৯
[আমাদের শিল্পের বিকৃতি। শিল্প তার স্বাভাবিক বিষয়বস্তু হারিয়েছে। কোন সজীবন অনুভূতি শিল্পে লক্ষ করা যায় না। শিল্প মুখ্যত তিনটি অপকৃষ্ট পর্যায়ের আবেগ সঞ্চারিত করে।]
ইউরোপীয় জগতের অভিজাত শ্রেণীর লোকের ধর্মবিশ্বাসহীনতার পরিণতি হল এই : ধর্মবোধসঞ্জাত মানব-উপলব্ধ উচ্চতম অনুভূতিকে শিল্পকর্মের মাধ্যমে সঞ্চারিত করে দেবার পরিবর্তে এমন একটি শিল্পক্রিয়ার অভ্যুদয় ঘটল-যার লক্ষ্য সমাজের বিশেষ একটি শ্রেণীর জন্য বেশি পরিমাণ উপভোগের ব্যবস্থা করা। বিস্তৃত শিল্পরাজ্য থেকে শিল্পক্রিয়ার সে অংশটি পৃথক করে রাখা হল, এবং একমাত্র বিশেষ গোষ্ঠীর মানুষের নিকট আনন্দ পরিবেশনকারী বস্তুকেই শিল্প নামে অভিহিত করা হল।
সমগ্র শিল্পজগৎ থেকে এইভাবে একটি ক্ষুদ্র অংশকে যোগ্যতার অভাব সত্ত্বেও নির্বাচন করা এবং সে শিল্পকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মূল্যায়িত বলে মূল্যায়িত করা –ইউরোপীয় সমাজ-জীবনের ওপর এর নৈতিক প্রভাবের প্রশ্নে না গেলেও এতে কোনই সন্দেহ নেই যে, এই বিকৃত শিল্পায়ন শিল্পকেই দুর্বল করেছে,-এমনকি তাকে ধ্বংসের সন্নিকটবর্তী করেছে। এই বিকৃতির প্রথম মারাত্মক ফল হল, তা শিল্পকে তার স্বাভাবিক অনন্ত বৈচিত্র্যময়, গভীর, ধর্মজাগতিক বিষয়বস্তু থেকে বঞ্চিত করেছিল। দ্বিতীয় পরিণাম হল মাত্র একটি ছোট গোষ্ঠীর লোক লক্ষ্যে থাকায় শিল্প তার রূপমূর্তির সৌন্দর্য হারিয়ে কৃত্রিম এবং অস্পষ্ট হয়ে পড়ল। তৃতীয় এবং মুখ্য পরিনাম হল, শিল্প তার স্বাভাবিকতা, এমনকি আন্তরিকতা ভ্রষ্ট হল এবং সম্পূর্ণরূপে কৃত্রিম এবং মগজপ্রসূত হয়ে উঠল।
প্রথম পরিণতির ফল-বিষয়বস্তুর দৈন্য ঘটার কারণ,-কেবলমাত্র তাই সৎ শিল্প বলে স্বীকৃতি লাভ করল যা মানুষের অনুভূত সজীব অনুভূতি-সঞ্চারক। যেহেতু চিন্তার ফসলকে একমাত্র তখনই অকৃত্রিম বলা যায়, যখন তা পূর্বজ্ঞাত বিষয়ের অনুবৃত্তি না করে নতুন ধারণা ও চিন্তা সঞ্চারিত করে। তেমনি শিল্পসৃষ্টি একমাত্র তখনই অকৃত্রিম বিবেচনার যোগ্য-যখন তা মানুষের জীবনপ্রবাহে নতুন অনুভূতি (তা যতই তুচ্ছ হোক না কেন) আনয়ন করে। শিশু এবং যুবকেরা যে নতুন অনুভূতি-সঞ্চারক (অর্থাৎ যে অনুভূতি তাদের পূর্বে ঘটেনি) শিল্পকর্ম দ্বারা প্রবলভাবে অভিভূত হয়, তার ব্যাখ্যাও এরই মধ্যে মিলবে।
সম্পূর্ণ অভিনব এবং ইতোপূর্বে অনভিব্যক্ত অনুভূতিসমূহও জনগণের ওপর তেমনি শক্তিমান প্রভাব বিস্তার করে। এই নতুন এবং সজীব অনুভূতির উৎস থেকে উচ্চ শ্রেণীভোগ্য শিল্প নিজেকে বঞ্চিত করেছে। তারা ধর্মীয় চেতনার সঙ্গে সুসঙ্গত অনুভূতিকে মূল্য না দিয়ে শুধু উপভোগ্যতার মানদন্ডে অনুভূতির বিচার করে এই দুর্গতি ঘটিয়েছে। উপভোগ থেকে অধিকতর পুরাতন এবং গতানুগতিক কিছু হতে পারে না, অপর পক্ষে প্রত্যেক যুগের ধর্মীয় চেতনা-উদ্ভুত অনুভূতির চাইতে সজীবও কিছু নেই। এর অন্যথা হওয়া সম্ভব নয়। প্রকৃতিই মানুষের উপভোগের সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে। অথচ ধর্মীয় চেতনা-জগতে অভিব্যক্ত মানবসমাজের অগ্রগতির কোন সীমা নেই। মানবধর্ম উপলব্ধির ক্রমবর্ধমান স্বচ্ছতার পরিণামে মানবসমাজের অগ্রগতির উত্তরোত্তর বৃহৎ পরিমাণে পদক্ষেপ ঘটায় মানুষ নতুন এবং সজীব অনুভূতির অভিজ্ঞতা লাভ করে। সুতরাং কেবলমাত্র ধর্মীয় উপলব্ধির ভিত্তিতেই (যা কোন যুগের মানুষের জীবন সম্পর্কীয় ধারণার উচ্চতম স্তর নির্দেশ করে) মানুষের অনুভূত নতুন আবেগের উদ্ভব হয়। প্রাচীন গ্রীকদের ধর্মীয় উপলব্ধি থেকেই হোমার এবং ট্র্যাজিক নাট্যকারদের রচনায় প্রকৃত অভিনব, গুরুত্বপূর্ণ এবং অন্তহীন বিচিত্র অনুভূতি প্রবাহিত হয়েছিল। যে ইহুদিরা এক ঈশ্বরের ধর্মীয় উপলব্ধির অধিকারী হয়েছিলেন তাদের বেলায়ও অনুরূপ ঘটনা ঘটেছিল। সেই উপলব্ধি থেকে ধর্মগুরুদের দ্বারা অভিব্যক্ত সমস্ত অভিনব এবং মহৎ আবেগও উৎসারিত হয়েছিল। মধ্যযুগের কবিদের সম্পর্কেও একই কথা প্রযোজ্য। তাঁরা যেমন স্বর্গধামবাসীদের নানা শ্রেণীবিন্যাসে বিশ্বাসী ছিলেন, তেমনি ক্যাথলিক মহাসংঘের অস্তিত্বেও বিশ্বাসী ছিলেন এবং বর্তমান কালে যে মানুষ প্রকৃত খ্রীষ্টধর্মের ধর্মীয় উপলব্ধি অর্থাৎ মানবভ্রাতৃত্বের ধারণা হৃদয়ঙ্গম করেছেন, তাদের পক্ষেও এটা সমান সত্য।
ধর্মীয় উপলব্ধিজাত সজীব অনুভূতির বৈচিত্র্য অন্তহীন। এ সমস্ত অনুভূতি অভিনব, যেহেতু ধর্মীয় চেতনা আর কিছুই নয়,-তা কেবল প্রত্যাসন্ন সত্যের পদসঞ্চার, অর্থাৎ জগতের সঙ্গে মানুষের নতুন সম্বন্ধের বার্তা এর অন্তরে নিহিত। অপরপক্ষে উপভোগের আকাঙ্ক্ষা থেকে উদ্ভুত অনুভূতিসমূহ শুধুমাত্র যে সীমিত তাই নয়, বরং বহুকালের উপলব্ধির এবং অভিব্যক্তির পুনরাবৃত্তি। কাজেই ইউরোপীয় সমাজের উচ্চবর্গীয় ব্যক্তিদের প্রতয়হীনতা তাদের এমন এক শিল্পের অধিকারী করেছে যার বিষয়বস্তু অতীব নিম্নমানের।
উচ্চ শ্রেণীভুক্ত লোকের শিল্পের বিষয়বস্তুর দৈন্য বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হবার আর একটি কারণ, ধর্মীয় আদর্শবঞ্চিত হয়ে যে শিল্প জনমানসের সংযোগও হারিয়েছে। এর ফলে তাদের শিল্প-সঞ্চারিত অনুভূতির সীশাও সংকুচিত হয়েছে। যে অনুভূতির সীমা স্বাভাবিকভাবে শ্রমিক জনসাধারণের আয়ত্তে আসে, জীবন ধারণের জন্য কোন শ্রমের অভিজ্ঞতাহীণ ক্ষমতাবান ধনীদের অনুভূতির সীমা তার চাইতে অনেক বেশি দীন, সীমাবদ্ধ এবং তুচ্ছ।
আমাদের গোষ্ঠীর নন্দনতত্ত্ববিদদের চিন্তা এবং বক্তব্য সাধারণত এর বিপরীত প্রান্তীয়। আমার স্মরণ আছে, অত্যন্ত চতুর, শিক্ষিত অথচ পুরোপুরি নাগরিক এবং নন্দনতত্ত্ববিদ্ Gonchrev নামক লেখক আমাকে বলেছিলেন, টুর্গেনিভের Sportsman’s Note-book এর পরে কৃষকজীবন সম্পর্কে লিখবার মতো বস্তু আর কিছু অবশিষ্ট নেই। এ বিষয়ে সব উপাদান ব্যবহৃত হয়ে গেছে। শ্রমিক জনগণের জীবন তাঁর নিকট এত সহজ মনে হয়েছিল যে, টুর্গেনিভের কৃষক জীবনভিত্তিক ছোটগল্পগুলিতে তাদের সম্পর্কে বর্ণনার যোগ্য সব কিছুই নাকি বলা হয়ে গিয়েছে। আমাদের বিত্তবান মানুষের জীবন, তাদের প্রণয়বৃত্তান্ত এবং জীবন সম্পর্কীয় অতৃপ্তি তাঁর নিকট অফুরন্ত বিষয়বস্তুতে পূর্ণ মনে হয়েছিল। একজন নায়ক তার প্রণয়িনীকে হাতের তালুর ওপর চুম্বন করল, আর একজন কনুইয়ের ওপর, তৃতীয় জন অপর কোন স্থানে। আলস্যপীড়িত বলে কোন ব্যক্তি অতৃপ্ত, মানুষের ভালোবাসা-বঞ্চিত বলে অপর ব্যক্তি অতৃপ্ত। Goncharev- এর মতে এই বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্য অন্তহীন। শ্রমজীবীর জীবন বিষয়বস্তুর দিক থেকে দীন, কিন্তু আমাদের মতো আলস্য পরায়ণদের জীবন চিত্তাকর্ষক-আমাদের সমাজের বহু সংখ্যক লোক এই মত পোষণ করেন। শ্রমিক-জীবনের বৈচিত্র্য অন্তহীন। সমুদ্রে এবং ভূপৃষ্ঠে শ্রমসংশ্লিষ্ট বিপদাপদ, শমিকের অস্থায়ী প্রবাসজীবন, নিয়োগকর্তা, ওভারসীয়ার, সহকর্মী, অপর ধর্মীয় ও জাতীয় লোকের সঙ্গে তার ভাবের আদান-প্রদান, প্রকৃতি ও বন্য পশুদের সঙ্গে তার সংগ্রাম, গৃহপালিত পশুদের সঙ্গে সাহচর্য, অরণ্যে, বৃক্ষহীন শুষ্ক প্রান্তরে, শস্যক্ষেত্রে, উদ্যানে, ফলের বাগানে তার কাজ : স্ত্রীপুত্রের সঙ্গে শুধুমাত্র নিকট সম্পর্কীয় মানুষ হিসেবে নয়, শ্রমের ক্ষেত্রে সহযোগী ও সহায়ক এবং প্রয়োজনে তার বদলি হিসেবে তাদের কাজ করা; শুধুমাত্র লোক দেখানো বা আলোচনার জন্য নয়, তার নিজের ও পারিবারিক জীবনের সমস্যা হিসেবে সকল অর্থনৈতিক প্রশ্নে তার উৎকণ্ঠা : আত্মনিগ্রহ ও অপরের কার্যে নিয়োজিত বলে তার অহংকার, ক্লান্তিহর খাদ্যগ্রহণে তার আনন্দ, এবং এই ব আগ্রহই ধর্মীয় চেতনায় ওতপ্রোত-এই সব কিছু আমাদের কাছে যাদের এই জাতীয় কোন অভিজ্ঞতাই নেই এবং ধর্মচেতনাও নেই, এবং যারা নিজেরা কোনো পরিশ্রম করি না, বরং পরের উৎপাদিত ভোগ্যদ্রব্যসমূহের ব্যবহার এবং ধ্বংস সাধন করি-আমাদের এই ক্ষুদ্র সম্ভোগপরায়ণ তুচ্ছ জীবন-ব্যাপৃতির তুলনায় শ্রমজীবীদের ওই জীবন একঘেয়ে মনে হয়! এ যুগের উচ্চাশ্রেণীভুক্ত মানুষের অভিজ্ঞতালব্ধ অনুভূতি অত্যন্ত গুরুত্ব ও বৈচিত্র্যপূর্ণ বলেই আমাদের নিজেদের ধারণা। কিন্তু বাস্তবপক্ষে এই শ্রেণীর মানুষের (অর্থাৎ আমাদের) প্রায় সমস্ত অনুভূতি তিনটি মাত্র অতি তুচ্ছ এবং অতি সবল অনুভূতির মধ্যে সীমাবদ্ধ : আত্মগরিমার অনুভূতি, যৌন আকাঙ্ক্ষার অনুভূতি এবং জীবন-অবসাদের অনুভূতি। ধনিকভোগ্য শিল্পের বিষয়বস্তুর প্রায় সম্পূর্ণটাই শাখা প্রশাখাসহ এই তিন জাতীয় অনুভূতির মধ্যেই নিহিত। প্রথমত, সার্বভৌম শিল্প থেকে উচ্চতর শ্রেণীসৃষ্ট স্বতন্ত্র শিল্পের বিচ্ছিন্নতার প্রারম্ভে শিল্পের প্রধান বিষয়বস্তু ছিল অহমিকার অনুভূতি। রেনেসাঁসের সময়ে এবং তারও পরবর্তীকালে শিল্পজগতের অবস্থা ছিল এই। সেকালে শিল্পকর্মের প্রধান বিষয়বস্তু ছিল পোপ, রাজা, ডিউক প্রভৃতি শক্তিমানের গুনকীর্তন। তাঁদের সম্মানে গীতিগাথা এবং প্রেমগীতিও রচিত হত। গীতিকাব্যে এবং স্তোত্রগুলিতেও তাঁরা প্রশংসিত হতেন। অনেকটা চাটুকারী কৌশলে তাঁদের প্রতিকৃতি চিত্রিত এবং মূর্তি খোদিত হত।
অতঃপর শিল্পরাজ্যে যৌন আকাঙ্ক্ষার উপাদান উত্তরোত্তর বেশি পরিমাণে অনুপ্রবেশ করতে লাগল। এই যৌন আকাঙ্ক্ষা সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া এবং নাটকে নভেলে বিনা ব্যতিক্রমে এখন ধনিকশ্রেণীর শিল্পকর্মের অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ধনিকশ্রেণীর শিল্প-সঞ্চারিত তৃতীয় অনুভূীত অর্থাৎ জীবনবিষয়ে অতৃপ্তি-আধুনিক শিল্পে আরও পরবর্তীকালে আবির্ভূত হয়েছে। বর্তমানে (ঊনবিংশ) শতাব্দীর প্রারম্ভে বাইরন, লিওপার্ডি এবং পরবর্তীকালে হাইনে প্রভৃতি অনন্য সাধারণ ব্যক্তিরাই এ অনুভূতির অভিব্যক্তি দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে এরূপ অনুভূতির প্রকাশ ফ্যাশনে পরিণত হল। অত্যন্ত সাধারণ এবং শূন্য গর্ভ মানুষও এই অতৃপ্তির অনুভূতির অভিব্যক্তি দিতে লাগল। ফরাসি সমালোচক ভুমিক নতুন লেখকদের রচনাকে খুবই সঙ্গতভাবে নিম্নোক্ত বৈশিষ্ট্যমন্ডিত বলে অভিহিত করেছেন :
‘….জীবনের বিষণ্ণতা, বর্তমান যুগের প্রতি ঘৃণা, শিল্প-বিভ্রান্তিজনিত অপর যুগের জন্য খেদ, আত্মবিরোধিতায় রুচি, অনন্যসাধারণ হবার আকাঙ্ক্ষা, সরলতার প্রতি আবেগময় অভীপ্সা, আশ্চর্য বস্তুর শিশুসুলভ পূজা, জাগর-স্বপ্নের প্রতি অসুস্থ প্রবণতা, স্নায়ুর বিক্ষিপ্ত অবস্থা-এবং সর্বোপরি ‘অত্যুগ্র ইন্দ্রিয়পরায়ণতাই দাবি।’
এই তিনটি অনুভূতির মধ্যে সর্বনিম্নতমটি অর্থাৎ ইন্দ্রিয়পরায়ণতাই (যা শুধু মানুষেরই অধিগম্য নয়, পশুদেরও সমান আয়ত্ত) সাম্প্রতিককালে শিল্পকর্মের মুখ্য বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে।
বোকাচিও (Boccaccio) থেকে মারচেল প্রেভোস্ট (Marcel Prevost) পর্যন্ত উপন্যাস ও কাব্যকবিতা বিভিন্ন রূপমূর্তির মধ্য দিয়ে যৌনভিত্তিক প্রেমের অনুভূতিকে অনিবার্যভাবে উৎসারিত করেছে। যৌন ব্যভিচার শুধু যে সর্বাধিক প্রিয় বিষয় তাই নয়, সমস্ত উপন্যাসের প্রায় একমাত্র অবলম্বন। কোন ছলে নারীরা উন্মুক্ত বক্ষ এবং অঙ্গপ্রতঙ্গ দেখিয়ে হাজির না হলে সে অভিনয়কেব মনে করা হয় না। সংগীত এবং রোমান্সগুলিও বিভিন্ন পরিমাণে আদর্শায়িত লালসারই অভিব্যক্তি।
ফরাসি শিল্পীদের অঙ্কিত চিত্রের অধিকাংশই নানাভাবে নারীদেহের নগ্নতার রূপায়ন। সাম্প্রতিক ফরাসি সাহিত্যে এমন একটি পৃষ্ঠা বা কবিতা দেখা যায় না যেখানে নগ্নতার বর্ণনা নেই। প্রাসঙ্গিক বা অপ্রাসঙ্গিক -যেভাবেই হোক না কেন, তাদের মধ্যে তাদের প্রিয় চিন্তা এবং শব্দ ‘হুঁ’ অর্থাৎ ‘নগ্ন’ অন্তত দুবার পুনরাবৃত্ত হয়নি-এমন দেখা যায় না। জবসু ফব এড়ৎসবহঃ নামক জনৈক লেখকের রচনা শুধু যে প্রকাশিত হয় তাই নয়, তিনি প্রতিভাবানও বিবেচিত হন। নতুন লেখকদের সম্পর্কে ধারণা লাভের অভিপ্রায়ে আমি তাঁর খবং ঈযবাধী ফব উরড়সবফব নামক উপন্যাসটি পড়ি। এই বইখানি কতিপয় নারীর সঙ্গে জনৈক ব্যক্তির ক্রমান্বয়ী সংসর্গের অনুপুঙ্খ বর্ণনা ছাড়া কিছু নয়। প্রতিটি পৃষ্ঠা লালসা-উদ্দীপক বর্ণনায় পরিপূর্ণ। Pierre Louy-i Aphrodite সম্পর্কেও একই মন্তব্য করা চলে। এই বইটিও জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। সাম্প্রতিক কালে Huysmans’-Gi Certains বইখানি আমার হাতে পড়ে। সেই বইটিতেও একই ব্যাপার। খুব ব্যতিক্রম ছাড়া সমস্ত ফরাসি উপন্যাসে একই আলেখ্য চিত্রিত। এর সবগুলিই যৌন আসক্তির বাতিকগ্রস্ত লোকের সৃষ্টি। তাদের মন অসুস্থ বলে তারা নিশ্চিন্ত করে, তাদের সমস্ত জীবন যৌনতামূলক বিভিন্ন বিকৃতিকে বৃহদায়তন করে দেখাবার কাজে যেমন কেন্দ্রীভূত, তেমনি পৃথিবীর সমস্ত লোকের জীবনই অনুরূপ কাজে কেন্দ্রয়িত। যৌনতাবাতিকগ্রস্ত এ পর্যায়ের লেখকের অনুকরণ চলছে সমস্ত ইউরোপ ও আমেরিকার শিল্পজগতে।
এভাবে বিত্তবান শ্রেণীর লোকদের প্রত্যয়হীনত এবং ব্যতিক্রমী ধারার জীবন পরিণতিতে বিষয়বস্তুর দিক থেকে এ গোষ্ঠীর লোকের শিল্প শুধুমাত্র দৈন্যদশায় উপনীত হয়নি, তা অহমিকার অনুভূতি, জীবন বিষয়ে অতৃপ্তি, এবং সর্বোপরি যৌন আকাঙ্ক্ষা- সঞ্চারের কদর্যতায় পর্যবসিত হয়েছে।