হোয়াট ইজ আর্ট – ৭

[শাসক শ্রেণীর জীবনদৃষ্টির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি নন্দনতত্ত্ব গঠিত হল।]

গির্জা অনুমোদিত খ্রীষ্টধর্ম আস্থা হারাবার পর থেকে উচ্চশ্রেণীর মানুষের নিকট সৌন্দর্য (অর্থাৎ শিল্পেদ্ভুত আনন্দ) উৎকৃষ্ট এবং নিকৃষ্ট শিল্প বিচারের মানদন্ড হয়ে দাঁড়াল। সে দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী উচ্চতর শ্রেণীর ব্যক্তিদের মধ্যে স্বভাবতই একটি নন্দনতত্ত্ব জন্মলাভ করল। সে দৃষ্টিভঙ্গি এমন একটি ধারণা বা তত্ত্বের সমর্থক-যা সৌন্দর্যসৃষ্টিই শিল্পের লক্ষ্য বলে ঘোষণা করে। এ তত্ত্ব যে সভ্রান্ত তা সপ্রমাণের জন্য এর সমর্থকেরা দৃঢ়ভাবে বললেন যে, এটা তাঁদের নিজস্ব কোন আবিষ্কার নয়, বরং বস্তুস্বভাবের মধ্যেই এর অস্তিত্ব নিহিত এবং এমনকি প্রাচীন গ্রীকদের দ্বারাও এ সত্য স্বীকৃত হয়েছিল। কিন্তু এ দৃঢ় স্বীকৃতি একটি স্বৈরতন্ত্রী মত ছাড়া আর কিছু নয় এবং প্রকৃতপক্ষে এর কোন ভিত্তিভূমি ছিল না। যেটুকু সত্য এর মধ্যে ছিল তা এই, খ্রীষ্টানদের তুলনায় প্রাচীন গ্রীকদের নৈতিক আদর্শ খুব নিম্নমানের হওয়ায় তাঁদের মঙ্গলবোধ এবং সৌন্দর্যবোধের মধ্যে তখন পর্যন্ত কোন সূক্ষ্ম বিভেদরেখা টানা হয়নি।

কল্যাণের যে সর্বোচ্চ সম্পূর্ণতা (যা সৌন্দর্যের সঙ্গে একাত্ম তো নয়ই, বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিরোধী) ইসাইয়া (Isaiah) কাল থেকে ইহুদিদের নিকট যা প্রতিভাত ছিল এবং খ্রীষ্টানদের মাধ্যমে যার পূর্ণ অভিব্যক্তি ঘটেছিল —গ্রীকদের নিকট তা ছিল সম্পূর্ণ অজ্ঞাত। তাঁদের বিবেচনায় সুন্দর বস্তুমাত্রই অবশ্যই শুভ। সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিস্টটল প্রভৃতি তাঁদের প্রধান চিন্তানায়কেরা অবশ্য অনুভব করেছিলেন, সৌন্দর্যের সঙ্গে সঙ্গতিহীন মঙ্গলের অভিব্যক্তি ঘটা অসম্ভব নয়। সক্রেটিস তো স্পষ্টভাবেই সৌন্দর্যের স্থান মঙ্গলবোধের নিম্নে নির্ধারণ করেছিলেন। এই দুই তত্ত্বের মিলন সাধনের উদ্দেশ্যে প্লেটো আধ্যাত্মিক সৌন্দর্যের উল্লেখ করেন। অপর পক্ষে শিল্পের ওপর অ্যারিস্টটলের দাবি ছিল যে, তা জনগণের ওপর নৈতিক প্রভাব বিস্তার করবে। কিন্তু এতদসত্ত্বেও সৌন্দর্য এবং মঙ্গলের একাত্মতার ধারণা তাঁরা সম্পূর্ণ বিসর্জন দিতে পারেননি।

এর ফলস্বরূপ ওই ধারণার বাঙ্ময় রূপ হিসেবে সে যুগের ভাষায় একটি যুগ্ম শব্দের (সৌন্দর্য-মঙ্গল) প্রবর্তন হল।

স্পষ্টত গ্রীক জ্ঞানী পুরুষেরা বৌদ্ধ এবং খ্রীষ্টধর্মে অভিব্যক্ত শুভবোধের ধারণার সন্নিকটবর্তী হতে লাগলেন। তবে সৌন্দর্যের সঙ্গে শুভবোধের সম্পর্কের সংজ্ঞা নির্ধারণে জটিল জালে জড়িয়ে পড়লেন। সৌন্দর্য এবং শুভবোধ সম্পর্কে প্লেটোর যুক্তি-স্ব- বিরোধিতায় পূর্ণ। এই ভাববিভ্রান্তির প্রভাবে পরবর্তী যুগের ইউরোপীয় সমাজ সমস্ত রকম বিশ্বাস বর্জিত হয়ে সে স্ব-বিরোধিতাকে একটি শিরূপ-বিধানে উন্নীত করবার প্রয়াস পেয়েছিলেন। এটা প্রমাণিত করবার জন্য তাঁরা চেষ্টিত ছিলেন যে, সকল বস্তুর অন্তরেই এই সৌন্দর্য ও শুভবোধের মিলন নিহিত। সৌন্দর্য এবং কল্যাণের মিলন অনিবার্য এবং ‘শিব-সুন্দর’ শব্দ এবং তত্ত্বটি (গ্রীকদের নিকট যা অর্থপূর্ণ ছিল, অথচ খ্রীষ্টানদের নিকট যা অর্থহীন) মানবজাতির সর্বোচ্চ আদর্শের প্রতিরূপ। এই বিভ্রান্তির ওপরেই নতুন নন্দনতত্ত্ব বিদ্যা প্রতিষ্ঠিত হল। এই নতুন তত্ত্বর যুক্তিযুক্ততা প্রতিপাদনের জন্য প্রাচীনদের শিল্পচিন্তাকে বিকৃত করা হল-যাতে এটা প্ৰতীয়মান হয় যে, এই নব-উদ্ভাবিত নন্দনতত্ত্ব গ্রীকদের মধ্যেও প্রচলিত ছিল।

বাস্তবক্ষেত্রে শিল্প বিষয়ে প্রাচীনদের বিচার আমাদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল। বেনার্ড (Benard) তাঁর অ্যারিস্টটলের নন্দনতত্ত্ববিষয়ক গ্রন্থে খুব সঙ্গতভাবেই মন্তব্য করেছেন : ‘সূক্ষ্ম সমীক্ষায় যে কেউ দেখতে পারেন, সৌন্দর্য এবং শিল্পতত্ত্ব প্লেটো এবং তাঁর সমস্ত অনুবর্তীদের থেকে অ্যারিস্টটলে এসে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।’ বস্তুতপক্ষে প্রাচীনদের শিল্পবিষয়ক বিচার আমাদের কালের নন্দনতত্ত্বকে শুধু যে সমর্থন করে না তা নয়, বরং তার সৌন্দর্য-মতবাদের বিরোধিতা করে। তবু স্যাচলার (Schasler) থেকে শুরু করে নাইট (Knight) পর্যন্ত নন্দনতত্ত্বের সমস্ত পথপ্রদর্শক ঘোষণা করেছেন যে সৌন্দর্য-বিজ্ঞান অর্থাৎ নন্দনতত্ত্ব বিদ্যার প্রারম্ভ সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিস্টটল প্রভৃতি প্রাচীনদের থেকে এবং তাঁরা এও বলেন, ওই ধারাটি কিয়ৎ পরিমাণে ভোগ বিলাসী এপিকিউরিয়ান (Epicureans) এবং সংযতেন্দ্রির স্টইক্ (Stoicks)-দের মধ্যে প্রসৃত ছিল, যেমন ছিল পুটার্ক, এমনকি প্লটিনাস পর্যন্ত। এঁদের ধারণা, দুর্ভাগ্যজনক কোন আকস্মিক দুর্ঘটনায় চতুর্থ শতাব্দীতে এ মতবাদটির অন্তর্ধান ঘটে এবং প্রায় দেড় হাজার বৎসর পর্যন্ত এর কোন হদিশ মেলে না। পনেরোশো বৎসর অতিক্রান্ত হবার পর ১৭৫০ সালে জার্মানিতে বৌমগার্টেনের মতবাদে এ বিজ্ঞানের পুনরুজ্জীবন ঘটে। স্যাচলার বলেন, প্লটিনাসের পরবর্তী পনেরো শতাব্দী অতিক্রান্ত হবার সময়-সীমার মধ্যে সৌন্দর্য এবং শিল্প সম্পর্কে সামান্যতম বৈজ্ঞানিক কৌতূহলও দেখা যায়নি। তাঁর মতে এই দেড় হাজার বৎসর নন্দনতত্ত্বের জগৎ থেকে হারিয়ে গিয়েছিল এবং এই বিজ্ঞানের জ্ঞানভূমিষ্ঠ হর্ম্যনির্মাণে এই কালটির অবদান কিছুই নেই।

বাস্তবক্ষেত্রে এ ধরনের কিছুই ঘটেনি। নন্দনতত্ত্ববিদ্যা, সৌন্দর্যবিজ্ঞান অন্তর্হিত হয়নি, হতে পারেও না। যেহেতু এ ধরনের বিজ্ঞানের কোন সময় অস্তিত্বই ছিল না। গ্রীকরা (সব সময় সর্বত্র ঠিক সকলের ন্যায়) শিল্পকে (সব কিছুর মতো) একমাত্র মঙ্গলের পোষক হলেই উৎকৃষ্ট বিবেচনা করতেন (মঙ্গলকে তাঁরা যে অর্থে বুঝতেন) এবং মঙ্গল- পরিপন্থী হলেই সে-শিল্প তাঁদের নিকট মন্দ বিবেচিত হত। গ্রীকদের নৈতিক মান এত অনুন্নত ছিল যে, তাঁদের নিকট সৌন্দর্য এবং মঙ্গল একাত্ম প্রতীয়মান হত। এই প্রচলিত অকেজো জীবনদৃষ্টির ওপর অষ্টাদশ শতাব্দীতে সৌন্দর্যবিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠা দেওয়া হয়েছিল-যা বিশেষভাবে বৌমগার্টেনের শিল্পতত্ত্ব রূপ পরিগ্রহ করে। গ্রীকদের (যে কোন ব্যক্তি অ্যারিস্টটল এবং তাঁর পরবর্তীদের সম্পর্কে বেনার্ডের প্রশংসনীয় গ্রন্থ এবং প্লেটো সম্পর্কে ওয়াল্টরের গ্রন্থ পড়লে দেখতে পাবেন) নন্দনতত্ত্ববিজ্ঞান বলে কিছু ছিল না।

বিগত প্রায় দেড়শ বৎসরের পূর্বে খ্রীস্টীয় ইউরোপীয় জগতের বিত্তবান শ্রেণীর মধ্যে কয়েকটি নন্দনতত্ত্বের উদ্ভব ঘটে। সে তত্ত্বগুলি জার্মান, ইতালীর, ডাচ, ফরাসি এবং ইংরেজ প্রভৃতি বিভিন্ন জাতির মধ্যে একই সঙ্গে জন্মলাভ করে। শিল্প সম্পর্কীয় মতবাদকে বৈজ্ঞানিক এবং তত্ত্বীয় রূপে সংঘটিত করে যিনি প্রতিষ্ঠা দেন তিনি বৌমাগার্টেন (Baumgarten )।

জার্মান চরিত্রসুলভ বহিরঙ্গীয় নিখুঁত যথার্থ্য, পান্ডিত্যাভিমান এবং সৌষম্য স্থাপনে অতি- প্রয়াসের সাহায্যে তিনি এ অসাধারণ তত্ত্বের পরিকল্পনা করেন এবং ব্যাখ্যা দেন। সারবস্তুর সুস্পষ্ট অভাব সত্ত্বেও তাঁর উদ্ভাবিত শিল্পতত্ত্বের মতো আর কারও তত্ত্ব সংস্কৃতিবান জনতাকে এত বেশি পরিতৃপ্ত করেনি, অথবা কোন রকম সমালোচনা ব্যতীত এত শীঘ্র গৃহীত হয়নি। এই তত্ত্ব উচ্চশ্রেণীর ব্যক্তিদের নিকট এতই গ্রহনযোগ্য বিবেচিত হয়েছিল যে, সম্পূর্ণ কিম্ভুত চরিত্র এবং দৃঢ়-উচ্চরিত বক্তব্যের স্বৈরভাব সত্ত্বেও শিক্ষিত, অশিক্ষিত সকলের দ্বারাই সন্দেহাতীত এবং স্বতঃপ্রতীয়মান সত্যরূপে পুনঃ পুনঃ উচ্চারিত হত।

বইয়ের বাগ্য নির্ভরশীল পাঠকের মগজের ওপর। এবং অনুরূপভাবে বরং অধিকতর সত্যরূপে মতবাদেরও অদৃষ্ট নির্ভর করে যে ভ্রমাত্মক অবস্থার সমাজ বাস করে তার ওপর, যেহেতু ওই সমাজেরই জন্য ওই তত্ত্বগুলির উদ্ভব ঘটে থাকে। যে তত্ত্ব সমাজের কোন অংশের অসত্য অবস্থানকে যুক্তির দ্বারা সমর্থন করে, সে তত্ত্ব যত ভিত্তিহীন এবং স্পষ্টত যত ভ্রান্ত হোক না কেন, সমাজের সে অংশের নিকট তা স্বীকৃতি এমনকি ধর্মবিশ্বাসের অনুরূপ মর্যাদা লাভ করে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, ম্যালথাস-ব্যাখ্যাত সুবিখ্যাত অথচ ভিত্তিহীন তত্ত্বও ছিল এরূপ। এ তত্ত্বের প্রতিপাদ্য, পৃথিবীর জনসংখ্যা বৃদ্ধি জ্যামিতিক প্রগতির হারে ঘঠলেও জীবনোপায়ের বৃদ্ধি ঘটে গাণিতিক প্রগতির হারে এবং এই প্রবণতারই ফল পৃথিবীর ধারণক্ষমতার যোগ্যতমের উদ্বর্তনও ছিল এ ধরনের তত্ত্ব (যা ম্যালথুসীয় তত্ত্ব-উদ্ভূত)। মার্কসীয় তত্ত্বের বক্তব্য-আমাদের চারদিকের পরিবেশে যে বৃহৎ ধনতান্ত্রিক উৎপাদন ক্রমশ ক্ষুদ্র ব্যক্তিগত প্রয়াসজাত উৎপাদনকে ধ্বংস করবে-এটাই নিয়তির অনিবার্য লেখন। এ সমস্ত তত্ত্ব যতই ভিত্তিহীন হোক না কেন এবং যতই মানব সমাজের আবহমান স্বীকৃত ধ্যান ধারণার বিপরীতধর্মী এবং যতই স্পষ্টত নীতিবিগর্হিত হোক না কেন, আত্যন্তিক বিশ্বাসেই সেগুলি গৃহীত এবং সমালোচনা ব্যতিরেকেই প্রচলিত, এমনকি হয়ত শতাব্দীর পর শতাব্দী কাল ধরে ও সেগুলি প্রাচারিত হবে যতদিন না সেই সামাজিক অবস্থার ধ্বংস ঘটবে অথবা তার অবাস্তবতা অতি প্রকট হয়ে উঠবে। এ পর্যায়ে পরে বৌমগার্টেনের সত্য-শিব-সুন্দরের পরমাশ্চর্য ত্রি-তত্ত্ব-যে তত্ত্বটি দু’হাজার বৎসর পূর্বের একটি ক্ষুদ্র, অর্ধবর্বর, দাসনিয়োগকারী জনগোষ্ঠীর জীবনাদর্শ থেকে গৃহীত— যে গোষ্ঠীর মানুষ নগ্ন মানবদেহের চমৎকার অনুকরণ এবং নয়নসুখকর হর্ম্য নির্মাণ করতে পারত। অর্থাৎ ঊনিশ শত বৎসর কালব্যাপী খ্রীষ্টবাণী প্রচারের পরেও ইউরোপীয় জাতিসমূহের কাছে এর চাইতে উচ্চতর কোন আদর্শ নেই। এ সমস্ত অসঙ্গত বস্তুও মানুষের নজর সম্পূর্ণ এড়িয়ে যায়। আধুনিক পণ্ডিতেরা সৌন্দর্যের ওপর দীর্ঘ ধোঁয়াটে প্রবন্ধ গ্রন্থ রচনা করেন-যে সৌন্দর্য তাঁদের মতে-সত্য-শিব-সুন্দর-এই মহৎ ত্রয়ীর অন্তর্গত। দার্শনিক, নন্দতত্ত্ববিদ্, শিল্পী, সাধারণ লোক, ঔপন্যাসিক এবং সংবাদপত্রের সাহিত্য বিভাগের লেখক সম্প্রদায় (feuilletonistes) সকলেই বড় বড় বর্ণমালার সাহায্যে তাঁরা Das schone, das Wahre, das Gute, le Vari, la Bon প্রভৃতি কথাগুলিকে পৌনঃপুনিক উচ্চারণের দ্বারা সংবর্ধিত করেন; এ সমস্ত অতি পবিত্র বা অলঙ্ঘ্য শব্দ উচ্চারণের সময় মনে করেন যে, কোন সুনির্দিষ্ট ও সারবান বস্তুরই তাঁরা আভাস দিচ্ছেন-এমন কিছু যার ওপর তাঁদের মতামত প্রতিষ্ঠা সম্ভব। বস্তুত এ সমস্ত শব্দের শুধু যে কোন সুনির্দিষ্ট অর্থই নেই তা নয়, বরং প্রচলিত শিল্প বিষয়ে সুস্পষ্ট অর্থ আরোপ প্রয়াসে আমাদের সামনে বাধার সৃষ্টি করে। আনন্দ বিধানে সক্ষম যে সমস্ত অনুভূতিকে শিল্প বলে আমরা গুরুত্ব অর্পণ করি, তার সমর্থনের জন্যই শুধু ওই শব্দগুলির প্রয়োজন অনুভূত হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *