হোয়াট ইজ আর্ট – ১৫

১৫

[বিষয়বস্তু নিরপেক্ষভাবে শিল্পগুণের (যা তার রূপমূর্তির ওপর নির্ভরশীল) বিবেচনা- শিল্পের লক্ষণ : সংক্রামকতা। বিকৃতরুচি ব্যক্তির নিকট শিল্প দুর্বোধ্য। সংক্রমণের শর্ত : ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, স্বচ্ছতা, সঞ্চারিত অনুভূতির অকৃত্রিমতা।]

আমাদের সমাজে শিল্প এত বেশি পরিমাণ বিকৃতি লাভ করেছে যে, নিকৃষ্ট শিল্পই যে উৎকৃষ্ট বলে বিবেচিত হয়েছে শুধু তাই নয়, এমনকি প্রকৃত শিল্প কী-সে উপলব্ধিও নষ্ট হয়ে গেছে। সুতরাং আমাদের সমাজ-প্রচলিত শিল্প বিষয়ে সক্ষমতা অর্জনের জন্য কৃত্রিম এবং যথার্থ শিল্পবস্তুর পার্থক্য নির্ণয় প্রথমেই প্ৰয়োজন।

যে সন্দেহাতীত লক্ষণ দ্বারা সৎ-শিল্পকে কৃত্রিম শিল্প থেকে পৃথক করা সম্ভব তা শিল্পের সংক্রামকতা। যদি কোন ব্যক্তি অপর ব্রক্তির সৃজনকর্ম দেখে শুনে বা পড়ে কোন প্রকার প্রয়াস এবং দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন না করেই এমন একটি মানসিক অভিজ্ঞতা লাভ করেন-যা তাকে সে ব্যক্তির সঙ্গে বা একই সৃষ্টিকর্ম-প্রভাবিত অপর ব্যক্তির সঙ্গেও মিলিত করে, তবে সে অবস্থা উদ্রেককারী বস্তুকে বলা চলে শিল্পকর্ম। কোন শিল্পকর্ম যতই কাব্যগুণসম্পন্ন, বাস্তবধর্মী চমকপ্রদ অথবা কৌতুহলোদ্দীপক হোক না কেন, যদি তা সেই আনন্দময় অনুভূতি উদ্রেক না করে ( যা অপরাপর সমস্ত অনুভূতি থেকে সম্পূর্ণ পৃথক) এবং অপর অর্থাৎ লেখকের এবং আরও যে সমস্ত ব্যক্তি তদ্বারা সংক্রমিত হয়েছেন তাদেরও সঙ্গে আত্মিক মিলনের অনুভূতি জাগ্রত না করে-তবে তা শিল্পসৃষ্টি নয়।

বলা বাহুল্য, শিল্পের এই লক্ষণটি অভ্যন্তরীণ এবং এমন ব্যক্তিরও অস্তিত্ব আছে যারা প্রকৃত শিল্পের ক্রিয়া বিস্মৃত হওয়ায় শিল্প থেকে অপর কিছু প্রত্যাশা করে (আমাদের সমাজে অধিকাংশ ব্যক্তির অবস্থা এই), এবং কাজে কাজেই এই পর্যায়ের ব্যক্তিরাই কৃত্রিম শিল্প-উদ্ভুত চিত্ত বিনোদনের অনুভূতি অথবা এক ধরনের উত্তেজনাকে নান্দনিক অনুভূতি বলে ভুল করতে পারে। বর্ণান্ধ ব্যক্তিকে সবুজ লাল নয়-এ বিষয়ে প্রত্যয়ান্বিত করা যেমন অসম্ভব, তেমনি ওই পর্যায়ের ব্যকিদেরও বঞ্চনামুক্ত করা অসম্ভব হলেও শিল্পবিষয়ক অনুভূতি বিকৃত বা ক্ষয়িষ্ণু হয়নি-এমন ব্যক্তির নিকট এই শিল্পলক্ষণ সম্পূর্ণ সুনির্দিষ্ট এবং তা শিল্পোদ্ভূত অনুভূতিকে অপরাপর অনুভূতি থেকে সুস্পষ্টভাবে পৃথক করে।

এই অনুভূতির প্রধান স্বকীয়তা এই যে, প্রকৃত শৈল্পিক অনুভূতি-প্রভাবিত ব্যক্তি শিল্পীর সঙ্গে এমন সাযুজ্য অনুভব করেন-যার প্রভাবে তার এমন উপলব্ধি ঘটে যে, শিল্পকর্মটি যেন তাঁরই সৃষ্ট, অপর কারো নয়-যেন বহুকাল যাবৎ তিনি যা প্রকাশ করতে চেয়েছেন, এই শিল্পকর্ম তারই অভিব্যক্তি। প্রকৃত শিল্পকর্ম উপভোক্তার চেতনায় নিজের এবং শিল্পীর মধ্যে ব্যবধানেরই যে বিলোপ সাধন করে শুধু তাই নয়, পরন্তু তার নিজের এবং ওই শিল্পের অপরাপর অনুরাগীর মধ্যেকার ব্যবধানও দূর করে। ব্যবধান ও বিচ্ছিন্নতা থেকে আমাদের ব্যক্তিত্বের এই মুক্তিসাধন এবং অপরের সঙ্গে এই ব্যক্তিত্বের মিলনেই শিল্পের প্রধান বৈশিষ্ট্য এবং আকর্ষণী শক্তি নিহিত।

যদি কোন ব্যক্তি লেখকের আত্মার আবেগ-প্রভাবে সংক্রমিত হয়, যদি সে এই আবেগ এবং অপরাপর ব্যক্তির সঙ্গে এই মিলন-চেতনা অনুভব করে, তবে যে বস্তুর মাধ্যমে এটা সাধিত হয়-তাই শিল্পকর্ম। কিন্তু যেখানে এ ধরনের কোন সংক্রমণ ঘটে না, যেখানে লেখকের সঙ্গে এবং একই সৃষ্টিকর্মপ্রভাবিত অপরাপর ব্যক্তির সঙ্গে সাযুজ্যও ঘটে না-তবে তা শিল্পপদবাচ্য নয়। সংক্রমণ যে শিল্পের নিশ্চিত লক্ষণমাত্র তাই নয়, বরং সংক্রমাকতার পরিমাণই শিল্পোৎকর্ষের একমাত্র মানদন্ড।

বিষয়বস্তু-নিরপেক্ষভাবে শিল্প বিষয়ে এখন বলতে গেলে অর্থাৎ সঞ্চারিত অনুভূতির জন্য বিবেচনা না করেও এ কথা বলা চলে যে, সংক্রমণের মাত্রার প্রাবল্য যত বেশি, শিল্পের উৎকর্ষও ততই বেশি।

এবং শিল্প সংক্রামকতার পরিমাণ নির্ভরশীল তিনটি শর্তের ওপর : (১) সঞ্চারিত অনুভূতির স্বাতন্ত্র্যের গভীরতা ও লঘুতার পরিমাণের ওপর, (২) অধিকতর অথবা স্বল্পতর স্বচ্ছতার সঙ্গে সঞ্চারিত অনুভূতির ওপর, (৩) শিল্পীর আন্তরিকতার ওপর অর্থাৎ সঞ্চারিত আবেগ শিল্পীর আপন মনে কিরূপ তীব্রতার সঙ্গে অনুভূত হয়েছিল-অধিক অথবা অল্প -তার ওপর।

সঞ্চারিত অনুভূতির স্বাতন্ত্র্যের মাত্রা অনুযায়ী শিল্প-উপভোক্তার ওপর তার প্রভাবও সেইরূপ প্রবল হবে। শিল্প-উপভোক্তা যে অনুপাতে অনন্য চিত্তস্থিতিতে উপনীত হবে, তার আনন্দের মাত্রাও তদ্রূপ বেশি হবে। সুতরাং সে আরও আগ্রহের সঙ্গে তা আস্বাদনে উন্মুখ হবে।

অভিব্যক্তির স্বচ্ছতা সংক্রমণের সহায়ক। এর কারণ যে চেতনার জগতে শিল্প উপভোক্তা লেখকের সঙ্গে একাত্ম, তিনি আরও পরিতৃপ্তি লাভ করেন যদি সে অনুভূতি আরও স্পষ্টভাবে সঞ্চারিত হয়। তখন তার মনে হয় যে, সে অনুভূতি তার বহু পরিচিত এবং সুদীর্ঘকাল তিনি যা উপলব্ধি করে এসেছেন, এরই মধ্যে তিনি তার অভিব্যক্তি খুঁজে পেয়েছেন।

কিন্তু শিল্পীর আন্তরিকতার মাত্রার অনুপাতে শিল্পের সংক্রামকতার পরিমাণ সর্বাধিক বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। দর্শন, শ্রোতা অথবা পাঠক যে মুহূর্তে অনুভব করেন, শিল্পী নিজেই স্বীয় সৃষ্টি-সংক্রমিত হয়েছেন এবং কেবলমাত্র অপরের ওপর প্রভাব বিস্তারে প্রয়াসী না হয়ে নিজের আনন্দেই লিখছেন, গান করছেন, অথবা বাজাচ্ছেন তখন শিল্পীর এই মানসিক প্রবণতা শিল্প-উপভোক্তাকেও সংক্রমিত করে। অপরপক্ষে দর্শক, পাঠক বা শ্রোতা যখনই অনুভব করে যে, লেখকের রচনা, গান অথবা বাদন নিজস্ব পরিতৃপ্তির জন্য নয়, তাঁর অভিপ্রেত প্রকাশের বিষয় তাঁর অনুভূতিজাত নয়, বরং শিল্প-উপভোক্তার পরিতৃপ্তির জন্য সে শিল্পকর্ম নিয়োজিত, তৎক্ষণাৎ তার মধ্যে বিরোধী মনোভাব জেগে ওঠে, এবং তখন সর্বাপেক্ষা স্বাতন্ত্র্যপূর্ণ অভিনব অনুভূতি এবং চতুর কৌশলও শুধু যে তাদের মনে সংক্রমণ সৃষ্টিতে অসমর্থ হয় তাই নয়, বরং বাস্তব ক্ষেত্রে তা মাদের মনকে তাঁর সৃষ্টিকর্মের প্রতি বিমুখ করে তোলে।

শিল্প-সংক্রমণের তিনটি শর্তের কথা উল্লেখ করলেও সবগুলিকে একটির মধ্যে সংহত করা চলে : সেটি হল সব চাইতে শেষোক্ত শর্ত-আন্তরিকতা। অর্থাৎ অনুভূতির অভিব্যক্তি দেবার উদ্দেশ্যে শিল্পী কোন অভ্যন্তরীণ আবেগের দ্বারাই পরিচালিত হবে। প্রথমটিও এই শর্তাধীন-যেহেতু শিল্পী যদি আন্তরিকত হন তবে তিনি তাঁর অনুভূতিরই যথাযথ অভিব্যক্তি দেবেন। এবং যেহেতু ব্যক্তিমাত্রই অপর সকল ব্যক্তি থেকে ভিন্ন প্রকৃতির, তার অনুভূতিও স্ব-ক্ষেত্রে স্বাতন্ত্র্য পরায়ণ হবে। সে অনুভূতি তাঁর শিল্পপ্রকৃতির যত গভীর উৎস থেকে উৎসারিত -তা তত বেশি স্বাতন্ত্র্যচিহ্নিত, সহৃদয় এবং অকৃত্রিম হবে। এই একই আন্তরিকতা শিল্পীকে তার অভিপ্রেত অনুভূতি-সঞ্চারের উপযোগী স্বচ্ছ প্রকাশ রীতি অনুসন্ধানের প্রবর্তিত করবে।

সুতরাং এই তিনটি শর্তের মধ্যে সব চাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল তৃতীয় শর্ত-অর্থাৎ আন্তরিকতা। কৃষকদের শিল্পকর্মে সর্বদা এই শর্তের স্বীকৃতি মিলে। এবং এই প্রকরণের শিল্প কেন যে এত বেশি প্রভাববিশিষ্ট তার ব্যাখ্যাও মিলবে এখানে কিন্তু আমাদের উচ্চবর্গীয়দের শিল্পজগতে এই স্থিতির একান্ত অভাব,-যেহেতু ব্যক্তিগত লোভ এবং অহংকার-প্রণোদিত হয়ে এ পর্যায়ে শিল্পীরা নিরবচ্ছিন্ন ভাবে শিল্পসৃষ্টি করে চলেছেন।

এই তিনটি শর্তই কৃত্রিম শিল্প থেকে খাঁটি শিল্পের পার্থক্য নির্দেশ করে এবং বিষয়বস্তু- নিরপেক্ষ প্রত্যেকটি শিল্পকর্মে উৎকর্ষ নির্ধারণ করে।

এই শর্তগুলির মধ্যে যে কোন একটিরও অভাব ঘটলে সৃজনকর্ম খাঁটি শিল্পের কোঠা থেকে বিচ্যুত হয় এবং কৃত্রিম শিল্পের কোঠায় গিয়ে পড়ে। সৃজনকর্ম কখনও শিল্পপদবাচ্য হবে না-যদি তা শিল্পীর বিশিষ্ট অনুভূতি সঞ্চারে অসমৰ্থ হয়, অর্থাৎ স্বাতন্ত্র্যপূর্ণ না হয়, যদি তার অভিব্যক্তি হয় দুর্বোধ্য, অথবা সেটি যদি লেখকের অন্ত নির্হিত অভিব্যক্তির প্রেরণায় উৎসারিত না হয়। কোন সৃষ্টিকর্মে এই সমস্ত শর্ত যদি ক্ষুদ্রতম পরিমাণেও বর্তমানে থাকে -তবে দুর্বল হলেও তা খাঁটি শিল্পকর্ম।

বিষয়বস্তুর কথা ছেড়ে দিলেও স্বাতন্ত্র্য, স্বচ্ছতা এবং অকৃত্রিমতা-এই তিনটি শর্তের বিভিন্ন আনুপাতিক উপস্থিতি শিল্পবিচারে কোন সৃজনকর্মের উৎকর্ষ নির্ণায়ক। এই শর্তগুলির মধ্যে প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয়টি কি পরিমাণে পূরণ করা হয়েছে তার অনুপাতের ওপর শিল্পকর্মের পর্যায়ক্রমিক উৎকর্ষ নির্ভরশীল। কোন সৃজনকর্মে সঞ্চারিত অনুভূতির স্বাতন্ত্র্য প্রাধান্য লাভ করতে পারে, অপরটিতে অভিব্যক্তির স্বচ্ছতা, তৃতীয়টিতে অকৃত্রিমতা, অপরপক্ষে চতুর্থটিতে অকৃত্রিমতা ও স্বাতন্ত্র্য থাকা সত্ত্বেও স্বচ্ছতার অভাব থাকা সম্ভব। পঞ্চমটিতে স্বাতন্ত্র্য এবং স্বচ্ছতা বিদ্যমান থাকলেও অকৃত্রিমতার পরিমাণ কম-এভাবে সকল প্রকার সম্ভাব্য অনুপাত ও সংযোগের মধ্যে সৃজনকর্মের অভিব্যক্তি দেখা যায়।

এভাবেই শিল্পপদবাচ্য নয় এমন বস্তু থেকে শিল্পকে পৃথক করা হয় এবং এই উপায়েই বিষয়বস্তু-নিরপেক্ষভাবে শিল্প হিসেবে শিল্পের গুণগত উৎকর্ষ নির্ধারিত হয়-অর্থাৎ শিল্পসঞ্চারিত অনুভূতি ভালো বা মন্দ তার ওপর নির্ভর না করেই শিল্প-মান সম্পর্কে সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব।

কিন্তু প্রশ্ন ওঠে, শিল্পের অন্তর্নিহিত ভাববস্তু অথবা বিষয়ের পরিপ্রেক্ষিতে কিভাবে উৎকৃষ্ট এবং নিকৃষ্ট শিল্পের সংজ্ঞা নিরূপণ করব?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *