হোয়াট ইজ আর্ট – ১৪

১৪

[পূর্ব পরিকল্পিত মতামত সম্পর্কে যে সত্য মারাত্মক তা তৎক্ষণাৎ স্বীকৃতি পায় না। প্রকৃত শিল্পকর্মের সঙ্গে কৃত্রিম শিল্পের অনুপাত। রুচিবিকৃতি এবং শিল্প অবধারণের অক্ষমতা। উদাহরণস্বরূপ।]

কেবল চতুর বলে বিবেচিত ব্যক্তিরাই নয়, এমনকি খুবই চতুর এবং জটিল বৈজ্ঞানিক, গাণিতিক, দার্শনিক সমস্যা উপলব্ধিতে সক্ষম অধিকাংশ ব্যক্তি-যারা সম্ভবত খুবই কষ্ট সহকারে কোন সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছেছেন, যে সিদ্ধান্ত সম্পর্কে তারা গর্বিত, যে বিষয়ে তারা অপরকে শিক্ষা দিয়েছেন এবং যার ভিত্তিতে নিজেদের জীবন গড়ে তুলেছেন-সে সিদ্ধান্ত যদি এমন হয় যে তাকে তারা ভ্রান্ত বলে স্বীখার করতে বাধ্য হন, তবে তারা যে সহজতম এবং স্পষ্টতম সত্যকেও কদাচিৎ দেখতে পান-সে কথা আমি জানি। সুতরাং যে বস্তুকে আমি আমাদের সমাজের শিল্প এবং রুচিবিকতির কারণ বলে অভিহিত করেছি তা যে স্বীকৃতি পাবে, এমনকি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হবে,-সে সম্পর্কে আমি খুব কম আশাই পোষণ করি। এতদ্‌সত্ত্বেও শিল্প সম্পর্কীয় আমার অনুসন্ধান আমাকে যে অনিবার্য সিদ্ধান্তের সম্মুখীন করেছে তা অবশ্যই আমি পুরোপুরি ব্যক্ত করব। এ অনুসন্ধান আমাকে এ প্রত্যয়ের সম্মুখীন করেছে যে, আমাদের সমাজ যা শিল্প, সৎ শিল্প এবং সামগ্রিক শিল্প বলে স্বীকার করে থাকে, তা বাস্তবিক পক্ষে খাঁটি বা সৎ এবং সামগ্রিক শিল্প তো নয়ই, বরং মূলত তা শিল্পপদবাচ্যই নয়,-তা মেকি বা কৃত্রিম শিল্প। আমার এই সিদ্ধান্ত খুবই অদ্ভুত এবং স্ব-বিরোধী মনে হবে, কিন্তু শিল্প যদি অনুভূতি-সঞ্চারক মানবিক ক্রিয়া বলে স্বীকৃত হয় (সৌন্দর্য সেবাও নয়, অথবা ভাবচিন্তার অভিব্যক্তিও নয় বা এই জাতীয় কিছু নয়) তবে অনিবার্যক্রমে এই পরবর্তী সিদ্ধান্তও মেনে নিতেই হবে। এটা যদি সত্য হয় যে, শিল্প এমন একটি ক্রিয়া যার সাহায্যে কোন ব্যক্তি স্বীয় উপলব্ধ অনুভূতি স্বেচ্ছায় অপরের মধ্যে সঞ্চারিত করেন, তবে অনিবার্য আমাদের আরও স্বীকার করতে হয় যে, যে সমস্ত বস্তু আমাদের দ্বারা শিল্প নামে অভিহিত হয় (উচ্চবর্গীয়দের শিক্ষা) অর্থাৎ উপন্যাস, গল্প, নাটক, মিলনান্তি কা, ছবি, স্থাপত্য, সিম্ফনি, গীতাভিনয়, হাল্‌কা গীতপ্রধান নাটিকা, নৃত্য প্রভৃতি- যেগুলিকে প্রকাশ্যে শিল্পকর্ম বলা হয়, তাদের লক্ষ্যের মধ্যে একটিও লেখক-অনুভূত আবেগপ্রসূত কিনা সন্দেহ, বাদবাকি সমস্তই শিল্পের নকল রূপেই তৈরি। সেগুলিতে অনুভূতি-সংক্রমণের স্থান গ্রহণ করেছে ধার-করা, অনুকৃতি, প্রভাব-সৃষ্টি, কৌতূহল সৃষ্টি প্রভৃতি। নকলের তুলনায় প্রকৃত শিল্পসৃষ্টির আনুপাতিক হার লক্ষ্যের কিংবা তার চাইতেও বেশির মধ্যে একটি মাত্র-তা নিম্নোক্ত পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাবে : আমি কোথাও পড়েছিলাম যে, একমাত্র প্যারিসেই চিত্রশিল্পীর সংখ্যা ৩০,০০০ খুব সম্ভব ইংলন্ডে তাদরে সংখ্যা ওই রকম, জার্মানিতেও অসুরূপসংখ্যক এবং ইতালি ও ছোট ছোট রাষ্ট্রকে একসঙ্গে ধললেও হবে সমানসংখ্যক। সুতরাং সর্বসাকুল্যে ইউরোপে চিত্রশিল্পীর সংখ্যা হবে ১,২০,০০০; সম্ভবত সংগীতশিল্পী এবং সাহিত্যশিল্পীর সংখ্যাও হবে অনুরূপ। এই ৩,৬০,০০০ ব্যক্তি প্রতি বৎসর যদি তিনটি করেও শিল্পকর্ম উৎপাদন করেন (তাঁদের মধ্যে অনেকেই দশটি অথবা তার বেশিও উৎপাদন করে থাকেন ) তাহলে প্রতি বৎসর দশ লক্ষেরও বেশি তথাকথিত শিল্পসৃষ্টি হয়। তাহলে বিগত দশ বৎসরে কত সংখ্যক শিল্প উৎপাদন হওয়া সম্ভব এবং যে সময় হতে অভিজাত শ্রেণীর শিল্প-সমগ্র জনগণের শিল্প থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে সে পুরো সময়টার মধ্যেই বা কত সৃষ্টি হয়েছে? নিঃসন্দেহে তাদের সংখ্যা হবে কোটি কোটি। তা সত্ত্বেও সূক্ষ্ম শিল্প- বিচার-বিশেষজ্ঞদের মধ্যে কোন বস্তু এই সমগ্র কৃত্রিম শিল্পবস্তুর পরিচয় লাভ করেছে? এ সমস্ত শিল্পকর্ম বিষয়ে ধারণাহীণ শ্রমিক শ্রেণীর উল্লেখ না হয় নাই করা হল। এমনকি অভিজাত শ্রেণীর মানুষের পক্ষেও এই সব শিল্পের হাজারের মধ্যে একটিরও পরিছয় লাভ সম্ভব নয়, এবং পরিচিত হলেও মনে রাখা সম্ভব নয়। এই সমস্ত সৃষ্টিকর্ম শিল্পের ছদ্মবেশে আত্মপ্রকাশ করায় কারও ওপর কোন প্রভাব বিস্তার করে না (একদল অলস ধনী জনতার অবসর বিনোদনের জন্য ব্যবহৃত হওয়া ব্যতীত) এবং সেগুলি সম্পূর্ণভাবে ভিলূপ্ত হয়।

এর উত্তরে সাধারণত বলা হয়, এই বৃহৎ সংখ্যক অ-সফল প্রয়াস ব্যতীত আমরা প্রকৃত শিল্পকর্মের সাক্ষাতই পেতাম না। এরূপ যুক্তি অনেকটা সেই রুটিওয়ালার মতো-রুটি খারাপ বলে ভর্ৎসিত হলে যে ব্যক্তি উত্তর দিত, এভাবে শত শত রুটি নষ্ট না হলে উত্তম সেঁকা রুটি একটিও পাওয়া যেত না। সোনা থাকলে বালির পরিমাণও যথেষ্ট থাকে-এটা সত্য। কিন্তু এ যুক্তি একটি জ্ঞানগর্ভ কথা বলার জন্য এক গাদা অর্থহীন প্রলাপ বকার যুক্তি হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে না।

শৈল্পিক বিবেচিত উৎপাদন সমূহের দ্বারা আমরা পরিবৃত। হাজারে হাজারে পদ্য, কবিতা, উপন্যাস, নাটক, ছবি, সংগীত-একের পর এক সৃষ্টি হয়েই চলেছে। কবিতাগুলি প্রেমের, প্রকৃতির অথবা লেখকের মানসিক অবস্থার বর্ণনা করে, তাদের সবগুলিতেই ছন্দ ও মিলের নিয়ম রক্ষা করা হয়। নাটক এবং মিলনান্তিকাগুলি চমৎকারভাবে মঞ্চায়িত এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অভিনেতৃবর্গ-কর্তৃক অভিনীত হয়। উপন্যাসগুলি বিভিন্ন পরিচ্ছেদে বিভক্ত। তাদের সবগুলির মধ্যে থাকে প্রেমের বর্ণনা, চমকপ্রদ পরিস্থিতি এবং জীবনের যথাযথ খুঁটিনাটি বর্ণনা। সকল সিম্ফনিতে থাকে চটুলগতি স্ফূর্তিব্যঞ্জক সুরসমষ্টি (allegro), অপেক্ষাকৃত ধীরগতিতে বাজানো সুর (andante), শক্তিভুয়িষ্ট সুরসঞ্চার (Scherzo), যন্ত্রসংগীতের পরিণামী গতিময় সুরসমাপ্তি (finale)। তার মধ্যে থাকে সুরের ওঠানামা, স্বরগ্রাম এবং উচ্চ পর্যায়ের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সংগীতজ্ঞদের দ্বারা সেগুলি বাজানো হয়। সোনালি ফ্রেমে বাঁধানো ছবিগুলিতে থাকে মুখ এবং আনুষঙ্গিকের উজ্জ্বল রূপায়ন। বিভিন্ন শিল্পশাখার যে কোন শাখায় লক্ষ লক্ষ সৃষ্টির মধ্যে একটি সৃষ্টি অন্যগুলির তুলনায় শুধু যে কিছু ভালো তাই নয়, তাদের থেকে তার শ্রেষ্ঠতা আসল ও নকল হীরার মধ্যে যে পার্থক্য-তার অনুরূপ। একটি অমূল্য, অপরগুলি জনরুচিকে জনরুচিকে প্রবঞ্চিত ও বিকৃত করে বলে শুধু যে মূল্যহীন তাই নয়,-মূল্যহীনের চাইতেও নিকৃষ্ট। তথাপি বিকৃত এবং ক্ষয়িষ্ণু শৈল্পিক অনুভূতিসম্পন্ন ব্যক্তির নিকট বাহ্যত সেগুলি ঠিক একই মূল্যমানের বস্তু বলে প্রতীয়মান হয়।

আমাদের সমাজের প্রকৃত শিল্পসৃষ্টিকে চিহ্নিত করবার অসুবিধা যে আরও বেড়ে গেছে তার কারণ, মেকি শিল্পসৃষ্টির বহিরাঙ্গিক উৎকর্ষ খাঁটি শিল্পসৃষ্টি থেকে নিকৃষ্ট তো নয়ই, বরং অনেক সময় অধিকতর উৎকৃষ্ট। কৃত্রিম শিল্প প্রকৃত শিল্পের চাইতে অধিকতর চমকপ্রদ এবং তার বিষয়বস্তুও অধিকতর কৌতূহলোদ্দীপক। এ অবস্থায় মানুষ এই দুয়ের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করবে কী করে? বহিরঙ্গে খাঁটি শিল্পের সঙ্গে যার কোনই প্রভেদ নাই-এমন লক্ষ লক্ষ নিখুঁত অনুকৃতির মধ্য থেকে লোকে খাঁটি শিল্পের নিদর্শনটি কী করে বেছে নেবে?

অবিকৃতরুচি গ্রাম্য চাষির পক্ষে এটা কিন্তু খুবই সহজ-যেমন সহজ কোন অবিকৃত ঘ্রাণশক্তিবিশিষ্ট প্রাণীর পক্ষে অরণ্যের হাজার হাজার পদচিহ্নের মধ্যে একটি প্রয়োজনীয় চিহ্ন অনুসরণ করা। পশুটি নির্ভুলভাবে তার অন্বিষ্টটি খুঁজে পায়। তেমনি যে ব্যক্তির স্বাভাবিক প্রকৃতিগত গুণগুলি বিকৃত হয়নি, সে ব্যক্তি হাজারো বস্তুর মধ্যে তার প্রয়োজনীয় খাঁটি শিল্পকর্মটি অব্যর্থভাবে নির্বাচন করে নেবে। সে অকৃত্রিম শিল্পকর্মের শিল্পী-উপলব্ধ অনুভূতি তাকে সংক্রমিত করবেই। কিন্তু শিক্ষা এবং জীবন- পরিবেশের প্রভাবে যে সমস্ত ব্যক্তির রুচি বিকৃত হয়েছে তাদের জীবনে এরূপ ঘটে না। এ পর্যায়ের মানুষের গ্রহণশক্তি ক্ষীণতাপ্রাপ্ত। শিল্পকর্মের মূল্য নির্ণয়ে তারা বিভ্রান্ত কারী আলোচনা ও পাঠের দ্বারা অনিবার্যত পরিচালিত হয়। এ কারণে আমাদের সমাজের অধিকাংশ ব্যক্তি স্থূলতম কৃত্রিম শিল্প থেকে পকৃতি শিল্পকর্মের পৃথকীকরণে সম্পূর্ণ অক্ষম। মানুষ ঘন্টার পর ঘন্টা কনসার্ট হল এবং থিয়েটারের প্রেক্ষাগৃহে বসে থাকে, নতুন সুরকারদের সংগীত শ্রবণ করে, বিখ্যাত আধুনিক ঔপন্যাসিকদের উপন্যাস পড়া কর্তব্য বিবেচনা করে, এবং হয়ত দুর্বোধ্য কোন চিত্রের দিকে তাকিয়ে থাকে, অথবা চিত্রে ঠিক সে বস্তুকেই দেখতে থাকে-বাস্তব জীবনে যা আরও বেশি ভালো করে দেখে থাকে। সর্বোপরি কৃত্রিম বস্তুর সব কিছুকে শিল্প বিবেচনায় তারা সেগুলির দ্বারা মোহিত হওয়াকে অবশ্য-কর্তব্য মনে করে। ওই একই কালে খাঁটি শিল্পনিদের্শনের প্রতি কোন প্রকার মনোযোগ না দিয়ে কিংবা অতি অবজ্ঞাভরে পাশ দিয়ে চলে যাবে শুধু এই কারণে যে, তাদের গোষ্ঠীর মধ্যে ওই নিদের্শনগুলি শিল্পতালিকার বহির্ভূত।

যে ধরনের বিষণ্ণ অনুভূতি দ্বারা আমি মাঝে মাঝে পীড়িত হই, কয়েকদিন আগে বেড়াবার পর সে রকমের অনুভূতি নিয়ে আমি বাড়ি ফিরছিলাম। বাড়ির সন্নিকটবর্তী হয়ে আমি বহুসংখ্যক কৃষক রমণীর সমস্বরে গীত উচ্চকণ্ঠ সংগীত শুনতে পেলাম। বিয়ের পর আমার মেয়ের গৃহ প্রত্যাবর্তনের ঘটনাটিকে উদযাপন করবার অভিপ্রয়ে তারা আমার মেয়েকে স্বাগত জানাচ্ছিল। চীৎকার এবং কাসেত শব্দ সহ এ সংগীতে এমন একটি সুনির্দিষ্ট আনন্দ, উল্লাস এবং সরলতা অভিব্যক্তি লাভ করেছিল যে-তা আমাকে কিভাবে সংক্রমিত করল তা লক্ষ্য না করে অপেক্ষাকৃত ভালো মন-মেজাজে আমি বাড়ির দিকে অগ্রসর হলাম এবং সহাস্যে বাড়ি পৌঁছালাম। ওই দিন সন্ধ্যায় ক্লাসিক্যাল সংগীতে নৈপুণ্যের জন্য যশস্বী এবং বিশেষ করে বেটোফেন-বাদনে পারদর্শী জনৈক আগন্তুক-সংগীতজ্ঞ আমাদের বেটোফেনের সোনাটা বাজিয়ে শোনালেন-যেটি বেটোফেনের ১০১ নং কৃতি। বেটোফেনের ওই সোনাটা সম্পর্কে আমার বিচারকে সে-সংগীত বোঝাবার অক্ষমতা ব্যক্তিরা যা বুঝে থাকেন, সংগীত বিষয়ে তীক্ষ্ণ অনুভূতিপ্রবণতার জন্য আমিও তাদের সমানই বুঝে থাকি। যে সমস্ত রূপহীন উদ্ভাবন বেটোফেনের শেষ পর্যায়ের সৃষ্টিকর্মের বৈশিষ্ট্য-তা থেকে আনন্দ আহরণের জন্য আমি বহুকাল পর্যন্ত নিজেকে তার জন্য অভ্যস্ত করে তুলেছিলেন। কিন্তু আমাকে শুধুমাত্র শিল্পের প্রশ্নটাই গভীরভাবে বিবেচনা করতে হয়েছিল এবং বেটোফেনের শেষ পর্যায়ের সৃষ্টিকর্ম বিষয়ে আমার উপলব্ধ ধারণার সঙ্গে তুলনা করতে হয়েছিল তৃপ্তিদায়ক, স্বচ্ছ, সবল, সাংগীতিক অনুভূতি-সম্বলিত বাখ্ (Bach)-এর ( তাঁর এরিয়া arias), হেইডেন (Haydn)-এর মোসার্ট (Mozart)-এর, সোপার (Chopin) (যখন তাঁর সুরগুলি জজিলতা এবং অলংকারিতার দ্বারা ভারাক্রান্ত হয় না), -এমনকি স্বয়ং বেটোফেনের প্রথম পর্যায়ের সংগীতের সঙ্গে এবং সর্বোপরি ইতালীয়, নরওয়েজীয়, রুশ প্রভৃতি পল্লীসংগীতসৃষ্ট অনুভূতি সঙ্গে -হাঙ্গেরীয় Csardas এবং এ পর্যায়ের অপরাপর সরল, স্বচ্ছ এবং শক্তিমান সংগীতের সঙ্গেও-যার ফলে বেটোফেনের শেষ পর্যায়ের সংগীতের যে অস্পষ্টতা এবং প্রায়-অস্বাস্থ্যকর উত্তেজনার প্রভাব একটা কৃত্রিম প্রয়াসের ফলে আমি নিজেই নিজের মনে উদ্রিক্ত করেছিলাম, তা যেন তৎক্ষণাৎ বিনষ্ট হয়ে গেল।

সংগীতানুষ্ঠান শেষ হবার পর (যদিও এটা দেখা যাচ্ছিল যে প্রত্যেকটা নিস্তেজ হয়ে উঠেছেন ) উপস্থিত সকলেই প্রচলিত স্বীকৃত পদ্ধতিতে বেটোফেনের গভীর সৃষ্টিকর্মের প্রশংসা জানালেন। এই বাড়তি কথাটাও তারা সংযোগ করতে ভুললেন না যে, ইতোপূর্বে তাঁর শেষ পর্যায়ের সৃষ্টিকর্মকে তারা বুঝতে সক্ষম না হলেও এখন উপলব্ধি করতে পারলেন যে, সে পর্যায়েই তিনি শ্রেষ্ঠ শিল্পকৃতির অধিকারী হয়েছিলেন। কৃষক রমণীদের সংগীত আমার এবং অপরাপর শ্রোতার ওপরও যে প্রভাব বিস্তার করেছিল- আমি সে সংগীতের সঙ্গে এই সোনাটার প্রভাবের তুলনা করতে সাহসী হলে বেটোফেনের প্রশংসাকারীরা এরূপ মন্তব্যের উত্তর দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা পর্যন্ত বিবেচনা না করে অবজ্ঞার সঙ্গে ঈষৎ হাস্য করলেন।

সকল দিক বিবেচনা করলে দেখা যায়, কৃষক রমণীদের সংগীত সুনির্দিষ্ট এবং সবল অনুভূতি-সঞ্চারী বলে প্রকৃত শিল্পনামধেয়, অপরপক্ষে বেটোফেনের ১০১ তম সোনাটা শিল্পসৃষ্টির একটি অকৃতার্থ প্রয়াস বলে তা ছিল সুনির্দিষ্ট অনুভূতিবর্জিত সুতরাং সংক্রমণশক্তিহীন।

শিল্প সম্পর্কীয় রচনার জন্য এই শীতকালে আমি প্রবল উদ্যমে পরিশ্রম সহকারে সমস্ত ইউরোপে প্রশংসিত কতকগুলি উপন্যাস ও ছোটগল্প পড়েছি। সেগুলি জোলা, বুর্জে (Bourget), উইসমান (Huysmans) এবং কিপলিং লিখিত। একই সঙ্গে ছেলেদের একটি পত্রিকায় সম্পূর্ণ অজানা জনৈক লেখকের একটি ছোটগল্প হঠাৎ আমার চোখে পড়ে। সে গল্পটিতে ছিল একটি দরিদ্র বিধবার পরিবারে ইস্টার উৎসব উপলক্ষে প্রস্তুতির কাহিনি। সে গল্পে আছে, মা কিভাবে খুবই কষ্টে কিছু ময়দা সংগ্রহ করে ঠাসার উদ্দেশ্যে টেবিলের ওপর ঢেলে রেখেছিল। তারপর সে খামি সংগ্রহের জন্য বাইরে গেল। যাবার আগে ছেলেদের বলে গেল, তারা যেন কুটির ছেড়ে না যায় এবং ময়দাগুলি যত্ন নেয়। মা চলে যাবার পর আর কতকগুলি ছেলে কলরব করে জানালার নিকট এসে খেলার জন্য কুটির থেকে বেরিয়ে আসতে তাদের ডাকল। ছেলেরা মায়ের সাবধান-বাণীর কথা ভুলে দৌড়ে রাস্তায় নেমে গেল এবং অবিলম্বে খেলায় মেতে উঠল। খামি নিয়ে বাড়ি ফিরবার পর মা দেখতে পেল, টেবিলের ওপর উঠে একটি মুরগি ময়দার শেষ অংশটুকু তার বাচ্চাদের ছড়িয়ে দিচ্ছে এবং বাচ্চাগুলি মাটির মেঝের ধূলা থেকে সেগুলি কুড়িয়ে নিতে ব্যস্ত। নৈরাশ্যপীড়িত মা ছেলেদের ভর্ৎসনা করলে তারা আকুল হয়ে কাঁধতে লাগল। মা তাদের জন্য করুণা অনুভব করল-কিন্তু ততক্ষণে সাদা ময়দাগুলি সবই নিঃশেষিত হয়ে গেছে। ব্যাপারটিকে জোড়াতালি দিয়ে সারিয়ে তোলার জন্য মা তখন বাজরার ময়দা ছেঁকে নিয়ে ইস্টার কেক তৈরি করার সিদ্ধান্ত নিল। ডিমের সাদা অংশটি ওপরে ছড়িয়ে দিয়ে তার চারদিকে ডিম ভেঙে দিল। ‘আমাদের তৈরি করা বাজরার রুটি ঠিক কেকের মতো’-সাদা ময়ধা দিয়ে তৈরি ইস্টারের কেক সংগ্রহে অসমর্থ হয়ে ছেলেদের সান্ত্বনা দেবার উদ্দেশ্যে মিলযুক্ত একটি প্রবাদ ব্যবহার করে মা একথা বলল। মানসিক নৈরাশ্য থেকে অতিদ্রুত অতি-উল্লাসের স্তরে উপনীত হয়ে ছেলেরা সে প্রবাদের পুনরাবৃত্তির শুরু করল এবং পূর্বাপেক্ষা আরও বেশি আনন্দ সহকারে ইস্টারের কেকের প্রতীক্ষা করে রইল।

বস্তুতপক্ষে জোলা, বুর্জে (Bourget), উইসমান (Huysmans), কিপলিং এবং আরও কোন কোন লেখকের গভীর বেদনাদায়ক বিষয়বস্তু নিয়ে লিখিত উপন্যাস ও ছোটগল্প আমাকে এক মুহূর্তের জন্যও আকর্ষণ করতে পারেনি। আমি এই সমস্ত লেখকের প্রতি সর্বক্ষণ বিরক্ত হয়ে উঠেছিলাম। যখন কোন ব্যক্তি অপর কোন ব্যক্তিকে সম্পূর্ণ কলাকৌশলশূন্য সরল বিবেচনায় তার ওপর প্রভাব বিস্তারের কৌশল পর্যন্ত গোপনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে না, তখন তার মনে যে বিরক্তির সঞ্চার হয়-আমার বিরক্তিও সে ধরনের। পথম পংক্তিগুলি থেকে বইটি লেখার উদ্দেশ্য ধরা পড়ে। সমস্ত খুঁটিনাটি বর্ণনা প্রয়োজনাতিরিক্ত মনে হয়, এবং বইটি পড়ার পর পাঠকের মনে অত্যন্ত নিষ্প্রাণ অনুভূতির সঞ্চার হয়। সর্বোপরি যে কোন ব্যক্তি অনুভব করে, গল্প বা উপন্যাস লেখার আকাঙ্ক্ষা ব্যতীত লেখকের সর্বক্ষণ আর কোন অনুভুতি ছিল না। সুতরাং পাঠক কোন শৈল্পিক অনুভূতি লাভ করে না। অপরপক্ষে অজ্ঞাত লেখকের বালক এবং মুরগি সংক্রান্ত কাহিনী থেকে আমি নিজেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারছিলাম না, যেহেতু লেখকের সুস্পষ্ট উপলব্ধ অনুভূতি তাঁর চিত্তে পুনরুদ্রিক্ত হয়ে গল্পটির মধ্যে সঞ্চারিত হওয়ায় তদ্বারা আমি তৎক্ষণাৎ সংক্রমিত হয়েছিলাম।

Vasnetsov আমাদের রুশ শিল্পীদের একজন। তিনি কিয়েভ গির্জায় ধর্মীয় চিত্র অঙ্কন করেছেন। এক ধরনের অভিনব উচ্চ মানের খ্রীষ্টীয় শিল্পের প্রবর্তক হিসেবে প্রত্যেকে তাকে প্রশংসা করে। দশ বৎসর কাল ব্যাপী তিনি এ সমস্ত চিত্র রচনায় নিয়োজিত ছিলেন। এ জন্য তাকে বহু সমস্র রুবল দেওয়া হয়েছিল। যদিও তাদের সবগুলিই ছিল নেহাত নিকৃষ্ট শ্রেণীর-খারাপ অনুকরণের অনুকরণ, কোন অনুভূতির স্ফুলিঙ্গবর্জিত। এই একই Vasnetsov একবার তুর্গেনিভের ‘তিতির’ (The Quail) নামক গল্পের জন্য একি ছবি এঁকেছিলেন (যাকে জনৈক পিতা কর্তৃক নিহত একটি তিতিরের জন্য পুত্র কিরূপ করুণা অনুভব করেছিল তার বর্ণনা আছে।) সেই চিত্রটিতে দেখানো হয়েছে ছেলেটি ঠোঁট ফুলিয়ে ঘুমোচ্ছে এবং তার ওপরে অনেকটা স্বপ্নের মতো তিতিরটি। এ চিত্রটি একটি প্রকৃত শিল্পকর্ম।

১৮৯৭ সনের ইংলিশ একাডেমিতে দুটি চিত্র একই সঙ্গে প্রদর্শিত হয়েছিল। সেগুলির মধ্যে একটি ছিল সন্ত এন্টনীর প্রলোভন। সেই সন্ত হাঁটু গেড়ে প্রার্থনা করছিলেন। তার পশ্চাতে ছির দন্ডায়মান একটি নগ্ন স্ত্রীলোক এবং এক জাতীয় কিছু পশু। এটা স্পষ্ট যে, এন্টনী আদৌ তার মনোযোগ আকর্ষণ করেনি, নগ্ন স্ত্রীলোকটিই শিল্পীকে অত্যধিক তৃপ্তি দিয়েছিল। ফলে সে প্রলোভন শিল্পীর নিকট ভয়ঙ্কর মনে হওয়া তো দূরের কথা, বরং ছিল অত্যন্ত প্রীতিপদ। কাজে কাজেই এই চিত্রের মধ্যে যদি কোন শিল্পের অস্তিত্ব থেকেও থাকে-তবে তা অত্যন্ত কুৎসিৎ এবং মিথ্যা। একাডেমি চিত্রগ্রন্থের পরের চিত্রটি লেংলে (Langley)-অঙ্কিত একটি নিঃসঙ্গ ভিক্ষুক বালকের ছবি। একজন স্ত্রীলোক স্পষ্টতই দয়া বরবশ হয়ে ছেলেটিকে ঘরে ডেকে নিয়েছে। ছেলেটি বেঞ্চির তলায় নগ্ন পা রেখে খাচ্ছে। স্ত্রীলোকটি দেখছে আর সম্ভবত ভাবছে সে আর বেশি খাদ্য চাইবে কিনা। প্রায় সাত বৎসরের একটি বালিকা তার বাহুর ওপর ভর করে গভীর মনোযোগের সঙ্গে গম্ভীর হয়ে এ দৃশ্য দেখছে, ক্ষুধার্থ বালকটির ওপর থেকে চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছে না। স্পষ্টতই দারিদ্র্য এবং মানুষের মধ্যে অসাম্য কি বস্তু-এই প্রথম তা সে উপলব্ধি করছে। এবং সে নিজেকে নিজেই জিজ্ঞেস করছে, কেনই বা তার জন্য সব কিছু আসছে এবং ছেলেটির খালি পায়ে চলার এবং ক্ষুধার্থ থাকার কারণ কী? তার মন বেদনায় ভরে যায়, কিন্তু তবু সে খুশিও হয়। ছেলেটি এবং হৃদয়বত্তার গুণ-এই উভয়কে সে ভালোবাসল..ছবিটি দেখতে দেখতে মনে হয়, এই মেয়েটি ভালোবেসে। যদিও আমি জানি এই শিল্পী বহুল পরিচিত নন, কিন্তু তার এই ছবিখানি একটি চমৎকার এবং খাটি শিল্পকর্ম।

রসি (Rossi) প্রযোজিত হ্যামলেটপ নাটকের অভিনয় দেখার কথা আমার মনে আছে। অভিনয়ের মুখ্য অংশগ্রহণকারী অভিনেতা এবং এই বিয়োগান্ত নাটক -এই উভয়েই আমাদের সমালোচকদের মতে সর্বোত্তম নাট্যীয় শিল্পের সর্বোচ্চ প্রতিনিধি বলে বিবেচিত। তথাপি নাটকের বিষয়বস্তু এবং অভিনয়-উভয় দিক থেকেই আমি সর্বক্ষম অনুভব করছিলাম, সেই বিশেষ যন্ত্রণা শিল্পের মিথ্যা অনুকৃতির দ্বারা উৎপন্ন হয়। কিন্তু আমি সম্প্রতি ভোন্ডল (Voguls) নামক একটি বর্বর উপজাতির একটি নাট্যভিনয়ের বর্ণনা পড়েছি। একজন দর্শক অভিনয়ের বর্ণনা দিচ্ছেন। একজন বয়স্ক এবং তরুণ ভোন্ডল বল্গা হরিণ-বর্মে সজ্জিত হয়ে একটি বল্গা হরিণী ও তার শাবকের ভূমিকায় অভিনয় করছিল। ধনুকধারী অপর একজন ভোন্ডল তুষারের ওপর ব্যবহারোপযোগী জুতা-পরা একজন শিকারির ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল। চতুর্থ জন পাখির কণ্ঠস্বরের নকল করে বল্গা হরিণগুলিকে বিপদ সম্পর্কে সাবধান করে দিচ্ছিল। শাবক সহ হরিণী যে পথ-পরিক্রমা করেছে শিকারিও সেই পথ অনুসরণ করেছে-এই হল নাটকটির বিষয়বস্তু। হরিণটি দৌড়ে দৃশ্যের বাইরে অদৃশ্য হয়ে আবার আবির্ভূত হল (এ ধরনের অভিনয়গুলির অনুষ্ঠান হয় একটি ক্ষুদ্র তাঁবু জাতীয় আবাসে)। পশ্চাদ্ধাবনশীল শিকারি ক্রমেই শিকারের নিকটবর্তী হচ্ছিল। হরিণ শিশুটি ক্লান্ত হয়ে তার মায়ের গা-ঘেঁসে রইল। নিশ্বাস নেবার জন্য হরিণীটি থামল। শিকারি তাদের নিকট এসে ধনুক উদ্যত করল। ঠিক সে মুহূর্তে পাখিটি হরিণীকে শব্দের সাহায্যে তাদের বিপদসংকেত দিল। তারা পালিয়ে গেল। আবার শুরু হল পশ্চাদ্ধাবন, আবার শিকারি নিকটবর্তী হয়ে তাদের ধরল এবং তার তীর নিক্ষেপ করল। তীরটি মৃগশিশুকে বিদ্ধ করল। দৌড়াতে অসমর্থ হওয়ায় হরিণশিশুটি তার মায়ের গা ঘেঁসে দাঁড়াল। মা তার ক্ষতস্থানকে লেহন করতে লাগল। শিকারি নিক্ষেপের জন্য আর একটি তীর তুলে নিল। প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় দেখা যায়, শ্রোতৃবৃদ্ধ উৎকণ্ঠাপূর্ণ অনিশ্চয়তায় যেন বিবশ হয়ে গেল। তাদের মধ্যে গভীর আর্তনাদ, এমনকি ক্রন্দন পর্যন্ত শোনা গেল। কেবলমাত্র বর্ণনা পড়েই আমি অনুভব করেছিলাম যে, এটি একটি সৎ শিল্পকর্ম।

আমি যা বলছি তা যুক্তিহীন ও স্ব-বিরোধী মনে হতে পারে এবং হয়ত তা কোন ব্যক্তির শুধু বিস্ময়ই উৎপাদন করবে। কিন্তু এতদ্‌সত্ত্বেও আমার চিন্তা অনুযায়ী আমাকে কথা বলতেই হবে। যেমন আমাদের গোষ্ঠীর মানুষদের মধ্যে কেউ কেউ কবিতা, গল্প, উপন্যাস, গীতাভিনয়, ঐকতান, সোনাটা প্রভৃতি রচনা করেন। সর্বপ্রকার চিত্রকে বর্ণালিম্পিত করেন, মূর্তি নির্মাণ করেন, অপরপক্ষে কেউ কেউ এ সমস্তর কথা শুনে সেগুলির দিকে তাকিয়ে থাকেন এবং অপর কেউ কেউ এ সবগুলির মূল্যায়ন এবং সমালোচনাও করেন : সেগুলি সম্পর্কে আলাপ-আলোচনা করেন, নিন্দা করেন, বিজয়োল্লাস অনুভব করেন এবং বংশানুক্রমে পরস্পরের প্রশংসার স্তম্ভ তৈরি করেন। এদের মধ্যে অল্প কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া-তাঁরা শিল্পী, জনসাধারণ কিংবা সমালোচক-যাই হোন না কেন, (একমাত্র শৈশবে এবং প্রথম যৌবনে শিল্প সম্পর্কীয় কোন আলোচনা শোনবার আগে) সরলতম লোকের, এমনকি একটি শিশুরও পরিচিত সহজ অনুভূতি কখনও আপন অন্তরে উপলব্ধি করেননি, অপরের অনুভূতি দ্বারা সংক্রমিত হবার অভিজ্ঞতা অর্জন করেননি-যে অনুভূতি অপরের আনন্দে উৎফুল্ল হতে, অপরের বেদনায় দুঃখিত হতে এবং অপরের হৃদয়ের সঙ্গে হৃদয় মিশ্রণে সবেগে আমাদের চালিত করে। অথচ এটিই শিল্পের প্রাণ। কাজে কাজেই এ সমস্ত ব্যক্তি কৃত্রিম শিল্প থেকে খাঁটি শিল্পকে শুধু যে বেছে নিতে অক্ষম তাই নয়, বরং সর্বাধিক অপকৃষ্ট এবং কৃত্রিম নিদর্শনকেই অবিরত খাঁটি শিল্প বলে ভুল করে। এবং যেহেতু কৃত্রিম শিল্পবস্তু মাত্রই সর্বদা বড় বেশি অলংকৃত, অপর পক্ষে সৎ-শিল্প সরল এবং নিরলঙ্কার, সে কারেণ প্রকৃত শিল্প বিষয়ে তাদের আদৌ কোন উফলব্ধিই ঘটে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *