হোয়াট ইজ আর্ট – ১০

১০

[বোধগম্যতার হ্রাস॥ ক্ষয়িষ্ণু শিল্প। সাম্প্রতিক ফরাসি শিল্প। এই শিল্পকে মন্দ বলবার অধিকার আমাদের আছে কী? সর্বোচ্চ শিল্প স্বাভাবিক মানুষের নিকট সর্বদাই উপলব্ধিগম্য। স্বাভাবিক প্রকৃতির ব্যক্তিকে সংক্রমণে অসমর্থ বস্তু শিল্প নয়।]

প্রত্যয়হীনতার ফলে অভিজাত শ্রেণীসৃষ্ট শিল্প বিষয়বস্তুর দিক থেকে দীন হয়ে পড়েছিল। তদ্ব্যতীত ক্রমাগত অধিকতর পরিমাণে স্বাতন্ত্র্য পরায়ণ হয়ে ওঠায় সে শিল্প উত্তরোত্তর বেশি পরিমাণে জটিল, কৃত্রিম এবং অস্পষ্ট হয়ে উঠেছিল।

সার্বভৌম কোন শিল্পী (গ্রীক শিল্পীদের অথবা ইহুদি ধর্মগুরুদের মধ্যে যেমন কেউ কেউ ছিলেন) যখনই কোন রচনাকর্মে প্রবৃত্ত হতেন, স্বভাবতই তিনি তাঁর বক্তব্যকে এমনভাবে প্রকাশের চেষ্টা করতেন যাতে তা সর্বজনবোধ গম্য হয়। কিন্তু কোন শিল্পী যখন কোন ব্যতিক্রমী পরিবেশের ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর মানুষের জন্য রচনা করতেন, এমনকি পোপ, কার্ডিনাল, রাজা, ডিউক, রানী অথবা রাজার কোন উপপত্নী প্রভৃতি বিশেষ কোন একজন ব্যক্তি বা তার পারিষদ্ববর্গের জন্য রচনাকর্মে লিপ্ত হতেন, স্বভাবতই তাঁর লক্ষ্য থাকত তাঁর ঘনিষ্ঠভাবে জানা এই কয়েকজন ব্যক্তিকে প্রভাবিত করা, যাদের অনন্যসাধারণ জীবনযাত্রার সঙ্গেও তিনি অতি-পরিচিত ছিলেন। এটা অপেক্ষাকৃত সহজ কাজ হওয়ায় আত্মপ্রকাশের জন্য শিল্পী এমন ইঙ্গিতময় ভাষার মাধ্যম ব্যবহার করতেন যা অপর সকলের কাছে অস্পষ্ট হলেও শুধুমাত্র ওই বিশেষ গোষ্ঠীর ব্যক্তিরেই বোধগম্য হত। প্রথমত, এই উপায় দ্বারা তাঁর পক্ষে অনেক বেশি বলা সম্ভব হত; দ্বিতীয়ত, এ ধরনের অভিব্যক্তির অস্পষ্টতার মধ্যেই সেই গোষ্ঠীর ব্যক্তিরা একটা বিশেষ আকর্ষণীয়তাও অনুভব করতেন। এই প্রকারে শব্দাড়ম্বরপূর্ণ রচনাশৈলী, এবং পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক পরোক্ষ উল্লেখ-বাহুল্যের মধ্যে অভিব্যক্ত প্রকাশপদ্ধতি ক্রমশ বহুলভাবে ব্যবহৃত হতে হতে অবশেষে ক্ষয়িষ্ণুদের (Decadents) শিল্পে তা চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে পৌঁছাল। সর্বশেষে তা এই পরিণতি লাভ করল : কেবলমাত্র অস্পষ্টতা, রহস্যময়তা, দুর্বোধ্যতা এবং স্বাতন্ত্র্যকেই (জনসাধারণকে দূরে সরিয়ে রেখে) যে শুধু শিল্পগুণের স্ত রে উন্নীত এবং কাব্যশিল্পের শর্ত বলে মেনে নেওয়া হল তা নয়, এমনকি যথার্থ্যহীনতা, অবয়বহীনতা এবং প্রকাশদৈন্যও মর্যাদার আসন লাভ করল।

বিখ্যাত Fleurs du Mal-এর ভূমিকায় থিয়োফিলে গতিয়ে (Theophile Gautier) বলেছেন, বোদলেয়ার কাব্যের জগৎ থেকে বাগবিভূতি আবেগ এবং সত্যের একনিষ্ঠ অনুকৃতিকে নির্বাসিত করেছেন।

বোদলেয়ার শুধু এতেই ক্ষান্ত হননি, স্বীয় কাব্যকবিতায় এই তত্ত্বকে অনুসরণও করেছেন। তাঁর Petits Poems en Prose-এর গদ্যে এই তত্ত্বের অনুসৃতি আরও উল্লেখ্যভাবে দেখা যায়। চিত্রাদির দ্বারা হেঁয়ালিপূর্ণভাবে নাম লিখনের মতো সে গদ্যের অর্থ অনুমান করে নিতে হয়। ফলে সে অর্থ অধিকাংশ ক্ষেত্রে অনাবিস্কৃতই থেকে যায়। কবি ভের্লেন (Verlaine) তো যিনি বোদলেয়ারের পরে আবির্ভূত এবং বড় কবি বলে সম্মানিত) একখানি Art poetique-ই লিখে ফেলেছিলেন যার মধ্যে তিনি নিম্নোক্ত ধরনের রচনাশৈলী অনুসরণের নির্দেশ দিয়েছিলেনঃ

সবার আগে চাই সংগীত, সংগীত!
বিকেন্দ্রিকেরা আজও পছন্দ করে,
ভাবভঙ্গিতে যা অস্পষ্ট, অর্থ গৌরবহীন,
দ্রবণীয়। তবু ভুল করে না
শব্দ নির্বাচনে, তবু সে কাজ করে লঘুহস্তে;
করে তা অবজ্ঞামিশ্রিত দৃষ্টিতে :
ধূসর গানগুলি সর্বাধিক প্রিয় যাতে মেশে
নিরূপিত এবং অনিরূপিত!
সর্বকালের সংগীত, বর্তমানে এবং চিরকালে!
তোমার সংগীত হোক এই বস্তু যা ডানা মেলেছে
বিদায়ী পলায়নপর আত্মার আবাস হোক,
চলে গেছে অপর ভালোবাসায় এবং আকাশ পারে।
চলে গেছে অপর ভালোবাসায় এবং অঞ্চলে
বিভ্রমকারী ঐশ্বর্যের পশ্চাতে,
সুগন্ধ গুল্ম এবং প্রভাতী নির্মলতা…..
অবশিষ্ট সকলই নিছক সাহিত্য।

এ দুজনের পরেই এলেন মালার্মে (Mallarme)-তরুণ কবিদের মধ্যে যিনি খুবই উল্লেখযোগ্য বলে বিবেচিত। তিনি সোজাসুজিই বলেন, কবিতার চমৎকারিত্ব নিহিত তার অর্থ অনুমানের মধ্যে-কবিতার মধ্যে সব সময় একটা ধাঁধা থাকবেই :

‘আমার মতে পরোক্ষ উল্লেখ (allusions) ছাড়া আর কিছুরই স্থান থাকা উচিত নয়। বস্তুর অনুধ্যন, সেই বস্তু-অনুপ্রাণিত জাগর-স্বপ্নের চলমান মূর্তিই সংগীত সৃষ্টির উপাদান। পারনেশিয়ানেরা (Parnassians ফরাসি কবিগোষ্ঠী যাঁরা কলাকৈবল্যবাদী মতবাদে বিশ্বাসী) সম্পূর্ণভাবে বস্তুর বিবরণ দেন, এবং বর্ণনায় তা দেখান। সুতরাং সৃজনকারী কল্পনায় তা রহস্যবঞ্চিত। তাঁরা মনকে সৃজনশীল কল্পনার আনন্দ থেকে বঞ্চিত করেন। কোন বস্তুর নামকরণ করার অর্থ একটা কবিতা উপভোগের বারো আনা অংশ ছেঁটে ফেলা। সে আনন্দ উপভোগ নিহিত অর্থকে অল্প অল্প করে অনুমান করে নেবার মধ্যে। ব্যঞ্জনা সৃষ্টি দ্বারা স্বপ্নকেই সৃষ্টি করা হয়। রহস্যের পূর্ণাঙ্গ ব্যবহারই প্রতীক : আত্মার অবস্থা প্রদর্শনের জন্য ক্রমশ বস্তুবোধকে জাগ্রত করতে হবে। অথবা বিপরীত ক্রমে প্রথমে একটি বস্তু নির্বাচন করতে হবে এবং স্তর পরস্পরায় সংকেতলিপির পাঠোদ্ধারের সাহায্যে সে বস্তু থেকে আত্মার অবস্থা বিমোচন করতে হবে।

‘…..মধ্যম শ্রেণীর কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তি সামান্য সাহিত্যিক প্রস্তুতি নিয়ে এভাবে লিখিত পুস্তক খুলে তা উপভোগ করছেন বলে ভাণ করলে তাতে বিভ্রান্তিই ঘটবে-বস্তুগুলিকে আবার স্বস্থানে প্রেরণ করতে হবে। কবিতায় সব সময় হেঁয়ালি থাকাই উচিত। সাহিত্যের লক্ষ্য পাঠক-অন্তরে বস্তুরূপকে সঞ্চার করা ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই। ‘ এভাবে নতুন গোষ্ঠীর কবিদের মধ্যে অস্পষ্টতা একটা মতবাদে উন্নীত হল। ফরাসি সমালোচক ডুমিক (Doumic) (যাঁর দ্বারা এ মতবাদ এখনও গৃহীত হয়নি) বেশ নির্ভুলভাবেই বলেছেন :

‘নতুন কবিগোষ্ঠী যে মতবাদকে কার্যত একটি অন্ধ বিশ্বাসে উন্নতী করেছেন-সে বিখ্যাত ‘অস্পষ্টতা তত্ত্বে’র অবসান ঘটাবার সময়ও এসে গেছে।’

শুধুমাত্র ফরাসি লেখকেরা এ পর্যায়ে চিন্তা করেননি। অপরাপর সকল দেশের কবিরাও অনুরূপ চিন্তা এবং কর্মধারার পরিচয় দিয়েছেন-যথা, জার্মান, স্ক্যান্ডিনেভীয়, ইতালীয়, রুশ এবং ইংরেজ। চিত্রশিল্প, স্থাপত্য, সংগীত প্রভৃতি সকল শাখার শিল্পীরাও এ পন্থা অনুসরণ করেছেন। নীশে এবং ঈশ্বরের (Wagner) ওপর নির্ভর করে নতুন যুগের শিল্পীরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, তাদের পক্ষে স্থূলবুদ্ধি জনসমাজের নিকট সুবোধ্য হওয়া অপ্রয়োজনীয়। জনৈক ইংরেজ নন্দনতাত্ত্বিকের বাগ্‌বৈশিষ্ট্য ধার করে তারা বলেছিলেন, উন্নতরুচির পরিবেশে লালিত মানুষের মনে কাব্যের আবেগ উদ্রেক করাই তাদের পক্ষে যথেষ্ট।

আমার বক্তব্য যাতে নিতান্ত ব্যক্তিগত সুদৃঢ় দাবি বিবেচিত না হয় সেজন্য আমি এই ফরাসি কাব্যন্দোলনের মুখ্য চালকদের কাব্য থেকে অন্তত কয়েকটি উদাহরণ উদ্ধার করব। এ ধরনের কবি অসংখ্য। আমি ফরাসি লেখকদেরই নির্বাচন করেছি-যেহেতু তাঁরাই নিঃসংশয়ভাবে অপরাপর লেখকদের চাইতে শিল্পের নতুন দিকের নির্দেশ দিয়ে থাকেন এবং অধিকাংশ ইউরোপীয় লেখকদের দ্বারা অনুকৃত হন। বিখ্যাত বলে ইতোপূর্বে বিবেচিত বোদলেয়ার, ভেরলেন প্রভৃতি ব্যতীত এখানে তাদের মধ্যে আরও কয়েকজনের নাম উল্লেখ করা হচ্ছে : জাঁ মোরেয়া (Jean Moreas), সার্ল মোরিস্ (Charles Morice), আঁরি দ্য রেনিয়ে (Henry de Regnier), সার্ল ভিনিয়ে (Charles Vignier), আদ্রিয়ে রেমাকেল ( Adrien Remacle), রেঁনে গিল্‌ (Ren Ghil), মরিস্ মেটারলিঙ্ক (Maurice Maeterlinck), জি. এলবেয়ার অরিয়ে (G. Albert Aurier), রেমি দ্য গুরম (Reme de Gourment), সোঁ-পোল-রু-লে-মানিফিক্ (Saint-Pol-Roux-le- Magnifique), জরজ্ রডেনবাক্ (Georgss Rodenbach), লে-কোৎ-রবেয়ার-দ্য- মতেস্ক্যু-ফেসেনজাক্ (Le Compte Robert De Montesquiou-Fezensac)। এঁরা প্রতীকা এবং ক্ষয়িষ্ণু (Decadents)। এর পর আমরা পাই ‘গধমর’-দের : জোসেফ্যাঁ পেলাদা (Josephin Peladau), পৌল আদাম (Paul Adam), ঝুল বোয়া (Jules Bois), মা পাপু (M. Papus) প্রভৃতি।

এঁরা ছাড়াও আছেন অপর আরও একচল্লিশ জন যাদের কথা ভুমিক উল্লেখ করেছেন পূর্বোল্লিখিত গ্রন্থে।

এঁদের মধ্যে যাঁরা সর্বোত্তম বিবেচিত তাঁদের রচনা থেকে এখানে কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া হল। এঁদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত এবং শ্রেষ্ঠ শিল্পী বলে স্বীকৃত এবং যিনি স্মৃতিস্তম্ভের সম্মানে ভূষিত হবার যোগ্য সেই বোদলেয়ারের রচনা থেকে উদাহরণ দেওয়া শুরু করা যেতে পারে। নিম্নোদ্ভূত কবিতাটি তাঁর বিখ্যাত Fleurs du mal থেকে নেওয়া-

Fleurs du mal (Flowers of evil)
অমঙ্গলের ফুল
২৪ নং
রাত্রির খিলানগুলির মতো আমি তোমাকে পূজা করি,
ওগো শোকের তরি, বাগ্ বিমুখ মহান,
তোমার উড়ন্ত সৌন্দর্যের জন্য তোমাকে আরো বেশি ভালোবাসি।
মনে হয় আমার রাত্রিকে সুন্দর করেছ তুমি, তুমি
যোজনের পর যোজন পুঞ্জীভূত করে চল, ব্যঙ্গের সঙ্গে পুঞ্জীভূত করা!-
যা আমার আলিঙ্গন থেকে অসীম নীলিমাকে বিচ্ছিন্ন করে।
আক্রমণের জন্য আমি এগিয়ে যাই, আঘাত করবার জন্য আরোহন করি,
সমাধিতে শবের দিক অগ্রসর ক্ষুদ্র ক্রিমির ঐকতান সংগীতের মতো,
তোমার শীতলতা, ওগো নিষ্ঠুর অপ্রশম্য পশু!
তবু তা তোমার সৌন্দর্যকে তীব্রতর করে, যা আমার
দৃষ্টির পক্ষে ভোজ বিশেষ।
এখানে একই লেখকের আর একটি :
৩৬ নং
ডুয়েলুম (Duellum)-অমঙ্গলের ফুল
দুজন যোদ্ধা দৌড়ে আসে, যুদ্ধ শুরু করে,
দীপ্তি আর রক্ত দিয়ে তারা বাতাসকে পঙ্কিল করে,
এ সব ক্রীড়া এবং অস্ত্রঝঞ্ঝনা উন্মাদ প্রেমের শিকার, যৌবনের নির্ঘোষ।
দীর্ঘ সরু ছোরাগুলি ভাঙা! আমাদের যৌবনের মতো
কিন্তু প্রিয়। ছোড়গুলির প্রতিহিংসা তৃপ্ত হল, এবং তরবারিরও।
ইস্পাতকঠিন নখ এবং সুদৃঢ় দত্তপংক্তির দ্বারা।
ওহো, প্রবীণ হৃদয়ের ক্ষোভ এবং ভালোবাসার দ্বারা বিক্ষত!
খাতের মধ্যে যেখানে আছে হিংস্র বনবিড়াল এবং চিতাবাঘের গুহা,
আমাদের বীরেরা গড়াগড়ি দিয়েছেন ক্ষুদ্র আলিঙ্গনে;
পত্রহীন কাঁটাঝোপের গায়ে তাদের চর্ম অধুনা বিকশিম,
সে গিরিসংকট একটি বন্ধু-অধ্যুষিত নরক!
তবে এসো আমরা আবর্তিত হই, হে অমানবিক নারী,
যে ঘৃণা প্রশমনের ঊর্ধ্বে, তাকে চিরন্তন করতে।

যথার্থের সঙ্গে বলতে গেলে এটা উল্লেখ্য, এ সংকলনে এমন সমস্ত কবিতা আছে যা এগুলির চাইতেও কম বোধগম্য। এমন একটি কবিতাও নেই যা সহজ, কোন রকমের প্রয়াস ছাড়া বোঝা যায়, এবং প্রয়াসের সাহায্যে পড়লেও কদাচিৎ পুরস্কার মিলে। যেহেতু কবি-সঞ্চারিত অনুভূতি সমূহ অশুভ তথা খুবই নিম্ন পর্যায়ের। এই অনুভূতিগুলির অভিব্যক্তি প্রায় সর্বদাই কবির স্বেচ্ছাকৃত উৎকেন্দ্রিকতা এবং অস্বচ্ছতায় আবিষ্ট। এই পরিকল্পিত অস্পষ্টতা বিশেষভাবে তাঁর গদ্যে লক্ষিত হয়, যেখানে ইচ্ছা করলেই লেখক সহজ ভাষায় নিজেকে প্রকাশ করতে পারতেন।

উদাহরণ স্বরূপ তাঁর Petits poems en prose (গদ্যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কবিতা)-এর প্রথম রচনাটি উল্লেখ করা যেতে পারে :

বোদলেয়ারের গদ্য রচনা থেকে

L’etranger (বিদেশি লোক)

হে রহস্যময় মানুষ,-বলো, তোমার পিতা, মাতা, ভগ্নী অথবা ভ্রাতা-কাকে তুমি সব চাইতে ভালোবাস?

‘আমার পিতা নেই, মাতা নেই, ভগ্নী নেই, কিংবা ভ্রাতাও নেই।’

তোমার বন্ধুরা?

‘এখানে তুমি এমন একটি শব্দ ব্যবহার করলে যার অর্থ এখনও আমার নিকট অপরিজ্ঞাত।’

তোমার দেশ?

‘আমি জানি না, কোন্ অক্ষাংশে তা অবস্থিত?’

সৌন্দর্য?

‘আনন্দের সঙ্গে আমি ভালোবাসব দেবীকে এবং চিন্তাকে।’

স্বর্ণ?

‘আমি তাকে ঘৃণা করি, যেমন তুমি ঈশ্বরকে ঘৃণা কর।’

হে অসামান্য বিদেশি, তবে তুমি কী ভালোবাসা?

‘আমি ভালোবাসি মেঘদেব……যে মেঘেরা চলে যায়…দূরে….সে বিস্ময়কর মেঘগুলিকে।

La Soupe et les nuages (স্যুপ ও মেঘের দল) নামক রচনাটি কবির ভালোবাসার পাত্রী রমণীর নিকটও কবি কি রকম দুর্বোধ্য তা প্রকাশের উদ্দেশ্যেই খুব সম্ভব লিখিত। আলোচ্য রচনাটি এই :

স্যুপ ও মেঘের দল

(The Soup and the Clouds)

আমার প্রিয় ছোট নির্বোধটি আমাকে অপরাহ্নিক আহার পরিবেশন করছিল। আমার চিত্ত তখন ব্যাপৃত ছিল ভোজনকক্ষের উন্মুক্ত জানালা দিয়ে দৃশ্যমান ঈশ্বরের বাষ্পসৃষ্ট চলবান স্থাপত্য এবং স্পর্শাতীতের অপরূপ নির্মাণকৌশলের বিস্ময় নিয়ে। আমার ভাবনাচিন্তার মধ্যেই আমি স্বগতোক্তি করলাম : এই সব অলীক ছায়ামূর্তিগুলি অনেকটা আমার সুন্দরী প্রিয়তমার চক্ষুর মতই সুন্দর-আমার এই আজব ক্ষুদ্র নির্বোধের সবুজ চক্ষুর মতই।

হঠাৎ আমার পিঠের ওপর একটি সজোর মুষ্ঠাঘাত অনুভব করলাম। আমি শুনলাম একিট কর্কশ, মনোরম কণ্ঠস্বর, বায়ুরোগগ্রস্ত একটি কণ্ঠস্বর, ব্রান্ডির প্রভাবে যা কর্কশ, আমার অতি প্রিয় ছোট্ট মানুষটির কণ্ঠস্বর-যে বলছিল, ওহে স….ব…মেঘের ব্যাপারী, তুমি কি তোমার স্যুপটা তাড়াতাড়ি খেয়ে নেবে?

এ দুটি অংশ যতই কৃত্রিম হোক না কেন, এ অংশগুলির দ্বারা লেখক কি বোঝাতে চেয়েছেন, কিন্তু প্রয়াসের সাহায্যে হলেও তা অনুমান করা তবু সম্ভব। কিন্তু কতকগুলি রচনা সম্পূর্ণ দুর্বোধ্য-অন্তত আমার কাছে। Le Galant Tireur (The Gallant Marksman) এমন একটি রচনা যার মর্মোদ্ধার করা আমার পক্ষে কোন মতে সম্ভব হয়ে ওঠেনি।

সাহসী কুশলী লক্ষ্যভেদী

(The Gallant Marksman)

শকটটি জঙ্গলের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করবার সময় একটি গুলি ছুঁড়বার উচ্চ মঞ্চের কাছে সেটিকে থামতে সে নির্দেশ দিল। এবং একথা সে বলল, সময়কে হত্যা করবার জন্য সে কয়েকটি গুলি ছুঁড়তে চায়। প্রত্যেক মানুষের পক্ষে ওই দৈত্যটির নিধন সর্বাধিক সাধারণ ও সঙ্গত ব্যাপৃতি নয় কী? শৌর্ষের মনোভাব নিয়ে সে তার অস্ত্রগুলি দিল তার প্রিয় মিষ্টি এবং অভিশপ্ত স্ত্রীকে-যে রহস্যময়ী নারীর নিকট সে শুধু গভীর আনন্দ বেদনার জন্যই ঋণী নয়, সম্ভবত তার প্রতিভার একটি বড় অংশের জন্যও সে তার নিকট ঋণী।

কতকগুলি গুলি লক্ষ্যস্থানের অনেক দূরে আঘাত করল,-এমনকি ছাদেও প্রবিষ্ট হল। স্বামীর অদ্ভুত কান্ডকে ব্যঙ্গ করে আকর্ষণীয় প্রাণীটি বন্য হাসি হাসলে সে হঠাৎ তার দিকে ফিরে বলল, -ডান পাশের ওই পুতুলটিকে দেখ তো-যার চোখে-মুখে ঔদ্ধত্য এবং নাকটি আকাশে তোলা। ওগো প্রিয়তমে, কল্পনায় আমার মনে হয় সে তুমি! তখন সে চক্ষু মুদ্রিত করল এবং ঘোড়া টিপল। খুব পরিচ্ছন্নভাবে পুতুলের শিরচ্ছেদ করা হল।

তারপর তার আনন্দদায়ক অভিশপ্ত স্ত্রীর নিকট, তার অনিবার্য করুণাহীন কাব্যপ্রেরণার নিকট, তার সেই প্রিয়ার সামনে মাথা নুইয়ে সম্ভ্রমের সঙ্গে তার হস্ত চুম্বন করে সে বলল, ‘ওগো আমার প্রিয়তম, আমার নৈপুণ্যের জন্য আমি কিভাবে তোমাকে ধন্যবাদ দেব!’

অপর বিখ্যাত লেখক ভেরলেন (Verlaine’s)-এর সৃষ্টিকর্মও কম কৃত্রিম ও কম দুর্বোধ্য নয়। দৃষ্টান্ত স্বরূপ Ariettes oubliees নামক অংশের প্রথম কবিতাটিই নেওয়া যাক : ভেরলেন-এর ‘বিস্মৃত সুর’

(Verlaines ‘Forgotten Airs )

॥ ১ নং ॥

‘সমতলের বায়ু
নিশ্বাস স্থগিত রেখেছে।
-ফাভার (Favart )
ভাবাবেশে স্তিমিত হচ্ছে
প্রণয়মগ্ন ক্লান্তি
বনের সমস্ত কাঁপন
মলয়ানিল আলিঙ্গিত
এটা ক্ষীণকণ্ঠের কাকলি,
ধূসর তরুগুলির উদ্দেশে।
হে ভঙ্গুর ও নবীন মর্মর!
পাখির গান ও মৌমাছির গুঞ্জন
ঘাসের দ্বারা নিঃশ্বসিত
মৃদু ক্রন্দনে সদৃশ।
ওহো, উপলখন্ডের আবর্তন
প্রবাহিত জলের নীচে!
ওহো, এই আত্মার আর্তনাদ,
নিদ্রালু অভিযোগের মধ্যে!
আমাদের মধ্যে তা কী বিলাপ-মুখর?
আমার এবং তোমার মধ্যে?
মৃদুকণ্ঠ স্তোত্র নিঃসরিত হয়
যখন শিশির পড়ে ধীর সঞ্চারে।
‘Choeur des petites voix’ এবং ‘cri doux que I’herbe agiteeexpire’- এর অর্থ কী? এবং এ সমস্ত কিছু বলতে কি বোঝায় তা এখনও আমার নিকট সম্পূর্ণ দুর্বোধ্য রয়ে গেছে এবং এখানে আর একটি অস্ত্রবঃব:

ভেরলেন-এর ‘বিস্মৃত সুর’
(Verlaine’s ‘Forgotten Airs )
এ দেশের সমাপ্তিহীন জড়তার মধ্যে
অনিশ্চিত তুষার
বালির মতো চক্ চক্ করছে।
কোনো রকম উজ্জ্বলতা নেই
তামাটে রঙের আকাশে,
যে চন্দ্রকে তুমি দেখতে পেতে
কখন বাঁচছে কখনো বা মরছে।
প্রতিবেশী অরণ্যের
মধ্যবর্তী কুয়াশায়
ধূসর ওক গাছেরা ভাসছে
মনে হচ্ছে তারা মেঘ।
ক্ষুধার্থ ও বিশীর্ণ নেকড়োনা
আর অনশনক্লিষ্ট কাক
যখন কটুগন্ধী বাতাস বয়
তখন তোমরা কী কর?
সমাপ্তিহীন
এ দেশের জড়তার মধ্যে
অনিশ্চিত তুষার
বালির মতো চক্ চক্ করছে।

তামার স্বর্গে চাঁদের বাঁচা মরাটা কিরূপ? বরফ কিরূপে বালির মতো চক্ চক্ করে?

সমস্ত ব্যাপারটিই কেবলমাত্র দুর্বোধ্য নয়, একটা অনুভূতি সঞ্চারের ভান করতে গিয়ে এটি কতকগুলি যথার্থ্যহীণ তুলনা এবং শব্দের মালা তৈরি করেছে।

এ সমস্ত কৃত্রিম ও অস্পষ্ট কবিতা ব্যতীত আরও সুবোধ্য কবিতা আছে, কিন্তু রূপ ও বিষয়বস্তুর দিক থেকে অত্যন্ত মন্দ হওয়ায় সেগুলির সুবোধ্যতারও মূল্য থাকে না La Sagesse শীর্ষনামের সমস্ত কবিতাই এরূপ। সাধারণভাবে প্রচলিত রোমান ক্যাথলিক এবং দেশপ্রীতির আবেগের খুবই বৈশিষ্ট্যহীন অভিব্যক্তি এই সমস্ত কবিতায় প্রধান স্থান গ্রহণ করেছে। উদাহরণ স্বরূপ এ ধরনের পদ্য পংক্তিসমূহের সাক্ষাৎ পাওয়া যায় :

আমার মা মেরী ছাড়া আমি আর কিছু চিন্তা করতে চাই না,
যিনি জ্ঞানের আকর এবং ক্ষমার উৎস,
আরও ভাবি ফরাসি দেশজননীর কথা, যার কাছে আমরা
অচঞ্চলভাবে প্রত্যাশা করি দেশের সম্মান।

অন্য কবিদের থেকে দৃষ্টান্ত দেখাবার আগে আমি বর্তমান কালে মহৎ বলে স্বীকৃত বোদলেয়ার এবং ভেরলেন নামক দুজন কবির আশ্চর্য খ্যাতির বিষয়ে কিছু বলতে চাই। যে ফরাসি লেখকদের মধ্যে ছিলেন শ্যেনির (Chenier), মুসে (Musset), লা মার্তিন (Lamartine) এবং সর্বোপরি উগো (Hugo) এবং যাঁদের মধ্যে সাম্প্রতিক কালে লেকৎ দ্য লীল (Laconte de Lisle), স্যুলি প্রুধোম (Sully-Prudhomme) প্রভৃতি তথাকথিত পানাসিয়ানেরা (Parnassian) আবির্ভূত হয়েছিলেন, তাঁদের অস্তিত্ব থাকা সত্ত্বেও রূপকর্মের দিক থেকে কলাকুশলতাহীন এবং বিষয়বস্তু উপস্থাপনার দিক থেকে অত্যন্ত ধিক্কারযোগ্য এমন দুজন পদ্য লেখককে ফরাসিরা কী করে এত মূল্য দিলেন তা আমার বুদ্ধির অগম্য। তাঁদের মধ্যে বোদলেয়ারের জীবনদর্শন ছিল স্থুল অহংবাদকে একটা তত্ত্বের স্তরে উন্নীত করা এবং নৈতিকতার স্থলে ধোঁয়াটে সৌন্দর্য-কল্পনা, বিশেষ ভাবে কৃত্রিম সৌন্দর্য স্থাপন করা। বোদলেয়ারের নিকট নারীমুখের স্বাভাবিক সৌন্দর্য থেকে তার প্রসাধিত মুখের সৌন্দর্যের প্রতি এবং প্রকৃত বৃক্ষ এবং স্বাভাবিক জল থেকে ধাতব বৃক্ষ এবং রঙ্গ মঞ্চে অনুকৃত জলের প্রতি ছিল অধিকতর পক্ষপাত এবং তা তিনি প্রকাশও করেছেন।

অপর কবি ভেরলেনের জীবনবিষয়ক ধারণা নিহিত ছিল দুর্বল অসচ্চরিত্রতায়, নৈতিক নপুংসকত্বের স্বীকৃতিতে, এবং সে নপুংসকত্বের প্রতিষেধক হিসেবে রোমান ক্যাথলিক প্রতিমা উপাসনায়। উপরন্তু উভয়েই ছিলেন স্বাবাবিকতা, আন্তরিকতা এবং সারল্যবঞ্চিত, এবং উভয়ের মধ্যেই কৃত্রিমতা, জোর করা মৌলিকতা এবং অহংমন্যতার আতিশয্য পরিলক্ষিত হয়। সুতরাং তাঁদের অপকৃষ্ট রচনাতেও বর্ণনীয় বিষয়ের পরিবর্তে আমরা দেখি মঁশিয়ে বোদলেয়ার এবং মঁশিয়ে ভেরলেনকে। কিন্তু এই দুজন সাধারণ স্ত রের পদ্য লেখক একটি কবিগোষ্ঠী সৃষ্টি করেছেন এবং শত শত অনুবর্তীদেরও তাঁদের আপন আদর্শে চালনা করেছেন।

এর একটি মাত্র ব্যাখ্যা আছে : তা হল, যে সমাজে এ পদ্যরচয়িতারা বাস করতেন, সে সমাজে শিল্প জীবন-সম্পর্কীয় কোন গভীর গুরুত্বপূর্ণ বিষয় না হয়ে নিছক আমাদের বিষয় বলেই গণ্য হত। এবং পৌনঃপুনিকতার ফলে সমস্ত আমোদই ক্লান্তিকর হয়ে ওঠে। সে ক্লান্তিকর আমোদকে পুনরায় সহনীয় ও সজীব করবার উদ্দেশ্যে কতকগুলি উপায় উদ্ভাবনের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। তাস খেলতে গিয়ে চল্লিশ তাসের তিনজনের খেলা যখন বাসী হয়ে পড়ে, তখন সমস্ত তাস নিয়ে খেলা শুরু হয়। সম্মিলিত চারজনের হুইস্ট (Whist) খেলা বাসী হলে তার জায়গায় ecrte (যে খেলায় হাতের তাস অপ্রয়োনীয় বলে অপরের জন্য ফেলে দেওয়া হয়) আসে; যখন ecrte খেলা ও বাসী হয়ে যায় অন্য অভিনব কিছু আবিষ্কৃত হয় এবং এভাবেই তাসের খেলা চলতে থাকে। আসল বস্তুটি একই রকম থাকে, শুধু তার বাইরের রূপটিই পরিবর্তিত হয়। এই জাতীয় শিল্পের ক্ষেত্রেও ওই অনুরূপ ব্যাপারটাই ঘটে। উচ্চবর্গীয়দের শিল্পের বিষয়বস্তু উত্তরোত্তর সংকীর্ণ হয়ে আসায় শেষ পর্যন্ত তা দাঁড়িয়েছে এরূপ : ব্যতিরেকী শ্রেণীর শিল্পীদের মনে হয়, যেন যা বলবার, তা ইতোপূর্বেই বলা হয়ে গেছে, নতুন কোন বক্তব্যের সন্ধান পাওয়া অসম্ভব। সুতরাং এই শিল্পকে সজীবতা দানের জন্য তারা নতুন বহিরঙ্গের (Form) সন্ধান করেন।

বোদলেয়ার এবং ভেরলেন এ ধরনেরই নতুন আঙ্গিক আবিষ্কার করেছেন। উপরন্তু এ যাবৎ অব্যবহৃত খুঁটিনাটি অশ্লীল বর্ণনার সাহায্যে তাকে পালিশ করেছেন। ফলে সমালোচকব এবং উচ্চবর্গীয় জনসমাজ তাদের মহৎ লেখক বলে অভিনন্দিত করেছেন।

শুধু বোদলেয়ার এবং ভেরলেনরই নয়, সমস্ত ক্ষয়িষ্ণুদেরই (Decadents) সার্থকতার এটাই একমাত্র ব্যাখ্যা।

দৃষ্টান্তস্বরূপ মালার্মে এবং মোটারলিঙ্কের অনেক কবিতা আছে যা অর্থহীন। তা সত্ত্বেও অথবা হয়ত ওই কারণের জন্যই সে সমস্ত কবিতা বিভিন্ন প্রকাশ মাধ্যমের সাহায্যে শুধু হাজারে হাজারে মুদ্রিতই হয় না, এমনকি তরুণ কবিদের শ্রেষ্ঠ কবিকর্মের সংকলনেও স্থানলাভ করেঃ

উদাহরণ স্বরূপ এখানে মালার্মের একটি সনেট দেওয়া হল-

A la nue accablante tu
Basse de basalte et de laves
A meme les echos esclaves
Par une trompe sans vertu.
Quel sepulcral Naufrage
(tu Le soir, ecume, maisy leaves)
Supreme une entre les epaves
Abokit le mat devetu.
Ou cela que furibond faute
De quelque pardition haute
Tout l’abime vain eploye
Dans le si blace cheveu qui traine
Avarment aura noye
Le flanc enflant d’une sirene.
( ‘Pan, ‘ 1৪95, No. 1 )

দুর্বোধ্য দিক থেকে এ কবিতাটি ব্যতিক্রম নয়। আমি মালার্মের আরও কতকগুলি কবিতা পড়েছি, এবং সেগুলিও কোন প্রকারেরই অর্থ ছিল না। আমি ২ নং পরিশিষ্টে তাঁর গদ্যের একটি নমুনা দিচ্ছি। Divagations নামে এ গদ্যের সম্পূর্ণ একটি গ্রন্থ আছে। তার কিছুমাত্র বোঝা অসম্ভব। স্পষ্টত সেটিই ছিল বোধ হয় গ্রন্থকারের অভিপ্ৰায়।

ভবিষ্যৎ দৃশ্য।-মালার্মে

(The future phenomenon )

(মালার্মের Divagations- এর প্রথম পৃষ্ঠা থেকে উদ্ধৃত)

ধ্বংসের চরমতম অবস্থায় মধ্য দিয়ে সমাপ্তির দিকে প্রাগসর পৃথিবীর ওপরে বিবর্ণ আকাশ, হয়ত বা মেঘের সঙ্গেই প্রায় বিলীন হয়ে যায় : সূর্যাস্তের বেগনি লাল জীর্ণ খন্ডগুলি দিগন্তের ঘুমন্ত নদীতে তাদের রং ধুয়ে ফেলেছে, স রং রশ্মি এবং জলের সঙ্গে মিশে গেছে। বৃক্ষগুলি ক্লান্ত, তাদের শুভ্রায়িত পর্ণরাজির নীচে (রাস্তার ধূলিলিপ্ত না হয়ে সময়ের ধূলির স্পর্শে যেগুলি সাদা হয়ে গেছে) মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে ‘অতীত বস্তুর সার্কাস খেলোয়াড়ের ক্যানভাস গৃহ। অনেক প্রদীপ সন্ধ্যাগোধূলির প্রতীক্ষারত এবং বহুযুগের অনন্তপ্রসারী ব্যাধি ও পাপের দ্বারা পরাজিত হতশ্রী জনতার মুখ আলোকিত করছে -ওই লোকগুলি তাদের ক্ষুদ্রকায় দুষ্কর্মের সহচারীদের নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, যে সহচরীদের গর্ভে সেই সর্বনাশা ভবিষ্যৎ লালিত হচ্ছে যা-এই পৃথিবীকে ধ্বংস করবে। সূর্যকে মিনতি করে সমস্ত চোখের ব্যাকুলিত নীরবতা নৈরাশ্যের ক্রন্দনে জলতলে ডুবে যায়-যার সহজ ঘোষণাটি এই : ‘ভেতরে যে দৃশ্য রয়েছে কোন বিজ্ঞাপনেই তা তোমাকে তার তৃপ্তি দিতে পারে না, যেহেতু এমন কোন চিত্রকর নেই যিনি এখন তার একটি বিষণ্ণ ছায়া আঁকতেও সক্ষম। আমি অপর কালের একজন জীবন্ত (এবং সার্বভৌম বিজ্ঞান দ্বারা দীর্ঘকালব্যাপী রক্ষিত) স্ত্রীলোককে আনছি। এক প্রকারের মূর্খতা কলাকৌশলশূন্য এবং আদিম, একটি স্বর্ণময় আবেশ-সেটি কি আমি জানি না, যাকে সে চুল বলে, সে চুল ঝালরের সৌন্দর্যের সঙ্গে এঁটে আছে এমন একটি মুখের চতুর্দিকে যা তার আরক্তিম ওষ্ঠদ্বয়ের নগ্নতায় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। অর্থহীন পোশাক পরিচ্ছদের পরিবর্তে তার আছে একটি দেহ; তার চক্ষুগুলি মূল্যবান প্রস্তরের মতো। সে বহুমূল্য প্রস্তর তার উৎফুল্ল দেহউদ্ভুত দৃষ্টির উপযুক্ত নয় : তার স্তনদ্বয় উন্নত, মনে হয় তা চিরন্ত ন দুগ্ধে পরিপূর্ণ, স্তনাগ্রভাগ আকাশের দিকে; তার মসৃণ পদদ্বয়ে লিপ্ত হয়ে আছে আদিম সমুদ্রের লবণ।’ নিজেদের হতশ্রী, কেশহীন, বিষণ্ন, ভয়াবহ স্ত্রীদের স্মরণ করে স্বামীরা এগিয়ে যায় : কৌতূহলাক্রান্ত সে সমস্ত স্ত্রীলোকও বিষণ্নচিত্তে তা দেখতে আগ্রহ বোধ করে।

একটি অভিশপ্ত যুগের চিহ্ন ওই মহান প্রাণীটি সম্পর্কে সকলের অনুধ্যান সমাপ্ত হবার পর তারা পরস্পরের দিকে চাইবে, উপলব্ধি করার মতো শক্তি না থাকায় কারো কারো দৃষ্টি হবে উদাসীন। কিন্তু ভগ্নহৃদয় অপর কারো কারো আত্মনিবেদনের প্রভাবে চক্ষুর পাতা আর্দ্র হবে, অপর পক্ষে সে যুগের কবিরা উপলব্ধি করবে তাদের স্তিমিত চক্ষু পুনঃপ্রদীপ্ত হয়েছে। তখন তারা তাদের প্রদীপের দিকে অগ্রসর হবে। ক্ষণিকের জন্য তাদের মস্তিষ্ক বিভ্রান্ত গৌরবের দ্বারা প্রভাবিত হবে। ছন্দস্পন্দন দ্বারা অভিভূত হয়ে একথা তারা বিস্মৃত হবে যে সৌন্দর্য অতিক্রমী একটি যুগে তাদের অস্তিত্ব বিদ্যমান। এ যুগের আর একজন বিখ্যাত লেখক মেটারলিঙ্কের একটি গান নিম্নে দেওয়া হল : যখন সে চলে গেল

(তখন আমি দরজার শব্দ পেলাম)
যখন সে চলে গেল
তার ঠোঁটের ওপর ছিল একটি মৃদু হাসি….
তার নিকট সে ফিরে এলো,
(তখন আমি বাতি জ্বালার শব্দ পেলাম)
তার নিকট সে ফিরে এলো,
তখন সে নারীর নিকট ছিল অপর কেউ….
আমি দেখা পেয়েছিলাম মৃত্যুর,
(এবং আমি নারীটির আত্মার আর্তি শুনতে পেয়েছিলাম)
আমি দেখা পেয়েছিলাম মৃত্যুর,
সে নারীর জন্য সে তখনও ছিল প্রতীক্ষমান ….
কেউ বলতে এলো,
(বৎস, আমি ভয় পেয়েছি)
আমার প্রদীপটি জ্বালিয়ে
ভয়ে ভয়ে আমি অগ্রসর হলাম…
একটি দ্বারের নিকট আমি এলাম,
(বৎস, আমি ভয় পেয়েছি)
একটি দ্বারের নিকট আমি এলাম
একটি কম্পন শিখাটিকে সচকিত করল…
দ্বিতীয় দ্বারের কাছে
(বৎস, আমি ভীত)
দ্বিতীয় দ্বারের কাছে
ওই শিখা থেকে শব্দগুলি উৎসারিত হল…
তৃতীয়টির কাছে আমি এলাম
(বৎস, আমি ভীত)
তৃতীয়টির কাছে আমি এলাম
তখন ক্ষুদ্র শিখাটির ঘটল মৃত্যু…
যদি সে কোনোদিন ফিরে
এবং তোমাকে দেখে মৃত?
বলো, আমি তাকে কামনা করেছিলাম
যখন আমি আমার মৃত্যুশয্যায়…
যদি সে তোমার কথা বলে
তার কি উত্তর দেবে, বল?
তাকে আমার স্বর্ণাঙ্গুরী দিও
এবং কোন উত্তর দিও না…
যদি সে প্রশ্ন করে
হলটি খালি কেন?
তাকে দেখিয়ে দিও অনাবৃত দুয়ার
বাতিটি আর প্রজ্বলিত নয়….
যদি সে আমাকে প্রশ্ন করে অন্তিম কাল নিয়ে?
বলো, আমি মৃদু হেসেছিলাম এই ভয়ে
পাছে সে একবিন্দু অশ্রুপাত করে…
উন্মীলিত ভালোবাসায় সে নারী গায়,
গায় এ আলোর নীচে,
এ শিখায়িত আগুন এবং সমস্ত স্বর্ণ
গোধুলি নিয়ে আসে
রাত্রি সমাগমের পূর্বে।

নিম্নোল্লিখিত আর কয়েকটি কবিতা শ্রদ্ধেয় তরুণ কবি ভেরায়রেন (Verhaeren) লিখিত এবং তাঁর রচনার ২৮ পৃষ্ঠা থেকে আমি এটি গ্রহণ করেছি :

আকর্ষণ [Attractions ]

বড় বড় রূপোর মুখোসগুলি, কুয়াসায় ভেসে গেছে,
এত আশ্চর্য সাদৃশ্য, তবু এত দূরবর্তী,
দিনাবাসনে বুড়ো সূর্যগুলির চারিদিকে ভাসে।
তারা আমাদের হৃদয়কে বিদ্ধ করে, করে অতি গভীরভাবে,
গভীর গোধূলিতে, সেই মৃদু সুদূর,
তাদের প্রেত চোখ তাদের মৃত মুখের ভিতরে তাকিয়ে থাকে।
চারিদিকে এখন নিস্তব্ধতা, কেবল সে সময় ছাড়া
যখন সন্ধ্যার বিবর্ণতায় তীব্রকণ্ঠ শিখারা
উল্লম্ফনে উৎসারিত এবং ঈশ্বরের দিকে উড্ডীন হয়।
যন্ত্রণাবিদ্ধ রহস্য আলিঙ্গনে আবিষ্ট করে
তোমার মনে হতে পারে মৃতেরা জানিয়েছে নীরব বিদায় সম্ভাষণ,
অহো, এই পৃথিবীতে সেই অতি গভীর মরমী সংবাদ
কারো কাছে বলবার নয়!
ভূগর্ভস্থ সমাধিতে পদ্মের মধ্যে নিদ্রামগ্ন খ্রীষ্টীয় যুবকদের
তারা কী স্মৃতিপুঞ্জ, বস্তুময় এবং উজ্জ্বল,
তারা কী তাদের মাংস অথবা চক্ষু?
অথবা ওটা কী সেই একমাত্র উজ্জীয়বান আশ্চর্যবস্তু, গভীর তলদেশে
কোনো রাত্রির স্বপ্নে সেগুলি প্রত্যাবৃত্ত হয়েছিল
আকাশকে আঘাত করে মূর্খতাকে জয় করবার জন্য?
ওদের নিঃস্ব কাজের জন্য-এটা আমরা অনুভব করি, মনে হয়,
এক বিন্দু ভালোবাসার জন্য, তাদের ভ্রমণ ও যন্ত্রণার জন্য
দূর দিগন্ত থেকে শোনা যায় তাদের আকাঙ্ক্ষার ক্রন্দনধ্বনি।
দিগন্তরে চিরকালের হৃদয় ও চিন্তার
পুরোনো সায়াহ্নগুলি অকস্মাৎ উজ্জ্বল প্রজ্জ্বলনে স্তিমিত হয়
যেহেতু মসীলিপ্ত গৌরব যন্ত্রণায় পরিপূর্ণ হয়।

৪ নং

নিম্নের কবিতাটি মোরেয়া (Moreas) লিখিত -যিনি নিঃসন্দেহে গ্রীক সৌন্দর্যের উপাসক। এটি তাঁর একটি কবিতাগ্রন্থের ২৮ পৃষ্ঠা থেকে গৃহীত :

স্বচ্ছ মুখচ্ছবির এনোনি
[Enone of the Clear Visage ]
এনোনি, তোমার সৌন্দর্য ভালোবাসতে গিয়ে আমি ভাবলাম
(যেখানে দেহ এবং আত্মার মিলন ঘটে)
আমার হৃদয় মন দৃঢ় করে আমার আরোহণ করা উচিত,
যা মৃত্যুকে জানে না তাকে না পাওয়া পর্যন্ত আমার খোঁজা উচিত :
অ-সৃষ্ট, তাই কিছু কুৎসিত, কিছু সুন্দরের সমাবেশ তার মধ্যে নেই,
এক অংশে শীতল এবং অপর অংশে উষ্ণ তাও নয়।
আমার ভাবতে ভালো লাগছিল, আমার কাব্যে উত্তম এবং অধম
এক পরম সামঞ্জস্য মিলিত হবে।
যেমন পালহিমনিয়ার সেবক আমি মেলাতে সক্ষম
গম্ভীর এবং তীব্রকে সমতান সঙ্গতিতে এবং বাজাতে পারেন
এমন মহত্তর সুর যা তার বাদ্যতন্ত্রী থেকে উচ্চতর।
কিন্তু আমার যে সাহস এখন শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলে
মৃত্যুর নিকট, বেদনাজীর্ণ ঘোষণা করেছে তীরটি-হায়, কী দুঃখ।
যা আমাকে বিদ্ধ করেছে, এবং ভালোবাসা দিয়ে আমাকে প্রথমে কাঁদিয়েছে,
সহজে নোয়ানো ধনুর জ্যা-নিঃসৃত তা কোন তীর নয়
একমাত্র পিতাসৃষ্ট ভেনাসের দ্বারা যা উৎপন্ন।
কিন্তু ভেনাস অপর দেবতা যে আমাকে বেদনা দিয়েছে,
যিনি ভীরু অন্তর নিয়ে ক্ষীণ মাতার জন্মজাত,
তবু এ দুরন্ত বর্বর, এ শিকারী যে এত সাহসী
যার তূণীর সূক্ষ্ম তীরগুলিকে সুকৌশলে ধারণ করে,
যিনি হেসে এবং মশাল নেবে (একদিনের জন্য!)
কেবলমাত্র কোমল এবং আনন্দিত ফুল ছাড়া আর কিছুর
ওপর বিশ্রাম নেয় না,
এবং সুললিত ত্বকের ওপর তার অশ্রুজল পড়েই শুকিয়ে যায়-
এনোনি, তবু যে ভালোবাসাকে আমরা জানি তা দেবতা।
এটা অতিক্রান্ত হোক, যেহেতু বসন্তের পাখিরা পলাতক
এবং আমি দেখি মৃতপ্রায় সুর্যের অন্তিম রশ্মি।
এনোনি, আমার দুঃখ, আহা সমন্বয়ী মুখ,
মহান নম্রতা, পবিত্র এবং কমনীয় কথাগুলি
গত রাত্রিতে দ্রুত হরফে আদ্ভূত জলাধারের দিকে আমি ফিরে চাইলাম,
বাগানের শেষ প্রান্তের সুন্দর জায়গাটিতে পাতা ছড়ানো
এবং বিগত দিনগুলিকে আমি আমার মুখের ওপর মুদ্রিত দেখি।

এটাও এম. মতেস্যু (M. Montesquion) লিখিত এ জাতীয় কবিতায় ভর্তি একটি বৃহৎ গ্রন্থের ২৮ পৃষ্ঠা থেকে উদ্ধৃত :

ছায়া ঘুমপাড়ানি গান

[The shadow Lullaby]

রূপমূর্তি, রূপমূর্তি, রূপমূর্তি
সাদা, নীল, সোনালি এবং রক্তিম
দেবদারু গাছগুলি থেকে নেমে
ঘুমন্ত শিশুর মাথার ওপর রূপমূর্তি!
পালক, পালক, পালক
পাখির আরামপ্রদ বাসা তৈরির জন্য।
বারোটা বাজে : কলরব থামিয়ে দেয়;
হাতুড়িগুলি বিশ্রাম নেয় …
ওগো পালকগুলি!
গোলাপ, গোলাপ, গোলাপ
ক্ষণিকের জন্য তার ঘুমকে সুরভিত করতে
তোমার সুগন্ধি দলগুলি বিবর্ণ
তার রক্তিম হাসির পাশে
ওগো গোলাপগুলি!
পাখা, পাখা, পাখা
মৌমাছি এবং গঙ্গাফড়িঙ্
তার কপালের চারদিকে গুঞ্জন করতে,
এবং তোমার দীর্ঘনিশ্বাসের সঙ্গে তাকে ঘুম পাড়াতে
ওগো পাখা!
শাখা, শাখা, শাখা
একটি ছায়াময় কুঞ্জ ঘিরে আছে
যার মধ্য দিয়ে ওগো দিনের আলো, ক্ষীণ পায়ে
নেমে এসো আমার ছোট্ট পাকাটির ওপরে। শাখাগুলি!
স্বপ্ন, স্বপ্ন, স্বপ্ন
তার অনাবৃত মনের ভেতর
একটি ছোট্ট মিথ্যা প্রবিষ্ট করো,
তার পশ্চাৎ জীবনের দৃশ্যগুলি, স্বপ্নগুলি!
পরী, পরী, পরী
তাদের সূত্রগুলি বেষ্টন ও আকুঞ্চন করুক
ছায়াস্বপ্নের তুলি দিয়ে
এ ছোট্ট মাথাগুলির মধ্যে
পরীগুলি!
দেবদূত, দেবদূত, দেবদূত
সুদূর মেঘলোক ছাড়ানো নির্মল আকাশে
সে অদ্ভুত শিশুগুলিকে বয়ে নিতে
যারা এখানে থাকতে চায় না…
আমাদের দেবদূতেরা!

এই কবিদের অপরাপর সৃষ্টিকর্মও সমান দুর্বোধ্য, অথবা খুব কষ্ট সহকারে বোধগম্য হয়, তাও আমার সম্পূর্ণভাবে নয়। এই সব শত শত কবি-যাদের মধ্যে আমি মাত্র কয়েকজনের উল্লেখ করেছি-সকলের রচনাই ওই একই গোত্রের। এবং জার্মান, সুইডিস, নরওয়েজীয়, ইতালীয় এবং আমাদের রুশদের মধ্যেও একই ধরনের কবিতা মুদ্রিত হয়। এ ধরনের রচনা ছাপা হয়ে কোটিতে কোটিতে না হলেও লক্ষ লক্ষ সংখ্যায় গ্রন্থাকারে গ্রথিত করা হয়। (এ পর্যায়ের এক একটি দশ বিশ হাজার বিক্রিও হয়)। এ সমস্ত বইয়ের টাইপ সাজাতে, পৃষ্ঠা চিহ্নিত করতে, ছাপতে এবং বাঁধাই করতে কোটি কোটি কাজের দিন ব্যয়িত হয়। সেই কাজের দিনের সংখ্যা অত্যাশ্চর্য পিরামিড নির্মাণে ব্যয়িত দিনের চেয়ে খুব সম্ভব সংখ্যায় কম নয়। এটাই সব নয়। অপরাপর শিল্পের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার চলছে : কোটি কোটি কাজের দিন ব্যয়িত হচ্ছে সমান দুর্বোধ্য চিত্রশিল্প, সংগীত, নাটক প্রভৃতি শিল্পকর্মে।

এ ব্যাপারে চিত্রশিল্প কবিতার থেকে যে তবু পিছিয়ে নেই তা নয়, বরং তাকে ছাড়িয়ে গেছে। এখানে শিল্পের একজন শিক্ষানবীশের ডায়েরি থেকে একটি অংশ উদ্ধৃত করছি। তিনি এটি লিখেছিলেন ১৮৯৪ সালে পারীর প্রদর্শনী দেখবার সময় :

আজকে আমি তিনটি প্রদর্শনীতে ছিলাম : প্রতীকীদের, ইম্প্রেশনিস্টদের এবং নব্য- ইম্প্রেশনিস্টদের (Neo-Impressionists)। আমি বিচারবুদ্ধি প্রয়োগের সাহায্যে এবং সযত্নে ছবিগুলি দেখছিলাম, কিন্তু আবারও আমি অনুরূপ হতবুদ্ধি এবং ক্রুদ্ধ মনোভাব অনুভব করলাম। প্রথম প্রদর্শনীটি ছিল কেমিল পিসারো (Camille Pissarro)-র। সে প্রদর্শনটি ছিল তুলনায় সর্বাধিক সুবোধ্য; চিত্রগুলির অঙ্কন ত্রুটিপূর্ণ এবং বিষয়বস্তুহীন এবং বর্ণের প্রলেপ ছিল একেবারেই অবাস্তব। অঙ্কন এতই অনির্দিষ্ট যে, অনেক সময় বোঝাই দুস্কর একটি হাত বা একটি মাথা কোন দিকে ঘোরানো। এই ছবিগুলির বিষয়বস্তু সাধারণত ছিল, “effects” বা দৃশ্যাবলী-কুয়াশার দৃশ্য, সন্ধ্যার দৃশ্য, সূর্যাস্তের দৃশ্য। কতকগুলি চিত্রে মূর্তি অঙ্কিত ছিল, কিন্তু সেগুলিতে বিষয়বস্তুর কোন নির্দেশ ছিল না।

রঙের বিন্যাসে উজ্জ্বল নীল এবং উজ্জ্বল সবুজের প্রাধান্য ছিল এবং প্রতিটি ছবিতে ছিল বিশেষ রঙের ব্যবহার, মনে হচ্ছিল সমগ্র ছবিটির ওপর সে রং ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। উদাহররণ স্বরূপ, হাঁসের পাহারায় নিযুক্ত একটি মেয়ে (A girl guarding geese) -এই নামাঙ্কিত ছবিটিতে যে বিশেষ রং ব্যবহৃত হয়েচে তা হল পিতলের ওপর সবুজ কলঙ্কের রঙের মতো (Vert de gris Verdigis)। মুখের ওপর, চুলের ওপর, হাতের ওপর, কাপড়ের ওপর, সে রঙের বিন্দুগুলি এদিক ওদিক সর্বত্র ছিটিয়ে দেওয়া হয়েছে। ডুরান্ডরুএল (Durand-Ruel)-এর ওই একই গ্যালারিতে আরও কিছু ছবি ছিল : যেমন, পুভি দ্য সাভান (Puvis de Chavanns), মানে ( Manet) মোনে (Monet) রেনোয়া (Renoir) সিসলে (Sisley) প্রভৃতির অঙ্কিত-যাঁরা সকলেই ইস্প্রেশনিস্ট্ গোষ্ঠীর শিল্পী। এঁদের মধ্যে যে একজনের নাম আমি হদিশ করতে পারিনি সে নাম খানিকটা যেন রেদর (Redon) মতো। তিনি এঁকেছিলেন রেখাচিত্রে একটি নীল মুখ। সমস্ত মুখাবয়বের ওপর ছিল শ্বেতাভ সীসের সঙ্গে নীল রঙের ছোপ। পিসারোর (Pissaro) ছিল একটি জলরঙের ছবি-যে শিল্পকর্মের সমস্তটাই বিন্দুর সাহায্যে সাধিত হয়েছিল। চিত্র-দৃশ্যমুখে ছিল একটি গরুর ছবি-যার সমস্তটাই আঁকা হয়েছিল বিচিত্র রঙের বিন্দুর সাহায্যে। ছবিটিকে যতদূর পিছিয়ে বা কাছের থেকে দাঁড়িয়ে দেখা যাক্ না কেন, সাধারণ রংকে পৃথক করে চিনবার উপায় নেই। সেখান থেকে আমি প্রতীকী শিল্পীদের ছবি দেখতে গেলাম। কাউকে কোন ব্যাখ্যা জিজ্ঞাসা না কর আমি অনেকক্ষণ সে ছবির দিকে তাকিয়ে রইলাম-উদ্দেশ্য সে ছবিগুলির অর্থ অনুমান করা। কিন্তু সেগুলির অর্থ মানুষের বোধগম্যতার অতীত। উচ্চাবচ প্রণালীতে কাষ্ঠনির্মিত একটি ভাস্কর্য প্রথমে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। সেটির নির্মাণ-প্রণালী ছিল অতি নিকৃষ্ট। সে ভাস্কর্যটি ছিল একটি নগ্ন স্ত্রীলোকের। উভয় হস্ত দিয়ে নিজের স্তন দুটি নিষ্পেষণ করে সে রক্তের স্রোত নিঃসারিত করছে। সে রং নিম্নের দিকে প্রবাহিত হয়ে ঈষৎ নীল রক্তিমাভ রঙে রূপান্তরিত হচ্ছে। তার চুলগুলি প্রথমে নীচের দিকে নেমে এসে অতঃপর ওপরের দিকে উঠে গিয়ে কতোগুলি বৃক্ষে পরিণত হয়েছে। সমস্ত মূর্তিটি হলুদ রঙে রঞ্জিত এবং চুলগুলি বাদামি।

‘পরবর্তী একটি ছবি : হলুদ রঙের সমুদ্রের ওপর এমন কিছু একটা সাঁতার দিচ্ছে যা জাহাজও নয়, হৃদপিন্ডও নয়, দিগন্ত জ্যোতির্মন্ডলবেষ্টিত একটি রেখাঙ্কিত মুখ-যা সমুদ্রে রূপান্তরিত হয়ে অদৃশ্য হয়। কয়েকজন চিত্রশিল্পী এত মোটা রকমের রঙের ব্যবহার করেছেন যে, তাদের শিল্পপরিণতি চিত্রশিল্প এবং ভাস্কর্যশিল্পের মাঝামাঝি কিছুতে পর্যবসতি হয়েছে। তৃতীয় প্রদর্শিত চিত্রটি আরও অনেক কম সুবোধ : সেটি একটি মানুষের রেখাচিত্র। তার সামনে ছিল একটি অগ্নিশিখা এবং কালো কালো কতকগুলি জোঁক। অবশেষে উপস্থিত একজন ভদ্রলোককে আমি জিজ্ঞাসা করলাম-এর অর্থ কী? তিনি আমাকে ব্যাখ্যা করে বললেন, কাঠের ওপর ক্ষোদিত মূর্তিটি একটি প্রতীক এবং তা ব্যঞ্জিত করছে এই পৃথিবীকে। হলুদ সমুদ্রে ভাসমান হৃপিন্ডটি ‘গুপ্ত মায়া’ এবং জোঁক সহ ভদ্রলোক হলেন অমঙ্গলের প্রতীক। আরও কতকগুলি ইম্প্রেশনিস্ট ছবিও ছিল : ফুলের মত কিছু হাতে নিয়ে কয়েকটি প্রাথমিক পর্যায়ের রেখামূর্তি। সে চিত্রগুলি একরঙা এবং তাদের অঙ্কন ত্রুটিপূর্ণ এবং হয় সম্পূর্ণ অস্পষ্ট অথবা ব্যাপক কালো রেখাঙ্কন দ্বারা চিহ্নিত।

এই ছিল ১৮৯৪ সালের পরিস্থিতি। সে একই প্রবণতা এখন আরও তীব্রভাবে লক্ষিতব্য। ফলে আমরা বোকলিন (Bocklin), স্টুক্ (Stuck), ক্লিঙ্গার (Klinger), শশা স্নাইডার (Sasha Schneideer) প্রভৃতি অপরাপর শিল্পীদের সাক্ষাৎ পেয়েছি। নাটকেও একই ব্যাপার ঘটছে। নাট্যকারেরা আমাদের উপহার দিচ্ছেন এমন একজন স্থপতিকে যিনি তার পূর্ব জীবনের আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করতে সমর্থ হননি, এবং কাজে কাজেই তিনি স্ব-নির্মিত একটি গৃহের ছাতে আরোহণ করেন এবং মাথাটি নিচু করে সে সেখানে থেকে পড়ে যান। অথবা একজন দুর্বোধ্য বৃদ্ধা স্ত্রীলোক (যে ইঁদুর মেরে বেড়ায়) কোন দুৰ্জ্জেয় কারণবশত একটি কবি-স্বভাব বালককে সমুদ্রে নিয়ে যায় এবং সেখানে তাকে ডুবিয়ে মারে। অথবা কিছু অন্ধ মানুষ সমুদ্রের ধারে বসে কোন কারণবশত একই জিনিসের সর্বক্ষণ পুনরাবৃত্তি করে চলে। অথবা এক ধরনের একটি ঘন্টা একটি হ্রদের মধ্যে পড়ে সেখানে বাজতে থাকে।

যে শিল্প সকল শিল্পের চাইতে প্রত্যেকের নিকট বেশি বোধগম্য হওয়া উচিত বলে বিবেচিত, সেই সংগীতশিল্পেও একই ব্যাপার ঘটছে।

তোমার পরিচিত কোন খ্যাতিমান সংগীতজ্ঞ পিয়ানোতে বসে স্ব-রচিত দাবি করে তোমার উদ্দেশে একটি গৎ বাজান, কিংবা নতুন সংগীত রচয়িতাদের মধ্যে কোন একজনের একটি গৎ বাজান। তুমি সে অদ্ভুত উচ্চধ্বনি শোনো, তার আঙুল চালনার কসরত দেখে বিস্ময় বোধ কর। এবং এটাও তোমার কাছে স্পষ্ট যে, বাদকসৃষ্ট ধ্বনিগুলির দ্বারা আত্মার বিচিত্র কাব্যময় অভীপ্সার ব্যঞ্জনা তোমার কাছে পৌঁছে দিতে চেষ্টা করছে। তবু তার এই অভিপ্রায়ের লক্ষ উপলব্ধি করেও একমাত্র অবসাদ ব্যতীত কোন অনুভূতি তোমার মধ্যে সঞ্চারিত হয় না। এরূপ সংগীতক্রিয়া দীর্ঘকাল চলতে থাকে। কোন প্রকার স্বচ্ছ ধারণায় আসতে অসমর্থ হওয়ায় সে সংগীত অন্তত তোমার নিকট খুবই দীর্ঘবিস্তারী মনে হয় এবং অনিচ্ছাকৃতভাবে আলফোনসেকার (Alphonese Karr)-এর উক্তি তোমার মনে পড়েঃ যা দ্রুততর বেগসম্পন্ন তার স্থায়িত্বও দীর্ঘতর। এবং এও তোমার মনে হবে যে, এর সবটাই হয়ত বা একটা চালাকি, বাদ্যযন্ত্রের ঘাটগুলির ওপর উন্মত্তেরর মতো হাত এবং আঙুলগুলি চালিয়ে সম্ভবত বাদক তোমাকে পরীক্ষা করছেন এই আশায় যে, ফাঁদে পড়ে তুমি তাঁর প্রশংসা করবে। তারপর তিনি হেসে স্বীকার করবেন, তোমাকে ধোঁকা দেওয়া যায় কিনা তিনি তা পরীক্ষা করছিলেন। কিন্তু বাজনা যখন শেষ হয়ে যাবে তখন ঘর্মাক্ত উত্তেজিত সংগীতশিল্পী স্পষ্টত প্ৰশংসা প্রত্যাশা করে যখন পিয়ানো থেকে উঠে দাঁড়াবেন, তুমি তখন এও উপলব্ধি করবে যে, তার বাজনা আগাগোড়া আন্তরিকই ছিল।

যে সব সংগীতানুষ্ঠানে Liszt, হ্বাগ্‌নার (Wagner), বারলিয়ো (Berlioz), ব্রাহ্মস্‌ (Brahms), এবং সর্বাপেক্ষা নবাগত রিচার্ড স্ট্রাউস Richard Strauss)-এর সৃষ্ট সংগীত পরিবেশন করা হয়, সেখানেও ওই একই ব্যাপার ঘটে থাকে, এবং নতুন গোষ্ঠীর অপরাপর অসংখ্য সংগীতকারেরা-যারা নিরবচ্ছিন্নভাবে গীতভিনায়ের পর গীতাভিনয়, সিম্ফনির পর সিম্ফনি, সংগীতের পর সংগীত রচনা করে চলেছেন-তাদের ক্ষেত্রেও ওই একই কথা।

উপন্যাস ও ছোটগল্পের ক্ষেত্রে দুর্বোধ্য হওয়াটা অসম্ভব বিবেচিত হলেও সেখানেও সেই একই ব্যাপার ঘটছে।

হুইসম্যানস (Huysmans)-এর La-Bas, কিপলিং-এর কোন কোন ছোটগল্প, অথবা Villiers de l’Isle – Adam – লিখিত Contes Cruels- এর অন্তর্গত L’Annonciateur পড়লে দেখবে, তারা শুধুমাত্র ‘abscons’-ই (এটি নতুন লেখকদের উদ্ভাবিত একটি শব্দ) নয়, বরং আঙ্গিক এবং বিষয়বস্তুর দিক থেকে সম্পূর্ণরূপে দুর্বোধ্য। বর্তমানেজবাব Blanche -তে প্রকাশিত ই, মোরেল (E. Morel) রচিত Terre Promise এই প্রকরণের আর একটি রচনা অধিকাংশ নতুন উপন্যাসই এ পর্যায়ের। রচনাশৈলী খুবই আড়ম্বরপূর্ণ, অনুভূতিসমূহ খুবই সমুন্নত মনে হলেও কার উদ্দেশ্যে, কোথায় কি ঘটছে তুমি তার কোন হদিশ করতে পারবে না। আমাদের যুগের অধিকাংশ নবীন শিল্পীদের শিল্পই এ পর্যায়ের।

এ শতাব্দীর প্রথমার্ধে যারা গ্যেটে, শীলার, মুসে (Musset), হুগো, ডিকেন্স, বেটোফেন, সো প্যাঁ (Chopia), র‍্যাফায়েল, দা ভিঞ্চি, মিকেলাঞ্জোলো (Michaelangelo) এবং ডিলারোশ (Delaroche) প্রভৃতির সৃষ্টিকর্মে আনন্দিত হয়ে বেড়ে উঠেছিলেন, তারা এই অভিনব শিল্পের মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে না পেরে এ-সবই কদর্য পাগলামিপ্ৰসূত বলে অভিহিত করেন এবং এদের সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেন। কিন্তু নতুন শিল্পধারার প্রতি এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক, যেহেতু, প্রথমত এ শিল্প শুধু যে উত্তরোত্তর প্রসার লাভ করেছে তা নয়, বর্তমান শতকের তৃতীয় দশকে (১৯শ শতাব্দী) রোমান্টিকেরা সমাজে যে অবস্থায় অধিষ্ঠিত ছিলেন, এ শিল্পও সমাজে তদনুরূপ একটি দৃঢ় আসন জয় করে নিয়েছে। দ্বিতীয়ত এবং মুখ্যত যার মর্মোদ্ধারে অক্ষম বলে যাকে আমরা ক্ষয়িষ্ণু শিল্প (Decadent Art) বলি, সেই সাম্প্রতিকতম শিল্পসৃষ্টিকে যদি এভাবে বিচারের আওতায় আনা হয়, তবে এটাও মনে রাখতে হবে, শ্রমিক এবং অ-শ্রমিক জনসাধারণের মধ্যে বিরাট সংখ্যক বহু মানুষ আমাদের বিবেচনায় যা প্রশংসার যোগ্য, তারা কিন্তু সে শিল্পসৃষ্টির মর্ম উদ্ধারে অক্ষম। সে শিল্পসৃষ্টির মধ্যে পড়ে গ্যেটে, শীলার, উগো প্রভৃতি আমাদের প্রিয় শিল্পীদের কবিতা, ডিকেন্সের উপন্যাসমূহ, বেটোফেন ও সোপ্যার সংগীত, র্যাফায়েল, মিকেলাঞ্জোলো, দ্য ভিঞ্চির চিত্রশিল্পসমূহ এবং এ পর্যায়ের আরও বহু শিল্পকর্ম।

যথোপযুক্ত মানসিক পরিণতির অভাব হেতু জনতার অধিকাংশ লোক আমার বিবেচনায় সন্দেহাতীত ভাল বস্তুকে উত্তম বলে উপলব্ধিতে অক্ষম বা অপছন্দ করে-এরূপ ভাবনার অধিকার যদি আমার থাকে, তেমনি এটা অস্বীকার করবার আমারও অধিকার নেই যে, সম্ভবত যে কারণে আমি নতুন শিল্পসৃষ্টি উপলব্ধি করতে বা ভালোবাসতে পারি না তার কারণ হল, সেগুলির মর্মগ্রহণের জন্য আমারও যথোপযুক্ত মানসিক পরিণতি ঘটেনি। যদি আমার এরূপ বলবার অধিকার থাকে যে, নতুন শিল্পসৃষ্টিতে বুঝবার মতো কিছুই নেই বলে আমি এবং আমারই সহকর্মী অধিকাংশ লোক তার কিছুই বুঝতে পারে না, সুতরাং শিল্পবিচারে তা মন্দ, তবে ঠিক সেই একই দাবিতে আরও অধিকাংশ ব্যক্তি অর্থাৎ সমস্ত শ্রমিক জনসাধারণ আমার স্বীকৃত সৎ শিল্পকে নিকৃষ্ট এবং তার মধ্যে বোঝাবার মতো কিছু নেই-এমন কথাও বলতে পারে।

আমার সামনেই দুর্বোধ্য কবিতার লেখক একজন কবি উৎফুল্ল আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে দুর্বোধ্য সংগীতকে ব্যঙ্গ করায় আমি নতুন শিল্পের প্রতি এক ধরনের নিন্দার অযৌক্তিকতা সুস্পষ্টভাবে একবার প্রত্যক্ষ করেছিলাম। কারণ খনিকক্ষণ পরেই দুর্বোধ্য সিম্ফনি-স্রষ্টা একজন সংগীতশিল্পী দুর্বোধ্য কবিতার উদ্দেশ্যে একই আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে বিদ্রূপাত্মক হাসি হেসেছিলেন। আমি (ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের একজন শিক্ষিত ব্যক্তি) তার কিছুই বুঝি না বলেই আধুনিক শিল্পকে নিন্দা করবার কোন দাবি বা অধিকার আমার নেই। আমি শুধু এটুকুই বলতে পারি, নতুন শিল্প আমার নিকট দুর্বোধ্য ক্ষয়িষ্ণু শিল্পের (Decaden Art) চাইতে আমার স্বীকৃত একমাত্র প্রাধান্য এই যে, বর্তমান যুগের শিল্পের চাইতে আমার স্বীকৃত শিল্প কিছু পরিমাণ অধিক সংখ্যক মানুষের নিকট বোধগম্য।

আমি এক ধরনের ব্যতিক্রমী শিল্পে অভ্যস্ত এবং সে পর্যায়ের শিল্প আমার বোধগম্য কিন্তু অধিকতর ব্যতিক্রমী অপর কোন শিল্পের মর্মগ্রহণে আমি অসমর্থ। এই অক্ষমতা আমাকে এমন কোন সিদ্ধান্তের অধিকারী করে না-যার সাহায্যে আমি বলতে পারি- আমার শিল্পই একমাত্র বাস্তব খাঁটি শিল্প এবং যে শিল্প আমার বোধগম্যতার অতীত তা অযথার্থ এবং অসৎ শিল্প। আমি মাত্র এই সিদ্ধান্তেই আসতে পারি যে, উত্তরোত্তর বেশি পরিমাণে ব্যতিক্রমী হয়ে ওঠার শিল্প ক্রমবর্ধমান মানুষের নিকট বেশি পরিমাণে দুর্বোধ্য হয়ে উঠেছে, এবং অধিক থেকে অধিকতর দুর্বোধ্যতার দিকে গতি হওয়ায় (যে পর্যায়ের একটি স্তরে আমি আমার সুপরিচিত শিল্প সহ অবস্থান করছি) তা এমন একটি বিন্দুতে এসে পৌঁছেছে যে, সে শিল্প একটি অতি ক্ষুদ্র সংখ্যক নির্বাচিত মানুষের নিকটই বোধগম্য এবং এ পর্যায়ের নির্বাচিত মানুষের সংখ্যা ক্রমশই ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর বৃত্তের মধ্যে সীশাবদ্ধ হয়ে আসছে।

সমাজের অভিজাত শ্রেণীর শিল্প সর্বজনীন শিল্প থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার পরই এমন একটি প্রত্যয় গড়ে উঠেছিল যে, জনসাধারণের বোধগম্যতার অতীত হলেও তা শিল্প হতে পারে। এ অবস্থাকে যে মুহূর্তে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছিল, অনিবার্যভাবে এটাও স্বীকার না করে উপায় ছিল না যে, শিল্প কেবলমাত্রা খুবই ক্ষুদ্রতম সংখ্যক নির্বাচিত ব্যক্তির নিকট বোধগম্য হতে পারে এবং পরিণামে তা দুই বা একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুর কিংবা শুধুমাত্র নিজের নিকটই বোধগম্য হতে পারে। বস্তুতপক্ষে আধুনিক শিল্পীরা এরূপ কথাই বলেছেন : আমার সৃষ্টিকর্মকে আমি নিজেই বুঝি, যদি কেউ আমাকে না বুঝতে পারেন, তবে তা তারই দুর্ভাগ্য।

একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীর নিকট দুর্বোধ্য হওয়া সত্ত্বেও শিল্প সৎ-শিল্প হতে পারে-এ দৃঢ় দাবি নিরতিশয় ন্যায়বিরোধী। এর পরিণতি স্বয়ং শিল্পের পক্ষেই ধ্বংসাত্মক। কিন্তু এটা সচরাচর এমনই ঘটতে দেখা যায়, এবং তা আমাদের সমস্ত ধারণার মূলে এমনই ঘূণ ধরিয়ে দিয়েছে যে, এর সামগ্রিক অবাস্তবতাকে যথেষ্ট স্বচ্ছভাবে উদ্ঘাটিত করা প্রায় অসম্ভব বললেই চলে।

বিখ্যাত শিল্পকর্ম সম্পর্কে সদা-সর্বদা একটা কথা শোনা যায় যে, তার মর্মোদ্ধার কষ্টকর। এ ধরনের দৃঢ় উক্তি শুনে শুনে আমরা খুবই খুবই অভ্যস্ত হয়ে গেছি। কোন শিল্প সৎ অথচ অধিকাংশ লোকের নিকট দুর্বোধ্য-এ কথা বলাও যা, তেমনি কোন খাবার খুবই উৎকৃষ্ট অথচ অধিকাংশ লোকের অনাস্বাদ্য-এ কথা বলাও তাই। বিকৃতরুচির লোকের নিকট প্রিয় খাদ্য বিবেচিত হলেও অধিকাংশ ব্যক্তির নিকট পচা পনির অথবা পচে-ওঠা বন্য কুক্কুট হয়ত পছন্দসই নয়। কিন্তু পাউরুটি এবং ফল একমাত্র তখনই উৎকৃষ্ট বিবেচিত হয়-যখন তা অধিকাংশ মানুষের তৃপ্তি বিধানে সমর্থ হয়। শিল্প সম্পর্কেও একই কথা প্রযোজ্য। বিকৃত শিল্প অধিকাংশ লোককে তৃপ্তি দিতে সমর্থ না হলেও সৎ শিল্প সব সময় প্রত্যেক মানুষকে সুতৃপ্ত করে।

সচরাচর এটা বলা হয়, সর্বোত্তম শিল্পকর্মের প্রকৃতিই এমন যে, তা জনতার বোধগম্য হতে পারে না। পরন্তু এ পর্যায়ের মহৎ শিল্পকর্ম উপলব্ধিতে আগ্রহী শুধুমাত্র নির্বাচিত ব্যক্তিদেরই সে শিল্পকর্মে প্রবেশাধিকার আছে। যদি অধিকাংশ লোকের তা বোধগম্য না হয়, তবে প্রয়োজনীয় শিল্প উপলব্ধির শিক্ষা তাদের দিতে হবে এবং সে শিল্পকর্মের মর্মার্থ তাদের সামনে তুলে ধরতে হবে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে এরূপ কোন জ্ঞানের সাক্ষাৎ পাওয়া যায় না এবং অধিকাংশ লোক সৎ শিল্পকর্মের মর্মোদ্ধারে অক্ষম-একথা যারা বলে থাকেন তারা কখনও ওই শিল্পকর্মে ব্যাখ্যা দেন না। শুধুমাত্র এ কথাই তারা ঘোষণা করে থাকেন যে, ওই শিল্পকর্মসমূহের মর্মে প্রবেশ করতে হলে ঐগুলিকে বারংবার পড়তে, দেখতে এবং শুনতে হবে। কিন্তু এটা তো ব্যাখ্যা হল না, এ শুধু নিজেদের অভ্যস্ত করা। এবং মানুষ যে কোন কিছুতে, এমনকি সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট বস্তুতেও নিজেদের অভ্যস্ত করে তুলতে পারে। মানুষ যেমন নিকৃষ্ট খাদ্যে, মাদক দ্রব্যে, তামাকে, আফিঙে নিজেদের অভ্যস্ত বলতে পারে, তেমনি একই উপায়ে নিকৃষ্ট নিজেদের অভ্যস্ত করে তুলতে পারে। বাস্তবেও ঠিক তাই ঘটছে।

অধিকনতু সর্বোত্তম শিল্পকর্মের প্রতি শ্রদ্ধার ভাব পোষণ করার পক্ষে অধিকাংশ লোক রুচিহীন-এমন কথা বলা চলে না। সর্বোত্তম শিল্প বলে যা স্বীকার্য, অধিকাংশ ব্যক্তি শুধু সর্বকালে নয়-বর্তমান কালেও একই মনোভাব নিয়ে সে শিল্পের মর্মগ্রহণ করে থাকে : যেমন, এবহবংরং- এর মহাকাব্য, খ্রীষ্ট-মুখনিসৃত সকল রূপক গল্প, লোককাহিনী, রূপকথা, লোক সংগীত প্রভৃতি। এগুলি মানুষের বোধগম্য। আমাদের মহান শিল্প- নিদর্শনগুলিকে উপলব্ধি করবার ক্ষমতা জনসাধারণ অকস্মাৎ হারিয়ে ফেলল-এটা কেমন করে সম্ভব?

একটি ভাষণ সম্পর্কে বলা যেতে পারে যে সেটি খুবই প্রশংসার যোগ্য, কিন্তু যে ভাষায় ভাষণটি প্রদত্ত হয়েছে তা জানা না থাকলে ভাষণটি সে ভাষা-অনভিজ্ঞ ব্যক্তিদের নিকট দুর্বোধ্য মনে হবে। চীনা ভাষায় একটি ভাষন চমৎকার হতে পারে, কিন্তু আমি যদি চীনা ভাষা না জানি তবে আমার নিকট তা দুর্বোধ্য থেকে যাবেই। সকল মানস-কর্ম থেকে শিল্পকর্মের পার্থক্য এখানেই নিহিত যে, শিল্পের বাণী সকল মানুষের নিকট বোধগম্য এবং ব্যক্তিনিরপেক্ষভাবে তা সকলকেই সংক্রমিত করে। একজন চীনবাসীর অশ্রু ও হাসি একজন রুশোর হাসি ও অশ্রুর মতো আমাকে সংক্রমিত করে। চিত্রশিল্প এবং সংগীতের বেলায়ও ওই একই কথা। এমনকি কাব্যও যদি আমার বোধগম্য ভাষায় রূপান্তরিত হয়, তবে তাও অনুরূপ প্রভাব বিস্তার করবে। একজন কিরঘিজ (Kirghiz) বা জাপানির সংগীত একজন কিরঘিজ এবং জাপানির চিত্তকে যেমন স্পর্শ করে, আমাকেও তেমনি অপেক্ষাকৃত কম অনুপাতে হলেও স্পর্শ করে। জাপানি চিত্রশিল্প, ভারতীয় স্থাপত্য, এবং আরব্য কাহিনির দ্বারাও আমি প্রভাবিত হই। জাপানি সংগীত এবং চীনা উপন্যাস যদি আমার ওপর কম প্রভাব বিস্তার করে, তা আমার এ পর্যায়ের শিল্পকর্মবোধের অভাবজনিত নয়, বরং তদপেক্ষা উচ্চতর শিল্পকর্মের সঙ্গে আমি পরিচিত এবং তা উপভোগে অভ্যস্ত বলে। তাদের শিল্প আমার নাগালের বাইরে- এ কারণে নয়। মহৎ শিল্পকর্মের মহত্ত্বের দাবি শুধু এ জন্যই যে, সে শিল্পের ভেতর সকলের প্রবেশাধিকার আছে এবং প্রত্যেকের নিকট তা সুবোধ্য। চীনা ভাষায় অনূদিত যোশেফের কাহিনি একজন চীনাবাসীর মনে সাড়া জাঘায়। শাক্যমুনির (বুদ্ধের) কাহিনি আমাদের অন্তর স্পর্শ করে। এমন হর্ম্য, চিত্র, মূর্তি, এবং সংগীতের অস্তিত্ব অবশ্যই আছে, যেগুলির প্রভাবিত করবার শাক্তিও অনুরূপ। সুতরাং মানুষকে অভিভূত করবার জন্য শিল্পের ব্যর্থতা দর্শক বা শ্রোতার বোধশক্তির অভাবজনিত, এটা বলা চলে না। বরং এর থেকে এই সিদ্ধান্তে আসাই স্বাভাবিক এবং সঙ্গত যে, এ পর্যায়ের শিল্প হয়ত নিকৃষ্ট কিংবা শিল্প নামের যোগ্যই নয়।

শিল্পকে বোধক্রিয়া থেকে পৃথক করা হয়, যেহেতু বোধক্রিয়ার জন্য প্রস্তুতি এবং কিছুটা জ্ঞানের পারস্পর্যের প্রয়োজন হয়, (যেমন, জ্যামিতি সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করবার আগে কেউ ত্রিকোণমিতি শিখতে পারে না), অথচ মানসিক বিকাশ ও শিক্ষানিরপেক্ষভাবে শিল্প মানুষের মনের ওপর ক্রিয়া করে। ব্যক্তিমনের বিকাশ যে স্তরেই থাকুক না কেন, একটি ছবি, সুরু, বা রূপমূর্তির মাধূর্য যে কোন স্তরের মানস-পরিণতিসম্পন্ন ব্যক্তিকে সংক্রমিত করে।

শিল্পক্রিয়া নিহিত ঠিক এখানে : বিতর্করূপে যা দুর্বোধ্য ও দুষ্প্রবেশ্য মনে হয় তাকে বোধের জগতে এবং অনুভূতিলোকে আনাই শিল্পের কাজ। যথার্থ শৈল্পিক দৃষ্টির অধিকারীর নিকট এটা সাধারণত মনে হয় যে বিষয়টি তাঁর পূর্বজ্ঞাত, তবে তার অভিব্যক্তি দিতে তিনি অসমর্থ হয়েছিলেন।

উৎকৃষ্ট সর্বশেষ্ঠ শিল্পের প্রকৃতি পূর্বাপর এরূপ। ইলিয়াড, ওডেসি, আইজাক (Isaac), জেকব এবং যোশেফ-এর কাহিনিসমূহ; হিব্রু ভবিষ্যৎ বক্তাগণ, স্তোত্রসমূহ (The Psams), যীশুখ্রীষ্টের মুখনিসৃত রূপক গল্প, শাক্যমুনির কাহিনি, বেদের স্তোত্রসমূহ-এ সবই সমুচ্চ অনুভূতি-সঞ্চারক। এতদ্‌সত্ত্বেও শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে সেগুলি আমাদের নিকট এখনও যথেষ্ট সুবোধ্য, যেমন সুবোধ্য ছিল সেগুলি আমাদের শ্রমিকদের চাইতেও স্বল্পশিক্ষিত বহুকাল পূর্ববর্তী যুগের মানুষের কাছে। মানুষ দুর্বোধ্যতার কথা বলে থাকে। কিন্তু শিল্প যদি মানুষের ধর্মীয় উপলব্ধি-উৎসারিত অনুভূতি সমূহ সঞ্চার করে, তবে ধর্মভিত্তিক অর্থাৎ ঈশ্বরের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কনির্ভর অনুভূতি কি করে দুর্বোধ্য হতে পারে? এ পর্যায়ের শিল্প সকলের নিকট বোধগম্য হওয়া উচিত এবং চিরকালই তা বোধগম্য ছিল। যেহেতু ঈশ্বরের সঙ্গে প্রত্যেক মানুষের সম্পর্ক এক এবং অভিন্ন। এ কারণে গির্জা এবং তার অভ্যস্তরস্থ প্রতিমূর্তিগুলি প্রত্যেকের নিকট বোধগম্য ছিল। সর্বোত্তম এবং সর্বোচ্চ অনুভূতিগুলি উপলব্ধির পক্ষে বাধা বিকাশধারার বা শিক্ষাবিধির ন্যূনতার মধ্যে আদৌ নিহিত নয় (খ্রীস্টের জীবনকাহিনিতে যা উল্লেখিত) পরন্তু সে বাধার কারণ মানুষের ভ্রান্ত পথে বিকাশে এবং ভ্রান্ত শিক্ষায়। সৎ এবং সমুচ্চ শিল্পকর্মও অবোধ্য হতে পারে, কিন্তু তা সহজপ্রকৃতির অবিকৃতচরিত্র কৃষক, শ্রমিকের নিকট নয় (যা কিছু সর্বোত্তম তা তারা সর্বদাই বুঝতে সক্ষম)। অতি-শিক্ষিত ধর্মবর্জিত বিকৃতরুচির মানুষের নিকট অনেক সময় তা অবোধ্য হতেও পারে এবং অবোধ্যও বটে। এবং এটা আমাদের সমাজে প্রায় সর্বদাই ঘটে থাকে-যেখানে উচ্চতম অনুভূতিগুলি মোটেই উপলব্ধ হয় না। উদাহরণ স্বরূপ, আমি এমন সব মানুষকে জানি যারা নিজেদের খুব সংস্কৃত বিবেচনা করেন, অথচ এঁরা বলে থাকেন, তাঁরা প্রতিবেশীর প্রতি ভালোবাসা বিষয়ক, আত্মোৎসর্গমূলক অথবা সতীত্ববিষয়ক কবিতার মর্ম বোঝেন না।

সুতরাং সৎ, মহৎ, সর্বজনীন, ধর্মীয় শিল্প একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর আত্মভ্রষ্ট মানুষের নিকট দুরধিগম্য হতে পারে, কিন্তু কোন বৃহৎ সংখ্যক সহজ-প্রকৃতির মানুষের নিকট অবশ্যই নয়।

শুধুমাত্র সৎ, মহৎ পর্যায়ের বলেই কোন শিল্প বৃহৎ জনতার নিকট অনধিগম্য হতে পারে না-যদিও এ যুগের শিল্পীদের অভিমত তাই। আমরা বরং এ সিদ্ধান্তে আসতে বাধ্য যে, বৃহৎ জনতার নিকট এ পর্যায়ের শিল্পের দুর্বোধ্যতার একমাত্র কারণ, এ শিল্পের প্রকৃতি খুবই অসৎ, অথবা তা আদৌ কোন শিল্পপদবাচ্যই নয়।

সংস্কৃতিবান জনতা কর্তৃক হাস্যকর সারল্যের সঙ্গে গৃহীত যে একটি মুখরোচক যুক্তি আমরা শুনি তা হল, শিল্পের রসগ্রহণের জন্য শিল্পের মর্ম অনুধাবন করা আবশ্যক। এর প্রকৃত অর্থ আর কিছুই নয়-ওই শিল্পে নিজেকে পূর্বে অভ্যস্ত করে তোলা চাই। এর সত্যতম ইঙ্গিত এই যে, এ জাতীয় পদ্ধতি অবলম্বনে যা আমাদের বুঝতে বলা হচ্ছে, তা হয় অত্যন্ত অসৎ, ব্যতিক্রমী শিল্প (Exclusive Art) অথবা আদৌ শিল্পই নয়। অনেকে বলে থাকেন, শিল্পকর্ম জনসমাজকে তৃপ্তি দিতে পারে না-যেহেতু জনগণ তার মর্ম উপলব্ধিতে অসমর্থ। কিন্তু শিল্পী-অনুভূত আবেগের দ্বারা মানুষকে সংক্রমিত করাই যদি শিল্পকর্মের লক্ষ্য হয়, তবে শিল্পের মর্মগ্রহণে অক্ষমতার কথা ওঠে কী করে? জনসমাজের কোন ব্যক্তি একটি বই পড়ে, চিত্র দেখে, কোন নাটক বা সিম্ফনি শুনে ও কোন অনুভূতি প্রভাবিত না হতে পারে। তাকে বলা হয়, তার এই অক্ষমতা বোধেল অভাবজনিত। কিছু ব্যক্তি কোন একজনকে একটি প্রদর্শনী দেখাবার প্রতিশ্রুতি দেয়। প্রদর্শনীতে প্রবেশ করে সে কিছুই দেখতে পায় না। তাকে বলা হয়, তার দৃষ্টি এ দৃশ্য দেখবার জন্য প্রস্তুত হয়নি। অথচ লোকটি নিশ্চিত জানে, সে বেশ ভালোই দেখতে পায়। লোকেদের প্রতিশ্রুতি মতো সে যদি কিছু দেখতে না পেয়ে থাকে, তবে সে একমাত্র সিদ্ধান্ত করে (যা খুবই সঙ্গত) যারা তাকে সে দৃশ্য দেখাবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল-তারা সে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি। নিজের অন্তরে শিল্পকর্মের প্রবাব অনুভবে সক্ষম এমন কোন ব্যক্তির পক্ষে অনুভূতি সঞ্চারে অক্ষম শিল্পী সম্পর্কে এ ধরনের সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া খুবই যুক্তিযুক্ত। কোন ব্যক্তি নেহাত মূর্খ বলে আমার শিল্প- প্রভাবিত হচ্ছে না-এমন অভিমত শুধুমাত্র আত্মম্ভরী ও রূঢ়ই নয়, এটা বাস্তব ভূমিকার বিপরীতও বটে। কোন রোগী যদি সুস্থ লোককে বিছানায় পাঠিয়ে দেয়-এ পরিবর্তনের চেহারা অনেকটা সে রকম।

ভলতেয়ার বলেছিলেন, ‘একমাত্র ক্লান্তিকর শৈলী ছাড়া সকল শৈলীই উৎকৃষ্ট কিন্তু আরও সত্য উপলব্ধির সঙ্গে একথা বলা চলে, ‘একমাত্র যা অবোধ্য বা কোন প্রভাব সৃষ্টিতে অসমর্থ, তা চাড়া সকল শৈলীই উৎকৃষ্ট। কারণ, যদি কোন বিশেষ উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য কোন প্রবন্ধ লেখা হয়ে থাকে, সে উদ্দেশ্য ব্যর্থ হলে সে রচনার মূল্য কোথায়?

বিশেষভাবে মনে রাখা দরকার : যদি আমরা স্বীকার করে নিই যে, সুস্থ মনের কোন ব্যক্তির কাছে দুর্বোধ্য হয়েও কোন কিছু শিল্প বলে স্বীকার্য হয়, তাহলে কেনই বা বিকবৃতরুচির মানুষেরা নিজেদের বিকৃতরুচির অনুভূতি কন্ডুয়নের উদ্যেশ্য নিজেদের ছাড়া আর সকলের কাছে দুর্বোধ্য রচনাদি সৃষ্টি করবে না এবং তাকে ‘শিল্প’ বলে অভিহিত করবে না? বস্তুতপক্ষে তথাকথিত ‘ক্ষয়িষ্ণুরা’ (Decadents) এরূপই করে আসছেন।

শিল্প যে অভিমুখে চলেছে তাকে তুলনা করা চলে-একটি বৃহৎ বৃত্তের ওপর পর পর ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর কতকগুলি বৃত্তের সংস্থাপনের সঙ্গে,-যার ফলে তা একটি শঙ্কুর রূপ নেয়। তার চূড়ায় কোন বৃত্তের আর স্থান নেই। আমাদের যুগের শিল্পের বেলায়ও ঘটেছে ঠিক তাই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *