১১
[মেকি শিল্পসৃষ্টির উপাদান : ধার করা, অনুকৃতি; চমকসৃষ্টি এবং কৌতূহল সৃষ্টি। প্রকৃত শিল্পসৃষ্টির জন্য যে সমস্ত গুণ অপরিহার্য এবং মেকি শিল্পসৃষ্টির জন্য যা যথেষ্ট বলে বিবেচিত।]
বিষয়বস্তুর দিক থেকে উত্তরোত্তর মূল্যহীন এবং রূপগত বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে ক্রমাগত অধিক পরিমাণ দুর্বোধ্য হয়ে ওঠায় অভিজাত শ্রেণীর সাম্প্রতিকতম শিল্পকর্ম শুধুমাত্র শিল্পের সমস্ত বৈশিষ্ট্যবঞ্চিত হয়নি, উপরন্তু তাদের শিল্পকর্মে অনুকৃতিই শিল্পের স্থানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সর্বজনীন শিল্প থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ায় অভিজাত শ্রেণীর শিল্পকর্ম শুধু যে বিষয়বস্তুর দিক থেকে দীন এবং আঙ্গিকের দিক থেকে অপকৃষ্ট হয়েছে, অর্থাৎ উত্তরোত্তর দুর্বোধ্য থেকে দুর্বোধ্যতর হয়ে উঠেছে তা নয়, কালক্রমে তা এমন মূর্তি লাভ করেছে যা আদৌ শিল্প নামের যোগ্য নয় এবং তার স্থান গ্রহণ করেছে মেকি শিল্পসমূহ।
এ পরিণতি ঘটেছে নিন্মোক্ত কারণগুলি থেকে : জনগণের মধ্যে কেন ব্যক্তি বলিষ্ঠ আবেগ অনুভব করবার পর অপর চিত্তে সঞ্চারের জন্য যখন কোন প্রয়োজনীয় অনুভব করেন, একমাত্র তখনই হয় সর্বজনীন শিল্পের জন্ম। অপর পক্ষে ধনিক শ্রেণীর শিল্পের উৎস শিল্পীর অন্তর্নিহিত আবেগ-উৎসারিত নয়, বরং অভিজাত শ্রেণীর লোকেরা উচ্চ মূল্য দাবি করেন এবং সেজন্য উচ্চ মূল্য দেন বলেই সে শিল্পের উদ্ভব হয়। শিল্প থেকে তারা তাদের তৃপ্তি বিধায়ক অনুভূতির সঞ্চার দাবি করেন, এবং শিল্পীও তাদের এ দাবি মেটাবার জন্য প্রয়াসী হন। কিন্তু এ কাজ অত্যন্ত দুরূহ। যেহেতু আলস্যবিলাসে অভ্যস্ত ধনিক সমাজ শিল্পের মাধ্যমে সর্বদাই চিত্তবিনোদন অন্বেষণ করেন। অথচ নিম্নতম মানের শিল্পেই ইচ্ছামাত্রই সৃষ্টি করা যায় না, শিল্পীর অন্তর্নিহিত সত্তায় স্বতঃস্ফূর্তভাবেই তাকে অস্তিত্বশালী করে তুলতে হয়। সুতরাং অভিজাত বর্গীয় ব্যক্তিদের দাবি পূরণের জন্য শিল্পীদের বাধ্য হয়ে শিল্পের অনুকরণ-সৃষ্টির উপায়গুলি উদ্ভাবন করতে হয়েছে। সে উদ্ভাসিত উপায়গুলি হল : (১) ধার করা, (২) অনুকৃতি, (৩) চমক সৃষ্টি (প্রভাব সৃষ্টিকারী) এবং (৪) কৌতূহল উদ্দীপন।
প্রথম উপায়, বিষয়বস্তুর সমস্তটা ধার করা, অথবা কেবলমাত্র প্রত্যেক ব্যক্তি দ্বারা কাব্যিক বলে স্বীকৃত পূর্বতন রচনার শুধুমাত্র পৃথক বৈশিষ্ট্যগুলি ধার করা এবং সেগুলিকে পুনর্গঠন কার্যে প্রবৃত্ত হয়ে টুকিটাকি সংযোজন করা-যাতে সেগুলি অভিনব বস্তুর আকৃতি লাভ করে।
এ পর্যায়ের সৃষ্টি এক শ্রেণীর লোকের মনে পূর্বের অভিজ্ঞতালব্ধ এক ধরনের শৈল্পিক অনুভূতির স্মৃতি জাগিয়ে তুলে শিল্পের সাদৃশ্যযুক্ত এক জাতীয় সংস্কারের জন্ম দেয়, এবং যদি সেগুলি আরও কয়েকটি প্রয়োজনীয় শর্ত মেনে চলে তবে আনন্দপিপাসুদের নিকট তা শিল্প বলে পরিগণিত হয়। পূর্ববর্তী শিল্পকর্ম থেকে ধারকরা বিষয়বস্তুকে সাধারণত বলা হয় কাব্যিক বিষয়বস্তু। যে সমস্ত বিষয়বস্তু এবং মনুষ্যবর্গকে ধার করা হয়, সেগুলিকে বলা হয় কাব্যিক বিষয়বস্তু সমূহ এবং কাব্যেচিত মনুষ্যবর্গ। সুতরাং আমাদের গোষ্ঠীর মধ্যে প্রচলিত সব ধরনের কাহিনী, গাথা এবং প্রাচীন ঐতিহ্যসমূহ কাব্যিক বিষয়বস্তু বলে বিবেচিত হয়। কাব্যিক চরিত্র এবং বিষয়বস্তুর মধ্যে আমরা এই সবকে গণ্য করে থাকি : কুমারী নারী, সৈনিক, রাখাল, তপস্বী, দেবদূত, সব প্রকৃতির শয়তান, চন্দ্রালোক, বজ্র, পর্বত, সমুদ্র, উচ্চ গিরিচূড়া, ফুল, দীর্ঘ কেশ, সিংহ, মেষ, কপোত, এবং নাইটিংগল পাখি। সাধারণভাবে ওই বস্তুগুলি কাব্যিক বলে বিবেচিত যা পূর্বের শিল্পীদের সৃষ্টিকর্মগুলিতে পুনঃ পুনঃ ব্যবহৃত হয়েছে।
প্রায় একচল্লিশ বৎসর আগে একজন স্থূলবুদ্ধি অথচ খুব উচ্চ সংস্কৃতিবান মহিলা (পরে লোকান্তরিতা) তাঁর লিখিত একখানি উপন্যাস শুনতে আমাকে অনুরোধ করেছিলেন। উপন্যাসটি শুরু হয়েছে একজন নায়িকাকে নিয়ে যার পরিধানে ছিল একটি কাব্যিক শুভ্র পোশাক, তার এলায়িত চুল কাব্যিক, সে একটি কাব্যিক অরণ্যে জলের ধারে বসে কবিতা পড়ছিল। দৃশ্যটি ছিল রাশিয়ায়, কিন্তু পিছনের ঝোপ থেকে হঠাৎ নায়কের আবির্ভাব হল। তার মাথায় একটি পালকযুক্ত টুপি (উইলিয়ম টেলের টুপির মতো- বইটিতে বিশেষ করে এটার উল্লেখ আছে), তার সঙ্গে ছিল দুটি কাব্যিক সাদা কুকুর। লেখিকা এ সমস্তকে খুবই উচ্চস্তরের কাব্য লক্ষণাক্রান্ত মনে করেছিলেন, এবং যদি নায়কের পক্ষে কিছু বলবার প্রয়োজন না হত তবে এটি হয়তো উৎকৃষ্ট শিল্প বলে পরীক্ষায় চমৎকার উরে যেত। কিন্তু যখনই উইলিয়ম টেল সদৃশ্য টুপীপরা ভদ্রলোক শুভ্র পরিচ্ছদ পরা কুমারী মেয়েটির সঙ্গে কথাবার্তা শুরু করলেন, এটা স্পষ্ট হয়ে উঠল যে লেখিকার বক্তব্য কিছুই নেই, তিনি কেবলমাত্র অপর রচনার কাব্যিক স্মৃতির দ্বারা অভিভূত হয়েছেন এবং কল্পনা করেছেন যে ওই সমস্ত স্মৃতির ওপর কিছু কিছু পরিবর্তন ঘটিয়ে শৈল্পিক প্রভাব সৃষ্টিতে সক্ষম হবেন। কিন্তু শৈল্পিক প্রবাব অর্থাৎ সংক্রমণ একমাত্র তখনই ঘটে যখন লেখক তাঁর সত্তায় পূর্ব সঞ্চারিত অপরের অনুভূতিকে নিজের বলে না চালিয়ে স্ব-জীবনের অভিজ্ঞতালব্ধ অনুভূতিকে নিজস্ব পদ্ধতিতে অভিব্যক্তি দেন। কোন কবিতা অবলম্বনে লিখিত এ ধলনের কাব্য কারো চিত্তকে সংক্রমিত করতে পারে না, তা কেবলমাত্র মেকি শিল্প হতে পারে এবং তাও একমাত্র বিকৃতরুচির মানুষের কাছেই গ্রাহ্য হতে পারে। আলোচ্য মহিলাটি খুব স্থূলবুদ্ধির এবং প্রতিভাহীন হওয়ায় এই সত্যটি তৎক্ষণাৎ প্রতিভাত হল। কিন্তু পান্ডিত্যের অধিকারী এবং প্রতিভাসম্পন্ন ব্যক্তিরা যখন এভাবে ধঅর করার আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং তাঁদের শিল্পকৌশলকে অনুশীলনের সাহায্যে আয়ত্ত করেন, তখন সে ধার-করা বিষয়গুলিকে আমরা পাই গ্রীক থেকে, পুরাতত্ত্ব থেকে, খ্রীষ্টীয় এবং পৌরাণিক জগৎ থেকে। তাদের সংখ্যা এত অধিক, বিশেষত শিল্পের নির্দিষ্ট কলাকৌশলের সাহায্যে সুঠাম রূপ দিতে পারলেই তা জনসাধারণ কর্তৃক শিল্পকর্ম বলে স্বীকৃত হচ্ছে।
কবিতার রাজ্যে এরূপ মেকি শিল্পের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ উদাহরণ হিসেবে রোস্টান্ডের (Rostand) Princesse Lointaine–কে নেওয়া যেতে পারে। এর ভেতর শিল্পের কোন দীপ্তিই নেই, অথচ এটি বহু ব্যক্তির নিকট অত্যন্ত কাব্যগুণান্বিত হয়েছে, এবং সম্ভবত লেখকের নিজের কাছেও তাই মনে হয় থাকবে।
শিল্পের সাদৃশ্য সঞ্চার করবার দ্বিতীয় পদ্ধতিকে আমি অভিহিত করেছি অনুকৃতি বলে। এ পদ্ধতির সারবস্তু হল বর্ণিত বা অঙ্কিত বস্তুর অনুষঙ্গী হিসেবে তার নানা খুঁটিনাটির জোগান দেওয়া। সাহিত্যশিল্পের ক্ষেত্রে এ পদ্ধতির মধ্যে থাকে চরিত্রগুলির বাহ্যিক অবয়ব, মুখমন্ডলী, পোশাক-আশাক, ভাবভঙ্গি, কণ্ঠস্বর, বাসগৃহাদির সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ণ বর্ণনা এবং সেই সঙ্গে থাকে বাস্তব জীবনের অন্যান্য আনুষঙ্গিকের বর্ণনা। উদাহরণ স্বরূপ, উপন্যাসে এবং ছোট গল্পে যখন কোন চরিত্র কথা বলে, তখন সে কোন্ সুরে কথা বলছে এবং সে সময়ে সে কি কাজে ব্যাপৃত তা পাঠককে জানানো হয়। এই কথাবার্তাকে যথাসাধ্য অর্থপূর্ণ করে উপস্থাপিত করা হয় না, বরং জীবনের ক্ষেত্রে যেমন ঘটে থাকে তেমনি অসংলগ্নভাবে, বাধাগ্রস্তভাবে এবং বিচ্ছিন্নভাবে পরিবেশন করা হয়। নাট্যশিল্পে এরূপ বাস্তব আলাপনের অনুকৃতি ছাড়াও এ পদ্ধতিতে আছে সমস্ত আনুষঙ্গিক এবং সমস্ত চরিত্র বাস্তব জীবনে ঠিক যেমনটি ঠিক তেমনভাবেই উপস্থিত করা। চিত্রশল্পে এ পদ্ধতি অনুসারে চিত্রাঙ্কনকে আলোকচিত্রের সামিল করা হয় এবং উভয় শিল্পের পার্থক্য ঘুচিয়ে ফেলা হয়। আশ্চর্যের কথা, সংগীতেও এ পদ্ধতি অনুসৃত হয়। শুধুমাত্র ছন্দস্পন্দের নয়, বরং বাস্তব জীবনের যে ঘটনাকে রূপ দিতে চাওয়া হয় তার অনুষঙ্গী যথাযথ ধ্বনিগুলির সাহাযেও এরূপ অনুকরণ প্রয়াস চলে।
তৃতীয় পদ্ধতিটি হল ক্রিয়া অবলম্বনে -যা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শারীরিক, বহিরিন্দ্রিয় আশ্রয়ী। এ পর্যায়ের সৃষ্টিকে ‘চমকপ্রদ’ এবং ‘কার্যকরী’ বলা হয়। সকল শিল্পে এ সমস্ত প্রভাবের অস্তিত্ব নিহিত মুখ্যত বৈপরীত্যের মধ্যে : অর্থাৎ ভয়ঙ্করের সঙ্গে কোমল, সুন্দর এবং কুৎসিত, উচ্চনদী এবং মৃদু, অন্ধকার এবং আলো এবং খুব সাধারণ এবং খুব অসাধারণকে একত্রীকরণের মধ্যে। শব্দগত শিল্পে বৈপরীত্বনির্ভর প্রভাব সৃষ্টি ছাড়াও এই রীতিতে এমন বিষয়ের অবতারণা করা হয়-যা তৎপূর্বে কখনও বর্ণিত হয়নি। এগুলি সাধারণত যৌন আকাঙ্ক্ষা-উদ্রেককারী খুঁটিনাটি অশ্লীল বর্ণনা, অথবা আতঙ্কের অনুভূতি উত্তেজক যন্ত্রণা বা মৃত্যুর বিস্তৃত বর্ণনা। দৃষ্টান্ত স্বরূপ, একটি হত্যাকান্ডের বর্ণনাকালে চিকিৎসা শাস্ত্রের অনুরূপ ছিন্ন বিচ্ছিন্ন পেশীসমূহের, স্ফীতির, এবং রক্তের পরিমাণ, ঘ্রাণ এবং বর্ণের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দেওয়া হয়। চিত্রশিল্পেও সেই একই ব্যাপার লক্ষিত হয়। অপরাপর বৈপরীত্যের ব্যবহার ছাড়াও একটি বিশেষ বৈপরীত্যের ব্যবহার সম্প্রতি চালু হয়েছে, তা হল, চিত্রমধ্যে একটি বস্তুকে সযত্ন সম্পূর্ণতা দান, অপরদিকে চিত্রের বাকি সব অংশকে উপেক্ষা করা। চিত্রশিল্পে যে মুখ্য এবং প্রচলিত প্রভাব সৃষ্টি করা হয়, তা হল আলোক-ব্যঞ্জনার প্রভাব এবং ভয়ঙ্করের উপস্থাপনা। নাটকে বৈপরীত্য সৃষ্টি ব্যতীত সর্বাপেক্ষা প্রচলিত উপাদানগুলি হল, সাধারণত, ঝড়ঝঞ্ঝা, বজ্রপাত, চন্দ্রালোক, সমুদ্রের অথবা সমুদ্রতীরের দৃশ্যাবলী, পোশাক পরিবর্তন, নারীদেহ প্রদর্শন, উন্মত্ততা, হত্যা এবং মৃত্যু। এ ছাড়া আছে মুমূর্ষ মানুষের যন্ত্রণার সকল পর্যায়ের অনুপুঙ্খ বিবরণ দান। সংগীতে খুব সচরাচর যে ভাবে সৃষ্টির প্রয়াস দেখা যায় তা হল ধ্বনির ক্রমবৃদ্ধি,-মৃদুতম এবং সহজতম ধ্বনি থেকে পূর্ণ অর্কেস্ট্রার (ঐকতানের ) উচ্চতম এবং জটিলতম সংঘাত সৃষ্টি; বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের ওপর সমস্ত সুর-অষ্টকের মধ্যে একই পর্যায়ের ধ্বনির পুনরাবৃত্তি। অথবা সেই সুর সমন্বয়, সুর ও ছন্দস্পন্দ যা স্বাভাবিক সংগীতচিন্তার ধারা থেকে আদৌ স্বত উৎসারিত নয়, বরং তাদের অপ্রত্যাশিত আবির্ভাব শ্রোতাকে চমকিত করে। এ সকল ব্যতীত সংগীত-জগতে, -বিশেষভাবে অর্কেস্ট্রায় (ঐকতান বাদনে) দৈহিক উপায়ে ধ্বনি সৃষ্টির সহায়তায় সর্বাধিক প্রচলিত প্রভাবসৃষ্টি করা হয়ে থাকে।
বিভিন্ন শিল্পের ক্ষেত্রে শিল্পসিদ্ধির সর্বাপেক্ষা প্রচলিত উপায়গুলি এরূপ। তথাপি সেগুলির মধ্যে একটি উল্লেখ করা হয়নি যা সবগুলি শিল্পের দ্বারা সাধারণভাবে অনুসৃত : তা হল, একটি শিল্পের দ্বারা যা সহজে প্রকাশ করা যায় অপর একটি শিল্পের দ্বারা তারই প্রকাশের চেষ্টা। দৃষ্টান্ত স্বরূপ, সংগীতকে বর্ণনার কাজে লাগানো (ক্ষাগনার এবং তার অনুবর্তীদের সংগীত তালিকায় যেমন করা হয়েছে), অথবা চিত্রশিল্প, নাটক, অথবা কবিতার দ্বারা বিশেষ একটি মনোভাব সৃষ্টির প্রয়াস (যা সমস্ত ক্ষয়িষ্ণু শিল্পের লক্ষ্য)। শিল্পকর্ম সম্পর্কে চতুর্থ পদ্ধতি হল, কৌতূহলোদ্দীপক কোন কিছুর সৃষ্টি (যা মনকে ব্যাপৃত রাখে) জটিল কোন প্লটের মধ্যে সে কৌতূহল নিতি থাকতে পারে। খুবই সাম্প্রতিক কাল পর্যন্ত ইংরেজি ও ফরাসি উপন্যাসে এই পদ্ধতি খুব বেশি অনুসৃত হয়েছে। কিন্তু এখন সে পদ্ধতি ফ্যাশন-বহির্ভূত হয়ে যাচ্ছে, এবং তার স্থান গ্রহণ করেছে বাস্তবতা, অর্থাৎ কোন ঐতিহাসিক যুগের অনুপুঙ্খ বর্ণনা, অথবা সমকালীন জীবনের কোন পুঙ্খনুপুঙ্খ বর্ণনা। এর উদাহরণ, কোন উপন্যাসে ইজিপ্সীয় বা রোমীয় জীবনধারার বর্ণনার সাহায্যে, কিংবা কয়লা খাদের কর্মীদের জীবন নিয়ে, অথবা কোন বৃহৎ বিপণির করণিকদের জীবন বর্ণনার সাহায্যে সে কৌতুহল সৃষ্টি হতে পারে। পাঠক সে জীবন বিষয়ে কৌতূহলী হয় এবং সে কৌতূহল সৃষ্টিকে শৈল্পিক অনুভব বলে ভুল করে। কেবলমাত্র অভিব্যক্তির প্রকাশব্যঞ্জনার ওপরও পাঠকের কৌতূহল নির্ভরশীল হতে পারে। বস্তুতপক্ষে এ ধরনের কৌতূহল-সৃষ্টি সাহিত্যজগতে বর্তমানে খুবই প্রচলিত। শুধুমাত্র কবিতা বা গদ্য নয়, এমনকি চিত্র, অভিনয়, সংগীত প্রভৃতির অভিব্যক্তিও এরূপভাবে দেওয়া হয়-যাতে সেগুলি অবশ্যই ধাঁধা বলে অনুমিত হয়। বস্তুতপক্ষে এই অনুমানের প্রক্রিয়াল দ্বারাই আবার আনন্দও অনুভূত হয়-সে আনন্দ আপাতদৃষ্টিতে শিল্পজাত অনুভূতিরই অনুরূপ।
কাব্যচেতনাময় অথবা বাস্তবতাপূর্ণ কিংবা চমকপ্রদ অথবা কৌতূহলোদ্দীপক বলে কোন শিল্পকর্মকে অনেক সময় অত্যন্ত উৎকৃষ্ট পর্যায়ের বলা হয়ে থাকে। এদের মধ্যে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় বা চতুর্থ অভিধার কোনটিই শুধু যে শিল্পোৎকর্ষের মান স্থাপন করে না, তাই নয়, এমনকি শিল্পের সঙ্গে এগুলির সাধারণ কোনও সারূপ্যও নেই।
কাব্যস্বভাবাপন্ন বলতে বোঝায় ধার-করা-বস্তু। সমস্ত ধার-করা বস্তুই পাঠক, দর্শক, শ্রোতার নিকট পূর্বতন কোন শিল্পকর্মের অস্পষ্ট শৈল্পিক পূর্বস্মৃতি স্মরণ করিয়ে দেয় এবং শিল্পী নিজস্ব উপলব্ধ অনুভূতি দ্বারা অপরকে সংক্রমিত করে না। গ্যেটের ফাউস্টের মতো ধার-করা তার ওপর প্রতিষ্ঠিত শিল্পকর্ম খুবই সুগঠিত হতে পারে। তার মধ্যে পূর্ণ মানসের অভিব্যক্তি এবং সকল পর্যায়ের সৌন্দর্যের বিকাশও সম্ভব। কিন্তু শিল্পী-উপলব্ধ সম্পূর্ণতা, অখন্ডতা, ভাব ও রূপের অবিচ্ছেদ্য যে মিলন শিল্পকর্মের মুখ্য বৈশিষ্ট্য বলে বিবেচিত, সে বৈশিষ্ট্যবর্জিত হওয়ায় তা কখনও যথার্থ শৈল্পিক রসসিদ্ধির সমুৎপাদক হতে পারে না। এ পদ্ধতি অবলম্বন করে শিল্পী কেবল তাঁর পূর্বতন কোন শিল্পকর্ম থেকে লব্ধ অনুভূতিই সঞ্চারণ করেন। সুতরাং সম্পূর্ণ বিষয়বস্তুর বা বিভিন্ন দৃশ্যের, পরিস্থিতির বা বর্ণনার প্রত্যেক ধার-করা বস্তুই শিল্পের প্রতিবিম্ব বা শিল্পের ভান হতে পারে, কিন্তু তা কখনই প্রকৃত শিল্প পদবাচ্য নয়। কাজে কাজেই কাজেই কাব্যস্বভাবাপন্ন বলে কোন সৃষ্টিকর্মকে উৎকৃষ্ট বলা অর্থাৎ তাকে সৎশিল্পের সদৃশ মনে করার অর্থ, প্রকৃত মুদ্রার সঙ্গে আপাত-সাদৃশ্য দেখে যে কোন একটি মুদ্রাকে অকৃত্রিম মনে করা।
অনুকৃতি ও বাস্তবতা অনেকের নিকট শিল্পোৎকর্ষের মানদন্ড বিবেচিত হলেও প্রকৃতপক্ষে তা এরূপ মান নির্ণায়ক হতেই পারে না। অনুকৃতি যে এরূপ মান নির্ণায়ক হতে পারে না তার কারণ, শিল্পের প্রধান বৈশিষ্ট্য শিল্পীর উপলব্ধি দ্বারা অপরকে সংক্রমিক করা। অনুভূতির দ্বারা সংক্রমণ তদনুষঙ্গী বর্ণনার সঙ্গে একাত্ম তো নয়ই, বরং প্রয়োজনাতিরিক্ত বর্ণনার দ্বারা সে সংক্রমণ-ক্রিয়া সাধারণত বাধাপ্রাপ্ত হয়। এ সমস্ত সূক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ নির্ভর বিস্তৃত বর্ণনার দ্বারা শিল্পরস গ্রহণেচ্ছুর মনোযোগ ভিন্নমুখী করে দেওয়া হয়। এমনকি অনুভূতির অস্তিত্ব থাকলেও সে খুঁটিনাটি বর্ণনা তার সঞ্চরণে বাধার সৃষ্টি করে।
বাস্তবতার পরিমাণ কিংবা উপস্থপিত বিষয়ের খুঁটিনাটি বর্ণনা কতটা যথার্থ তার সাহায্যে শিল্পকর্মের মূল্যায়ন খাদ্যের বহিরঙ্গ দেখে তার পুষ্টি সংক্রান্ত গুণের বিচার করার মতই অদ্ভুত। বাস্তবতার নিরিখে কোন শিল্পবস্তুর মূল্যায়ন করার দ্বারা এটাই দেখানো হয় যে, এর দ্বারা কোন শিল্পকর্মের কথা হচ্ছে না, হচ্ছে শুধু মেকি শিল্পকর্মের কথা।
শিল্প অনুকৃতির তৃতীয় পদ্ধতি -অর্থাৎ চমকপ্রদ অথবা কার্যকরী কোন বস্তুর ব্যবহারও প্রাগুক্ত দুটি পদ্ধতি থেকে প্রকৃত শিল্পের সঙ্গে খুব বেশি মিলযুক্ত নয়। এর কারণ, কার্যকারিতার দিক থেকে (অভিনবত্বের, অপ্রত্যাশিতের, বৈপরিত্যের, অথবা ভয়ঙ্করের প্রভাব) সেগুলি কোন অনুভূতি সঞ্চারিত করে না, স্নায়ুর ওপর ক্রিয়াশীল হয় মাত্র। শিল্পীকে যদি প্রশংসনীয়ভাবে কোন রক্তাক্ত ক্ষত চিত্রিত করতে হয়, সে ক্ষতের দৃশ্য মনকে আলোড়িত করলেও সেটি শিল্প বিবেচিত হবে না। শক্তিশালী অর্গানের সাহায্যে নিরবচ্ছিন্ন সুরের যোজনা উল্লেখ্য প্রভাব সৃষ্টি করে সন্দেহ নেই, এমনকি অনেক সময় তা অশ্রুপাতও ঘটাতে পারে, কিন্তু এর মধ্যে কোন সংগীত নেই, যেহেতু কোন অনুভূতি এখানে সঞ্চারিত হচ্ছে না। অথচ এ পর্যায়ের শারীরতাত্ত্বিক প্রভাব আমাদের গোষ্ঠীর মানুষের মনে সর্বক্ষণ শিল্পের ভ্রান্তি জন্মায়। এই ভ্রান্তি তবু সংগীতের ক্ষেত্রে নয়, কবিতা, চিত্র এবং নাটকের ক্ষেত্রেও হয়ে থাকে। এমন কথা বলা হয়ে থাকে যে, শিল্প সুসংস্কৃত হয়েছে। পরন্তু শিল্পকর্ম যে ধরনের ফলেৎপত্তির প্রয়াসী হয়েছে তার কল্যাণে শিল্প অত্যন্ত স্থূলত্ব প্রাপ্ত হয়েছে। নতুন কোন শিল্পকর্ম পরিবেশিত হলে ইউরোপের সর্বত্র তা স্বীকৃত হয়। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়-Hanneles Himmelfahrt নামক এ পর্যায়ের নাটকখানিতে লেখক একটি নিপীড়িত বালিখার জন্য দর্শকের অন্তরে করুণা সঞ্চারে অভিলাষী। শিল্পের সাহয্যে শ্রোতার অন্তরে এ অনুভূতি সঞ্চারের উদ্দেশ্যে লেখক তাঁর সৃষ্ট কোন একটি চরিত্রের সাহায্যে হয়ত এ করুণায় এমন অভিব্যক্তি দেবেন-যাতে তা প্রত্যেককে সংক্রমিত করে, অথবা মেয়েটির অনুভূতির এমন বর্ণনা দেবেন যা হবে খুবই যথার্থ। কিন্তু এ কর্ম সম্পাদনে তিনি অসমর্থ কিংবা অনিচ্ছুক এবং তিনি অপর একটি পন্থা নির্বাচন করেন যা মঞ্চ-ক্রিয়ার পক্ষে খুব জটিল হলেও লেখকের পক্ষে সহজতর। তিনি মঞ্চের ওপর মেয়েটির মৃত্যু ঘটান, এবং দর্শকদের স্নায়বিক চাপ বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে প্রেক্ষাগৃহের আলোগুলি নিভিয়ে দিয়ে তাদের অন্ধকারে বসিয়ে রাখেন, এবং মেয়েটির মদ্যপ পিতা তার পশ্চাদ্ধাবন করে কিভাবে তাকে প্রহার করেছিল, করুণ সুরের সাহায্যে তা প্রদর্শন করেন। মেয়েটি ভয়ে জড়োসড়ো হয়, আর্তনাদ করে, যন্ত্রণাকাতর শব্দ করে-এবং পড়ে যায়। দেবদূতেরা আবির্ভূত হয়ে তাকে বহন করে নিয়ে যায়। এ সমস্ত দৃশ্য অভিনীত হবার সময় দর্শকেরা কিয়ৎপরিমাণে উত্তেজনা অনুভব করে এবং সে উত্তেজনাকে প্রকৃত নান্ননিক অনুভূতি বলে বিশ্বাস করে। কিন্তু এরূপ উত্তেজনার মধ্যে নান্দনিক অনুভূতির অস্তিত্বই নেই, যেহেতু এ পরিস্থিতিতে একজন মানুষ অপরের অনুভূতির দ্বারা সংক্রমিত হচ্ছে না, বরং তার মনে একটা বিমিশ্র করুণার অনুভূতিই সৃষ্টি হয়। এ ছাড়া সে নিজে কোন যন্ত্রণা ভোগ করছে না, এ জন্য আত্মতুষ্টি সৃষ্টি হয়। এ ছাড়া সে নিজে কোন যন্ত্রণা ভোগ করছে না, এ জন্য আত্মতুষ্টি বোধ করে। প্রাণদন্ডের দৃশ্য দেখে আমরা যা অনুভব করি, অথবা রোমকরা সার্কাসে গিয়ে যা অনুভব করত, এটা তার অনুরূপ।
নান্দনিক অনুভূতির স্থলে এ জাতীয় প্রভাব সৃষ্টি সংগীত-শিল্পেই বিশেষভাবে দেখা যায়- যেহেতু সংগীত-শিল্প তার স্বভাব অনুসারেই আমাদের স্নায়ুর ওপরে তাৎক্ষণিক শারীরতাত্ত্বিক ক্রিয়া ঘটায়। নিজের উপলব্ধ অনুভূতিকে সুরের সাহায্যে সঞ্চারিত করার পরিবর্তে নতুন গোষ্ঠীর সংগীতকার ধ্বনিগুলিকে পুঞ্জীভূত ও জটিল করে তোলেন। সেগুলিকে কখনও উচ্চনাদী, কখনও বা দুর্বল করে তিনি শ্রোতাদের ওপর একপ্রকার শারীরিক প্রভাব সৃষ্টি করেন-যে প্রভাব (এ উদ্দেশ্যে আবিষ্কৃত) একটি যন্ত্রের সঙ্গে পরিমাপ করা যায়। জনসাধারণ এই শারীরিক অনুভূতিকে শিল্পের প্রভাব বলে ভুল করে।
কৌতূহলোদ্দীপক বলে অভিহিত চতুর্থ পদ্ধতিকেও অনেক সময় শিল্পের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা হয়। শুধুমাত্র কবিতা, উপন্যাস বা চিত্র সম্পর্কে নয়, এমনকি সাংগীতিক অবদান সম্পর্কেও এরূপ মন্তব্য শোনা যায় যে, তা কৌতূহলোদ্দীপক। এর অর্থ কী? কৌতূহলোদ্দীপক কোন শিল্পকৃতি বলতে আমরা এই বুঝি যে, হয় তা আমাদের কাছে নতুন কোন তথ্য পরিবেশন করে, অথবা সে শিল্পবস্তুটি সম্পূর্ণ বোধগম্য না হলেও প্রয়াসের সাহায্যে তার অর্থ ক্রমশ হৃদয়ঙ্গম হয়, এবং সে অর্থ অনুমান-প্রক্রিয়ার মধ্যে আমরা এক ধরনের আনন্দ লাভ করি। এর কোনটির ক্ষেত্রেই শৈল্পিক রস-সংবেদনার সঙ্গে কৌতূহলের কোন সাযুজ্য নেই। শিল্পীর উপলব্ধ অনুভূতির সাহায্যে অপরকে সংক্রমিক করাই শিল্পের লক্ষ্য। কিন্তু দর্শক, শ্রোতা বা পাঠকের পক্ষে সে শিল্পকর্মবিধৃত নতুন বিষয়বস্তু আয়ত্ত করার চেষ্টা, অথবা উপস্থাপিত হেঁয়ালির অর্থ অনুধাবনে যে মানসিক প্রয়াস প্রয়োজন হয়, তা তার মনকে বিক্ষিপ্ত করে বলে রস-সংক্রমণে বাধার সৃষ্টি হয়। সুতরাং কোন শিল্পকর্মের কৌতুহলোদ্দীপক দিকটা তার শৈল্পিক উৎকর্ষের পক্ষে একান্তই অবান্তর, এবং তা শৈল্পিক অনুভূতির সহায়ক না হয়ে বরং প্রতিবন্ধক হয়ে ওঠে।
কোন শিল্পকর্মে আমরা কাব্যধর্মী এবং বাস্তবধর্মী, চমকপ্রদ এবং কৌতূহলোদ্দীপক বস্তুর সাক্ষাৎ লাভ করতে পারি, কিন্তু এগুলি শিল্পের সারবস্তুর, অর্থাৎ শিল্পীর উপলব্ধ অনুভূতির স্থান গ্রহণ করতে পারে না। পরবর্তীকালে উচ্চবর্গীয়দের শিল্পে অধিকাংশ বস্তুকে যে শিল্পকর্মের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। তার সঙ্গে শিল্পের সাদৃশ্য মাত্রই দেখা যায়। কিন্তু তা শিল্পের অপরিহার্য বৈশিষ্ট্যবর্জিতদ-বস্তুতপক্ষে সে বিশেষত্বের অস্তিত্ব নিহিত শিল্পীর উপলব্ধ অনুভূতির মধ্যে। ধনীদের চিত্তবিনোদনের উদ্দেশ্যে শিল্পের কারিগরদের দ্বারা এ ধরনের বস্তু ক্রমাগতই বিপুল পরিমাণে উৎপাদিত হচ্ছে।
প্রকৃত শিল্পকর্ম সৃষ্টির জন্য শিল্পীকে অনেকগুলি শর্ত অবশ্যই পূরণ করতে হবে। স্ব- যুগের সর্বোচ্চ জীবন-ভাবনার ভূমিতে দাঁড়ানো তার পক্ষে প্রয়োজন তো বটেই, এতদ্ব্যতীত তাকে অনুভূতি অর্জনের এবং তা সঞ্চারিত করবার অভিলাষ এবং ক্ষমতার অধিকারীও হতে হবে। উপরন্তু শিল্পরূপগুলির কোন একটিতে তাকে প্রতিভাসম্পন্ন হতে হবে। কিন্তু এ জাতীয় প্রচলিত পদ্ধতি অনুসরণ করে অর্থাৎ ধার-করা, অনুকরণ করা, প্রভাব সৃষ্টি করা এবং কৌতূহল উদ্দীপনের সাহায্যে আমাদের সমাজে নিরবচ্ছিন্ন ধঅরায় যে মেকি শিল্পের উৎপাদন হয়ে চলেছে এবং যা আমাদের সমাজে শিল্প বলে স্বীকৃতি পাচ্ছে এবং যথেষ্ট অর্থমূল্যও পাচ্ছে-তার জন্য একমাত্র কোন একটি শিল্প শাখায় কিছু প্রতিভার অধিকারী হওয়া ব্যতীত আর কোন কিছুরই প্রয়োজন নেই, এবং তার সাক্ষাৎ আমরা সচরাচর পেয়েও থাকি। এখানে প্রতিভা দ্বারা আমি অবশ্য বোঝাতে চাই পারঙ্গমতা : সাহিত্যশিল্পে ব্যক্তির চিন্তা এবং ধারণাকে প্রকাশ করবার সহজ ক্ষমতা, বৈশিষ্ট্যপূর্ণ খুঁটিনাটিগুলিকে লক্ষ্য করা এবং মনে করা; চিত্রাঙ্কন, খোদাই করা প্রভৃতি চারুকলায় রেখা, রূপ এবং রঙের পার্থক্য চেনা, এবং স্মরণে রাখা, সংগীতে যতিগুলির তারতম্য অনুধাবন করা এবং ধ্বনির পারস্পর্যের রূপটি স্মরণে রাখা এবং তা সঞ্চারিত করা। কোন ব্যক্তি যদি কোন বিশেষ শিল্পশাখা নির্বাচন করেন এবং সেই শাখায় অনুসৃত মেকি শিল্পসৃষ্টি কৌশল আয়ত্ত করে যদি তার যথেষ্ট ধৈর্য থাকে এবং যদি তার নান্দনিক অনুভূতি (যার প্রভাবে এ জাতীয় শিল্পোৎপাদন তার নিকট ঘৃণ্য মনে হতে পারে) নষ্ট হয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে সে আমাদের সমাজে শিল্পনামধেয় বস্তু আমরণ নিরবচ্ছিন্ন ধারায় উৎপাদন করে যেতে পারবে।
প্রত্যেক শিল্প-শাখায় এ জাতীয় মেকি শিল্পসৃষ্টি সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট নিয়ম এবং প্রস্তুত- প্রণালীর নির্দেশ মিলবে। সুতরাং পারঙ্গম ব্যক্তিরা সেগুলি আয়ত্ত করে নিরুত্তাপ- নিরাবেগ নিষ্প্রাণ ভঙ্গিতে এ জাতীয় শিল্পোৎপাদন করে যেতে পারবে।
কবিতা লেখার জন্য সাহিত্যিক প্রতিভাসম্পন্ন ব্যক্তির এ গুণগুলি থাকলেই চলে : ছন্দ ও মিলের প্রয়োজনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে একটি যথার্থ যোগ্য শব্দের পরিবর্তে দশটি প্রায় অনুরূপ অর্থের শব্দ ব্যবহারের কৌশল অর্জন; এমন বাগ্ধারা নির্বাচন করতে শেখা যায় স্পষ্ট অর্থের জন্য একটি স্বাভাবিক শব্দ-পরস্পরা থাকার প্রয়োজন, এবং সম্ভাব্য সকল ভাঙচুর সত্ত্বেও তার কিছুটা অর্থ বজায় রাখতে পারা। সর্বশেষে মিলের জন্য প্রয়োজনীয় শব্দ অনুসরণ করে সে শব্দের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ চিন্তা, অনুভূতি ও বর্ণনা উদ্ভাবনে সক্ষম হওয়া। এ সমস্ত গুণ অর্জিত হলে অবিচ্ছিন্নভাবে তিনি কবিতা সৃষ্টি করে যেতে পারেন। পাঠকের দাবি অনুযায়ী সে কবিতা ক্ষুদ্র বা দীর্ঘ হতে পারে; ধর্মীয়, প্রণয়োদ্দীপক অথবা দেশাত্মবোধকও হতে পারে।
সাহিত্যিক বোধসম্পন্ন কোন ব্যক্তি ছোটগল্প বা উপন্যাস লিখতে ইচ্ছুক হলে তাঁর একমাত্র প্রয়োজনীয় বিষয় হল, রচনাশৈলী আয়ত্ত করা-অর্থাৎ দৃশ্যমান সব কিছুর বর্ণনার কৌশল আয়ত্ত করা। এভাবে অভ্যস্ত হয়ে উঠলে নিজের অভিপ্রায় বা অপরের দাবি অনুযায়ী ইতিহাসভিত্তিক, প্রকৃতিনির্ভর, সামাজিক, কামোদ্দীপক, মনস্তত্ত্বমূলক এমনকি ধর্মীয় বিষয় নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে উপন্যাস বা ছোটগল্প রচনায় তিনি সক্ষম হবেন। শেষোক্ত বিষয় নিয়ে রচনার দাবি এবং ফ্যাশন ইদানীং শুরু হয়েছে। কোন বই থেকে কিংবা জীবনের ঘটনা থেকে তিনি বিষয় সংগ্রহ করতে পারেন, এমনকি নিজ পরিচয়ের পরিধি থেকেও মানুষের চরিত্রের প্রতিরূপ নিজের বইয়ে ফুটিয়ে তুলতে পারেন।
এ ধরনের উপন্যাস ও ছোটগল্প যদি সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণাত্মক এবং সযত্ন সংগৃহীত খুঁটিনাটি বর্ণনাপূর্ণ হয়, বিশেষভাবে যদি কামোদ্দীপক বর্ণনায় আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে-তবে উপলব্ধ কোন অনুভূতির স্ফুলিঙ্গ ছাড়াও সেগুলি শিল্পকর্ম বলে বিবেচিত হবে।
নাটকে শিল্পগুণ সঞ্চারের উদ্দেশ্যে উপন্যাস ও ছোটগল্পের জন্য যে সমস্ত বস্তু প্রয়োজনীয়, তা ছাড়াও প্রতিভাবান ব্যক্তিকে তাঁর চরিত্রগুলির মুখে যত বেশি সম্ভব চতুর এবং বুদ্ধিদীপ্ত সংলাপ যোজনায় অভ্যস্ত হতে হবে। এ ছাড়া নাট্যক্রিয়ার প্রভাব কিভাবে সদ্ব্যবহার করা যায়, সে কৌশল তাকে অবশ্যই জানতে হবে। তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলির ক্রিয়াকলাপ এমন নিপুণভাবে গ্রথিত করতে হবে-যাতে তার ভেতর যেন দীর্ঘ সংলাপ না থাকে। মঞ্চের ওপর যথাসম্ভব বেশি পরিমাণ কর্মব্যস্ততা ও গতিবিধি থাকা প্রয়োজন। এ ধারায় দক্ষতা অর্জন করলে লেখক আইন আদালতের রিপোর্ট, অভিজাত সমাজের সম্প্রতিকতম আলোচনার বিষয়বস্তু,-যেমন, সম্মোহন বিদ্যা, বংশানুক্রম প্রভৃতি, অথবা অতি প্রাচীন যুগের তথ্যাদি এমনকি খেয়ালি কল্পনার জগৎ থেকে বিষয়বস্তু নির্বাচন করে নিরবচ্ছিন্নভাবে একের পর এক নাট্যগ্রন্থ রচনা করতে পারেন।
চিত্রশিল্প ও ভাস্কর্যশিল্পের ক্ষেত্রে প্রতিভাবান লোকের পক্ষে শিল্পের অনুকরণাত্মক রচনা সহজতর। বিশেষভাবে নগ্ন দেহের অঙ্কন, রঙের ব্যবহার, এবং গঠনপ্রকৃতি সম্পর্কে জ্ঞান থাকলেই তাঁর চলবে। এই সঞ্চয় নিয়ে তিনি তাঁর প্রবৃত্তি অনুযায়ী বিষয়বস্তু নির্বাচন করে একের পর এক চিত্রাঙ্কন অথবা মূর্তি নির্মাণ করে যেতে পারবেন। তাঁর শিল্প রচনার বিষয়বস্তু পৌরাণিক, ধর্মীয়, অদ্ভুত অথবা প্রতীকী-যে কিছু হতে পারে; অথবা সংবাদপত্রে লিখিত বিষয়কে তিনি চিত্রায়িত করতে পারেন : যেমন, কোন রাজ্যভিত্তিক, কোন ধর্মঘট, তুর্কী-গ্রীসীয় যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষের দৃশ্য, অথবা যা সহজতম, তাঁর চোখে যা কিছু সুন্দর ঠেকবে-নগ্ন স্ত্রীলোক থেকে তাম্রপাত্র পর্যন্ত সব কিছুর তিনি প্রতিলিপি রচনা করতে পারেন।
সংগীতশিল্প সৃষ্টির জন্য প্রতিভাবান লোকের পক্ষে শিল্পের সারবস্তুর (অর্থাৎ যে অনুভূতির সাহায্যে অপরকে সংক্রমিত করা যায়) প্রয়োজন আরও কম। অপর পক্ষে নৃত্য ব্যতীত অন্য যে কোন শিল্প অপেক্ষা শারীরিক শ্রম ও ব্যায়াম তার পক্ষে অধিকতর প্রয়োজন। সাংগীতিক শিল্পকর্ম সৃষ্টির জন্য চূড়ান্ত দক্ষ শিল্পীর মতো তাকে একটি যন্ত্রের ওপর অতি-দ্রুত আঙুল চালানো অবশ্যই শিখতে হবে। তারপর তাঁকে অবশ্যই জানতে হবে আগেকার দিনে বিমিশ্র ধ্বনি-সমন্বিত সংগীত কিভাবে রচিত হতো এবং Counterpoint and fugue বিষয়ে তাঁকে জ্ঞান অর্জন করতে হবে; অধিকন্তু ঐকতান বাদনের কৌশল তাকে অবশ্যই আয়ত্ত করতে হবে-যার দ্বারা বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের সুরের সমন্বয় ঘটানো যায়। এ সমস্ত বিষয়ে জ্ঞান অর্জনে সক্ষম হলেই সংগীতশিল্পী নিরবচ্ছিন্নভাবে নানা ধলনের শিল্পকর্ম সৃষ্টি করতে পারেন : ঘটনা বা দৃশ্য-ব্যঞ্জক সংগীত (programme-music), গীতাভিনয় অথবা গান (শব্দের সঙ্গে যথাসাধ্য ধ্বনি উৎপাদক) অথবা নাতিবৃহৎ প্রকোষ্ঠের উপযোগী সংগীত (Chamber music), তার মানে অপরের বিষয়বস্তু নিয়ে বিপরীতধর্মী সুরের বিন্যাস এবং বিমিশ্র সুরের সাংগীতিক রচনার (Counterpoint I fugue) সাহায্যে তিনি সেগুলিকে সুনির্দিষ্ট রূপ দান করতে পারেন। অথবা যা খুবই সচরাচর দেখা যায়, অদ্ভুত প্রকৃতির সংগীতও তিনি রচনা করতে পারেন, অর্থাৎ খামখেয়ালিভাবে উৎপন্ন ধ্বনির সঙ্গে নানাবিধ জটিলতা ও অলঙ্করণ যুক্ত করে তিনি অদ্ভুত কিছু সৃষ্টি করতে পারেন।
এভাবে শিল্পের সকল ক্ষেত্রে পূর্বনির্দিষ্ট প্রণালীতে প্রস্তুত কৃত্রিম শিল্পের উৎপাদন চলছে এবং এ সমস্ত কৃত্রিম শিল্পকেই আমাদের সমাজের অভিজাতবর্গ প্রকৃত শিল্প বলে গ্রহণ করছেন।
সর্বজনীন শিল্প থেকে উচ্চবর্গীয়দের শিল্পের বিচ্ছিন্নতার তৃতীয় এবং সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ পরিণতি হল প্রকৃত শিল্পের স্থলে এই কৃত্রিম শিল্পের প্রতিস্থাপন।