হোয়াট ইজ আর্ট – ১৬

১৬

[রূপমূর্তির উৎকর্ষ সংক্রামক করে তোলে বলে কতিপয় সৃজনকর্মকে শিল্প বলে স্বীকার করবার পর সে সমস্ত সৃজনকর্মের বিষয়বস্তু যে অনুভূতিসৃষ্ট, তার উৎকর্ষ বিচার। অনুভূতির উৎস যত বেশি হবে, শিল্পের উৎকর্ষও সে পরিমাণে বাড়বে। সংস্কৃতিবান জনতা। আমাদের যুগের ধর্মীয় উপলব্ধি। শিল্পের ওপর নতুন আদর্শসমূহের নতুন দাবি। শিল্প মিলিত করে। ধর্মীয় শিল্প। সর্বজনীন শিল্প। উভয়ের সহযোগিতা একই ফলোপধায়ী। শিল্পের নতুন মূল্যায়ন। নিকৃষ্ট শিল্প। উদাহরণ। সৌন্দর্য শিল্পের কোন মানদন্ড না হলেও শিল্পরাজ্যে তার ন্যায্য স্থান আছে। বেটোফেনের নবম সস্কনি।]

শিল্পের বিষয়বস্তুর মধ্যে কোটি ভালো বা মন্দ তা আমরা কিরূপে বিচার করব? ভাষার মতো শিল্পও আদান-প্রদানের এবং সেই হেতু প্রগতিরও উপায়বিশেষ, অর্থাৎ চরম উৎকর্ষের অভিমুখে মানবতার অগ্রসৃতি। পূর্ববর্তী প্রজন্মের মানুষের অভিজ্ঞতায়, চিন্তায় এবং তাদের যুগের সর্বোত্তম এবং সর্বাগ্রগণ্য ব্যক্তিদের প্রয়াসে যে সমস্ত জ্ঞান আবিষ্কৃত হয়েছে, ভাষাই সাম্প্রতিকতম বংশীয়দের সে জ্ঞানের রাজ্যে প্রবেশাধিকার দেয়। শিল্প শুধু পূর্ববর্তী যুগের মানুষেল উপলব্ধ অনুভূতিজগতে সাম্প্রতিকতম মানুষকে প্রবেশাধিকার দেয়নি, এমনকি স্ব-যুগের সর্বোত্তম এবং সর্বাগ্রগণ্য ব্যক্তিদের উপলব্ধ অনুভূতি-জগতেও তাদের প্রবেশাধিকার দেয়। ভ্রান্ত এবং অপ্রয়োজনীয় ধারণাকে অপসারিত করে অধিকতর সত্য ও প্রয়োজনীয় ধারণাকে সে স্থলে স্থাপন করায় জ্ঞানের বিবর্তন যেমন ক্রমোন্নতির পথে এগিয়ে যায়, তেমনি শিল্পমাধ্যমে অনুভূতিও বিবর্তিত হয়-মানবমঙ্গলের দিক থেকে অপেক্ষাকৃত অকরুণ এবং অনাবশ্যক অনুভূতির স্থলে অধিকতর দয়ার্দ্র ও আবশ্যক অনুভূতি প্রতিস্থাপিত হয়। শিল্পের উদ্দেশ্যও তাই। যে অনুভূতিসমূহ শিল্পের বিষয়বস্তু সেগুলির কথা বলতে গেলেও এই কথাই বলতে হয় যে, যত অধিক পরিমাণে শিল্প উদ্দেশ্য সাধন করে-ততই তা অধিকতর উৎকর্ষ অর্জন করে এবং সে লক্ষ্য পূরণে যতই তা অসমর্থ, সে শিল্প ততই নিকৃষ্ট।

অনুভূতিসমূহের মূল্যাবধারণ (অর্থাৎ মানবজাতির মঙ্গলের জন্য এক বা অপর জাতীয় অনুভূতির শুভংকরতা বা আবশ্যকতার স্বীকৃতি) করা হয় যুগের ধর্মীয় উপলব্ধির সাহায্যে।

ইতিহাসের প্রত্যেক যুগে এবং প্রত্যেক মানবসমাজে জীবনের অর্থ উপলব্ধির একটি চেতনা বিদ্যমান থাকে। সেই সমাজের মানুষ যে উচ্চতম স্তরে উপনীত সেই চেতনা তারই সূচক এবং তা সে সমাজের অভীপ্সিত সর্বোচ্চ মঙ্গলের নির্দেশক। কোন নির্দিষ্ট সময় ও সমাজের ধর্মীয় উপলব্ধিই এই চেতনা বা বোধি। এ ধর্মীয় উপলব্ধি সর্বদাই স্পষ্ট অভিব্যক্তি লাভ করে স্বল্প কয়েকজন প্রগতিশীল ব্যক্তির মধ্যে। সমাজের সাধারণ মানুষের দ্বারাও তা অল্পবিস্তর স্পষ্ট অনুভূত হয়। এই ধরনের ধর্মীয় উপলব্ধি এবং তার নিজস্ব অভিব্যক্তি সর্বকালে প্রত্যেক সমাজে বিদ্যমান। যদি আমাদের এরূপ মনে হয়, আমাদের সমাজে কোন ধর্মীয় উপলব্ধির অস্তিত্ব নেই, তার কারণ এই নয় যে-বাস্তবে তা সত্য সত্যই অস্তিত্বহীন, বরং তার এইমাত্র কারণ যে-আমরা তার অস্তিত্ব অনুভবে অনিচ্ছুক। আমাদের জীবন সে-ধর্মীয় উপলব্ধির সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ সেই সত্য ধরা পড়ে যায় বলেই অধিকাংশ সময়ে আমরা তার অস্তিত্ব স্বীকার করতে চাই না।

কোন সমাজের ধর্মীয় অনুভূতি প্রবহমান নদীর অভিমুখিতার মতো। নদী যদি আদৌ প্রবাহিত হয় তবে নিশ্চয় তার একটা লক্ষ্য থাকবেই। সমাজ সজীব হলে তবে অবশ্যই তার একটি ধর্মীয় চেতনাও থাকবে-যা ওই সমাজের সকল মানুষের অল্পাধিক সচেতনভাবে অনুসৃত জীবনধারার নির্দেশক।

সুতরাং প্রত্যেক সমাজে বহুকাল পূর্ব থেকে ধর্মীয় অনুভূতি যেমন প্রবহমান ছিল, তেমনি সে অনুভূতির এখনও অস্তিত্ব আছে। এই ধর্মীয় উপলব্ধির মানদন্ডে শিল্প- সঞ্চারিত অনুভূতিগুলির সর্বদা মূল্যায়ন করা হয়েছে। স্ব-যুগের একমাত্র এই ধর্মীয় উপলব্ধির ভিত্তিইে মানুষ শিল্পজগতের অনন্ত বৈচিত্র্যের মধ্যে সে শিল্পকেই নির্বাচিত করেছে-যে শিল্প-সঞ্চারিত অনুভূতি বাস্তবজীবনে ধর্মীয় উপলব্ধিকে সক্রিয় করে তোলে। এরূপ শিল্পকেই সর্বদা সমাদর এবং উৎসাহ দান করা হয়েছে। অপরপক্ষে যে শিল্প বিগত যুগের নিষ্প্রাণ ধর্মীয় উপলব্ধি-সঞ্চারক, সে শিল্প সর্বদাই ধিক্‌কৃত এবং ঘৃণ্য বিবেচিত হয়েছে। এ ছাড়া বিচিত্র অনুভূতি-সঞ্চারক যে অবশিষ্ট শিল্প-মাধ্যমে মানুষ পারস্পরিক ভাব-বিনিময় করে তা নিন্দিত হত না, এবং ধর্মীয় চেতনা-বিরোধী অনুভূতি সঞ্চার না করলেই তাকে প্রশ্রয় দেওয়া হত। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, প্রাচীন গ্রীকদের মধ্যে সৌন্দর্য, শক্তি ও সাহসের অনুভূতি-সঞ্চারী শিল্প [হেসিয়ড (Hesiod) হোমার, ফিডিয়াস (Phidias)] নির্বাচিত, অনুমোদিত এবং উৎসাহিত হয়েছিল। অপরপক্ষে স্থূল ইন্দ্রিয়পরায়ণতা, নৈরাশ্য এবং স্ত্রৈণ অনুভূতি-সঞ্চারক শিল্প নিন্দিত ও ধিক্‌কৃত হত। ইহুদিদের মধ্যে ভক্তির অনুভূতি-সঞ্চারক শিল্প এবং হিব্রুদের ঈশ্বর ও তার নির্দেশের প্রতি আনুগত্য-সঞ্চারক শিল্পকে (জেনেসিস মহাকাব্য, হিব্রু প্রবক্তাগণের বাণীসমূহ, স্তোত্রাবলী) নির্বাচিত এবং উৎসাহিত করা হয়েছিল, অপরপক্ষে যে শিল্প পৌত্তলিকতার অনুভূতি সঞ্চারিত করত (সুবর্ণময় গোবৎস)-তা নিন্দিত ও ঘৃণিত হত। অবশিষ্ট শিল্পসমূহ -যেমন, গল্প, গান, নৃত্য, গৃহের তৈজসপত্রের এবং পরিচ্ছদাদির অলংকরণ প্রভৃতি যেগুলি ধর্মীয় উপলব্ধির পরিপন্থী নয়, সেগুলি উল্লেখযোগ্য বলে চিহ্নিত হয়নি, অথবা আলোচনার যোগ্যও বিবেচিত হয়নি। এভাবে বিষয়বস্তুর দিক থেকে শিল্পের মূল্য সর্বদাই সর্বত্র নির্ণীত হয়ে আসছে। বস্তুতপক্ষে এ ভাবেই শিল্পের মূল্যমাণ নির্ধারিত হওয়া উচিত, যেহেতু শিল্পের প্রতি এ দৃষ্টিভঙ্গি মানবপ্রকৃতির মৌলিক বৈশিষ্ট্য নিঃসৃত এবং সে সমস্ত বৈশিষ্ট্য অপরিবর্তনীয়।

আমি জানি, আমাদের কালে একটি প্রচলিত মত আছে যে, ধর্ম একটি কুসংস্কার মাত্র- যা প্রগতিশীল মানবজাতি পিছনে ফেলে এসেছে। কাজেই এটাও ধরে নেওয়া হয় যে, আমাদের সকলের পক্ষে সমভাবে প্রযোজ্য এমন কোন ধর্মীয় উপলব্ধির অস্তিত্ব নেই- যার সাহায্যে আমাদের যুগের শিল্পের মূল্যায়ন করা যেতে পারে। আমি জানি, বর্তমান কালের ছদ্ম সংস্কৃতিবান গোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে প্রচলিত মত এই। নিজেদের বিশেষ সামাজিক সুবিধা ক্ষুণ্ন করে বলে যে সমস্ত ব্যক্তি খ্রীষ্টধর্মকে যথার্থ স্ব-রূপে স্বীকার করেন না এবং নিজেদের অর্থহীন এবং অবৈধ জীবনধারা আত্মগোপন করবার উদ্দেশ্যে সব ধরনের দার্শনিক এবং নান্দনিক তত্ত্ব আবিষ্কার করেন-তাদের বিকল্প কিছু ভাবা সম্ভব নয়। এ সমস্ত ব্যক্তি স্বেচ্ছায় এবং কোন সময় অনিচ্ছায় ধর্মীয় অনুষ্ঠান-পদ্ধতির সঙ্গে ধর্মীয় উপলব্ধিকে গুলিয়ে ফেলেন এবং মনে করেন, সে অনুষ্ঠানকে অস্বীকার করে তাঁরা ধর্মীয় অনুভূতিকেই অস্বীকার করলেন। ধর্মের ওপর এই আক্রমণই এবং আমাদের যুগের ধর্মীয় উপলব্ধির জীবনধারণা প্রতিষ্ঠার সমস্ত প্রয়াসই খুব স্পষ্টভাবে ধর্মীয় উপলব্ধির অস্তিত্বই সপ্রমাণ করে এবং সে উপলব্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন সমস্ত জীবনকে ধিক্‌কৃত করে।

মানবতার যদি প্রগতি হয় অর্থাৎ মানব সমাজ যদি সমানের দিকে এগিয়ে চলে-তবে সে গতিপথ নির্ধারক কোন চালক অবশ্যই থাকবে। এবং ধর্মসমূহ সর্বদাই সে পথ – নির্দেশকের ভূমিকা গ্রহণ করেছে। সকল ইতিহাসই এ সাক্ষ্য দেয় যে, মানব-প্রগতি ধর্মের নির্দেশ ছাড়া আর কিছুতেই সম্ভব হয় না। কিন্তু মানবজাতি যদি ধর্মের নির্দেশ ব্যতীত প্রগতিপথে অগ্রসর হতে না পারে, যে প্রগতির স্রোত সদা প্রবহমান বলে কাজে কাজেই আমাদের যুগেও প্রবাহিত, তবে আমাদের যুগেরও অবশ্যই একটি ধর্ম আছে। ফলে আজকের যুগের সংস্কৃতিবান মানুষদের নিকট তা তৃপ্তি বা অতৃপ্তিদায়ক যাই হোক না কেন-তারা ধর্মের অস্তিত্ব অবশ্যই স্বীকার করবেন। সে ধর্ম ক্যাথলিক, প্রোটেস্টান্ট বা অণ্য কোন ধর্মীয় তন্ত্র নয়, বরং একটি ধর্মীয় উপলব্ধি-যা এমনকি আমাদের যুগেও যেখানে কোন প্রগতি দেখা যায় তার পথ-প্রদর্শকরূপে, সর্বদাই বিদ্যমান। এবং আমাদের মধ্যে যদি কোন ধর্মীয় উপলব্ধির অস্তিত্ব থাকে, তবে আমাদের শিল্পে যে সমস্ত অনুভূতি উপাদানরূপে ব্যবহৃত হয়েছে তার মূল্যায়ন হওয়া উচিত এই ধর্মীয় উপলব্ধির ভিত্তিতেই। এবং সর্বত্র সব সময় যেমন ঘটে আসছে তেমনি যে শিল্প আমাদের স্ব-কালের ধর্মীয় উপলব্ধি-জাত অনুভূতি-সঞ্চারক-তাকেই সকল পর্যায়ের নিকৃষ্ট শিল্প থেকে পৃথক করে স্বীকৃতি ও উচ্চ সমাদর এবং উৎসাহ দান করতে হবে। অপরপক্ষে সে উপলব্ধির বিপরীত স্রোতে প্রবাহিত শিল্পকে নিন্দা এবং ধিক্কারের বিষয় করে তুলতে হবে। এবং উদ্দেশ্যহীন বাকি সব শিল্পকেও কোন মর্যাদা বা উৎসাহের যোগ্য বিবেচনা না করাই উচিত।

আমাদের যুগের ধর্মীয় উপলব্ধি তার ব্যাপকতম ও সর্বাধিক বাস্তবপ্রয়োগের ক্ষেত্রে এই বোধসঞ্চারী চেতনার জন্ম দিয়েছে যে, আমাদের বৈষয়িক, আধ্যাত্মিক, ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত, ঐহিক এবং চিরকালীন মঙ্গল মানুষের ভ্রাতৃত্ববোধের বিকাশে এবং পারস্পরিক প্রেমময় সামঞ্জস্যের মধ্যে নিহিত। কেবলমাত্র খ্রীষ্ট এবং অতীত যুগে সমস্ত শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদের দ্বারাই যে এই উপলব্ধির অভিব্যক্তি ঘটেছে শুধু তাই নয়, আমাদের যুগের সর্বোৎকৃষ্ট ব্যক্তিদের দ্বারা বিভিন্ন রূপে বিচিত্র দিক থেকেও এই উপলব্ধির কথা পুনরাবৃত্ত হয়েছে। কিন্তু শুধুমাত্র তাই নয়, বরং এই উপলব্ধি মানুষের সর্ববিধ জটিল প্রয়াসের মর্মসন্ধানী সূত্র হিসেবে ইতিমধ্যেই কার্যকর। এ প্রয়াসের একদিকে আছে মানবমিলনের বস্তুগত এবং নৈতিক বাধার অপসারণ, অপর দিকে সকল মানুষের পক্ষে প্রযোজ্য এমন কতকগুলি সাধারণ নীতির প্রতিষ্ঠা-যা তাদের সর্বজনীন ভ্রাতৃত্বের অনুভূতিতে মিলিত করতে পারে এবং করাই প্রত্যাশিত। এই উপলব্ধির ভিত্তিতেই আমাদের জীভনের সমস্ত প্রত্যক্ষ ব্যাপারের যেমন মূল্যায়ন করা উচিত, তেমনি জীবনের অবশিষ্ট ক্ষেত্রে শিল্পেরও মূল্যায়ন হওয়া উচিত-যা কিছু এই ধর্মীয় উপলব্ধিজাত অনুভূতি সঞ্চারিত করে সমগ্র শিল্পজগৎ থেকে সে ধরনের নিদর্শন নির্বাচন, তাদের উচ্চ প্রশংসা এবং উৎসাহ দান, এবং যা কিছু এর পরিপন্থী-সেগুলিকে খারিজ করা এবং বাকি সমস্ত শিল্পেরও যে গুরুত্ব প্রাপ্য নয়, তা না দেওয়া।

তথাকথিত রেনেসাঁসের যুগে উচ্চবর্গীয় লোকেরা একটি বড় ভুল করেছিলেন-সে ভুলের আমরা এখনও পুনরাবৃত্তি করে চলেছি। সেই ভুল কেবল এই নয় যে, তারা ধর্মীয় শিল্পের প্রতি কোন গুরুত্ব আরোপ করেননি-তাদের ভুল হল এই যে, অনুপস্থিত ধর্মীয় শিল্পের স্থলে তারা একটি নগণ্য, শুধুমাত্র তৃপ্তিদায়ক শিল্পকে স্থাপন করেছিলেন। অর্থাৎ ধর্মীয় শিল্পের বদলে তারা এমন শিল্পের নির্বাচন, সমাদর করতে ও উৎসাহ দিতে শুরু করলেন-যা কোন মতেই সেরূপ সম্মান ও উৎসাহের যোগ্য নয়। সে যুগের লোকেরা যে ধর্মীয় শিল্পের প্রতি কোন গুরুত্ব দেননি তার কারণ হল, এ যুগের অভিজাতবর্গের মতই তাঁরা অধিকাংশ জনগণ-গৃহীত ধর্মমতে কোন আস্থা স্থাপন করতে পারেননি। জনৈক ধর্মযাজকের বক্তব্য হল, ঈশ্বরের সম্পর্কে মানুষের অজ্ঞতা ততটা মারাত্মক নয় যতটা মারাত্মক তারা ঈশ্বরের স্থলে অনিশ্বরকে স্থাপন করেছে। শিল্পের বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য।

আমাদের কালের অভিজাত সমাজের বড় দুর্ভাগ্য ততটা নয় যে-তারা ধর্মীয় শিল্প- বঞ্চিত, বরং সমগ্র শিল্প-জগতে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ এবং মূল্যবান ধর্মীয় শিল্প বলে যা চিহ্নিত তার জায়গায় তারা নির্বাচন করেছেন সব চাইতে গুরুত্বহীন এবং সাধারণত ক্ষতিকর এমন শিল্প-যার লক্ষ্য শুধুমাত্র কতিপয় লোককে আনন্দ দেওয়া। সুতরাং যে খ্রীষ্টীয় নীতিনির্ভর সর্বজনীন ঐক্যের মধ্যে আমাদের স্ব-যুগের ধর্মীয় উপলব্ধি নিহিত-এ শিল্প অন্ততপক্ষে তার ব্যতিক্রমী স্বভাবের জন্যেও সে নীতির পরিপন্থী। ধর্মীয় উপলব্ধিময় শিল্পের পরিবর্তে শূন্যগর্ভে এবং দূষিত শিল্পকে অনেক সময় তুলে ধরা হচ্ছে, এবং মানুষকে উন্নত করবার জন্য যে যথার্থ ধর্মীয় শিল্পের প্রয়োজন, এই অসৎ শিল্প সেই প্রয়োজনটাকেই গোচরে আসতে দেয় না।

যে শিল্প আমাদের যুগের ধর্মীয় উপলব্ধির দাবিকে পূরণ করে তা পূর্ব যুগের শিল্প থেকে সম্পূর্ণ পৃথক-এটা স্বীকার্য। কিন্তু এই বৈসাদৃশ্য সত্ত্বেও যে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় নিজের নিকট থেকে সত্য গোপন করেন না, তাঁর নিকট আমাদের যুগের ধর্মীয় উপলব্ধিময় শিল্পের স্বরূপ অত্যন্ত স্বচ্ছ এবং সুনির্দিষ্ট। পূর্বযুগে উচ্চতম ধর্মীয় উপলব্ধি কেবলমাত্র কিছু সংখ্যক লোককে মিলিত করত বলে (তাদের সমাজের গঠন বৃহৎ হলেও তা আরও অনেক সমাজের মধ্যে একমত-যেমন, ইহুদিরা, এথেনীয়গণ অথবা রোমান নাগরিকবৃন্দ) সেই সময়ের শিল্প-সঞ্চারিত অনুভূতি উৎসারিত হত সে সমাজের শক্তি, মহত্ত্ব, যশ এবং উন্নতির আকাঙ্ক্ষা থেকে এবং সে শিল্পকর্মের নায়ক হতেন এমন সমস্ত ব্যক্তি যারা শক্তি, কৌশল, বঞ্চনা অথবা নিষ্ঠুরতার সাহায্যে সে উন্নতির জন্য কিছু অবদান রাখতেন (যেমন, ইউলিসিস, জেকব, ডেভিড, স্যামসন, হারকিউলিস প্রভৃতি এ পর্যায়ের অপরাপর সমস্ত নায়ক)। কিন্তু আমাদের যুগের ধর্মীয় উপলব্ধি কোন বিশেষ একটি সমাজকে বেছে নেয় না, বরং তা মানুষের মিলন দাবি করে- ব্যতিক্রমহীনভাবে সম্পূর্ণত সকল মানুষেল এবং সর্বমানবের ভ্রাতৃত্ববোধকে অন্য সকল গুণের চাইতে উচ্চতর স্থান দেয়। সুতরাং আমাদের যুগের শিল্প-সঞ্চারিত অনুভূতি পূর্বযুগের শৈল্পিক অনুভূতির সঙ্গে শুধু যে সমধর্মী হতে পারে না তা নয়, বরং অনিবার্যত তার বিপরীত স্রোতে প্রবাহিত হতে বাধ্য।

প্রকৃত খ্রীষ্টীয় শিল্প এতকাল পর্যন্ত প্রতিষ্ঠা পাওয়ার চেষ্টা সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত স্ব-প্রতিষ্ঠা হতে পারেনি। এর একমাত্র কারণ, মানবতা যেভাবে ক্ষুদ্র পদক্ষেপে সতত প্ৰগতি লাভ করে-খ্রীষ্টীয় ধর্মীয় উপলব্ধি ঠিক তদনুরূপ ছিল না। বরং সে উপলব্ধি এমন প্রচন্ড বিপ্লবের মতো-যা মানবসমাজের সম্পূর্ণ জীবনধারণাকে তথা সে জীবনের সামগ্রিক অভ্যন্তরীণ সংগঠনকে যদি এখনও সম্পূর্ণ বদলে না দিয়ে থাকে, ক্রমে বদলে ফেলবেই। একথা সত্য, ব্যক্তিজীবনের মতো মানবসমাজেও নিয়মিত গতিতে অগ্রসর হয়। কিন্তু সেই নিয়মিত গতির মধ্যেও এমন ক্রান্তিকালের আবির্ভাব হয়-যা পূর্ববর্তী ও পরবর্তী জীবনের মধ্যে সুনির্দিষ্ট ভেদরেখা অঙ্কিত করে। খ্রীষ্ট ধর্মের আবির্ভাব এরকমই একটি ক্রান্তিলগ্ন-অন্তত আমরা যারা খ্রীষ্টীয় ধর্মচেতনার আলোক জীবন নির্বাহ করি আমাদের কাছে সে রকম মনে হওয়া খুবই স্বাভাবিক। খ্রীষ্টীয় উপলব্ধি সকল মানবীয় অনুভূতিকে আর একটি নতুন দিকে চালিত করেছিল এবং কাজে কাজেই সেই উপলব্ধি শিল্পের বিষয়বস্তু এবং তাৎপর্য-উভয়কেই ইহুদিরা সম্পূর্ণভাবে পরিবর্তিত করেছিল। গ্রীকরা পারসিক শিল্পের ব্যবহার জানত, রোমানেরাও গ্রীক শিল্প-ব্যবহারে অভ্যস্ত ছিল। অথবা অনুরূপভাবে ইহুদিরা ইজিপ্সীয় শিল্পের অনুসরণ করত, তাদের শিল্পগত মৌলিক আদর্শ ছিল এক এবং সমপর্যায়ের। সে আদর্শ ছিল কখনও পারস্যবাদীদের মহত্ত্ব এবং সমৃদ্ধি, কখনও গ্রীকদের মহত্ত্ব ও সমৃদ্ধি এবং কখনও বা রোমানদের। সেই একই শিল্পকে ভিন্নতর পরিস্থিতিতে স্থানান্তরিত করায় সেই শিল্প নতুন জাতিসেবায় নিয়োজিত হয়েছিল। কিন্তু খ্রীষ্টীয় আদর্শ সব কিছুকে পরিবর্তিত ও ওলট-পালট করে দিল। ফলে, খ্রীষ্ট বাণীতে যেমন বলা হয়েছে : ‘মনুষ্য সমাজে যা ছিল উচ্চ-প্রশংসিত ঈশ্বরের দৃষ্টিতে তাই হয়ে দাঁড়াল অতি ঘৃণার্হ বস্তু।’ প্রাচীন মিশরের রাজার অথবা কোন কোন রোমান সম্রাটের মহত্ত্ব অতঃপর আদর্শ বলে আর বিবেচিত হল না, কোন গ্রীকের সৌন্দর্য অথবা ভিনিসিয়ার ঐশ্বর্যের কথাও বলা হল না, বরং বিনয়, পবিত্রতা, করুণা এবং প্রেমই সেই আদর্শের স্থান গ্রহণ করল। ডাইভিস (Dives) (বাইবেলোক্ত ধনী ব্যক্তি) আর এখন নায়ক রইলেন না, নায়কের মর্যাদা দেওয়া হল ভিখিরি লেজেরাসকে (Lazarus) সৌন্দর্যলিপ্ত জীবনের মেরী মেকডেলিন নয়, তার অনুতাপদগ্ধ জীবনই প্রাধান্য পেল। সম্পদ আহরণকারীদের কথা না বলে বলা হল এমন ব্যক্তিদের কথা যারা সম্পদ পরিত্যাগ করেছে। প্রাসাদে বসবাসকারীরা নন, ভূগর্ভস্থ সমাধি ও কুডেঘরবাসীরাই প্রাধান্য পেল, শাসকগোষ্ঠীরা নন, যাঁরা ঈশ্বর ব্যতীত অপর কারো কর্তৃত্ব স্বীকার করেন না, তাঁদেরই মুখ্য স্থান দেওয়া হল। বিজয়ীদের মূর্তি-সম্বলিত বিজয়সূচক গির্জা আর শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্ম বলে বিবেচিত হল না, বরং যন্ত্রণাবিদ্ধ এবং নিহত হয়েও অত্যাচারীর প্রতি করুণা এবং ভালোবাসায় নবজন্মপ্রাপ্ত মানবাত্মার প্রতিরূপ শিল্পকর্মকেই শ্রেষ্ঠ শিল্পের মর্যাদা দেওয়া হল।

এই পরিবর্তন এত বিরাট যে, খ্রীষ্টীয় জগতের মানুষের পক্ষে পূর্বতন আজীবন-অভ্যস্ত অ খ্রীষ্টীয় শিল্পের গতানুগতিকতা প্রতিরোধ করা কঠিন হয়ে দাঁড়াল। খ্রীষ্টীয় ধর্মভিত্তিক শিল্পের বিষয়বস্তু তাদের নিকট এত অভিনব এবং পূর্ববর্তী শিল্পের বিষয়বস্তু থেকে তা এত ভিন্নধর্মী ছিল যে, সেই খ্রীষ্টীয় শিল্প তাদের নিকট শিল্পের অস্বীকৃতি বলেই অনুভূত হল, এবং এ কারণে তারা মরীয়া হয়ে পুরাতন ঐতিহ্যগত শিল্পকেই আঁকড়ে রইল। কিন্তু এই পুরাতন শিল্প আমাদের যুগে কোন ধর্মীয় উপলব্ধিজাত না হওয়ায় তার তাৎপর্য হারিয়েছে। সুতরাং আমাদের অভিপ্রেত হোক বা না হোক, সেই পুরাতন শিল্প আমাদের পরিত্যাগ করতেই হবে।

প্রত্যেক মানুষই ঈশ্বরের সন্তান-এ কারণে ঈশ্বরের সঙ্গে মানুষের এবং মানুষের পারস্পরিক মিলনের স্বীকৃতির মধ্যেই খ্রীষ্টীয় উপলব্ধির সারমর্ম নিহিত-খ্রীষ্টের উপদেশবাণীতেও এ কথা বলা হয়েছে (Rbxviiz) সুতরাং খ্রীষ্টীয় শিল্পের বিষয়বস্তু এই প্রকৃতির : অনুভূতির মাধ্যমেই মানুষ ঈশ্বরের সঙ্গে এবং পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হতে পারে।

মানুষকে ঈশ্বরের সঙ্গে এবং পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত কর-এমন ধরনের কথা সে পর্যায়ের মানুষের কাছে অস্পষ্ট মনে হতে পারে-যারা প্রথাসিদ্ধ এ সমস্ত কথার অসদ্ব্যবহারে অভ্যস্ত। এতদ্‌সত্ত্বেও এ সমস্ত কথার সম্পূর্ণ পরিষ্কার একটি অর্থ আছে। তা এ নির্দেশই দেয় যে,-খ্রীষ্টীয় অনুভূতিজাত মানবমিলন (যা সীমিত সংখ্যক লোকের স্বাতন্ত্র্যবাদী মিলনবিরোধী) সেই ধরনের বস্তু যা ব্যতিক্রমহীনভাবে সকল মানুষকে একত্রিত করে।

শিল্প মাত্রেরই বৈশিষ্ট্য হল এই যে, তা মানুষকে মিলন-সূত্রে গ্রথিত করবে। প্রত্যেক শিল্পের ক্ষেত্রেই যাদের চিত্তে শিল্পীর অনুভূতি সঞ্চারিত হয়, শিল্পীর সঙ্গে ওই সমস্ত ব্যক্তির একটি আত্মিক সংযোগও স্থাপিত হয়। শুধু তাই নয়, ওই শিল্পীর দ্বারা প্রভাবিত সকলের মধ্যেই একটা আত্মিক যোগ সংস্থাপিত হয়। কিন্তু খ্রীষ্টীয় অনুভূতিবর্জিত শিল্প কিছু সংখ্যক লোককে যেমন মিলিত করে, তেমনি সেই মিলনকেই ওই মিলনভুক্ত মানুষ এবং অপরাপর জনসাধারণের মধ্যে বিভেদের কারণ করে তোলে। ফলে এ ধরনের মিলন অনেক সময় শুধু বিভেদের উৎসে পরিণত হয় না, এমনকি অপরের প্রতি শত্রুতার উৎসেও পর্যবসতি হয়। সংগীত, কবিতা, স্মৃতিস্তম্ভ প্রভৃতির মধ্যে অভিব্যক্ত সকল দেশাত্মবোধক শিল্পই এই পর্যায়ের। গির্জা-সম্পৃক্ত সকল শিল্প অর্থাৎ প্রতিমা, ভাস্কর্য, শোভা যাত্রা এবং অপর আঞ্চলিক উৎসবগুলিসব কোন কোন ধর্মীয় গোষ্ঠীর শিল্পও এই প্রকৃতির। এ ধরনের শিল্প খুবই অ-সামরিক এবং অ-খ্রীষ্টীয়। এ জাতীয় শিল্পে এক তন্ত্রীয় লোকদের মিলনসূত্রে গ্রথিত করা হয় শুধুমাত্র অপর তন্ত্রীয় লোকদের সঙ্গে অধিকতর তীব্রভাবে বিভেদ জাগানোর জন্য, এমনকি তাদের পরস্পরের মধ্যে বৈরিতার সম্পর্ক সৃষ্টি করবার জন্য। খ্রীষ্টীয় শিল্পের প্রবণতা কোন ব্যতিক্রম ছাড়াই সকলের মিলন সাধনের দিকে। শুধু ব্যক্তি মানুষ নয়, সকল মানুষই ঈশ্বর এবং প্রতিবেশীদের সঙ্গে সে একই সম্বন্ধসূত্রে বদ্ধ, খ্রীষ্টীয় শিল্প সে উপলব্ধি জাগ্রত করে, অথবা মানুষের মধ্যে সমজাতীয় অনুভূতির উদ্রেক করে। সে অনুভূতির স্বরূপ সরলতম হতে পারে,-তবে এই শর্তে যে, তা যেন খ্রীষ্টীয় আদর্শবিরোধী না হয় এবং তা অব্যতিক্রমে প্রত্যেকের নিকট স্বাভাবিক বলে অনুভূত হয়।

আমাদের যুগের সৎ খ্রীষ্টীয় শিল্প জনসাধারণের নিকট দুর্বোধ্য হতে পারে। সে দুর্বোধ্যতা আসতে পারে তার রূপের অসম্পূর্ণতা অথবা মানুষের অনবধানতার জন্য, কিন্তু সে শিল্পের প্রকৃতি এমন হওয়া দরকার যাতে সকল পর্যায়ের মানুষের চিত্তে সে শিল্প-সঞ্চারিত অনুভূতির উপলব্ধি ঘটে। সে শিল্প কোন গোষ্ঠীভুক্ত মানুষের, অথবা কোন শ্রেণীর, অথবা কোন জাতির অথবা কোন ধর্মীয় তন্ত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ হবে না,- যা বিশেষ কোন আদর্শে শিক্ষাপ্রাপ্ত কোন মানুষেরই শুধু অধিগম্য হবে, কিংবা যার ভেতর শুধুমাত্র কোন অভিজাত, কোন ব্যবসায়ী অথবা কেবলমাত্র একজন রুশ, অথবা একজন জাপানি, অথবা কোন রোমান ক্যাথলিক অথবা একজন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী অথবা ওই জাতীয় কার প্রবেশাধিকার থাকবে। বরং সে শিল্প অবশ্যই এমন অনুভূতিসমূহের সঞ্চার করবে, যা প্রত্যেক ব্যক্তির অধিগম্য। কেবলমাত্র এ ধরনের শিল্পই আমাদের যুগে সৎ-শিল্প বলে স্বীকৃত হতে পারে। অবশিষ্ট সকল শিল্প থেকে একমাত্র এ পর্যায়ের শিল্পই নির্বাচিত এবং উৎসাহিত হবার যোগ্য।

মৌলিক অর্থে ক্যাথলিক শব্দ বলতে যা বোঝায় খ্রীষ্টীয় শিল্প অর্থাৎ আমাদের যুগের শিল্প হবে ঠিক সে প্রকৃতির অর্থাৎ সর্বজনীন, এবং কাজে কাজেই সে শিল্পের ভূমিকা হওয়া উচিত সকল মানুষকে মিলিত করা। শুধুমাত্র দুই প্রকরণের অনুভূতিই সর্বমানবকে মিলিত করেঃ প্রথম, মানুষ মাত্রই যে ঈশ্বরের সন্তান এবং পরস্পর ভ্রাতৃত্ববন্ধনে আবদ্ধ-এই উপলব্ধিজাত অনুভূতি, এবং দ্বিতীয়ত, সাধারণ মানবজীবনের সরল অনুভূতি যা অব্যতিক্রমে সর্বসাধারণের অনুভূতিবেদ্য-যেমন, আনন্দ, করুণা, উল্লাস, প্রশান্তি প্রভৃতির অনুভূতি। শুধুমাত্র এই দুই পর্যায়ের অনুভূতিই এখন সৎ বিষয়বস্তু-প্রধান শিল্পের উপাদান যোগাতে পারে।

এই দুই প্রকরণের শিল্পের ক্রিয়া ব্যাহত খুবই বিসদৃশ হলেও বাস্তবিক পক্ষে এক এবং সমপর্যায়ের। ঈশ্বরের সন্তানত্ব এবং মানুষের ভ্রাতৃত্বের চেতনা থেকে উদ্ভুত অনুভূতিসমূহ-যেমন সত্যে নিশ্চয়তা, ঈশ্বরের ইচ্ছার প্রতি অনুরক্তি, আত্মোৎসর্গ, মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা-এ সমস্তই ধর্মীয় উপলব্ধি দ্বারাই উদ্রিক্ত। এ ছাড়া সহজতম অনুভূতিসমূহ- যেমন কোন সংগীত অথবা সর্বজনবোধ্য আমোদজনক কোন কৌতূক অথবা মর্মস্পর্শী কোন কাহিনি, অথবা কোন চিত্রাঙ্কন অথবা ছোট্ট একটি পুতুল-প্রভাবিত কোমল অথবা উৎফুল্ল মানসিকতা-এই দুই পর্যায়ের অনুভূতিই এক প্রকার এবং সমপর্যায়ের অনুভূতি সৃষ্টি করে। সে পরিণামী প্রভাব মানুষের সঙ্গে মানুষের পরিপূর্ণ মিলনের। কখনও দেখা যায়, পরস্পর বৈরীভাবাপন্ন না হলেও মেজাজমর্জি এবং অনুভূতির দিক থেকে কিছুটা বিরুদ্ধভাবাপন্ন মানুষ যদি একত্রিত হয় এবং যদি একটি গল্প, অভিনয়, চিত্র, এমনকি একটি ভবনের সৌন্দর্য এবং সর্বোপরি সংগীতের মাধুর্য উপভোগ করে, তবে তা যেন বিদ্যুচ্চমকের মতো সকল হৃদয়কে সম্মিলিত করে। পূর্বেকার বিচ্ছিন্নতা এমনকি বৈরিতা সত্ত্বেও তখন তারা পারস্পরিক মিলন এবং প্রীতি সম্পর্কে সচেতন হয়। প্রত্যেকেই এ জন্য আনন্দ অনুভব করে যে, অপর ব্যক্তির অনুভূতিও ঠিক তার নিজেরই মতো। উপস্থিত সকলের সঙ্গে তার পারস্পরিক ভাববিনিময় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এ জন্যই শুধু সে সুখী নয়, বরং সমকালীর জীবিত সকল ব্যক্তিই যে তাঁর ওই অনুভূতি মৃত্যুর পরও বিস্তারিত হবে, অতীতে যারা একই অনুভূতির দ্বারা এখনও প্রভাবিত হবার অপেক্ষায় আছে-তাদের সকলের সঙ্গে এই আত্মিক যোগের অনুভূতি তার চিত্তে একটা নিগূঢ় আনন্দের সঞ্চার করে। যে ধর্মীয় চেতনাময় শিল্প ঈম্বর এবং প্রতিবেশীর প্রতি প্রেমের অনুভূতি সঞ্চারিত করে এবং সর্বজনীন শিল্প সরলতম অনুভূতি সঞ্চার করে-এই উভয় পর্যায়ের শিল্পের সাহায্যেই এই মনোভাব সৃষ্টি হয়।

মুখ্যত যে একটি দিক থেকে পূর্ব যুগের শিল্প থেকে আমাদের যুগের শিল্পের পৃথক মূল্যায়ন হওয়া উচিত সেটি এই : খ্রীষ্টীয় শিল্প (ধর্মীয় উপলব্ধির ওপর প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় যা মানুষের মিলন দাবি করে) সৎ বিষয়বস্তু-সমন্বিত শিল্পরাজ্য থেকে এমন সব স্বাতন্ত্র্যধর্মী অনুভূতিকে বর্জন করে-যা মানুষকে পরস্পর মিলিত না করে তাদের বিচ্ছেদ ঘটায়। এই শিল্প এ জাতীয় স্বাতন্ত্র্যধর্মী শিল্পকর্মকে অসৎ বিষয়বস্তু-সমন্বিত বিবেচনায় শিল্পজগত থেকে নির্বাসিত করে। অপরপক্ষে পূর্বে নির্বাচনযোগ্য এবং সম্মানযোগ্য বিবেচিত না হলেও খ্রীষ্টীয় শিল্প এমন কিছু শিল্পকর্মকে সৎ-বিষয়বস্তু সম্বলিত শিল্পের পর্যায়ভুক্ত করে যার গুণ সর্বজনীনতা, অর্থাৎ তা অতি অকিঞ্চিতকর ও সরল অনুভূতি-সম্পন্ন হলেও তা সর্বমানব-হৃদয়সংবেদ্য এবং সকল মানুষের মিলন- বিধায়ক। আমাদের যুগে এরূপ শিল্প-সৎ-শিল্পের মর্যাদা লাভ না করেই পারে না, যেহেতু খ্রীষ্টধর্ম আমাদের কালের ধর্মীয় উপলব্ধিকে মানবতার সামনে যে আদর্শে স্থাপিত করেছে-এ শিল্পে সে আদর্শই মূর্ত হয়েছে।

খ্রীষ্টীয় শিল্প মানুষের মনে হয় ভগবৎপ্রীতি এবং প্রতিবেশীর প্রতি প্রীতিপূর্ণ অনুভূতির উদ্বোধন ঘটিয়ে মানুষকে গভীর থেকে গভীরতর মিলনের দিকে আকর্ষণ করে এবং ওই মিলনের জন্য তাদের প্রস্তুত ও সক্ষম করে তোলে। অথবা সে শিল্প তাদের মনে এমন অনুভূতি উদ্রেক করে যার প্রভাবে এই সত্য তাদের কাছে উদ্‌ঘাটিত হয় যে-তারা সর্বমানবের সুখে দুঃখে একাত্ম। সুতরাং আমাদের যুগে খ্রীষ্টীয় শিল্প দুই পর্যায়ভুক্ত হতে পারে এবং বাস্তবিকপক্ষে তার স্বরূপও দ্বিবিধ : প্রথম, ঈশ্বর ও প্রতিবেশীর সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের ফলে ধর্মীয় উপলব্ধিজাত অনুভূতি-সঞ্চারক শিল্প-সীমিত অর্থে যাকে বলা যায় ধর্মীয় শিল্প; দ্বিতীয়ত, সাধারণ জীবনের সরলতম অনুভূতি-সঞ্চারক শিল্প-যে সব অনুভূতি সর্বকালে সর্বমানব সংসারে সকল হৃদয়-সংবেদ্য-সর্বসাধারণের জীবন সম্পর্কীয় শিল্প-জনগণের শিল্প-অর্থাৎ সর্বজনীন শিল্প। এই দুই প্রকরণের শিল্পই আমাদের যুগে সৎ-শিল্প বলে বিবেচিত হবার যোগ্য।

প্রথমটি, অর্থাৎ ধর্মীয় শিল্প ঈশ্বর ও প্রতিবেশীর প্রতি সদর্থক ভালোবাসার অনুভূতি এবং প্রীতিভঙ্গজনিত নঞর্থক ক্রোধ, ঘৃণা ও ভয়-এই উভয় জাতীয় অনুভূতির সঞ্চার করে। এই অনুভূতির অভিব্যক্তি ঘটে মুখ্যত ভাষারূপের মাধ্যমে এবং কিয়ৎ পরিমাণে চিত্রশিল্পে এবং ভাস্কর্যশিল্পেও। দ্বিতীয় প্রকরণের সার্বজনীন শিল্প সর্বজনের অধিগম্য অনুভূতি সঞ্চারিত করে অভিব্যক্তি লাভ করে ভাষায়, চিত্রশিল্পে, স্থাপত্যে, নৃত্যে, ভাস্কর্যে এবং সর্বোপরি সংগীতে।

এই প্রকরণের প্রতিটি শিল্পের আধুনিক উদাহরণ দিতে আমাকে যদি বলা হয়, তবে ঈশ্বর এবং মানুষের পতি প্রীতিসঞ্জাত শ্রেষ্ঠতম শিল্পের উদাহরণ হিসেবে (উচ্চতর- সদর্থক, নিম্নতর-নঞর্থক-এ উভয় পর্যায়ের) সাহিত্যে আমি নাম করব শীলারের The Robbers, ভিক্টর হুগোর Les Pauvres Gens এবং Les Miserables, ডিকেন্সের উপন্যাস ও ছোটগল্প – The Tale of Two Cities, The Christmas Carol, The chimes এবং অপর উদাহরণের মধ্যে- Uncle Tom’s Cabin, দস্তয়ে- ভস্কির (Dostoevski) রচনাসমূহ-বিশেষ করে তাঁর Memoirs from the House of Death জর্জ এলিয়টের Adam Bede।

আশ্চর্যের কথা, আধুনিক চিত্রশিল্পে, বিশেষভাবে খ্যাতনামা চিত্রশিল্পীদের এই প্রকরণের শিল্পকর্মে ঈশ্বর ও প্রতিবেশীর প্রতি প্রত্যক্ষ খ্রীষ্টীয় ভালোবাসার অনুভূতি-সঞ্চারক শৈল্পিক দৃষ্টান্ত প্রায় দেখতেই পাওয়া যায় না। খ্রীষ্টের উপদেশাত্মক কাহিনিসমূহকে কেন্দ্র করে প্রচুর চিত্রাবলী আছে। ঐতিহাসিক ঘটনার পুঙ্খনুপুঙ্খ ঐশ্বর্যময় বর্ণনা সত্ত্বেও এ পর্যায়ের চিত্রশিল্পীদের জীবনে ধর্মীয় অনুভূতির অস্তিত্ব না থাকায় এই চিত্রগুলি শুধু যে ওই জাতীয় অনুভূতি সঞ্চার করে না তা নয়, সে অনুভূতি সঞ্চারে অক্ষমও। বিচিত্র মানুষের ব্যক্তিগত অনুভূতিকেন্দ্রিক অনেক চিত্র আছে, কিন্তু আত্মোৎসর্গমূলক মহৎ কর্ম এবং খ্রীষ্টীয় প্রেমের নিদর্শক চিত্রের সংখ্যা খুবই স্বল্প। এই স্বল্পসংখ্যক চিত্রগুলিও মুখ্যত অখ্যাত শিল্পী অঙ্কিত এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেগুলি চিত্রপদবাচ্যও নয়-রেখাচিত্র মাত্র। এ পর্যায়ের দৃষ্টান্ত কধসংশড়ু-অঙ্কিত রেখাচিত্র-যা তাঁর অনেক নিখুঁত চিত্রের মধ্যে মূল্যবান। সে চিত্রে অলিন্দ সহ একটি বিশ্রামকক্ষ দেখানো হয়েছে-যা অতিক্রম করে যাচ্ছে যুদ্ধ-প্রত্যাগত বিজয়-উল্লাসদীপ্ত সৈন্যেরা। সে অলিন্দে একটি ক্ষুদ্র শিশু ও বালককে ধরে একজন স্তন্যদাত্রী ধাত্রী দন্ডায়মান। তারা ষৈন্যদলের শোভাযাত্রার প্রশংসারত, কিন্তু মা রুমাল দিয়ে মুখ আবৃত করে সোফায় পড়ে ক্রন্দনরতা। ওয়ালটার লেংলি-র অনুরূপ চিত্রের কথাও আমি পূর্বে উল্লেখ করেছি। এ প্রকরণের আর একটি চিত্র ফরাসি শিল্পী মোরলোন (Morlon) অঙ্কিত। প্রবল ঝঞ্ঝার মধ্যে ধ্বংসোন্মুখ একটি জাহাজের সাহায্যার্থ একটি জীবনরক্ষক নৌকো দ্রুত ধাবমান-এ দৃশ্যের বর্ণনা দিয়ে চিত্রখানি রচিত। সশ্রদ্ধ এবং সপ্রেম-বর্ণনাত্মক কঠোর শ্রমশীল কৃষকের আর একখানি চিত্রও শিল্পগুণের দিক থেকে উক্ত চিত্রগুলির প্রায় সমগোত্রীয়। মিলে (Millet) রচিত চিত্রগুলিও অনুরূপ, বিশেষ করে তাঁর ‘নিড়ানি সহ মানুষ’ (The man wiht the Hoe) নামক রেখাচিত্রটি। এই শৈলীতে রচিত জুল ব্রেতোঁ (Jules Breton), লেরমিং (Lhermitte), ডেফ্রেগার (Defregger) এবং আরও কোন কোন শিল্পীর চিত্রবালীও এই পর্যায়ের। ভগবৎ এবং মানবপ্রেমের অস্বীকৃতি হেতু যে ঘৃণামিশ্রিত ক্রোধ এবং ভয়াবহ অনুভূতির সৃষ্টি হয়-এমন চিত্রের দৃষ্টান্ত, গে-র (Gay) ছবি বিচার (Judgement) এবং লাইসেন মায়ার (Leizen-Mayer)- এর মৃত্যুদন্ডের স্বাক্ষর (Signing the Death Warrant)। তবে এ প্রকরণের চিত্রের সংখ্যাও খুবই স্বল্প। চিত্র রচনার কলাকৌশল এবং চিত্রের অধিকাংশ স্থলে সৌন্দর্য সমাবেশের জন্য আকুতি অনেক সময় অনুভূতিকে আচ্ছন্ন করে। উদহারণ স্বরূপ, জেরোমের (Geromes) ‘Pollice Verso’ নামক চিত্রটি অনুষ্ঠিত বিষয়ের ভয়াবহতাকে ঠিক সে পরিমাণে পরস্ফুট করে তোলে না-যে পরিমাণে সে দৃশ্যের সৌন্দর্যের আকর্ষণকে অভিব্যক্তি দেয়।

আমাদের অভিজাত শ্রেণীসৃষ্ট দ্বিতীয় প্রকরণের আধুনিক শিল্প : সৎ সর্বজনীন শিল্প, এমনকি একটি জাতির জীবনকেন্দ্রিক শিল্পের উদাহরণ দেওয়া আরও শক্ত-বিশেষত সাহিত্যে ও সংগীতে। অন্তনির্হিত বিষয়বস্তুর জন্য কিছু সৃষ্টিকর্মকে যদিও বা এ শ্রেণীর অন্তর্ভূক্ত করা যেত (যেমন, ডন কুইকসট, মলিয়েরের কমেডিগুলি, ডিকেন্সের ডেভিড কপারফিল্ড এবং পিকউইক পেপারস, গোগোল এবং পুসকিনের কাহিনিগুলি এবং মোপাসাঁর কিছু রচনা) অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী অনুভূতি সঞ্চার করায় এবং কাল ও অঞ্চল সম্পর্কীয় বিশেষ খুঁটিনাটি বর্ণনার আতিশয্য থাকা হেতু এবং সর্বোপরি প্রাচীন শিল্পসমূহের উদাহরণের তুলনায় (দৃষ্টান্ত, যেমন যোশেফের গল্প) বিষয়বস্তুর দৈন্যের জন্য শুধুমাত্র নিজেদের গোষ্ঠীর মানুষের কাছেই এগুলি বোধগম্য। যেমন, যোশেফের ভাইয়েরা তার প্রতি পিতার অত্যধিক স্নেহের জন্য ঈর্ষাকাতর হয়ে যোশেফকে বণিকদের নিকট বিক্রি করে দিল; পতিফারের (Potiphar) স্ত্রী যুবকটিকে প্রলুব্ধ করতে ইচ্ছুক হল এবং সর্বোচ্চ পদাখিকার লাভ করবার পর প্রিয় বেঞ্জামিন সহ সে ভাইয়েদের প্রতি করুণাপরায়ণ হল, -এগুলি এবং এ পর্যায়ের অপরাপর সমস্ত অনুভূতি শুধুমাত্র একজন রুশ কৃষকের নিকট নয়, একজন চীনদেশবাসী, একজন শিশু অথবা একজন বৃদ্ধ-শিক্ষিত অশিক্ষিত নির্বিশেষে সকলের নিকট সমান অধিগম্য। এবং এ সমস্ত বিষয় এত সংযমের সঙ্গে লিখিত, এত অবান্তর খুঁটিনাটিবর্ণনামুক্ত যে, যে কোন গোষ্ঠীর মানুষের নিকট তা বর্ণনা করা সম্ভব এবং তা সমানভাবে সকলের নিকট অধিগম্য ও মর্মস্পর্শী হবে। কিন্তু ডন কুইকসট অথবা মলিয়েরের নায়খদের (যদিও মলিয়ের বর্তমান যুগের শিল্পীদের মধ্যে সম্ভবত সর্বাপেক্ষা সর্বজনীন, সুতরাং সর্বোৎকৃষ্ট) অনুভূতি ঠিক এ পর্যায়ের নয়, এমনকি পিকউইক এবং তার বন্ধুদের অনুভূতিও ঠিক সেরূপ নয়। এদের অনুভূতি সকল মানুষের পক্ষে সমান নয়, ব্যতিক্রমী, এবং সে কারণে ওই সমস্ত অনুভূতিকে সংক্রামক করার উদ্দেশ্যে গ্রন্থকারেরা সেগুলির সকল দিকে স্থান এবং কালের প্রচুর খুঁটিনাটি বর্ণনার সমাবেশ করেছেন। যে সমস্ত পাঠক গ্রন্থকার-বর্ণিত জগতের সীমানার মধ্যে বাস করেন না, তাদের নিকট এই খুঁটিনাটি বর্ণনার অতি-বাহুল্য গল্পগুলিকে বোধগম্যতার দিক থেকে অত্যন্ত কষ্টসাধ্য করে তোলে।

যোশেফের কাহিনির লেখকের পক্ষে এ যুগের লেখকের বর্ণনা-রীতি অনুযায়ী যোশেফের রক্তরঞ্জিত কোট, জেকবের বাসগৃহ এবং পোশাকপ-পরিচ্ছদ, পটিফারের স্ত্রীর বিশেষ ভঙ্গি এবং পরিচ্ছদ, বাম বাহুতে বলয় পরাকালীন তার উক্তি-’আমার কাছে এসো’ ইত্যাদির বিস্তৃত বর্ণনার কোন প্রয়োজন ছিল না। এই উপন্যাসের বিষয়বস্তুগত অনুভূতির তীব্রতা এত বেশি যে,-’যোশেফ বেরিয়ে আর একটি ঘরে কাঁদতে গেল’-র মতো খুবই অপরিহার্য কথা ব্যতীত সমস্ত খুঁটিনাটি বর্ণনা অনাবশ্যক এবং আবেগ সঞ্চারের পক্ষে সেগুলি বাধাই সৃষ্টি করত মাত্র। সুতরাং এ উপন্যাস সকল পাঠকের উপলব্ধিগম্য, সর্বজাতির তরুণ, বৃদ্ধ সকল শ্রেণীর লোককে অভিভূত করে, এবং শুধুমাত্র আমাদের যুগ পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছে তা নয়,-অনাগত ভবিষ্যতে আরও হাজার হাজার বৎসর পর্যন্ত স্থায়ী হবে। কিন্তু আমাদের যুগের শ্রেষ্ঠ উপন্যাসের খুঁটিনাটি বর্ণনা যদি ছেঁটে ফেলা হয়, তবে তার আর থাকে কী?

সুতরাং সর্বজনীনতার দাবি সর্বতোভাবে পূরণে সক্ষম আধুনিক সাহিত্যে এমন রচনার হদিশ দেওয়া অসম্ভব। বর্তমান যুগপ্রচলিত রচনা সাধারণত ‘বাস্তবতা’ নামে অভিহিত বস্তুর দ্বারা অনেকাংশ পন্ড হয়। একে শিল্পে বাস্তবতার ‘শিল্পে গ্রাম্যতা’ বলাই বোধ হয় অধিকতর সঙ্গত।

একই কারণে কথাশিল্পের মতো সংগীত শিল্পেও অনুরূপ জিনিসই ঘটে থাকে। অন্ত নির্হিত অনুভূতি দৈন্যের জন্য বর্তমান সংগীতস্রষ্টাদের অদ্ভুত, শূন্যগর্ভ এবং অকিঞ্চিৎকর। এরূপ মূল্যহীন সুরসৃষ্ট প্রভাবকে শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যে নতুন সংগীতস্রষ্টারা প্রত্যেকটি তুচ্ছ সুরকে জটিল উত্থান-পতনের অঙ্গীভূত করেন। কিন্তু তাও করা হয় শুধু যে তাদের জাতীয় ভঙ্গিতেই তা নয়, পরম্ভ তাদের অতি-স্বাতন্ত্র্যবর্গী নিজেদের গোষ্ঠীর এবং সংগীত মতবাদীদের অনুসরণে। প্রত্যেকটি সুরই মুক্ত এবং সকলেরই বোধগম্য হতে পারে, কিন্তু যখনই তা বিশেষ কোন সুসমন্বয়ে গ্রথিত হয়, তখনি তা ওই সুর সমন্বয়ে অনুশীলনপ্রাপ্ত ব্যক্তি ছাড়া অপর কারো নিকট অধিগম্য হয় না। এবং শুধুমাত্র অপর জাতির সাধারণ লোকের নিকটই যে তা দুর্বোধ্য মনে হয় তা নয়, পরে কোন বিশিষ্ট সুর সমন্বয়ী রূপের সঙ্গে পরিচিত গোষ্ঠীর লোক ব্যতীত অপর সকল ব্যক্তির নিকটও তা অদ্ভুত মনে হয়। সুতরাং কবিতার মতো সংগীতও একটি দুষ্ট চক্রমধ্যে আবর্তন করে। তুচ্ছ এবং স্বাতন্ত্র্যধর্মী সুরগুলিকে আকর্ষণীয় করে তোলবার উদ্দেশ্যে তাদের ওপর সমন্বয়ী, ছন্দময়, ঐকতানিক জটিলতা চাপানো হয়। ফলে সেগুলি আরও স্বাতন্ত্র্যধর্মী হয়ে ওঠে এবং সার্বজনীন হওয়া তো দূরের কথা, জাতীয় পদবিরও যোগ্য নয়। অর্থাৎ সেগুলি সমগ্র জনগণের নিকট বোধগম্য না হয়ে শুধুমাত্র কতিপয় লোকের বোধগম্য হয়।

সংগীতে বিভিন্ন সুরকারদের রচিত সর্বজনীন শিল্পের দাবি পূরণকারী ছন্দময় চলন এবং নৃত্যের অনুষঙ্গী সুর ছাড়া এ পর্যায়ের খুবই স্বল্পসংখ্যক শিল্পের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে : যেমন, বাখ্ (Bach)-এর প্রসিদ্ধ বেহালার এরিয়া (aria), সোপার E Flat major-এ স্বপ্নময় সংগীত (nocturne), এবং সম্ভবত ছোট ছোট এক ডজন সংগীত (সমগ্র সংগীত নয়, সংগীতাংশ সমূহ) যা হেইড্‌ (Haydn), মোৎসার্ট (Mozart), শুবার্ট (Schubert), বেটোফেন (Beethoven) এবং সোপার (Chopin) রচনা থেকে নির্বাচন করা যেতে পারে।

চিত্রশিল্পে কবিতা ও সংগীতের মতো একই বস্তু পুনরাবৃত্ত হলেও-অর্থাৎ পরিকল্পনার দিক থেকে দুর্বল সৃষ্টিকর্মকে অধিকতর কৌতূহলোদ্দীপক করার উদ্দেশ্যে সকল দিকে স্থান-কালের খুঁটিনাটি বর্ণনাত্মক আনুষঙ্গিক বস্তুর সাহায্যে এমনিভাবে তাকে ঘিরে রাখা হয় যাতে সার্বজনীন আবেদন সৃষ্টির পরিবর্তে একটি সামরিক ও স্থানিক কৌতূহল সৃষ্টি হয় মাত্র। তথাপি শিল্পের অন্যান্য বিভাগের চাইতে-বিশেষভাবে চিত্রশিল্পে, এমন সৃষ্টিকর্মেরই বেশি সন্ধান মিলে যা সার্বজনীন খ্রীষ্টীয় শিল্পের দাবি পূরণ করে, অর্থাৎ সকল মানুষের অংশগ্রহণ করার মতো অনুভূতির অভিব্যক্তিমূলক শিল্পকর্মের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়।

চিত্রশিল্পে এবং ভাস্কর্য শিল্পে যে সমস্ত ছবি এবং মূর্তি তথাকথিত পরিচিত সাধারণ জীবননির্ভর শৈলীতে চিত, যেমন, পশুজীবনের প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র, প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী, প্রত্যেকের বোধগম্য বিষয়বস্তু নিয়ে রচিত ব্যঙ্গচিত্রাবলী, সকাল প্রকার অলংকার প্রভৃতি বিষয়বস্তুর দিক থেকে সর্বজনীন। চিত্রশিল্পে এবং ভাস্কর্যে এরূপ সৃষ্টিকর্মের সংখ্যা অসংখ্য (উদাহরণ, চীনা পুতুল)। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ জাতীয় কাজ (দৃষ্টান্ত স্বরূপ, সকল প্রকারের অলংকার প্রভৃতি) হয়ত শিল্প বলে বিবেচিতই হয় না, হলেও নিম্নমানের শিল্প বলে বিবেচিত হয়। বস্তুত এ সমস্ত নিদর্শন যদি শিল্পী- উপলব্ধ এবং প্রত্যেকের অধিগম্য অকৃত্রিম অনুভূতি সঞ্চারিত করে (তা আমাদের নিকট যত অকিঞ্চিৎকরই মনে হোক না কেন) তবে সেগুলি যথার্থ, সৎ এবং খ্রীষ্টীয় চেতনাসম্পন্ন শিল্প।

আমার ভয় হয় এখানে আমার বিরুদ্ধে একটি সবল আপত্তি উত্থাপিত হতে পারে। সেটি হল, সৌন্দর্যের ধারণা যে শিল্পকর্মের মান হতে পারে-তা অস্বীকার করবার পর অলংকারকে সৎ-শিল্পকর্মের নিদর্শন বলে স্বীকার করে আমি নিজেরই স্ব-বিরোধিতা করছি। এরূপ বিরূপ সমালোচনা অযৌক্তিক, যেহেতু সকল প্রকারের অলংকরণের বিষয়বস্তু শুধুমাত্র সৌন্দর্যের মধ্যে নিহিত নয়, বরং তা নিহিত শিল্পীর উপলব্ধিগত অনুভূতির মধ্যে (রেখার সঙ্গে রঙের মিশ্রণে যে বিস্ময় এবং আনন্দ জাগে তার মধ্যে)- যার সাহায্যেই তিনি দর্শকদের সংক্রমিত করেন। শিল্পের অবস্থিতি পূর্বে যেমন ছিল এবং যেরূপ হওয়া অবশ্য-কর্তব্য ঠিক তেমনই আছে-তা হল, শিল্পী-উপলব্ধ অনুভূতি যখন কোন ব্যক্তিবিশেষ বা অপর সকল ব্যক্তিকে সংক্রমিত করে-শিল্প তা ছাড়া আর কিছুই নয়। এ সমস্ত অনুভূতির মধ্যে দর্শন-ইন্দ্রিয়ের তৃপ্তিবিধায়ক অনুভূতিই আনন্দের। দর্শন-ইন্দ্রিয়ের তৃপ্তিবিধানে সমর্থ বস্তুসমূহ ক্ষুদ্র বা বৃহৎ জনসমষ্টিকে আনন্দ দিতে পারে, অথবা এমন হওয়া সম্ভব-যা সকল মানুষকেই আনন্দ দেয়। অলংকারও অধিকাংশ ক্ষেত্রে শেষোক্ত পর্যায়ের আনন্দ বিধায়ক বস্তু। একটি খুব অসাধারণ দৃশ্যের নিসর্গচিত্র অথবা বিশিষ্ট বিষয়কেন্দ্রিক সাধারণ কোন জীবনচিত্র হয়থ প্রত্যেককে আনন্দ দিতে পারে না, কিন্তু yakutsk অলংকার থেকে গ্রীক অলংকার পর্যন্ত সকল ধরনের গয়না সকলের বোধগম্য এবং সকলের মনে একই প্রকারের বিস্ময়বিমুগ্ধ প্রশংসার অনুভূতি জাগ্রত করে। সুতরাং খ্রীষ্টীয় সমাজে অবজ্ঞাত এ পর্যায়ের শিল্প ব্যতিক্রমী, দাম্ভিক চিত্রাবলী এবং ভাস্কর্যসমূহ থেকে উচ্চতর সম্মানীর আসন লাভেল যোগ্য বিবেচিত হওয়া উচিত।

সুতরাং সঞ্চারিত অনুভূতির পরিপ্রেক্ষিতে সৎ খ্রীষ্টীয় শিল্প মাত্র দুই প্রকরণের। অবশিষ্ট যে সমস্ত শিল্প এই দুই বিভাগের পর্যায়ভুক্ত নয়, সেগুলি অসৎ শিল্প বলে স্বীকৃত হওয়া উচিত। এ ধরনের শিল্প আনুকূল্য লাভের যোগ্য তো নয়ই, বরং শিল্পের ভূমিকায় মানুষকে মিলিত না করে পৃথক করায় বহিষ্কৃত, অস্বীকৃত এবং ধিকৃত হওয়াই উচিত। সাহিত্যশিল্পে যাজকীয় অথবা স্বাদেশিক অনুভূতি-সঞ্চারক সমস্ত উপন্যাস ও কবিতাও এ পর্যায়ের। এ ছাড়া মানবসমাজের অধিকাংশের সম্পূর্ণ অনধিগম্য অলস ধনিকশ্রেণীর স্বাতন্ত্র্যপূর্ণ অনুভূতি, যথা-আভিজাতপূর্ণ সম্মান, বিতৃষ্ণা, বিদ্বেষ, নৈরাশ্যবাদ এবং যৌন ভালোবাসা-উদ্ভুত সূক্ষ্ম এবং দূষিত অনুভূতিও এ কোঠায় পড়ে।

চিত্রশিল্পেও যাজকধর্মীয়, স্বাদেশিক এবং স্বতন্ত্র স্বভাবের চিত্রকে অবশ্যই অনুরূপভাবে অসৎ শিল্পের পর্যায়ভুক্ত করতে হবে। এ ছাড়া বিত্তবান এবং অলস জীবনের আমোদ এবং প্রলোভনের নির্দেশক চিত্রাবলী, শুধুমাত্র বিশেষ কোন গোষ্ঠীর কাছেই বোধগম্য তথাকথিত প্রতীকী চিত্রসমূহ, সর্বোপরি সমস্ত প্রদর্শনী এবং চিত্রশালায় আকীর্ণ ইন্দ্রিয়- উদ্দীপক, স্ত্রীলোকের নগ্নতাকেন্দ্রিক জঘন্য বিষয়বস্তু নিয়ে অঙ্কিত চিত্রসমূহকেও উক্তশ্রেণীর অন্তর্ভূক্ত করা চলে। আমাদের যুগের অপেরা এবং ‘চেম্বার মিউজিক’-ও ওই শ্রেণীভুক্ত -যা বিশেষ করে বেটোফেন থেকে শুরু (শ্যমান, বার্লিও, লিট্স, ভাগ্‌নার), যে সমস্ত ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যধর্মী, কৃত্রিম, এবং জটিল প্রকৃতির এই সংগীত-প্রাভাবিত এক প্রকারের অসুস্থ স্নায়বিক উত্তেজনা অনুভব করে থাকেন-এ সংগীতের বিষয়বস্তু একমাত্র তাদেরই অধিগম্য অনুভূতি সমূহের প্রকাশে নিয়োজিত।

‘কী! নবম ঐকতান (Ninth Symphony) সং শিল্পকর্ম নয়!’ -বিরক্ত বহু মানুষের কণ্ঠ থেকে এরূপ বিস্ময়বোধক উক্তি আমি শুনতে পাচ্ছি।

এর উত্তরে আমি বলি : নিশ্চয়ই তা নয়। আমি যা লিখেছি তার একমাত্র লক্ষ্য হল, শিল্পকর্মের উৎকর্ষ-নির্ণায়ক একটি স্বচ্ছ এবং যুক্তিপূর্ণ মান অনুসন্ধান করা। এই মান সহজ এবং স্বচ্ছ বোধের নির্দেশের সঙ্গে ঐক্যযুক্ত বলে সন্দেহাতীতভাবে মনে এ ধারণার সৃষ্টি করে যে, বেটোফেনের সিম্ফনি একটি সৎ শিল্পকর্ম নয়। অবশ্যই বিশেষ কোন সৃষ্টিকর্ম এবং তার স্রষ্টাদের স্তুতিবাদকর্মে শিক্ষাপ্রাপ্ত বিকৃতরুচির ব্যক্তির নিকট এ ধরনের একটি বিখ্যাত সৃষ্টিকর্ম যে অপকৃষ্ট-এরূপ অভিমত আশ্চর্য এবং অদ্ভুত মনে হবে। কিন্তু যুক্তি এবং সাধারণ জ্ঞানের নির্দেশ আমরা অতিক্রম করব কিরূপে? বেটোফেনের নবম সিম্ফনি একটি শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্ম বলে বিবেচিত। এ ধরনের দাবির গ্রহণযোগ্যতা বিচারে প্রথমেই আমার মনে এই আত্মজিজ্ঞাসা জাগ্রত হয়-এ শিল্পকর্ম উচ্চতম ধর্মীয় অনুভূতি সঞ্চার করে কী? উত্তরে আমি বলি-না, যেহেতু সংগীত এককভাবে এরূপ অনুভূতি সঞ্চারে অক্ষম। সুতরাং এর পরেই আমার মনে জিজ্ঞাসা জাগে : এই সৃষ্টিকর্ম উচ্চতম পর্যায়ের ধর্মীয় শিল্পের পর্যায়ভুক্ত না হলেও আমাদের স্ব- যুগের সৎ-শিল্পের বৈশিষ্ট্যসমন্বিত কিনা? অর্থাৎ যে গুণে সর্বমানব একটি সাধারণ অনুভূতিসূত্রে একত্রিত হয়-উক্ত পর্যায়ের শিল্প সেই খ্রীষ্টীয় সর্বজনীন শিল্পের একস্তরে বসবার যোগ্য কিনা। আবার নেতিবাচক উত্তর দেওয়া ছাড়া আমার বিকল্প কিছুই থাকে না। কারণ, শুধু যে আমি এটা বুঝতে অক্ষম কিভাবে এই শিল্প-সঞ্চারিত অনুভূতি সেই সব মানুষকে একত্রে সম্মিলিত করতে পারে যারা এক জটিল সম্মোহনের নিকট আত্মসমর্পণে বিশেষভাবে দীক্ষিত হয়নি তাই নয়, অধিকন্তু আমি এমন একদল স্বাভাবিক মানুষেল কল্পনাও করতে পারি না-যারা এই দীর্ঘ, বিশৃঙ্খল ও কৃত্রিম সৃষ্টিটির কিছুমাত্র অনুধাবনে সক্ষম-একমাত্র দুর্বোধ্যতার সমুদ্রে হারিয়ে যাওয়া ছোট কিছু খন্ড অংশ ছাড়া, সুতরাং আমার পছন্দমাফিক হোক বা না হোক, এ সিদ্ধান্তে আসতে আমি বাধ্য যে, এই সৃষ্টিকর্ম অসৎ শিল্পের পর্যায়ভুক্ত। এ প্রসঙ্গে এটা খুবই কৌতূহলোদ্দীপক যে, ঠিক এই সিম্ফনির সমাপ্তিতেই শীলারের একটি কবিতা যুক্ত আছে-যা কিছুটা অস্পষ্টভাবে হলেও ঠিক এ ভাবেরই অভিব্যক্তি দান করে যা হল ঠিক সে পর্যায়ের অনুভূতি (শীলার কেবলমাত্র আনন্দের অনুভূতির কথাই বলেছেন) যা মানুষকে মিলিত এবং তাদের অন্তরে ভালোবাসাবোধ জাগ্রত করে। কিন্তু এ কবিতা সিম্ফনির শেষের দিকে গীত হলেও কবিতায় অভিব্যক্ত ভাবের সঙ্গে সংগীতের কোন সামঞ্জস্য নেই। এর কারণ, সে সংগীত স্বাতন্ত্র্যধর্মী, সকল মানুষকে মিলিত না করে বরং মানবজাতির অবশিষ্টাংশ থেকে তাদের বিশ্লিষ্ট করে দিয়ে শুধুমাত্র কতিপয় ব্যক্তিকেই সম্মিলিত করে।

শিল্পের সকল শাখায় আমাদের সমাজের অভিজাত শ্রেণীর নিকট যে বৃহৎ সংখ্যক শিল্পকর্ম মহৎ বলে বিবেচিত, সেগুলিকেও ঠিক একই উপায়ে বিচার করতে হবে। এ ধরনের একটি নিশ্চিত মানদন্ডের সাহায্যে আমাদের বিচার্য বিখ্যাত ‘ডিভাইন কমেডি এবং ‘জেরুজেলাম ডেলিভার্ড,’ শেকস্পীয়র এবং গ্যেরে, সৃষ্টিকর্মের অধিকাংশ এবং চিত্রশিল্পে র‍্যাফায়েলের ‘রূপান্তরীকরণ’ (Transfiguration) বিষয়ক চিত্রপট সহ অলৌকিকের প্রত্যেকটি প্রতিরূপকে।

সৃষ্টিকর্মের রূপ যাই হোক না কেন এবং সে সৃষ্টিকর্ম যতই প্রশংসিত হোক না কেন, আমাদের প্রথম জিজ্ঞাসা হবে-তা প্রকৃত শিল্পসৃষ্টি কিংবা কৃত্রিম। কোন সৃষ্টিকর্ম একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীকেও সংক্রমিত করেছে দেখে যদি তাকে শিল্পরাজ্যের অন্তর্ভূক্ত করি, তাহলে সে ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে পরবর্তী প্রশ্নটির মীমাংসা হওয়া দরকার। সে প্রশ্ন, এই সৃষ্টিকর্ম কি অসৎ স্বাতন্ত্র্যধর্মী-শিল্পের অন্তর্ভূক্ত-যা ধর্মীয় উপলব্ধিময় অথবা মানব মিলন-বিধায়ক খ্রীষ্টীয় ভাবচৈতন্যময় শিল্পের বিরোধী? কোন সৃষ্টিকর্মকে প্রকৃত খ্ৰীষ্টীয় উপলব্ধিময় শিল্প বলে স্বীকার করবার পর আমাদের বিচার করতে হবে-তা কি ভাগবত ও মানবপ্রেম-উৎসারিত অনুভূতির-সঞ্চারক অথবা তা সর্বমানব-মিলন সাধক সহজতম অনুভূতি-সঞ্চারক। এই বিচারের পরিপ্রেক্ষিতেই সেই শিল্পকর্মকে ধর্মীয় শিল্পের অথবা সার্বজনীন শিল্পের কোঠায় স্থান দিতে হবে।

একমাত্র এরূপ সত্য পরীক্ষার ভিত্তিতে শিল্প নামে আমাদের সমাজ-স্বীকৃত সমস্ত বস্তু থেকে যথার্থ, গুরুত্বপূর্ণ, প্রয়োজনীয়, আধ্যাত্নিক খাদ্য বলে বিবেচিত সৃষ্টিকর্মকে নির্বাচন করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে এবং সেগুলিকে আমাদের চারদিককার অনিষ্টকর, মূল্যহীন এবং বিকৃত শিল্প থেকে পৃথক করে নিতে পারব। একমাত্র এরূপ সত্য পরীক্ষার ভিত্তিতেই ক্ষতিকর শিল্পের ধ্বংসাত্মক পরিণতি থেকে আমরা নিজেদের মুক্ত করতে সক্ষম হব এবং খাঁটি ও সৎ-শিল্পের অন্বিষ্ট যে হিতকর ফলশ্রুতি ব্যক্তিমানুষ ও মানবজাতির অধ্যাত্মিক জীবনের পক্ষে অপরিহার্য-তাও সংগ্রহ করতে পারব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *