হোয়াট ইজ আর্ট – ৬

[শিল্প আনন্দের জন্য-এই মতবাদ কিভাবে সম্মানের আসন পেল? ধর্ম ভালোমন্দের পার্থক্য নির্দেশ করে। গির্জা-নির্দিষ্ট খ্রীষ্টধর্ম। রেনেসাঁস। উচ্চা শ্রেণীর সংশয়প্রবণতা। সৌন্দর্যের সঙ্গে মঙ্গলকে গুলিয়ে ফেলে তারা বিভ্রম সৃষ্টি করেন।

কিন্তু এটা কী করে সম্ভব হল, যে শিল্পকে প্রাচীন যুগে কোনমতে সহ্য করা হত (আদৌ হয়ে থাকেল) সেই শিল্প আমাদের কালে শুধুমাত্র আনন্দ দানের ক্ষমতার অধিকারী বলে অনিবার্য উৎকৃষ্ট বলে বিবেচিত হয়?

নিম্নোক্ত কারণের ফলেই শিল্পের এই পরিণাম ঘটেছে। শিল্পমূল্য সম্পর্কে ধারণা (অপর কথায় শিল্প-সঞ্চারিত অণুভূতি) মানুষের জীবনের অর্থ সম্পর্কীয় উপলব্ধির ওপর এবং জীবনের ক্ষেত্রে ভালোমন্দের দৃষ্টিভঙ্গির ওপর নির্ভরশীল। যে সমস্ত বস্তু ধর্ম নামে অভিহিত, তার পরিপ্রেক্ষিতে ভালোমন্দের সংজ্ঞাও নির্ণীত হয়।

নিম্নতর পর্যায়ের অপেক্ষাকৃত আংশিক অস্পষ্ট জীবনবোধের সীমা থেকে ব্যাপক ও স্বচ্ছতর জীবনবোধের অভিমুখে মানবজাতির অবিচ্ছিন্ন গতি অব্যাহত। সমস্ত আন্দোলনের মতো এই যাত্রাপথের নায়কও দেখা যায়। এঁরা অপরাপর ব্যক্তি থেকে জীবনের অর্থ অধিকতর স্বচ্ছ করে উপলব্ধি করেছেন। এ প্রাগ্রসর ব্যক্তিদের মধ্যে সর্বযুগে অন্তত একজন তাঁর কথা এবং জীবনের মাধ্যমে এই অর্থকে অপরাপর ব্যক্তি থেকে স্পষ্টতর, বিশদ এবং বিশদ এবং দৃঢ়ভাবে ব্যক্ত করেছেন। এ পর্যায়ের ব্যক্তির জীবন-মর্মার্থের অভিব্যক্তির সঙ্গে তাঁর স্মৃতিকেন্দ্রিক যে সমস্ত কুসংস্কার, ঐতিহ্য ও অনুষ্ঠানগুলি সাধারণত গড়ে ওঠে, তাই ধর্ম। নির্দিষ্টকালে বিশেষ সমাজ ব্যবস্থায় যে ধারণা সর্বোত্তম এবং প্রথম সারির ব্যক্তির নিকট অধিগম্য, সে উচ্চতম মানের জীবনবোধই ধর্মের স্বরূপ। সমাজের অবশিষ্ট অংশকেও এ জীবনবোধে উদ্বুদ্ধ হবার অভিমুখে অনিবার্য এবং দুর্নিবার গতিতে অগ্রসর হতে হবে। সুতরাং মানবিক হৃদয়ভাবের মূল্যায়নের ভিত্তিরূপে একমাত্র ধর্মই চিরকালের মতো এখনও ধারণ করে আছে। অনুভূতিসমূহ মানুষকে ধর্মনির্দেশিত আদর্শের যদি সন্নিকটবর্তী করে, ধর্মাদর্শের বিরোধিতা না করে মানবিক অনুভূতি যদি ধর্মাদর্শের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়-তবে সে সমস্ত অনুভূতি উত্তম। যে সব অনুভূতি মানুষকে ধর্মাদর্শ-বিচ্ছিন্ন করে এবং সে আদর্শের প্রতিরোধী, সেগুলি অবশ্যই মন্দ।

ইহুদিরা ধর্মনির্দিষ্ট জীবনের অর্থ খুঁজে পেয়েছিল অদ্বৈত ঈশ্বরের সাধনায় এবং যা তাঁর ইচ্ছারূপে প্রতিভাত তার অনুসরণের মধ্যে। যদি ভগবৎ প্রেম এবং তাঁর নির্দেশ পালনের আকাঙ্ক্ষা-উৎসারিত অনুভূতিসমূহ কাব্যশিল্পে, ভবিষ্যৎ প্রবক্তাদের দ্বারা, ভক্তিগীতির সাহায্যে অথবা জেনেসিস (Genesis) মহাকাব্যের মাধ্যমে সার্থকভাবে অপর মনে সঞ্চারিত হয়, তবে নিঃসন্দেহে তা উত্তম এবং উচ্চমানের শিল্প। এবং অনুরূপভাবে ভিন্ন দেশীয় দেবতার প্রতি ভক্তিভাবের উৎসার, অথবা ভগবৎ নির্দেশবিরোধী অনুভূতি সমূহকে অপর মনে সঞ্চারিত করে দেবার উক্ত ধর্মাদর্শ- পরিপন্থী প্রয়াস নিকৃষ্ট শিল্প বলে বিবেচিত হবে। গ্রীকেরা মনে করতেন, ধর্ম-নির্দেশিত জীবনের অর্থ নিহিত জাগতিক সুখ, সৌন্দর্য ও শান্তির মধ্যে। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে সার্থক জীবনানন্দ এবং জীবনবেগ-সঞ্চারক শিল্পই উৎকৃষ্ট বিবেচিত হবার যোগ্য। অপর পক্ষে মেয়েলি অনুভূতি ও নৈরাশ্যবোধের চেতনা-সঞ্চারক শিল্প তাদের নিকট নিকৃষ্ট বিবেচিত হত। বস্তুতপক্ষে স্ব-জাতির মঙ্গলবিধানের মধ্যে যদি জীবনের অর্থ অনুভব করা হয়, কিংবা রোমক ও চৈনিক জাতির মতো পূর্বপুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনে এবং তাদের জীবনের অনুবর্তনের মধ্যে যদি জীবনের সে অর্থ খুঁজে পাওয়া যায়, তবে যে শিল্প জনসাধারণের মঙ্গলার্থে ব্যক্তিস্বার্থ বিসজুনজনিত আনন্দের অনুভূতি সঞ্চার করে কিংবা পূর্বপুরুষদের গৌরব ঘোষণা এবং তাদের ঐতিহ্য অক্ষুণ্ণ রক্ষায় নিয়োজিত হয়, তবে তাও উৎকৃষ্ট শিল্প বলে বিবেচিত হবে। এবং যে শিল্পে এর বিপরীত অনুভূতির অভিব্যক্তি ঘটে, তা নিম্নমানের শিল্পের পর্যায়ে পড়বে। যদি পশুত্বের সীমা উত্তীর্ণ হওয়ার মধ্যে জীবনের অর্থ খুঁজে পাওয়া যায়, যেমন পেয়েছিলেন বৌদ্ধেরা, তাহলে আত্মার উন্নয়নে এবং দেহের দলনে সক্ষম সার্থক অনুভূতি-সঞ্চারক শিল্পই উত্তম শিল্প বলে অভিহিত হবে। অপর পক্ষে তীব্র দৈহিক বাসনার অনুভূতি-উদ্দীপক শিল্প-মাত্রই নিম্ন মানের শিল্পের পর্যায়ে পড়বে।

ভালোমন্দের ধারণা সম্পর্কে প্রত্যেক মানবগোষ্ঠীর সমভাবে গ্রহণযোগ্য প্রতিযুগে একটি ধর্মচেতনা আছে। এই ধর্মীয় উপলব্ধিই শিল্প-সঞ্চারিত অনুভূতি সমূহেরও মূল্য নির্ধারণ করে। ধর্মীয় চেতনার পরিপ্রেক্ষিতে যে সমস্ত শিল্প-সঞ্চারিত অনুভূতি সকল জাতির নিকট উত্তম বিবেচিত হত, সেগুলিই শুভজনক বলে স্বীকৃতি পেত এবং সেগুলিকেই উৎসাহিত করা হত। পরন্তু সাধারণ ধর্মচেতনার নিরিখে শিল্প-সঞ্চারিত যে সমস্ত অনুভূতি মন্দ বিবেচিত হত, সেগুলিকে বর্জন করা হত। বিস্তীর্ণ শিল্পরাজ্যের যে অবশিষ্টাংশের সাহায্যে মানুষ পারস্পরিক ভাব বিনিময় করে থাকে, তা তাদের নিকট শিল্পের মর্যাদাই পেত না। স্ব-যুগের ধর্মীয় উপলব্ধির বিপরীত স্রোতে প্রবাহিত হলেই সেগুলি মানুষের লক্ষ্যে আসত। সেগুলিকে তখন শুধুমাত্র বর্জন করা হত। গ্রীক, ইহুদি, ভারতীয়, মিশরীয় এবং চৈনিক-সমস্ত জাতির মধ্যে এই রীতির সর্বথা পরিদৃষ্ট হত। এবং খ্রীষ্টীয় ধর্মের আবির্ভাবের পরে তার ক্ষেত্রেও এটা সমান সত্য ছিল।

প্রথম কয়েক শতাব্দী পরিব্যাপ্ত খ্রীষ্টধর্ম একমাত্র লোককাহিনি, সাধু-সন্তদের জীবনী, ধর্মীয় উপদেশ, প্রার্থনা, খ্রীষ্ট প্রেম-উদ্বোধক স্তোত্রগান, তাঁর জীবন স্মরণে আবেগ, তাঁর দৃষ্টান্ত অনুসরণের আকাঙ্ক্ষা, আনুষ্ঠানিকভাবে ইহজীবন পরিত্যাগ, বিনয় এবং অপরের প্রতি ভালোবাসা প্রভৃতিকে উৎকৃষ্ট শিল্পসৃষ্টি বলে স্বীকৃতি জানিয়েছিল। ব্যক্তিগত সুখভোগের অনুভূতি প্রকাশকে সৃষ্টিকর্মকে মন্দ বিবেচনায় বর্জন করা হত। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, কেবলমাত্র মৃন্ময় প্রতীকী প্রতিকৃতিই তারা সহ্য করত, কিন্তু সমস্ত পৌত্তলিক ভাস্কর্যকে তারা বর্জন করেছিল।

এটা ঘটেছিল প্রথম দিককার কয়েক শতাব্দীর খ্রীষ্টানদের মধ্যে। এ কালসীমায় খ্রীষ্টানেরা খ্রীষ্টবাণীকে যথার্থরূপে গ্রহণ না করলেও পরবর্তী কালের মতো ঠিক তার বিকৃত, পৌত্তলিক রূপে স্বীকার করেনি।

কিন্তু কনসটেনটাইন (Constantine), সার্লমেন (Charlemagne), ভলাদিমির (Vladimir) প্রভৃতির কালে কর্তৃপক্ষের নির্দেশে জাতিসমূহের সম্পূর্ণাঙ্গ ধর্মান্তিকরণের সময় থেকে এই খ্রীষ্টধর্মের পাশাপাশি গির্জা-প্রভাবিত আর একটি খ্রীষ্টধর্মের অভ্যুদয় হল, যার বৈশিষ্ট্য খ্রীষ্টের উপদেশসম্মত নয়, বরং তা ছিল পৌত্তলিকতার সন্নিকটবর্তী। এই গির্জা-অনুমোদিত খ্রীষ্টধর্ম স্বীয় শিক্ষাদর্শের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে জনসাধারণের অনুভূতি এবং অনুভূতিসঞ্চারক শিল্পসৃষ্টিকে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে মূল্যায়ন করেছিল।

গির্জা-অনুসৃত এই খ্রীষ্টধর্ম প্রকৃত খ্রীষ্টধর্মের মৌলিক এবং সারবস্তুকেই যে শুধু অস্বীকার করেছিল তা নয়,-জগৎপিতার সঙ্গে প্রত্যেক মানুষের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক, সেই ভাবপ্রসূত ভ্রাতৃত্ব, সর্বমানব-সাম্য, যে কোন প্রকার হিংসার স্থলে বিনয় ও প্রেমের স্থাপনকে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। অপরপক্ষে অনেকটা পৌত্তলিক পুরাণের সঙ্গে সাদৃশ্য রেখে এবং স্বর্গীয় দেবতাদের ক্রমোচ্চ শ্রেণীবিভাগ স্থাপন করে খ্রীষ্ট উপাসনা, সাধু উপসনা, শহীদ উপাসনার মাধ্যমে সমস্ত দৈবসত্তার উপাসনামাত্র নয়, তাদের মূর্তি উপাসনারও প্রবর্তন করে এই নব পর্যায়ের খ্রীষ্টধর্ম লোকের মনে গির্জা এবং তার নির্দেশ সম্পর্কে একটি অন্ধ বিশ্বাস উৎপাদন করল, এবং তার মধ্যেই ধর্মবাণীর সারবস্তু নিহিত-এটি প্রতিপাদন করল।

খ্রীষ্টধর্মের এই নববিধান প্রত্যেক খ্রীষ্টধর্ম থেকে যতই দূরবর্তী হোক না কেন, এবং প্রকৃত খ্রীষ্টধর্মের তুলনায় শুধু নয়, এমনকি জুলিয়ান এবং অপর রোমানদের জীবনধারণার তুলনায় যতই নিম্নমানের হোক না কেন, যে সমস্ত বর্বর শ্রেণীর লোক এই ধর্মশিক্ষা গ্রহণ করেছিল, সে শিক্ষা তাদের নিকট ভূতপূর্ব দেব উপাসনা, বীর স্তব, শুভ এবং অশুভ বুদ্ধির প্রেতাত্মা সমূহের উপাসনা থেকে উচ্চ পর্যায়ের ধর্মতত্ত্ব বলে বিবেচিত হয়েছিল। সুতরাং এ ধরনের শিক্ষাই তাদের জীবনে ধর্মের স্থান গ্রহণ করেছিল এবং এই ধর্মভিত্তির পরিপ্রেক্ষিতেই সে যুগের শিল্পমূল্য নির্ণিত হত। যে শিল্প গির্জা ধর্মের প্রতি অন্ধ বিশ্বাস এবং অনুবর্তিতার নির্দেশ এবং মৃত্যুর পরে শাস্তির ভয় এবং শান্তির আনন্দময় আশ্বাস থাকত-সে শিল্প উৎকৃষ্ট বিবেচিত হত। এই ধর্মধারণার বিপরীতপন্থী সমস্ত শিল্পকেই নিকৃষ্ট বলে মনে করা হত।

যে ধর্মশিক্ষার উপর ভিত্তি করে এ শিল্পের উদ্ভব হয়েছিল তা খ্রীষ্টের ধর্মবাণীর বিকৃতি। কিন্তু এ বিকৃত শিক্ষাভিত্তিক শিল্পকেই প্রকৃত শিল্প ভাবা হত, যেহেতু জনসাধারণের জীবনোদ্ভুত এই শিল্পের সঙ্গে তাদের ধর্মীয় জীবনদৃষ্টির যথেষ্ট সাদৃশ্য ছিল।

মধ্যযুগের শিল্পীরা ছিলেন জনগণের মতো একই ধর্মীয় অনুভূতি দ্বারা উদ্দীপ্ত। তাদের অভিজ্ঞতালব্ধ অনুভূতি এবং মানসিক অবস্থাকে স্থাপত্য, ভাস্কর্য, চিত্রশিল্প, সংগীত, কাব্য-নাটকে সঞ্চারিত করে দিয়েছিলেন বলেই তাঁরা খাঁটি শিল্পী পদবাচ্য। তাঁদের শৈল্পিক ক্রিয়া স্ব-যুগে অধিগম্য উচ্চতম উপলব্ধির ওপরই শুধু প্রতিষ্ঠিত ছিল না, সে শিল্পে প্রবেশাধিকার ছিল সমগ্র জনসমাজের। এ যুগে সে শিল্প নিম্নমানের বিবেচিত হতে পারে-তথাপি সে শিল্প উপভোগে সমগ্র জাতি অংশীদার ছিল বলে তা খাঁটি শিল্প। ইউরোপীয় সমাজের অভিজাত, বিত্তবান, অধিকতর শিক্ষিত শ্রেণীর মনে গির্জা অনুসৃত খ্রীষ্ট ধর্মে অভিব্যক্ত জীবনবোধ বিষয়ে সন্দেহ উপস্থিত হওয়া পর্যন্ত এই ছিল শিল্প জগতের পরিস্থিতি। ধর্মযুদ্ধের (Crusades) পরবর্তীকালে যাজকশক্তির সর্বোচ্চ পরিমাণ বিকাশ এবং আনুষঙ্গিক বিকৃতি ঘটবার পর বিত্তবান শ্রেণীর লোকেরা ক্লাসিক সাহিত্যধৃত জ্ঞানজগতের সঙ্গে পরিচিত হলেন। একদিকে তাঁরা দেখলেন প্রাচীন ঋষি- প্রচারিত শিক্ষার যুক্তিপূর্ণ প্রাঞ্জলতা, অপরদিকে খ্রীষ্টীয় উপদেশবাণীর সঙ্গে গির্জা- মতবাদের অসঙ্গতি। সে অবস্থায় গির্জা-প্রচারিত ধর্মোপদেশের ওপর আস্থা অক্ষুণ্ণ রাখা তাঁদের পক্ষে অসম্ভব হল।

বাহ্যত গির্জা-অনুসৃত শিক্ষার আনুগত্য স্বীকার করলেও তাঁরা বেশিকাল সে শিক্ষায় আস্থা স্থাপন করতে পারেননি। শুধুমাত্র নিষ্ক্রিয়তা এবং জনসাধারণের ওপর প্রভাব বিস্ত ারের উদ্দেশ্যেই তাঁরা সে শিক্ষাকে আঁখড়ে ছিলেন। জনসাধারণের মনে গির্জা মতবাদে অন্ধবিশ্বাস তখনও অক্ষুণ্ণ। অভিজাত শ্রেণীর লোকেরা নিজেদের সুবিধার জন্য ওই অন্ধ বিশ্বাসকে উৎসাহিত করা প্রয়োজন বোধ করতেন।

এভাবে একটা সময় উপস্থিত হল, গির্জা-অনুসৃত খ্রীষ্টধর্ম যখন সকল খ্রীষ্ট ধর্মাবলম্বী মানুষের নিকট আর সাধারণ ধর্মীয় মতবাদের স্বীকৃতি পেল না। তবে কিছু অংশ-অজ্ঞ জনসাধারণ অন্ধভাবে তা অনুসরণ করেই চলল। কিন্তু অভিজাত শ্রেণী-শুধু যাদের হাতেই ক্ষমতা ও বিত্তের অধিকার ছিল এবং সেই কারণেই শিল্পসৃষ্টি ও তার উৎসাহ দানে যাদের অখন্ড অবসর ছিল, তারা ওই ধর্মে আর বিশ্বাসী ছিলেন না। খ্রীষ্টধর্মের আবির্ভাবের পূর্বে শিক্ষিত রোমানদের যে মনোভাব ছিল, অভিজাত শ্রেণীর মনোভাবও ঠিক তদনুরূপই হয়ছিল। জনসাধারণের অনুসৃত ধর্মে তাঁরা আর আস্থাবান ছিলেন না। অথচ যে ক্ষয়িষ্ণু গির্জা-মতবাদ তাঁদের নিকট অর্থহীন অনুভূত হয়েছিল, সে স্থান পূরণ করবার মতো এমন কোন ধর্মবিশ্বাসও তাদের ছিল না।

উভয় শ্রেণীর ধর্মবিশ্বাস পার্থক্য ছিল মাত্র এখানে : যে স্থলে রোমানেরা সম্রাটের দেবত্ব এবং গৃহদেবতার ওপর বিশ্বাস হারিয়েছিলেন এবং বিজিত জাতির কাছে ধার-করা সমস্ত জটিল পৌরাণিক কাহিনি থেকে আর বেশি কিছু নিষ্কাশন সম্ভব ছিল না, এবং সে কারণেই তাদের পক্ষে জীবন সম্পর্কীয় সম্পূর্ণ নতুন ধারণা অনুসন্ধান করার প্রয়োজন অনুভূত হয়েছিল, সেই স্থলে মধ্যযুগের মানুষের মনে গির্জা-অনুসৃত ধর্ম-শিক্ষার সত্য সম্পর্কে সংশয় উপস্থিত হবার পর তাদের নতুন কিছু অনুসন্ধানের প্রয়োজন ছিল না। যে খ্রীষ্ট্রীয় ধর্মদেশনাকে বিকৃত রূপে তাঁরা গির্জা-মতবাদ বলে স্বীকার করতেন, সে দেশনার মধ্যে ভাবীকালের মানবিক পথ-নির্দেশ বহু পূর্ব থেকেই চিহ্নিত ছিল। কাজেই তাদের একমাত্র করণীয় ছিল সমস্ত বিকৃতি ও আবরণ থেকে খ্রীষ্টবাণীকে মুক্ত করা এবং তার প্রকৃত তাৎপর্যকে গ্রহণ করা -পূর্ণভাবে না হলেও অন্তত গির্জা অপেক্ষা অধিকতর পরিমাণে সেই সত্যবাণীকে আত্মস্থ করা। এটি আংশিকভাবে সম্পন্ন হয়েছিল শুধুমাত্র ওয়াইক্লিফ (Wyclif), হুস, (Huss), লুথার ও কেলভিনের সংস্কারকার্যে নয়, বরং গির্জা-বহির্ভূত সমগ্র খ্রীষ্টীয় ধর্মমত-বিশ্বাসীরা এ সংস্কারকার্যে হাত লাগিয়েছিলেন। পূর্বযুগে এদের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন পলিসিয়ান (Paulicians)- রা ও বোগোমাইলিটিস (Bogomilities)-রা, এবং পরবর্তীকালে ওয়ালডেনসেস্ (Waldenses) এবং ধর্মোদ্রোহী নামে আখ্যাত অপরাপর গির্জা-বহির্ভূত খ্রীষ্টানরা। শাসন ক্ষমতায় যাদের অধিকার নেই এমন দরিদ্র ব্যক্তিদের দ্বারাই এই সংস্কারকার্য সম্ভব হতে পেরেছিল এবং মুখ্যত তাদের দ্বারাই এই সংস্কার সাধিত হয়েছিল। বিত্তবান এবং শক্তিমান ব্যক্তিদের কেউ কেউ, যেমন অ্যাসিসির ফ্রান্সিস (Francis of Assisi) এবং অপরাপর কোন ব্যক্তির সামাজিক বিশেষ অধিকার ক্ষুণ্ণ হওয়া সত্ত্বেও তারা খ্রীষ্টের উপদেশবাণীকে পূর্ণ তাৎপর্যে গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু উচ্চতর শ্রেণীর অধিকাংশ লোকের পক্ষে (যদিও আত্মার গভীরে তাঁরা গির্জার ধর্মশিক্ষায় বিশ্বাস হারিয়েছিলেন) অনুরূপভাবে কাজ করা সম্ভব হয়নি বা সে ধারায় কাজ করতে তাঁরা ইচ্ছুকও হননি। এর কারণ, গির্জা-প্রচারিত ধর্মীয় বিশ্বাস বর্জন করবার পর খ্রীষ্টীয় জীবনদৃষ্টির যে সারবস্তু তাদের সামনে গহীত হবার জন্য প্রস্তুত হয়েছিল, তার বৈশিষ্ট্য ছিল মানবভ্রাতৃত্বের (সুতরাং সাম্যের) শিক্ষা। তাঁরা যে সমস্ত বিশেষ সুযোগ-সুবিধার মধ্যে লালিত ও বর্ধিত হয়েছিলেন, শিক্ষিত হয়েছিলেন এবং যে সমস্ত সুযোগ-সুবিধা ভোগে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন, ভ্রাতৃত্ববোধের নীতির দ্বারা তা ধিক্‌কৃত হত। যে গির্জা- প্রচারিত শিক্ষা স্বীয় যুগের পক্ষে ছিল অনুপযোগী এবং তাদের নিকট তাৎপর্যহীন, অন্ত রের গভীরে সে শিক্ষায় তারা বিশ্বাস হারিয়েছিলেন। ওদিকে তাঁদের মনে প্রকৃত খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণের বলিষ্ঠতাও ছিল না। এ অবস্থায় ধর্মযাজকশ্রেণী (পোপ), রাজা, সামন্ত শ্রেণী (ডিউক) এবং দেশের সমস্ত গণ্যমান্য ক্ষমতাবানেরাই কোন প্রকার ধর্মীয় অবলম্বন ব্যতীত শুধুমাত্র ধর্মের বাহ্য রূপ নিয়েই সন্তুষ্ট রইলেন। যেহেতু ধর্মের এই বাহ্য রূপের সমর্থন তাদের পক্ষে লাভজনক এবং তাদের বিশেষ অধিকার ভোগের পোষক বলে প্রয়োজনীয় ছিল। বস্তুতপক্ষে আমাদের যুগের প্রথম কয়েক শতাব্দীর রোমানদের মতো এ সমস্ত ব্যক্তি কোন কিছুতেই বিশ্বাস করতেন না। অথচ এঁরাই ছিলেন ক্ষমতা বিত্তবান শ্রেণীর মানুষ; এঁরাই ছিলেন শিল্পকর্মের পুরস্কারদাতা ও পরিচালক।

এখানে একটি মন্তব্য করা প্রয়োজন। ঠিক এ পর্যায়ের মানুষের মধ্যেই এক বিশেষ ধরনের শিল্প বিকাশ লাভ করল। সে শিল্পকে মর্যাদা দেওয়া হত মানুষের ধর্মীয় অনুভূতির সার্থক অভিব্যক্তির জন্য নয়, বরং তার সৌন্দর্যের আনুপাতিক পরিপ্রেক্ষিতে -অপর কথায় তার আনন্দ পরিবেশনের সামর্থ্য অনুসারে।

গির্জা-অনুমোদিত ধর্মের ভ্রান্তি ধরা পড়ায় ঐশ্বর্যশালী এবং ক্ষমতাবান ব্যক্তিরা সে ধর্মের ওপর আর বেশিকাল আস্থা স্থাপন করতে পারলেন না। প্রকৃত খ্ৰীষ্টীয় ধর্মদেশনা তাঁদের সামগ্রিক জীবনধারাকে সমর্থন না করায় সে ধর্মে আনুগত্য স্বীকারেও তারা অক্ষম হলেন। ফলে এ সমস্ত বিত্তবান ও ক্ষমতাশালী মানুষ ধর্মবোধবর্জিত হয়ে স্বভাবতই পৌত্তলিক দৃষ্টিভঙ্গির জগতে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন-যে দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্তিগত সুখভোগের মধ্যে জীবনের অর্থ প্রতিষ্ঠ করে। অতঃপর উচ্চতর সমাজের মধ্যে রেনেসাঁস নামে আখ্যাত বিজ্ঞান ও শিল্পের পুনরুজ্জীবন ঘটল। এই রেনেসাঁস প্রত্যেক ধর্মের শুধু অস্বীকৃতি মাত্র নয়, বরং ধর্ম যে অপ্রয়োজনীয়-তারই দৃঢ় ঘোষনা।

গির্জা মতবাদ এত সংসক্ত একটা পদ্ধতি যে, সম্পূর্ণ বিনষ্ট না করে তার পরিবর্তন বা সংশোধন করা সাধ্য নয়। পোপ যে অভ্রান্ত এ বিষয়ে সংশয় উপস্থিত হবার সঙ্গে সঙ্গে (সকল শিক্ষিত ব্যক্তির মনেই তখন এ সংশয় ছিল) ধর্মীয় ঐতিহ্যের সত্য সম্পর্কেও অনিবার্য সংশয় দেখা দিল। কিন্তু ঐতিহ্যের সত্য সম্পর্কীয় সংশয় রোমান ক্যাথলিক ধর্ম এবং বিশ্বজনীন উদার-চিত্ততার পক্ষেই শুধু মারাত্মক ছিল না, প্রথাবদ্ধ ধারণা সহ সমগ্র গির্জা-মতবাদ, খ্রীষ্টের ঈশ্বরত্ব, তাঁর পুনরভ্যুত্থান এবং ত্রিত্ববাদ সম্পর্কেও মারাত্মক ছিল এবং এই সংশয় শাস্ত্রের কর্তৃত্ব এবং শাসনকেও অস্বীকার করত, যেহেতু ওই শাস্ত্র গির্জার ঐতিহ্যের দ্বারাই অনুপ্রাণিত।

সুতরাং সে যুগের উচ্চতম শ্রেণীর অধিকাংশ ব্যক্তি-এমনকি পোপ এবং পাদ্রিরাও আদৌ কোন কিছুর ওপর আস্থাবান ছিলেন না। গির্জার মতবাদে তাঁদের বিশ্বাস ছিল না, যেহেতু সে মতবাদ যে দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিল, তা তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন। খ্রীষ্টের নৈতিক এবং সামাজিক শিক্ষাকে স্বীকৃতি জানাতে গিয়ে তাঁরা অ্যাসিসির ফ্রান্সিস্য (Francis of Assisi) এবং chelczic-এর (Peter of chelczic) পটার এবং অধিকাংশ প্রচরিলত ধর্মমতবিরোধীদের অনুসরণ করতে পারেননি-কারণ সে শিক্ষা তাঁদের সামাজিক মর্যাদা ক্ষুণ্নকারী। সুতরাং এঁরা সর্বপ্রকার ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি বর্জিত হয়েই রইলেন। এবং এই অবস্থায় একমাত্র ব্যক্তিগত সুখভোগ ছাড়া তাদের সামনে শিল্প- বিচারের এমন কোন মানদন্ড ছিল না যার সাহায্যে তারা সৎ শিল্পের মানদন্ড হিসেবে মেন নেওয়ার ইউরোপীয় সমাজের এই উচ্চ শ্রেণীর ব্যক্তিবর্গ শিল্প সম্পর্কীয় ধারণায় প্রাচীন গ্রীকদের স্থূল শিল্পবোধের জগতে ফিরে গিয়েছিলেন-যে ধারণাকে প্লেটো ইতিপূর্বে ধিক্‌কৃত করেছিলেন। এই জীবনবোধের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে একটি শিল্প- মতবাদও গঠিত হয়েছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *