৪
[সৌন্দর্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত শিল্পের সংজ্ঞা। রুচির সংজ্ঞা অনির্ণের। শিল্পবস্তুর নিশ্চিত জ্ঞানের জন্য একটি পরিচ্ছন্ন সংজ্ঞার প্রয়োজনীয়তা।]
সৌন্দর্যের এ সমস্ত সংজ্ঞার সামগ্রিক তাৎপর্য কী? সৌন্দর্য বিষয়ে যে সম্পূর্ণ অযথার্থ সংজ্ঞা শিল্পের যথার্থ ধারণা দিতে অক্ষম এবং যেগুলির মতে সৌন্দর্যের স্বরূপ উপযোগিতায় কিংবা উদ্দেশ্য সাধনে অথবা সুষমতায় বা শৃঙ্খলায় বা পরিমিতবোধে বা লালিত্যে বা বিভিন্ন অংশের সঙ্গতিতে অথবা বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যে কিংবা এ সমস্ত বৈশিষ্ট্যের একত্র সংযোগের মধ্যে নিহিত-বস্তুমুখী সংজ্ঞার এ সমস্ত নন্দনতাত্ত্বিক সংজ্ঞা আমদিগকে দুটি মৌলিক ধারণার দিকে চালিত করে। তার প্রথমটি হল, সৌন্দর্য এমন বস্তু যার স্বতন্ত্র অস্তিত্ব আছে (সৌন্দর্য আত্মলীন)। অর্থাৎ সৌন্দর্য পরমবিশুদ্ধির অন্যতম অভিব্যক্তি, অর্থাৎ সৌন্দর্য চরম ভাবপদার্থের, চিৎ-সত্তার, এষণার (Will) অথবা ঈশ্বরেরই বহিঃপ্রকাশ। অপরটি হল, সৌন্দর্য আমাদের দ্বারা অনুভূত এক ধরনের আনন্দ-যার বিষয় ব্যক্তিগত সুযোগ সুবিধা নয়।
অপেক্ষাকৃত লঘুস্তরের নন্দনতাত্তিকদের কথা ছেড়ে দিয়ে বলা যায়, এ সমস্ত সংজ্ঞার মধ্যে প্রথমটি গৃহীত হয়েছিল ফিকটে, শেলিং, হেগেল, সোপেনহাওয়ার এবং ফরাসি দার্শনিকতা-বিলাসী কুজেঁ (Cousin), জুফ্রয় (Jouffroy), রভাইজঁ (Ravaisson) প্রভৃতি কর্তৃক। আমাদের যুগের অধিকাংশ শিক্ষিত ব্যক্তিও সৌন্দর্যের এইএকই বস্তুধর্মী মরমিয়া সংজ্ঞা স্বীকার করে থাকেন। এই ধারণাটি অধুনা বহুব্যাপ্ত, বিশেষভাবে প্রবীণ সমাজের মধ্যে।
দ্বিতীয় মত অর্থাৎ ব্যক্তিগত কোন সুবিধার লক্ষ্য ছাড়া আমাদের দ্বারা অনুভূত এক ধরনের আনন্দই যে সৌন্দর্য -এই মত মুখ্যত নন্দনতাত্ত্বিক লেখকদের প্রিয়। আমাদের সমাজের অপর অংশ-প্রধানত তরুণ বয়সিরা এই মতের অনুসারী।
সুতরাং সৌন্দর্যের দুটি মাত্র সংজ্ঞা আছে (এর কোন বিকল্প হতে পারে না) : একটি বস্তুধর্মী, রহস্যাশ্রয়ী, যে ধারণা পরম বিশুদ্ধ অর্থাৎ ঈশ্বরে লীন হয়-এই সংজ্ঞাটি আজগুবি, শূন্যগর্ভ। অপর সংজ্ঞাটি এরই বৈপরীত্যে খুবই সহজ, সুবোধ্য এবং ব্যক্তিধর্মী। এ সংজ্ঞা অনুসারে যা আনন্দ দেয় তাই সৌন্দর্য (আমি ‘আনন্দ দেওয়ার সঙ্গে ‘কোন লাভেল লক্ষ্য ছাড়া’-এ কথাগুলি যোগ করছি না, যেহেতু ‘আনন্দ দেয়’ কথাটির মধ্যে স্বভাবতই লাভ লোকসানের কোন প্রশ্ন নেই।
একদিকে সৌন্দর্যকে দেখা হয় অতীন্দ্রিয় খুব উচ্চ স্তরের বস্তু হিসেবে। তবে দুর্ভাগ্যক্রমে সৌন্দর্যকে একদিকে দেখা হয় খুবই অনির্দিষ্ট বস্তু হিসেবে। তাই সৌন্দর্য দর্শন, ধর্ম এমনকি জীবনকে পর্যন্ত ধারণ করে আছে (যেমন শেলিং, হেগেল এবং তাঁদের জার্মান এবং ফরাসি অনুবর্তীদের তত্ত্বে তা লক্ষণীয়); অথবা অপরদিকে (কান্ট এবং তাঁর অনুবর্তীদের সংজ্ঞা থেকে যা স্বাভাবিকভাবে উদ্ভুত) সৌন্দর্য আমাদের দ্বারা অনুভূত এক প্রকারের নৈর্ব্যক্তিক আনন্দ ব্যতীত আর কিছুই নয়। সৌন্দর্য সম্পর্কে এ ধারণা খুবই স্বচ্ছ মনে হলেও দুর্ভাগ্যবশত ইহাও অযথার্থ। কারণ ইহা অতিব্যাপ্তি দোষে দুষ্ট, অর্থাৎ পানীয়, খাদ্য এবং নরম ত্বকের স্পর্শ থেকে যে আনন্দ লভ্য, এর মধ্যে সে আনন্দও আছে। এ মতবাদ গুয়ো (Guyau), ক্রলিক (Kralik) ও আরও অনেকের দ্বারা স্বীকৃত।
এটা সত্য, সৌন্দর্যের নান্দনিক মতবাদের বিকাশ অনুসরণ করলে আমরা দেখি, যদিও প্রথমে (নন্দনতত্ত্ববিজ্ঞানের ভিত্তি স্থাপিত ইহার সময়) সৌন্দর্যের অধিবিদ্যাগত সংজ্ঞারই প্রাধান্য ছিল, তথাপি সমকালের যতই নিকটে আসি ততই একটি পরীক্ষামূলক সংজ্ঞা (সম্প্রতি যা শারীরতাত্ত্বিক মতবাদে রূপ নিয়েছে) আমাদের সামনে প্রাধান্য লাভ করেছে। যার ফলে পরিণামে আমরা সৌন্দর্য ধারণা থেকে সম্পূর্ণভাবে প্রতিসরণশীল ভেরোঁ (Veron) এবং সালি (Sully)- -র মতো নন্দনতাত্ত্বিকদের সাক্ষাৎ পাই। কিন্তু এ সমস্ত নন্দনতত্ত্ববিদ্ খুব কম সাফল্যই অর্জন করেছেন। বর্তমানে জনসাধারণের অধিকাংশ এবং শিল্পী ও জ্ঞানীদের মধ্যে সৌন্দর্য সম্পর্কে একটি ধারণা খুব দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে-যে ধারণা অধিকাংশ এবং শিল্পী ও জ্ঞানীদের মধ্যে সৌন্দর্য সম্পর্কে একটি ধারণা খুব দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে-যে ধারণা অধিকাংশ নন্দনতাত্ত্বিক গ্রন্থের অন্তর্গত সংজ্ঞার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। সে সংজ্ঞা সৌন্দর্যকে অতীন্দ্রিয়, অধিবিদ্যাগত অথবা বিশেষ এক ধরনের আনন্দ বলে স্বীকার করে। শিল্পের সংজ্ঞা নির্দেশক সৌন্দর্যের এই যে ধারণা আমাদের গোষ্ঠীর এবং কালের মানুষদের দ্বারা এরূপ দৃঢ়তার সঙ্গে স্বীকৃত, সেই ধারণাটির স্বরূপ কী?
ব্যাক্তি অনুভবের দিক থেকে তাকেই আমরা সৌন্দর্য বলি যা বিশেষ এক ধরনের আনন্দ দেয়।
বস্তুগত দিক থেকে তাকেই সৌন্দর্য বলি যা নিখুঁত ও সম্পূর্ণ। এই স্বীকৃতির কারণ, এই অখন্ড সম্পূর্ণতার অভিব্যক্তি থেকে আমরা এক বিশেষ ধরনের আনন্দ পাই। সুতরাং এই বস্তুবাদী সংজ্ঞাটি ভিন্নতর রূপে অভিব্যক্ত ব্যক্তির অনুভবকেন্দ্রিক ধারণা ছাড়া কিছুই নয়। বস্তুতপক্ষে সৌন্দর্যের উভয় ধারণাই কার্যত এক এবং সমভাবাপন্ন বস্তু। একে বলা যেতে পারে আমাদের দ্বারা উপলব্ধ এক ধরনের আনন্দ। অর্থাৎ যা আমাদের মনে আকাঙ্ক্ষার উদ্রেক না করে আনন্দের অনুভূতি জাগ্রত করে তাকেই আমরা ‘সুন্দর’ বলে অভিহিত করি।
এরূপ ক্ষেত্রে এটা মনে হওয়াই স্বাভাবিক যে শিল্পবিজ্ঞান সৌন্দর্যভিত্তিক (অথাৎ যা আনন্দ দেয়) শিল্প সংজ্ঞা গ্রহণে অনিচ্ছুক এবং সকল শিল্প সৃষ্টি সম্পর্কে প্রযোজ্য এাকটি সাধারণ সংজ্ঞা দিতে আগ্রহী হবে-যে সংজ্ঞা অনুসারে আমরা সহজে নির্ধারণ করতে পারি কোন বস্তুটি শিল্পের অন্তর্গত এবং কোন্ বস্তুটি তা নয়। কিন্তু আমার দেওয়া নন্দনতত্ত্বের সারাংশে পাঠক দেখতে পাবেন, সে রকম কোন সংজ্ঞা পরিবেশন করা হয়নি। পাঠক যদি মৌলিক নন্দনতাত্ত্বিক গ্রন্থগুলি পাঠ করতে আয়াস স্বীকার করেন, তবে এ কথা আরও স্পষ্ট করে উপলব্ধি করবেন। পরম সুন্দরকে তার স্ব-রূপে সংজ্ঞা দান করবার সমস্ত প্রয়াস-যেমন, প্রকৃতির অনুকৃতি হিসেবে, উদ্দেশ্যের অনুগামিতার দিক থেকে, অথবা সুমিতি, সামঞ্জস্য, ঐক্য ইত্যাদির প্রতি লক্ষ্য রেখে বিশুদ্ধ অখন্ড সৌন্দর্যের যে সমস্ত সংজ্ঞা দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে, তা হয় কোন কিছুরই সংজ্ঞা প্রকাশ করতে পারেনি অথবা কোন কোন শিল্পকর্মের দুই একটি লক্ষণ উদ্ঘাটিত করেছে। বহুকাল পূর্ব থেকে মানুষ শিল্প বলে যা ভেবে এসেছেন এবং এখন পর্যন্ত যে সমস্ত বস্তুকে শিল্প বিবেচনা করে থাকেন এ সমস্ত সংজ্ঞা সে সব বস্তুকে অন্তর্ভূক্ত করতে পারেনি।
সৌন্দর্যের বস্তুগত কোন সংজ্ঞা নেই। প্রচলিত সংজ্ঞাগুলি (অধিবিদ্যাগত ও সমীক্ষামূলক) একটিমাত্র সংজ্ঞায় পর্যবসতি এবং একই আত্মমুখী সংজ্ঞার অর্থব্যঞ্জনা বহন করে। সে সংজ্ঞা অনুসারে (যদিও কথাটা শুনতে অদ্ভুত) সে বস্তুই শিল্প যা সৌন্দর্যকে প্রকাশ করে এবং কোন আকাঙ্ক্ষা উদ্দীপ্ত না করে যা তৃপ্তি বিধানে সক্ষম, তাকেই বলা যায় সৌন্দর্য। বহু নন্দনতত্ত্ববিদ্ এ জাতীয় সংজ্ঞার ন্যূনতা এবং দুর্বলতা অনুভব করেছেন এবং সে সংজ্ঞার ভিত্তি দৃঢ় করবার জন্য নিজেদেরকে প্রশ্ন করেছেন, কোন বস্তু যে আনন্দ দেয়, তার কারণ কী? হাচেসন (Hutcheson), ভলতেয়ার, দিদেরো প্রভৃতি অনেকের মতো তাঁরা সৌন্দর্য সম্পর্কীয় আলোচনার বিষয়কে রুচির প্রশ্নে রূপান্তরিত করেছেন। রুচির সংজ্ঞা নির্ণয়ের সমস্ত প্রয়াসই যে ব্যর্থতায় পর্যবসতি হতে বাধ্য, তা যে কোন পাঠক নন্দনতত্ত্বের ইতিহাস থেকে বা নিজে পরীক্ষা করে উপলব্ধি করতে পারেন। কোন বস্তু একজনকে কেন তৃপ্তি দেয়, এবং অপরকে অতৃপ্ত করে-এর কোন বিধান নেই এবং হতেও পারে না। তাই একটি বিজ্ঞান থেকে আমরা যা প্রত্যাশা করতে পারি, প্রচলিত তথাকথিত নন্দনতত্ত্ব তা দিতে পারে না, অর্থাৎ শিল্প শিল্পের লক্ষণ বা নিয়মের সংজ্ঞা দিতে পারে না অথবা সুন্দর (যদি তা শিল্পের বিষয়বস্তু হয়) কি-তার বিবরণ দিতে পারে না, অথবা যদি রুচি শিল্প ও তার গুণাগুণের নিয়ামক হয় সেই প্রশ্নের মীমাংসা করতে পারে না, এবং তারপর য সকল সংজ্ঞা বিবরণ মীমাংসার ভিত্তিতে যে সকল শিল্পকর্ম এই সব নিয়মের অনুবর্তী তাকেই শিল্প বলে স্বীকৃতি দিতে ও যারা এই সকল নিয়মের অনুগামী নয় তাদের খারিজ করতে পারে না। এই নন্দতত্ত্ব-বিজ্ঞানের স্বভাবলক্ষণ এই প্রকার : প্রথমে কিছু সংখ্যক সৃষ্টিকর্মকে তৃপ্তিদায়ক বলেই শিল্প বলে স্বীকার এবং তারপর এমন একটি তত্ত্ব রচনা করা -যার আধারে এই বিশেষ গোষ্ঠীর তৃপ্তিবিধায়ক সৃষ্টিকর্মগুলি স্থান পায়। সৎ শিল্পবস্তুর একটি তালিকা আছে যদনুসারে আমাদের গোষ্ঠীর সমাদৃত কিছু সৃষ্টিকর্ম শিল্প বলে স্বীকৃত- যেমন, ফিডিয়াস (Phidias), সফোক্লিস, হোমার, টিসিয়ান (Titian) রাফায়েল (Raphael) বাক্ (Bach), বেটোফেন, দান্তে, সেক্সপীয়র, গেটে এবং আরও অনেকের সৃষ্টি। এক্ষেত্রে নন্দনতাত্ত্বিক বিধিগুলিও নিশ্চয়ই সে জাতীয় হবে-যা এই শিল্পকর্মগুলিকে আপন পরিধিভুক্ত করে। নন্দনতত্ত্ব সম্পৰ্কীয় সাহিত্যে শিল্পের গুণ এবং গুরুত্ব সম্পর্কে এমন মতামত সব সময় লভ্য-যার ভিত্তি কোন শিল্পতাত্ত্বিক বিধান নয় যার দ্বারা শিল্পের গুণাগুণ বিচায, কিন্তু যা কেবলমাত্র পূর্বগৃহীথ এবং একটি সৎ শিল্পের তালিকার অন্তর্ভূক্তির প্রশ্নের দ্বারাই বিবেচিত হয়। এদের ভিত্তি হচ্ছে আমরা যে নিয়ম খাড়া করেছি তারই পরিপ্রেক্ষিতে এ সমস্ত মতামত গড়ে উঠেছে।
এই তো সেদিন আমি ফলগেল্ট-র (Falgelt) লেখা একখানি সুলিখিত বই পড়ছিলাম। শিল্পকর্মে নৈতিকতার দাবি সম্পর্কে লেখক স্পষ্টই বলেছেন, শিল্পকর্মে আমরা অবশ্যই নৈতিকতার দাবি করব না। এ উক্তির সমর্থনে তিনি বলেন, আমরা যদি এ দাবি স্বীকার করি তবে সেক্সপীয়রের রোমিও জুলিয়েট, এবং গ্যাটের উইলহেল্ম মাইস্টার (Wilhelm Meister) উৎকৃষ্ট শিল্পের আওতায় আসবে না। কিন্তু এই উভয় গ্রন্থ আমাদের গৃহীত সৎশিল্প-তালিকার অন্তর্ভূক্ত বলে তিনি এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, এই দাবি অযৌক্তিক। সুতরাং এমন একটি শিল্পসংজ্ঞার সন্ধান নেওয়া প্রয়োজন যা এ সব গ্রন্থের উপযোগী হবে। নৈতিকতার দাবির পরিবর্তে ফলগেল্ট শিল্পের ভিত্তি হিসেবে স্বীকার্য মনে করেছেন গুরুত্বের দাবিকে (Bedeutungsvolles)।
প্রচলিত সকল নন্দনতত্ত্বের নির্ধারিত হয়েছে এই পরিকল্পনার ওপর। প্রথমত খাঁটি শিল্পের সংজ্ঞা দিয়ে, তারপর বিচার করে দেখতে হবে কোন শিল্পকর্ম সে সংজ্ঞার অনুবর্তী কিনা। এ কাজ না করে এরা দেখছে কতকগুলি শিল্প একশ্রেণীর লোকের মনোরঞ্জন করছে এবং তাকে শিল্প বলে গ্রহণ করে এদের পক্ষেই প্রযোজ্য এমন শিল্পের সংজ্ঞা উদ্ভাবন করে। সাম্প্রতিক কালে এ পদ্ধতির উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হিসেবে একটি উত্তম জার্মান গ্রন্থের সন্ধান আমি পেয়েছিলাম-সেটি মুথার (Muther)-এর “ঊনবিংশ শতাব্দীর শিল্পের ইতিহাস’ (History of Arty in the Nineteenth Century) প্রি-রাফেলাই (Pre-Rephaelites) ক্ষয়িষ্ণুদের এবং প্রতীকীদের (The Symbolists) (যাঁদের ইতোপূর্বেই সৎ-শিল্পী বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে) বর্ণনা দিয়ে তিনি শুধু যে তাঁদের প্রবণতাকে আক্রমণ করতে সাহসী হননি, তা নয়; বরং সে সমস্ত প্রবণতাকে শিল্পের অন্তর্ভূক্ত করবার অভিলাষে তিনি তাঁর শিল্পমানকে বিস্তৃততর করবার জন্য বিশেষভাবে চেষ্টা করেছেন। যেহেতু সেগুলি বাস্তবতার আতিশয্যের বিরুদ্ধে সঙ্গত প্রতিক্রিয়ার প্রতিনিধিত্ব করে বলেই তাঁর মনে হয়েছে। শিল্পজগতে যত মতিচ্ছন্নতার আবির্ভাবই হোক না কেন, আমাদের অভিজাত সমাজ কর্তৃক গৃহীত হওয়া মাত্রই সে শিল্পকে ব্যাখ্যা এবং সমর্থন জানাবার জন্য অতি দ্রুত একটি তত্ত্বও আবিষ্কৃত হয়। এ দেখে মনে হয় যেন ইতিহাসে এমন আর কোন যুগ দেখা যায়নি- যখন কোন কোন বিশেষ গোষ্ঠী ভ্রান্ত, বিকৃত, অর্থহীন শিল্পকে স্বীকৃতি দেয়নি বা সমর্থন জানায়নি, অথচ সে সকল শিল্প একেবারে বিস্মৃত হয়ে গেছে, এখন তার চিহ্নমাত্র নেই। বর্তমান যুগে আমাদের গোষ্ঠীর মধ্যে সৃষ্ট শিল্পকর্মের দিকে দৃষ্টিপাত করলেই শিল্পজগতে উন্মত্ততা এবং বিকৃতি কি পরিমাণ হতে পারে, বিশেষত আজকের দিনে শিল্পকে কিরূপ অভ্রান্ত বিবেচনা করা হয় তার একটা ধারণা পাওয়া যেতে পারে। সুতরাং সৌন্দর্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত যে শিল্পতত্ত্ব নন্দনতাত্ত্বিকদের দ্বারা ব্যাখ্যাত এবং খুব অস্পষ্টভাবে জনসাধারণ কর্তৃক স্বীকৃত তা হল আর কিছুই নয়-যা আমাদের অর্থাৎ একটি বিশেষ শ্রেণীর লোককে তৃপ্তি দিয়েছে এবং দিয়ে থাকে-তাকেই সৎ-শিল্প বলে তুলে ধরা।
কোন মানবিক কাজের সংজ্ঞা দিতে গেলে তার তাৎপর্য এবং গুরুত্ব উপলব্ধি করা প্রয়োজন। তার জন্য প্রথমেই সে ব্যাপারটি পরীক্ষা করে দেখতে হবে, যে কারণ পরস্পরার ওপর তা নির্ভরশীল এবং তার ফলশ্রুতি কি -তাও বিচার করতে হবে।
কোন কর্মের লক্ষ্য শুধু আমাদের আনন্দ মাত্র-যদি এই আমাদের বক্তব্য হয় এবং সে আনন্দের পরিপ্রেক্ষিতেই যদি আমরা তার সংজ্ঞা নিরূপণ করি তবে আমাদের সে সংজ্ঞা অনিবার্যভাবেই ভ্রান্ত প্রমাণিত হবে। কিন্তু শিল্পের সংজ্ঞা নির্ণয় প্রয়াসে ঠিক এ ধরনের ব্যাপারেই ঘটেছে। খাদ্যের প্রশ্ন বিবেচনায় জোরের সঙ্গে এ অভিমত প্রকাশ করা যায় না যে, আহারের সময় প্রাপ্ত আনন্দের মধ্যেই খাদ্যের মূল্য নিহিত। রসনার তৃপ্তিই খাদ্যের গুণাগুণ নির্ণয়ের একমাত্র ভিত্তি হতে পারে না-এটা সৰ্ববাদীসম্মত। সুতরাং আমাদের পূর্ব থেকেই মনে করবার কোন অধিকার নেই যে, গোলমরিচ, পনির, মদ প্রভৃতি যে আহার্যে আমরা অভ্যস্ত, এবং যে আহার্য আমাদের রসনার তৃপ্তি বিধান করে, তাই মানুষের সর্বোত্তম খাদ্য।
একই যুক্তি অনুসারে সৌন্দর্য অথবা আমাদের তৃপ্তিবিধায়ক বস্তুমাত্রই কোনক্রমেই শিল্প সংজ্ঞার ভিত্তি বলে বিবেচিত হতে পারে না। এ ছাড়া আমাদের আনন্দ দিতে সক্ষম এমন বস্তু পরস্পরাও শিল্পের সম্ভাব্য আদর্শ বিবেচিত হতে পারে না।
বর্বরদের মতো নিম্নতম নৈতিক বিকাশপ্রাপ্ত ব্যক্তিরাই ধারণা করে থাকে যে খাওয়ার সময় যে আনন্দ পাওয়া যায় আহার্যের উদ্দেশ্য ও সার্থকতা তাই। শিল্প থেকে যে আনন্দ পাওয়া যায় সেটাই শিল্পের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য-এই ধারণাও ওই বর্বরদের ধারণার অনুরূপ।
খাদ্যের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য আনন্দ বলে যে সমস্ত ব্যক্তি বুঝে থাকেন তারা যেমন খাদ্যগ্রহণের প্রকৃত অর্থ অনুধাবন করতে পারেন না, তেমনি যারা শিল্পের লক্ষ্য আনন্দ বলে বিবেচনা করেন তারা তার প্রকৃত অর্থ এবং উদ্দেশ্য হৃদয়ঙ্গম করতে অক্ষম। যেহেতু তারা একটি ক্রিয়ার ওপর এমন অর্থ আরোপ করেন যা প্রত্যক্ষভাবে জীবনের ইন্দ্রিয়গোচর বস্তুর অপর দিকের সঙ্গে সম্পর্কিত-যে দিককে বলা চলে শিল্পের ভ্রান্ত ও ঔপচারিক লক্ষ্য। খাদ্য গ্রহণ ক্রিয়ার উদ্দেশ্য আনন্দ-মানুষের এই ভ্রান্ত ধারণার তখনই নিরসন হয় যখন সে বুঝতে পারে খাদ্য গ্রহণের একমাত্র উদ্দেশ্য দেহের পুষ্টি। শিল্পকর্মের লক্ষ্য সৌন্দর্য অর্থাৎ আনন্দ-এ ধরনের বিবেচনা-মুক্ত হলেই মানুষ শিল্পের প্রকৃত অর্থ উপলব্ধি করবে। সৌন্দর্যের স্বীকৃতি (অর্থাৎ শিল্প-উদ্বৃত এক প্রকার আনন্দ) শিল্পের লক্ষ্য বিবেচিত হওয়ায় শিল্পের সংজ্ঞা নিরূপণে তা আমাদের সহায়তা করতে শুধু যে ব্যর্থ হয়েছে তা নয়, পরন্তু শিল্প-বহির্ভূত প্রদেশে তাকে প্রতিস্থাপিত করে (যেমন, অধিবিদ্যাগত, মনস্তাত্ত্বিক, শারীরতাত্ত্বিক, এমনকি ঐতিহাসিক এবং কোন বিশেষ সৃষ্টিকর্ম এক ব্যক্তিকে কেন আনন্দ দেয়-এই জাতীয় আলোচনা) শিল্পের সংজ্ঞা নিরূপণ-প্রয়াসকে অসম্ভব করে তোলে। যেহেতু কোন এক ব্যক্তি নাশপাতি খেতে, অপরজন মাংস খেতে ভালবাসে কেন-এ ধরনের বিতর্ক পুষ্টির মীমাংসায় রুচির প্রশ্ন (শিল্প সম্পৰ্কীয় আলোচনায় এ প্রশ্ন স্বতই উদ্ভুত হয়) শিল্পতত্ত্ব নামে অভিহিত বিশেষ মানবিক কর্মে রুচির প্রকৃত অবস্থান কোথায়-তা স্বচ্ছ করতে আমাদের সহায়তা করে না। বরং যে ধারণা সব রকমের শিল্পকেই সমর্থন করে সমস্ত শিল্প আলোচনায় বিভ্রান্তি ঘটায়, সে ধারণা থেকে মুক্ত না হলে শিল্প-স্বরূপের বিশদ ব্যাখ্যা একেবারে অসম্ভব।
এখন মূল প্রশ্নে ফিরে আসা যাক্। যে শিল্পের বেদীমূলে লক্ষ লক্ষ লোকের শ্রম, মানুষের জীবন, এমনকি নীতি পর্যন্ত সমর্পিত হয়েছে-সে শিল্প কী? প্রচলিত নন্দনতত্ত্ব থেকে আমরা এ প্রশ্নের যে সমস্ত উত্তর নিষ্কাশন করে নিয়েছি তার মর্মার্থ এই : শিল্পের লক্ষ সৌন্দর্য। আনন্দ দানেই সৌন্দর্যের পরিচয়। শৈল্পিক আনন্দ উত্তম এবং মূল্যবান বস্তু, যেহেতু তা আনন্দ। এক কথায় আনন্দই উত্তম, যেহেতু তা আনন্দ। এ দৃষ্টিতে দেখলে শিল্পের সংজ্ঞা বলে যা বিবেচিত, তা আদৌ কোন সংজ্ঞাই নয়, বরং তালগোল পাকিয়ে প্রচলিত শিল্পকে সমর্থন করবার এটি একটি কৌশল মাত্র। সুতরাং খুবই অদ্ভুত মনে হলেও একথা বলা চলে, শিল্প সম্পৰ্কীয় পর্বতপ্রমাণ বই লিখিত হওয়া সত্ত্বেও শিল্পের যথাযথ সংজ্ঞা এ পর্যন্ত নিরূপিত হয়নি। এর একমাত্র কারণ হল, সৌন্দর্যবিষয়ক ধারণার ওপরেই শিল্পের ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।