হোয়াট ইজ আর্ট – ১২

১২

[কৃত্রিম শিল্প সৃষ্টির কারণ। পেশাদারী। সমালোচনা। শিল্পের গোষ্ঠীসমূহ। প্ৰকৃত শিল্পকর্মের বৈশিষ্ট্য বলে স্বীকৃত সংক্রমণ সৃষ্টির জন্য শিল্পপ্রমূর্তির পরোৎকর্ষের প্রয়োজনীয়তা।]

কৃত্রিম শিল্পবস্তুর সৃজন ব্যাপারে আমাদের সমাজে তিনটি কারণের পারস্পরিক সহযোগিতা দেখা যায়। সেগুলি (১) শিল্পোৎপাদনের জন্য শিল্পীদের প্রভূত শ্রমমূল্য লাভ-শিল্পীদের মধ্যে যা পেশাদারী প্রবণতা সৃষ্টি করেছে (২) শিল্প সমালোচনা (৩) শিল্পগোষ্ঠীসমূহ।

শিল্প বিভাজনের পূর্ববর্তীকালে একমাত্র ধর্মীয় শিল্পই যখন মূল্যবান এবং পুরস্কারযোগ্য বিবেচিত হত এবং যদৃচ্ছ শিল্পসৃষ্টি সমাদৃত হত না-তখন পর্যন্ত কৃত্রিম শিল্পের অস্তিত্ব ছিল না। কোথাও এ পর্যায়ের শিল্পের অস্তিত্ব দেখা গেলেও তা সমগ্র জনসমাজের সমালোচনার সামগ্রীতে পরিণত হয়ে দ্রুত বিলয় প্রাপ্ত হত। কিন্তু এই বিভাজন ঘটার পর অভিজাতবর্গীয়েরা শুধুমাত্র তাদের আনন্দবিধানক্ষম হলেই যে কোন শিল্পকর্মকে সৎ-শিল্প আখ্যায় অভিহিত করতে লাগলেন এবং সেই শিল্পকে অপরাপর সামাজিক শ্রমের তুলনায় অধিকতর উচ্চ হারে পুরস্কৃত করতে লাগলেন। ফলে অনেক লোক সঙ্গ সঙ্গেই এই জাতীয় কাজে আত্মনিয়োগ করল, যার পরিণামে শিল্প সম্পূর্ণ ভিন্ন চরিত্র পরিগ্রহ করে পেশায় পরিণত হল।

শিল্পের এরূপ পরিণতি সংঘটনের সঙ্গে সঙ্গে শিল্পের মুখ্য এবং সব চাইতে মূল্যবান গুণ বলে স্বীকৃত অকৃত্রিমতা তৎক্ষণাৎ অত্যধিক দুর্বল হয়ে পড়ল এবং শেষে পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেল।

পেশাদার শিল্পীকে স্ব-সৃষ্ট শিল্পের সাহায্যেই জীবিকা নির্বাহ করতে হয় বলে শিল্পকর্ম সৃষ্টির জন্য ক্রমাগতই তাকে নতুন নতুন বিষয়বস্তু আবিষ্কার করতে হয় এবং তিনি তা আবিস্কার করেও চলেন। এটা খুবই স্পষ্ট, প্রাচীন শিল্পকর্মের সঙ্গে আধুনিক শিল্পের পার্থক্য বিরাট হতে বাধ্য। যেমন একদিকে ইহুদি ধর্মগুরুরা, স্তোত্র রচিয়তাগণ, আসিসির সন্ত ফ্রান্সিস, ইলিয়াড এবং ওডিসির লেখক, লোক-কাহিনির, রূপকথার এবং লোকসংগীতের লেখকগণ-যাদের মধ্যে অনেকেই শুধু যে তাঁদের রচনার জন্য কোন শ্রম-মূল্যই পাননি তা নয়, এমনকি তাঁদের রচনার সঙ্গে নিজেদের নামও যুক্ত করেননি। আর এক দিকে দেখা যায়-রাজসভায় কবি, নাট্যকার এবং সংগীতকারগণ যারা সম্মান ও শ্রমমূল্য উভয়ই লাভ করেছেন। এবং তারও পরবর্তীকালে পেশাদার শিল্পীরা-সংবাদপত্রের সম্পাদক, প্রকাশক, শিল্প-প্রযোজক থেকেই যে শুধু শ্রমমূল্য পান তাই নয়,-সাধারণভাবে শিল্পী এবং শিল্প-উপভোক্তা নাগরিক জনসমাজের মধ্যবর্তী দালালদের কাছ থেকেও শ্রমমূল্য লাভ করেন।

ভ্রান্ত এবং কৃত্রিম শিল্প ছড়িয়ে পড়ার প্রথম কারণ শিল্পের পেশাদারিত্ব।

দ্বিতীয় কারণ, সাম্প্রতিককালে শিল্প সমালোচনার বিকাশ। অর্থাৎ শিল্পের মূল্যায়ন যে কোন ব্যক্তি, বিশেষ করে সরল প্রকৃতির ব্যক্তিদের দ্বারা নির্ধারিত না হয়ে পণ্ডিতদের অর্থাৎ বিকৃত আত্মপ্রত্যয়সম্পন্ন ব্যক্তি বিশেষের দ্বারা হয় বলে শিল্পজগতে এই বিকৃতি। সমালোচকদের সঙ্গে শিল্পীদের সম্পর্কের কথা বলতে গিয়ে আমার জনৈক বন্ধু লঘূ কৌতূকের সঙ্গে তার ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন এভাবে : ‘সমালোচক মাত্রই নির্বোধ এবং তারা জ্ঞানীদের বিষয় আলোচনা করে। এ সংজ্ঞা যতই অসম্পূর্ণ, যথার্থহীন এবং রূঢ় মনে হোক না কেন, এর আংশিক সত্যথা অবশ্যগ্রহ্য। বস্তুতপক্ষে যে সংজ্ঞা অনুসারে সমালোচকদের শিল্পকর্ম ব্যাখ্যায় নিপুণ বলে গণ্য করা হয়, এই আলোচ্য সংজ্ঞা তদপেক্ষা অনেক গুণে যথার্থ।

‘সমালোচকেরা ব্যাখ্যা করেন!’ তাঁরা কী ব্যাখ্যা করেন?

শিল্পীকে যথার্থ শিল্পী হতে হলে তাঁর উপলব্ধ অনুভূতিকে রচনার সাহায্যে অপরের অন্ত রে সঞ্চারিত করে দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে ব্যাখ্যার কী আছে?

রচনা উত্তম শিল্পকর্ম হলে শিল্পী-অভিব্যক্ত নৈতিক বা দুর্নীতিপরায়ণ যে কোন অনুভূতিই অপরর অন্তরের সঞ্চারিত হবেই। অন্তরে সঞ্চারিত হলে অপরে তো অনুভব করবেনই। এবং তাই সকল ব্যাখ্যা-ভাষ্য সেখানে বাহুল্য মাত্র। শিল্পকর্ম মানুষকে সংক্রমিত করতে অসমর্থ হলে কোন ব্যাখ্যাই তাকে সংক্রমণশক্তি-সম্পন্ন করে তুলতে সমর্থ হয় না। শিল্পীর শিল্পকর্ম ব্যাখ্যার অতীত। তাঁর বক্তব্য যদি কথায় প্রকাশ করা সম্ভব হতো, শিল্পী তবে ভাষার সাহায্যেই আত্মপ্রকাশের আশ্রয় নিতেন। তাঁর উপলব্ধ অনুভূতি অপর উপায়ে সঞ্চার করে দেওয়া সম্ভব নয় বলেই তিনি শিল্পের সাহায্যে তা প্ৰকাশ করেন। শুধুমাত্র কথার সাহায্যে শিল্পকর্মের ব্যাখ্যার দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয় যে, ভাষ্যকার নিজের অন্তরে শিল্প-সংক্রমণ অনুভবে অক্ষম। বাস্তব ক্ষেত্রের অবস্থাও ঠিক তাই। যেহেতু এরূপ অভিমত যতই অদ্ভুত মনে হোক না কেন, সমালোচকেরা অপরাপর ব্যক্তি অপেক্ষা শিল্পের দ্বারা সংক্রমিত হবার ক্ষমতায় সর্বাধিক বঞ্চিত, এটা সত্য। অনেকাংশে তারা শক্তিমান লেখক, শিক্ষিত ও চতুর সন্দেহ নেই, কিন্তু তাদের শিল্প-সংক্রমিত হবার সামর্থ্য সম্পূর্ণ বিকারগ্রস্ত অথবা ক্ষয়প্রাপ্ত। সুতরাং তাদের সমালোচনা যারা পাঠ করে এবং তাদের কথায় যারা বিশ্বাস স্থাপন করে, সেই জনসাধারণের রুচি-বিকৃতির জন্য তাদের লেখাই পূর্বাপর বৃহৎ পরিমাণে দায়ি।

যে সমাজে শিল্প অবিভাজ্য এবং কাজে কাজেই সে সমাজে সর্বতোব্যপ্ত জীবনচেতনার দ্বারা শিল্পমূল্য নিরূপিত, সে সমাজে শিল্প সমালোচনার অস্তিত্ব তো ছিলই না, থাকতেও পারে না। শুধুমাত্র স্ব-যুগের ধর্মীয় অনুভূতির ওপর বিশ্বাসহীন উচ্চবর্গীয় লোকদের শিল্পের ওপরেই শিল্পসমালোচনার উদ্ভব এবং বিকাশ লাভ ঘটেছিল এবং ঘটা সম্ভব ছিল।

সর্বজনীন শিল্পের সুনির্দিষ্ট এবং সন্দেহাতীত অন্তর্নিহিত মানদন্ড হল ধর্মীয় অনুভূতি। উচ্চ পর্যায়ের শিল্পে এই অনুভূতির অভাব দেখা যায় বলে সে শিল্পের সমজদারেরা শিল্পবহির্ভূত মানদন্ড আঁকড়ে থাকতে বাধ্য হন। একজন ইংরেজ সৌন্দর্যবাদীর অভিমত অনুসারে সর্বোচ্চ বৈদগ্ধ্যসম্পন্ন ব্যক্তির সিদ্ধান্তের মধ্যেই এই মানদন্ডের পরিচয় নিহিত। অর্থাৎ যাঁরা শিক্ষিত বলে গণ্য এ বিষয়ে তাঁদের মতই প্রামাণ্য। এবং শুধু তাঁদের সিদ্ধান্তেই নয়, এ জাতীয় প্রামাণিকতার ঐতিহ্যের মধ্যেও তার অস্তিত্ব বিদ্যশান। এ ঐতিহ্য অতিমাত্রায় বিভ্রান্তিকর দ্বিবিধ কারণে : যেহেতু বৈদগ্ধ্যসম্পন্ন ব্যক্তিদের মতামত অনেক সময় ভ্রান্ত হয়। এ ছাড়া যে সিদ্ধান্ত এক কালে গ্রাহ্য বলে বিবেচিত হয়, কাল অতিক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে সে অবস্থার পরিসমাপ্তি ঘটে। কিন্তু সমালোচকদের সিদ্ধান্তের কোন ভিত্তি না থাকায় তারা কখনও সে শিল্প-ঐতিহ্যের পুনরাবৃত্তি করতে বিরত হন না। ক্লাসিকপন্থী ট্র্যাজেডি লেখকেরা এক সময় উত্তম স্ৰষ্টা বিবেচিত হতেন। সুতরাং সমালোচকদের নিকট তাঁরা এখন পর্যন্ত সে পর্যায়ের বিবেচিত হন। দান্তে একদা মহৎ কবি বলে গণ্য হতেন, অনুরূপভাবে রাফায়ল মহৎ চিত্রকর, বাখ্ (Bach) মহৎ সংগীতকার, কিন্তু উৎকৃষ্ট শিল্পকে নিকৃষ্ট থেকে পৃথক করবার একটা মানদন্ডের অভাবহেতু সমালোদচকবর্গ এই সমস্ত শিল্পীকে শুধু মহৎ মনে করেন না, তাঁদের সমস্ত শিল্পকর্মকেই প্রশংসনীয় এবং অনুকৃতিযোগ্য বিবেচনা করেন। সমালোচকদের দ্বারা প্রামাণ্য বলে স্বীকৃতি এই সব খ্যাতিমানেরাই শিল্পবিকৃতির জন্য পূর্বাপর যত বেশি দায়ি, তেমন আর কিছুই নয়। কোন ব্যক্তি যখন শিল্প সৃষ্টি করে, সে নিজের উপলব্ধ অনুভূতিকে নিজস্ব বিশেষ ভঙ্গিতে রূপ দান করে-প্রত্যেক খাঁটি শিল্পীও তাই করে থাকেন। অধিকাংশ লোক শিল্পীর অনুভূতির দ্বারা সংক্রমিত হন এবং এভাবে তাঁর শিল্পকর্ম লোকের গোচরে আসে। তারপর শিল্পী সম্পর্কে সমালোচনায় বলা হয় যে, শিল্পকর্মটি মন্দ নয়; তবে একই সঙ্গে এমন মন্তব্য করা হয় যে,-শিল্পী দান্তে নন, শেকস্পীয়র নন, গ্যেটে নন, রাফায়েল নন, এমনকি, শিল্পীজীবনের শেষ পর্যায়ে বেটোফেন যা -ঠিক সে রকমও নন। সমালোচকরা অনুকরণযোগ্য বলে তরুণ শিল্পীদের সামনে যে শিল্পাদর্শ তুলে ধরেন, তার অনুসরণেই শিল্পকর্মে তিনি অগ্রসর হন। এতে তিনি শুধু মূল্যহীণ শিল্পই সৃষ্টি করেন না, ভ্রান্ত শিল্পকর্ম অর্থাৎ কৃত্রিম শিল্পও সৃষ্টি করেন।

উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, আমাদের পুশকিন Evgeni Onegin, The Gipsies প্রভৃতি ক্ষুদ্র কবিতা লিখেছেন, এবং ছোটগল্পও লিখেছেন। গুণগতভাবে এ সমস্ত সৃষ্টিকর্মের তারতম্য আছে। কিন্তু এর সব ক’টিই অকৃত্রিম শিল্প। কিন্তু শেকস্পীয়রের প্রশংসা করে যে ভ্রান্ত সমালোচনা করা হয়, তার প্রভাবে পড়ে তিনি Boris Godunov লেখেন। এ রচনা হৃদয়ের উষ্ণতাবর্জিত, মস্তিষ্কপ্রসূত, অথচ এ সৃষ্টিকর্মই সমালোচকদের দ্বারা শুধু অভিননতি হয়নি, আদর্শ হিসেবেও খাড়া করা হয়েছে। ফলে এর অনুকৃতিও দেখা দিল : যেমন, Ostrovski-কৃত Minin, এলেক্স টলস্টয় (Alexey Tolstoy) লিখিত Tsar Boris। এ সমস্ত অনুকৃতির অনুকৃতি মূল্যহীন সৃষ্টিকর্মের আবর্জনায় সমস্ত সাহিত্যে ভিড় জমাচ্ছে।

সমালোচকেরা সৃষ্টি জগতে যে বড় রকমের ক্ষতি করে থাকেন তা এই : শিল্প-সংক্রমিত হবার ক্ষমতা আয়ত্তে না থাকায় (এবং এটাই সমস্ত সমালোচকের বৈশিষ্ট্য, যেহেতু এরূপ ক্ষমতার অভাব না ঘটলে তারা শিল্পকর্মের ব্যাখ্যা রচনার মতো অসম্ভব কিছু করবার প্রয়াস পেতেন না) তারা মস্তিষ্কপ্রসূত অভিনব শিল্পকর্মের প্রতি সে সর্বাধিক মনোযোগী হন এবং সে পর্যায়ের শিল্পকর্মের শুধু যে প্রশংসা করেন তা নয়, শিল্পকর্ম রচনায় সেগুলিকেই অনুকরণের যোগ্য আদর্শ হিসেবে তুলে ধরেন। এ কারণেই তারা এত প্রত্যয়ের সঙ্গে গ্রীক ট্র্যাজেডিকারদের, দান্তে, ট্যাসো, মিল্টন, শেকস্পীয়র, গ্যেটের রচনা (তিনি যা লিখেছিলেন তার প্রায় সমস্ত কিছুর) এবং সাম্প্রতিক লেখকদের মধ্যে জোলা, এবং ইবসেন, বেটোফেনের শেষ পর্যায়ের সংগীত এবং হ্বাগ্‌নার প্রভৃতির উচ্চ প্রশংসা করেন। তাদের প্রশংসিত এ সমস্ত মস্তিস্ক-প্রসূত অভিনব কর্মের সমর্থনের জন্য তারা কতকগুলি সামগ্রিক তত্ত্বের উদ্‌ভাবন করে বসেন (তার মধ্যে বিখ্যাত সৌন্দর্যতত্ত্ব একটি)। শুধু স্থুল বুদ্ধিসম্পন্ন নয়, প্ৰতিভাবান শিল্পীরাও এ সমস্ত তত্ত্বের সঙ্গে নিখুঁত সঙ্গতি বজায় রেকে শিল্পকর্ম রচনা করেন। এর পরিণতিতে দেখা যায়, খাঁটি শিল্পীরা পর্যন্ত কোন কোন সময় তাঁদের প্রতিভার অপচয় করে এ সমস্ত তত্ত্বের নিকট আত্নসমর্পণ করেন।

সমালোচকদের দ্বারা উচ্চ প্রশংসিত প্রত্যেকটি ভ্রান্ত শিল্পকর্মের প্রবেশপথ দিয়ে ভন্ড শিল্পীরা তৎক্ষণাৎ শিল্পরাজ্যে ভিড় করে।

আমরা সফোক্লিস, ইউরিপিডিস, ইসকাইলাস, বিশেষ করে এরিস্টোফেনিস প্রভৃতি প্রাচীন গ্রীকদের রুক্ষ, অমার্জিত এবং আমাদের পক্ষে অর্থহীন রচনার যে প্রশংসা করি তা মুখ্যত এই যুগের সমালোচকদের প্রভাবেই। অনুরূপভাবে আমরা দান্তে, ট্যাসো, মিল্টন, শেকস্পীয়র প্রভৃতি আধুনিক লেখকদেরও প্রশংসা করি। চিত্রশিল্পে রাফায়েলের সমস্ত চিত্র, মিকেলেঞ্জেলোর সমস্ত সৃষ্টি (তাঁর উদ্ভট ‘শেষ বিচার’সহ), সংগীত বাখ্ (Bach)-এর সব কিছু এবং বেটোফেনের শেষ পর্যায়ের সংগীতসহ সমগ্র সংগীতের যে প্রশংসা করি-সেও কেবল এই সমালোচকদের প্রভাবে পড়ে। এ ছাড়াও এ যুগে যে ইবসেন, মেটারলিঙ্ক, ভেরলেন, মালার্মে, পুভি দ্য শাভান (Puvis de Chavanne), ক্লিঙ্গার (Kliner), বোকলিন (Bocklin), স্টুক (Stuck), স্নাইডার (Schneider)-দের এবং সংগীতে হ্বাগ্‌নার (Wagner), লিস (Liszts), বেলিংও (Berliozes), ব্রাহ্মস (Brahmses) এবং রিচার্ড স্ট্রাউস-দের এবং সমস্ত অনুকারীর অপদার্থ অনুকারীর দলের উৎপত্তি যে সম্ভব হয়েছে, সেও কেবলমাত্র এই জাতীয় সমালোচকদেরই কল্যাণে। সমালোচনার অনিষ্টকর প্রভাব সম্পর্কে ভালো দৃষ্টান্ত হিসেবে বেটোফেনের সংগীত সম্পর্কে আলোচনার উল্লেখ করা যেতে পারে। তাঁর অত্যন্ত দ্রুতগতিতে সম্পাদিত ফরমায়েশি সৃষ্টিকর্মের মধ্যে আঙ্গিক সম্পর্কিত কৃত্রিমতা সত্ত্বেও প্রকৃত শিল্পসৃষ্টির সন্ধান পাওয়া যায়। কিন্তু সুরের কান তিনি ক্রমশ হারিয়ে ফেলেন, সুরের মাধুর্য শুনতে পান না, এবং এমন শিল্পকর্ম রচনা আরম্ভ করেন-যা উদ্‌ভাবিত, অসম্পূর্ণ, সুতারং অনেক সময় অর্থহীন এবং সংগীত হিসেবে দুর্বোধ্য। এটা আমি জানি যে, সংগীতজ্ঞরা খুব স্পষ্টভাবে ধ্বনির কল্পনা করতে পারেন, স্বরলিপি পাঠ করার সময় সে ধ্বনিগুলি প্রায় শুনতেই পায়। কিন্তু কল্পিত ধ্বনি কখনও বাস্তব ধ্বনির সমপর্যায়ভুক্ত হতে পারে না, এবং সুরসৃষ্টিকে সম্পূর্ণতা দিতে হলে প্রত্যেক সুরকারকে অবশ্যই নিজ-সৃষ্ট সুর শুনতে হবে। বেটোফেন কিন্তু সে সুর শুনতে পেতেন না, কাজেই তাঁর সৃষ্টিকে সম্পূর্ণতাও দিতে পারেননি। ফলে তিনি এমন সৃষ্টি করেছেন-যা উন্মত্ত শৈল্পিক প্রলাপের মতো শোনায়। কিন্তু সমালোচকগণ তাকে একবার মহৎ সুরকার বলে স্বীকৃতি দেওয়ায় তাঁর এই সব অস্বাভাবিক শিল্পকর্মও পরম আদরের সঙ্গে গৃহীত হতে থাকে এবং সংগীতরসিকেরা তার মধ্যে অসামান্য সৌন্দর্যের সন্ধানও করে থাকেন। এবং এই সব প্রশংসার সমর্থনের জন্য সমালোচকগন (সংগীতশিল্পের অর্থটিকেই বিকৃত করে) যে বর্ণনা সংগীতের সাধ্যতীত-তাও সংগীতে আরোপ করেন। এভাবে অনুকারীর দল জুটে যায়-এবং সুর উপভোগের শ্রবণ-সামর্থ্য হারিয়ে ফেলা অবস্থায় বেটোফেন যে সুর সৃষ্টির অস্বাভাবিক প্রয়াস পেয়েছিলেন-অসংখ্য অনুকারী সেগুলির অনুকরণ শুরু করে।

এর পর আবির্ভাব হয় হ্বাগ্‌নারের। তিনি তাঁর সমালোচনাত্মক প্রবন্ধগুলিতে বেটোফেনের এই শেষ পর্যায়ের সৃষ্টিকর্মকেই প্রশংসা করেন। বেটোফেনের সংগীতের সঙ্গে তিনি সোপেনহাওয়ারের ‘সংগীত যে এষণারই অভিব্যক্তিমাত্র’-এই অতীন্দ্রিয় তত্ত্বের একটি সম্পর্ক স্থাপন করেন। তিনি বলেন, এ সংগীত বিভিন্ন স্তরে বস্তুরূপায়িত পৃথক এষণার অভিব্যক্তি নয়, বরং তারই সারবস্তু–যা বেটোফেনের সংগীতের রচনা করেন। সেই সংগীত রচনাকালে তিনি ওই তত্ত্বের সঙ্গে আর একটি ভুল ধারণার সংযোগ সাধন করেন যে-সংগীতজগৎ শিল্পের সমন্বয়ী রূপ। হ্বাগ্‌নারের পরে শিল্পজগৎ থেকে আরও বহুদূর অপসৃত নতুন অনুকারীর দলের আবির্ভাব হল : এঁরা হলেন ব্রাহ্মস (Brahmses), রিচার্ড স্ট্রাউস ( Richard Strauss) এবং আরও অনেকে। এই হল সমালোচনার পরিণতি। কিন্তু শিল্পবিকৃতির তৃতীয় উপাদান অর্থাৎ শিল্পবিদ্যাসমূহ সম্ভবত আরও অধিকতর বিপজ্জনক।

যে মুহূর্তে শিল্প সর্বসাধারণের জন্য সৃষ্টি না হয়ে কেবলমাত্র ধনিক শ্রেণীর জন্য সৃষ্টি হতে শুরু করল, তখন থেকে তা ব্যবসায়ে পরিণত হবার সঙ্গে সঙ্গে তার শিক্ষণ পদ্ধতিসমূহও উদ্‌বাবিত হল। যে সমস্ত ব্যক্তি শিল্পকে ব্যবসা হিসেবে নির্বাচন করলেন, তাঁরা এ সমস্ত পদ্ধতি শিখতে লাগলেন। এভাবে ব্যবসাভিত্তিক শিল্পবিদ্যালয় গজিয়ে উঠল। জনসাধারণের জন্য শিক্ষায়তনের প্রতিষ্ঠা হল, সংগীতের জন্য সংগীতের এবং নাট্যশিল্পের জন্যও বিদ্যায়তন দেখা দিল।

শিল্প-বিদ্যালয়

এই পর্যায়ের বিদ্যালয়েই শিল্প শিক্ষা দেওয়া চলতে লাগল। কিন্তু শিল্পী নিজের অন্তরে যে বিশেষ অনুভূতি উপলব্ধি করেন, অপর মনে তার সঞ্চরণক্রিয়াই তো শিল্প। কিন্তু কোন শিল্প, বিদ্যালয়ে এরূপ কি প্রকারে শেখানো সম্ভব?

বস্তুতপক্ষে কোন বিদ্যালয়ের পক্ষে ব্যক্তিবিশেষের অন্তরে অনুভূতি উদ্রেক করা সাধ্য নয়। এবং সে অনুভূীতর আপন বিশিষ্ট শৈলীতে অভিব্যক্তি দান যে কোন বিদ্যালয়ের পক্ষে আরও অসাধ্য। অথচ শিল্পের সারবস্তু তো এই সমস্তের মধ্যেই নিহিত।

কোন শিল্পী তাঁর উপলব্ধ অনুভূতিগুলিকে কি উপায়ে সঞ্চারিত করেছেন- এই একমাত্র বিষয়ই এই সমস্ত বিদ্যালয় শিক্ষা দিতে সক্ষম। ব্যবসাভিত্তিক বিদ্যালয় বস্তুতপক্ষে এ ধরনের শিক্ষাই দিয়ে থাকে। এ পর্যায়ের শিক্ষা অকৃত্রিম শিল্প বিস্তারে সহায়তা তো করেই না, পরস্তু মেকি শিল্পকে বহুব্যাপ্ত করে জনসাধারণকে অধিক পরিমাণে প্রকৃতি শিল্প-উপলব্ধি ক্ষমতাবঞ্চিত করে।

যে বিষয়বস্তু সম্পর্কে তারা কখনও ভাবেনি, যাদের নিজস্ব কোন বক্তব্য নেই, কিভাবে সে বিষয়ে বহু পৃষ্ঠ-সমন্বিত একটি রচনা লেখা যায়, সাহিত্য-শিল্প বিদ্যালয়ে সে শিক্ষাই দেওয়া হয়। উপরন্তু সে শিক্ষা এমনভাবে দেওয়া হয়-যাতে রচনাটি বিখ্যাত বলে স্বীকৃত কোন লেখকের রচনার সঙ্গে সাদৃশ্যযুক্ত মনে হয়।

চিত্রশিল্পে মুখ্য প্রশিক্ষণ হল, অনুকৃতি এবং মডেল থেকে ঠিক সেই ধরনের বস্তু রেখাচিত্র এবং বর্ণে আঁকতে শেখা, প্রধানত নগ্নদেহ অঙ্কন (যা কখনও দৃষ্টিগোচর হয় না এবং প্রকৃত শিল্পচর্চায় ব্যাপৃত শিল্পীদের খুব কম ক্ষেত্রেই যার রূপ দিতে হয়) এবং পূর্ববর্তী শিল্পাচর্যরা যেভাবে তাঁদের ছবিতে রেখা এবং রঙের বিন্যাস করেছিলেন তদনুরূপ রেখা এবং রঙের ব্যবহার শেখা। পূর্ববর্তী স্বীকৃত খ্যাতিমান শিল্পীরা যে বিষয়বস্তুর সাহায্যে চিত্রশিল্পের রূপ দিতেন, অনুরূপ বিষয়বস্তুর সাহায্যে চিত্রাঙ্কন শেখানো হয়।

খ্যাতিমান বিবেচিত ট্র্যাজেডি অভিনেতারা যেভাবে শব্দাড়ম্বরবহুল ভাষায় ভাবোচ্ছ্বাসপূর্ণ আবৃত্তি করতেন, নাট্যশিক্ষালয়ের ছাত্রদেরও সেভাবে স্বগতোক্তি আবৃত্তিতে অভ্যাস করানো হয়।

সংগীতেও চলছে ঠিক একই ব্যাপার। স্বীকৃত শ্রেষ্ঠ সংগীত-রচয়িতারা যে পদ্ধতিগুলি ব্যবহার করেছেন, সংগীতের সামগ্রিক তত্ত্বও সে সমস্ত পদ্ধতির পারস্পর্যহীন পুনরাবৃত্তি ছাড়া আর কিছু নয়।

অন্যত্র আমি রুশ শিল্পী Bryulov শিল্প সম্পর্কে যে গভীর অর্থপূর্ণ মন্তব্য করেছেন তার উদ্বৃতি দিয়েছি। এখানে তার পুনরাবৃত্তি না করে আমি পারছি না, যেহেতু বিদ্যালয়গুলিতে কি শিক্ষা দেওয়া সম্ভব এবং কি সম্ভব নয়-এর চাইতে ভালো দৃষ্টান্ত দিয়ে তা বোঝানো যায় না। একজন ছাত্রের পাঠ শুদ্ধিকরণের সময় Bryulov মাত্র কয়েকটি জায়গা দেখিয়ে দিয়েছিলেন, এবং সেই নিম্নস্তরের নিষ্প্রাণ পাঠ তৎক্ষণাৎ খুবই প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিল। ‘যেহেতু আপনি শুধু এর একটু মাত্র ছুঁয়ে দিয়েছেন অমনি সেটি সম্পূর্ণ অপর জিনিসে রূপান্তরিত হয়েছে’-একথা বলেছিল ছাত্রদের মধ্যে একজন। ইষড়া উত্তর দিয়েছিলেন, ‘ওই একটুকুর মধ্যেই শিল্পের প্রারম্ভ।’ -এ কথাগুলির দ্বারা তিনি শিল্পের সর্বাপেক্ষা বড় বৈশিষ্ট্য কী-তার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এ মন্তব্য সকল শিল্প সম্বন্ধেই সত্য, কিন্তু সংগীত অনুষ্ঠানের মধ্যেই এই উক্তির সার্থকতা বিশেষভাবে লক্ষিত হয়। সংগীতকে শৈল্পিক অর্থাৎ শিল্পস্বরূপে পরিণতি লাভের জন্য অর্থাৎ সংক্রমণশক্তি অর্জনের জন্য তিনটি প্রধান শর্ত অবশ্যই পালন করতে হবে। সাঙ্গীতিক পরোৎকর্ষ লাভের জন্য আরও অনেক গুণের প্রয়োজন আছে : একটি ধ্বনি থেকে অপর ধ্বনিতে উত্তরণের প্রক্রিয়া অবশ্যই বিরতিপূর্ণ অথবা অবিচ্ছিন্ন হবে : ধ্বনির উত্থান বা হ্রাসপ্রাপ্তি ঘটবে খুবই স্থিরগতিতে; অপর ধ্বনির সঙ্গে না মিশিয়ে একটি বিশেষ ধ্বনির সঙ্গে মিশ্রণ ঘটাতে হবে; সে ধ্বনির বিচিত্র সুর-বৈশিষ্ট্য অবশ্যই থাকবে, এ ছাড়া আরও বৈশিষ্ট্য থাকতে পারে, কিন্তু তা হবে তিনটি প্রধান শর্ত অনুযায়ী : তা নির্দিষ্ট সুরে বাঁধা থাকবে, বিশেষ তালে নিবদ্ধ হবে এবং তাতে থাকবে ধ্বনির বলিষ্ঠতা। সংগীতক্রিয়া শিল্প পর্যায়ে উত্তীর্ণ হয়ে সংক্রমণ ঘটাতে তখনই সমৰ্থ হয়-যখন ব্যবহৃত ধ্বনি যোগ্যমাত্রা থেকে একটু উঁচু বা নিচু না হয়, অর্থাৎ সুরের সূক্ষ্মতম কেন্দ্রবিন্দুটিকে গ্রহণ করা হয়, ঠিক যতটুকু প্রয়োজন সুরটিকে ততটুকুই দীর্ঘায়িত করা হয় এবং ধ্বনির সরলতা প্রয়োজনের একটুও কম বা বেশি না হয়। স্বরগ্রামের উঁচু নিচু তালের গতির সামান্যতম হ্রাসবৃদ্ধি অথবা ধ্বনির প্রয়োজনাতিরিক্ত শক্তিবৃদ্ধি কিংবা হ্রাস-এ সবই সাংগীতিক পরোৎকর্ষের ধ্বংসের কারলন হয়, এবং কাজে কাজেই তার সংক্রামকতাকেও বিনষ্ট করে। সুতরাং সংগীতশিল্পসৃষ্ট সংক্রমণের অনুভূতি অত্যন্ত সরল এবং সহজলভ্য মনে হলেও তা একমাত্র তখনই পাওয়া সম্ভব যখন সংগীতশিল্পী সংগীতে পরোৎকর্ষের জন্য প্রয়োজনীয় সীমাহীন সূক্ষ্মতম পরিমাপগুলির নির্ভুল সন্ধান পান। সকল শিল্প সম্পর্কে এই এক কথাই প্রযোজ্য : চিত্রশিল্পে ডানে বা বাঁয়ে একটুখানি হাল্কা বা একটুখানি গাঢ়তা; একটু বর্ণাঢ্যতা বা একটু লঘুতা; নাট্যশিল্প স্বরকেম্পনের একটু ক্ষীণতা বা শক্তিবৃদ্ধি বা একটুখানি দ্রুত বা ধীর গতি; কবিতায় কোথাও কানিকটা বাদ দিয়ে, কোথাও অতিরিক্ত জোর দিয়ে বা অতিরঞ্জিত করে বলা,-সর্বত্রই এর ফল সংক্রমণের বিনষ্টি। শিল্পী যখন শিল্পকর্মধৃত অতিসূক্ষ্ম পরিমাপগুলি নির্ভুল প্রয়োগ করতে পারেন-একমাত্র তখনই সংক্রমণ ঘটে, এবং শিল্পী এ বিষয়ে যে পরিমাণে সিদ্ধিলাভ করেন সে পরিমাণে সংক্রমণও ঘটে থাকে। বাহ্যিক কোন উপায়ের সাহায্যে মানুষকে এ সমস্ত সূক্ষ্মতম পরিমাপগুলি খুঁজতে শেখানো সম্পূর্ণ অসম্ভব। একমাত্র অনুভূতি-প্রভাবিত হলেই মানুষ সেগুলির সন্ধান পায়। কোন শিক্ষাই নৃত্যশিল্পীকে সংগীতের ছন্দথ-লয়ের নির্ভুল মর্মগ্রহণে সাহায্য করতে পারে না, তেমনি কোন শিক্ষাই গায়ক বা সেতারীকে তাঁর সুরের সূক্ষ্মতম কেন্দ্র সম্পর্কে অবহিত করতে পারে না, অথবা কোন চিত্রশিল্পীকে সম্ভাব্য সকল রেখার মধ্যে যথোপযোগী রেখাটি আঁকতে সহায়তা করে না কিংবা কোন কবিকে যোগ্যতম শব্দরাজির সার্থকতম বিন্যাস উদ্‌ভাবনে সাহায্য করতে অক্ষম। কেবলমাত্র অনুভূতির সাহায্যেই এ সমস্ত শৈল্পিক সূক্ষ্ম জ্ঞান আয়ত্ত করা সম্ভব। সুতরাং বিদ্যালয়গুলি শিল্পসদৃশ কিছু বস্তু উৎপাদনক্ষম প্রয়োজনীয় শিক্ষা দিতে পারলেও প্রকৃত শিল্পসৃষ্টির শিক্ষা কখনও দিতে পারে না।

যেখানে শিল্পের সূক্ষ্মতম পরিমাপচেতনার উদ্ভট ঘটে অর্থাৎ প্রকৃত শিল্পের উল্লেখ শুরু হয়, সেখানেই বিদ্যালয়-প্রদত্ত শিক্ষার অবসান। মানুষকে শিল্পসদৃশ্য কোন বস্তুচর্চায় অভ্যস্ত করানো মানে তাকে সৎশিল্প উপলব্ধির ক্ষমতা বঞ্চিত করা। এবং এজন্যই দেখা যায় যে, ব্যবসায়ী বিদ্যালয়গুলি থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে পরীক্ষোত্তীর্ণ ছাত্রদের থেকে শিল্পঅনুভূতিহীন ব্যক্তি সচরাচর দৃষ্ট হয় না। সাধারণত পুরোহিত, যাজক, এবং ধর্মশিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য ধর্মতত্ত্ববিষয়ক কলেজ-প্রদত্ত শিক্ষায় ধর্মবিষয়ে যে ভন্ডামি জন্মে, ব্যবসাভিত্তিক শিল্পবিদ্যালয়গুলিকে শিক্ষাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মনেও শিল্পবিষয়ে সেই একই পর্যায়ের ভন্ডামির সৃষ্টি হয়। কোন বিদ্যালয় কোন ব্যক্তিকে ধর্মগুরুর আসনে উন্নীত হবার প্রশিক্ষণ দেওয়া যেমন কোনক্রমেই সম্ভব নয়, তেমনি কোন ব্যক্তিকে শিল্পী হওয়ার উপায় শিক্ষা দেওয়া অসম্ভব।

শিল্পবিদ্যালয়গুলি এভাবে দুদিক থেকে শিল্পের ধ্বংসের কারণ হয়। প্রথমত, যারা দুর্ভাগ্যবশত সে সমস্ত বিদ্যালয়ে প্রবেশ করে এবং সাত-আট বৎসর কালব্যাপী শিক্ষাক্রম গ্রহণ করে,-বিদ্যালয়গুলি তাদের অকৃত্রিম শিল্প উৎপাদনের ক্ষমতা সম্পূর্ণ ধ করে দেয়। দ্বিতীয়ত, তারা এত বৃহৎ পরিমাণে কৃত্রিম শিল্প উৎপাদন করে চলে যে, তা জনসাধারণের রুচির যেমন বিকৃতি সাধন করে, তেমনি আবর্জনা স্তূপেও পৃথিবীকে ভরে তোলে। সহজাত প্রতিভাবান শিল্পীরা পূর্বতন শিল্পী-উদ্ভাবিত বিভিন্ন শিল্পের পদ্ধতি সম্পর্কে যাতে ওয়াকিবহাল হতে পারে, সেজন্য প্রত্যেক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অঙ্কন এবং সংগীত (কণ্ঠ সংগীত) শিক্ষণের ব্যবস্থা থাকা উচিত, যাতে সে বিদ্যালয়গুলিতে পরীক্ষোত্তীর্ণ প্রত্যেক প্রতিভাবান ছাত্র সর্বজনবোধ্য প্রচলিত শিল্পাদর্শ অনুশীলনের সাহায্যে স্বাধীন প্রয়াসের দ্বারা শৈল্পিক উৎকর্ষ আয়ত্ত করতে পারে।

শিল্পীর ব্যবসায়িকতা, শিল্প সমালোচনা, এবং শিল্প বিদ্যালয়গুলি-এই ত্রিবিধ কারণ সমবায় যে পরিণতি সৃষ্টি করেছে তা এই : আমাদের কালের অধিকাংশ মানুষ শিল্প কি বস্তু তা অনুধাবনে সম্পূর্ণ অসমর্থ হয়ে পড়েছে এবং তারা শিল্পরাজ্যের স্থূলতম কৃত্রিমতাকেই শিল্প বলে গ্রহণ করছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *