হাবুর বিপদ

হাবুর বিপদ

স্কুলের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে হাবু ভাবল, থাক ফিরে যাই। গরমকাল। মর্নিং স্কুল হচ্ছে। আর কয়েক মিনিট পরে সাতটা বাজবে। ঘণ্টা পড়বে স্কুল আরম্ভের। একতলা স্কুল বাড়িটির ঘরে ঘরে ছেলেদের কলরব। উঠানে কিছু ছেলে খেলছে। হাবুর মনে ভেসে ওঠে সুধীরবাবু, ভারিক্কি চেহারা। গম্ভীর মুখ, মোটা চশমার কোণের আড়ালে বড়ো বড়ো দুটি চোখের তীক্ষ্ণ চাহনি। হাবু জানে স্যার তাকে পছন্দ করেন। কিন্তু তা হলে ক্লাসের কাজে অবহেলা ক্ষমা করার লোক নন তিনি।

যদি স্কুল না যায়? সময় কাটাবার জায়গার অবশ্য অভাব নেই। দত্তদের আমবাগানে ঢুকলেই খাসা সময় কেটে যাবে। কিন্তু ক্লাস কামাই করলে কাল বাবার কাছ থেকে চিঠি আনতে হবে, অনুপস্থিত হবার কারণ দর্শিয়ে। তখন? বাবাকে কী কৈফিয়ত দেবে? বই হাতে স্কুলে বেরিয়ে গিয়েছিল কোন চুলোয়? অতঃপর অবধারিত মারাত্মক পরিণতির কথা ভেবে হাবু শিউরে ওঠে। ভীষণ রাগ হতে থাকে ভজার ওপর। ওর পাল্লায় পড়েই এই গণ্ডগোল। হাবু তো প্রথমে রাজি হয়নি। ভজাটা কিছুতেই ছাড়ল না। এখন?

বাবা না সুধীরবাবু? না না, বাবা কিছুতেই নয়। যদি বরাতে দুর্ভোগ থাকে স্যারের হাতেই হোক। হাবু স্কুলে ঢুকে পড়ে।

উঁহু, আজ লাস্ট বেঞ্চ নয়। ওটার ওপর স্যারদের চিরকাল কড়া নজর। মাঝামাঝি বসা যাক। ভাগ্যে থাকলে পাঁচ-ছজনের ভিড়ে মিশে হয়তো এ যাত্রায় পার পেয়ে যেতে পারে। থার্ড বেঞ্চের এককোণে তিনকড়ির পাশে হাবু বসে পড়ল।

পর পর তিনটে ক্লাস কেটে গেল। এবার আসবেন সুধীরবাবু। বাংলা রচনার ক্লাস। তারপর টিফিন। হাবু বাইরে যতটা সম্ভব শান্ত থাকবার চেষ্টা করছে। বুকের মধ্যে কিন্তু তার হাপর পড়ছে।

সুধীরবাবু ধীর পদক্ষেপে ক্লাসে ঢুকলেন। দশাসই মানুষটির পরনে ধুতি পাঞ্জাবি। কাঁধে পাট করা সাদা চাদর। ছাত্ররা তাঁকে ভয়-ভক্তি দুটোই করে। ছাত্রদের উন্নতির জন্য তিনি প্রচুর খাটেন, তবে বড্ড কড়া মাস্টার।

চেয়ারে বসে সুধীরবাবু প্রশ্ন করলেন, ‘গতবারে কী রচনা লিখতে দিয়েছিলাম জান?’

—‘বাংলাদেশে বর্ষাকাল।

—‘ও হ্যাঁ। সবাই লিখে এনেছ?’

—‘হ্যাঁ স্যার!’ ক্লাসসুদ্ধ ছেলেরা ঘাড় হেলে।

—‘বেশ, কয়েকটা শোনা যাক।’

ছেলেরা যে যার রচনা খাতা বের করে ওপরে রাখে।

এটাই সুধীরবাবুর মেথড। কয়েকজনকে বেছে বেছে পড়তে বলেন। অন্যদের বলেন মন দিয়ে শুনবে। অন্যের লেখা শুনলে নিজের লেখার মান সম্বন্ধে একটা ধারণা হবে। আমি তো সবার খাতা বাড়ি নিয়ে গিয়ে শুধরে দেব। কিন্তু

প্রত্যেকের লেখা তো প্রত্যেকে পড়তে পারবে না। অন্তত ক্লাসে কয়েকখানা রচনা শোনা যাক। কে কেমন লিখেছে কিছুটা জানো।

—‘প্রফুল্ল পড়ো।’ সুধীরবাবু আদেশ দিলেন।

প্রফুল্ল খাতা খুলে ‘বাংলাদেশে বর্ষাকাল’ পড়তে আরম্ভ করে। পাতা দুই শোনার পর হঠাৎ ধমকে ওঠেন, ‘থামো। আমি রচনা লিখতে বলেছি। বই থেকে কপি করতে বলিনি।’

—‘কেন স্যার?’ প্রফুল্ল আমতা আমতা করে।

—‘আবার কেন। দে-সরকারের রচনার বই থেকে হুবহু টুকে এনেছে। এ চলবে না। কাল নতুন করে লিখে এনে দেবে। আর কষ্ট করে আরও দু-একখানা বই উল্টিও। মনে থাকবে?’

এবার তাঁর লক্ষ্য লাস্ট বেঞ্চ।

—‘নিতাই?’

নিতাই নামকরা ফাঁকিবাজ। প্রথমটা ভান করল যেন শুনতেই পায়নি।

—‘নিতাই?’

—‘আমাকে বলছেন স্যার?’

—‘হ্যাঁ, ক্লাসে আর কটা নিতাই আছে? পড়?’

নিতাই মুখ নীচু করে দাঁড়িয়ে রইল। ‘কী হল?’

—‘আজ্ঞে লিখতে পারিনি।’

—‘কেন?’

—‘আজ্ঞে, সময় পাইনি, মায়ের অসুখ।’

—‘ও তোমায় বুঝি মায়ের সেবা করতে হয়েছে। দুই দিদি কী করছিল?’

—’আজ্ঞে বারবার ডাক্তার ডাকা, ওষুধ আনা করতে হয়েছে কি না। বাবার মোটে সময় নেই তাই।’

—‘কী হয়েছে তোমার মায়ের?’

—‘জ্বর, সর্দি, কাশি।’

—‘এখন কেমন আছেন?’

—‘জ্বর ছেড়েছে। আজ ভাত খেয়েছেন।’

—‘মিথ্যাবাদী!’ সুধীরবাবুর গর্জনে সারা ক্লাস কেঁপে ওঠে। ‘গতকাল তোমার মাকে দেখেছি গোঁসাইবাড়িতে কীর্তন শুনছেন। দাঁড়িয়ে থাকো ওই কোণে, টিফিনেও বেরুবে না। দাঁড়িয়ে থাকবে। কালকেই তোমার রচনা চাই। এই নিয়ে পর পর দুদিন হল। এর পরে যদি রচনা আনতে ভুল হয় তাহলে তোমার কপালে দুঃখ আছে। মনে থাকবে?’

—‘মনে থাকবে,’ সুধীরবাবুর একটি মুদ্রাদোষ। মনে থাকুক না থাকুক তিনি সবাইকে বলে যান— ‘মনে থাকবে?’

—‘প্ৰশান্ত!’

ফার্স্ট বয় প্রশান্ত খাতা বাগিয়ে বুক ফুলিয়ে উঠে দাঁড়ায়।

বেশ দীর্ঘ রচনা, সুন্দর গুছিয়ে লেখা। বর্ষার বর্ণনায় কয়েকটা তালমাফিক কবিতার উদ্ধৃতি হয়েছে। সুধীরবাবু মন দিয়ে শোনেন।

তবে ছেলেরা লক্ষ্য করে স্যারের কপালের মাঝখানে একটি ভাঁজ অর্থাৎ তিনি বিশেষ সন্তুষ্ট নন। ওই ভাঁজ তার চিহ্ন।

প্রশান্তর পাঠ শেষ হয়, সুধীরবাবু বললেন, ‘ভালো হয়েছে, তবে আরেকটু মৌলিক হওয়া উচিত। শুধু রচনা বইগুলোর ওপর নির্ভর করবে কেন? চাই নিজস্ব ভাব, ভাষা। নিজের অভিজ্ঞতার বর্ণনা। তবেই রচনার প্রকৃত সাহিত্যিক মূল্য আসবে। মনে থাকবে?’

প্রশান্ত একটু ক্ষুণ্নমনে বসে পড়ে।

সুধীরবাবুর সন্ধানী দৃষ্টি ঘুরছে, ‘হাবুলচন্দ্র!’

হাবু নিজের কানকে যেন বিশ্বাস করতে পারে না।

‘হাবুল!’

হাবু এবার উঠে দাঁড়ায়। উঃ, কী ভাগ্য তার!

—‘পড়ো তোমার রচনা।’

হাবু হাইবেঞ্চে রাখা বইখাতাগুলোর ওপর থেকে একটা খাতা তুলে নিল। পাতা খুলে ওর সামনে মেলে ধরে একটুক্ষণ তাকিয়ে রইল।

—‘কী আরম্ভ করো। বড্ড সময় নিচ্ছ।’ সুধীরবাবু তাড়া দেন।

—‘হ্যাঁ স্যার।’ হাবু পড়তে শুরু করে—

—‘আষাঢ়-শ্রাবণ এই দুই মাসকে বাংলাদেশে বর্ষাকাল বলে। এই দুই মাসে প্রচুর বৃষ্টি পড়ে তাই এই ঋতুর নাম বর্ষা। বর্ষার আগে গ্রীষ্মকাল। প্রচণ্ড গরম পড়ে। তখন মাঠ-ঘাট শুকিয়ে খটখটে হয়ে যায়। ডোবা, পুকুরের জল যায় মরে। সূর্যের তাপে মানুষজন, পশুপাখি, গাছপালা সবাই হাঁসফাঁস করতে থাকে। মাঝে মাঝে ঝড় বৃষ্টি হয় বটে, তবে বৃষ্টি দু-এক পশলা, ঝড়ের দাপটটাই হয় বেশি। জ্যৈষ্ঠের শেষাশেষি আকাশে কালো মেঘ জমতে শুরু করে। আষাঢ় মাসে নামে অঝোর বৃষ্টিধারা। বর্ষা এসে সব-কিছু ভিজিয়ে দেয়। প্রকৃতি স্নিগ্ধ হয়ে ওঠে।

হাবু প্রথম দিকটায় ঠেকে ঠেকে আস্তে আস্তে পড়ছিল। ক্রমে তার পড়ার গতি বাড়ে, বেশ ঝরঝর করে বলে চলে।

‘বর্ষা নামে বাংলাদেশের সব জায়গায়। শহরে, গ্রামে, জঙ্গলে পাহাড়ে। শহরে বর্ষা কোনো দিন দেখিনি, তবে গ্রামে থাকি কিনা, তাই প্রতি বছরই বর্ষাকালে গ্রামের অবস্থা কেমন হয় বেশ জানি। দেখতে দেখতে মজে যাওয়া পুকুর, ডোবা, খাল, বিল জলে ভরে ওঠে। রাস্তাঘাট হয় কাদা প্যাচপ্যাচে। চলতে ফিরতে তখন ভারি অসুবিধা। কাগজে পড়েছি শহরে রাস্তাঘাট ভালো, কাদা হয় না। কিন্তু সেখানেও রাস্তায় জল জমে। কাগজে ছবি দেখেছি, কলকাতার কোথাও কোথাও এক কোমর জল দাঁড়িয়েছে। লোকে নৌকা চালাচ্ছে।’

—‘অ্যাই তিনকড়ি, মুখ নামাও।’ সুধীরবাবু ধমকে ওঠেন।

তিনকড়ি হাঁ করে হাবুর খাতার পানে চেয়ে ছিল। তৎক্ষণাৎ ঘাড় নামায়। হাবু চমকে পড়া বন্ধ করে।

—‘হুঁ। তারপর।’ সুধীরবাবু চেয়ারে হেলান দিয়ে আরাম করে বসেন। হাবু আরম্ভ করতে একটু দেরি করে। খাতার ওপর চোখ রেখে দাঁড়িয়ে থাকে।

—‘কী হল?’ নিশ্চয় নিজের হাতের লেখা নিজেই পড়তে পারছে না। নাঃ, বকে বকেও হাতের লেখার উন্নতি করা গেল না ছেলেটার। সুধীরবাবু ভাবেন।

হাবু আবার পড়ে—

—‘তবে বর্ষাকালে চাষিদের ভারি ফুর্তি। বৃষ্টি ভালো হলে চাষ ভালো হবে অনেক ফসল উঠবে ঘরে। যে বছর বৃষ্টি কম হয় সেবার তাদের মাথায় হাত। বাগদীপাড়ার রাম অনাবৃষ্টির বছর আমাদের গোলা থেকে ধান নিয়ে যায়। নইলে যে তার ছেলে বউ না খেতে পেয়ে মরবে। বেশি বৃষ্টির আবার বিপদ আছে, নদীতে বন্যা হয়। আগের বছর আমাদের গাঁয়ের পাশে খরস্রোতা নদীতে বান ডাকল। দুপাশে মাঠ ভেসে গেল। কত শস্যক্ষেত ডুবে নষ্ট হল। গাঁয়ের মধ্যেও জল ঢুকে এসেছিল। ছোটো ছোটো অনেক মাটির ঘর পড়ে গেল। মাঝরাত্রে বান এসেছিল। ভাগ্যিস দুলু মাঝি হাঁক দিয়ে ডেকে সবাইকে সাবধান করে দিল, নইলে অনেকে ভেসে যেত। আমাদের বাড়িতে অনেক পরিবার এসে আশ্রয় নিয়েছিল সে রাতে।…’

সুধীরবাবু মন দিয়ে শোনেন। খাসা লিখছে। বই-টইয়ের ধার ধারেনি। সব নিজের অভিজ্ঞতা, ভাষাটিও সুন্দর— ছেলেটা চর্চা রাখলে বড়ো হয়ে নির্ঘাত সাহিত্যিক হবে।

ফার্স্ট বয় প্রশান্ত পাশের ছেলেকে কনুই দিয়ে মৃদু গোঁতা মারল, ‘শুনছিস? স্রেফ আবোল তাবোল। পয়েন্ট কই?’ সে ফিসফিসিয়ে বলে।

—‘তিনকড়ে—!’ তিনকড়ি আবার ঊর্ধ্বগ্রীবা বিস্ফারিত নয়নে হাবুর মুখের দিকে চেয়েছিল। স্যারের ধমক শুনে মাথা নোয়ায়।

হাবু পড়ে যায়। বর্ষাকালে তার গ্রামের জীবনের নানা বিচিত্র কাহিনি— বর্ষায় নাকি অসুখ-বিসুখ খুব বাড়ে। বিশেষত পেটের অসুখ আর সর্দিজ্বর। ডাক্তারবাবুরা নাকি নাওয়া খাওয়ার সময় পান না তখন। গাছে গাছে সবুজ পাতা বেরোয়। কখনও সখনও সারারাত টিপটিপ করে বৃষ্টি হয়। আর ব্যাংগুলো পাল্লা দিয়ে হেঁড়ে গলায় গান জোড়ে। ভারি মজা লাগে। জলে গর্ত বুজে যাওয়ায় মাঝে মাঝে ঘরের দাওয়ায় সাপ উঠে আসে। প্রত্যেক বছরই গ্রামের দু-একজনকে সাপে কামড়ায়।

‘ভোরবেলা চাষিরা লাঙল কাঁধে হেট হেট করে গোরু তাড়িয়ে ক্ষেতে যায়। দুপুরেও মাঠে থাকে। তাদের ঘরের লোক ভাত নিয়ে যায় দুপুরে খাবার জন্যে।’

আরও অনেক কিছু লিখেছে সে। মাঝে মাঝে পাতা উলটিয়ে বলে চলে— বর্ষাকালে গ্রামে তাদের কী সব পালাপার্বণ ব্রত হয়। ওই সময় স্কুলে নাকি ছাত্র কম আসে। তাদের ক্ষেতে কাজ করতে হয়, তাই ছুটি নেয়। হাবুর কাজ করার দরকার নেই। তাই রোজ স্কুলে আসতে বাধ্য হয়। এমনি কত—

হাবুর রচনা শেষ হল। সুধীরবাবু স্মিতমুখে বলেন, ‘বেশ হয়েছে, নিজের দেখা জিনিস লিখেছ। খুব ভালোভাবে আর একটু গুছিয়ে লেখা দরকার।’

তিনি ঘড়ি দেখলেন ক্লাস শেষ করতে আর পনেরো মিনিট বাকি। এবার সামনের সপ্তাহের রচনার বিষয় দিয়ে দেবেন আর এ সপ্তাহের খাতাগুলো নিয়ে নেবেন সংশোধনের জন্য। ‘হরিপদ, খাতা নাও।’

মনিটর হরিপদ প্রত্যেকের কাছে গিয়ে রচনা খাতা সংগ্রহ করতে লেগে যায়। সুধীরবাবু ভাবেন আসছে বারে কী রচনা দেওয়া যায়! ঠিক আছে, দুর্গাপুজো। দুর্গাপুজোর পৌরাণিক আখ্যানটা বলে দেবেন ক্লাসে।

—‘স্যার, হাবু খাতা দিচ্ছে না।’

হরিপদর ডাকে সুধীরবাবু অবাক হন। ‘কেন?’

—‘তা জানি না। বলছে কালকে দেবে।’

—‘হাবুল!’

হাবু উঠে দাঁড়ায়।

—‘খাতা দিচ্ছ না কেন?’

হাবুর মুখে কথা নেই।

—‘কী উত্তর দাও?’

—‘আজ্ঞে, কাল ভালো করে লিখে দেব।’

—‘দেখি খাতাটা। সুধীরবাবু রহস্য উদ্ধারের চেষ্টা করলেন।

হরিপদ হাবুর রচনা খাতার উদ্দেশ্যে হাত বাড়াতেই তিনকড়ি টপ করে ওপরের খাতাখানা তাঁর হাতে তুলে দেয়। হরিপদ সেখানা স্যারের হাতে সমর্পণ করে।

খাতার মলাটে চোখ বুলিয়েই তাঁর কাছে রহস্য পরিষ্কার হয়— গোটা গোটা করে লেখা ‘বীজগণিত খাতা’।

ও, এইজন্যে এত ধানাই পানাই! কাল ভালো করে লিখে এনে দেব। নাঃ, ছেলেটা অতি অগোছালো! তিনি পই পই করে সব্বাইকে বলে দিয়েছেন একটা আলাদা রচনা খাতা করতে। যা-তা খাতায় লিখবে না। দু সপ্তাহে একটা বাংলা রচনার ক্লাস, তিনি সমস্ত খাতা বাড়ি নিয়ে যান। ভালো করে সংশোধন করে তিন-চার দিন পরে খাতা ফেরত দেন। এবার অবশ্য ফেরত দিতে আরও তিনদিন বেশি দেরি হয়েছিল। শ্রীমান ইতিমধ্যে হোমটাস্ক লিখে বসে আছে। তাড়াতাড়ি লিখেছ খুব ভালো কথা। কিন্তু তা বলে অঙ্ক খাতায় লিখবে? কোনো আলগা কাগজে বা রাফখাতায় লিখতে পারত। তারপর আসল খাতা ফেরত পেলে তাতে টুকে নিত। আর হতে পারে হাবুল রচনা খাতাটি হারিয়ে বসে আছে। ফলে হাতের কাছে যা পেয়েছে তাতেই লিখেছে। ছি ছি একী নোংরামি, আজ তিনি আচ্ছা করে ধুচুনি দেবেন হাবুলকে। ছেলেখেলা পেয়েছে? সুধীরবাবু খাতার পাতা ওলটাতে ওলটাতে হাবুকে বকুনি দেবার জন্য মনে মনে কড়া কড়া বাক্য ভাঁজতে থাকেন।

অ্যাঁ এ কী! খাতা শেষ! কিন্তু রচনা কই?

—‘হরিপদ, তুমি ভুল খাতা দিয়েছ, এতে রচনা নেই।’

—‘অ্যাই, ঠিক খাতা দে। যেটায় লিখেছিস।’ হরিপদ হাবুকে তাড়া লাগান। তিনকড়ি তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, ‘না স্যার। ওই খাতা দেখেই পড়েছে।’ হ্যাঁ, তাই তো! নীল মলাটে রবিঠাকুরের ছবি ছাপা। তিনি পড়বার সময় লক্ষ্য করেছিলেন। সুধীরবাবু আর একবার পাতাগুলো সব উল্টে দেখেন, নেই!

ব্যাপার কী? ম্যাজিক নাকি? তিনি কী রকম ঘাবড়ে যান। তিনি শুনলেন, ক্লাসের ছেলেরা শুনল— অত বড়ো লেখাটা পড়ল।

—‘হাবু, এই খাতা দেখেই পড়েছ?’

—‘হ্যাঁ,’ হাবু ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানায়।

—‘তবে লেখা কই?’

হাবু নীরব নিস্পন্দ। ‘কী? উত্তর দাও।’ হাবু চুপ

তবে কি সম্ভাবনাটা বিদ্যুতের মতো তাঁর মস্তিষ্কে উদায় হয়। কিন্তু এ যে অবিশ্বাস্য।

—‘তবে কি মানে, তুমি কি লেখনি? বানিয়ে বানিয়ে বললে?’ —হ্যাঁ স্যার।’ ক্ষীণ কণ্ঠে হাবুর উত্তর আসে।

সুধীরবাবু হতভম্ব। তাঁর কুড়ি বছরের মাস্টারি জীবনে এ সমস্যা একেবারে অভিনব। শোনেননি কখনও।

প্রথমেই তাঁর কান গরম হয়ে উঠল রাগে। কী আস্পর্ধা। বেমালুম ঠকাল আমাকে। বেয়াদপ। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয় চিন্তাটা মাথায় আসে।

চশমার পুরু কাচের ভিতর থেকে সুধীরবাবুর বড়ো বড়ো চোখ দুটোর স্থির দৃষ্টি হাবুর ওপর নিবদ্ধ। শুধু হাবু নয়, গোটা ক্লাস কাঠ হয়ে আছে ভয়ে। হাবুর ভবিষ্যৎ ভেবে সবাই আতঙ্কিত। হাবু মনে মনে জপছে— হে ভগবান। যা হয় ইস্কুলে, বাবার কানে যেন না পৌঁছায়। হে ভগবান দয়া করো।

তখন সুধীরবাবুর মাথায় ঘুরছে— অদ্ভুত কাণ্ড! অতখানি রচনা স্রেফ বানিয়ে বলে গেল। আর এমন সুন্দর করে। আশ্চর্য! সত্যি বলতে কি তাঁর ইচ্ছে করছে নেমে গিয়ে ছেলেটার পিঠ চাপড়ে বলেন, ‘সাবাস!’

না, অতটা বাড়াবাড়ি করা ঠিক হবে না। ক্লাসের ডিসিপ্লিন রাখা তাহলে শক্ত হয়ে পড়বে। হয়তো এর পর থেকে প্রত্যেক ছেলে না লিখে বানিয়ে বলবার চেষ্টা করবে হাবুর দেখাদেখি। অবশ্য আর কারও ক্ষমতা নেই অমন বানায়। এমনকী ফার্স্ট বয় প্রফুল্লরও সাধ্য নেই।

থমথমে মুখ, গুরুগম্ভীর স্বরে সুধীরবাবু বললেন, ‘কী, লেখনি কেন? দুসপ্তাহের মধ্যে সময় হল না!’

—‘আজ্ঞে, ভেবেছিলাম কাল সন্ধেবেলা লিখে ফেলব।’ হাবু মিনমিন করে, ‘কিন্তু গোপালপুরের মেলা গিয়েছিলাম বিকেলে। ফিরতে রাত হয়ে গেল। এসে দেখি খেতে দিচ্ছে। খেয়ে পড়া বাবার বারণ, তাই—’

—‘হুম! তা সোজাসুজি স্বীকার করলে পারতে

—‘ভেবেছিলাম করব।’

—‘ও! তারপর বুঝি বুদ্ধি গজাল?’

—‘না স্যার!’ হাবুর কণ্ঠে কান্নার আভাস।

‘বেশ, মনে থাকে যেন। কাল আমার রচনা চাই। ঠিক যা যা বললে সব পরিষ্কার করে লিখে আনবে। মনে থাকবে? খাসা বলেছ।’

শারদীয় ১৩৭৮

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *