১৩
[স্বাগনারের ‘Nibelungen Ring’ এ ধরনের কৃত্রিম শিল্প। এর সাফল্য এবং তার কারণ।]
আমাদের শ্রেণীর এবং কালের মানুষ কি পরিমাণে অকৃত্রিম শিল্প উপলব্ধির ক্ষমতা বঞ্চিত হয়ে শিল্পের সঙ্গে সাদৃশ্যহীন বস্তুকে শিল্পের পর্যাদা দিতে অভ্যস্ত হয়েছে, তার সব চাইতে বড় দৃষ্টান্ত রিচার্ড হ্বাগ্নারের রচনাবলী। তাঁর রচনা ইদানীং শুধুমাত্র জার্মানদের দ্বারাই যে ক্রমে অধিকতর সমাদৃত হচ্ছে তা নয়, নতুন দিগন্ত উন্মোচনকারী সর্বোচ্চ শিল্পরূপে ফরাসি এবং ইংরেজদের কাছেও সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাগনারের সুপরিচিত সংগীত বৈশিষ্ট্য এই : কবিকর্মের সমস্ত বৈশিষ্ট্য অভিব্যক্তি সহ সংগীথ হবে কবিতার অনুসারী।
পঞ্চদশ শতাব্দীতে ইতালীতে উদ্ভাবিত হয় নাটকের সঙ্গে সংগীতের মিশ্রণইে ধারণায় যে, এর দ্বারা তারা প্রাচীন গ্রীক সংগীত-নাটকের পুনরুজ্জীবন ঘটাবে। আঙ্গিকের দিক থেকে কৃত্রিম হওয়ায় তা পূর্বাপর সার্থকতা লাভ করেছিল একমাত্র উচ্চবর্গীয় মানুষের মধ্যে। তাদের মধ্যে প্রতিভাবান সুরকার-যেমন মোৎসার্ট (Mozart), হেববার (ডবনবৎ), রসিনি (Rossini) প্রভৃতি কোন নাটকীয় বিষয় থেকে অনুপ্রেরণা লাভ করে স্বেচ্ছায় সে প্রেরণার অনুবর্তী হয়েছেন এবং কথাবস্তুকে সংগীতের নিয়ন্ত্রণাধীন করেছেন। কাজে কাজেই তাঁদের গীতাভিনয়ে শোতার কাছে একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ জিনিস ছিল শুধুমাত্র কথাবস্তুর ওপর সংগীতের কারিগরি, কথাবস্তুর আদৌ কোন গুরুত্ব ছিল না। সেই কথাবস্তু এধমরপ ঋষঃব-এর মতো কোন নাটকে সম্পূর্ণ উদ্ভট প্রতীয়মান হলেও শৈল্পিক রসসংবেদনা সৃষ্টিতে সংগীতের পক্ষে কোন বাধার সৃষ্টি করেনি।
সংগীতকে কবিতার দাবি মেনে নিতে বাধ্য করে এবং কবিতার সঙ্গে মিশ্রণ ঘটিয়ে বাগনার গীতাভিনয়কে সংশোধন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু প্রত্যেক শিল্পের সুনির্দিষ্ট নিজস্ব এলাকা আছে, যা অপর শিল্পসমূহের সঙ্গে একাত্ম নয়-একটি শিল্প অপর শিল্পের সংস্পর্শে আসে মাত্র। সুতরাং যদি দেখা যায়, বহু নয়, দুটি মাত্র শিল্পও-যেমন নাটক এবং সংগীত-যদি একটি সামগ্রিক সৃষ্টিকর্মের মধ্যে সম্মিলিত হয়, তাহলে এদের যে কোন একটি শিল্পের দাবি অপর শিল্পের দাবি পূরণকে অসম্ভব করে তুলবে। এটা সাধারণত গীতাভিনয়ে অর্থাৎ অপেরায় সর্বদাই ঘটত দেখা যায়-যেখানে নাট্যশিল্প সংগীতের আনুগত্য স্বীকার করেছে বা সংগীতকে সম্পূর্ণ স্থান ছেড়ে দিয়েছে। হ্বাগ্নার চান, সংগীত -শিল্প নাট্টীয় শিল্পের আনুগত্য স্বীকার করুক এবং পূর্ণ শক্তি নিয়ে দুটিরই আবির্ভাব ঘটুক। কিন্তু এটা কোনমতেই সম্ভব নয়, যেহেতু শিল্পকর্ম মাত্রকেই অকৃত্রিম হতে হলে তা হবে শিল্পীর আন্তরিক অনুভূতির অভিব্যক্তি, একান্তভাবে স্বাতন্ত্র্যপূর্ণ এবং অপর যে কোন কিছুর সঙ্গে সাদৃশ্যহীন। প্রকৃত শিল্পপদবাচ্য হতে হলে সাংগীতিক সৃষ্টিকর্ম কিংবা নাট্যশিল্পকর্ম এরূপই হবে। সুতরাং কোন একটি শিল্পশাখার সৃষ্টিকর্ম অপর একটি শাখার সৃষ্টিকর্মের সঙ্গে সর্বতোভাবে একাত্ম হওয়ার মানে অসম্ভবেরই প্রত্যাশা করা। অর্থাৎ বিভিন্ন শিল্পরাজ্যের দুটি শিল্পকর্ম হ ব সম্পূর্ণ মৌলিক, পূর্ববর্তী সব কিছু থেকে স্বতন্ত্র। এবং তবু তারা সর্বতোভাবে মিলে যাবে, একাত্ম হবে।
কিন্তু দুটি মানুষ, এমনকি গাছের দুটি পাতাও যেমন ঠিক এক রকম দেখতে পাওয়া যায় না, তেমনি এমনটিও হতে পারে না। সাংগীতিক এবং সাহিত্যিক -পৃথক শিল্পরাজ্যের বিষয় বলে এই দুই পর্যায়ের শিল্পকর্ম সম্পূর্ণ সাদৃশ্যযুক্ত হবার সম্ভাবনা তো আরও কম। যদি সেগুলি সর্বতোভাবে মিলে যায় তবে বুঝতে হবে, একটি প্রকৃত শিল্পকর্ম এবং অপরটি কৃত্রিম অথবা দুটিই কৃত্রিম। দুটি সজীভ পাতা ঠিক এক রকম হয় না, অথচ দুটি কৃত্রিম পাতা একই রকম হতে পারে। এই সত্য শিল্পকর্মের বেলায়ও প্রযোজ্য। দুটি শিল্পকর্মের তখনই সর্বতোভাবে মিলন ঘটবে পারে যদি কোনটিই শিল্পপদবাচ্য না হয়,-পরন্তু দুটিই শুধুমাত্র চাতুর্যের সঙ্গে উদ্ভাবিত কৃত্রিম শিল্প হয়।
স্তোত্র, গান, রোমান্সের ক্ষেত্রে এই সংযুক্তি ঘটলেও (যদিও এগুলির মধ্যে হ্বাগ্নার- অভিপ্রেত সংগীত প্রত্যেকটি কবিতা-পংক্তির পরিবর্তনের অনুষঙ্গী হয় না, বরং গান এবং সংগীতধ্বনি মনের ওপর শুধুমাত্র সমিল ধ্বনি বিস্তার করে)। এরূপ ঘটার একমাত্র কারণ, গীতিকবিতা ও সংগীত কিয়ৎপরিমাণে একই লক্ষ্যাভিমুখী : সে লক্ষ্য এমন একটি মনোভাবের সৃষ্টি-যাতে গীতিকবিতা এবং সংগীতের প্রভাব অল্পবিস্তর একাত্মতা লাভ করে। কিন্তু এরূপ সংযুক্তির মধ্যেও আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু সব সময় দুটি সৃষ্টিকর্মের একটির মধ্যে নিহিত থাকে,-যাতে তাদের মধ্যে কেবলমাত্র একটিই শিল্প-সংবেদনার সৃষ্টি করে, এবং অপরটি মনোযোগের অযোগ্য থেকে যায়। মহাকাব্য, নাট্যকাব্য এবং সংগীতের এরূপ একত্র সংযুক্তি আরও অসম্ভব।
এ ছাড়া সর্বপ্রকার পূর্ব-পরিকল্পিত দাবি থেকে শিল্পীর সম্পূর্ণ মুক্তি শিল্প-সৃষ্টির মুখ্য শর্তগুলির মধ্যে অন্যতম। তাঁর সাংগীতিক কর্মকে অপর একটি শিল্পরাজ্যের সৃষ্টিকর্মের সঙ্গে সমন্বিত করার প্রয়োজন এ ধলনের একটি পূর্বপরিকল্পিত দাবি-যা সৃজনীশক্তির সমস্ত সম্ভাবনাকে বিনষ্ট করে দিতে পারে। সুতরাং এ পর্যায়ের সমন্বিত কর্মগুলি (যেমন সব সময় ঘটে আসছে) শিল্পকর্ম তো নয়ই, বরং রোমান্টিক মিলনান্তক নাটকের সংগীতের মতো, চিত্রের শিরোনামের মতো, বইয়ের চিত্রগুলির মত এবং দীর্ঘ গীতাভিনয়ের সংলাপের মতো শিল্পের অনুকৃতি হতে বাধ্য।
হ্বাগ্নারের সৃষ্টিকর্মগুলিও এই পর্যায়ের। হ্বাগ্নারের নতুন সংগীতে অকৃত্রিম শিল্পকর্মের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলির অস্তিত্বহীনতার মধ্যেই এই মতের সমর্থন মিলবে। অর্থাৎ এই সংগীতে সেই সমগ্রতা এবং সম্পূর্ণতা নেই-যা থাকলে আঙ্গিকের সামান্যতম পরিবর্তনেও সামগ্রিক সৃষ্টিকর্মটির অর্থ বিচলিত হয়। যেমন কোন শারীরিক জীবের জীবন বিনষ্ট না করে তার দেহের এক স্থান থেকে একটি প্রত্যঙ্গ সরিয়ে অপর এক স্থানে সেটি স্থাপন করা অসম্ভব, তেমনি কবিতা, নাটক, চিত্র, গান, সিম্ফনি প্রভৃতি যে কোন প্রকৃত শিল্পকর্মের অঙ্গ থেকে শিল্পের তাৎপর্য ক্ষুণ্ণ না করে একটি ছত্র, একটি দৃশ্য, একটি মূর্তি, একটি ‘বার’-এর (bar) স্থানান্তরিতকরণ কোনক্রমেই সম্ভব নয়। কিন্তু হ্বাগ্নারের শেষ পর্যায়ের সংগীতে স্বল্প গুরত্বপূর্ণ কোন অংশ ব্যতীত (যেগুলির স্বতন্ত্র তাৎপর্য বিদ্যমান) সকল প্রকার স্থান পরিবর্তনই সম্ভব, অর্থাৎ সাংগীতিক অর্থের ব্যত্যয় না ঘটিয়ে পূর্ববর্তীকে পশ্চাদ্বর্তী অথবা বিপরীতক্রমে সাজানো সম্ভব। বাগনারের সংগীতে অংশবিশেষের এই স্থান পরিবর্তন যে সংগীতের অর্থবোধের কোন পরিবর্তন করে না, তার কারণ সে অর্থ কথার মধ্যেই নিহিত,-সংগীতের মধ্যে নয়।
আজকাল এমন পদ্য-লিখিয়ে দেখা যায়, যাদের সংখ্যা বলতে গেলে অজস্র-যারা পদ্য লেখার কায়দাকানুন এমন রপ্ত করেছে যে, যে কোন বিষয়ে যে কোন ছন্দ-মিলে তারা পদ্য লিখতে পারে এবং যা শুনলে মনে হয় বুঝিবা তার কিছু অর্থ আছে। এমনি একজন পদ্য-লিখিয়ের যদি ইচ্ছা হয়, সে বেটোফেনের কোনো সোনাটা বা সোপার কোন বালাদকে (ballade) এইভাবে পদ্যে রূপায়িত করবে : এক ঠাটের প্রথম তানগুলির সে নিজের জ্ঞানবুদ্ধিমতো পদ্যরূপ দিল। এর পরে এলো অন্য ধরনের ঠাটের কিছু তান। সে তার জ্ঞানবুদ্ধিমতো আবার এগুলির পদ্যরূপ দিল। যদিও প্রথম পদ্যগুলির সঙ্গে দ্বিতীয় পর্যায়ের পদ্যপংক্তির কোনই আন্তরিক সংযোগ থাকল না এবং হয়ত বা তা ছন্দ-মিল-ছুট্ হল। এইরূপ একটি বস্তু সংগীতবর্জিত হলে যা দাঁড়াবে, হ্বাগ্নারের গীতাভিনয়গুলির সংগীত যদি তাদের কথাবস্তু ছাড়া শোনা যেত, তা সে রকমই দাঁড়াত।
কিন্তু বাগনার শুধুমাত্র সংগীতজ্ঞ নন, -তিনি কবিও, অথবা তিনি সংগীতজ্ঞ এবং কবি দুই-ই। সুতরাং বাগনারকে বিচারের জন্য তাঁর ঠিক সেই ধরনের কবিতার সঙ্গে পরিচিত আবশ্যক, যে ক্ষেত্রে সংগীতকে কবিতার অনুবর্তী হয়ে চলতে হয়। হ্বাগ্নারের মুখ্য কাব্যধর্মী সৃষ্টি ‘নিবেলুঙ্গেন রিঙ্’ (Nibelungen Ring)। আমাদের যুগে এ গ্রন্থখানি এত বেশি গুরুত্ব অর্জন করেছে এবং শিল্পসৃষ্টি বলে স্বীকৃত সমস্ত কিছুর ওপর এত অধক পরিমাণ প্রভাব বিস্তার করেছে যে আজকের দিনে এ গ্রন্থখানি সম্পর্কে প্রত্যেকেরই কিছু ধারণা থাকা আবশ্যক। এ গ্রন্থধৃত চারখানি পুস্তিকা আমি খুব যত্নের সঙ্গে পড়ে তার একটি সংক্ষিপ্তসারও রচনা করেছি। সে সংক্ষিপ্তসার তৃতীয় নম্বর পরিশিষ্টে আমি সন্নিবিষ্ট করেছি। আমি পাঠককে উচ্চকণ্ঠে পরামর্শ দেব (যদি তিনি সে কবিতা যত্নের সঙ্গে পাঠ না করে থাকেন, -যদিও পাঠ না করাটাই তার পক্ষে সর্বোত্তম হতো) এই অনন্যসাধারণ গ্রন্থ সম্পর্কে কিছু ধারণার জন্য আমার বিবরণটি পড়ে দেখতে। এটি কৃত্রিম শিল্পের একটি আদর্শ এবং এত স্থূলতাধর্মী যে হাস্যকর বলেও অভিহিত করা যায়।
বাগনারের সৃষ্টিকর্মে মঞ্চে প্রত্যক্ষ না করলে তার বিচার অসম্ভব-এমন মন্তব্য করা হয়েছে। এই নাটকের ‘দ্বিতীয় দিন’ (Second Day) সমস্ত গ্রন্থের মধ্যে শ্রেষ্ঠ অংশ বলে আমাকে জানানো হয়েছিল। এই অংশটি গত শীতে মস্কোতে অভিনীত হবার সময় আমি সে অভিনয় দেখতে গিয়েছিলাম।
উপস্থিত হবার পর দেখা গেল বিরাট প্রেক্ষাগৃহ আগাগোড়া লোকে ঠাসা। তার মধ্যে রয়েছেন বড় বড় ডিউক, সেরা অভিজাতবর্গ, বণিক শ্রেণী, বিদগ্ধ ব্যক্তিবর্গ এবং মধ্যশ্রেণীর আমলাবর্গ। প্রায় সকলের হাতেই গীতাভিনয়ের কথাবস্ত (libetto) এবং সকলেই তার মর্মগ্রহণে অভিনিবিষ্ঠ ছিলেন। সংগীতবেত্তাগণের মধ্যে কেউ কেউ ছিলেন বয়স্ক শুভ্রকেশ ব্যক্তি। তাঁদের হস্তধৃত সংগীতের স্বরলিপি তাঁরা অনুসরণ করছিলেন। নিঃসন্দেহে এই সংগীতানুষ্ঠানটি ছিল একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।
আমার কিছুটা দেরি হয়ে গিয়েছিল। অবশ্য আমাকে বলা হল, যে ক্ষুদ্র প্রস্তাবনা দিয়ে অঙ্কটি শুরু হয়েছে তার গুরুত্ব বেশি নয়, এবং সেটি দেখার সুযোগ নষ্ট হওয়ায় কোন ক্ষতি হয়নি। আমি উপস্থিত হয়ে দেখলাম একজন অভিনেতা রঙ্গমঞ্চের ওপর একটি গুহাদৃশ্যের মধ্যে উপবিষ্ট। তার সামনে কামারের হাপর-সদৃশ কিছু একটা বিদ্যমান। তার পরিধানে ছিল হাতে বোনা গরম উলের আঁটোসাঁটো পরিচ্ছদ, গায়ে ছিল চামড়ার ঢিলা আংরাখা, মাথায় পরচুলা, আর মুখে কৃত্রিম দাঁড়ি। শুভ্র, দুর্বল, কায়দাদুরস্ত হাতে (তার চলাফেরার সহজ গতি, বিশেষ করে উদরের আকৃতি এবং পেশীর অস্তিত্বহীনতাই অভিনেতা বলে তাকে চিহ্নিত করে) একটি অস্বাভাবিক হাতুড়ির সাহায্যে একখানি অবাস্তব তরবারির ওপর আঘাত করছিল-যেভাবে কখনও কেউ হাতুড়ি ব্যবহার করে না। এবং একই কালে অদ্ভুত শব্দ উদগীরণের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বিভিন্ন যন্ত্রসংগীত বাজছিল। গীতাভিনয়ের আখ্যান-পুস্তিকা থেকে একথা বুঝতে পারা যাচ্ছিল, যে অভিনেতা ওই গুহাবাসী একজন শক্তিধর বামন-বীরের ভূমিকায় রূপদান করছেন। এবং সে বামন-বীর তৎকর্তৃক লালিত সিফ্রিডের (Siegfried) জন্য একখানি তরবারি নির্মাণ করছিল। সর্বক্ষণ গরম পোশাকে ঢাকা হাঁটু নুইয়ে চলা দেখে সে যে একজন বামনের অভিনয় করছিল-এটা বোঝা যাচ্ছিল। এ বামনটি তখনও একই অদ্ভুত মুখব্যাদন সহকারে দীর্ঘকালবিস্তারী গান বা চীৎকার করছিল। ইতোমধ্যে সে সংগীত অজ্ঞাত কিছুর সঙ্গে আচমকা ধাক্কা খেল, যেন সূচনার ছেদ পড়ে গেল এবং তা সমাপ্তিতে পৌঁছল না। আখ্যানপুস্তিকা থেকে এটা বুঝতে পারা যাচ্ছিল যে, ওই বামন- বীর স্বগতোক্তি করছে একটি দৈত্য সম্পর্কে, যে একটি আংটি হস্তগত করেছে এবং যে আংটিটি সিফ্রিডের সাহায্যে বামন সংগ্রহ করতে চায়। সিগফ্রিড এদিকে একখানি ভালো তলোয়ার যাচ্ঞা করেছে যা নির্মাণে ওই বামন-বীর ব্যাপৃত। এই স্বগতোক্তি বা স্বগতগীতি দীর্ঘকাল চলার পরে অর্কেস্ট্রয় নতুন কিছু সুর শোনা গেল-এও যেন কিছু শুরু হল অথচ শেষ হল না। আর একজন অভিনেতার আবির্ভাব হল যার কাঁধে ঝোলানো ছিল একটি শিঙা এবং তার সঙ্গে ছিল চতুষ্পদ ভালুকের বেশে সজ্জিত ধাবমান একটি মানুষ, যাকে এই শিঙাধারী অভিনেতাটি বামন-বীর কামারের দিকে লেলিয়ে দিল। শেষোক্ত জন তার গরম পোশাকে ঢাকা হাঁটু সোজা না করেই পালিয়ে গেল। শিঙাধারী অভিনেতা নায়ক সিগ্ফ্রিডের ভূমিকায় অভিনয় করছিল। এই অভিনেতার প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে অর্কেস্ট্রায় যে স্বরগ্রাম উত্থিত হল তার উদ্দেশ্য সিফ্রিড চরিত্রের আভাস দেওয়া এবং সে ধ্বনিসমষ্টির অভিধা সিফ্রিড চরিত্রের মূল সুর। সিফ্রিডের প্রতিবার আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে এই ধ্বনিসমষ্টির পুনরাবৃত্তি ঘটে। প্রত্যেক চরিত্রের মূল-সুর-নির্দেশক এই জাতীয় ধ্বনিসমষ্টি ছিল এবং যখনই কোন চরিত্রের আবির্ভাব ঘটছিল, তখনি তার মূল-সুর-নির্দেশক (leit-votiv) ধ্বনি বেজে উঠছিল, এবং যখনই কোন চরিত্রের উল্লেখ ঘটছিল তখনই তার মূল-সুর-নির্দেশক ধ্বনিও শোনা যাচ্ছিল। উপরন্তু প্রত্যেক বস্তুরও মূলনির্দেশক ধ্বনিসমষ্টি বা সুর ছিল। আংটির জন্য একটি, শিরস্ত্রাত্রের জন্য আর একটি, আপেলের একটি, আগুন, বর্শা, তরবারি, জল প্রভৃতিরও ভিন্ন ভিন্ন সুর ছিল। যে মুহূর্তে আংটি, শিরস্ত্রাণ অথবা আপেলের উল্লেখ করা হচিছল, সেই সেই বস্তুর মূল সুরও বেজে উঠছিল। শিঙাধারী অভিনেতা বামনের মতই অস্বাভাবিকভাবে মুখব্যাদন করে উচ্চকণ্ঠ সুর সহযোগে কতকগুলি শব্দ দীর্ঘ সময় আওড়াচ্ছিল। ওই জাতীয় একটি সুরে মিমি (Mime) (এই হল বামনের নাম) তার কথার কিছু উত্তর দিচ্ছিল। এ সংলাপের অর্থ একমাত্র গীতাভিনয়ের আখ্যান পুস্তিকা থেকে আবিষ্কার করা সম্ভব ছিল। সে অর্থ হল, সিগফ্রিড বামনের দ্বারা লালিত হলেও কোন কারণে তাকে ঘৃণা করে এবং সব সময় তাকে হত্যার কামনা করে। বামন সিগ্ফ্রিডের জন্য একখানি তরবারি ঢালাই করছে, কিন্তু সিফ্রিডের তা মনঃপূত হয়নি। সে একই প্রকর মুখব্যাদন এবং গীত সম্বলিত আধ ঘন্টা স্থায়ী দশ পৃষ্ঠাব্যাপী সংলাপ থেকে (গীতাভিনয়ের শব্দযুক্ত মূলের সাহায্যে) এটা প্রতীয়মান হচ্ছিল যে সিফ্রিডের মা তাকে সেই বনে জন্ম দেয়। তার পিতা সম্পর্কে এইটুকু মাত্র জানা যায় যে, তার একটি ভাঙা তলোয়ার ছিল যার অংশগুলি ছিল মিমির অধিকারে। সিগফ্রিড ভয় কাকে বলে জানে না এবং সে ওই বন থেকে নিষ্ক্রান্ত হতে চায়। মিমি অবশ্য তাকে যেতে দিতে চায় না। সংলাপের সময় যখনই পিতা, তরবারি ইত্যাদির উল্লেখ ঘটছিল, সংগীত ওই সব ব্যক্তি বা বস্তুর মূল সুর কখনই বাদ পড়ছিল না। এ সব সংলাপের পর নতুন সুর ধ্বনিত হল (যা হোটান (Wotan) দেবের) এবং একজন পথিকের আবির্ভাব হয়। এই পথিকই দেবতা হোটান (Wotan)। পরচুলা এবং আঁটোসাঁটো পোশাকে সজ্জিত এই দেবতা হ্বোটান একটা বর্শা সহ নির্বোধ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে মিমির পুর্বেকার পরিজ্ঞাত বিষয় পুনঃ স্মরণ করা সঙ্গত মনে করেন। শ্রোতাদের জানানো প্রয়োজন বলে তিনি এই পুনর্বিবরণ দিতে থাকেন, কিন্তু তিনি তা সোজাসুজি বলেন না,-বলেন ধাঁধায় যার অর্থ অনুমান করতে শ্রোতাকে নির্দেশ দেন এবং তিনি নিজের মাথা জামিন রাখেন (কি কারণে জানা যায় না যে শ্রেতা নিশ্চয়ই নির্ভুল অনুমান করবে)। উপরন্তু পথিক তার বর্শা মাটির সঙ্গে ঠেকাবার সঙ্গে সঙ্গেই মাটি থেকে আগুন বেরুতে থাকে। অর্কেস্ট্রাতে বর্শা এবং আগুনের শব্দ শোনা যায়। অর্কেস্ট্রা সংলাপের অনুষঙ্গী হয় এবং মানুষ ও উল্লেখিত বস্তুগুলির মূল সুরের শিল্প- সম্মতভাবে পারস্পরিক সংমিশ্রণ ঘটে। এ ছাড়া সংগীত খুব সরল ভঙ্গিতে অনুভূতিগুলির অভিব্যক্তি দেয়, যেমন খাদের সুরের দ্বারা ভয়ঙ্কর অভিব্যক্ত হয়, চঞ্চল উচ্চগ্রামের সুর-সাহায্যে লঘু তরল ভাব আভাসিত হয়, ইত্যাদি।
ধাঁধাগুলোর আর কোন অর্থই নেই কেবলমাত্র শ্রোতাদের জানানো ছাড়া যে, Nibelung-এরা কারা, দৈত্যেরা কারা, দেবতারা কারা এবং পূর্বে কি ঘটেছে ইত্যাদি। গীতাভিনয়ের আখ্যান পুস্তিকার আট পৃষ্ঠা জুড়ে এই সংলাপও অদ্ভুত মুখব্যাদানে দীর্ঘকাল ধরে মঞ্চের ওপর গীত হয়, এরপর সেই পথিক প্রস্থান করে। সিগফ্রিড প্রত্যাবর্তন করে এবং মিমির সঙ্গে তেরো পৃষ্ঠা জোড়া আলাপ করে। এই সম্পূর্ণ সময় কালের মধ্যে কেবলমাত্র উল্লিখিত মানুষ এবং বস্তুর মূল সুরগুলির সংমিশ্রণ ছাড়া আর কোন সুরই শোনা যায় না। সংলাপে দেখা যায়, মিমি সিগ্ফ্রিডকে ভয় সম্পর্কে শিক্ষা দিতে চায়, কিন্তু ভয় কাকে বলে সিগফ্রিড তা জানে না। এই সংলাপ শেষ হবার পর সিফ্রিড সেই ভগ্ন তরবারির প্রতিরূপের অংশবিশেষ নিজের হাতে নেয়, করাতে দিয়ে তাকে কাটে, এবং হাপরের প্রতিরূপের মধ্যে তাকে ধরে এবং গালায়, এবং ঢালাই করে এবং গান ধরে-’হেইহো! হেইহো! হেইহো! হো! হো! আহা! ওহো! আহা! হেইহো! হেইহো! হেইহো! হো! হো! হাহেই! হো হো! হা হেই!’ এর পর অঙ্কটির সমাপ্তি ঘটে। যে প্রশ্ন মীমাংসার জন্য আমি এই রঙ্গালয়ে এসেছিলাম, সে বিষয়ে আমি সম্পূর্ণ স্থিরনিশ্চয় হয়েছিলাম-যেমন হয়েছিলাম আমার পরিচিত সেই মহিলার গুণাগুণ সম্পর্কে যখন তিনি তার একটি দৃশ্য আমাকে পড়ে শুনিয়েছিলেন-যে দৃশ্যে ছিল অবিন্যস্ত শ্বেতাম্বরা একটি কুমারী মেয়ে এবং দুটি সাদা কুকুরওয়ালা নামক যার মাথায় উইলিয়ম টেলের অনুরূপ পালকবিশিষ্ট টুপী।
সকল প্রকার নান্দনিক অনুভূতিকে দলিত করে যে লেখক আমার দেখা এরূপ কৃত্রিম দৃশ্য রচনা করতে পারেন-তার থেকে প্রত্যাশার কিছু ছিল না। এ ধরনের লেখক যা কিছু ছিল না। এ ধরনের লেখক যা কিছু লিখবেন তা নিকৃষ্ট হবে, অতি স্বচ্ছন্দেই এ সিদ্ধান্তে আসা যায়। যেহেতু শিল্পকর্ম কাকে বলে তা যে তিনি জানেন না, এটা খুবই স্পষ্ট। আমি চলে আসতে চাইলে আমার সংগীয় বন্ধুরা আমাকে থাকতে বললেন। তাঁরা বললেন, একটি মাত্র অঙ্কের অভিনয় দেখে কোন মত গঠন করা যায় না, দ্বিতীয় অঙ্ক ভালো হবে। সুতরাং দ্বিতীয় অঙ্ক অভিনয়ের জন্য আমি অপেক্ষা করলাম।
দ্বিতীয় অঙ্ক। রাত্রি। তারপর প্রত্যূষ। সাধারণভাবে সমস্ত নাটকটাই বিবিধ আলো, মেঘ, চন্দ্রালোক, অন্ধকার, ঐন্দ্রজালিক আগুন, বজ্ৰ প্ৰভৃতিতে ঠাসা।
দৃশ্যটি একটি বন যাতে রয়েছে একটি গুহা। সেই গুহার প্রবেশপথে আঁটোসাঁটো পোশাকে চতুর্থ অভিনেতা বসে আছে, যে আর একজন বামনের ভূমিকায় অবতীর্ণ 1 পুনরায় বর্শা নিয়ে পথিকের ছদ্মবেশে বোটান (Wotan) দেবতা প্রবেশ করলেন। আবার তার শব্দ ধ্বনিত হল-এবং তৎসঙ্গে গভীরতম খাদের সুরে (যতদূর গভীর সম্ভব সংগীতের সুর শোনা গেল। পরবর্তী ধ্বনিগুলি একটি ড্রাগনের সংলাপ সূচিত করছিল। বোটান (Wotan) সেই ড্রাগনকে জাগালেন। সেই খাদের সুর পুনরাবৃত্ত হল, সে সুর গভীর থেকে গভীরতর হতে লাগল। ড্রাগন প্রথমে বলল, ‘আমি ঘুমুতে চাই।’ কিন্তু পরে গুহা থেকে হামাগুড়ি দিয়ে সে বেরিয়ে এলো। দুজন মানুষ ড্রাগনের রূপদান করছিল : সবুজ আঁশওয়ালা চামড়ার পরিচ্ছদে ভূষিত ছিল ড্রাগনটি, এক প্রান্তে সে একটি লেজ নাড়ছে, অপর প্রান্তে কুমিরের মতো একটি চোয়াল বাঁধা যা কেবল ব্যাদিত হচ্ছিল এবং যার অভ্যন্তরে অগ্নিশিখা দৃষ্ট হচ্ছিল। ড্রাগনটি -(যাকে ভীষণদর্শন করা উদ্দেশ্য ছিল কিন্তু মাত্র পাঁচ বৎসরের শিশুর কাছেই যে ভয়ঙ্কর মনে হতে পারে) ভয়ানক খাদে নামানো সুরে কতকগুলি কথা উচ্চারণ করে। মেলায় অস্থায়ীভাবে নির্মিত চালাঘরে যেমন খেলা দেখানো হয় সমস্ত ব্যাপারটি তেমনি নির্বোধ ধরনের। সাত বৎসরের অধিক বয়স্ক লোক যে মনোযোগের সঙ্গে এরকম জিনিস দেখতে পারে, তা খুবই বিস্ময়কর। তবু হাজারে হাজারে অর্ধ-সংস্কৃতিবান মানুষ খুব মনোযোগের সঙ্গে বসে বসে তা দেখছিল, শুনছিল এবং আনন্দ লাভ করছিল।
শিঙাধারী সিফ্রিড পুনরায় আবির্ভূত হয়, সঙ্গে সঙ্গে মিমিও। অর্কেস্ট্রায় তাদের আবির্ভাব-নির্দেশক ধ্বনি নির্গত হয়। সিগফ্রিড ভয় কাকে বলে জানে, কি জানে না সে সম্পর্কে তাদের মধ্যে কথাবার্তা চলে। মিমি চলে যায়। তারপর আর একটি দৃশ্যের অবতারণা হয়-অভিপ্রায় ছিল সেটিকে সেটিকে সর্বাধিক কাব্যমন্ডিত করে তোলা। বোঝা যাচ্ছিল, সিগফ্রিড আঁটোসাঁটো পোশাকে সুন্দরমন্য ভঙ্গিতে শুয়ে পড়ে, পর্যায়ক্রমে চুপ করে থাকে এবং স্বগতোক্তি করে। মনোযোগ দিয়ে সে কিছু চিন্তা করে, পাখির গান শোনে এবং তাদের অনুকরণ করতে চায়। এ উদ্দেশ্যে নিজের তরবারির সাহায্যে একটি বেনুবাঁশ কেটে সে একটি বাঁশি তৈরি করে। সকালটি উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়। পাখিলা গান করে! সিগফ্রিড পাখিদের অনুকরণের চেষ্টা করে। অর্কেষ্ট্রায় পাখিদের অনুকরণ শোনা যায়। এবং পর্যায়ক্রমে সিগফ্রিডের স্বগতোক্তির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ধ্বনিও শোনা যায়। কিন্তু সিগফ্রিড তার বংশীবাদনে সফল না হওয়ায় পরিবর্তে শিঙা বাজাতে থাকে। এ দৃশ্যটা অসহ্য বিরক্তিকর। লেখকের মানসিক অভিজ্ঞতা সঞ্চারিত করবার উপায় হিসেবে এ সংগীতের অর্থাৎ শিল্পের কোন ব্যঞ্জনা পর্যন্ত নেই। সংগীতের দিক থেকে তার মধ্যে এমন কিছু বর্তমান-যা সম্পূর্ণ দুর্বোধ্য। সাংগীতিক অর্থে ক্রমান্বয়ী আশা সঞ্চারের সঙ্গে সঙ্গে আসে নিরাশা, যেন একটি বাবনার শুরু হল শুধুমাত্র খন্ডিত হয়ে যাবার জন্যে। এই নাট্যক্রিয়ায় সাংগীতিক আরম্ভের মতো যদি কিছু থেকেও থাকে তবে তা এত সংক্ষিপ্ত, সমন্বয় এবং ঐকতানের দিক থেকে এত জটিল, বৈপরীত্বের প্রভাবমুখী, এত অস্পষ্ট, অসম্পূর্ণ এবং ইতোমধ্যে মঞ্চে সংঘটিত ব্যাপারগুলি এত জঘন্য মিথ্যা যে, তাদের দ্বারা সংক্রমিত হওয়া তো দূরের কথা,-এমনকি সেই খন্ড সংগীতের মর্ম উদ্ধার করাও কঠিন। সর্বোপরি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এবং প্রত্যেকটি সুরের মধ্যে লেখকের উদ্দেশ্য এতটা সোচ্চার এবং দ্রষ্টব্য ছিল যে, কেউ সিফ্রিড এবং পাখিদের দেখতে বা শুনতেও পাচ্ছিল না। পরস্তু একজন সীমিত দৃষ্টির আত্মম্ভরী জার্মান-যার রুচি এবং শৈলী অত্যন্ত নিকৃষ্ট স্তুরের এবং যার কাব্যধারণা নিতান্ত মিথ্যা, তিনি স্থূলতম এবং আদিমতম উপায়ে তাঁর এ সমস্ত মিথ্যা ও ভ্রান্ত ধারণাগুলি অপরের মনে সঞ্চারিত করে দিতে আগ্রহী-এটাই ছিল প্ৰত্যক্ষ।
লেখকের সুস্পষ্ট পরিকল্পনা-উদ্ভূত সৃষ্টির বিরুদ্ধে যে অপ্রত্যয় এবং প্রতিরোধের অনুভূতি সর্বদাই জাগ্রত হয়, তা সকলেই জানে। কথক যদি পূর্বেই শুধু এই কথাই বলে দেন যে, ‘কাঁদতে প্রস্তুত থাকো,’ অথবা ‘হাসতে প্রস্তুত হও,’ তবে এটা নিশ্চিত যে, কেউ কাঁদবেও না, হাসবেও না। কিন্তু যদি দেখা যায়, মর্মস্পর্শী তো নয়ই, বরং হাস্যকর ও বিরক্তিকর কিছুর পতি লেখক আমাদের আবেগ উদ্রেকে প্রয়াসী, এবং অধিকন্তু পাঠককে তিনি সম্পূর্ণ অভিভূত করেছেন, লেখকের এ জাতীয় আত্মপ্রত্যয় দৃষ্ট হয়, তা পাঠকের মনে একপ্রকার বেদনাপূর্ণ যন্ত্রণাদায়ক অনুভূতির সৃষ্টি করে, যে রকমটি ঘটে যদি কোন বৃদ্ধা বিকৃতাঙ্গ স্ত্রীলোক নাচের পোশাক পরে কারো হৃদয় জয় সম্পর্কে নিশ্চিত ভঙ্গিতে হাসি-হাসি মুখে তার সামনে ছিনালি করে। আমার চারপাশে তিন হাজার জনতার ভিড় দেখে আমার এ ধারণা আরও দৃঢ় হল-যারা অত্যন্ত ধৈর্যের সঙ্গে এ সমস্ত অসম্ভব আজগুবি জিনিসই যে শুধু দেখছে তা নয়, এমনকি সেগুলি দেখে আনন্দিত হওয়াও তাদের কর্তব্য বিবেচনা করছে।
পরবর্তী দৃশ্য পর্যন্ত আমি কোনমতে বসে থাকলাম। সে দৃশ্যে সিফ্রিডের মূল সুরের সঙ্গে সংমিশ্রিত খাদের গুরুগম্ভীর ধ্বনি সহ দৈত্যটির আবির্ভাব হল। কিন্তু সে দৈত্যের সঙ্গে যুদ্ধ আরম্ভ হবার সঙ্গে সঙ্গে গর্জন, আগুন, তলোয়ার আন্দোলন শুরু হলে তা আমার সহ্যের সীমা অতিক্রম করল। তখন থিয়েটার থেকে এমন বিরাগের অনুভূতি নিয়ে আমি নিষ্ক্রান্ত হলাম-যা এখনও আমি ভূলতে পারি না।
এ গীতাভিনয় দেখে-শুনে নিজের অজ্ঞাতেই একজন শ্রদ্ধেয়, বিজ্ঞ, শিক্ষিত গ্রামাঞ্চলের শ্রমিকের কথা আমার মনে হল-আমার জানা কৃষকদের মধ্যেই একজন বিজ্ঞ প্রকৃত ধার্মিক ব্যক্তির কথাই আমার মনে হল। আমি যা প্রত্যক্ষ করছিলাম যদি এ রকম একজন ব্যক্তির তা দেখতে হত, তবে তিনি কী প্রচন্ড বিভ্রান্তির মধ্যে পড়তেন-তার ছবি আমি মনে মনে আঁকবার চেষ্টা করলাম।
এ ধরনের অভিনয়ের জন্য যে পরিমাণ শ্রম ব্যয়িত হয়েছে তা যদি তিনি জানতেন, এবং যাদের তিনি শ্রদ্ধা করতে অভ্যস্ত যে সমস্ত সম্মানীয় বৃদ্ধ, বিরলকেশ, শুভ্র শ্মশ্রুমন্ডিত সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের পাঁচঘন্টাব্যাপী এ সমস্ত মূর্খতাপূর্ণ অভিনয় নিশ্চুপ বলে মনোযোগের সঙ্গে উপভোগ করতে দেখতেন, তবে তিনি কী মনে করতেন? একজন বয়স্ক শ্রমিকের কথা না হয় বাদই দেওয়া গেল, সাত বৎসরের অধিক বয়স্ক একটি বালকও এরূপ অর্থহীন, সামঞ্জস্যহীন রূপকথা দেখতে নিজেকে ব্যাপৃত রাখছে-এটা ভাবাও যায় না।
এতদ্সত্ত্বেও সংস্কৃতিবান উচ্চবর্গীয়দের সেরা প্রতিনিধি এই বিরাট শ্রোতৃসমাজ উন্মত্ত এই অভিনয় দেখবার জন্য পাঁচঘন্টা কাল পর্যন্ত বসে থাকার পর এ কথা কল্পনা করে চলে যান যে, এই অর্থহীন ব্যাপারের প্রতি প্রশংসা অর্পণ করে তারা নিজেদের প্রগতিশীল এবং আলোকপ্রাপ্ত মনে করবার নতুন দাবি অর্জন করেছেন। আমি মস্কোর জনসাধারণের কথা বলছি। কিন্তু এই জনসাধারণের পরিচয় কী? সে জনসাধারণ সর্বোচ্চ শিক্ষিতন্মন্য জনতার এক শতাংশ মাত্র। এঁরা শিল্প-সংক্রমিত হবার ক্ষমতা হারানোকে একটি গুণ বলে বিবেচনা করেন। এঁরা শিল্প-সংক্রমিত হবার ক্ষমতা হারানোকে একটি গুণ বলে বিবেচনা করেন। এর ফলে বিদ্রোহচেতনা অনুভব না করে তারা এই নির্বোধ ছলনামূলক বস্তুও যে শুধু দেখতে পারেন তাই নয়, অধিকন্তু এর থেকে তারা আনন্দও আহরণ করতে পারেন।
বেইরুথ (Bayreuth) নামক স্থানে এ অভিনয় প্রথম প্রদর্শিত হবার সময় জনসাধারণের মধ্যে নিজেদের উচ্চস্তরের সংস্কৃতিবান বিবেচনা করেন এমন ব্যক্তিরা পৃথিবীর দূর প্রান্ত থেকে সেখানে সমবেত হয়েছিলেন, প্রত্যেকে এ অভিনয় দেখবার জন্য ১০০ পাউন্ডের মতো খরচ করে পর পর চারদিন পর্যন্ত দীর্ঘ ছয় ঘন্টাব্যাপী এই অর্থহীন আবর্জনা দেখা এবং শোনার জন্য হাজির হয়েছিলেন।
কিন্তু এ অভিনয় দেখার জন্য মানুষ পূর্বেই বা যেত কেন, বর্তমানেও যায় কেন, এবং কেনই বা তার প্রশংসা করে? এ প্রশ্ন স্বতই উত্থিত হয় : বাগনারের সৃষ্টিকর্মের সার্থকতা কিভাবে ব্যাখ্যা করা যায়?
আমি নিজের নিকট সে সার্থকতা এভাবে ব্যাখ্যা করি। রাজার সম্পদের অধিকারী হবার দুর্লভ সৌভাগ্য অর্জন করায় বাগনার কৃত্রিম শিল্পসৃষ্টির সমস্ত পদ্ধতি আয়ত্ত করেছিলেন-যা বহুল প্রচলনের প্রভাবে যথেষ্ট সার্থকতা অর্জন করেছিল। বিশেষ দক্ষতার সঙ্গে সে পদ্ধতিকে প্রয়োগ করে বাগনার কৃত্রিম শিল্পের একটি আদর্শও প্রস্তুত করেছিলেন। যে কারণে আমি তাঁর সৃষ্টিকর্মকে উদাহরণ হিসেবে গ্রহণ করেছি তা এই : বাগনারের সৃষ্টিকর্মে ধার-করা, অনুকৃতি, নাট্টীয় প্রভাব-সৃষ্টি এবং কৌতূহল সৃষ্টি প্রভৃতির একত্র মিশ্রণে যেভাবে শিল্পে কৃত্রিমতা সঞ্চার করা হয়েছে, আমার পরিজ্ঞাত আর কোন কৃত্রিম শিল্পে এত সামর্থ্য ও সার্থকতার সঙ্গে তা অবলম্বিত হয়নি। প্রাচীন যুগের বিষয়বস্তু ধার-করা থেকে শুরু করে মেঘের বর্ণনা, সূর্য ও চন্দ্রোধয় প্রভৃতি যে সমস্ত বিষয় কাব্য-স্বভাবের বিবেচিত হয়, বাগনার সেগুলিকে তার সৃষ্টিকর্মে ব্যবহার করেছেন। তার সৃষ্টিকর্মে আমরা দেখি-নিদ্রিত সৌন্দর্য, পরী, ভূগর্ভস্থ অগ্নি, বামন, যুদ্ধ, তরবারি, ভালোবাসা, নিষিদ্ধ যৌনসংসর্গ এবং সংগীতরত পাখি, কাব্যজগতের সমস্ত উপাদানকে এখানে কাজে লাগানো হয়েছে।
উপরন্তু সব কিছুই অনুকরনাত্মক : অলংকরণে অনুকরণ, সাজসজ্জায় অনুকরণ। প্রত্নতত্ত্বের তথ্যভিত্তিক প্রাচীন যুগের সব কিছুতে যথাযথ রূপ দেওয়া হয়েছে। ধ্বনিগুলি পর্যন্ত অনুকরণাত্মক, যেহেতু বাগনারের সাংগীতিক প্রতিভার অভাব ছিল না বলে এমন সমস্ত বিধান আবিষ্কার করেছিলেন যা হাতুড়ির ঘা, গলিত লোহার হিস্ হিস্ শব্দ, এমনকি পাখির গান পর্যন্ত অনুকরণে সমর্থ।
উপরন্ত এই সৃষ্টিকর্মের সব কিছুই প্রভাব-সৃষ্টিতে এবং অদ্ভুত উপাদানে সাতিশয় চমকপ্রদ : এর দৈত্যরা, ঐন্দ্রজালিক অগ্নিসমূহ, জলতলস্থ দৃশ্যাবলী, শ্রোতাদের উপবেশন স্থানের অন্ধকার, অর্কেস্ট্রার অদৃশ্যগোচরতা এবং এ যাবৎ অব্যবহৃত সুরসমবায়ের মিশ্রণ প্রভৃতি -সবই।
এ ছাড়া সব কিছুই খুবই কৌতূঞলোদ্দীপক। কে কাকে হত্যা করবে, কে কাকে বিয়ে করবে, কে কার ছেলে, এর পর কী ঘটবে-এ সমস্ত প্রশ্নের মধ্যেই শুধু কৌতূহল নিহিত নয়-সংগীতের সঙ্গে কথা-মূলের সম্পর্কের মধ্যেও, কৌতূহল নিহিত। রাইনের তরঙ্গপ্রবাহকে সংগীতে অভিব্যক্তি দেওয়া যাবে কী করে? দুষ্ট প্রকৃতির বামনের আবির্ভাবকেই বা সংগীতে অভিব্যক্তি দেওয়া হবে কী ভাবে? সেই বামনের ইন্দ্রিয়পরায়ণতাকেই বা ফুটিয়ে তোলা হবে কি রূপে? সাহসিকতা, আগুন অথবা আপেলকে সংগীতে অভিব্যক্ত করা হবে কিভাবে? মঞ্চে আলাপরত ব্যক্তি এবং যে সমস্ত ব্যক্তি বা বস্তু সম্পর্কে কথা বলা হচ্ছে-এ উভয়ের মূল-সুরকে পরস্পরসম্বন্ধ করা যাবে কী করে? সংগীতের আরও একটি বৈশিষ্ট্য আছে। পূর্বস্বীকৃত সমস্ত নিয়ম ভঙ্গ করে সংগীতে খুবই অপ্রত্যাশিত এবং সম্পূর্ণ নতুন ধরনের সুরের ভাজের সৃষ্টি হয় (এটা শুধু সম্ভব নয়, কোন অভ্যন্তরীণ নিয়মের অস্তিত্ব না থাকায় সংগীতের ক্ষেত্রে এমনকি এটা সহজও)। বেসুরগুলিও অভিনব এবং অভিনব রীতিতে তাদের সন্নিবেশ করা হয় এবং এটাও খুবই কৌতূহলোদ্দীপক।
হ্বাগ্নারের প্রতিভার বৈশিষ্ট্যের গুণে এবং অনুকূল বৈষয়িক পরিবেশের সহায়তায় তাঁর এই কাব্যপণা, অনুকারিতা, চমৎকারিত্ব এবং কৌতূহলধর্মিতা তাঁর সৃষ্টিকে সার্থকতার সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে দিয়েছিল। এ কারণে তা দর্শকের মনের ওপর সম্মোহনের প্রভাব বিস্তার করে, -যেরূপ সম্মোহন ক্রমান্বয়ী কয়েক ঘন্টাব্যাপী অসামান্য বাগ্নিতায় উচ্চারিত পাগলের প্রলাপ শুনলে সচরাচর ঘটে।
অনেকে বলেন, বাগানরকে বেইরুথের অভিনয়ে না দেখে তুমি তার বিচার করতে পার না-যেখানে অন্ধকারে মঞ্চের নীচে প্রচ্ছন্ন অর্কেষ্ট্রা অদৃশ্য হয়ে থাকে এবং অভিনয়কে সর্বোচ্চ উৎকর্ষ দান করা হয়। এ সত্যই প্রমাণ করে যে, শিল্প সম্পৰ্কীয় কোন জিজ্ঞাসা এখানে অবান্তর, প্রধান বিচার্য বিষয় হল সম্মোহন। প্রেততত্ত্ববাদীরাও ঠিক এ ধরনের কথাই বলেন। অপচ্ছায়ার বাস্তবতাকে দর্শকের নিকট প্রত্যয়ান্বিত করবার উদ্দেশ্যে তারা সাধারণত বলে থাকেন : ‘তুমি এখনই বিচার করতে পার না, তুমি আরও দেখ, প্রেততত্ত্ববাদীদের আরও কয়েকটি বৈঠকে উপস্থিত থেক।’ অর্থাৎ অর্ধপ্রকৃতিস্থ ব্যক্তির সঙ্গে একই কক্ষে নীরবে অন্ধকারে তুমি চুপ্ করে বসো, এবং অন্তত বার দশেক এর অভিজ্ঞতা অর্জন করে, তাহলেই আমরা যা দেখছি তুমিও তাই দেখতে পাবে।’ হ্যাঁ, খুব স্বাভাবিকই বটে! কেবলমাত্র অনুরূপ পরিস্থিতিতে নিজেকে স্থাপন কর, তবে তুমি যা চাইছ তা দেখতে পাবে। কিন্তু সুরাপান কিংবা অহিফেন প্রসাদে এই অবস্থায় আরও দ্রুততর পৌঁছানো সম্ভব। হ্বাগ্নারের অপেরা শুনতে গেলেও ঠিক অনুরূপ ব্যাপারই ঘটে। পুরোপুরি প্রকৃতিস্থ নয়-এমন লোকের সঙ্গে অন্ধকারে চারদিন পর্যন্ত বসে থাক এবং শ্রবণসম্পর্কিত স্নায়ুর সাহায্যে তোমার মস্তিষ্ককে সে শক্তিশালী ধ্বনিপুঞ্জের অধীন কর-যা মস্তিস্ককে উত্তেজিত করতে সর্বাপেক্ষা উপযোগী। তাহলে নিঃসন্দেহে একটি অস্বাভাবিক অবস্থায় উপনীত হয়ে তুমি উদ্ভট বস্তুরাজির দ্বারা সম্মোহিত হবে। এ অবস্থায় পৌঁছাতে তোমার চারদিন সময়ও লাগবে না, মস্কোতে অনুষ্ঠিত পাঁচ ঘন্টাব্যাপী একটি ‘দিন’ অভিনয়ই এর পক্ষে পর্যাপ্ত। পাঁচ ঘন্টারও প্রয়োজন নেই। শিল্পের প্রকৃতি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণাহীন ব্যক্তির পক্ষে এক ঘন্টাই প্রচুর সময়,-যেহেতু তারা এই সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে আছে যে, তাদের দ্রষ্টব্য বস্তু চমৎকার, এবং এই শিল্পকৃতি সম্পর্কে উদাসীনতা অথবা অসন্তুষ্টি দ্রষ্টার হীন মানসিকতা এবং সংস্কৃতির অভাবেরই পরিচায়ক।
এ অভিনয়ে আমি শ্রোতাদের পর্যবেক্ষণ করলাম। শ্রোতৃবৃন্দের যারা নেতৃস্থানীয় এবং তাদের যারা বৈশিষ্ট্য বিধান করছিলেন তারা পূর্বেই সম্মোহিত হয়েছিলেন, এবং সেই অভ্যস্থ সম্মোহনে পুনরায় কবলিত হচ্ছিলেন। উপরন্তু শিল্প-সমালোচকদের শিল্প- সংক্রমিত হবার ক্ষমতাবঞ্চিত হবার কারণ এই : তাঁরা হ্বাগ্নারের গীতাভিনয়ের মতো মনঃপ্রধান সৃষ্টিকর্মকে সর্বদা বিশেষ মূল্য দিয়ে থাকেন। এ ছাড়াও তারা এই সৃষ্টিকর্মটির-যার মধ্যে যুক্তিবিচারের যথেষ্ট উপাদান আছে তার সপক্ষে গভীর পাণ্ডিত্য সহযোগে তাদের অভিমত ব্যক্ত করেন। এ দুটির অনুসরণে বৃহৎ নাগরিক জনতা চলতে থাকে (যারা খাঁটি শিল্পের প্রতি উদাসীন, যেহেতু তাদের সংক্রমিত হবার ক্ষমতা বিকৃত এবং অংশত ক্ষয়প্রাপ্ত)। তাদের পুরোভাগে বিরাজ করেন রাজন্যবর্গ, কোটিপতিরা, এবং শিল্পের পৃষ্ঠপোষকেরা -যারা শশক -শিকারী কুকুরের মতো এই উচ্চাভাষী, অসংশয়িত অভিমত-দাতাদের কাছে থাকতে ভালোবাসেন।
‘ওহো, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই! কী কবিতা! অপূর্ব! বিশেষ করে পাখিগুলি!’ ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি সম্পূর্ণ মোহিত’-এইরূপ উচ্ছ্বাসপূর্ণ বাক্যে তারা তাদের নিকট প্রামাণ্য বলে স্বীকৃত ব্যক্তিদের কাছ থেকে ক্ষণপূর্বে শোনা অভিমত পুনরাবৃত্তি করে চলে।
যদি কেউ কেউ উদ্ভট ও অসার ব্যাপার দেখে অপমানিতও বোধ করে তবু সে ভয়ে ভয়ে চুপ করে থাকে, যেমন পানোন্মত্ত ব্যক্তি-পরিবেষ্টিত প্রকৃতিস্থ মানুষ ভয়ে চুপ করে থাকে।
এইভাবে খাঁটি শিল্পের সঙ্গে সম্পূর্ণ সঙ্গতিহীন বস্তুকে নিপুণ কৌশলের সাহায্যে কৃত্রিম শিল্পে পরিণত করা হয় এবং সে অর্থহীন, স্থূল, ভেজাল মাল সমস্ত জগতের স্বীকৃতি লাভ করে। অথচ সেই কৃত্রিম শিল্প-উৎপাদনের জন্য লক্ষ লক্ষ রুবলের প্রয়োজন হয়। এবং সেই অপ-শিল্প উচ্চবর্গীয়দের রুচি এবং শিল্প ধারণার ক্রমিক বিকৃতি সাধন করে চলে।