ভূমিকা – কবীর চৌধুরী
সাহিত্যে আত্মপ্রকাশের সূচনা থেকেই জুলফিকার নিউটনের অসামান্য শিল্প প্রতিভা অবিসংবাদিত। যে অল্প কয়েকজন লেখক বাংলা গদ্যরীতিকে নিজস্ব ব্যক্তিত্ব এবং অনুশীলনের দ্বারা বিচিত্র পথে অদীনসত্ত্ব করে তুলেছেন, পাঠক-পাঠিকার মনোরঞ্জন করে গাড়ি বাড়ির আশায় কলমপেশা অবলম্বন করেননি, যাঁদের গদ্যরচনা স্টাইল বা অনন্যতার দ্বারা নন্দিত জুলফিকার নিউটন তাঁদের একজন।
গল্প, উপন্যাস এবং প্রবন্ধ-সাহিত্যতত্ত্ব, দর্শন, সমাজ-সংস্কৃতি, রাজনীতি সমকালীন ঘটনার ঘাত প্রতিঘাত প্রতিক্ষেত্রেই জুলফিকার নিউটনের সংবিৎ সক্রিয় ও সুপ্রকাশ। বৈচিত্র্যে প্রাচুর্যে এবং মনণের পরিবাহিতাশক্তিতে বর্তমান লেখকদের মধ্যে তিনি অপ্রতিরথ। সময়ের অপ্রতিরোধ্য প্রেষ এবং মৌলবাদের আক্রমণ তাঁর অনুলম্ব চিন্তনকে নিরুদ্যম করতে পারেনি। অনিঃশেষ তাঁর কৌতুহল, অনাবরত তাঁর জীবন জিজ্ঞসা, প্রমিতাক্ষর তাঁর বাচনকলা, নিস্কম্প দীপশিখার মত তাঁর বিবেকিতা। তাঁর লেখার সঙ্গে যারা পরিচিত তারা জানেন আমাদের জীবন যাত্রার, সমাজ ব্যবস্থার, ধ্যান-ধারণার, ভাষা এবং সাহিত্যের উৎকর্ষ সাধন জুলফিকার নিউটনের সাহিত্য চর্চার মূল্য উদ্দেশ্য। এই প্রয়াস সাধনে তাঁর রচনা দুটি প্রধান ধারায় বহমান। প্রথমটি সমাজের সমালোচনা, বিশ্লেষণ এবং রূপান্তরের উদ্দেশ্যে প্রবহমান, অন্য ধারাটি ভাষা ও সাহিত্যের উৎকর্ষের সাধনায় নিয়োজিত।
জুলফিকার নিউটন একাধারে লেখক, গবেষক এবং অনুবাদক। ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর সাড়া জাগানো কিশোর উপন্যাস ‘ইলাডিং বিলাডিং’ এবং প্রবন্ধ গ্রন্থ ‘শিল্পের নন্দনতত্ত্ব’। তারপর থেকে তিনি নিরলসভাবে লিখে যেতে থাকেন যা আমাদের সাহিত্যের বিভিন্ন শাখাকে সমৃদ্ধ করেছে। আমার বিশেষভাবে যেসব গ্রন্থের কথা মনে পড়ে তার মধ্যে রয়েছে- মরমী লালন ফকির- (১৯৯০), নজরুলের শিল্প ব্যাক্তিত্ব- (১৯৯৩), সাহিত্যের সৌন্দর্য- (১৯৯৪), বঙ্গবন্ধু গান্ধী লেলিন- (১৯৯৬), সত্যজিৎ সাহিত্য (১৯৯৫), নোবেল বিজয়ীদের জীবন ও সাহিত্য- (১৯৯৫), বিশ্ববরেন্যদের জীবন ও সাহিত্য- (১৯৯৬), বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ- (১৯৯৭), নারীর নারীত্ব- (১৯৯৭), নাটকের শিল্পশৈলী- (১৯৯৭), বিদদ্ধ বাঙালী কবীর চৌধুরী- (১৯৯৮), বাংলা গদ্যের গন্তব্য- (১৯৯৮), শিল্পস্রষ্টা ও সমালোচক- (১৯৯৮), রবীন্দ্রনাথের শিল্পব্যক্তিত্ব- (১৯৯৮), বঙ্গবন্ধুর শিল্পব্যক্তিত্ব- (১৯৯৮), বঙ্গবন্ধু ও বাঙালি সংস্কৃতি- (১৯৯৯), লেখক ও পাঠক- (১৯৯৯), বাঙালির বঙ্গবন্ধু- (১৯৯৯), লোকসংস্কৃতির শিল্পরূপ- (২০০০), রবীন্দ্র সংগীতের শিল্পরূপ- (২০০০), রম্যা রঁলা ও রবীন্দ্রনাথ- (২০০১), জ্ঞানের সমাজতত্ত্ব- (২০০১), দেশরত্ন শেখ হাসিনা- (২০০১), উপন্যাসের শিল্পরূপ- (২০০২), বঙ্গবন্ধু ও বাঙালির মুক্তি সংগ্রাম- (২০০৩), বিদগ্ধ বিবেক- (২০০৪), বঙ্গবন্ধু ও সেকুলার জাতীয়তাবাদ- (২০০৫), সংগীত সংস্কৃতি- (২০০৬), বাউল লালন রবীন্দ্রনাথ- (২০০৭), কবিতার শিল্পতত্ত্ব- (২০০৮), রবীন্দ্রনাথের জীবনদর্শন- (২০০৯), সুস্থ সমাজের সন্ধানে- (২০১০), সংস্কৃতির সমাজতত্ত্ব- (২০১১), মণীষী কবীর চৌধুরী- (২০১২), বাংলার বাউল ফকির-(২০১২) ইত্যাদি প্রভৃতি গবেষণামূলক গ্রন্থ। জুলফিকার নিউটনের রচনায় আমরা নির্ভুলভাবে লক্ষ্য করি তাঁর জিজ্ঞাসু মন এবং বৈচিত্রময় সৃষ্টিশীলতা।
জ্ঞান, মনন-বুদ্ধি ও ভাবচিন্তার শিল্পরূপ হচ্ছে প্রবন্ধ। সাহিত্য চর্চার সূচনায় জুলফিকার নিউটনের ধারণা ছিল জ্ঞানের বাহনরূপে প্রবন্ধই হচ্ছে সাহিত্যে সর্বশ্রেষ্ঠ শিল্পরূপ। সেজন্য তাঁর সাহিত্য জীবনের সূচনালগ্নে রচিত প্রবন্ধের সংখ্যা অন্যান্য সৃষ্টিশীল রচনার চেয়ে একটু বেশি। তারপর তিনি অবশ্য অনুবাদে অজস্রপ্রসূ হন। জুলফিকার নিউটনের প্রবন্ধ শুধু সহজ সামান্য কথায় জটিল প্রশ্নের আলোচনাই নয়, প্রবন্ধে যুক্তি ও তর্কের সঙ্গে বুদ্ধির পাশাপাশি রসের উপস্থিতিও। একাধিক লেখায় লেখক প্রবন্ধের সরসতার প্রতি তাঁর বিশেষ মনোযোগের কথা বলেছেন। সরসতা সত্ত্বেও তাঁর প্রবন্ধ রম্য রচয়িতার মেজাজে লেখা নয়। তথ্যনিষ্ঠ রচনা, মিষ্টিক মনের দৃষ্টি দিয়ে লেখা। মোহমুগ্ধের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে নয়। জুলফিকার নিউটনের প্রবন্ধ একই সঙ্গে সামাজিক ও সাহিত্যিক, সমসাময়িক ও যুগোত্তীর্ণ, সাবজেকটিভ ও অবজেকটিভ, সাহসী ও মরমী, স্বজ্ঞাযুক্ত ও যুক্তিপূর্ণ। তাঁর অধিকাংশ প্রবন্ধে লেখকের আদর্শ হলো সবচেয়ে কম কথায় সবচেয়ে সহজ ও সরলভাবে প্রকাশ।
তাঁর গল্প-উপন্যাস যেমন প্রীতিপদ, অনুবাদ-গবেষণা যেমন সুখপ্রদ, প্রবন্ধ ও আলোচনাও তেমনই কোন না কোন দিক থেকে চমকপ্রদ। প্রচলিত মতের পুনরাবৃত্তি করেন না কখনো জুলফিকার নিউটন। সব সময়েই তাঁর আলোচনায় থাকে চিন্তাকে উসকে দেবার মতো অজস্র উপাদান, নতুনভাবে দৃষ্টিকোণ থেকে বিচারে উদ্বুদ্ধ করার মতো ক্ষুরধার বিশ্লেষণ।
জুলফিকার নিউটনের নিজস্ব চিন্তা, রুচি, বিবেচনা ও বুদ্ধি নির্ভর রচনাগুলি অন্তর্লীন গভীরতা যেমন পাঠককে নিয়ত প্ৰাণিত করে তেমনি বিস্ময়ের উদ্রেক করে তার বিষয় বৈচিত্র্যে। অনুবাদ চর্চায় নিজস্ব চিন্তা ও মতপ্রকাশে জুলফিকার নিউটন কোথাও আপোস করেন নি। বলিষ্ঠ, সমৃদ্ধ ও সৃজন সম্ভাবনাময় গদ্যে রচিত এই অনুবাদগুলি আবহমান মানুষের বিবর্তনশীল জীবন দর্শনের প্রাতিম্বিক ও বৈশ্বিক পরিচয়।
ধাপে ধাপে তাঁর লেখায় নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। স্পষ্ট চিন্তা, স্বচ্ছ ভাষা, গাঢ় উপলদ্ধি, দৃঢ় প্রত্যয় এইসব নিয়ে তাঁর প্রবন্ধগুলি আক্ষরিক অর্থেই প্রবন্ধ। ঘটনাকে অবলম্বন করে প্রতিষ্ঠিত তত্ত্বের মূল্যায়ন, নতুন তত্ত্ব গঠন, ঘটনা পারস্পরের মধ্যে তত্ত্বের প্রয়োগ পরস্পর বিরোধী তত্ত্বকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে সমন্বয়সাধন এবং অবশেষে কল্যানমুখী কর্মসূচীর খসড়া রচনা-প্রবন্ধলেখক হিসেবে এটাই তাঁর স্বাভাবিক চলন শৈলী। বেঁচে থাকার প্রতিটি মুহূর্তে জুলফিকার নিউটন যা দেখেণ, বোঝেন এবং অনুভব করেন, সবই তাঁর তত্ত্বগঠন প্রণালীর অন্তগর্ত হয়ে যায়। এই ভাবে জীবনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমস্ত অভিজ্ঞতাগুলি গাঁথা হয় তাঁর ব্যক্তিসত্তার সুতোয়, রচনা হয় একটি ক্রমবিকাশশীল জীবনদর্শন।
জুলফিকার নিউটন প্রধানত যুক্তিবাদী। কিন্তু যুক্তিবিরোধী নয় অথচ যুক্তির উর্ধ্বে মানুষের যেসব সূক্ষ্ণ অনুভূতি ও উপলদ্ধি, সেগুলি সম্পর্কে তাঁর মন অসাড় তো নয়ই, বরং তাদের অস্তিত্ব ও অপরিহার্যতা বিষয়ে তিনি নিঃসংশয়। মানব সংস্কৃতিতে ধর্মের স্থান ও প্রভাব নিয়ে তিনি গভীর চিন্তা ভাবনা করেছেন ও লিখেছেন। একটা মানব ঐক্যের আদর্শ দিয়ে জুলফিকার নিউটন মানুষকে তার ব্যক্তিগত ও সামাজিক পরিচয়ের মধ্যে দিয়ে বুঝাতে চেয়েছেন যে সব বিদ্যার মধ্য মানুষের চিন্তা ও কর্মের বিচিত্র প্রকাশ, সেই সবরে প্রতিই তাঁর গভীর আগ্রহ। মানুষের কর্ম ও অবসর, মমতা ও নির্মমতা, স্বার্থ ও স্বার্থত্যাগ নিয়ে যে দ্বন্দ্বাত্মক কাহিনী বিশ্ব ইতিহাসের পাতায় পাতায় লেখা হয়ে চলছে, তাতেই মগ্ন হয়ে আছেন তিনি; ঘটনা পরস্পরা অনুসরণ করে মানুষের আত্ম প্রকাশের ধারাটির প্রকৃতি বুঝতে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু শুধুমাত্র জানা এবং বোঝাই তাঁর লক্ষ্য নয়। এই ধারাটির শুভনিয়ন্ত্রনে বিবেকী মানুষের সজাগ ও সক্রিয় ভূমিকাটিও চিনে নেওয়া এবং পালন করার উপায় সম্বন্ধে ভেবেছেন। এটাই তাঁর জীবনের কাজ, লেখার মধ্য দিয়ে এই কাজটাই তিনি করতে চেয়েছেন। তাঁর লেখা বিশ্লেষণে তীক্ষ্ণ, বেদনায় কোমল লেখার মধ্যে অতিবিস্তার নেই, আধিক্য নেই, ততটাই লেখেন যতটা না লিখলে হয় না। নিবিড় অধ্যায়নের আভাস একটা মৃদু সৌরভের মত অন্তরালে থেকে তাঁর প্রকাশকে সমৃদ্ধ করে। যুক্তিবাদী হিসেবে একটা প্রাথমিক অবিশ্বাস-প্রবণতাই তাঁর মনের ধর্ম, কিন্তু এই ব্যাখ্যা গভীর নৈরাশ্যের পরিস্থিতিতেও মানুষের প্রতি বিশ্বাস এবং নৌরাশ্য-উত্তীর্ণ আশাবাদের মানসিকতাই তিনি জাগিয়ে রাখেন শেষ পর্যন্ত, যার ফলে তিক্ততা প্রায় কখনোই দেখা যায় না তাঁর লেখায়।
জুলফিকার নিউটনের রাজনীতি বিষয়ক লেখায় যে চিন্তাগুলি প্রাধান্য পেয়েছে তা হলঃ সাম্যবাদ ও গণতন্ত্র। হিংসাশ্রয়ী ও অহিংস রাজনীতি, রাজনীতিতে অতিকেন্দ্রন ও বিকেন্দ্রন, জাতীয় সংহতি ও সাম্প্রদায়িকতা, জাতীয়তাবাদ ও বিশ্ববাদ, বিশ্বশান্তি ইত্যাদি।
প্রথম থেকেই গণতন্ত্রের প্রতি জুলফিকার নিউটনের একনিষ্ট প্রেম। কেবল রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা হিসেবে নয়, জীবনদর্শন হিসেবে। ভ্রাতৃত্বের আদর্শকে সামনে রেখে নিজের কথা বলবার স্বাধীনতা ও অপরের কথা শোনবার সহিষ্ণুতা-এই দুইটি জরুরী মূল্যবোধকে লালন করা একমাত্র গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যেই কিছুটা সম্ভব বলে তিনি মনে করেন।
মার্কসবাদ ও জাতীয়তাবাদের অভ্যুত্থানের ইতিহাসও বর্তমান অবস্থা বিশ্লেষণ করে জুলফিকার নিউটন দেখিয়েছেন কীভাবে প্রাথমিক বিরোধিতা অতিক্রম করে পরবর্তী পর্যায়ে মার্কসবাদ জাতীয়তাবাদের কাছাকাছি এসে গেছে। যেমন মার্কসবাদের বিপদ, তেমনি জাতীয়তাবাদের বিপদ সম্বন্ধেও তিনি পূর্ণ সচেতন। বিশেষতঃ বাংলাদেশের রাজনীতিতে। একাধিক প্রবন্ধে তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, যদিও দেশের স্বাধীনতার জন্য, পুনরুজ্জীবনের জন্য জাতীয়তাবাদের প্রয়োজন ছিল কিন্তু বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ঐক্যের ভিত্তি আক্রমনধর্মী জাতীয়তাবাদের ওপর নয়, বরং সাংস্কৃতিক সম্বন্বয়ের দ্বারা বহুর মধ্যে একের প্রতিষ্ঠায় এই গ্রহণশীল উদারতার পথটি পরিত্যাগ করা বাংলাদেশের সংহতির পক্ষে মারাত্মক হবে এই তাঁর দৃঢ় প্রত্যয়। উদ্বেগের সঙ্গে তিনি উল্লেখ করেছেন কীভাবে ধর্মীয় ও অন্যান্য সাম্প্রদায়িকতা বাংলাদেশে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে ও এদেশের রাজনীতিকে এক হিংসাশ্রয়ী অসহিষ্ণুতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। দেশে আর বিদেশে যেসব মহান ব্যক্তির চিন্তাধারা আর কর্ম জুলফিকার নিউটনের চিন্তা ও ব্যক্তিত্বের ওপর যথেষ্ট ছাপ ফেলেছে, শ্রদ্ধার সঙ্গে তিনি তাঁদের কয়েকজনের মূল্যায়ন করেছেন। এই আলোচনা অনেক সময়েই করা হয়েছে তুলনামূলক ভাবে এবং যুগের সঙ্গে প্রাসঙ্গিকতা রেখে। এরা হলেন রবীন্দ্রনাথ, কাল মার্কস, মহাত্মা গান্ধী ও বঙ্গবন্ধু। যেসব ভাবনাচিন্তা প্রসঙ্গে এইসব মনস্বীদের কথা আলোচনা করা হয়েছে, তা হল স্বাধীনতা ও সাম্য, গণতন্ত্র ও মানবতাবাদ, বিশ্ববোধ প্রেম ও নিয়ম দ্বন্দ্ব ও অহিংসা, যুক্তি ও ধর্ম, সবকিছু নিয়ে সামাজিক প্রগতি, ব্যক্তিগত ও সামাজিক মুক্তি। রবীন্দ্রনাথের কাছে জুলফিকার নিউটন যা পেয়েছেন তার কৃতজ্ঞতা স্বীকার মিলবে তাঁর প্রায় প্রত্যেকটি রচনার মধ্যে। ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতা, স্বাধীনতা ও স্ব-নির্ভরতা বিশ্ববোধ ও মানবতা, পল্লী পুর্নগঠন, শিক্ষা ও সংস্কৃতি ইত্যাদি প্রসঙ্গে তিনি যা লিখেছেন সবতাতেই রবীন্দ্রনাথের কথা এসেছে সেই সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর প্রসঙ্গ। জুলফিকার নিউটন একজন বাঙালী রবীন্দ্রনাথ ও বঙ্গবন্ধু যাঁকে সমানভাবে আকৃষ্ট ও প্রভাবিত করেছেন। তিনি মনে করেন যে এ দেশে জাতীয় জীবনের ও জাতীয় চরিত্রের উন্নয়নে এই দুই শ্রেষ্ঠ সন্তানের ভূমিকা পরস্পরের পরিপূরক। এঁদের চিন্তার মধ্যে মিল যেমন দেখিয়েছেন, তেমনি অমিলের দিকটাও বিশ্লেষণ করেছেন জুলফিকার নিউটন। এই অমিল হল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার, বৃহৎ যন্ত্র ও বৃহৎ শিল্পের ব্যবহার, পল্লীর সঙ্গে নগরের সম্পর্কে নিয়ে। তাছাড়া মানুষের প্রতি বিশ্বাস ও ভালাবাসা যদিও এই দুজনেরই আত্মিক শক্তির একটা প্রধান উৎস ছিল, কিন্তু জীবনের মূল সুর ওমূল ঝোঁকের ব্যাপারে দুজনের অনেকখানি অমিল ছিল। এই মিল ও অমিল জুলফিকার নিউটনের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ-কারণ এঁদের দৃষ্টি ভঙ্গির পার্থক্য ঠিক মতো অনুধারন করতে পারলে তবেই আমরা জাতীয় জীবনে এঁদের বাণীকে সফল করে তুলতে পারবো। বাঙালী হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ও বঙ্গবন্ধুকে যুগৎ গ্রহণ করার মধ্যে জুলফিকার নিউটনের চিন্তার একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য দেখা যায়।
কার্ল মার্কস এমন একজন ব্যক্তি, যাঁর লক্ষ্য সম্বন্ধে জুলফিকার নিউটনের অগাধ শ্রদ্ধা, যাঁর ব্যাপক প্রভাব ও অবদান সম্পর্কে পূর্ণ সচেতন, যাঁর মতকে তিনি গ্রহন করেছেন আংশিক ভাবে; এবং যাঁর পথকে কখনোই অন্তরের সঙ্গে গ্রহণ করেননি। তিনি জানেন যে এযুগের রাজনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতি, সাংস্কৃতিক রূপান্তর, ভবিষ্যৎ পৃথিবীর চেহারা এসব বুঝতে গেলে মার্কসকে এক মুহূর্তের জন্যও ভুলে থাকা চলবে না বা পাশ কাটিয়ে যাওযা যাবে না। মার্কসবাদে শুভ-অশুভ কোন অবদাকেই উপেক্ষা করলে চলবে না। কীভাবে মার্কসের সঠিক মূল্যায়ন সম্ভব তার বিশদ আলোচনা আছে তাঁর লেখায়।
জুলফিকার নিউটনের ‘প্রবন্ধ সমগ্রতে’ মননের সঙ্গে উপলদ্ধির এক অসাধারন রাসায়নিক সংমিশ্রনে গড়ে উঠেছে একটি সম্পূর্ণ জীবনবোধ। মানুষ সম্পর্কে, জীবন ও মৃত্যু সম্পর্কে, প্রেম সম্বন্ধে, জীবনের মহত্তর মূল্যবোধ সম্বন্ধে এই রচনাগুলি। এর মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে একদিকে সাধনালদ্ধ নৈব্যক্তিক নিরাসক্ত দৃষ্টি, অন্যদিকে মহানুভব ও স্বার্থহীন প্রীতি। সব মিলিয়ে এক ব্যাপক বিশ্বদৃষ্টি ও নিগূঢ় জীবনবোধ।
জুলফিকার সারাজীবন ধরে পথের সন্ধান করছেন। কীসের পথ? এক নতুন সমাজ, মুক্ত সমাজে পৌঁছবার পথ। লিখছেন, “মুক্ত সমাজ বলতে যথাসম্ভব বেশি মানুষের মনে মুক্তির জন্য ঔদার্য আছে, উপযোগী পরিবেশ আছে- অন্তরে ও বাইরে।” সেই সমাজ দারিদ্র্যমুক্ত কিন্তু বিত্তলোলুপ নয়। সেই সমাজ অসাম্যবর্জিত, অহিংসায় বিশ্বাসী, যুক্তি ও সৃজনশীলতায় আস্থাশীল, সমবায় ও সহযোগিতায় অভ্যস্ত। সে লক্ষ্যে কবে পৌঁছনো যাবে, আদৌ পৌঁছনো যাবে কিনা জানা নেই। তবু লক্ষ্য স্থির রাখা, সঠিক পথ চিনে নেওয়া এবং সেই পথে চলতে শুরু করা- এটাই বড় কাজ। এই কাজটাই করে চলেছেন জুলফিকার নিউটন দীর্ঘকাল ধরে- তাঁর লেখার মধ্য দিয়ে- তাঁর নিজের বিচারবুদ্ধি এবং বিবেককে অনুসরণ করে।
জুলফিকার নিউটন তাঁর নিজস্ব রীতিতে নানা প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন- যা এই সময়ের জন্য এবং পরবর্তী বহু বছরের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তথ্যনিষ্ঠ, যুক্তিনিষ্ঠ, নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ করে জুলফিকার নিউটন সমস্যাগুলির স্বরূপ দেখাবার এবং একটা পথের দিশাও দেবার চেষ্টা করেছেন। সেই সঙ্গে প্রায় প্রত্যেকটি লেখার মধ্যে কোথাও স্পষ্টভাবে, কোথাও অস্পষ্টভাবে পাওয়া যাবে অন্য এক উপলদ্ধি- মানুষের জীবনের চরম লক্ষ্যের সঙ্গে যার যোগ। এই উপলদ্ধি আগেও ছিল, এখন যেন আরও বেশি করে, আরও গাঢ়ভাবে। তাঁর সব রচনার মধ্যে এখন দুটি ভাবের সহ-অবস্থান। একটি হল: একজন সমাজ সচেতন, বিবেকবান, দায়িত্বশীল মানুষ হিসেবে তাঁর গভীর উদ্বেগ। মানুষ, মানুষের সভ্যতা আজ যে মহাসংকট, মহতী বিনষ্টির মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে, কেমন করে কোন পথে চললে তা থেকে পরিত্রাণ। অন্য ভাবটি হল- একজন ব্যক্তি মানুষের অন্তরের গভীর ব্যাকুলতা- “মুক্তি তোরে পেতেই হবে”। নানা প্রসঙ্গে জুলফিকার নিউটন এই মুক্তির স্বরূপ বর্ণনা করেছেন, মুক্তির আকাঙ্ক্ষার কথা বলেছেন। তাঁর মধ্যে বোধের মধ্যে এই মুক্তি হল ক্ষুদ্র অহং থেকে বৃহৎ বিশ্বের মুক্তি, ভয়বোধ থেকে বিস্ময়বোধের মুক্তি। বিদ্বেষের মেঘাবরণ সরিয়ে অহেতুক প্রেমের নির্মল আলোর মধ্যে মুক্তি। এই উপলদ্ধির আভাস বারবার পেয়েছি তাঁর লেখায়। তারই একটি উদ্ধৃতি:
“মন থেকে বিদ্বেষের মেঘ দূর হলে আশ্চর্যভাবে চিদাকাশে প্রবেশ করে অন্য এক আলো, বিশ্বের সঙ্গে মিলনের আনন্দ, তারই নাম মুক্তি। একে পেয়েও আমরা হারাই, হারিয়ে ফিরে পাই। ফিরে পাবার এই সাধনাই মুক্তির সাধনা। মুক্তিকাম মানুষের এটাই যোগ্য সাধনা।”
জুলফিকার নিউটনের প্রবন্ধের মধ্যে একটি ধারাবাহিক ক্রম পরিকল্পনা থাকে। হয়তো প্রাথমিকভাবে অনেকক্ষেত্রে মনে হয় অনুচ্ছেদগুলি বিচ্ছিন্ন- পরস্পরা সূত্রে যুক্ত নয়। কিন্তু এর অন্তর্লীন গঠনের নির্মাণসূত্র ক্রমান্বয়ে তাকে প্রথিত করে। প্রবন্ধের শেষ অনুচ্ছেদ পর্যন্ত না পৌঁছলে সে পরিকল্পনার রূপ স্পষ্ট হয় না। অনেক আপাত সংযোগহীন বিষয়ও বার বার বিবরণের আকারে চলে আসে। এই সব বিবরণের সমবেত নিহিতার্থ আপাত বিচ্ছিন্নতার আড়াল থেকে স্পষ্টতর হয়ে ওঠে ক্রমান্বয়ে শেষ পর্বে। তাঁর প্রবন্ধে যত গভীরতর বিষয়ই হোক, এক ধরনের সংলাপধর্মিতা সহজেই গ্রস্ত করে আমাদের। যে কোনও দুরূহ, জটিল বা বাস্তব বিষয়ও শেষ মুহূর্তে এক দার্শনিকতার মাত্রা পায়। তাই মননের সঙ্গে তার বোঝাপড়া যতটুকু তা যুক্তিকে অবলম্বন করে যেতে যেতে বোধিকে দীপ্ত করে।
জুলফিকার নিউটনের অনুবাদ সাবলীল উপভোগ্য, উচ্চ প্রশংসার দাবিদার। অনুবাদগুলো ভাবানুবাদ নয় তবে আক্ষরিক অনুবাদও নয়। কোথাও কোথাও তিনি একটু বদলে নিয়েছেন, সামান্য সম্প্রসারিত করেছেন। কোথাও কোথাও, কিন্তু কখনোই মূল সুরকে বিকৃত বা ব্যাহত হতে দেননি। বাংলা ছন্দের ব্যপক ঐতিহ্য এবং বাংলা ভাষার শব্দভান্ডারকে তিনি তাঁর অনুবাদে নিপুন ভাবে ব্যবহার করেছেন। কিছু কিছু শব্দ প্রয়োগের মধ্য দিয়ে এটাও বুঝা যায় যে অনুবাদক সচেতন ভাবে তার অনুবাদ সম্পর্কে আমাদেরকে নিজস্ব সামাজিক সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলের সঙ্গে একাত্ব করতে প্রয়াস পেয়েছেন। তবে এ জাতীয় কয়েকটি প্রয়োগের অপরিহার্যতা বা উৎকর্ষ নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ আছে। কিন্তু ব্যাপক অর্থে জুলফিকার নিউটনের ভাষা বেগবান, বিষয়ের সঙ্গে সুসামঞ্জস্য, বক্তব্য, পটভূমি, চরিত্র ইত্যাদির সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করে ছন্দ ও শব্দের যে বৈচিত্র্য তিনি এনেছেন তা বিশেষ প্ৰশংসনীয়।
লেখকের রচনার প্রতি বিশ্বস্ততা অনুবাদর্মের অণ্যতম দায়িত্ব। যদি মূল লেখকের প্রতি আন্তরিক অনুরাগ থাকে তাহলে অনুবাদ স্বেচ্ছায় ও দায়িত্ব মেনে নেন। এবং জানেন কীভাবে তাদের ভাষায় সমার্থক শব্দ ও বাক্য খুঁজে বের করতে হয়। জুলফিকার নিউটনের অনুবাদের পরিমাণও নেহায়েত কম নয়। তাঁর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- আলেক্স হেলির-রুটস্- (১৯৯৪), লিও টলস্টয়ের-রেজারেকশান- (১৯৯৬), আনা কারেনিনা- (১৯৯৬), ওয়ার এন্ড পিস- (১৯৯৭), চিনুয়া আচিবির- থিংকস ফল অ্যাপার্ট- (১৯৯৬), বিশ্বের শ্রেষ্ঠ গল্প- (১৯৯৭), হারমান মেলভিলের- মবি ডিক (১৯৯৭), হাওয়ার্ড ফাস্টের-সাইলাস টিম্বারম্যান- (১৯৯৭), আলেজান্ডার সলজেনিৎসিনের- ইভান দেনিসোভিচ- (১৯৯৭), ক্যান্সার ওয়ার্ড- (১৯৯৯), বিশ্বের শ্রেষ্ঠ দশটি উপন্যাস- (১৯৯৮), এরিখ মারিয়া রেমার্কের- থ্রি কমরেডস- (১৯৯৮), দি স্পার্ক অফ লাইফ- (২০০১), ফ্রানৎস কাফকার- দি ট্রায়াল- (১৯৯৮), দি ক্যাসল- (১৯৯৯), বিশ্বের শ্রেষ্ঠ দশটি কিশোর উপন্যাস- (১৯৯৮), গুস্তাভ ফ্লোবেয়ারের-মাদাম বোভারি – (১৯৯৮), নোবেল বিজয়ীদের দশটি উপন্যাস- (১৯৯৮), জেমস জয়েসের- ডাবলিনার্স- (১৯৯৯), নোবেল বিজয়ীদের শ্রেষ্ঠ গল্প- (১৯৯৯), আলবেয়ার কাম্যু- দি প্লেগ- (১৯৯৯), দান্তের-ডিভাইন কমেডি- (১৯৯৯), স্তাদালের-দি রেড এন্ড দি ব্ল্যাক- (১৯৯৯), হোমারের- ইলিয়াড ও ওডেসি- (২০০০), নোবেল বিজয়ীদের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস (১ম খন্ড)- (২০০০), টমাস হার্ডির- ফার ফ্রম দি ম্যাডিং ক্রাউড- (২০০০), অ্যাগনেস স্মেডলির -ডটার অফ আর্থ- (২০০০), ভিক্টর হুগোর- লা মিজারেবল- (২০০১), মার্ক টোয়েনের কিশোর উপন্যাস- (২০০১), ম্যাক্সিম গোর্কির শ্রেষ্ঠ গল্প- (২০০১), ম্যাক্সিম গোর্কির শ্রেষ্ঠ উপন্যাস (২০০২), বরিস পাস্তেরনাকের- ডঃ জিভাগো- (২০০২), টমাস হার্ডির কিশোর উপন্যাস- (২০০২), নোবেল বিজয়ীদের শ্রেষ্ঠ নাটক – (২০০২), মার্কেজের শ্রেষ্ঠ গল্প- (২০০২), নোবেল বিজয়ীদের শ্রেষ্ঠ কবিতা- (২০০২), মোরাভিয়ার প্রেমের গল্প- (২০০৩), জ্যাক লন্ডনের শ্রেষ্ঠ গল্প- (২০০৪), জ্যাক লন্ডনের কিশোর উপন্যাস- (২০০৪), চার্লস ডিকেন্সের কিশোর উপন্যাস- (২০০৪), মিগেল সার্ভেন্টিসের- ডন কুইকজোট- (২০০৫), মাইকেল ওয়াইন্ডিংয়ের- দি প্যারাণ্ড্যইয়ান এক্সপেরিমেন্ট- (২০০৬), আলেকজান্ডার ডুমার কিশোর উপন্যাস- (২০০৭), জন ষ্টাইনবেকের কিশোর উপন্যাস- (২০০৫), লিও টলস্টয়ের শ্রেষ্ঠ গল্প- (২০০৫), গী দ্য মোপাসার শ্রেষ্ঠ গল্প- (২০০৫), ভিক্টর হুগোর কিশোর উপন্যাস- (২০০৬), কাফকার শ্রেষ্ঠ গল্প- (২০০৭), মার্ক টোয়েনের শ্রেষ্ঠ গল্প (২০০৭), আন্তন চেখভের শ্রেষ্ঠ গল্প- (২০০৮), এডগার অ্যালান পোর শ্রেষ্ঠ গল্প- (২০০৮), অ্যালন পেটনের- কাঁদো প্রিয় দেশ- (২০০৯), মোপাসাঁর প্রেমের উপন্যাস- (২০১০), গিওভার্নি বোক্কাচিওর- ডেকামেরণ- (২০১১), জ্যা পল সার্ত্রের-বিয়িং এন্ড নাথিংনেস- (২০১১), বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কবিতা- (২০১২) ইত্যাদি।
ছোটদের মনের মতো সাহিত্য রচনায় জুলফিকার নিউটনের কৃতিত্ব অনেক দিক থেকেই অনন্য। এখানে তাঁর স্থান ও অন্যদের চেয়ে আলাদা। কিশোর সাহিত্যে নানা মুখী বৈচিত্রসৃষ্টিতে জুলফিকার নিউটন শুরু থেকেই সার্থক। তাঁর লেখা গল্প কাহিনী- ছোটদের মাতিয়ে রেখেছে অন্য আশ্বাদে, অন্যতর পরিবেশনার গুণে। তাঁর প্রতিটি কিশোর উপন্যাস ক্ষুদে পাঠকদের মনোযোগ যেভাবে আকর্ষন করে, তা অনেকের কাছেই ঈর্ষনীয়। জুলফিকার নিউটন জানেন ছোটদের লেখায় কী করে ছোটদের স্বপ্ন আর আকাঙ্খা, কল্পনা আর অনুপ্রেরণা, রোমাঞ্চ আর আনন্দ-যন্ত্রণাকে ফুটিয়ে তুলতে হয়। তাঁর সব লেখাতেই থাকে খুব সূক্ষ্মভাবে মেশানো একটা বক্তব্য। রূপকথার অনন্য ভঙ্গিতে লেখা সেই সব অপরূপ কথা পড়ে ছোটরা তাই একই সঙ্গে পায় গল্প পড়ার অফুরন্ত আনন্দ এবং জীবনকে ঠিকমতো চিনে নিয়ে সব রকমের বাঁধা বিপত্তিকে জয় করবার দূরন্ত প্রেরণা। আমি স্বতপ্রনোদিত হয়ে তার কিশোর উপন্যাস “ইলাডিং, বিলাডিং”, ইংরেজিতে অনুবাদ করেছি। “ইলাডিং, বিলাডিং”- কিশোর উপন্যাসের ভূমিকায় লিখেছিলাম- Zulfikar Newton’s Ilading Bilading is a juvenile novel with a difference. It has clear elements of folktale, legend, fairy tale; it has talking birds and trees. But the another’s presentation of the familiar elements is non traditional. They are enriched by a symbolism that is simple but appealing.
The main characters of the novel are two little birds, a decayed old apple tree, a large whit breasted kit, and a pine tree. Among the human characters are a sly bird-catcher, an old man living in an abandoned house with his young grandson, and a tribal village woman living with her boy in a thatched hut at the edge of a dense forest.
There is a subsidiary tale within the main story which is told by the pine tree, where we meet a greedy fisherman is intent on plundering the riches of a beautiful coral island and the daughter of mother nature who apposes him and finally brings about his death.
In Ilading Bilading we find a most vivid portrayal of nature. The beauty of trees \, lakes, rocks, the sea and its waves is gracefully projected. We see nature both in its quiet serenity and in its wild fusy: the calm sea, the devastating storm, the wild forest fire There is an enderiable moral overtone in the novel but it is not strained. Courage, love, friendship, fellow feeling, desire for liberty, hatred of greed etc are highlighted as integral elements of the story but with no didactic touch. They find their place in the tale spontaneously and are not imposed as a part of any deliberate scheme.
I think both young and adult readers will enjoy Zulfikar Newton’s Ilading Bilading. I for one, enjoyed reading as well as translating it.
জুলফিকার নিউটন উপন্যাস সমগ্রের সর্বত্রই আমরা দেখি যে, তাঁর কাহিনী জমজমাট ঠাস বুনোট, তাতে কোথাও কোনও ফাঁক ফোকর নেই। ফলে পাঠকের কোথাও ক্লান্তি আসে না কাহিনীর টানই তাঁকে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যায়, কোথাও একটু হোঁচট খেতে দেয় না। কিন্তু শুধু গল্প শোনাবার জন্যই তো জুলফিকার নিউটন উপন্যাস লেখেন না। একই সঙ্গে শোনাতে চান জগৎ এ জীবন সম্পর্কে কিছু জরুরি কথা। তাঁর উপলদ্ধির কথা। মজা এই যে, স্রেফ কাহিনীর টানে যিনি তাঁর উপন্যাস পড়েন, উপন্যাস পাঠ শেষ হবার পরে তিনিও হয়তো বুঝতে পারেন যে, জরুরি সেই বক্তব্য আর নেখকের সেই উপলদ্ধি তাঁর মনের মধ্যে গেঁথে গেছে, পাঠক হিসেবে তাঁকে পালই দিয়েছে অনেকখানি।
মানব সম্পর্কের যে সব নিভূত কন্দরে, কিংবা মানুষের যে সব গূটেষার গোপন অন্ধকার গুহায় আমাদের লেখকরা এমনকি উঁকি মারতেও সাহসী হন না, জুলফিকার নিউটন সেখানেও অকুতো ভয়ে ঢুকে পড়েন। দেখে আমরা চমকে যাই, আবার একই সঙ্গে স্বীকারও করি যে, বাংলা সাহিত্য এমন একজন লেখক পেয়েছে, কোন কিছুই যার কাছে অশূম্য কিংবা অনালোচ্য নয়।
যে সময়ে বাংলাদেশের বাজারি অভিযাচনার চাপে উপন্যাস মননবিমুখ, ফচকেমি, ন্যাকামি আর গালগল্পে পর্যবসিত হতে চলেছে সে সময়ে জুলফিকার নিউটনের সৃজনশীল সাহিত্যকর্মের সঙ্গে পরিচয় হয়তো এখনকার লেখক ও পাঠকের মনে বাংলা উপন্যাসের প্রতিশ্রুতি ও সামথ্যে বিশ্বাস ফিরিয়ে আনলেও আনাতে পারে।
জুলফিকার নিউটনের রচনা শৈলীর পেছনে যে ন্ধিতা ও সরলতা তার কারণ তাঁর লোকমানস, আর যে বিশুদ্ধি ও বিজ্ঞান মনস্কতা তার কারণ তাঁর মানবতাবাদী চিন্তা ভাবনা পাশ্চাত্য ধরনের। বস্তুত তাঁর সাহিত্য চেতনার এই উভয়যোজ্যতা এক সমন্বয় প্রবণতা তথা বৃহত্তর সংশ্লেষণ প্রয়াসের দিকে এগিয়ে যায়। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য, শিল্প ও জীবন, বিশ্বাস ও মনন এবং দেশ কাল পাত্র সবকিছুকে মিলিয়ে তিনি এক নান্দনিক সমীকরণে পৌঁছে যেতে চান। লেখকের কথাসাহিত্যের যে লক্ষ্য, উদ্দেশ্য আদর্শ এককভাবে তাঁর গল্পেরও অনুরূপ কয়েকটি মূল থিম রয়েছে, মানব প্রকৃতি, সত্যান্বেষণ, শাশ্বত প্রেম ও চিরন্তনী নারী, রূপদর্শন ও সৌন্দর্যের অন্বেষণ, ব্যক্তির, দেশের, বা জাতির রিনিউয়াল। জুলফিকার নিউটনের অনেক গল্প আসলে বড় গল্প অথবা উপন্যাসধর্মী। বড় মাপের থিমকে গল্পের পরিসরে ঢোকানো। গল্প ও উপন্যাস উভয় ক্ষেত্রেই তাঁর প্রতিন্যাস এক ও অভিন্ন। জীবনের সত্যকে সাহিত্যে আনা, মেকি উদভাবন না করা।
জুলফিকার নিউটনের উপন্যাস পাঠের পরিক্রমা শেষে সামগ্রিকভাবে কয়েকটি বৈশিষ্ট্য সহজেই মনে আসে। তিনি তার উপন্যাস বিষয়ে একাধিক ক্ষেত্রে নর-নারীর প্রেমবোধের স্বরূপ নিয়ে ব্যস্ত থেকেছেন শিল্পীর মানসিকতায়। জুলফিকার নিউটন মানুষে মানুষে ভালবাসা, সখ্য, মানুষের জীবনের সুস্থিতি, আশাবাদ, নানান বৈপরিত্যের ব্যঞ্জনায় আঁকতে সক্ষম এবং সফল। লেখকের আঁকা মানুষগুলো প্রধানত উচ্চবিত্ত সমাজ ও মানুষ থেকে মধ্যবিত্ত ও নিবিত্তদের সীমায় সক্রিয় থাকে। লেখক নির্দ্বিধায় নিজেকে উপন্যাসের বিষয়ে ও চরিত্র সূক্ষ্মভাবে যুক্ত করতে আগ্রহী। নিজের কথাই নিজে বলেন সততায় ও নিষ্ঠায়। নারী চরিত্রে বৈচিত্র্য ও জটিল মনস্তত্ত্বকে জুলফিকার নিউটন যেভাবে আঁকতে উৎসুক, তা তাঁর মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গির নতুনত্বের অভিজ্ঞনেরই সমর্থন। বিশেষভাবে প্রেম সম্পর্কে নর-নারীর প্রেম ভাবনাকে নিয়ে বেশি ভেবেছেন নিজের মতো করে। কোনও কোনও দার্শনিক মনে করেন ‘Love in a flood which wells up form the depths of our personality love is an emotional action, a warm, affirmative participation with the other being for its own sake. একজন বিখ্যাত কবির কথা ‘Love is not an emotion or desire, but a cognitive act in which we grasp the very essence of other person: এই সংজ্ঞায় মান্য থেকেও জুলফিকার নিউটনের প্রেম এ প্রেমিক প্রেমিকাদের নতুন মাত্রা পেতে দেখা যায়। তা যাবতীয় সংজ্ঞা ও আলোচনা থেকে সরে আসা প্রেমের নতুন আলো, নতুন বিশ্বাস, নতুন নতুন সময়ের যুবক যুবতীদের হৃদয় অভিজ্ঞান। প্রেমের তত্ত্ব জুলফিকার নিউটনের অজানা নয়। “মেয়েদের দেহটা সেতারের মত। অজস্র তার, কত জটিল বিন্যাস। বাজাতে যে জানে, সেই শুধু সেই নিরেট তার থেকে আশ্চর্য সুর তুলতে পারে”। এই সুরকে আশ্রয় করে জীবনে আনন্দের প্রতিষ্ঠা কতটা সম্ভব? নানা জনের থাকবে এ বিষয়ে নানা অভিমত। এটাই কাম্য ও স্বাভাবিক। মানুষের জীবন Chaotic, হৃদয় সম্পর্ক তাই জটিলতম।
জুলফিকার নিউটনের আঁকা চরিত্রের গ্যালারিও পাঠককে আবিষ্ট করে। সেসব চরিত্রের একটিও পাঠকের অস্বাভাবিক বা অচেনা বলে মনে হয় না। সামাজিক ও নাগরিক চরিত্রগুলো সবই তাঁর মা, বাবা, ভাই-বোন, কাকা-জেঠা ইত্যাদি আত্মীয় স্বজন বা রাস্ত াঘাটে হাটে-বাজারে অফিস কাছারিতে নিয়ত দেখতে পাওয়া চেনা মানুষের আদলে আঁকা বলে মনে হয়। আর ভাষা? জুলফিকার নিউটনের ভাষার মধ্যে কোন বানিয়ে তোলার ব্যাপারে নেই। যে ভাষায় তিনি গল্প-উপন্যাস লেখেন, তার মধ্যে কোথাও কোন কসরত কিংবা পাঁচ জনের থেকে নিজেকে আলাদা করে দেখাবার চেষ্টা আমাদের চোখে পড়ে না। তাঁর ভাষায় কৃত্রিমতার চিহ্ন নেই। যে ভাষায় আমরা কথা বলি, চিঠি লিখি এও সেই স্বাভাবিক ভাসা আর এরই ফলে তাঁর গল্প-উপন্যাস এবং অনুবাদ সাহিত্য এমন একটা সতেজ সাবলীল প্রাণময়তার সঞ্চার হয়, পাঠককে যা প্রবলভাবে কাছে টানে।
তাঁর শ্রেষ্ঠ গল্পগুলিতে তন্নিষ্ঠ পর্যবেক্ষন, অন্তর্মুখ ভাবনা ও ইঙ্গিতঋদ্ধ কল্পনা দূর্লভ সংযুক্তি রচনা করেছে। আধুনিক বাংলা সাহিত্যে উচ্ছসিত, শ্লেস্মাবিজড়িত, আবেগপৃথুল, গদগদ ভাবটি বেশ প্রবল। জুলফিকার নিউটনের অনুভব এবং প্রকাশ এই ধরনের আতিশয্য থেকে অনেকটাই মুক্ত। ইউরো-আমেরিকান লেখকদের অনুকরনে অনেক সমকালীন কাহিনীকার ‘অ্যালিয়েনেশন’-কে তাঁদের লেখার প্রধান উপজীব্য করেছেন। কিন্তু জুলফিকার নিউটন তাঁর ‘অশান্ত অশোক’ গল্পগ্রন্থে যে অনতিক্রম্য মানস ব্যবধানের আভাস দিয়েছেন এখনকার গল্প উপন্যাসে তার তুলনা দেখি না। নিঃশর্তভাবে প্রশংসা করার মতো লেখক জুলফিকার নিউটন।
A Golden Dream গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছিলাম- Ever since Zulfikar Newton bodly stepped into the literary world, he developed a style uniqely his own in many ways. He is one of those distinguished writers who, by dint of their individual talent mastered a partcular prose style of Bengali instead of following the routine tradtional format.
Zulfikar Newton is concurrently active in different branches of literature, such as short stories, novels, and essays as he is reasonably conversant with philosophy, sociology, politics and current affairs of the world. The new generation is gradly attached to the writers neither the hostile forces of time nor the opposition of the fundamentalist elements can stifle the vital force of his creativity which is sustained by his insatiable curiosity, constant inquiry into life. Artistic style in diction and unflickering conscience, Zulfikar Newton’s firm, prominent and well-founded presence stands as a beacon in the midst of engulfing darkness, barbarity and immorality aflicting the social structure of human life-
Zulfikar Newton’s creative disposition is characterized by his clear and enlightened diction, humorous analysis of his subject and bold and well- balanced expositions of his theme. His discretionary power is open, enduring and sharp. Although he is bold enough to ridicule privileges claimed by either the majority people or the veteran elite class, he seems as disposed to accept the sensibilities of his predecessors as he is well-aware of his responsibility to the next generation while supporting individual rights of men; and on the whole he is an artist of language. His artistic pursuit may be compared to the absorbing workmanship of a potter who moulds the image as conceived in his mind on a lump of earth with his unshaken hand working on the lump to render exact and permanent shape to the image without excess and wastage of the material being used. As he has enriched his mental faculty by its constant exercise, he has also perfected his writing style with the selection of appropriate words and expressions. As a very close and virtuous fellowman, Zulfikar Newton always shares our thoughts and sentiments; for instance, upholding humanity, universal franchise, innate value of arts, individuality of man, freedom and equity of men and women, reliance on experience and intellect for knowledge, determining principles not on the basis of scripture or customs but on discretions; resisting all types of repression, lethargy and hypocracy and belief in human worth for self-development and creating history.
The chief literary attributes displayed by Zulfikar Newton as an artist and thinker in his essays include his capacity of objective and subjective reflection, sense of universality and tradition, diversified curiosity and liberal dispositions, uncompromising ethics and relentless inquisitiveness. Passion for life seasoned with moral values as displayed in his works is remarkable. On the whole, among the few rising literary aspirants in Bengali literature Zulfikar Newton can claim to be one who pursues his vocation as an extremely socially conscious and forceful writer. ( Introduction – A Golden Dream).
জুলফিকার নিউটনের রচনায় একই সঙ্গে মিশে থাকে যুক্তিবাদী বিশ্লেষণ, দার্শনিক মনন ও হার্দিক সংবেদন। তাঁর দেখার ধরন স্বতস্ত্র, লেখার ভঙ্গি স্বচ্ছ। গভীর কথাকেও নিতান্ত সহজ করে বলতে পারেন তিনি। যে প্রসঙ্গেই কিছু বলুন না তিনি তাঁর বক্তব্য শুনতেই হয়। তাঁর চিন্তা ঋজু ও যুক্তিপূর্ণ, মতামত দ্বিধাহীন ও অভিজ্ঞতাপুষ্ট। প্রসঙ্গ সাময়িক হলেও জীবনবোধ থেকে উৎসারিত বলে প্রতিটি মতামত অমূল্য। চিন্তার স্পষ্টতায়, ভাষার স্বচ্ছতায়, বিশ্লেষণের ব্যাপকতায়, উপলব্ধির গূঢ়তায়, প্রত্যয়ের দৃঢ়তায় জুলফিকার নিউটনের প্রবন্ধগুলি আক্ষরিক অর্থেই প্রবন্ধ। তাঁর একটি লেখাকেও অস্বীকার করা যায় না। এক কথায় নস্যাৎ করে দেওয়া যায় না তাঁর চিন্তার যুক্তি পরম্পরাকে। তিনি সেই বিরল প্রাবন্ধিকদের একজন যার রচনা পরবর্তীকালের হারায় না প্রাসঙ্গিকতা, যার চিন্তা আমাদের বহু ভাবনাচিন্তার সমস্যা সংকটের জট ছাড়াতে, কর্মপন্থা নির্বাচন করতে সহায়ক হয়ে উঠে।
জুলফিকার নিউটনের প্রবন্ধে প্রায় সর্বত্রই অসামান্য অর্ন্তদৃষ্টি ও ভাষার নিপুণতা লক্ষণীয়। তাঁর বৈদগ্ধ এবং সংবেদনশীলতা, তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির মৌলিকতা এবং যুক্তিবিন্যাসের দৃঢ়তা, তাঁর ভাষার গতিশীলতার লাবণ্য পাঠক হিসাবে আমাদের অভিভূত করে। সাম্প্রতিক লঘুচিত্ততার আবহে বীতশ্রদ্ধ, পৈশূন্যজারিত প্রতিন্যাসের আঘাতে আর্ত, কোন এক সদাশয় পাঠক যদি বাংলা ভাষায় মননশীল এবং সরস সাহিত্যের স্বাদ পেতে চান তবে তাঁর পাঠ্যক্রমে জুলফিকার নিউটনের রচনালীকে অবশ্যই অন্তর্ভূক্ত করতে হবে।
কবীর চৌধুরী
৪১ নয়াপল্টন, ঢাকা।