১১. অ্যারিস্টটল

১১. অ্যারিস্টটল

…এক অতি খুঁতখুতে এবং সতর্ক বিন্যাসকারী যিনি আমাদের ধারণাগুলোকে পরিষ্কার করতে চেয়েছেন…

সোফির মা যখন বিকেলে দিবান্দ্রিা দিচ্ছেন, সে তখন নিজের গুহায় চলে এলো। গোলাপী খামটার ভেতরে এক মুঠো চিনি রেখে সেটার বাইরে প্রতি, অ্যালবার্টো লিখে দিয়েছে সে।

নতুন কোনো চিঠি আসেনি, কিন্তু খানিক পরেই সোফি কুকুরটার এগিয়ে আসার শব্দ শুনতে পেল।

হার্মেস! ডেকে উঠল সোফি। আর ঠিক তার পর মুহূর্তেই কুকুরটা বড়সড় একটা বাদামি খাম মুখে নিয়ে বেড়ার ভেতর দিয়ে পথ করে গুহার ভেতর এসে ঢুকল।

গুড বয়! সোফি হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল কুকুরটাকে, সিন্দুঘোটকের মতো ঘোঘোৎ করছে সেটা, শ্বাস নিচ্ছে জোরে জোরে। চিনির ডেলাসহ গোলাপী খামটা নিয়ে সেটা কুকুরটার মুখে ধরিয়ে দিল সোফি। বুকে ভর দিয়ে বেড়ার ভেতর দিয়ে পথ করে আবার বনের দিকে চলে গেল কুকুরটা।

 বেশ একটা উত্তেজনা নিয়ে বড় খামটা খুলল সোফি, সেটাতে কেবিন আর নৌকো সম্বন্ধে কিছু লেখা আছে কিনা সে-কথা ভাবতে ভাবতে।

দেখা গেল, বরাবরের মতোই টাইপ করা কিছু পৃষ্ঠা একটা পেপারক্লিপ দিয়ে আটকান আছে খামটার মধ্যে। তবে সেই সঙ্গে ভেতরে আলাদা একটা কাগজও রয়েছে। তাতে লেখা:

প্রিয় মিস গোয়েন্দা, কিংবা, আরো সঠিকভাবে বললে, মিস সিঁদেল চোর, কেসটা এরিমধ্যে পুলিশের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে।

এমনি-ই বললাম। না, আমি রাগ করিনি। দর্শনের ধাঁধাগুলোর উত্তর বের করার জন্যেও যদি তুমি একই রকম কৌতূহলী হও তাহলে বলব তোমার সেই অ্যাডভেঞ্চারটি সত্যিই বেশ সম্ভাবনাময় ছিল। তবে আমাকে ১২৬

এখন একটু ঝামেলা করে অন্য কোথাও সরে যেতে হবে। তারপরেও, আমার ধারণা, ব্যাপারটার জন্যে আমিই দায়ী। আমার জানা উচিত ছিল যে তুমি সেইসব মানুষের দলে যারা সবসময় কোনো কিছুর শেষ না দেখে সন্তুষ্ট হয় না।

—শুভেচ্ছা, অ্যালবার্টো

হাঁফ ছেড়ে বাঁচল সোফি। উনি তাহলে রাগ করেননি। কিন্তু তাঁকে ওখান থেকে অন্যখানে সরে যেতে হবে কেন?

কাগজগুলো নিয়ে সে দৌড়ে উঠে এলো তার ঘরে। তার মা যখন ঘুম থেকে উঠবেন তখন বাড়িতে থাকাটাই বিচক্ষণের কাজ হবে। বিছানায় আয়েশ করে শুয়ে অ্যারিস্টটল সম্পর্কে পড়তে শুরু করল সে।

.

দার্শনিক এবং বৈজ্ঞানিক

প্রিয় সোফি: প্লেটোর ভাবতত্ত্ব সম্পর্কে পড়ার পর তুমি সম্ভবত বেশ আশ্চর্য হয়ে গেছে। কিন্তু এই দলে তুমি একা নও! ব্যাপারটা তুমি পুরোপুরি ধরতে পেরেছে কিনা বা তোমার কোনো সমালোচনামূলক মন্তব্য ছিল কিনা জানি না। কিন্তু যদি থেকে থাকে তাহলে জেনো, একই রকমের সমালোচনা অ্যারিস্টটলও (Aristotle, খ্রিস্ট পূর্ব ৩৮৪-৩২২) করে গেছেন। প্রায় বিশ বছর তিনি প্লেটোর একাডেমির একজন ছাত্র ছিলেন।

অ্যারিস্টটল এথেন্সে জন্মগ্রহণ করেননি। তিনি জন্মেছিলেন মেসিডোনিয়ায় এবং প্লেটোর বয়স যখন ৬১ তখন তার একাডেমিতে এসেছিলেন তিনি। অ্যারিস্টটলের বাবা ছিলেন একজন সম্মানিত চিকিৎসক, কাজেই তিনি বিজ্ঞানীও বটে। এই পারিপার্শ্বিক অবস্থা থেকেই অনুমান করা যায় অ্যারিস্টটলের দর্শনের মূল বিষয় কী ছিল। প্রকৃতি পর্যবেক্ষণেই সবচেয়ে বেশি উৎসাহী ছিলেন তিনি। তিনি কেবল গ্রীসের শেষ মহান দার্শনিকই ছিলেন না, ছিলেন ইউরোপের প্রথম মহান জীববিজ্ঞানী।

আরো বেশ খানিকটা এগিয়ে গিয়ে এ-কথা বলা যায় যে শাশ্বত আকার বা ভাব নিয়ে প্লেটো এতোটাই মগ্ন ছিলেন যে প্রকৃতিতে যে-সব পরিবর্তন ঘটে সেদিকে নজর দেয়ার কোনো অবসরই পাননি তিনি বলতে গেলে। অন্যদিকে অ্যারিস্টটল ব্যস্ত থেকেছেন ঠিক এই সব পরিবর্তন নিয়েই, বা যাকে আমরা এখন বলি প্রাকৃতিক ঘটনাবলী তাই নিয়ে।

আরো দুঃসাহসী হয়ে বলা যায় ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে। থেকেছেন প্লেটো, চারদিকে আমরা যা দেখি সেগুলোর দিকে চোখ তুলে তাকাননি। (গুহা থেকে পালিয়ে গিয়ে শাশ্বত ভাব-জগতে বিচরণ করতে চেয়েছেন তিনি!) অ্যারিস্টটল করেছেন এর ঠিক উল্টো কাজটি। চার হাত পায়ে হামাগুড়ি দিয়ে পর্যবেক্ষণ করে গেছেন ব্যাঙ, মাছ, বায়ু-পরাগী ফুল অ্যানিমন আর পপিফুল।

 প্লেটো যেখানে তার প্রজ্ঞা ব্যবহার করেছেন অ্যারিস্টটল সেখানে সেই সঙ্গে তার ইন্দ্রিয়গুলোকেও কাজে লাগিয়েছেন।

দুজনের মধ্যে বিস্তর ফারাক লক্ষ করি আমরা, তাদের লেখার মধ্যে সে-ফারাক আরো বেশি বৈ কম নয়। প্লেটো ছিলেন কবি এবং পুরাণবিদ। অ্যারিস্টটলের লেখাগুলো বিশ্বকোষের লেখাগুলোর মতো নীরস কিন্তু যথাযথ। অন্যদিকে, তিনি যা লিখেছেন তা লিখেছেন একেবারে সাম্প্রতিক ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণের ওপর ভিত্তি করে।

প্রাচীনকালের নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, তিনি সম্ভবত ১৭০টি বই লিখেছিলেন। তার মধ্যে ৪৭ টি সংরক্ষণ করা গেছে। এগুলো অবশ্য সম্পূর্ণ বই নয়; এগুলোর বেশির ভাগই লেকচার নোট। তার সময়েও দর্শন ছিল মূলত একটি মৌখিক বা বাচনিক কর্মকাণ্ড।

ইউরোপিয় সংস্কৃতিতে অ্যারিস্টটলের গুরুত্বের আরো একটি বড় কারণ হচ্ছে বিজ্ঞানীরা আজ যে-সব পরিভাষা ব্যবহার করেন সেগুলোও তাঁরই অবদান। তিনি ছিলেন এক মহান বিন্যাসকারী যিনি নানান বিজ্ঞানের ভিত্তি স্থাপন এবং সেগুলোর শ্ৰেণী বিন্যাস করেছিলেন।

অ্যারিস্টটল যেহেতু সব ধরনের বিজ্ঞানের ওপরই লিখেছেন, আমি কেবল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি ব্যাপারে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখবো। প্লেটো সম্পর্কে অনেক কথা বলেছি আমি তোমাকে, এখন তাহলে শোনো তাঁর ভাবতত্ত্বকে অ্যারিস্টটল কীভাবে নাকচ করলেন। তারপর আমরা নজর দেবো অ্যারিস্টটল কীভাবে নিজের প্রকৃতিবাদী দর্শন রচনা করলেন সেদিকে, কারণ তাঁর আগের প্রকৃতিবাদী দার্শনিকেরা যা কিছু বলে গেছেন সে-সবের সার-সংক্ষেপ তৈরি করেছেন অ্যারিস্টটল-ই। আমরা দেখবো কী করে তিনি আমাদের ধারণাগুলোর শ্রেণী বিন্যাস করেছেন এবং যুক্তিবিদ্যাকে (Logic) একটি বিজ্ঞান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আর সবশেষে আমি বলব মানুষ এবং সমাজ সম্পর্কে অ্যারিস্টটলের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে কিছু কথা।

.

সহজাত ভা বলতে কিছু নেই

প্লেটো তার আগের দার্শনিকদের মতোই সমস্ত পরিবর্তনের মাঝে শাশ্বত এবং অপরিবর্তনীয়ের সন্ধান করেছেন। এই অনুসন্ধানের ফলস্বরূপ তিনি পেয়েছিলেন নিখুঁত ভাবগুলোকে যা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের চেয়ে উন্নত শ্রেণীর। প্লেটো আরো বিশ্বাস করতেন যে প্রকৃতির সমস্ত কিছুর চেয়ে ভাব বেশি বাস্তবতাসম্পন্ন। ভাব ঘোড়া প্রথমে এসেছে, তারপর এসেছে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের সমস্ত ঘোড়া, সেই গুহার দেয়ালের ছায়াগুলোর মতো নাচতে নাচতে। সমস্ত মুরগি আর ডিমের আগে এসেছে ভাব মুরগি।

অ্যারিস্টটলের কাছে মনে হলো প্লেটো পুরো ব্যাপারটাই একেবারে উল্টে দিয়েছেন। তিনি তার শিক্ষকের সঙ্গে এ-বিষয়ে একমত হলেন যে ঘোড়া বয়ে চলে এবং কোনো ঘোড়া-ই চিরকাল বাঁচে না। তিনি আরো স্বীকার করলেন যে ঘোড়ার প্রকৃত আকার শাশ্বত এবং অপরিবর্তনীয়। কিন্তু ভাব ঘোড়া স্রেফ একটা ধারণা মাত্র, যে-ধারণা আমরা মানুষেরা বেশ কিছু ঘোড়া দেখার পর তৈরি করেছি। অ্যারিস্টটলের ধারণা অনুযায়ী, ভাব বা আকার ঘোড়া তৈরি হয়েছে ঘোড়ার বৈশিষ্ট্যগুলোর সমন্বয়ে আর এর ওপর ভিত্তি করেই আজ আমরা যেটকে অশ্ব প্রজাতি বলি তার সংজ্ঞা নির্মিত হয়েছে।

আরো সঠিকভাবে বলতে গেলে: আকার ঘোড়া দিয়ে অ্যারিস্টটল সেটাকেই বুঝিয়েছেন যা সব ঘোড়ারই বৈশিষ্ট্য। আর, এখানে কিন্তু জিঞ্জারব্রেড ছাঁচটার উপমা খাটবে না, কারণ, একটি বিশেষ জিঞ্জারব্রেড বিস্কিট-এর ওপর ছাঁচটার অস্তিত্ব নির্ভর করে না। অ্যারিস্টটল এমন কোনো ছাঁচ বা আকারের অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেন না যেগুলো প্রাকৃতিক জগতের বাইরের কোনো জগতে তাদের নিজেদের তাকের ওপর শুয়ে থাকে। উল্টো বরং, অ্যারিস্টটলের বিবেচনায় আকার রয়েছে বস্তুর মধ্যেই, কারণ এই আকারগুলোই এ-সব জিনিসের বিশেষ বৈশিষ্ট্য।

কাজেই অ্যারিস্টটল প্লেটোর সঙ্গে এই বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করলেন যে ভাব মুরগি আসল মুরগির আগে এসেছে। অ্যারিস্টটল যাকে ভাব মুরগি বলেছেন তা মুরগির কিছু নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য হিসেবে প্রতিটি মুরগির মধ্যেই বিদ্যমান, এই যেমন, মুরগি ডিম পাড়ে। কাজেই বাস্তবের মুরগি আর ভাব মুরগি দেহ ও আত্মার মতোই অবিচ্ছেদ্য।

আর এটাই আসলে প্লেটোর ভাবতত্ত্ব সম্পর্কে অ্যারিস্টটলের সমালোচনার সার কথা। চিন্তার জগতে এটি যে একটি অত্যন্ত নাটকীয় একটি বাক সে-কথা উপেক্ষা করলে কিন্তু চলবে না। প্লেটোর তত্ত্বে সর্বোচ্চ স্তরের বাস্তবতা হলো তাই যা আমরা আমাদের প্রজ্ঞা দিয়ে ভাবি। ঠিক একইভাবে অ্যারিস্টটলের কাছে সর্বোচ্চ স্তরের বাস্তবতা হলো সেটা যা আমরা আমাদের ইন্দ্রিয়গুলোর সাহায্যে প্রত্যক্ষ করি। প্লেটো মনে করতেন প্রাকৃতিক জগতে আমরা যেসব জিনিস দেখতে পাই সেগুলো ভাব জগতের সর্বোচ্চ স্তরের বাস্তবতায় অর্থাৎ মানব আত্মায় থাকা জিনিসগুলোর প্রতিবিম্ব ছাড়া কিছু নয়। অ্যারিস্টটল এর বিপরীতটিই বিশ্বাস করতেন: মানব আত্মায় যে-সব জিনিস বর্তমান সেগুলো স্রেফ প্রকৃতির নানান বস্তুর প্রতিবিম্ব ছাড়া কিছু নয়। কাজেই প্রকৃতি-ই হচ্ছে বাস্তব জগৎ। অ্যারিস্টটলের মতে, প্লেটো একটি পৌরাণিক বিশ্বের ছবিতে বন্দি হয়ে পড়েছিলেন, যেখানে মানব-কল্পনাকেই ভুল করে বাস্তব জগৎ বলে মনে করা হতো।

অ্যারিস্টটল এই বলে মন্তব্য করেছিলেন যে চেতনায় এমন কোনো কিছু নেই যা পঞ্চ ইন্দ্রিয় প্রথমে প্রত্যক্ষ করেনি। প্লেটো হলে বলতেন প্রাকৃতিক জগতে এমন। কিছু নেই যা প্রথমে ভাব-জগতে ছিল না। অ্যারিস্টটল মনে করতেন এভাবে প্লেটো আসলে জিনিস-পত্রের সংখ্যা দ্বিগুণ করে ফেলেছিলেন। একটি ঘোড়াকে তিনি ব্যাখ্যা করতেন ভাব ঘোড়া দিয়ে। কিন্তু সোফি, এটা কী রকম ব্যাখ্যা হলো? ভাব ঘোড়াটা কোথা থেকে এলো, আমার প্রশ্ন সেটাই। তাহলে কি একটা তৃতীয় ঘোড়াও থাকতে হয় না, ভাব ঘোড়াটা যার অনুকরণ মাত্র?

অ্যারিস্টটল মনে করতেন আমরা যা দেখেছি এবং শুনেছি সে-সবের মধ্যে দিয়েই আমাদের সমস্ত ভাবনা-চিন্তা এবং ধারণা আমাদের চেতনায় প্রবেশ করেছে। কিন্তু সেই সঙ্গে আমাদের রয়েছে প্রজ্ঞার একটি সহজাত শক্তি। প্লেটো যেমনটি মনে করতেন সে-রকম কোনো সহজাত ভাব বা ধারণা আমাদের নেই ঠিকই, কিন্তু ইন্দ্রিয়গত সমস্ত অভিজ্ঞতাকে নানান বিষয় ও শ্ৰেণী অনুযায়ী বিন্যস্ত করার একটা সহজাত শক্তি আমাদের সবারই আছে। এভাবেই পাথর, গাছ, জীব-জন্তু, এবং মানুষ সংক্রান্ত ধারণার জন্ম হয়। একইভাবে জন্ম হয় ঘোড়া, গলদা চিংড়ি আর ক্যানারি সংক্রান্ত ধারণাও।

অ্যারিস্টটল মনে করতেন মানুষ সহজাত প্রজ্ঞার অধিকারী। অন্যদিকে, অ্যারিস্টটল এটাও মনে করতেন যে, প্রজ্ঞাই মানুষের সবচেয়ে চোখে পড়ার মতো বৈশিষ্ট্য। কিন্তু কিছু প্রত্যক্ষ করার আগ পর্যন্ত আমাদের প্রজ্ঞা পুরোপুরি অসার। কাজেই মানুষের কোনো সহজাত ভাব নেই।

.

জিনিসের কা সেটার বিশেষ বৈশিষ্ট্য

প্লেটোর ভাবতত্ত্বের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে অ্যারিস্টটল এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন যে বিভিন্ন পৃথক পৃথক জিনিস দিয়েই বাস্তবতা তৈরি হয় আর এ-সব বিভিন্ন জিনিসই আকার এবং সারবস্তু-র (substance) ঐক্য রক্ষা করে। সারবস্তু হলো একটি জিনিস যা দিয়ে তৈরি তাই, অন্যদিকে আকার হচ্ছে প্রতিটি জিনিসের নির্দিষ্ট সব বৈশিষ্ট্য।

একটা মুরগি হয়ত তোমার সামনে ডানা ঝাঁপটাচ্ছে, সোফি। মুরগিটা যে ডানা ঝাঁপটায়, কক্ কক্ করে ডাকে, ডিম পাড়ে, ঠিক এগুলোই মুরগির আকার। কাজেই একটি মুরগির আকার বলতে আমরা এর প্রজাতিটির নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যগুলোর কথা বা অন্য কথায় এটা কী করে তাই বুঝিয়ে থাকি। মুরগিটা যখন মারা যায়, কক্ কক করে আর ডাকে না, তখন সেটার আকার-ও বিলুপ্ত হয়। যা থাকে তা হচ্ছে (দুঃখের বিষয় সোফি) স্রেফ মুরগিটার সারবস্তু, কিন্তু তখন আর ওটা মুরগি থাকে না।

আগেই বলেছি, সোফি, অ্যারিস্টটল চিন্তিত ছিলেন প্রকৃতিতে ঘটা সমস্ত পরিবর্তন নিয়ে। সারবস্তু-র মধ্যে সব সময়ই একটি নির্দিষ্ট আকারকে পরিণতি দানের সম্ভাবনা থাকে। আমরা বলতে পারি যে, সারবস্তু সব সময় চেষ্টা করে একটি সহজাত সম্ভাবনা অর্জন করার। অ্যারিস্টটলের মতে প্রকৃতির প্রতিটি পরিবর্তনই হলো সম্ভাবনা থেকে বাস্তবতায় সারবস্তুর রূপান্তর।

ঠিক আছে, বুঝিয়ে বলছি, সোফি। এই মজার গল্পটা তোমাকে সাহায্য করতে পারে কিনা দেখো। এ্যানিট পাথরের একটা বিশাল টুকরো নিয়ে কাজ করছেন একজন ভাস্কর। আকারহীন পাথরের টুকরোটাকে প্রতিদিন কেটে চলেছেন তিনি। একদিন একটি ছোট্ট ছেলে এসে তাঁকে জিগ্যেস করে, কী খুঁজছ তুমি ওটার ভেতর? অপেক্ষা করলেই দেখতে পাবে, ভাস্কর জবাব দেন। কিছুদিন পর ফিরে আসে ছোট্ট বালকটি, ততদিনে ভাস্কর গ্র্যানিট পাথরের টুকরো কেটে চমৎকার একটি ঘোড়র ভাস্কর্য তৈরি করে ফেলেছেন। অবাক হয়ে সেটার দিকে তাকিয়ে থাকে বালকটি, তারপর ভাস্করের দিকে ঘুরে শুধোয়, কী করে জানলে তুমি যে ঘোড়াটা ছিল এখানে?

সত্যি-ই তো, তিনি কী করে জানলেন! এক অর্থে, এ্যানিট পাথরের টুকরোটির মধ্যে ভাস্কর ঘোড়র আকার সত্যিই দেখতে পেয়েছিলেন তার কারণ একটি ঘোড়ার আকৃতিতে গঠিত হওয়ার সম্ভাবনা এ্যানিট পাথরের বিশেষ সেই টুকরোটির মধ্যে ছিল। একইভাবে, অ্যারিস্টটল মনে করতেন যে প্রকৃতির প্রতিটি জিনিসেরই একটি বিশেষ আকার ধারণ করার বা অর্জন করার সম্ভাবনা রয়েছে।

 সেই মুরগি আর ডিমের প্রসঙ্গে ফিরে যাওয়া যাক। মুরগির ডিমের সম্ভাবনা রয়েছে মুগরি হওয়ার। এ-কথার অর্থ এই নয় যে পৃথিবীতে যত মুরগির ডিম আছে তার সবগুলোই মুরগি হয়, ভাজা ডিম সেদ্ধ ডিম ইত্যাদি হিসেবে সে-সবের অনেকগুলোই সকালে নাশতার টেবিলে চলে যায়, তাদের সম্ভাবনার বাস্তবায়ন না ঘটিয়েই। তবে এ-কথা পানির মতো স্পষ্ট যে মুরগির ডিম হাঁস হতে পারে না। সেই সম্ভাবনা একটি মুরগির ডিমের নেই। কাজেই, একটি জিনিসের আকার যেমন সেটার সম্ভাবনার কথা বলে, তেমনি সেটার সীমাবদ্ধতার কথাও বলে।

অ্যারিস্টটল যখন বিভিন্ন জিনিসের সারবস্তু এবং আকারের কথা বলেন, তখন তিনি কেবল জীবম্ভ সত্তার কথা বোঝন না। মুরগির আকার যে-রকম কক্ কক্ করে ডাকা, ডানা ঝাঁপটানো আর ডিম পাড়া, ঠিক সে-রকম পাথরের আকার হচ্ছে মাটিতে পড়ে যাওয়া। মুরগি যেমন কক কক না করে থাকতে পারে না, পাথরও তেমনি মাটিতে না পড়ে থাকতে পারে না। তুমি অবশ্য একটা পাথর তুলে নিয়ে অনেক উঁচুতে ছুঁড়ে দিতে পারো, কিন্তু পাথরের স্বভাব যেহেতু মাটিতে পড়া কাজেই তুমি সেটাকে চাদে পাঠিয়ে দিতে পারবে না। (এই পরীক্ষাটা করার সময় অবশ্য সাবধানে থাকতে হবে তোমাকে, প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে পাথরটা সংক্ষিপ্ততম পথ ধরে পৃথিবীতে ফিরে আসতে পারে।)

.

অন্তিম কার

আকার সম্পন্ন সমস্ত সপ্রাণ ও প্রাণহীন জিনিসের কথা ছেড়ে যে-আকার সে-সব জিনিসের সম্ভাব্য কাজ (এর কথা বলে) অন্য প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে আরেকটা কথা আমাকে বলতেই হচ্ছে যে প্রকৃতিতে কার্য-কারণ (causality) সম্পর্কে একটি অসাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অ্যারিস্টটলের।

আজ আমরা যখন কোনো কিছুর কারণ (cause) নিয়ে কথা বলি তখন আমরা আসলে এটাই বুঝিয়ে থাকি যে ব্যাপারটা কীভাবে ঘটল। জানলার কাঁচটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে তার কারণ পিটার সেটা লক্ষ্য করে একটা ঢিল ছুঁড়েছিলো; এক পাটি জুতো তৈরি হয়েছে তার কারণ চর্মকার কয়েক টুকরো চামড়া সেলাই করে এক সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন। কিন্তু অ্যারিস্টটল মনে করতেন পৃথিবীতে বিভিন্ন ধরনের কারণ আছে। সব মিলিয়ে চার ধরনের কারণের কথা বলেছেন তিনি। এ-সব কারণের মধ্যে তিনি অন্তিম কারণ (final cause) বলতে কী বুঝিয়েছেন সেটা বোঝা জরুরি।

জানলার কাচ ভাঙার ঘটনার ক্ষেত্রে এ-কথা জিগ্যেস করা খুবই যুক্তিসঙ্গত যে পিটার পাথরটা ছুঁড়েছিল কেন। প্রশ্নটা করে আমরা আসলে জানতে চাইছি, তার উদ্দেশ্য কী ছিল। এ-ব্যাপারে কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না যে জুতো তৈরির ব্যাপারেও উদ্দেশ্য-র একটা ভূমিকা ছিল। কিন্তু প্রকৃতির নিখাদ প্রাণহীন প্রক্রিয়া বা ঘটনাবলীর মধ্যেও অ্যারিস্টটল একই ধরনের একটি উদ্দেশ্য নিহিত রয়েছে বলে ভেবেছেন। একটা উদাহরণ দিচ্ছি তোমায়:

বৃষ্টি কেন হয়, সোফি? স্কুলে তুমি জেনে থাকবে যে বৃষ্টি হয় তার কারণ মেঘের জলীয় বাষ্প ঠাণ্ডা এবং ঘনীভূত হয়ে বৃষ্টির ফোঁটায় পরিণত হলে সেগুলো মাধ্যাকর্ষণ শক্তির টানে মাটিতে এসে পড়ে। এ-ব্যাপারে অ্যারিস্টটলও হয়ত দ্বিমত পোষণ করতেন না। কিন্তু সেই সঙ্গে তিনি এ-কথাটাও জুড়ে দিতেন যে এ-পর্যন্ত তুমি কারণগুলোর মধ্যে তিনটের কথা বলেছে। বস্তুগত কারণ (material cause) হচ্ছে এই যে বাতাস যখন ঠাণ্ডা হয়েছিল ঠিক সেই মুহূর্তে জলীয় বাষ্প উপস্থিত ছিল। কুশলী কারণ (efficient cause) হলো জলীয় বাষ্প ঠাণ্ডা হয়েছে এবং আকারগত কারণ (formal cause) এই যে পানির আকার বা স্বভাব হচ্ছে মাটিতে পড়া। কিন্তু এখানে এসে তুমি থেমে গেলে অ্যারিস্টটল এই কথাটা যোগ করতেন যে বৃষ্টি পড়ে তার কারণ বড় হওয়ার জন্যে গাছপালা এবং জীব-জন্তুর পানি দরকার। এটাকেই তিনি বলেছেন অন্তিম কারণ। বৃষ্টির ফোঁটাগুলোকে অ্যারিস্টটল একটি উদ্দেশ্য বরাদ্দ করেছেন।

পুরো ব্যাপারটা উল্টে দিয়ে আমরা এ-কথা বলতে পারি যে গাছপালা বড় হয় তার কারণ তারা জলীয় বাষ্প পায়। তফাত্তা তুমি নিশ্চয়ই ধরতে পারছো, সোফি, তাই না? অ্যারিস্টটল বিশ্বাস করতেন প্রকৃতির প্রতিটি জিনিসের পেছনে একটা উদ্দেশ্য আছে। বৃষ্টি হয়, যাতে গাছপালা বড় হতে পারে। কমলা এবং আঙুর জন্মে, যাতে লোকে তা খেতে পারে।

বর্তমান যুগের বৈজ্ঞানিক কারণ অনুসন্ধানের পদ্ধতি এটা নয়। আমরা বলি যে মানুষ এবং জীব-জন্তুর জীবনধারণের জন্যে খাদ্য এবং পানি দুটো প্রয়োজনীয় শর্ত। এই শর্ত দুটো পূরণ না হলে আমাদের অস্তিত্ব থাকতো না। কিন্তু তাই বলে আমাদের খাদ্য হওয়াটা পানি কিংবা কমলা লেবুর উদ্দেশ্য নয়।

এই কার্য-কারণ প্রসঙ্গে তাহলে কি অ্যারিস্টটল ভুল করলেন? কিন্তু তড়িঘড়ি করে সে-সিদ্ধান্তে যাওয়া উচিত হবে না। বহু মানুষই এ-কথা বিশ্বাস করে যে পৃথিবীটা যেমন ঠিক তেমন করেই ঈশ্বর এটাকে তৈরি করেছেন যাতে তার সমস্ত প্রাণী এখানে বাস করতে পারে। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে স্বাভাবিকভাবেই এ কথা দাবি করা যেতে পারে যে নদীতে পানি আছে কারণ, বেঁচে থাকার জন্যে জীব জম্ভ এবং মানুষের পানি প্রয়োজন। কিন্তু এটাতো ঈশ্বরের কথা হয়ে গেল। আমাদের কল্যাণের ব্যাপারে বৃষ্টির ফোঁটা বা নদীর পানির কোনো উৎসাহ বা স্বার্থ নেই।

.

যুক্তিবিদ্যা (Logic)

জগতের নানান জিনিসের মধ্যে আমরা কীভাবে পার্থক্য নির্ণয় করি সে-ব্যাপারে অ্যারিস্টটলের ব্যাখ্যায় আকার এবং সারবস্তু-র মধ্যে তফাৎটির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে।

আমরা যখন বিভিন্ন জিনিসের পার্থক্য বিচার করি তখন আসলে আমরা সেগুলোকে নানান দল বা শ্রেণীতে বিন্যস্ত করি। প্রথমে একটা ঘোড়া দেখি আমি, তারপর আরেকটা দেখি, তারপর আরেকটা। ঘোড়াগুলো সব যদিও হুবহু এক রকম নয়, কিন্তু সব কটিরই একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য আছে আর এই সাধারণ বৈশিষ্ট্যটিই ঘোড়ার আকার। অন্যদিকে যে-জিনিসটি স্বাতন্ত্র্যসূচক বা বিশেষ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত তা ঘোড়ার সারবস্তু-র অন্তর্ভুক্ত।

তো, এভাবেই আমরা প্রত্যেকটি জিনিস একেকটি খোপে রাখতে শুরু করি। গরুগুলোকে রাখি গোয়ালে, ঘোড়াগুলোকে আস্তাবলে, শুয়োরগুলোকে শুয়োরের খোয়াড়ে আর মুরগিগুলোকে মুরগির খোপে। সোফি অ্যামুন্ডসেন যখন তার ঘর গোছায় তখনো ঠিক এই ব্যাপার ঘটে। বইগুলোকে সে রাখে বই-এর তাকে, স্কুলের বইগুলো স্কুলের ব্যাগে আর ম্যাগাজিনগুলোকে ড্রয়ারে। তারপর সে তার কাপড় চোপড় সুন্দর করে ভাঁজ করে রেখে দেয় ক্লজেটে-এক তাকে অন্তর্বাস, আরেকটাতে সোয়েটারগুলো আর মোজাগুলোকে রাখে সেগুলোর জন্যে নির্দিষ্ট একটি ড্রয়ারে। খেয়াল করে দেখো, ঠিক একই ব্যাপার আমরা আমাদের মনের মধ্যেও করি। পাথরের তৈরি জিনিস, উলের তৈরি জিনিস, রাবারের তৈরি জিনিস, এ-সব সহজেই চিনে ফেলি আমরা। বুঝতে পারি বা আলাদা করে চিনতে পারি জীবন্ত বা মৃত জিনিসগুলো, চিনে নেই সজি, জম্ভ বা মানুষ।

 বুঝতে পারছো নিশ্চয়ই সোফি? প্রকৃতির ঘরের সব কিছু গুছিয়ে ফেলতে চেয়েছিলেন অ্যারিস্টটল। তিনি দেখতে চেয়েছিলেন যে প্রকৃতির সব কিছুই বিভিন্ন শ্ৰেণী বা উপশ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। (হার্মেস একটি জীবন্ত প্রাণী, আরো নির্দিষ্ট করে বললে একটি স্তন্যপায়ী প্রাণী, আরো নির্দিষ্ট করে বললে একটি কুকুর, আরো নির্দিষ্ট করে বললে একটি ল্যাব্রাডর, আরো নির্দিষ্ট করে বললে একটি মর্দা ল্যাব্রাডর।)

নিজের ঘরে গিয়ে মেঝে থেকে একটা কিছু, যে-কোনো কিছু, তুলে নাও, সোফি। সেটা যা-ই হোক না কেন, দেখতে পাবে যে তুমি যা ধরে আছো সেটা উচ্চতর একটা শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। যেদিন তুমি এমন কিছু দেখতে পাবে যা তুমি কোনো শ্রেণীতে ফেলতে পারছে না সেদিন কিন্তু তুমি একটা ধাক্কা খাবে। উদাহরণস্বরূপ, একদিন যদি তুমি ছোট্ট একটা না-জানি-কী আবিষ্কার করো এবং বলতে না পারে সেটা প্রাণী, না সজি না খনিজ, তাহলে কিন্তু আমার মনে হয় না ওটা ধরার সাহস তোমার হবে।

প্রাণী, সজি আর খনিজের কথা বলতে গিয়ে একটা পার্টি গেম এর কথা মনে পড়ে গেল আমার, এই খেলাটায় চোরকে ঘরের বাইরে পাঠিয়ে দেয়া হয় এবং সে। যখন ফিরে আসে তখন তাকে বলতে হয় ঘরের বাকি সবাই কী চিন্তা করছে। সবাই আসলে ঠিক করেছে তারা ফ্লাফি নামের বেড়ালটার কথা ভাববে, বেড়ালটা এখন। পাশের বাড়ির বাগানে আছে। ঘরের মধ্যে এসে চোর অনুমান করতে শুরু করে। তার উত্তরে অন্যরা হ্যাঁ অথবা না দিয়ে জবাব দেবে। সে যদি অ্যারিস্টটলের একজন ভালো অনুসারী হয়ে থাকে তাহলে অবশ্য সে আর চোর থাকবে না-তাহলে খেলাটা অনেকটা এরকম হবে বলে ধরে নেয়া যায়:

এটা কি নিরেট কোনো কিছু (হা!) খনিজ? (না!) এটার কি প্রাণ আছে? (হ্যাঁ।) সজি? (না!) জম্ভ? (হা!) এটা কি একটা পাখি? (না!) কোনো স্তন্যপায়ী প্রাণী? (হ্যা!) এটা কি পুরোটাই একটা প্রাণী? (হা!) এটা কি একটা বেড়াল? (হাঃ) এটা কি ফ্লাফি? (হা অ্যা…সমস্বরে হাসি…)

 তো, এই খেলাটা আসলে অ্যারিস্টটলই আবিষ্কার করেছিলেন। প্লেটোকে আমরা দেবো লুকোচুরি খেলা আবিষ্কারের কৃতিত্ব। আর ডেমোক্রিটাসকে তো এরিমধ্যে লেগো আবিষ্কারক হিসেবে ঘোষণাই করা হয়ে গেছে।

অ্যারিস্টটল ছিলেন একজন অতি খুঁতখুতে বিন্যাসকারী যিনি আমাদের সব ধারণাকে পরিষ্কার করতে চেয়েছিলেন। সত্যি বলতে কী, তিনিই যুক্তিবিদ্যার স্রষ্টা। কিছু কার্যকর সিদ্ধান্ত বা প্রমাণের ওপর নির্ভর করে বেশ কিছু সূত্র দাঁড় করিয়ে গেছেন তিনি। একটা উদাহরণ দিলেই পরিষ্কার হয়ে যাবে। প্রথমে যদি আমি প্রমাণ করতে পারি যে সমস্ত জীবন্ত প্রাণীই মরণশীল (প্রথম সূত্র) এবং তারপর প্রমাণ করতে পারি যে হার্মেস একটি জীবন্ত প্রাণী (দ্বিতীয় সূত্র), তাহলে আমি অনায়াসে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে পারি যে হার্মেস মরণশীল।

এই উদাহরণ থেকে এটা পরিষ্কার যে অ্যারিস্টটলের যুক্তিবিদ্যা বিভিন্ন রাশি বা পদ (term)-এর মধ্যেকার সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে স্থাপিত হয়েছে, এই ক্ষেত্রে জীবন্ত প্রাণী এবং মরণশীল। যদিও আমাদেরকে স্বীকার করতে হবে যে ওপরে। সিদ্ধান্তটা ১০০% ভাগ সত্য, কিন্তু সেই সঙ্গে এ-কথাটাও আমরা যোগ করতে পারি যে এটা মোটেই নতুন কিছু জানাচ্ছে না আমাদের। (হার্মেস একটি কুকুর আর সব কুকুরই জীবন্ত প্রাণী, যা কিনা মরণশীল, এভারেস্ট পর্বতের পাথরের মতো নয়।) অবশ্যই আমরা সেটা জানতাম, সোফি। কিন্তু বিভিন্ন জিনিসের শ্রেণীর মধ্যেকার সম্পর্ক সব সম। এতো স্পষ্ট নয়। মাঝে মধ্যেই আমাদের ধারণাগুলোকে পরিষ্কার করে নেয়ার দরকার হতে পারে।

উদাহরণস্বরূপ প্রশ্ন করা যেতে পারে, ছোট ছোট ইঁদুরের বাচ্চা কি মেষশাবক এবং শুয়োর শাবকের মতোই স্তন্যপান করে? ইঁদুর নিশ্চয়ই ডিম পাড়ে না (নাকি দেখেছি আমরা কখনো কোনো ইঁদুরের ডিম?)। কাজেই বোঝা গেল তারা শুয়োর এবং ভেড়ার মতো জীবন্তু বাচ্চা প্রসব করে। কিন্তু আমরা তাদেরই জন্তু বলি যারা জীবন্ত স্তন্যপায়ী শাবক প্রসব করে-আর স্তন্যপায়ী হচ্ছে সেই ধরনের জম্ভ যারা তাদের মায়ের দুধ খায়। এই তো আমরা জায়গামতো পৌঁছে গেছি। উত্তরটা আমাদের ভেতরেই ছিল কিন্তু সেটা আমাদের চিন্তা করে বের করতে হলো। কিছুক্ষণের জন্যে আমরা ভুলে গিয়েছিলাম যে ইঁদুরেরা তাদের মায়ের স্তন্য পান করে। ভুলে যাওয়ার কারণ সম্ভবত এই যে আমরা কখনো কোনো বাচ্চা ইঁদুরকে স্তন্যপান করতে দেখিনি, তার কারণটা স্রেফ এই যে ইঁদুরেরা মানুষের উপস্থিতিতে বাচ্চাকে স্তন্য দিতে লজ্জা পায়।

.

প্রকৃতির স্কেল

অ্যারিস্টটল এই গোছগাছ করতে গিয়ে প্রথমেই দেখিয়েছেন যে প্রাকৃতিক জগতের জিনিসগুলোকে দুটো প্রধান শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। এক দিকে রয়েছে পাথর, পানির ফোঁটা বা মাটির ঢেলার মতো প্রাণহীন জিনিস। এ-সব জিনিসের মধ্যে পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনা নেই। অ্যারিস্টটলের মত অনুযায়ী, প্রাণহীন জিনিস বাইরের প্রভাব ছাড়া পরিবর্তিত হতে পারে না। কেবল জীবন্ত জিনিসগুলোরই পরিবর্তনের সম্ভাবনা রয়েছে।

জীবন্ত জিনিসগুলোকে অ্যারিস্টটল দুটো ভিন্ন শ্রেণীতে ভাগ করেছেন। তার একটিতে আছে উদ্ভিদ, অন্যটিতে প্রাণী। আর সবশেষে, এই প্রাণীগুলোকে আবার দুটো উপশ্রেণীতে ভাগ করা যেতে পারে, জম্ভ এবং মানুষ।

এ-কথা তোমাকে স্বীকার করতে হবে যে অ্যারিস্টটলের এই শ্রেণীগুলো স্পষ্ট এবং সরল। প্রাণহীন এবং জীবন্ত জিনিসগুলোর মধ্যে বিশেষ একটা পার্থক্য রয়েছে, উদাহরণস্বরূপ, একটা গোলাপ ফুল আর একটা পাথরের কথা বলা যেতে পারে; ঠিক একইভাবে, একটি উদ্ভিদ এবং একটি পশুর মধ্যেও বিশেষ পার্থক্য রয়েছে, যেমন একটি গোলাপ এবং একটি ঘোড়া। আমি এ-ও বলবো যে ঘোড়া এবং মানুষের মধ্যেও যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই পার্থক্যটা ঠিক কী? বলতে পারো আমাকে?

দুর্ভাগ্যবশত, উত্তরটা লিখে সেটা এক মুঠো চিনির সঙ্গে একটা খামের মধ্যে তোমার পুরে দেয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করার সময় নেই আমার, কাজেই জবাবটা আমি নিজেই দিচ্ছি। অ্যারিস্টটল যখন প্রাকৃতিক জিনিসগুলোকে শ্রেণীবিন্যাস করেন তখন তার মাপকাঠি বা মানদণ্ড হলো সেই জিনিসটির বৈশিষ্ট্যসমূহ, বা আরো সঠিকভাবে বললে সেটা কী করতে পারে বা করে।

 যেসব জিনিসের প্রাণ আছে (যেমন উদ্ভিদ, জীব-জন্তু, মানুষ) তারা পুষ্টিগ্রহণ করতে পারে, বেড়ে উঠতে পারে এবং নিজেদের সংখ্যাবৃদ্ধি করতে পারে। সমস্ত জীবম্ভ প্রাণী (জীব-জম্ভ এবং মানুষ) আরো একটি বাড়তি গুণের অধিকারী আর সেটা হলো তারা তাদের চারপাশের জগৎ প্রত্যক্ষ করতে পারে অর্থাৎ সেটা সম্পর্কে সচেতন হতে পারে এবং ঘুরে ফিরে বেড়াতে পারে। তাছাড়া, সব মানুষের চিন্তা ভাবনা করার ক্ষমতা রয়েছে, বা অন্যভাবে বললে, তারা তাদের উপলব্ধিকে বিভিন্ন দল এবং শ্রেণীতে বিন্যস্ত করতে পারে।

কাজেই বোঝা যাচ্ছে, প্রাকৃতিক জগতে আসলে সে-রকম কোনো স্পষ্ট বিভাজন রেখা বা সীমানা নেই। সামান্য ঝোঁপঝাড় থেকে আরো জটিল গাছপালা, ছোট ছোট জন্তু-জানোয়ার থেকে শুরু করে আরো বড় বড় জটিল ধরনের প্রাণীর দিকে একটা পর্যায়ক্রমিক রূপান্তর লক্ষ করি আমরা। এই স্কেল-এর একেবারে ওপরে রয়েছে। মানুষ, অ্যারিস্টটলের মতে যারা প্রকৃতির পুরো জীবনটি উপভোগ করে। মানুষ গাছপালার মতোই জন্মায় এবং পুষ্টিগ্রহণ করে, তার কিছু বিশেষ বিশেষ আবেগ অনুভূতি থাকে, জীব-জন্তুর মতো সে চলাফেরা করে বেড়াতে পারে, কিন্তু সেই সঙ্গে মানুষ হিসেবে আবার তার একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে আর সেটা হলো যুক্তিসঙ্গতভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা।

সুতরাং বলা যায়, মানুষের মধ্যে ঐশ্বরিক প্রজ্ঞার একটি স্ফুলিঙ্গ রয়েছে, সোফি। হ্যাঁ, ঐশ্বরিক কথাটা আমি সচেতনভাবেই বলেছি। কারণ, কিছুক্ষণ পরপরই অ্যারিস্টটল আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন যে ঈশ্বর নামের একজন অবশ্যই আছেন যিনি প্রাকৃতিক জগতের সমস্ত কার্যক্রম শুরু করেছেন। কাজেই প্রকৃতির স্কেল-এ সবচেয়ে ওপরেই ঈশ্বরের স্থান।

অ্যারিস্টটল মনে করতেন গ্রহ এবং নক্ষত্রের গতিই পৃথিবীর যাবতীয় গতি বা ক্রিয়া-কর্ম নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু একটা কিছু নিশ্চয়ই আছে যা আবার এ-সব গ্রহ নক্ষত্রের গতি নিয়ন্ত্রণ করে। এই একটা কিছুকেই অ্যারিস্টটল বলেছেন আদি চালক (first mover) বা ঈশ্বর। আদি চালক নিজে কিন্তু স্থির, কিন্তু এটাই গ্রহ নক্ষত্রের তথা প্রকৃতির সমস্ত গতির আকারগত কারণ (formal cause)।

.

নীতিবিদ্যা

আবার মানুষের প্রসঙ্গে যাওয়া যাক, সোফি। অ্যারিস্টটলের মতে, মানুষের আকার আত্মা দিয়ে গঠিত, যে-আত্মার রয়েছে একটি উদ্ভিদ-সদৃশ অংশ, একটি প্রাণী-অংশ আর একটি বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন (rational) অংশ। তো, এবার তার প্রশ্ন: আমরা কীভাবে জীবনযাপন করবো? একটি সুন্দর জীবনযাপন করার জন্যে কী প্রয়োজন? আবার তারই উত্তর: মানুষ তার সমস্ত সামর্থ্য এবং যোগ্যতার পূর্ণ ব্যবহার করেই কেবল সুখী হতে পারে।

অ্যারিস্টটল মনে করতেন সুখ তিন ধরনের। প্রথম ধরনের সুখ হচ্ছে আনন্দ এবং উপভোগের জীবন। দ্বিতীয় রকমের সুখ হচ্ছে মুক্ত এবং দায়িত্ববান নাগরিকের জীবন আর তৃতীয় ধরনের সুখ হচ্ছে একজন চিন্তাবিদ ও দার্শনিকের জীবন।

কেউ যদি সুখ এবং পরিপূর্ণতা পেতে চায় তাহলে, অ্যারিস্টটলের মতে, তার জীবনে একই সঙ্গে এই তিন ধরনের সুখই থাকতে হবে। তার কাছে কোনো ধরনের ভারসাম্যহীনতার প্রশ্রয় নেই। তিনি যদি এখন জীবিত থাকতেন তাহলে হয়ত বলতেন যে যে-লোক শুধু তার শরীরটির উন্নতিসাধন করে সে ঠিক তার মতোই ভারসাম্যহীন যে কেবল তার মাথাকেই ব্যবহার করে। পুরোপুরি একপেশে এই দুই ধরনের জীবনই বিকৃত জীবন।

মানবসম্পর্কের বেলাতেও একই কথা খাটে। আর এখানে অ্যারিস্টটল মধ্য পন্থাই শ্রেষ্ঠ পন্থা (golden mean), এই নীতির সমর্থক। আমরা যেন ভীরু-ও না হই, দুঃসাহসীও না হই, বরং হই যেন সাহসী (সাহস খুব কম থাকাই ভীরুতা, খুব বেশি থাকাটা দুঃসাহসিকতা), কৃপণও না হই আবার অপব্যয়ীও না হই, বরং উদার হই (যথেষ্ট উদার না হওয়াই কৃপণতা, আবার বেশি উদার হওয়া অপব্যয়িতা)। খাওয়া-দাওয়ার বেলাতেও একই কথা প্রযোজ্য। খুব কম খাওয়াটাও বিপজ্জনক, বেশি খাওয়াটাও তাই। প্লেটো এবং অ্যারিস্টটল দুজনের নীতিশাস্ত্রই গ্রীসের চিকিৎসাশাস্ত্রের প্রতিধ্বনিস্বরূপ: কেবল সুষমতা এবং মিতাচার অভ্যাস করার মাধ্যমেই আমি একটি সুখী বা সুসামঞ্জস্যপূর্ণ জীবন লাভ করবো।

.

রাজনীতি

চরমপন্থার চর্চা যে কাম্য নয় সে-কথা অ্যারিস্টটল সমাজের প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিতেও প্রকাশ করেছেন। তার কথা হচ্ছে মানুষ স্বভাবতই একটি রাজনৈতিক প্রাণী। তিনি দাবি করেছেন, আমাদের চারপাশের সমাজ ছাড়া আমরা সত্যিকার অর্থে মানুষ নই। তিনি মন্তব্য করেছেন যে খাদ্য, আন্তরিকতা, বিয়ে এবং সন্তান-লালন পালন, আমাদের এ-সব প্রাথমিক চাহিদা পূরণ করে পরিবার এবং গ্রাম। তবে মানব সম্পর্কের চূড়ান্ত রূপ পাওয়া যাবে কেবল রাষ্ট্রর মধ্যে।

এই সূত্র ধরেই প্রশ্ন আসে রাষ্ট্র কীভাবে গঠিত হবে? (প্লেটোর দার্শনিক রাষ্ট্র-র কথা মনে আছে তোমার নিশ্চয়ই?) অ্যারিস্টটল তিনটি ভালো শাসনব্যবস্থার কথা বলে গেছেন। প্রথমটি হচ্ছে রাজতন্ত্র (monarchy/kingship), যার অর্থ রাষ্ট্রের মাথা থাকবে একজনই। এ-ধরনের শাসনব্যবস্থা কেবল ততক্ষণই ভালো থাকতে পারে যতক্ষণ তা স্বৈরতন্ত্র-তে পরিণত না হয়, অর্থাৎ এমন একটি অবস্থায় রূপ না নেয় যেখানে একজন শাসক তার নিজের স্বার্থ পূরণের জন্যে রাষ্ট্র পরিচালনা করে। আরেকটি ভালো শাসনব্যবস্থা হলো অভিজাততন্ত্র (aristocracy), যেখানে একটি বড় বা ছোট শাসকগোষ্ঠী রাষ্ট্র পরিচালনা করে। এই শাসনব্যবস্থাকে খেয়াল রাখতে হয় যেন তা গোষ্ঠীতন্ত্র (oligarchy) বা মুষ্টিমেয় কিছু লোকের শাসনব্যবস্থায় পরিণত না হয়। এই গোষ্ঠীতন্ত্রের একটি উদাহরণ হলো জানটা বা হুনটা (junta) বা সামরিক শাসকচক্র। তৃতীয় ভালো শাসনব্যবস্থাকে অ্যারিস্টটল বলেছেন পলিটি (polity) যার অর্থ গণতন্ত্র। কিন্তু এই শাসনব্যবস্থারও নেতিবাচক দিক আছে। এটি খুব তাড়াতাড়ি জনতার শাসনে পরিণত হতে পারে। (খোদ স্বৈরতন্ত্রী হিটলার যদি জার্মানীর রাষ্ট্রপ্রধান না-ও হতেন, তারপরেও তার অধীনস্ত নাৎসীরাই ভয়ংকর এক জনতার শাসন কায়েম করতে পারত।)

.

নারী প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি

সবশেষে নজর দেয়া যাক নারীর প্রতি অ্যারিস্টটলের দৃষ্টিভঙ্গির দিকে। দুর্ভাগ্যক্রমে তা প্লেটোর মতো ইতিবাচক ছিল না। অ্যারিস্টটল বরং এ-কথা বিশ্বাস করতেই আগ্রহী ছিলেন যে নারীরা এক অর্থে অসম্পূর্ণ মানুষ। নারী হচ্ছে অসমাপ্ত পুরুষ। অ্যারিস্টটলের মতে, বংশবৃদ্ধির ক্ষেত্রে নারী নিষ্ক্রিয় এবং গ্রহীতা, অন্যদিকে পুরুষ সক্রিয় এবং সৃজনশীল, কাণ, শিশু কেবল পুরুষের বৈশিষ্ট্য লাভ করে। তিনি বিশ্বাস করতেন যে শিশুর সমস্ত বৈশিষ্ট্যই নিহিত থাকে পুরুষের শুক্রাণুর ভেতর। নারী হচ্ছে মাটি, তা বীজ গ্রহণ করে এবং সেই বীজ থেকেই চারা গজায়, অন্যদিকে পুরুষ হচ্ছে বীজ বপনকারী। অথবা, অ্যারিস্টটলের ভাষায় বললে, পুরুষ দেয় আকার এবং নারী প্রদান করে সারবস্তু। অন্য সব দিক দিয়ে এতো বুদ্ধিমান এবং বিচক্ষণ একজন মানুষ যে নর-নারীর সম্পর্কের ব্যাপারে এমন ভুল করতে পারেন তা একই সঙ্গে আশ্চর্যজনক এবং অত্যন্ত দুঃখের বিষয়। কিন্তু এ-থেকে দুটো জিনিস প্রমাণিত হয়। প্রথমত, অ্যারিস্টটলের সম্ভবত নারী এবং শিশুর জীবনধারা সম্পর্কে খুব বেশি বাস্তব অভিজ্ঞতা ছিল না; দ্বিতীয়ত, দর্শন এবং বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে পুরুষকে একচ্ছত্র আধিপত্য দেয়া হলে কী প্রমাদ ঘটতে পারে সেটাও সহজে অনুমান করা যায়।

নর-নারী সম্পর্কে অ্যারিস্টটলের ভ্রান্তিপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি আরো বেশি মারাত্মক হয়ে দাঁড়িয়েছিল তার কারণ তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিরই একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল পুরো মধ্য যুগ ধরে, প্লেটোর নয়। এভাবেই গির্জা নারী সম্পর্কে এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গি লাভ করে যা বাইবেলের সঙ্গে আদৌ সঙ্গতিপূর্ণ নয়। যীশু নিশ্চয়ই নারীবিদ্বেষী ছিলেন না।

আজ এ-পর্যন্তই। তবে আবার কথা হবে আমাদের।

.

অ্যারিস্টটলের ওপর লেখা অনুচ্ছেদটা বার দেড়েক পড়া হয়ে যাওয়ার পর সেটাকে বাদামি খামের মধ্যে পুরে শূন্যের দিকে তাকিয়ে বসে রইল, সোফি। তার চারপাশের অগোছাল অবস্থা সম্পর্কে হঠাৎই সচেতন হয়ে উঠল সে। বইপত্তর আর রিং বাইণ্ডারগুলো মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। মোজা, সোয়েটার, টাইট আর জিন্সের প্যান্টের অর্ধেকটাই বেরিয়ে আছে ক্লজেট থেকে। রাইটিং ডেস্কটার সামনে যে-চেয়ারটা সেটার ওপর তূপ হয়ে আছে ময়লা জামা-কাপড়।

সব কিছু গোছগাছ করে ফেলবার ভীষণ একটা তাড়া অনুভব করল সোফি। প্রথমেই সে ক্লজেট থেকে সব কাপড়-চোপড় বের করে এনে মেঝেতে রাখল। একেবারে গোড়া থেকেই শুরু করা ভালো। তো, এরপর সে তার কাপড়-চোপড় খুব। সুন্দরভাবে ভাজ করে সেগুলো তাকের ওপর সাজিয়ে রাখতে শুরু করল। সাতটা তাক রয়েছে ক্লজেটে। একটা অন্তর্বাসের জন্যে, একটা মোজা আর টাইটস্-এর জন্যে আর একটা জিন্সের প্যান্টের জন্য। প্রত্যেকটা তাক ধীরে ধীরে ভরে ফেলল সে। কোথায় কোনটা রাখতে হবে সে-ব্যাপারে কোনো চিন্তা করতে হলো না তাকে। নিচের তাকটাতে রাখা প্লাস্টিকের একটা ব্যাগে চলে গেল ময়লা কাপড় চোপড়গুলো। তবে একটা জিনিস নিয়ে আসলেই সমস্যায় পড়তে হলো তাকে আর সেটা হচ্ছে হাঁটু পর্যন্ত লম্বা সাদা একটা মোজা। সমস্যাটা হচ্ছে জোড়ার দ্বিতীয়টা পাওয়া যাচ্ছে না। তারচেয়ে বড় কথা, মোজাটা সোফির-ই নয় আদৌ।

ভালো করে ওটা পরীক্ষা করে দেখল সোফি। মালিককে শনাক্ত করার মতো কিছুই পেল না সে, কিন্তু একজনের ব্যাপারে প্রবল সন্দেহ হলো তার। সবচেয়ে ওপরের তাকটায়, যেখানে লেগো, ভিডিও ক্যাসেট আর লাল স্কার্ফটা আছে সেখানে ওটা ছুঁড়ে দিল সে।

এরপর মেঝের দিকে নজর দিল সে। বই-পত্তর, রিং-বাইন্ডার, ম্যাগাজিন আর পোস্টার, এগুলো সব আলাদা করে ফেলল সে, দর্শনের শিক্ষক অ্যারিস্টটলের ওপর লেখা চ্যাপ্টারে যেভাবে বর্ণনা দিয়েছেন ঠিক সেভাবে। খালি একটা রিং বাইন্ডার আর একটা হোল পাঞ্চ খুঁজে বার করল সে, পাতাগুলোতে ফুটো করল, তারপর রিং বাইন্ডারে সেগুলো আটকে রাখল। এটাও ঠাই পেল সবচেয়ে ওপরের তাকটায়। পরে কোনো এক সময় গুহা থেকে বিস্কিটের টিনটা এনে রাখতে হবে তাকে।

এখন থেকে পরিপাটিভাবে সাজানো থাকবে জিনিসগুলো। আর সেটা যে কেবল তার ঘরের বেলাতেই প্রযোজ্য তা নয়। অ্যারিস্টটল সম্পর্কে পড়ার পর সে বুঝতে পেরেছে তার ধ্যান-ধারণাগুলোকে সুন্দরভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখাটাও সমান জরুরি একটা কাজ। সবচেয়ে ওপরের তাকটায় যে-সব জিনিস আছে সে-ধরনের জিনিসের জন্যেই তাকটা বরাদ্দ রেখেছে সে। ঘরের এই একটা জায়গার ওপরই। কেবল এখনো তার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।

প্রায় দুঘণ্টা কোনো সাড়াশব্দ নেই তার মায়ের। নিচে নেমে এলো সোফি। তাকে ঘুম থেকে জাগানোর আগে সে তার পোষা প্রাণীগুলোকে খাবার খাওয়াবে বলে ঠিক করল।

রান্নাঘরে গিয়ে গোল্ডফিশের গামলাটার ওপর ঝুঁকে পড়ল সে। একটা মাছ কালো, একটা কমলা আর একটা লাল-সাদা। এই জন্যেই সে এগুলোর নাম দিয়েছে ব্ল্যাক জ্যাক, গোল্ডটপ আর রেড রাইডিংহুড।

পানিতে মাছের খাবার ছড়িয়ে দিতে দিতে সে বলল:

‘তোরা পড়েছিস প্রকৃতির জীবন্ত প্রাণীগুলোর মধ্যে, তোরা খাদ্য আর পুষ্টি নিতে পারিস, বড় হতে পারিস, আবার নিজেদের বংশবৃদ্ধি করতে পারিস। আরো ঠিকমতো বললে, তোরা আসলে জীব-জগতের মধ্যে পড়েছিস। অর্থাৎ তোরা এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়াতে পারিস, জগৎটার দিকে চোখ মেলে তাকাতে পারিস। সংক্ষেপে বললে, তোরা হচ্ছিস মাছ, তোরা তোদের কানকো দিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাসের কাজ চালাস, জীবনদায়ী পানির মধ্যে সাঁতার কেটে ঘুরে ফিরে বেড়াতে পারিস।‘

মাছের খাবারের কৌটোটার ঢাকনা বন্ধ করে দিল সোফি। প্রকৃতির স্কেলে যেভাবে সে গোল্ডফিশকে রাখল তাতে বেশ সন্তুষ্ট হলো সে নিজেই। বিশেষ করে সে খুশি হলো জীবনদায়ী পানি কথাটার জন্যে। তো, এবার বাজারিগার দুটোর পালা।

 খানিকটা বার্ডসিড ওদের খাওয়ার কাপটায় ঢেলে দিয়ে সোফি বলে উঠল: প্রিয় স্মিট আর স্মিউল, তোরা দুই ছোট্ট সোনামণি বাজারিগার হয়েছিস তার কারণ ছোট্ট দুটো সুন্দর বাজারিগারের ডিম থেকে জন্মেছিস তোরা আর এই ডিমগুলোর বাজারিগার হওয়ার সম্ভাবনা ছিল বলেই বরাতজোরে তোরা কর্কশ গলা কাকাতুয়া হোসনি।

এরপর সোফি গেল বড় বাথরুমটায়, সেখানে বড়সড় একটা বাক্সের মধ্যে শুয়ে আছে কুঁড়ে কচ্ছপটা। সোফির মা গোসল করার সময় প্রায়ই এই বলে চেঁচিয়ে ওঠেন যে একদিন ওটাকে মেরে ফেলবেন তিনি। কিন্তু এ-পর্যন্ত সেটা একটা অসার হুমকি বলেই প্রমাণিত হয়েছে। একটা জ্যামের জার থেকে সোফি একটা লেটুস পাতা ছিঁড়ে নিয়ে বাক্সের মধ্যে রেখে দিল।

গোবিন্দ সোনা, সে বলল, তুই হয়ত তীরবেগে ছুটতে পারিস না, কিন্তু আমরা যে বিশাল জগত্তাতে বাস করি তার একটা ছোট্ট অংশকে তুই ঠিকই দেখতে, শুনতে আর বুঝতে পারিস। তবে একটা কথা জেনে তুই সন্তুষ্ট থাকতে পারিস যে তুই ছাড়াও আরো অনেকেই আছে যারা তাদের নিজেদের সীমা অতিক্রম করতে পারে না।

শিয়ার্কান নিশ্চয়ই ইঁদুর ধরতে বেরিয়েছে, শত হলেও সেটাই বেড়ালের স্বভাব। সোফি তার মায়ের ঘরে যাওয়ার জন্যে বসার ঘরটা পেরিয়ে এলো। কফি টেবিলের ওপর ফুলদানীতে এক গোছ ড্যাফোডিল রাখা। মনে হলো যেন, সোফি যাওয়ার সময় হলুদ ফুলগুলো ঝুঁকে তাকে কুর্নিশ করল। মুহূর্তের জন্যে থেমে দাঁড়িয়ে সেগুলোর মসৃণ চুড়োয় আলতো করে আঙুল রাখল সে। বলল, প্রকৃতির জীবন্ত অংশে তোরাও আছিস। সত্যি বলতে কী, যে-ফুলদানীটায় তোরা আছিস সেটার চেয়ে অনেক ভাগ্যবান তোরা। তবে দুর্ভাগ্যবশত সে-কথা উপলব্ধি করার মতো ক্ষমতা তোদের নেই।

এরপর সোফি পা টিপে টিপে ঢুকল গিয়ে তার মায়ের শোবার ঘরে। তার মা যদিও গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, তারপরেও তার কপালে একটা হাত রাখল সোফি।

সে বলল, তুমিই হচ্ছে সবচেয়ে সৌভাগ্যবানদের মধ্যে একজন। কারণ মাঠের লিলি ফুলগুলোর মতো তুমি কেবল জীবন্তই নও। এবং শিয়ার্কান আর গোবিন্দ-র মতো তুমি কেবল একটি জীবন্ত প্রাণীই নও। তুমি একজন মানুষ, ফলে তোমার রয়েছে চিন্তা-ভাবনা করার শক্তি।

কী ঘোড়ার ডিম বলছিস এ-সব, সোফি?

তার মা অন্যান্য দিনের চাইতে আগে উঠে পড়েছেন।

আমি শুধু এটাই বলছিলাম যে তোমাকে দেখতে একেবারে একটা কুঁড়ে কচ্ছপের মতো লাগছে। যাই হোক, তোমার অবগতির জন্যে জানাচ্ছি, আমি আমার ঘরটা একেবারে দার্শনিক পুঙ্খানুপুঙ্খতায় গুছিয়ে ফেলেছি।

সোফির মা মাথা তুললেন।

 এক্ষুণি আসছি আমি, বললেন তিনি। তুই একটু কফির পানিটা চাপিয়ে দিবি?

তাকে যা বলা হলো তাই করল সোফি, একটু পরেই দেখা গেল দুজনে কফি জুস আর চকোলেট সামনে নিয়ে রান্নাঘরে বসে পড়েছে।

হঠাৎ করেই সোফি জিগ্যেস করল, তুমি কি কখনো ভেবে দেখেছো, মা, আমরা কেন বেঁচে আছি?

ফের শুরু করলি?

করলাম, তার কারণ এখন আমি উত্তরটা জানি। এই গ্রহে লোকজন বেঁচে থাকে যাতে তারা ঘুরে ঘুরে প্রত্যেকটা জিনিসের একটা করে নাম দিতে পারে।

তাই বুঝি? সে কথা তো মনে হয়নি কখনো।

 সেক্ষেত্রে তোমার মধ্যে বড়সড় একটা সমস্যা রয়েছে, কারণ মানুষ হচ্ছে চিন্তা শীল প্রাণী। যদি চিন্তা-ভাবনা না করো তাহলে বলতে হবে তুমি ঠিক মানুষ নও।

সোফি!

একেবার ভাবো তো, শুধু যদি শাক-সজি আর জীব-জন্তু থাকত তাহলে কী হতো? বিড়াল আর কুকুর বা লিলি ফুল আর গুজবেরি-র মধ্যে তফাৎ কী সেটা বলে দেবার মতো কেউ থাকতো না। শাক-সজি আর জীব-জন্তুও জীবন্ত, কিন্তু আমরাই হচ্ছি একমাত্র প্রাণী যারা প্রকৃতিকে নানান দল আর শ্রেণীতে ভাগ করতে পারি।

তোর মতো এমন অদ্ভুত মেয়ে আমি আর একটাও দেখিনি, সোফির মা বললেন।

আমিও তাই মনে করি, প্রত্যেকেই কম-বেশি অদ্ভুত। আমি একজন ব্যক্তি, কাজেই আমি কম-বেশি অদ্ভুত। তোমার মেয়ে আছে সাকুল্যে একটি, কাজেই আমি সবচেয়ে অদ্ভুত।

আমি আসলে বলতে চেয়েছি যে তোর এ-সব নতুন নতুন কথা শুনে ভয়ে আমার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে।

তার মানে তুমি খুব সহজেই ভয় পাও।

পরে, সেদিনই বিকেলবেলা সোফি তার গুহায় গেল। তার মায়ের নজর এড়িয়েই বিস্কিটের টিনটা চুপিচুপি নিজের ঘরে পাচার করে দিতে সক্ষম হলো সে।

প্রথমে সে সব কটা পাতা ঠিকমতো সাজাল। তারপর সেগুলোর গায়ে ছিদ্র করে রেখে দিল রিং বাইরে, অ্যারিস্টটটলের ওপর লেখা চ্যাপ্টারটার আগে। সবশেষে প্রতি পৃষ্ঠার ওপরের ডান কোনায় নম্বর বসাল সে। সব মিলিয়ে পঞ্চাশ পৃষ্ঠা হয়েছে। সোফি দর্শনের ওপর তার নিজের বই সংকলনে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। বইটা তার লেখা নয় ঠিকই, তবে বিশেষভাবে তার জন্যেই লেখা।

সোমবারের হোমওয়ার্ক করার আর সময় রইল না তার হাতে। সম্ভবত ধর্মীয় জ্ঞান-এর ওপর একটা পরীক্ষা দিতে হবে তাদের, তবে তার শিক্ষক সব সময়ই বলেন যে তিনি ব্যক্তিগত কমিটমেন্ট আর মূল্যবোধকে গুরুত্ব দেন। সোফির মনে হলো এই দুক্ষেত্রেই খানিকটা ভিত্তি তৈরি হয়েছে তার মধ্যে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *