১৮. দেকার্ত

১৮. দেকার্ত

…নির্মাণস্থান থেকে সব ময়লা আবর্জনা সরিয়ে ফেলতে চেয়েছিলেন তিনি…

উঠে পড়লেন অ্যালবার্টো, লাল আলখাল্লাটা খুলে ফেললেন, রেখে দিলেন সেটা একটা চেয়ারের ওপর। তারপর ফের গিয়ে থিতু হলেন কোনার সোফাটায়।

রেনে দেকার্ত-এর (René Descartes) জন্ম ১৫৯৬ খ্রিস্টাব্দে। জীবনের বিভিন্ন সময়ে তিনি ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বাস করেছেন। তরুণ বয়েসেই মানুষ এবং মহাবিশ্বের স্বরূপ জানার জন্যে একটি অন্তদৃষ্টি পাবার প্রবল ইচ্ছে জাগে তাঁর মনে। কিন্তু দর্শন পাঠ করার পর নিজের অজ্ঞতা সম্পর্কে ক্রমেই আরো বেশি করে নিশ্চিত হতে থাকেন তিনি।

সক্রেটিসের মতো?

হ্যাঁ, অনেকটা তার মতোই। সক্রেটিসের মতো তাঁরও নিশ্চিত ধারণা জন্মে যে বিশেষ কিছু জ্ঞান কেবল প্রজ্ঞার সাহায্যেই অর্জন করা সম্ভব। প্রাচীন বই-পত্তর আমাদেরকে যা বলে তার ওপর আমরা কখনোই বিশ্বাস করতে পারি না। আমরা এমনকী আমাদের ইন্দ্রিয়গুলোর ওপরও বিশ্বাস রাখতে পারি না।

প্লেটোও তাই মনে করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন কেবল প্রজ্ঞাই আমাদেরকে কিছু জ্ঞান দিতে পারে।

ঠিক তাই। সক্রেটিস আর প্লেটো থেকে সেন্ট অগাস্টিন হয়ে দেকার্ত পর্যন্ত দর্শনে একটা পরিষ্কার ধারা লক্ষ করা যায়। এঁরা সবাই-ই ছিলেন যাকে বলে আদর্শ বুদ্ধিবাদী (rationalist), প্রজ্ঞা-ই যে জ্ঞান লাভের একমাত্র উপায় সে-ব্যাপারে কোনো সন্দেহ ছিল না তাদের। গভীর অধ্যয়নের পর দেকার্ত এই সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছান যে মধ্য যুগ থেকে যে-জ্ঞান প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরের কাছে এসে পৌঁছেছে। সেটা খুব একটা নির্ভরযোগ্য নয়। এ-ব্যাপারে তুমি তাকে সক্রেটিসের সঙ্গে তুলনা করতে পারো, যিনি এথেন্সের নগর-চত্বরে লোকজনের সঙ্গে কথা বলে যে-সব দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে পরিচিত হতেন বা যে-সব ধারণার কথা জানতে পারতেন সেগুলো বিশ্বাস করতেন না। তো, এ-রকম পরিস্থিতিতে লোকে কী করে, সোফি, বলতে পারো?

মানুষ তখন নিজের দর্শন দাঁড় করায়।

ঠিক! দেকার্ত ঠিক করলেন তিনি সারা ইউরোপ ঘুরে বেড়াবেন, ঠিক যেমন সক্রেটিস এথেন্সের লোকের সঙ্গে কথা বলে জীবন কাটিয়েছেন। তিনি ঠিক করলেন, নিজের ভেতর অথবা জগতের বিশাল বই-এ যে-জ্ঞান পাওয়া যাবে তারই অনুসন্ধানে জীবন কাটিয়ে দেবেন। কাজেই, সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে যুদ্ধে চলে গেলেন তিনি, তার ফলে মধ্য ইউরোপের বিভিন্ন অংশে বেশ কিছুদিন কাটাবার সুযোগ হলো তাঁর। এরপর তিনি প্যারিসে কাটান কয়েক বছর, তারপর, ১৬২৯-এ চলে যান হল্যান্ড, সেখানে তিনি গণিত আর দর্শন বিষয়ক লেখালেখি নিয়ে কাটিয়ে দেন প্রায় বিশ বছর।

১৬৪৯-এ রানী ক্রিস্টিনার আমন্ত্রণে তিনি সুইডেন যান। কিন্তু তাঁর ভাষায় সেই ভালুক, বরফ আর পাহাড়ের দেশে তাঁর অবস্থানকালে তিনি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ১৬৫০-খ্রিস্টাব্দের শীতকালে মৃত্যুবরণ করেন।

অর্থাৎ মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র ৫৪ বছর?

কিন্তু, এমনকী তাঁর মৃত্যুর পরেও, দর্শনের ওপর গভীর প্রভাব বিস্তার করে গেছেন তিনি। কোনোরকম অতিরঞ্জন ছাড়াই বলা যায় যে দেকার্তই ছিলেন আধুনিক দর্শনের জনক। রেনেসা-র সময় মানুষ আর প্রকৃতির ঝোড়ো গতির পুনরাবিষ্কারের পর সমসাময়িক চিন্তা-ভাবনাকে একটি সুসম্বদ্ধ দার্শনিক পদ্ধতিতে একত্রিত করার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয় নতুন করে। প্রথম গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতির নির্মাতা ছিলেন দেকার্ত, তারপর এলেন স্পিনোজা আর লাইবনীজ, লক আর বার্কলে, হিউম আর কান্ট।

দার্শনিক পদ্ধতি বলতে কী বোঝাতে চাইছেন?

বোঝাতে চাইছি এমন এক দর্শনের কথা যে-দর্শন তৈরি হয়েছে একেবারে মাটি থেকে ওপরের দিকে আর যা কিনা দর্শনের একেবারে মূল প্রশ্নগুলোর ব্যাখ্যা খুঁজে বের করার কাজে নিয়োজিত। প্রাচীন যুগের মহান পদ্ধতি-নির্মাতা ছিলেন প্লেটো আর অ্যারিস্টটল। মধ্য যুগে ছিলেন সেন্ট টমাস অ্যাকুইনাস, যিনি অ্যারিস্টটলের দর্শন আর খ্রিস্টিয় ঈশ্বরতত্ত্বের মধ্যে একটি সেতু তৈরি করতে চেয়েছিলেন। এরপর এলো রেনেসা-প্রকৃতি ও বিজ্ঞান, ঈশ্বর ও মানুষ সম্পর্কে পুরনো আর নতুন বিশ্বাসের এক ধারাস্রোত নিয়ে। সপ্তদশ শতাব্দীর আগ পর্যন্ত দার্শনিকেরা নতুন ধারণাগুলোকে একটি স্বচ্ছ দার্শনিক পদ্ধতিতে বিন্যস্ত করার চেষ্টা করেননি। আর সে-কাজটা যিনি প্রথম করলেন তিনি দেকার্ত। পরবর্তী প্রজন্মগুলোতে যা কিনা হবে দর্শনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প তারই বার্তাবহ ছিল তার কাজ। দেকার্তের চিন্তার মূল বিষয় ছিল আমরা যা জানতে পারি, বা অন্যভাবে বললে, সুনিশ্চিত জ্ঞান (certain knowledge)। অন্য আরেকটা যে বড় প্রশ্ন তাকে ব্যস্ত রেখেছিল তা হচ্ছে দেহ এবং মনের মধ্যেকার সম্পর্ক। এই দুই প্রশ্নই ছিল পরবর্তী দেড়শ বছরের দার্শনিক বিতর্কের মূল বিষয়।

তিনি নিশ্চয়ই তার সময়ের থেকে এগিয়ে ছিলেন?

তা ঠিক, কিন্তু এটা সে-যুগেরও প্রশ্ন ছিল। বিশেষ কোনো জ্ঞান অর্জনের প্রশ্নে তার সমসাময়িক অনেকেই পুরোপুরি দার্শনিক সংশয়বাদ-এর পরিচয় দিয়েছিলেন। তারা মনে করতেন মানুষের এ-কথাটি মেনে নেয়া উচিত যে সে কিছুই জানে না। কিন্তু দেকার্ত সে-কথা মানতে চাইলেন না। মানলে তিনি কখনোই একজন খাঁটি দার্শনিক হতে পারতেন না। আবারো সক্রেটিসের সঙ্গে তুলনা টেনে আনতে পারি আমরা; তিনিও সোফিস্টদের সংশয়বাদ মেনে নেননি। তাছাড়া, দেকার্তের সময়-ই নতুন প্রাকৃতিক বিজ্ঞান এমন একটি পদ্ধতির জন্ম দিচ্ছিল যার সাহায্যে প্রাকৃতিক ঘটনাবলী বা প্রক্রিয়াসমূহের একটা বিশেষ এবং সঠিক বর্ণনা দেয়া যায়।

দেকার্ত-ও বাধ্য হলেন নিজেকে এই প্রশ্ন করতে যে দার্শনিক চিন্তা-ভাবনারও এ-রকম কোনো বিশেষ আর সঠিক পদ্ধতি রয়েছে কিনা।

সেটা বুঝতে পারছি।

কিন্তু ওটা হলো পুরো ব্যাপারটার একটা অংশ মাত্র নতুন পদার্থ বিদ্যা-ও বস্তুর স্বরূপ সম্পর্কে অর্থাৎ কোন জিনিসটি প্রকৃতির বাস্তব প্রক্রিয়া (physical process) নির্ধারণ করে সে-ব্যাপারে প্রশ্ন তুলেছিল তখন। প্রকৃতির একটি যান্ত্রিক রূপের পক্ষেই মানুষের মতের প্রকাশ ঘটছিল দিন দিন আরো বেশী করে। কিন্তু বাস্তব জগৎকে যতই যান্ত্রিকভাবে দেখা হচ্ছিল দেহ আর আত্মার সম্পর্ক সংক্রান্ত প্রশ্নটিও ততোই জরুরি হয়ে দেখা দিচ্ছিল। সপ্তদশ শতাব্দীর আগ পর্যন্ত আত্মাকে সাধারণত জীবনের প্রশ্বাস হিসেবে মনে করা হতো যা কিনা সমস্ত জীবন্ত প্রাণীর ভেতর জুড়ে থাকে। আত্মা (soul) এবং চিদাত্মা (spirit) শব্দের মূল অর্থ অবশ্য শ্বাস বা শ্বাসকার্য। ইউরোপিয় প্রায় সমস্ত ভাষাতেই তাই। অ্যারিস্টটলের কাছে আত্মা এমন একটা জিনিস যা কোনো অর্গানিজম বা জীবদেহ-র সমস্ত জায়গা জুড়ে থাকে সেটার জীবন ধারা হিসেবে, ফলে সেটাকে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো কিছু বলে চিন্তা করা যায় না। সে-কারণে তাঁর পক্ষে উদ্ভিদ আত্মা বা প্রাণী আত্মা-র কথা বলা সম্ভব ছিল। সপ্তদশ শতাব্দীর আগ পর্যন্ত দার্শনিকেরা আত্মা ও দেহের মধ্যে মৌলিক কোনো পার্থক্যের কথা বলেননি। তার কারণ হচ্ছে, সমস্ত বস্তুগত জিনিসের– দেহ, প্রাণী বা মানুষের– গতিকে যান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অন্তর্ভুক্ত বলে ব্যাখ্যা করা হতো। কিন্তু মানুষের আত্মা নিশ্চয়ই এই দেহযন্ত্রের অংশ হতে পারে না, তাই না? তাহলে আত্মা কী? এই প্রশ্নের যেমন একটা ব্যাখ্যা দরকার ছিল ঠিক তেমনি এই ব্যাপারটিরও একটি ব্যাখ্যা প্রয়োজন ছিল যে আধ্যাত্মিক একটা কিছু কী করে একটা যান্ত্রিক প্রক্রিয়া শুরু করতে পারে।

এটা কিন্তু সত্যিই একটা অদ্ভুত ধারণা।

কোনটা?

আমি ঠিক করলাম হাত ওঠাবো আর তখনই হাতটা নিজে নিজে উঠে গেল। কিংবা ভাবলাম বাস ধরতে ছুটবো, ঠিক পরের মুহূর্তেই আমার পাগুলো নড়ে উঠল। কিংবা দুঃখের কোনো কিছু ভাবছি, হঠাৎ করেই কাঁদতে শুরু করলাম। কাজেই দেহ আর চৈতন্যের (consciousness) মধ্যে নিশ্চয়ই রহস্যময় একটা সম্পর্ক রয়েছে।

ঠিক এই সমস্যা থেকেই দেকার্তের চিন্তা-ভাবনাগুলো ডানা মেলতে শুরু করে। প্লেটোর মতো তিনিও এ-ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন যে চিদাত্মা আর বস্তুর মধ্যে একটি সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। কিন্তু মন কীভাবে দেহকে প্রভাবিত করে– বা আত্মা দেহকে– প্লেটো সে-প্রশ্নের কোনো জবাব দিতে পারেননি।

আমিও পারছি না, তাই আমি শুনতে চাইছি দেকার্ত এ-ব্যাপারে কোন তত্ত্ব দিলেন।

তাহলে চলো তার নিজস্ব যুক্তি কী ছিল তাই শোনা যাক।

এই বলে অ্যালবার্টো তাঁদের দুজনের মধ্যের টেবিলটার ওপর যে-বইটা রয়েছে সেটার দিকে আঙুল তুললেন।

একটা দার্শনিক সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে দার্শনিককে কোন পদ্ধতি অবশ্যই অবলম্বন করতে হবে সে-ব্যাপারে প্রশ্ন তুললেন দেকার্ত তার ডিসকোর্স অন মেথডনামক বইতে। বিজ্ঞান এরিমধ্যে একটি নতুন পদ্ধতি পেয়ে গিয়েছিল…।

হ্যাঁ, সে-রকমই বলেছিলেন আপনি।

দেকার্তের মত অনুযায়ী, কোনো কিছুকে পরিষ্কার এবং আলাদাভাবে ইন্দ্রিয় দিয়ে প্রত্যক্ষ (perceive) না করা পর্যন্ত আমরা সেটাকে সত্য বলে মেনে নিতে পারি না। সেজন্যে, কোনো জটিল সমস্যাকে যতগুলো সম্ভব একক সমস্যায় ভেঙে নেয়া বা ছোট করে নেয়া দরকার হতে পারে। তখন সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সহজ ভাব থেকে আমরা আমাদের কাজ শুরু করতে পারি। এক অর্থে তুমি বলতে পারো। যে প্রতিটি একক চিন্তাকে যাচাই করতে হবে, পরিমাপ করে নিতে হবে, গ্যালিলিও যেভাবে সব কিছুরই পরিমাপ করে নিতে চেয়েছিলেন, যেটাকে পরিমাপ করা যায় না সেটাকে পরিমাপের যোগ্য করে নিতে চেয়েছিলেন, অনেকটা সেভাবে। দেকার্ত বিশ্বাস করতেন দর্শনের অগ্রসর হওয়া উচিত সরল থেকে জটিলের দিকে। কেবল তখনই সম্ভব হবে একটা নতুন অন্তদৃষ্টি পাওয়া। সবশেষে নিরন্তর গোনা-গুনতি আর নিয়ন্ত্রণ-এর মধ্যে দিয়ে এই বিষয়টি নিশ্চিত করা দরকার হবে যে কোনো। কিছুই বাদ পড়ে যায়নি। আর তখনই হাতের নাগালে এসে ধরা দেবে একটা দার্শনিক সিদ্ধান্ত বা উপসংহার।

এতো রীতিমতো অংক পরীক্ষার মতো শোনাচ্ছে।

ঠিক বলেছো। দেকার্ত গণিতবিদ ছিলেন; তাকে বিশ্লেষণাত্মক জ্যামিতির জনক বলা হয়। বীজগণিতের ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে গেছেন তিনি। দার্শনিক মত গঠন করার সময়ও গাণিতিক পদ্ধতি ব্যবহার করতে চেয়েছেন দেকার্ত। লোকে যেভাবে গাণিতিক উপপাদ্য প্রমাণ করে তিনি সেভাবেই দর্শনগত সত্য প্রমাণ করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। অন্য কথায় বলতে গেলে, আমরা যখন ফিগার নিয়ে কাজ করি তখন আমরা যে হাতিয়ার বা যন্ত্র ব্যবহার করি, তিনিও ঠিক সেই হাতিয়ার বা যন্ত্র ব্যবহার করতে চাইলেন আর সেই যন্ত্রের নাম প্রজ্ঞা, কারণ কেবল প্রজ্ঞাই আমাদেরকে নিশ্চিতি দিতে পারে। আমাদের ইন্দ্রিয়গুলোর ওপর একেবারেই ভরসা রাখা চলে না। দেকার্তের সঙ্গে এরিমধ্যে আমরা প্লেটোর সাদৃশ্যের কথা উল্লেখ করেছি এবং প্লেটোও মনে করতেন ইন্দ্রিয়গুলোর দেয়া প্রমাণের চেয়ে অংক আর সংখ্যাগত অনুপাত-ই বেশি নিশ্চয়তা দিতে পারে আমাদেরকে।

কিন্তু দর্শনগত সমস্যাগুলো কি এভাবে সমাধান করা যায়?

আমরা বরং দেকার্তের নিজের চিন্তাধারার কথায় ফিরে যাই। দেকার্তের লক্ষ্য হলো জীবনের স্বরূপ বা প্রকৃতি সম্পর্কে নিশ্চয়তায় পৌঁছানো আর তার যাত্রা শুরু হলো এই মত থেকে যে গোড়াতে সবারই উচিত সব কিছুই সন্দেহ করা। তার মানে তিনি স্রেফ বালুর ওপর তার বাড়ি তৈরি করতে চাননি।

চাননি তার কারণ ভিত্তিটাই যদি নড়ে যায় তাহলে গোটা বাড়িটাই ভেঙে পড়বে হুড়মুড় করে।

একেবারে ঠিক বলেছো। তো, সব কিছুকে সন্দেহ করা যে যুক্তিসঙ্গত নয় সেটা যে দেকার্ত বোঝেননি তা নয়, কিন্তু তিনি ভেবেছিলেন নীতিগতভাবে সব কিছুকেই সন্দেহ করা সম্ভব। যেমন ধরো, প্লেটো বা অ্যারিস্টটল পড়ে আমরা যে আমাদের দার্শনিক লক্ষ্যের দিকে এগোচ্ছি সেটা কোনোমতেই নিশ্চিতভাবে ধরে নেয়া যায় না। এতে ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান বাড়তে পারে, কিন্তু জগৎ সম্পর্কে নয়। একান্তই নিজের দর্শনগত ধারণা সৃষ্টির আগে কাল পরম্পরায় চলে আসা বা গৃহীত সব ধরনের শিক্ষা থেকে নিজেকে মুক্ত করা দেকার্তের জন্য অত্যন্ত জরুরি ছিল।

 নিজের বাড়ি তৈরির আগে নির্মাণস্থান থেকে সব ময়লা আবর্জনা সরিয়ে ফেলতে চেয়েছিলেন তিনি…।

ধন্যবাদ। তাঁর নতুন চিন্তা দিয়ে গড়া অট্টালিকা যে কিছু দিন যেতে না যেতেই ভেঙে পড়বে না এই বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার জন্যে তিনি একেবারে নতুন মাল-মশলা ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। তবে দেকার্তের সন্দেহ কিন্তু ছিল আরো গভীর। তিনি বললেন, আমাদের ইন্দ্রিয়গুলো আমাদেরকে যা বলে আমরা এমনকী সে-কথাও বিশ্বাস করতে পারি না। ইন্দ্রিয়গুলো তো আমাদেরকে ফাঁকি দিতে পারে।

কী করে?

স্বপ্ন দেখার সময় আমাদের মনে হয় আমরা বাস্তবেই রয়েছি। আমাদের জাগ্রত অবস্থার অনুভূতি আর স্বপ্নকালীন অনুভূতির মধ্যে পার্থক্য ঠিক কোনখানে?

দেকার্ত লিখেছেন: বিষয়টি অত্যন্ত মনোযোগর সঙ্গে বিবেচনা করার সময় আমি এমন একটি বৈশিষ্ট্য-ও লক্ষ করি না যা জাগ্রত অবস্থা আর স্বপ্ন দেখার সময়ের অবস্থার মধ্যে নিশ্চিতভাবে কোনো পার্থক্য নির্দেশ করতে পারে। আপনার গোটা জীবনটাই যে একটা স্বপ্ন নয় সে-ব্যাপারে আপনি নিশ্চিত হবেন কীভাবে?

ব্যারনের বিছানায় ঘুমাবার পর জেপ ভেবেছিল সে স্রেফ স্বপ্ন দেখছিল।

আর সে যখন ব্যারনের বিছানায় শুয়ে ছিল তখন তার কাছে মনে হয়েছিল গরীব কৃষক হিসেবে তার জীবনটা একটা স্বপ্ন ছাড়া কিছু নয়। তো, এভাবেই দেকার্ত সব কিছুকেই সন্দেহ করতে লাগলেন। তার আগে অনেক দার্শনিকই এইখানে এসে আর কোনো পথ খুঁজে পাননি।

অর্থাৎ তারা তাহলে বেশি দূর যেতে পারেননি।

কিন্তু দেকার্ত এই জিরো পয়েন্ট থেকেই এগোতে চাইলেন। সব কিছুকেই সন্দেহ করলেন তিনি আর একমাত্র এই বিষয়টি সম্পর্কেই অর্থাৎ সন্দেহের ব্যাপারেই কেবল নিশ্চিত ছিলেন তিনি। কিন্তু এরপর হঠাৎ একটা ব্যাপার মনে হলো তাঁর: একটা বিষয় সত্য হতেই হবে আর তা হলো তিনি যে এই সন্দেহ করছেন সেই বিষয়টি। এবং যখন তিনি সন্দেহ করেন তখন নিশ্চয়ই তিনি চিন্তা করেন আর যেহেতু তিনি চিন্তা করছেন তাহলে নিশ্চয়ই তিনি একটি চিন্তাশীল প্রাণী। বা, তিনি নিজে যেভাবে ব্যাপারটি বর্ণনা করেছিলেন সেভাবে বললে কব্জিটো এর্গো সাম (Cogito ergo sum) i

তার মানে?

আমি চিন্তা করি, তাই আমি আছি।

তিনি যে বিষয়টি উপলব্ধি করেছিলেন তাতে অবাক হচ্ছি না আমি।

 স্বাভাবিক। কিন্তু যে স্বজ্ঞামূলক (intuitive) নিশ্চয়তার সঙ্গে নিজেকে হঠাৎ করে তিনি একটি চিন্তাশীল সত্তা হিসেবে প্রত্যক্ষ করলেন সেটা খেয়াল করো। হয়ত এ-প্রসঙ্গে তোমার প্লেটোর কথা মনে পড়বে; তিনি বলেছিলেন আমরা আমাদের ইন্দ্রিয় দিয়ে যা বুঝতে পারি তার চেয়ে আমরা আমাদের প্রজ্ঞা দিয়ে যা বুঝতে পারি সেটাই বেশি বাস্তব। দেকার্তের বেলাতেও ব্যাপারটি তাই। তিনি যে একটি চিন্তাশীল আমি সেটাই যে তিনি কেবল উপলব্ধি করলেন তাই নয়, সেই সঙ্গে তিনি আরো উপলব্ধি করলেন যে এই চিন্তাশীল আমি আমাদের ইন্দ্রিয়গুলোর সাহায্যে প্রত্যক্ষ করা বস্তুগতের চেয়েও বেশি বাস্তব। তো, এভাবেই এগিয়ে চললেন তিনি। তাঁর দর্শনগত অনুমান শুধু ঐটুকুতেই শেষ হয়ে গেল না।

এরপর কী এলো?

একই রকম স্বজ্ঞামূলক নিশ্চয়তা দিয়ে তিনি অন্য কিছু প্রত্যক্ষ করতে পারছেন কিনা সে-কথা নিজেকে শুধোলেন তিনি। তখন তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে তাঁর নিজের মনের মধ্যে একটি নিখুঁত সত্তা সম্পর্কে একটি পরিষ্কার ও স্বতন্ত্র ধারণা রয়েছে। এই ধারণাটি তাঁর সব সময়েই ছিল, ফলে এটা দেকার্তের কাছে আপনা আপনিই প্রমাণিত হয়ে গেল যে এমন একটি ধারণা সম্ভবত তাঁর নিজের ভেতর থেকে আসতে পারে না। তিনি দাবি করলেন, যে-সত্তা নিজেই ত্রুটিযুক্ত তার কাছ থেকে কখনো ত্রুটিহীন বা নিখুঁত কোনো সত্তার ধারণা আসতে পারে না। কাজেই একটি নিখুঁত সত্তার ধারণা নিশ্চয়ই স্বয়ং সেই নিখুঁত সত্তাটির কাছ থেকেই এসেছে, বা অন্যভাবে বলতে গেলে, ঈশ্বরের কাছ থেকে এসেছে। অতএব, ঈশ্বরের যে অস্তিত্ব আছে এই ধারণাটি দেকার্তের কাছে ঠিক ততোটাই স্বতঃপ্রমাণিত একটি বিষয় যতটা এই ধারণাটি যে একটি চিন্তাশীল সত্তা অবশ্যই অস্তিত্বশীল।

 এই জায়গায় এসে তিনি লাফ দিয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছে গিয়েছিলেন দেখছি। গোড়াতে তো আরো বেশি সাবধানী ছিলেন তিনি।

 ঠিকই বলেছ তুমি। অনেকেই এটাকে তার দুর্বল দিক বলে বর্ণনা করেছেন। তবে তুমি বললে সিদ্ধান্ত। আসলে এটা কিন্তু কোনো কিছু প্রমাণ করার বিষয় ছিল না। দেকার্ত শুধু বলতে চেয়েছেন যে আমাদের সবার মধ্যেই একটি নিখুঁত সত্তার ধারণা বিদ্যমান আর সেই ধারণাটির মধ্যেই এই সত্যটি লুকিয়ে রয়েছে যে এই নিখুঁত সত্তাটি অবশ্যই অস্তিত্বশীল। কারণ, যদি সেটার অর্থাৎ নিখুঁত সত্তাটির অস্তিত্বই না থাকে তাহলে আর সেটা নিখুঁত হয় কী করে। তাছাড়া নিখুঁত কোনো সত্তা না থাকলে সেটা সম্পর্কে আমাদের মনে কোনো ধারণাও থাকত না। আমরা যেহেতু নিখুঁত নই, তাই নিখুঁতত্বের ধারণা আমাদের কাছ থেকে আসতে পারে না। দেকার্তের মত অনুযায়ী, ঈশ্বর-এর ধারণা সহজাত (innate); কারিগরের তৈরি জিনিসে যেমন তার চিহ্নের ছাপ মারা থাকে এই ধারণাটির ছাপও আমাদের জন্ম থেকেই আমাদের ওপর মারা আছে।

বুঝলাম, কিন্তু আমার মনে কোফ্যান্টের (crocophant) ধারণা থাকার মানেই তো এই নয় যে কোফ্যান্টের অস্তিত্ব রয়েছে।

দেকার্ত হয়ত বলতেন যে কোফ্যান্টের ধারণার ভেতর সহজাতভাবেই এই বিষয়টি নিহিত নেই যে কোফ্যান্টের অস্তিস্ব রয়েছে। অন্যদিকে, একটি নিখুঁত সত্তার ধারণার মধ্যেই কিন্তু এই বিষয়টি সহজাতভাবে নিহিত রয়েছে যে এ-ধরনের সত্তা অস্তিত্বশীল। দেকার্তের মত অনুযায়ী, ব্যাপারটা ঠিক ততোটাই নিশ্চিত যতটা নিশ্চিত বৃত্ত সম্পর্কিত এই সহজাত ধারণাটি যে বৃত্তের পরিধির যে কোনো বিন্দু বৃত্তের কেন্দ্র থেকে সমান দূরত্বে অবস্থিত। এই সূত্রের সঙ্গে মেলে না এমন কোনো বৃত্ত তুমি পাবে না। ঠিক তেমনি, এমন কোনো নিখুঁত সত্তা তুমি পাবে না যার মধ্যে সেটার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যটি-ই, অর্থাৎ সেটার অস্তিত্ব নেই।

এ বড় অদ্ভুত ধরনের চিন্তা।

এটা একেবারেই বুদ্ধিবাদী ধরনের চিন্তা। সক্রেটিস আর প্লেটোর মতো দেকার্তও বিশ্বাস করতেন যে প্রজ্ঞা আর সত্তার মধ্যে একটা সম্পর্ক রয়েছে। কারো প্রজ্ঞার কাছে কোনো জিনিস যত বেশি স্বত:প্রমাণিত হবে, ততোই বেশি করে এটা নিশ্চিত হবে যে সে-জিনিসটির অস্তিত্ব রয়েছে।

তো, আপাতত তিনি এ-পর্যন্ত পৌঁছুলেন যে তিনি একজন চিন্তাশীল ব্যক্তি আর দ্বিতীয়ত, এক নিখুঁত সত্তার অস্তিত্ব রয়েছে।

হ্যাঁ আর এই যাত্রাবিন্দু থেকেই এগোতে শুরু করলেন তিনি। বাহ্যিক বাস্তবতা, এই যেমন সূর্য, চন্দ্র ইত্যাদি, এ-সব সম্পর্কে আমাদের ধারণার প্রশ্নে একটা সম্ভাবনা রয়েছে যে এগুলো হয়ত কল্পনা বা ফ্যান্টাসি। কিন্তু এই বাহ্যিক বাস্তবতারও এমন কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা আমরা আমাদের প্রজ্ঞার সাহায্যে প্রত্যক্ষ বা উপলব্ধি করতে পারি। এগুলো হচ্ছে গাণিতিক বৈশিষ্ট্য, বা অন্য কথায় বললে, সেই সব জিনিস যা পরিমাপ করা যায়, যেমন দৈর্ঘ্য, প্রস্থ এবং পুরুত্ব। এ-সব সংখ্যাবাচক বৈশিষ্ট্য আমার প্রজ্ঞার কাছে ঠিক ততটাই পরিষ্কার আর স্বতন্ত্র যতটা পরিষ্কার এবং স্বতন্ত্র এই সত্যটি যে আমি একটি চিন্তাশীল সত্তা। অন্যদিকে রঙ, গন্ধ আর স্বাদের মতো গুণবাচক বৈশিষ্ট্য আমাদের ইন্দ্রিয়গত প্রত্যক্ষণ বা উপলব্ধির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, ফলে সেগুলো বাহ্যিক বাস্তবতাকে বর্ণনা করে না।

প্রকৃতি তাহলে আদৌ স্বপ্ন নয়।

না আর এই প্রসঙ্গে দেকার্ত আবারো সেই নিখুঁত সত্তা সম্পর্কে আমাদের ধারণার দ্বারস্থ হচ্ছেন। আমাদের প্রজ্ঞা যখন কোনো কিছুকে পরিষ্কার এবং স্বতন্ত্রভাবে চিনতে পারে-এই যেমন বাহ্যিক বাস্তবতার গাণিতিক বৈশিষ্ট্যগুলোর মতো-তখন তা অবশ্যই সে-রকমই হবে। কারণ, এক নিখুঁত ঈশ্বর আমাদেরকে ধোঁকা দেবেন না। আমাদের প্রজ্ঞার সাহায্যে আমরা যা প্রত্যক্ষ করি তা যে বাস্তবতার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত এ-বিষয়ে দেকার্ত ঈশ্বরের গ্যারান্টি-র কথা জোর দিয়ে বলেছেন।

বেশ, এ-পর্যন্ত তিনি যা যা আবিষ্কার করলেন তা হলো তিনি একটি চিন্তাশীল সত্তা, ঈশ্বর আছেন আর একটি বাহ্যিক বাস্তবতার অস্তিত্ব রয়েছে।

হ্যাঁ, কিন্তু বাহ্যিক বাস্তবতা নিশ্চিতভাবেই চিন্তার বাস্তবতা থেকে ভিন্ন। দেকার্ত এবার বললেন যে দুই ধরনের বাস্তবতা বা সারবস্তু রয়েছে। একটি সারবস্তু হচ্ছে চিন্তা (thought) বা মন (mind), অন্যটি ব্যাপ্তি (extension) বা বস্তু (matter)। মন পুরোপুরি সচেতন এবং স্থানগত দিক দিয়ে এটা কোনো জায়গা দখল করে না, ফলে এটাকে ছোট ছোট খণ্ডে বিভক্ত করা যায় না। বস্তু অবশ্য পুরোপুরি ব্যাপ্তি, এটা জায়গা দখল করে স্থানগত দিক দিয়ে এবং একে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর অংশে বিভক্ত করা চলে, তবে এর কোনো চৈতন্য বা চেতনা নেই। দেকার্তের মত অনুযায়ী দুই সারবস্তুই ঈশ্বরের কাছ থেকে এসেছে, কারণ একমাত্র ঈশ্বর-ই অন্য কোনো কিছুর মুখাপেক্ষী না হয়েও অস্তিত্বশীল। তবে চিন্তা আর ব্যাপ্তি ঈশ্বর-এর কাছ থেকে এলেও দুটো জিনিসের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। চিন্তা পুরোপুরি বস্তু নিরপেক্ষ এবং উল্টোভাবে, বস্তুগত প্রক্রিয়া একেবারে চিন্তা নিরপেক্ষ।

তার মানে, ঈশ্বরের সৃষ্টিকে তিনি দুভাগে বিভক্ত করলেন।

ঠিক তাই। দেকার্ত-কে দ্বৈতবাদী (dualist) বলা হয়। তার অর্থ, তিনি চিন্তার বাস্তবতা এবং বস্তুগত বাস্তবতার মধ্যে একটি সুস্পষ্ট পার্থক্যে বিশ্বাস করতেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, কেবল মানুষেরই মন আছে। জীব-জন্তুরা পুরো বস্তুগত বাস্তবতার অন্তর্ভুক্ত। তাদের জীবনযাপন এবং চলাফেরা যান্ত্রিকভাবে সম্পন্ন হয়। জম্ভকে দেকার্ত একটি জটিল স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র হিসেবে দেখতেন। বস্তুগত বাস্তবতা সম্পর্কে তিনি পুরোপুরি যান্ত্রিক একটি দৃষ্টিভঙ্গির আশ্রয় নিয়েছেন, ঠিক বস্তুবাদীদের মতো।

হার্মেস কিন্তু একটি যন্ত্র বা স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র বলে আমার একেবারেই মনে হয় না। ঘোর সন্দেহ আছে আমার এ-ব্যাপারে। দেকার্ত নিশ্চয়ই জীব-জন্তু ভালোবাসতেন না। তা, আমরা কী? আমরাও কি স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র?

হ্যাঁ, আবার না। দেকার্ত এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন যে মানুষ একটি দ্বৈত প্রাণী যা চিন্তা-ভাবনাও করে, আবার স্থানগত দিক দিয়ে জায়গা দখল করে। অর্থাৎ মানুষের একটি মন আছে আর আছে বস্তুগত দেহ। সেন্ট অগাস্টিন আর টমাস অ্যাকুইনাস অনেকটা এরকম কথাই বলেছিলেন আগে তারা বলেছিলেন জীব জম্ভর মতো মানুষের একটি দেহ আছে আর দেবদূতদের মতো আত্মা আছে। দেকার্তের মত অনুযায়ী মানুষের দেহ একটি নিখুঁত যন্ত্র। কিন্তু মানুষের একটি মনও আছে যা দেহ-নিরপেক্ষভাবে অর্থাৎ দেহের সাহায্য ছাড়াই কাজকর্ম করতে পারে। দেহগত প্রক্রিয়াগুলোর এতোটা স্বাধীনতা নেই, তারা তাদের নিজেদের আইন অনুযায়ী চলে। তবে আমরা আমাদের প্রজ্ঞা দিয়ে যা কিছু চিন্তা করি তা দেহে ঘটে, ঘটে মনে, যেমন ব্যাপ্তিগত বাস্তবতা থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন। ভালো কথা, আমার অবশ্য এ-কথাটাও বলা উচিত যে জীব-জন্তুরা যে চিন্তা-ভাবনা করতে পারে এ রকম সম্ভাবনার কথা দেকার্ত একেবারে নাকচ করে দেননি। তবে সে-গুণটি তাদের থাকলে চিন্তা আর ব্যাপ্তির মধ্যেকার একই দ্বৈততা (dualism) তাদের বেলাতেও প্রযোজ্য হবে।

এটা নিয়ে আগেও কথা বলেছি আমরা। বাসের পেছনে ছুটবো বলে ঠিক করলে পুরো স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রটাই কাজে নেমে পড়ে। আর বাসটা ধরতে না পারলে আমি কাঁদতে শুরু করি।

মন আর দেহের মধ্যে যে অবিরাম একটা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার খেলা চলে দেকার্ত সে-কথা অস্বীকার করতে পারেননি। তিনি বিশ্বাস করতেন, মন যতক্ষণ দেহের মধ্যে আছে ততক্ষণ তা মস্তিষ্কের সঙ্গে বিশেষ একটি ব্রেইন অরগ্যানের সাহায্যে-যেটাকে তিনি বলেছেন পিনিয়াল গ্রন্থি-সেটার সাহায্যে যুক্ত থাকে আর সেই পিনিয়াল গ্রন্থিতে চিদাত্মা আর বস্তুর মধ্যে অনবরত ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া চলে। কাজেই, দেহগত প্রয়োজনের সঙ্গে সম্পর্কিত আবেগ-অনুভূতি মনকে অনবরত প্রভাবিত করতে পারে। কিন্তু মন এ-সব নীচ তাড়না থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে স্বাধীনভাবে, দেহের পরোয়া না করে, কাজ করতে পারে। উদ্দেশ্য, প্রজ্ঞাকে চালকের আসনে আসীন করা। কারণ, আমার পাকস্থলীতে নিদারুণ ব্যথা হলেও ত্রিভুজের তিন কোণের সমষ্টি ১৮০ ডিগ্রীই থাকবে। তো এভাবেই, দেহগত প্রয়োজনের উর্ধ্বে উঠে যুক্তিসঙ্গতভাবে আচরণ করার ক্ষমতা মানুষের রয়েছে। এদিক থেকে বিচার করলে মন দেহের চেয়ে উঁচু অবস্থানে রয়েছে। আমাদের পায়ের বয়স হতে পারে, সেগুলো দুর্বল হয়ে পড়তে পারে, পিঠটা বেঁকে যেতে পারে, পড়ে যেতে পারে সব কটা দাঁত, কিন্তু আমাদের ভেতর প্রজ্ঞা যতক্ষণ কাজ করছে ততক্ষণ দুই আর দুইয়ে চার হয়ে যেতেই থাকবে। প্রজ্ঞা কখনো বেঁকে যায় না বা দুর্বল হয়ে পড়ে না। দেহই বরং বুড়িয়ে যায়। দেকার্তের মত অনুযায়ী, মন মূলগতভাবেই চিন্তা। কামনা আর ঘৃণার মতো হীনতর আবেগ-অনুভূতিগুলো আমাদের দেহগত কাজকর্মের সঙ্গেই বরং আরো বেশি জড়িত, ফলে ব্যাপ্তিগত বাস্ত বতার সঙ্গে।

আমি এই ব্যাপারটাই বুঝে উঠতে পারছি না যে দেকার্ত কী করে মানব দেহকে যন্ত্র বা স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের সঙ্গে তুলনা করলেন।

তুলনাটা মূলত এই বিষয়টি থেকে এসেছে যে তার সময়ে লোকে ভীষণ মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল যন্ত্র আর ঘড়ির ক্রিয়াকর্ম দেখে যেগুলো নিজের থেকেই কাজ করে যায় বলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হতো। ওগুলো যে আপনা থেকেই কাজ করে সেটা স্পষ্টই একটা বিভ্রান্তি ছাড়া কিছু ছিল না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, একটা অ্যাস্ট্রনমিকাল ঘড়ি তৈরি করতে হয়, হাত দিয়ে সেটাকে দমও দিতে হয়। দেকার্ত বললেন যে ওসব অসাধারণ আবিষ্কার আসলে মানুষ আর জীবজন্তুর দেহ অসংখ্য যে হাড়, পেশী, স্নায়ু, শিরা, উপশিরা আর ধমনীর সমন্বয়ে তৈরি সে তুলনায় অনেক স্বল্প সংখ্যক পার্টস দিয়ে তৈরি। যান্ত্রিক নিয়মের ওপর ভিত্তি করে একটি জন্তু বা মানুষের দেহ তৈরি করতে না পারার মতো কোনো কারণ ঈশ্বরের নেই।

ইদানিং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে মেলা কথা শোনা যাচ্ছে।

 হ্যাঁ, ওটাই হলো আমাদের কালের স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র। আমরা এমন সব যন্ত্র তৈরি করেছি যা আমাদের মনে কখনো কখনো এই মিথ্যা বিশ্বাসের জন্ম দেয় যে সেগুলো বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন। এ-ধরনের যন্ত্রগুলো দেকার্তকে হয়ত আতঙ্কে হতবুদ্ধি করে দিত। তিনি যতটা মনে করেছিলেন মানুষের প্রজ্ঞা কি আসলেই এত মুক্ত ও স্বাধীন কিনা তা নিয়ে হয়ত সন্দেহ দেখা দিত তাঁর মনে। এবং কিছু কিছু দার্শনিক রয়েছেন যারা বিশ্বাস করেন মানুষের আধ্যাত্মিক জীবন তার দেহগত প্রক্রিয়ার মতোই পরাধীন। স্বভাবতই, মানুষের আত্মা যে-কোনো ডেটা প্রোগ্রামের চেয়ে অন্তহীনভাবে বেশি জটিল, কিন্তু কিছু লোক মনে করে তত্ত্বগতভাবে আমরা এ-সব ডেটা প্রোগ্রামের মতোই পরাধীন। কিন্তু সোফি, চলো একটা জিনিস দেখাই তোমাকে।

ঘরের অন্য প্রান্তে বড় একটা লেখার টেবিলের দিকে আঙুল তাক করলেন অ্যালবার্টো। ওটার ওপর ছোট্ট একটা কম্পিউটার রাখা আছে। সেটার কাছে এগিয়ে গেলেন তিনি। সোফিও গেল তার পিছু পিছু।

 সুইচ টিপে কম্পিউটারটি চালু করে দিলেন অ্যালবার্টো, শিগ্‌গিরই দেখা গেল স্ক্রীনের একেবারে ওপরে সি: লেখা রয়েছে। তিনি লিখলেন লায়লা, ব্যাখ্যা করে বললেন এটা একটা উন্নতমানের কথোপকথন প্রোগ্রাম।

শিগগিরই স্ক্রীনের একেবারে ওপরে কিছু লেখা ফুটে উঠল:

হাই, আমার নাম লায়লা। তুমি আরাম করে বসেছ তো?

একটা অক্ষর লিখল সোফি;

হ্যাঁ, অবশ্য তখনো বসেনি সোফি। তার জন্যে একটা চেয়ার নিয়ে এলেন অ্যালবার্টো নক্স।

তোমার নাম কী? স্ক্রীনে লেখা ফুটে উঠল।

সোফি সোফি অ্যামুন্ডসেন লিখতেই কম্পিউটার জবাব দিল:

৩ ক্লোভার ক্লোজ। তোমার সঙ্গে পরিচিত হয়ে ভালো লাগল, সোফি। তুমি কি তোমার পঞ্চদশ জন্মদিনের জন্যে অপেক্ষা করছ?

চমকে গেল সোফি। অ্যালবার্টো তার কাঁধে একটা হাত রেখে বলে উঠলেন: আমি ওকে স্রেফ তোমার নাম, ঠিকানা আর জন্ম তারিখটা বলেছিলাম। ব্যাপারটা অনেকটা নতুন কোনো বন্ধুর সঙ্গে পরিচিত হওয়ার মতো। তাদের সম্পর্কে আগে থেকে কিছু জানা থাকা ভালো।

মন্দ নয়, সোফি লিখল।

আহা তোমার নিশ্চয়ই খারাপ লাগছে না, সোফি। তবে আলাপ করার সময় পুরো বাক্য ব্যবহার করার চেষ্টা করবে।

ধন্যবাদ। আমি একদম ঠিক আছি। তোমাকে একটা কথা জিগ্যেস করতে পারি?

তুমি ভালো আছো জেনে খুশি হলাম। তা বলল, তুমি কী জানতে চাও।

 তোমার বয়স কত? সোফি লিখল।

১৯৮৮ সালের ৮ই অগাস্ট আমাকে আটলান্টায় তৈরি করা হয়। তবে নরওয়েজিয় ভাষায় আমার রূপান্তর ঘটানো হয় ১৯৯০ সালের ২৮শে মার্চ, নরওয়েজিয় পলিটেকনিক-এ।

গশ!

বলেছি না পুরো বাক্য ব্যবহার করবে কথা বলার সময়।

আমি শুধু বলেছি গশ।

আমি স্ল্যাং বুঝি না। ১০০,০০০-এরও বেশি শব্দ আছে আমার শব্দ ভাণ্ডারে। কিন্তু গ-এর সবচেয়ে কাছাকাছি যে-শব্দটা আছে তা হলো গসপেল।

ওই শব্দটার অর্থ হলো যীশুর গল্প।

 সোফি, তুমি কি খ্রিস্টান?

 আমি জানি না।

না জানাটাকে নতুন জ্ঞানের দিকে একটি পদক্ষেপ বলেই ধরা হয় সাধারণত।

সম্ভবত সক্রেটিসও ঠিক একই কথা বলতেন।, দেকার্ত।

সক্রেটিস ছিলেন একজন গ্রীক দার্শনিক, তাঁর জন্ম ও মৃত্যু যথাক্রমে ৪৭০ ও ৩৯৯ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে। এর চেয়ে বেশি কিছু জানতে চাইলে এফ সেভেন চাপ দাও। দেকার্ত ছিলেন একজন ফরাসী দার্শনিক। তাঁর জন্ম ও মৃত্যু যথাক্রমে ১৫৯৬ ও ১৬৫০ খ্রিস্টাব্দে। এর চেয়ে বেশি কিছু জানতে চাইলে এফ সেভেন চাপ দাও।

ধন্যবাদ, এটুকুই যথেষ্ট। তোমাকে আরেকটা কথা জিগ্যেস করি?

 এটুকুই যথেষ্ট জেনে খুশি হলাম। তা, বলল না, কী জানতে চাও।

 অ্যালবাটো মৃদু হাসলেন। সোফি লিখল : হিল্ডা মোলার ন্যাগ কে?

হিল্ডা মোলার ন্যাগ লিলেস্যান্ড-এ থাকে; তার বয়স আর সোফি অ্যামুসেনের বয়স একই।

তুমি কীভাবে জানলে?

জানি না, কীভাবে। হার্ড ডিস্কে পেয়েছি তাকে।

 সোফি তার কাঁধে একটা হাতের স্পর্শ অনুভব করল।

হিল্ডা সম্পর্কে আমাদের হাতে যতটুকু তথ্য আছে সেটাই আমি ডেটা প্রোগ্রামে ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম, অ্যালবার্টো বললেন।

হিল্ডা সম্পর্কে তুমি আর কী জানো? সোফি লিখল।

হিল্ডার বাবা লেবাননে জাতিসংঘ বাহিনীর একজন পর্যবেক্ষক। তাঁর ব্যাংক মেজর এবং তিনি তাঁর মেয়েকে প্রায়ই পোস্টকার্ড পাঠান।

আমি চাই তুমি তাকে খুঁজে বার করো।

আমি সেটা করতে পারি না। আমার কোনো ফাইলে তার কথা নেই আর তাছাড়া, অন্য কোনো ডেটা বেস-এর সঙ্গেও আমি যুক্ত নই।

আমি বলছি তাকে খুঁজে বের করো!!!!!!!!

তুমি কি রেগে গেছে, সোফি? এতোগুলো বিস্ময়বোধক চিহ্ন ত্রুদ্ধ অনুভূতির পরিচায়ক।

হিডার বাবার সঙ্গে কথা বলতে চাই আমি।

নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে সমস্যা হয় তোমার। তুমি যদি তোমার শৈশব নিয়ে কথা বলতে চাও তাহলে এফ নাইফ চাপ দাও।

ফের সোফির ঘাড়ের ওপর হাত রাখলেন অ্যালবার্টে।

 ও ঠিকই বলেছে। এটা ক্রিস্টাল বল নয়। লায়লা স্রেফ একটা ডেটা প্রোগ্রাম।

চুপ করো! সোফি লিখল।

তোমার যা অভিরুচি, সোফি। আমাদের পরিচয় পর্ব মাত্র ১৩ মিনিট ৫২ সেকেন্ড স্থায়ী হলো। আমরা যা যা বললাম তার সবই মনে থাকবে আমার। এবার আমি প্রোগ্রামটা শেষ করব।

স্ক্রীনে আবারো সিঃ অক্ষরটা দেখা গেল।

এবার আবার বসতে পারি আমরা, অ্যালবার্টো বললেন।

 কিন্তু এরিমধ্যে সোফি অন্য কয়েকটা কী-তে চাপ দিয়ে ফেলেছে।

ন্যাগ, লিখেছে সে।

সঙ্গে সঙ্গে স্ক্রীনের ওপর ফুটে উঠল নিচের মেসেজটা:

আমি এখানে।

এবার অ্যালবার্টোর লাফ দিয়ে ওঠার পালা।

কে তুমি? সোফি লিখল।

মেজর অ্যালবার্ট ন্যাগ অ্যাট ইয়োর সার্ভিস। সোজা লেবানন থেকে এসেছি আমি। তোমার কম্যান্ড কী, বলল।

এটা তো দেখছি সবকিছুকে ছাপিয়ে গেল। একটা শ্বাস টেনে বললেন অ্যালবার্টো। ইঁদুরটা হার্ডডিস্কেও ঢুকে পড়েছে দেখছি।

সোফিকে সরে যাওয়ার ইঙ্গিত করে কী বোর্ডের সামনে বসে পড়লেন তিনি

 আমার পিসির ভেতর তুমি ঢুকলে কী করে? লিখলেন তিনি।

স্রেফ হাতসাফাই, প্রিয় সহকর্মী। যেখানে যাবো বলে ঠিক করি ঠিক সেখানেই চলে যাই আমি।

জঘন্য ডেটা ভাইরাস কোথাকার!

আহা, আহা, চটছ কেন? এই মুহূর্তে এখানে আমি একটা বার্থডে ভাইরাস হিসেবে আছি। তা, বিশেষ একটা শুভেচ্ছাবাণী পাঠাতে পারি?

না, ধন্যবাদ। এ-সব মেলা দেখেছি আমরা।

কিন্তু আমার খুব বেশি সময় লাগবে নাঃ সব তোরই সম্মানে, প্রিয় হিল্ডা। আবারো অনেক অনেক খুশি শুভ জন্মদিন জানাচ্ছি তোকে তোের পঞ্চদশ জন্মবার্ষিকীতে। কিন্তু যে পরিস্থিতিতে জানাচ্ছি সে-জন্যে তুই আমাকে ক্ষমা করিস, কিন্তু আমি চেয়েছি আমার পাঠানো জন্মদিনের শুভেচ্ছা তুই সেখানেই যাস সেখানেই তোকে ঘিরে থাক, সেখানেই তোকে জড়িয়ে ধরুক। ভালোবাসা নিস, বাবা, যে তোকে আদর করে জড়িয়ে ধরার জন্যে ছটফট করছে।

অ্যালবার্টো কিছু লেখার আগেই সি: চিহ্নটা ফের ফুটে উঠল স্ক্রীনে।

অ্যালবার্টো লিখলেন ডিআইআর ন্যাগ*.*, তাতে নিচের তথ্য ভেসে উঠল স্ক্রীনে:

ন্যাগ.এলআইবি    ১৪৭,৬৪৩   o৬-১৫-৯০   ১২:৪৭
ন্যাগ.এলআইবি    ৪২৬,৪৩৯    ০৬-২৩-৯০   ২২:৩৪

অ্যালবার্টো লিখলেন ইরেজ ন্যাগ*.* তারপর সুইচ টিপে বন্ধ করে দিলেন কম্পিউটার।

এইবার-ইরেজ করে দিয়েছি আমি ওকে, বললেন তিনি। কিন্তু পরের বার ও যে কোথায় উদয় হবে তা ঠিক করে বলা মুশকিল।

ওখানেই বসে থাকলেন তিনি, চেয়ে রইলেন স্ক্রীনটার দিকে। তারপর যোগ করলেন:

এরচেয়ে বাজে দিকটা হলো নামটা। অ্যালবার্ট ন্যাগ…।

নাম দুটোর মধ্যেকার মিল দেখে এই প্রথমবারের মতো চমকে উঠল সোফি। অ্যালবার্ট ন্যাগ আর অ্যালবার্টো নক্স।  কিন্তু অ্যালবার্টো এতোটাই চটে আছেন যে কোনো কথা বলার সাহস হলো না তার। উঠে গিয়ে কফি টেবিলে বসল তারা দুজন আবার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *