হোয়াট ইজ আর্ট – ৩

[বৌমগার্টেন থেকে বর্তমান যুগ পর্যন্ত বিভিন্ন নন্দনতাত্ত্বিক মত ও সংজ্ঞার সংক্ষিপ্তসার। এ অধ্যায়ে দেখা যাবে শিল্পের কোন সন্তোষজনক সংজ্ঞা উদ্ভাসিত হয়নি। এ সংজ্ঞা নির্দেশ এমন বস্তু অনেক পাঠক যা এড়িয়ে যেতে বা আলতোভাবে ছুঁয়ে যেতে পছন্দ করে। মন্তব্যের নঞর্থক দিক ছাড়া এর মধ্যে টলস্টয়ের নিজস্ব চিন্তার কোন অস্তিত্ব নেই।]

নন্দনতত্ত্বের প্রবর্তক বৌমগার্টেনের (১৭১৪-১৭৬২) কথা দিয়েই আমি শুরু করছি। বৌমাগার্টেনের (Baumgarten) মতে যুক্তিনির্ভর জ্ঞানের লক্ষ্য সত্য, নান্দনিক (অর্থাৎ ইন্দ্রিয়জ) জ্ঞানের লক্ষ্য সৌন্দর্য। বিচারের দ্বারা উপলব্ধ চরম উৎকর্ষই সত্য। নৈতিক এষণার সাহায্যে প্রাপ্ত চরম উৎকর্ষই মঙ্গল।

পারস্পরিক সামঞ্জস্যকে বৌমগার্টেন শিল্পের সংজ্ঞা বরে নির্দেশ দিয়েছেন। অর্থাৎ পারস্পরিক সম্বন্ধযুক্ত অংশগুলির সুশৃঙ্খল বিন্যাস এবং সমগ্রের সঙ্গে সুসমঞ্জস সম্পর্কই সৌন্দর্য। সৌন্দর্যের লক্ষ্য আনন্দবিধান বা কোন আকাঙ্ক্ষার উদ্রেক করা- কান্ট-এর সৌন্দর্যের লক্ষণ এবং স্বভাব সংক্রান্ত সংজ্ঞার যা সম্পূর্ণ বিপরীত।

সৌন্দর্যের বহিঃপ্রকাশ বিষয়ে বৌমগার্টেন মনে করেন, সৌন্দর্যের সর্বোচ্চ অভিব্যক্তি নিসর্গ প্রকৃতিতে দৃষ্ট হয়। সুতরাং তাঁর মতে সৌন্দর্যের সর্বোচ্চ লক্ষ্য প্রকৃতির অনুকরণ। (সর্বাধুনিক নন্দনতত্ত্ববাদীদের সিদ্ধান্তে এ মতেরও সোজাসুজি প্রতিবাদ করা হয়েছে)।

মাইয়ার (Maier), এশেনবুর্গ (Echenburg), এবেরহার্ড (Eberhard) প্রভৃতি নন্দনতত্ত্ববিদরা বৌমগার্টেনের অপ্রধান অনুবর্তীবর্গ তাঁরা সুন্দর প্রীতপ্রদ বস্তুর পার্থক্য নির্দেশ করে গুরুর মতবাদকে কিঞ্চিৎ সংশোধিত করেছিলেন। তাঁদের কথা ছেড়ে দিয়ে বৌমগার্টেনের অব্যবহিত পরবর্তী যে সমস্ত লেখক সৌন্দর্যকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাখ্যা করেছিলেন আমি তাঁদের সংজ্ঞাগুলির উদ্ধৃতি দেব।

এ সমস্ত লেখক হলেন সুত্সার (Sultzer), মেনডেলসন্ (Mendelsson) এবং মরিস (Moritz)। তাঁরা বৌমগার্টেনের মূল বক্তব্যের বিরোধিতা করে সৌন্দর্যের স্থলে মঙ্গলকেই শিল্পের লক্ষ্য বলে ধার্য করেছেন। যেমন সুসার (Sultzer 1720-1777) বলেন, যা মঙ্গলময় একমাত্র তাই সুন্দর বলে বিবেচ্য। এ মত অনুসারে মানুষের সমগ্র জীবনের লক্ষ্য সমাজজীবনের হিত। নৈতিক অনুভূতির অনুশীলনের দ্বারাই সে হিত লভ্য এবং শিল্পের উচিত এ লক্ষ্যের অনুবর্তী হওয়া। যে বস্তু এ নৈতিক অনুভূতিকে উদ্ভিক্ত ও পরিশীলিত করে-তাই সৌন্দর্য।

মেনডেনসও (১৭২৯-১৭৮৬) প্রায় এভাবেই সৌন্দর্যকে বুঝতে চেয়েছেন। তাঁর মতে সৌন্দর্যের বিকাশই শিল্প এবং যতক্ষণ তা সত্য ও মঙ্গলের রূপ লাভ না করে, তা আমাদের অনুভূতির কাছে স্পষ্টভাবে ব্যক্ত হয় না। শিল্পের লক্ষ্য নৈতিক পরোৎকর্ষ এ গোষ্ঠীর নন্দনতাত্ত্বিকদের নিকট সৌন্দর্যের আদর্শ হল সুন্দর দেহের অন্তর্গত সুন্দর আত্মা। কাজেই বৌমাগার্টেন যে পরমকে সত্য, মঙ্গল এবং সৌন্দর্যে ত্রিধাবিভক্ত করেন তা এ গোষ্ঠীর দ্বারা সম্পূর্ণ অস্বীকৃত। এবং সৌন্দর্য পুনর্বার সত্য ও মঙ্গলের সঙ্গে একাত্মতা লাভ করে।

কিন্তু এ ধারণা পরবর্তী নন্দনতাত্ত্বিকদের দ্বারা শুধু যে পরিত্যক্ত হয়েছে তাই নয়, বরং এ তত্ত্বের সম্পূর্ণ বিপরীত কোটিতে ভিনকেলমানের (Winckelmann) নান্দনিক মতবাদের উদ্ভব হয়েছে। এই মতবাদ শিল্পের লক্ষ্যকে মঙ্গলের লক্ষ্য থেকে সর্বাপেক্ষা তীক্ষ্ণ এবং খুবই দৃঢ়ভাবে পৃথক করেছে, বহিঃসৌন্দর্যকে শিল্পের লক্ষ্য বলে ঘোষণা করেছে, এমনকি দৃশ্যমান সৌন্দর্যের মধ্যে শিল্পকে সীমাবদ্ধ করেছে।

ভিনকেলমানের (Winckelmann 1717-1767) বিখ্যাত গ্রন্থ অনুসারে সকল শিল্পের প্রকৃতি এবং উদ্দেশ্য কেবলমাত্র সৌন্দর্যই-যে সৌন্দর্য মঙ্গল থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন এবং মঙ্গল নিরপেক্ষ। তিন রকমের সৌন্দর্য আছেঃ (১) গঠনগত সৌন্দর্য, (২) ভাবের সৌন্দর্য যা মূর্তির মধ্যে স্বতঃ প্রকাশিত (মৃৎ শিল্প), (৩) প্রকাশের সৌন্দর্য-যার উপস্থিতি অনুভব করা যায় একমাত্র তখনই যখন শিল্পদেহে প্রথম দুইটি বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান থাকে।

বস্তুতপক্ষে প্রকাশের সৌন্দর্যই শিল্পের চরম লক্ষ্য যা প্রাচীন শিল্প সম্পূর্ণ আয়ত্ত করেছিল। সুতরাং প্রাচীন শিল্পের অনুকরণই আধুনিক শিল্পের আদর্শ হওয়া উচিত। লেসিং, হারডার (Herder) এবং পরবর্তীকালে গ্যেটে এবং কান্ট পর্যন্ত জার্মানির সকল উল্লেখযোগ্য নন্দনতত্ত্ববিদেরাই শিল্পের তাৎপর্য এ ভাবেই উপলব্ধি করেছিলেন। কান্টের যুগ থেকে অবশ্য শিল্পের অপর একটি পৃথক ধারণা পুনরায় সৃষ্টি হয়েছে। এ সময়ে ইংলন্ড, ফ্রান্স, ইতালী এবং হলান্ডে তৎস্থানিক নন্দনতাত্ত্বিক মতবাদের উদ্ভব হয়। জার্মান উৎস থেকে গৃহীত না হলেও সেগুলি সমভাবে ধোঁয়াটে এবং স্ব- বিরোধিতাপূর্ণ ছিল। জার্মান নন্দনতাত্ত্বিকদের মতো এ সমস্ত লেখকও সুন্দরের ধারণার ওপর তাঁদের শিল্পতত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁদের ধারণায় সৌন্দর্য এমন বস্তু যার অস্তিত্ব অবিসংবাদী এবং অল্প বা অধিক মঙ্গলের সঙ্গে জড়িত অথবা তারই সহিত অভিন্নমূল। ইংলন্ডে বৌমগার্টেনের সমকালে, এমনকি কিছুকাল পূর্বেও সেফট্সবারি (Shaftesbury), হাচিসন (Hutcheson), হোম, বার্ক, হোগার্থ এবং আরও অনেকে শিল্প বিষয়ে তাঁদের ধারণা লিপিবদ্ধ করেছেন।

সেফটসবারির (১৬৭০-১৭১৩) মতে ‘যা সুন্দর তা সামঞ্জস্যপূর্ণ ও সমানুপাতিক, যা সামঞ্জস্যপূর্ণ ও সমানুপাতিক তাই সত্য, এবং যা একই সঙ্গে সুন্দর ও সত্য তা পরিণতিতে প্রীতিপদ ও শুভ। তিনি বলেছেন যে মনই সৌন্দর্যের জ্ঞাতা। ঈশ্বরই সৌন্দর্যের মূল ভিত্তি। সৌন্দর্য এবং মঙ্গল একই উৎসজাত।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, সেফারির বিবেচনার সৌন্দর্য ও মঙ্গল পৃথক হলেও তারা পরিনামে অভিন্ন ও একাত্ম।

হাচিসন (১৬৯৪-১৭৪৭)-এর Inquiry into the Original of our Ideas of Beauty and Virtue গ্রন্থের মতে শিল্পের লক্ষ্য সৌন্দর্য এবং সে সৌন্দর্যের মর্মবস্তু আমাদের চিত্তে সমতা ও বৈচিত্র্যের বোধ জাগায়। শিল্পবস্তুর সঙ্গে পরিচিত হতে গেলে আমরা অন্তরেন্দ্রিয়ের দ্বারা চালিত হই। এই অন্তশ্চেতনা নৈতিক চেতনার বিরোধীও হতে পারে। সুতরাং হাচিসনের মতে সৌন্দর্য যে সব সময় মঙ্গলের অনুষঙ্গী এমন নয়, বরং সৌন্দর্য অনেক সময় মঙ্গলবিচ্ছিন্ন এবং কখনও মঙ্গলবিরোধীও হয়।

হোম, লর্ড কেস (Kames ১৬৯৬-১৭৮২)-এর মতে সৌন্দর্য তাই যা প্রীতিপদ। সুতরাং শুধুমাত্র রুচির সাহায্যেই সৌন্দর্যের সংজ্ঞা দেওয়া যায়। নির্ভুল রুচির আদর্শ হল স্বল্পতম পরিসরে রসভূয়িষ্ঠতা, পূর্ণতা, শক্তি এবং ভাব-বৈচিত্র্যের সর্বাধিক সমাহার। শ্রেষ্ঠ শিল্পবস্তুর আদর্শও তাই।

বার্ক (1729-1797-Philosophical Inquiry into the origin of own Ideas of the Sublime and Beautiful)-এর মতে শিল্পের লক্ষ যে সৌন্দর্য ও মহনীয়তা তার উসে মানুষের আত্মরক্ষা ও সমাজরক্ষার প্রণোদনা। এ অনুভূমি সমূহের উৎস পরীক্ষায় দেখা যাবে সেগুলি ব্যক্তির মাধ্যমে জাতিকে রক্ষা করবার উপায় মাত্র। প্রথমটি (আত্মরক্ষা) লাভ করা যায় পুষ্টি, প্রতিরোধ ও যুদ্ধের মাধ্যমে। দ্বিতীয়টি (সমাজ) পারস্পরিক মেলামেশা ও সন্তান উৎপাদন। সুতরাং জাতিরক্ষার সঙ্গে অনিবার্যভাবে যুক্ত আত্মরক্ষা এবং যুদ্ধকর্মই মহান সৌন্দর্যের উৎসস্থল। সঙ্গপ্রিয়তা ও যৌনপ্রবৃত্তির সঙ্গে যুক্ত বলে এগুলিও সৌন্দর্যের উৎস।

অষ্টাদশ শতকের মুখ্য ইংরেজ লেখকদের শিল্প ও সৌন্দর্যের সংজ্ঞা ছিল এরূপ।

একই সময়ে ফরাসি দেশে শিল্প বিষয়ক লেখকদের মধ্যে ছিলেন পেয়ার আঁদ্রে (চবৎব অহফত্ব) এবং বাত্তো (Batterux) এর পরে আসেন দিদারো, ডি’ এলেমবার্ট (D’ Alembert) এবং কিছু পরিমাণে ভলতেয়ার।

পেয়ার আঁদ্রের মতে (Essai Sur le Beau, 1741) সুন্দর তিন জাতীয় : স্বৰ্গীয় সৌন্দর্য, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং কৃত্রিম সৌন্দর্য।

বাত্তো (Batterux) (1713-17৪0)-র মতে, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অনুকরণই শিল্প-যার লক্ষ্য উপভোগ। দিদারোর শিল্প-সংজ্ঞাও অনুরূপ।

ইংরেজ লেখকদের মতে ফরাসি লেখকেরাও মনে করেন, মানুষের রুচিই সুন্দরের স্বরূপ নির্ধারণ করে। তবে রুচি- সম্পর্কীয় বিধিবিধান শুধু যে অলিখিত তাই নয়, বরং এটা স্বীকৃত সত্য যে, এ ধরনের কোন আইন-কানুন নির্ধারণ করা যায় না। ডি’ এলেমবার্ট (D’ Alembert) এবং ভলতেয়ারও একই মত পোষণ করতেন।

সে যুগের ইতালীয় নন্দনতত্ত্ববিদ্ পাগানোর (Pagano) মতে, প্রকৃতিতে বিক্ষিপ্ত সৌন্দর্যরাশিকে সম্মিলিত করার মধ্যেই শিল্পের স্বরূপ নিহিত। যে সামর্থ্যের সাহায্যে এ সৌন্দর্য অনুভব করা যায় তা রুচি, যে শক্তির সাহায্যে সে সৌন্দর্যরাশির অখন্ড রূপ দেওয়া সম্ভব, তা শিল্পপ্রতিভা। সৌন্দর্য মঙ্গলের সঙ্গে একাত্মতা লাভ করে, যার ফলে সৌন্দর্য মঙ্গলরূপে প্রতিভাত হয় এবং অন্তর্নিহিত সৌন্দর্যই মঙ্গল।

অপরাপর ইতালীয়দের, যেমন মুরাতৌরি (Muratori ) ( 1672-1750 ) Reflessioni Sopra il buon gusto intorno le scienze e le arti, -এবং বিশেষ করে স্পালেত্তির (Spaletti) – Saggio Sopra la bellezza (1765) মতে শিল্প অহংকেন্দ্রিক চেতনারই প্রকাশ যার ভিত্তিতে রয়েছে (বার্কও মনে করেন) আত্মরক্ষা এবং সমাজ রক্ষার আকাঙ্ক্ষা।

ডাচ লেখকদের মধ্যে হেমস্টারহুইস (Hamsterhuis, 1720-1790) ছিলেন খুবই উল্লেখযোগ্য। তাঁর মত জার্মান নন্দনতাত্ত্বিকদের ও গ্যেটেকেও প্রভাবিত করেছিল। তাঁর মতানুসারে প্রচুর পরিমাণে আনন্দবিধায়ক বস্তুই সৌন্দর্য, এবং স্বল্পতম সময়ের মধ্যে প্রভূততম অনুভূতি সঞ্চারক বস্তুই আমাদের সর্বাধিক আনন্দদায়ক। স্বল্পতম সময়ের মধ্যে বৃহত্তর পরিমাণে অনুভূতি সঞ্চারক বলেই সুন্দর বস্তুর উপভোগ মানুষের অধিগম্য মহত্তম সংবেদনা।

গত শতাব্দীতে জার্মানির বাইরে এই হল নান্দনিক তত্ত্বগুলির পরিচয়। ভিঙ্কেলমানের (Winckelmann) পরে জার্মানিতে সম্পূর্ণ নতুন এক নান্দনিক তত্ত্বের উদ্ভব হল। কান্ট (১৭২৪-১৮০৪) উদ্ভাবিত এই তত্ত্বটি সৌন্দর্য এবং তদনুষঙ্গী শিল্পের প্রকৃত মর্ম অপর সকল মত অপেক্ষা বিশদতর।

কান্টের নান্দনিক তত্ত্বের মূল কথা নিম্নরূপ : মানুষ নিজের বাইরে স্থিত নিসর্গকে যেমন জানে, তেমনি নিজেকে নিসর্গের অন্তর্গত বলে জানে। আত্মবহির্ভূত নিসর্গলোকে সে খোঁজে সত্য; নিজের মধ্যে সে খোঁজে মঙ্গল। প্রথমটি বিশুদ্ধ যুক্তির ব্যাপার, অপরটি বাস্তব যুক্তির (স্বাধীন এষণার) বিষয়। এই দুটি জ্ঞানলাভের উপায় ব্যতিরেকে আর রয়েছে মানুষের বিচার ক্ষমতা (Urteilskraft-যা যুক্তি ছাড়াই বিচার করে এবং কোন প্রকার আকাঙ্ক্ষা ছাড়াই আনন্দ সৃষ্টি করে ( Urteil ohne Begriff and Vergnugen ohne Begehren)। এ ক্ষমতাই নান্দনিক অনুভূতির ভিত্তি। কান্টের মতে আত্মনিষ্ঠ হয়ে দেখলে সৌন্দর্য সেই বস্তু যা সাধারণভাবে এবং অনিবার্য গতিতে যুক্তিকে এড়িয়ে বাস্তবক্ষেত্রে কোন প্রকার সুবিধা-নিরপেক্ষ শুধুমাত্র আনন্দ দান করে। এবং বস্তুগত অর্থে সৌন্দর্য তদনুযায়ী উদ্দেশ্য সাধক একটি রূপ যে রূপের উপলব্ধিতে প্রয়োজন সিদ্ধির কোন স্থান নেই।

কান্টের অনুবর্তীরাও সৌন্দর্যের অনুরূপ সংজ্ঞা নির্দেশ করেছেন যাঁদের অন্যতম শীলার (১৭৫৯-১৮০৫) -নন্দনতত্ত্ব বিষয়ে যাঁর রচনা সুপ্রচুর। সেই শীলার কান্টের মতই মনে করতেন যে, শিল্পের লক্ষ্য সৌন্দর্যসৃষ্টি। সে-সৌন্দর্যের উৎস বাস্তব লাভ-নিরপেক্ষ।

আনন্দ শিল্পকে একটি ক্রীড়া বলে অভিহিত করা যায়, যে ক্রীড়া কোন লঘু ব্যাপৃতি নয়, বরং বীবনেরই নানা সৌন্দর্য প্রকাশক উদ্যোগ-সৌন্দযসৃষ্টিই যার একমাত্র উদ্দেশ্য। শীলার ছাড়া নন্দনতত্ত্বের জগতে কান্টের অনুবর্তীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ভিলহেল্‌ম হুমবোল্ট (Wilhelm Humboldt) সৌন্দর্যের সংজ্ঞার সঙ্গে অতিরিক্ত কিছু যোগ করতে সক্ষম না হলেও নাটক, সংগীত, হাস্যকৌতুক ইত্যাদি সৌন্দর্যের বিভিন্ন রূপমূর্তির তিনি ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন।

কান্টের পর দ্বিতীয় শ্রেণীর দার্শনিকেরা ছাড়া নন্দনতত্ত্ব-সম্পর্কীয় লেখকেরা হলেন ফিকটে, শেলিং (Schelling), হেগেল এবং তাঁদের অনুবর্তীরা।

ফিটে (১৭৬২-১৮১৪) বলেন, সৌন্দর্যের অনুভূতির উদ্ভব ঘটে এভাবে : জগৎ অর্থাৎ প্রকৃতির দুটি দিক আছে। তা আমাদের সীমাবদ্ধতার এবং স্বাধীন আদর্শবাদী ক্রিয়ার যোগফল। প্রথম, পরিপ্রেক্ষণায় জগৎ সীমাবদ্ধ, দ্বিতীয়, তা মুক্ত। প্রথম দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রত্যেকটি বস্তুই সীমাবদ্ধ, বিকৃত, সংকুচিত, অবরুদ্ধ-ফলে আমরা দেখি বিকৃতি; দ্বিতীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে আমরা অনুভব করি তার অন্তর্নিহিত সামগ্রিকতা, সজীবতা, নবজন্ম- ফলে আমরা প্রত্যক্ষ করি সৌন্দর্যকে। ফিটের মতে বস্তুর বিকৃতি বা সৌন্দর্য নির্ভর করে দ্রষ্টার দৃষ্টিভঙ্গির ওপর। সুতরাং সৌন্দর্যের অস্তিত্ব বহির্জগতে নয়, সুন্দর আত্মার মধ্যে (Schoner Geist)। এই সুন্দর আত্মার অভিব্যক্তিরই শিল্প। শিল্পের লক্ষ্য শিক্ষা, তবে শুধুমাত্র মনের শিক্ষা নয়,-সে কাজ মনস্বীদের, শুধুমাত্র হৃদয়ের শিক্ষাও নয়,-সে কাজ নীতিশিক্ষকদের এক্তিয়ারভুক্ত,-বরং শিল্পের লক্ষ্য সমগ্র মানুষটির শিক্ষা। অতএব সৌন্দর্যের বৈশিষ্ট্য কোন বহিবস্তুর মধ্যে নিহিত নয়, বরং তার অধিষ্ঠান শিল্পীর অন্ত নিহিত সুন্দর আত্মায়।

ফিটের অনুসরণে একই পথে ফ্রিডরিখ শ্লেগেল (Friedrich Schlegel) এবং এডাম মূলার (Adam Muller)-ও সৌন্দর্যের সংজ্ঞা দিয়েছিলেন। শ্লোগেলের (১৭৭২-১৮২৯) মতে শিল্পের সৌন্দর্যকে আমরা বুঝি অত্যন্ত অসম্পূর্ণ, একপেশে এবং বিচ্ছিন্নভাবে। শুধুমাত্র শিল্পের মধ্যেই সৌন্দর্যের অধিষ্ঠান নয়, বরং প্রকৃতি এবং ভালোবাসার মধ্যেও সৌন্দর্যের অবস্থান। ফলে প্রকৃত সুন্দর অভিব্যক্তি লাভ করে শিল্প, প্রকৃতি এবং ভালোবাসার সম্মিলনে।

সুতরাং শ্লেগেল নীতি এবং দর্শনভিত্তিক শিল্পকে নান্দনিক শিল্পের সঙ্গে অভিন্ন মনে করেন।

এডাম মূলার (Adam Muller, 1779-1৪29) -এর মতে সৌন্দর্যের রূপ দ্বিবিধঃ একটি সাধারণ সৌন্দর্য যা মানুষকে আকর্ষণ করে-যেমন সূর্য আকর্ষণ করে গ্রহকে। প্রধানত প্রাচীন শিল্পেই এর অস্তিত্ব দেখা যায়। অপরটি ব্যক্তিকেন্দ্রিক সৌন্দর্য-যার উদ্ভব ঘটে দ্রষ্টার সূর্যসদৃশ হয়ে সৌন্দর্যকে আকর্ষণের মাধ্যমে। এই-ই হল আধুনিক শিল্পের সৌন্দর্য। যে জগতে সকল স্ববিরোধিতার সামঞ্জস্য হয় সেটিই উচ্চতম সৌন্দর্য। প্রত্যেকটি শিল্পকর্মই এই সার্বিক সামঞ্জস্যের প্রতিরূপ। জীবনশিল্পই সর্বোচ্চ শিল্প।

ফিকটে এবং তাঁর অনুবর্তীদের পরে এলেন তাঁর সমসাময়িক দার্শনিক শেলিং (Schelling, 1775-1৪45)। আমাদের যুগের নান্দনিক ধারণার ওপর তার প্রভাব খুবই প্রবল। শেলিং-এর দর্শন অনুযায়ী শিল্প সেই বস্তুধারণারই সৃষ্টি বা পরিণতি যার সাহায্যে জ্ঞাত বিষয়ের সঙ্গে অভিন্ন হয় অথবা বিষয় জ্ঞাতৃত্বে পরিণত হয়। সীমার মধ্যে অসীমের অনুভূতিই সৌন্দর্য এবং শিল্পকর্মের মুখ্য বৈশিষ্ট্য নিজ্ঞান সীমাহীনতা। আত্মনিষ্ঠের, প্রকৃতির সঙ্গে বুদ্ধির, নিজ্ঞানের সঙ্গে সজ্ঞানের মিলনই শিল্প। সুতরাং শিল্পজ্ঞান অর্জনের শ্রেষ্ঠ মাধ্যম। আদি রূপের মধ্যে (in den urbildern) বর্তমান বস্তুর যথার্থ স্বরূপের অনুধ্যানই সৌন্দর্য। শিল্পী তাঁর জ্ঞান বা ণৈপুণ্যের সাহায্যে সৌন্দর্যসৃষ্টি করেন না, বরং তাঁর অবস্থিত সৌন্দর্যের ধারণাই সৌন্দর্যের স্রষ্টা।

শেলিং-এর অনুবর্তীদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ছিলেন সলগার (Solger, 17৪0 – 1৪19-Vorlesungen uber aesthetik)| তাঁর মতে সৌন্দর্যের ধারণা সব কিছুর মূলগত ধারণা। পৃথিবীতে আমরা মৌলিক ধারণার কেবল বিকৃতিই লক্ষ্য করি। কিন্তু কল্পনার সাহায্যে শিল্প সে-ধারণার শীর্ষে পৌঁছাতে সক্ষম। সুতরাং শিল্প সৃষ্টিরই স্ব-গোত্রীয়। শেলিং-এর আর একজন অনুবর্তী ক্রাউজের (কধঁংব) (১৭৮১-১৮৩২) মতে ব্যক্তির মধ্যে ভাবের বহিঃপ্রকাশই যথার্থ সদর্থক সৌন্দর্য। মানুষের মুক্ত আত্মার জগতে যে সৌন্দর্যের অবস্থান শিল্প তাকে বাস্তবে পরিণত করে। শিল্পের সর্বোচ্চ স্তর জীবনশিল্প। শিল্পের কর্মধারা বিস্তৃত জীবন অলংকর কর্মে-যাতে জীবন সুন্দর মানুষের জন্য সুন্দর আবাসস্থলে পরিণত হতে পারে।

শেলিং এবং তাঁর অনুবর্তীদের পরে পাই হেগেলের নতুন নান্দনিক সূত্র। সে সূত্রটি আজ পর্যন্ত অনেকের দ্বারা সচেতনভাবে অনুসৃত হয়। তবে অধিকাংশ লোকই না বুঝে বা অজ্ঞাতসারে এর অনুসরণ করে। এই মত পূর্ববর্তী মতের তুলনায় যে কোন অংশে স্বচ্ছতার বা অধিকতর সুনির্দিষ্ট নয় তা নয়, বরং সম্ভবত আরও বেশি ধোঁয়াটে এবং রহস্যাবৃত।

হেগেলের (১৭৭০-১৮৩১) মতে ঈশ্বর সৌন্দর্য রূপে প্রকৃতি এবং শিল্পে নিজেকে প্রকাশিত করেন। ঈশ্বর নিজেকে অভিব্যক্ত করেন দুই উপায়ে : বস্তুতে এবং যে মন বস্তুকে গ্রহণ করে তার মধ্যে প্রকৃতিতে এবং আত্মায়। বস্তুজগতের মধ্যে ভাবব্রহ্ম যে উদভাসিত হয় সেই জ্যোতির্ময় রূপের নামই সুন্দর। আত্মা এবং আত্মার সঙ্গে সম্পর্কিত বস্তুমাত্রই সুন্দর। সুতরাং প্রকৃতির সৌন্দর্য আত্মার স্বাভাবিক সৌন্দর্যের প্রতিবিম্ব মাত্র। সৌন্দর্যের মধ্যে বিধৃত আছে কেবলমাত্র আধ্যাত্মিক সারবস্তু। তবে আধ্যাত্মিককে অবশ্যই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য রূপে উপস্থিত হতে হবে। আত্মার ইন্দ্রিয় সচেতন অভিব্যক্তিই কেবলমাত্র মূর্তি (Schein), এবং এ মূর্তিই সুন্দরের একমাত্র বাস্তবসত্তা। সুতরাং শিল্পকে বলা যায় ভাবব্রহ্মের মূর্তি। ধর্ম এবং দর্শনের সঙ্গে শিল্পও মানবজাতির নিগূঢ়তম সমস্যা এবং আত্মার উচ্চতম সত্য প্রকাশের উপায় মাত্র।

হেগেলের মতে সত্য ও সৌন্দর্য এক এবং সমভাবাপন্ন বস্তু। এই দুইয়ের মধ্যে একমাত্র পার্থক্য এই যে, স্ব-নিষ্ঠ ভাব্রহ্মই সত্য এবং এ সত্য ভাবনার যোগ্য। যে ভাব্রহ্ম বহির্বিশ্বে প্রকাশ লাভ করে তা বোধের জগতে শুধুমাত্র সত্য নয়, সুন্দরও! সুন্দর ভাবব্রহ্মের বহিঃপ্রকাশ মাত্র।

হেগেলকে অনুসরণ করে তাঁর বহু অনুবর্তীর আবির্ভাব হল। এঁরা : ভাইসে (Weisse), আর্নল্ড রুগে (Arnold Ruge), রোজেনক্রান্তস্ (Rosenkrantz), থিয়োডোর ফিসার (Theodor Vischer) এবং আরও কেউ কেউ।

ভাইসের (Weisse, 1৪01-1৪67) মতে শিল্পের লক্ষ্য সৌন্দর্যের চরম ও পরম আধ্যাত্মিক সত্তাকে বাহ্য, জীবনহীন এবং নিরপেক্ষ বস্তুর মধ্যে প্রবর্তিত করা (Einbildung)। যে সৌন্দর্য এই বস্তু প্রপঞ্চের মধ্যে অনুস্যূত হয় তা ছেড়ে দিলে এই শেষোক্ত অনুভব সমস্ত অস্তিত্বকে স্বীকার করে।

ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে ভাইসে (Weisse) বলেন, সত্যের ধারণার ক্ষেত্রে জ্ঞানের আত্মমুখী (subjective) এবং বিষয়বস্তুমুখী (objective) দিকের স্ববিরোধিতা বিদ্যমান-যেহেতু প্রাতিস্বিক অহংচেতনার দ্বারা সর্বগত সত্যের উপলব্ধি ঘটে। স্ববিরোধিতার ফলে আমাদের সত্যানুভূতিতে বিশ্বজনীন এবং ব্যক্তি যেখানে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে সেখানে বোধের সাহায্যে স্ববিরোধিতাকে অস্বীকার করে বিশ্বজনীন এবং ব্যক্তিকে মিলিত করা সম্ভব। এইরূপ বোধই সমন্বিত সত্য (aufgehoben)। সৌন্দর্যই সেই সমন্বিত সত্য। হেগেলের যথার্থ অনুরাগী রুগে (Ruge 1৪02-1৪৪0)-এর মতে সৌন্দর্য স্বতঃ প্রকাশিত ভাব্রহ্ম মাত্র। আত্মা আত্মচিন্তার দ্বারাই সম্পূর্ণ অভিব্যক্তি লাভ করে। সেই পূর্ণ অভিব্যক্তিই সৌন্দর্য। সে অভিব্যক্তি অসম্পুর্ণ হতে পারে। অসম্পূর্ণ হলে সে খন্ডিত অভিব্যক্তিকেই পরিবর্তিত করার প্রয়োজন অনুভূত হয়। এ প্রক্রিয়ায় তা সৃজনধর্মী শিল্পে পরিণতি লাভ করে।

ভিসারের (Vischer, 1৪07-1৪47) মতে সৌন্দর্য হল আইডিয়া বা ভাবব্রহ্মের সীমিত রূপায়ন। ভাবব্রহ্ম অবিভাজ্য নয়, তবে তা এমন একটি ভাবসমাবেশ যা আরোহী এবং অবরোহী রেখাসমূহ দ্বারা উপস্থাপিত করা সম্ভব। ভাব বা আইডিয়া যত উচ্চমার্গের হবে ততই তা বেশি সৌন্দর্যের অধিকারী হবে। তবে নিম্নতম ভাবের মধ্যেও সৌন্দর্য আছে, যেহেতু তা সে পদ্ধতির অপরিহার্য যোগসূত্র রূপে কাজ করে। ভাববহ্মের উচ্চতর রূপ ব্যক্তিত্ব। সুতরাং যে বিষয়বস্তুর মধ্যে ব্যক্তিত্বের সর্বোচ্চ প্রকাশ বিধৃত, তাকেই উচ্চতম পর্যায়ের শিল্প বলা যায়।

জার্মান নন্দনতত্ত্ববিদদের তত্ত্বগুলি সে পর্যায়ের যাদের প্রবণতা ছিল হেগেলীয় ভাবধারার দিকে। তবে তাঁরা নন্দনতাত্ত্বিক আলোচনার ওপর একচেটিয়া অধিকার বিস্ত ার করেননি। জার্মানিতে হেগেলীয় তত্ত্বের সঙ্গে সঙ্গে এবং সমকাল-ভাব্রহ্মের বহিঃপ্রকাশই সৌন্দর্য-হেগেলের এই মতের সঙ্গে শুধু নিঃসম্পর্কিত নয়, বরং এর বিরোধী মতবাদও গড়ে ওঠে। তবে সে মতবাদ ছিল প্রত্যক্ষভাবে এ তত্ত্বের বিরোধী। এ তত্ত্ব পূর্বোক্ত তত্ত্বকে শুধু অস্বীকার করেনি, ব্যঙ্গও করেছে। হার্বার্ট, বিশেষভাবে সোফেনহাওয়ারও এ পথেই অগ্রসর হয়েছিলেন।

হার্বাট (১৭৭৬-১৮৪১)-এর মতে সৌন্দর্য নামক স্ব-নির্ভর কোন বস্তুর অস্তিত্ব নেই, থাকতেও পারে না। যে অস্তিত্বের কথা বলা হয় তা আমাদের অভিমত মাত্র। সে অভিমতের ভিত্তি খুঁজে দেখা প্রয়োজন (Asthetisches Elementarurtheil)। এ ভিত্তিসমূহ আমাদের ধারণার সঙ্গে সম্পর্কিত। এমন কতকগুলি সম্পর্কযুক্ত বস্তু আছে যাদের আমরা সুন্দর বলি। আর্টের কাজ সে সম্পর্কগুলিকে খুঁজে বের করা। সে সম্পর্কগুলি অবস্থান কর চিত্রশিল্প, মৃৎশিল্প এবং স্থাপত্যশিল্পে। সংগীতে তা ক্রমান্বয়ে এবং একই সময়ে বিদ্যমান থাকে। কাব্যে তা অবিমিশ্রভাবে পৌর্বাপর্য ক্রমসম্বলিত। পূর্ববর্তী নন্দনতাত্ত্বিকদের বিরোধিতা করে হার্বার্ট মনে করেন, অনেক সময় কোন কোন বস্তু আদৌ কিছু প্রকাশ করে না, অথচ তারা সুন্দর। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, রেখা এবং রেখা এবং রঙের জন্য ইন্দ্রধনু সুন্দর-আইরিস (Iris) অথবা নোয়া (Noah)-র ইন্দ্রধনুর সঙ্গে পৌরাণিক সম্পর্কের জন্য নয়।

হেগেলের আর একজন বিরুদ্ধ মতবাদী ছিলেন সোপেনহাওয়ার যিনি হেগেলের নন্দনতত্ত্ব সহ সমস্ত তত্ত্বই অস্বীকার করেছিলেন।

সোপেনহাওয়ারের মতে (১৭৮৮-১৮৬০) পৃথিবীর বিভিন্ন স্তর পর্যায়ে এষণা (Will) বস্তুরূপে আত্মপ্রকাশ করে, এবং যদিও উচ্চতর পর্যায়ে বস্তুরূপ লাভ করবার ফলে তা অধিকতর সৌন্দর্যমন্ডিত হয়, তথাপি প্রত্যেকটি পর্যায়েরই নিজস্ব সৌন্দর্য আছে। ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিসর্জন এবং এষণার অভিব্যক্তির যে কোন একটি পর্যায়ের অনুধ্যান আমাদের মনে সৌন্দর্য সৃষ্টি করে। সোপেনহাওয়ার বলেন, ভাব্রহ্মকে বিভিন্ন পর্যায়ে বস্তুরূপ দেবার ক্ষমতা সকল মানুষেরই আছে। শিল্পীর প্রতিভায় হে ক্ষমতা অধিকতর পরিমাণে বিদ্যমান। এবং এ জন্যই শিল্পী-প্রতিভা উচ্চতর সৌন্দর্যের অভিব্যক্তি দিতে সক্ষম।

জার্মানিতে এ সমস্ত বিশিষ্ট লেখকদের পরে আবির্ভূত হন অপেক্ষাকৃত কম মৌলিক এবং কম প্রবাভশালী লেখকবৃন্দ-যেমন,

লেখকবৃন্দ-যেমন, হার্টমান (Hartmann), কাশীমান (Kirchmann), শ্লাসে (Schnase) এবং কিয়ৎ পরিমাণে হেলেমহোৎস (Helmholtz) (নন্দনতাত্ত্বিক হিসেবে), বার্গমান ( Bergmann), য়ুঙ্গমান (Jungmann) এবং আরও অনেকে যাদের সংখ্যা অজস্র।

হার্টমান (Hartmann, 1৪42)-এর মতে সৌন্দর্যের অবস্থান বহিজগতে নয়, বস্তুর স্বরূপেও নয়, মানুষের আত্মার জগতেও তার অবস্থান নয়, বরং তা নিহিত শিল্পসৃষ্ট প্রতিভাসে (Schin)। বস্তুসত্তার নিজস্ব কোন সৌন্দর্য নেই, শিল্পীর হাতেই তা সৌন্দর্যে রূপান্তরিত হয়।

শাসে (Schnase 179৪-1৪75)-র মতে পৃথিবীতে নিখুঁত সৌন্দর্যের অস্তিত্ব নেই। প্রকৃতিতে এ পর্যায়ের সৌন্দর্যের দিকে একটা অভিমুখিতা দেখা যায় মাত্র। প্রকৃতির পক্ষে যা সম্ভব নয়, শিল্প তাই দান করে। প্রকৃতির রাজ্যে যে সামঞ্জস্য লক্ষিত হয় না, মুক্ত অহং-এর প্রেরণা সেই সামঞ্জস্য সচেতনভাবে অনুভব করে সৌন্দর্য উদ্‌ঘাটিত করে।

কীর্শমান (Kirchmann, 1৪02-1৪৪4) লিখেছিলেন সমীক্ষামূলক নন্দনতত্ত্ব সম্পর্কে। তাঁর তত্ত্ব ইতিহাসের সকল দিক বিশুদ্ধ আপতিক ঘটনার দ্বারা সংযুক্ত। তাঁর মতে ইতিহাসের ছয়টি প্রদেশ আছে : জ্ঞানের ঐশ্বর্যের, নীতির, বিশ্বাসের, রাষ্ট্রনীতির এবং সৌন্দর্যের। শেষোক্ত প্রদেশের ক্রিয়াকলাপই শিল্প।

হেমহোৎস (Helmholt, 1৪21-1৪94) সংগীতের সঙ্গে সম্পর্কিত সৌন্দর্য বিষয়েই লিখেছিলেন। তাঁর মতে একমাত্র অপরিবর্তনীয় বিধান অনুসরণ করেই সংগীতের জগতে সৌন্দর্যসৃষ্টি সম্ভব। এ বিধানগুলি শিল্পীর অজ্ঞাত। এ কারণে শিল্পী নিজ্ঞান চেতনার সাহায্যে সৌন্দর্যের অভিব্যক্তি দেন। এ অবস্থায় এ পর্যায়ের সৌন্দর্যকে সমীক্ষার অধীন করা চলে না।

বার্গমান (Bergmann, জন্ম ১৮৮৫), (Uber das Schone, 1৪৪7)-এর মতে সৌন্দর্যের বস্তুগত সংজ্ঞা দেওয়া অসম্ভব। সৌন্দর্যের অনুভূতি ঘটে শুধুমাত্র আত্মগতভাবে। সুতরাং নন্দনতত্ত্বের সমস্যা হল কোন্ বস্তু কাকে তৃপ্তি দেয়। তার সংজ্ঞা নির্ধারণ করা। যুঙ্গমান (Jungmann, মৃত্যু ১৮৮৫)-এর মতে, প্রথমত, সৌন্দর্য বস্তুর ইন্দ্রিয়ানুভূতির অতীত গুণ, দ্বিতীয়ত, শুধুমাত্র সৌন্দর্য-ভাবনার মধ্য দিয়েই সৌন্দর্য আমাদের মনে আনন্দ উৎপাদন করে। তৃতীয়ত, সৌন্দর্য প্রেমের ভিত্তিভূমি।

সাম্প্রতিক কালে ফ্রান্স, ইংলন্ড এবং অন্যান্য জাতির প্রধান প্রতিনিধিদের নন্দনতত্ত্ব সমূহের পরিচয় এ রকম :

এ সময়ে ফরাসি দেশে নন্দনতত্ত্ব সম্পর্কে উল্লেখ্য লেখকরা হলেন : কুজ্যা (Cousin), জুফ্রয় (Jouffroy), পিক্টে (Pictet), রভাইসঁ (Ravisson) এবং লেভেক্ (Leveque)। কুজ্যা (১৭৯২-১৮৬৭) ছিলেন বিভিন্ন মতে আগ্রহী এবং জার্মান আদর্শবাদীদের অনুসরণকারী। তাঁর তত্ত্বানুসারে সৌন্দর্যের সর্বদা একটি নৈতিক ভিত্তি বর্তমান। শিল্প অনুকৃতি এবং যা আনন্দপ্রদ তাই সুন্দর-এ মতবাদের তিনি বিরোধিতা করেন। তিনি জোর দিয়ে বলেন, সৌন্দর্যের বস্তুগত সংজ্ঞা দেওয়া সম্ভব এবং বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের ভিতর মুখ্যত সৌন্দর্যের অধিষ্ঠান।

কুজ্যা (Cousin)-র পরে এলেন জুফ্রয় (Jouffroy, 1796-1৪42)। তিনি কুজ্যাঁর শিষ্য এবং জার্মান নন্দনতত্ত্ববিদদের অনুবর্তী। তাঁর সংজ্ঞা অনুসারে সৌন্দর্য দৃষ্টির অগোচর অভিব্যক্তি-যার প্রকাশ ঘরে কতকগুলি স্বভাবগত লক্ষণায়। দৃশ্যমান জগৎ যেন পরিচ্ছদ যার সাহায্যে আমরা সৌন্দর্যকে প্রত্যক্ষ করি।

হেগেল এবং প্লেটোর পুনরাবৃত্তি করেছিলেন সুইস লেখক পিটে (Pictet)। তাঁর ধারণায় ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য রূপের জগতে অভিব্যক্তে দৈবী ভাব্রহ্মের প্রত্যক্ষ এবং অবাধ প্রকাশেই সৌন্দর্যের অবস্থান।

লেভেক্ (Leveque) ছিলেন শেলিং এবং হেগেলের অনুবর্তী। তাঁর মতে সৌন্দর্য প্রকৃতির অন্তরালবর্তী অদৃশ্য কোন বস্তু। এবং তা এমন একটি শক্তি বা ভাববস্তুর যা সুবিন্যস্ত প্রেরণায় স্ব-প্ৰকাশ।

সৌন্দর্যের প্রকৃতি সম্পর্কে অনুরূপ অস্পষ্ট মতামত প্রকাশ করেছিলেন ফরাসি অধিবিদ্যাবিদ্ রভাইস (Ravaisson)। তিনি সৌন্দর্যকে পৃথিবীর চরম লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য বলে মনে করতেন। সর্বাধিক পবিত্র এবং সর্বোচ্চ নিখুঁত সৌন্দর্যের মধ্যে জগতের সমস্ত রহস্য নিহিত। আবার বলা হয়েছে, সমস্ত জগৎ একটি পরম বা অখন্ড সৌন্দর্যের সৃষ্টি এবং বস্তুর মধ্যে প্রেমের সঞ্চার দ্বারাই সে বস্তুর অস্তিত্বের কারণ হয়। আমি ইচ্ছা করেই এই অধিবিদ্যাবিষয়ক মূল উক্তিগুলি উদ্ধার করেছি। যেহেতু জার্মানরা যতই অস্পষ্ট হন না কেন, ফরাসিরা একবার যদি জার্মানদের তত্ত্বগুলি আত্নসাৎ করতে পারে এবং তাদের অনুকরণ করতে শুরু করে, তবে তারা বিভিন্ন জাতের মতামতকে একটি গ্রন্থনায় প্রকাশ করে, এবং যচ্ছভাবে কোন একটি অর্থকে পুরোভাগে এনে জার্মানদেরও অনেকদূর পশ্চাতে ফেলে যেতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, ফরাসি দার্শনিক লাসেলিয়ে সৌন্দর্য (Lachelier) সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে বলেন :

‘এ কথা বলতে অবশ্যই আমরা ভীত হবে না যে, যে সত্য সুন্দর নয়, তা আমাদের বুদ্ধিবৃত্তির যুক্তিনির্ভর খেলা মাত্র এবং যে সত্য সূর্ণগর্ভ এবং সার্থকনামা তাই সৌন্দর্য। জার্মান দর্শনের প্রভাবে যে সমস্ত আদর্শবাদী নন্দনতাত্ত্বিকেরা পূর্বে লিখেছিলেন এবং এখনও লিখছেন তাঁদের মধ্যে নিম্নোক্ত সাম্প্রতিক লেখকেরা ফরাসি দেশে শিল্প সম্পর্কীয় ধারণা এবং সৌন্দর্যকে প্রভাবিত করেছেন। এঁরা হলেন টেইন, (Guyau), গুয়ো শাবুলিয়ে (Cherbuliex), কস্টার (Coster) এবং ভেঁর (Veron) টেইন (১৮২৮- ১৮৯৩) এর মতে সৌন্দর্য কোন গুরুত্বপূর্ণ ভাবের মূলীভূত বৈশিষ্ট্যের সেই অভিব্যক্তি যা বাস্তবে অনধিগম্য।

গুয়ো (Guyau) বলতে চেয়েছিলেন, সৌন্দর্য বস্তুর বহির্বিভাগের কোন রূপ নয়, বস্তুর ওপর পরগাচার মতো তা বেড়েও ওঠে না-বরং তা বাস্তব-স্বরূপের অভিব্যক্তি। শিল্প যুক্তিপূর্ণ এবং সচেতন জীবনেরই অভিব্যক্তি। শিল্প আমাদের অস্তিত্বের গভীরতম চেতনা, সৌন্দর্যের গভীরতম অনুভূতি এবং মহত্তম চিন্তাকে জাগ্রত করে। শিল্প মানুষকে ব্যক্তিগত জীবন থেকে বিশ্বজীবন উত্তীর্ণ করে। শুধু বিশ্বজনীন ভাব ও বিশ্বাসের অঙ্গীভূত হয়েই এই উত্তরণ সম্ভব হয় না, আবেগের সাদৃশ্যের সাহায্যেও এই উত্তরণ ঘটে।

Cherbuliez -এর মতে শিল্প এমন একটি ক্রিয়া (১) যা বহির্জগতের রূপের জন্য আমাদের আন্তরিক প্রীতির তৃপ্তি সাধন করে, (২) এ সমস্ত রূপমূর্তিকে ভাবাবিষ্ট করে, (৩) আমাদের ইন্দ্রিয়চেতনায়, হৃদয়ে এবং যুক্তিতে আনন্দ সঞ্চার করে। বস্তুর মধ্যে সৌন্দর্য অন্তর্নিহিত থাকে না, সৌন্দর্য আত্মার একটি ক্রিয়া মাত্র। সৌন্দর্য মায়া; পরম (absolute) সৌন্দর্যের অস্তিত্ব নেই। আমাদের বিবেচনায় বৈশিষ্ট্যপূর্ণ এবং সামঞ্জস্যময় বস্তুই আমাদের সুন্দর মনে হয়।

কস্টার (Coster) মনে করতেন সুন্দর, কল্যাণ এবং সত্য সম্পর্কীয় ভাবগুলি সহজাত। এ সমস্ত ভাবচেতনা আমাদের মনকে আলোচিত করে, ঈশ্বরের সঙ্গে এরা একাত্ম-যে ঈশ্বর মঙ্গল, সত্য ও সৌন্দর্যের প্রতিমূর্তি। সারবস্তুর ঐক্য, সংঘটনী উপাদানের বৈচিত্র্যে এবং শৃঙ্খলা যা জীবনের বিচিত্র বিকাশকে ঐক্যবদ্ধ করে-এ সকলই সৌন্দর্য ধারণার অঙ্গীভূত।

এ আলোচনার সম্পূর্ণতা সাধনের জন্য আমি শিল্প সম্পর্কীয় সাম্প্রতিকতম আরও কয়েকটি রচনার কথা উল্লেখ করব।

La Psychologie du beau et de laart, Par Maria Pilo (1৪95 ) বলে, সৌন্দৰ্য আমাদের শারীরিক অনুভূতিসৃষ্ট। শিল্পের উদ্দেশ্য আনন্দ, তবে লেখকদের মতে কয়েকটি কারণে এ আনন্দ স্বতই হবে খুবই নৈতিকতাপূর্ণ।

Essai Sur laart Contemporain, par Fierens Gevaert (1৪9৪)-তে বলা হয়েছে, অতীতের সঙ্গে সংযোগ এবং বর্তমানের ধর্মীয় আদর্শের ওপর শিল্প নির্ভলশীল। শিল্পকর্মে নিজের ব্যক্তিত্বের স্বরূপ আরোপ করতে গিয়ে শিল্পী এরকম ধারণা পোষণ করেন।

আবার Sar Paladan – L’art idealiste et mystique (1৪94) গ্রন্থে বলা হয়েছে ঈশ্বরের নানাবিদ প্রকাশের মধ্যে শিল্প অন্যতম। অর্থাৎ ঈশ্বর ব্যতীত সত্তার অস্তিত্ব নেই, ঈশ্বর ছাড়া আর কোন সত্য নেই, আর কোন সৌন্দর্য নেই। এই বইখানি খুবই অদ্ভুত এবং অশিক্ষিত মনের পরিচায়ক, কিন্তু এর বক্তব্যের বৈশিষ্ট্য আছে এবং ফ্রান্সের তরুণ সমাজে এ-সকল বক্তব্য প্রতিষ্ঠালাভ করেছে বলে এখানে উল্লেখযোগ্য। বর্তমান কাল পর্যন্ত ফ্রান্সে বিক্ষিপ্ত সকল নন্দনতত্ত্বই এই জাতীয়। তবে এগুলির মধ্যে ভেরো (Veron) L’esthetique- -র একটু ব্যতিক্রম। বইখানি যুক্তিনির্ভর এবং স্বচ্ছ। এই বইখানি শিল্পের যথাযথ সংজ্ঞা নির্দেশ না করলেও নন্দনতত্ত্বকে পরম সৌন্দর্যের ধোঁয়াটে ধারণামুক্ত করেছে।

ভেরোঁ (Veron 1৪25-1৪৪9)-র মতে শিল্প আবেগেরই প্রকাশ। সে আবেগ বাহ্যত সঞ্চারিত হয় রেখা, রূপ ও রঙের সমন্বয় অথবা গতি, ধ্বনি অথবা কতকগুলি ছন্দনিয়ন্ত্রিত হয় রেখা, রূপ ও রঙের সমন্বয় অথবা গতি, ধ্বনি অথবা কতকগুলি ছন্দনিয়ন্ত্রিত কাজের ক্রমান্বয়ী গতির জন্য।

এ কালবৃত্তের মধ্যে ইংলন্ডে নন্দনতত্ত্বসম্পৰ্কীয় লেখকেরা গুণগত ভিত্তিতে না করে রুচির ভিত্তিতে সৌন্দর্যের সংজ্ঞা নিরূপণ করেছেন। ফলে রুচি-বিষয়ক আলোচনা সৌন্দর্যসংক্রান্ত আলোচনাকে অতিক্রম করেছে।

রেইড (জবরফ, ১৭০৪-১৭৯৬) স্বীকার করেছিলেন, সৌন্দর্য সম্পূর্ণভাবে দর্শকের ওপর নির্ভরশীল। তারপর এলিসন-ও (Alison) Essay on the Nature and Principles of Taste তাঁর (1790)-এ এই বক্তব্য সপ্রমাণ করেছিলেন। অপর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে একই কথা গভীর প্রত্যয়ের সঙ্গে বলেছিলেন ইরাসমাস ডারউইন (Erasmus Darwin, 1731-1৪02)। তিনি ছিলেন বিখ্যাত চার্লস ডারউইনের পিতামহ। তিনি বলেন, আমাদের ভালোবাসার ধারণার সঙ্গে সম্পর্কিত বস্তুকেই আমরা সুন্দর বিবেচনা করি। রিচার্ড নাইট (Richard Knight) তাঁর An Analytical Inquiry into th ePrinciples of Taste নামক গ্রন্থেও একই সুরে কথা বলেছেন।

ইংরেজি নন্দনতাত্ত্বিক মতবাদের অনেকগুলিতে একই সুর ধ্বনিতে হয়েছে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইংলন্ডে নন্দনতত্ত্ববিষয়ক উল্লেখযোগ্য লেখকেরা হলেন চার্লস ডারউইন (কিছু পরিমাণে), হার্বার্ট স্পেনসার, গ্রান্ট্ এলেন, কার (Ker) এবং নাইট

চালর্স ডারউইন (১৮০০-১৮৮২) Descent of Man, 1৪71 )-এর মতে সৌন্দর্য এমন একটি অনুভূতি যা শুধু মানুষের পক্ষে নয়, পশুর পক্ষেও স্বাভাবিক। সুতরাং মানুষের পূর্বপুরুষের মধ্যেও এ অনুভূতি ছিল। পাখিরা নিজেদের নীড় অলংকৃত করে, সঙ্গিনীদের অঙ্গধৃত সৌন্দর্যের মূল্য দেয়। বিবাহের ওপরও সৌন্দর্যের প্রভাব আছে। সৌন্দর্যের মধ্যে নানাবিধ বিচিত্র ধারণার সমাবেশ আছে। সংগীতশিল্পের গোড়ার কথা স্ত্রীলোকের প্রতি পুরুষের আহ্বান।

হার্বাট স্পেনসার (১৮২০)-এর মতে শিল্পের উৎস খেলা। এই একই ভাবচিন্তা পূর্বেই ব্যক্ত করেছিলেন শীলার। নিম্নতর প্রাণীদের মধ্যে জীবনের শক্তি ব্যয় হয়ে যায় জীবনরক্ষা এবং বংশরক্ষার প্রয়োজন। এ সমস্ত প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলেও মানুষের মধ্যে কিছু উদ্বৃত্ত শক্তি বর্তমান থাকে। খেলায় যে উদ্বৃত শক্তি ব্যবহৃত হয় তা ক্রমে শিল্পে পরিব্যাপ্ত হয়। খেলা যেমন কাজের অনুকৃতি শিল্পও তাই। নান্দনিক আনন্দের উৎস ত্রিবিধ : (১) যা ‘মানসিক শক্তিকে সম্পূর্ণ নিয়োজিত করে অথচ অতিরিক্ত অণুশীলনের ফলে যেখানে দোষত্রুটি ঘটে সর্বাপেক্ষা কম’। (২) ‘কোন উদ্দীপনার প্রচুর পার্থক্য বা একটি প্রীতিপূর্ণ প্রাণবন্ত অনুভূতি উদ্রেক করে।’ (৩) বিশেষ সংযোজন সহ একই বস্তুর আংশিক পুনরুজ্জীবন।

টডহান্টারের সৌন্দর্যতত্ত্ব (Todhunter’s Theory of the Beautiful) গ্রন্থে আছে, সৌন্দর্য অনন্ত রমণীয়তা যা বুদ্ধি এবং প্রেমের উদ্দীপনায় আমরা উপলব্ধি করি। সৌন্দর্যের স্বীকৃতি এ পর্যায়ের হওয়ায় তা রুচির ওপর নির্ভলশী; সৌন্দর্য বিচারের কোন মাপকাঠি থাকতে পারে না। একমাত্র সংস্কৃতির মধ্যেই এর কিছুটা সংজ্ঞা পাওয়া যায় (অথচ সংস্কৃতি কি বস্তু তার সংজ্ঞা নির্ণিত হয়নি)। অন্তনির্হিত গুণের দিক থেকে শিল্প-যা রেখা, রং, ধ্বনি এবং কথার মধ্য দিয়ে আমাদের অন্তরে দাগ কাটে-তা কোন অন্ধ শক্তির সৃষ্টি নয়, তা যুক্তিপূর্ণ শক্তিসমূহের সৃষ্টি এবং তারাও পরস্পরের সহযোগিতায় যুক্তিযুক্ত সত্যের দিকে অগ্রসর হয়। সৌন্দর্য বিভিন্ন স্ববিরোধিতার সমন্বয়।

গ্রান্ট এলেন ছিলেন স্পেনসারের অনুবর্তী। তাঁর Physiological Aesthetics (1৪77) গ্রন্থে তিনি বলেছেন, সৌন্দর্যের একটি দৈহিক উৎসও আছে। সৌন্দর্যের অনুধ্যান থেকে আসে নান্দনিক আনন্দ, তবে সৌন্দর্যের ধারণা লাভ করা যায় একটি দেহতাত্ত্বিক প্রক্রিয়ায় সাহায্যে। শিল্পের উৎস খেলা; শারীরিক শক্তি প্রয়োজনাধিক হলে মানুষ খেলায় প্রবৃত্ত হয়। আগ্রহণ শক্তি উদ্বৃত্ত হলে মানুষ শিল্প সৃষ্টিতে প্রবৃত্ত হয়। সৌন্দর্য সেই বস্তু বা সর্বনিম্ন পরিমাণ অপচয় এবং সর্বোচ্চ পরিমাণ উদ্দীপনা সৃষ্টি করে। সৌন্দর্যের মূল্যায়নে মতপার্থক্য ঘটে রুচির বিভিন্নতা থেকে। রুচি গঠন শিক্ষাসাপেক্ষ। উৎকৃষ্ট শিক্ষা দীক্ষায় লালিত এবং ভালোমন্দের পার্থক্য নির্ধারণে সক্ষম মানুষের বিবেচনার ওপর আমাদের বিশ্বাস রাখতেই হবে। এ ধরনের মানুষই পরবর্তী প্রজন্মের রুচি নির্ধারণ করেন।

কার (Ker) -Gi Essay on Philosophy of Art (শিল্পদর্শন বিষয়ক নিবন্ধ, ১৮৩৩)-এ বলা হয়েছে, শিল্প বস্তুবিশ্বের অংশ বিশেষকে আমাদের নিকট বোধগম্য করে। বিজ্ঞান যে অনিবার্যক্রমে বস্তুবিশ্বের অপর অংশের উদ্ঘাটন করে শিল্প তা নিয়ে মাথা ঘামায় না! সুতরাং শিল্প এক এবং বহুকে, বিধান এবং তার অভিব্যক্তিকে, বিষয় এবং বস্তুকে মিলনসূত্রে গ্রথিত করে এগুলির মধ্যেকার বিরোধিতার অপনোদন করে। শিল্প মুক্তির উদ্ঘাটন ও স্বীকৃতি, যেহেতু শিল্প অন্ধকারমুক্ত এবং সীমাবদ্ধ বস্তুর মতো বোধাহীত নয়।

নাইট-এর ‘সুন্দরের দর্শন,’ দ্বিতীয় খন্ড, ১৮৯৩ (Philosophy of the Beautiful, Part II, 1৪93) গ্রন্থের মতে সৌন্দর্য (যেমন, ছিল শেলিং-এর ধারণায়) বস্তু ও ভাবের মিলন, মানুষের যা সগোত্র, প্রকৃতি থেকে তার নিষ্কাশন এবং সকল প্রকৃতির যা সাধারণ ধর্ম ব্যক্তিসত্তার মধ্যে তার স্বীকৃতি।

সৌন্দর্য এবং শিল্প সম্পর্কে এখানে যে সমস্ত অভিমত উল্লিখিত হল তার ব্যাপকতা এই সব উল্লেখের অপেক্ষা অনেক বেশি। প্রতিদিনই নন্দনতত্ত্ব-সম্পর্কে নতুন নতুন লেখকের উদ্ভব হচ্ছে-সৌন্দর্যের সংজ্ঞা নির্ণয়ে যাদের বিশদ আলোচনায় একই রকম মোহময় বিভ্রান্তি এবং স্ব-বিরোধিতা দেখা যায়। কেউ কেউ কিছু বৈচিত্র্য সত্ত্বেও নিষ্ক্রিয়তায় আচ্ছন্ন হয়ে বৌমগার্টেন এবং হেগেলের অতীন্দ্রিয় নন্দনতত্ত্বের পথে বিচরণ করেন, অন্যেরা প্রশ্নটিকে আত্মভাবমূলকতার দিকে বিষয়ান্তরিত করেন এবং রুচির ধারণার মধ্যে সৌন্দর্যের ভিত্তি খোঁজেন। অপর দল সাম্প্রতিকতম নন্দনতত্ত্ববিদেরা। এঁরা সৌন্দর্যের উৎস খোঁজেন শরীরতত্ত্বের নিয়ম-পদ্ধতির মধ্যে। পরিশেষে আর একদল আবার পুরোপুরি সৌন্দর্যের ধারণা-নিরপেক্ষভাবে প্রশ্নটির সমীক্ষা করেন। এভাবে সালি (Sully) তাঁর Sensation and Intuition : Studies in Philosophy and Aesthetics (1৪74) গ্রন্থে সৌন্দর্যের ধারণাকে সম্পূর্ণরূপে খারিজ করে দিয়েছেন। তাঁর সংজ্ঞা অনুসারে শিল্প কোন স্থায়ী বস্তু অথবা চলমান ক্রিয়ার সৃষ্টি। সে সৃষ্টি সৃজনকর্তার মধ্যে সক্রিয় উপভোগ্যতা পরিবেশনের সামর্থ্য। কিছু সংখ্যক দর্শক এবং শ্রোতার মধ্যেও তা প্রীতিপ্রদ অনুভূতি সৃষ্টি করতে পারে। সে অনুভূতি অবশ্যই দ্রষ্টা ও শ্রোতার ব্যক্তিগত লাভক্ষতি-নিরপেক্ষ হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *