হোয়াট ইজ আর্ট – ১৯

১৯

[ভাবীকালের শিল্প নির্বাচিত সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি হবে না,-হবে পরোৎকর্ষ এবং ঐক্যলাভের উপায়।

লোকে ভাবীকালের শিল্পের কথা বলে। এই শিল্প বলতে তারা বোঝাতে চায় বিশেষ সুমার্জিত এক ধরনের নতুন শিল্পকে। বর্তমানে উচ্চতম শিল্প -বিবেচিত শ্রেণীবিশেষের অতি স্বাতন্ত্র্যধর্মী শিল্প থেকে সেই ভাবী শিল্প বিকাশ লাভ করবে বলে তারা কল্পনা করে। এ জাতীয় নতুন কোন ভাবী শিল্প দেখা যাবে না বা দেখা যেতে পারে না। খ্রীষ্টীয় জগতের আমাদের অভিজাত শ্রেণীর স্বতন্ত্র শিল্প এবটি কানা গলিতে প্রবেশ করেছে। যে দিকে এর গতি তা কোথাও পৌঁছাবে না। শিল্পের পক্ষে যা অপরিহার্য (অর্থাৎ ধর্মীয় উপলব্ধিজাত নির্দেশনা) তার থেকে স্খলিত হওয়ায় এই শিল্প উত্তরোত্তর অধিকতর পরিমাণে স্বাতন্ত্র্যধর্মী হয়ে পড়েছে এবং কাজে কাজেই ক্রমেই অধিকতর বিকৃতি লাভ করেছে ও অবশেষে চরম নিষ্ফলতায় পর্যবসিত হয়েছে। ভাবী শিল্প-যা সত্য সত্যই আসন্ন-তা বর্তমান শিল্পের বিকশিত রূপমাত্র হবে না, বরং-যে সব বস্তু আমাদের বর্তমান অভিজাত শ্রেণীর শিল্প-নিয়ন্ত্রিত, তাদের সঙ্গে এর কোন সাদৃশ্য থাকবে না,-সম্পূর্ণ পৃথক এবং নতুন ভিত্তির ওপর সে শিল্পের আবির্ভাব ঘটবে।

ভাবীকালের শিল্প অর্থাৎ মানবজাতির মধ্যে বিক্ষিপ্ত সমগ্র শিল্পরাজ্য থেকে বিশেষ যে অংশ নির্বাচিত হবে, তা এ-কালের মতো একমাত্র ধনিক শ্রেণীর লোকদের অধিগম্য অনুভূতি-সঞ্চারক হবে না, বরং তা আমাদের যুগের সর্বোচ্চ ধর্মীয় উপলব্ধি- বিধৃত অনুভূতি-সঞ্চারকই হবে। একমাত্র মানবভ্রাতৃত্বের অনুভূতি-সঞ্চারক কিংবা সৰ্বমানব মিলন-বিধায়ক সর্বজনীন অনুভূতি-সঞ্চারক, সৃষ্টিকর্মই শিল্প বলে বিবেচিত হবে। শুধুমাত্র এ পর্যায়ের শিল্পই নির্বাচিত, সমর্থিত, অনুমোদিত এবং সর্বত্র পরিব্যাপ্ত হবে। তবে যে শিল্প অপ্রচলিত, জীর্ণ, ধর্মীয় নির্দেশনা-উৎসারিত অনুভূতি সঞ্চার করে, যে শিল্প যাজকীয়, স্বদেশপ্রেমাত্মক, কামোদ্রেককারী, যা কুসংস্কারাচ্ছন্ন ভীতি,-অহংকার, অভিমান, অথবা জাতীয় বীরদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসামূলক-শিল্পীগোষ্ঠীর স্বদেশীয়দের প্রতি যে শিল্প এককেন্দ্রিক অনুরাগ উদ্দীপ্ত করে অথবা ভোগবিলাসিতা উত্তেজক-তা অসৎ ও ক্ষতিকর শিল্প বিবেচিত হবে এবং জনসাধারণ কর্তৃক তা নিন্দিত ও ধিকৃত হবে। কেবলমাত্র মানুষের একাংশের অধিগম্য অনুভূতি-সঞ্চারক অবশিষ্ট সমস্ত শিল্প গুরুত্বহীন বিবেচিত হবে এবং তাদের স্থান হবে নিন্দা-প্রশংসার বহির্ভূত অঙ্গনে। এবং নির্বিশেষ শিল্পের মূল্যায়নও বর্তমানের মতো স্বতন্ত্র ধনিক শ্রেণীর ওপর বর্তাবে না, তার দায়িত্বভার পড়বে সামগ্রিক জনগোষ্ঠীর ওপর। সুতরাং কোন সৃষ্টিকর্মকে সৎ বলে, বিবেচিত, সমর্থিত এবং সম্প্রসারিত হতে হলে একই ধরনের এবং প্রায়শ অস্বাভাবিক জীবনচর্যায় অভ্যস্ত কতিপয় মানুষের দাবি মিটালেই চলবে না, স্বাভাবিক শ্রমনির্ভর জীবনযাত্রার অভ্যস্ত বৃহৎ জনসমষ্টির দাবিও মিটাতে হবে।

শিল্পকর্মের স্রষ্টা শিল্পও বর্তমানের মতো জাতির ক্ষুদ্র অংশ থেকে নির্বাচিত কতিপয় মানুষ মাত্র হবেন না, বরং তাঁরা হবেন শিল্পক্রিয়ার প্রতি অনুরক্ত সমগ্র জনসমাজের মধ্যে প্রতিভাবান এবং শিল্প-সৃষ্টিতে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণে সক্ষম ব্যক্তি। শৈল্পিক ক্রিয়া তখনই হবে সকল মানুষের সহজ অধিগম্য। সেই ভাবী শিল্পে সামগ্রিক জনসমষ্টির সহজ অধিগম্যতার কারণ : প্রথমত, যে জটিল আঙ্গিক বর্তমানের শিল্পসৃষ্টিকে বিকৃত করে এবং যে বৃহৎ প্রয়াস এবং সময় ব্যয়ের প্রয়োজন হয়, ভাবীকালের শিল্পে শুধু যে তার প্রয়োজন থাকবে না তা নয়, পরন্তু স্বচ্ছতা, সারল্য এবং সংহতিই হবে সে শিল্পের দাবি। কোন যান্ত্রিক পদ্ধতি-প্রয়োগের দ্বারা সে অবস্থার সৃষ্টি হবে না, বরং রুচির অনুশীলনের দ্বারাই তা সম্ভব হবে। দ্বিতীয়ত, শৈল্পিক ক্রিয়া জনগণের সকল ব্যক্তির নিকট অধিগম্য হবে, যেহেতু বর্তমান ব্যবসায়িক বিদ্যালয়গুলিতে কেবলমাত্র কয়েক ব্যক্তির নিকট অধিগম্য হবে, যেহেতু বর্তমান ব্যবসায়িক বিদ্যালয়গুলিতে কেবলমাত্র কয়েক ব্যক্তির প্রবেশাধিকার লাভের পরিবর্তে সকলেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়ার সঙ্গে সঙ্গেই সংগীত এবং চারুকলা (গান এবং চিত্রাঙ্কন) শিখবে। সে শিক্ষা এমনভাবে সম্পন্ন হবে যাতে প্রত্যেকটি মানুষ চিত্রাঙ্কন এবং সংগীতে প্রথম পাঠ নিয়ে নিজের সক্ষমতা সম্পর্কে সচেতন হবার পর কোন একটি অপর শিল্পের প্রতি আকর্ষন অনুভব করবে এবং সে শিল্পে নিজেকে নিখুঁত শিল্পী হিসেবে গড়ে তুলতে সক্ষম হবে।

লোকে এরূপ ভাবে যে, বিশেষ প্রকরণের শিল্প বিদ্যালয় না থাকলে শিল্পের কলাকৌশলের অবনতি ঘটবে। কলাকৌশল বলতে যদি আমরা বর্তমানে উৎকৃষ্ট বিবেচিত শিল্পের জটিলতাকে বুঝি, তবে নিঃসন্দেহে তার অবনতি হবে। কিন্তু কলাকৌশলের দ্বারা যদি শিল্পকর্মে স্বচ্ছতা, সৌন্দর্য, সরলতা এবং সংহতি-বোধের উপলব্ধি ঘটে, তবে জাতীয় বিদ্যালয়গুলিতে অঙ্কন এবং সংগীতের উপাদানগুলি সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়া না হলেও কলাকৌশলর অবনতি তো ঘটতই না, বরং সকল কৃষক-সৃষ্ট সমুদয় শিল্পে যেমন দেখা যায়, তেমনি সে কলাকৌশল আরও শতগুণে বেশি উৎকৃষ্ট হত। শিল্পের যে অভ্যুন্নতি ঘটবে তার কারণ, জনসাধারণের মধ্যে বর্তমানে প্রচ্ছন্ন প্রতিভাবান শিল্পীরাই ভবিষ্যতে শিল্পস্রষ্টা হবেন এবং উৎকর্ষের এমন আদর্শ উপস্থিত করবেন-যা (যেমন সব সময় হয়ে থাকে) তাদের পরবর্তীয়দের জন্য কলাকৌশল শিক্ষার সর্বাপেক্ষা উত্তম বিদ্যালয় বলে বিবেচিত হবে। যেহেতু এখনও প্রত্যেক অকৃত্রিম শিল্পী মহৎ শিল্পীদের দৃষ্টান্ত অনুসরণে জীবন থেকেই তার কলাকৌশ শিক্ষা করেন,-বিদ্যালয়ে নয়। তারপর সমগ্র জাতির সর্বোৎকৃষ্ট শিল্পীদের দ্বারা শিল্পীসৃষ্টি হবে, এবং সে ধরনের আরও অনেক অনেক দৃষ্টান্ত মিলবে এবং সেগুলি আরও অধিগম্য হবে। তখন বিদ্যায়তনিক শিক্ষার অংশগ্রহণে ভবিষ্যৎ শিল্পী অপারগ হলেও সমাজব্যাপ্ত সৎ-শিল্পের অসংখ্য উদাহরণ থেকে তিনি যে প্রশিক্ষণ পাবেন, তার দ্বারা তাঁর শতগুণ ক্ষতিপূরণ হয়ে যাবে।

এই হবে বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ শিল্পের মধ্যে একটি পার্থক্য। অপর পার্থক্য হবে : যে সমস্ত ব্যবসাবৃত্তিধারী শিল্পী কাজের বিনিময় অর্থ পায় এবং শিল্পকর্ম ব্যতীত অপর কিছুতে ব্যাপৃত থাকে না, তাদের দ্বারা ভবিষ্যৎ শিল্পসৃষ্টি হবে না। শিল্পকর্মের প্রয়োজন উপলব্ধি করে-এমন সমস্ত ব্যক্তির দ্বারাই ভাবীকালের শিল্পসৃষ্টি হবে। যখনই তাঁরা এরূপ সৃজনক্রিয়ার তাগিদ অনুভব করবেন, একমাত্র তখনই শিল্পকর্মে ব্যাপৃত হবেন। আমাদের সমাজের মানুষের একটা ধারণা আছে, সুনির্দিষ্ট জীবিকার অধিকারী হলেই শিল্পীর সৃষ্টিকর্ম হবে উৎকৃষ্টতর এবং তার সৃষ্টির পরিমাণও হবে বেশি। এই অভিমত পুনরায় স্পষ্ট প্রমাণিত করবে-এখনও যদি এমন প্রমাণের প্রয়োজন থাকে যে-আমাদের মধ্যে শিল্প বলে যা বিবেচিত, প্রকৃতপক্ষে তা শিল্পই নয়, শিল্পের নকল মাত্র। বুটজুতা বা পাউরুটি তৈরির জন্য শ্রমের বিভাজন খুবই সুবিধাজনক-এ কথা খুবই খাঁটি। বুট তৈরির মিস্ত্রী অথবা পাউরুটি প্রস্তুতকারক নিজের খাদ্য প্রস্তুত কিংবা জ্বালানি সংগ্ৰহ না করে যদি শুধু নিজের কর্ম নিয়েই ব্যাপৃত থাকত, তবে তারা আরও বেশি বুটজুতা এবং পাউরুটি প্রস্তুত করতে সমর্থ হত। কিন্তু এ কথা মনে রাখা দরকার, শিল্প কারুশিল্প নয়, শিল্পী-উপলব্ধ অনুভূতির সঞ্চারণই শিল্প। সর্বতোভাবে স্বাভাবিক এবং মনুষ্য- জনোচিত জীবনযাপন করলে একমাত্র তখনই কোন ব্যক্তির মনে সুস্থ অনুভূতি জন্মাতে পারে। সুতরাং জীবনোপায়ের নিরাপত্তার অবস্থা শিল্পীর প্রকৃত উৎপাদনশীলতার দিক থেকে হানিকর, যেহেতু তা শিল্পীকে সর্বমানবের স্বাভাবিক অবস্থা অর্থাৎ নিজের এবং অপরের জীবন রক্ষার জন্য প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রাম থেকে বিচ্যুত করে। কাজেই এরূপ নিরাপত্তাই মানুষের পক্ষে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ এবং সহজ অনুভূতিগুলি উপলব্ধির সুযোগ এবং সম্ভাবনা থেকে শিল্পীকে বঞ্চিত করে। আমাদের সমাজে শিল্পীরা সাধারণত যে সম্পূর্ণ নিরাপত্তা এবং বিলাসের মধ্যে জীবন যাপন করেন-শিল্পীর সৃষ্টিশীলতার দিক থেকে আর কোন অবস্থা এত বেশি ক্ষতিকারক নয়।

ভাবীকালের শিল্পী কোন শ্রমসাধ্য জীবিকার দ্বারা সাধারণ মানুষের মতই জীবন যাপন করবেন। যে উচ্চতম আত্মিক শক্তির বিকাশ তার মধ্যে ঘটবে, তার ফল তিনি বৃহত্তম সংখ্যক মানুষের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাইবেন। যেহেতু তাঁর উপলব্ধ অনুভূতি এভাবে অপরের মনে সঞ্চারণের মাধ্যমে তিনি আনন্দিত ও পুরস্কৃত বোধ করবেন। রচনাকে বহুব্যাপ্ত করে দেওয়ার মধ্যেই ভবিষ্যৎ শিল্পীর মুখ্য আনন্দ নিহিত হওয়ায় কোন অর্থের বিনিময়ে মানুষকে সে আনন্দ পরিবেশন করা যায়, তিনি তা উপলব্ধি করতে অক্ষম হবেন।

শিল্প-ব্যবসায়ীদের যে পর্যন্ত না শিল্পমন্দির থেকে বহিষ্কৃত করা হয়, সে যাবৎ শিল্পমন্দির মন্দির বলে বিবেচিত হবে না। তবে ভাবীকালের শিল্প এ পর্যায়ের ব্যক্তিদের বহিষ্কৃত করবেই।

সুতরাং আমার কল্পিত ভাবীকালের শিল্পের বিষয়বস্তু বর্তমান শিল্পের বিষয়বস্তু থেকে সম্পূর্ণ পৃথক হবে। তা হবে ব্যতিক্রমী অনুভূতির অভিব্যক্তিতে নয় : কথা, অহংকার, বদমেজাজ, অতিভোগজনিত বিতৃষ্ণা, সকল প্রকার সম্ভাব্য ইন্দ্রিয়পরায়ণতা প্রভৃতি-যা কেবলমাত্র মানুষের স্বাভাবিক শ্রমজীবন থেকে সবলে আত্মবিচ্ছিন্ন ব্যক্তিদের কাছেই একমাত্র অধিগম্য এবং কৌতূহলোদ্দীপক; এবং তা এ যুগের ধর্মীয় অনুভূতির উপলব্ধিতেই রূপলাভ করবে-যা হবে অব্যক্তিক্রমে সর্বমানবের অধিগম্য এবং সকল মানুষের পক্ষে স্বাভাবিক জীবন যাপনে অভ্যস্ত ব্যক্তির অভিজ্ঞতালব্ধ।

যে সমস্ত অনুভূতির ওপর ভিত্তি করে ভাবীকালের শিল্পের বিষয়বস্তু গঠিত হবে, আমাদের গোষ্ঠীর মানুষ তা জানে না এবং জানতে পারে না অথবা বুঝতেও পারবে না। যে স্বতন্ত্র শিল্পের সূক্ষ্ম খুঁটিনাটি নিয়ে তারা বর্তমানে ব্যাপৃত, তার তুলনায় এরূপ বিষয়বস্তু তাদের নিকট অত্যন্ত দীন মনে হবে। খ্রীষ্টীয় পারস্পরিক মানবপ্রীতি সম্পর্কে নতুন করে বলবার কী আছে? তাদের বিবেচনায় সর্বসাধারণের পক্ষে যে অনুভূতিগুলি সাধারণ, তা নিতান্তই অকিঞ্চিকর এবং একঘেয়ে। তবু আমাদের যুগের যথার্থ সজীব অনুভূতি হতে পারে একমাত্র বাধাহীন সকলের অধিগম্য ধর্মীয় খ্রীষ্টীয় অনুভূতি। আমাদের যুগের ধর্মীয় উপলব্ধি -সঞ্জাত খ্ৰীষ্টীয় অনুভূতি সীমাতিক্রমী, অভিনব ও বিচিত্র -তবে কিছু লোক যেমন অনুমান করে, সে ধরনের নয়। সেই অনুভূতিগুলি খ্রীষ্ট এবং খ্রীষ্টের জীবনবৃত্তান্তমূলক কাহিনি বর্ণনা দ্বারা উদ্রিক্তত করা যায় বলেই নয়, অথবা মানব-মিলন, ভ্রাতৃত্ববোধ, সাম্য এবং প্রেম এই খ্রীষ্টীয় সত্যগুলি সতুন আকারে বারংবার উচ্চারণ দ্বারা যে লাভ করা যায় তাও নয়,-পরন্তু খ্রীষ্টীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করা মাত্রই প্রাচীনতম, সাধারণতম এবং সব চাইতে গতানুগতিক জীবনব্যাপার- সমূহ নবতম, অপ্রত্যাশিত এবং তীক্ষ্ণ অনুভূতিগুলিকে জাগ্রত করে-এটাই এর কারণ। বিবাহিত দম্পতির সম্পর্ক, সন্তানদের সঙ্গে পিতামাতার সম্পর্ক, পিতামাতার সঙ্গে সন্ত নিদের সম্পর্ক, স্বদেশবাসী এবং বিদেশীয়দের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক, কোন আক্রমণ, প্রতিরক্ষা, সম্পত্তি, ভূমি অথবা পশুদের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের চাইতে প্রাচীনতম বস্তু আর কী হতে পারে? কিন্তু যে মুহূর্তে মানুষ এ সমস্তকে খ্রীষ্টীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার করে-তৎক্ষণাৎ অন্তহীন, বিচিত্র, সজীব, এবং তীব্র আবেগের উদ্ভব হয়।

একই প্রকারে সাধারণ জীবনের সরলতম, সর্বজনীন, উন্মুক্ত অনুভূতির সঙ্গে সম্পর্কিত ভাবী শিল্পের বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রে সংকীর্ণতাপ্রাপ্ত না হয়ে বরং প্রসারিত হবে। আমাদের পুরাতন শিল্পে কোন ব্যতিক্রমী অবস্থার মানুষের স্বাভাবিক অনুভূতির অভিব্যক্তি মাত্রই শিল্প-সঞ্চারিত হবার যোগ্য বিবেচিত হত। তবে সে যোগ্যতার শর্ত ছিল এই যে, সে সমস্ত অনুভূতি অধিকাংশ লোকের দুর্বোধ্য খুবই সূক্ষ্ম উপায়ে সঞ্চারিত হওয়া চাই। লোকশিল্পের বিস্তৃত ভূভাগ, শিশুদের জন্য শিল্প-কৌতূক, প্রবাদবাক্য, ধাঁধা, গান, নৃত্য, শিশুদের খেলাধূলো, অনুকৃতি প্রভৃতি শিল্পরাজ্যের উপযোগী বিবেচিত হত না। ভাবীকালের শিল্পী এ কথা উপলব্ধি করবেন যে,-রূপকথা রচনা, মর্মস্পর্শী ছোট গান, ঘুম-পাড়ানি ছড়া, আনন্দাদায়ক ধাঁধা, আমোদজনক কৌতুক এবং নক্সা অঙ্কন-যা কয়েক প্রজন্মের বংশধরকে এবং বহু লক্ষ শিশু এবং বয়স্কদের আনন্দ দানে সক্ষম-তা চিত্তবান শ্রেণীর কিছু লোকের স্বল্পকালীন অবসর বিনোদন ও পরে বিস্মৃতির গর্ভে বিলীনতাপ্রাপ্ত একটি উপন্যাস, বা সিম্ফনি রচনা অথবা চিত্রাঙ্কন অপেক্ষা তুলনাহীনভাবে বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং অধিকতর ফলপ্রসূ। সর্বজন-বেদ্য সহজ অনুভূতিপূর্ণ বিপুলপ্রসার এই শিল্পরাজ্যে এ পর্যন্ত বিশেষ বিচরণ করা হয়নি।

সুতরাং বিষয়বস্তুর দিক থেকে ভাবীকালের শিল্প দীনতার না হয়ে সীমাহীন ঐশ্বর্যবান হবে। ভবিষ্যৎ শিল্পরূপও বর্তমান শিল্পাঙ্গিক থেকে নিকৃষ্ট হবে না, বরং হবে সীমাতিরিক্ত উচ্চতর পর্যায়ের। সূক্ষ্ম এবং জটিল ভঙ্গির দিক থেকে শ্রেষ্ঠতর নয়, বরং শিল্পী নিজে যে অনুভূতির উপলব্ধিকে অপরের নিকট পৌঁছিয়ে দিতে চান, -তা বাহুল্যবর্জিত, সংহত, সহজ এবং স্বচ্ছভাবে সঞ্চারের ক্ষমতায় শ্রেষ্ঠতর।

একবার একজন বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানীর সঙ্গে আলাপের কথা আমার স্মরণে আছে। তিনি ছায়াপথের তারকাদের বর্ণালী বিশ্লেষন করে জনসাধারণের উদ্দেশ্যে কতকগুলি বক্তৃতা দিয়েছিলেন। তাঁর জ্ঞান এবং চমৎকার বক্তৃতাশক্তির সাহায্যে শুধুমাত্র পৃথিবীর গঠন ও গতি সম্পর্কে ভাষন দিলে তা খুব উত্তম হত-তাঁকে এ কথা আমি বলেছিলাম। এর কারণ, ছায়াপথের তারকার বর্ণালী বিশ্লেষণমূলক তাঁর বক্তৃতায় এমন অনেক ব্যক্তি, বিশেষত অনেক স্ত্রীলোক নিশ্চয়ই উপস্থিত ছিলেন-যারা রাত্রি দিনের এবং গ্রীষ্ম শীতের অনুবর্তন করে কেন-এই বিষয়ে স্পষ্ট জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন না। উত্তর দেবার সময় বিজ্ঞ জ্যোতির্বিজ্ঞানী ঈষৎ হেসে বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ, এটা উত্তম কার্য হলেও খুবই কষ্টসাধ্য হত। ছায়াপথের বর্ণালী বিশ্লেষণ সম্পর্কে বক্তৃতা দেওয়া এর চাইতে অনেক সোজা।’

শিল্প বিষয়েও একই কথা প্রযোজ্য। অনাবশ্যক খুঁটিনাটিবর্জিত গল্পকারের অনুভূতি সঞ্চারে সক্ষম একটি ছোটগল্প, অথবা পেন্সিলে আঁকা কোন নক্সা যা দর্শকচিত্তকে স্পর্শ ও আমোদিত করে, অথবা কোন বাদ্যযন্ত্রের সাহায্য ব্যতিরেকে ভাবব্যঞ্জক ও শ্রোতার স্মরণযোগ্য স্বচ্ছ সহজ সুরের চারিটি মাত্রা রচনা অপেক্ষা ক্লিওপেট্টার যুগের বর্ণনা দিয়ে সমিল একটি কবিতা লেখা, নীরোর রোম জ্বালানোর দৃশ্য-বর্ণনাত্মক একটি চিত্রাঙ্কন অথবা ব্রাহ্মস্ (Brahms) বা রিচার্ড স্ট্রাউস (Richard Strauss)-এর সিম্ফনির মতো একটি সিম্ফনি রচনা কিংবা বাগনারের অনুসরণে একটি অপেরা রচনা-অনেক সহজতর।

এ যুগের শিল্পীরা বলেন, ‘আমাদের সংস্কৃতি নিয়ে আদিম অবস্থায় প্রত্যাবর্তন আমাদের পক্ষে অসম্ভব। জোসেফের অথবা অডিসি-র (Odyssey) মতো গল্প লেখা এখন আমাদের পক্ষে অসম্ভব। মিলো-র (Milo) ভেনাসের মর্মর মূর্তির মতো মূর্তি নির্মাণ অথবা লোক-সংগীতের মতো সংগীত রচনাও অসম্ভব।’

বস্তুতপক্ষে আমাদের সমাজের ও কালের শিল্পীর পক্ষে এরূপ শিল্পসৃষ্টি অসম্ভব। কিন্তু বিষয়বস্তুহীনতাকে গোপন করে কলাকৌশলগত উন্নতি-প্রয়াসের সমস্ত বিকৃতি থেকে মুক্ত হওয়ার কারণে ভাবীকালের শিল্পীর পক্ষে এরূপ সৃষ্টি অসম্ভব হবে না। ব্যবসায়ী শিল্পীর মতো শিল্পকর্মের জন্য কোন অর্থ গ্রহণ না করে শুধুমাত্র দুর্নিবার অভ্যন্তরীণ আবেগ-তাড়িত হয়েই তিনি শিল্প সৃষ্টি করবেন।

সুতরাং বিষয়বস্তুগত এবং রূপগত বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে ভাবীকালের শিল্প বর্তমান শিল্প নামধোর বস্তু থেকে সম্পূর্ণ পৃথক হবে। ভাবী শিল্পের একমাত্র বিষয়বস্তু হবে এমন অনুভূতির সৃষ্টি-যা মানুষকে পরস্পরের সঙ্গে মিলিত করবে, অথবা মানুষকে এখনই মিলিত করেছে-এমন অনুভূতি। সে শিল্পের রূপগত বৈশিষ্ট্যও হবে সর্বজনবেদ্য। সুতরাং ভাবীকালের শিল্পের উৎকর্ষের আদর্শ কেবলমাত্র কতিপয় ব্যক্তির অধিগম্য অনুভূতির স্বাতন্ত্র্য হবে না, বরং সে আদর্শ হবে শিল্পের সর্বজননীতা। বর্তমানে আয়তনের যে পৃথুলতা, অস্পষ্টতা এবং রূপাঙ্গিকের জটিলতার জন্য শিল্পসৃষ্টিকে মূল্য দেওয়া হয়, ভবিষ্যতে সে মূল্য দেওয়া হবে না। পরন্তু শিল্পের মূল্য নির্ণীত হবে তার সংহতি, স্পষ্টতা এবং অভিব্যক্তির সরলতার জন্য। একমাত্র উক্ত বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হলেই শিল্প বর্তমানের মতো মানুষের চিত্তবিলাসে অথবা চিত্ত কলুষিত করার কাজে ব্যাপৃত থাকবে না, এবং মানুষের সব শক্তি-সামর্থ্য তারই পেছনে ব্যয় করবার আহ্বানও জানাবে না। বরং ভাবী শিল্প হবে, যা হওয়া উচিত,-ধৰ্মীয় খ্রীষ্টীয় উপলব্ধিকে বুদ্ধি ও মননের রাজ্য থেকে অনুভূতির রাজ্যে সঞ্চারিত করবার বাহন। এবং ধর্মীয় চেতনায় যে পরোৎকর্ষ ও মানব মিলনের আদর্শ নির্দেশিত, বাস্তব জীবনেও ভাবী শিল্প মানুষকে সেই পরোৎকর্ষ ও পারস্পরিক মিলনের দিকে আকর্ষন করবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *