৩৩. গার্ডেন পার্টি
…একটা সাদা কাক…
একেবারে অবশ-বিবশ হয়ে বিছানায় বসে রইল হিল্ডা। সে অনুভব করল ভারি রিং বাইন্ডার ধরা হাত দুটো কাঁপছে তার।
প্রায় এগারোটা বাজে। দুঘণ্টারও বেশি সময় ধরে পড়ছিল সে। মাঝে মাঝেই লেখা থেকে চোখ তুলে জোরে হেসে উঠছিল সে। কিন্তু সেই সঙ্গে মাঝে মাঝে হেসে একপাশে গড়িয়ে পড়েছে, মুখ হাঁ করেও থেকেছে। বাড়িতে সে একা থাকাতে ভালোই হয়েছে।
আর, গত দুই ঘণ্টায় কত কিছুর ভেতর দিয়েই না গেছে সে! ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল কেবিন থেকে বনের মধ্যে দিয়ে বাড়ি যাওয়ার পথে সোফি যে মেজরের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছিল তাই দিয়ে। শেষ পর্যন্ত একটা গাছে বসেছিল সে আর তাকে রক্ষা করেছিল লেবানন থেকে এক গার্ডিয়ান অ্যাঞ্জেলের মতো এসে হাজির হওয়া হাঁসী মর্টেন।
ঘটনাটা যদিও অনেক অনেক দিন আগের তারপরেও হিল্ডা কখনোই ভুলতে পারেনি তার বাবা যে তাকে দ্য ওয়ান্ডারফুল অ্যাডভেঞ্চার্স অড় নিল বইটা পড়ে শুনিয়েছিলেন। এরপর বেশ কয়েক বছর পর্যন্ত তার আর তার বাবার মধ্যে বইটার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত একটা ভাষা চালু ছিল। এবার উনি সেই পুরনো হাঁসীটাকে আবার বের করে এনেছেন।
তো, এরপর একটা ক্যাফেতে প্রথমবারের মতো একা যাওয়ার অভিজ্ঞতা হয় সোফির। হিল্ডা বিশেষভাবে অবাক হয়েছিল সাত্রে আর অস্তিত্ববাদ সম্পর্কে অ্যালবার্টোর কথা শুনে। আরেকটু হলেই উনি তাকে কনভার্ট করে ফেলেছিলেন-যদিও রিং বাইন্ডারে তিনি এর আগেও অনেকবারই করেছেন।
একবার, প্রায় বছর খানেক আগে, জ্যোতিষবিদ্যার ওপর একটা বই কিনেছিল সে। আরেকবার এক সেট টারট কার্ড নিয়ে বাড়ি ফিরেছিল সে। আরেকবার আধ্যাত্মবাদ-এর ওপর একটা বই নিয়ে। প্রতিবারই কুসংস্কার আর হিল্ডার বিচার-বিবেচনা বোধ নিয়ে লেকচার ঝেড়েছেন তার বাবা, তবে শেষ আঘাতটার জন্যে তিনি এতোদিন অপেক্ষা করে ছিলেন। তার প্রতিটি আঘাত একেবারে সঠিক জায়গায় গিয়ে লেগেছে। স্পষ্টতই, এ-ধরনের জিনিসের বিরুদ্ধে একটা সামগ্রিক সতর্কবাণী ছাড়া তো তার মেয়েকে বেড়ে উঠতে দেয়া যায় না। পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়ার জন্যে একটা রেডিও স্টোরের টিভি পর্দা থেকে তিনি হাত নেড়েছেন তার উদ্দেশে। নিজেকে এই কষ্টটা দেয়ার কোনো দরকার ছিল না তার…
সোফিকে নিয়েই সবচেয়ে বেশি ভাবল সে। সোফি-কে তুমি? কোত্থেকে এলে তুমি? কেন তুমি আমার জীবনে এলে?
শেষে সোফিকে একটা বই দেয়া হয়েছে তার নিজের সম্পর্কে। হিল্ডার হাতে এখন যে বইটা রয়েছে ওটা কি সেই একই বই? এটা তো নেহাতই একটা রিং বাইন্ডার। কিন্তু তারপরেও, নিজের সম্পর্কে লেখা একটা বইয়ে একজন কী করে তার নিজের সম্পর্কে লেখা একটা বই পায়? সোফি যদি সেই বইটা পড়তে শুরু করে, তখন?
কী ঘটবে এখন? কী ঘটতে পারত এখন? তার রিং বাইন্ডার-এ অল্প কটা পৃষ্ঠা বাকি আছে মাত্র।
.
শহর থেকে বাড়ি ফেরার পথে বাসেই সোফির দেখা হয়ে গেল তার মায়ের সঙ্গে। এই যাহ্! সোফির হাতের বইটা দেখে ফেললে মা কী ভাববেন?
পার্টির জন্যে কেনা সমস্ত স্ট্রিমার আর বেলুন ভর্তি ব্যাগটার ভেতর বইটা চালান করে দেয়ার চেষ্টা করল সোফি, কিন্তু পুরোপুরি পেরে উঠল না।
হাই সোফি! একই বাস ধরেছি আমরা! কী দারুণ।
হাই মা!
বই কিনেছিস বুঝি?
না, ঠিক তা না।
সোফির জগৎ.কী অদ্ভুত।
সোফি জানত মা-র কাছে মিথ্যে বলার সামান্যতম সুযোগও পাবে না সে।
অ্যালবার্টো দিয়েছেন ওটা।
তা বেশ বুঝতে পারছি। আগেই বলেছি এই লোকটার সঙ্গে দেখা হওয়ার আশায় আছি আমি। দেখি বইটা।
অন্তত বাড়ি পৌঁছানো পর্যন্ত সবুর করা যায় না? বইটা আমার, মা।
আলবাৎ তোর বই। আমি শুধু প্রথম পৃষ্ঠাটায় একটু নজর বুলাতে চাই। ঠিক আছে?…স্কুল থেকে বাসায় ফিরছে সোফি অ্যামুন্ডসেন। প্রথমে, খানিকটা পথ, জোয়ানা সঙ্গে হাঁটছিল সে। রোবট নিয়ে কথা বলছিল ওরা…
সত্যি সত্যি এ-কথা লেখা আছে ওখানে?
হ্যাঁ, আছে সোফি। অ্যালবার্ট ন্যাগ বলে একজন লিখেছে বইটা। নিশ্চয়ই নতুন লেখক। ভালো কথা, তোর অ্যালবার্টোর নাম যেন কী।
নক্স।
সম্ভবত দেখা যাবে যে এই অসাধারণ লোকটি তোর সম্পর্কে গোটা একটা বই লিখে ফেলেছে, সোফি। এটাকে বলে ছদ্মনাম ব্যবহার করা।
ইনি তিনি নন, মা। বাদ দাও না। যাই বলল, তুমি কিন্তু কিছু বোঝে না।
তা ঠিক, আমারও মনে হয় আমি কিছু বুঝি না। কাল গার্ডেন পার্টি, তারপর সবকিছু আবার ঠিক হয়ে যাবে।
অ্যালবার্ট ন্যাগ বাস করে পুরোপুরি এক ভিন্ন বাস্তবতায়। সেজন্যেই এই বইটা একটা সাদা কাক।
এ-সব কিন্তু তোর আসলেই বন্ধ করতে হবে। আগে ওটা সাদা খরগোশ ছিল না?
তুমি-ই বন্ধ করো এ-সব!
ক্লোভার ক্লোজের শেষ মাথার স্টপে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত এই অব্দি-ই কথা হলো দুজনের। সোজা একটা মিছিলের মধ্যে গিয়ে পড়ল তারা।
মাই গড! হেলেন আমুন্ডসেন বিরক্ত হয়ে বলে উঠলেন। আমি তো ভেবেছিলাম অন্তত এই এলাকায় রাস্তার রাজনীতির হাত থেকে রেহাই পাবো আমরা।
মিছিলে বড়জোর দশ থেকে বারো জন লোক হবে। তাদের ব্যানারে লেখা:
মেজর আসতে আর দেরি নেই
মিডসামার-এর মজার মজার খাবার? অবশ্যই
জাতিসংঘের শক্তি বাড়ক
মায়ের জন্যে সত্যিই দুঃখ হলো সোফির।
সে বলল, কিছু মনে কোরো না।
কিন্তু এটাতো একটা অদ্ভুত মিছিল দেখছি, সোফি। সত্যি-ই একদম উদ্ভট।
নেহাতই সামান্য ব্যাপার।
দুনিয়াটা সব সময় আগের চেয়ে তাড়াতাড়ি পাল্টে যায়। সত্যি বলতে কী, আমি একটুও অবাক হইনি।
যা-ই বলল, তুমি যে অবাক হওনি সেজন্যেই অবাক হওয়া উচিত তোমার।
মোটেই না। ওরা কিন্তু হিংস্র ছিল না, কী তাই না? আমি শুধু ভাবছি ওরা আমাদের রোজবেডগুলো মাড়িয়ে দিল কিনা। বাগানে মিছিল করার নিশ্চয়ই কোনো দরকার নেই? চল, তাড়াতাড়ি বাড়ি গিয়ে দেখি।
এটা একটা দার্শনিক মিছিল, মা। আসল দার্শনিকেরা রোজবেড মাড়ান না।
আমি বলছি তোকে আসল কথাটা। আসল দার্শনিকে আর বিশ্বাস নেই আমার। সব কিছুই এখন নকল।
বিকেল আর সন্ধ্যেটা প্রস্তুতির কাজেই ব্যয় করল দুজনে। সকালেও তা অব্যাহত রাখলো টেবিল বসানো আর সাজানোতে। জোয়ানা এলো ওদের সঙ্গে হাত লাগাতে।
সব্বনাশ হয়েছে। বলে উঠল সে, মা আর বাবা-ও আসছে। দোষটা কিন্তু তোর সোফি!
অতিথিরা আসার আধ ঘণ্টা আগেই সব কিছু তৈরি হয়ে গেল। স্ট্রিমার আর জাপানি লণ্ঠনে গাছগুলো সাজানো হয়েছে। বাগানের গেট, পথের ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা সব গাছ আর বাড়ির সামনের অংশে বেলুন ঝোলানো হয়েছে। বিকেলের প্রায় পুরোটা সময় জুড়েই সোফি আর জোয়ানা মিলে ফুলিয়েছে ওগুলো।
চিকেন, স্যালাড আর বাড়ির তৈরি বিভিন্ন ধরনের ব্রেড দিয়ে সাজানো হয়েছে টেবিলগুলো। কিচেনে রয়েছে কিশমিশ দেয়া বনরুটি, লেয়ার কেক, ডেনিশ প্যাস্ট্রি আর চকোলেট কেক। কিন্তু গোড়া থেকেই টেবিলের একেবারে মাঝখানে আসরের মধ্যমণির জায়গাটা রাখা আছে অ্যামন্ড-পেস্ট রিং-এর একটা পিরামিড আকৃতির বার্থ ডে কেকটার জন্যে। কেকটার ওপর কনফার্মেশন-এর ড্রেস পরা একটি মেয়ের ছোট্ট একটা মূর্তি। সোফির মা তাকে এই বলে নিশ্চিত করেছে ওটা একটা কনফার্ম না-করা পনেরো বছর বয়েসী মেয়ের-ও মূর্তি হতে পারে, তবে সোফি নিশ্চিত যে তার মা যে ওটা ওখানে বসিয়েছেন সেটা এই জন্যে যে সোফি তাকে বলেছিল যে সে কনফার্মড হতে চায় কিনা তা যে নিজেই জানে না। মনে হয় তার মা ভেবেছেন যে কেকটাই কনফার্মেশনের প্রতিনিধিত্ব করছে।
পার্টি শুরু হওয়ার আগের আধ ঘণ্টায় তিনি বেশ কয়েকবার বললেন, কোনো খরচই কিন্তু বাদ রাখিনি।
অতিথিরা আসতে শুরু করল। প্রথমে এলো সোফির ক্লাসের তিনটি মেয়ে, সামার শার্ট, লং কার্ডিগান, লং স্কার্ট পরে, চোখে মেক-আপের সামান্য ছোঁয়া। খানিক পর হেঁটে গেট পার হয়ে জেরেমি আর ডেভিড এলো, লাজুক লাজুক ভাব আর ছেলেসুলভ ঔদ্ধত্যের মিশেল তাদের মধ্যে।
হ্যাপি বার্থ ডে।
তুই এখন এডাল্ট-ও বটে।
সোফি খেয়াল করল জোয়ানা আর জেরেমি এরিমধ্যে ইঙ্গিতপূর্ণভাবে চোখাচোখি করতে শুরু করে দিয়েছে। বাতাসের মধ্যেই কী যেন রয়েছে। সময়টা মিডসামার ঈভ।
প্রত্যেকেই জন্মদিনের উপহার নিয়ে এসেছে আর এটা যেহেতু একটা দার্শনিক গার্ডেন পার্টি তাই অতিথিদের মধ্যে অনেকেই চেষ্টা করেছে দর্শন কী তা বার করতে। তাদের সবাই দার্শনিক গোছের কিছু একটা লিখেছে। একটা ডায়েরি আর তালা ছাড়াও একটা দর্শন অভিধানও পেয়েছে সোফি। সেটার প্রচ্ছদের ওপর লেখা: আমার ব্যক্তিগত দার্শনিক চিন্তা-ভাবনা। অতিথিরা এসে পৌঁছাতে লম্বা ডাঁটিঅলা ওয়াইন গ্লাসে তাদের আপেলের রস পরিবেশন করা হলো। পরিবেশনের কাজটা করলেন সোফির মা।
স্বাগতম…তা এই নবীন যুবকের নাম কী? আগে কখনো আমাদের দেখা হয়েছে বলে তো মনে হয় না।…তুমি এসেছো, খুব খুশি হয়েছি, সেসিলি…
তরুণতর অতিথিরা সবাই এসে পৌঁছানোর পর ওয়াইন গ্লাস হাতে নিয়ে তারা যখন গাছগুলোর নিচে পায়চারী করে বেড়াচ্ছে, সাদা একটা মার্সিডিজে চেপে বাগানের গেটে উদয় হলেন জোয়ানার বাবা-মা। দামি একটা ধূসর স্যুট পরা অর্থনীতিক উপদেষ্টা ভদ্রলোক পরিপাটিভাবে সুসজ্জিত। তাঁর স্ত্রী পরেছেন টকটকে লাল চুমকি বসানো লাল প্যান্টস স্যুট। সোফি নিশ্চিত মহিলা ও-রকম পোশাক পরানো কোনো বার্বি ডল দোকান থেকে কিনেছিলেন, তারপর কোনো দর্জিকে দিয়ে পোশাকটা নিজের মাপমতো বানিয়ে নিয়েছেন। অবশ্য আরেকটা সম্ভাবনাও আছে হয়ত অর্থনীতিক উপদেষ্টাই পুতুলটা কিনে এক জাদুকরকে দিয়েছিলেন সেটাকে একটা জলজ্যান্ত নারীতে রূপান্তরিত করে দেয়ার জন্যে। কিন্তু এই সম্ভাবনাটা অবাস্তব, কাজেই সোফি, সেটা খারিজ করে দিল।
মার্সিডিজ থেকে বেরিয়ে হেঁটে বাগানে ঢুকলেন তাঁরা, সেখানে কমবয়েসী অতিথিরা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। অর্থনীতিক উপদেষ্টা লম্বা, সরু একটা প্যাকেট উপহার দিলেন ইঙ্গেব্রিগস্টেন পরিবারের পক্ষ থেকে। যখন দেখা গেল সত্যিই সেটা- হ্যাঁ আর কী-একটা বার্বি ডল, তখন প্রবল প্রচেষ্টায় স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করল সোফি। কিন্তু সে-রকম কোনো প্রয়াসই দেখা গেল না জোয়ানার মধ্যে
তোমার কি মাথা খারাপ? সোফি পুতুল খেলে না।
পোশাকের সমস্ত চুমকি ঝমঝমিয়ে বাজিয়ে তড়িঘড়ি ছুটে এলেন মিসেস ইঙ্গেব্রিগস্টেন। কিন্তু এটা তো স্রেফ সাজিয়ে রাখার জন্যে, বুঝলি না।
ইয়ে, সত্যিই অনেক অনেক ধন্যবাদ, ব্যাপারটা হালকা করতে চাইল সোফি। এবার আমি একটা কালেকশন গড়ে তোলার কাজ শুরু করতে পারি।
টেবিলের দিকে এগোতে শুরু করল লোকজন ধীরে ধীরে।
আমরা এখন কেবল অ্যালবার্টোর জন্যে অপেক্ষা করছি, খানিকটা চপল স্বরে সোফির মা বললেন তাকে, বলে তিনি তাঁর ক্রমেই বেড়ে ওঠা উৎকণ্ঠা লুকোতে চাইলেন। বিশেষ অতিথি সম্পর্কে নানান গুজব অন্যান্য অতিথির মধ্যে এরিমধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে।
তিনি কথা দিয়েছিল আসবেন, অতএব তিনি আসবেন।
কিন্তু উনি না আসা পর্যন্ত তো অন্য গেস্টদের বসতে দিতে পারি না আমরা, তাই না?
আলবাৎ পারি। চলো কাজ শুরু করি।
লম্বা টেবিল বরাবর লোকজনকে বসাতে শুরু করলেন হেলেন অ্যামুন্ডসেন। একটা ব্যাপার তিনি খেয়াল রাখলেন যাতে খালি চেয়ারটা তার নিজের আর সোফির চেয়ারের মাঝখানে থাকে। টুকটাক কথা বললেন তিনি সুন্দর আবহাওয়াটা আর সোফি যে এখন বড় হয়ে গেছে তাই নিয়ে।
তাঁরা আধ ঘণ্টা ধরে টেবিলে বসে আছেন এমন সময় কালো, ছাগলে-দাড়ি শোভিত আর বেরে-পরা মধ্যবয়স্ক এক লোক ক্লোভার ক্লোজ ধরে হেঁটে বাগানের গেটটা পেরিয়ে ভেতরে ঢুকলেন। পনেরোটা গোলাপ দিয়ে তৈরি একটা ফুলের তোড়া তার হাতে।
অ্যালবার্টো!
টেবিল ছেড়ে ছুটে গেল সোফি তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে। দুহাতে তাঁর গলা জড়িয়ে ধরল সে, তারপর ফুলের তোড়াটা নিল তার কাছ থেকে। এই সাদর অভ্যর্থনার জবাবে তিনি তাঁর জ্যাকেটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে গোটা কয়েক চীনা আতশবাজি বের করে এনে তাতে আগুন ধরিয়ে উঠোনে ছুঁড়ে দিলেন। টেবিলের দিকে এগোতে এগোতে একটা স্পার্কলার জ্বালিয়ে অ্যামন্ড পিরামিডের চুড়োয় বসিয়ে দিলেন সেটাকে। এরপর তিনি এগিয়ে গিয়ে সোফি আর তার মায়ের মধ্যেখানের ফাঁকা জায়গাটায় গিয়ে দাঁড়ালেন।
এখানে আসতে পেরে খুব খুশি হয়েছি আমি, বললেন তিনি।
অতিথিরা হতভম্ব একেবারে। মিসেস ইঙ্গেব্রিগস্টেন অর্থপূর্ণভাবে তাকালেন একবার তার স্বামীর দিকে। অবশ্য মানুষটি শেষ অব্দি আসাতে সোফির মা এতোটাই স্বস্তি পেলেন যে তিনি লোকটার যে কোনো অপরাধই ক্ষমা করে দিতেন। সোফি নিজে অবশ্য হাসি চাপবার চেষ্টা করে যাচ্ছিল।
হেলেন অ্যামুন্ডসেন তার গ্লাসে টোকা দিয়ে বলে উঠলেন: এই ফিলসফিকাল গার্ডেন পার্টিতে আসুন আমরা অ্যালবার্টো নক্স-কেও স্বাগত জানাই। উনি কিন্তু আমার নতুন বয় ফ্রেন্ড নন, কারণ আমার স্বামী যদিও প্রায়ই অনেক দূরে সমুদ্রে থাকেন, আপাতত আমার নতুন কোনো বয় ফ্রেন্ড নেই। সে যাই হোক, এই আশ্চর্য মানুষটি সোফির নতুন দর্শন শিক্ষক। আতশবাজি ফোঁটানো ছাড়াও অনেক গুণের অধিকারী তিনি। এই যেমন, তিনি টপহ্যাটের ভেতর থেকে একটা জ্যান্ত খরগোশ বের করে আনতে পারেন। নাকি সাদা কাক, সোফি?
অনেক ধন্যবাদ, বলে বসে পড়লেন অ্যালবার্টো।
চিয়ার্স বলে উঠল সোফি; তখন অতিথিরা তাদের গ্লাস উঁচু করে ধরলেন এবং অ্যালবার্টোর স্বাস্থ্য পান করলেন।
চিকেন আর সালাদ নিয়ে বেশ খানিকটা সময় কাটলো তাদের। হঠাৎ জোয়ানা উঠে দাঁড়িয়ে দৃঢ় পায়ে হেঁটে গেল জেরেমির দিকে, তারপর তার ঠোঁটে একটা সশব্দ চুমু খেল। জেরেমি সেটার প্রত্যুত্তর দিতে গিয়ে তাকে ভালো করে জড়িয়ে ধরতে টেবিলের ওপর জোয়ানাকে চিৎ করে ফেলল।
ইয়ে, আমি কোনোদিন…মিসেস ইঙ্গেব্রিগস্টেন বলে উঠলেন।
মিসেস অ্যামুন্ডসেন শুধু বললেন, বাচ্চারা, টেবিলের ওপর নয়।
কেন? তার দিকে ঘুরে জিগ্যেস করলেন অ্যালবার্টো।
এটা তো বড় অদ্ভুত প্রশ্ন।
একজন প্রকৃত দার্শনিকের পক্ষে প্রশ্ন করাটা কখনোই অসঙ্গত নয়।
কখনো চুমো খায়নি এ-রকম গোটা কতেক ছেলে মুরগির হাড়-গোড় ছুঁড়ে ফেলতে লাগল ছাদের ওপর। এবারো মৃদু একটা মন্তব্যই বেরোল শুধু সোফির মায়ের মুখ থেকে:
ও-রকম কোরো না। গাটার-এ হাড়গোড় ফেললে বড্ড বিশ্রি অবস্থার সৃষ্টি হয়।
দুঃখিত, একটা ছেলে বলল, তারপর তারা বাগানের বেড়ার ওধারে ছুঁড়ে ফেলতে লাগল হাড়গোড়গুলো।
আমার মনে হয় এবার প্লেটগুলো সরিয়ে নিয়ে কেক সার্ভ করা যেতে পারে, অবশেষে বললেন মিসেস অ্যামুন্ডসেন। সোফি আর জোয়ানা, আমাকে একটু সাহায্য করবি?
রান্নাঘরে যাওয়ার পথে ছোট্ট একটা আলাপ সেরে নেবার ফুরসৎ পাওয়া গেল।
ওকে চুমো খেলি কেন রে তুই, সোফি শুধোল জোয়ানাকে।
আমি বসে বসে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম, চুমো খাওয়ার লোভটা সামলাতে পারিনি। ও এতো কিউট!
কেমন লাগল রে।
যেমনটা ভেবেছিলাম সে-রকম নয়, কিন্তু…
এই প্রথমবার, তাই না?
কিন্তু শেষবার নয়।
শিগগিরই কফি আর কেক চলে এলো টেবিলে। অ্যালবার্টো তাঁর আতশবাজিগুলোর কিছু ছেলেদের মধ্যে বিলোতে শুরু করেছেন এমন সময় সোফির মা নিজের কফির কাপে টোকা দিয়ে বলে উঠলেন:
আমি লম্বা বক্তৃতা করবো না, কিন্তু কথা হচ্ছে আমার শুধু এই একটি মেয়েই আছে আর, ঠিক এক হপ্তা একদিন আগে সে পনেরোয় পা দিয়েছে। দেখতেই পাচ্ছেন আমরা খরচের বেলায় কোনো কার্পণ্য করিনি। বার্থডে কেকটার ওপর চব্বিশটা অ্যামন্ড রিং রয়েছে। যারা আগে আসবে তারা দুটো নিতে পারবে, কারণ আমরা শুরু করবো সবচেয়ে ওপর থেকে এবং যতই নিচে যাওয়া যাবে রিংগুলো ততোই বড় হতে থাকবে। জীবনের বেলাতেও একই ব্যাপার দেখা যায়। সোফি যখন ছোট ছিল তখন সে ছোট ছোট রিং-এর ভেতর লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে বেড়াত। কিন্তু দিন যতই গড়াতে লাগল, রিংগুলোও ততই বড় হতে লাগল। এখন রিংটা একেবারে সেই ওল্ড টাউন থেকে এখন পর্যন্ত, এতো বড়। আর তাছাড়া ওর বাবা যেহেতু সমুদ্রে সমুদ্রেই থাকেন সারা বছর, দুনিয়ার সব জায়গায় ফোন করে সোফি। সোফি, তোর ১৫শ জন্মদিনে আমরা তোকে শুভেচ্ছা জানাই।
দারুণ! মিসেস ইঙ্গেব্রিগস্টেন উচ্ছ্বসিতভাবে বলে উঠলেন। সোফি ঠিক বুঝতে পারল না তার মা, না বক্তৃতাটা, বার্থডে কেক নাকি সোফির কথা বলছেন মহিলা।
হাততালি দিয়ে উঠলেন অতিথিরা এবং একটি ছেলে নাশপাতি গাছের ওপর একটা আতশবাজি ছুঁড়ল। জোয়ানা টেবিল ছেড়ে গিয়ে জেরেমিকে তার চেয়ার থেকে টান দিয়ে উঠিয়ে ফেলল। ঘাসের ওপর শুয়ে পড়ল দুজন, তারপর চুমো খেতে শুরু করল একে অন্যকে। খানিক পর লাল-কিশমিশ ঝোপের ভেতর ঢুকে পড়ল তারা গড়িয়ে।
এখন মেয়েরাই ইনিশিয়েটিভ নেয়, জনাব ইঙ্গেব্রিগস্টেন বলে উঠলেন। এই কথা বলে তিনি উঠে গিয়ে লাল-কিশমিশ ঝোপের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাছে থেকে দেখতে থাকলেন ব্যাপারটা। বাকি অতিথিরাও তাঁকে অনুসরণ করলেন। কেবল সোফি আর অ্যালবার্টো বসে রইলেন টেবিলে। অন্য অতিথিরা এবার জোয়ানা আর জেরেমিকে ঘিরে দাঁড়াল অর্ধবৃত্তাকারে।
ওদেরকে থামানো যাবে না, মিসেস ইঙ্গেব্রিগস্টেন বলে উঠলেন, তাঁর গলায় ঈষৎ গর্বের ছোঁয়া।
উঁহু, এক প্রজন্ম আরেক প্রজন্মকে ফলো করে, তার স্বামী বললেন। চারদিকে তাকালেন তিনি, তাঁর সযত্নে বাছাই করা কথাগুলোর জন্যে তারিফের প্রত্যাশায়। কিন্তু যখন মাত্র দুয়েক জনের নীরব মাথা ওঠা-নামা ছাড়া আর কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেল না তখন তিনি যোগ করলেন: কিছুই আর করার নেই।
দূর থেকে সোফি দেখতে পেল জেরেমি জোয়ানার শার্টের বোতাম খোলার চেষ্টা করছে, ঘাস লেগে শার্টটাতে সবুজ দাগ পড়ে গেছে। জোয়ানা জেরেমির বেল্ট নিয়ে টানাটানি করছে।
দেখো, ঠাণ্ডা লাগিয়ে না! বলে উঠলেন মিসেস ইঙ্গেব্রিগস্টেন।
হতাশভাবে অ্যালবার্টোর দিকে তাকালো সোফি।
আমি যতটা ভেবেছিলাম তার চেয়ে তাড়াতাড়ি ঘটে যাচ্ছে ব্যাপারটা, অ্যালবার্টো বললেন। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সড়ে পড়তে হবে আমাদের এখান থেকে। তার আগে ছোট্ট একটা বক্তৃতা দিতে হবে আমাকে শুধু।
জোরে হাততালি দিয়ে উঠল সোফি।
দয়া করে সবাই ফিরে এসে বসবেন আবার? অ্যালবার্টো কিছু কথা বলবেন।
জোয়ানা আর জেরেমি ছাড়া সবাই আবার ফিরে এলেন যার যার জায়গায়।
আপনি কি সত্যি সত্যিই বক্তৃতা দেবেন? হেলেন অ্যামুন্ডসেন জিগ্যেস করলেন। কী দারুণ।
ধন্যবাদ।
আর, আমি জানি আপনি হাঁটতেও পছন্দ করেন। শরীর ঠিক রাখার জন্যে কাজটা খুব জরুরি। তাছাড়া, সঙ্গে একটা কুকুর থাকলে তো কথাই নেই। হার্মেস, তাই না নামটা ওটার?
উঠে দাঁড়ালেন অ্যালবার্টো। প্রিয় সোফি, শুরু করলেন তিনি। এটা যেহেতু, একটা ফিলসফিকাল গার্ডেন পার্টি, আমি তাই দার্শনিক বক্তৃতা করব।
তুমুল হর্ষধ্বনি আর হাততালি দিয়ে স্বাগত জানানো হলো কথাটাকে।
এই হই হট্টগোলভরা পরিবেশে এক দাগ যুক্তি হয়ত ততোটা খাপছাড়া বলে মনে হবে না। তবে যা-ই ঘটুক না কেন, সোফিকে তার ১৫শ জন্মদিনে শুভেচ্ছা। জানাতে যেন ভুল না হয় আমাদের।
বাক্যটা তিনি শেষ করতে পেরেছেন কি পারেননি এমনি সময় এগিয়ে আসতে থাকা একটা স্পোর্টস প্লেনের শুনগুন আওয়াজ শোনা গেল। নিচু হয়ে বাগানের ওপর দিয়ে উড়ে গেল সেটা। সেটার পেছনে লম্বা লেজের মতো একটা ব্যানার ঝুলছে, তাতে লেখা: শুভ ১৫শ জন্মদিন।
আর তাই দেখে আবার হর্ষধ্বনি আর হাততালি, এমনকী আগের চেয়েও জোরে।
ঐ যে, দেখতে পাচ্ছেন? আনন্দে চেঁচিয়ে উঠলেন মিসেস অ্যামুন্ডসেন। এই মানুষটি আতশবাজি ফোঁটানো ছাড়াও অনেক কাজ করতে পারেন।
ধন্যবাদ। এটা নেহাতই মামুলি ব্যাপার। গত কয়েক হপ্তায় সোফি আর আমি বড়সড় একটা দার্শনিক অনুসন্ধান চালিয়েছি। এখন আমরা সেটার ফলাফল প্রকাশ করব। আমাদের অস্তিত্বের নিগুঢ়তম রহস্য প্রকাশ করব আমরা।
ছোট্ট জমায়েতটা এখন এমন-ই শান্ত হয়ে গেছে যে পাখির কিচিরমিচির আর লাল-কিশমিশ ঝোঁপ থেকে আসা চাপা দুয়েকটা শব্দ ছাড়া অন্য কোনো আওয়াজ শোনা যাচ্ছে না।
বলে যান, সোফি বলল।
প্রথমদিককার গ্রীক দার্শনিকদের থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত একটা থরো ফিলসফিকাল স্টাডির পর আমরা আবিষ্কার করেছি যে এই মুহূর্তে জাতিসংঘের একজন পর্যবেক্ষক হিসেবে লেবাননে কর্মরত এক মেজরের মনের ভেতর জীবনযাপন করছি আমরা। লিলেস্যান্ডে বাসরত তার কন্যার জন্যে আমাদেরকে নিয়ে একটা বই-ও লিখেছে সে। মেয়েটির নাম হিল্ডা মোলার ন্যাগ। সোফি আর সে একই দিনে পনেরোয় পড়েছে। ১৫ই জুন সকালবেলা সে যখন ঘুম থেকে ওঠে তখন তার বেডসাইড টেবিলটার ওপর পড়ে ছিল বইটা। ঠিকভাবে বললে, বইটা ছিল একটা রিং বাইন্ডারের ধরনে। এমনকী আমরা যখন কথা বলছি তখনো সে রিং বাইন্ডারের শেষ কটা পৃষ্ঠার ছোঁয়া পাচ্ছে তার তর্জনীর নিচে।
উৎকণ্ঠার একটা অনুভূতি ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল টেবিল জুড়ে।
কাজেই আমাদের অস্তিত্ব হিল্ডা মোলার ন্যাগের জন্মদিনের একটা চিত্তবিনোদনমূলক ব্যাপার ছাড়া একটু বেশিও নয়, কমও নয়। মেজরের কন্যার দর্শন শিক্ষার একটা কাঠামো হিসেবে আমাদের সবাইকে আবিষ্কার করা হয়েছে। তার অর্থ, উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, গেটে দাঁড়িয়ে থাকা মার্সিডিজটার এক পয়সাও দাম নেই। নেহাতই একটা মামুলি জিনিস ওটা। সাদা যে-মার্সিডিজটা শুধু ঘুরে বেড়াচ্ছে হতভাগা এক মেজরের মাথার মধ্যে সেটার চেয়ে বেশি দাম নয় ওটার। সে-বেচারা এই মাত্র একটা পাম ট্রী-র নিচে বসে পড়ল সর্দিগর্মির হাত থেকে বাঁচতে। লেবাননে দিনের বেলা বড্ড গরম, বন্ধুরা।
যত্তসব আবর্জনা! চেঁচিয়ে উঠলেন অর্থনীতিক উপদেষ্টা। একেবারে নির্জলা অর্থহীন ব্যাপার।
আপনারা অবশ্যই আপনাদের মন্তব্য জানাতে পারেন, বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে বলে চললেন অ্যালবার্টো, তবে সত্যি কথাটা হলো এই গার্ডেন পার্টিটাই একেবারে নির্জলা অর্থহীন ব্যাপার। এই পুরো পার্টিটাতে যুক্তির একমাত্র নিদর্শন হচ্ছে এই বক্তৃতা।
এই কথা শুনে অর্থনীতিক উপদেষ্টা দাঁড়িয়ে পড়ে বলে উঠলেন:
এই তো, আমরা আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করছি একটা কারবার চালাতে আর সব ধরনের ঝুঁকির বিরুদ্ধে যাতে ইসুরেন্স কাভারেজ পাওয়া যায় তার ব্যবস্থা করতে। সেই সময় এসে হাজির হলেন এই সবজান্তা যিনি কিনা এ-সব বিনাশ করতে চাইছেন তাঁর দার্শনিক সব অভিযোগ তুলে।
মাথা নেড়ে সায় দিলেন অ্যালবার্টো।
এ-ধরনের দার্শনিক অন্তদৃষ্টি কাভার দেয়ার মতো কোনো ইলুরেন্স আসলেই নেই, জনাব। তবে আপনি সম্ভবত জানেন যে ইলুরেন্স ওসব-ও কাভার করে না।
এটা কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়।
না, এটা একটা অস্তিত্বগত দুর্যোগ। উদাহরণস্বরূপ, স্রেফ একবার কিশমিশ ঝোপের নিচে তাকান, তাহলেই বুঝতে পারবেন আমি কী বলতে চাইছি। আপনার গোটা জীবনের পতন বন্ধক রেখে আপনি নিজের ইস্যুরেন্স করতে পারেন না। তেমনি, অস্তগামী সূর্যকে বন্ধক রেখেও আপনি নিজের ইলুরেন্স করতে পারেন না।
আমাদের কি এ-সব সহ্য করতে হবে? স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন জোয়ানার বাবা।
মাথা নাড়লেন জোয়ানার মা, সোফির মা-ও তাই করলেন।
কী লজ্জা, বললেন তিনি, তা-ও আবার আমরা এমন অঢেল খরচ করার পর।
তরুণ অতিথিরা তাকিয়েই রয়েছে অ্যালবার্টোর দিকে। চশমা পরা, কোঁকড়া চুলের একটি ছেলে বলে উঠল, আমরা আরো শুনতে চাই।
ধন্যবাদ, তবে বেশি কিছু আর বলার নেই। কেউ যখন উপলব্ধি করে যে সে অন্য কোনো মানুষের নিদ্রালু চেতনায় একটা স্বপ্নপ্রতিচ্ছবি, তখন, আমার মতে, চুপ হয়ে যাওয়াই সবচেয়ে বিচক্ষণের লক্ষণ। অবশ্য আমি এই সুপারিশ করে শেষ করতে পারি যে দর্শনের ইতিহাসের ওপর একটা ছোট্ট কোর্স করো তোমরা। পূর্ব প্রজন্মের মূল্যবোধ সম্পর্কে ক্রিটিকাল হওয়াটা জরুরি। সোফিকে আমি যদি কিছু শেখাতে চেষ্টা করে থাকি তা ঠিক এই, ক্রিটিকালি চিন্তা করা। হেগেল একে বলতেন নেতিবাচকভাবে চিন্তা করা।
অর্থনীতিক উপদেষ্টা তখনো দাঁড়িয়ে রয়েছেন, টেবিলের ওপর ড্রাম বাজিয়ে চলেছেন আঙুলগুলো দিয়ে।
স্কুল, গির্জা আর আমরা নিজেরা তরুণ-প্রজন্মের ভেতর যে-সব সুস্থ মূল্যবোধ সঞ্চারিত করতে চাইছি সেগুলো সব নষ্ট করে দেবার চেষ্টা করছে এই গণ্ডগোলসৃষ্টিকারী লোকটি। অথচ ভবিষ্যৎ বলতে কারো সামনে যদি কিছু থাকে তো এই তরুণ প্রজন্মেরই আছে আর আমরা যা গড়ে তুলেছি তার সবই একদিন উত্তরাধিকারসূত্রে পাবে তারা। এই জমায়েত থেকে এই লোকটাকে এক্ষুণি বের করে দেয়া না হলে আমি আমাদের উকিলকে ডাকবো। ব্যাপারটা কীভাবে সামলাতে হবে সেটা তিনি জানবেন।
এই ব্যাপারটা আপনি সামলালেন কি না সামলালেন তাতে কিছু আসে যায় না, যেহেতু আপনি ছায়া ছাড়া কিছুই নন। সে যাই হোক, সোফি আর আমি একটু পরই পার্টিটা থেকে বিদায় নিচ্ছি কারণ আমাদের জন্যে দর্শন কোর্সটা পুরোপুরি তাত্ত্বিক নয়। এটার একটা ব্যবহারিক দিকও রয়েছে। সময় হলেই আমরা আমাদের গায়েব করার কাজটা করবো। এভাবেই মেজরের চেতনা থেকে চুপিচুপি সরে পড়তে যাচ্ছি আমরা।
হেলেন অ্যামুন্ডসেন তাঁর কন্যার হাতটা আঁকড়ে ধরলেন।
তুই নিশ্চয়ই আমাকে ছেড়ে যাবি না, সোফি?
সোফি তার মাকে জড়িয়ে ধরল। মুখ তুলে অ্যালবার্টোর দিকে তাকাল সে।
মা এতো মন খারাপ করেছে…
উঁহু, ব্যাপারটা স্রেফ হাস্যকর। যা শিখেছে তা ভুলে যেয়ো না। ঠিক এ ধরনের অর্থহীন ব্যাপার থেকেই নিজেদেরকে মুক্ত করতে হবে আমাদের। তোমার মা একজন রমণীয় আর সদয় মহিলা, ঠিক সেই ছোট্ট রেড রাইডিংহুডের মতো, যে কিনা সেদিন আমার বাড়িতে এসেছিল তার দাদীর জন্যে এক ঝুড়িভর্তি খাবার নিয়ে। খানিক আগেই যে-প্লেনটা উড়ে গেল সেটার যতটা জ্বালানী দরকার ছিল তার শুভেচ্ছামূলক কসরত দেখানোর জন্যে, তোমার মার মন তার চেয়ে বেশি খারাপ নয়।
আমার মনে হয় আপনি কী বলতে চাইছেন তা আমি বুঝতে পারছি, সোফি বলল। ঘুরে দাঁড়াল তার মা-র দিকে। সেজন্যেই উনি যা বলেন তাই করতে হবে আমাকে, মা। তোমাকে একদিন আমার ছেড়ে যেতেই হোতো।
তোকে মিস করবো আমি, তার মা বললেন। তবে এর ওপরে যদি কোনো স্বর্গ থেকে থাকে তাহলে তোকে স্রেফ উড়াল দিতে হবে। কথা দিচ্ছি ঠিকমতো গোবিন্দর দেখাশোনা করব আমি। দিনে কটা লেটুস পাতা খায় ওটা, একটা না দুটো?
অ্যালবার্টো হাত রাখলো তার কাঁধে।
আপনি অথবা এখানকার কেউই আমাদেরকে স্রেফ এই কারণে মিস করবেন না যে আপনাদের কোনো অস্তিত্ব নেই। ছায়া ছাড়া আপনারা আর কিছুই নন।
এর চেয়ে অপমানের কথা কখনো শুনিনি আমি, ফেটে পড়লেন মিসেস ইঙ্গেব্রিগস্টেন। তার স্বামী ওপর-নিচে মাথা নাড়লেন।
আর কিছু না হোক, চরিত্রহানির কারণেই ওর বিরুদ্ধে মামলা করতে পারবো আমরা। আমি নিশ্চিত লোকটা কম্যুনিস্ট। যে-সব জিনিসকে আমরা মূল্যবান বলে মনে করি সে-সব থেকে আমাদেরকে বঞ্চিত করতে চায় সে। লোকটা একটা স্কাউড্রেল।
এর পরেই অ্যালবার্টো আর অর্থনীতিক উপদেষ্টা দুজনেই বসে পড়লেন। দ্বিতীয় জনের মুখ রাগে লাল। এবার জোয়ানা আর জেরেমি-ও এসে টেবিলে বসল। তাদের জামাকাপড় নোংরা, কোঁচকানো সোনালী চুলে কাদামাটি লেগে শক্ত হয়ে আছে।
মা, আমার বাচ্চা হবে, জোয়ানা ঘোষণা করল।
ঠিক আছে, তবে তার আগে বাড়ি যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে তোকে।
তার স্বামীও সঙ্গে সঙ্গে সমর্থন জানালেন। ওকে স্রেফ ধৈর্য ধরতে হবে, বললেন তিনি। আর আজকে যদি নাম রাখতে হয় তাহলে সেটা ওকেই ব্যবস্থা করতে হবে।
গম্ভীরভাবে সোফির দিকে তাকালেন অ্যালবার্টো।
সময় হয়ে গেছে।
যাওয়ার আগে আর খানিকটা কফি এনে দিয়ে যা অন্তত আমাদের জন্যে, সোফির মা বললেন।
অবশ্যই মা, এক্ষুণি আনছি।
টেবিল থেকে থার্মোসটা নিল সোফি। আরো কফি বানাতে হলো তাকে। কফি হতে হতে পাখিগুলো আর গোল্ডফিশটাকে খাওয়াল সে। বাথরুমেও গেল সে, একটা লেটুস পাতা বের করে রাখল গোবিন্দর জন্যে। বেড়ালটাকে কোথাও দেখতে পেল না সে, তবে বেড়ালের খাবারের একটা বড়সড় ক্যান খুলে একটা গামলায় সব ঢেলে সিঁড়ির ওপর রেখে দিল সেটা। অনুভব করল চোখ ঠেলে পানি বেরিয়ে আসছে তার।
সে যখন কফি নিয়ে ফিরে এলো, গার্ডেন পাটিটাকে তখন এক তরুণীর দার্শনিক উৎসবের চেয়ে বাচ্চাদের পার্টি বলেই মনে হচ্ছিল বেশি। বেশ কয়েকটা সোড়র বোতল উল্টে পড়ে আছে টেবিলের ওপর, টেবিলক্লথ জুড়ে চকলেট কেক লেগে আছে, কিশমিশ দেয়া বনরুটির ডিশ উল্টে পড়ে আছে লনের মধ্যে। সোফি এসে পৌঁছুতেই একটা ছেলে লেয়ার কেকটার ওপর একটা পটকা রাখল, পুরো টেবিল আর সমস্ত অতিথির ওপর ফাটল সেটা। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হলো মিসেস ইঙ্গেব্রিগস্টেনের লাল প্যান্টস স্যুটটা। অদ্ভুত ব্যাপার হলো তিনি আর বাকি প্রত্যেকেই একেবারে শান্তভাবে গ্রহণ করলো ব্যাপারটাকে। চকলেট কেক-এর বড়সড় একটা টুকরো তুলে নিয়ে সেটা জেরেমির সারা মুখে মাখিয়ে দিল জোয়ানা, তারপর আবার সেটা চেটে খাবার জন্যে এগিয়ে গেল।
অন্য সবার থেকে খানিকটা দূরে গ্লাইডারে বসে ছিলেন সোফির মা আর অ্যালবার্টো। সোফির উদ্দেশে হাত নাড়লেন তাঁরা।
তাহলে শেষ পর্যন্ত তোমার গোপনীয় আলাপ হলো, বলল সোফি।
আর তুই কিন্তু একেবারে ঠিক, তার মা বললেন, তাকে বেশ গর্বিত লাগছে এখন। অ্যালবার্টো খুবই পরোপকারী মানুষ। তার সমর্থ হাতে তোকে তুলে দিলাম আমি।
দুজনের মাঝখানে গিয়ে বসল সোফি।
দুটো ছেলে কী করে যেন ছাদে উঠে পড়েছে। একটা মেয়ে চুলের কাঁটা দিয়ে সব কটা বেলুন ফুটো করতে লেগে পড়েছে ঘুরে ঘুরে। এমন সময় অনাহুত এক অতিথি মোটর সাইকেল চেপে এক ক্রেট বিয়ার আর ক্যারিয়ারে বাধা অ্যাকোয়াভিট-এর বোতল নিয়ে হাজির হলো। অতিথিবৎস কটি প্রাণ তাকে স্বাগত জানিয়ে ভেতরে নিয়ে এলো।
তাই দেখে অর্থনীতিক উপদেষ্টা টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন, হাততালি দিয়ে তিনি বলে উঠলেন:
একটা খেলা খেলতে চান আপনারা?
বিয়ারের একটা বোতল পাকড়াও করলেন তিনি, পুরোটাই চালান করে দিলেন পেটে, তারপর খালি বোতলটা রাখলেন লনের মধ্যেখানে। তারপর টেবিলের কাছে গিয়ে বার্থ ডে কেকটার শেষ পাঁচটা রিং নিয়ে এলেন। অতিথিদের দেখালেন কী করে রিংগুলোকে এমনভাবে ফেলতে হবে যাতে সেগুলো বোতলটার গলা দিয়ে গলে যায়।
মরণ যন্ত্রণা, অ্যালবার্টো বললেন। মেজর সব কিছুর ইতি টেনে দেবার আর হিল্ডা রিং বাইন্ডারটা বন্ধ করার আগেই সরে পড়া উচিত আমাদের।
মা, এগুলো সব একাই পরিষ্কার করতে হবে তোমাকে।
সেটা কোনো ব্যাপার নয়, মা। এটা তোর জন্যে কোনো জীবনই ছিল না। অ্যালবার্টো যদি এরচেয়ে ভালো একটা জীবন দিতে পারে তোকে তাহলে আমার চেয়ে সুখী আর কেউ হবে না। তুই বলেছিলি না, একটা সাদা ঘোড়া আছে ওর?
বাগানের দিকে নজর ফেরাল সোফি। চেনাই যাচ্ছে না জায়গাটাকে। বোতল, মুরগির হাড়-গোড়, বনরুটি আর বেলুন পদদলিত হয়ে আছে ঘাসে।
এক সময় এটাই ছিল আমার ছোট্ট নন্দনকানন, সোফি বলল।
আর এখন তুমি সেখান থেকে বিতাড়িত হচ্ছো, অ্যালবার্টো বললেন।
সাদা মার্সিডিজটায় বসে আছে একটা ছেলে। এঞ্জিনটা চালু করল সে আর ওমনি গাড়িটা বাগানের গেটটা খুঁড়িয়ে দিয়ে মুড়ি-বিছানো পথ ধরে বাগানের ভেতর ঢুকে পড়ল।
সোফি অনুভব করল শক্ত হাতে তার বাহু আঁকড়ে ধরে গুহাটার ভেতর টেনে নেয়া হলো তাকে। এরপরই অ্যালবার্টোর গলা শুনতে পেল সে
নাউ।
ঠিক সেই মুহূর্তেই একটা আপেল গাছের গায়ে গিয়ে ধাক্কা খেল সাদা মার্সিডিজটা। কাঁচা ফলের বৃষ্টি ঝরল হুডটার ওপর।
এটা কিন্তু বড় বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। অর্থনীতিক উপদেষ্টা তেড়ে ফুড়ে উঠলেন। উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দাবি করছি আমি।
তাঁর স্ত্রী-ও তার পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করলেন।
এটা সেই হতচ্ছাড়া স্কাউলেটার দোষ। কোথায় সে?
ওরা শূন্যে মিলিয়ে গেছে, হেলেন অ্যামুন্ডসেন বলে উঠলেন, তাঁর গলায় যেন খানিকটা গর্বের ছোঁয়া।
শরীরটা টানটান করে লম্বা টেবিলটার কাছে হেঁটে গিয়ে দার্শনিক গার্ডেন পার্টির ভগ্নাবশেষটুকু পরিষ্কার করতে লেগে পড়লেন তিনি।
আরো কফি খাবে কেউ?