২
[শিল্প কি এতখানি অশুভের ক্ষতিপূরণের ক্ষমতা রাখে? শিল্প কী? বিভিন্ন মতের বিভ্রান্তি -এ কী সেই বস্তু ‘যা সৌন্দর্য সৃষ্টি করে?’-রুশ ভাষায় ‘সৌন্দর্য নামক শব্দ-সৌন্দর্যতত্ত্বে নানা মতের কোলাহল। ]
প্রতিটি যৌথনৃত্য, সাকার্স, গীতাভিনয়, গীতপ্রধান নাটিকার অভিনয়, প্রদর্শনী, চিত্র, ঐকতান অথবা মুদ্রিত গ্রন্থ উৎপাদনে যে সহস্র সহস্র লোকের মাত্রাতিরিক্ত এবং স্বেচ্ছাবিরুদ্ধ শ্রমের প্রয়োজন হয়, তা অনেক ক্ষেত্রেই ক্ষতিকর এবং অবমাননাকর। শিল্পীরা যদি শিল্পের প্রয়োজনে নিজেরাই সব কিছু করে নিতেন তা হলে বলার কিছু থাকত না। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, শিল্পসৃষ্টির লক্ষ্য ব্যতীতও নিজেদের স্বাভাবিক বিলাসপূর্ণ জীবনযাত্রার জন্য তাদের সকলেরই শ্রমিকদের সাহায্যের প্রয়োজন। কোন না কোন উপায়ে তারা তা সংগ্রহ করেন, -কখনও বা ধনিক শ্রেণী প্রদত্ত অর্থের আনুকূল্যে অথবা সরকারি অনুদানের সাহায্যে-যেমন দৃষ্টান্ত স্বরূপ রাশিয়াতে থিয়েটার, সংগীত শিক্ষণকেন্দ্র, সংস্কৃতি পরিষদ্ প্রভৃতির জন্য লক্ষ লক্ষ রুবল অনুদান দেওয়া হয়। এ অর্থ সংগৃহীত হয় জনসাধারণ থেকে-যাদের মধ্যে এমন অনেক দরিদ্র আছে যাকে একমাত্র গোরুটি বিক্রি করে সরকারি কর মেটাতে হয় এবং যারা শিল্প রিবেশিত আনন্দ কখনও উপভোগ করতে পারে না।
ঊনবিংশ শতাব্দীর কোন গ্রীক বা রোমান শিল্পী, এমনকি কোন রুশ শিল্পীর পক্ষে (যখন দাসত্বপ্রথা বিদ্যমান ছিল এবং তার ঔচিত্য সম্পর্কে কাও সন্দেহ ছিল না) বিনা দ্বিধায় বহু ব্যক্তিকে তার নিজের বা তার শিল্পের সেবায় নিয়োগ করা অসঙ্গত ছিল না। কিন্তু আমাদের যুগে সকল মানুষের মনে সমানাধিকার সম্পর্কে যখন কিছুটা চেতনার সঞ্চার হয়েছে, তখন শিল্পের জন্য অনিচ্ছুক মানুষকে জোর করে খাটানো অসম্ভব। এ প্রয়াসের পূর্বে এ প্রশ্নের মীমাংসা হওয়া প্রয়োজন, শিল্প কি এতই উৎকৃষ্ট এবং গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার যে তা এ অশুভ কর্মের ক্ষতিপূরণে সক্ষম?
তা যদি না হয়, তবে একটি ভয়ঙ্ক সত্যের মুখোমুখি আমাদের হতেই হবে যে, যে শিল্পের বেদীতে বিপুল শ্রম, মানুষের জীবন, এমনকি ন্যায়নীতি পর্যন্ত ভয়াবহভাবে বিসর্জিত হচ্ছে সে শিল্প শুধুমাত্র অকেজো শুধু তাই নয়, এমনকি অনিষ্টকরও বটে। সুতরাং যে সমাজে শিল্পকর্মের উদ্ভট ঘটে এবং সে শিল্প পোষকতা লাভ করে তা যথার্থ শিল্পকর্ম কিনা, এবং (আমাদের সমাজে যেরূপ প্রচলিত ধারণা) শিল্পবস্তু মাত্রেই সৎ, এবং শিল্পের জন্য যত কিছু উৎসর্গিত হয় শিল্পের তদনুরূপ কোন মূল্য আছে কিনা, তা পরীক্ষা করে দেখা দরকার। প্রত্যেক বিবেকবান শিল্পীরই এ বিষয়ে আরও নিশ্চিত হওয়া দরকার এই কারণে, যাতে তিনি নিঃসন্দেহে হতে পারেন যে, যা কিছু তিনি করছেন তা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ- যে ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর মধ্যে তিনি বাস করেন এটা তাদের মোহাচ্ছন্নতাপ্রসূত নয়-যে মোহাচ্ছন্নতা তার মধ্যে একটি অলীক আশ্বাস উদ্দীপ্ত করেছে যে, যা তিনি করছেন তা অতি উত্তম কাজ এবং নিজের আড়ম্বরবহুল বিলাসপূৰ্ণ জীবনযাত্রার জন্য অপরের নিকট থেকে যা তিনি গ্রহণ করছেন তাঁর নিজের সৃষ্ট শিল্পকর্ম দ্বারা তার ক্ষতিপুরণ হয়ে যাবে। এ কারণেই উক্ত প্রশ্নগুলির উত্তর খোঁজা আমাদের যুগে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
মানব সমাজের পক্ষে যা এত গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় বলে বিবেচিত-যার জন্য এত শ্রম, মানুষের জীবন এমনকি মঙ্গলবোধ পর্যন্ত বিসর্জিত হয়- সেই শিল্প বস্তুটি কী? শিল্প কি? প্রশ্নটি একটু অদ্ভুত। স্থাপত্য, ভাস্কর্য, চিত্রশিল্প, সংগীত এবং কবিতার বিবিধ রূপ, এ সবই শিল্প-এটাই তো সচরাচর জনসাধারণ, শিল্পের শিক্ষানবীশ, এমনটি স্বয়ং শিল্পীরই উত্তর। তারা জানেন, যে বিষয় নিয়ে তারা কথা বলছেন তা সম্পূর্ণভাবে স্বচ্ছ এবং সমানভাবে প্রত্যেকের নিকট বোধগম্য। কিন্তু স্থাপত্যের বেলায় কেউ কেউ আরও প্রশ্ন করতে পারেন যে, এমন বাড়িও কী দেখা যায় না যা শিল্পকর্ম বলে পরিগণিত নয়? অপরপক্ষে এমন বাড়িও কী দেখা যায় না শিল্পরচনার অহংকৃত প্রয়াস সত্ত্বেও যেগুলি অসার্থক এবং কুৎসিত-সুতরাং শিল্প বলে বিবেচিত হবার অযোগ্য? তাহলে শিল্পকর্মের স্বরূপ-লক্ষণটি কোথায় নিহিত?
স্থাপত্য, সংগীত এবং কবিতার বেলায়ও এ কথা প্রযোজ্য। সব ধরনের শিল্পেরই একদিনের সীমায় আছে বাস্তব প্রয়োজন সিদ্ধি, এবং অপরদিকে শিল্প রচনার অসার্থক প্রয়াস। এই দুইয়ের মধ্যে শিল্পকে কীভাবে স্বতন্ত্ররূপে চিহ্নিত করা যাবে? আমাদের গোষ্ঠীর সাধারণ শিক্ষিত লোক, এমনকি যে শিল্পী নন্দনতত্ত্ব নিয়ে নিজেকে বিশেষভাবে ব্যাপৃত রাখেন না-এ প্রশ্ন নিয়ে কোন দ্বিধার সম্মুখীন হবেন না। তাঁর বিবেচনায় এ প্রশ্নের মীমাংসা বহু পূর্বে হয়ে গেছে এবং প্রত্যেকের নিকট তা সুবিদিত।
এ পর্যায়ের লোকের বক্তব্য : ‘শিল্প সে ধরনেরই কর্ম যা সৌন্দর্য সৃষ্টি করে।’ শিল্প যদি তাই হয় তবে প্রশ্ন উঠতে পারে- ‘একটি নৃত্যনাট্য কিংবা গীতাভিনয় কী শিল্প? একটু দ্বিধাযুক্ত হলেও সাধারণ লোকের উত্তর হবে- ‘হ্যাঁ, উত্তম নৃত্যনাট্য বা লালিতপূর্ণ গীতাভিনয়ও শিল্প-অবশ্য সৌন্দর্যের অভিব্যক্তির পরিমাণ অনুসারে।’
কিন্তু উত্তম নৃত্যনাট্য এবং সুললিত গীতাভিনয় থেকে তাদের বিপরীত বস্তুর পার্থক্য কোথায় সাধারণ লোককে এ প্রশ্ন না করেও (এ প্রশ্নের উত্তর দিতে তাকে যথেষ্ট বেগ পেতে হতো)। যদি তাকে জিজ্ঞেস করা হয় যে, পোশাক প্রস্তুতকারক এবং বেশবাস বিন্যাসকারী-যারা এই সব নৃত্যনাট্য এবং গীতাভিনয়ের জন্য স্ত্রীলোকের দেহে অলংকরণ এবং মুখের প্রসাধন করে তাদের সে কাজ শিল্প নামের যোগ্য কিনা, অথবা পোশাক প্রস্তুতকারক, সুগন্ধিপ্রস্তুতকারক এবং পাচকদের কাজকে শিল্পকর্ম বলা চলে কিনা? বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাদের কাজ শিল্পরাজ্যের কোঠায় পড়ে বলে তারা স্বীকার করবে না। বিশেষজ্ঞ নয় বলে সাধারণ ব্যক্তি এখানে একটু ভুল করে, যেহেতু ব্যক্তি হিসেবে সে সাধারণ এবং নান্দনিক প্রশ্ন নিয়ে সে কখনও মাথা ঘামায়নি। এ সব বিষয়ে মনোযোগী হলে বিখ্যাত লেখক রেনার (জবহধহ) গ্রন্থ মার্ক ওরেল-এর (Marc- Aurele) ভেতর সে দেখতে পেত, কেশবিন্যাসকারীর কর্মও শিল্প এবং যারা স্ত্রীলোকদের সুসজ্জিত করার কাজের মধ্যে শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্মের স্বাক্ষর দেখে না তারা ভয়নক সংকীর্ণচেতা এবং স্থূলবুদ্ধির লোক। রেনা (Renan) বলেন, ‘C’est le grand art’ অর্থাৎ এটি একটি মহৎ শিল্প। এ ছাড়া সে সাধারণ ব্যক্তি আরও জানতে পারত অনেক নান্দনিক পদ্ধতিতে-যেমন বিজ্ঞ অধ্যাপক ক্রলিক-এর (Kralik) নন্দনতত্ত্বে (Weltschonheit, Versuch einar allgemeinen Esthetik, Von Richard Kralik ) Ges BI-i (Guyau) Les problems de I’ esthe tique Contemporaine পোশাক পরিচ্ছদ, রুচিকর আহার্য, এবং স্পর্শেল আনন্দকেও শিল্পের অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে।
আমাদের আত্মলীন উপলব্ধি থেকে শিল্পের পঞ্চমুখী বিকাশ ঘটে-এ কথা বলেছেন ক্রলিক। এগুলি পাঁচ ইন্দ্রিয়ের নান্দনিক ব্যবহার। এই পাঁচ প্রকরণের শিল্প নিম্নরূপ : এর মধ্যে প্রথমটি সম্পর্কে তিনি বলেন : রসনেন্দ্রিয়ের শিল্প…শৈল্পিক উপস্থাপনার উপাদান যোগাবার জন্য সাধারণত দুটি, কিংবা বড় জোর তিনটি ইন্দ্রিয়কে যোগ্য মনে করা হয়। কিন্তু আমার মনে হয় এই মতটি শর্তসাপেক্ষে সঠিক। আমি এ তথ্যের উপর খুব বেশি জোর দেব না, কারণ, আমাদের সাধারণ ভাষা ব্যবহারে আরও অনেকগুলি শিল্পের স্বীকৃতি আছে-দৃষ্টান্ত স্বরূপ বলা যায় রন্ধনশিল্প।
আরও বলা হয়েছে : রন্ধনশিল্প পশুর মৃতদেহকে যখন সর্বতোভাবে আস্বাদ্য বস্তুতে পরিণত করে তখন এটাকেও নিশ্চয়ই নান্দনিক সাফল্যের কাজ বলতে হবে। রাসন- শিল্পের (যা তথাকথিত রন্ধনশিল্পকে অতিক্রম করে) মূল সূত্রগুলি তাহলে হল এই : যে সমস্ত বস্তু খাদ্য বলে বিবেচিত সেগুলিকে কোন ভাবের প্রতীক বলে গ্রহণ করা উচিত এবং প্রকাশিতব্য ভাববস্তুর সঙ্গে তাদের সামঞ্জস্য থাকা উচিত।
রেঁনার মতো এ গ্রন্থকারও (Kostumkunst) পরিচ্ছদ শিল্পকেও শিল্প বলে স্বীকার করেন।
ফরাসি লেখখ গুইও-র অভিমতও অনুরূপ। ইনি আমাদের কালের কিছু কিছু লেখকের বিশেষ শ্রদ্ধার পাত্র। Les problems de I’ esthe tique Contemporaine নামক গ্রন্থে তিনি স্পর্শন, আস্বাদন, এবং ঘ্রাণ প্রভৃতিও নান্দনিক অনুভূতি প্রদান করে বা করতে সক্ষম বলে পেশ গভীর সুরে মত প্রকাশ করেছেন:
‘বর্ণানুভূতিহীন স্পর্শেন্দ্রিয় এমন একটি উপলব্ধ জায়গা যা কেবল দৃষ্টির সাহায্যে পাওয়া সম্ভব নয়, এবং যার নান্দনিক মূল্যও কম নয়, অর্থাৎ সে উপলব্ধি কোমলতার, রেশম পেলবতার এবং মসৃণতার। ভেলভেটের সৌন্দর্য তার ঔজ্জ্বল্যের অপেক্ষা স্পর্শকোমলতার মধ্যে অধিকতর সূচিত। স্ত্রীলোকের সৌন্দর্য সম্পর্কে আমাদের যে ধারণা তাতে ত্বকের কোমলতাও অত্যাবশ্যক উপাদান বলে বিবেচিত হয়।
‘একটু মনোযোগী হলে বোধ হয় আমরা প্রত্যেকে এমন রসনার আনন্দের কথা মনে করতে পারব যা প্রকৃতপক্ষে শিল্পসুলভ আনন্দেরই স্বরূপ।’
পার্বত্য পরিবেশে এক গ্লাস দুগ্ধ পান তাকে কি শৈল্পিক আনন্দ দান করেছিল তা তিনি এ প্রসঙ্গে বর্ণনা করেন।
কাজেই দেখা যাচ্ছে যে, সৌন্দর্যের অভিব্যক্তিই শিল্প-এই ধারণা আপাত দৃষ্টিতে যত সরল মনে হয় মোটেই তত সহজ নয়, বিশেষত যেখানে সাম্প্রতিকতম নন্দন- তাত্ত্বিকেরা আমাদের স্পর্শ, স্বাদ ও ঘ্রাণচেতনাকেও সৌন্দর্যবোধের অন্তর্ভূক্ত করেছেন। কিন্তু সাধারণ লোক এ সব জানে না, বা জানতে চায় না। এ সম্পর্কে তাঁর দৃঢ় প্রত্যয় যে, শিল্প সম্পর্কে সমস্ত প্রশ্নের সহজে এবং স্পষ্টভাবে সমাধান করা যায় যদি সৌন্দর্যকে শিল্পের বিষয়বস্তু হিসেবে স্বীকার করে নেওয়া হয়। তার নিকট একথা স্পষ্ট এবং বোধগম্য যে সৌন্দর্য প্রকাশের মধ্যেই শিল্পের অস্তিত্ব নিহিত এবং একমাত্র সৌন্দর্যের প্রসঙ্গেই শিল্প বিষয়ক সব প্রশ্নের সমাধান সম্ভব।
প্রশ্ন ওঠে, শিল্পের যা প্রাণ সে সৌন্দর্য বস্তুটি কী? এর সংজ্ঞা কী?
এর স্বরূপ কী? এটা সব সময় দেখা যায়, একটি কাজের দ্যোতনা যতই ধোঁয়াটে এবং বিভ্রান্তিকর হয়, মানুষ ততই বৃহত্তর আত্মপ্রত্যয় এবং ঋজুতার সঙ্গে শব্দটি ব্যবহার করে। এবং ভাণ করে কথাটি এতই সরল ও স্পষ্ট যে তা প্রকতৃপক্ষে কি বোঝায় তা আলোচনার যোগ্যই নয়।
এভাবেই রক্ষণশীল ধর্মের বিষয়গুলি সাধারণত বিবেচনা করা হয় এবং সৌন্দর্য বিষয়েও মানুষ যথন ওই ভাবেই আচরণ করেন। এটা এখন ধরেই নেওয়া হয় যে, সৌন্দর্য কথাটির মর্ম সবাই বোঝে ও জানে। তা সত্ত্বেও সৌন্দর্যের স্বরূপ এখন পর্যন্ত শুধু যে অজ্ঞাত তা নয়, বরং বিগত একশো পঞ্চাশ বৎসর ধরে (১৭৫০ সনে বৌমগার্টেন কর্তৃক নন্দনতত্ত্ব প্রতিষ্ঠার পর থেকে) বহু পন্ডিত এবং চিন্তাশীল ব্যক্তি এ বিষয়ে বইয়ের পাহাড় রচনা করলেও ‘সৌন্দর্য কী’? -এ প্রশ্ন এখনও অমীমাংসিত থেকে গেছে। নন্দনতত্ত্ব সম্পর্কীয় প্রত্যেকটি নতুন গ্রন্থে নতুনভাবে এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে লিখিত বইয়ের মধ্যে শেষ যে ক্ষুদ্র বইটি আমি পড়ি তা জুলিয়াস মিথেলটার লিখিত। বইখানির নাম- Ratsel des Schonen (The Enigma of the Beautiful অর্থাৎ সুন্দরের হেঁয়ালি)। এই পুস্তকখানির রচনা খুব খারাপ নয়। পুসিতকার শীর্ষনামটি উক্ত প্রশ্ন সম্পর্কীয় অবস্থাটি যথাযথভাবে ব্যক্ত করেছে-সৌন্দর্য কী? একশো পঞ্চাশ বৎসর পর্যন্ত হাজার হাজার পন্ডিতব্যক্তি কর্তৃক এ বিষয়ে বহু আলোচনার পরও সৌন্দর্য শব্দের অর্থ এখনও হেঁয়ালি থেকে গেছে। জার্মানরা এ প্রশ্নের একশো রকমের বিভিন্ন উত্তর দিয়েছেন, যদিও তাদের নিজস্ব ভঙ্গিতে। দেহতাত্ত্বিক নন্দনতত্ত্ববাদীরা, বিশেষ করে হার্বার্ট স্পেনসার, গ্রান্ট এলেন এবং তাঁর গোষ্ঠীভুক্ত ইংরেজরা-প্রত্যেকে নিজের মতো করে এ প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। ফরাসি মুক্তবুদ্ধিজীবীরা এবং গুয়ো (Guyau) এবং টেইন-এর অনুবর্তীরাও এ বিষয়ে নিজেদের মতো করে বলেছেন। এঁরা সকলেই তাঁদের পূর্ববর্তী বৌমগার্টেন, কান্ট, সেলিং, শীলার, ফিটে, উইঙ্কেলমান (Winckelmann) লেসিং, হেগেল, সোপেনহাওয়ার হার্টমান (Hartmann) স্যাচলার (Schasler), কুজ্যাঁ (Cousin), লেভেক্ (Leveque) প্রভৃতির দেওয়া পূর্ব সিদ্ধান্তের কথা জানতেন।
সুতরাং প্রশ্ন ওঠে, সৌন্দর্য এমন কী অদ্ভুত বস্তু যা ভাবনা-চিন্তাহীন লোকের কাছে খুব সরল মনে হলেও যার সংজ্ঞা নির্ণয়ে বিচিত্র প্রবণতাসম্পন্ন বিভিন্ন জাতির দার্শনিকেরা দেড় শতাব্দী কালের মধ্যেও কোন মতানৈক্যে পৌঁছাতে পারেননি? সৌন্দর্যের যে মৌলিক সর্বজনগ্রাহ ধারণার ওপর শিল্পের বিশিষ্টতম মতবাদ দাঁড়িয়ে আছে, তা কী? রুশ ভাষায় Krasota (সৌন্দর্য) শব্দ দ্বারা সেই বস্তুকেই বোঝায় যা দর্শনেন্দ্রিয়ের তৃপ্তি বিধান করে। পরবর্তীকালে মানুষ ‘একটি কুৎসিত কাজ’ অথবা ‘সুন্দর সংগীত’ বলতে শুরু করলেও তাকে ঠিক ভাল রুশ ভাষা বলা যায় না।
বিদেশি ভাষায় অনভিজ্ঞ কোন সাধারণ রুশীয়কে যদি বলা হয়, কোন ব্যক্তি তার শেষ কোটটি কাউকে দান করেছে এবং সে কাজ সুন্দরের পর্যায়ে পড়ে কিংবা যে ব্যক্তি অপরকে প্রবঞ্চিত করেছে, তার সে কাজ কুৎসিত অথবা একটি সংগীত খুবই সুন্দর- তবে সে তার মর্ম অনুদাবনে সমর্থ হবে না।
রুশ ভাষায় কোন কাজ সহৃদয়তামূলক এবং ভাল, নির্দয় বা মন্দ হতে পারে। সংগীত তৃপ্তিদায়ক এবং উত্তম এবং অতৃপ্তকরও মন্দ হতে পারে; কিন্তু ‘সুন্দর’ এবং ‘কুৎসিত’ সংগীত বলে এমন কোন বস্তুর অস্তিত্ব থাকতে পারে না।
‘সুন্দর’ কথাটি মানুষ, ঘোড়া, বাড়ি, দৃশ্য অথবা গতি সম্পর্কে প্রযোজ্য। কোন ক্রিয়া, চিন্তা, চরিত্র অথবা সংগীত যদি আমাদের তৃপ্তি দেয় তবে তাকে আমরা ভাল বলতে পারি অথবা আমাদের তৃপ্তিবিধানে অক্ষম বস্তুকে আমরা মন্দ বলি। কিন্তু যা শুধুমাত্র আমাদের দর্শনের তৃপ্তি বিধান করে আমরা সে ধরনের বস্তুকে বলতে পারি সুন্দর। সুতরাং ‘উত্তম’-এই শব্দটির ধারণার মধ্যেই মধ্যে মঙ্গলের ধারণা অন্তর্ভূক্ত নয়। চেহারা দেখে মূল্য বিচার করে কোন বস্তুকে উত্তম বলার অর্থ সে বস্তু সুন্দর, কিন্তু কোন বস্তুকে যদি আমরা সুন্দর বলি তবে সেটি যে একটি উত্তম বস্তু এ কথা আদৌ বোঝায় না। রুশ ভাষায় এরূপ অর্থই আরোপ করা হয়। সুতরাং ‘উত্তম’ এবং ‘সুন্দর’ শব্দের ধারণার মধ্যে রুশ জনসাধারণের বোধেরই পরিচয় পাওয়া যায়।
সমস্ত ইউরোপীয় ভাষায় অর্থাৎ যে সমস্ত জাতির ভাষায় সৌন্দর্যই শিল্পের সারবস্তু-এ মতবাদ বিস্তার লাভ করেছে সে সব ভাষায় ‘beau’ ‘Schon,’ ‘beautiful,’ ‘bellow’ প্রভৃতি শব্দ স্বরূপত সুন্দর অর্থ বজায় রেকেও চমৎকারিত্ব, সহৃদয়তা প্রভৃতি অর্থও প্রকাশ করে, অর্থাৎ এগুলি ‘উত্তম’ শব্দের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
সুতরাং যে সমস্ত fvlvq ‘belle ame, ‘Schone,’ ‘Gedanken’ অথবা ‘সুন্দর কাজ’ প্রভৃতি মতো অভিব্যক্তির ব্যবহার খুবই স্বাভাবিক হয়ে এসেছে, ওই ভাষাগুলিতে রূপগত সৌন্দর্য নির্দেশক আর কোন যথোপযোগী শব্দ না থাকার কারণ এই, সে ভাব প্রকাশের জন্য ‘beau par la forme,’ ‘beautiful to look at’ দেখতে সুন্দর’ প্রভৃতি একাধিক শব্দ সমবায় ব্যবহার করতে হয়।
একদিকে রুশ ভাষায় ‘সৌন্দর্য’ এবং ‘সুন্দর’ শব্দ অপরদিকে এ নান্দনিক মতবাদ- প্রভাবিত অপর সমস্ত ইউরোপীয় ভাষায় ওই শব্দগুলির যে অর্থ পার্থক্য দেখা যায়, সে পার্থক্য পর্যবেক্ষণ করলে আমরা দেখি শেষোক্ত ক্ষেত্রে ‘সৌন্দর্য’ শব্দ একটি বিশেষ অর্থ অর্জন করেছে যে অর্থে ‘সৌন্দর্য’ আর ‘মঙ্গল’ অভিন্ন।
আরও বৈশিষ্ট্যপূর্ন বিষয় হল, রুশীয়ারা ক্রমাগত বেশি পরিমাণে ইউরোপীয় শিল্পদৃষ্টি গ্রহণ করবার পর থেকে আমাদের ভাষায়ও একই বিবর্তন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। কোন কোন ব্যক্তি বিস্ময় সৃষ্টি না করেও বেশ আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে সুন্দর সংগীত, কুৎসিত কাজ, এমনকি সুন্দর অথবা কুৎসিত চিন্তা সম্পর্কে কথাবার্তা বলেন বা লেখেন। অথচ চল্লিশ বৎসর আগে আমি যখন যুবক ছিলাম ‘সুন্দর সংগীত’ এবং ‘কুৎসিত কাজ’ প্রভৃতি কথা শুধুমাত্র অস্বাভাবিক বিবেচিত হত না, বরং অবোধ্যও ছিল। স্পষ্টত ইউরোপীয় চিন্তা-প্রভাবিত সৌন্দর্যের প্রতি এই নতুন অর্থের আরোপ রুশীয় সমাজে নিজস্ব বস্তু হিসেবে স্বীকৃত হতে শুরু করেছে।
প্রকৃতপক্ষে এই অর্থ কী? ‘সৌন্দর্য’ বলতে ইউরোপীয় মানুষ যা বোঝেন তাই বা কী? এ প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে প্রচলিত নান্দনিক পদ্ধতিতে যে সমস্ত সৌন্দর্যের সংজ্ঞা সাধারণত গৃহীত হয়ে থাকে তার মধ্যে অন্তত ক্ষুদ্র একটি নির্বাচিত সংজ্ঞা আমি এখানে অবশ্যই উদ্ধার করব। আমি বিশেষভাবে অনুরোধ করব পাঠক যেন এই নীরস উদ্ধৃতিগুলি পড়ে পীড়া অনুভব না করেন, বরং এ অংশগুলিকে খুব খুঁটিয়ে পড়েন। জার্মান নন্দনতাত্ত্বিকদের স্ফীতকায় গ্রন্থের উল্লেখ না করেও বলা যায়, এ উদ্দেশ্যে খুব উৎকৃষ্ট গ্রন্থ হবে ক্রলিক (Kralik) -রচিত জার্মান গ্রন্থ কিংবা নাইট (Knight)-রচিত ইংরেজি রচনা অথবা লেভেক (Leveque)- রচিত ফরাসি গ্রন্থ। এ বিষয়ে বিজ্ঞ নন্দন- তাত্ত্বিকদের মধ্যে অন্তত একজনের রচনা পাঠ অবশ্যই প্রয়োজনীয়। যেহেতু এই চিন্তার রাজ্যে কত মতবৈচিত্র্য এবং ভয়ঙ্কর অস্পষ্টতা বিদ্যমান সে বিষয়ে নিজের প্রত্যক্ষ পরিচয় সাধনের জন্য অন্যতর পন্থা নেই। এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অপরের উপর নির্ভরশীল না হওয়াই কর্তব্য।
জার্মান নন্দনতত্ত্ববিদ্ স্যাচলার (Schasler) তাঁর নন্দনতত্ত্ব সম্পর্কীয় প্রসিদ্ধ, বৃহদায়তন, পুঙ্খনুপুঙ্খ তথ্য সম্বলিত গ্রন্থের ভূমিকায় যা বলেছেন উদাহরণ স্বরূপ এখানে তা উদ্বৃত হল :
‘নন্দনতত্ত্বের ক্ষেত্রের মতো খুব কম দার্শনিক বিজ্ঞানের সীমায় আমরা এরূপ বিভিন্নমুখী পরীক্ষাপদ্ধতি এবং ব্যাখ্যা দেখি যা প্রায় স্ব-বিরোধিতার সামিল। একদিকে আমরা যেমন পাই অসার মার্জিত শব্দসজ্জা-যার অধিকাংশ অত্যন্ত একপেশে ও অগভীর, তেমনি অপর দিকে সমীক্ষণের অনস্বীকার্য গভীরতার সঙ্গে বিষয়বস্তুর ঐশ্বর্য যুক্ত হওয়ায় আমরা পাই দার্শনিক পরিভাষার কুৎসিত বিসদৃশতা যা অতি সহজ ভাবকে বিমূর্ত বিজ্ঞানের সাজসজ্জায় ভূষিত করে-এই বিশ্বাসে যেন এভাবেই এগুলিকে এই তন্ত্রের পবিত্র প্রাসাদে প্রবেশ করবার উপযুক্ত করে তোলা হচ্ছে। পরিশেষে সমীক্ষা এবং ব্যাখ্যার এই দুই পন্থার মধ্যবর্তী তৃতীয় আর একটি সেতুস্বরূপ পদ্ধতিও দেখা যায় যাকে বলা যায় বিভিন্ন মতের যথেচ্ছ সংকলন-কখনও মার্জিত বাক্যবন্ধের প্রদর্শনী, আবার কখনও পান্ডিত্যের আড়ম্বর..। এ তিনটি ত্রুটির অন্তর্গত নয় এমন একটি ব্যাখ্যাশৈলী যা প্রকৃতপক্ষে বাস্তবধর্মী এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কেও স্বচ্ছ এবং সর্বজনবোধ্য দার্শনিক ভাষায় প্রকাশ করে তা নন্দনতত্ত্বের রাজ্যে যত কম চোখে পড়বে তেমন আর কোথাও নয়।
স্যাচলারের এই উক্তির যথার্থ অনুধাবনের জন্য স্যাচলারের গ্রন্থখানি পড়াই যথেষ্ট।
একই বিষয়ে ভেরো (Veron) তাঁর নন্দনতত্ত্বসম্পর্কীয় অতি চমৎকার গ্রন্থের ভূমিকায় বলেছেন :
‘নন্দনতত্ত্ব ছাড়া আর কোন বিজ্ঞান অধিবিদ্যাবিদদের স্বপ্নের জগতে এত সম্পূর্ণভাবে সমর্পিত হয়নি। প্লেটো থেকে শুরু করে আমাদের যুগের প্রচলিত মতবাদ পর্যন্ত মানুষ সর্বত্র শিল্পকে বিশুদ্ধ খেয়ালি কল্পনা এবং অতীন্দ্রিয় রহস্যময়তার অদ্ভুত মিশ্রণে পরিণত করেছে-যার মহত্তম প্রকাশ ঘটেছে একটি বিশুদ্ধ আদর্শ সৌন্দর্যের ধারণায়-যে সৌন্দর্য পার্থিব বস্তু সমূহের অপরিবর্তনীয় এবং দৈবী আদি রূপ।
পাঠক যদি নন্দনতত্ত্ব সম্পর্কীয় মুখ্য লেখকদের রচনা থেকে আহৃত সৌন্দর্যের সংজ্ঞা বিষয়ক নিম্নের উদ্ধৃতিগুলি কষ্ট করে পাঠ করেন, তাহলেই তিনি নিঃসন্দিগ্ধ হবেন যে আমাদের এই নিন্দা খুবই যুক্তিযুক্ত।
সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিস্টটল প্রভৃতি থেকে প্লটিনাস পর্যন্ত প্রাচীনদের নামে সৌন্দর্যের যে সংজ্ঞা আরোপিত হয় আমি সেগুলির উদ্ধৃতি দেব না। যেহেতু আমাদের যুগে মঙ্গলবিশ্লিষ্ট সৌন্দর্যের যে ধারণা নন্দনতত্ত্বের ভিত্তি এবং লক্ষ -প্রকৃতপক্ষে প্রাচীনদের সে ধারণা ছিল না। নন্দনতত্ত্বে সাধারণত দেখা যায়, সৌন্দর্য সম্পৰ্কীয় আমাদের ধারণার ব্যাখ্যাকালে প্রাচীনদের এ বিষয়ে সিদ্ধান্তের যখন উল্লেখ করা হয়, তখন তাদের এমন অর্থ আরোপ করা হয় যে অর্থ আদৌ তাঁদের নয়।