হোয়াট ইজ আর্ট – ৫

[সৌন্দর্যভিত্তিক নয় এমন শিল্প সংজ্ঞা। টলস্টয়-প্রদত্ত সংজ্ঞা। শিল্পের সীমা এবং প্রয়োজনীয়তা। অতীতে মানুষ কিভাবে উত্তম এবং নিম্নমানের শিল্পের মধ্যে সীমারেখা টানতেন।]

যে বিভ্রান্তিকর সৌন্দর্যের ধারণা সমস্ত ব্যাপারকে গুলিয়ে ফেলে, সে ধারণাবিষয়ক বিচার আপাতত স্থগিত রেখে শিল্প বলতে কি বোঝায় এখন তার বিচার করা যাক। সৌন্দর্যের ধারণা বাদ দিলে শিল্পের সাম্প্রতিকতম এবং সর্বাপেক্ষা ব্যাপক সংজ্ঞা নিম্নরূপ : (১) (ক) শিল্প এমন একটি ক্রিয়া যার আত্মপ্রকাশ এমনকি পশুজগতেও দেখা যায়। যৌন আকাঙ্ক্ষা এবং খেলার প্রবণতা শিল্পের উৎস (শীলার, ডারউইন, স্পেনসার) এবং (খ) স্নায়ুতন্ত্রীর আনন্দময় উত্তেজনা শিল্পক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত (গ্রান্ট এলেন)। এটি শারীরতাত্ত্বিক বিবর্তনবাদী সংজ্ঞা। (২) মানুষের উপলব্ধ অনুভূতিগুলিকে রেখা, বর্ণ, গতি, ধ্বনি অথবা শব্দের সাহায্যে বহির্জগতে অভিব্যক্তি দেওয়াই শিল্প। (ভেরোঁ, Veron )।

এই হল শিল্পের সমীক্ষানির্ভর সংজ্ঞা।

খুব সাম্প্রতিক সংজ্ঞা মতে (Sully) -র (৩) শিল্প ‘কোন স্থায়ী বস্তু অথবা চলমান ক্রিয়ার সৃষ্টি-যা স্রষ্টার মনে শুধুমাত্র সক্রিয় আনন্দ দানেই সমর্থ নয়, বরং বহুসংখ্যক দর্শক বা শ্রোতার মনে আনন্দময় অনুভূতি সৃষ্টিতে সক্ষম, শিল্প-উদ্ভুত যে অনুভূতি কোন ব্যক্তিগত লাভালাভের প্রশ্ন থেকে স্বতন্ত্র।

এ সমস্ত সংজ্ঞা সৌন্দর্যের ধারণানির্ভর অধিবিদ্যাগত সংজ্ঞার চাইতে উন্নতমানের হলেও যথার্থ শিল্পসংজ্ঞা থেক বহুদূরবর্তী। প্রথম, অর্থাৎ শারীরতাত্ত্বিক বিবর্তনবাদী সংজ্ঞা (১) (ক) অযথার্থ : যেহেতু প্রকৃত আলোচ্য বস্তু শৈল্পিক ক্রিয়া বিষয়ে আলোচনা না করে সে সংজ্ঞা শিল্পের ব্যুৎপত্তি নির্ণয়ে ব্যাপৃত। এর ওপরে সংশোধিত। (খ) মানব দেহের ওপর শারীরতাত্ত্বিক প্রভাবনির্ভর সংজ্ঞাও অযথার্থ-যেহেতু এ সংজ্ঞার সীমার মধ্যে অপরাপর আরও অনেক মানবিক ক্রিয়াকে অন্তর্ভূক্ত করা যায়। যেমন, নব নন্দনতাত্ত্বিক মতবাদের সুন্দর বস্ত্র তৈরি, প্রীতিদায়ক গন্ধদ্রব্য, এমনকি খাদ্য ও পানীয় প্রস্তুতকেও এ তত্ত্ববাদীরা শিল্প বলে বিবেচনা করেন।

কর্মক্ষেত্রে প্রয়োগগত পরীক্ষামূলক সংজ্ঞা : (২) যা শুধুমাত্র আবেগের অভিব্যক্তিকেই শিল্প বিবেচনা করে-তাও অযথার্থ। যেহেতু কোন ব্যক্তি রেখা, রং, ধ্বনি অথবা কাজের সাহায্যে আবেগ প্রকাশে সক্ষম হলেও এ ধরনের প্রকাশব্যঞ্জনা যদি অপর ব্যক্তির ওপর প্রভাব বিস্তারে অসমর্থ হয়, তবে তাঁর আবেগের অভিব্যক্তিও শিল্প বলে বিবেচ্য নয়।

তৃতীয় সংজ্ঞাও (Sully-র) অযথার্থ, যেহেতু স্রষ্টার মনে আনন্দ সৃষ্টি অথবা দর্শক বা শ্রোতার কোন ব্যক্তিগত সুবিধা বিধান ব্যতিরেকে আনন্দময় আবেগসৃষ্টিতে সক্ষম কোন বস্তু উৎপাদন বা ক্রিয়াকেও শিল্প বলা যায় না। কারণ, এরূপ ক্রিয়ার মধ্যে পড়ে ঐন্দ্রজালিক কৌশল কিংবা শারীরিক কসরত অথবা ওই ধরনের আরও কোন কোন ক্রিয়া যা-শিল্পপদবাচ্য নয়। অধিকন্তু এমন অনেক বস্তু দেখা যায় যার অভিব্যক্তি স্রষ্টার মনে কোন আনন্দ সঞ্চার করে না। বরং সে সমস্ত বস্তু-উদ্ভুত চেতনা অতৃপ্তিদায়ক। উদাহরণস্বরূপ, কাব্য বা নাটকে বর্ণিত কোন বিষণ্ণ, হৃদয়বিদারক দৃশ্য মনকে বেদনাচ্ছন্ন করে। তথাপি এ সমস্ত দৃশ্য নিঃসন্দেহে শিল্পকর্ম হতে পারে।

যে কারণে এ সমস্ত সংজ্ঞা যথাযথ হয়ে ওঠেনি তা হল এই : এ সমস্ত সংজ্ঞার সব ক- টির মধ্যে (এমনকি অধিবিদ্যাগত সংজ্ঞার ক্ষেত্রেও) শিল্প কি পরিমাণে আনন্দ বিধানে সক্ষম, এ প্রশ্নই শুধু বিবেচিত হয়েছে-ব্যক্তি মানুষ বা মানবজীবনে শিল্প কি উদ্দেশ্য সাধনের উপযোগী তা বিবেচিত হয়নি।

শিল্পের অভ্রান্ত সংজ্ঞা নির্দেশের জন্য প্রথমেই প্রয়োজন শিল্পকে আনন্দদানের বাহন হিসেবে বিবেচনা না করে মানবজীবনকেই একটি অঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করা। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে শিল্প মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের উপায়গুলির মধ্যে অন্যতম-এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে আমাদের ভুল হবে না।

প্রত্যেক শিল্পকর্ম উপভোক্তাকে শিল্পস্রষ্টার সঙ্গে একটি বিশেষ সম্পর্কে আসতেই শুধু সাহায্য করে না, সমকালীন বা পরবর্তী কালে ওই শিল্প-প্রভাবিত ব্যক্তিদের সঙ্গেও আত্মীয়তার সূত্রে আবদ্ধ হতে সহায়তা করে।

মানবিক চিন্তা এবং অভিজ্ঞতা সঞ্চারক ভাষাই মানুষের মধ্যে এই মিলনসূত্র রচনা করে। শিল্পও সেই একই উদ্দেশ্য সাধন করে। শেষোক্ত মানব সম্পর্কে বিধায়ক উপায়টির বৈশিষ্ট্য শাব্দিক যোগসূত্রের উপায় থেকে পৃথক। সে বৈশিষ্ট্যের স্বরূফ এই : ভাষার সাহায্যে মানুষ নিজের চিন্তাসম্পদকে অপরের নিকট পৌঁছিয়ে দেয়; অপর পক্ষে শিল্পের মাধ্যমে সে নিজ অনুভূতিকে অপরের মধ্যে সঞ্চারিত করে।

শিল্পক্রিয়ার ভিত্তি এই সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত যে, শ্রবণ ও দর্শনের সাহায্যে যখন কেউ অপরের ভাবানুভূীত উপলব্ধি করে, ওই আবেগচালিত মানুষের আবেগটিও সে-অন্তরে উপলব্ধি করতে সক্ষম।

একটি অত্যন্ত সহজ দৃষ্টান্ত নেওয়া যেতে পারে : কোন ব্যক্তি হাসলে অপর ব্যক্তি সে হাসি শুনে আনন্দ অনুভব করে, অথবা কোন ব্যক্তি কাঁদলে অপর ব্যক্তি সে কান্না শুনে দুঃখ বোধ করে। কোন ব্যক্তিকে উত্তেজিত বা বিরক্ত দেখলে অপর ব্যক্তির মনেও একই ভাব জাগ্রত হয়। অঙ্গসঞ্চালন বা কণ্ঠস্বরের সাহায্যে কোন ব্যক্তি যখন সাহস, দৃঢ়সঙ্কল্প, বিষণ্ণতা বা ধৈর্যের অভিব্যক্তি প্রকাশ করে, তার এ মানসিক অবস্থা অপরের মধ্যে সঞ্চারিত হয়। কোন ব্যক্তি যন্ত্রণাগ্রস্ত হলে গোঙানি এবং মাংসপেশীর আক্ষেপের সাহায্যে তা ব্যক্ত করে, এবং তার এই যন্ত্রণাই যেন অপরের মধ্যে সঞ্চারিত হয়। যখন কেউ কোন বস্তু, ব্যক্তি অথবা ইন্দ্রিয়গোচর কোন দৃশ্যের প্রতি স্বীয় বিস্ময়, অনুরাগ, ভয়, শ্রদ্ধা বা ভালবাসার অনুভূতি প্রকাশ করে তখন অনুরূপভাবে অপরেও সে একই বস্তু, ব্যক্তি অথবা দৃশ্যের প্রতি একই ধরনের বিস্ময়, অনুরাগ, ভীতি, শ্রদ্ধা অথবা ভালোবাসার অনুভূতির দ্বারা সংক্রামিত হয়।

বস্তুতপক্ষে অপর ব্যক্তির ভাবানুভূতির ব্যঞ্জনার মর্মগ্রহণ এবং সে অনুভূতি আপন হৃদয়ে অনুভব করার সামর্থ্যই শিল্পক্রিয়ার ভিত্তি।

যদি কোন ব্যক্তি হৃদয়ে আবেগমথিত হয়ে আপন দেহলক্ষণ বা কণ্ঠনিসৃত কাজের সাহায্যে প্রত্যক্ষ ও তাৎক্ষণিকভাবে অপর ব্যক্তি বা ব্যক্তিসমূহকে সংক্রমিত করেন, হাই তোলান, হাসতে বা কাঁদতে, অথবা নিজে যন্ত্রণা ভোগ করায় অপরের মনেও যন্ত্রণার অনুভূতি সৃষ্টি করেন-সেটা কিন্তু শিল্পপদবাচ্য নয়।

শিল্পের আবির্ভাব তখনি ঘটে যখন কোন ব্যক্তি অপর একজন বা একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে মিলনের অভিপ্রায়ে সমভাবাপন্ন অনুভূতি-প্রভাবে বাহ্যিক লক্ষণ বা ইঙ্গিতের সাহায্যে সে অনুভূতির অভিব্যক্তি দেন। সহজতম একটি উদাহরণ দেওয়া যাক : একটি নেকড়ে বাঘের সম্মুখীন হয়ে একটি বালক যে অভিজ্ঞতা অর্জন করল, ধরা যাক্-সে অভিজ্ঞতা ভয়ের। এ সাক্ষাৎকারের অভিজ্ঞতা তার অন্তরে যে অনুভূতি সৃষ্টি করেছিল অপরের মধ্যে তা উদ্দীপিত করার উদ্দেশ্যে সে নিজের বিষয়ে বর্ণনা, নেকড়ের সাক্ষাৎকারের অবস্থা, সেখানকার পরিবেশ এবং বনের বিবরণ, নিজ অন্তরের নিরুদ্বিগ্নতার বর্ণনার পর নেকড়ের আকৃতি, চলাফেরা, তার থেকে নেকড়ের দূরত্ব ইত্যাদির পরিচয় দিয়ে বাঘের সম্মুখীন হওয়ার অভিজ্ঞতা ইত্যাদি বর্ণনা করল। এ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়ে বালকটির মনে যে অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছিল, গল্প বলার সময় যদি তার অন্তরে সে অনুভূতির নরাবির্ভাব ঘটে এবং শ্রোতৃবৃন্দ যদি সে অনুভূতি দ্বারা সংক্রমিত হয়-তবে অবশ্যই তা শিল্পপদবাচ্য। সে বালকটি নেকড়ে বাঘ না দেখেও বারংবার নেকড়ে বাঘের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের একটি ঘটনা উদ্ভাবন করে এবং পুঙ্খনুপুঙ্খভাবে তার বর্ণনা দেয় এবং তার মনে যে ভীতির অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছিল তার শ্রোতাদের সে অনুভূতির অংশভাগী করতে সমর্থ হয়, তাও শিল্প বলে বিবেচতি হবে। যখন কেউ ভয় বা যন্ত্ৰণা, অথবা উপভোগের আকর্ষণ (বাস্তবে বা কল্পনায় যাতেই হোক না কেন)-এর অভিজ্ঞতা লাভ করে সে অনুভূতিকে ক্যানভ্যাস বা মার্বেলের ওপর ফুটিয়ে তোলেন এবং সে দৃশ্য দেখে অপর ব্যক্তিও যদি সংক্রমিত হন-একই ভাবে তাও শিল্পের স্বীকৃতি পাবে। এ ছাড়া কোন ব্যক্তির অন্তরে, এমনকি কল্পনায়ও উল্লাস, আনন্দ, দুঃখ, নৈরাশ্য, সাহস অথবা বিষণ্নতার অনুভূতি জাগ্রত হবার পর তিনি যদি এ অনুভূতিগুলির পারস্পরিক ক্রমসঞ্চারকে সুরের সাহায্যে এমনিভাবে অভিব্যক্তি দেন যে-শ্রোতারা তার দ্বারা শুধু সংক্রমিত হন না, বরং সুরকর্তার অভিজ্ঞতাকে নিজের অন্তরে অনুভব করেন-তবে সেটাও শিল্প বলে স্বীকৃতি লাভ করবে।

যে অনুভূতির সাহায্যে শিল্পী অপরকে সংক্রমিত করেন তা খুব তীব্র অথবা খুব মৃদু, খুব গুরুত্বপূর্ণ অথবা খুব অকিঞ্চিৎকর, খুবই মন্দ অথবা খুবই উত্তম-নানা ধরনের হতে পারে। স্বদেশের জন্য ভালোবাসার চেতনা, নাটকে অভিব্যক্ত আত্মনিবেদন, ঈশ্বর বা ভাগ্যের নিকট আত্মসমর্পণ, উপন্যাসে বর্ণিত প্রেমিক যুগলের আত্মহারা অবস্থা, কোন চিত্রে প্রকাশিত ইন্দ্রিয়পরায়ণতার অনুভূতি, বিজয়ী কুচকাওয়াজে অভিব্যক্ত সাহস, কোন নৃত্য দ্বারা উদ্রিক্ত কলহাস্যময় পুলকোচ্ছ্বাস, কৌতুকপূর্ণ গল্পসৃষ্ট হাস্যরস, সান্ধ্য প্রকৃতির দৃশ্য, অথবা ঘুম-পাড়ানির গান দ্বারা সঞ্চারিত প্রশান্তির অনুভূতি, সুন্দর ও অদ্ভুত কোন অলংকার দর্শনে মুগ্ধ প্রশংসা-এ সবই শিল্প।

স্রষ্টার অন্তরে যে অনুভূতি জাগ্রত হয়েছিল দর্শক এবং শ্রোতাও যদি তার দ্বারা সংক্রমিত হন, তবে নিঃসন্দেহে তা শিল্প।

এককালে উপলব্ধ অনুভূতি নিজের মধ্যে জাগ্রত করা, সে জাগ্রত অনুভূতিকে গতি, রেখা, রং, ধ্বনি ও রূপের সাহাযে কথায় প্রকাশ করা এবং অপর ব্যক্তি মধ্যে স্রষ্টার সেই অনুভূতির অভিজ্ঞতাকে সঞ্চারিত করাকেই বলা চলে শিল্পক্রিয়া।

শিল্প একটি মানবিক ক্রিয়া। শিল্পসৃষ্টির প্রক্রিয়া এরূপ : কোন ব্যক্তি আপন হৃদয়ে উপলব্ধ অনুভূতিকে বাহ্য অভিজ্ঞানের সাহায্যে অপরের চিত্তে সঞ্চারিত করেন এবং অপরেও যখন অনুরূপ ভাবানুভূতির দ্বারা সংক্রমিত হন এবং আপন হৃদয়ে অনুরূপভাবে উপলব্ধি করেন, তখনি হয় শিল্পের জন্ম।

অধিবিদ্যাবিদেরা শিল্পকে সৌন্দর্যের অথবা ঈশ্বরের কোন অতীন্দ্রিয় চরম ভাবপদার্থের অভিব্যক্তি বলে যে বর্ণনা করেন, শিল্প তা য়। নন্দনতাত্ত্বিক শারীরততত্ত্ববিদরো মানুষের সঞ্চিত উদ্বৃত কর্মশক্তির মুক্তির উৎস-ক্রীড়াকে যে শিল্প বলে মত প্রকাশ করেন-শিল্প তাও নয়। বাহ্যিক কোন অভিজ্ঞানের সাহায্যে আবেগের অভিব্যক্তি দেওয়াও শিল্প নয়। প্রীতিদায়ক বস্তুর সৃষ্টিও শিল্প নয়। সর্বোপরি শিল্প আনন্দ নয়। বরং শিল্প এমন একটি বস্তু- যা একই অনুভূতির মাধ্যমে মানুষকে একত্র সংযুক্ত করে। ব্যক্তি ও মানবতার জীবন ও মঙ্গলময় প্রগতির উপায় হিসেবে শিল্পের প্রয়োজন অপরিহার্য।

ভাষার মাধ্যমে চিন্তা প্রকাশের ক্ষমতার অধিকারী বলে পূর্ববর্তী মানবসমাজের অবদান কী, পরবর্তী কালে প্রত্যেক মানুষ তা জানতে পারে। অপরের চিন্তাধারা উপলব্ধিতে সক্ষম বলে বর্তমান কালের মানুষ পূর্ববর্তীদের ক্রিয়াকলাপের অংশীদার হতে পারে। এ যুগের মানুষ অপর ব্যক্তির যে চিন্তাধারা আত্মসাৎ করেছে কিংবা তার মানব জগতে যে চিন্তাধারা জন্ম নিয়েছে, তা তার সমসাময়িকদের বা পরবর্তী বংশধরদের দিয়ে যেতে পারে। সুতরাং শিল্প মাধ্যমে অপর মানুষের অনুভূতি দ্বারা সংক্রমিত হতে পারে বলে সমসাময়িক মানুষের সর্বপ্রকারের অভিজ্ঞতা এ যুগের মানুষের আয়ত্তগম্য। শুধু তাই নয়, হাজার হাজার বছর আগে মানুষ যে অনুভূতির অভিজ্ঞতা লাভ করেছিল, তা সে যেমন অনুভব করতে পারে, তেমনি এ যুগের মানুষের পক্ষেও অপরচিত্তে তার হৃদয়সংবেদনা সঞ্চারিত করে দেওয়া সম্ভব।

পূর্বগামী মানুষের চিন্তাধারা আপন চিত্তে গ্রহণ করবার ক্ষমতা এবং অপরের চিত্তে আপন চিন্তাধারা সঞ্চারের আপন চিত্তে গ্রহণ করবার ক্ষমতা এবং অপরের হতো বন্য পশুর কিংবা কাসপার হৌসের (Kasper Hauser) মতো।

শিল্প-সংক্রমিত হবার অপর ক্ষমতা বঞ্চিত হলে মানুষের অবস্থা হত আরও বেশি বর্বরের মতো। সর্বোপরি তারা পরস্পরবিচ্ছিন্ন হয়ে একের প্রতি অপরে বৈরী ভাবাপন্ন হয়ে পড়তো।

সুতরাং শিল্প-ক্রিয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। সে ক্রিয়া এমনকি বাক্‌শক্তির মতোই সম- গুরুত্বপূর্ণ এবং বাক্শক্তির মতো সর্বব্যাপ্ত।

কথা আমাদের ওপর উপদেশ, বক্তৃতা বা গ্রন্থমাধ্যমেই শুধু ক্রিয়াশীল নয়, আমাদের পারস্পরিক চিন্তা এবং অভিজ্ঞতা বিনিময়ের মধ্যেও ক্রিয়াশীল। ব্যাপক অর্থে শিল্প ও তেমনি আমাদের সমগ্র জীবনে ব্যাপ্ত হয়ে আছে। তবে শিল্পের কয়েকটি মাত্র অভিব্যক্তির প্রতি আমরা খুব সীমাবদ্ধ অর্থেই শব্দটি প্রয়োগ করি।

থিয়েটারে, ঐকতানবাদনে বা চিত্র প্রদর্শনীতে আমরা যা শুনি বা দেখি কেবল তাকেই আমরা শিল্প বলে ভাবতে অভ্যস্ত। এর সঙ্গে হর্ম্যরাজি, ভাস্কর্য, মূর্তি, কবিতা ও উপন্যাসকেও শিল্প মনে করা হয়।…কিন্তু যে শিল্পের সাহায্যে আমরা জীবনে পারস্পরিক আদানপ্রদান করি, এগুলি তার খুব সামান্য অংশ মাত্র। আমাদের সকলেরই জীবন শত প্রকারের শিল্পকর্ম দ্বারা পরিপূর্ণ, যেমন ঘুমপাড়ানি গান, হাসি- ঠাট্টা, ব্যাঙ্গানুকরণ, গৃহের অলংকরণ, পোশাক-পরিচ্ছদ এবং বাসন-কোশন থেকে শুরু করে গির্জায় উপাসনা, দালান, স্মারকস্তম্ভ এবং বিজয়-মিছিল ইত্যাদি। এ সবই শিল্পকর্ম। সুতরাং সীমাবদ্ধ অর্থে শিল্প করতে আমরা অনুভূতিসঞ্চারক মানবিক ক্রিয়া মাত্রকেই বুঝি না, বরং আমরা যে অংশটিকে বিশেষ কারণে নির্বাচন করি অথবা যার ওপর বিশেষ গুরুত্ব অর্পণ করি, তাকেই শিল্প বলি।

মানুষ শিল্প ক্রিয়ায় সে অংশের ওপরই সব চাইতে বেশি গুরুত্ব অর্পণ করেছে যা তাদের ধর্মীয় উপলব্ধি-উৎসারিত অনুভূতি সঞ্চার করে। এই ক্ষুদ্র অংশটির প্রতি শিল্পের সম্পূর্ণ অর্থ আরোপ করে সে অংশটিকেই তারা বিশেষভাবে শিল্প নামে অভিহিত করেছে।

সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিস্টটল প্রভৃতি পূর্বযুগের মানুষ শিল্পকে দেখেছিলেন এ দৃষ্টিভঙ্গির সাহায্যেই। হিব্রু প্রবক্তাগণ এবং প্রাচীন যুগের খ্রীস্টানেরাও অনুরূপ দৃষ্টিতে শিল্পের বিচার করতেন। শিল্প সম্পর্কে মুসলমানদের ধারণাও পূর্বাপর এরূপ। আমাদের ধর্মবোধ-সম্পন্ন কৃষক জনসাধারণও শিল্প করতে এ যাবৎ ঠিক এই-ই বুঝে থাকেন। মানবজাতির কোন কোন শিক্ষক -যেমন প্লেটো তাঁর Repulic-এ, আদি যুগের খ্রীষ্টানদের মতো কোন কোন ব্যক্তি, গোঁড়া মুসলমান এবং বৌদ্ধেরা শিল্প-ভাবনায় এত চরমপন্থী ছিলেন যে, তাঁরা সকল প্রকার শিল্পকেই অস্বীকার করেছেন।

শিল্পবিরোধী এই মত অনুসারে, শিল্প মানুষকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে সংক্রমিত করবার ভয়ঙ্কর শক্তি রাখে বলে নির্বিচারে শিল্পমাত্রাকেই স্বীকার করা অপেক্ষা সমস্ত শিল্পকে বিসর্জন দেওয়াও মানবজাতির পক্ষে কম ক্ষতিকর। বলা বাহুল্য, এই মতটি বর্তমানে প্রচলিত ‘প্রীতিপ্রদ শিল্পমাত্রই উত্তম’-এই মতের বিপরীত।

এ পর্যায়ের মানুষ সকল প্রকরণের শিল্পকে নস্যাৎ করে দিয়ে ভুলই করেছিল-এটা খুবই স্পষ্ট। যেহেতু তারা এমন বস্তুকে অস্বীকার করেছে-যা অনস্বীকার্য। শিল্প মানবিক আদানপ্রদানের সেই অপরিহার্য উপকরণ, যার অভাবে মানবজাতির অস্তিত্ব রক্ষা সম্ভব হত না। কিন্তু যে শিল্প শুধুমাত্র সৌন্দর্য সেবার নিয়োজিত অর্থাৎ মানুষকে আনন্দ দান করে, সে পর্যায়ের যে কোন শিল্পের আনুকূল্য করে আমাদের শ্রেণীভূক্ত এ যুগের ইউরোপীয় সমাজের সুসভ্য মানুষও অবশ্য কম ভুল করেনি।

পূর্বকালে মানুষের মনে একটা ভয় ছিল,-শিল্পকর্মের মধ্যে এমন কিছু থাকা সম্ভব যার দ্বারা কোন কোন মানুষ কলুষিত হতে পারে। এ কারণে তারা শিল্পকে সম্পূর্ণভাবে বর্জন করেছিল। এখন তাদের একমাত্র ভয়, পাছে তারা শিল্প-উদ্ভুত কোন আনন্দ উপভোগ থেকে বঞ্চিত হয়। এ কারণেই তারা যে কোন প্রকরণের শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতা করে। আমার মতে শেষোক্ত ভ্রান্তি প্রথমোক্ত ভ্রান্তির অপেক্ষা অনেক বেশি কুৎসিত এবং পরিণামে অনেক বেশি ক্ষতিকর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *