১৪. দুই সংস্কৃতি
…শূন্যে ভেসে বেড়ানো এড়াবার একমাত্র উপায়…
প্রিয় সোফি, শিগগিরই দেখা হবে আমাদের। আমি আন্দাজ করেছিলাম মেজরের কেবিনে যাবে তুমি আবার, সেজন্যেই হিল্ডার বাবার পাঠানো কার্ডগুলো সব ওখানেই রেখে এসেছিলাম। কার্ডগুলো ওর কাছে পৌঁছানোর আর কোনো উপায় ছিল না। কার্ডগুলো সে কীভাবে পাবে তা নিয়ে বেশি মাথা ঘামানোর দরকার নেই তোমার। ১৫ই জুনের আগে অনেক কিছুই ঘটতে পারে।
আমরা দেখেছি হেলেনিস্টিক দার্শনিকেরা কীভাবে তাঁদের আগেকার দার্শনিকদের ধারণাগুলোকে ব্যবহার করে নতুন দর্শনের সৃষ্টি করেছেন। কেউ কেউ তো আবার তাদের পূর্বসূরীদেরকে ধর্মীয় প্রবক্তাতেও রূপান্তরিত করতে চেয়েছিলেন। প্লটিনাস প্লেটোর প্রশংসা করতে গিয়ে তাঁকে মানব জাতির ত্রাণকর্তার আসন দিয়েছিলেন প্রায়।
কিন্তু আমরা জানি, আমরা এখন যে-সময়টা নিয়ে আলোচনা করছি ঠিক এই সময়েই আরেক জন ত্রাণকর্তা জন্ম নিয়েছিলেন আর সে-ঘটনাটা ঘটেছিল গ্রেকো-রোমান এলাকার বাইরে। আমি নাজারেথ-এর যীশুর কথা বলছি। এই অধ্যায়ে আমরা দেখবো হিল্ডার জগৎ যেভাবে ধীরে ধীরে আমাদের জগতে ঢুকে পড়ছে অনেকটা সেভাবে খ্রিস্ট ধর্ম কি করে ধীরে ধীরে গ্রেকো-রোমান জগতে ঢুকে পড়ল।
যীশু ছিলেন ইহুদি আর ইহুদিরা সেমিটিক সংস্কৃতির মানুষ। গ্রীক এবং রোমানরা ইন্দো-ইউরোপিয় সংস্কৃতির মানুষ। ইউরোপিয় সংস্কৃতির শেকড় এই দুই সংস্কৃতিতেই রয়েছে। তবে, খ্রিস্ট ধর্ম কী করে গ্রেকো-রোমান সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করল সেটা ভালো করে বোঝার চেষ্টা করার আগে এই শেকড়গুলো পরীক্ষা করে দেখাটা ভীষণ জরুরি।
.
ইন্দো–ইউরোপিয়দের কথা (The Indo-Europeans)
ইন্দো-ইউরোপিয় বলতে আমরা সেই সব জাতি এবং সংস্কৃতির কথা বুঝিয়ে থাকি যারা ইন্দো-ইউরোপিয় ভাষা ব্যবহার করে। যে-সব জাতি ফিনো-ইউগরিয়ান ভাষাগুলোর (লাপ, ফিনিশ, এস্তোনিয় এবং হাঙ্গেরিয়) কোনো একটি বা বাস্ক ভাষা ব্যবহার করে সেগুলো ছাড়া ইউরোপিয় সমস্ত জাতিই ইন্দো-ইউরোপিয়। তাছাড়া ভারতীয় এবং পারসিক বেশিরভাগ ভাষাই ইন্দো-ইউরোপিয় ভাষা গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত।
আদি ইন্দো-ইউরোপিয়রা আজ থেকে ৪,০০০ বছর আগে কৃষ্ণ সাগর এবং কাস্পিয়ান সাগরের আশেপাশের এলাকায় বাস করত।
সেখান থেকে এই ইন্দো-ইউরোপিয় জনগোষ্ঠী বিভিন্ন দলে ছড়িয়ে পড়ে দক্ষিণ পূর্বে পারস্য (ইরান) আর ভারতে, দক্ষিণ-পশ্চিমে গ্রীস, ইতালি আর স্পেনে, পশ্চিমে মধ্য ইউরোপ থেকে ফ্রান্স আর ব্রিটেনে, উত্তর পশ্চিমে স্ক্যানডিনেভিয়ায় আর উত্তরে পূর্ব ইউরোপ ও রাশিয়ায়। যেখানেই গিয়েছে, ইন্দো-ইউরোপিয়রা স্থানীয় সংস্কৃতিকে নিজেদের অঙ্গীভূত করে নিয়েছে, অবশ্য সব জায়গাতেই ইন্দো ইউরোপিয় ভাষা এবং ইন্দো-ইউরোপিয় ধর্ম তার প্রাধান্য বজায় রেখেছে।
প্রাচীন ভারতীয় বেদশাস্ত্র, গ্রীক দর্শন এবং সরি স্টুলুসান (Snorri Sturluson-এর পূরাণ, এগুলো সব একই ধরনের ভাষাতে লেখা হয়েছে। তবে শুধু যে ভাষাগুলোই এক রকম তা নয়। একই রকম ভাষা, একই রকম ধ্যান-ধারণারও জন্ম দেয়। এই কারণেই আমরা প্রায়ই একটি ইন্দো-ইউরোপিয় সংস্কৃতির কথা বলে থাকি।
ইন্দো-ইউরোপিয়দের সংস্কৃতিকে সবচেয়ে বেশি যা প্রভাবিত করেছিল তা হলো বহু দেবতায় তাদের বিশ্বাস। বহু দেবতায় এই বিশ্বাসকে বলা হয় বহুদেবত্ববাদ (polytheism)। এই দেবতাদের নাম এবং ধর্মীয় পরিভাষার অনেক কিছুই গোটা ইন্দো-ইউরোপিয় এলাকা জুড়ে পাওয়া যাবে। কয়েকটা উদাহরণ দিচ্ছি তোমাকে:
প্রাচীন ভারতীয়রা দিয়ায়ুস (Dyaus) বলে একজন স্বর্গীয় দেবতার পূজা করতো। সংস্কৃত এই শব্দটির অর্থ আকাশ, দিবস, স্বর্গ। গ্রীক ভাষায় এই দেবতার নাম জিউস (Zeus), লাতিনে জুপিটার (Jupiter, প্রকৃতপক্ষে ইয়ভ-পেত্র বা স্বর্গপিতা) এবং প্রাচীন নর্স ভাষায় টির (Tyr)। কাজেই দিয়ায়ুস, জিউস, ইয়ভ এবং টির হচ্ছে একই শব্দের উপভাষাগত (dialectical) পরিবর্তিত রূপ।
তোমার হয়ত জানা আছে প্রাচীন ভাইকিংরা আসের (Aser) নামের একদল দেবতায় বিশ্বাস করত। এই শব্দটিও গোটা ইন্দো-ইউরোপিয় অঞ্চল জুড়ে প্রচলিত। ভারতের প্রাচীন ধ্রুপদী ভাষা সংস্কৃততে দেবতাদের অসুর বলা হয়, পারসিক ভাষায় আহুর। সংস্কৃত ভাষায় দেবতা বোঝাতে দেব শব্দটিও ব্যবহৃত হয়। পারসিকে দায়েভা, লাতিনে দিউস এবং প্রাচীন নর্স-এ টি।
ভাইকিংদের সময়ে লোকজন উর্বরতার বিশেষ একদল দেবতায় বিশ্বাস করত (যেমন নিয়ৰ্ড, ফ্রেইর, ফ্রেইয়া)। এই দেবতাদের সবাইকে বিশেষ একটা সামষ্টিক নামে ডাকা হতো: ভানের (vaner), এই শব্দটির সঙ্গে লাতিন ভাষায় উর্বরতার দেবী ভেনাসএর নামের সঙ্গে মিল রয়েছে। সংস্কৃততে কাছাকাছি শব্দ একটি আছে বাণী, যার অর্থ ইচ্ছা।
ইন্দো-ইউরোপিয় কিছু কিছু পুরাণের মধ্যেও মিল লক্ষ করা যায়। প্রাচীন নর্স দেবতাদের যে-সব কাহিনী সুরি লিখে গেছেন সেগুলোর সঙ্গে দুই তিন হাজার বছর আগে থেকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে প্রচলিত ভারতীয় কিছু পুরাণের সাদৃশ্য রয়েছে। যদিও সুরির পুরাণের প্রেক্ষাপট নর্ডিক, ভারতীয় পুরাণের ভারতীয়, তারপরেও সেগুলোর অনেকগুলোতেই এমন কিছু বৈশিষ্ট্য বা চিহ্ন বর্তমান যা দেখে বোঝা যায় সেগুলোর উৎস এক। যে-সব পুরাণ অমৃত এবং দেবতা ও অরাজকতা সৃষ্টিকারী দৈত্যদের মধ্যে যুদ্ধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সেগুলোতেই এ-সব চিহ্ন সবচেয়ে সুস্পষ্ট।
ইন্দো-ইউরোপিয় সংস্কৃতিগুলো জুড়ে চিন্তার ধরনেও সুস্পষ্ট সাদৃশ্য দেখতে পাবো আমরা। একটি খুব সাধারণ সাদৃশ্য হচ্ছে জগৎকে একটি নাটকের অন্তর্ভুক্ত হিসেবে বিবেচনা করার ধরনে, যেখানে শুভ এবং অশুভ শক্তিগুলো এক নিরন্তর সংগ্রামে রত। সেজন্য ইন্দো-ইউরোপিয়রা প্রায়ই শুভ এবং অশুভ-র মধ্যেকার যুদ্ধের গতি-প্রকৃতি নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করার চেষ্টা করত।
ইন্দো-ইউরোপিয় সাংস্কৃতিক বলয়ে গ্রীক দর্শনের উদ্ভব যে কোনো দুর্ঘটনা বা আকস্মিক ঘটনা নয় সে-কথা একেবারে মিথ্যে নয়। ভারতীয়, গ্রীক এবং নর্স, সব পুরাণেই জগৎ সম্পর্কে একটি দার্শনিক বা চিন্তাশীল দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে।
ইন্দো-ইউরোপিয়রা জগতের ইতিহাসের ভেতর অন্তদৃষ্টি-র (insight) অনুসন্ধান করেছে। গোটা ইন্দো-ইউরোপিয় বিশ্ব জুড়ে এক সংস্কৃতি থেকে আরেক সংস্কৃতিতে অন্তদৃষ্টি বা জ্ঞান বোঝাতে আমরা এমনকী একটি বিশেষ শব্দ-ও পাবো। সংস্কৃততে শব্দটি বিদ্যা। বিদ্যা এবং প্লেটোর দর্শনে সেই অতি গুরুত্বপূর্ণ গ্রীক idea বা ভাব শব্দটি একই। লাতিনে আমরা পাই ভিডিও (video), রোমান পরিমণ্ডলে যার অর্থ স্রেফ দেখা। আমরা যখন বলি দেখতে পাচ্ছি, তখন তার অর্থ হতে পারে বুঝতে পারছি আর কার্টুনে উডি উডপেকার-এর মাথায় যখনই কোনো অসাধারণ চিন্তা বা বুদ্ধি খেলে যায় তখন হয়ত তার ওপর একটা বাল্ব জ্বলে উঠতে দেখা যায়। (আমাদের যুগ আসার আগ পর্যন্ত দেখা শব্দটা টিভি পর্দার দিকে তাকিয়ে থাকার সমার্থক হয়নি। আমরা জানি ইংরেজিতে wise এবং wisdom বলে দুটো শব্দ আছে, জার্মান ভাষায় রয়েছে wissen (জানা)। নরওয়েজিয় ভাষায় রয়েছে viten শব্দটি, মূলগতভাবে যা ভারতীয় শব্দ বিদ্যা, গ্রীক ida এবং লাতিন video-র মতোই।
মোট কথা, এ-কথা আমরা জোর দিয়ে বলতে পারি যে ইন্দো-ইউরোপিয়দের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইন্দ্রিয় ছিল দৃষ্টি। ভারতীয়, গ্রীক, পারসিক এবং টিউটন, সব ভাষার সাহিত্যই বিশিষ্ট হয়ে আছে মহৎ মহাজাগতিক দৃষ্টি বা কল্পনার কারণে। (আবার সেই শব্দটি এসে গেল: দৃষ্টি বা vision শব্দটি এসেছে লাতিন ক্রিয়া video থেকে।) দেব-দেবীর এবং পৌরাণিক ঘটনার ছবি আঁকা ও মূর্তি গড়াটাও ইন্দো-ইউরোপিয় সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য।
সব শেষে বলা যায়, ইতিহাস সম্পর্কে ইন্দো-ইউরোপিয়দের ছিল একটি আবর্তনশীল দৃষ্টিভঙ্গি। এর অর্থ হচ্ছে এই বিশ্বাস যে, বছরের ঋতুগুলোর মতো ইতিহাস-ও চক্রাকারে ঘোরে। কাজেই, ইতিহাসের শুরুও নেই শেষও নেই, তার বদলে আছে নানান সভ্যতা; জন্ম এবং মৃত্যুর ভেতরে এক শাশ্বত পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে সে-সব সভ্যতার উত্থান এবং পতন ঘটে।
হিন্দু এবং বৌদ্ধ, প্রাচ্যের এই দুই বড় ধর্মেরই উৎস ইন্দো-ইউরোপিয়। গ্রীক দর্শনেরও তাই এবং হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের মধ্যে আমরা যেমন বেশ কিছু স্পষ্ট সাদৃশ্য দেখতে পাবো, তেমনি পাবো এই দুইয়ের সঙ্গে গ্রীক দর্শনের। এমনকী আজো হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্ম ভীষণভাবে দার্শনিক চিন্তা-ভাবনা প্রভাবিত।
হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মে এই বিষয়টির ওপর প্রায়ই বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে যে সব কিছুর মধ্যেই দেব-দেবী বা ঈশ্বর রয়েছেন (সর্বেশ্বরবাদ, Pentheism) এবং ধর্মীয় অন্তদৃষ্টির সাহায্যে মানুষ ঈশ্বরের সঙ্গে মিলিত হতে পারে। (প্লটিনাসের কথা মনে পড়ে, সোফি?) সেজন্যে চাই গভীর আত্নসংযোগ বা ধ্যান। এই কারণেই প্রাচ্যে নিষ্ক্রিয়তা এবং নিঃসঙ্গতাকে কখনো কখনো ধর্মীয় আদর্শ হিসেবে দেখা হয়। প্রাচীন গ্রীসেও অনেক মানুষ ছিলেন যারা আত্নার নির্বাণলাভের জন্য কঠোর তপস্যাপূর্ণ বা ধর্মীয়ভাবে নিঃসঙ্গ একটি জীবনে বিশ্বাস করতো। মধ্যযুগীয় সন্ন্যাস জীবনের বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য গ্রেকো-রোমান সভ্যতার বিভিন্ন বিশ্বাস থেকে নেয়া।
একইভাবে, দেহান্তর বা পুনর্জন্ম ইন্দো-ইউরোপিয় বহু সংস্কৃতিরই একটি মৌলিক বিশ্বাস। ২,৫০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রত্যেক ভারতীয়র জীবনের পরম উদ্দেশ্য এই পুনর্জন্মের চক্র থেকে মুক্তি লাভ। প্লেটোও দেহান্তরে বিশ্বাস করতেন।
.
সীমাইটদের কথা (The Semites)
সোফি, এবার যাওয়া যাক, সীমাইটদের প্রসঙ্গে। এরা সম্পূর্ণ ভিন্ন সংস্কৃতি এবং ভাষা বিশিষ্ট একটি দল। আরবীয় উপদ্বীপ উৎপত্তিস্থল হলেও, এরাও পৃথিবীর নানান স্থানে ডেরা বেঁধেছে। ইহুদিরা নিজেদের ঘর-বাড়ি থেকে বহু দূরে ঘুরে বেড়িয়েছে ২,০০০ বছর ধরে। খ্রিস্ট সমাজের বদৌলতে সেমিটিক ইতিহাস এবং ধর্ম তার উৎস থেকে যারপরনাই দূরে চলে যায়, অবশ্য সেমিটিক সংস্কৃতি ইসলামের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল দূর-দূরান্তে।
ইহুদী, খ্রিস্টান এবং ইসলাম, পশ্চিমের এই তিনটি ধর্মই পটভূমিগত দিক দিয়ে সেমিটিক। মুসলিমদের পবিত্র শাস্ত্রগ্রন্থ কোরান সেমিটিক ভাষাগোষ্ঠীর ভাষায় লেখা হয়েছিল; ওল্ড টেস্টামেন্টও তাই। দেবতা বোঝাতে ওল্ড টেস্টামেন্টে যে-সব শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে তার একটি শব্দার্থগত মূলের দিক থেকে মুসলিম আল্লাহর মতোই। (আল্লাহ শব্দের সাদামাটা অর্থ দেবতা।)।
আমরা যখন খ্রিস্টধর্মের দিকে তাকাই, ছবিটা তখন বেশ জটিল হয়ে ওঠে। খ্রিস্টধর্মেরও একটি সেমিটিক পটভূমি রয়েছে, কিন্তু নিউ টেস্টামেন্টরচিত হয়েছিল গ্রীক ভাষায়; এবং খ্রিস্টিয় ধর্মতত্ত্ব যখন গঠিত হয় তখন তাতে গ্রীক ও লাতিন প্রভাব পড়েছিল, ফলে হেলেনিস্টিক দর্শনের প্রভাবও বাদ যায়নি।
ইন্দো-ইউরোপিয়রা বহু দেবতায় বিশ্বাসী ছিল। এদিকে সীমাইটদের বৈশিষ্ট্য এই যে, একেবারে গোড়ার দিক থেকেই তারা এক ঈশ্বরে বিশ্বাসী এবং এই বিশ্বাসই তাদেরকে এক করেছে। একে বলা হয় একেশ্বরবাদ (monotheism)। ইহুদি, খ্রিস্টান এবং ইসলাম, এই তিন ধর্মই এই মৌলিক ধারণায় বিশ্বাসী যে, ঈশ্বর আছেন কেবল একজনই।
সেই সঙ্গে সীমাইটরা ইতিহাস সম্পর্কে একটি একরৈখিক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করত। অন্য কথায় বলতে গেলে, ইতিহাসকে দেখা হোতো ক্রমেই এগিয়ে যেতে থাকা একটি রেখা হিসেবে। গোড়াতে ঈশ্বর জগৎ সৃষ্টি করেছেন আর সেটাই ছিল ইতিহাসের শুরু। কিন্তু একদিন ইতিহাসের সমাপ্তি ঘটবে এবং সে হবে বিচারের দিন সেদিন ঈশ্বর জীবিত এবং মৃতদের বিচার করবেন বা তাদের পাপ-পুণ্যের হিসাব নেবেন।
ইতিহাস যে-ভূমিকা পালন করে তা এই তিন পশ্চিমী ধর্মে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে বিবেচিত। এ-কথা বিশ্বাস করা হয় যে, ঈশ্বর ইতিহাসের গতিপথে হস্তক্ষেপ করেন বা বাগড়া দেন, এমনকী ব্যাপারটা আসলে এ-রকম যে ঈশ্বর যাতে জগতে তার ইচ্ছার বাস্তবায়ন ঘটাতে পারেন সেজন্যেই ইতিহাসের সৃষ্টি হয়েছে। ঠিক যেভাবে একবার তিনি আব্রাহামকে প্রতিশ্রুত দেশের পথ দেখিয়েছিলেন, সেভাবেই তিনি মানবজাতির পদক্ষেপকে ইতিহাসের ভেতর দিয়ে শেষ বিচারের দিনের দিকে নিয়ে যান। দিনটি যখন আসবে সেদিন জগতের সমস্ত অশুভ ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে।
ইতিহাসের গতিপথে ঈশ্বরের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে এই জোরালো বিশ্বাসে বিশ্বাসী সীমাইটরা কয়েক হাজার বছর ধরেই ইতিহাস লিপিবদ্ধ করার কাজে নিজেদের ব্যস্ত রেখেছে। আর ইতিহাসগত এ-সব শেকড়ই তাদের পবিত্র শাস্ত্রগ্রন্থগুলোর ভিত্তিমূল রচনা করেছে।
এমনকী আজো ইহুদি, খ্রিস্টান এবং মুসলিম, সবার কাছে জেরুজালেম একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় স্থান বলে বিবেচিত। এ-ব্যাপারটি এই তিন ধর্মের একই প্রেক্ষাপট বা পটভূমির কথাই নির্দেশ করে। শহরটিতে রয়েছে কয়েকটি বিখ্যাত সিনাগগ (ইহুদিদের), গির্জা (খ্রিস্টানদের) আর মসজিদ (মুসলিমদের)। কাজেই এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে জেরুজালেম একটি কলহের বিষয় হয়ে উঠেছে, মানুষের হাতেই মারা পড়েছে হাজার হাজার মানুষ, স্রেফ এই কারণে যে তারা কেউই এই ব্যাপারে একমত হতে পারছে না যে এই শাশ্বত নগরী-র কর্তৃত্ব কার হাতে থাকবে। কামনা করি জাতিসংঘ একদিন জেরুজালেমকে এই তিন ধর্মেরই পবিত্র স্থান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে। (আমরা আমাদের দর্শন কোর্সের এই আরো বাস্তব সংশ্লিষ্ট অংশটি সম্পর্কে আপাতত কোনো কথা বলব না। আমরা এটাকে হিল্ডার বাবার হাতেই ছেড়ে দেবো। এতোদিনে নিশ্চয়ই তুমি বুঝতে পেরেছে যে তিনি লেবাননে জাতিসংঘের একজন পর্যবেক্ষক। আরো সঠিকভাবে বললে আমাকে বলতে হয়, তিনি সেখানে মেজর হিসেবে চাকুরিরত আছেন। তুমি যদি কিছু কিছু যোগসূত্র আবিষ্কার করে থাকো সেটা অস্বাভাবিক কিছু নয়, এমনটিই হওয়া উচিত। তবে আগ বাড়িয়ে কিছু ভেবে নেয়াটাও সঙ্গত হবে না।)
আমরা বলেছি যে ইন্দো-ইউরোপিয়দের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইন্দ্রিয় ছিল দৃষ্টি। শ্রবণ যে সীমাইটদের কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল সে-ব্যাপারটিও কিন্তু কম আকর্ষণীয় নয়। এটা কোনো আকস্মিক ব্যাপার নয় যে ইহুদি ধর্মমতের গোড়াতেই এই কথাগুলো রয়েছে: হে বনী ইসরায়েলগণ, শোনো! ওল্ড টেস্টামেন্ট পড়ে আমরা জানতে পারি লোকজন কী করে ঈশ্বরের কথা শুনতো। তাছাড়া ইহুদিরা সচরাচর এভাবেই তাদের ধর্মীয় উপদেশ শুরু করতো: এবং জিহোভা (ঈশ্বর) বললেন। ঈশ্বরের কথা শোনার ওপর খ্রিস্টধর্মেও গুরুত্ব দেয়া হয়। খ্রিস্টান, ইহুদি এবং ইসলাম ধর্মের নানান আচার-অনুষ্ঠান এবং উৎসবে জোরে বা সশব্দে পড়া বা আবৃত্তি-র একটি বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে।
আমি এ-কথাও বলেছি যে ইন্দো-ইউরোপিয়রা সব সময়ই তাদের দেব-দেবীর ছবি আঁকত বা মূর্তি গড়তো। অন্য দিকে সীমাইটদের বৈশিষ্ট্য হলো এ-কাজটি তারা কখনোই করতো না। ঈশ্বর বা দেবতা-র ছবি আঁকা বা মূর্তি গড়া বারণ ছিল তাদের জন্যে। ওল্ড টেস্টামেন্টে স্পষ্ট আদেশ দেয়া আছে যে মানুষ ঈশ্বরের কোনো প্রতিমূর্তি তৈরি করতে পারবে না। ইহুদি এবং ইসলাম ধর্মে এটা আজো অবশ্যপালনীয় একটি নিয়ম। আবার বিশেষ করে ইসলাম ধর্মে ছবি তোলা এবং ছবি আঁকার ব্যাপারে একটি বিরাগপূর্ণ মনোভাব রয়েছে, কারণ কোনো কিছু তৈরিতে ঈশ্বরের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হওয়া মানুষের উচিত নয়।
কিন্তু, তুমি হয়ত ভাবছে, খ্রিস্টানদের গির্জায়-তো যীশু এবং ঈশ্বরের ছবির ছড়াছড়ি। সে-কথা সত্যি, সোফি, তবে খ্রিস্ট সমাজ যে গ্রেকো-রোমান বিশ্ব দ্বারা কতটা প্রভাবিত হয়েছিল এটা তারই একটা নিদর্শন মাত্র। (গ্রীক অর্থোডক্স চার্চে, অর্থাৎ গ্রীস এবং রাশিয়ায় খোদাই করা মূর্তি বা ভাস্কর্য বা যীশুর ক্রুশবিদ্ধমূর্তি একেবারে সেই বাইবেলের যুগ থেকেই নিষিদ্ধ।)
পশ্চিমী তিন ধর্ম ঈশ্বর এবং তাঁর সৃষ্টির মধ্যেকার একটি দূরত্বের ব্যাপারে গুরুত্ব আরোপ করে, যা কিনা প্রাচ্যের প্রধান ধর্মগুলোর দৃষ্টিভঙ্গির একবারে বিপরীত। আর, উদ্দেশ্যটা পুনর্জন্মের চক্রের হাত থেকে নিস্তার পাওয়া নয়, বরং পাপ এবং দোষ-ক্রটি মুক্ত হওয়া। তাছাড়া, আত্ম-সংযোগ এবং ধ্যান নয়, বরং প্রার্থনা, উপদেশ এবং শাস্ত্রগ্রন্থ পাঠই এই তিন ধর্মীয় জীবনের বৈশিষ্ট্য।
.
ইস্রায়েল
সোফি, তোমার স্কুলের ধর্ম শিক্ষকের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়ার কোনো ইচ্ছে আমার নেই, কিন্তু তারপরেও চলো খ্রিস্ট ধর্মের ইহুদি পটভূমির ব্যাপারে চট করে একটা নজর বুলিয়ে নেয়া যাক।
ঈশ্বর জগৎ সৃষ্টি করার পরেই শুরু হয়েছিল সব কিছু। বাইবেলের প্রথম পাতাটা পড়লেই তুমি জেনে যাবে কীভাবে তা ঘটেছিল। তো, এরপর মানুষ ঈশ্বরের বিরুদ্ধাচারণ করতে শুরু করে। তার শাস্তিস্বরূপ যে অ্যাডাম এবং ঈকে নন্দনকানন (Garden of Eden) থেকে কেবল তাড়িয়েই দেয়া হয় তা নয়, সেই সঙ্গে পৃথিবীতে মৃত্যুর প্রচলন ঘটে।
গোটা বাইবেল জুড়েই ঈশ্বরের বিরুদ্ধে মানুষের বিদ্রোহের নানা কাহিনী ছড়িয়ে আছে। বুক অত্ জেনেসিস-এর আরো খানিকটা এগোলেই আমরা মহাপ্লাবন আর নোয়া-র (Noah) জাহাজের কাহিনী পাবো। এরপর আমরা দেখতে পাবো ঈশ্বর আব্রাহাম আর তার বংশধরদের সঙ্গে একটি চুক্তিতে (covenant) আবদ্ধ হলেন। এই চুক্তি অনুযায়ী আব্রাহাম আর তার সব বংশধর ঈশ্বরের অনুশাসন মেনে চলবেন। আর তার বিনিময়ে ঈশ্বর প্রতিজ্ঞা করলেন, তিনি আব্রাহামের বংশধরদের নিরাপত্তা বিধান করবেন বা তাদের রক্ষা করবেন। ১২০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দের দিকে সিনাই পর্বতের ওপর মোজেস-কে দশটি অনুজ্ঞা প্রদানের সময় এই চুক্তিটি নতুন করে করা হয়। ইস্রায়েলিয়রা তখন দীর্ঘদিন যাবৎ মিশরে বন্দি, কিন্তু ঈশ্বরের সাহায্যে তাদেরকে আবার ইস্রায়েলে ফিরিয়ে আনা হয়।
যীশুর জন্মের প্রায় ১,০০০ বছর আগে, অর্থাৎ গ্রীক দর্শন নামের কোনো কিছুর যখন কোনো অস্তিত্ব ছিল না, সেই সময়কার তিন জন মহান ইস্রায়েল রাজার কথা জানা যায়। প্রথম জন হলেন সজল, দ্বিতীয় জন ডেভিড এবং তৃতীয়জন সলোমন। এই সময় সমস্ত ইস্রায়েলিয় একটি রাজ্যে সংঘবদ্ধ হয় এবং বিশেষ করে রাজা ডেভিডের নেতৃত্বে রাজনৈতিক, সামরিক এবং সাংস্কৃতিক গৌরবের একটি যুগ অতিবাহিত করে।
কেউ রাজা হওয়ার পর জনগণ তার শরীরে আনুষ্ঠানিকভাবে তেল লেপন করত, ফলে রাজা মেসিয়াহ (Messiah) উপাধি লাভ করতেন। কথাটার অর্থ, যার শরীরে তেল লেপন করা হয়েছে। ধর্মীয় দৃষ্টিতে রাজাকে দেখা হতো ঈশ্বর আর তাঁর লোকজনের মাঝখানে একজন মধ্যস্থতাকারী হিসেবে। কাজেই রাজাকে তাই। ঈশ্বরের পুত্র-ও বলা যেতো আর তার রাজ্য বা দেশকে ঈশ্বরের রাজ্য।
কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই ইস্রায়েল তার ক্ষমতা হারাতে শুরু করে এবং এ সময় উত্তর রাজ্য (ইসরায়েল) ও দক্ষিণ রাজ্য (জুডা) এই দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ৭২২ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে উত্তরের রাজ্যটি অ্যাসিরিয়রা জয় করে নেয় এবং দেশটি তার সমস্ত রাজনৈতিক ও ধর্মীয় গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে। দক্ষিণ রাজ্যটির বেলাতেও এর চেয়ে ভালো কিছু ঘটল না, ব্যাবিলনিয়দের হাতে রাজ্যটির পতন ঘটে ৫৮৬ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে। রাজ্যের মন্দিরটি ধ্বংস করে ফেলা হয় আর বেশিরভাগ লোকজনকেই দাস হিসেবে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় ব্যাবিলনে। এই ব্যাবিলনীয় দাসত্ব ৫৩৯ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ পর্যন্ত স্থায়ী হয়, এই বছরেই তাদেরকে জেরুজালেমে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয় এবং এই বছরেই বিশাল মন্দিরটি পুনর্নির্মাণ করা হয়। তবে যীশুর জন্মের আগ পর্যন্ত বাকি সময়টা ইহুদিদেরকে বৈদেশিক শাসনাধীনই কাটাতে হয়।
ইহুদিদের মনে এবার প্রশ্ন জাগতে শুরু করে ডেভিডের রাজ্য কেন ধ্বংস হয়ে গেল আর ঈশ্বর ইসরাইলকে নিজের হাতেই রাখবেন এ-প্রতিশ্রুতি তিনি ইহুদিদের দেয়ার পরেও কেন একের পর এক মহাদুর্যোগ নেমে আসছে তাদের ওপর। তবে এ-কথাও সত্যি যে লোকজনও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তারা ঈশ্বরের অনুজ্ঞা বা আদেশ যথাযথভাবে পালন করবে। তাই ধীরে ধীরে তারা মেনে নিতে শুরু করে যে ঈশ্বর ইস্রায়েলকে তার অবাধ্যতার শাস্তি দিচ্ছেন।
আসলে ৭৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকেই বিভিন্ন নবী বলতে শুরু করেন যে ঈশ্বর তাঁর নির্দেশ পালন না করায় ইস্রায়েল-এর ওপর ক্রুদ্ধ হয়েছেন। তারা বলতেন, ঈশ্বর একদিন ইস্রায়েল-এর বিচার করতে বসবেন। এ-ধরনের ভবিষ্যদ্বাণীকে বলা হয় শেষ দিন-এর ভবিষ্যদ্বাণী।
ধীরে ধীরে আরো নবী আসেন যাঁরা বলতে শুরু করেন যে ঈশ্বর কিছু নির্বাচিত লোকজনকে ক্ষমা করবেন এবং তাদের কাছে ডেভিডের বংশে এক শান্তির রাজপুত্র বা এক রাজা পাঠাবেন। তিনিই ডেভিডের হারানো রাজ্য পুনরুদ্ধার করবেন এবং মানুষ একটি সমৃদ্ধশালী ভবিষ্যৎ পাবে।
নবী ইসাইয়া বললেন, যে-সব লোক অন্ধকারে পথ চলেছে তারা একটি বিরাট আলো দেখতে পাবে আর যারা মৃত্যুর ছায়ার দেশে বাস করে তাদের ওপর আলো পড়ে ঝলমল করবে। এ-সব ভবিষ্যদ্বাণীকে আমরা বলি পরিত্রাণ লাভের ভবিষ্যদ্বাণী।
সংক্ষেপে বললে: রাজা ডেভিডের অধীনে ইস্রায়েলের লোকজন সুখেই ছিল। কিন্তু পরে যখন তাদের অবস্থার অবনতি ঘটে তখন তাদের নবীরা জোর দিয়ে বলতে থাকেন যে ডেভিডের বংশে একদিন নতুন রাজার আবির্ভাব ঘটবে। এই মেসিয়াহু বা ঈশ্বর-পুত্র মানুষকে পরিত্রাণ করবেন, ইস্রায়েল-এর মহত্ত্ব ফিরিয়ে আনবেন এবং ঈশ্বরের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করবেন।
.
যীশু
ধরে নিচ্ছি তুমি এখনো আছে আমার সঙ্গে, সোফি। সে যাই হোক, আসল কথা হলো মেসিয়াহ, ঈশ্বর-পুত্র আর ঈশ্বরের রাজ্য। গোড়ার দিকে এর সব কটিকেই নেয়া হয়েছিল রাজনৈতিকভাবে। যীশুর সময়ে অনেকেই মনে করতো রাজনৈতিক, সামরিক আর ধর্মীয় একজন নেতার অর্থে রাজা ডেভিডের সমকক্ষ একজন মেসিয়াহু আসবেন। কাজেই এই রক্ষাকর্তাকে দেখা হতো এক জাতীয় পরিত্রাতা হিসেবে যিনি রোমান শাসনাধীন ইহুদিদের দুঃখ-যন্ত্রণা দূর করবেন।
বেশ, ভালো কথা। কিন্তু দূরদৃষ্টিসম্পন্ন আরো বেশ কিছু মানুষও ছিল তখন। এর আগে প্রায় দুশো বছর ধরে অনেক নবী এসেছেন যারা বিশ্বাস করতেন যে প্রতি মেসিয়া গোটা বিশ্বের পরিত্রাণ করবেন। তিনি শুধু ইস্রায়েলিয়দেরই বিদেশী শাসনের জোয়াল থেকে মুক্ত করবেন না, সমস্ত মানবজাতিকেই রক্ষা করবেন তিনি পাপ আর দোষ থেকে, এমনকী মৃত্যু থেকেও। মুক্তিলাভের অর্থে মোক্ষলাভ-এর তীব্র আকাঙ্খ তাই গোটা হেলেনিস্টিক জগতে ছড়িয়ে পড়ে।
অতএব আবির্ভূত হলেন নাজারেথ এর যীশু (Jesus of Nazareth°)। ইতিহাসে তিনিই যে প্রথম প্রতিশ্রুত মেসিয়াহ হিসেবে সামনে এসে দাঁড়ালেন তা কিন্তু নয়। যীশু নিজেও ঈশ্বর-পুত্র, ঈশ্বরের রাজ্য আর মুক্তিলাভ, এই কথাগুলো ব্যবহার করেছেন। সেদিক দিয়ে পূর্ববর্তী নবীদের সঙ্গে তার একটা যোগসূত্র রয়েছে। বিশেষ এক সিংহাসন আরোহন অনুষ্ঠান বা আচারের মাধ্যমে প্রাচীন রাজারা যেভাবে অভিষিক্ত হতেন, ঠিক সেভাবেই তিনি জেরুজালেমে প্রবেশ করে নিজেকে মানুষের কাছে তাদের রক্ষাকর্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করলেন। জনসাধারণ তাঁকে সেভাবেই বরণ করে নিল। তিনি বললেন, সময় হয়েছে। ঈশ্বরের রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হতে আর দেরি নেই।
তবে এখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় রয়েছে: স্পষ্ট করে একটা কথা বলে যীশু নিজেকে অন্যান্য মেসিয়াহ্ থেকে আলাদা করে ফেললেন যে তিনি কোনো সামরিক বা রাজনৈতিক বিদ্রোহী নন। তাঁর আরাধ্য কাজ আরো বড়। প্রত্যেকের কাছেই তিনি নির্বাণ বা মোক্ষ লাভ আর ঈশ্বরের ক্ষমার কথা বললেন। যাদের সঙ্গে তাঁর পথে দেখা হলো তাদেরকে তিনি বললেন, তোমাদের পাপ ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে তার নামধারী আরেক জনের অছিলায়।
এভাবে পাপমুক্তি বিলি করার কথা আগে কখনো শোনেনি মানুষ। তারচেয়ে যেটা ভয়ংকর কথা ঈশ্বরকে তিনি পিতা (আব্বা) বলে সম্বোধন করলেন। এ ধরনের কোনো নজির ইহুদি সম্প্রদায়ে একেবারেই ছিল না তখন। ফলে কিছুদিনের মধ্যেই ধর্মের ধ্বজাধারীরা নাখোশ হয়ে ওঠে তার বিরুদ্ধে।
তো, পরিস্থিতিটা ছিল মোটামুটি এরকম: যীশু খ্রিস্টের সময়ে অসংখ্য মানুষ একজন মেসিয়াহ্-র জন্যে অপেক্ষা করছিল যিনি বিপুল তূর্যনিনাদের মধ্যে (অন্য কথায়, আগুন আর তরবারির সাহায্যে) ঈশ্বরের রাজ্য পুনঃস্থাপন করবেন। যীশু উপদেশ এবং শিক্ষার মধ্যে ঈশ্বরের রাজ্য কথাটি প্রায়ই এসেছে ঘুরে ফিরে, কিন্তু অনেক বৃহত্তর অর্থে। যীশু বলেছেন ঈশ্বরের রাজ্য হচ্ছে প্রতিবেশীকে ভালোবাসা, দুর্বল আর গরীবদের জন্যে সহানুভূতি আর যারা ভুল করেছে তাদের জন্যে ক্ষমা।
এ-ছিল রণলিপ্সু একটি প্রাচীন অভিব্যক্তির অর্থের এক নাটকীয় পরিবর্তন। লোকজন আশা করছিল এক সামরিক শাসক, শিগগিরই যিনি ঈশ্বরের রাজ্য-র পত্তনের কথা ঘোষণা করবেন, অথচ এলেন আলখাল্লা আর চপ্পল পরা যীশু, বললেন ঈশ্বরের রাজ্য বা নতুন চুক্তি-টি হচ্ছে নিজেকে যেমন ভালোবাসো ঠিক সে রকমভাবে ভালোবাসতে হবে তোমার প্রতিবেশীকে। কিন্তু সেটাই সব কথা নয় সোফি। তিনি আরো বললেন যে, শত্রুকেও ভালোবাসতে হবে আমাদের। তারা। যখন আমাদেরকে আঘাত করবে তখন আমরা কোনোভাবেই পাল্টা আঘাত হানতে পিরবো না। বরং অন্য গালটা পেতে দেবো। সেই সঙ্গে তাদের ক্ষমা করে দেবো, সাতবার নয়, সত্তর গুণ সাতবার।
যীশু নিজেই দেখিয়ে গেছেন যে বারবণিতা, দুর্নীতিপরায়ণ সুদখোর অথবা রাজনৈতিকভাবে ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত ব্যক্তিকে তিনি অস্পৃশ্য বলে ঘৃণা করতেন না। তিনি বরং আরো এক ধাপ এগিয়ে বলেছিলেন যে কাজ-কর্ম কিছুই জানে না এমন কোনো লোক যে-কিনা তার বাবার কাছ থেকে পাওয়া সমস্ত ধন-সম্পত্তি ফুকে দিয়েছে, অথবা সরকারী তহবিল তছরূপ করেছে এমন কোনো সাধারণ কর্মচারীও যখন ঈশ্বরের সামনে দাঁড়িয়ে অনুতাপ করে এবং ক্ষমা প্রার্থনা করে তখন তারাও পুণ্যবান হয়ে যায়, ঈশ্বরের করুণা এতোই অপার।
শুধু তাই নয়, যীশু এখানেই থামলেন না তিনি আরো বললেন যে এই ধরনের পাপীরা ঈশ্বরের কাছে সেই সব নিষ্কলঙ্ক ফ্যারিসির (Pharisee) চেয়েও বেশি ন্যায়পরায়ণ আর তার ক্ষমার যোগ্য যারা তাদের সদৃগুণের প্রদর্শনী করে বেড়ায়।
যীশু মন্তব্য করেছেন যে কেউই ঈশ্বরের করুণা অর্জন করতে পারে না। আমরা নিজেরা আমাদের নির্বাণ বা মোক্ষ দিতে পারি না (অনেক গ্রীক যা কিনা বিশ্বাস করতো)। সামন অন দ্য মাউন্ট বা পর্বতের হিতোপদেশ-এ যে কঠোর নৈতিক শুদ্ধতা যীশু দাবি করেছেন সে কেবল ঈশ্বরের ইচ্ছা কী তাই শেখাবার জন্যেই নয়, বরং এ-কথাও জানানোর জন্যে যে ঈশ্বরের দৃষ্টিতে কেউ-ই ন্যায়পরায়ণ নয়। তার করুণা অপার, কিন্তু তার ক্ষমা পেতে চাইলে আমাদেরকে ঈশ্বরের মুখাপেক্ষী হতে হবে আর তার ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে।
যীশু আর তাঁর শিক্ষার ব্যাপারে আরো ব্যাপক পড়াশোনার ব্যাপারটি আমি তোমার ধর্মশিক্ষকের হাতেই ছেড়ে দিতে চাই। কাজটা নেহাৎ সামান্য হবে না তার জন্যে। আমার ধারণা, যীশু যে কী অসাধারণ এক মানুষ ছিলেন সেটা বুঝিয়ে দিতে সফল হবেন তিনি। এক অসাধারণ উপায়ে তিনি তার সময়ের ভাষা ব্যবহার করেছেন প্রাচীন রণ-উম্মাদনাকে এক নতুন সারবস্তু দান করতে। তিনি যে ক্রুশবিদ্ধ হয়ে প্রাণ ত্যাগ করেছেন তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। স্বার্থ আর ক্ষমতাসংক্রান্ত যে-সমস্ত বিষয় তিনি দূর করতে এসেছিলেন তার সঙ্গে মুক্তিলাভ সম্পর্কে তাঁর একেবারে মৌলিক বার্তার একটা বিরোধ দেখা দিল।
সক্রেটিস প্রসঙ্গে কথা বলার সময় আমরা দেখেছি মানুষের প্রজ্ঞা-র (Reason) কাছে আবেদন জানালে তা কতটা বিপজ্জনক হতে পারে। যীশু প্রসঙ্গে আমরা দেখছি নিঃশর্ত ভ্রাতৃতুল্য ভালোবাসা আর শর্তহীন ক্ষমার দাবি জানানো কতটা বিপজ্জনক হতে পারে। এমনকী আজকের এই পৃথিবীতেও আমরা দেখতে পাই শান্তি, ভালোবাসা আর গরীব মানুষের জন্যে খাবার এবং রাষ্ট্রের শত্রুর প্রতি রাজক্ষমার মতো সাধারণ কিছু দাবির মুখে বড় বড় শক্তি কীভাবে ভেঙে পড়ে।
তোমার হয়ত মনে আছে, এথেন্সের সবচেয়ে ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তিকে জীবন বিসর্জন দিতে হয়েছিল বলে প্লেটো কত ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। খ্রিস্টিয় শিক্ষা অনুযায়ী, পৃথিবীর সবচেয়ে ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তি ছিলেন যীশু। তারপরেও তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছিল। খ্রিস্টানরা বলে, যীশু মানবতার স্বার্থে প্রাণত্যাগ করেছিলেন। একেই খ্রিস্টানরা বলে থাকে যীশুর প্যাশন (Passion) বা যন্ত্রণাভোগ ও মৃত্যু। যীশু ছিলেন সেই যন্ত্রণাভোগী ভৃত্য যিনি এই কারণে মানবজাতির পাপ নিজ অঙ্গে ধারণ করেছিলেন যাতে আমরা প্রায়শ্চিত্ত করতে পারি, রক্ষা পেতে পারি ঈশ্বরের ক্রোধ থেকে।
.
পল
যীশুকে ক্রুশবিদ্ধ করার এবং কবর দেয়ার কিছুদিন পরেই একটা গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে তিনি কবর থেকে উঠে এসেছেন। তাতে করে তিনি প্রমাণ করেছেন যে তিনি সাধারণ কোনো মানুষ নন। সত্যিই তিনি ঈশ্বর-পুত্র।
আমরা বলতে পারি, ইস্টারের সকালে যীশুর পুনরুত্থানের গুজবের মধ্যে দিয়ে খ্রিস্টিয় গির্জার পত্তন হয়েছিল। আর সে-কথা পল-ই অত্যন্ত জোর দিয়ে বলে গেছেন: যীশু যদি পুনরুত্থিত না হয়ে থাকেন তাহলে আমাদের এই শিক্ষাদানও অসার, তোমাদের বিশ্বাসও অসার।
তো, এবার পুরো মানবজাতিই দেহের পুনরুত্থানের জন্যে আশা করতে পারে, তার কারণ আমাদেরকে রক্ষা করার জন্যেই যীশু ক্রুশবিদ্ধ হয়েছিলেন। কিন্তু, প্রিয় সোফি, একটা কথা মনে আছে নিশ্চয়ই যে ইহুদি ধর্মের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আত্মার অমরত্ব বা কোনো ধরনের দেহান্তর-এর প্রসঙ্গ অবান্তর ওটা একটা গ্রীক, তার অথ, ইন্দো-ইউরোপিয় চিন্তা। খ্রিস্ট ধর্ম অনুযায়ী-ও মানুষের মধ্যে এমন কিছু নেই, যেমন ধরা যাক আত্মা, যা নিজে অমর। খ্রিস্টিয় গির্জা যদিও দেহের পুনরুত্থান এবং অনন্ত জীবনে বিশ্বাসী, কিন্তু মানুষ মৃত্যু এবং নরকভোগ-এর হাত থেকে রক্ষা পেতে পারে কেবল ঈশ্বরের অলৌকিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমেই। সেটা আমাদের নিজস্ব কোনো গুণ বা অন্য কোনো প্রাকৃতিক বা সহজাত ক্ষমতার কারণে হবে না।
কাজেই গোড়ার দিককার খ্রিস্টানরা যীশু খ্রিস্টের ওপর বিশ্বাসের মাধ্যমে মোক্ষলাভের সুসমাচার প্রচার করতে শুরু করল। তার মধ্যস্থতায় ঈশ্বরের রাজ্য বাস্তব হয়ে উঠলো প্রায়। জয় করার জন্যে গোটা পৃথিবীই রইল এখন যীশু খ্রিস্টের সামনে। (হিব্রু শব্দ মেসিয়াহু বা যাকে অভিষিক্ত করা হয়েছে, তারই গ্রীক অনুবাদ হচ্ছে ক্রাইস্ট)।
যীশুর মৃত্যুর কয়েক বছর পর ফ্যারিসি পল (Paul) খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষিত হন। গোটা গ্রেকো-রোমান বিশ্বে তার মিশনারী সফরের মাধ্যমে খ্রিস্ট ধর্মকে বিশ্বের নানান অঞ্চলে ছড়িয়ে দেন তিনি। সে-কথা আমরা জানতে পারি দি অ্যাক্টস অভ দ্য অ্যাপোসল্স-এ। গোড়ার দিককার খ্রিস্টিয় ধর্মসভার কাছে লেখা পলের অসংখ্য চিঠির মাধ্যমে আমরা খ্রিস্টানদের উদ্দেশে তাঁর উপদেশ ও পরামর্শর কথা জানতে পারি।
এক সময় তিনি হাজির হলেন এথেন্সে। সোজা গিয়ে হাজির হলেন দার্শনিক রাজধানীর নগর-চত্বরে। বলা হয়ে থাকে, তখন সেই নগর প্রতিমাতে পরিপূর্ণ দেখিয়া তাহার অন্তরে তাঁহার আত্মা উত্তপ্ত হইয়া উঠল। তিনি এথেন্সে ইহুদিদের সিনাগগে গিয়ে এপিকিউরিয় আর স্টোয়িক দার্শনিকদের সঙ্গে আলাপ করলেন। তারা তাকে অ্যারিওপেগস পর্বতে নিয়ে গিয়ে জিগ্যেস করলেন, এই যে নূতন শিক্ষা আপনি প্রচার করিতেছেন, ইহা কি প্রকার, আমরা কি জানিতে পারি? কারণ আপনি কতকগুলি অদ্ভুত কথা আমাদের কানে তুলিতেছেন; অতএব আমরা জানিতে বাসনা করি এ সকল কথার অর্থ কি।
তুমি কল্পনা করতে পারো, সোফি? একজন ইহুদি হঠাৎ করে এথেন্সের বাজারে গিয়ে এমন একজন পরিত্রাতার কথা বলতে শুরু করলেন যিনি ক্রুশবিদ্ধ হয়ে মারা গিয়েছিলেন এবং পরে কবর থেকে উত্থিত হয়েছিলেন। এথেন্সে পলের এই সফর থেকেও গ্রীক দর্শন আর খ্রিস্টিয় পাপমুক্তি তত্ত্বের মধ্যেকার একটি আসন্ন বিরোধের আভাস পাই আমরা। তবে এথেন্সবাসীদেরকে পল তাঁর কথা শোনাতে সফল হয়েছিলেন বেশ ভালো করেই। অ্যারিওপেগস থেকে, অ্যাক্রোপলিসের গর্বিত সব মন্দিরের নিচে দাঁড়িয়ে পল এই ভাষণ দিলেন:
হে আথীনীয় লোকেরা, দেখিতেছি, তোমরা সর্ববিষয়ে বড়ই দেবতাব। কেননা বেড়াইবার সময়ে তোমাদের উপাস্য বস্ত সকল দেখিতে দেখিতে একটী বেদি দেখিলাম যাহার উপরে লিখিত আছে, অপরিচিত দেবের উদ্দ্যেশে। অতএব তোমরা যে অপরিচিতের ভজনা করিতেছ, তাহাকে আমি তোমাদের নিকট প্রচার করি।
ঈশ্বর, যিনি জগৎ ও তন্মধ্যস্থ সমস্ত বস্তু নির্মাণ করিয়াছেন, তিনিই স্বর্গের ও পৃথিবীর প্রভু, সুতরাং হস্তনির্মিত মন্দিরে বাস করেন না; কোনো কিছুর অভাব প্রযুক্ত মনুষ্যদের হস্ত দ্বারা সেবিতও হন না, তিনিই সকলকে জীবন ও শ্বাস ও সমস্তই দিতেছেন। আর তিনি এক ব্যক্তি হইতে মনুষ্যদের সকল জাতিকে উৎপন্ন করিয়াছেন, যেন তাহারা সমস্ত ভূতলে বাস করে; তিনি তাহাদের নির্দিষ্ট কাল ও নিবাসের সীমা স্থির করিয়াছেন; যেন তাহারা ঈশ্বরের অন্বেষণ করে, যদি কোন মতে হাতড়িয়া হাতড়িয়া তাঁহার উদ্দেশ পায়; অথচ তিনি আমাদের কাহারও হইতে দূরে নহেন। কেননা তাহাতেই আমাদের জীবন, গতি ও সত্তা; যেমন তোমাদের কয়েকজন কবিও বলিয়ছেন, কারণ আমরাও তাঁহার বংশ। অতএব আমরা যখন ঈশ্বরের বংশ, তখন ঈশ্বরের স্বরূপকে মনুষ্যের শিল্প ও কল্পনা অনুসারে ক্ষোদিত স্বর্ণের কি রৌপ্যের কি প্রস্তরের সদৃশ জ্ঞান করা আমাদের কর্তব্য নহে। ঈশ্বর সেই অজ্ঞানতার কাল উপেক্ষা করিয়াছিলেন, কিন্তু এখন সৰ্ব্বস্থানের সকল মনুষ্যকে মন পরিবর্তন করিতে আজ্ঞা দিতেছেন।
কেননা তিনি একটি দিন স্থির করিয়াছেন, যে দিনে আপনার নিরূপিত ব্যক্তি দ্বারা ন্যায়ে জগৎ-সংসারের বিচার করিবেন; এই বিষয়ে সকলের বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ দিয়াছেন, ফলতঃ মৃতগণের মধ্য হইতে তাহাকে উঠাইয়াছেন।
এথেন্স সফররত পল, সোফি! ভিন্ন একটা কিছু হিসেবে গ্রেকো-রোমান জগতে প্রবেশ করতে শুরু করেছে খ্রিষ্ট ধর্ম, এমন একটা কিছু যা এপিকিউরিয়, স্টোয়িক বা নিওপ্লেটোনিক দর্শন থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। তারপরেও পল তার প্রচারিত ধর্মের সঙ্গে এই সংস্কৃতির কিছু মিল খুঁজে বের করলেন। তিনি এ-কথা জোর দিয়ে বললেন যে ঈশ্বরের অনুসন্ধান করা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। কথাটা গ্রীকদের কাছে নতুন কিছু নয়। কিন্তু পলের শিক্ষা বা ধর্মোপদেশের মধ্যে যে-বিষয়টি নতুন তা হলো ঈশ্বর নিজেকে মানুষের কাছে প্রকাশ করেছেন এবং সত্যি বলতে কী, তিনি তাদের দিকে হাত বাড়িয়েও দিয়েছেন। কাজেই যে-ঈশ্বরকে লোকে তাদের বোধশক্তি দিয়ে বুঝতে পারে তিনি সে-রকম দার্শনিক ঈশ্বর নন। আবার, তিনি স্বর্ণ বা রৌপ্য বা প্রস্তর মূর্তি-ও নন, যে-ধরনের মূর্তি অ্যাক্রোপলিস বা নিচের বাজারে তখন ভুরি ভুরি পাওয়া যেতো। তিনি এমন এক ঈশ্বর যিনি হস্তনির্মিত মন্দিরে বাস করেন । তিনি একজন ব্যক্তিগত ঈশ্বর যিনি ইতিহাসের গতিপথে হস্তক্ষেপ করেন এবং মানবজাতির স্বার্থে কুশের ওপর নিজের জীবন বিসর্জন দেন।
দি অ্যাক্টস অভ অ্যাপোসলস-এ আমরা পড়ি, পল অ্যারিওপেগসে বক্তৃতা দেয়ার সময় মৃত্যু থেকে পুনর্জাগরণ সম্পর্কে যা বলেছিলেন তাই নিয়ে কিছু লোকজন তাঁকে উপহাস করেছিল। কিন্তু অন্যেরা বলেছিল: আপনার কাছে এ বিষয় আর একবার শুনিব। (১৭:৩২– অনুবাদক) সেখানে আরো কিছু লোক ছিল যারা পল কে অনুসরণ করে খ্রিস্ট ধর্মে বিশ্বাস স্থাপন করেছিল। একটা বিষয় এখানে উল্লেখযোগ্য যে এই বিশ্বাসস্থাপনকারীদের মধ্যে দামারিস নামের এক নারীও ছিল। খ্রিস্টমতে ধর্মান্তরিতদের মধ্যে সবচেয়ে আগ্রহী ছিল নারীরা।
তো, পল তার মিশনারী কার্যকলাপ চালিয়ে গেলেন। যীশুর মৃত্যুর কয়েক দশক পর সব কটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রীক ও রোমান নগরীতে-এথেন্স, রোম, আলেজান্দ্রিয়া, এফিসস আর করিন্থে-খ্রিস্টান জনগোষ্ঠী তৈরি হয়ে গেল। তিন থেকে চারশ বছরের মধ্যে গোটা হেলেনিস্টিক জগৎ-ই খ্রিস্টান হয়ে গেল।
.
ধর্মমত
শুধু একজন মিশনারী হিসেবেই যে পল খ্রিস্ট ধর্মের জন্যে অসাধারণ অবদান রেখেছিলেন তা কিন্তু নয়। খ্রিস্টিয় ধর্মসভাগুলোর (congregations) ওপরও তার প্রভাব অপরিসীম। আধ্যাত্মিক নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হচ্ছিল তখন চারদিকে।
যীশুর মৃত্যুর অল্প কয়েক বছরের মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে প্রশ্নটি দেখা দিল তা হচ্ছে যারা ইহুদি নয় তারা প্রথমে ইহুদি না হয়ে খ্রিস্টান হতে পারবে কিনা। যেমন ধরো, একজন গ্রীককে কি পথ্যবিধি মেনে চলতে হবে? পল বিশ্বাস করতেন, তার কোনো দরকার নেই। খ্রিস্ট ধর্ম ইহুদি ধর্মের নিছক কোনো উপদল নয়, তার চেয়ে বেশি কিছু। মোক্ষলাভের এক সার্বজনীন বাণীর মাধ্যমে তা নিজেকে সবার কাছে তুলে ধরে। ঈশ্বর আর ইস্রায়েল-এর মধ্যেকার পুরনো চুক্তি-র জায়গা নিয়েছে তখন নতুন চুক্তি, সে-চুক্তি যীশু সম্পাদন করেছেন ঈশ্বর আর মানবজাতির মধ্যে।
সে যাই হোক, খ্রিস্ট ধর্মই কিন্তু একমাত্র ধর্ম ছিল না তখন। আমরা দেখেছি হেলেনিজম কীভাবে নানান ধর্মের একীভবনের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়েছিল। কাজেই খ্রিস্ট ধর্মের একটি যথার্থ সংক্ষিপ্তসার নিয়ে এগিয়ে আসা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল খ্রিস্টিয় সম্প্রদায়ের জন্য, অন্যান্য ধর্মের সঙ্গে একটা দূরত্ব সৃষ্টির জন্যে তো বটেই, সেই সঙ্গে নিজ সম্প্রদায়ের মধ্যে যাতে মতভেদ বা ভাঙন সৃষ্টি না হয় সেজন্যেও। কাজেই, মূল খ্রিস্টিয় মতবাদ (dogma) বা নীতিগুলো সংক্ষেপ করে তৈরি হলো প্রথম ধর্মমত (Creed)।
এ-রকম একটি মূল মতবাদ ছিল এই যে, যীশু হলেন ঈশ্বর আর মানুষ দুই-ই। তিনি কেবল তার ক্রিয়াকলাপের বদৌলতেই ঈশ্বর-পুত্র নন। তিনি-ই স্বয়ং ঈশ্বর। কিন্তু সেই সঙ্গে তিনি একজন সত্যিকারের মানুষও বটে, যিনি মানুষের দুঃখ দুর্দশাগুলো ভাগ করে নিয়েছেন এবং বাস্তবিকই ক্রুশে যন্ত্রণাভোগ করেছেন।
ব্যাপারটা স্ববিরোধী বলেই মনে হতে পারে। কিন্তু খ্রিস্ট ধর্মের বক্তব্য ঠিক এই যে ঈশ্বর মানুষে পরিণত হয়েছেন। যীশু উপদেবতা (অর্থাৎ, অর্ধেক মানুষ এবং অর্ধেক দেবতা) ছিলেন না। এ-ধরনের উপদেবতায় বিশ্বাস অবশ্য গ্রীক আর হেলেনিস্টিক ধর্মগুলোতে যথেষ্ট পরিমাণে প্রচলিত ছিল। খ্রিস্ট ধর্ম শেখাল, যীশু ছিলেন সম্পূর্ণ ঈশ্বর এবং সম্পূর্ণ মানুষ।
.
পুনশ্চ
প্রিয় সোফি, পুরো ব্যাপারটা কী করে একসঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে সে-কথা বলতে দাও আমাকে। গ্রেকো-রোমান জগতে খ্রিস্ট ধর্মের প্রবেশের সময় আমরা দুই সংস্কৃতির এক নাটকীয় মিলন দেখতে পাই। সেই সঙ্গে দেখতে পাই ইতিহাসের মহান সাংস্কৃতিক বিপ্লবগুলোর একটিকে।
প্রায় বেরিয়ে আসছি আমরা প্রাচীন যুগ থেকে। প্রাচীন গ্রীক দার্শনিকদের পর প্রায় এক হাজার বছর পার হয়ে গেছে। আমাদের সামনে এখন খ্রিস্টিয় মধ্য যুগ। এ-যুগটিও প্রায় এক হাজার বছর স্থায়ী হয়েছিল।
জার্মান কবি গ্যেটে একবার বলেছিলেন, তিন হাজার বছর যে কাজে লাগাতে পারে না তার জীবন অর্থহীন। আমি চাই না শেষ পর্যন্ত তোমার জীবনও এ-রকম হোক। আমি সাধ্যমত চেষ্টা করবো তোমাকে তোমার ঐতিহাসিক শেকড়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে। মানুষ হওয়ার এটাই একমাত্র উপায়। একটা নগ্ন নর বানরের চেয়ে বেশি কিছু হওয়ার এটাই একমাত্র উপায়। এটাই শূন্যে ভেসে বেড়ানো এড়াবার একমাত্র উপায়।
.
মানুষ হওয়ার এটাই একমাত্র উপায়। একটা নগ্ন নর-বানরের চেয়ে বেশি কিছু হওয়ার এটাই একমাত্র উপায়…
বেড়ার ছোট ছোট ফুটো দিয়ে বাগানের দিকে বেশ কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে চেয়ে বসে রইল সোফি। সে বুঝতে শুরু করেছে তার ঐতিহাসিক শেকড় সম্পর্কে জানাটা কেন এত জরুরি। ইস্রায়েল-এর লোকজনের কাছেও নিশ্চয়ই খুব জরুরি ছিল বিষয়টা।
সে নিজেও খুব সাধারণ একজন ব্যক্তি। তবে সে যদি তার ঐতিহাসিক শেকড় সম্পর্কে জানতে পারে তাহলে আর অতটা সাধারণ থাকবে না সে।
অল্প কিছু বছরের বেশি থাকছে না সে এই গ্রহে। তবে মানবজাতির ইতিহাস তার নিজের ইতিহাস হলে, এক অর্থে তার বয়স হাজার হাজার বছর।