হোয়াট ইজ আর্ট – ২০

২০

[বিজ্ঞান ও শিল্পের সম্পর্ক। ভ্রান্ত বিজ্ঞান। অকিঞ্চিৎকর বিজ্ঞান। বিজ্ঞান হবে মানব জীবনের বৃহৎ সমস্যাকেন্দ্রিক এবং শিল্পের ভিত্তিভূমি।]

উপসংহার

শিল্প সম্পর্কীয় আমার প্রিয় বিষয়টি পনেরো বৎসর কাল ব্যাপী সাধনায় আমার শ্রেষ্ঠ শক্তি নিয়োগ করে আমি সমাপ্ত করেছি। এই বিষয়টি পনেরো বৎসর পর্যন্ত আমাকে কর্মব্যস্ত রেখেছিল-এই কথা আমি এই অর্থে ব্যবহার করিনি যে, পনেরো বৎসর ধরে আমি ইে বই লিখে আসছি। বরং এ কথাই বলতে চেয়েছি যে, পনেরো বৎসর আগে আমি শিল্প সম্পর্কে যখন লিখতে শুরু করি,-ভেবেছিরাম, একবার যখন এই কাজে হাত দিয়েছি, তখন কোন প্রকার বিরতি ছাড়াই তা সম্পূর্ণ করব। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা গেল, বিষয়টি সম্পর্কে আমার দৃষ্টিভঙ্গি এতখানি অস্বচ্ছ ছিল যে, আমার বিবেচনায় সন্তোষজনকভাবে আমি সেগুলিকে বিন্যস্ত করতে পারিনি। সে সময় থেকে বিষয়টি নিয়ে আমার চিন্তার কোন ছেদ পড়েনি, এবং আমি বিষয়টির ওপর ছয়বার কি সাতবার নতুন করে লেখা আরম্ভ করি। কিন্তু প্রতিবারই বৃহৎ একটা অংশ লেখার পর আমি উপলব্ধি করি যে, আমার আরদ্ধ কর্মকে সন্তোষজনক পরিণামমুখী করতে আমি অসমর্থ হয়েছি। এ কারণে কাজটিকে আমার এক পাশে সরিয়ে রাখতে হয়েছে। এখন সে কর্মটি আমি সমাপ্ত করেছি। আমার পরিসমাপ্ত কর্মটি সু-সম্পাদিত হোক না হোক, আমার প্রত্যাশা এই যে, আমাদের সমাজে শিল্পের প্রবণতা এবং গতি যে ভ্রান্ত পথের অভিমুখী, সে ভ্রান্ত পথ অনুসরণের কারণ এবং শিল্পের প্রকৃত লক্ষ্য বিষয়ে আমার মৌলিক চিন্তা ভ্রান্তিহীন, -সুতরাং আমার রচনাটি সেইদিক দিয়ে মূল্যহীন বিবেচিত হবে না। কিন্তু আমার আশা ফলবতী হওয়ার জন্যে এবং শিল্প যাতে তার ভ্রান্ত পথ পরিত্যাগ করে ও নতুন লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর হয় সে জন্যে আরও একটি সমান গুরুত্বপূর্ণ আত্মিক মানবিক ক্রিয়া বিজ্ঞান-যার ওপর শিল্পও নিবিড়ভাবে নির্ভরশীল-সেই বিজ্ঞানেরও শিল্পের অনুরূপ বর্তমানে অনুসৃত ভ্রান্তপথ বর্জন করা বাঞ্ছনীয়।

বিজ্ঞান ও শিল্প ফুস্ফুস্ এবং হৃদপিন্ডের মতো নিকট সম্পর্কে সংযুক্ত। এ কারণে একটি অঙ্গ দূষিত হলে অপরটিরও যথাযথভাবে কাজ করতে পারে না। বিশুদ্ধ বিজ্ঞান অনুসন্ধানের সাহায্যে নির্দিষ্ট কাল এবং সমাজ-বিবেচিত খুবই গুরুত্বপূর্ণ সত্য এবং জ্ঞানকে মানব-চেতনার সম্মুখীন করে। শিল্প এ সমস্ত সত্যকে বোধেল জগৎ থেকে আবেগের জগতে সঞ্চারিত করে। সুতরাং বিজ্ঞান-নির্বাচিত পথ ভ্রান্ত হলে শিল্প- অনুসৃত পথও ভ্রান্ত হবে। বিজ্ঞান ও শিল্প এক বিশেষ ধরনের নোঙর-সম্বলিত (কবফমব-ধহপযড়ৎং) বজরার মতো। এ ধরনের বজরা আমাদের নদীগুলিতে এক সময় যাতায়াত করত। বিজ্ঞান নোঙরগুলিকে উজানের দিকে নেওয়া তরীর মতো-যে নোঙরগুলি তরীগুলিকে সুরক্ষিত করত এবং তার সম্মুখগতি সুনিশ্চিত করত। অপরপক্ষে শিল্প চরকি-কলের মতো বজরাকে নোঙরের দিকে আকর্ষণ করে। বস্তুতপক্ষে এরই দ্বারা ঘটে সম্মুখ-গতির সঞ্চার। সুতরাং বিজ্ঞানের ভ্রান্ত কার্যকলাপ অনিবার্যত অনুরূপ ভ্রান্ত শিল্পক্রিয়ার সৃষ্টি করে।

সকল শিল্পের বৈশিষ্ট্য সর্বপ্রকার অনুভূতির সঞ্চারণ হলেও, স্বীকৃত গুরুত্বপূর্ণ অনুভূতি- সঞ্চারক না হলে সীমাবদ্ধ অর্থে আমরা কোন বস্তুকে শিল্প বলে অভিহিত করি না। তেমনি সকল বিজ্ঞান সাধারণভাবে সর্বপ্রকারের সম্ভাব্য জ্ঞানের সঞ্চারক হলেও, শব্দটির সীমিত অর্থে স্বীকৃত গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞান-সঞ্চারক বস্তুকেই আমরা বিজ্ঞান বলে অভিহিত করি।

শিল্প-সঞ্চারিত অনুভূতি এবং বিজ্ঞান-সঞ্চারিত তথ্য উভয়ের গুরুত্বের পরিমাণ নির্দিষ্ট কোন সময় এবং সমাজের ধর্মীয় উপলব্ধির দ্বারা মীমাংসিত হয়। অর্থাৎ নির্দিষ্ট সময়ের অথবা সমাজের জীবনধৃত সর্বজনিক লক্ষ্যের উপলব্ধির দ্বারাই মীমাংসিত হয়।

সে লক্ষ্য সাধনের সর্বাপেক্ষা অধিক সহায়ক বিষয়কে সর্বপ্রযত্নে অনুধাবন করতে হবে; সে লক্ষ্য সাধনে স্বল্প সহায়ক বিষয়ের প্রতি কম মনোযোগী হতে হবে; আর মানবজীবনের লক্ষ্য সাধনে আদৌ সহায়তা করে না এমন বিষয়কে পুরোপুরি উপেক্ষা করতে হবে। সে বিষয়ে পর্যবেক্ষণ করা হলেও সে প্রয়াসকে বিজ্ঞান বলে স্বীকার করা চলবে না। মানবিক জ্ঞান এবং মানবজীবনের প্রকৃতিও এরূপ বলে এই ধারা সব সময় চলে আসছে এবং এই রকম চলাই উচিত। কিন্তু আমাদের যুগের অভিজাত শ্রেণীর লোকদের বিজ্ঞান কোন ধর্মকেই শুধু যে অস্বীকার করে তাই নয়, বরং ধর্ম মাত্রকেই কুসংস্কার বিবেচনা করায় পূর্বের মতো এখনও এই ধরনের পার্থক্য নির্ণয়ে অক্ষম।

আমাদের কালের বিজ্ঞানীরা সব কিছুই নিরপেক্ষভাবে সমীক্ষা করেন বলে দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করেন। কিন্তু ‘সব কিছু’ কথাটি বস্তুতপক্ষে সীমাহীন বস্তুপুঞ্জের অর্থজ্ঞাপক বলে ‘সব কিছু’ বললে খুব বেশি করে বলা হয়। সুতরাং সমানভাবে সব কিছুর সমীক্ষা অসম্ভব। বস্তুতপক্ষে শুধু তত্ত্বের দিক থেকে বলা হলেও কার্যক্ষেত্রে সব কিছু সমীক্ষা করা অসম্ভব। সে সমীক্ষা নিরপেক্ষভাবে করা তো হয়ই না, বরং একমাত্র সে বস্তুরই সমীক্ষা করা হয় একদিকে যার খুবই চাহিদা আছে এবং যারা বিজ্ঞান নিয়ে ব্যাপৃত তাদের কাছে সর্বাধিক প্রীতিপ্রদ। বিজ্ঞান নিয়ে ব্যাপৃত অভিজাত শ্রেণীর ব্যক্তিদের সর্বাপেক্ষা অভিপ্রেত বিষয় হল এমন পদ্ধতির সংরক্ষণ-যার সাহায্যে তারা নিজেদের বিশেষ সুবিধাগুলি অক্ষুণ্ণ রাখতে পারেন। যে সমস্ত বস্তু অলস-কৌতূহল চরিতার্থ করে, বৃহৎ কোন মানসিক প্রয়াস দাবি করে না এবং বাস্তবক্ষেত্রের যার প্রযুক্তি সম্ভব সেগুলিই তাদের নিকট সর্বাধিক প্রীতিপ্রদ।

সুতরাং ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন সহ প্রচলিত সমাজবিন্যাসের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বিজ্ঞানের এক অংশ এবং একই পর্যায়ের ইতিাহসও অর্থনীতি-একমাত্র প্রচলিত সমাজবিন্যাসই স্থায়ী হওয়া উচিত বলে প্রমাণ করতে ব্যাপৃত। এই সমাজবিন্যাসের উদ্ভব এবং অস্তিত্ব রক্ষার মূলে এমন সমস্ত নিয়ম ক্রিয়াশীল-মানুষের ইচ্ছায় যার পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব নয়। সুতরাং এ সমস্ত নিয়ম পরিবর্তনের সকল প্রয়াসই অনিষ্টকর এবং ভ্রান্ত। অংকশাস্ত্র, জ্যোতির্বিজ্ঞান, রাসায়ন, পদার্থবিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা এবং প্রাকৃতিক বিজ্ঞান সমূহ-যা পরীক্ষামূলক বিজ্ঞান নামক অপর অংশের অন্তর্ভূক্ত, সেগুলি মানবজীবনের লক্ষ্যের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সম্পর্কহীন বস্তু নিয়ে সর্বক্ষণ ব্যাপৃত। এ সব বিজ্ঞান অদ্ভুত বিষয়সমূহ এবং এমন সব বস্তু নিয়ে ব্যাপৃত যার বাস্তব প্রয়োগ হলে অভিজাত শ্রেণীরাই লাভবান হতে পারেন। সমীক্ষার নির্বাচিত বিষয় সমূহকে সমর্থন করবার জন্য (যা তাদের নিজস্ব স্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ) আমাদের যুগের বিজ্ঞানীরা একটি কাজ করেছেন। সেটি হল, শুধু ‘বিজ্ঞানের জন্যই বিজ্ঞান’-এরূপ একটি তত্ত্ব খাড়া করেছেন যা ‘শিল্পের জন্যই শিল্প’ মতবাদের অনুরূপ।

‘যা কিছু আমাদের আনন্দ দেয় তাই শিল্প’-কলা কৈবল্যবাদী মতবাদ দ্বারা একথা যেমন প্রমাণিত হয়, তেমনি আমাদের কৌতূহল উদ্রেককারী বস্তুর সমীক্ষা মাত্রই বিজ্ঞান- বিজ্ঞানের জন্য বিজ্ঞান তত্ত্ব দ্বারাও এ কথাই প্ৰতীয়মান হয়।

এ অবস্থায় বিজ্ঞানের একটি অংশ মানুষ কিভাবে জীবনের লক্ষ্য চরিতার্থ করবার জন্য বেঁচে থাকবে-এই সমীক্ষার পরিবর্তে আমাদের জীবন-পরিবেশে যে অশুভ এবং মিথ্যা বিন্যাস বিদ্যমান-তাকে ন্যায়সঙ্গত এবং অপরিবর্তনীয় বলে প্রমাণিত করে। বিজ্ঞানের অপর অংশ অর্থাৎ পরীক্ষামূলক বিজ্ঞান শুধুমাত্র সহজ কৌতূহল এবং প্রয়োগ- কৌশলগত সমুন্নতি নিয়েই ব্যাপৃত।

বিজ্ঞানের এই শ্রেণী-বিভাগের মধ্যে প্রথমটি যে হানিকর সে শুধু এই কারণেই নয় যে, তা মানুষের বোধশক্তিকে বিভ্রান্ত করে মানুষকে ভ্রান্ত সিদ্ধান্তের দিকে পরিচালিত করে, বরং শুধুমাত্র স্বীয় অস্তিত্বের দ্বারা প্রকৃত বিজ্ঞানের স্থান অধিকার করেছে বলেও তা হানিকর। সে ক্ষতির স্বরূপ এই : জীবনের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ জিজ্ঞাসার সম্মুখীন হবার জন্য প্রত্যেক মানুষকে প্রথমেই যুগ যুগ ব্যাপী মানুষের জীবনের প্রত্যেকটি অনিবার্য প্রশ্নের চতুর্দিকে পুঞ্জীভূত এবং সকল প্রকার মানবীয় উদ্ভাবন শক্তির সাহায্যে পুষ্ট মিথ্যাকে অস্বীকার করতে হবে।

দ্বিতীয় যে বিভাগ সম্পর্কে বর্তমান বিজ্ঞান বিশেষভাবে অহমিকার ভাব পোষণ করে এবং বহু ব্যক্তির নিকট যা একমাত্র প্রকৃত বিজ্ঞান বলে বিবেচিত-তাও হানিকর, যেহেতু তা যথার্থ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় থেকে অকিঞ্চিৎকর বিষয়ের দিকে মানুষের চিত্তকে বিক্ষিপ্ত করে। এই শ্রেণীর বিজ্ঞান প্রত্যক্ষভাবেও যে হানিকর তার কারণ, সমাজের বর্তমান অন্যায় ব্যবস্থায়-(যে ব্যবস্থাকে প্রথম শ্রেণীর বিজ্ঞান ন্যায়সঙ্গত বলে সমর্থন করে)- বৈজ্ঞানিক প্রয়োগগত সুফলগুলি সমস্ত মানবজাতির কল্যাণে নিয়োজিত না হয়ে ক্ষতিরই কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

বাস্তবিক পক্ষে শুধুমাত্র এই ধরনের সমীক্ষায় আত্মনিবেদিত ব্যক্তির নিকটেই এটা মনে হয়, যেন প্রাকৃতিক বিজ্ঞান-জগতে সমস্ত আবিষ্কার মাত্রই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রয়োজনীয়। এ সমস্ত ব্যক্তি নিজের পারিপার্শ্বিকের দিকে যখন দৃষ্টিপাত করেন না, এবং প্রকৃত গুরুত্বপূর্ণ বস্তু কী -তা উপলব্ধি করেন না, তখনই তাদের এরূপ মনে হয়। যে মনস্তাত্ত্বিক আনুবীক্ষণিক দৃষ্টির সাহায্যে তাঁরা পরীক্ষানিরীক্ষা চালান, তাদের একমাত্র কর্তব্য তার থেকে নিজেকে সবলে বিযুক্ত করা এবং চারিদিকে চোখ মেলে দেখা। তা হলেই তারা বুঝতে পারবেন, কী সব অকিঞ্চিৎকর বিষয় নিয়ে তারা শিশুসুলভ গর্ব অনুভব করেন। অর্থাৎ বুঝতে পারবেন, যে জ্ঞান আমরা হেলায় বর্জন করেছি এবং ধর্মতত্ত্ব, আইনশাস্ত্র, রাষ্ট্রনীতি এবং অর্থশাস্ত্র ইত্যাদির অধ্যাপকদের হাতে বিকৃতি-কবলিত হতে দিয়েছি, তার তুলনায় তাঁদের (বিজ্ঞানীদের) বহুমাত্ৰিক জ্যামিতি, ছায়াপথের বর্ণালী বিশ্লেষণ, আনবিক গঠন, প্রস্তর যুগের মানুষের খুলির আয়তন, এবং ওই জাতীয় নানা নগণ্য বিষয়সমূহের জ্ঞানই শুধু নয়,-এমনকি জীবাণুবিদ্যার, রঞ্জনরশ্মি ইত্যাদির জ্ঞানও কত অকিঞ্চিৎকর। আমরা আমাদের চতুর্দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করলেই হৃদয়ঙ্গম করতে পারব যে, প্রকৃত বিজ্ঞানের সঙ্গত কাজ কৌতূহলোদ্দীপক বস্তুমাত্রেরই সমীক্ষা নয়, বরং যে উপায়ে মানুষের জীবন প্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিত তার অনুধ্যান-অর্থাৎ ধর্মের, নীতির এবং সামাজিক জীবনের সে সমস্ত জিজ্ঞাসার অনুসন্ধান যার মীমাংসা ব্যতীত প্রকৃতি-বিষয়ক আমাদের সকল জ্ঞান হানিকর অথবা তুচ্ছ।

আমরা খুবই গর্ব এবং আনন্দ অনুভব করি যে, আমাদের বিজ্ঞান ঝলপ্রপাতের শক্তিকে সদ্ব্যবহার করা এবং কলকারখানার কাজে নিয়োজিত করা সম্ভব করেছে, এবং তার সাহায্যে আমরা পর্বত বিদীর্ণ করে সুড়ঙ্গপথ নির্মাণে সমর্থ হয়েছি, ইত্যাদি। কিন্তু পরিতাপের কথা এই যে, আমরা সে জলপ্রপাতের শক্তিকে কাজে লাগিয়েছি শ্রমিকদের হিতার্থে নয়, বরং বিলাসদ্রব্য উৎপাদনকারী পুঁজিবাদীদের অথবা মানববিধ্বংসী যুদ্ধাস্ত্র নির্মাণকারীদের আরও ঐশ্বর্যশালী করে তুলবার জন্য। যে ডিনামাইটের সাহায্যে সুড়ঙ্গপথ নির্মাণের জন্য আমরা পর্বত বিদীর্ণ করেছি, যে ডিনামাইটকে আমরা যুদ্ধের কাজেও ব্যবহার করি। এই শেষোক্ত কাজ থেকে বিরত থাকতে আমরা যে শুধু অনিচ্ছুক তাই নয়, বরং এরূপ কাজকে অনিবার্য বিবেচনা করে অবিচ্ছিন্নভাবে তারই জন্য প্রস্তুত হয়ে চলি।

আমরা হয়ত এখন ডিপথেরিয়ার জীবাণুকে প্রতিষেধক হিসেবে টীকা দিতে সক্ষম হয়েছি, রঞ্জনরশ্মির সাহায্যে শরীরের ভিতরকার একটি ছুঁচও দেখতে পাই, কুব্জকে ঋজু করতে পারি, উপদংশ রোগকে নিরাময় করতে পারি এবং আশ্চর্য অস্ত্রোপচারে সক্ষম হয়েছি। তা সত্ত্বেও প্রকৃত বিজ্ঞানের যথাযথ লক্ষ্য উপলব্ধি করলে এ সমস্ত অর্জিত কৃতিত্ব নিয়ে (যদি তা তর্কাতীতভাবে প্রমাণিত হয়ও) আমাদের গর্বিত হওয়া উচিত নয়। বিশুদ্ধ কৌতূহলোদ্দীপক বস্তুর পিছনে অথবা নিছক বাস্তব প্রয়োগমূলক প্রকৃত বিজ্ঞানের জন্য ব্যয়িত হত, তাহলে বর্তমান যে সব রুগীদের মধ্যে অতি সামান্য সংখ্যক ব্যক্তি হাসপাতালে আরোগ্য লাভ করে,-তাদের অর্ধেকের বেশি রোগমুক্ত থাকত। কারখানার পরিবেশে রক্তশূন্য বা বিকৃত শিশুরা বেড়ে উঠত না, শিশুমৃত্যু বর্তমান কালের মতো শতকরা পঞ্চাশ ভাগ হত না, এবং বর্তমান বিজ্ঞান মূর্খতা এবং দুঃখের ভয়াবহতাকে যে মানবজীবনের একটা প্রয়োজনীয় অবস্থা বিবেচনা করে-তার অস্তিত্বও থাকত না।

আমরা বিজ্ঞানের ধারণাকে এতটা বিকৃত করেছি যে, যদি বলা হয়, শিশুমৃত্যু, বেশ্যাবৃত্তি, উপদংশ রোগ, সমস্ত জাতির অধোগতি, এবং মানুষের সামগ্রিক হত্যার নিবারণ করাই বিজ্ঞানের কর্তব্য, তবে তা আমাদের যুগের মানুষের কাছে অদ্ভুত মনে হবে। বিজ্ঞান আমাদের নিকট প্রকৃত বিজ্ঞান বলে প্রতীয়মান হয় -যখন কোন ব্যক্তি রসায়নাগারে এক পাত্র থেকে আর একটি পাত্রে তরল দ্রব্য ঢালে, অথবা বৰ্ণালী বিশ্লেষণ করে, অথবা ব্যাঙ্ বা শুশুক জাতীয় প্রাণী-বিশেষকে ব্যবচ্ছেদ করে, কিংবা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ বৈজ্ঞানিক মিশ্র ভাষায় প্রচলিত বাগ্‌বৈশিষ্ট্যের অস্পষ্ট জাল বোনে। অধিবিদ্যাগত, দার্শনিক, ঐতিহাসিক, মামলা-মকদ্দমার বিচার সম্পর্কীয়, অথবা রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-যা সে ব্যক্তির নিজের নিকটও অর্ধস্পষ্ট এবং যার উদ্দেশ্য যা আছে তাই থাকা উচিত -এটা প্ৰদৰ্শন।

কিন্তু বিজ্ঞান, যথার্থ বিজ্ঞান,-সেই জাতীয় বিজ্ঞান যা প্রকৃতই সম্মানের অধিকারী-যে সম্মান এখন বিজ্ঞানের মতো এক (সব চাইতে কম গুরুত্বপূর্ণ) অংশের অনুবর্তীরা দাবি করেন-তা একেবারেই ওই প্রকৃতির নয়। প্রকৃত বিজ্ঞান হচ্ছে এইটি জানা -আমাদের কি বিশ্বাস করা উচিত, কিভাবে উচিত নয়; যৌন সম্পর্ককে কিভাবে দেখতে হবে, শিশুদের কিভাবে শিক্ষা দেওয়া উচিত, ভূমির ব্যবহার কেমন হবে, অপরকে নির্যাতন না করে কিভাবে নিজের চেষ্টায় কর্ষণ করা যায়, বিদেশীদের এবং পশুদের প্রতি আচরণ কি রকম হওয়া উচিত এবং মানুষের জীবনের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ আরও অনেক কিছু। প্রকৃত বিজ্ঞান চিরকালই এই প্রকার এবং তা এই রকমই হওয়া উচিত। আমাদের যুগে এই পর্যায়ের বিজ্ঞানেরই অভ্যুদয় ঘটেছে। কিন্তু একদিকে সমাজের স্থিতাবস্থায় সমর্থক বৈজ্ঞানিকদের দ্বারা এই প্রকৃত বিজ্ঞান অস্বীকৃত এবং খন্ডিত, অপরদিকে পরীক্ষামূলক বিজ্ঞান-সাধকদের নিকট এই ধরনের বিজ্ঞান অন্তঃসারশূন্য, অপ্রয়োজনীয় এবং অবৈজ্ঞানিক বলে বিবেচিত।

উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, গির্জা-মতবাদ বর্তমানে যে অপ্রচলিত এবং অবাস্তব তা দেখাবার জন্য বিভিন্ন গ্রন্থ এবং উপদেশসমূহের আবির্ভাব ঘটছে যাতে আমাদের যুগোযোগী যুক্তিগ্রাহ্য, ধর্মীয় উপলব্ধিকে স্বচ্ছভাবে ব্যাখ্যা করবার প্রয়োজনীয়তার কথাও বলা হচ্ছে। যে অধিবিদ্যাকে প্রকৃত বিজ্ঞান মনে করা হয়, তা কেবলমাত্র এ সমস্ত গ্রন্থকে খন্ডন করবার কাজে ব্যাপৃত এবং যে সমস্ত কুসংস্কার দীর্ঘকাল থেকে অপ্রচলিত এবং বর্তমানে অর্থহীন, সেগুলির সমর্থন এবং যৌক্তিকতা প্রতিপাদনে এই অধিবিদ্যায় মানববুদ্ধিকে পুনঃ পুনঃ নিয়োগ করা হচ্ছে। অথবা ধরুন, একটি ধর্মদেশনার আবির্ভাব ঘটল-যাতে বলা হচ্ছে, ভূমির ব্যক্তিগত মালিকানা অন্যায় এবং ভূমিসংক্রান্ত ব্যক্তিগত মালিকানার প্রতিষ্ঠানটি জনসাধারণের দারিদ্র্যের মুখ্য কারণ। স্বভাবতই প্রকৃত বিজ্ঞানের কর্তব্য, এ রকম ধর্মদেশনাকে স্বাগত জানানো এবং এই প্রতিপাদ্য থেকে আরও কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। কিন্তু আমাদের যুগের বিজ্ঞান এই ধরনের কিছুই করে না : পরন্তু রাষ্ট্রনৈতিক-অর্থনীতি বিপরীত সিদ্ধান্তের নির্দেশ দেয়। যেমন, অপরাপর সব রকমের সম্পত্তির মতো ভূমিজ সম্পত্তিও খুব স্বল্প সংখ্যক মালিকের হাতে উত্তরোত্তর অধিক পরিমাণে অবশ্যই কেন্দ্রীভূত হওয়অ উচিত। আবার অনুরূপভাবে কেউ মনে করতে পারেন, প্রকৃত বিজ্ঞানের কাজ হল যুদ্ধ এবং হত্যার অযৌক্তিকতা, লাভহীনতা এবং অনৈতিকতা প্রদর্শন করা, অথবা বেশ্যাবৃত্তির অমানবিকতা এবং অনিষ্টকারিতা, অথবা মাদকদ্রব্য ব্যবহার এবং পশুমাংস ভক্ষণের চরম বুদ্ধিহীনতা, অনিষ্টকারিতা এবং অনৈতিকতা প্রদর্শন, অথবা স্বাদেশিকতার অযৌক্তিকতা, অনিষ্টকারিতা অথবা সেকেলে মনোভাব প্রদর্শন। যদিও এ ধরনের গ্রন্থের অস্তিত্ব বিদ্যমান আছে, তথাপি সেগুলি সবই অবৈজ্ঞানিক বলে বিবেচিত অপরপক্ষে যে সমস্ত গ্রন্থ এ সব ব্যাপারের ওচিত্য প্রমাণের উদ্দেশ্যে রচিত এবং যার লক্ষ্য মানবজীবনের সঙ্গে সম্পর্কহীন শুধুমাত্র অলস জ্ঞানতৃষ্ণার পরিতৃপ্তি-তাকেই বৈজ্ঞানিক বলে বিবেচিত করা হয়।

প্রকৃত লক্ষ্য থেকে আমাদের যুগের বিজ্ঞান যেভাবে বিচ্যুত হয়েছে কতিপয় বিজ্ঞানী- উপস্থাপিত আদর্শের সাহায্যে তা উজ্জ্বলভাবে দেখানো যেতে পারে এবং অধিকাংশ বৈজ্ঞানিক মনোভাবাপন্ন মানুষই সে আদর্শকে অস্বীকার না করে বরং স্বীকৃতি জানিয়েছেন।

এক হাজার বা তিন হাজার বৎসর পরে পৃথিবীর রূপ কি হবে তার বর্ণনা দিয়ে মুর্খতাপূর্ণ ফ্যাশনবিলাসী গ্রন্থে এ সমস্ত আদর্শের শুধু যে অভিব্যক্তি দেওয়া হয়েছে তা নয়, যে সমস্ত সমাজতাত্ত্বিক নিজেদের চিন্তাশীল বিজ্ঞান-চেতনাসম্পন্ন মানুষ বিবেচনা করেন, তারাও এরূপ আদর্শ প্রচার করেছেন। এই আদর্শগুলি হল, কৃষিকার্য দ্বারা ভূমি থেকে খাদ্য প্রাপ্তির পরিবর্তে খাদ্য তৈরি হবে রসায়নাগারে, এবং প্রাকৃতিক শক্তির সদ্ব্যবহারের সাহায্যে মানবিক শ্রমকে প্রায় সম্পূর্ণভাবে বাতিল করা যাবে। বর্তমানের মতো ভবিষ্যতের মানুষ পোষা মুরগির ডিম খাবে না, কিংবা নিজের ক্ষেতের শস্যজাত পাউরুটি খাবে না, অথবা তার বাগানের গাছের আপেল খাবে না,-যে গাছে ফুল ফোটা থেকে ফল সুপক্ক হওয়া পর্যন্ত সে নিজে চোখে দেখেছে; বরং যে খাদ্য গবেষণাগারে সংযুক্ত শ্রমের সাহায্যে প্রস্তুত হয়, এবং যে শ্রমের খুব ক্ষুদ্র পরিমাণ অংশমাত্র সে বহন করে-সেই স্বচ্ছ পুষ্টিকর খাদ্য সে আহার করবে। ভবিষ্যতে মানুষের পরিশ্রম করবার প্রায় প্রয়োজনই হবে না এবং বর্তমানে অভিজাত প্রশাসক শ্রেণীর মানুষ যে আলস্যের স্রোতে গা ঢেলে দেয়, তেমনি সকল মানুষই সে আলস্য-বিলাসে সমর্থ হবে।

আমাদের যুগের বিজ্ঞান কি পরিমাণে সত্যপথ-বিচ্যুত-এ সব আদর্শের মধ্যে তা যেমন স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান, তেমন আর কিছুতে নয়।

আমাদের যুগের অধিকাংশ মানুষ উত্তম এবং সুপ্রচুর খাদ্য পায় না (বাসগৃহ, পোশাক পরিচ্ছদ এবং জীবনের প্রাথমিক প্রয়োজনীয় বস্তুও পায় না)। অধিকাংশ মানুষ নিজস্ব স্বার্থের হানি হওয়া সত্ত্বেও ক্রমাগতই শক্তির অতীত পরিশ্রম স্বীকারে বাধ্য হয়। এই উভয় অমঙ্গলকে খুব সহজেই অপসারিত করা সম্ভব পারস্পরিক দ্বন্দ্ব, বিলাসিতা, এবং অন্যায় বিত্ত বন্টন-এক কথায় মিথ্যা অনিষ্টকর সমাজবিন্যাস বাতিল করে একটা যুক্তিপূর্ণ মানবিক জীবনরীতি প্রতিষ্ঠার সাহায্যে। কিন্তু বিজ্ঞান প্রচলিত সমাজবিন্যাসকে গ্রন্থগুলির গতির মতো অপরিবর্তনীয় বিবেচনা করে, এবং সে কারণে এরূপ ধঅরণাও করে যে, বিজ্ঞানের কাজ এ ভ্রান্ত সমাজ-ব্যবস্থাকে বিশদ করা নয়, এবং একটা নতুন যুক্তিপূর্ণ জীবনরীতির আয়োজনও নয়,-বরং প্রচলিত সমাজ-ব্যবস্থার মধ্যেই সমস্ত লোকের আহার সংস্থান করা এবং দুষিত প্রশাসক শ্রেণীর তুল্য জীব, যাপনরত সকলের পক্ষেই অলস জীবন যাপন সম্ভব করে তোলা।

ইতোমধ্যে এঁরা ভুলে গেছেন যে, নিজের শ্রমের দ্বারা ভূমি থেকে প্রাপ্ত শস্য, সজি এবং ফল দ্বারা যে পুষ্টি লাভ করা যায় এবং পুষি।ট সব চাইতে আনন্দদায়ক, স্বাস্থকর, সহজতম এবং সর্বাপেক্ষা স্বাভাবিক পুষ্টিকর এবং পেশীসমূহের ব্যবহার জীবনধারণের পক্ষে নিশ্বাস-প্রশ্বাসের সাহায্যে রক্তের মধ্যে অক্সিজেন সঞ্চারিত করার মতো সমান প্রয়োজনীয়।

সম্পত্তি এবং শ্রম বিভাজনকে অক্ষুণ্ণ রেখে রাসায়নিক উপায়ে প্রস্তুত খাদ্যের দ্বারা মানুষের উত্তম পুষ্টির ব্যবস্থা করা এবং প্রাকৃতিক শক্তির দ্বারা মানুষের কাজ করিয়ে নেওয়ার উপায় উদভাবন, অনেকটা বদ্ধ দূষিত বায়ুপূর্ণ ঘরে অবস্থিত কোন ব্যক্তির ফুসফুসে অক্সিজেন পাম্প করার উপায় উদ্ভাবনের মতো-যখন ওই বদ্ধ ঘরে আর বন্ধ হয়ে না থাকাটাই সে ব্যক্তির পক্ষে একমাত্র প্রয়োজনীয়।

উদ্ভিদ এবং পশুজগতে খাদ্য উৎপাদনের জন্য এমন একটা রসায়নাগারের ব্যবস্থা আছে-যা কোন অধ্যাপকের পক্ষেও অতিক্রমসাধ্য নয়। এই রসায়নাগারের উৎপাদন- সম্ভোগ এবং তাতে অংশ গ্রহণের জন্য মানুষের একমাত্র যা করণীয় তা হল, চির- আনন্দময় প্রবর্তনার কাছে আত্মসমর্পণ-যার অভাবে মানুষের জীবন যন্ত্রণা-বিশেষ। কিন্তু আশ্চর্যের সঙ্গে এটা লক্ষ্য করা যায়, আমাদের যুগের বিজ্ঞানীর মানুষের ভোগের জন্য সবস্তু সম্ভোগে সমস্ত বিঘ্নকে সর্বশক্তির সাহায্যে উৎপাদন আত্মনিয়োগ না করে সেই ব্যবস্থাকে অপরিবর্তনীয় বলে মেনে নেয়। আনন্দের সঙ্গে কাজ এবং ভূমিজাত ভোজ্য আহরণের দ্বারা জীবন-বিন্যাসের পরিবর্তে তারা এমন উপায় উদ্ভাবন করে-যা তাদের কৃত্রিম গর্ভস্রাবে পরিণত করবে। এটা মানুষকে বদ্ধ অবস্থা থেকে মুক্ত বাতাসে আনয়নের জন্য সহায়তা নয়, বরং তৎপরিবর্তে এমন উপায়ের উদ্‌ভাবন-যার সাহায্যে তার দেহে প্রয়োজনীয় পরিমাণ অক্সিজেন প্রবাহিত করা যায় এবং এমন ব্যবস্থা করা যাতে গৃহে বসবাসের পরিবর্তে সে শ্বাসরোধকারী ক্ষুদ্র কক্ষে বাস করতে বাধ্য হয়। বিজ্ঞান ভ্রান্ত পথে না গেলে এ ধরনের মিথ্যা আদর্শের অস্তিত্ব থাকতে পারত না।

তথাপি শিল্প-সঞ্চারিত অনুভূতিগুলির বিকাশ বিজ্ঞানসৃষ্ট ভিত্তির ওপর।

কিন্তু ভ্রান্ত পথে পরিচালিত এই বিজ্ঞান কোন্ অনুভূতি উদ্রেক করতে সমর্থ? এই বিজ্ঞানের একাংশ অপ্রচলিত ও মানবজাতি-নিঃশেষিত এমন অনুভূতি উদ্রিক্ত করে- আমাদের যুগে বা অশুভ এবং ব্যকিক্রমী। বিজ্ঞানের অপর দিক মানব জীবন-স্বভাবের সঙ্গে সম্পর্কহীন বিষয়ের সমীক্ষায় ব্যাপৃত-যা আপন স্বভাবের নিয়মেই শিল্পের ভিত্তি হিসেবে গণ্য হতে পারে না।

সুতরাং প্রকৃত শিল্পনামধেয় হবার জন্যে আমাদের যুগের শিল্পকে হয়তো বিজ্ঞান- নিরপেক্ষভাবে নিজস্ব পথ খুঁজে নিতে হবে, অথবা এমন বিজ্ঞান থেকে অবশ্যই পথনির্দেশ নিতে হবে-যা বিজ্ঞানের রক্ষণশীল দল দ্বারা অস্বীকৃত। এবং শিল্প-যেখানে তা অংশতও সার্থক-এরূপ কওে থাকে।

এটা আশা করা যেতে পারে, শিল্প সম্পর্কীয় যে কাজ আমি করতে প্রয়াসী হয়েছি, বিজ্ঞানের জন্যও তা করণীয়। ‘বিজ্ঞানের জন্যই বিজ্ঞান’-এ মতবাদের ভ্রান্তি প্রদর্শিত হবে। খ্রীষ্টীয় উপদেশকে প্রকৃত অর্থে স্বীকারের প্রয়োজনীয়তাকে পরিষ্কারভাবে দেখিয়ে দিতে হবে এবং সেই উপদেশের ভিত্তিতে যে জ্ঞানের অধিকারী বলে আমরা এত গর্বিত, তার পুনমূল্যও নির্ধারণ করতে হবে। পরীক্ষামূলক বিজ্ঞানের গৌণ স্বভাব এবং অকিঞ্চিতকরতা, ধর্মীয়, নৈতিক এবং সামাজিক জ্ঞানের প্রাধান্য এবং গুরুত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে হবে; এবং এরূপ জ্ঞান বর্তমান কালের মতো কেবল অভিজাত শ্রেণীর মানুষের দ্বারাই পরিচালিত হবে না বরং সকল মুক্ত সত্যপ্রেমী ব্যক্তির নিকট প্রধান আগ্রহের বিষয়ে পরিণত হবে-সেই পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গের নিকট যারা অভিজাত শ্রেণীর সাহায্য ব্যতিরেকে সর্ব সময়ে প্রকৃত জীবন-বিজ্ঞানকে অগ্রসর করে দিয়েছেন।

জ্যোতির্বিদ্যাবিষয়ক, পদার্থবিদ্যাবিষয়ক, রাসায়িক এবং জীববিদ্যা সম্পৰ্কীয় বিজ্ঞান, এমনকি প্রযুক্তিবিদ্যা এবং চিকিৎসা-বিজ্ঞানের পাঠও কেবলমাত্র ততখানি নিতে হবে যতখানি তা মানবাজাতিকে ধর্মীয়, আইন-আদালতের এবং সামাজিক বঞ্চনা থেকে মুক্ত করার উপযোগী, অথবা যা কোন এক শ্রেণীর মঙ্গলবিধয়াক না হয়ে সর্বমানবের মঙ্গলবিধানে সমর্থ।

একমাত্র তখনই বিজ্ঞান বর্তমান স্বভাবধর্ম থেকে মুক্ত হবে-বা একদিকে প্রচলিত জীর্ণ সমাজবিন্যাস পরিপোষণের জন্য ভ্রান্ত যুক্তিজাল মাত্র এবং অপর দিকে যা জালগোল- পাকানো নানা অসম্বন্ধ জ্ঞানের সমাহার-যে জ্ঞান অধিকাংশত যৎসামান্যই মঙ্গলবিধায়ক নয়। এর স্থলে বিজ্ঞান হয়ে উঠবে সুন্দর অবয়ব-বিশিষ্ট, প্রাণবান ঐক্যময় সমগ্রতা-যা সর্বজনবোধগম্য হবে, অর্থাৎ যা আমাদের যুগের ধর্মীয় উপলব্ধিসঞ্জাত সত্যকে মানবচৈতন্যের সঙ্গে যুক্ত করবে।

এবং একমাত্র তখনই শিল্প-যা সর্বদাই বিজ্ঞানের ওপর নির্ভরশীল-জীবন ও মানবপ্রগতির পক্ষে বিজ্ঞানের মতই সমান তাৎপর্যপূর্ণ বাহনে পরিণত হবে এবং এরূপই হওয়া উচিত।

শিল্প কোন সুখ নয়, সান্ত্বনা নয়, কিংবা আমোদও নয়। শিল্প একটি মহৎ ব্যাপার। শিল্প মানবজীবনের এমন একটি অঙ্গ-যা মানুষের যুক্তিনির্ভর উপলব্ধিকে অনুভূতিলোকে সঞ্চারিত করেছে। আমাদের যুগে মানুষের সাদারণ ধর্মীয় উপলব্ধিকে বলা যায় মানবভ্রাতৃত্বের চেতনা-আমরা জানি, প্রতিবেশীর সঙ্গে মিলনের মধ্যেই মানুষের মঙ্গল নিহিত। বিভিন্ন পদ্ধতি প্রয়োগের সাহায্যে এ চেতনাকে কিভাবে জীবনের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যায়-যথার্থ বিজ্ঞানের উচিত তার নির্দেশ দেওয়া। এই উপলব্ধিকে আবেগে রূপান্ত রিত করাই শিল্পের কর্তব্য।

শিল্পের কর্তব্যকর্ম সুবৃহৎ। আইন-আদালত, পুলিশ, দাতব্য প্রতিষ্ঠানসমূহ, কারখানা পরিদর্শন প্রভৃতি বাহ্যিক উপায়গুলির সাহায্যে যে শান্তিময় সামাজিক সহাবস্থান বর্তমানে বজায় রাখা হয়-প্রকৃত শিল্পপ্রভাবের মাধ্যমে, বিজ্ঞানের সাহায্যে, ধর্মের নির্দেশে মানুষের মুক্ত এবং আনন্দময় ক্রিয়াকলাপের সহায়তায় তা আয়ত্ত, করা উচিত। শিল্প হিংসাকে বিদূরিত করবে।

একমাত্র শিল্পের দ্বারাই এটা সাধিত হওয়া সম্ভব।

বলপ্রয়োগ এবং শান্তিনিরপেক্ষভাবে যা কিছুই আমাদের বর্তমান সমাজজীবনকে সম্ভব করে তুলেছে (এবং ইতোমধ্যেই আমাদের জীভনযাত্রায় যা একটা বড় অংশ অধিকার করে আছে)-তার সবই শিল্পের দ্বারাই সাধিত হয়েছে। যখন শিল্পের দ্বারাই এই শিক্ষা অনুপ্রবিষ্ট হয়েছে যে, ধর্মীয় বিষয়, পিতামাতা, সন্তান-নন্ততি, স্ত্রী, আত্মীয়-কুটুম্ব, অপরিচিত ব্যক্তি ও বিদেশীয়দের সঙ্গে কিরূপ ব্যবহার করা উচিত, বয়োজ্যেষ্ঠ এবং উপরিস্থদের সঙ্গে আচরণে কোন্ পন্থা অনুসরণীয়, যন্ত্রণাপীড়িত ও শত্রুদের সঙ্গে এবং পশুদের সঙ্গে তাদের ব্যবহার কি রকম হওয়া উচিত এবং শুধুমাত্র বলের দ্বরা প্রভাবিত না হয় লক্ষ কোটি মানুষ এর দ্বাবা বংশানুক্রমে এটা মেনে চলেছে, এবং এমন দৃঢ়ভাবে মেনে চলেছে যে, একমাত্র শিল্প-মাধ্যম ছাড়া এ ধরনের রীতিনীতিগুলিকে আর কোন কিছুর সাহায্যে বিচলিত করা সম্ভব নয়। তাহলে অনুরূপভাবে শিল্পের সাহায্যেই আমাদের যুগের ধর্মীয় উপলব্ধির সঙ্গে আরও বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ অপরাপর রীতিনীতিও আবির্ভূত হতে পারে। শিল্প যদি মূর্তির প্রতি, যীশুখ্রীষ্টের নৈশভোজের প্রতি, এবং রাজার ব্যক্তিত্বের প্রতি শ্রদ্ধার আবেগ সঞ্চারে সমর্থ হয়ে থাকে, সহযোগীর প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার জন্য ঘৃণার ভাব জাগ্রত করে, পতাকার উদ্দেশ্যে ভক্তিভাব, কোন অপমানের জন্য প্রতিহিংসার প্রয়োজনীয়তা, স্বীয় সম্মান অক্ষুণ্না রাকার জন্য কর্তব্যবোধ অথবা স্বদেশের জন্য গৌরববোধ সঞ্চারিত করে থাকে,-তবে সে একই শিল্প প্রতিটি ব্যক্তির মানবিক মর্যাদা এবং প্রতিটি প্রাণীর জীবনের প্রতি শ্রদ্ধার ভাব জাগ্রত করতেও সক্ষম। বিলাসিতা, হিংসা ও প্রতিহিংসা এবং অপরের প্রয়োজনীয় বস্তুকে নিজস্ব আনন্দ উপভোগের উদ্দেশ্যে ব্যবহারের জন্য মানুষের মনে লজ্জার অনুভূতিও সৃষ্টি করতে পারে শিল্প। এ ছাড়া শিল্প মানুষকে স্বেচ্ছায়, আনন্দিত অন্তরে এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে মানবসেবায় আত্মবিসর্জনে উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম।

শিল্পের করণীয় হল, সমাজের একমাত্র সর্বোত্তম ব্যক্তিদের উপলব্ধ ভ্রাতৃত্ব এবং প্রতিবেশীদের প্রতি ভালোবাসার অনুভূতিকে সর্বমানবের মধ্যে অভ্যস্ত সংবেদনার এবং সহজাত প্রবৃত্তিতে পরিণত করা। কল্পিত পরিস্থিতিতে ভ্রাতৃত্ব এবং ভালোবাসার অনুভূতি জাগ্রত কর ধর্মীয় শিল্প মানুষকে বাস্তব জীবনে একই পরিস্থিতিতে একই অনুভূতি অর্জনের প্রশিক্ষণ দেবে। মানুষের অন্তরে সেই শিল্প এমন স্থায়ী সংস্কার সৃষ্টি করবে-যার বলে শিল্পপরিশীলিত ব্যক্তির কার্যাবলী অতি সহজে নিয়ন্ত্রিত হবে। সর্বজনীন শিল্প এভাবে বিচ্ছিন্নতাকে উন্মলিত করে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির মানুষকে একই সাধারণ অনুভূতি-সূত্রে গ্রথিত করবে। মানুষকে মিলনের শিক্ষা দেবে, এবং যুক্তির সাহায্য ব্যতিরেকে স্বয়ং জীবনের দ্বারাই জীবন-নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রমী সর্বজনীন মিলনের আনন্দের সন্ধান দেবে।

যে মানবমঙ্গল মানবমিলনের মধ্যে নিহিত, আমাদের যুগে শিল্প -নিয়তি যুক্তির রাজ্য থেকে অনুভূতির রাজ্যে সে সত্যকে সঞ্চারিত করবে। শিল্পের লক্ষ্য হবে প্রচলিত বলের শাসনের পরিবর্তে ভাবগত অর্থাৎ প্রেমের রাজ্যসংস্থাপন -যে প্রেম মানবজীবনের মহত্তম লক্ষ্য বলে সর্ব-স্বীকৃত।

বিজ্ঞানও সম্ভবত ভবিষ্যতে শিল্পের সামনে নবতর এবং উচ্চতর আদর্শ অনাবৃত করতে পারে-যা শিল্পীর দ্বারা আয়ত্তগম্যও হতে পারে। আমাদের যুগে শিল্পনিয়তি সুস্পষ্ট এবং সুনির্দিষ্ট। খ্রীষ্টীয় শিল্পের কাজ হল,-সমস্ত মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্বসুলভ মিলনের প্রতিষ্ঠা।

পরিশিষ্ট

What is Art?- এর ত্রয়োদশ অধ্যায়ে উল্লেখিত ওয়াগ্নার-এর Nibelungen Ring’- এর বিষয়বস্তু হল এইঃ

প্রথম অংশে বর্ণনা আছে যে, রাইন নদীর কন্যা জলপরীরা কোন কারণে রাইন নদীর সোনা পাহারা দিতে দিতে গান করে : Weia, Waga, Woge du Welle, Walle zur Weige, Wagalaweia, Wallala, weila. Weia ইত্যাদি।

একজন বামন এই সংগীতরতা পরীদের ধরবার উদ্দেশ্যে তাদের পশ্চাদ্ধাবন করল। বামন তাদের কাউকেও ধরতে পারে না। তখন সোনা পাহারারতা পরীরা-যা তাদের গোপনীয় রাখা উচিত, সেই কথা বামনটিকে বলল। সেটি হল, যদি কেউ ভালোবাসা বিসর্জন দেয়, তাহলে তাদের সংরক্ষিত সোনা সে অপহরণে সক্ষম হবে। বামনটি তখন ভালোবাসা বিসর্জন দেয় এবং সোনা অপহরণ করে।

এখানেই প্রথম দৃশ্যের সমাপ্তি।

দ্বিতীয় দৃশ্যে দেখা যায়, তাদেরই জন্য দৈত্যদের দ্বারা নির্মিত একটি দুর্গের দৃষ্টিসীমার মধ্যে একজন দেবতা এবং একজন দেবী মাঠে শায়িত। অচিরেই তারা জেগে ওঠে এবং দুর্গটি দেখে খুশি হয়। এবং তারা বলে যে, এ কাজের মূল্য হিসেবে তারা দেবী ফ্রেইয়াকে (Freia) অবশ্যই দৈত্যদের কাছে সমর্পণ করবে। দৈত্যেরা সেই মূল্য গ্রহণের জন্য এল। কিন্তু দেবতা উওটান (Wotan) ফ্রেইয়াকে দান করতে আপত্তি করে। দৈত্যেরা ক্রুদ্ধ হয়। দেবতারা শোনে যে সেই বামন রাইনের সোনা চুরি করেছে। তারা প্রতিজ্ঞা করে যে, ওই সোনা তারা দখল করবে এবং তারা দ্বারা দৈত্যদের প্রাপ্য মিটিয়ে দেবে। কিন্তু দৈত্যেরা তাদের বিশ্বাস করল না, এবং জামিন স্বরূপ দেবী ফ্ৰেইয়াকে আটকে রাখল।

তৃতীয় দৃশ্যের ঘটনা-স্থান ভূগর্ভে। এলবেরিখ (Alberich) নামে সোনাচোর সেই বামনটি কোন কারণে মিমে (Mime) নামক আর একজন বামনকে প্রহার করল এবং তার শিরস্ত্রাণটি নিয়ে নিল। সেই শিরস্ত্রাণের দ্বিবিধ ক্ষমতা ছিল : মানুষকে অদৃশ্য করা এবং পশুতে পরিণত করা। উওটান এবং অন্যান্য দেবতারা উপস্থিত হল এবং নিজেদের মধ্যে এবং বামন দুটির মধ্যে ঝগড়া করে এবং সোনাটা দখল করতে চায়। কিন্তু এলবেরিখ তা ছাড়বে না (এবং বইয়ের আগাগোড়া সকলের মতো) এমনভাবে ব্যবহার করে, যাতে তার নিজের ধ্বংস অনিবার্য হয়ে ওঠে। শিরস্ত্রাণ মাথায় দিয়ে প্রথমে সে একটি ড্রাগন, তারপর কুনো ব্যাঙে পরিণত হয়। দেবতারা কুনো ব্যাটিকে ধরে শিরস্ত্রাণটি কেড়ে নেয় এবং এলবেরিখকে তাদের সঙ্গে ধরে নিয়ে যায়।

চতুর্থ দৃশ্য। দেবতারা এলবেরিখকে নিজেদের গৃহে এনে হুকুম করে, -সমস্ত সোনা নিয়ে আসবার জন্যে সে যেন তার বামনদের নির্দেশ দেয়। বামনেরা সোনা নিয়ে আসে। এলবেরিখ সোনা দিয়ে দিলেও একটি ঐন্দ্রজালিক আংটি রেখে দেয়। দেবতারা আংটিটি নিয়ে নেয়। তখন এলবেরিখ আংটিটিকে এই বলে অভিশাপ দেয় যে, তা যেন তার যে কোন মালিকের দুর্ভাগ্যের কারণ হয়। দৈত্যেরা আসে। তারা দেবী ফ্রেইয়াকে আনে এবং তার মুক্তিপণ দাবি করে। তারা ফ্রেইয়ার উচ্চতার মাপে কতকগুলি কাষ্ঠদন্ড পোঁতে এবং ওই কাষ্ঠদন্ডগুলির মধ্যবর্তী স্থলে সোনা ঢালা হয় : এটাই হবে তার সে মুক্তিপণ। অপর্যাপ্ত সোনা না থাকায় ওই শিরস্ত্রাণটিকেও স্বর্ণস্তূপের মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়, এবং তারা ওই আংটিও দাবি করে। উওটান তা দিতে অস্বীকার করে। কিন্তু দেবী এরডা (Erda) আবির্ভূত হন এবং তাকে আংটিটি দিয়ে দেবার নির্দেশ দেন, যেহেতু তা দুর্ভাগ্য আনয়ন করবে। তখন উওটান তা দিয়ে দেয়। ফ্রেইয়া মুক্ত হয়। দৈত্যেরা আংটি পেয়ে নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করে এবং তাদের মধ্যে একজন অপরকে হত্যা করে। এখানেই প্রস্তাবনার শেষ এবং আমরা উপস্থিত হই প্রথম দিনটিতে।

এ দৃশ্যে দেখা যায় বৃক্ষের ওপর একটি গৃহ। ক্লান্ত সীড্ (Sigmund) দৌড়ে প্রবেশ করে এবং শুয়ে পড়ে। সে বাড়ির কর্ত্রী [এবং হুনডিং (Hunding)-এর স্ত্রী সীগলিন্ডা] তাকে একটি মাদক পানীয় দিলে তারা পরস্পর প্রেমে পড়ে। সীগলিন্ডার স্বামী বাড়ি আসে। জানতে পারে সীগমুন্ড বৈরী জাতির অন্তর্গত ব্যক্তি এবং পরের দিন তার সঙ্গে যুদ্ধ করতে চায়। কিন্তু সীগলিন্ডা স্বামীকে মাদকের সাহায্যে অভিভূত করে এবং সীন্দ্রে কাছে আসে। সীগমুন্ড্ আবিষ্কার করে যে সীগলিন্ডা তারই আপন ভগ্নী এবং তার পিতা একটি গাছের মধ্যে একটি তরবারি প্রবিষ্ট করেছিলেন যাতে কেউ তা বের করতে সমর্থ না হয়। সীগমুড্ তরবারিটিকে টেনে বার করে এবং নিজের বোনের সঙ্গে যৌন সংসর্গ করে।

দ্বিতীয় অঙ্ক। হুনডিং-এর সঙ্গে সীগমুন্ডের যুদ্ধ হবে। কাকে বিজয়মাল্য দিয়ে পুরস্কৃত করা যায়, দেবতারা এ প্রশ্ন আলোচনা করেন। উত্তটার বোনের সঙ্গে সীগমুন্ডের যৌন সম্পর্কে সমর্থন করে তাকে রক্ষা করতে চায়, কিন্তু তার স্ত্রী ফ্রিকা-র (Frica) চাপে পড়ে সে ভালকিরী ব্রুনহিল্ডাকে (Valkyrie Brurchilda) সীগমুডন্ডকে হত্যার আদেশ দেয়। সীগমুন্ড যুদ্ধ করতে যায়। সীগলিন্ডা মুচ্ছ প্রাপ্ত হয়। ব্রুনহিল্ডা আবির্ভূত হয় এবং সীগমুন্ডকে হত্যা করতে ইচ্ছা করে। সীগমুন্ড সীগলিন্ডাকেও হত্যা করতে চায়। কিন্তু ব্রুনহিল্ডা তা অনুমোদন করে না এবং সীগমুন্ড হুনডিং-এর সঙ্গে যুদ্ধ করে। ব্রুন হিল্ডা সীগমুন্ডের পক্ষ সমর্থন করে, কিন্তু হুনডিং-কে রক্ষা করে উওটান। সীগমুন্ডের তরবারি ভগ্ন হয় এবং সে নিহত হয়। সীগলিন্ডা দৌড়ে পালায়।

তৃতীয় অঙ্ক। ভালকিরীজেরা (Valkyries – দৈবী রণরঙ্গিনীররা) রঙ্গমঞ্চে আসে। ভালকিরী ব্রুনহিলডা সীগমুন্ডের দেহ সঙ্গে নিয়ে আসেন। অবাধ্যতার জন্য উওটান তার পশ্চাদ্ধাবন করেছে বলে সে পলায়নপর। উওটান তাকে ধরে ফেলে এবং শাস্তি হিসেবে ভালকিরীর পদ থেকে তাকে অপসারিত করে। সে তার ওপর একটি মন্ত্রজালও প্রয়োগ করে-যার প্রভাবে তাকে ঘুমাতে হয় এবং না জাগানো পর্যন্ত সে ঘুমাতে থাকে। যখন কোন ব্যক্তি তাকে জাগাবে সে তার প্রেমে পড়বে। উওটান তাকে চুম্বন করে: সে ঘুমিয়ে পড়ে। উওটান আগুন উদ্গীরণ করে-যা ব্রুনহিল্ডাকে ঘিরে ফেলে।

এরপর দ্বিতীয় দিন। বামন মিমে (গরসব) বনের মধ্যে এককানি তরবারি ঢালাই করে। সীফ্রড্‌ দেখা দেয়। সে হল ভ্রাতা ও ভগ্নীর যৌন সংসর্গজাত (সীগমুন্ড ও সীলিন্ডার) সন্তান। বামন কর্তৃক সে এই বলে লালিত-পালিত হয়েছে। সাধারণভাবে বলতে হয়, এই রচনার প্রত্যেকের ক্রিয়াকর্মের উদ্দেশ্যে দুর্বোধ্য। সীগফ্রীড় তার জন্মের উৎস জানতে পারে। এ কথাও জানতে পারে যে, ভাঙা তলোয়ারখানি তার পিতার। সে মিমকে সেটি আবার ঢালাই করতে আদেশ দেয় এবং তারপরে চলে যায়। উওটান একজন পথিকের ছদ্মবেশে এস যা সংঘটিত হবে তা বর্ণনা করে : যে ব্যক্তি ভয় কাকে বলে জানে না, সে-ই তরবারিটিকে ঢালাই করতে পারবে এবং সকলকে পরাজিত করবে। বামন সীফ্রিডকে সে ব্যক্তি বলে অনুমান করে এবং তাকে বিষ প্রয়োগ করতে চায়। সীফ্রিড্ ফিরে এসে পিতার তরবারি ঢালাই করে, এবং ‘হেই হো! হেই হো! হেই হো! হো! হো! হো হো! হেই!’ -এরূপ চীৎকার করতে করতে দৌড়ে বেরিয়ে যায়।

এবার আমরা তৃতীয় অঙ্কে এসে পড়ি। এলবেরিখ একটি দৈত্যের পাহারায় উপবিষ্ট। সেই দৈত্যটি ড্রাগনের রূপ ধারণ করে তার প্রাপ্ত সোনা পাহারা দিচ্ছে। উওটান আবির্ভূত হয় এবং কোন অজ্ঞাত কারণে ভবিষ্যদ্বাণী করে যে, সীগফ্রিড্ আসবে এবং ওই ড্রাগনকে হত্যা করবে। এলবেরিখ ড্রাগনকে জাগিয়ে আংটিটি চায় এবং সীফ্রিড্ থেকে তাকে রক্ষার প্রতিশ্রুতি দেয়। ড্রাগন কোন মতে আংটিটি হাতছাড়া করবে না। এলবেরিখ নিষ্ক্রান্ত হয়। মিমে এবং সীফ্রিড্ উপস্থিত হয়। মিমে আশা করে, ড্রাগন সীফ্রিকে ভয় করতে শিক্ষা দেবে। কিন্তু সীফ্রিড্ ভয় করে না। সে মিমেকে বিতাড়িত করে ড্রাগনকে হত্যা করে। এর পর সে ড্রাগনের রক্তে রঞ্জিত নিজের আঙুল নিজের ঠোঁটের ওপর রাখে। এটা তাকে মানুষের গোপন চিন্তা ও পাখিদের ভাসা জানতে সক্ষম করে। পাখিরা সঞ্চিত সম্পদ এবং আংটি কোথায় তা তাকে বলে দেয়, একথাও জানায়, মিমে তার ওপর বিষ প্রয়োগ করতে চায়। মিমে ফিরে আসে এবং উচ্চৈঃস্বরে সীফ্রিড়ে ওপর বিষ প্রয়োগের ইচ্ছা প্রকাশ করে। এ কথার তাৎপর্য হল, ড্রাগনের রক্তের স্বাদ গ্রহণ করে সীফ্রিড্‌ মানুষের গোপন চিন্তা বুঝতে পারে। মিমের অভিপ্রায় জানতে পেরে সীফ্রিড্‌ তাকে হত্যা করে। পাখিরা সীফ্রিকে ব্রুনহিল্ডার অবস্থানের কথা জানালে সীফ্রিড্ তার অনুসন্ধানে যায়।

তৃতীয় অঙ্ক। উওটান এরডাকে (Erda) আহ্বান করে। এরডা উওটানের নিকট ভবিষ্যদ্বাণী করে এবং তাকে উপদেশ দেয়। সীফ্রিড্‌ আবির্ভূত হয়ে উওটানের সঙ্গে কলহ এবং যুদ্ধ করে। হঠাৎ সীফ্রিড়ে তরবারি সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী বলে স্বীকৃত উওটানের বর্শা ভেঙে দেয়। সীফ্রিড্‌ আগুনের মধ্য দিয়ে ব্রুনহিল্ডার কাছে গিয়ে তাকে চুম্বন করে। সে জেগে ওঠে। তার দৈবীসত্তা পরিত্যাগ করে সীফ্রিড়ের বাহুর মধ্যে নিজেকে আত্মসমর্পণ করে।

তৃতীয় দিন। প্রস্তাবনা। তিনজন নিয়তি-চরিত্র একটি সোনার দড়ি বিনুনি করে ভবিষ্যৎ বিষয়ে আলোচনা করে। তারা চলে যায়। সীফ্রিড্‌ এবং ব্রুনহিল্ডা আবির্ভূত হয়। সীফ্রিড্‌ ব্রুনহিলডার নিকট থেকে বিদায় নিতে গিয়ে তাকে আংটিটি দেয় এবং চলে যায়।

প্রথম অঙ্ক। রাইনের ধারে। একজন রাজা বিবাহ করতে চায় এবং তার ভগ্নীকেও বিবাহ দিতে ইচ্ছা করে। রাজার দুষ্ট ভাই হেগেন (Hagen) ব্রুনহিল্ডাকে বিয়ে করবার জন্য এবং নিজের ভগ্নীকে সীফ্রিকে দেবার জন্য উপদেশ দেয়। সীফ্রিড্ আবির্ভূত হয়। তারা তাকে একটি মাদক পানীয় দেয়-যার প্রভাবে সে অতীত ভুলে যায় এবং রাজার ভগ্নী গুটুনে (Gutrune)-র প্রেমে পড়ে। এরপর সে গুনথারের সঙ্গে অশ্বারোহণে যাত্রা করে-উদ্দেশ্যে, ব্রুনহিল্ডাকে রাজবধূ করা। দৃশ্যের পরিবর্তন হয়। ব্রুনহিল্ডা আংটিটি নিয়ে বসে আছে। একজন ভালকারী তার নিকট আসে এবঙ বলে যে, উওটানের বর্শা ভেঙে গেছে। তাকে উপদেশ দেয় আংটিটি রাইন পরীদের দিয়ে দেবার জন্যে। সীফ্রিড্‌ আসে এবং ঐন্দ্রজালিক শিরস্ত্রাণের সাহায্যে নিজেকে গুনথারের রূপান্তরিত করে, ব্রুনহিল্ডা থেকে আংটি দাবি করে, সেটি অধিকার করে এবং তার সঙ্গে ঘুমুতে তাকে সবলে আকর্ষণ করে নিয়ে যায়।

দ্বিতীয় অঙ্ক। রাইনের ধারে। এলবেরিখ এবং হেগেন আংটি পাবার উপায় আলোচনা করে। সীফ্রিড্ এসে গুনথারের জন্য কিভাবে একটি কনে জোগাড় করেছে এবং কিভাবে রাত্রিবাস করেছে, কিন্তু সেই রাত্রিবাসের সময় কনের এবং নিজের মধ্যস্থলে একটি তরবারি রেখেছিল, তা বলে। ব্রুনহিল্ডা ঘোড়ায় চড়ে এসে সীফ্রিড়ে হাতের আংটি চিনতে পারে এবং ঘোষণা করে যে, যার সঙ্গে সে বাস করেছিল সে গুনথার নয়, সে সীফ্রিড্‌। হেগেন প্রত্যেককে সীফ্রিড়ের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে এবং পরের দিন শিকারের সময় তাকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়।

তৃতীয় অঙ্ক। রাইনের পরীরা আবার কি ঘটেছে, বর্ণনা করে। পথ-হারানো সীফ্রিড্ আবির্ভূত হয়। পরীরা তার নিকট আংটিটি চাইলে সে তা দিতে অস্বীকৃত হয়। শিকারিরা আসে। সীফ্রিড্‌ নিজের জীবনকাহিনি বলে। হেগেন তখন তাকে একটি পানীয় দিলে তার স্মৃতি আবার ফিরে আসে। ব্রুনহিল্ডাকে জাদিয়ে কিভাবে তাকে লাভ করল,- সীফ্রিড্ তার বর্ণনা দিলে প্রত্যেকে তা শুনে চমৎকৃত হল। হেগেন তাকেই পঠে ছুরি মারে এবং দৃশ্যটি পরিবর্তিত হয়। গুট্রনে সীফ্রিডের মৃতদেহটি দেখতে পায়। গুনথার এবং হেগেনের মধ্যে আংটি নিয়ে কলহ হল এবং হেগেন গুনথারকে হত্যা করল। ব্রুনহিল্ডা কাঁদতে থাকে। হেগেন সীফ্রিড়ের হাত থেকে আংটি নিতে চাইলে মৃতের হাতটি ভয় দেখাবার ভঙ্গিতে উত্থিত হল। ব্রুনহিল্ডা সীফ্রিড়ে হাত থেকে আংটিটি খুলে নেয় এবং সীফ্রিড়ে শব যখন চিতার ওপর বয়ে নেওয়া হল, ব্রুনহিল্ডা একটি ঘোড়ায় উঠে চিতাগ্নিতে লাফিয়ে পড়ল। রাইনের জল বেড়ে ওঠে এবং তরঙ্গগুলি চিতা পর্যন্ত পৌঁছায়। নদীতে ছিল তিনটি পরী। হেগেন আংটিটি লাভ করবার জন্যে আগুনের মধ্যে ঝাঁপ দিল। কিন্তু পরীরা তাকে ধরে ফেলে দূরে অপসারিত করল। তাদের মধ্যে একজন আংটি হাতের মুঠোয় ধরে রইল। এখানেই কাহিনির পরিসমাপ্তি।

আমার এই পুনরুল্লেখ থেকে যে ধারণা হবে, তা অবশ্য অসম্পূর্ণ। কিন্তু যতই অসম্পূর্ণ হোক না কেন, যে চারিটি পুস্তিকার মধ্যে রচনাটি মুদ্রিত, তা পড়ে যে ধারণা জন্মে-তার থেকে আমার এই অসম্পূর্ণ পুনরল্লেখ অবশ্যই অনেক বেশি সন্তোষজনক ॥

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *