যাপারটা মনে রাখে। সে-ই তার কলম দিয়ে এসব করছে। কিন্তু যদিও আমরা পরস্পরকে যা বলি তার সব কিছুই সে মনে রাখে, তারপরেও কিন্তু এখনো পুরোপুরি ঘুম ভাঙেনি তার।

কী বলতে চাইছেন?

 সুপ্ত স্বপ্ন চিন্তাগুলোর কথা সে জানে না, সোফি। সে ভুলে যাচ্ছে যে এটাও একটা ছদ্ম স্বপ্ন।

আপনার কথাবার্তা বড়ো অদ্ভুত শোনাচ্ছে।

মেজর তাই মনে করছে। তার কারণ, সে তার নিজের স্বপ্নের ভাষা বুঝতে পারছে না। সেজন্যে আমাদের কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত। এতে করে যৎকিঞ্চিত স্বাধীনতা পাচ্ছি আমরা, বুঝলে। আর এই স্বাধীনতাটুকু নিয়েই শিগগিরই আমরা তার ঘোলাটে সচেতনতার বাইরে জোর করে বেরিয়ে আসবো, গরমকালে জলহঁদুর রোদের মধ্যে যেমন তিড়িং বিড়িং করে লাফায় ঠিক সে-রকম করে।

আপনার কি মনে হয় কাজটা আমরা করতে পারবো?

পারতেই হবে আমাদের। দু-একদিনের মধ্যেই তোমার সামনে নতুন একটা দিগন্ত খুলে দেবো আমি। তখন মেজর আর জানবে না জলহঁদুরগুলো কোথায় রয়েছে বা এরপর কোথায় মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে তারা।

কিন্তু হলামই না হয় আমরা ক্ষুদে স্বপ্নছবি, তারপরেও আমি আমার মায়ের মেয়ে। পাঁচটা বেজে গেছে। ক্যাপ্টেনের বাঁকে আমার বাড়িতে গিয়ে গার্ডেন পার্টির প্রস্তুতি নিতে হবে আমাকে।

হুম্…বাড়ি ফেরার পথে আমার একটা ছোট্ট উপকার করতে পারবে?

কী?

বাড়তি খানিকটা মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা কোরো। চেষ্টা কোরো পুরো পথটা মেজর যাতে তোমার দিকেই নজর রাখে কেবল। বাড়ি পৌঁছে তার কথা চিন্তা করার চেষ্টা কোরো। তখন সে-ও তোমার কথা ভাববে।

তাতে লাভ?

তাহলে আমি আমার গোপন পরিকল্পনাটা নিয়ে নির্বিঘ্নে কাজ করতে পারবো। মেজরের অবচেতন মনে ডুব দিতে যাচ্ছি আমি। ফের আমাদের দেখা হওয়ার আগ পর্যন্ত সেখানেই থাকবো আমি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *