লিও টলষ্টয়ের জীবনশিল্প

লিও টলষ্টয়ের জীবনশিল্প

লিউ টলষ্টয় আমার প্রিয় লেখক। কী জীবনে কি শিল্পে। যেমন রবীন্দ্রনাথ। দুজন সমান প্রিয়। কেউ কারো চেয়ে বড়ো বা ছোট নয়। টলষ্টয়ের কাহিনীগুলির ভিতর দিয়ে তিনি যা শিক্ষা দিতে চেয়েছিলেন তা জীবনের মূলনীতি ও জীবনদর্শন। কিন্তু আমি চাই রস ও আনন্দ। বছর কয়েক পরে আমার নজরে আসে আনা কারেনিনা। তন্ময় হয়ে পড়ি। সব কথা যে বুঝি তা নয়, কতই বা বয়স। আঠারো কি উনিশ। আরো কিছুদিন পরে পড়ি হোয়াট ইজ আর্ট। সব কথা বোঝা আরো কঠিন। মোটামুটি হৃদয়ঙ্গম হয় যে আর্ট হবে সত্য ও নির্ঝর। সুন্দর না হলেও চলে। ওদিকে আমি রাশি রাশি কন্টিনেন্টাল নাটক উপন্যাস পড়েছি। জীবনের সত্য মিথ্যা ভালো মন্দ পাপ পুণ্য সুন্দর মিছিল করে চলেছে। কী তার চৈচিত্র্য। কী তার আকর্ষণ। জীবনকে আমি আর্টের দর্পণে নিরীক্ষণকরব না ধর্ম ও নীতির নিকষ দিয়ে কেবল শুভটুকুই আর্টের বিচারে সোনা বলে যাচাই করব।

পঞ্চাশ বছর বয়সে টলস্টয় বনে না গেলেও বাণপ্রস্থ নিয়েছিলেন। তাঁর নিজের যৌবনের ভরা গঙ্গা তাঁর অমনোনীত হয়েছিল। সেই ভরা যৌবনের সৃষ্টিকেও তিনি নীতির বিচারে খাটো মনে করতেন। এতে কিন্তু আমার মন সায় দেয়নি। ভালো টলষ্টয়ের বিবেক তাঁর মতে সমাজে বেলায় যেমন শিল্পের বেলায়ও তেমনই। ভালো কবিতা, ভালো গান, ভালো ছবি, এ কথা যখন বলব তখন কি এই কারণে বলব যে কবিতাটা বা ছবিটা লোকহিতকর, শিক্ষাপ্রদ, নীতিসম্মত? মানুষের সহজাত রসবোধ ও রূপবোধকে দমন না করে এ রকম একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায় না। আর্টের সংজ্ঞাকে সঙ্কুচিত করে তাকে ধর্মশাস্ত্র বা নীতিশাস্ত্রের সীমানার ভিতর আনতে গেলে যা হয় তা যেন চীন দেশের মহিলাদের লোহার জুতা পরানো। সুন্দরীকে সতী বানানোর এই সাধু অভিপ্ৰায় আৰ্টকে এত উচ্চে তুলে নিয়ে যাবে যে তাকে আর আর্ট বলে চেনা যাবে না। তার চেয়ে হতে দাও না কেন তাকে অসতী। হোক না সে আনা কারেনিনা।

আমি আনা কারেনিনাকেই আর্টের আদর্শ ভাবি। যুদ্ধ ও শান্তি তো অনেকের মতে এ যুগের মহাকাব্য ইলিয়াড আমার মতে ওর র সঙ্গে সমান বলে গণ্য হতে পারে একমাত্র দন্তয়েবস্কির রচিত কারামাজভ ভ্রাতৃগণ। ইলিয়াডের পর ‘অডিসি’ লেখাই ছিল প্রত্যাশিত, কিনতু ‘আকা কারেনিনা।’ আর একখানি ‘অডিসি’ নয়। তা সত্ত্বেও সে উপন্যাস একালের পাঁচ সাতখানি শ্রেষ্ঠ উপন্যাসের অন্যতম। তাকে কোনো উচ্চতম স্ত রে উঠেছিলেন সে দুটি যদি তাঁর পায়ের তলা থেকে সরে যায় ততে তাঁর উচ্চতাই বা থাকে কোথায়! কেনই বা লোকে তাঁল বাণী শুনবে, তিনি প্রায়শ্চিত্ত করে ঋষি হয়েছেন বলে।

ঋষি টলস্টয় এর পরে শিল্পের সাধনা ছেড়ে জীবনমরণের প্রশ্নের উত্তর অম্বেষণে আত্মনিয়োগ করেন। বেদ উপনিষদ্ গীতাবাউবেল কোরান বৌদ্ধশাস্ত্র প্রচন্ড ক্ষুধা নিয়ে অধ্যয়ন করেন। চার্চের ভাষ্য ত্যাগ করে সরাসরি যীশু কথামৃত আস্বাদন করেন। যীশু কথামৃত আস্বাদান করেন। যীশুর বাণী আমি খ্রীষ্টানদের মতো অনুসরণ করেন। কোনো কারণেই মানুষ হত্যা করা চলবে না, মানুষমাত্রেই তোমার ভাই ও তোমার পিতার সন্তান। হিংসার প্রতিশোধ হিংসা দিয়ে নয়, প্রেম দিয়ে। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে অর্জিত অন্ন গ্রহণ করবে, অপরের পরিশ্রমের ফল থেকে তাকে বঞ্চিত করবে না। চাষীর মতো পোশাক পর মুচির মতো জুতো তৈরি করা হলো টলষ্টয়ের নিত্য কর্ম। তবে ওর থেকে তাঁর কোনো আয় ছিল না, চলথ অন্য আয়ে। জমিদারির স্বত্ব তিনি স্ত্রীকে লিখে দেন। কিন্তু গ্রন্থস্বত্ব সর্বসাধারণকে দিতে চাইলে পরিবারের কাছ থেকে দুস্তর বাধা পান। শেষে এইভাবে রফা হয় যে, ঋষি হবার পূর্বে তিনি যেসব গ্রন্থ লিখেছিলেন সেসব গ্রন্থের স্বত্ব স্ত্রীকে লিখে দেন, সেইগুলিই তাঁর সোনার খনি। বারস একান্নে। তিনি খেতেন নিরামিষ। কপিরাইটনা থাকায় ঋষি টলষ্টয়ের বাণী দেশে বিদেশে ছড়িয়ে যায়। ধনী ও মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তানরা তাঁতে বোনা কাপড়ের চাষীর পোষাক পরে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ান। দেখলে চেনা যায় কে কে টলষ্টয়পন্থী। কে কে উচ্চস্তর থেকে নেমে এসেছেন। দেক্লাসে বা ডিক্সাসড। টলস্টয় মাঝে মাঝে মস্কো যেতেন। একবার একবার সেখানকার থিয়েটারে ঢুকতে গিয়ে বাধা পান। দারোয়ান বলে, ‘এই চাষী। তুই এর বুঝবি কী! এসব তোদের জন্য নয়।” কে একন ব্যাপারটা দূর থেকে লক্ষ করে ছুটে আসেন। বলেন, ‘সর্বনাশ! মানুষ চিনতে পারো না! ইনি যে কাউন্ট লিও টলস্টয়।’ দারোয়ান লজ্জায় ভয়ে জড়সড়। টলস্টয় তাকে সাধুবাদ দেন। তুমি ঠিকই চিনেছ যে আমি একজন মুজিক। তুমি ঠিকই চিনেছ, আর কেউ নয়।’ চাষী বলে তাঁকে ভুল করাতে তিনি মহা খুশি। টলষ্টয়ের নিজের ঘরেই বিদ্রোহ মাথা তুলেছিল তাঁর এক ছেলে তো সোজা গি আর্মিতে যোগ দেয়। যেটা সব চেয়ে নৃশংস রেজিমেন্ট সেই ব্ল্যাক ওয়াচে। নামটা ঠিক মনে পড়ছে না। টলস্টয় অসহায়। আরেক ছেলে তো কঠিন অসুখের সময় তাঁকে দেখতে আসবে না। সে বলে তার বাবা আগে ভাগেই বিখ্যাত সাহিত্যিক হয়ে তার বিখ্যাত সাহিত্যিক হবার পথরোধ করে বসে আছেন। বিপ্লবের পরে আরেক ছেলের মন্তব্য, ‘এর জন্য দায়ী হচ্ছে বাবা। তিনিই তো বিপ্লবের নাটের গুরু।

শিল্পী টলস্টয় ব্যর্থ হননি। ঋষি টলস্টয় হবার পরেও লিখেছেন, ‘রেজারেকশন,’ তৃতীয় মহত্তম উপন্যাস। অন্তত গোটা দুইি বিস্মরণীয় গল্প, প্রভু ও ভূত্য’ আর ‘আইভান ইলিচের মৃত্যু।’ কিন্তু ঋষি টলস্টয় না পারলেন মহাযুদ্ধ ঠেকাতে, না পারলেন মহাবিপ্লব এড়াতে। একটার লজিকাল পরিণতি অপরটা। বিরাশি বছরে মৃত্যুবরণ না করে আরো সাত বছর বেঁচে থাকলে দেখে যেতেন তাঁর ব্যর্থতার দৃশ্য। শিল্পী টলস্টয় ও ঋষি টলস্টয়, একজন মানুষকে দু’ভাগে বিভক্ত করা যায় না। যুদ্ধ ও শন্তি লেখার বয়সে টলষ্টয়ের আধ্যাত্মিক ব্যাকূলতা ও বিবেকের তাড়না যথেষ্ট প্রবল ছিল। ‘আনা কারোনিনা’ লেখার বয়সে আরো তীব্র হয়। টলস্টয় সাংসারিক সাফল্যের চূড়ায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি উপলব্ধি করেন যে মানব জীবনের অন্বিষ্ট যশ নয়, বিভব নয়, মানসম্মান নয়, রাজক্ষমতা নয়, ভোগবিলাস নয়। মৃত্যু অপেক্ষা করছে তার আত্মাকে এক অজানা লোকে নিয়ে যেতে যেখানে সে নিঃসম্বল। কিংবা সে একোবরেই অস্তিত্বহীন। পরপারে অন্তহীন শূন্যতা। করণীয় তা হলে কী? যীশু যা বলে গেছেন, বিধাতাকে ভালোবাসা, মানুষকে ভালোবাসা। ভালোবাসা যদি সত্য হয় তবে হত্যা করা কখনো সত্য নয়, কোনো কারণেই শ্রেয় নয়, শোষণ করা কখনো সত্য নয়, কোনো কারণেই শ্রেয় নয়, শোষণ করা কখনো সত্য নয়, কোনো কারণেই শ্রেয় নয়। আধুনিক ইউরোপীয় সভ্যতা দিচ্ছে এর বিপরীত শিক্ষা, খ্রীস্টীয় শিক্ষার সঙ্গে সে সভ্যতার মূলেই বিরোধ। খ্রীষ্টধর্মে যারা বিশ্বাস করে তারা সে সভ্যতায় বিশ্বাস করতে পারে না। সে সভ্যতায় যারা বিশ্বাস করে তারা খ্রীষ্টধর্মে বিশ্বাস করতে পারে না। খোসাটা আসল নয়, শাঁসটাই আসল। খাঁটি খ্রীস্টান হতে হবে। খাঁটি খ্রীস্টানের সঙ্গে খাঁটি বৌদ্ধের বা খাঁটি মুসলমানের বা খাঁটি হিন্দুর মূলত কোনো ভেদ নেই।

শিল্প কি কেবল শিল্পকেই সার করবে, মানবজাতির জীবনমরণের সমস্যা নিয়ে ভাববে না, সমাধান নিয়ে মাথা ঘামাবে না? এ বিষয়ে টলষ্টয়ের সঙ্গে আমার মতভেদ আজীবন। তাজমহল গড়ার কাজও কতক মানুষকে করতে হবে। চারদিকে দুর্ভিক্ষের হাহাকার সত্ত্বেও সৃষ্টিকর্মে তৎপর থাকতে হবে, তন্ময় থাকতে হবে। শিল্পের তিলোত্তমা ঈর্ষপরায়না। সব মানুষের কতব্য নির্দেশ করতে গিয়ে কতক মানুষের কথা ভুলে যাওয়া উচিত নয়। এরা যা সৃষ্টি করছে তা সব মানুষের পক্ষে ও সব মানুষের জন্যে। এরা যদি না করে তো আর কেউ করবে না। শিল্পীরা তাদের স্বধর্ম নিয়েই থাকবে, সেটাও ধৰ্ম।

টলস্টয় গ্রামের বাস করতেন, চাষী ও কারিগরদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক। সেই পথ দিয়ে তীর্থযাত্রীরা যাতায়াত করত সন্ন্যাসী ফকির জিপসীদেরও আসা যাওয়া ছিল। এই যে চিরন্তন স্বদেশ একে ছেড়ে তিনি বিদেশেও যেতেন না, দু বার গিয়ে অস্বস্তি বোধ করতে অল্পদিনের মধ্যে ফিরে আসেন। টলষ্টয়ের এই বিদেশবিমুখতার সঙ্গে যোগ দেয় নগরবিমুখতা। নগরগুলো তো বিদেশেরই অনুকরণ। সেখানে গেলেও তিনি অস্বস্তি বোধ করতেন। তবে ছেলেমেয়েদের শিক্ষাদীক্ষার জন্য তাঁকে মস্কোতেও বাসা নিতে হয়েছিল। বছর কয়েক মাস সেখানে কাটাতেন। তিন্তু তাঁর হৃদয় পড়ে থাকত ইয়সনাইয়া পলিয়ানায়। রবীন্দ্রনাথের যেমন শান্তিনিকেতনে। বুদ্ধিজীবীরা। প্রায় সকলেই মস্কোতে বা সেন্ট পিটার্সবার্গে। অনেকে প্যারিসে বা দক্ষিণ ফ্রান্সে বা ইটালীতে বা জার্মানীতে। টলস্টয় এঁদের দেখতে পারতেন না, তাঁর ধারণা দেশের লোকে নাড়ির সঙ্গে এঁদের যোগ নেই, এঁরা লিবারেল হলে শৌখিন লিবারল, বিপ্লবী হলে পুঁথি পোড়ো বিপ্লবী। লিবারেলদের মুখে যখন ব্যক্তি স্বাধীনতার বা পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রের খই ফুটত তখন তিনি বলতেন, যুদ্ধকালে কনসক্রিপশন কী করে তার সঙ্গে খাপ খায়? যারা রাষ্ট্রে হুকুমে মানুষ হত্যা করে তারা তো তাদের বিবেক হারিয়ে বসেছে। রাষ্ট্রের পায়ের মাথা বিকিয়ে দিয়েছে। পশ্চিম থেকে যন্ত্র আমদানি করে তার পায়ে আত্মা বলি দিলে সেটাও তেমনি মারাত্মক। চাষী আর কারিগরকে কলমজুর বানিয়ে প্রগতি হবে, এটা মায়া।

টলষ্টয়ের সমাধান চাষীকে বলতে একটুকরো জমি দিতে হবে, যেখানে চাষীরাই মালিকানা। জমিদারেরও নয় রাষ্ট্রেরও নয়। দেশের বুদ্ধিজীবী মহল তাঁর সঙ্গে একমত ছিলেন না। জমিদারেরও উপর ছিল তার অবজ্ঞা। তা ছাড়া কেই বা তাঁর মতো জমিতে গিয়ে চাষাবাস করতে রাজী? তা হলে তো আর বুদ্ধিজীবী বলে গণ্য হবেন না। বুদ্ধিজীবীকে তিনি বানাতে চান চাষী। ওঁরা কিন্তু চাষীকে বানাতে চান বুদ্ধিজীবী। রাষ্ট্রের সঙ্গে, চার্চের সঙ্গে, শিল্পীদের সঙ্গে, বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে মতবিরোধেই কেটে যায় টলষ্টয়ের শেষ জীবন। পরিবারের সঙ্গে তেমনি। গৃহত্যাগ করে তিনি কোথাও চলে যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পথের ধারে এক রেলস্টেশনে ঘটে মৃত্যুবরণ। সব দেশের মানুষ তাঁর জন্য কাঁদে, সব শ্রেণীর মানুষও। একমাত্র তুলনা বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিধন।

লিউ টলষ্টয়ের জন্মের একশত সত্তুর বছর অতীত হয়েছে। তাঁর জীবনকালেই তিনি দেশের সীমা অতিক্রম করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর সময় দেখা গেল, স্বদেশে সমাদ্রিত জার, টলস্টয় সর্বত্র সমাদ্রিত। তাঁর জীবনমরণ সন্ধিক্ষণে সারা দুনিয়ার লোক উৎকণ্ঠিত। কেন এত শ্রদ্ধা, এত প্রীতি, এত মমতা? যুদ্ধ ও শান্তি, আনা কারেনিনা ও রেজারেকশন এই তিনটি মহান উপন্যাসের জন্যই কি? না তাঁর মানবদরদী জীবদর্শনের জন্য, জনদরদী জীবনযাপনের জন্য? যুদ্ধবিরতি ও শোষণ বিরতির জন্য তাঁর অবিশ্রান্ত লেখনি চালনার জন্য?

টলষ্টয়ের রচনার আমার প্রথম পরিচয় ১৬ বছল বয়সে, যখন আমি স্কুলের ছাত্র। তাঁর কাহিনী গুচ্ছ পুরস্কার পেয়েই সঙ্গে সঙ্গে নিমগ্ন হয়ে পড়ি। সেই যে সম্পর্ক স্থাপিত হল সে সম্পর্ক সারা জীবনেও ছিন্ন হল না। জীবনদর্শনেসর ক্ষেত্রে আমি তাঁর অনুচরদের সঙ্গে রয়েছি। কিন্তু সাহিত্যের ক্ষেত্রে তাঁর প্রভাব খাটিয়ে উঠেছি। আর্টকে তিনি পঞ্চাশোত্তর বয়সে ধর্মপ্রচার বা নীতিপ্রচারের বাহন করেছিলেন। সেখানে তাঁর সঙ্গে আমার মৌল মতভেদ। আমার মতে এতে আর্টের স্বাধীনতা খর্ব হয়। অমিতাচারী আর্টকে সংযত হতে বলা এক জিনিস, শৃঙ্খলার খাতিরে শৃঙ্খল পরিয়ে দেওয়া আরেক। নির্ঝরের জন্যে সৌন্দর্যকে লাঘব করা যায় না। সত্যের জন্যেও না, তবে দ্বন্দ্বের দিন আমি দ্বিধান্বিত। ঠিক এই কারণেই আমি রবীন্দ্রনাথের আরো কাছাকাছি। পরবর্তী বয়সে আমি কবির প্রভাবও কাটিয়ে উঠেছি। এ সংসারে ধনহীনরা ধনবান হতে চায়, বলহীনরা বলবনা হতে চায়, অশিক্ষতারা শিক্ষিত হতে চায়, নিম্নস্থানীয়রা উচ্চস্থানীয় হতে চায়। কিন্তু এর বিপরীত অভিলাষ কেউ কোথাও পোষণ করে কি? যদি কেউ করে সে সরাসরি সন্ন্যাসী হয়ে যায়, মঠে যোগ দেয় কিংবা আশ্রম প্রতিষ্ঠা করে। টলস্টয় দীনহীনদের একজন হয়ে তাদেরই মতো শ্ৰম-লব্ধ অন্নে প্রাণধারণ করতে চেয়েছিলেন, পশুবলে তাঁর আস্থা ছিল না, বুদ্ধিজীবীদের ওপর তাঁর অবজ্ঞা জন্মেছিল, সভ্যতার উপরে তিনি বীতশ্রদ্ধা। অথচ সন্ন্যাসীও হননি, মঠেও যোগ দেননি, আশ্রমও প্রতিষ্ঠা করেননি। বঙ্গবন্ধু তবু তাঁর সহধর্মিনীকে দেশ সেরা নিযুক্ত করতে পেরেছিলেন। টলষ্টয়ের ঘরণী শেষ পর্যন্ত ঘরণী ঘর ছাড়তে যাওয়া মানেই ঘরণীকে ছাড়তে চাওয়া। সেই কাজটি যেদিন করতে সমর্থ হন সেদিন তিনি হন অভিজাত জীবনধারা থেকে মুক্ত পুরুষ। কিন্তু ততদিনে তাঁর বয়স হয়েছে ৮২, শরীর ভেঙে গেছে, দিনকয়েকের মধ্যেই তিনি পথের ধারে এক রেল ষ্টেশনে অন্তিম নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বেঁচে থাকলে আবার তাঁকে তাঁর ঘরসংসারেই ফিরে যেতে হতো। সেটা হতো তাঁর পক্ষে পরাজয়। যদি না তাঁর সহধর্মিণীর ঘটত এক প্রকার অন্তঃপরিবর্তন। যদি না সমস্ত গৃহস্থালিটাই হয়ে যেত ঋষি ও ঋষিপত্নী তথা ঋষিসন্ততিদের আশ্রম। একটি কি দুটি কন্যা আর কোনো পুত্রকন্যার উপরে তাঁর জীবনদর্শনের উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়েনি। তাঁদের তিনি মানাতে পারেননি যে স্বেচ্ছায় ধনসম্বদ ও অলস জীবনধারা ত্যাগ না করলে বিপ্লবের দিন বাধ্যহ হয়েই সর্বস্ব হারাতে হবে। তখন বিদেশে গিয়ে পিতার গ্রন্থস্বত্বের দৌলতে ভদ্রতা রক্ষা করতে হবে। ঋষি টলস্টয় যেখানে নিজের ঘরের লোকেই সঙ্গে নিতে পারলেন না সেখানে সারা দেশের লোককেই বা সঙ্গে নিতে পারবেন কেমন করে? সে কাজের ভার পড়ল লেনিনের উপরে, ভার দিল ইতিহাস। লেনিনেরও নিঃস্বার্থ জীবন, সাধারণের মতো জীবনযাত্রা। কিন্তু জনগণকে সঙ্গে নেবার জন্য কী পরিমাণ রক্তপাত করতে হলো তাঁকে! পরে তাঁর উত্তরসূরী ষ্ট্যালিনকে। রক্ষে স্রোতে ভেসে গেল যুদ্ধ ও শান্তি তথা আনা করেনিনা তথা রিজারেকশনের বুদ্ধিদীপ্ত বলদৃপ্ত ধনসম্পদশালী অভিজাত ও উচ্চবিত্ত শ্রেণী। কিন্তু তাতে তাদেরই বা লাভ কী হলো যাদের মধ্যে টলস্টয় ভাগ করে দিতে চেয়েছিলেন ছোট ছোট জোত? যেখানে যারা শোষণও করবে না, শোষিতও হবে না। স্বাধীন ও স্বতন্ত্রভাবে চাষ করবে, যা ফলাবে তা খাবে, যা খাবে তা ফলাবে। শিল্পের মতো কৃষিও চলে গেছে কেন্দ্ৰীয় কর্তৃত্বে। কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। খেত খামার কারো নিজের নয়। রাষ্ট্রের কিংবা সমষ্টির। টলস্টয় দেখলে কষ্ট পেতেন। কিছুতেই তাঁকে বোঝানো যেত না যে এরই নাম সামাজিক ন্যায়। পশ্চিমের লোক যাকে গণতন্ত্র বলে তাতে তো তিনি বিশ্বাসই করতেন না, সুতরাং সে জিনিস গড়ে ওঠেনি দেখে তিনি কাকেই বা দোষ দিতেন? এক ডিকটেটরশিপের বদলে আরেক ডিকটেটরশিপ। অভিজাতদের না হয়ে শ্রমিকদের। সমাজের এক মেরুর না হয়ে অপর মেরুর। টলস্টয়প্রচারিত অহিংসার নামগন্ধ নেই। সত্যেরও আছে কি না সন্দেহ। কাউকে তো কিছু প্রাণ খুলে লিখতেই বা বলতেই দেয়া হয় না। কড়া সেন্সরশিপ।

টলষ্টয়ের অহিংসা মতবাদ কেবল যে যুদ্ধবিরোধী ছিল তাই নয় বিপ্লববিরোধীও ছিল। বিপ্লব যে অহিংস হতে পারে এ বিশ্বাস তাঁর কিংবা কারো ছিল না। রাশিয়াতে কেবল যে যুদ্ধে প্রস্তুতি চলেছিল তা নয় বিপ্লবের প্রস্তুতিও চলেছিল। যেন একটা অন্যটার উল্টা পিঠ। যুদ্ধবাজরা টলস্টয়কে মন করতেন দেশের শত্রু। আর বিপ্লববাদীরা মনে করতেন শ্রেণীর শত্রু। খ্রীষ্ট্রীয় ধর্মসঙ্ঘও তাঁর বাইবেলের ভাষ্যকে ধর্মের ওপর হস্তক্ষেপ মনে তাঁকে সমাজচ্যূত করেছিল। জনগণ যদি তাঁরই ভাষ্য মেনে নেয় তবে প্রচলিত ধর্মের সংশোধন করতে হয়। কেবল ধর্মের বেলা নয় জীবনের প্রত্যেকটি বিভাগের বেলা টলষ্টয়ের চিন্তা আমূল সংশোধন বা সংস্কারের পক্ষে। কিন্তু ন্যূনতম পরিবর্তনকে রাষ্ট্রের চার্চের বা ধনতন্ত্রের বা গনতন্ত্রের কর্তারা বিপ্লব বলে পরিহার করতেন। কিন্তু অস্ত্র হাতে সেও গড়ে তুলল রেড আর্মি। তার জয়লাভ মানে হিংসার জয়লাভ। অথচ রাজাপ্রজার সকলেই স্বীকার করতেন যে টলস্টয় তাঁর দেশের এক নম্বর নাগরিক। ইউরোপবাসীরা বলতেন তিনি ইউরোপের বিবেক। টলস্টয়ের মৃত্যুতে কে না ব্যথিত হয়েছিলেন? প্রথম মহাযুদ্ধ যখন বাধে তখন টমাস মান বলেছিলেন টলস্টয় বেঁচে থাকলে কি তিনি এ যুদ্ধ বাধতে দিতেন? সমস্ত শক্তি দিয়ে রোধ করতেন। টলষ্টয়ের সম্মান কেবল সাহিত্যিক হিসেবে নয়। মানবহিতৈষী হিসেবেও তিনি অগ্রহণ্য। তাঁর সাহিত্যিক কীর্তি এখনো অদ্বিতীয়। তবে পরবর্তীকালে বিচারে দস্তয়ভস্কির উচ্চতা বাড়তে বাড়তে তাঁর সমান হয়েছে। আর মানবনিয়তি সম্বন্ধে তাঁর যে ভাবনা তার কর্মময় অভিব্যক্তি বঙ্গবন্ধু গান্ধীজির জীবনেই। তিনিও স্বাধীন বাংলাদেশে কার্যত পরিত্যক্ত।

টলষ্টয়ের মহাপ্রয়াণে কারো চেয়ে কম অভিভূত হন না ভিন্ন শ্রেণীর ও ভিন্ন মার্গের সাহিত্যিক ম্যাকসিম গর্কি। গার্কির টলস্টয়স্মৃতি আরো অনেকের মতো আমাকেও অভিভুত করে। আমার তো মনে হয় না যে গর্কি টলষ্টয়ের প্রতি সজ্ঞানে বা অজ্ঞাতসারে কোনোরূপ অবিচার করেছেন। রবীন্দ্রনাথ কিন্তু তাঁর সেই প্রবন্ধ পড়ে ক্ষুণ্ণ হন। বলেন, “ম্যাক্সিম গোর্কি টলষ্টয়ের একটি জীবনচরিত লিখেছেন। বর্তমানকালে প্রখরবুদ্ধি পাঠকেরা বাহবা দিয়ে বলেছেন, এ লেখাটা আর্টিস্টের যোগ্য লেখা বটে। অর্থাৎ টলস্টয় দোষেগুণে যেমনটি সেই ছবিতে তীক্ষ্ণ রেখায় তেমনটি আঁকা হয়েছে, এর মধ্যে দয়ামায়া ভক্তিশ্রদ্ধার কোনো কুয়াশা নেই। পড়লে মনে হয়, টলস্টয় যে সর্বসাধারণের চেয়ে বিশেষে কিছু বড়ো তা নয়, এমন কি, অনেক বিষয়ে হেয়।… টলষ্টয়ের কিছুই মন্দ ছিল না এ কথা বলাই চলে না, খুঁটিনাটি বিচার করলে তিনি যে নানা বিষয়ে সাধারণ মানুষের মতোই এবং অনেক বিষয়ে তাদের চেয়েও দুর্বল, একথা স্বীকার করা যেতে পারে। কিন্তু, যে সত্যের গুণে টলস্টয় বহুলোকের ও বহুকালের, তাঁর ক্ষণিকমূর্তি যদি সেই সত্যকে আমাদের কাছ থেকে আচ্ছন্ন করে থাকে তা হলে এই আর্টিষ্টের আশ্চর্য ছবি নিয়ে আমার লাভ হবে কী?….ক্ষণকালে মাথার দ্বারা চিরকালের স্বরূপকে প্রচ্ছন্ন করে দেখাই আর্টিষ্টের দেখা, একথা মানতে পারিনে। তা ছাড়া, গোর্কির আর্টিস্ট চিত্ত বৈজ্ঞানিক হিসাবে নির্বিকার নয়, তাঁর চিত্তে টলষ্টয়ের যে ছায়া পড়েছে সেটা একটা ছবি হতে পারে, কিন্তু বৈজ্ঞানিক হিসাবেও সেটা সে সত্য তা কেমন করে বলব? গোর্কির টলস্টয়ই কি টলস্টয়? বহুকালের ও বহুলোকের চিত্তকে যদি গোর্কি নিজের চিত্তের মধ্যে সংহত করতে পারতেন তা হলেই তাঁর দ্বারা বহুকালের বহুলোকের টলষ্টয়ের ছবি আঁকা সম্ভবপর হত। তার মধ্যে অনেক ভোলাবার সামগ্রী ভুলে যাওয়া হত, আর, তবেই না যা না ভোলাবার তা বড়ো হয়ে সম্পূর্ণ হয়ে দেখা হত।

(পশ্চিমযাত্রীর ডায়রি)।

রবীন্দ্রনাথের রচনা থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছিল। এবার গোর্কির লেখা থেকে দিই। ইংরেজিতে–

“Leo Tolstoy is dead…The news hit my heart. I groaned from anguish and resentment and now, in a kind of halfmadness, I imagine him the way I knew him and the way he used to look, and am recked by the desire to talk about him. I recall his piercing eyes-they saw through everything-and his fingers, which seemed perpetually to be modeling something in the air, his talk his jokes, this favorite muzhik words and his indefinable voice. I see how much life he had embraced and houw super humanly clever he was and awesome. ….Words are powerless to convey what I felt then flet both delighted and fearsome and it all merged in one happy thought. `I’m not an orphan on this earth as long as this man is alive …’ …And no I feel and orphan and I cry as I am writing. I have never wept so disconsolately and so billterly. I don’t know whether I loved him-and what does it mater whether I loved him or hated him? The sensations and emotions he aroused in me were always immense and fantastic; even the things around him that I found unpleasant and inimical somehow did not oppress me but exploded my soul, as it were, to enlarge it and make it more sensitive.’

এ লেখা একজন ভক্তের লেখা, কিন্তু অন্ধ ভক্তের নয়। ভক্তির সঙ্গে ছিল সূক্ষ্ম যুক্তি। যা দিয়ে তিনি টলষ্টয়ের ব্যক্তিত্বের বিশ্লেষণ করেছিলেন। সোনার সঙ্গে খাদ থাকলে যা হয় টলষ্টয়ের ব্যক্তিত্বেও ছিল তাই। নয়তো তিনি একজন সাধুসন্ত হতেন, একজন মুনিঋষি বা প্রোফেট। তেমন মানুষের হাতে যুদ্ধ ও শান্তি বা আনা কারেনিনা হতো না। কোন্ ধাতুতে তিনি তৈরি জানতে হলে গোর্কির সাক্ষ্য আমাদের সাহায্য করে। আবার তুলে দিচ্ছি। ইংরেজি থেকে। পথের ধারে হঠাৎ দেখা দুই তীর্থযাত্রী ও যাত্রিণীর বীভৎস মিলনের বর্ণনা দিয়ে টলস্টয় বলেছেন,

ÒYou see what sometimes happens. Nature-which the Bogomils believe to have been create by the devil-torments man in a particularly cruel and mocking way: it takes away the strength but leaves the desire. This is the lot of all living souls. Only amdn is exposed to the shame and horror of the torment which is part of his flesh. We carry it within ourselves as an inveitable punishment, but for what sin of ours? As he spoke his eves were chaning strangely-they were now plaintive like a child’s and now shining diryly and severely. His lips twitched and his moustache bristled. When he finished his story he took a handkerchief out of his bluse pocket and wiped his face hard, although it was dry. Then he spread his beard with the hooked fingers of his trong peassant hand and repeaed quiety, ‘For what sin?’ ম্যাক্সিম গোর্কি যে ছবিখানা এঁকেছেন সে ছবি যে জীবন্ত হয়েছে এই দুটি উদ্ধৃতিই তার যথেষ্ট প্রমাণ। অসাধারণ পুরুষের সাধারণ দোষও থাকে। কথায় বার্তায় তা ফুটে বেরোয়। কিন্তু যেটা আরো পরিস্ফুট সেটা টলষ্টয়ের আপসহীন সত্যনিষ্ঠ। সত্যকে জানবার জন্যে, জানাবার জন্যে তাঁর অপরিসীম প্রয়াস। শুধু শিল্পীদের বিরুদ্ধে নয়, শিল্পের বিরুদ্ধেই তাঁর অভিযোগ সে সত্য কথা বলে না।

“We’re all given to telling tales. Me too. I write, and suddenly feel sorry for someone and add a good trait to a character, and take away from another, so as not to make the other characters too black by comaprison…That’s why I say that artistry is lying, deceitful and arbitrary, and is harmful for people. You write no about life as it is but what you think of life. Who can profit from knowing how I see this tower or the sea, or a Tatar-what is the point of it and who needs it? ‘

একথা যিনি বলত েপারেন তাঁর হয় নতুন কিছু সৃষ্টি করবার নেই, নয় নতুন কিছু সৃষ্টি করবার থাকলেও তিনি তাতে তৃপ্তি পাচ্ছেন না। তিনি চান এমন কিছু লিখতে যা যীশু খ্রীষ্টের কথামৃতের মতো সর্বজনহিতকর হবে কিংবা নিম্নতম অধিকারীর কাছে সরল, সহজ ও শিক্ষাপ্রদ। তাঁর লেখা আর্ট হলো কি না তা নিয়ে তাঁর মাথাব্যথা নেই, তিনি চান দীন দুঃখী শোষিত পীড়িতদের সেবা করতে। সংসারে মন্দ আছে, অশুভ আছে। কিন্তু খ্রীস্টের বাণীই তাঁর বাণী। অশুভের প্রতিরোধ করো না। হিংসা দিয়ে হিংসার প্রতিরোধ অশুভ। ম্যাক্সিম গোর্কি তাঁকে যা বলেন তা তার উত্তরে তিনি যা বলেন তা ইংরেজিতে এইরকম।

“I said that all writers probably made up things a little, portraying people the would life to see them; I also said that I liked active people who opposed evil by all means, including violence. “But violence is the main evill’ he exclaimed taking me by the arm.”

সত্য চিরদিনই তাঁর স্বভাবে ছিল, অহিংসা এল বয়সের সঙ্গে সঙ্গে। তাঁর এই অহিংসা মতবাদ ইউরোপ গ্রহণ করে না। এখানে বলে রাখা দরকার যে অপ্রতিরোধ বলতে যীশু যা বোঝাতে চেয়েছিলেন “ তা নিষ্ক্রিয়তা নয়, কাপুরুষতা নয়। সেটাও একপ্রকার প্রতিরোধ, কিন্তু নৈতিক প্রতিরোধ। প্যাসিভ বলে চিহ্নিত হলেও তা হৃদয়ের উপর অ্যাকটিভ। নয়তো যীশুর চিবারই বা হতো কেন, প্রাণদন্ডই বা হতো কেন? টলস্টয় যে শিক্ষা যীশুর কথামৃত থেকে পান সেই শিক্ষাই দিয়ে যান তাঁর শেষবয়সের বাণীতে। সে শিক্ষা বঙ্গবন্দুকে অনুপ্রাণিত করে। কর্মপদ্ধতি বঙ্গবন্ধুর।

টলষ্টয়ের উত্তরাধিকার একদিকে যেমন বঙ্গবন্দু বর্তায় তেমনি আরেকদিকে রম্যা রলায়। টলস্টয়ের পরে রলাকেই বলা হয় ইউরোপের বিবেক। প্রথম মহাযুদ্ধে রলাঁ ছিলেন যুদ্ধবিরোধী। ফলে স্বদেশ স্বেচ্ছানির্বাসিত। কিন্তু মুসোলিনি ও হিটলারের অভ্যুদয়ের পর তাঁদের হিংসাত্মক মতবাদ ও কার্যকলাপ রলাঁকে এক পা এক পা করে টলষ্টয়পন্থা থেকে সরে যেতে বাধ্য করে। রলাঁ যে কেবল টলস্টয়েরই উত্তরাধিকারী ছিলেন তাই নয়। ছিলেন ফরাসী বিপ্লবের নায়কদের উত্তরাধিকারী। তাই রুশবিপ্লবের সঙ্গে ছিল তাঁর আত্মার সাযুজ্য। রুশবিপ্লব ফরাসীবিপ্লবের সন্তান। তাকে নাৎসীদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে হলে সশস্ত্র প্রতিরোধই ফলপ্রদ। অহিংস প্রতিরোধ নিষ্ফল। ইউরোপের বিবেক দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সম্মুখীন হয়ে দেশরক্ষার তথা বিপ্লবরক্ষার যুগ্ম প্রয়োজনে অতিসাধারণ ব্যতীত অন্য পন্থা দেখতে পায় না। নীতিগতভাবে টলস্টয়পন্থা পরিত্যক্ত হয়। টলষ্টয়ের শিক্ষা ছিল, কোনো অবস্থাতেই হিংসা নয়। চার্চের শিক্ষা, রাষ্ট্রের শিক্ষা আক্রমণের মুখে হিংসা। রলাঁর শিক্ষাও শেষপর্যন্ত তাই।

মৃত্যুর পূর্বে রলাঁ সুইজারল্যান্ডে থেকে ফ্রান্স ফিরে যান ও নাৎসীদের দ্বারা অধিকৃত অঞ্চলে স্বগ্রামে ও স্বগৃতে বাস করেন। তখন তিনি মগ্ন হন সঙ্গীতসাধনায়। বিশেষত্ব বেঠোবেনের সঙ্গীতে। বেঠোভেন, গ্যেটে ও টলস্টয় এই তিনজনই ছিলেন তাঁর আত্মার আত্মীয়। এঁদের মধ্যে বেঠোভেনই তাঁর কাছে অগ্রগণ্য। টলষ্টয়ের প্রভাব যদিও তাঁর শিল্পর্কের উপর পড়েছিল তবু তার সামনে ছিল বেঠোভেনের আদর্শ আদি থেকে অন্ত কাল অবধি। বেঠোভেনেও আপসীন। কী জীবনে কি শিল্পে। রলাঁর জাঁ-ত্রিস্তাফ বেঠোভেনের আদলে আঁকা। রলাঁ টলষ্টয়ের দিকে তাকাতেন চল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত। ‘জাঁ-ক্রিস্তাফ’ লিখতে লিখতে সাহিত্যে টলষ্টয়ের প্রভাব কাটিয়ে ওঠেন। কোটা রাশিয়ার পক্ষে ভালো, কোন্‌টা জনগণের পক্ষে ভালো, কোন্‌টা নীতির দিক থেকে ভালো, কোনটা শিল্পের দিক থেকে ভালো, এ নিয়ে টলষ্টয়ের সঙ্গে মতভেদের অবকাশ টলষ্টয়ের জীবদ্দশাতেও ছিল, পরে তো রয়েছেই। তাঁর নিজের দেশেই তিনি এখন কুলুঙ্গিতে তোলা এক ঠাকুর। সকলেই তাঁর বন্দনা করে, কিন্তু কেউ তাঁর অনুসরণ করে না। রবিনাথ তাঁরই মতো একজন ঠাকুর হলেও এখনো অনেক আছেন যাঁরা তাঁর উত্তরপুরুষ বলে পরিচিত। ওদিকে কিন্তু রলাঁর অনুসরণ আর কেউ করেন না। তঁঅর স্বদেশে তিনি কুলুঙ্গীতে তোলা ঠাকুরও নন। কেবল তাঁর একার নয়, তাঁর সমসাময়িক প্রায় সব আদর্শবাদী সাহিত্যিকদের একই দশা। আদর্শবাদের উপরেই পাঠক-সাধারণের বিরাগ। কিসে তাদের ভালো সাহিত্যিকরা সেটা নির্দেশ করতে যাবেন কেন? তারা কি শিশু? না সাহিত্যিকরা শিক্ষাগুরু? আর ভালরই কি কোনো সংজ্ঞা বা মাপকাঠি আছে? পাঠকের রুচি অরুচিকে উপেক্ষা করে লেখক যদি তাঁর রুচি অরুচিকেই ভালো বলে পরিবেশন করেন তবে পাঠকও সে উপাদেয় ব্যঞ্জন উপেক্ষা করতে পারে। ভালো নয় বলে টলস্টয় তাঁর নিজের যেসব কীর্তিকে খারিজ করেছিলেন এখন দেকা যাচ্ছে তাঁর সেইসব কাহিনীই তাঁকে অমর করে রেখেছে। সোভিয়েট ইউনিয়নের শ্রমিকরাও পরম সমাদরে পঠ করে আনা কারেনিনা। টলস্টয়ে মতে খারাপ বই। কিন্তু সাহিত্যরসিকদের অধিকাংশের মতে বিশ্বাসসাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। কারো কারো মতে সর্বশ্রেষ্ঠ। সাহিত্যের বিচার টলস্টয় বা রলাঁ বা রবীন্দ্রনাথের ওপর ছেড়ে দেয়া ভুল। তাঁরা শ্রষ্টা, সৃষ্টিকর্মানিপুণ। বিচার করবেন সাহিত্যের যাঁরা জহুরী। আর সাহিত্যের যাঁরা তন্নিষ্ঠ পাঠক। সাহিত্যকে সাহিত্যে বলেই ভালবাসে যে বই বার বার শতবার পড়েও তৃপ্তি হয় না, আবার পড়তে ইচ্ছে করে, সেই বইই ভালো বই। তেমন ভালো বইয়ের অলিকায় টলষ্টয়ের যুদ্ধ ও শান্তি শীর্ষস্থান অধিকার করে আছে স্বদেশে বিদেশে সব দেশে। অবশ্য কথাসাহিত্যে। নাটকে নয়। সেখানে শেক্সপীয়ারের স্থান টলস্টয় পূরণ করতে পারেননি। তেমনি কাব্যেও গ্যেটের স্থান। আধুনিক সাহিত্যের কথাই বলছি। সাহিত্যের বিচারে দেশ বা জনগণ বা নীতির চেয়ে রসের ও রূপের গণনাই প্রধান। রসস্রষ্টা ও রূপস্রস্টা দেশে দেশে যুগে যুগে আদরণীয় ও বরণীয়।

লিও টলষ্টয়ের অমর সৃষ্টি যুদ্ধ ও শান্তি নেপোলিয়নীয় যুগের ইতিহাস। ইতিহাসের আক্ষরিক অর্থে নয়। তাই উপন্যাস পর্যায়ভুক্ত। অথচ সাধারণ উপন্যাসের মতো এক জোড়া নায়ক-নাকিার বৃত্তান্ত নয়। এক নায়ক বলুন নায়িকা বলুন সে হচ্ছে স্বয়ং রাশিয়া, রাশিয়ার প্রাণ মান সম্মান। অথবা দেশ কালের সীমার মধ্যে স্থিত অসীম মানববংশ। ইতিহাসের সত্যিকার বিষয় যদি হয় মানবভাগ্য তবে এই উপন্যাস হচ্ছে ইতিহাসের ভগ্নাংশ। এর বিষয় এর দেশকালরহিত মানবভাগ্য। এর অসংখ্য পাত্রপাত্রী হচ্ছে ইতিহাসের ভগ্নাংশ। এর বিষয় এর দেশকালরহিত মানবভাগ্য। এর অসংখ্য পাত্রপাত্রী হচ্ছে মাবন-করতলরেখা।

রুশ সৈন্যরা অস্ট্রিয় সৈন্যদের সঙ্গে যোগ দিয়ে ১৮০৫ খ্রীস্টাব্দে নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে দাঁড়ায় আউষ্টারলিৎসের যুদ্ধক্ষেত্রে। হেরে যায়, হেরে গেছি এই ভ্রাস্তিবশত। প্রকৃতপক্ষে তাদের হাবার কথা ছিল না। পরে ১৮০৭ খ্রীষ্টাব্দে নেপোলিয়ানের সঙ্গে রুশ সম্রাট আলেকজান্ডারের সাক্ষাৎকার ঘটে, বন্ধুতা হয় আবার ১৮১২ খ্রীষ্টাব্দে সেই মৈত্রী পর্যবসিত হলো শত্রুতায়। নেপোলিয়ন রাশিয়া আক্রমণ করেন কিন্তু রুশ সেনাপতি কুটুজভ দেখেন যে প্রতিরোধ করলে নিশ্চিত পরাজয়। নেপোলিয়নের সৈন্যরা অবাধে মস্কো প্রবেশ করল, কিন্তু মস্কো জনশূন্য। একিটও রাশিয়ান তাদের সহযোগিতা করতে চাইল না। কেউ জানে না কে লাগিয়ে দিল শহরে আগুন। এরা বলে ওরা লাগিয়েছে। ওরা বলে এরা লাগিয়েছে। লুটপাট করে ফরাসীরা স্থির করল ফেরা যাক। কিন্তু যে বাঘ খাঁচায় ঢুকে পেট ভরিয়েছে ছাগ মাংসে তারই মতো দশা হলো তাদের। যতটা পথ এসেছিল ঠিক ততটা পথ ফেরার মুখে বুগুণ মনে হল। কুটুজভ ইচ্ছা করলেই রাস্তায় হানা দিয়ে তাদের নির্বংশ করতেন। কিন্তু অনাবশ্যক রক্তপাতে তাঁর প্রবৃত্তি হল না, তারা যখন স্বেচ্ছায় রাশিয়া ত্যাগই করছে। তাঁর কোনো কোনো সৈনিক কসাকদের দলপতি হয়ে চোরের উপর বাটপাড়ি করল। এইসব গেরিলা যুদ্ধে ও শীতে বরফে খাদ্যের অভাবে নেপোলিয়ানের গ্রাদ আর্মে কাহিল হয়ে পড়ল, সৈন্যদের অল্পই বাঁচল। তাও হলো পথি বিজর্জিত। নেপোলিয়ন চুপি চুপি দিলেন মস্ত এক লম্ফ।

এই হল কাঠামো। সাধারণ ঔপন্যাসিক হলে তাঁর পাত্রপাত্রীদের দিয়ে বড়ো বড়ো কাজ করাতেন। নতুবা যারা বড়ো বড়ো কাজ করেছে বলে ইতিহাসে লেখে তাদেরকেই করতনে পাত্রপাত্রী। জাতীয় গৌরবের রঙ সমস্তটা হতো অতিরঞ্জিত। সাধারণ ঐতিহাসিক ঘটনার পশ্চাতে দেখতেন, মানুষের ইচ্ছা, মানুষের পরিকল্পনা, মানুষের দূরদৃষ্টি। সেনাপতিদের চাল দেয়া, সৈনিকদের ঝড়ের মতো চলা, অধিক কৌশলীর জয়লাভ। পরাভূত পক্ষের ঐতিহাসিক ধরতেন উঠোনের দোষ-নেপোলিয়নের সর্দিকে করতেন দুর্ঘটনার জন্য দায়ী। ঘটনাচক্রে কুটুজভ মস্কো রক্সা না করাই বুদ্ধিমানের কাজ বলে সাব্যস্ত করলেন, তাঁর পরামর্শ-পরিষদের সম্পূর্ণ অমতে। আর রোষ্টোপশিনের শত চেষ্টা সত্ত্বেও শহরের লোক যে যেদিকে পারে পালিয়ে আত্মরক্ষা করল, নেপোলিয়ন থাকতে সেখানে ফিরল না। জাতীয় ঐতিহাসিক হলে টলস্টয় বলতেন, এ কি আমরা না ভেবেচিন্তে করেছি? আমরা অনেকদিন থেকে মাথা খাটিয়ে ঠিক করেছিলাম যে নেপোলিয়কে বাধা না দিয়ে দেশের ভিতরের দিকে টেনে আনব ও মস্কো কালি করে তাতে আগুন লাগিয়ে দিয়ে মজা দেখব। টলস্টয় ঋষি। তিনি তাঁর দিব্যদৃষ্টিতে প্রত্যক্ষ করলেন ঘটনা কেমন করে ঘটল, কেমন করে ঘটে থাকা সম্ভব। যারা খেলা করে তারা জানে কার কত দূর দৌড়। কিন্তু যুদ্ধে অপর পক্ষে সামর্থ্য পরিমাপ করবার কোনো ধ্রুব মান নেই। যারা লড়াই করে তাদের এটাই একমাত্র ভাবনা নয়, তারা সবাই বীরও নয়। তাদের নিজেদের ছোট ছোট ঈর্ষা দ্বেষ। তাদের কারুর মনে পড়ছে ঘরসংসার, কেউ গণনা করছে কবে মাইনে পাওয়া যাবে। সেনাপতিদের এক-একজনের এক-এক মত, তাদের সবাইকে এক মনে কাজ করানো প্রধান সেনাপতির নিত্য সমস্যা। পদাতিকদের অনুপ্রেরণা জয়গৌরব ততটা নয় যতটা লুটতরাজ। মরণের সঙ্গে মুখোমুখি হয়েও বীরপুরুষেরা লুটের মাল আঁকড়ে থাকে। যুদ্ধ জিনিসটা একজনের হুকুমে হয় এর মতো ভ্রান্তি আর নেই। যুদ্ধ হয় একবার কোনো মতে শুরু করে দিলে আপনা-আপনি। থামে হয়তো একটা উড়ো কথায়। কেউ একজন চেঁচিয়ে উঠল, “আমরা হেরে গেছি।” অমনি সবাই ভঙ্গ দিল।

কেন যে যুদ্ধ হয়, কেন যে মানুষ মরেও ও মরে, কী যে তার অন্তিম ফল টলস্টয় তার সম্বন্ধে অজ্ঞেয়বাদী। নেপোলিয়ন হুকুম করলেন, ‘যুদ্ধ হোক,’ আর অমনি যুদ্ধ হলো এই সুলভ ব্যাখ্যায় তিনি সন্দিহান। নেপোলিয়ন নিয়তির বাহন, তাও একটা ঐরাবত কি উচ্চৈঃশ্রবা নন, প্রতিভা তাঁর নেই। মস্কোতে তিনি আগাগোড়া নির্বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছেন। সেই শহরে খাদ্য মজুত ছিল ছয় মাসের। কিন্তু নেপোলিয়ন তার হিসাব রাখলেন না। সৈন্যরা লুটপাত করে তছনছ করল। মস্কোর ধনসন্তার তাদের লোভ জাগিয়ে তাদেরকে এত দুরদেশে এনেছিল। সেই লোভের তান্ডব নাচ চলল। নেপোলিয়ন মোরগের মতো নিশ্চিত জানতেন যে, নাগরিকরা তাঁর লম্বা চওড়া ইস্তাহার পড়ে ফিরবে, আবার দোকানপাট বসাবে। গ্রামিকরা আসবে মাছ, তরকারি বেচতে। তাদেরকে তিনি ভারো করে বুঝিয়ে দেবেন যে, যুদ্ধে যেমন তিনি অপরাজেয় শান্তি কালেও তেমনি তিনি প্রজারঞ্জক।

রাশিয়ার জনগণকেই টলস্পয় দিয়েছেন সাধুবাদ। তারা কোনো ব্যক্তিবিশেষের দ্বারা চালিত হয়নি। তারা পরস্পরের পরামর্শ নেয়নি। তারা অন্তরে উপলব্ধি করল নিয়তির অভিপ্রায়। তাই মূঢ় রোষ্টোপশিনের অনুজ্ঞায় কর্ণপাত না করে শহর ছেড়ে দিল। শহরে আগুন ধিল কে তা কিন্তু বলা যায় না। হয়তো রাশিয়ানরা হয়তো ফরাসিরা। যে-ই দিক সে নিয়তির ইঙ্গিতে দিয়েছে। বোঝেনি কিসের ফল কী দাঁড়াবে। শত্রুর সঙ্গে অসহযোগ করব, ফিরব না মস্কোতে এই যে তাদের অপ্রতিরোধের সংকল্প-এ-ও কারুর নির্দেশে বা শিক্ষায় নয়। এ-ও তারা একজোট হয়ে পরস্পরের পরামর্শ নিয়ে করেনি। এ তাদের প্রত্যেকের অন্তরের আদেশ। এমন যদ না হতো তবে সম্রাট বা সেনাপতিদের ইচ্ছা নেপোলিয়নের ইচ্ছার সঙ্গে যুক্ত হয়ে প্রলয় বাধাত, প্রলঙ্করের করতালি তো এক হাতে বাজে না। শেষ জীবনে টলস্টয় যে জনগণের স্বভাববিজ্ঞতায় আস্থাবান হবেন, অপ্রতিরোধতত্ত্বের গোস্বামী হবেন, তার পূর্বাভাষ তার যৌবনের এই গন্থেও লক্ষ করা যায়। নামহীন পরিচয়হীন মহাজনতায় আপনাকে হারিয়ে দেওয়া হয়েছিল তাঁর সাধনা। পারেননি, এমনি উগ্র তাঁর ব্যক্তিত্ব। বদ্ধমূল আভিজাত্য উন্মুল হল না। তবু তাঁর দানবিক প্রয়াস একবারে ব্যর্থ হয়নি। টলস্টয়কে দ্বিখন্ডিত করে, কেউ নিয়েছে তাঁর যৌবনের অনবদ্য শিল্পিত্ব। কেউ নিয়েছে তাঁর পরিণত বয়সের অপ্রতিরোধতত্ত্ব।

কিন্তু এই যে তাঁর জনগণের সহজ বিচারের প্রতি আস্থা এই তাঁর উভয় বয়সের, উভয় প্রতিকৃতির মধ্যে সাদৃশ্য নির্ণয়ের সংকেত। শিল্পী-ঋষি ও সাধু-ঋষি মূলত ঋষি। তাঁর দৃষ্টিতে বিশ্বের কোন্ রহস্য ধরা পড়েছে? ধরা পড়েছে এই যে, যাবতীয় ঘটনার যথার্থ পাত্রপাত্রী ইতিহাসপ্রসিদ্ধ ব্যক্তিরা নন। নাম পরিচয়হীন নির্বিশেষে জনতা যা করে তাই হয়। এবং যা করে তা নিয়তির চালনায়। নিয়তি অন্ধ নয়, খেয়ালী নয়, তার ব্যবহারে আছে নিয়ম। যেমন পৃথিবীর ঘূর্ণর আমাদের বোধের অতীত বলে আমরা একদা তাকে স্থাণু মনে করেছিলাম নিয়তির ইচ্ছায় কাজ করতে থেকেও আমরা তার সম্বন্ধে অচেতন, আমরা ভাবছি আমরা ইচ্ছাময়।

যুদ্ধ থেকে ওঠে নিয়তির কথা। তেমনি শান্তি থেকে ওঠে প্রকৃতির। বিচিত্র সংসারের ধারাবাহিকতায় কত রস, কত রূপ। যুদ্ধ চলেছে জাতিতে জাতিতে। কিন্তু অলক্ষিতে বালিকা হয়ে উঠেছে বালা, বালা হয়ে উঠেছে যুবতী। অন্তরীক্ষে শীতের সূর্য সুদাবর্ষণ করে যাচ্ছে, আকাশ ঘন নীল। কে বলবে যে এই সুন্দরী ধরণী একদিনহবে রণক্ষেত্রে, বারুদের ধুমে ও গন্ধে নিঃসন্দিগ্ধ পশুপক্ষীর হবে শ্বাসরোধ, পাতা ও ফুল যাবে বিবর্ণ হয়ে? টলষ্টয়ের এই গুণকে কেউ কেউ আখ্যা দিয়েছেন আইডিল, সুখ সরলতার ছবি। এক হিসাবে তা সত্য। সহজ, প্রসন্ন জীবন। বিশেষ অভাব অভিযোগ নেই। নেই তেমন কোনো দ্বন্দ্ব। কারুর অতি বড় সর্বনাশ ঘটে না, বিধাতা সকলেরই শেষ নাগাদ একটা সদ্ব্যবস্থা করেন। কাউকে দেন সুমধুরু মৃত্যু, মুখে হাসিটি লেগে থাকে। কাউকে রাখেন চিরকুমারী করেন, নিজের নিষ্ফলতায় সন্তুষ্ট। কেউ আরম্ভ করেছিল বিশ্বের ভাবনা ভেবে। মরতে মরতে বেঁচে গেল। তারপর বিয়ে করল, সুখে থাকল।

আধুনিক পাঠকের এতটা শান্তি বিশ্বাস হবে না। তবে এটুকু সান্ত্বনা হবে যে পাপের পরাজয়, পূণ্যের জয় প্রতিপন্ন করবার অভিপ্রায় ছিল না ঋষির টলষ্টয়ের। আর এও না মেনে উপায় নেই যে প্রত্যেকটি কাল্পনিক চরিত্র ইতিহাসপ্রসিদ্ধ চরিত্রের মতো উৎরে গেছে তার মানে ওরা আস্ত মানুষ, কবি ওদের দেখেছেন সকলের মাঝে, দেখিয়েছেন যথাযথ রূপে। ওরা থাকলেও থাকতে পারত ইতিহাসের পাতায়। ইতিহাসে থাকলে বিশ্বাস করতাম ওদের জীবনযাত্রার শান্তি। কথা হচ্ছে যুদ্ধের মতো শান্তিকালেও টলস্টয় পড়েছিলেন তার অন্তর্নিহিত অর্থ। যুদ্ধের যেমন নিয়তি, শান্তির তেমনি সহজ বিকাশ, বিশুদ্ধ অস্তিত্ব। দ্বন্দ্বের স্থান রণাঙ্গনে। গৃহে বড়ো জোর একটু মান অভিমান, সহজ কলহ। একটু ব্যঙ্গ, একটু রঙ্গ। রাগ হলে বা রাগ হওয়া উচিত বলে মনে করলে, একটা ডুয়েল। তাতে মরেও না শেষ পর্যন্ত কোনো পক্ষ।

শান্তি যে আজ আমাদের দিনে যুদ্ধের নামান্তর, প্রকারন্তর বলে গণ্য হবে তা তো ঊনবিংশ শতকের প্রথম পর্বে সূচিত হয়নি। বিশেষত রাশিয়ায়, এবং অভিজাত সম্প্রদায়ের মধ্যে। ঐতিহাসিক উপন্যাসের গণ্ডী কালচিহ্নিত। যেমন খাপ তেমনি তরবারি। তথাপি সেকালের চিন্তায় জমিদার ও চাষার সম্বন্ধে কেমন হবে সে জিজ্ঞাসা ছিল।

সমসাময়িক সমস্যার চেয়ে টলস্টয়কে ঢের বেশী আকুল করেছিল সনাতন জীবনরহস্য। কেন বাঁচব, কেমন করে বাঁচব, বাঁচার মতো বাঁচব কাকে বলে? এর এক- একটি প্রশ্নের উত্তর তিনি এক-এক জনের চরিত্রে দিয়েছেন। মেয়েদের মধ্যে নাম করা যায় নাতাশার, মারিয়ার, সোনিয়ার, হেলেনের। পুরুষদের মধ্যে উল্লেখ করতে হয় অ্যান্ড্রকে, পিটারকে নিকোলাসকে। যাদের অগ্রাহ্য করলাম তারা কেউ উপেক্ষণীয় নয়। কিন্তু কিন্তু তাদের সংখ্যা শতাবধি। এত রকম এত ব্যক্তি অন্য কোন্ গ্রন্থে আছে? ডস্টয়েভ, স্কিও টলষ্টয়ের পিছনে পড়ে যান।

নাতাশকে আমরা প্রথম যখন দেখি তখন তার শৈশব সারা হয়ে গেছে অথচ কিশোর উত্তীর্ণ হয়নি। সে দেখতে তত সুশ্রী নয়, বরং কৃষ্ণমনি বলা যেতে পারে। কিন্তু রূপের অভাব পুষিয়ে দিয়েছে উচ্ছলিত প্রাণ। তখনো তার পুতুল খেলার অভ্যাস ভাঙেনি। হাসতে হাসবে লুটিয়ে পড়ে। তার সে হাসি সংক্রামক। এই মেয়ে বছর চারেক পরে হয়েছে ষোড়শী, ভাবাকুলা, সুদর্শনা। কিন্তু রয়েছে তেমনি প্রাণময়ী। সামাজিক নৃত্যে সে এমন আনন্দ পায় যে তার নিষ্পাপ চিত্ত সকলের আনন্দ কামনা করে। তার উল্লাস যেন কোনো অপ্সরার, তা দিকে দিকে সৃষ্টি উল্লাস। তার অখলতা, তার অকৃত্রিমতা, তার সরল মাধুরী তার প্রতি আকৃষ্ট করল অ্যান্ড্রুকে। অ্যান্ড্রু উচ্চপদস্থ, উচ্চবংশীয়, উচ্চমান। বয়সেওও বড়ো। দেশের মঙ্গলের নানা পরিকল্পনা ছিল তাঁর ধ্যান। কিন্তু তাঁর প্রথম বিবাহের স্ত্রী তা৭র উপযুক্ত সঙ্গিনী ছিলেন না। সামাজিকতার অশেস তুচ্ছতায় তাঁর প্রতিভার অফুরন্ত খুচরো খরচ হয়েছিল, বাজে খরচ। বিরক্ত হয়ে তিনি যুদ্ধে গেলেন, কিন্তু যুদ্ধের স্বরূপ দর্শন কর তাঁর তাতেও অরুচি ধরল। যাকে আদর্শস্থানীয় বলে বিশ্বাস করেছিলেন সেই নেপোলিয়নকে নিকট থেকে দেখে বীতশ্রদ্ধ হলেন। প্রশান্ত নীল আকাশের নীচে আহত হয়ে পড়ে থাকার সময় তাঁর মনে হলো তাঁর বুদ্ধিগম্য যাবতীয় বিষয় অসার, সার কেবল ঐ অসীম বিশ্বরহস্য। এমন যে অ্যান্ড্রু তাঁরও নতুন করে বাঁচতে ইচ্ছা করল নাতশার স্বতঃস্ফূর্ত প্রাণপ্রবাহে বেসে। তার নেই লেশমাত্র মলিনতা, সে ঝরণা। এক বছরের জন্যে অ্যান্ড্রু দেশের বাইরে গেলেন, ফিরে এসে নাতাশাকে বিয়ে করবেন। এই এক বছরে নাতাশা তাঁর প্রতীক্ষায় অধৈর্য হয়ে উঠল। এল তার কুগ্রহ আনাতোল। ক্ষণিক। উন্মাদনায় সে প্রতারকের কবলে আত্মসমর্পণ করতে যাচ্ছিল। বাধা পেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করল। বেঁচে গেল কিন্তু বদলে গেল। অ্যান্ড্রু দেশে ফিরে যা শুনলেন তাতে তাঁর জীবনের স্পৃহা লোপ পেল, নারীর কাছে তিনি কোনো রূপ মহত্ত্ব প্রত্যাশা করলেন না, এত দুর্বল তারা। তিনি ক্ষার গেলেন যুদ্ধে, এইবার মৃত্যু কামনা করে। আহত হয়ে ফিরে এলেন। ঘটনাচক্রে নাট্যাশাদের আশ্রয়ে। মরণকালে তাঁর চিত্ত উদ্ভাসিত হল বিদ্য ভাবে। তিনি ক্ষমা করলেন, তিনি ভালোবাসলেন, প্রাণীমাত্রাকে, সংসারকে। তাঁর মনে ব্যর্থতার নিত্য খেদ রইল না। অনুতপ্তা সেবিকা প্রিয়াকে আশীর্বাদ করলেন।

নাতাশাকে তার শৈশব থেকে ভালোবাসত পিটার। লোকটা কেবল যে লাজুক, ভালোমানুষ, কিম্ভুতকিমাকার, মাথাপাগলা তাই নয়, নামগোত্রহীন সত্যসঙ্গী। তাই কাউকে কোনোদিন জানায়নি ভালোবাসর কথা। হঠাৎ মারা গেলেন কাউন্ট বেসুকো, উত্তরাধিকারী হলো পিটার, বিরাট ভূসম্পত্তির তথা পদবীর। তখন তাকে লুফে নিল নাতাশাদের চেয়ে উদ্যোগসম্পন্ন প্রতিপত্তিমান কুরাগিন বংশ। তার বিয়ে হলো যার সঙ্গে সে অসামান্য রূপবতী, সোসাইটির উজ্জ্বলতম নক্ষত্র, হেলেন, কোনো পক্ষে প্ৰেম নেই। বিভবের সঙ্গে সৌন্দর্যের বিবাহ। দুজনেই পরম অসুখী হলো। হেলেন খুজল অমন অবস্থায় ও রূপ সমাজের রানীমক্ষিকরারা যা খোঁজে। আর বেচারা পিটার হলো ফ্রীমেসন। চরিত্রকে দিন দিন উন্নত করতে চেষ্টা করল, বিশ্বকল্যাণ চেষ্টারত। দোষের মধ্যে মদটা খায় অপরিমিত। তার সেই ভালোবাসা তার অন্তরে রুদ্ধ থাকে। নাতাশার সঙ্গে তার সহজ বন্ধুতা। নাতাশা তাকে সরল মানুষটি সঙ্গে তার সহজ বন্ধুতা। নাতাশা তাকে সরল মানুষটি বলে সখীর মতো বিশ্বাস করে। নেপোলিয়ন যখন রাশিয়া আক্রমণ করলেন পিটারের ধারণা জন্মাল যে, বাইবেলে যে রাক্ষসের বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী আছে নেপোলিয়নই সেই রাক্ষস এবং তাকে হত্যা করবে যে সে আর কেউ নয়। সে আমাদের পিটার, যে একটা বন্দুকও ছুঁড়তে জানে না। পিটারের প্রয়াসের শেষ ফল হল এই যে পিটার অন্যান্যদের সঙ্গে ধৃত হয়ে প্রাণদন্ডের প্রতীক্ষায় সারি বেঁধে দাঁড়াল। তার চোখের সুমুখে মানুষ মরল ঘাতকের গুলিতে। তারও উপর গুলি চলবে এমন সময় তার প্রানদন্ড মকুব হল, সে চলল বন্ধী হয়ে ফিরন্ত ফরাসীদের সঙ্গে। কৃষকদের সাহায্যে অন্যান্য বন্ধীদের সাথে তাকেও উদ্ধার করল ডেনিসোভ ডোলোগোভ প্রভৃতি গেরিলা যুদ্ধের নায়ক। মৃত্যুর সামনাসামনি দাঁড়িয়ে, বহু লাঞ্ছনা সয়ে যে দুঃখ আমাদের পাওনা নয় সেই দুঃখকেও কেমন ভক্তির সাথে গ্রহণ করতে হয় তার দৃষ্টান্ত কারাটাইয়েভ নামক একটি পরম দুঃখী ঈশ্বর বিশ্বাসীর জীবনে প্রত্যক্ষ করে পিটারের গভীর অন্তঃপরিবর্তন ঘটেছিল। শৌখিন মানব কল্যাণ আর তাকে উদ্ভ্রান্ত করছিল না। সে পথ পেয়েছিল। বিষণ্ণ নাতাশাকে বিয়ে করে-ততদিনে হেলেন মরেছিল সে দস্তুরমতো সংসার হল। নাতাশা আবার সেই আনন্দময়ী। প্রকৃতি নিজে তাকে সহজ আনন্দ জোগায়, উদ্ভিদকে যেমন রস। সে কালক্রমে ফলভারানবত পূর্ণবিকশিত পাদপের মতো প্রসারিত, সমৃদ্ধ হল। কে তাকে দেথে চিনবে যে এ ছিল একদিন তন্বী আলোকলতা! তবু তাই তার প্রাকৃতিক পরিণতি। তাই নহলে যা হোত সেটা তার বিকৃতি। নাতাশা টলষ্টয়ের মানসী নারী। সে ভালো। কিন্তু সজ্ঞানে ও সাধনার দ্বারা নয়। শিক্ষার দ্বারা নয়। নীতির চূল চেরা তর্ক তার মনে ওঠে না। তার প্রাণ যা চায় সে তা-ই চায়। তার প্রাণ যা চায় তার ফলে অনর্থ ঘটলে সে তা ভোগে। নালিম করতে চায় না।

অ্যান্ড্রুর বোন মারিয়া হচ্ছে কতক তার রূপহীনতার প্রতিক্রিয়ায় কতক তার কঠোর স্বভাব পিতার তাড়নায় তপস্বিনী। তার সমবয়সিনীরা যখন খেলা করছে, লীলা করছে শিকার করছে দুই অর্থে, মারিয়া তখন জ্যামিতির পড়া তৈরি করছে আর করছে লুকিয়ে লুকিয়ে অধ্যাত্নচর্চা। যা অমন দুঃখিনী হলে নারীমাত্রই করে থাখে। নিজেকে মিষ্টিরর জীবনের যোগ্য করছে নিষ্ঠার সঙ্গে, বিবাহের তো প্রত্যাশা নেই। তা বলে আশা কি মরেও মরে! কতবার নিরাশ হল। অবশেষে নাতাশার ভাই নিকোলাস তার পৈত্রিক সম্পত্তির খাতিরে তাকে বিয়ে করল, অবশ্য বিয়ের আগে তাকে বিদ্রোহী প্রজাদের হাত থেকে উদ্ধার করে তার হৃদয় জয় করে। তাদের বিয়ে বেশ সুখেরই হল। সংযম ও সাধুতা তাকে শুদ্ধ সুবর্ণের আভা দিয়েছিল। তার রূপহীনতাকে ঢেকেছিল সেই আভা। নিকোলাস নাতাশারই মতো প্রাণময়, তবে, সহাস্য নয় সুগম্ভীর। তার সব কাজে হাত লাগানো চাই, উৎসাহ তার অদম্য, ব্যগ্রতা তার মজ্জাগত। ঘোড়ার চড়ায়, ঘোড়া কেনা, তরুণ সৈনিকের ভাবনাশূন্য জীবনের হাজার ভাবনা, শিকার, জুয়া এই সব তার বহির্মুখির নানা দিক। তাকে ভালোবাসে তাদের পরিবারের আশ্রিতা একটি মেয়ে, সোনিয়া। নিকোলাসও তাকে ভালবাসে। সে ভালবাসে তার অন্যান্য কাজের মতো ছেলেমানুষি। কথা দিয়েছিল বিয়ে করবে, কিন্তু সোনিয়ার অপরাধ সে গরীব। তাকে বিয়ে করলে নিকোলাসদের নষ্ট সম্পত্তি ফিরবে না। তার বাবা যে জুয়ার সব হারিয়ে বসে রয়েছেন। খুশি হয়ে মায়ের পীড়াপীড়িতে সোনিয়া তাকে তার প্রতিশ্রুতি থেকে মুক্তি দিয়ে নিজের সুখ বিসর্জন দিল। নিকোলাস বর্তে গেল সে তো কিছুতেই তার পিতামাতাকে অসন্তুষ্ট করতে পারত না, অথচ প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘন করার মতো বেঈমান সে নয়। সোনিয়া এই কাব্যের উপেক্ষিতা। ডোলোগোভ নিকোলাসের বন্ধু। কিন্তু দিব্যি বন্ধুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিল জুয়াতে ভীষণ হারিয়ে। লোকটা অসাধারণ সাহসী, অথচ অবাধ্য। তার মনে একটা বড়ো দুঃখ সে গরিব। তাতে তাকে নির্দয় করেছিল। তার আর একটা বৃহৎ ক্ষোভ সে একটিও নারী দেখল না যাকে সে শ্রদ্ধা করতে পারে, সম্মান করতে পারে। তার ধারণা রাণী থেকে দাসী পর্যন্ত প্রত্যেক রমণীকে কেনা যায়। সে যে বেঁচে আছে শুধু তার মানসীকে হয়তো একদিন দেকতে পাবে এই অসম্ভব আশায়। ততদিন সে শয়তানী করবে। করবে গুণ্ডামি। তার বিধবা মা আর কুজা বোন আর গুটিকয়েক বন্ধু ছাড়া সবাইকে সে খাতির করবে না।

টলষ্টয়ের বর্ণনাকুশলতা এমন যে সব সময় মনে হতে থাকে টলস্টয় স্বয়ং এসব দেখেছেন। এসব জায়গায় উপস্থিত থেকেছেন। এসব জায়গায় উপস্থিত থেকেছেন। যুদ্ধক্ষেত্রে, মন্ত্রণাসভায়, দরবারে, অভিজাত মহলে, ফ্রীমেসনদের আড্ডায়, গ্রামের বাড়িতে, শিকারের পশ্চাতে, নাচের মজলিসে, চাষাদের সঙ্গে, বন্দিদের সঙ্গে, গেরিলাদের-সর্বস্থলে তিনি আছেন। কল্পনার এই পরিব্যাপ্তি, সহানুভূতির এই প্রসার বিশ্বাসাহিত্যে বিরল। অবশ্য সমাজের নিম্নতর স্তরগুলিতে তাঁর চিত্তের প্রবেশ ছিল বলে মনে হয় না। থাকলে তিনি হয়তো শেষ বয়সে তাদেরই দিকে সম্পূর্ণ মনোযোগ দিতেন না। তারপর এত খুঁটিনাটি ভালবাসতেন বলে তার প্রতিক্রিয়াবশত শেষের দিকে একেবারে ও জিনিস বর্জন করলেন। এক চরমপন্থা থেকে অপর চরমপন্থায় চললেন। টলষ্টয়ের জীবনের তথা আর্টে ট্র্যাজেডি এই। আলোচ্যগ্রন্থে তিনি যাকে জয়যুক্ত করেছেন সে পিটার, নাট্যমাশুক্ত পিটার। কারাটাইয়েড মরণের পূর্বে তাকে যে মন্ত্র দিয়েছিল তার প্রতিধ্বনি তার কানে বাজতে থাকে। জীবনই সমস্ত। জীবনই বিধাতা। সর্বভূতের আছে গতি। সেই গতিই বিধাতা। যতক্ষণ জীবন আছে ততক্ষণ আছে বিধাতার অস্তিত্বকে জানবার আনন্দ। জীবনকে ভালোবাসলেই বিধাতাকে ভালোবাসা হয়। জীবনে সবার চেয়ে কঠিন অথচ সবচেয়ে গুণের কাজ হচ্ছে জীবনের যাবতীয় অহেতুক জ্বালা সত্ত্বেও জীবনকে ভালোবাসা।

আনা কারেনিনা প্রকাশের পর শতবর্ষ পূর্ণ হয়েছে। শতবর্ষের আলোয় ওর নতুন একটা সমীক্ষার প্রয়োজন। শেষ জীবনে টলস্টয় তাঁর নিজের সৃষ্টির ওপর বিরুপ হয়েছিলেন। আর্টের যে সীমানা তিনি বেঁধে দিতে চেয়েছিলেন তা মহৎ ভিন্ন আর কাউকে স্বীকৃতি দেবে না। আনা কারেনিনার বিষয়বস্তু তাঁর মতে মহৎ নয়। শুধু তাঁর মতে কেন, অনেকেই মতে মহৎ নয়। কিন্তু ইলিয়াডের বিষয়বস্তু যদি হয় হেলেন ও প্যারিসের নিষিদ্ধ প্রেম তা হলে সেই মহাকাব্যকেই বা মহৎ কাব্য বলব কেন? তাতে যুদ্ধের বর্ণনা আছে? টলস্টয় তো শেষজীবনে যুদ্ধের পক্ষপাতী ছিলেন না। আনা কারেনিনার শেষখন্ডে তাঁর যুদ্ধবিরোধী জীবনদর্শনের প্রভাব পড়েছে।

টলষ্টয় স্বয়ং খাটো করতে চাইলেও আমি তাঁর আনা কারেনিনাকে কখনো খাটো করতে রাজি হইনি। প্রথম বয়স থেকেই আমি আনা কারেনিনার অনুরাগী। উপন্যাস যদি লিখতেই হয়তো ওরই মতো উপন্যাস। তাতে জীবনের সব দিক আছে। নীতি নিপুণের মতো তার কোনো অংশ বাদ দেওয়া উচিত নয়। শিল্পবস্তু হিসেবেও আমি ওর মূল্যবত্তায় বিশ্বাস করি। মহৎ উপন্যাস বলতে যা বোঝায় আনা কারেনিনা নিঃসন্দেহে তার পর্যায়ভুক্ত। আর্টের রাজ্যে যা গ্রেট তা হয়তো মরালিটিররাজ্যে গ্রেট নয়। মরালিটির রাজ্যে যা গ্রেট তা হয়তো আর্টের রাজ্যে গ্রেট নয়। যে চিত্র মরাল টেষ্টে উত্তীর্ণ হবে না সে এস্থেটিক টেষ্টে হতেও পারে। সেই রকমই বা উপন্যাস বা আর্ট। তাকেও এস্থেটিক টেষ্টে উত্তীর্ণ হতে হয়। তা যদি সে হয় তবে মরাল টেষ্টে তার পরের কথা। এটাই ছিল আমার প্রথম বয়সের মতো। পরে আমিও লিখতে লিখতে উপলব্ধি করেছি যে আর্টের সঙ্গে মরালিটির সম্বন্ধ অবান্তর নয়। প্রচ্ছন্নভাবে নৈতিক ভালোমন্দের নিষ্কর্ষও থাকে। তবে নির্জলা ভালো বা নির্জলা মন্দ বলে কিছুই নেই। সাদা ও কালো মাঝামাঝি আরো অনেকগুলো রং আছে। বিধাতা ও শয়তানের বৈপরীত্য মানুষের বেলায় খাটে না। সত্যিকার মানুষ এত জটিল যে তাকে সরল করে আনার চেষ্টা ব্যর্থ হতে বাধ্য। যেমন জীবনে তেমনি আর্টে। আনা কারেনিনা যে ব্যর্থ হয়নি তার কারণ সত্যিকার সরল মানুষকে টলষ্টয় সরল করতে যাননি। তত্ত্ব এখানে সত্যকে লোহার ছাঁচে ঢালাই করেনি।

আনা কারেনিনা যখন প্রথম পড়ি তখন আমার বয়স কত? আঠারো উনিশ কুড়ি। বইখানা নিষিদ্ধ নয়, কিন্তু বিষয়বস্তু নিষিদ্ধ। নিষিদ্ধ বলেই আগ্রহ এতে। আদ্যোপান্ত পড়ার মতো, ধৈর্য নেই, অর্ধেকের উপর তো লেভিনের অর্থাৎ টলষ্টয়ের জমিদারি দর্পণ ও জীবনবিজ্ঞাসা। ওসব আমি লাফ দিয়ে ডিঙিয়ে যাই। আমার একমাত্র আকর্ষন নিষিদ্ধ প্রেমে ও প্রেমিকার মিলনে বিরহ। পরিণাম যে লেভিন ও কিটির সমাজসম্মত প্রেমের বেলা হবে সুখের এটা তো ভালই, কিন্তু আনা ও ভ্রণস্কির অসামাজিক প্রেমের বেলা হবে পাপের ও পাপের ফলে পতনের ও পতনের ফলে মৃত্যুর এতে আমার অন্ত রের আপত্তি ছিল। এটা তো হোমারের মতো হলো না, হলো না খ্রীষ্টপূর্ব গ্রীক জীবনবোধের বা মূল্যবোধের মতো। পাপ থেকে পতন, পতন থেকে মৃত্যু হেলেনের বেলায় পারিসের সঙ্গে পতিপত্নীরূপে আনন্দেই দশ বছর বাস করেছিল। পরে হেলেনই মেলেলাউসের ঘরে সম্মানের সঙ্গে ফিরে আসে ও পতিপত্নীরূপে বাস করে। সমাজবিধানে বা নীতিবোধে বাধে বা। খ্রীস্টয় ক্ষমাধর্মেরও প্রয়োজন হয় না। হেলেন হরনের জন্যে ট্রয় অভিযানেরই প্রয়োজন ছিল। যেহেতু গ্রীকদের সম্মান নষ্ট হয়েছিল। নষ্ট সম্মান পুনরুদ্ধার করতে হলে যুদ্ধ করে হেলেনকে পুনরুদ্ধার করতে হয়। এর মধ্যে পাপ কোথায়, পতনই বা কার? পতন যদি কারো হয়ে থাকে তবে তা ট্রোজানদের। মৃত্যুও তাদেরই। কিন্তু হেলেনকে তা বলে কেউ বলবে না ফলন উওম্যান বা ‘পতিতা নারী। বস্তুত ‘পতিতা’ কথাটিও ইংরেজি ‘ফলন নারী’র অনুবাদ। এখন ওটি গণিকার সমার্থক হয়েছে। গ্রীকরা বা প্রাচীন বাঙ্গালীরা অমন কথা ভাবতেই পারতেন না। ওটা ওহুদী-খ্রীস্টান ধারণা। টলস্টয় ওটা গ্রীক রোমান ক্লাসিক ঐতিহ্য সূত্রে পাননি, পেয়েছেন ইহুদী খ্রীষ্টীয় অপরাধ। দশবিধ অনুজ্ঞার অন্যতম “ব্যভিচার করিয়ো না।’ নারীপক্ষে অতি কঠোর শাস্তি। সকলের দ্বারা লোষ্ট্রঘাতে নিধন। পুরুষের পক্ষে অতটা কঠোর নয়। কারো কারো বেলা আদৌ কঠোর নয়। রাজা ডেভিড তো অপরের ক্ষেত্রে পুত্রলাভ করেন। ইতিহাসে রাজা সলোমনের স্থান কত উচ্চে’ সেই উত্থানের পেছনে ছিল পতন, কিন্তু তার জন্যে শান্তির কথা কেউ কখনো বলেনি। সাধারণের বেলায়ই শাস্তি। বিশেষত নারীর বেলায়। টলস্টয় এই প্রাচীন ধারণার উত্তরসূরী।

খ্রীস্টধর্ম প্রবর্তনের পরও তার সঙ্গে সমান্তরালভাবে প্রবাহিত হচ্ছিল অভিজাত সমাজের পূর্বতন নরনারীর প্রেমনীতি। নাইট ও লেডীদের হৃদয় বিবাহের দ্বারা শাসিত ছিল না। রাজা আর্থারের রানী গুইনেভোয়ার ছিলেন নাইট ল্যান্সলটের প্রেমাসক্ত। সে প্রেম নিতান্ত অশরীরী ছিল না। ‘কোর্টলি লাভ’ বা রাজসভাসম্মত প্রেম যাকে বলা হতো সেটা ছিল উত্তমের প্রতি অধমের সেবা নিবেদন। অন্তত প্রকাশ্যে কামগন্ধহীন। তার থেকে এসেছে অসংখ্য রোমান্স ও ক্রবাদুর গীতি। এদেশে যেমন কানু বিনে গীত নেই ইউরোপে তেমনি ‘কোর্টলি লাভ’ বিনে মধ্যযুগীয় কাব্য ও রোমান্স নেই। সাধুরা পছন্দ করতেন না, কিন্তু জনসাধারণ ভালোবসত। সাধুরা নিয়ে এলেন এর মধ্যে পাপবোধ। পাপের পরিণাম মৃত্যু। যেখানে মৃত্যু নয় সেখানে সমাজের বাইরে পতিত হয়ে থাকা। সেটা মৃত্যুর চেয়েও অসহনীয়। আত্মঘাতিনী না হলে টলষ্টয়ের আনা কারেনিনাকেও অপাঙ্ক্তেয় হয়ে থাকতে হতো। বড়লোকের রক্ষিতার যে পরিমাণ মর্যাদা তার বেশী সে পেত না। ভ্রনস্কির দ্বারা পরিত্যক্ত হলে সে যা হতো তাকে বলে ফরাসীভাষায় ‘দেমি মদ’। আমরা বলি ‘হাফ গেরস্ত’। অপের বা থিয়েটারের অভিনেত্রীদের মর্যাদা আগে যেরকম ছিল। দিনকাল বদলেছে। তাঁরাও জাতে উঠেছেন। একশো বছর পরে লেখা হলে ‘আনা কারেনিনা’র পরিনাম অবশ্যম্ভাবীরূপে ট্র্যাজিক হতো না। এমন কি সমসাময়িক ফ্যান্সে বা ইংলন্ডে লেখা হলেও কাহিনীর শেষটা অতখানি মর্মান্তিক না হতেও পারত। গলসওয়ার্দি যে ওটা মেনে নিতে পারলেন না তার কারণ তাঁর অভিজ্ঞতা ভিকটোরিয় ভন্ডামির হলেও পশ্চিম ইউরোপীয় উদারতার। টলস্টয় দুটোর কোনেটার পক্ষপাতী ছিলেন না। তিনি মনে প্রাণে খ্রীষ্টিয় আদর্শে বিশ্বাসী। তার থেকে করুণা। আবার তারই থেকে মরণান্ত সমাধান। মাঝখানে অবশ্য আরো একটা বিকল্প ছিল। আনা অনুতাপ করে স্বামীর সংসারে ফিরে যেত। সেই ভরসায় স্বামীস্ত্রীর ডিভোর্স ঘটানো হয়নি। কিন্তু তাতে রসভঙ্গ হতো। টলস্টয় নীতি নিপুণ হলেও আর্টিষ্ট। আর্টের দিক থেকে স্বামীর সঙ্গে মিলন অসম্ভব। আবার নীতির দিক থেকে প্রেমিকের সঙ্গে বিবাহ অবাঞ্ছনীয়। তা হলে তো নারীর পদস্খলনকে পুরস্কৃত করা হলো। সেই সঙ্গে পুরুষের পদস্খলনকেও।

‘যুদ্ধ ও শান্তি’ শেষ হয় ১৮৬৯ সালে। পরের বছর টলষ্টয়ের পত্নী তাঁর বোনকে লেখেন এবার তাঁর স্বামী লিখতে চান একটি অভিজাতশ্রেণীর বিবাহিতা মহিলার পদস্খলনের কাহিনী। তাঁর সমস্যা হবে তাঁর কাহিনীর নায়িকাকে এমনভাবে উপস্থাপিত করা, যাতে তাকে গিলটি মনে না করে প্যাথেটিক মনে করা হয়। দোষী মনে না করে করুণ মনে করা হয়। বই লেখা শুরু হয় ১৮৭৩ সালে। কিন্তু ইতিমধ্যে ১৮৭২ সালে ঘটে যায় এক সত্যিকার দুর্ঘটনা। রেল লাইনে কাটা পড়ে মারা যান এক ভদ্রমহিলা, তাঁর নামও আনা। প্রতিবেশী এক বিপত্নীক জমিদারের উপপত্নী। জমিদার তাঁর সন্তানদের গবর্নেসকে বিবাহ করতে চান। শুনে আনা আত্মহত্যা করেন। টলস্টয়কে এই অপ্রত্যাশিত দুর্ঘটনা বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। সম্ভবত এর থেকেই তিনি পেয়ে যান তাঁর নায়িকার নাম ও পরিণাম। যা শুধুমাত্র করুণ হতে পারত তাই হলো ট্র্যাজিক। ট্র্যাজেডীকে অবশ্যম্ভাবী করতে হলে তার কারণ দর্শাতে হয়। কারণ থেকে কার্য ঘটে এটা যেমন সত্য তেমনি সত্য কার্য ও কারণকে চুম্বকের মতো নিয়তির অভিমুখ টানে। আমার অনুমান টলষ্টয়ের আনার ভবিতব্যই তার অতীতকে নিয়ন্ত্রিত করেছে। কাহিনীকে সত্য ঘটনামূলক করতে গিয়ে মূল কল্পনাকে তদানুযায়ী করতে হয়েছে। ওরকম একটা দুর্ঘটনা না ঘটলে কার্য হয়তো কারণ থেকে নিম্নমুখে বইত, কার্য থেকে কারণ উজান বইত কিছুদূর এগোতে না এগোতেই এক রেল দুর্ঘটনা। একটি লোক চাকার তলায় পড়ে মারা যায়। স্বেচ্ছায় কিংবা নেশার ঘোরে কিংবা কুয়াশায়। ভ্রনস্কির সঙ্গে আনার প্রথম সাক্ষাতের পরক্ষণে ওটা কি শুভদৃষ্টি না অশুভদৃষ্টি।

আনার বিয়ে হয়েছিল যাঁর সঙ্গে তিনি তার থেকে বয়স বিশ বছরের বড়ো, সুদক্ষ ও প্রবীন রাজকর্মচারী। দেশের বসাই তাকে এক ডাকে চেনে। বিদেশেও তাঁর নামডাক। এমন মানুষের সময় কোথায় যে স্ত্রীকে সঙ্গ দেবেন? বিয়ের আগে ভালোবাসা হয়নি, বিয়ের পরেও না। স্বামী স্ত্রীর সম্বন্ধ নিতান্তই কর্তব্যের সম্বন্ধ। দু’জনেরই দু’জনের প্রতি কর্তব্যপরায়ন। ভালোবাসা আনার জীবনে যখন এল তখন সে শুধু একজন বিবাহিত মহিলা নয়, একটি পুত্রের জননী। তার ছেলের বয়স আট বছর। তার হৃদয়ের সমস্ত ভালোবাসা তার ছেলের উপরেই কেন্দ্রীভূত। তার ছেলেই তার জীবনের কেন্দ্র। একটা দিনের জন্যেও সে ছেড়ে থাকতে পারবে না। এমন যে পুত্রগত প্রাণ জননী তার জীবনে কোন্ এক অশুভক্ষণে অবিবাহিত ভ্রনস্কির আবির্ভাব। কাউন্ট ভ্রনস্কি ধনীর সন্ত ান, স্বেচ্ছায় বেছে নিয়েছে সৈনিকের জীবন, সেটা তার কেরিয়ার হলেও জীবিকা নয়, ঘোড়দৌড় ইত্যাদি নিয়েই সে নিজেকে ব্যস্ত রাখে। প্রেমে পড়ার মতো অবসরও নেই, অভিপ্রায়ও নেই। বিবাহ তো দূরের কথা। তাকে স্বামীরূপে কামনা করেছিল আনার ননদ কিটি, তার প্রেমেও পড়েছিল ওই অষ্টাদশী তরুণী। আনার আরেক ননদ ডলি একদিন তার স্বামী ষ্টিভার অবিশ্বস্ততার প্রমাণ পেয়ে স্তম্ভিত ও কিংকর্তবিমূঢ় হয়। তখন তাকে শান্ত করার জন্যে পিটার্সবুর্গ থেকে মস্কো ছুটে আসে আনা। রেলপথে সহযাত্রিণী হন বর্ষীয়সী কাউন্টেস ভ্রনস্কি। মস্কো ষ্টেশনে তাকে ট্রন থেকে নামিয়ে বাড়ির আনার জন্যে যায় তাঁর পুত্র। সেই সূত্রে ভ্রনস্কির সঙ্গে আনার প্রথম দর্শনে প্ৰেম। এই নিষিদ্ধ প্রেম তাদের দু’জনকেই ভাসিয়ে নিয়ে যায় এক অপ্রতিরোধ্য বণ্যায়। সে যেন এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যার উপরে মানুষের হাত নেই। প্রকৃতি স্থির করে দেয় তাদের নিয়তি। আনার বিবেক একটু সায় দেয় না, কিন্তু সারা দেহ সারা মন সারা হৃদয় সারা সত্তা সাড়া দেয়। এই বন্যায় সে তার পায়েল তলার মাটি থেকে ছিটকে পড়ে। সেটার নামই কি পদস্খলন? পতন? ভ্রষ্টতা? ভ্রনস্কিরও একই দশা। কিন্তু তার তো স্ত্রী নেই, সন্তান নেই, তাদের প্রতি কর্তব্যের টান নেই। সে অপেক্ষাকৃত স্বাধীন। কিন্তু পুরোপুরি স্বাধীন সেও নয়। নিষিদ্ধ প্রেমে জড়িয়ে পড়ে মিলিটারি ডিউটিতে অবহেলা করলে তারও চাকরি নিয়ে টানাটানি। অবিবাহিত পুরুষের জীবনে বিবাহিতা নারীর সঙ্গে ‘অ্যাফেরার’ নতুন কিছু নয়। অমন তো কত হয়। তেমনি বিবাহিতা নারীর জীবনেও অবিবাহিত পুরুষের সঙ্গে ‘অ্যাফেয়ার’ অজ্ঞাত বা অশ্ৰুত নয়। উভয় পক্ষই ওটাকে ক্ষণস্থায়ী বলে জানে, তাই অনিত্যের জন্যে নিত্যকে বিসর্জন দেয় না। ওটা ক্ষণিকের মতিভ্রম। ব্যাপারটাকে ওইভাবে নিলে আনাকেও কূলত্যাগ করতে হতো না, তার স্বামীকেও হতমান হতে হতো না, ভ্রনস্কিরও মিলিটারি সার্ভিস থেকে পদত্যাগ ঘটত না, কিটিরও হতাশ প্রেম থেকে অসুখ বাধত না, ভ্রনস্কির সঙ্গেই শেষ পর্যন্ত তার বিয়ে দিয়ে মধুরেণ সমাপয়েৎ করতে পারা যেত। ‘আনা কারেনিনা’ হতো একখানি কমেডী। তা না হয়ে যা হলো তা একখানি ট্র্যাজেডী। মূল কারণ, আনা ও ভ্রনস্কির প্রেম অভিজাত সমাজে প্রচলিত সাধারণ একটা ‘অ্যাফেয়ার’ নয়, যাকে দু’দিন বাদে বা দু’বছর বাদে ঝেড়ে ফেলতে পারা যায়। অবৈধ সহবাস সত্ত্বেও। অবৈধ সন্তানলাভ সত্ত্বেও। কারেনিনা যথেষ্ট ক্ষমাশীল ছিলেন, আত্মীয়স্বজনও যথেষ্ট দরদী। কিন্তু যে-নারী পরপুরুষকে ও যে-পুরুষ পরনারীকে বরাবরের জন্যে নিজের করতে চায় তাদের এক পক্ষের যদি একটি সন্তান তাকে ও সে সন্তানের মায়া কাটানো পরমদুঃখকর হয় তবে তার পরম দুঃখের কোনো ক্ষতিপুরণ নেই। সেই দুঃখিনী দয়িতাকে সুখী করা ধন দিয়ে নয়, মন দিয়ে নয়, সঙ্গ দিয়ে নয়, এমন কি তালাকের পর বিবাহ দিয়েও কারো সাধ্য নয়।

এ ক্ষেত্রে ধনের কোনো অভাব ছিল না মানের অভাব ছিল, পিটার্সবুর্গের অভিজাত সমাজে আনা অপমানিত হয়েছিল। মস্কোর অভিজাত মহলেও সে অপাঙ্ক্তোয়। গ্রামে গিয়ে বসবাস করাই ছিল প্রকৃষ্ট পন্থা। যেদিন ওরা গ্রামে ফিরে যাবে তার আগের দিন ঘটে আনার স্বেচ্চাকৃত অপঘাত। আনার নিশ্চয়ই আশঙ্কা করেছিল যে, গ্রামেও সে সমানভাবে মিশতে পারবে না। সেখানেও তার আসন হবে জমিদারের রক্ষিতার। সেখানেও তার মনে সন্দেহ থাকবে যে আনার তালাক যখন হয়নি তখন ভ্রনস্কি তাকে বিয়ে না করে অন্য একজনকে বিয়ে করতে পারে। অথচ আনার তালাকের জন্য ভ্রনস্কির যত মাথাব্যথা আনার ততখানি নয়। আনার পক্ষে ডিভোর্স পাওয়া না পাওয়া ছির সেকালের আইন অনুসারে তার স্বামীর করুণানির্ভর। যে নারী ব্যভিচার দোষে দোষী সে কখনো তার স্বামীকেই দোষ দিয়ে তালাকের জন্য আদালতে যেতে পারে না। আদালতে যেতে হলে যেতে হবে তার স্বামীকেই। স্বামীই স্ত্রীকে দোষ দিয়ে তালাক আদাল করতে পারে। কিন্তু সেরূপ স্থলে স্ত্রীর কলঙ্ক হবেত, ছেলের কলঙ্ক হবে, স্বামীও যে কলঙ্ক হবে না তা নয়। কারেনিনা। সেটা এড়াতে চেয়েছিলেন, তা সত্ত্বেও উকিলের পরামর্শ নেন। পরে দেখা গেল কারেনিনা একজন বিশ্বাসী খ্রীষ্টান। খ্রীস্ট নিষেধ করে গেছেন স্ত্রীকে তালাক করতে। দোষী হলেও তাকে ক্ষমা করতে হবে। চার্চেরও সেই বিধান। কারেনিনা প্রথমটা উপরোধে পড়ে নিজের ঘাড়ে দোষটা টেনে নিয়ে আনাকে তালাক দিতে রাজি হয়েছিলেন। তার মানে তাঁকে মিথ্যা কথা বলতে হতো যে তিনিই অন্য নারীগামী। আনার খাতিরে তিনি এতদূর যেতে রাজি হলেও ছেলেকে ছেড়ে দিতে রাজি ছিলেন না। পরে তাঁর কথা থেকে মনে হলো তিনি তাতেও রাজি, কিন্তু কন্যার জন্মের পর কন্যাকে নিয়ে যখন আনার ভ্রনস্কির সঙ্গে ইতালি চরে যায় তখন কারেনিনার সঙ্গে কথাবার্তার খেই ছিঁড়ে যায়। ইতিমধ্যে কারেনিনা পড়েন কাউন্টেস লীডিয়ার প্রভাবে। এই ধার্মিক মহিলা তাঁকে বোঝান যে তালাক পেলে আনা ঘরে ফিরে আসতে চাইলেও ফিরে আসতে পারবে না, তার ভালো হওয়ার পথ বন্ধ হয়ে যাবে। আনার মঙ্গলের জন্যই ওর প্রত্যাবর্তনের পথ খোলা রাখাই শ্রেয়। কারেনিনা নিজে আবার বিয়ে করতেন না। তিনি আদর্শ খ্রীস্টান হতে চেয়েছিলেন। কেউ যদি তোমার একগালে চড় মারে তুমি তার দিকে আরেক গাল বাড়িয়ে দেবে, এই নীতির অনুসরণে তিনি অপরাধিনী স্ত্রীকে তার দ্বিতীয় বিবাহে সাহায্য করতে সম্মত হয়েছিলেন। কিন্তু আনা তাঁর কাছে করুণা প্রার্থন করেনি, তার হয়ে করেছিলেন তার ভাই। সে অনুতপ্ত হয়নি। প্রেমের জন্য তার দেহমনহৃদয় ক্ষুধার্ত। তার ক্ষুধার নিবৃত্তি তার ভরা যৌবনে না হলে সে সারাজীবন জ্বলত। তার জীবন জুড়িয়েছে বলে কি সে অনুপাত করবে? তবে এটাও জানে যে সে বিবাহের শপথভঙ্গ করে অপরাধী হয়েছে। তার অপরাধবোধ সত্য। অথচ অপরাধের দরুণ করণীয় যে অনুশোচনা সেটা অসত্য। বিধাত তাকে যেমন করে গড়েছেন সে তেমনি। সে সত্যকথা বলে, সত্যাচরণ করে, না পারলে বিবেকের দংশনে পীড়া পায়। ছলনা তার স্বভাবে নেই। স্বামীর অঙ্গীকৃত ডিভোর্স প্রত্যাখ্যান করে আনা দ্বিতীয় বিবাহের সুযোগ হারায়। পরে যখন ভ্রনস্কির পীড়াপীড়িতে স্বামীর করুণাপ্রার্থী হয় ততক্ষণে খুব বেশি দেরি হয়ে গেছে। তিনি অঙ্গীকারভঙ্গ করেন।

ভ্রনস্কির মতো সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তানকে যে দুঃখ পোহাতে হয় সে দুঃখ অন্যপ্রকার। আনার গর্ভে তার যে কন্যা হয়েছে তাকে সে নিজের বলে দাবী করতে পারে না। আইনত সে করেনিনার। তার পদবী ভ্রনস্কির নয়, কারেনিন। পরে যেসব সন্তান জন্মাবে তারাও কেউ ভ্রনস্কি বলে পরিচিত হবে না, হবে কারেনিন বলে। তা হলে বংশরক্ষা হবে কী করে? সে ধরে নিয়েছে যে আনার সঙ্গে তার আইন অনুসারে বিয়ে হবে, যদি তার আগে তালাকটা হয়। চার্চ তেমন বিবাহ স্বীকার করবে না, কিন্তু রাষ্ট্রে তার নজীর আছে। তখন তো তার সন্তানদের ভ্রনস্কি বলে পরিচিত হতে বাধা থাকবে না। আনার মহিগিত কিন্তু বিপরীত। সে আর মা হতে চায় না। তা বলে সে ব্রহ্মচারিণী নয়। জন্মশাসনের উপায় জেনে নিয়েছে। এ নিয়ে প্রেমিক প্রেমিকাতে মনোমালিন্য। ভ্রনস্কি চায় স্বামী-স্ত্রীর সহজ স্বাভাবিক জীবন। তার কি ধনের অভাব যে একটি সন্ত ানেই সে সন্তুষ্ট হবে? তাও পরের নামাঙ্কিত। সে চায় আরো সন্তান। পুত্রসন্তান। সম্পত্তির উত্তরাধিকারী। আনার সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। তার কাছে তার স্বাশীর দিকের পুত্রই যথেষ্ট। এক মুহূর্তের জন্যেও সে তার পুত্রকে ভুলতে পারে না। তার জীবনকে সে ভাগ করে দিয়েছে পুত্র আর প্রেমিক দুজনের মধ্যে। সে একই কালে পুত্রগত প্ৰাণ ও প্রেমিকগত প্রাণ। কী করে তাদের একবৃন্তে মেলাবে এইতার সমস্যা। ডিভোর্স এ সমস্যার সমাধান নয়, যদি না পুত্রকেও তার পিতার তার মাতার সঙ্গে থাকতে দেন। না, কিছুতেই তিনি এতে রাজী হবেন না। এই দুরাশা।

আনা ভিতরে ভিতরে ভেঙে পড়ছিল পুত্রের সঙ্গে প্রেমিকের জোড় মেলাতে না পেরে। সে মেনে নিতে পারছিল না যে তাকে পুত্রের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে জীবনধারণ করতে হবে। তার মনে হচ্ছিল তার মরণই ভালো। এ রকম একটা সমাধান তার মাথায় আসে যখন তার কন্যাসন্তান ভূমিষ্ঠ হবার পরে সূতিকারোগে তার প্রাণ সংশয় হয়। ঘটনাটি ঘটে তার স্বামীর গৃহেই। আনাকে বাঁচাতে তিনিও যথাসাধ্য চেষ্টা করেন। কন্যাটি যদিও তাঁর নয় তা সত্ত্বেও তিনি তাকে ভালোবাসেন। সেই সন্ধিক্ষণে আনার মৃত্যু হলে আশ্চর্যের বিষয় হতো না, কারণ ডাক্তারও সেই আশঙ্কা করেছিলেন। ভ্রনস্কির বেদনা তখন দেখবার মতো। মৃত্যু আসন্ন জেনে আনা নিজেই উদ্যোগী হয়ে স্বামীর সঙ্গে প্রেমিকের শাস্তি স্থাপন করে। এমন একটি স্বর্গীয় দৃশ্য বিশ্বসহিত্যে দুর্লভ। গ্রন্থ যদি এইখানেই সমাপ্ত হতো স্বামী স্ত্রী ও প্রেমিকের মহিমাময় মিলনের মধ্যে কাহিনীর পরিণত কী মহৎ হতো! তবে সূতিকারোগে মরণ ঘটত আনার।

কিন্তু গ্রন্থকারের অভীষ্ট ছিল সে রকম মৃত্যুর নয় অন্যরকম মৃত্যুর সংঘটন। তার ইঙ্গিত তিনি দিয়ে রেখেছিলেন ভ্রনস্কির সঙ্গে আনার প্রথম দর্শনের সময়। দুর্ঘটনার বার্তা শুনে আনা মন্তব্য করেছিল, এটা একটা অশুভ লক্ষণ। তাদের মিলনের পরেও দেখা দেয় আর একটা অশুভ সঙ্কেত। ঘোড়দৌড়ে জয়হতে যাচ্ছে ভ্রনস্কির। এমন সময় সে লম্ফমান ঘোড়ার পিঠে লম্বামান না হয়ে ধফ করে বসে পড়ে। ঘোড়ার পিঠ ভেঙে যায়। যন্ত্রণার থেকে মুক্তিদানের অন্য উপায় মা থাকায় ঘোড়াটিকে গুলি করে মারতে হয়। ওটি অশ্ব নয়, অশ্বিনী। সুন্দরী ও সুগঠিত। যেন আনা কারেনিনার প্রতিরূপ। ভ্রনষ্কি তাকে ভালবেসে মনোনয়ন করেছিল। অথচ তারই অপঘাত মৃত্যুর নিমিত্ত হলো। শেষের দিকে আনা মৃত্যুর জন্য অধীর হয়ে উঠেছিল। ডিভোর্স পেরেও কি সে বাঁচতে চাইত? দ্বিতীয়বার বিবাহ করলেও কি সে বাঁচত? তার জীবন কি সার্থক হতো পুত্রকে বরাবরের মতো হারিয়ে প্রত্যাবর্তনের পথ বরাবরের মতো রুদ্ধ করে? ‘এ বই তিনরকম ভাবে লিখতে পারা যেত। এ ব্যাপারে পঞ্চাশ বছর আগে ঘটলে কারেনিন পুশকিনের মতো ডুয়েল লড়ে মারা যেতেন। ভ্রনস্কিও তো আনার মৃত্যু আসন্ন দেখে আত্মঘাতী হতে যাচ্ছিল। গুলীটা বুকে লাগলে সে-ই মারা যেত। ত্রিভুজকে দ্বিভুজে পরিণত করতে হলে একজন না একজনকে মরতে হতোই। সেই একজন হলো টলস্টয়ের বিচারে আনা। লেখকের চিবার চূড়ান্ত। আনা যোগ দিল বিশ্বসাহিত্যের ট্র্যাজিক হিরোইনদের সঙ্গে। হেলেন তাদের একজন নয় তার সঙ্গে তুলনা বৃথা। ট্রাকিক হিরোইন হওয়া ক িসম্ভব হতো আনা যদি পতিহারা বা সাথীহারা হয়ে বেঁচে থাকত? পতিহারা হলে পুনর্বিবাহ পুসগ হতো সন্দেহ নেই, কিন্তু পুত্রের সঙ্গে দ্বিতীয় স্বামীর সামঞ্জস্য কতো কী করে? সাথীহারা হলে পুত্রসুখে সুখী হতো, কিন্তু প্রিয়সঙ্গ পেত কোথায়?

মরণ ঝাঁপ দেবার আগে আনার স্বগতচিন্তার বিক্ষিপ্ত টুকরোর মধ্যে এটাও ছিল যে তার প্রেমিক তাকে প্রেম দিয়ে তৃপ্ত করতে পারেনি। কামনার তৃপ্তির জন্যে সে পিপাসার্ত। তার শঙ্কাও ছিল যে ভ্রনস্কি তাকে একদিন সঙ্গ না দিয়ে পরিত্যাগ করবে। পতি পরিত্যাগিনী হবে প্রেমিকপরিত্যাক্ত। ভ্রনস্কি আগের মতো সমাজে মেশে, আনা তো তা পারে না। এটাও তার সহ্য হয় না। তা বলে কি পুরুষ মানুষ তার সব কাজ ফেলে প্রিয়ার সঙ্গে সমস্ত ক্ষণ কাটাবে? একটি দিনের জন্যও বাইরে যাবে না? গেলে তার প্রিয়ে তাকে ভুল বুঝবে? বস্তুত বিবাহ একজন পুরুষকে বা নারীকে যে পরিমাণ স্বাধীনতা দেয় বিবাহব্যতিরিক্ত একত্রবাস সে পরিমাণ স্বাধীনতা দেয় না। বিবাহের নিরাপত্তা বেশি। শান্তি বেশি। সুখের চেয়ে শান্তি ভালো। কারেনিনের সঙ্গে আনার সুখ ছিল না, শান্তি ছিল। আর ছিল সামাজিক মর্যাদা ও মেলামেশার পরিসর। ভ্রনস্কির সঙ্গে সুখ ছিল, শান্তি ছিল না। আর ছিল না সামাজিক স্বীকৃতি ও নিমন্ত্রণ আমন্ত্রণ। কোলের মেয়েটিকে নিয়ে কী জানি কেন তার আনন্দ ছিল না। ভ্রনস্কিরও না। সে-ই হতে পারত তাদের মিলনের সেতু। কিন্তু আনা তাকে ভালবাসত না, ভ্রনস্কিও যে আদর করতে তা তো মনে হয় না। বরং কারেনিনেরই তার প্রতি একটা অহেতুক মমতা। টলস্টয় তাঁর পরিকল্পিত নায়িকাকে গিলটি বলে বিশোষিত করতে চাননি। করতে চেয়েছিলেন শুধুমাত্র প্যাথেটিক। কিন্তু তাঁর পূর্ব কল্পনা ঘটনাচক্রে পরিবর্তিত হয়। তাই আনা কারেনিনা শুধুমাত্র প্যাথেটিক নয় মূলত গিটি। সে নিজেও মানে ও কথা এক শতাব্দি পরে জন্মালে মানত না। গিল্ট সম্বন্ধে নরনারীর বদ্ধমূল ধারণা ছিন্নমূল হয়েছে। প্রেমহীন বিবাহে দেহদান দৃষ্টিতে ক্রীতদাসের নীতি। স্বাধীন মানুষের নীতি নয়। বিবাহহীন প্রেম তার চেয়ে নীতিসম্মত। একালের বিদগ্ধ পাঠক আমাকে দোষী বলে দন্ড দিতে কুণ্ঠিত হবেন। যতদিন সে তার স্বামীর ঘরে ছিল ততদিন তার দ্বৈতজীবন নীতিবিরুদ্ধ ছিল, কিন্তু গৃহত্যাগের পর সে কেবল প্রেমিকের সঙ্গেই থাকে। নীতির নিকষে আমি তো এতে অপরাধের দাগ দেখতে পাইনে। সমাজের নিকষও ঠিক আগের মতো নেই। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের পর এ কালের আনারা অনায়াসেই কারেনিনাদের ফেলে ভ্রনস্কিদের সঙ্গে বাস করছে। তালাক হয়তো হয়নি, পুনর্বিবাহ হয়তো ঘটেনি, সন্তান হলে বার্থ রেজিষ্টারে ভ্রনস্কিদের নাম লেখা হচ্ছে। আইন এখন এতদূর উদার হয়েছে যে তালাকের মামলায় কোনো পক্ষের অপরাধ প্রমান করতে হয় না। কে অপরাধী কে নয় তাতে কিছু আসে যায় না। কে অপরাধী কে নয় তাতে কিছু আসে যায় না। একালের পাঠক বুঝতেই পারবে না আনা কারেনিনা কী এমন অপরাধ করেছিল, কেন তার অমন নিষ্ঠুর পরিনাম হলো।

টলস্টয়ের যুদ্ধ ও শান্তির একটা শাশ্বত আবেদন আছে। এক শতাব্দি পরেও তার হেরফের হয়নি। আনা করেনিনা সম্বন্ধেও সে কতা বলা চলে কি? তারও কি একটা তেমনি সার্থক, তেমনি প্যাশন ও তেমনি কম্প্যাশন ভরা? টলষ্টয় যে সব প্রতিমায় জীবন্যাস করেছিলেন তারা কি তেমনি রক্তমাংসের মানুষ, তেমনি ভালয় মন্দে মেশা? এটি একটি আশ্চর্য চরিত্রশালা। যে যেমন সে তেমন। প্রত্যেকেই বিশিষ্ট। শিল্পকর্মে হিসেবে আনা কারেনিনা এখনো অতুলনীয়। যে টলষ্টয় আর্টিস্ট তিনি তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন এতে। আর্টের দিক থেকে স্বয়ং ডস্টয়েভস্কির মতে এ উপন্যাস নিখুঁত। বিতর্ক কেবল মনস্তত্ত্ব নিয়ে। মনস্তত্ত্ব ইতিমধ্যে আরো বেশি সূক্ষ্ম হয়েছে। ফ্রয়েড এসে চিরকালের রুদ্ধ দুয়ার খুলে দিয়েছেন। অবচেতনে অবগাহন করলে চিন্তার ও আচরণের অন্যরকম ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। তার পর সেকালের সেই সাদা-কালো দুরঙা নীতিও নরনারীর দুরেখা নীতি একালে মেনে নেয়া যায় না। মরালিষ্ট টলষ্টয়ের সঙ্গে একালের বিদগ্ধ জনের মতভেদ অন্যায্য নয়। আনা যদি বাঁচত তা হলে ভ্রনস্কির প্রতি তাঁর একনিষ্ঠ প্রেমই তাকে সাধারণ স্বামী ভক্তির চেয়ে মহত্তর আসন দিত। যেমন দিয়েছে রাধাকে। পরিত্যাক্ত বলে রাধাকে তো মরতে হয়নি। তবে রাধা তো শ্যামের জন্য কুলত্যাগ করেননি। যার জন্যে কুলত্যাগ সে-ই যদি পরিত্যাগ করে তবে তার শাস্তি প্রাণত্যাগ। তার মর্ম নিজের মৃত্যু। ভ্রনস্কিকে আনা ভুল বুঝে গুরু দন্ড দিয়ে গেল। ধ্বংস করে গেল তারজীবন। যাকে ভালোবাসে তার সর্বনাশ করাই কি প্রেমিকার সাজে? এটাই হয়তো বাস্তব সত্য। যেমন তীব্র প্যাশন তেমনি তীব্র সন্দেহ ও ঈর্ষা। দুঃখীরা দুঃখ দিতে ভালোবাসে। আনার মতো দুঃখনিী কে? ওটাও তো প্রেমের পরীক্ষা। ভ্রনস্কির প্রেম যদি সর্বংসহ হতো তবে হয়তো বা তাদের মিলিত জীবন স্থায়ী হতো।

এদের দু’জনের প্রেমকে আমরা সামাজিক তথা নৈতিক দৃষ্টিতে দেখতে অভ্যস্ত। তাই মনে করি এদের ট্র্যাজেডির মূলে সামাজিক তথা নৈতিক বিধি লঙ্ঘন। এ ধারনা ভুল নয়, কিন্তু পুরোপুরি ঠিকও নয়। মূলের নিচেও মূল আছে। তলিয়ে না দেখলে নজরে পড়ে না। এই রহস্যের তল মনস্তত্ত্বের অতলে। আনা ভ্রনস্কিকে ভালবাসে বহুভাগ্যে পরস্পরকে কাছে পেয়েছে। কিন্তু এই যে কাছে পাওয়া ওটাই ওদের কাল হল। কাছে এলেই ঠোকাঠুকি বাধে। কেন বাধে তার নানা বিচিত্র কারণ। কিন্তু আধুনিক মনোবিদ্যা ক্রমেই উপলব্ধি করেছেন যে, অনুরাগের উল্টো পিঠে বিরাগও থাখে। যাকে সব চেয়ে আনন্দ তাতে সব চেয়ে বেদনা বা বিকার। তা ছাড়া ওটা এক প্রকার রণ। রণ থাকলে জয়-পরাজয়ের প্রশ্নও থাকে। আনা চায় ভ্রনস্কির ওপর বিজয়িনী হতে। ভ্রনস্কি কি বার বার পরাজয় মেনে নেবে? কখনো কি বিদ্রোহী হবে না? আনা চায় বিজিতকে বন্দি করে রাখতে। বন্দি কি মুক্তির জন্য ছটফট করবে না? আজকাল প্রাই শুনতে পাওয়া যায় একটা কথা। সেকসত্তার। ওর তর্জমা করলে কটু লাগবে। উপযুক্ত পরিভাষিক শব্দ নেই। আনা কারেনিনার স্রষ্টা শুধু যে মনোবিদ্‌ ছিলেন তাই নয়, বহু নারীর সংসর্গে এসে হাতে কলমে পরীক্ষা নিরীক্ষাও করেছিলেন। তাঁর নারীচরিত্রগুলি সেই জন্য এমন জীবান্ত। তিনি যেন তাদেরই একজন হয়ে ভিতর থেকে তাদের দেখেছিলেন ও বুঝেছিলেন। নারীজাতি সম্বন্ধে বিষম তিক্ত ছিলেন টলষ্টয়। গর্কিকে যা বলেছিলেন তা মর্ম নারী সম্বন্ধে সত্য কথা বলা বিপজ্জনক। যেদিন তাঁর মৃত্যু হবে সেদিন তিনি একটি পা কবরের মধ্যে রেখে নারী সম্বন্ধে সত্য কথাটি নির্ভয়ে বলবেন। তাড়াতাড়ি আর একটি পা কবরের ভিতরে টেনে নিয়ে ধপ করে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়বেন। সঙ্গে সঙ্গে শেষ নিঃশ্বাস ফেলবেন। দুঃখের বিষয় তাঁর মৃত্যুর কয়েকদিন আগেই তিনি সংজ্ঞা হারান। মনের কথাটা মনেই থেকে যায়।

আনার কারেনিনা বিশ্লেষণধর্মী রচনা। তখনকার দিনের পক্ষে ব্যতিক্রম। তা হলেও নরনারী সম্পর্কের ওপর নির্ভয়ে আলোকপাতের অনুকল করে নিতে হয়। টলষ্টয় মেনটালের খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে এলিমেন্টের স্তরে পৌঁছেছিলেন। যে কথা বলি বলি বার করে বলতে সাহস হল না সে কথা বোধহয় এলিমেন্টাল।

উপন্যাসটির চাবি নিহিত রয়েছে বাইবেল থেকে উদ্বৃত সেই উক্তিটিতে যেটি মুদ্রিত হয়েছে আনা কারেনিনা নামটির নিচে। তার মর্ম প্রতিশোধ আমারই। আমিই অন্যায়ের শোধ নেব। অর্থাৎ দন্ডদানের কর্তা বিধাতা স্বয়ং। দন্ড দিতে হয় তিনিই দেবেন যথাকালে যথানিয়মে। মানুষ মানুষকে দন্ড দিতে পারে না। কারেনিনা আনাকেও না। আনা ভ্রনস্কিকেও না। বাইবেলে আছে:

ÒDearly beloved, avenge not yourselves, but rather give place unto wrath; for it is written, Vengeance is mine; I will repay, saith the Lord. Therefore if thine enemy hounger, feed him: if he thirst, give him dirnk: for in so doing thou shall heap coals of fire on his head. Be not overcome of evil, but overocme evil with good.” (New Testament, Romans, Chapter 12, verses 19-2)

এই বই লেখার সময় টলষ্টয়ের বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। সাংসারিক সাফল্যে তাঁর বৈরাগ্য এসেছিল। তিনি খুঁজছিলেন জীবনের অর্থ। যা না পেলে জীবন বৃথা। একটু একটু করে তিনি ঝুঁকছিলেন খ্রীষ্ট ধর্মের দিকে। কিন্তু গির্জার দিকে নয়। অন্যান্য ধর্মের প্রতি তাঁর দৃষ্টি ছিল। ধীরে ধীরে তিনি এই প্রত্যয়ে পৌঁছান যে, হিংসার উত্তর প্রতিহিংসা নয়, অহিংসা। আঘাতের উত্তর প্রত্যাঘ্যাত নয়, ক্ষমা। অনিষ্টের উত্তর পাল্টা অনিষ্ট নয়, উপকার। ভ্রষ্টতার উত্তর বর্জন নয়, করুণা। পাপের উত্তর সাজা নয়, অন্যায়ের উত্তর প্রতিশোধ নয়, শত্রুকে তার ক্ষুধার অন্ন তুষার পানি যোগানে। মন্দের উত্তর প্রতিরোধ নয়, অপ্রতিরোধ।

এই উপন্যাসের অন্যতম প্রধান চরিত্র লেভিন। সে যেন ৩৩ বছর বয়সের টলষ্টয়। জীবিকার চেয়ে জীবনকে নিয়েই সে ভাবিত। তার জীবন পরিশেষে অর্থবান হয়, তার অন্তর হয় নতুন অনুভূতির দ্বারা আপ্লুত। তাকে ভালো হতে হবে, ভালো কাজ করতে হবে, তার জীবনকে ভালো দিয়ে ভরে দিতে হবে। লেভিনের মতো টলষ্টয়ের জীবনও ভালো দিকে মোড় নেয়। সেই বয়সে নয়, আরো পণিত বয়সে। আনা কারেনিনা লিখতে গিয়ে তিনি লেভিনের কলমে নিজের ধর্মীয় অনুভূতির কথাও লিপিবদ্ধ করেন। আনা ও ভ্রনস্কির কাহিনী ফুরিয়ে যাবার পরেও লেভিনের কাহিনীর রেশ থাকে। আর্ট নয়, মরালিটি নয়, মনস্তত্ত্ব নয়, ধর্মীয় উপলব্ধির উপরেই যবনিকা পড়ে। লেভিনের তথা টলস্টয়ের আন্তঃপরিবর্তন এ গ্রন্থের উপসংহার। এখন থেকে তিনি ঋষি টলষ্টয়।

বছর পঞ্চাশ বয়সে টলষ্টয়ের জীবনদর্শন এমন গভীরভাবে বদলে যায় যে সেই পরিবর্তন যেন একপ্রকার ধর্মপরিবর্তন বা কনভারসন। ভিতরে তিনি ফিরে যান যীশু খ্রীস্টের আদি শিষ্যদের যুগে। যাঁদের জীবনযাত্রা ছিল সরল, নিরলঙ্কার, সকলের প্রতি সপ্রেম, হিংসা প্রতিহিংসা বর্জিত, ক্ষমাপরায়ণ, শাসনমুক্ত, শোষণমুক্ত, আত্মশ্রমনির্ভর, নারীসম্পর্কহীন বা পরনারী সম্পর্কহীন, বেশ্যাবৃত্তিবিরোধী। আদি খ্রীষ্টানদের ছোট ছোট কমিউন পরবর্তীকালে অতিকায় চার্চে পরিণত হয়, চার্চের উচ্চভিলাস রাষ্ট্রের উচ্চাভিলাষকেও ছাড়িয়ে যায়, খ্রীস্টানরা খ্রীস্টানদের আগুনে পুড়িয়ে মারে, ক্রীতদাস বানিয়ে কেনাবেচনা করে, বেশ্যাবৃত্তির প্রশ্রয় দেয়, সৈনিকবৃত্তির সমর্থন করে, যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত হয়, শ্রমিকদের শ্রমের উদ্বৃত্ত মূল্য থেকে তাদের বঞ্চিত করে, কৃষকদের জমি কেড়ে নেয়। টলষ্টয় যেমন রাষ্ট্রের ধ্বংস করার প্রবর্তনা দেন না। যে প্রবর্তনা থেকে উদ্ভূত হয়েছিল ফরাসি বিপ্লব। যে বিপ্লবের জের চলছিল রুশদেশের শিক্ষিত মানসে। টলষ্টয়ের বাণী হলো, ফিরে চল মাটির টানে, ফিরে চল যীশুর আদর্শে, ফিরে চল নীতির জগতে।

আনা কারেনিনা লিখতে লিখেতেই তিনি এই প্রত্যয়ে উপনীতি হন যে যীশুর প্রদর্শিত পথই শ্রেষ্ঠ পথ, যদি তাকে অক্ষরে অক্ষরে অনুসরণ করা হয়। তিনি প্রথম নিজের জীবনে পরে পরিবারের জীবনে ও আরো পরে দেশের তথা মানবজাতির জীবনে প্ৰেম, ক্ষমা, অপ্রতিরোধ, অপ্রতিশোধ, কায়িক শ্রম প্রভৃতি মূলনীতিগুলি প্রয়োগ করতে চেষ্টা করেন। তাঁর লেখার কাজ হয়ে ওঠে তাঁর জীবনসাধনার অঙ্গ। আর্টের জন্য আর্ট যারা বলে তারা অর্থকরী পণ্যের পসারী, পণ্য তাদের বিলাসী ও বিলাসিনীদের উপভোগের জন্য, এরা ধনিক শ্রেণীর লোক, এদের পঙ্কিল জীবনই তাতে প্রতিফলিত হয়, জনগণের আর্ট অন্য জিনিস। সেই জন্য জিনিসের চর্চা করতে করতে টলষ্টয় তাঁর ছোটগল্পগুলিকে যীশুরু উপদেশাত্মক উপকথার মতো সরল, সহজ, সর্বপ্রকার বাহুল্য ও কৌশল মুক্ত করেন। উপন্যাস নামক প্রকরণটার উপরেই তাঁল অনীহা জন্মায়। দুটি একটি উপন্যাসিকা লিখেই তিনি পাঠকদের দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে চান। কিন্তু ঠিকরা তাতে তৃপ্ত হবে কেন? কী একটা কারণে টলষ্টয়পত্নী একবার সম্রাটের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে সম্রাট স্বয়ং নালিশ করেন, টলষ্টয়পত্নী একবার সম্রাটের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেল সম্রাট স্বয়ং নালিশ করেন “টলষ্টয় আর উপন্যাস লেখেন না কেন? কাউন্টেস এর কী কৈফিয়ৎ দেবেন? অসাধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন ঔপন্যাসিক স্বেচ্ছায় সে পথ থেকে সরে গিয়ে চাষী মজুরের জন্যে ধর্মীয় উপকথা লিখছেন। সেসব উপকথা চিরন্তনহতে পারে, কিন্তু সমসাময়িক সমস্যার প্রতিফলন কোথায়? আধুনিক জীবনটাই যদি জটিল হয়ে থাকেতবে সেই জটিলতাও কি আর্টের বিষয় নয়? বিষয় যদি দাবি করে উপন্যাসের আকার ও আধার তা হলে উপন্যাসই লিখতে পারে। তা বলে কি সেটা অর্থকরী পণ্য! কেবল পড়লোকেরাই কিনবে! লিখবে যারা তারা সকলেই বড়লোক হবে?

এসব প্রশ্ন এড়ানোর জন্য টলষ্টয় সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে তাঁর গ্রন্থের উপর কপিরাইট থাকবে না। যার ইচ্ছা সে বিনা অনুমতিতে প্রকাশ করতে পারে। পাঠকদের ঘরে ঘরে পৌঁছায় এটাই তার কাম্য, অর্থ তিনি চান না। কিন্তু সংসার চলবে কী করে, যদি বই থেকে টাকা না আসে? যদি জমিদারিও চাষীদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া হয়? যদি অন্য কোনো আয়ের পন্থা না থাকে? পরিবারটিও তো ক্ষুদ্র নয়। টলষ্টয় পরিবার পরিকল্পনা বিশ্বাস করতেন না। মিষ্টিকের প্রয়াস ব্যর্থ হয়। কপিরাইট না থাকলে প্রকাশকরাই লাভের সমস্তটা পান স্ত্রীপুত্রকন্যা ভেসে যায়। শেষে একটা রফা হয় স্ত্রীর সঙ্গে। জীবনের মোড় পরিবর্তনের আগেকার লেখার উপর কপিরাইট থাকবে টলষ্টয় পরিবারের। পরবর্তী রচনার কপিরাইট কারোর নয়। সেগুলি সৃজনধর্মী নয়, প্রচারধর্মী। বিশ্বময় ছড়িয়ে পড় ক এই হলো লেখার উদ্দেশ্য!

আনা কারেনিান লিক টলষ্টয় মনে করেছিলেন আর উপন্যাস লিখতে হবে না। কিন্তু অমন একজন জাতশিল্পী কি তাঁল প্রতিভাকে বন্ধ্যা রাখতে পারেন? বিশ বছর বাদে উপন্যাসের জগতে ফিরে যেতেই হলো। উদ্দেশ্যটা বিশুদ্ধ আর্ট সৃষ্টি নয়। তার আবরণে নীতিনির্দেশ। রেজারেকশনের টলষ্টয় স্বদেশের ও সব দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নন, অন্যতম শ্রেষ্ঠ নীতিনির্দেশক। তাঁর এই উপন্যাসের নায়িকা সম্ভ্রান্ত বংশের কুলবধূ নয়, চোটবেলাকের ঘরের পিতৃপরিচয়হীন বারবধূ। যীশুখ্রীষ্টের শিষ্যা মেরী ম্যাগডালেনের মতো আর কোনো গণিকার পতনের পর পুনরুত্থান আমার জানা নেই। টলষ্টয়ের সৃষ্ট কাতুশা মাসলোভার পতনের পর পুনরুত্থান আমার মনে হয় মেরী ম্যাগডালেনের পদাঙ্ক অনুসরণ। তার পতনের মূলে ছিন্ন তার দোষ নয়, আরেকজনের। সে এই উপন্যাসের নায়ক নেখসুলভ। নায়িকাকে কলঙ্কিত অবস্থায় পদত্যাগ করে সে তার কথা সম্পূর্ণ বিস্মৃতি হয়। দশ বছর বাদে যখন তাকে পুনরাবিস্কার করে তখন সে বাধ্য হয়ে বেশ্যা। শুধু তাই নয়, তার বিরুদ্ধে দুদ্যুতা ও মানুষ হত্যার অভিযোগ। আদালতে জুরির বিচার চলছিল। নেখলুডভের ডাক পড়েছিল একজন জুরর হিসাব। এ যেন রবীন্দ্রনাথের সেই বিচারক।

কাতুরাশ এই দুর্গতির জন্য দায়ী কে? নেখলুডভের বিবেক জাগ্রত হয়। সে দায়ী করে নিজেকেই। মামলার বিবরণ শুনে তার বিশ্বাস হয় না যে কাতুশা টাকার জন্য মানুষ খুন করেছে। কিন্তু জুরির বিচার তো। জুরির রায়, সে দুস্যতার অপরাধে অপরাধী নয়, কিন্তু খুনের অপরাধে অপরাধী। এতে নেখলুডভের অমত ছিল। কিন্তু অন্যমনস্কভাবে সে সকলের সঙ্গে একমত হয় ও পরে সচেতন হয়ে শিউরে ওঠে যে কাতুশা বিনা অপরাধেই চার বছর সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত ও সাইবেরিয়ায় নির্বাসিত। এই ঘোর অবিচারের বিরুদ্ধে সে কাতুশার হয়ে আপীল করে। আপীল নিষ্ফল হয়। তখন মহামান্য সম্রাটের কাছে আবেদন করে। শেসে কারাদন্ড মওকুব হয়, কিন্তু নির্বাসন বহাল থাকে।

নেখসুলভ পন করেছিল সে কাতুশাকে রাজদ্বার থেকে উদ্ধার করবেই, কিন্তু তাই যথেষ্ট নয়। মেয়েটি যাতে আবার বেশ্যাবৃত্তি অবলম্বন না করে, যাতে সমাজের সম্মানের স্থান পায় সেজন্য তাকে বিবাহ করবে। এটা তার নিজের প্রায়শ্চিত্ত। কাতুশাকে পাকে নামিয়েছে যে, সে-ই তাকে পাঁক থেকে টেনে নির্মল করবে। তা হলে তো তাকেই নির্মল হতে হয় তার আগে! তার নিজের জীবনকেও উন্নত করতে হয়। সে কি আর পাঁচজন জমিদারের মতো কৃষকের রক্ত শোষণ করে না? সে কি তাদেরই মতো বিলাসব্যাসনে নিমগ্ন নয়? সে কি তাদেরই মতো একজন পরকীয়ার সঙ্গে প্রেম করে না? একই কালে একটি কুমারীকে বিয়ে করে স্বকীয়া রূপে পেতে চায় না? লেখসুডভ হাত ধূয়ে নিজেকে সাফ করে। প্রেম করা ছেড়ে দেয়। বিয়ের সম্বন্ধ ভেঙে দেয়। জমিদারি চাষীদের মধ্যে বিলিয়ে না দিলেও খুব কম খাজনায় বিলি করে। ঘরবাড়ি ছেড়ে সাইবেরিয়ায় গিয়ে কাতুশার সহচর হবার জন্যে প্রস্তুত হয়। কাতুশা যতদিন চাইবে ততদিন সে নিজের সুখস্বাচ্ছন্দ্য ত্যাগ করবে। কায়িক সম্ভোগ বর্জন করবে।

কিন্তু একরাতে উচ্ছৃঙ্খলতায় একটি নিরীত নিষ্পাপ মেয়েকে পাপের পথে ঠেলে দেওয়া যেমন সহজ তাকে সেই পথের মাঝখান থেকে ফিরিয়ে আনা তেমন সহজ নয়। বেশ্যালয়ে শত শত-শত শত কেন, সহস্রাধিক-পুরুষ তাকে পাপের সাথী করেছে, তার শরীর নিয়ে কেনাবেচা করেছে। সে কি আর মানুষ! সে কি আর নারী! সে এখন নারকী। নেখলুডভ যদি কামের প্রস্তাব করত তা হলে সে অনায়াসে বুঝত। তা তো নয়, এ প্রস্তাব প্রেমের প্রস্তাব, বিবাহের প্রস্তাব। এ প্রেম স্বর্গীয়, এ বিবাহ সামাজিক। এর মধ্যে কামগন্ধ নেই। নেখলুডভ এখন অন্য মানুষ। মানুষ হয়ে সে মানুষকে শোষণ করে না, শাস্তি দেয় না, যুদ্ধবিগ্রহ ও দন্ডদান থেকে তার বিশ্বাস উঠে গেছে। সে সকলের মঙ্গল করতে চায়। নিজে ভালো হবে, পরের ভালো করবে। কাতুশা যদি তাকে প্রত্যাখ্যান করে তা হলেও সে ওকে পরিত্যাগ করবে না। ওর সঙ্গে সাইবেরিয়া যাবে ও সেখানে চার বছর থেকে ওর সেবা করবে। সেইভাবে প্রায়শ্চিত্ত তাকে করতে হবেই। সে একদম নাছোড়বান্দা। এটা তার নিজের বিবেকের তাড়বনা থেকে উদ্‌গত কর্তব্য।

কাতুশা তাকে ভুল বোঝে। এসব কথা মনে থাকা উচিত ছিল দশ বছর আগে। তা হলে তো জীবন অন্যরম হতো দু’জনের। সে যা বলে তার মর্ম, সেদিন যাকে তুমি কায়িক সুখের জন্যে ব্যবহার করেছিলে আজ তাকে ব্যবহার করতে চাও আত্মার কল্যাণের জন্যে। ঈশ্বরের রোষ থেকে রক্ষা পেতে। তোমাকে বিয়ে করার আগে আমি আত্মহত্যা করব। আমার জীবনটাকেই নষ্ট করে দিলে তুমি। তোমার জন্যে আমার গর্ভে সন্তান এল। সেও মারা গেল। আবার তুমি এসেছ কী করতে? আমাকে কারামুক্ত করতে? উত্তম। পারো তো আমার? বিবাহ? তা কি কখনো হয়? তুমি কত বড়ো আর আমি কত ছোট! তুমি একজন প্রিন্স। তুমি বিয়ে করবে একজন প্রিন্সেসকে। আমাকে বিয়ে করে তুমি কোনোদিন সুখী হবে না। একটানা ত্যাগস্বীকার করে তুমি অসুখী হবে। আমি তোমার অমন আত্মত্যাগ গ্রহণ করতে নারাজ।

আসলে নেখলুডভের অন্তরে যে প্রেম ছিল সে প্রেম করুণাঘন খ্রীষ্টিয় প্রেম। তাকে প্লেটোনিক প্রেম বলা চলে না। রোমান্টিক প্রেম তো নয়ই কাতুশা কামগন্ধ আর চায় না, চায় সেই ভালোবাসা যা কাতুশাকে কাতুশা বলে ভালোবাসা। দুঃখিনী বলে দয়া করা নয়, পতিত বলে উদ্ধার করা নয়, ছোটলোক বলে অনুগ্রহ করা নয়। কারাগারে ও সাইবেরিয়া পথে কাতুশার সঙ্গে নেখলুডভের অনেকবার দেখা সাক্ষাৎ ও কথাবার্তা হয়। এক পক্ষের ক্ষমাহীন মনোভাব অপরপক্ষের একনিষ্ঠতার ফলে একটু একটু করে বদলায়। অভিজাত শ্রেণীর লোক হওয়ার মস্ত মড়ো সুবিধা এই যে তার সামনে সব দরজা খুলে যায়। যেটা খোলে না সেটা টাকার ফুস মন্তরে খোলে। চারদিকে ঘুষের রাজত্ব। বিশেষ করে সাইবেরিয়ায়। এক দিন কাতুশা কারাগার থেকে মুক্তি পায়, কিন্তু নির্বাসন থেকে নয়। তাকে সাইবেরিয়াতেই চার বছর কাটাতে হবে। তখন তারই উপর স্থির করার ভার ছেড়ে দেয় নেখলুডভ, সে কাকে বিয়ে করতে চায়, কার সঙ্গে বা কার কাছে থাকতে চায়। স্বতঃস্ফুতবাবে কাতুশা স্থির করে, সে চায় একজন বিপ্লবী বন্দীর সাথী হতে। তার নাম সাইমনসন। সে সত্যবাদী, অহিংসক, জিতেন্দ্রিয়। তার সঙ্গে সম্পর্কটা কামগন্ধহীন। সেও বিবাহের প্রস্তাব করেছে। বিপ্লববাদিনী মারিয়া পাভলোভনা কিন্তু কটাক্ষ করে যে বিবাহটা কামগন্ধহীন থাকবে না। যা হয়ে থাকে তাই হবে।

কাতুশা যখন সাইমনসনকে বরণ করেছে তখন নেখলুডভের আর করণীয় কী আছে? সে মুক্তি পায়। ততদিনে সেও হৃদয়ঙ্গম করেছে যে তারও ঘর চাই, ঘরণী চাই, সন্তান চাই নরনারীর স্বাভাবিক সম্পর্ক চাই। সমাজ শ্রেণীশূণ্য হোক আর নাই হোক, পুরুষ নারীশূন্য হতে পারে না, পরিবার সন্তানশূন্য হতে পারে না। কাতুশা তাকে স্বাধীনতা দিয়েছে, সে স্বাধীনভাবে মনোনয়ন করবে। কাকে, কবে, এসব কথা পরে। পাতত সে কাতুশার প্রতি কর্তব্যের দায় থেকে মুক্ত। তার অতীতের প্রায়শ্চিত্ত সমাপ্ত। সে এখন নতুন মানুষ। এখন থেকে তার নতুন কর্তব্য যীশু যাকে বিধিতার রাজ্য বিধিতার ন্যায়ধর্ম বলেছেন তারই অন্বেষণ। সর্বপ্রকার অন্যায়ের প্রতিকার। খ্রীষ্টিয় চার্চকে উপেক্ষা করে সে সরাসরি খ্রীষ্টের কাছে যায়। তাঁর বাণী মান্য করে।

শ্রণীচ্যুত হওয়াও তার লক্ষ্য। তবে হিংসার ভিতর দিয়ে বৈপ্লবিক পরিবর্তন কাম্য নয়। তা বলে হিংসাচালিত বিপ্লবীদের সবাইকে সে মন্দ মনে করে না। ভালো, মন্দ, মাঝারি তাদের মধ্যে আছে। যারা একটি সামান্য প্রাণীকেও আঘাত করতে চায় না তারাও তাদের বৈপ্লবিক উদ্দেশ্যসিদ্ধর জন্যে অকাতরে মানুষহত্যা করতে পিছপাও নয়। মরিয়া পাভলোভনা তো অভিজাতকন্যা। সে থাকে গরিবদের সঙ্গে গরিবদের মতো, তাদেরই মতো খেটে খায়। পুলিশ হানা দিলে পুলিশকে গুলি করে একজন কমরেড। মারিয়া তার খুনের দায়ে নিজের ঘাড়ে টেনে নেয়। বলে, আমিই গুলি করেছি। যদিও সে রিভলবার ধরতে জানে না। সাইবেরিয়াযাত্রী বিপ্লবীদের সান্নিধ্যে এসে কাতুশার নৈতিক পরিবর্তন লক্ষণীয়। কিছুটা হলেও এতটা নেখলুডভের সাহচর্যে হতো না। চরিত্রের দিক থেকে বিপ্লবীরা অনেক উন্নত। ওদের সঙ্গে মিশে নেখলুডবের দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন ঘটে। সেটা ভালোর দিকে। কিসের জন্য এরা সর্বস্ব ত্যাগ করেছে, দুঃখ বরণ করেছে, বিপদের মুখে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, প্রাণ বিসর্জন দিতেও প্রস্তুত? আত্ম সুখের জন্য? ব্যক্তিস্বার্থের জন্যে? না। তাদের সামনে এক মহান লক্ষ্য।

‘রেজাকশন’ ছিল যীশু খ্রীস্টের কবর থেকে পুনরুত্থান। খ্রীষ্টধর্মের এটি একটি মূলতত্ত্ব। টলষ্টয় এটিকে অন্য অর্থে ব্যবহার করেছেন। প্রথমত, এটি একটি বেশ্যালয়ে কবরস্থ নারীর পুনরস্থান। সাইবেরিয়ায় তার সাজা হয়নি, হয়েছে শাপে বর। কমরেডকে বিয়ে করে সেও কমরেড হবে। বিপ্লবের দিনে তাকে দেখা যাবে বারাঙ্গনা বেশে নয়, বীরাঙ্গনা বেশে। প্রিন্সকে বিয়ে করে তার এমন কী সৌভাগ্য হতো! অভিজাত সমাজ কি তাকে পূর্ণ মর্যাদা দিত? ঘৃণা করত না? রাশিয়ার উচ্চতর শ্রেণীর যে চিত্র একেছেন টলষ্টয় তা যেন বিসুবিয়াস আগ্নেগিরির উপরে অবস্থিত দুর্নীতর্জর্জরিত পাম্পিয়াই নগরী। বিপ্লব যে কত সন্নিকট তা কি টলষ্টয় স্বয়ং জানতেন? এ বই সমাপ্ত হয় ১৮৯৯ সালে। সম্রাটের পতন হয় ১৯১৭ সালে। বিপ্লবীরা বেশ্যাবৃত্তি উচ্ছেদ করে। সেটা কি ‘রেজারেকশনে’র প্রভাবে? তাই যদি হয়ে থাকে তবে টলষ্টয়ের নৈতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়েছে বলতে হবে। তিনি তো আর্টের জন্যে আর্ট সৃষ্টি করেননি। তাঁর ছিল সমাজ কল্যাণের লক্ষ্য। বেশ্যাবৃত্তির মতো হাজার হাজার বছরের ইভিল কি আর কোনো উপায়ের দূর হতে পারত? বিপ্লব ভিন্ন? ‘রেজারেকশন’ এই অর্থে মেরী ম্যাগডালেনেরও পুনরুত্থান। কাতুশা মাসলোভা তারই প্রতিরূপ। মেয়েটির সর্বনাশ হয়েছিল ঠিকই, তবু তার মধ্যে কয়েকটি সদ্গুণ ছিল। সে কিছুতেই মিথ্যা কথা বলবে না। আত্মরক্ষার জন্যেও না। যে সত্যে স্থির সেও তো সতী। কায়িক অর্থে নয়, আত্মিক অর্থে। সে পরদুঃখকাতর। পরের জন্যে সাহায্য চায়, নিজের জন্যে নয়। সাজা পেলেও সে বিচলিত নয়। সাজাও একদিক থেকে ভালো। সাজা না পেত? বেশ্যালয়ে পচে মরত না। সাইবেরিয়াও তাকে মুক্তির স্বাদ দেয়। আর যাই হোক সে নরক নয়। দূর থেকে ভয়ঙ্কর দেখায়। কাছে গেলে ভয় ভেঙে যায়।

দ্বিতীয়ত, ‘রেজারেকশন’ হচ্ছে নেখলুডভেরও পুনরুত্থান। নীতিহীন জীবনে সে সুখের অন্বেষণ করছিল। তার মতো আরো অনেকে। তারা তারই মতো সুবিধাভোগী শ্রেণীর লোক। তাদের কেউ বা জমিদার, কেউ বা বণিক, কেউ বা সামরিক কর্মচারী, কেউ বা অসামরিক কর্মচারী। আবার কেউ বা চাচূের ধর্মাধিকার এদের ব্যয়বহুল জীবনযাত্রার বোঝা জগদ্দল পাথরের মতো চেপেছিল যাদে পিঠে তারা দেশের পরিশ্রমী জনগণ। নেখলুডভ মর্মে মর্মে অনুভব করে যে তার ও তার শ্রেণীর জীবন যাপনের ধারা ঠিক নয়। যা ঠিক নয় তাকে শোধরাতে হবে। তা যদি সময়ে শোধরানো না হয় তবে মহতী বিনষ্টি। সে নিজের জীবন যাপনের ধারা শোধরানোর সংকল্প নেয়। ফলে তার যে পরিবর্তন হয় সেটাও টলষ্টয়ের মতো একপ্রকার কনভারসন। ভিতরে ভিতরে সে মরে যাচ্চিল, মরণ থেকে তার পুনরুত্থান হলো। তারই মতো যদি তার শ্রেণীর সকলের হতো তা হলে রুশদেশেরও বিনা দ্বন্দ্বে পুনরুত্থান হতো। কার্যত তা হলো না, হবার নয়, সুবিধাভোগী শ্রেণী কখনো বিনা দ্বন্দ্বে আত্নসমর্পণ করে না। এই বই বেরোনোর বিশ বছরের মধ্যে ওইসব প্রিন্স, কাউন্ট, জেনারেলের দল হওয়ার সঙ্গে হাওয়া হয়ে গেল! তাদের কেল্লার মতো ভেঙে পড়ল পুরাতন শৃঙ্খলা। সবচেয়ে ক্ষতি হলো চার্চের। বিপ্লবীরা নিরীশ্বরবাদী। যারা বিধাতাই মানে না তারা খ্রীস্টকে মানবে কেন? গির্জার সম্পত্তিকে রেহাই দেবে কেন? রাষ্ট্র নতুন কর্তাদের হস্তগত হয়ে রক্ষা পেল। কিন্তু চার্চ গেল সুবিধাভোগী শ্রেণীর সঙ্গে সহমরণে বা সহপলায়নে। চার্চ গেল বলে কি খ্রীষ্টধর্ম গেল? রাশিয়ার জনগণ মনে প্রাণে খ্রীষ্টান। তাদের কাছ থেকেই টলষ্টয় খ্রীস্টধর্মের কর্মগত প্রেরণা পেয়েছিলেন। বাইবেলে থেকে যা পেয়েছিলেন তা পুঁথিগত শিক্ষা বেঁচে থাকলে তিনি দেখে মর্মাহত হতেন যে বাথরুমের ময়লা পানির সঙ্গে সঙ্গে শিশুটিকেও ফেলে দেওয়া হয়েছে। সেদিক থেকে তঁর রেজারেকশন লেকা ব্যর্থ। তাঁর নিজের পরিবারের লোকই পলাতক। কপিরাইট লুপ্ত। সপ্তত্তি রাষ্ট্রায়ত্ত্ব। আয়ের পন্থা কোথায় যে মানসম্ভ্রম নিয়ে ওঁরা বাঁচবেন! সত্যি সত্যি কায়িক পরিশ্রম দিয়ে পরিবার পোষণ করত। ততদূর পরিবর্তন টলষ্টয় তাঁর চরিত্রে দেখাননি। দেখিয়েছিলেন কাতুশার চরিত্রে। সে কায়িক শ্রমে কাতর তো নয়ই বরং উৎসাহী। সে জনগণের কন্যা। কায়িক শ্রমের থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল বেশ্যালয়ে। তাতেই তার চরিত্রহীন ঘটেছিল। চরিত্র ফিরে পায় কঠোর কায়িক শ্রমে। অনুতপ্ত বিবেকী জমিদার নয়, গুণমুগ্ধ তেজস্বী বিপ্লবীই তার মনের মতো পুরুষ।

নেখলুডভও উচ্চমনা পুরুষ। কিন্তু সে বরাবর একটা ভুল ধারণা নিয়ে কাজ করেছে। তার ধারণা-যে-সর্বনাশটা সে করেছে তার প্রকৃষ্ট প্রতিকার হচ্ছে বিবাহ। কিন্তু বিবাহও কুলটাকে কুল দিতে পারে না, গণিকাকে গৃহলক্ষ্ণীর মর্যাদা দিতে পারে না। যদি না বিশ্বময় একটা ভাববিপ্লব ঘটে যায়। বেশ্যাবৃত্তি রহিত করা সেদিকে একটা প্রাথমিক পদক্ষেপ। কিন্তু সেই যথেষ্ট নয়। বেশ্যাকে বিয়ে করতে আদর্শবাদী পুরুষ এগিয়ে আসবে না। পাড়াপড়শিরা এলাকায় টিকতে দেবে না। কিংবা পাড়ার বখাটে ছেলেরা এসে উত্তক্ত করবে। যে অগ্নিপরীক্ষার ভিতর দিয়ে সীতাকে যেতে হয়েছিল তার চেয়েও অসহনীয় অগ্নিপরীক্ষা একজন আনা বা কাতুশার সম্মুখে। তেমন এক অগ্নিপরীক্ষার দিন সে কি ভ্রনস্কির ওপর বা নেখলুডভের ওপর নির্ভর করতে? লোকভয়, সমাজভয়, রামের মতো মহামানবকেও সীতার মতো সতীনারীর মানরক্ষা করতে পারেনি। আর এরা তো সতী নারীও নয়। হতে পারে অন্তরের দিক থেকে খাঁটি সোনা।

এ ক্ষেত্রে নেখলুডভ বা সাইমনসনের মতো পুরুষের কাছ থেকে কাতুশার মতো নারী যা প্রত্যাশা করে তার নাম বিবাহ নয়, প্রেম। সাইমনসন বিবাহের নাম উচ্চারণ করেছে। না করলেও পারত। কাতুশাকে সে ভালবাসা। ভালবাসাই কাতুশার মৃতসঞ্জবিনী। তাই দিয়েই তার পুনরুত্থান। নেখলুডভ যদি তাকে ভালোবাসাত তবে তার সেই ভালবাসার ওপর নির্ভর করেই কাতুশা তার হাত ধরত। প্রেমের জন্যে নারী সর্বস্ব হারাতে পারে। সতীত্বও তার মধ্যে পড়ে। প্রেমই সেই সোনার কাঠি যার ছোঁয়া লেগে অসতী সতী হয়। প্রথম বয়সে কাতুশা ও নেখলুডভ দুজনেই দুজনের প্রেমে পড়েছিল। সেটা কামগন্ধহীন মিষ্টি প্রেম। তিন বছর বাদে যেটা এল সেটা কাতুশাকে আচমকা নষ্ট করে গেল। নষ্টের গোড়া নেখলুডভের প্রেমহীন কাম। দশ বছর বাদে তার মধ্যে জাগ্রত হলো বিবেক। কিন্তু প্রেমের স্থান কি বিবেক নিতে পারে? প্রেমের জন্যে পিপাসিত হৃদয়কে পিপাসার পানীয় দিতে পারল না বিবেকবান প্রাক্তন প্রেমিক ও কামী। সে বিবেকের দায়ে বিবাহ করতে চায়, প্রেমের দায়ে নয়। সে প্রাণভরে ভালবাসে না। ভালবাসলে দেহকেও ভালবাসতে হয়। তার বেলা সে কুণ্ঠিত। মনে মনে যা চেয়েছিল তা প্রেম নয়, বিবাহও নয়, তা ক্ষমা, তা মুক্তি। কাতুশা তাকে তাই দেয়।

নেখলুডভের বিশ্বাস কাতুশা তাকে ভালবাসে বলেই বিবাহের দায় থেকে অব্যাহতি দিল। সে যাতে সমান ঘরে বিয়ে করে সুখী হতে পারে! আত্মত্যাগে নায়ক নায়িকাকে নয়, নায়িকাই নায়ককে ছাড়িয়ে গেল। মিলনান্ত না হলেও এ কাহিনী ট্র্যাজিক নয়। না কাতুশার পক্ষে না নেখলুডভের পক্ষে। বিপ্লবী সাইমনসনকে দেবতার মতো আকাশ থেকে নামিয়ে এনে টলষ্টয় শেষরক্ষা করেছেন। সেটা একটা মামুলি কৌশল। সেই কারণে এ কাহিনী দুর্বলও হয়েছে। সাইমনসন আবির্ভূত হয়ে কাতুশার ভার না নিলে নেখলুডভকে চারটি বছর সাইবেরিয়োয় একঘরে হয়ে কাটাতে হতো। ও যে শ্রমিক বা কৃষাণের জীবনের শরিক হতো তা তো মনে হয় না। জমিদারি থেকেই মাসোহারা পাঠানো হতো। কাতুশা ওকে বিয়ে করতে রাজি হলেও সমাজে মেলামেশা সুগম হতো না। দুর্জয় প্রাণের আনন্দও ভঙ্গ হতো। এটা টলষ্টয়েরও ব্যক্তিগত সমস্যা! সবার জমিদারঘটিত ব্যাপারটা স্ত্রীর নামে লিখে দিলেও উপস্বত্ব তিনি নিজেও ভোগ করতেন। জীবনযাত্রার ষ্টাইলের বিশেষ হেরফের হয়নি। এর জন্য তাঁর মনে অস্বস্তি ছিল। অপরাধবোধ ছিল। নেখলুডভ এদিক থেকে আর একটি লেভিন। অর্থাৎ টলষ্টয়। তা ছাড়া আমার মনে হয় যে-কাঁটা টলষ্টয়ের নিজের বিবেকেও। সেটা সম্পত্তিঘটিত নয়। কুমারীর কৌশার্যগটিত। ক্ষমা! ক্ষমার জন্য তাঁর আন্তরাত্মা আকুল। এ বই লিখে তিনি শাপমুক্ত হলেন। তার মানে এ নয় যে কাহিনীর সমস্তটা সত্য। গোড়ার দিকটা সত্য হওয়াই সম্ভবপর। ঋষি বাল্মীকিও তো যৌবনে দস্যু রত্মাকার ছিলেন।

আর্ট সম্বন্ধে টলষ্টয় যেসব নতুন সূত্র নির্দেশ করেছিলেন সেসব তিনি ছোটগল্পের বেলাতে পালন করেছিলেন। বড়গল্পের বেলায়ও বহু পরিমাণে। কিন্তু রেজারকেশন লিখতে গিয়ে তিনি নিজেই নিজে নির্দেশ থেকে সরে যান। ফিরে যান সাবেক সূত্রে। যুদ্ধ ও শান্তি আর আনা কারেনিনার সঙ্গে রেজারেকশন কলাবিধি সংক্রান্ত তেমন কোনো পার্থক্য নেই। থাকলেও প্রকন্ঠ নয়। তৎকালীন সমাজব্যবস্থায় অপরাধের বিচার কী ভাবে হতো, শাস্তি কী প্রকার হতো, কারাবাস ও নির্বাসন কেমনতর হতো, এসব যদি বিশদ করতে হয় তবে উপন্যাস বৃহদায়তন হবেই। আর উপন্যাস যদি বিশ্বকোষ হয় আর্টের সূত্র পুরোপুরি মেনে চলা সম্ভব নয়। কী নতুন কী পুরানো। শওকত ওসমান একবার আমাকে বলেছিলেন যে প্রত্যেকটি বাক্য ঠিক লিখতে গেলে উপন্যাস লেখা চলে না।

আনা কারেনিনা প্রেমের উপন্যাস। যদিও সে প্রেম নিষ্কাম নয়! প্যাশনপূৰ্ণ। রেজারেকশন প্রেমের উপন্যাস নয়। এর সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে অবলার উপর প্রবলের কাম থেকে, সমাধান হয়েছে প্রবলের প্রায়শ্চিত্তে ও অবলার পূর্ণ মর্যাদালাভে। অবলাই নৈতিক বলে বলীয়ান হয়ে অন্যায়কারীকে ক্ষমা করে। টলষ্টয় সকলের উপরে স্থান দিয়েছেন ক্ষমা ক্ষমাগুণকে। বলবানই ক্ষমা করতে পারে। দুর্বল পারে না। কাতুশা অবশেষে আশ্বাস দেয় যে সব শোধবোধ হয়ে গেছে। তখন নেখলুডভ তার বন্দনা করে। কী যে ভালো মেয়ে তুমি! বিবেকের তাড়নায় বিবাহ কি কাতুশাকে কৃতার্থ করত! না। সেভাবে একটা ঘোর অন্যায়ের প্রতিকার হতো, কিন্তু অন্যায় আর প্রতিকার নিয়েই কি নরনারীর আনন্দ? অমন এক নিরানন্দ ঘরসংসার নিয়ে কাতুশাই বা কী করত আর নেখলুডভই বা কী করত!

টলষ্টয়ের রেজারেকশন হচ্ছে অর্ধ-খ্রীস্টীয় আর অর্ধ-বৈপ্লবিক। তার এক জায়গায় কার্লমার্কস লিখিত সুসমাচারেও উল্লেখ আছে। তবে বিপ্লবীদের বেশির ভাগই মার্কসবাদী নয়, নারদনিক বা পপুলিষ্ট। তাদের অন্বিষ্ট প্রোলিতারিয়ান ডিকটেটরশিপ নয়, পিপলস ডেমোক্রাসি। কাতুশাকে উন্নত করতে নেখলডভ একক তপস্যায় অক্ষম হতো। তার সমস্যার সমাধান খ্রীষ্টেরও অসাধ্য হতো, যদি না মারিয়া পাভলোভনা, সাইমনসন প্রমুখ বিপ্লবীরা এসে অসাধ্যসাধন করত। তাদের যে নীতি তাতে কাতুশা পতিতা নয়, পাপীয়সী নয়, শোষিতা। সাইমনসন তাকে সাদরে গ্রহণ করে। নেখলুডভরা নয়, সাইমুনসনরাই নারী ও শূদ্রের ভরসা। তা হলেও টলষ্টয়ের এই টেষ্টামেন্ট মথি-লিখিত সুসমাচাইে শেষ।

ইচ্ছা করলে ও চেষ্টা করলে বেশ্যাও গুচি হতে পারে, সাধ্বী হতে পারে, পাপের পথ ছেড়ে পূণ্যের পথ নিতে পারে, পরকালে স্বর্গে যেতে পারে, কিন্তু ইহকালে কোনো মহাপুরুষ তাকেসমাজে ফিরিয়ে আনতে পারবেন না। খ্রীষ্টও যে পেরেছিলেন তারও কোনো নজীর নেই। মেরী ম্যাগডালেও সমাজে স্থান ফিরে পাননি। সব দেশেই সব যুগেই বেশ্যারা সমাজের বাইরে। পুরুষ বাইরে গেলে ভিতরে ফিরে আসে, কিন্তু নারী যদি একবার বাইরে গেল তা বাইরেই থেকে গেল। রেজারেকশনর সমস্যাটা তো হল এইখানে। বিশ্বের প্রাচীনতম সমস্যা এই প্রাচীনতম পেশাকে ঘিরে। টলষ্টয় কি এর মুখোমুখি হলেন? না পাশ কাটিয়ে গেলেন? আনাকে নিয়ে যে সমস্যা হয়েছিল সে সমস্যা মেটেনি, আনা সমাজ ফিরে পায়নি! কাতুশকে নিয়ে যে সমস্যা সেটাও কি মিটল? সেও কি সমাজ ফিরে পেল?

টলষ্টয় ঠিক করেন নতুন উপন্যাস লিখে তাঁর হাতে দিতে। উপন্যাস প্রকাশ করলে তার থেকে লাভ হবে তা দিয়ে প্রবন্ধের লোকসান পুষিয়ে যাবে। গৃহিণীর তাতে আপত্তি ছিল। যদিও ১৮৮১ সালের পর লেখা তবু উপন্যাস তো। উপন্যাস লিখলে তাঁকেই দিতে হবে, দিলে সেটা টলষ্টয় রচনাবলির সামিল হবে। রচনাবলির প্রকাশক স্বয়ং টলষ্টয়গৃহিণী। এ নিয়ে মতান্তর ও মনান্তর গৃহিণীর সঙ্গে প্রধান শিষ্যকে ছাড়েন না। শিষ্যই তাঁর মতবাদ প্রচারের অগ্রণী। যাই হোক, রেজারেকশন টলষ্টয় চড়া দামে বিক্রি করেন। তখন কপিরাইট যে তাঁর নিজের এটা প্রমাণিত হয়। কিন্তু আয় যা হয় তা পরার্থে ব্যয় হয়। দুখোবরদের অপরাধ ওরা সৈন্যদলে যোগ দেয় না। ওদের ধর্মমত আদি খ্রীষ্টনদের অনুরূপ। যুদ্ধে মানুষ মারতে হয়। সেটা ওদের মতে খ্রীষ্টিয় শিক্ষাবিরুদ্ধ। তাদের নির্বাসিত করা হয় না। কিন্তু তাদের ওপর জোর জুলুম করা হয়।

তারা সহ্য করতে না পেরে দেশত্যাগের সংকল্প নেয়। টলষ্টয় সহায় হন। রেজারেকশন লিখে অর্থসাহায্য করেন। ওরা দেশত্যাগ করে।

স্ত্রীর সঙ্গে মতভেদ কেবল গ্রন্থস্বত্ব নিয়ে নয়। গৃহিণী নিজেই ১৮৮১ সাল পর্যন্ত গ্রন্থের প্রকাশিকা হয়েছিলেন। তাতে লাভ হতো বেশি। টলষ্টয়ের পুত্রকন্যা ছাড়াও বিস্তর আশ্রিত আশ্রিতা ছিল। এত বড়ো সংসার ঘাড়ে নিয়ে সোনিয়া দেখেন প্রকাশকরা যা দেন তা যথেষ্ট নয়। নিজে প্রকাশ করবে আয় হয় বেশি। দষ্টয়ভস্কি-পত্নীও স্বামীর গ্রন্থ স্বয়ং প্রকাশ করে আয় বৃদ্ধি করেছিলেন। টলষ্টয়-পত্নী তাঁরই পদাঙ্ক অনুসরণ করেন। কিন্তুটলষ্টয় প্রণীত গ্রন্থ থেকে সংসারের যে আয় তা তো ১৮৮১ সালের পর রচিত গ্রন্থ থেকে হয় না। কেমন করে তা হলে সংসারের ব্যয় নির্বাহ করবেন? সোনিয়া তাই জমিদারির ভারও গ্রহণ করেন। টলষ্টয় জমিদারি প্রথামর উপর বিরূপ হয়েছিলেন। শাসন ও শোষণ না করে জমিদারি চালানো যায় না। দুটোই তার কাছে অন্যায়। তাঁর মতে সব জমি চাষীদের দেয়া উচিত। কিন্তু এত বড়ো ত্যাগের জন্য পরিবার প্রস্তুত ছিল না। ওরা খরচ চালাবে কী করে? ছেলেমেয়েদের সংখ্যাও বেড়েছে, বয়সও বেড়েছে। রোজগারে মন নেই। বাপকেই উপার্জন করতে হয়। শুধুমাত্র বইপত্রের আয়ে কুলায় না। শুধুমাত্র জমিদারির আয়েও কুলায় না। গৃহিণী শক্ত হাতে হাল ধরেন। কিন্তু তাঁর কড়াকড়ির জন্যে চাষীদের কাছে টলষ্টয়ের জনপ্রিয়তা হ্রাস পায়। গাছকাটার জন্যে জমিদারপত্নী কয়েক জনের বিরুদ্ধে নালিশ করেন। ওদের সাজা হয়! টলষ্টয়ের মতে সেটা অধর্ম। স্ত্রীর মতে আইনসঙ্গত।

এ সমস্ত সহ্য হতো। কিন্তু স্বামী চান দরিদ্রের সঙ্গে দরিদ্রজনের মতো থাকতে। ধনীদের সঙ্গে ধনীদের মতো নয়। গান্ধী ও কস্তুরবার বেলা যেটা সম্ভব হয় না। টলষ্টয় চান শ্রেণীচ্যুত হতে। সোনিয়া তাঁর সন্তানদের শ্রেণীচ্যুত হতে দেবেন না। জন্মসূত্রে ওরাও কাউন্ট ও কাউন্টেস। ওরা ওদের আভিজাত্য বজায় রাখবে-বাপের খরচে অবশ্য। দুনিয়ার কত লোক টলষ্টয়কে গুরু বরে মনে। কিন্তু একজন কি দু’জন বাদে তাঁর পুত্রকন্যারাই মানে না। তাঁকে পাগল বলে সার্টিফিকেট দেবার প্রসঙ্গও নাকি উঠেছিল। তার হলে আদালত থেকে একজনকে তাঁর গার্জেন নিয়োগ করা হতো। সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণ সেই গার্জেনই করতেন। কিন্তু তাঁর কলমটা কেউ কেড়ে নিতে পারত না। দুনিয়া জানত তিনি পাগল নন। যাই হোক তাঁকে পাগল বলে ঘোষণা করা হয়নি। এই রক্ষে।

ওদিকে চার্চ তো সমাজচ্যুত করেছিলই, ষ্টেটও তাঁকে তার বিপ্লবী বাবধারা প্রচার করার অপরাধে জেলে পাঠাতে পারত, যদি সংবাদপত্র বিশেষের সম্পাদকীয় প্রবন্ধের কথায় কাজ করত। তখনো ১৯০৫ সালের বিপ্লব ঘটেনি। বিপ্লবীদের প্রতি তাঁর নরম মনোভাব তার বহুবর্ষ পূর্বের। বিপ্লবের সমর্থন তিনি করতেন না। কিন্তু ১৯০৫ সালের বিপ্লবের পর যাদের ফাঁসি দেয়া হল তাদের প্রাণদন্ডের বিরুদ্ধে তিনি একটি সাংঘাতিক প্রবন্ধ লিখেছিলেন। আমি নীরব থাকতে পারিনে। ফলে সারা দুনিয়ায় সাড়া পড়ে যায়। তাতে তিনি বলেছিলেন তাঁকেও যেন ফাঁসি দেয়া হয়। তাঁ জনপ্রিয়তা ফিরে আসে। রাষ্ট্র তাঁকে ঘটায় না।

টলষ্টয়ের পূর্বসুরী পুশকিন নাকি শতাধিক নারী সম্ভোগ করেছিলেন। টলষ্টয়ের রেকর্ড লম্বা নয়। তাঁর মধ্যে এ নিয়ে বরাবরই একটা অন্তর্দ্বন্দ্ব ছিল। ঋষবংয যা চাইছে ঝঢ়রত্রঃ তাতে সায় দিচ্ছে না। বিবাহের পর স্বকীয়র সঙ্গেও একই অন্তর্দ্বন্দ্ব। ব্রহ্মচর্যের সংকল্প বার বার নিয়েছেন। বার বার ভঙ্গ করেছেন। ফলে তেরোটি পুত্রকন্যা। তাঁর স্ত্রী গোড়া থেকেই অনিচ্ছুক। তাঁকে স্বাধীনতা দিলে তিনি দুটি কি তিনটির বেশী চাইতেন না। নারীর উপর এতগুলি সন্তান চাপানো পুরুষেরই দোষ। এমনি করে পুরুষ নারীকে বন্দিনী করে রাখে। অথচ এর জন্যে তো কই টলষ্টয়কে অনুতপ্ত হতে দেখা গেল না। ক্রয়টজার সোনাটা আমি কলেজে পড়েছিরাম। ও বই আমার একেবাইে ভালো লাগেনি। ওটা এই কারণেই মূল্যবান যে টলষ্টয় নরহত্যার মতো নারী হত্যারও বিরোধী। কিন্তু ও কাহিনীর মরাল ইস্যুটা তো মার্ডার নয়, সস। যেখানে নারীকেই দোষ দেওয়া হয়েছে। যেন নারীই একমাত্র পার্টনার।

টলষ্টয়ের সেক্স সংক্রান্ত দুর্বলতার পূর্ণ সুযোগ নিয়েছিলেন তাঁর স্ত্রী। বিবাহের পর স্বামীগৃহে এসেই আবিষ্কার কনের গ্রামবাসিনী আকসিনিয়াকে। যার পুত্রের প্রকৃত পিতা নাকিট টলষ্টয়। স্বামীকে চোখে চোখে রাখা সেই যে গুরু হয় তার পর আটচল্লিশ বচর ধরে চলে। নজরবন্দি অবস্থা থেকে মুক্তি বৃদ্ধ বয়সে মিলে না। একদিন কি দু’দিন বাড়ির বাইরে কাটালেও সন্দেহ করা হতো যে উদ্দেশ্যটা নারীসঙ্গ। রেখার উপরে ও কড়া নজর। সেক্স নিয়ে কিছু লিখতে গেলেই সন্দেহ। অভিজ্ঞতার অনুপাতে সামান্যই তিনি লিখতেন। তাও রেখে ঢেকে। তবে বিবাহপূর্ব ডায়েরিতে সব কথা ছিল। তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন সে ডায়েরি যেন অবিকল ছাপা হয়। সেটা কিন্তু হয়নি। অনেক বাদসাদ দেয়া হয়েছে। পরিবারের বাইরেও তাঁর একটি পুত্র ছিল। তিনি তার নামটা পর্যন্ত ভুল করেন। তাকে স্বীকারও তিনি করেননি। তবে তাকে তাঁর বাড়িতে কোচম্যানের কাজ দেয়া হয়েছিল। টলষ্টয়ের জীবদ্দশায় ঞযব উবারষ প্রকাশিত হয়নি স্ত্রীর ভয়ে। তাতে ছিল আকসিনিয়ার সঙ্গে প্রণয়ের উত্তাপ। সে এক কৃষকবধু। সোনিয়ার ঈর্ষা বিবাহের ছেচল্লিশ বছর পরেও সমান তীব্র ছিল। স্বামীকে তিনি বিশ্বাস

করতেন না।

এই উপন্যাসের রচনাকালে ১৮৮৯ সাল। পান্ডুলিপি লুকিয়ে রাখা হয় চার্টকভের কাছে। চার্টকভও নিজের কাছে রাখতে সাহস পান না। রাখেন তাঁর মায়ের কাছে। কী মনে করে টলষ্টয় ওর একটা নকল লুকিয়ে লুকিয়ে তৈরি করিয়ে এনে তাঁর এক পুরোনো আরাম কেদারায় অয়েল ক্লথের ঢাকনার আড়ালে লুকিয়ে রাখেন। এত সতর্কতা সত্ত্বেও ওটি ধরা পড়ে যায় সোনিয়ার কাছে ১৯০৯ সালে। তার মানে টলষ্টয়ের মৃত্যুর এক বছর আগে। পুরাতন ঈর্ষার ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণ। আশির উপর বয়স। তবু নিস্তার নেই। পারকীয় চাষানীর সঙ্গে তিনি যে উল্লাস বোধ করেছিলেন তারই বর্ণনা ছিল নায়েকের বেনামীতে। বিবাহের পর নায়ক তাঁর স্বশ্রেণীর স্বকীয়ার সঙ্গে উল্লোসের পরিবর্তে যাতনা বোধ করেন। এ এক নির্মম সত্য। একে লিপিবদ্ধ না করে টলষ্টয়ের সোয়াস্তি ছিল না। অথচ তাঁর জীবদ্দশায় স্ত্রীর নজের পড়লে কী বিষম কান্ড হবে সেটাও তিনি অনুমান করেছিলেন। যা ঘটবার তা ঘটে যাবার পর দু’জনেই কান্নাকাটি করে শান্ত হন। ছাপা কিন্তু বন্ধ থাকে।

আমার তো মনে হয় টলষ্টয়ের গৃহত্যাগের অন্যতম কারণ টলষ্টয়ের সত্যকথনের সোনিয়ার নিদারুণ অসহিষ্ণতা। আকসিনিয়ার প্রতি যে প্যাশন তার মতো প্যাশন তিনি সোনিয়ার প্রতি অনুভব করেননি। কিন্তু সেটা তো চুকে বুকে গেছে কতকাল আগে। তা হলেও সে আগুন যেমন লেখকের স্মরণে জীবন্ত ছিল, উপন্যাসের পাতায়ও তেমনি জ্বলন্ত। এখানেই শিল্পীর কৃতিত্ব। কিন্তু সোনিয়ার চোখে তিনি তো শিল্পী নন, তিনি স্বামী। যে স্বামী এতকাল পরেও সেই পুরাতন প্যাশনের বর্ণনায় মুখর তিনি কি স্ত্রীকে সত্যিই ভালবেসেছেন? স্ত্রীর বেলায় এমন নিরুত্তাপ কেন? বিবাহের ৪৬ বছর বাদে এই আবিষ্কার সোনিয়াকে পাগল করে তোলে। উইল, ডায়েরি ইত্যাদির দরুন যে অশান্তি তার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়, এই আত্মজীবনীমূলক গুপ্ত পুঁথির দরুণ। টলষ্টয়ের নিজের চরিত্রেও ঈর্ষা নিহিত ছিল। সত্তর বছর বয়সের বৃদ্ধ তাঁর ৫৪ বছর বয়সের স্ত্রীর কাছে কৈফিয়ৎ তলব করেন কেন তিনি তানেয়েভ নামক সঙ্গীতকারের সঙ্গে মিলিত হবার জন্য বোনের বাড়ি যান। তিনি কি সঙ্গীতের প্রেমে অন্ধ না সঙ্গীতকারের প্রেমে? সোনিয়া তো ক্রোধে উন্মাদ। স্বামীকে শাসিয়ে বলেন, তুমি যদি তোমার রেজারেকশন প্রকাশ কর তো আমিও আমার ছোট গল্পগুলো প্রকাশ করব। শেষে সন্ধি নয়।

বিরাশি বছর বয়সেও টলষ্টয় নিয়মিত ব্যায়াম করে শুতে যেতেন। সে রাত্রে শুয়ে শুয়ে তিনি একখানি বই পড়ছিলেন। ডস্টয়েভস্কির মহান উপন্যাস কারামাজভ ভ্রাতৃগণ। এ যুগের যে ক খানি বই টলষ্টয়ের বিচারে আর্ট হিসাবে উত্তীর্ণতারই একখানি। পড়তে পড়তে কখন এক সময় ঘুমিয়ে পড়েন। হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায় রাত তিনটে নাগাদ। তাঁর স্ত্রী শুতেন অন্য ঘরে। সে ঘর থেকে স্বামীর ঘরে এসে তিনি করেছেন কী না স্বামীর কাগজপত্র খানাতল্লাসি। টলষ্টয় অন্ধকারে ঘাপটি মেরে শুয়ে থাকেন, জানতে দেন না যে তিনি জেগে আছেন। কাউন্টেস নিরাশ হয়ে চলে গেলে টলষ্টয় শয্যাত্যাগ করেন। কন্যা আলেকজান্দ্রা ছিলেন তাঁর পরম অনুগত ও একমাত্র বিশ্বাসভাজন। তাঁকে ডেকে বলেন, “আমি আজ এই রাত্রেই বেরিয়ে যাচ্ছি। কোথায় যাব স্থির নেই। কোচম্যানকে বল গাড়ি জুততে। কেউ যেন টের না পায়।”

আলেকজান্দ্রা স্তম্ভিত হন। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মনঃস্থির করেন যে তিনিও তাঁর অথর্ব পিতার পথের সাথী হবেন। ওই অসহায় মানুষটিকে একলা ছেড়ে দেবেন না। পিতা- মাতার মনোমালিন্য একদিনের নয়। প্রায় ত্রিশ বছরের। যেদিন থেকে টলষ্টয় ভোগ ছেড়ে ত্যাগ আরম্ভ করেছেন। তাঁর সেই ত্যাগের সাধনায় পরিবারের আর কারো সহানুভূতি বা সমর্থন ছিল না। ছিল শুধু টি কি তিনটি কন্যার। তাদের মধ্যে আলেকজান্দ্রা তখনো অবিবাহিত। ইতিমধ্যে টলষ্টয় তার সম্পত্তি স্ত্রী তাতে বাধা দেওয়ায় ত্রিশ বছর পূর্বের বইগুলির গ্রন্থস্বত্তার স্ত্রীর জন্যে সংরক্ষিত করে পরবর্তী বয়সের রচনা জনসাধারণের হাতে তুলে দেন। কিন্তু মুশকিল বাধে তাঁর ডায়েরি নিয়ে। শেষ ত্রিশ বছরের ডায়েরির ওপর এক্তিয়ার কার? প্রকাশের ব্যবস্থা কে করবেন? ডায়েরিতে যদি এমন কিছু থাকে যা প্রকাশ করলে পরিবারের মুখে কালি পড়বে তা হলে সেটা বর্জন করার অধিকার নিশ্চয়ই পরিবারের। বিশেষ সহধর্মিনীর। কাউন্টেসের বিশ্বাস তাঁর স্বামীর ডায়েরিতে তাঁকে সক্রেটিসপত্নী জান্তিপের মতো বদমেজাজি ও ঝগড়াটে রূপে আঁকা হয়েছে। ভাবীকাল তাঁকে নিন্দা করবে।

টলষ্টয় তাঁর ডায়েরি বিয়ের আগেই তাঁর বাগদত্তাকে দেখিয়েছিলেন। তাঁর রাহু-গ্রস্ত অতীতকে তিনি ঢাকা দিতে চাননি। সোনিয়া ইচ্ছা করলে তাঁকে প্রত্যাখ্যান করতে ও তখনো ‘যুদ্ধ ও শান্তি’ লেখেননি তবু সেই বয়সেই লব্ধপ্রতিষ্ঠা। তা বলে সোনিয়াও কম যান না। সাহিত্যচর্চা তাঁদের বংশেও ছিল। তিনিও একটুও আধটু লিখতে পারতেন। টলষ্টয়ের ডায়েরি পড়ে তিনি দারুন আঘাত পেলেন ঠিকই, কিন্তু অমন সুপাত্রকে কি হাতছাড়া করা যায়? সেই বয়সের কেই বা আপাপবিদ্ধ জিতেন্দ্রিয়? সোনিয়া ডায়েরীর উত্তরে পাঠিয়ে দেন এক উপন্যাস, রাতারাতি লেখা। তাতে টলষ্টয়কে চিত্রিত করেন এক কুৎসিত কিমাকার পৌঢ় রূপে। যার চরিত্রও রূপের মতো বিকট। টলষ্টয় তো মাথায় হাত দিয়ে বসেন। ভাবেন, আমি খারাপ বলে কি এত খারাপ! যাক, বিয়েটা ভালোয় হয়ে যায়। সুখেরও হয়। কিন্তু ডায়েরি লেখার অভ্যাস টলষ্টয়ের সারাজীবনের অভ্যাস। ডায়েরি থেকেই তাঁর গল্প উপন্যাস একে একে জন্মায়। ডায়েরি তিনি দেখতেও দিতেন স্ত্রীকে। আপত্তিকর বিশেষ কিছু থাকতও না। তাতে। কুকর্ম তো আর করতেন না। কিন্তু যা লিখতেন না খোলাখুলিই লিখতেন। স্ত্রীর মুখ চেয়ে রেখে ঢেকে লিখতেন না। কিন্তু যা লিখতেন তা খোলাখুলিই লিখতেন। স্ত্রীর মুখ চেয়ে রেখে ঢেকে লিখতেন না। সেকালের এক সঙ্গীতশিল্পীর প্রতি কাউন্টেসের আকর্ষণ তিনি সুনজরে দেখেননি। যদিও স্ত্রী তখন মক্কা যাবার বয়স। কাউন্টেস এর জন্যে তাঁকে ক্ষমা করেননি। তিনিও ডায়েরি লিখতেন। দেখতে দিতেন। কী জানি কেমন করে সম্পর্কটা ভিতরে ভিতরে চিড় খায়। শেষে এমন হলো যে পাশাপাশি ঘরে থেকেও তাঁরাও পরস্পরকে চিঠি লিখতেন। টলষ্টয় সম্বোধন করতেন, ‘বন্ধু’। কাউন্টেস মাঝে মাঝে হিষ্টিরিয়াগ্রন্থের মতো ব্যবহার করতেন। তাঁর ও তাঁর স্বামীর মাঝখানে অন্য কোনো নারী ছিল না। কিন্তু ছিলেন বিশেষ এক শিষ্য। টলষ্টয় যাঁকে তাঁর তাত্ত্বিক উত্তরাধিকারী মনে করতেন। চার্টকভ তাঁর নাম। কাউন্টেসের মতে লোকটা সুবিধাবাদী ও ভন্ড। টলষ্টয়ের মতে আদর্শবাদী ও সুযোগ্য বাণীবাহক। টলষ্টয়ের অবর্তমানে যিনি তাঁর তত্ত্ব বা মতবাদ জগতের কাছে প্রচার করতে পারবেন। শেষ বয়সের ডায়েরিখানা তিনি তাঁরই হাতে দিয়ে যেতে চান। তিনিও সে দায়িত্ব নিতে রাজী। কিন্তু কাউন্টেস জেদ ধরেন যে ডায়েরিতে কী আছে না আছে তিনি দেখবেন ও দেখে শুনে অনুমতি দেবেন বা চেপে রাখবেন। তা ছাড়া তাঁর কানে এসেছিল যে টলষ্টয় একখানা গুপ্ত উইল করেছেন ও সেটা নিজের ঘরে লুকিয়ে রেখেছেন। সে রাত্রে বোধ হয় গুপ্ত উইলের সন্ধানেই কাগজপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করা হচ্ছিল। গুপ্ত উইলটা সম্ভবত চার্টকভের অনুকূলে। সম্পত্তিঘটিত নয়, পুঁথিপত্রঘটিত। জমিদারি অনেকদিন আগ থেকেই স্ত্রীর নামে লিখে রাখা হয়েছিল। যেসব গ্রন্থ ১৮৮০ সালের আগে লেখা সেসব গ্রন্থে গ্রন্থস্বত্ব অনুকূলে হস্তান্তরিত হয়েছিল।

সম্পত্তি নিয়েও অশান্তির শেষ ছিল না। জমিদারিটি তখন টলষ্টয়ের নয়, তাঁর স্ত্রীর। তিনিই দেখাশুনা করতেন। দায় দায়িত্ব তাঁরই। চাষীরা যদি তাঁর অনুমতি না নিয়ে গাছ কেটে নিয়ে যায় তবে পুলিশকে চিঠি লিখে সেটা বন্ধ করতে চাওয়া কি তার কর্তব্য নয়? তাঁর মতে তিনি ঠিকই করেছিলেন। পুলিশ এসে চাষীদের ধরপাকড় করে। তারা ধরে নেয় এসব টলষ্টয়ের ইচ্ছায় ও জ্ঞাতসারে ঘটেছে। মুখে বলা হচ্ছে, আমি ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে বিশ্বাস করিনে, আমি সম্পত্তি ত্যাগ করেছি, কিন্তু আচরণ তো পুরোপুরি বিষয়ী লোকেরই মতো। স্ত্রীর বেনামীতে সম্পত্তিরক্ষা। রাস্তার মাঝখানে টলষ্টয়ের ঘোড়া থামিয়ে জনাকয়েক চাষী তাঁকে যা তা বলে শাসায়। “এই বুড়ো! তুই এখনো বেঁচে আছিস। মর, মর, তুই জলদি মর। নয়তো আমরাই তোকে খতম করব।’ টলষ্টয় বিষম আঘাত পান। দেহে নয়, মনে। জমিদারির চাষীদের জন্য তিনি আজীবন যা কিছু করেছিলেণ তার পরিণাম কি এই! আর তাঁর সেই যে মতবাদ, সব অবস্থায় অপ্রতিরোধ, কোনো অবস্থায় অন্যায়ের প্রতিকার অন্যায়ের দ্বারা নয়, সেই মতবাদ কি তাঁর নিজের সহধমিণই লঙ্ঘন করলেন না পুলিশকে ডেকে এনে, ধরপাকড় করিয়ে? চাষীরা তো তাঁকে ভন্ড সাধু বলে অশ্রদ্ধা করবেই। অমান্যও করবে। পুলিশের সাহায্যে তিনি মান্য হতে চান না। তিনি রাষ্ট্র জিনিসটারই বিরোধী। তিনি পুলিশ বা আদালত বা জেল বা সৈন্যসামন্ত কোনোটাই রাখতে চান না। মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক হবে ভয়ের নয়, প্রেমের। ভয়ের শাসনের স্থান নেবে প্রেমের শাসন। কিন্তু তাঁর শিক্ষার সঙ্গে তাঁর আচরনের মিল কোথায়? তাঁর নিজের পরিবারেই তিনি অবহেলিত। দেশ বিদেশের লোক তাঁর দর্শন পেতে আসে, তাঁদের চোখে তিনি একজন যুগপ্রবর্তক। কিন্তু তাঁর আপন জনকেই তিনি বোঝাতে পারেন না যে শোষিত শ্রেণীর শ্রমের উপর প্রতিষ্ঠিত অভিজাত জীবন শ্রেয় হলেও শ্রেয় নয়। শ্রেয় হচ্ছে শ্রমিকদের শ্রমের অংশ নেওয়া, কৃষক হওয়া। শ্রেয় হচ্ছে শস্ত্রের দ্বারা অপরকে দাবিয়ে না রাখা, প্রেমের দ্বার অপরকে বশ করা। শ্রেয় হচ্ছে দেশের শত্রুকেও মিত্রে পরিণত করা, তার মার ফিরিয়ে না দেওয়া, স্বেচ্ছায় আত্মত্যাগ করা। এসব টলষ্টয়ের মৌলিক বাণী নয় যীশুর বাণীরই প্রতিধ্বনি। চার্চ এ পত্রের থেকে বিচ্যুত হয়েছে। তিনি চান বিচ্যুতের সংশোধন করতে।

স্কুলে পরীক্ষায় সফল হয়ে আমি যেমন টলষ্টয়ে ‘টোয়েন্টি-থ্রী টেলস’ পুরস্কার পেয়েছিলাম তেমনি পেয়েছিলাম বানিয়ানের আরো বিখ্যাত বই ‘পিলগ্রিমস প্রোগ্রেস।’ তদার এক জায়গায় ছিল নায়কের উক্তি-

“O! My dear wife and ypu, the children of my bowels, I, your dear friend, am i myself undone, byt reason of a burde that lieth hard upon me. Moreover, I are for certain informed that this our city win be burned with fire from heaven; in which fearful overthrow both myself, with these my wife, and you my sweet babes, sha miserably come to ruin, except (the which yet I see not) some way of escape can be found whereby we may be delivered.”

পরিবারের প্রতি টলষ্টয়ের বক্তব্য তারই অনুরূপ তিনি দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছিলেন যে যুদ্ধ আসতে বিপ্লবও আসছে, ধ্বংস হয়ে যাবে তাঁর পরিবার, তাঁর আত্মীয়স্বজন, তাঁর শ্রেণী, তাঁর সমাজ, তাঁর চার্চ তাঁর রাজবংশ। এর থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় সময় থাকতে আমূল পরিবর্তন। যে পরিবর্তন স্বতঃপ্রণোদিত। যার সূচনা নিজের জীবনযাত্রায় স্ত্রীপুত্রকন্যার জীবনযাত্রায়।

ইচ্ছা করলেই তিনি তাঁল নিজের জীবনের আমূল পরিবর্তন ঘটাতে পারতেন, কিন্তু পরিবারের আজ সকলের অমূল পরিবর্তন কি এতই সহজ? তা ছাড়া মদ্য মাংস তামাক বর্জন করা এক জিনিস, পত্নীর পরিহার করা আরেক। বাহান্ন বছর বয়সী পুরুষের নিবৃত্তিমর্গ ছত্রিশ বছর বয়সী যুবতী প্রবৃত্তিমার্গের সম্পূর্ণ বিপরীত। বিপরীতের উপর বিপরীত কি একতরফা চাপানো যায়? তেমন সিদ্ধ কি এককভাবে নেওয়া যায়? চাই দু’পক্ষের সম্মতি যতদিন সেটা সম্ভব না হয়েছে ততদিন আমার পরিবর্তন অসম্ভব। অসম্ভবকে সম্ভব করতে গেলে হয় তার নাম সেক্স ওয়ার। ক্লাস ওয়ারের চোখ কম তীব্র নয়। একপক্ষ ভিতরে ভিতরে দগ্ধ হয়ে অপরপক্ষকেও দগ্ধায়। সংসারে সেটা বিভিন্ন আবার ধারণ করে। অশান্ত সংসার থেকে মুক্তি পেতে হবে সংসারত্যাগই প্রশস্ত।

কিন্তু সেরকম একটা চরম সিদ্ধান্ত নিতে টলষ্টয়ের বিবেকের আপত্তি। স্বামীভক্ত পত্নীকে কোন কারণেই ত্যাগ করা যায় না। ত্যাগ করলে পরে যদি পাপ করে তবে স্বামীও হবে পারে জন্য দায়ী এই হলো খ্রীষ্টায় শিক্ষা। সত্য ও অহিংসার পর একলা চলা যায়, কিন্তু মিষ্টিকের পথে যদি শুনে কেউ না আসে তবে ‘একলা চল রে’ এগিয়ে গেলে মন ভেঙে যায়, ঘর ভেঙে যায়, আর জোড়া লাগে না। টলষ্টয় এর জন্যে প্রস্তর ছিলেন না। গৃহত্যাগের চিন্তা কি কখনো উদয় হতো না মনে? কিন্তু সে বয়সে গৃহত্যাগ মানেই দেহত্যাগ। কোথায় গিয়ে মাথা গুঁজবেন, সেবা করবে কে, শুশ্রদ্ধা করবে কে, এসব প্রশ্ন সঙ্গে সঙ্গে উদয় হতো। অথচ পরিবারের আর দর্শনের মতো ঐশ্বর্যের মধ্যে অভিজাত মানের জীবন যাপন করে আন্তর্জাতিক যুদ্ধ বা আভ্যন্তরিক বিপ্লবের হাত কেতে পরিত্রাণ মেলে না। আর চার বছর বেঁচে থাকলে তিনি যুদ্ধের সাক্ষী হতেন। আরো তিন বছর বেঁচে থাকলে বিপ্লবের সাক্ষী। অমন সুনিয়ন্ত্রিত যাঁর জীবন তিনি যথাস্থানে থেকে পরিবারের সেবাযত্নে ও নিজস্ব চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে নব্বই বছর বাঁচলে আশ্চর্যের বিষয় হতো না। সম্ভবত তিনি যুদ্ধের বা বিপ্লবের জীবন্ত সাক্ষী হতে চাননি। তার আগেই মহাপ্রস্থানের পথে যাত্রা করতে অধীর হয়েছিলেন। দৈবাৎ একটা উপলক্ষ জুটে গেল মধ্যরাতে তাঁর কাগজপত্রে অন্যায় হস্তক্ষেপে। উঠের পিঠে শেষ কুটো। টলষ্টয় স্ত্রীকে জাগালেন না, তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিলেন না। আর যারা ছিল তারাও রইল ঘুমিয়ে। গৌতমের মতো তাঁর এই গৃহত্যাগেও সহায় ছিল এক বিশ্বস্ত অনুচর। তাঁর কোচম্যান। তফাতের মধ্যে সহযাত্রী ছিল তাঁর অনুগতা কন্যা আলেকজান্দ্রা।

রেলস্টেশনে পৌঁছে কোচম্যানকে বিদায় দেন। তৃতীয় শ্রেণীর কামরায় অপরিচিতদের সঙ্গে অপরিচিতের মতো ভ্রমণ করেন। নিরুদ্দেশ যাত্রা। বোধহয় অসুখ নিয়েই রওয়ানা হয়েছিলেন। পথের মাঝখানে অসুখটা বেড়ে যায়। কেউ কেউ চিনতে পারে যে উনি মহামতি টলষ্টয়। কাগজে ওঁর ছবি কে না দেখেছো? ওঁকে পথের ধারে এক অখ্যাত ষ্টেশনে ট্রেন থেকে নামিয়ে ষ্টেশন মাষ্টারের ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। খবরটা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। তখন ইয়াসনায়া পোলিয়ানাতেও পৌঁছায় সেই প্রথম তাঁর স্ত্রী জানতে পান টলষ্টয় কোথায়। স্বামী সন্দর্শনে যান। কিন্তু এমনি তাঁর দুর্ভাগ্য যে চিকিৎসকরা কেউ তাঁকে রোগীর ঘরে যেতে দেয় না, পাছে রোগী তাঁকে দেখে উত্তেজিত হয়ে পড়েন। তিনিও অপরাধী বোধ করে নিরস্ত হন। সারা দিন বাইনে ঘোরাঘুরি করে কাটান, রাত্রে রেল লাইনের সাইডিং-এ রাখা ট্রেনের একটি কামরায় ঘুমান। শেষে যখন টলষ্টয়ের অজ্ঞান অবস্থা তখন স্ত্রীকে তাঁর কাছে যেতে দেয়া হয়। তিনি হাতে চুমু খেয়ে কানে কানে বলেন, ক্ষমা করো। টলষ্টয় গভীর দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলেন। ঘন্টা দুই পরে মৃত্যুবরণ।

গৃহত্যাগ না করলে টলষ্টয় আরো কিছু দিন বাঁচতেন আমার এ অনুমান অযথা নয়। কিন্তু যুদ্ধ দেখার জন্য আরো চার বছর ও বিপ্লব দেখার জন্য আরো তিন বছর বেঁচে থাকতেন এটা আমার বাসনা মেশানো চিন্তা। তিনি গৃহত্যাগ করেন ১৯১০ সালের ২৪ অক্টোবর, মৃত্যুবরণের কারণ ধরে নিয়ে দোষটা গিয়ে পড়ে তাঁর দুঃখিনী সহধর্মিণীর উপরে। সেটা কিন্তু কাউন্টেসের প্রতি অবিচার। সোনিয়া ছিলেন সকল প্রকারেই স্বামী ভক্ত, কিন্তু কেবল একটি অর্থে নয়। স্বামীর আদর্শ তাঁর নিজের আদর্শ ছিল না। তিনি বুঝতেই পারতেন না অভিজাত শ্রেণীর পক্ষে সম্পত্তি বিসর্জন কেন একান্ত জরুরি। গাছ লাগাবেন জমিদার, গাছ কেটে নিয়ে যাবে প্রজা, এটা কি ন্যায় না অন্যায়? বই লিখবেন গ্রন্থাকার, মুনাফা লুটবে যে-কোনো প্রকাশক, এটা কি ন্যায় না অন্যায়? জমিদার তা হলে বাঁচবেন কি খেয়ে? গ্রন্থকারই বা খাবেন কী?

ভদ্রমহিলাকে বোঝানো শক্ত জমিদারি চাল বজায় রাখতে হলে শোষণের আশ্রয় নিতে হয় আর শোষণ অভ্যাহত রাখতে হলে ভায়োলেন্স অপরিহার্য। তার মানে শ্রেণীতে শ্রেণীতে দ্বন্দ্ব। শ্রেণীদ্বন্দ্বে জমিদারের জয় তখনি সুনিশ্চিত যখন রাষ্ট্র তার মুঠোর মধ্যে। তার মানে রাষ্ট্র যখন স্বৈরাচারী সম্রাটের শাসনাধীন। এ ব্যবস্থা দিকে দিকে যুদ্ধ ডেকে এনেছে ও আনতে যাচ্ছে। এর অবশ্যাম্ভাবী পরিণাম বিপ্লব। একথা যদি সত্য হয়ে থাকে তবে সত্য প্রকাশ করাই সাহিত্যিকদের কর্তব্য। আর তিনি যদি মনে করেন যে এটা তাঁর জীবনব্রত তবে এটাকে জীবিকার পর্যায়ে নামিয়ে আনলে ব্রতসিদ্ধি হয় না, হয় কিঞ্চিৎ অর্থলাভ। শেষবয়সে টলষ্টয়ের জীবনব্রত বা মিশন ছিল সত্য প্রকাশ তথা সত্য প্রচার। তিনি একপ্রকার মিশনারি। মিশনারিরা কি যীশুর কথামৃত বিক্রি করে বেড়ান? করলে ক জন কিনবে ও পড়বে? তা দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে গেলে খুব সাদাসিধে ভাবে থাকতে হবে। অভিজাতদের মতো নয়।

এককালে লেখার জন্য সব চেয়ে চড়া দাম হাঁকতেন টলষ্টয় ও টুর্গেনিভ। দুই জমিদার। এ নিয়ে ক্ষোভ ছিল তাঁদের সমকক্ষ ডষ্টয়েভস্কির। তিনি লিখেছিলেন তাঁর স্ত্রীকে আনা কারেনিনা প্রসঙ্গে-”কাল পড়লাম (তুমি বোধহয় আগেই শুনেছ) যে, লিও টলষ্টয় তাঁর উপন্যাস, চল্লিশ কিস্তিবিক্রি করেছেন রাশিয়ান মেসেনজারকে। প্রকাশ শুরু হবে আগামী জানুয়ারি থেকে। দাম কিস্তি পিছু পাঁচশো রুবল। অর্থাৎ মোট বিশ হাজার রুবল। আমাকে তো ওরা আড়াই শো রুবল দিতেও ইতস্তত করেছিল। হুঁ, ওরা আমাকে হীনমূল্য মনে করেন, লেখাই আমার জীবনোপায় কিনা। এ অভিয়োগ যুক্তিযুক্ত। জমিদার হলে তাঁরও দরাদরি করার জোর বাড়ত। তবে অমন লেখা জমিদারের হাত দিয়ে হতো কি না সন্দেহ।

আনা কারেনিনার পর আর্ট সম্বন্ধে টলষ্টয়ের ধারণা আমূল পরিবর্তিত হয়। নিজের উপরেই তিনি বীতশ্রদ্ধ হন এই বলে যে তিনি টাকার জন্য লিখেছেন। দষ্টয়ভস্কির উপরেই তাঁর বীতশ্রদ্ধ হন এই বলে যে তিনি টাকার ন্যে লিখেছেন। দষ্টয়েভস্কির উপরেও তাঁর তেমন শ্রদ্ধ ছিল না, কিন্তু পরে তিনি হিসাব করে দেখেন যে প্রকৃত আর্টপদবাচ্য রচনা যে কটি উত্তীর্ণ হয়েছে, তাদের মধ্যে রয়েছে দষ্টয়ভস্কির কোনো কোনো লেখা। যেমন, কারামাজভ ভ্রাতৃগণ। গৃহত্যাগ প্রাক্কালে সেই বইখানিই হাতে নিয়ে তিনি শয্যাগ্রহণ করে। পাঠ বোধ হয় অসমাপ্ত থেকে যায়। কিন্তু সেই তাঁর জীবনের শেষ অধ্যয়ন।

কাউন্টেস অনেকদিন আগেই লক্ষ্য করেছিলেন যে টলষ্টয় আর এ জগতের লোক নন। তাঁর আয়ু শেষ হয়ে আসছে ও তাঁর চেহারায় একটা অতিমর্ত্য আভা ফুটে উঠেছে। তাঁর স্ত্রীকে লেখা চিঠিগুলির সুর কী করুণ। কোথাও অহঙ্কারের লেশমাত্র নেই। দেশ বিদেশের বড়ো বড়ো মাথা যাঁর কাছে নত হয়, যাঁর কীর্তি মানবজতিরও কীর্তি, যাঁর উচ্চতা মানবাত্মার উচ্চতা সেই টলষ্টয় ক্রমাগত আত্মপরীক্ষা ও আত্মনিগ্রহ করতে করতে তাঁর সহজাত অহঙ্কারকে জয় করেছেন। জীবনে যেসব পাপকর্ম করেছেন তার জন্যে প্রায়শ্চিত্ত করেছেন। মৃত্যুর পূর্বেই তাঁর সাধনা প্রায় সমাপ্ত। সে সাধনা রেজারেকশনের ঐ নামের উপন্যাসে যার তাৎপর্য নিহিত।

সহজভাবেই তাঁর মৃত্যু ঘটত মাসখানেক বা বছরখানে বাদে, যদি না তাঁর স্ত্রীর অনধিকার হস্তক্ষেপ তাঁকে গৃহত্যাগের প্রবর্তনা দিত। কাউন্টেসকে তিনি ক্ষমা প্রার্থনার একটা সুযোগও দিরেন না। বিদায় তো নিলেনই না। সোপন রাখলেন তাঁর গতিবিধি কাজটা কি নীতিসম্মত হলো? তাঁর মতো সত্যসন্ধ পুরুষের পক্ষে সেটাও কি তাঁর স্ত্রী গোপন প্রবেশের চেয়ে কম গর্হিত? কিন্তু এর থেকে প্রমাণ হয় যে টলষ্টয়ও মানুষ তাঁর আচরণও মানুষের মতো। তাঁর ট্র্যাজেডি হিউমান। নাটকীয়ভাবে তিনি গৃহত্যাগ করেন। তাঁর মৃত্যুবরণও নাটকীয়।

টলষ্টয়ের মৃত্যুতে যে বিশ্বব্যাপী শোকোচ্ছ্বাস ওঠে তার কোনো নজীর নেই। পরবর্তকালে তার একমাত্র তুলনা বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে নৃশংস হত্যায় বিশ্বময় শোকাবেগ। টলষ্টয় রুশ ভাষায় লিখলেও সব দেশের জন্যে লিখেছেন। স্বকালের কথা লিখলেও সব কালের জন্যে লিখেছেন। স্বকালের কথা লিখলেও সব কালের জন্যে লিখেছেন। কতক মানুষের কাহিনী লিখলেও সব মানুষের জন্যে লিখেছেন। তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলি আমাদের কাছে পর নয়, বিদেশী হলেও আমাদের কাছে আপন। তাদের সুখদুঃখ আমাদের সুখদুঃখ। পুরাতন হলেও তারা কালজয়ী।

তবে যুদ্ধ আর বিপ্লব দুটোই ঘরে যাবার পরে টলষ্টয়ের মতবাদের আর সে প্রাসঙ্গিকতা নেই, যেটা ছিল প্রথম মহাযুদ্ধের ও প্রথম সমাজ বিপ্লবের পূর্বে। সে মতবাদের অনুসরণ যদি কেউ জীবনে করতে চান করতে পারেন, কিন্তু সাহিত্যে তার অনুসরণ তেমন সৃষ্টিশীল হবে না। তাঁর নিজের সার্থক সৃষ্টিও তাঁর আর্ট বিষয়ক তত্ত্ব অনুসরণ করেছে বলেই সার্থক হয়েছে তা নয়। হয়েছে তাঁর সত্য সৃষ্টি বা রসানুভূতির জন্যেই। সাংসারিক অর্থে সফল হয়েছে কি না অবান্তর।

শিল্পের বিভিন্ন শাখা সম্পর্কে গভীর চিন্তা, বিচার ও বিশ্লেষণের সাহায্যে যুক্তিসম্মত সার্বভৌম শিল্প-স্বরূপ নির্ণয়-প্রয়াস বহুকাল চলে আসছে। তার মধ্যে টলষ্টয়ের শিল্পভাবনা এবং ভাবীকালের শিল্পের বাস্তব রূপ-পরিকল্পনা নিঃসন্দেহে অন্যতম। টলষ্টয়ের শিল্পতত্ত্ব শিল্পের প্রবণতা ও উদ্দেশ্যের গতানুগতিক আলোচনা, গবেষণা অথবা বিবৃতি মাত্র নয়,-তা তাঁর বৈচিত্র্যপূর্ণ শিল্পী-জীবনের পরিণামী সুগভীর মানবপ্রত্যয়-জাত সত্যের বলিষ্ঠ প্রকাশ। বলা বাহুল্য, শিল্পের সার্বভৌম প্রেরণার উৎস হিসেবে শ্রেণীনিরপেক্ষ সর্বস্তরের মানবজীবনের মাহাত্ম্য উপলব্ধি টলষ্টয়ের শিল্পভাবনাকে এমন সমুচ্চ মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে-যা ইতোপূর্বে কোন শিল্পতাত্ত্বিকের শিল্পভাবনায় দেখা যায়নি। শিল্পের স্বরূপ নির্ণয়ে কোন কোন ক্ষেত্রে দৃষ্টি ও চিন্তার সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও, সার্বভৌম শিল্পের আদর্শ হিসেবে শ্রমনির্ভর মানবজীবন এবং অকৃত্রিম হৃদয়ানুভূতির মাহাত্ম্য উপলব্ধি টলষ্টয়ের শিল্পতাত্ত্বিক চিন্তাভাবনাকে চিরকালীন মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছে।

টলষ্টয় বহুকালব্যাপ্ত শিল্পভাবনার বহুমুখী প্রবাহের সঙ্গে অন্তরঙ্গভাবে পরিচিত ছিলেন। তথাপি পূর্বসূরী বা সমসাময়িক কোন শিল্পতাত্ত্বিকের দ্বারা তিনি প্রভাবিত হননি। তাঁর শিল্পভাবনা একান্তভাবে মৌলিক। সে ভাবনা সূক্ষ্মদেহী, বায়বীয় বা ভাববাদী নয়,- সম্পূর্ণ বাস্তববাদী, জীবনঘনিষ্ঠ। শিল্পসৃষ্টির উৎস হিসেবে কল্পনার বৈদ্যুতশক্তিকে তিনি অস্বীকার করেননি, কিন্তু তাঁর মতে শিল্পের পরোৎকর্ষ নির্ভরশীল শিল্পীর বহুবিস্তৃত সুনিবিড় জীবন-উপলব্ধির ওপর। উপলব্ধিহীন খুঁটিনাটি-বর্ণনাত্মক বাস্তবধর্মী শিল্প তাঁর মতে নিম্নমানের-তাঁর ভাষায়-গ্রাম্য স্বভাবের। এতদ্ব্যতীত, তাঁর বিবেচনায় শিল্প শুধুমাত্র শিল্পীর জীবনোদ্ভুত নয়, মানবজীবনকেও কল্যাণের পথে আকর্ষণ করবার শক্তিশালী মাধ্যম। শিল্পের স্বরূপ উপলব্ধিতে এই মানব-কল্যাণ বা মানব-মঙ্গলবোধ টলষ্টয়ের শিল্পাদর্শকে সমকালীন শিল্পচিন্তার জগতে স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। বস্তুতপক্ষে শিল্পের স্বরূপ সন্ধানে টলষ্টয়ের এই শিল্পাদর্শ বর্তমান যুগ-প্রচলিত কলাকৈবল্যবাদী এবং নিছক সৌন্দবাদী শিল্পতত্ত্বের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ।

টলষ্টয়ের মানবকল্যাণমুখী শিল্পাদর্শ এ যুগের বহুজনপ্রিয় সৌন্দর্য ও আনন্দবাদী শিল্পাদর্শের বলিষ্ঠ বিরোধীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ায় আধুনিক শিল্পতাত্ত্বিক মহলে তীব্র সমালোচনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। অনেকে তাঁর শিল্পাদর্শকে রক্ষণাশীল, সেকেলে (ফবসড়ফব) বলে অভিহিত করতেও দ্বিধাবোধ করেননি। তথাপি তাঁর শিল্পীজীবনের পরিণতিতে শিল্পই মানবমিলনের শ্রেষ্ঠ বাহন-এই জ্যোতির্ময় উপলব্ধির প্রভাবে শিল্পের স্বরূপ সম্পর্কে স্বীয় প্রত্যয়ে তিনি অবিচল থেকেছেন। কর্মব্যস্ত লেখক-জীবনের চূড়ান্ত পর্যায়ে তিনি শিল্পের স্বরূপ সন্ধানে বিশ্বসাহিত্য এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের জগৎ থেকে অজস্র তথ্য আহরণ করেন এবং সুগ্রথিত করে শিল্পাদর্শ বিষয়ে নিজস্ব বক্তব্য প্রতিষ্ঠিত করেন। তাঁর এই মহান প্রয়াসের ফল ১৮৯৮ সালে প্রকাশিত ডযধঃ রং অৎঃ? নামক সুবিখ্যাত ক্লাসিক পর্যায়ের গ্রন্থ।

শিল্প-সম্পর্কিত টলষ্টয়ের এই জগদ্বিখ্যাত গ্রন্থের বিভিন্ন ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হলেও বাংলায় এক পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। সাম্প্ৰতিক কালে আমাদের শিল্পরসিক মহলে শিল্পতত্ত্ব বিষয়ে আগ্রহ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাওয়ায় এই মনীষী শিল্পতাত্ত্বিকের শিল্প সম্পর্কীয় অসামান্য গ্রন্থখানির বাংলায় অনুবাদ অপরিহার্য কর্তব্যকর্ম বলে অনুভব করেছি। দীর্ঘ ছয় বৎসরের অক্লান্ত পরিশ্রমে বারংবার পরিমার্জনার পর এতদিনে এই অনুবাদকর্ম সমাপ্ত হল।

দীর্ঘকালের শিল্পচিন্তা এবং শিল্পবিষয়ক গ্রন্থলোকে বিচরণের ফলে আমার মনে হয়েছে, টলষ্টয়ের শিল্পভাবনা আপাতদৃষ্টিতে প্রাচীনপন্থী এবং রক্ষণশীল মনে হলেও তার মধ্যে এমন সুস্পষ্ট আবেদন বর্তমান-যা সর্বজনীন এবং সর্বকালিক। বস্তুতপক্ষে ব্যক্তি, সমাজ এবং মানবকল্যাণ-চিন্তাহীন কলা-কৈবল্যবাদী শিল্পদর্শের প্রেরণায় বর্তমান যুগে জগৎব্যাপী শিল্পসৃষ্টি যে নৈরাশ্যজনক অবক্ষয়ের পথে নিম্নাভিমুখী, তার বিরুদ্ধে সবিবেকসম্পন্ন শিল্পরসিক মহলে জীবনমুখী কল্যাণভূমিষ্ঠ শিল্পসৃষ্টির জন্য দাবি ক্রমশ সোচ্চার হয়ে উঠেছে। আমাদের দেশেও নিছক সৌন্দর্যবাদী ব্যতিক্রমী শিল্পের (ঊীপযঁংরাব ধৎঃ) স্থলে জনগণজীবন-কেন্দ্রিক শিল্পই যে সাম্প্রতিক শিল্পরসিক মহলে আদৃত হতে চলেছে-এ সত্যও কারও অজানা নয়।

এই পরিস্থিতিতে টলষ্টয়ের জীবনধর্মী কালজয়ী শিল্পভাবনাকে বৃহত্তর বাঙালি পাঠকের নিকট উপস্থিত করা পবিত্র কর্তব্য বিবেচনায় এই দুরূহ অনুবাদকর্মে প্রবৃত্ত হই। অনুবাদকে মূলানুগ অথচ সহজবোধ্য করে পরিবেশন করা যে কি বিপুল শ্রম, ধৈর্য এবং একাগ্রতাসাপেক্ষ, -শেষ বারের পরিমার্জনার সময় তা বেশ ভালো করেই উপলব্ধি করি। দীর্ঘকালের একনিষ্ঠ পরিশ্রমে এই জটিল অনুবাদকর্ম সমাপ্ত হলেও তা যে সর্বাংশে ত্রুটিশূন্য এবং নিখুঁত হয়েছে-এমন সদম্ভ দাবি আমার নেই। সহৃদয় পাঠকবর্গ যদি অনুগ্রহপূর্বক এই অনুবাদকর্মের যে কোন ত্রুটির প্রতি আমার মনোযোগ আকর্ষণ করেন, তবে পরবর্তী সংস্করণে সানন্দে তা অপসারিত করতে আমি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ রইলাম।

১৮৯৮ সালের রুশ ভাষায় What is Art? প্রকাশের পর এই গ্রন্থের বহু অনুবাদ প্রকাশিত হয়। তার মধ্যে Aylmer Maude

এর অনুবাধ সর্বাপেক্ষা নির্ভরযোগ্য। এই অনুবাদকর্মে মড্ স্বয়ং টলষ্টয়ের ব্যক্তিগত সহযোগিতা লাভ করেছিলেন এবং টলষ্টয় নিজে এই অনুবাকর্মের উৎকর্ষও স্বীকার করেছিলেন। বর্তমান অনুবাদ মুখ্যত – Oxford University Press প্রকাশিত World’s Classics Series -এর ৩৩১ নং গ্রন্থ What is Art? অবলম্বনে করা হয়েছে। উক্ত সিরিজে মড্-এর এই অনুবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৩০ সালে, এবং বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা লাভ করায় এই সংস্করণেই গ্রন্থটির বহুবার পুনর্মুদ্রণ প্রয়োজন হয়।

পাশ্চাত্য শিল্পতত্ত্ব-জগতের অপর দুই শ্রেষ্ঠ মনীষী অ্যারিস্টটল এর ক্রোচের মূল্যবান শিল্পতাত্ত্বিক চিন্তা ইতোপূর্বে বাংলায় অনূদিত হয়েছে। টলষ্টয়ের শিল্পতত্ত্ব-বিষয়ক অমূল্য ভাবনা বাংলা ভাষায় রূপান্তরিত না হওয়ায় বাংলা সাহিত্যের একটা বড় অভাব ছিল। এই অনুবাদ বাংলা সাহিত্যের, তথা শিল্পজিজ্ঞাসু বাঙালি পাঠক-সমাজের সেই অভাব পুরণে সমর্থ হলে আমি কৃতার্থ বোধ করাব।

জুলফিকার নিউটন
উত্তরা, ঢাকা-১২৩০।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *