১
[শিল্প বিষয়ে যে পরিমাণ সময় ও শ্রম ব্যয়িত হয়-শিল্প-সেবায় জীবন খ্ৰীকৃত-শিল্পের বেদীতে নৈতিকতার বিসর্জন -একটি গীতাভিনয়ের মহড়ার বর্ণনা। ]
যে কোন সাধারণ সংবাদপত্র নিলেই দেখা যাবে তার কিছু অংশ নাটক ও সংগীতের আলোচনায় নিয়োজিত। প্রায় প্রত্যেক সংখ্যাতেই কোন শিল্প-প্রদর্শনীর অথবা নির্দিষ্ট কোন ছবির বর্ণনসা পাবেন। এ ছাড়া নতুন কোন শিল্পকর্মের, কবিতা বা গল্পসংগ্রহের কিংবা উপন্যাসের সমালোচনাও সব সময় চোখে পড়বে।
কোন অভিনয় অনুষ্ঠিত হবার সঙ্গে সঙ্গেই তার বিস্তৃত বিবরণ প্রকাশিত হয়ে থাকে : কোন্ নাটকে বা কমেডিতে বা অপেরায় অমুক অভিনেত্রী বা অভিনেতা এ-ভূমিকায় বা ও-ভূমিকায় কিরূপ অভিনয় করেছেন। শুধু তাই নয়, অভিনয়ের দোষগুণ সহ নতুন নাটক, কমেডি ও অপেরার বিষয়বস্তুও সে বিবরণে প্রকাশ করা হয় অনুরূপ যত্নের সঙ্গে ও সবিস্তারে অথবা তার চাইতেও বেশি পরিমাণে পাঠকদের জানানো হয় অমুক অমুক শিল্পী গানটি কেমন করে গাইল, অথবা পিয়ানো বা বেহালায় গানটি কেমন করে বাজাল এবং তার পরিবেশনার দোষগুণই বা কোথায়? প্রত্যেকটি বড় শহরে যদি একাধিক নাও হয়, তবে অন্তত একটি নতুন ছবির প্রদর্শনী হয়ে থাকে-যার দোষগুণ সমালোচক এবং বিশেষজ্ঞরা অত্যন্ত পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার করে থাকেন।
নতুন উপন্যাস ও কবিতা পুস্তকাকারে কিংবা সাময়িকপত্রে প্রায় প্রত্যহই আত্মপ্রকাশ করছে। এই সব শিল্পকর্মের বিস্তৃত বিবরণ পাঠকদের সমানে তুলে ধরা সংবাদপত্রগুলি তাদের কর্তব্য বলেই মনে করে।
রাশিয়ায় শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতার উদ্দেশ্যে (যেখানে জনসাধারণের প্রত্যেককে শিক্ষার সুযোগে দেবার জন্য প্রয়োজনের তুলনায় মাত্র শতাংশ ব্যয়িত হয়) সরকার সংস্কৃতি পরিষদ্, সংগীত শিক্ষায়তন, এবং থিয়েটারগুলিকে কোটি কোটি রুবল অনুদান দিয়ে থাকেন। ফরাসি দেশে শিল্পের জন্য দুই কোটি ফ্রাঁ নির্দিষ্ট আছে। অনুরূপ পরিমাণ সরকারি অনুদান জার্মানিতে এবং অন্যত্রও দেওয়া হয়ে থাকে।
প্রত্যেক বড় শহরে যাদুঘর, সাহিত্য পরিষদ্, সংগীত বিদ্যালয়, নাট্য বিদ্যালয় এবং অভিনয় ও কনসার্টের জন্য অতি বৃহৎ হর্ম্যরাজি নির্মিত হয়ে থাকে। শিল্পের দাবি মেটাবার জন্য লক্ষ লক্ষ শ্রমিক-রাজমিস্ত্রী, চিত্রী, কাঠমিস্ত্রী, কাগজ সজ্জাকর, দর্জি, কেশবিন্যাস শিল্পী, জহুরি, ঢালাইকর, মুদ্রণ সহায়ক-কঠোর পরিশ্রমে তাদের সমগ্র জীবন ব্যয় করে। কাজেই একমাত্র সামরিক বিভাগ ছাড়া মানবিক কর্মের আর কোন বিভাগেই এত শক্তি ব্যয়িত হয় না।
এই কাজে শুধু যে বিপুল পরিমাণ শ্রমই ব্যয়িত হয় তাই নয়, যুদ্ধের মতো এতেও বহু মনুষ্যজীবন বিসর্জিত হয়ে থাকে। শিশুকাল থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ দ্রুত পদসঞ্চারী শিক্ষায় (নৃত্যশিল্পী), অতি দ্রুত সংগীতের সুর এবং বাদ্যযন্ত্রের স্পর্শের কৌশল আয়ত্ত করবার জন্য, অথবা বর্ণানুলেপনে চিত্র রচনা এবং দৃষ্ট বস্তুর রূপ দানের কাজে (চিত্রশিল্পী), অথবা প্রত্যেকটি বাক্যাংশের ওলট-পালট ঘটানো এবং প্রত্যেক শব্দের মিল আবিষ্কারে সমস্ত জীবন নিয়োজিত করে। এই সব লোক অনেক ক্ষেত্রে হৃদয়বান ও কুশলী এবং সর্বপ্রকার প্রয়োজনীয় কাজে দক্ষ হলেও বিশেষ একজাতীয় ও বুদ্ধি- বৈনাশিক কাজের চর্চায় বর্বর সদৃশ হয়ে ওঠে এবং একপেশে আত্মসন্তুষ্ট স্পেশালিস্টে পরিণত হয়। জীবনের সকল গভীর দিকগুলির প্রতি এদের কোন ঔৎসুক্য থাকে না, একমাত্র পা ঘোরাবার কায়দা অর্জনে এবং জিহ্বা ও আঙুল চালাবার কৌশল আয়ত্ত করাতেই তারা দক্ষতা অর্জন করে।
কিন্তু এভাবে মানব জীবনকে খর্ব করাও শোচনীয়তম ব্যাপার নয়। ইউরোপ এবং আমেরিকার রঙ্গমঞ্চে যে সমস্ত নতুন নাট্যাভিনয় হয়, সেরূপ একটি নতুন নাট্যাভিনয়ের মহড়ায় আমি একবার উপস্থিত ছিলাম মনে পড়ে।
আমি সে প্রেক্ষাগৃহে উপস্থিত হবার আগেই প্রথম অঙ্কের অভিনয় শুরু হয়ে গিয়েছিল। প্রেক্ষাগৃহে পৌঁছাবার জন্য আমাকে রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ পথের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল। অনেক অন্ধকার পথ ও দরজা অতিক্রম করে মঞ্চের দৃশ্যসজ্জা এবং আলোকসজ্জা পরিবর্তনের কাজে ব্যবহৃত বিরাট বিরাট যন্ত্রের পাশ কাটিয়ে আমাকে নিয়ে যাওয়া হল একটি প্রকান্ড ভবনের ভূগর্ভস্থ কক্ষের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল। অনেক অন্ধকার পথ ও দরজা অতিক্রম করে মঞ্চের দৃশ্যসজ্জা এবং আলোকসজ্জা পরিবর্তনের কাজে ব্যবহৃত বিরাট বিরাট যন্ত্রের পাশ কাটিয়ে আমাকে নিয়ে যাওয়া হল একটি প্রকান্ড ভবনের ভূগর্ভস্থ কক্ষের মধ্য দিয়ে। সেখানে অন্ধকার এবং ধূলার মধ্যে আমি শ্রমিকদের প্রচন্ড কর্মব্যস্ত দেখলাম। এদের মধ্যে এক ব্যক্তি বিবর্ণ, চোখ মুখ বসা, ময়লা জামা গায়ে, কর্মক্লান্ত ময়লা হাত ও আড়ষ্ট আঙুল, দেখলেই মনে হয় সে অত্যন্ত ক্লান্ত এবং বিরক্ত -সে আমার পাশ দিয়ে ক্রুদ্ধভাবে আর একজনকে বক্তে বক্তে চলে গেল। অন্ধকার একটি সিঁড়ি বেয়ে আমি মঞ্চের দৃশ্যসজ্জার কাঠের পাটাতনের ওপর এসে পৌঁছালাম। হরেক রকমের খুঁটি, চক্র এবং ইতস্তত বিক্ষিপ্ত দৃশ্যসজ্জার অংশ- বিশেষ এবং অলঙ্করণ ও পর্দার মধ্যে শ’য়ে শ’য়ে না হলেও কয়েক ডজন রঙ-মাকা আঁটো পোশাকে সজ্জিত ব্যক্তিকে দাঁড়ানো এবং ইতস্তত সঞ্চরমান অবস্থায় দেখতে পেলাম। এ ছাড়া এদের মধ্যে আমি কতকগুলি স্ত্রীলোকও দেখলাম -যারা প্রায় নগ্ন এরা সকলে গায়ক গায়িকা, ঐকতানের অংশ গ্রহণকারী, অথবা যৌথনৃত্যের নর্তকী। এরা প্রতীক্ষায় ছিল কখন এদের পালা আসবে আমার পথনির্দেশক আমাকে রঙ্গমঞ্চের ওপর নিয়ে গেল এবং একটি পাটাতনের সেতুর সাহায্যে অর্কেস্ট্রা বাদকদলের মধ্য দিয়ে আমাকে আমার নির্দিষ্ট আসনে নিয়ে গেল। সে দলের মধ্যে নাকাড়া থেকে বাঁশি এবং বীণাবাদক শ’খানেক সর্বজাতীয় যন্ত্রীর সমাবেশ দেখেছিলাম।
একটু উঁচুতে প্রতিফলক সহ দুটি বাতির মাঝখানে এবং সংগীতমঞ্চের সম্মুখে স্থাপিত একটি আরাম কেদারায় সংগীতদলের নির্দেশক বসে ছিলেন। তার হাতে একটি খুদে লাটি (বেটন)-যার সাহায্যে তিনি ঐকতান বাদকদল এবং গায়কদের নির্দেশ দিচ্ছিলেন। সাধারণভাবে বলা যায়, সমস্ত নাট্যভিনয়ের পরিচালক ছিলেন তিনি। তখন অভিনয় শুরু হয়ে গেছে। অভিনয় মঞ্চের ওপর একটি নববধূকে গৃহে আনা উপলক্ষে ভারতীয়দের একটি শোভাযাত্রা দেখা গেল। অভিনয়সজ্জা পরিহিত নরনারী চাড়াও সাধারণ পোশাক পরিহিত দুজন লোক ব্যস্তসমস্ত হয়ে রঙ্গমঞ্চের ওপর দ্রুত ছোটাছুটি করছিল। এদের মধ্যে একজন অভিনয়াংশের নির্দেশক। নরম জুতো পরে অপর যে ব্যক্তি অসাধারণ দ্রুত পায়ে এখান থেকে ওখানে দৌড়ে বেড়াচ্ছিলেন তিনি নৃত্যশিক্ষক। এদের মাসিক মাইনে দশজন শ্রমিকের সারা বৎসরের আয়ের চাইতে বেশি।
এ তিনজন নির্দেশক সংগীত, ঐকতান এবং শোভাযাত্রা পরিচালনা করছিলেন। শোভাযাত্রাটিতে সচরাচর যেমন হয় তেমনি অংশগ্রহণ করেছিল জোড়ায় জোড়ায় পুরুষ ও স্ত্রীলোক। তাদের কাঁধে ছিল রাংতায় মোড়া যুদ্ধকুঠার। তারা সকলেই এক জায়গা থেকে এসে বারে বারে ঘুরে ঘুরে পরিক্রমা করছিল এবং তারপর থামছিল। সে- শোভাযাত্রার ব্যবস্থা করতে দীর্ঘ সময় লেগেছিল। প্রথমে যুদ্ধকুঠার নিয়ে ভারতীয়েরা খুবই দেরি করে এল। তারপর নির্দিষ্ট সময়ের আগেই এসে পড়ল। তারপর যথাসময় এলেও নির্গমন পথের মুখে ভিড় করে থাকল। পরের বার ভিড় না করলেও মঞ্চের দুই পাশে তারা অত্যন্ত বিশ্রীভাবে দাঁড়িয়ে রইল। এতে প্রত্যেকবারই সমস্ত অভিনয়টি বন্ধ রেখে আবার নতুন করে শুরু করা হচ্ছিল। শোবাযাত্রার পূর্বে একটি আবৃত্তি হল। আবৃত্তি করল এক ব্যক্তি যার পোশাক পরিচ্ছদ ছিল এক ধরনের তুর্কীর মতো। ওই ব্যক্তি অদ্ভুতভাবে মুখ খুলে গান ধরল- ‘কনেকে আমি বাড়ি আনি।’ আাখার তলা থেকে তার অনাবৃত বাহু নড়ছিল। এরপর শোভাযাত্রা শুরু হল। কিন্তু এখানে আবৃত্তির সহযোগী ফরাসি শিঙাবাদক একটি ভুল করে ফেলায় পরিচালক মহোদয় সাংঘাতিক বিপর্যয় ঘটেছে এমনভাবে কাঁপতে কাঁপতে তার লাঠি দিয়ে মঞ্চের ওপর খটখট্ করে আঘাত করল। তৎক্ষণাৎ সব কিছু বন্ধ হয়ে গেল। নির্দেশক ঐকতানের দলের দিকে তাকিয়ে ফরাসি শিঙাবাদকের প্রতি গর্জে উঠলেন। এবং গাড়োয়ানী ভাষায় অত্যন্ত কর্কশভাবে তাকে ভর্ৎসনা করতে লাগলেন, যেহেতু সে ভুল পর্দায় বাজিয়েছিল। সমস্ত ব্যাপার আবার নতুন করে শুরু হল। যুদ্ধের কুঠার নিয়ে ভারতীয়েরা আবার এল। তাদের পায়ে অদ্ভুত রকমের জুতো। তাই পরে তারা আস্তে আস্তে হাঁটছিল। গায়ক আবার গাইল-’কনেকে আমি বাড়ি আনি-ই-ই…’। পুনরায় আাখার তল থেকে অনাবৃত বাহুর একই ভঙ্গি, আবার কাঁধে যুদ্ধকুঠার রেখে যুগলের মৃদু পরিক্রমা। তাদের কারও মুখ বিষণ্ণ এবং গম্ভীর, কেউ কথা বলছিল এবং মৃদু মৃদু হাসছিল। তারপর চক্রাকারে বিন্যস্ত হয়ে তারা গান শুরু করল। মনে হচ্ছিল সবই ঠিক ঠিক চলছে। কিন্তু আবার লাঠির খটখট্ এবং সমবেত গায়ক গায়িকাদের প্রতি পরিচালকের আহত ক্রুদ্ধ কণ্ঠের ভর্ৎসনা। মনে হল, গাইবার সময় মাঝে মাঝে তারা উৎসাহের চিহ্নব্যঞ্জক হাত তুলতে ভুলে গিয়েছিল। ‘তোমরা কী মরে গেছ, না আর কিছু? কেমন বলদ হে তোমরা? তোমরা কী মরা মানুষ যে নড়তে চড়তেও পার না?’ আবার তারা শুরু করে- ‘কনেকে আমি বাড়ি আনি-ই-ই…”। আবার সংগীত দলের মেয়েরা প্রথমে একজন, তারপর আর একজন বিষণ্ন মুখে হাত তুলে গান ধরে। দুজন সংগীত দলের মেয়ে পরস্পর কথা বললে আবার খুদে লাঠির আরও প্রচন্ড আওয়াজ শোনা যায়। ‘তোমরা কী এখানে কথা বলতে এসেছ। তোমরা কী বাড়িতে গালগল্প করতে পার না। ওই যে লাল পায়জামা পরা মেয়ে, কাছে এসো তো, তাকাও আমার দিকে! আবার শুরু করো।’ আবার ‘কনেকে আমি বাড়ি আনি-ই-ই…।’ এবং এক ঘন্টা, দুই ঘন্টা, তিন ঘন্টা ধরে এর পুনরাবৃত্তি চলে। এ ধরনের মহড়ার পুরোপুরি সমাপ্ত হতে সময় লাগে ছয় ঘন্টা। লাঠি ঠোকা, পৌনঃ পুনিকতা, ঠিক ঠাক করে বসানো, গায়ক, অর্কেস্ট্রা, শোভাযাত্রা, এবং নৃত্যশিল্পীদের ভুল শুধরে দেওয়া-সবই সম্পন্ন হয় ক্রুদ্ধ ভর্ৎসনার সাহায্যে। এক ঘন্টার মধ্যে অন্তত চল্লিশবার যন্ত্রশিল্পী এবং গায়কদের উদ্দেশ্যে ‘গর্দভ,’ ‘নির্বোধ,’ ‘জড়বুদ্ধি,’ ‘শূয়োর’-এ ধরনের শব্দ ব্যবহার করতে আমি শুনেছি। ফুটবাদক, শিঙাবাদক, গায়ক প্রভৃতি যে সমস্ত হতভাগ্য ব্যক্তির উদ্দেশে এ সমস্ত গালাগালি বর্ষিত হয়, দৈহিক ও মানসিক দুর্বলতাগ্রস্ত বলে তারা উত্তর পর্যন্ত দেয় না। তাদের যেভাবে নির্দেশ দেওয়া হয় সেভাবেই তারা চলে। কনেকে আমি বাড়ি আনি- ই-ই…’-এই একটি মাত্র বাক্যকে অন্তত কুড়িবার পুনরাবৃত্তি করা হয় এবং হলদে জুতো পরে এবং যুদ্ধকুঠার কাঁধে নিয়ে অন্তত কুড়িবার এদিক ওদিক পদচারণা চলে। নির্দেশক এটা জানে, এই মানুষগুলি এতই আত্মবিশ্বাসহীন যে তারা শিঙা বাজানো এবং হলদে জুতো রে কুঠার নিয়ে পদচারণা ছাড়া এখন আর কিছু করার যোগ্য নয়। এ ছাড়া তারা এত চমৎকার আয়েশি জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গেছে যে ওই আরামটুকু বজায় রাখবার জন্য তারা সব কিছু সহ্য করবে। নির্দেশক তাই অনায়সে এই ইতরামো প্রকাশ করে। বিশেষ করে সে যখন প্যারিস ও ভিয়েনাতেও এই রকম ইতরতাই দেখে এসেছে এবং জানে যে শ্রেষ্ঠ নির্দেশকেরা এই রকম ব্যবহারই করে থাকে। বড় বড় সংগীত শিল্পীদের এটাই ঐতিহ্য-অসামান্য শিল্পকর্মের প্রভাবে তাঁরা এতই আত্মবিস্মৃত হন যে অপর শিল্পীদের অনুভূতি নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় তাঁদের নেই।
এর চাইতে নিন্দনীয় দৃশ্য খুঁজে বার করা খুবই কষ্টসাধ্য। মাল খালাসের সময় একটি মজুরের মাথায় অতিরিক্ত বোঝা চাপানো হলে অপর মজুর তার সহায়তায় এগিয়ে না আসায় সে তাকে গালাগালি দিচ্ছে এ আমি দেকেছি, যেমন দেখেছি গাঁয়ের মোড়ল চাষিকে গাল দিচ্ছে ঠিকমতো খড়কে গাদা করতে না পারার জন্য এবং সে-চাষিকে নিঃশব্দে নতি স্বীকার করতেও আমি দেখেছি। এ রকম দৃশ্য যতই অপ্রীতিকর হোক না কেন, হাতের কাজটি খুবই প্রয়োজনীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় সে-অপ্রীতি অনেকটা হ্রাস পেয়েছিল এবং যে দোষের জন্য মোড়ল চাষিকে বকছিল সেটিও একটি জরুরি কাজ যা নষ্ট হতে পারত।
কিন্তু রঙ্গমঞ্চে কী-ই বা হচ্ছিল? কিসের জন্য এবং কার জন্য? ভূগর্ভস্থ কক্ষ অতিক্রম করার সময় আমি যে ক্লান্ত মজুরটিকে দেখেছিলাম সম্ভবত নির্দেশকও তেমনি পরিশ্রান্ত ছিলেন। বস্তুতপক্ষে তিনি যে অবসন্ন হয়ে পড়েছিলেন তা দেখাই যাচ্ছিল। কিন্তু কে তাকে অবসন্ন করেছিল এবং কি কারণে তিনি নিজেকে অবসন্ন করছিলেন? যে নাট্যাভিনয়ের তিনি মহড়া দিচ্ছিলেন সেটি যারা অপেরা দেখে থাকেন তাদের নিকট অতি-পরিচিত অপেরার অন্যতম-যদিও এটির মধ্যে বিপুল পরিমাণ আজগুবি ও উদ্ভটের সমাবেশ ছিল। একজন ভারতীয় রাজা বিবাহেচ্ছু। তার জন্যে একটি কনে আনা হল। রাজা একটি চারণের ছদ্মবেশে ধারণ করলেন। কনেটি সে চারণের সঙ্গে প্রেমে পড়ে নিজেকে বিপন্ন বোধ করল। কিন্তু পরিশেষে আবিষ্কার করল যে সে-চারণই স্বয়ং রাজা। এই শুভ পরিণতিতে সকলেরই মহা আনন্দ হল।
এ ধরনের ভারতীয়ের অস্তিত্ব কখনও ছিল না বা হতে পারে না। তাদের সঙ্গে ভারতীয়দের শুধু যে মিল ছিল না তা নয়, বরং নিঃসন্দেহে বলা চলে তাদের কার্যাবলীর মিল একমাত্র অপেরার জগৎ ছাড়া আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যেত না। কোন মানুষই এরূপ আবৃত্তির সুরে কথাবার্তা বলে না, চারজনের যৌথ সংগীতের সময় তারা ওই রকম নির্দিষ্ট দূরত্বে নিজেদের স্থাপিত করে না এবং অনুভূতি প্রকাশের জন্য বাহুযুগলও ঐভাবে আন্দোলিত করে না। একমাত্র থিয়েটার ছাড়া অপর কোথাও মানুষ এভাবে রাংতার কুঠার নিয়ে চপ্পল পায়ে যুগলে ঘুরে বেড়ায় না। কেউ এভাবে ক্রুদ্ধ হয় না, এইভাবে অভিভূত হয় না। হাসে না অথবা কাঁদে না। পৃথিবীর কেউ এ ধরনের আচরণের দ্বারা যে বিন্দুমাত্রও বিচলিত হতে পারে না, তা সন্দেহাতীত।
স্বভাবতই এই প্রশ্ন উপস্থিত হয় : কার জন্য এ সব করা হচ্ছে? এ কার মনোরঞ্জন করবে? যদি গীতিনাট্যে মাঝে মাঝে মিষ্টি সুরের গান থাকে যা শ্রুতিসুখকর, সেগুলি এ সব নির্বোধের মতো পোশাক পরিচ্ছদ, শোভাযাত্রা, আবৃত্তি এবং বাহুর আন্দোলন ছাড়াই স্বাভাবিকভাবে গীত হতে পারত।
যৌথনৃত্যে অর্ধনগ্ন স্ত্রীলোকেরা ইন্দ্রিয় উদ্দীপক অঙ্গভঙ্গি করে, বিভিন্ন উপায়ে দেহকে কুন্ডলী পাকায় -যা কামনার উদ্রেক করে। এক কথায় এটি একটি ইতর শ্রেণীর অভিনয়।
কার জন্য এ সব-ভেবে মানুষ হতবুদ্ধি হয়। সংস্কৃতিবান মানুষকে এ বিষয়গুলি আন্ত রিক পীড়া দেয়, অপরপক্ষে প্রকৃত শ্রমিকের নিকট এগুলি একেবারেই অবোধ্য। যদি কোন ব্যক্তি এ সমস্ত দেখে খুশি হয় (যা সন্দেহজনক) সে কেবলমাত্র কোন তরুণ গৃহভৃত্য অথবা বিকৃতরুচি কারিগর-যারা উঁচুতলার মানুষের মনোভাব-সংক্রমিত কিন্তু যাদের আমোদপ্রমোদ এখনও বিতৃষ্ণা আসেনি। তাদের একমাত্র অভিপ্রায় তারা কত উঁচু দরের লোক তা দেখানো
এ সব কদর্য নিবুদ্ধিতার আয়োজন করা হয় সহজভাবে নয়, সহৃদয় কোন আমোদপ্রমোদের মাধ্যমেও নয়,-বরং ক্রোধ এবং পাশবিক নির্মমতার সহযোগে। এটা বলা হয়, এ সমস্তেরই অনুষ্ঠান শিল্পের খাতিরে এবং শিল্প একটি ভয়ানক গুরুত্বপূর্ণ বস্তু। কিন্তু এটা কি সত্য যে শিল্প এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বস্তু যার জন্য এ ধরনের ত্যাগ স্বীকার করা উচিত? এ জিজ্ঞাসা বিশেষ জরুরি, যেহেতু যে শিল্পের জন্য লক্ষ লক্ষ রোকের শ্রম, মানুষের জীবন, সর্বোপরি মানুষের পারস্পরিক ভালোবাসা সবই বিসর্জিত হয়-সে শিল্পই ক্রমশ অস্পষ্টতর এবং মানুষের বুদ্ধির কাছে বিভ্রান্তিকর হয়ে উঠেছে।
যে সমালোচনার ভেতর শিল্পরসিকেরা তাদের মতামতের সমর্থন পেতেন সে সমালোচনাও সাম্প্রতিক কালে এত স্ববিরোধী হয়ে উঠেছে যে বিভিন্ন গোষ্ঠীর সমালোচকেরা শিল্প নামের অযোগ্য বলে যেগুলিকে চিহ্নিত করেন, সেগুলিকে শিল্পরাজ্য থেকে বাদ দেওয়া হলে শিল্প বলে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না।
বিভিন্ন গোষ্ঠীর ধর্মতাত্ত্বিকদের মতো বিভিন্ন শ্রেণীর শিল্পীরাও পরস্পরকে শিল্পী বলে অস্বীকার এবং নস্যাৎ করেন। আমাদের যুগের বিভিন্ন গোষ্ঠীর শিল্পীদের বক্তব্য শুনলে দেখা যাবে, সকল শাখার প্রতিটি শিল্পীগোষ্ঠী অপর গোষ্ঠীর শিল্পীকে অস্বীকার করেছেন। কাব্যের ক্ষেত্রে প্রাচীনপন্থী রোমান্টিকেরা ‘পার্নার্সিয়ান’ এবং ‘ডেকাডেন্ট্স’- দের (Parnassians and the decadents) অস্বীকার করেন; ‘পানার্সিয়ান’রা রোমান্টিক এবং ডেকাডেন্টদের অস্বীকার করেন; তেমনি আবার ‘ডেকাডেন্ট’-রা তাদের সমস্ত পূর্বসূরী এবং ‘সিম্বলিস্ট’-দের অস্বীকার করেন, ‘সিম্বলিস্ট’রা তাদের সমস্ত পূর্বসূরী এবং Les mages (লে মাজ)-দের অস্বীকার করেন এবং Les Mages (লে মাজ)-রা আবার তাদের সমস্ত পূর্ববর্তীদের অস্বীকার করেন। ঔপন্যাসিকদের ক্ষেত্রেও প্রকৃতিবাদীরা, মনস্তত্ত্ববাদীরা এবং স্বভাববাদীরা সকলেই একে অপরকে খারিজ করে দেন। একই ব্যাপার দেখা যায় নাট্যশিল্পে, চিত্রশিল্পে এবং সংগীতশিল্পে। সুতরাং যে শিল্প মানুষ থেকে এত বেলি পরিমাণ শ্রম দাবি করে মানবজীবনকে খর্ব করে এবং মানবিক প্রেমের বিরুদ্ধে অপরাধ করে, সে শিল্পের কোন স্পষ্ট এবং দৃঢ়বদ্ধ সংজ্ঞাই যে শুধু নির্দিষ্ট হয়নি তা নয়, বরং শিল্পসেবীদের মধ্যেই সে শিল্পের অর্থ এতই স্ববিরোধী যে, শিল্প বলতে তারা কি বোঝাতে চায় তা বলা কঠিন-বিশেষ করে সৎ এবং প্রয়োজনীয় শিল্প কী সে বিষয়ে ধারণা আরও শক্ত। এ হেন পরিস্থিতিতে শিল্পের জন্য যে এত মূল্য দেওয়া হচ্ছে তা কোন্ যুক্তিতে ক্ষমার্হ, তা বিচার করে দেখতে হবে।