০৯. প্লেটো
…আত্মার রাজ্যে ফিরে যাওয়ার বাসনা…
পরদিন সকালে চমকে ঘুম থেকে জেগে উঠল সোফি। ঘড়ির দিকে তাকাল। পাঁচটার একটু বেশি বাজে, কিন্তু ঘুম পুরোপুরি টুটে যাওয়াতে সে উঠে বসল বিছানার ওপর। তার গায়ে এই পোশাক কেন? তারপরই মনে পড়ে গেল সব।
একটা টুলের ওপর দাঁড়িয়ে ক্লজেটের সবচেয়ে ওপরের তাকটার দিকে তাকাল সে। হ্যাঁ, ওই তো, পেছন দিকেই রয়েছে ভিডিও ক্যাসেটটা। ব্যাপারটা তাহলে স্বপ্ন নয়। অন্তত, পুরোটা নয়।
কিন্তু সে নিশ্চয়ই প্লেটো আর সক্রেটিসকে সত্যি সত্যি দেখেনি। যাকগে, ব্যাপারটা নিয়ে আর কিছু ভাবার মতো শক্তি পাচ্ছিল না সে। হয়তো তার মায়ের কথাই ঠিক, হয়তো ইদানিং তার আচার-ব্যবহার একটু খাপছাড়াই হয়ে পড়েছে।
সে যাই হোক, এখন তো আবার ঘুমানো চলে না। সম্ভবত তার এখন গুহাটায় গিয়ে দেখে আসা উচিত কুকুরটা কোনো চিঠি রেখে গিয়েছে কিনা। পা টিপে টিপে নিচে নেমে এলো সোফি, এক জোড়া জগিং শ্য পরে নিল, তারপর বেরিয়ে পড়ল।
বাগানে সবকিছু ছিমছাম, পরিষ্কার। পাখিরা এতো কলরব করছে যে সোফি না হেসে পারল না। ঘাসের ওপরে স্ফটিকের ফোঁটার মতো ঝকমক করছে শিশির। জগতের অবিশ্বাস্য বিস্ময় আরো একবার চমকে দিল সোফিকে।
পুরনো বেড়ার ভেতর দিকটাও বেশ ভেজা ভেজা। দার্শনিকের কাছ থেকে আসা নতুন কোনো চিঠি দেখতে পেল না সোফি, তারপরেও মোটাসোটা একটা শেকড় মুছে নিয়ে সেটার ওপর বসে পড়ল সে।
তার মনে পড়ে গেল ভিডিওর প্লেটো তাকে কয়েকটা প্রশ্ন দিয়েছেন উত্তর বের করার জন্যে। প্রথমটা হলো একজন রুটিওয়ালা কী করে একই রকম দেখতে পঞ্চাশটা বিস্কিট তৈরি করে। খুব মনোযোগ দিয়ে চিন্তা করতে হলো সোফিকে, কারণ প্রশ্নটা সহজ নয়। তার মা মাঝে মধ্যে বেশ কিছু বিস্কিট তৈরি করেছেন, কিন্তু সেগুলো দেখতে হুবহু একই রকম হয়নি। কিন্তু তিনি তো আর প্যাস্ট্রি কুক হিসেবে পটু নন; মাঝে মধ্যে রান্নাঘরটা দেখলে মনে হতো যেন সেখানে কোনো বোমা পড়েছে। এমন কি বেকারী থেকে তারা যে বিস্কিট কেনে সেগুলো-ও তো সব। দেখতে হুবহু একইরকম হয় না কখনো। রুটিওয়ালা তার নিজের হাতে প্রত্যেকটা বিস্কিট আলাদা আলাদাভাবে তৈরি করে।
এরপরই সন্তুষ্টির একটা হাসি খেলে গেল সোফির মুখে। তার মনে পড়ে গেল একবার সে আর তার বাবা কেনাকাটা করতে গিয়েছিল আর তার মা তখন বাড়িতে ব্যস্ত ছিলেন বড় দিনের বিস্কিট তৈরিতে। তারা বাড়িতে ফিরে দেখেছিল রান্নাঘরের টেবিলের ওপর বেশ কিছু জিঞ্জারব্রেড মানুষ বিছানো রয়েছে। সবগুলো নিখুঁত না হলেও এক হিসেবে দেখতে সেগুলো এক রকমই ছিল। কী করে হলো সেটা? নিশ্চয়ই তার মা সব কটার জন্যে একই ছাঁচ ব্যবহার করেছিলেন।
ঘটনাটার কথা মনে করতে পেরে সোফি এতোটাই খুশি হয়ে গেল যে সে ধরেই নিল যে প্রথম প্রশ্নটার জবাব দেয়া হয়ে গেছে। যদি কোনো রুটিওয়ালা হুবহু একই রকমের দেখতে পঞ্চাশটা বিস্কিট তৈরি করে তাহলে ধরে নিতে হবে যে সে নিশ্চয়ই সবগুলোর জন্য একই ছাঁচ ব্যবহার করেছে। তাছাড়া আর কী!
তো, ভিডিও-র প্লেটো এরপর জিগ্যেস করেছিলেন ঘোড়াগুলো সব একই রকমের কেন। কিন্তু তা তো নয় একদম। বরং সোফির কাছে মনে হলো দুজন মানুষ যেমন একরকম নয় তেমনি ঘোড়াগুলোও সব একেকটা একেকরকম।
সে প্রায় হাল ছেড়েই দিতে বসেছিল, এমন সময় বিস্কিট সম্পর্কে সে যা ভেবেছিল সে-কথা মনে পড়ে গেল তার। কোনোটাই সব দিক দিয়ে আরেকটার মোন নয়। কোনোটা হয়ত অন্যগুলোর চেয়ে বেশি পুরু, কোনোটা ভাঙা। কিন্তু তারপরেও সবাই-ই বলবে যে বিস্কিটগুলো-এক হিসেবে-হুঁবহু একই রকমের।
প্লেটো সম্ভবত আসলে যা জানতে চেয়েছিলেন তা হলো একটা ঘোড়া কেন সব সময় ঘোড়া-ই; অন্য কিছু-এই যেমন, ঘোড়া আর শুয়োরের সংকর-কেন নয়। তার কারণ, ঘোড়াগুলোর মধ্যে কিছু ভালুকের মতো বাদামি আবার কিছু কিছু ভেড়ার মতো সাদা হলেও সব ঘোড়ার মধ্যেই একটা মিল রয়েছে। এই যেমন, আজ পর্যন্ত ছয় বা আট পা-অলা কোনো ঘোড়া দেখেনি সোফি।
তাই বলে প্লেটো নিশ্চয়ই এ-কথা বিশ্বাস করতেন না যে একই ছাঁচ থেকে বানানোর কারণেই ঘোড়াগুলো সব একই রকম হয়েছে?
এরপর সত্যিই একটা খুব কঠিন প্রশ্ন করেছেন প্লেটো মানুষের আত্মা কি অমর? সোফির মনে হলো এই প্রশ্নের উত্তর দেয়ার যোগ্যতা তার নেই। সে কেবল এটুকুই জানে যে, মৃতদেহগুলোকে হয় পুড়িয়ে ফেলা হয় আর নয়ত কবর দেয়া হয়, কাজেই তাদের ভবিষ্যৎ বলে আর কিছু থাকে না। মানুষের আত্মা অমর হলে ধরে নিতে হয় মানুষ দুটো আলাদা অংশ দিয়ে তৈরি: একটা দেহ, যেটা বেশ কিছু বছর পার হলে পর ক্ষয়ে যায়, জীর্ণ হয়ে যায় আর একটি আত্মা, যা কিনা দেহের যা কিছু হোক না কেন মোটামুটি স্বাধীনভাবে কাজ চালিয়ে যায়। সোফির দাদী একবার বলেছিলেন যে তিনি মনে করেন তার দেহটাই কেবল বুড়ো হয়েছে। ভেতরে তিনি সব সময় আগের সেই তরুণীই রয়ে গেছেন।
তরুণী-র চিন্তাটা সোফিকে শেষ প্রশ্নে নিয়ে এলো। নারী আর পুরুষ কি একই রকম সুবুদ্ধিসম্পন্ন সোফি ঠিক নিশ্চিত নয় এ-ব্যাপারে। ব্যাপারটা নির্ভর করছে প্লেটো সুবুদ্ধিসম্পন্ন বলতে কী বুঝিয়েছেন তার ওপরে।
সক্রেটিস সম্পর্কে বলা দার্শনিকের কিছু কিছু কথা মনে পড়ল সোফির। সক্রেটিস দেখিয়ে দিয়েছেন যে নিজের বিচার-বুদ্ধি ব্যবহার করলেই সবার পক্ষে দর্শনগত সত্যগুলো বোঝা সম্ভব। তিনি আরো বলেছেন, যে-কোনো অভিজাতবংশীয় লোকের যে স্বাভাবিক বিচার-বুদ্ধি আছে একজন দাসেরও তাই আছে। সোফি নিশ্চিত তিনি একথাও বলতেন যে নারীর বিচার-বুদ্ধিও পুরুষের মতোই।
সে যখন বসে বসে এ-সব ভাবছে, বেড়ার গায়ে খসখস একটা আওয়াজ শোনা গেল, সেই সঙ্গে মনে হলো কী একটা যেন হাঁপাচ্ছে আর বাষ্পীয় এঞ্জিনের মতো শব্দ করছে। পর মুহূর্তেই সোনালী ল্যাব্রাডরটা সুড়ৎ করে ঢুকে পড়ল গুহার মধ্যে। মুখে তার বড়সড় একটা খাম।
সোফি চেঁচিয়ে উঠল, হার্মেস! ফেলো ওটা! ফেলল ওটা!
সোফির কোলের ওপর খামটা ফেলে দিল কুকুরটা, সেটার মাথায় হাত বুলিয়ে দেবার জন্যে হাত বাড়িয়ে দিল সোফি।
গুড বয়, হার্মেস। বলল সোফি।
নিজের গায়ে হাত বুলাতে দেবার জন্যে শুয়ে পড়ল কুকুরটা। কিন্তু একটু পরেই উঠে দাঁড়াল সেটা তারপর বেড়ার যেখান দিয়ে ঢুকেছিল সেখান দিয়েই বেরিয়ে গেল ঠেলেঠুলে জায়গা করে নিয়ে। বাদামি খামটা নিয়ে সোফি অনুসরণ করল সেটাকে। ঘন ঝোঁপ ঠেলে একটু পরেই বাগানের বাইরে এসে দাঁড়াল সে।
হার্মেস অবশ্য এরিমধ্যে বনের প্রান্তের দিকে ছুট দিয়েছে, সোফি কয়েক পা দৌড়ে গেল সেটার পেছন পেছন। বার দুই ঘুরে দাঁড়িয়ে ঘেউ ঘেউ করে উঠল কুকুরটা। কিন্তু সোফি দমবার পাত্রী নয়।
এইবার সে দার্শনিককে খুঁজে বার করবেই, সেজন্যে যদি তাকে এথেন্সে পর্যন্ত ও দৌড়ে যেতে হয় তো সে রাজি আছে।
গতি বাড়িয়ে দিল কুকুরটা, তারপর হঠাৎ করেই দিক পরিবর্তন করে সরু একটা পথ ধরে ছুটতে লাগল। সোফিও তাড়া করল সেটাকে, কিন্তু কিছুক্ষণ পর কুকুরটা ঘুরে দাঁড়িয়ে মুখোমুখি হলো তার। ডাকতে শুরু করল পাহারাদার কুকুরের মতো। তারপরেও হাল না ছেড়ে বরং এই সুযোগে তাদের মধ্যেকার দূরত্বটা কমিয়ে আনল সোফি। ঘুরে দাঁড়াল হার্মেস, তারপর ছুট দিল তীরবেগে। সোফি বুঝে গেল তার পক্ষে কুকুরটার নাগাল ধরা সম্ভব নয়। মনে হলো যেন অনন্তকাল ধরে দাঁড়িয়ে রইল সোফি, শুনতে পাচ্ছে কুকুরটার পায়ের আওয়াজ ক্রমেই দূরে চলে যাচ্ছে। একসময় আর শোনা গেল না শব্দটা।
বনের মধ্যে একটা ফাঁকা জায়গায় গাছের একটা গুঁড়ির ওপর বসে পড়ল সোফি। তার হাতে তখনো সেই বাদামি খামটা। সে ওটা খুলে ফেলল, বের করে নিল টাইপ করা পাতা কটা, তারপর শুরু করল পড়তে:
প্লে টো র এ কা ডে মি
একসঙ্গে আমরা নুর যে-সময়টুকু কাটালাম সেজন্যে ধন্যবাদ তোমাকে, সোফি। বুঝতেই পারছ, আমি এথেন্সে কাটানো আমাদের সময়ের কথা বলছি। নিজেকে অন্ত ত প্রকাশ তো করেছি আমি। আর যেহেতু প্লেটোর সঙ্গেও আমি পরিচয় করিয়ে দিয়েছি তোমার সুতরাং এখন আর কথা না বাড়িয়ে কাজ শুরু করতে পারি আমরা।
সক্রেটিস যখন হেমলক পান করেন প্লেটোর (Plato, ৪২৮-৩৪৭ খ্রি. পূ.) বয়স তখন উনত্রিশ। তার বেশ আগে থেকেই তিনি সক্রেটিসের ছাত্র এবং তার শিক্ষকের বিচারের পুরো প্রক্রিয়াটি তিনি খুব মন দিয়ে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। এথেন্স যে তার সবচেয়ে মহৎ নাগরিককে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করতে পারে এই ব্যাপারটি তার ওপর একটি গভীর দাগ কেটেছিল বললেও কম বলা হয়। এই ঘটনাটিই তাঁর সামগ্রিক দার্শনিক প্রচেষ্টার রূপরেখা তৈরি করে দিয়েছিল।
প্লেটোর কাছে সক্রেটিসের মৃত্যুর ঘটনাটি ছিল বাস্তবের সমাজ এবং খাঁটি বা আদর্শ সমাজের মধ্যেকার দ্বন্দ্বের একটি উজ্জ্বল উদাহরণ। দার্শনিক হিসেবে প্লেটো প্রথম যে-কাজটি করেছিলেন তা হলো সক্রেটিস বিশাল জুরি বোর্ডের উদ্দেশে যে আবেদন রেখেছিলেন তার বর্ণনা সম্বলিত অ্যাপলজি কৈফিয়ত) প্রকাশ করা।
তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে যে সক্রেটিস কিছুই লিখে রেখে যাননি, যদিও সক্রেটিস-পূর্ববর্তী অনেকে তাঁদের বক্তব্য লিখে রেখে গিয়েছিলেন। সমস্যা হচ্ছে, তাঁরা যা লিখেছিলেন তার প্রায় কিছুই পাওয়া যায়নি। তবে প্লেটোর বেলায় এ-কথা বিশ্বাস করার কারণ রয়েছে যে তার মূল কাজগুলো সবই সংরক্ষণ করা হয়েছিলো। (সক্রেটিসের অ্যাপলজি ছাড়াও তিনি এপিসল নামে চিঠিপত্রের একটি সংকলন আর প্রায় পাঁচটি দর্শনগত ডায়লগ রচনা করেছিলেন।) আজ যে আমরা তাঁর এই রচনাগুলো পাচ্ছি তার পেছনে কিংবদন্তীর গ্রীক ব্যক্তিত্ব অ্যাকাডেমাস-এর নামে এথেন্স থেকে সামান্য দূরে এক তরুবীথির মধ্যে স্থাপিত প্লেটোর দর্শনের স্কুলটির ভূমিকাও কম নয়। তো, সেই স্কুলটি পরিচিত ছিল একাডেমি নামে। (এরপর থেকে সারা পৃথিবী জুড়ে হাজার হাজার একাডেমি স্থাপিত হয়েছে। এখনো আমরা। একাডেমিকস্ এবং একাডেমিক বিষয়, এই কথাগুলো ব্যবহার করি।)
প্লেটোর একাডেমিতে যে-সব বিষয় শেখানো হতো তা হলে দর্শন, গণিত এবং জিমনাস্টিক্স বা ব্যায়াম। অবশ্য শেখানো শব্দটি এক্ষেত্রে কতটা প্রযোজ্য তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। প্লেটোর একাডেমিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল প্রাণবন্ত আলাপ-আলোচনা বা কথোপকথন। কাজেই প্লেটোর রচনাগুলো যে সংলাপের ধরনে লেখা সেটা নেহাত কোনো আকস্মিক ব্যাপার নয়।
.
শাশ্বত সত্য, শাশ্বত সুন্দর এবং শাশ্বত মঙ্গলজনক
এই কোর্সের গোড়ার দিকে আমি বলেছিলাম যে বিশেষ একজন দার্শনিকের মূল আলোচ্য বিষয় কী সেদিকে নজর দেয়াটা জরুরি। কাজেই এখন আমার প্রশ্ন: প্লেটো কোন কোন সমস্যার দিকে নজর দিয়েছিলেন?
সংক্ষেপে বলতে গেলে, আমরা দেখতে পাবো যে এই জগৎ সংসারে যা কিছু শাশ্বত বা অপরিবর্তনীয় এবং যা কিছু বয়ে চলে এই দুইয়ের মধ্যেকার সম্পর্কই ছিল প্লেটোর চিন্তার কেন্দ্রবিন্দু। (ঠিক সেই প্রাক-সক্রেটিস দার্শনিকদের মতো।) আমরা দেখেছি সোফিস্টরা আর সক্রেটিস কীভাবে প্রকৃতিবাদী দর্শন থেকে মানুষ এবং সমাজের দিকে নজর ফিরিয়েছিলেন। তারপরেও, এক অর্থে, এমনকী সক্রেটিস এবং সোফিস্টরাও শাশ্বত বা অপরিবর্তনীয়তা এবং পরিবর্তনশীলতার মধ্যেকার সম্পর্ক নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। মানুষের নৈতিকতা এবং সমাজের আদর্শ বা গুণাবলীর সঙ্গে বিষয়টি কতটা সংশ্লিষ্ট সেটাই ছিল তাদের চিন্তার কেন্দ্রবিন্দু। অত্যন্ত সংক্ষেপে বলতে গেলে, সোফিস্টরা মনে করতেন ন্যায়-অন্যায়ের ধারণা একেক নগর-রাষ্ট্র এবং একেক প্রজন্মে একেক রকম। কাজেই ন্যায়-অন্যায় এমন একটি বিষয় যা বয়ে চলে। সক্রেটিস এই ব্যাপারটি একেবারেই মেনে নিতে পারেননি। কোনটি ন্যায় কোনটি অন্যায় সে-বিষয়ে শাশ্বত এবং পরম নীতির অস্তি ত্বে বিশ্বাসী ছিলেন তিনি। মানুষের প্রজ্ঞা আসলে যেহেতু শাশ্বত এবং অপরিবর্তনীয়, তাই কাণ্ডজ্ঞান ব্যবহার করে আমাদের পক্ষে এ-সমস্ত অপরিবর্তনশীল আদর্শে পৌঁছানো সম্ভব।
বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না তো, সোফি? এরপর এলেন প্লেটো। প্রকৃতিতে শাশ্বত জিনিস কী, পরিবর্তনশীল জিনিসই বা কী আর সেই সঙ্গে নৈতিকতার দিক দিয়ে সমাজে শাশ্বত ব্যাপার কী, এই দুটোই তাঁর চিন্তা-ভাবনার বিষয়। প্লেটোর কাছে এই দুটো সমস্যাই ছিল এক। তিনি এমন একটি বাস্তবতাকে ধরতে চাইছিলেন যা শাশ্বত এবং অপরিবর্তনীয়।
আর খোলাখুলিভাবে বলতে গেলে, দার্শনিকদের দরকার আমাদের এ-জন্যেই। একজন সুন্দরী-শ্রেষ্ঠ নির্বাচন করতে বা টমেটোর বাজারদর ঠিক করার জন্যে তাদের দরকার নেই আমাদের। (তাঁরা যে প্রায়-ই অ-জনপ্রিয় হন তার কারণ এটাই।) দার্শনিকেরা প্রায়-ই অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক বা দৈনন্দিন বিষয়গুলোকে উপেক্ষা করে যা কিছু শাশ্বত সত্য, শাশ্বত সুন্দর এবং শাশ্বত মঙ্গলজনক তার দিকে জনসাধারণের মনোযোগ ফেরাবার চেষ্টা করেন।
তো, এভাবে আমরা অন্তত প্লেটোর দর্শনের মূল বিষয়ের একটা আভাস পেতে শুরু করেছি। তবে তাড়াহুড়ো না করে, ধীরে সুস্থে, একবারে একটি বিষয় নিয়ে এগোনোই ভালো হবে। অসাধারণ একটি মনকে বোঝার চেষ্টা করছি আমরা, এমন একটি মন যা পরবর্তীকালের ইউরোপিয় দর্শনের ওপর গভীর প্রভাব রেখে যাবে।
.
ভাব–জগৎ
এম্পিডক্লেস এবং ডেমোক্রিটাস দুজনেই এই বিষয়টির দিকে লোকের মনোযোগ আকর্ষণ করেছিলেন যে প্রাকৃতিক জগতে প্রতিটি জিনিসই বয়ে চললেও এমন কিছুর অস্তিত্ব নিশ্চয়ই রয়েছে কখনোই যার কোনো পরিবর্তন হয় না (সেই চারটে মূল বা পরমাণু)। প্লেটো-ও এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত ছিলেন, তবে একেবারে ভিন্ন এক অর্থে।
প্লেটো বিশ্বাস করতেন, প্রকৃতিতে স্পর্শযোগ্য বা বাস্তব প্রতিটি জিনিসই বয়ে চলে। কাজেই এমন কোনো বস্তু নেই যার ক্ষয় নেই। বস্তু জগতের প্রতিটি জিনিস এমন কোনো না কোনো বস্তু দিয়ে তৈরি যা ক্ষয়যোগ্য, তবে প্রতিটি জিনিসই তৈরি করা হয়েছে একটি চিরন্তন ছাঁচ বা আকার-কে অনুকরণ করে যা শাশ্বত এবং অপরিবর্তনীয়।
বুঝতে পেরেছো কথাটা? উঁহু, বোঝেনি।
ঘোড়াগুলো সব একইরকম কেন, সোফি? সম্ভবত তোমার ধারণা, ঘোড়াগুলো আদপেই সব একরকম নয়। তবে একটা কথা তুমি নিশ্চয়ই স্বীকার করবে যে প্রতিটি ঘোড়ারই এমন কিছু আছে যা সব ঘোড়ার ভেতরেই বিদ্যমান, এমন একটা কিছু যা দেখে সেগুলোকে ঘোড়া বলে চিনতে আমাদের কোনো কষ্টই হয় না। স্বভাবতই একটা ঘোড়া চিরকাল একরকম থাকে না। সেটা বুড়ো আর খোঁড়া হয়ে যেতে পারে এবং এক সময় সেটা মারা যাবে। কিন্তু ঘোড়ার আকার চিরন্তন বা শাশ্বত এবং অপরিবর্তনীয়।
যা শাশ্বত এবং অপরিবর্তনীয়, প্লেটোর বিচারে তা ভৌত মৌলিক সারবস্তু (physical basic substance) নয়, কিন্তু এম্পিডক্লেস এবং ডেমেক্রিটাস সেটাই মনে করতেন। প্লেটোর ধারণা, সব কিছুই তৈরি করা হয়েছে প্রকৃতিগত দিক দিয়ে আধ্যাত্মিক ও বিমূর্ত কিছু শাশ্বত এবং অপরিবর্তনীয় নকশার আদলে।
ব্যাপারটা এভাবে বলা যাক: সক্রেটিস-পূর্ব দার্শনিকেরা প্রাকৃতিক পরিবর্তনের একটি মোটামুটি চমৎকার ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, সেজন্যে তাদেরকে আগে থেকেই ধরে নিতে হয়নি যে সব কিছুরই আসলে পরিবর্তন ঘটে। তারা ভাবতেন, প্রাকৃতিক পরিক্রমার ভেতরেই শাশ্বত এবং অপরিবর্তনীয় কিছু ক্ষুদ্রতম উপাদান রয়েছে যার বিনাশ নেই। তা না হয় বোঝা গেল, সোফি। কিন্তু এই ক্ষুদ্রতম উপাদানগুলি, যেগুলো দিয়ে এক সময় একটি ঘোড়া তৈরি হয়েছিল, সেগুলোই কী করে চারশ পাঁচশ বছর পরে হঠাৎ কোনো এক পাকচক্রে একসঙ্গে জড়ো হয়ে সম্পূর্ণ নতুন একটা ঘোড়ায় রূপ নেয় বা কোনো হাতি বা কুমীর বনে যায় তার কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা তারা দিয়ে যাননি। প্লেটোর যুক্তি ছিল এই যে, ডেমোক্রিটাসের পরমাণুগুলো কখনোই এক সঙ্গে জড়ো হয়ে কোনো জীব-জন্তুতে পরিণত হয় না। এই সূত্র ধরেই তাঁর দর্শনগত চিন্তা-ভাবনার যাত্রা শুরু।
তুমি যদি এরিমধ্যে বুঝে ফেলে থাকো আমি কী বলতে যাচ্ছি তাহলে এই অনুচ্ছেদটা তুমি বাদ দিয়ে পরেরটাতে চলে যেতে পারো। কিন্তু তারপরেও, তুমি বুঝতে পারোনি ধরে নিয়ে আমি বিষয়টা খোলাসা করে বলছিঃ ধরা যাক, তোমার এক বাক্স লেগে রয়েছে আর তাই দিয়ে তুমি একটি ঘোড়া তৈরি করলে। তো, এরপর তুমি লেগোগুলো খুলে ফেলে ব্লকগুলো আবার বাক্সের মধ্যে রেখে দিলে। তো, এখন নিশ্চয়ই আশা করতে পারো না যে স্রেফ বাক্সটা ঝাঁকিয়েই তুমি একটা ঘোড়া তৈরি করে ফেলবে? লেগো ব্লকগুলো কী করে একে অন্যকে চিনে নিয়ে নিজেরাই একটা নতুন ঘোড়া তৈরি করে ফেলবে আবার? না, সোফি, ঘোড়াটাকে আবার তৈরি করতে হবে তোমায়। আর তুমি যে কাজটা করতে পারবে তার কারণ হলো ঘোড়া দেখতে কেমন তার একটা ছবি তোমার মনে আঁকা আছে। লেগো ব্লক দিয়ে তৈরি ঘোড়াটা এমন একটা মডেল বা আদর্শ রূপ থেকে তৈরি করা হয়েছে যে মডেলটি যে-কোনো ঘোড়ার বেলাতেই একই থাকে।
সেই হুবহু একই রকমের বিস্কিটের বেলায় কী ঘটেছিল? ধরা যাক, তুমি এইমাত্র মহাকাশ থেকে পড়েছে এবং জীবনে কোনো রুটিওয়ালা দেখোনি। হঠাৎ তোমার চোখে পড়ে গেল একটা দারুণ লোভনীয় রুটির দোকান আর সেখানেই তুমি দেখতে পেলে, একটা তাকের ওপর, হুবহু একই রকমের দেখতে পঞ্চাশটা জিঞ্জারব্রেড মানুষ। আন্দাজ করা যায়, তোমার মনে প্রশ্ন জাগবে ওগুলো একই রকমের হলে কী করে। এমন অবশ্য হতে পারে যে ওগুলোর কোনো একটার হয়ত একটা হাত নেই, আরেকটার হয়ত মাথার সামান্য অংশ খোয়া গেছে, তৃতীয়টার পেটটা হয়ত হাস্যকরভাবে খানিকটা ফুলে আছে। কিন্তু তারপরেও, মন দিয়ে চিন্তা করে দেখলে তুমি এই সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছুবে যে জিঞ্জারব্রেড মানুষগুলোর প্রতিটিরই একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। ওগুলোর একটিও যদি নিখুঁত না হয় তারপরেও কিন্তু এই সন্দেহ তোমার মনে নিশ্চয়ই উঁকি দিয়ে যাবে যে, ওগুলোর উৎস একই। তুমি বুঝতে পারবে যে, সব কটা বিস্কিটই একই ছাঁচ দিয়ে গড়া। আর তার চেয়েও বড় ব্যাপার কী জানো সোফি, এবার তোমার একটা অদম্য ইচ্ছে জাগবে ছাঁচটা দেখার। কারণ, স্পষ্টতই, ছাঁচটা নিশ্চয়ই একেবারে নিখুঁত হবে– সেই সঙ্গে, আরেক অর্থে, নিশ্চয়ই আরো সুন্দর হবে, সেই খুঁতবিশিষ্ট অনুকৃতিগুলোর তুলনায়।
যদি তুমি নিজে থেকেই এই সমস্যাটির সমাধানে পৌঁছে গিয়ে থাকো সেক্ষেত্রে প্লেটো যেভাবে সেই দর্শনগত সমাধানে পৌঁছেছিলেন তুমিও ঠিক সেভাবেই সেখানে পৌঁছেছ।
বেশিরভাগ দার্শনিকের মতোই, তিনিও মহাশূন্য থেকে পড়েছিলেন। (খরগোশটার একটা মিহি রোমের একেবারে ডগার ওপর দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি।) সমস্ত প্রাকৃতিক ব্যাপার-স্যাপার কী করে এমন এক হতে পারে তাই দেখে অবাক বনে গিয়েছিলেন তিনি এবং শেষে এই সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছেছেন যে এমনটি না হয়ে উপায় ছিল না; তার কারণ, আমরা আমাদের চারপাশে যা-কিছু দেখি তার সবগুলোর নেপথ্যেই সীমিত সংখ্যক কিছু আকার রয়েছে। প্লেটো এই আকারগুলোর নাম দিয়েছিলেন ভাব (idea)। প্রতিটি ঘোড়া, শুয়োর কিংবা মানুষের নেপথ্যেই রয়েছে একটি করে ভাব ঘোড়া, ভাব শুয়োর এবং ভাব মানুষ (ঠিক একইভাবে, আমরা যে রুটির দোকানের কথা বললাম সেখানেও থাকতে পারে জিঞ্জারব্রেড মানুষ, জিঞ্জারব্রেড ঘোড়া এবং জিঞ্জারব্রেড শুয়োর। কারণ, প্রতিটি সম্ভ্রান্ত রুটির দোকানেই একাধিক ছাঁচ রয়েছে। তবে প্রত্যেক ধরনের জিঞ্জারব্রেড বিস্কিটের জন্যে একটি ছাঁচই যথেষ্ট।)।
প্লেটো এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন যে বস্তুজগতের নেপথ্যে নিশ্চয়ই একটি বাস্ত বতা রয়েছে। এই বাস্তবতাকে তিনি বলেছিলেন ভাব-জগৎ; এই জগতে রয়েছে প্রকৃতিতে আমরা যে-সব ব্যাপার-স্যাপার দেখি সেগুলোর নেপথ্যের শাশ্বত এবং অপরিবর্তনীয় নকশা। এই অসাধারণ দৃষ্টিভঙ্গিটি প্লেটোর ভাবতত্ত্ব (theory of ideas) নামে পরিচিত।
.
প্রকৃত জ্ঞান
প্রিয় সোফি, আমি নিশ্চিত, আমার কথা বুঝতে তোমার অসুবিধা হচ্ছে না। কিন্তু তুমি হয়ত ভাবছো প্লেটো এ-সব গুরুত্বের সঙ্গে বলেছিলেন কিনা। এ-ধরনের আকার সম্পূর্ণ ভিন্ন এক বাস্তবতায় আসলেই রয়েছে বলে তিনি কি সত্যিই বিশ্বাস করতেন?
ব্যাপারটা হয়ত তিনি সারা জীবন আক্ষরিক অর্থে বিশ্বাস করতেন না কিন্তু তার লেখা কিছু সংলাপে বিষয়টা তিনি ঠিক এভাবেই বোঝাতে চেয়েছেন। চলো, তাঁর চিন্তার সূত্রটি অনুসরণ করা যাক।
আমরা দেখেছি যে, একজন দার্শনিক এমন একটা কিছু পেতে চান যা শাশ্বত এবং অপরিবর্তনীয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বিশেষ একটা সাবানের ফেনার অস্তিত্ব নিয়ে একটি দার্শনিক প্রবন্ধ লেখার কোনো অর্থই হয় না। তার কারণ অংশত এই যে, কেউ সেটাকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করার আগেই ওটা ফেটে যাবে এবং অংশত এই কারণেও যে কেউ যা কখনো দেখেনি আর যার অস্তিত্ব মাত্র পাঁচ সেকেন্ডের, এমন একটি বিষয়ের ওপর লেখা দার্শনিক প্রবন্ধের পাঠক খুঁজে পাওয়া সত্যিই কঠিন।
প্লেটো বিশ্বাস করতেন যে, প্রকৃতিতে আমরা যা কিছু দেখি, যা কিছু স্পর্শযোগ্য তার সবই সাবানের একটি ফেনার সঙ্গে তুলনীয়, কারণ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের সব কিছুই ক্ষণস্থায়ী। এই যেমন আমরা জানি যে, প্রতিটি মানুষ আর প্রতিটি জীব-জন্তুই মারা যাবে, বিলীন হয়ে যাবে, তা সে আজ হোক আর কাল-ই হোক। এমনকী মার্বেল পাথরের একটা বড়সড় টুকরোরও পরিবর্তন ঘটে, বিলুপ্তি ঘটে। (অ্যাক্রোপলিসও ধ্বংসস্তূপে পরিণত হচ্ছে, সোফি। ব্যাপারটা লজ্জাজনক ঠিকই, কিন্তু এটাই হচ্ছে বাস্তবতা।) প্লেটোর বক্তব্য হচ্ছে, যা অবিরত পরিবর্তিত হচ্ছে। তার সম্পর্কে প্রকৃত জ্ঞানলাভ সম্ভব নয়। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতে যা কিছু আছে, স্পর্শযোগ্য জিনিস, সে-সম্পর্কে আমরা কেবল আমাদের মতামতই ব্যক্ত করতে পারি। আর, যে-সব বিষয় আমরা আমাদের প্রজ্ঞা দিয়ে বুঝতে পারি, কেবল সে সব বিষয়েই প্রকৃত জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব আমাদের পক্ষে।
ঠিক আছে, সোফি, আরো সহজ করে বুঝিয়ে বলছি একটা জিঞ্জারব্রেড বিস্কিটের ক্ষেত্রে এমনটা হতেই পারে যে বিস্কিট তৈরির এতোসব ঝকমারির ধকলে সেটা এমনভাবে বদলে গেল যে ওটাকে বিস্কিট বলে চেনাই গেল না। কিন্তু ডজন ডজন মোটামুটি ভাল জিঞ্জারব্রেড বিস্কিট দেখার পর বিস্কিটের ছাঁচটা কেমন হতে পারে সে-সম্পর্কে আমি একরকম নিশ্চিত-ই হয়ে যাবো। কখনোই না দেখার পরেও আমি অনুমান করে নিতে পারবো। আমাদের ইন্দ্রিয়গুলোর ওপর আমরা যেহেতু সব। সময় ভরসা করতে পারি না তাই আসল ছাঁচটা দেখলেও যে খুব বেশি সুবিধে হতো সে-কথা জোর দিয়ে বলা মুশকিল। ব্যক্তিভেদে দৃষ্টিশক্তির পার্থক্য হতে পারে। অথচ অন্যদিকে, আমরা আমাদের প্রজ্ঞার ওপর ভরসা রাখতে পারি কারণ সবার। ক্ষেত্রেই তা একই রকম।
তুমি যদি আরো তিরিশজন ছাত্র-ছাত্রীর সঙ্গে কোনো ক্লাসে বসে থাকো আর শিক্ষক এসে জিগ্যেস করেন রঙধনুর কোন রঙটি সবচেয়ে সুন্দর, সেক্ষেত্রে তিনি সম্ভবত বিভিন্ন রকমের উত্তর পাবেন। কিন্তু ৩ কে ৮ দিয়ে গুণ করলে কত হয়। জিগ্যেস করলে, আশা করা যায়, গোটা ক্লাসই একই উত্তর দেবে। কারণ, এবার কথা বলছে প্রজ্ঞা এবং প্রজ্ঞা এক হিসেবে সে-রকমই ভাবছি বা মনে হচ্ছে-র। পুরোপুরি বিপরীত। প্রজ্ঞাকে আমরা ঠিক এই জন্যে শাশ্বত এবং সার্বজনীন বলতে পারি যে তা কেবল শাশ্বত এবং সার্বজনীন অবস্থার কথাই বলে।
অংকশাস্ত্র প্লেটোর মনে খুব দাগ কেটেছিল তার কারণ গাণিতিক অবস্থার কখনো পরিবর্তন হয় না। কাজেই যে-বিষয় সম্পর্কে আমরা প্রকৃত জ্ঞান অর্জন করতে পারি গাণিতিক অবস্থাগুলো তাই। তবে এক্ষেত্রে উদাহরণ হলে ভাল হয় আমাদের।
ধরো, বনের মধ্যে গোল একটা পাইন ফল পেলে তুমি। হয়ত তুমি বললে তোমার মতে সেটা পুরোপুরি গোল, ওদিকে জোয়ানার জোর দাবি ওটার একটা পাশ খানিকটা চ্যাপ্টা। (তো, এরপর কি আর তর্ক শুরু না হয়ে পারে?) কিন্তু চোখে। যা দেখা যায় সে সম্পর্কে তো কোনো প্রকৃত জ্ঞানলাভ সম্ভব নয়। অথচ কোনোরকম সন্দেহের অবকাশ না রেখেই তুমি বলতে পারবে যে একটি বৃত্তের সব কটা কোণের যোগফল ৩৬০ ডিগ্রি। এক্ষেত্রে অবশ্য তুমি বলছ একটি আদর্শ বৃত্তের কথা, যার অস্তিত্ব হয়ত এই পার্থিব জগতে নেই, যদিও মনের চোখে তুমি সেটা দিব্যি দেখতে পাবে। (এক্ষেত্রে তুমি জিঞ্জারব্রেড বিস্কিটের লুকানো ছাঁচটা নিয়ে কাজ করছো, রান্নাঘরের টেবিলের ওপরের বিশেষ কোনো বিস্কিট নিয়ে নয়।)।
ছোট্ট করে বলতে গেলে, আমরা আমাদের ইন্দ্রিয়গুলো দিয়ে যে-সব বস্তুর অস্তি ত্ব টের পাই সেগুলো সম্পর্কে আমরা কেবল ত্রুটিপূর্ণ ধারণাই পাই। কিন্তু যে-সব বিষয় আমরা আমাদের প্রজ্ঞা দিয়ে বুঝতে পারি, কেবল সে-সব বিষয় সম্পর্কেই প্রকৃত জ্ঞানলাভ করা সম্ভব আমাদের পক্ষে। ত্রিভুজের তিন কোণের সমষ্টি ১৮০ ডিগ্রিই থাকবে অনন্ত কাল। ঠিক একইভাবে, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের সমস্ত ঘোড়ার একটা পা ভেঙে গেলেও ভাব ঘোড় চার পায়েই হাঁটবে।
.
অমর আত্মা
আগেই ব্যাখ্যা করেছি, প্লেটো বিশ্বাস করতেন বাস্তবতা দুটো ক্ষেত্রে বিভক্ত।
একটি ক্ষেত্র হচ্ছে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ, যে-জগৎ সম্পর্কে আমরা কেবল আপাত বা অসম্পূর্ণ জ্ঞানই পেতে পারি আমাদের (আপাত বা অসম্পূর্ণ) পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে। এই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতে সব কিছুই বয়ে চলে, কিছুই স্থায়ী নয়। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতে কোনো কিছুই অস্তিমান নয়। এখানে যা কিছু তার সবই আসে কিছু হওয়ার জন্যে এবং তারপর তারা চলে যায়।
অন্য ক্ষেত্রটি হলো ভাব-জগৎ, সে-জগৎ সম্পর্কে আমরা প্রকৃত জ্ঞান লাভ করতে পারি আমাদের প্রজ্ঞা ব্যবহার করে। এই ভাব-জগৎ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপলব্ধি করা বা বোঝা যায় না, কিন্তু এই ভাব (কিংবা আকার) শাশ্বত এবং অপরিবর্তনীয়।
প্লেটোর বক্তব্য অনুযায়ী, মানুষ দ্বৈত সত্তা বিশিষ্ট প্রাণী। আমাদের একটি দেহ আছে যা বয়ে চলে এবং যা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের সঙ্গে অচ্ছেদ্য বাঁধনে বাঁধা আর সেই সঙ্গে যা জগতের অন্য সমস্ত কিছুর মতোই-এই যেমন ধরো, সাবানের ফেনা-একই নিয়তির অধীন। আমাদের সব কটি ইন্দ্রিয়ই আমাদের দেহ-নির্ভর, ফলে সেগুলোর ওপর ভরসা করা যায় না। কিন্তু আমাদের একটি আতা-ও রয়েছে যা অমর আর এই আত্মাটিই হলো প্রজ্ঞার রাজ্য। এবং আত্মা যেহেতু অশরীরী, সেটা ভাব-জগতে ঘুরে বেড়াতে পারে সে-জগত্তাকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করার জন্যে।
কিন্তু সেটাই সব নয়, সোফি। সেটাই সব নয়।
প্লেটো আরো বিশ্বাস করতেন যে, দেহের ভেতর বাসা বাঁধবার আগে থেকেই আত্মার অস্তিত্ব ছিল। (বিস্কিটের ছাঁচগুলোর সঙ্গে আলমারির একটা তাকের ওপরই ছিল সেটা।) কিন্তু একটি মানব দেহে আত্মাটি জেগে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই সেটা সমস্ত নিখুঁত ভাব-এর কথা ভুলে গেছে। তখন ঘটতে শুরু করে আরেকটি ঘটনা। সত্যি বলতে কী, শুরু হয় এক বিস্ময়কর প্রক্রিয়া। মানুষটি যখন প্রাকৃতিক জগতে নানান ধরনের আকার আবিষ্কার করতে থাকে, একটা আবছা স্মৃতি তার আত্মাকে অস্থির করে তোলে। আত্মা একটা ঘোড়া দেখতে পায়, কিন্তু যে-ঘোড়াটা সে দেখে সেটা নিখুঁত ঘোড়া নয়। (একটা জিঞ্জারব্রেড ঘোড়া!) কিন্তু সেটা এক নজর দেখেই আত্মার ভেতরে নিখুঁত ঘোড়াটার একটা আবছা স্মৃতি জেগে উঠতে দেরি হয় না, যে-ঘোড়াটিকে আত্মা দেখেছিল একবার ভাব-জগতে আর এতে করেই আত্মাটি তার প্রকৃত রাজ্যে ফিরে যাওয়ার একটা প্রবল আকুলতা অনুভব করে। প্লেটো এই প্রবল আকুলতার নাম দিয়েছেন এরস (eros), যার অর্থ ভালোবাসা। তো, আত্মাটি তখন তার সত্যিকারের উৎসে ফিরে যাওয়ার একটি তীব্র ইচ্ছা অনুভব করে। এরপর থেকে দেহ এবং ইন্দিয়গ্রাহ্য গোটা জগৎকেই আত্মা ত্রুটিযুক্ত এবং মামুলি হিসেবে দেখতে থাকে। আত্মা এক তীব্র আকুলতা অনুভব করে ভালোবাসার ডানায় ভর করে ভাব-জগতে তার নিজের আবাসে ফিরে যাওয়ার জন্যে। দেহের শেকল থেকে মুক্ত হওয়ার জন্যে আঁকুপাকু করতে থাকে সে।
এইখানে চট করে একটা জরুরি কথা বলে রাখি যে প্লেটো কিন্তু বলছেন একটি আদর্শ জীবনধারা সম্পর্কে, কারণ সব মানুষ তো আর তাদের আত্মাকে মুক্ত করে দেবে না যাতে সেটা ভাব-জগতে ফিরে যাওয়ার জন্যে তার যাত্রা শুরু করতে পারে। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের যে-প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই, বেশিরভাগ লোক তাই নিয়েই জীবন কাটিয়ে দেয়। তারা একটা ঘোড়া দেখে, তারপর আরেকটা ঘোড়া দেখে। কিন্তু প্রতিটি ঘোড়া যে-ঘোড়ার দুর্বল অনুকরণ সেটাকে তারা দেখতে পায় না। (তারা হুড়মুড় করে রান্নাঘরে ঢুকে পেট পুরে জিঞ্জারব্রেড বিস্কিট খেয়ে নেয়, ওগুলো কোত্থেকে এলো তা নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথা না ঘামিয়েই।) প্লেটো আসলে যা বলছেন তা দার্শনিকদের বেলায় প্রযোজ্য। তাঁর দর্শনকে দর্শনচর্চার বর্ণনা হিসেবেও দেখা যেতে পারে।
কোনো ছায়া দেখলেই তুমি নিশ্চয়ই এ-কথা ভাবো যে সেই ছায়ার পেছনে একটা কায়া আছে যার কারণে ছায়াটি পড়ছে। হয়ত তুমি কোনো একটি জন্তুর ছায়া দেখলে, দেখে ভাবলে ছায়াটি ঘোড়ার বোধহয়, কিন্তু তুমি নিশ্চিত নও। কাজেই তুমি নিশ্চয়ই ঘুরে দাঁড়াবে আর তখনই দেখতে পাবে ঘোড়াটিকে এবং সেটা নিশ্চয়ই সেই আবছা ঘোড়র-ছায়াটার চেয়ে যারপরনাই সুন্দর হবে দেখতে, সেটার কাঠামোর রেখাগুলোও ছায়াটার চেয়ে অনেক বেশি স্পষ্ট এবং নিখুঁত হবে। ঠিক একইভাবে প্লেটোও বিশ্বাস করতেন যে প্রাকৃতিক সমস্ত কিছুই শাশ্বত আকার কিংবা বা ভাব-এর ছায়া ছাড়া কিছু নয়। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষই ছায়ার মধ্যেকার জীবন নিয়েই খুশিমনে থাকে। ছায়াটা কীসের তা নিয়ে মাথা ঘামায় না তারা। তারা মনে করে ওখানে ছায়া ছাড়া আর কিছুই নেই; এ-কথা তারা উপলব্ধি করে না যে ওগুলো আসলে ছায়া, আসল বস্তু নয়। ফলে তারা তাদের আত্মার অমরত্ব নিয়ে কোনো মাথাই ঘামায় না।
.
গুহার অন্ধকারের বাইরে
এই ব্যাপারটিই বিশদ করে বোঝাবার জন্যে একটা পুরাণের সাহায্য নিয়েছেন প্লেটো। এটাকে বলা হয় গুহা-পুরাণ। আমি নিজের ভাষায় গল্পটা বলছি তোমাকে।
মনে করো কিছু লোক মাটির নিচের একটি গুহায় বাস করে। গুহার প্রবেশপথের দিকে পেছন ফিরে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় তারা এমনভাবে বসা যে গুহার পেছনের। দেয়ালটাই শুধু দেখতে পায় তারা। তাদের পেছনে রয়েছে একটা উঁচু দেয়াল আর সেই দেয়ালের পেছন দিয়ে মানুষের মতো কিছু প্রাণী আসা-যাওয়া করে দেয়ালটার ওপরে নানান ধরনের মূর্তি উঁচু করে ধরা অবস্থায়। এ-সব মূর্তির পেছনে একটা অগ্নিকুণ্ড থাকায় গুহার পেছনের দেয়ালে এই মূর্তিগুলোর কাঁপা কাঁপা ছায়া পড়ে। কাজেই গুহার বাসিন্দারা এই ছায়াবাজিই দেখতে পায় কেবল। জন্ম থেকেই এই অবস্থায় বসে আছে তারা, কাজেই তারা মনে করে এই ছায়াগুলো ছাড়া জগতে আর কিছুই নেই।
এবার কল্পনা করো, এই গুহাবাসীদের মধ্যে একজন কোনোরকমে বাঁধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিতে সক্ষম হলো। প্রথমেই সে নিজেকে যে প্রশ্নটি জিগ্যেস করে তা হলো গুহার দেয়ালে এই ছায়াগুলো কোত্থেকে এলো। তো, ঘুরে দাঁড়িয়ে সে দেয়ালের ওপরে তুলে ধরা মূর্তিগুলো দেখার পর কী ঘটবে বলে মনে হয় তোমার? প্রথমেই, প্রখর সূর্যের আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে যাবে তার। মূর্তিগুলোর স্পষ্টতা দেখেও তার চোখ ধাধিয়ে যাবে, কারণ এতোদিন সে কেবল সেগুলোর ছায়াই দেখে এসেছে। সে যদি দেয়ালের ওপরে উঠে অগ্নিকুণ্ডটার পাশ দিয়ে বাইরের পৃথিবীতে চলে আসতে পারে তাহলে তো তার চোখ ধাঁধাবে আরো। কিন্তু চোখ দুটো রগড়ে নিয়ে সামনে তাকালে প্রতিটি জিনিসের সৌন্দর্য দেখে সে হতবাক হয়ে যাবে। প্রথমবারের মতো সে দেখতে পাবে নানান রং এবং স্পষ্ট কিছু আকৃতি। দেখতে পাবে আসল জীব-জন্তু ও ফুল; গুহার ছায়াগুলো ছিল এগুলোরই দুর্বল প্রতিচ্ছবি। এবারো সে ভাববে এ-সব জীব-জন্তু ও ফুল কোত্থেকে এলো। এরপর সে হয়ত দেখতে পাবে আকাশের সূর্যটাকে, উপলব্ধি করবে যে এই জিনিসটিই এ সব ফুল এবং জীব-জন্তুকে প্রাণ দিয়েছে, ঠিক যেমন অগ্নিকুণ্ড দৃশ্যমান করে তুলেছিল ছায়াগুলোকে।
নিজের এই সদ্য-পাওয়া স্বাধীনতায় উৎফুল্ল হয়ে উচ্ছল গুহাবাসীটি এরপর তিড়িং বিড়িং নাচতে নাচতে গ্রামের পথে উধাও হয়ে যেতে পারতো, কিন্তু তার বদলে তার মনে পড়ে যায় এখনো গুহায় রয়ে যাওয়া তার সঙ্গীদের কথা। ফিরে যায় সে। সেখানে পৌঁছে সে গুহাবাসীদের বোঝাবার চেষ্টা করে যে গুহার ছায়াগুলো বাস্তব জিনিসের কাঁপা কাঁপা প্রতিচ্ছবি ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু তারা তাকে বিশ্বাস করে না। গুহার দেয়ালটার দিকে ইঙ্গিত করে তারা বলে তারা যা দেখছে সেগুলো ছাড়া অন্য কোনো কিছুরই অস্তিত্ব নেই। শেষে তারা সবাই মিলে মেরে ফেলে লোকটাকে।
গুহা-পুরাণের সাহায্যে প্লেটো আসলে ছায়াময় প্রতিচ্ছবির দিক থেকে সমস্ত প্রাকৃতিক ঘটনার নেপথ্যে অবস্থিত প্রকৃত ভাব-এর দিকে দার্শনিকের যাত্রাপথটিকেই বোঝাতে চেয়েছেন। সম্ভবত তিনি সক্রেটিসের কথাও ভাবছিলেন, যাকে গুহাবাসীরা এই কারণে খুন করেছিল যে তিনি তাদের চিরায়ত ধ্যান-ধারণায় নাড়া দিয়েছিলেন এবং প্রকৃত অন্তদৃষ্টির পথটি দেখাতে চেয়েছিলেন। গুহা-পুরাণটি সক্রেটিসের সাহস এবং তার নৈতিক দায়িত্ববোধকেই ফুটিয়ে তুলেছে।
গুহার অন্ধকার আর গুহার বাইরের জগতের মধ্যে যে সম্পর্ক, তা প্রাকৃতিক জগতের আকার এবং ভাব-জগতের মধ্যেকার সম্পর্কের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ, এটাই প্লেটোর বক্তব্য। তার মানে এই নয় যে তিনি বলতে চান প্রাকৃতিক জগৎ অন্ধকার এবং নীরস, তবে ভাব-এর স্পষ্টতার সঙ্গে তুলনায় তা অন্ধকার এবং নীরস। চমৎকার একটা ভূ-দৃশ্য বা ল্যান্ডস্কেপের ছবি নিশ্চয়ই অন্ধকারাচ্ছন্ন এবং নীরস নয়? কিন্তু সেটাতো কেবলই ছবি, তাই নয় কি?
.
দর্শনগত অবস্থা
গুহাপুরাণটির উল্লেখ পাওয়া যাবে রিপাবলিক নামে প্লেটোর এক সংলাপে। এই সংলাপে প্লেটো একটি আদর্শ রাষ্ট্রের ছবি তুলে ধরেছেন, অর্থাৎ তিনি একটি কাল্পনিক, আদর্শ বা আমরা যাকে ইউটোপিয়ান বলি সে-রকম একটি রাষ্ট্রের কথা বলেছেন। সংক্ষেপে, আমরা বলতে পারি, প্লেটো বিশ্বাস করতেন দার্শনিকেরাই রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন। মানবদেহের গঠনের ওপর ভিত্তি করে তিনি এ-ব্যাপারে তাঁর ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছেন।
প্লেটোর মতে, মানবদেহ তিনটি অংশ দিয়ে তৈরি: মাথা, বুক আর পেট। এই তিনটি অংশের প্রতিটির জন্যে মানবাত্মার মধ্যে একটি করে বিভাগ রয়েছে। প্রজ্ঞা মাথার অন্তর্গত, ইচ্ছা রয়েছে বুকে আর ক্ষুধা পড়েছে পেট-এর ভাগে। আত্মার এই তিনটি বিভাগের প্রতিটির রয়েছে আলাদা আলাদা আদর্শ বা গুণ। প্রজ্ঞার লক্ষ্য বিজ্ঞতা-র (wisdom) দিকে, ইচ্ছার লক্ষ্য সাহস-এর দিকে আর ক্ষুধার ক্ষেত্রে সেটাকে দমিয়ে রাখাটাই প্রথম কাজ, যাতে মিতাচার-এর (temperance) চর্চা করা যায়। দেহের এই তিনটি অংশ যখন একটি একক সত্তা হিসেবে কাজ করে, কেবল তখনই একটি সুসমঞ্জস বা গুণী ব্যক্তিকে দেখতে পাই আমরা। স্কুলে পড়ার সময় একটি শিশুকে প্রথমে অবশ্যই তার ক্ষুধাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার কৌশল শিখতে হবে, তারপরে তাকে অর্জন করতে হবে সাহস এবং শেষ পর্যন্ত প্রজ্ঞা এগিয়ে যাবে বিজ্ঞতার দিকে।
তো, প্লেটো এবারে ঠিক তিনভাগে বিভক্ত মানবদেহের মতোই একটি রাষ্ট্রের কথা কল্পনা করলেন। দেহের যেমন রয়েছে মাথা, বুক আর পেট, তেমনি রাষ্ট্রে থাকবে কিছু শাসক, সাহায্যকারী এবং শ্রমিক (এই, যেমন, কৃষক)। প্লেটো এখানে স্পষ্টতই গ্রীসের চিকিৎসাবিজ্ঞানকে তার মডেল হিসেবে ব্যবহার করছেন। একজন স্বাস্থ্যবান এবং সুসামঞ্জস্যপূর্ণ মানুষ যেমন ভারসাম্য ও মিতাচারের চর্চা করেন, ঠিক তেমনি একটি সুন্দর রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য হলো সেই রাষ্ট্রের প্রত্যেকেই সামগ্রিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তার নিজের অবস্থান সম্পর্কে ওয়াকিবহাল বা সচেতন।
প্লেটোর দর্শনের প্রতিটি অংশের মতো তার রাজনৈতিক দর্শনেরও বৈশিষ্ট্য বুদ্ধিবাদ (rationalism)। একটি সুন্দর রাষ্ট্র তখনই গঠিত হতে পারে যখন তা প্রজ্ঞার সাহায্যে পরিচালিত হয়। এবং মাথা যেমন দেহকে শাসন করে তেমনি সমাজকেও শাসন করবে দার্শনিকেরা।
এবার তাহলে দেখা যাক মানুষের এবং রাষ্ট্রের তিনটি অংশের মধ্যেকার সম্পর্ক একটি সহজ চিত্রের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা যায় কিনা।
দেহ আত্মা গুণ রাষ্ট্র
মাথা প্রজ্ঞা বিজ্ঞতা শাসক
বুক ইচ্ছা সাহস সাহায্যকারী
পেট ক্ষুধা মিতাচার শ্রমিক
হিন্দুদের বর্ণপ্রথার সঙ্গে প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের বেশ মিল রয়েছে। বর্ণপ্রথা অনুসারে, সবার মঙ্গলের জন্যে প্রত্যেকের জন্যে একটি কাজ নির্দিষ্ট করা আছে। আসলে প্লেটোর সময়ের অনেক আগে থেকেই হিন্দু বর্ণপ্রথা এই একইভাবে তিনভাগে বিভক্ত এবং এই তিনটে বর্ণ হচ্ছে সহায়ক শ্রেণী (পুরুত শ্রেণী), যোদ্ধা শ্ৰেণী এবং শ্রমিক শ্রেণী। এখনকার যুগে আমরা হয়ত প্লেটোর এই রাষ্ট্রকে টোটালিটারিয়ান বা একনায়কতন্ত্রী বলব। কিন্তু এই ব্যাপারটি লক্ষণীয় যে তিনি বিশ্বাস করতেন যে নারীরা ঠিক পুরুষদের মতো দক্ষতার সঙ্গেই শাসন করতে সক্ষম এবং সেটা স্রেফ এই সরল কারণে যে শাসকরা তাদের প্রজ্ঞার বলেই শাসন করেন। তিনি জোর দিয়ে বলেছেন যে প্রজ্ঞা প্রয়োগ করার ক্ষমতার দিক দিয়ে নারী এবং পুরুষের মধ্যে কোনো তফাৎ নেই, তবে শর্ত হচ্ছে তাদেরকে একই ধরনের প্রশিক্ষণ দিতে হবে আর সেই সঙ্গে সন্তান লালন-পালন ও ঘর-বাড়ি দেখাশোনার কাজ থেকে অব্যাহতি দিতে হবে। প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রে শাসক এবং যোদ্ধাদেরকে পারিবারিক জীবনযাপন করার বা ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারী হওয়ার এক্তিয়ার দেয়া হয়নি। আর সন্তান লালন-পালনের কাজকে এতোই গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়েছে যে ব্যক্তির হাতে ছেড়ে না দিয়ে দায়িত্বটি রাষ্ট্রের হাতেই ন্যস্ত করা হয়েছে। (প্লেটোই প্রথম দার্শনিক যিনি রাষ্ট্র পরিচালিত নার্সারি স্কুল এবং সার্বক্ষণিক শিক্ষার পক্ষে মত ব্যক্ত করেছেন।)
বেশ কিছু রাজনৈতিক অঘটনের পর প্লেটো লিখলেন তাঁর আইন নামের গ্রন্থটি। আর বইটিতে তিনি দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রের মর্যাদা দিলেন সাংবিধানিক রাষ্ট্রকে। এবার তিনি ব্যক্তিগত সম্পত্তি এবং পারিবারিক বন্ধন এই দুয়েরই প্রবর্তন করলেন। এতে করে নারী স্বাধীনতা খানিকটা ক্ষুণ্ণ হলো। অবশ্য তিনি এ-কথাও বললেন যে, যে রাষ্ট্র নারী জাতিকে শিক্ষা দেয় না, প্রশিক্ষণ দেয় না, সে-রাষ্ট্র হচ্ছে সেই মানুষটির মতো যে কেবল তার ডান হাতটিকেই নানান কাজ করার উপযুক্ত করে গড়ে তোলে।
মোটের ওপর আমরা এ-কথা বলতে পারি যে প্লেটো যে-যুগে বাস করে গেছেন সে-যুগের বিবেচনায় নারীর প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ইতিবাচক। সিম্পোজিয়াম নামের তার সংলাপে একজন নারীকে, কিংবদন্তীসম এক যাজিকা দিওতিমা-কে (Diotima), তিনি এক বিরল সম্মানে ভূষিত করেছেন। প্লেটোর বক্তব্য অনুযায়ী, সক্রেটিস তাঁর দার্শনিক অন্তদৃষ্টি লাভ করেছেন এই নারীরই কাছ থেকে।
তো, সোফি, এই হচ্ছেন প্লেটো। তার অবাক করা তত্ত্বগুলো দুহাজারেরও বেশি সময় ধরে আলোচিত হয়েছে, সমালোচিত হয়েছে। আর এ-কাজটি যিনি সর্বপ্রথম করেছিলেন তিনি তাঁরই একাডেমির একজন ছাত্র। নাম তার অ্যারিস্টটল এবং তিনিই এথেন্সের তৃতীয় মহান দার্শনিক।
আজ এ-পর্যন্তই।
***
সোফি যখন প্লেটো সম্পর্কে পড়ছিল, পুবদিকে বনের ওপর তখন সূর্য উঠে গেছে। সে যখন ঐ জায়গাটা পড়ছিল কী করে এক লোক গুহা থেকে বেরিয়ে বাইরের চোখ ধাঁধানো আলোয় এসে চোখ পিটপিট করছিল, সূর্যটা তখন দিগন্তের ওপরে উঠে উঁকি দিচ্ছিল।
ব্যাপারটা যেন অনেকটা এরকম যে সে নিজেই মাটির নিচের একটা গুহা থেকে বাইরে এসে দাঁড়িয়েছিল। সোফি উপলব্ধি করল প্লেটো সম্পর্কে পড়ার পর প্রকৃতির ব্যাপারে তার দৃষ্টিভঙ্গি পুরোপুরি পাল্টে গেছে। যেন কালার বর্নান্ধ সে আগে। কিছু ছায়া দেখতো, কিন্তু কোনো স্পষ্ট ভাব কখনো দেখেনি।
সোফি ঠিক নিশ্চিত নয় শাশ্বত নকশা (patterns) সম্পর্কে প্লেটো যা যা বলেছেন তার সবই সঠিক কিনা, কিন্তু তারপরেও তার মনে হলো জগতের সমস্ত কিছুই যে ভাব-জগতের আকারগুলোর ত্রুটিপূর্ণ অনুকৃতি, এই চিন্তাটি খুবই চমৎকার। কারণ, সব ফুল, গাছ, মানুষ আর জীব-জন্তুই কি অসম্পূর্ণ নয়?
তার চারপাশের সব কিছুই এতো সুন্দর আর জীবন্ত বলে মনে হচ্ছে যে ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে চোখ দুটো রগড়ে নিতে হলো তাকে। কিন্তু সে যা দেখছে তার কিছুই টিকবে না, থাকবে না। তারপরেও একশ বছরের মধ্যেই সেই একই। ফুল একই জীব-জন্তু ফের এসে হাজির হবে এখানে। প্রতিটি ফুল, প্রতিটি জীব-জন্তু পৃথিবীর বুক থেকে মুছে যাওয়ার পরেও এমন একটা কিছু রয়ে যাবে যার মনে থাকবে এগুলো সব দেখতে কেমন ছিল।
বাইরের দিকে তাকাল সোফি। হঠাৎ একটা কাঠবেড়ালী একটা পাইন গাছের কাণ্ড বেয়ে দৌড়ে উঠে গেল। কয়েক বার পাক খেল সেটা কাণ্ডটাকে ঘিরে, তারপর হারিয়ে গেল ডালপালার আড়ালে।
আগেও তোকে দেখেছি আমি, ভাবল সোফি। এটা সে ঠিকই বুঝতে পারল যে, হয়ত ঠিক এই কাঠবেড়ালীটিকেই সে দেখেনি আগে। কিন্তু সে ঠিক একই আকার দেখেছে। কারণ তার মনে হলো প্লেটো সম্ভবত ঠিকই বলেছেন। হয়ত সে সত্যিই শাশ্বত কাঠবেড়ালী দেখেছে ভাব-জগতে, তার আত্মা একটি মানবদেহে বাসা বাঁধার আগে।
এমন কি সত্যিই হতে পারে যে এই জীবনের আগে তার একটা জীবন ছিল? আগেও একবার জীবনধারণ করেছে সে? ঘুরে বেড়ানোর মতো একটা দেহ পাওয়ার আগে তার আত্মার কি সত্যিই কোনো অস্তিত্ব ছিল? আর এটাও কি আসলেই সত্যি যে নিজের ভেতরে সে একটা ছোট সোনার পিণ্ড বয়ে নিয়ে বেড়ায়– একটা মানিক, যার কোনো ক্ষয় হয় না সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, একট আত্মা, যা তার নিজের দেহ বুড়ো হয়ে মরে যাওয়ার পরেও বেঁচে থাকবে?