১০. মেজরের কেবিন
… দুই চোখ দিয়েই চোখ টিপল মেয়েটি..
সোয়া সাতটা বাজে কেবল। এখনই তড়িঘড়ি করে বাসায় যাওয়ার কোনো দরকার নেই। রোববার সোফির মা সব সময়ই একটু আয়েশ করেন, কাজেই সম্ভবত তিনি আরো ঘন্টা দুয়েক ঘুমোবেন।
বনের ভেতর খানিকটা এগিয়ে গিয়ে অ্যালবার্টো নক্সকে একটু খোঁজার চেষ্টা করলে কেমন হয়? তাছাড়া, কুকুরটা তার উদ্দেশে অমন বদমেজাজীর মতো ঘেউ ঘেউ করে উঠছিল কেন?
উঠে পড়ল সোফি, তারপর হার্মেস যেদিকে গিয়েছিল সেদিকেই পা বাড়াল। প্লেটোর ওপর লেখা পৃষ্ঠাগুলো ভরে-রাখা বাদামী খামটা হাতে তার। পথটা যেখানে দুভাগ হয়ে গেছে সেখানে এসে অপেক্ষাকৃত চওড়াটি বেছে নিল সে।
চারদিকে পাখিরা কিচিরমিচির করছে গাছে, আকাশে, ঝোপে, ঝাড়ে। তারা যথারীতি তাদের সকালের কাজে নেমে পড়েছে। রোববারের সঙ্গে সপ্তাহের অন্যান্য দিনের তফাৎ তাদের জানা নেই। এ-সব করতে কে শিখিয়েছে পাখিগুলোকে? ওদের প্রত্যেকের ভেতরেই কি ছোট্ট একটা কম্পিউটার আছে, তাতে প্রোগ্রাম করা আছে কী কী করতে হবে না হবে?
ছোট্ট একটা পাহাড়ের ওপর উঠে গেছে পথটা, তারপর খাড়াভাবে নেমে গেছে উঁচু উঁচু পাইন গাছের ভেতর দিয়ে। বনটা এদিকে এতো ঘন যে গাছের ভেতর দিয়ে কয়েক গজের বেশি দেখতে পাচ্ছে না সে।
হঠাৎ পাইন গাছের কাণ্ডগুলোর ভেতর দিয়ে চকচকে কিছু একটা নজরে পড়ল তার। নিশ্চয়ই কোনো লেক ওটা। পথটা অন্য দিকে বেঁকে গেছে, কিন্তু সোফি গাছগুলোর ভেতর দিয়েই এগিয়ে চলল। তার পা দুটো তাকে যেদিকে নিয়ে গেল ঠিক সেদিকেই চলতে থাকল সে, কেন তা ঠিক না বুঝেই।
একটা ফুটবল মাঠের চেয়ে বড় হবে না লেকটা। সেটার অপর পাড়ে ছোট্ট একটা ফাঁকা জায়গায় রুপোলি বার্চ গাছ বেষ্টিত লাল রঙ-করা একটা কেবিন চোখে পড়ল তার। হালকা ধোঁয়ার একটা রেখা চিমনি দিয়ে বেরুচ্ছে দেখা গেল।
পানির কিনারায় নেমে এলো সোফি। বেশ কিছু জায়গা কাদাটে হয়ে আছে অনেকটা, কিন্তু তারপরই একটা দাঁড়-টানা নৌকো দেখতে পেল সে। নৌকোটার অর্ধেকটা ডাঙায় টেনে তোলা। এক জোড়া বৈঠাও আছে নৌকোয়।
চারদিকে তাকাল সোফি। জুতো না ভিজিয়ে লেকটা ঘুরে লাল কেবিনটায় যাওয়া কোনোভাবেই সম্ভব হবে না তার পক্ষে। কাজেই দৃঢ় পায়ে নৌকোটার দিকে এগিয়ে গেল সে, তারপর ঠেলে পানিতে নামাল সেটাকে। চড়ে বসল নৌকোয়, দাঁড় বাঁধার নির্দিষ্ট জায়গায় বসালো দাঁড় দুটোকে, তারপর দাঁড় বেয়ে চলল আড়াআড়ি পথ ধরে। কিছুক্ষণের মধ্যেই উল্টো দিকের তীরে এসে ঠেকল নৌকোটা। নৌকো থেকে নেমে সেটাকে ডাঙায় তোলার চেষ্টা করল সে। উল্টো দিকের তীরটার চেয়ে এই তীরটা বেশি খাড়া।
কেবিনটার দিকে পা বাড়ানোর আগে একবার মাত্র ঘাড় ফিরে তাকাল সোফি।
নিজের সাহস দেখে নিজেই অবাক হয়ে গেল সোফি। কী করে এমন কাজ করার সাহস হলো তার? সে জানে না। যেন কিছু একটা বাধ্য করেছে তাকে কাজটা করতে। দরজার কাছে গিয়ে টোকা দিল সোফি। অপেক্ষা করল একটু, কিন্তু সাড়া দিল না কেউ। সাবধানে হাতলটা ঘোরানোর চেষ্টা করতেই খুলে গেল দরজাটা।
শুনছেন! বলে উঠল সে। বাড়িতে কেউ আছেন?
ভেতরে ঢুকে পড়ল সে, নিজেকে আবিষ্কার করল বসবার ঘরে। দরজাটা বন্ধ করে দেয়ার সাহস হলো না তার।
নিশ্চয়ই কেউ ছিল এখানে। পুরনো স্টোভটাতে চড়চড় করে কাঠ পোড়র আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে সে। এই একটু আগেও কেউ ছিল এখানে।
একটা বড়সড় খাবার টেবিলের ওপর একটা টাইপরাইটার, কিছু বই, দুটো পেন্সিল আর এক তাড়া কাগজ পড়ে আছে। একটা জানলার পাশে অপেক্ষাকৃত ছোট একটা টেবিল আর দুটো চেয়ার রয়েছে, জানলা থেকে দিব্যি দেখা যাচ্ছে লেকটা। ঘরে তেমন আর কোনো আসবাবপত্র নেই, যদিও একটা দেয়ালের পুরোটাই ঢাকা পড়ে গেছে সার বেঁধে রাখা বুক শেলফে এবং সেগুলো বইয়ে ঠাসা। সাদা একটা চেস্ট অভ ড্রয়ার্স-এর ওপরে ভারি পেতলে বাঁধানো বড় একটা আয়না ঝুলছে। দেখেই বোঝা যায় বেশ পুরনো ওটা।
একটি দেয়াল থেকে দুটো ছবি ঝুলছে। তার মধ্যে একটা তেলচিত্র, তাতে দেখা যাচ্ছে একটা সাদা বাড়ি, বাড়িটা একটা উপসাগর আর একটা বোট হাউসের কাছ থেকে সামান্য দূরেই দাঁড়িয়ে আছে। বাড়ি আর বোটহাউসের মাঝখানে আপেলগাছসহ ঢালু একটা বাগান, ঘন কয়েকটা ঝোঁপ আর কিছু পাথর। বার্চ গাছের একটা ঘন বেড়া মালার মতো ঘিরে আছে বাগানটাকে। তেলচিত্রটার নাম লেখা রয়েছে বিয়ার্কলে।
তেলচিত্রটার পাশেই একজন পুরুষ মানুষের প্রতিকৃতি ঝুলছে, মানুষটি একটি চেয়ারে বসে আছে একটা জানলার পাশে। তার কোলে একটি বই। এই চিত্রের পটভূমিতেও গাছ এবং পাথরসহ একটি ছোট্ট উপসাগর দেখা যাচ্ছে। চিত্রটি দেখে মনে হয় এটি আঁকা হয়েছে বেশ কয়েকশ বছর আগে। এই ছবিটির নাম বার্কলে। চিত্রকরের নাম লেখা রয়েছে সিমবার্ট।
বার্কলে এবং বিয়ার্কলে। কী অদ্ভুত।
সোফি তার তদন্ত চালিয়ে গেল। বসার ঘরের দরজা দিয়ে ছোট্ট একটা রান্নাঘরে যাওয়া যায়। কেউ একজন কয়েক পদ খাবার তৈরি করে রেখে গেছে। একটা তোয়ালের ওপর কিছু প্লেট আর গ্লাস পাকারে রাখা। সেগুলোর কোনো কোনোটাতে এখনো চকচক করছে সাবান পানির কিছু ফোঁটা। মেঝেতে পড়ে আছে একটা টিনের গামলা, তাতে কিছু ভুক্তাবশেষ। এখানে যে-ই থাকুক তার একটা পোষা প্রাণী আছে, কুকুর, নয় বেড়াল।
বসার ঘরে ফিরে এলো সোফি। আরেকটা দরজা দিয়ে ছোট্ট একটা শোবার ঘরে যাওয়া যায়। সেখানে বিছানার পাশে মেঝেতে দুটো কম্বলের পুরু বান্ডিল। কম্বল দুটোর ওপর কিছু সোনালী পশম আবিষ্কার করল সোফি। এই তো পাওয়া গেছে প্রমাণ। এইবার সোফি জেনে গেছে এই কেবিনের বাসিন্দারা হচ্ছে অ্যালবার্টো নক্স আর হামেস।
বসার ঘরে ফিরে আয়নাটার সামনে এসে দাঁড়াল সোফি। কাঁচটা সে-রকম দামি নয়, তাছাড়া সেটার গায়ে নানান আঁচড়ের ছড়াছড়ি। ফলে তার প্রতিচ্ছবিটি ঝাপসা দেখাচ্ছে। বাড়িতে গোসলখানায় সে যেমনটি করে থাকে, এখানেও সে নিজেকে ভেংচাতে লাগল। তার প্রতিচ্ছবিটিও, খুব স্বাভাবিকভাবেই, ঠিক তাই করতে থাকল।
কিন্তু হঠাৎ করেই একটা গা ছমছম করা ব্যাপার ঘটে গেল। স্রেফ একবার, সেকেন্ডের ভগ্নাংশের মধ্যে সোফি স্পষ্ট দেখতে পেল আয়নার মেয়েটা দুই চোখ বন্ধ করেই চোখ টিপল। চমকে পিছিয়ে এলো সোফি। সে নিজেই যদি ওভাবে চোখ টিপে থাকে তাহলে সে কী করে দেখতে পেল যে আয়নার মেয়েটাও চোখ টিপছে? তাছাড়া শুধু তাই নয়, মনে হলো যেন মেয়েটা সোফিকে এই কথা বলার জন্যেই চোখ টিপেছে যে আমি তোমাকে দেখতে পাচ্ছি, সোফি। এখানেই আছি আমি, আয়নার অন্য দিকে।
সোফি অনুভব করল তার বুক ধড়ফড় করছে আর ঠিক এই সময়েই সে শুনতে পেল দূরে একটা কুকুর ডেকে উঠল। হার্মেস! এক্ষুণি এখান থেকে বেরিয়ে পড়তে হচ্ছে তাকে। তখনই তার নজর চলে গেল আয়নার নিচে চেস্ট অত্ ড্রয়ার্স-এর ওপর রাখা একটা সবুজ ওয়ালেট-এর দিকে। তাতে একশো আর পঞ্চাশ ক্রাউনের একটা করে নোট আর স্কুলের একটা পরিচয়পত্র। পরিচয়পত্রে উজ্জ্বলবর্ণ চুলের একটি মেয়ের ছবি রয়েছে। ছবির নিচে লেখা রয়েছে মেয়েটির নাম: হিল্ডা মোলার ন্যাগ…
কেঁপে উঠল সোফি। আবার কুকুরের ডাক শুনতে পেল সে। এই মুহূর্তে বেরিয়ে পড়তে হবে তাকে।
সে যখন টেবিলের পাশ দিয়ে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে আসছে তখন হঠাৎ করেই বই আর কাগজের স্তূপের মাঝখানটায় সাদা একটা খাম নজরে পড়ল তার। খামটার গায়ে একটাই মাত্র শব্দ লেখা: সোফি।
সে কী করছে তা সে নিজেই বুঝে ওঠার আগে ছোঁ মেরে খামটা নিয়ে সেটা প্লেটো সম্পর্কে লেখা কাগজগুলো রাখা খামটার ভেতর ভরে ফেলল সোফি। তারপরেই এক ছুটে দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসে সশব্দে বন্ধ করে দিল সেটা।
কুকুরের ডাকটা ক্রমেই কাছে এগিয়ে আসছে। কিন্তু সবচেয়ে যেটা খারাপ ব্যাপার তা হলো নৌকোটা হাওয়া। অবশ্য দুএক সেকেন্ড পরেই সেটাকে দেখতে পেল সে, লেকের মাঝ বরাবর ভেসে চলে গেছে সেটা। একটা বৈঠা ভাসছে সেটার পাশে। আর এর সবই ঘটেছে যে-কারণে তা হলো নৌকোটা সে টেনে ডাঙায় পুরোপুরি তুলে রাখতে পারেনি তখন। কুকুরের ডাকটা বেশ কাছে চলে এসেছে। এখন, তাছাড়া লেকের অপর পাড়ে গাছের ফাঁক দিয়ে কীসের যেন নড়াচড়া দেখা যাচ্ছে।
আর ইতস্তত করল না সে। বাদামি খামটা হাতে নিয়ে তীর বেগে ঢুকে পড়ল কেবিনের পেছনের ঝোঁপ-ঝাড়ের ভেতর। একটু পরেই তাকে জলাময় অঞ্চলের ভেতর দিয়ে হাঁটা শুরু করতে হলে, বেশ কয়েকবার গোড়ালির বেশ খানিকটা ওপর পর্যন্ত ডুবে গেল তার পা। কিন্তু পা না চালিয়ে উপায় ছিল না তার। যে করেই হোক বাড়ি পৌঁছুতে হবে তাকে। একসময় একটা পথের ওপর হোঁচট খেয়ে পড়ল সে। এই পথ ধরেই কি এসেছিল সে? গায়ের কাপড় নিংড়ে পানি ঝরাবার জন্য থামল সে। আর তারপরই কাঁদতে শুরু করল সোফি।
এমন নির্বোধের মতো একটা কাজ সে কী করে করল? এর মধ্যে সবচেয়ে বাজে ব্যাপার হচ্ছে সেই নৌকোটা। একটা বৈঠা অসহায়ের মতো পাশে ভেসে থাকা অবস্থায় নৌকোটার সেই ছবিটা মন থেকে সরাতে পারছিল না সে। পুরো ব্যাপারটাই এতো অস্বস্তিকর, এতো লজ্জাজনক…
দর্শন শিক্ষক নিশ্চয়ই এতোক্ষণে লেকটার কাছে পৌঁছে গেছেন। বাড়ি ফেরার জন্যে নৌকোটা দরকার হবে তার। নিজেকে সোফির প্রায় অপরাধীর মতো মনে হলো। তবে কাজটা সে ইচ্ছে করে করেনি।
খামটা! ওটা বোধহয় আরো খারাপ হয়েছে। কেন সে নিতে গেল ওটা? সেটা অবশ্য এ-জন্যে যে তার নাম লেখা ছিল তাতে, কাজেই এক অর্থে ওটা তারই। কিন্তু তারপরেও নিজেকে কেমন চোরের মতো মনে হলো সোফির। সে-ই যে ওখানে গিয়েছিল তার প্রমাণ রেখে এসেছে সে।
খামটার ভেতর থেকে চিরকুটটা বের করে আনল সোফি। তাতে লেখা:
কোনটা আগে এসেছে-মুরগি না ‘ভাব’ মুরগি?
আমারা কি সহজাত ‘ভাব’ নিয়ে জন্মগ্রহণ করি?
একটি গাছ, প্রাণী আর মানুষের মধ্যে তফাৎ কী?
বৃষ্টি হয় কেন?
একটি সুন্দর জীবনযাপন করার জন্যে কী প্রয়োজন?
এ-সব প্রশ্ন নিয়ে চিন্তা করার মতো অবস্থা সোফির এখন নেই যদিও, কিন্তু সে ধারণা করল এগুলোর সঙ্গে পরবর্তী দার্শনিকের একটা সম্পর্ক রয়েছে। অ্যারিস্টটল নাম না তার?
শেষ পর্যন্ত সে যখন বনের ভেতর দিয়ে এতোটা পথ দৌড়ে এসে বেড়াটা দেখতে পেল তখন তার মনে হলো সে যেন জাহাজডুবির পর সাঁতরে তীরে এসে পৌঁছেছে। উল্টো দিক দিয়ে বেড়াটাকে হাস্যকর বলে মনে হলো।
হামাগুড়ি দিয়ে গুহায় ঢোকার আগে ঘড়ির দিকে চোখ যায়নি তার। সাড়ে দশটা বাজে। অন্যান্য কাগজের সঙ্গে বড় খামটা বিস্কিটের টিনের ভেতর রেখে দিল সে, তারপর নতুন প্রশ্নগুলো লেখা চিরকুটটা ঢুকিয়ে রাখল তার টাইটস্ এর ভেতর।
সে যখন বাড়িতে ঢুকল তার মা তখন টেলিফোনে কথা বলছেন। সোফিকে দেখতে পেয়ে তাড়াতাড়ি ফোনটা রেখে দিলেন তিনি।
.
কোথায় গিয়েছিলি তুই?
আমি…আমি একটু হাঁটতে গিয়েছিলাম…বনের মধ্যে, আমতা আমতা করে বলল সে।
তা তো দেখতেই পাচ্ছি।
চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল সোফি, তার কাপড় থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় পড়তে থাকা পানির দিকে তাকিয়ে থাকল।
জোয়ানাকে ফোন করছিলাম…
জোয়ানা?
তার মা কিছু শুকনো কাপড় এনে দিলেন তাকে। কোনো রকমে দার্শনিকের চিরকুটটা লুকোতে সক্ষম হলো সোফি। এরপর তারা দুজনে রান্নাঘরে গিয়ে বসল। তার মা গরম চকোলেট ড্রিংক বানালেন খানিকটা।
তুই কি ওঁর সঙ্গেই ছিলি? খানিক পর জিগ্যেস করলেন তিনি।
ওঁর সঙ্গে?
তার দর্শন শিক্ষক ছাড়া অন্য কারো কথা মাথায় এলো না সোফির।
ওঁর সঙ্গে, হ্যাঁ, ওঁর সঙ্গে…তোর সেই খরগোশটা!
মাথা ঝাঁকাল সোফি।
দুজনে এক সঙ্গে হলে কী করিস তোরা, সোফি? তোর গা এমন ভেজা ছিল কেন?
গম্ভীর মুখে টেবিলে বসে রইল সোফি। বেচারী মা, এখন তাকে এ-সব নিয়ে চিন্তা করতে হচ্ছে।
আবার মাথা ঝাকাল সে। তারপরই আরো অনেক প্রশ্ন বৃষ্টির মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল তার ওপর।
এবার আমি সত্যি কথাটা জানতে চাই। তুই কি সারা রাতই বাইরে ছিলি? জামা-কাপড় না বদলেই বিছানায় গিয়েছিলি কেন তুই? আমি ঘুমোতে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নিশ্চয়ই চুপিচুপি বেরিয়ে পড়েছিলি তুই? তোর বয়েস মাত্র চোদ্দ, সোফি। আমি জানতে চাই কার সঙ্গে দেখা করছিস তুই।
কাঁদতে শুরু করল সোফি। তারপর মুখ খুলল সে। তখনো তার ভয় কাটেনি আর কেউ যখন ভয় পায় তখন সে কথা বলে।
সোফি বলল বেশ সকালে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল তার এবং সে বনের মধ্যে হাঁটতে গিয়েছিল। সেফি তার মাকে কেবিন, নৌকো এবং সেই রহস্যময় আয়নার কথা বলল। কিন্তু গোপন করেসপন্ডেন্স কোর্স সম্পর্কে সে তাকে কিছুই বলল না। সবুজ ওয়ালেটটা সম্পর্কেও না। সে ঠিক জানে না কেন, কিন্তু হিল্ডার ব্যাপারটা সে চেপে রাখাটাই শ্রেয় বলে মনে করল।
তার মা দুহাতে তাকে বেড় দিয়ে ধরলেন এবং সোফি বুঝতে পারল তিনি তার কথা বিশ্বাস করেছেন।
আমার কোনো বয় ফ্রেন্ড নেই, সশব্দে শ্বাস নিয়ে সোফি বলল। কথাটা আমি বলেছিলাম স্রেফ এজন্যে যে তুমি সেই সাদা খরগোশটা নিয়ে ভীষণ আপসেট হয়ে পড়েছিলে।
কিন্তু তুই সেই মেজরের কেবিন পর্যন্ত গিয়েছিলি… তার মা চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন।
মেজরের কেবিন? বড় বড় চোখ করে মায়ের দিকে তাকাল সোফি।
বনের সেই ছোট্ট কেবিনটাকে মেজরের কেবিন-ই বলা হয়, তার কারণ কয়েক বছর আগে আর্মির এক মেজর ওখানে কিছু দিনের জন্যে ছিলেন। আমার ধারণা লোকটা একটু খেয়ালি, একটু ক্ষ্যাপাটে ধরনের ছিল। কিন্তু ও কিছু না। কিন্তু তারপর থেকে কেবিনটা খালিই পড়ে আছে।
না, তা নয়। ওখানে এক দার্শনিক থাকেন এখন।
আহ্, থামতো। আবার আকাশ কুসুম ভাবতে শুরু করিস না।
যা ঘটে গেল তা নিয়ে ভাবতে লাগল সোফি নিজের ঘরে বসে। তার মাথাটা হৈ হট্টগোলে জুরা একটা সার্কাসের মতো গম গম করতে লাগল গদাইলস্করী সব হাতী, হাস্যকর সব ক্লাউন, দুর্দান্ত সাহসী দড়াবাজ আর শেখানো-পড়ানো বানরগুলো সমেত। কিন্তু একটা ছবিই বার বার, অবিরামবাবে ফিরে আসতে থাকল তার মনে। একটা দাঁড় নিয়ে ছোট্ট একটা নৌকো বনের ভেতর একটা লেকের মধ্যে ভেসে বেড়াচ্ছে আর, বাড়ি পৌঁছুনোর জন্যে একজনের সেই নৌকোটা দরকার হচ্ছে।
এটুকু সৈ নিশ্চিতভাবেই বুঝতে পারল যে দর্শন শিক্ষক তার কোনো ক্ষতি করতে চাননি এবং সে যে তাঁর কেবিনে গিয়েছিল সেটা জানতে পারলে তিনি তাকে ক্ষমা করে দেবেন। কিন্তু সে একটা চুক্তি ভঙ্গ করেছে। দর্শনের এই কোর্সটার জন্যে সোফির কাছ থেকে তিনি তাহলে এই উপহারই পেলেন। কী করে সে এর ক্ষতি পূরণ করবে?
সে তার গোলাপী নোটপেপার নিয়ে লিখতে বসে গেল:
প্রিয় দার্শনিক, রোববার ভোরবেলা আমিই আপনার কেবিনে গিয়েছিলাম। আপনার সঙ্গে দেখা করার এবং দর্শনগত সমস্যার ব্যাপারে আলাপ করার ভীষণ ইচ্ছে হয়েছিল আমার। আপাতত আমি যদিও প্লেটোর ভক্ত বনে গেছি কিন্তু তিনি অন্য এক বাস্তবতায় অস্তিত্বশীল যে-সব ভাব বা নকশার ছবির কথা বলেছেন সে-সব ঠিক কিনা তা নিয়ে আমি নিশ্চিত নই। জিনিসগুলো যে আমাদের আত্মার মধ্যেই আছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু আমার ধারণা, অন্তত এই মুহূর্তের জন্যে, সেটা একটা ভিন্ন ব্যাপার। সেই সঙ্গে অবশ্য আমাকে এ-কথাও স্বীকার করতে হচ্ছে যে আত্মার অমরত্বের ব্যাপারেও আমি পুরোপুরি নিঃসন্দেহ নই। ব্যক্তিগতভাবে আমার আগেকার জীবনগুলোর কোনো স্মৃতিই আমার মধ্যে নেই। তবে আপনি যদি আমাকে এ-কথা বিশ্বাস করাতে পারেন যে আমার মৃতা দাদীর আত্মা সুখে আছে তাহলে আমি খুবই কৃতজ্ঞ থাকবো।
আসলে দর্শনগত কোনো সমস্যা নিয়ে আলাপ করার জন্যে আমি আপনাকে এই চিঠি লিখতে বসিনি। আমি স্রেফ এ-কথা বলতে চেয়েছি যে অবাধ্য হওয়ার জন্যে আমি দুঃখিত। নৌকোটাকে আমি পুরোপুরি ডাঙায় তুলতে চেয়েছিলাম, কিন্তু স্পষ্টতই, তা আমার শক্তিতে কুলোয়নি। বড়সড় কোনো ঢেউয়ের কারণেও নৌকোটার এভাবে সরে যাওয়াটা বিচিত্র নয়।
আশা করছি, পা না ভিজিয়েই আপনি বাড়ি ফিরতে পেরেছিলেন। যদি না পেরে থাকেন তাহলে এ-কথা শুনে সম্ভবত আপনি খানিকটা সান্ত্বনা পাবেন যে আমিও ভিজে গিয়েছিলাম এবং সম্ভবত ভীষণ ঠাণ্ডা লাগবে আমার। কিন্তু সেজন্যে মিই দায়ী থাকবো।
কেবিনের কিছুই আমি স্পর্শ করিনি, তবে আমি দুঃখিত যে টেবিলের ওপর রাখা খামটা নেয়ার লোভ আমি সংবরণ করতে পারিনি। আমি যে কিছু চুরি করতে চেয়েছিলাম এবং সেজন্যেই ওটা নিয়েছি তা নয়, আসলে আমার নাম ওটার গায়ে লেখা ছিল বলে সেই তালগোল পাকানো পরিস্থিতিতে আমার মনে হয়েছিল ওটা বুঝি আমারই। আমি সত্যিই আন্ত রিকভাবে দুঃখিত, সেই সঙ্গে কথা দিচ্ছি আর কখনো আপনাকে হতাশ করবো না।
পুনশ্চ: এই মুহূর্ত থেকেই নতুন প্রশ্নগুলো নিয়ে ভালোভাবে চিন্তা শুরু করবো আমি।
পুনঃ পুনশ্চ: সাদা চেস্ট অভ ড্রয়ার্সের ওপরের পেতলের ফ্রেমের আয়নাটা কি সাধারণ কোনো আয়না না জাদুর আয়না? কথাটা আমি জিগ্যেস করছি এই কারণে যে আমি আমার প্রতিবিম্বকে একই সঙ্গে দুই চোখ দিয়ে চোখ টিপতে দেখায় অভ্যস্ত নই।
—-শ্রদ্ধান্তে, আপনার একান্তই আগ্রহী ছাত্রী, সোফি।
খামে পোরার আগে চিঠিটা আগাগোড়া দুবার পড়ে নিল সোফি। তার মনে হলো, এটা আগেরটার চেয়ে কম আনুষ্ঠানিক হয়েছে। নিচতলায়, রান্নাঘরে এক মুঠো চিনি আনতে যাওয়ার আগে আজকের দিনের প্রশ্নগুলো লেখা চিরকুটটার দিকে নজর দিল সে।
কোনটা আগে এসেছে-মুরগি না ভাব মুরগি?
প্রশ্নটা মুরগি আর ডিম সংক্রান্ত সেই প্রাচীন ধাঁধাটার মতোই চালাকীপূর্ণ। মুরগি ছাড়া মুরগির ডিম হতে পারে না, আবার ডিম ছাড়া মুরগি হতে পারে না। মুরগি না মুরগির ভাব আগে এসেছে সেটা বের করা কি এতই কঠিন? প্লেটো কী বলতে চেয়েছেন সেটা সোফি বুঝতে পারল। তিনি বলতে চেয়েছেন ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতে মুরগি আসার অনেক আগেই ভাব-জগতে মুরগির ভাবের অস্তিত্ব ছিল। প্লেটোর বক্তব্য অনুসারে, একটা দেহে বাসা বাঁধবার আগেই আত্মা মুরগির ভাব দেখে নিয়েছিল। কিন্তু সোফির কি মনে হয় না যে প্লেটো ঠিক এই জায়গাতেই ভুল করেছেন? যে-মানুষটি কোনোদিন কোনো জীবন্ত মুরগি বা মুরগির ছবি দেখেনি তার কী করে মুরগি সম্পর্কে ভাব থাকবে? এই প্রশ্নটিই তাকে পরের প্রশ্নে নিয়ে এলো:
আমরা কি সহজাত ভাব নিয়ে জন্মগ্রহণ করি? নিতান্তই অসম্ভব, ভাবল সোফি। নানান ভাব-এ সমৃদ্ধ সদ্যোজাত শিশুর কথা অনেক কষ্ট করেও কল্পনা করতে পারল না সে। তাই বলে অবশ্য এ-ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া মুশকিল, কারণ, স্পষ্টতই, শিশুটির মুখে সে-মুহূর্তে কোনো ভাষা না থাকার মানেই নিশ্চিতভাবে তা এই নয় যে তার মাথায় কোনো ভাব-ও নেই। তবে এ-কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে এই পৃথিবীতে কোনো কিছু সম্পর্কে কোনো ধারণা পেতে হলে সেটাকে আগে দেখতে হয় আমাদের।
একটি গাছ, প্রাণী এবং মানুষের মধ্যে তফাৎ কোথায়? পরিষ্কার কিছু তফাৎ তো মুহূর্তের মধ্যেই ধরা পড়ল সোফির কাছে।
উদাহরণস্বরূপ, একটা গাছের খুব জটিল কোনো আবেগপ্রবণ জীবন আছে বলে সে মনে করে না। কে কবে একটা ভগ্নহৃদয় রুবেল ফুলের কথা শুনেছে? গাছ বড় হয়, পুষ্টি গ্রহণ করে, বীজ তৈরি করে যাতে তা থেকে আবার আরেকটি গাছ জন্ম নিতে পারে। গাছের ব্যাপারে এই তো হলো গিয়ে সারকথা। সোফি এই সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছুল যে গাছের বেলায় যে-কথা খাটে, প্রাণী এবং মানুষের বেলাতেও সেই একই কথা খাটে। অবশ্য প্রাণীদের অন্যান্য গুণও রয়েছে। যেমন, তারা চলাফেরা করতে পারে। (গোলাপ ফুল আবার কবে ম্যারাথন রেসে অংশ নিয়েছে?) অবশ্য জীব-জন্তু আর মানুষের মধ্যে আরো কোনো পার্থক্য বের করা একটু কষ্টকর। মানুষ চিন্তা-ভাবনা করতে পারে, কিন্তু জীব-জম্ভরাও কি তা পারে না? সোফি নিশ্চিত, তার শিয়ার্কেন চিন্তা করতে পারে। অন্ততপক্ষে বেড়ালটা যে বেশ হিসেবী তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু ওটা কি কোনো দর্শনগত প্রশ্ন নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করতে পারে? একটা বেড়াল কি একটা গাছ, প্রাণী আর মানুষের মধ্যেকার তফাৎ নিয়ে চিন্তা করতে পারে? সে-সম্ভাবনা খুবই কম। হতে পারে একটা বেড়াল সুখী বা অসুখী, কিন্তু সেটা কি ঈশ্বরের অস্তিত্ব বা তার নিজের আত্মা অমর কিনা তা নিয়ে চিন্তা করতে পারে? সে-ব্যাপারে ঘোর সন্দেহের অবকাশ আছে বলে মনে হলো সোফির। কিন্তু এখানে একই প্রশ্ন তোলা হয়েছে শিশু এবং সহজাত ভাব নিয়ে। এ-বিষয়ে একটা বেড়ালের সঙ্গে আলোচনা করা আর একটি শিশুর সঙ্গে কথা বলা ঠিক একই রকমের সমস্যার সৃষ্টি করবে।
বৃষ্টি কেন হয়? সোফি কাঁধ ঝাঁকাল। বৃষ্টি সম্ভবত এই কারণে হয় যে সমুদ্রের পানি বাষ্প হয়ে উড়ে যায় আর মেঘ ঘন হয়ে বৃষ্টির ফোঁটায় পরিণত হয়। এটা কি সে থার্ড গ্রেডেই শেখেনি? অবশ্য লোকে এ-কথাও বলতে পারে যে গাছপালা আর জীব-জন্তু যাতে বড় হতে পারে সেজন্যেই বৃষ্টি হয়। কিন্তু সেটা কি সত্যি? বৃষ্টির কি আসলেই কোনো উদ্দেশ্য থাকে? শেষ প্রশ্নটা নিশ্চিতভাবেই এই উদ্দেশ্য নিয়ে একটি সুন্দর জীবন যাপন করার জন্যে কী প্রয়োজন?
এই কোর্সের বেশ গোড়ার দিকেই দার্শনিক এ-বিষয়ে কিছু কথা লিখেছিলেন। খাদ্য, উষ্ণতা, ভালোবাসা আর যত্ন সবারই দরকার। যে-কোনো অবস্থাতেই এই মৌলিক জিনিসগুলো একটি সুন্দর জীবনের প্রাথমিক শর্ত। তো, এরপর দার্শনিক মন্তব্য করেছিলেন যে, সেই সঙ্গে দর্শনগত কিছু প্রশ্নের উত্তর জানা থাকাটাও মানুষের জন্যে জরুরি। পছন্দমতো একটা চাকরি বা বৃত্তি পাওয়াটাও সম্ভবত বেশ জরুরি। এই যেমন, কেউ যদি রাজপথের যানবাহন, লোকজন ইত্যাদি অপছন্দ করে তাহলে সে ট্যাক্সিচালক হিসেবে খুব সুখী বোধ করবে না। আবার কেউ যদি হোমওয়ার্ক করতে পছন্দ না করে তাহলে শিক্ষক হতে চাওয়াটা নিশ্চয়ই তেমন ভালো কাজ হবে না। জীব-জন্তু সোফির খুব পছন্দ, সে পশু-চিকিৎসক হতে চায়। তবে সে যাই হোক, একটি সুন্দর জীবন যাপন করার জন্যে লটারিতে লক্ষ টাকা জেতাটা জরুরি বলে সে মনে করে না।
তার উল্টোটা হলেই সম্ভবত ভালো। সেই যে একটা প্রবাদ আছে নাঃ অলস হাতে শয়তান-ই কাজ যুগিয়ে দেয়।
সোফির মা দুপুরের সময় বিশাল এক ভোজের আয়োজন করে তাকে নিচে ডাকার আগ পর্যন্ত সে তার নিজের ঘরেই থাকল। গরুর পেছনের মাংসের স্টেক আর বেন্ড পটেটো তৈরি করেছেন তিনি। তাছাড়া ডেজার্ট হিসেবে আছে ক্লাউডবেরি আর ক্রিম।
রাজ্যের সব বিষয় নিয়ে কথা হলো দুজনের। সোফির মা জানতে চাইলেন সে তার পঞ্চদশ জন্মদিন কীভাবে পালন করতে চায়। আর মাত্র কয়েক হপ্তা পরেই। জন্মদিন।
শ্রাগ করল সোফি।
তুই কি কাউকে দাওয়াত দিবি না? মানে বলতে চাইছি, তুই কি চাস না একটা পার্টি হোক।
হয়ত।
মার্থা আর অ্যান মেরিকে বলতে পারি আমরা…হেলেনকেও। তাছাড়া জোয়ানাও আছে। জেরেমিকেও ডাকা যেতে পারে। তবে সেটা তুই ঠিক করবি। আমার নিজের এই জন্মদিনটার কথা আমার ভীষণ স্পষ্টভাবে মনে আছে, বুঝলি। মনে হয় এই সেদিন বুঝি। মনে হয়েছিল একেবারে বড় হয়ে গেছি আমি। ব্যাপারটা অদ্ভুত না, সোফি? আমার মনে হয় সেদিনের পর থেকে আমার কোনো পরিবর্তনই। হয়নি।
হয়নি-ই তো। কিছুই বদলায় না। তুমি স্রেফ বড় হয়েছে, তোমার বয়স বেড়েছে….
হু…এটা কিন্তু বড়দের মতো কথা বললি। আমার তো ধারণা ব্যাপারটা খুব তাড়াতাড়ি ঘটেছে।