৮
[এ নান্দনিক তত্ত্ব কারা গ্রহণ করেছেন? সকল মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় প্ৰকৃত শিল্প। আমাদের শিল্প জনগণের পক্ষে খুবই ব্যয়বহুল, দুর্বোধ্য এবং ক্ষতিকারক। ‘নির্বাচিত’দের শিল্পতত্ত্ব।
মানবিক ক্রিয়া হিসেবে মানুষের উপলব্ধ সর্বোত্তম এবং সর্বোচ্চ অনুভূতিকে অপরের মনে সঞ্চারিত করাই যদি শিল্পের লক্ষ্য বিবেচিত হয়, তবে প্রশ্ন ওঠে মানবসমাজ শুধু নির্দিষ্ট কাল-সীমায় নয়, তার অস্তিত্বের দীর্ঘকাল যাবৎ (যে কাল থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত মানুষ গির্জার মতবাদে বিশ্বাস হারিয়েছে) এই গুরুত্বপূর্ণ মানবিক ক্রিয়া ব্যতীত বাঁচল কী করে? শুধু তাই নয়, শিল্পের এই উচ্চ আদর্শের পরিবর্তে কেবলমাত্র আনন্দের অনুভূতি সঞ্চারকারী তুচ্ছ শিল্পকর্ম নিয়ে মানুষ ব্যাপৃত রইল কেমন করে?
এ প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে প্রচলিত শিল্পের ওপর মানুষ যে অকৃত্রিম সর্বজনীন শিল্পের গুরুত্ব অর্পণ করে, প্রথমেই সে ভুল ভেঙে দেওয়া প্রয়োজন। হাস্যকর সরলতায় ককেশীয় পরিবারভুক্ত মানুষকেই যে শুধুমাত্র আমরা সর্বোত্তম গোষ্ঠীভুক্ত মানুষ বিবেচনা করতে অভ্যস্ত তা নয়, ইংরেজ বা আমেরিকান হলে অ্যাংলো-স্যাক্সন জাতিকে শ্রেষ্ঠ জাতি, জার্মান হলে টিয়োটনিককে, ফরাসি হলে গেলো-লাটিনকে (Gallo-Latin), রুশ হলে শ্লাভ জাতিকে শ্রেষ্ঠতম জাতি বিবেচনা করি। তেমনি আমাদের শিল্প প্রসঙ্গ এলে সে শিল্পই যে প্রকৃত শিল্প সে বিষয়ে আমরা শুধুমাত্র পূর্ণ প্রত্যয়ম্বিত অনুভব করি না, বরং এমন অনুভবও করি যে, শিল্পই সর্বোত্তম এবং একমাত্র খাঁটি শিল্প। বাস্তবিক পক্ষে আমাদের শিল্প শুধু যে একমাত্র শিল্প নিদর্শন নয়-তা নয়, (এক সময়ে বাইবেলকে একমাত্র গ্রন্থ মনে করা হত)- তা এমনকি সমগ্র খ্রীষ্টীয় জগতের শিল্পও নয়, বরং আমরা মানবজাতির যে অংশভুক্ত তারও একটি ক্ষুদ্র সম্প্রদায়ের শিল্প। ইহুদি, গ্রীক অথবা ইজিস্পীয় শিল্প বলে যা অভিহিত হত তা বরং যথার্থ, এমনকি জাতির সমস্ত মানুষ অংশীদার বলে বর্তমান কালের চীনা, জাপানি বা ভারতীয় শিল্পকেও শিল্প বলা চলে। রাশিয়াতেও প্রথম পিটারের সময়কাল পর্যন্ত সকল জাতির গ্রহণীয় শিল্পের অস্তি ত্ব ছিল, এবং ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ শতক পর্যন্ত ইউরোপের অবশিষ্টাংশেও এ পর্যায়ের শিল্প বর্তমান ছিল। কিন্তু ইউরোপীয় সমাজের অভিজাত শ্রেণীর লোকেরা গির্জা- প্রচারিত শিক্ষায় বিশ্বাস হারাবার পর থেকে প্রকৃত খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ না করে কোন প্রকার ধর্মপ্রতয় ছাড়াই ছিলেন বলে সম্পূর্ণাঙ্গ শিল্প অর্থে সমগ্র খ্রীষ্টীয় জাতিসমূহের উচ্চবিত্তের লোকেরা গির্জা অনুমোদিত খ্রীষ্ট ধর্মে বিশ্বাস হারাবার পর তাঁদের শিল্প অবশিষ্ট জনসাধারণের শিল্প থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। তখন থেকে দুই ধরনের শিল্প দেখা দিল- জনসাধারণের শিল্প এবং মার্জিত সম্প্রদায়ের শিল্প। অকৃত্রিম শিল্পের অস্তিত্ব না থাকায় কিছুকালের জন্য হলেও মানবজাতি কি করে বাঁচল এবং যে শিল্প শুধুমাত্র ভোগপ্রবৃত্তির তৃপ্তি সাধন করে তাই বা কি উপায়ে প্রকৃত শিল্পের স্থান গ্রহণ করল-এ প্রশ্নের উত্তর এই যে, সমগ্র মানব সমাজ কিংবা সে সমাজের একটি বৃহৎ অংশের কথাও এখানে অবান্তর, কেবলমাত্র ইউরোপীয় খ্রীষ্টীয় সমাজের উচ্চতর শ্রেণীর মানুষেরাই -তাও অপেক্ষাকৃত স্বল্প সময়ের জন্য (রেনেসাঁসের প্রারম্ভ থেকে বর্তমান কালসীমা পর্যন্ত) শিল্প ব্যতীত জীবনধারণ করেছে।
প্রকৃত শিল্পের অভাবের পরিণতিতে এই শ্রেণীর মানুষের মধ্যে ভ্রান্ত শিল্পের উপভোগজনিত অনিবার্য বিকৃতি দেখা দিল। শিল্পের বিভ্রান্তিজনক সকল দুর্বোধ্য তত্ত্ব, শিল্প-সম্পৰ্কীয় সমস্ত ভ্রান্ত ও স্ব-বিরোধী সিদ্ধান্ত এবং বিশেষভাবে ভ্রান্তপথে প্রবাহিত আমাদের শিল্পের অতিপ্রত্যয়ী পল্বলবদ্ধতা-এ সবরেই উদ্ভব এই দাবি থেকে যে, সাধারণ্যে প্রচলিত এবং প্রশ্নাতীত সত্যরূপে গৃহীত হলেও আমাদের উচ্চ শ্রেণীর শিল্পই একমাত্র এবং সমগ্র শিল্প-যে দাবি শুধু অদ্ভুত নয়, স্পষ্টত মিথ্যা। যদিও এ দৃঢ় অভিমত (যা বিভিন্ন গির্জার ধর্মজ্ঞ মানুষের একই পর্যায়ের দৃঢ় বিশ্বাসের মত যে তাদের অনুসৃত ধর্মই একমাত্র সত্যধর্ম) সম্পূর্ণ খামখেয়ালিপূর্ণ এবং স্পষ্টই অযৌক্তিক। তথাপি আমাদের গোষ্ঠীর সকল মানুষ এর অভ্রান্ততায় বিশ্বাস রেখে ঠান্ডা মাথায় এই দৃঢ় অভিমত বারবার উচ্চারণ করে থাকেন।
আমাদের শিল্পকে শিল্পসমগ্র, অকৃত্রিম এবং একমাত্র শিল্প বলে দাবি করা হলেও মানবজাতির দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ (এশিয়া এবং আফ্রিকার সমস্ত মানুষ) এই অদ্বিতীয় এবং সর্বোচ্চ শিল্পের কিছুমাত্র জ্ঞানলাভ না করে বাঁচে এবং মরে। এমনকি আমাদের খ্রীষ্টীয় সমাজে খুব বেশি হলেও শতকরা একজন মাত্র মানুষ আমাদের দ্বারা ‘শিল্পসমগ্র’ বলে কথিত বস্তুটির সুযোগ গ্রহণ করে থাকে। অবশিষ্ট শতকরা নিরাব্বই জন মানুষ বংশানুক্রমে শ্রমপীড়িত হয়ে এই শিল্পের স্বাদ গ্রহণ না করেই জীবনধারণ ক েএবং মৃত্যুবরণ করে। উপরন্তু সে শিল্পের প্রকৃতি এমনই যে, উপভোগের সুযোগ পেলেও তারা সে শিল্পের মর্ম অনুধাবন করতে সক্ষম হত না। বর্তমান নন্দনতাত্ত্বিক মতবাদ অনুসারে শিল্পকে আমরা ভাবস্বরূপ, ঈশ্বর এবং সৌন্দর্যের সর্বোচ্চ অভিব্যক্তি বলে স্বীকার করি। এ ছাড়া আমরা আরও বিশ্বাস করি যে, বস্তুনির্ভর মঙ্গলের ক্ষেত্রে না হলেও অন্তত আধ্যাত্মিক মঙ্গলে সমস্ত মানুষের সমান অধিকার আছে। এতদ্সত্ত্বেও আমাদের ইউরোপীয় জনসমাজের অন্তত শতকরা নিরানব্বই জন ব্যক্তি বংশানুক্রমে শ্রমপীড়িত হয়ে বাঁচে এবং মরে। যে শিল্প তাদের কোন কাজে আসে না, সে শিল্পসৃষ্টির জন্যও তাদের শ্রমের বজু পরিমাণ অংশ ব্যয়িত হয়। তা সত্ত্বেও আমরা অবিচলিত দৃঢ়তায় দাবি করি, আমাদের সৃষ্ট শিল্পই বাস্তব, সত্য, একমাত্র শিল্প-শিল্পসমগ্র!
আমাদের শিল্প প্রকৃত শিল্প নামধেয় হলে প্রত্যেকেরই সে শিল্প-উদ্ভুত সুবিধার অধিকারী হওয়া উচিত-এ মন্তব্যের উত্তরে বলা হয় যে, প্রত্যেকটি মানুষ বর্তমানে প্রচলিত শিল্পের উপভোগে অসমর্থ হলে সে দোষ শিল্পের ওপর বর্তায় না-সে ত্রুটি ভ্রান্ত সমাজ- ব্যবস্থার-কেউ কেউ এমন কল্পনা করতে পারেন। ভবিষ্যতে এমন সমাজ-ব্যবস্থার উদ্ভব হবে যখন দৈহিক শ্রম অংশত যন্ত্র দ্বারা বাতিল হবে, ন্যায্য বন্টনের সাহায্যে কিছুটা লঘু হবে এবং শিল্পসৃষ্টির জন্য শ্রম পর্যায়ক্রমে গৃহীত হবে : কতক লোক সব সময় মঞ্চের তলায় বলে মঞ্চসজ্জা স্থানান্তিকরণে ব্যস্ত থাকবে, কিংবা যন্ত্র চালনায় নিযুক্ত থাকবে, অথবা পিয়ানো বা ফরাসি সিঙা বাজাবে কিংবা অক্ষর সাজিয়ে বই ছাপবে – ভবিষ্যতে এ সবের হয়ত কোন প্রয়োজনই হবে না। বরং এ ধরনের কর্মরত মানুষকে দিনের পর দিন মাত্র কয়েক ঘন্টা কাজে ব্যাপৃত থাকবে হবে এবং অবকাশ মুহূর্তগুলি তারা শিল্পের আনন্দ উপভোগে কাটাতে পারবে।
আমাদের স্বাতন্ত্র্যবাদী শিল্প-সমর্থকদের বক্তব্য এ রকমঃ জনগণের দাসত্বের ওপরে শিল্পবিকাশ নির্ভরশীল, এটা তারা স্বীকার না করে পারেন না। তারা আরও মনে করেন, দাসত্বের ধারা অব্যাহত থাকলে শিল্প-বিকাশের ধারাও অবিচ্ছিন্ন থাকে। এই প্রত্যয়ের থেকেও তারা মুক্তি পান না যে, শ্রমিকদের তীব্র দুঃখকষ্ট ভোগের মাধ্যমেই লেখক, সংগীতজ্ঞ, নৃত্যকুশলী, অভিনেতা প্রভৃতি বিশেষজ্ঞরা শিল্পের পরোৎকর্ষ আয়ত্ত করেন, কিংবা তাঁদের মার্জিত শিল্পকর্ম উপলব্ধিতে সূক্ষ্মবোধসম্পন্ন জনসমাজ সৃষ্টি হতে পারে। দাসদের ধনতন্ত্রের প্রভাব থেকে মুক্ত করা হলে এ ধরনের মার্জিত শিল্পকর্ম সৃষ্টি করা অসম্ভব হবে।
কিন্তু যা স্বীকার্য নয় তাকেও স্বীকৃতি দিয়ে যদি আমরা বলি যে, এমন উপায়ের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে-যার সাহায্যে শিল্পকে (যা আমাদের নিকট শিল্প বলে বিবেচিত ) সমগ্র মানবসমাজের নিকট পৌঁছিয়ে দেওয়া সম্ভব, তাহলেও আর একটি বিষয় বিবেচ্য হয়ে ওঠে। তা হল, ফ্যাশনবিলাসী শিল্প কখনও শিল্পসমগ্র বিবেচতি হতে পারে না, যেহেতু সে শিল্প জনসাধারণের নিকট সম্পূর্ণ দুর্বোধ্য। পূর্বে মানুষ ল্যাটিনে কবিতা রচনা করতেন। কিন্তু এখনকার মানুষের শিল্পরচনা জনসাধারণের নিকট এত দুর্বোধ্য যে, মনে হয় সেগুলি যেন সংস্কৃত লিখিত হয়েছে। এর উত্তরে সাধারণত বলা হয়ে থাকে, জনসাধারণ বর্তমান শিল্পের মর্মোদ্ধারে অসমর্থ হলেও তার দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয় যে, তারা অনগ্রসর। শিল্পসৃষ্টির প্রত্যেক নবতর পর্যায়ে এমনটি ঘটে আসছে। প্রথম পর্যায়ে সে শিল্পকর্ম কিছুই উপলব্ধ হয়নি, পরবর্তীকালে অবশ্য মানুষ সে শিল্প- উপলব্ধিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে।
আমাদের বর্তমান শিল্প বিষয়েও একই অবস্থান পুনরাবর্তন ঘটবে। আমাদের শিল্প সমর্থকদের অভিমত, জনসাধারণের প্রত্যেকে উচ্চশ্রেণীর শিল্পস্রষ্টা ব্যক্তির মতো সুশিক্ষিত হলেই তবে তারা বর্তমান শিল্পের মর্মগ্রহণে সমর্থ হবে। কিন্তু এই দাবি স্পষ্টতই পূর্ববর্তী অভিমত থেকে অনেক বেশি ভ্রান্ত। কারণ, একথা আমরা জানি যে, উচ্চশ্রেণীর লোকদের অধিকাংশ শিল্পসৃষ্টি-যেমন, গাথা-কবিতা, কবিতা, নাটক, গীতি- গাথা, রাখালিয়া গীতি, চিত্র প্রভৃতি তাদের সৃষ্টিকালেই উচ্চশ্রেণীর লোকদের আনন্দ দিত। পরবর্তীকালে মানবজাতির বৃহত্তর অংশ কখনও সেগুলির অর্থ উপলব্ধিতে সক্ষম হয়নি বা সেগুলির কোন মূল্য দেয়নি। এ কারণে সেগুলি সৃষ্টির প্রথম যুগের মতো পরবর্তীকালেও সমকালীন ধনী ব্যক্তিদের নিছক অবসর-বিনোদনের সামগ্রী হয়ে থেকেছে। সেগুলির কোন গুরুত্ব যদি থেকেও তাকে তা ছিল শুধু ধনী ব্যক্তিদেরই নিকট। জনসাধারণ কোন সময় আমাদের শিল্পের স্বরূপ অবশ্যই উপলব্ধি করবে-এ দাবির সমর্থনে প্রমাণ হিসেবে একথাও অনেক সময় জোর দিয়ে বলা হয় যে, তথাকথিত ক্লাসিকপন্থী কবিতা, সংগীত অথবা চিত্রশিল্প প্রভৃতি কতকগুলি সৃষ্টিকর্ম পূর্বে জনসাধারণকে তৃপ্তি দিতে অসমর্থ হলেও বহুলভাবে সেগুলিকে তাদের নিকট উপস্থিত করায় বর্তমানে ওই একই জাতীয় শিল্পকর্ম ওই পর্যায়ের জনগণের মনে তৃপ্তি দিতে শুরু করেছে। এর থেকে এ কথাই প্রমাণিত হয় যে-জনতা, বিশেষত শহুরে অর্ধচরিত্রভ্রষ্ট জনতা অতি সহজেই (সে জনতার রুচি বিকৃত হয়ে যাওয়ায়) যে কোন পর্যায়ের শিল্পকমে উপভোগে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারে। উপরন্তু এ শিল্প এই জনগণের সৃষ্ট নয়, এমনকি তাদের দ্বারা নির্বাচিতও নয়, বরং প্রকাশ্য স্থানে এ সব শিল্পকর্মের নিদর্শন স্থাপন করে জনগণের মনের ওপর তা জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয়। অধিকাংশ শ্রমিকশ্রেণীর নিকট শুধুমাত্র উচ্চমূল্যের জন্যই আমাদের শিল্প যে দুরধিগম্য তা নয়, প্রকৃতির দিক থেকেও সে শিল্প অদ্ভুত। এই শিল্পের সাহায্যে এমন সমস্ত অনুভূতি সঞ্চর করে দেওয়া হয়-যা শ্রমনির্ভর জীবন পরিবেশ থেকে বহু দূরবর্তী-যে শ্রমসাধ্য জীবন বৃহত্তর মানবসমাজের পক্ষে খুবই সহজ ও স্বাভাবিক। বিত্তবান সম্প্রদায়ের নিকট যা উপভোগ্য অনুভূত হয়, একজন শ্রমিকের পক্ষে সে আনন্দ অনধিগম্য। সে উপভোগ্য বস্তু তার মনে হয়ত কোন অনুভূতিই সঞ্চার করে না, অথবা একজন অলস ও ভোগতৃপ্ত মানুষের মনে তা যে অনুভূীত বর্তমান শিল্পের মুখ্য বিষয়বস্তু বলে স্বীকৃত -যেমন, আত্মাভিমান, দেশাত্মবোধ, গুপ্ত প্রণয়-প্রবণতা-তা একজন শ্রমিকের তাদের অবসর সময়ে সমকালীন শিল্পের অন্তর্গত শ্রেষ্ঠ অবদানগুলিকে যদি দেখতে পড়তে বা শুনতে কোন সুযোগও দেওয়া হয় (যে সুযোগ শিল্প-প্রদর্শনী, জনপ্রিয়, ঐক্যতান এবং গ্রন্থাগারের সাহায্যে কিয়ৎ পরিমাণে শহরগুলিতে দেওয়া হয়) তবে একজন শ্রমিক ( যে প্রকৃত শ্রমিক পদবাচ্য)-আলস্যে আক্রান্ত হয়ে যে এখনও বিকৃত মানসিকতা লাভ করেনি) আমাদের সুকুমার শিল্প থেকে কিছু অর্জনে সমর্থ হবে না। যদি সে শিল্প বিষয়ে কিছুটা ধারণা করতেও পারে, তবে সে জ্ঞান তার চিত্তের সমুন্নতি বিধান না করে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তার বিকৃতি ঘটাবে। সুতরাং চিন্তাশীল এবং আন্তরিক মানুষের কোন সন্দেহই থাকতে পারে না যে, আমাদের উচ্চশ্রেণীর মানুষের শিল্প কখনও সমগ্র জনসমাজের উপভোগ্য শিল্পের স্থান গ্রহণ করতে পারে না। শিল্প যদি একটা গুরুত্বপূর্ণ বিণয় হয়, সকল মানুষের জন্য আবশ্যক আধ্যাত্মিক আশীর্বাদ স্বরূপ হয় (যেমন, শিল্পভক্তেরা বলতে ভালোবাসেন-ধর্মের মত), তবে সেই শিল্প প্রত্যেকের অধিগম্য হওয়া উচিত। আমাদের যুগের শিল্পে সর্বসাধারণের প্রবেশাধিকার না থাকায় খুব অত্যাবশ্যক বস্তু বলে দেখানো হলেও বস্তুতপক্ষে সে শিল্পের ওই দাবি সত্য নয়। কিংবা এও বলা চলে, শিল্প নামে আমাদের অভিহিত বস্তু যথার্থ শিল্পই নয়।
এই হেঁয়ালি অনিবার্য। সুতরাং চতুর এবং দুর্নীতিপরায়ণ লোকেরা শিল্পের একটি অংশকে অস্বীকার করে শিল্পকে এড়িয়ে চলেন। সেটি হল, সাধারণ লোকের শিল্পের ওপর যে দাবি আছে, তার অস্বীকৃতি। এরা খুব সোজাসুজি উচ্চকণ্ঠে বলেন যে, (যে বক্তব্য বিষয়টির কেন্দ্রবিন্দুস্পর্শী) তাদের বিবেচনায় সুন্দরতম শিল্প, অর্থাৎ সর্বাপেক্ষা আনন্দদায়ক শিল্পের অংশীদার এবং ব্যবহারকারীরা হবেন একমাত্র Sehone Geister অর্থাৎ সুকুমার চিত্তবৃত্তি সম্পন্ন ব্যক্তি-রোমান্টিকেরা যে অভিধায় তাঁদের অভিহিত করতে অর্থাৎ নির্বাচিত শ্রেষ্ঠগণ (The Elect) কিংবা নীটশের অনুবর্তীরা যাদের বলতেন Uebermenschen (civgvbe)। শিল্পোদ্ভূত এই আনন্দ উপভোগে অসমর্থ অবশিষ্ট বর্বরশ্রেণীর মানুষ অবশ্যই উচ্চবর্গীয়দের মহৎ আনন্দে উপভোগের কাজে নিয়োজিত থাকবে। এই অভিমত পোষণকারী ব্যক্তিরা অন্তত কোন ভাণ করেন না, কিংবা অসঙ্গতিপূর্ণ বস্তু সমন্বয়ের কোন চেষ্টা করেন না। বরং স্পষ্টভাবে এটা স্বীকার করেন যে, আমাদের শিল্প কেবলমাত্র সমাজের উচ্চবর্গীয়দের শিল্প। বাস্তবক্ষেত্রে আমাদের সমাজে শিল্পচর্চাকারীদের নিকট শিল্পের স্বরূপ পূর্বের মতো এখনও এরূপই প্রতীয়মান।