দূত

দূত

আমরা প্রশান্ত মহাসাগরের একটি ক্ষুদ্র দ্বীপে এসে উপস্থিত হলাম। আমরা মানে— আমি, সুনন্দ ও মামাবাবু। আমার বাল্যবন্ধু সুনন্দ ও তার মামা অধ্যাপক নবগোপাল বাবুর পরিচয় আপনারা আগেই পেয়েছেন (‘ড্রাগন-ফ্লাই’, সন্দেশ, এপ্রিল ‘৬৬)। নবগোপালবাবু বিখ্যাত প্রাণীবিজ্ঞানী। সুনন্দ তাঁর সংসারে একমাত্র আপনজন— প্রিয় ছাত্র ও শিষ্য। নানা গবেষণায় যুক্ত হয়ে নবগোপালবাবু প্রায়ই দেশবিদেশে ভ্রমণ করেন। সুনন্দ সর্বদাই তাঁর সঙ্গে যায়। এবার সুনন্দের আগ্রহে আমিও তাদের সঙ্গে জুটে পড়েছি।

মামাবাবু এখানে এসেছেন এক আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক গবেষণা সংস্থার উদ্যোগে। দ্বীপের পাশেই একটি ছোটো জাহাজ নোঙর করেছে। জাহাজটি সামুদ্রিক গবেষণার উপযুক্ত আধুনিক যন্ত্রপাতিতে পূর্ণ। নানা দেশ থেকে আরও কয়েকজন বৈজ্ঞানিক গবেষক এসেছেন। সমুদ্র স্রোত, সমুদ্রগর্ভের প্রাণীকুল, খনিজ পদার্থ ইত্যাদি নিয়ে গবেষণা চলবে। অন্যান্য গবেষকরা জাহাজেই বাস করবেন স্থির করেছেন, অবশ্য আবহাওয়া খারাপ থাকলে বা ঝড় উঠলে দ্বীপে আশ্রয় নেবেন। থাকা-খাওয়ার সমস্ত সুবন্দোবস্তই জাহাজে বর্তমান। আমরা কিন্তু ঠিক করেছি মাটির ওপর থাকব। দিন-রাত অতটুকু জাহাজে বন্ধ হয়ে থাকা পোষাবে না। দ্বীপে একটি সুন্দর ছোটো কুটিরে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। জাহাজের এক লশকর আপাতত আমাদের সঙ্গে কুটিরে থাকবে, আমাদের রান্নাবান্না ও অন্যান্য কাজ করে দেবে।

সীমাহীন সমুদ্রবুকে বিন্দুবৎ এই ভূখণ্ড। আমাদের দ্বীপটি প্রশান্ত মহাসাগরের দক্ষিণ অংশে টঙ্গা দ্বীপপুঞ্জের অন্তর্গত। প্রায় একশো পঞ্চাশটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপ নিয়ে টঙ্গা দ্বীপপুঞ্জ গঠিত। তার মধ্যে মাত্র চল্লিশ-পঞ্চাশটিতে জনবসতি আছে।

প্রথম তিন-চার দিন আমি মহা ফ্যাসাদে পড়লুম। হাতে অফুরন্ত সময়— সারাক্ষণ কী করি কী করি চিন্তা। কিন্তু দুঃখের বিষয় করার তো কিছু পাই না।

মামাবাবু সক্কালে প্রাতরাশ করে জাহাজে চলে যান। তীর থেকে লঞ্চে করে গিয়ে জাহাজে ওঠেন। সারাদিন সেখানে কাটান— নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ব্যস্ত থাকেন, ফেরেন সন্ধেবেলা। এক-একদিন রাত্রেও কাজ চলে— জাহাজেই থেকে যান সে রাত। সুনন্দ কোনো দিন তাঁর সঙ্গে যায়, সে দিন আমি একেবারে নিঃসঙ্গ।

এখানে বেড়াবার জায়গা অতি অল্প, দেখার বস্তুও ততোধিক সামান্য। মাত্র শ-খানেক স্থানীয় পলিনেশিয়ানের বাস এই দ্বীপে। এদের চেহারা সুশ্রী, চালাক চতুর হাবভাব। মাছ ধরে ও নারিকেল চালান দিয়ে প্রধানত জীবিকা নির্বাহ করে। ইচ্ছে ছিল এদের সঙ্গে আলাপ জমাই। কিন্তু ভাষাই প্রধান প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়াল। ওরাও বোঝে না আমার ভাষা, আমিও বুঝি না ওদের। কাজেই দূর থেকে লক্ষ্য করি।

দ্বীপটি প্রবাল দিয়ে তৈরি। ঝোপঝাড় গাছপালা প্রচুর। সমুদ্র-উপকূলে সারি সারি সুউচ্চ নারিকেল বৃক্ষগুলি সর্বদাই ঝোড়ো বাতাসে মাথা দোলাচ্ছে।

প্ল্যান করলাম সমুদ্র দেখব। প্রাণভরে এই অকূল পাথার সুনীল জলধি দর্শন করেই সময় কাটাব।

যে পাশটায় নোঙর করেছে তার উল্টোদিকে, নির্জন সমুদ্রসৈকতে ঘোরাফেরা আরম্ভ করলাম। দ্বীপের এ অংশ জনবসতিহীন। জলের কিনারায় খাড়া দাঁড়িয়ে আছে এক আলোকস্তম্ভ। স্তম্ভের মাথায় সারা রাত আলো জ্বলে। উজ্জ্বল চক্ষু মেলে অতন্দ্র প্রহরীর ন্যায় সে পাহারা দেয়। সাগরবক্ষে জাহাজ ও নৌকোকে নিশানা দেখায়। কূলের কাছে কয়েকটা ডুবো পাহাড় আছে। সমুদ্রগামী তরণীকে এই অদৃশ্য বিপদ হতে সতর্ক করে দেবার জন্য আলোকস্তম্ভটি নির্মিত হয়েছে।

ওই আলোকস্তম্ভের একটি মাত্র রক্ষক। স্তম্ভের ডগায় ছোট্ট ঘরের জানলা দিয়ে তাকে দেখা যেত। শুনেছি লোকটা বড়ো মেশে না কারো সঙ্গে। একা একা সমুদ্রতীরে ঘোরে বা লাইটহাউসের মধ্যেই বসে থাকে।

সমুদ্রের আকর্ষণ বড়ো দুর্বার। সে সদাই চঞ্চল, সদাই অস্থির। দেখতে দেখতে নেশা ধরে যায়। সাগর দেখে ক্লান্তি আসত না আমার। যেদিন সুনন্দও থাকত না, একা কূলে বসে দেখতাম— ঢেউগুলো প্রতি মুহূর্তে চলে এসে ক্রুদ্ধ গর্জনে লাফিয়ে পড়ছে বালির ওপর। আবার সরসর করে পিছিয়ে যাচ্ছে— পালিয়ে যাচ্ছে। জলোচ্ছ্বাসের একটানা সংগীত। দিকচক্রবালের জল নিয়ত বদলাচ্ছে। তীরের কাছে নানান সামুদ্রিক পাখি উড়ে বেড়ায়। কখনো ঢেউয়ের বুকে খোঁচা মারে মাছের আশায়। মস্ত বড়ো বড়ো কচ্ছপ ধীরে ধীরে ডাঙায় উঠে আসে। বালি খুঁড়ে ডিম পেড়ে বালি চাপা দিয়ে রেখে আবার ডুব মারে সাগরগর্ভে।

একটা জিনিস লক্ষ করছি, এখানকার বাতাসের গুণ। সমুদ্রের বাতাসে কিছুক্ষণ তাকালেই খিদে পেয়ে যায়। সারাদিন তাই কেবলই খাই খাই করি।

খাচ্ছি তো কম নয়! প্রচুর সমুদ্রের মাছ। অতি সুস্বাদু কচ্ছপের মাংস, তাছাড়া আছে টিনের খাবার। নামমাত্র মূল্যে নারকেল ও কলা মেলে। যখন-তখন নারকেল চিবুচ্ছি, দিনে গণ্ডাকয়েক কদলী গলাধঃকরণ করছি, কিন্তু তবু খিদে মেটে না কেন? আশা করছি দেশে ফেরার আগেই শরীরটা দিব্যি বাগিয়ে ফেলব।

দুই

সেদিন আমি সমুদ্রতীরে পায়চারি করছি, হঠাৎ দেখি কে একজন দাঁড়িয়ে। চোখে দূরবীন লাগিয়ে দূর আকাশের পানে তাকিয়ে আছে।

আরে এ তো সেই লাইটহাউসের রক্ষক। লোকটাকে ভারি রহস্যময় ঠেকত। ভালো করে দেখবার জন্যে কাছে এগিয়ে যাই।

সেও আমাকে দেখেছে। ঘুরে দাঁড়িয়ে। গায়ে নাবিকের পুরনো পোশাক। বয়স হয়েছে, কিন্তু বেশ শক্ত শরীর। রোদে পোড়া, জলে ভেজা পোড় খাওয়া চেহারা। একমুখ সাদা দাড়ি। মাথায় উশকোখুশকো পাকা চুল। তীব্র চোখের দৃষ্টি।

আমাকে একদৃষ্টে খানিকক্ষণ নজর করে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে রুক্ষ স্বরে সে প্রশ্ন করল— হ্যাল্লো, এখানে কী করছ? পাখি-টাখি মারার মতলব আছে নাকি?

বুঝলাম পাখি শিকার সে পছন্দ করে না। তাড়াতাড়ি উত্তর দিই— মোটেই না, সে রকম কোনো অভিসন্ধি নেই, স্রেফ সমুদ্রের হাওয়া খাচ্ছি। তাছাড়া দেখছই তো সঙ্গে আমার কোনো বন্দুক-টন্দুক নেই।

জবাব শুনে লোকটা একটু সন্তুষ্ট হল। বলল— বেশ বেশ। সমুদ্রের হাওয়া অতি উত্তম বস্তু। সব রোগ সারিয়ে দেয়। আমি সারা জীবন এই হাওয়া টেনেছি বুক ভরে। কখনো অসুখ হয় না আমার।

একটু একটু করে ওর সঙ্গে ভাব জমাই।

নাম ভন ডিকি। জাতিতে ওলন্দাজ। আগে ছিল নাবিক। বয়স হওয়ার পর এই পদটি গ্রহণ করেছে!

আমাকে বলল— মুখ দেখে মনে হচ্ছে যেন ইন্ডিয়ান? ইস্ট ইন্ডিজের লোক?

আমি বলি— হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিক ধরেছ ইন্ডিয়ান বেঙ্গলি। ক্যালকাটার নাম শুনেছ? সেখানে থাকি আমরা-

সে বলল— বটে, ক্যালকাটার লোক! ক্যালকাটার নাম শুনব না বলো কী হে! কতবার গিয়েছি ক্যালকাটা পোর্টে। খুব জমকালো শহর।

জিজ্ঞেস করি, একা লাগে না তোমার? এই নির্জনে সারাক্ষণ লাইটহাউসের মধ্যে সময় কাটাও?

ডিকি বলল, না না, একা লাগবে কেন? সমুদ্রই তো আমার সঙ্গী রয়েছে। ঢেউয়ের ভাষা আমি বুঝি! কত রাজ্যের খবর বয়ে এনে আমায় শোনায়। দেশেও আমার আপনজন তেমন কেউ নেই। তাছাড়া সারা জীবন সাতসাগরের বুকের ওপর চষে বেড়িয়েছি, জল দেখে দেখে অভ্যেস হয়ে গেছে। লোনা বাতাস নাকে না গেলে দম আটকে তোলে। এ বয়েসে আর গ্রামে ফিরে, প্রতিবেশীর ভিড়ে শুকনো ডাঙায় ঘর বাঁধতে পারব না। এই দ্বীপেই তাই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেব ঠিক করেছি।

ডিকি তার নাবিক জীবনের, সমুদ্র-ভ্রমণের অনেক চমকপ্রদ অভিজ্ঞতা শোনাল। চমৎকার দিলখোলা বৃদ্ধ— আমার সঙ্গে ভারি ভাব হয়ে গেল তার।

দেখছিলুম কথা বলতে বলতে ডিকি মাঝে মাঝে একদৃষ্টে দূর দিগন্তে তাকিয়ে থাকছে। দূরবীন চোখে দিয়ে কী জানি দেখবার চেষ্টা করছে! কৌতূহলী হয়ে আমি জিজ্ঞেস করলাম— কী দেখছ ডিকি? কোনো জাহাজ-টাহাজ আসবার কথা আছে নাকি?

—‘না না জাহাজ নয়। পাখি! গরম পড়ে গেল, এখন তাদের এসে পড়বার কথা।

—‘কী পাখি? কোত্থেকে আসবে!

—‘প্লোভার! গোল্ডেন প্লোভার। আসবে বহু দূর থেকে। প্রশান্ত মহাসাগরের উত্তর সীমায় সেই যে ঠান্ডার দেশ, সেখান থেকে আসবে। সেখানে এখন শীত এসে পড়ল। তুষারপাত হবে। সারা দেশ ঢেকে যাবে বরফে। কনকনে হিমেল হাওয়া বইবে। প্লোভাররা তাই এ সময়ে প্রতি বছর দক্ষিণে চলে আসে। কিছু পাখি এই দ্বীপে এসে আশ্রয় নেয়। আমি তাদেরই জন্য প্রতীক্ষা করছি।

আশ্চর্য হয়ে বলি— বলো কী হে! এই দুস্তর প্রশান্ত মহাসাগর পেরিয়ে আসবে সামান্য ওই ছোট্ট পাখিগুলো? এ অসম্ভব!

ডিকি ঘাড় নাড়ে— দেখতে ওইটুকু হলে কী হবে পাখির জান ভারি কঠিন। অবশ্য এসে যখন পৌঁছয় খুবই ক্লান্ত হয়ে পড়ে; কিন্তু তবুও আসে, প্রতি বছর আসে। আবার সেই উত্তরদেশে যখন শীত কমে গরম পড়ে, পাখিরা দ্বীপ ছেড়ে চলে যায়।

রাত্রে খাওয়ার পর মামাবাবুর সঙ্গে আমাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলে।

মামাবাবুকে বললেন, ঠিকই বলেছে ডিকি। অক্টোবর মাস নাগাদ এখানে প্যাসিফিক গোল্ডেন প্লোভারের আগমন ঘটে।

প্রশ্ন করি— কত বড়ো পাখি এই প্লোভার!

—‘বড়ো নয়, ছোটো পাখি। আসলে প্লোভার হল তিতির। তিতির একটি গোষ্ঠী। এই গোষ্ঠীতে প্রায় পঁচাত্তর রকম স্পিসিস অর্থাৎ প্রজাতি আছে। গোল্ডেন প্লোভার বা সোনালি তিতিররা স্বভাবে যাযাবর। বুঝলে, ভারতবর্ষের গোল্ডেন প্লোভার দেখা যায়— কেবল শীতকালে। ভারতের বাইরে থেকে আসে শীতকাল কাটাতে।

—‘তা ওই ‘প্যাসিফিক’ আখ্যাটা আবার জুড়লেন কেন?

—‘কারণ প্যাসিফিক মানে প্রশান্ত মহাসাগরের সঙ্গে এই পাখিগুলির যোগ আছে। যে গোল্ডেন প্লোভারদের বাস আলাস্কায় পশ্চিমে ও সাইবেরিয়ায় পূর্ব প্রান্তে তাদেরই নাম প্যাসিফিক গোল্ডেনপ্লোভার। প্রতি শীতে এই প্লোভাররা ‘মাইগ্রেট’ করে প্রশান্ত মহাসাগরের ওপর দিয়ে উড়ে আসে হাওয়াই, টঙ্গা, নিউজিল্যান্ড প্রভৃতি দ্বীপে। কারণ উত্তর গোলার্ধে যখন শীত দক্ষিণে তখন গ্রীষ্ম!

—‘বলেন কী প্রত্যেক বছর আসে, আবার ফিরে যায়।

মামাবাবু বললেন, সত্যি, ‘বার্ড-মাইগ্রেশন’ এক আশ্চর্য প্রাকৃতিক ঘটনা। পৃথিবীতে শত শত জাতের পাখি আছে যারা স্বভাবে যাযাবর। প্রতি বছর তাদের দেশে অর্থাৎ যে অঞ্চলে তারা ডিম পাড়ে সেই অঞ্চলে যখন শীতের আবির্ভাব ঘটে যাযাবর পাখিরা তখন অন্য কোনো অঞ্চলে উড়ে যায়। এক-এক জাতের পাখি এক-একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে এসে শীতকাল কাটায়। বোধহয় ঠান্ডার ভয়ে বা কীটপতঙ্গ ইত্যাদি খাদ্যের অভাব হওয়ায় শীতের আগমনে যাযাবর পাখিরা দলে দলে তাদের অন্য আস্তানা অভিমুখে রওনা হয়। সেখানে তখন উষ্ণতর আবহাওয়া, প্রচুর খাদ্য। কোনো কোনো জাতের পাখি আছে যারা সাগর গিরি মরুভূমি লঙ্ঘন করে দূর দূর দেশে চলে যায়। যেমন ধরো, ছোট্ট পাখি আর্টিক ‘টার্ন’, উত্তর মেরুর কাছে বাড়ি। উত্তর গোলার্ধে শীত পড়লে চলে আসে দক্ষিণ গোলার্ধেরও দক্ষিণ অঞ্চলে। যাওয়া-আসায় মোটামুটি বাইশ হাজার মাইল পথ অতিক্রম করে! প্যাসিফিক গোল্ডেন প্লোভাররাও বড়ো কম হয় না— যাতায়াতে বারো তেরো হাজার মাইলের ধাক্কা!

মামাবাবু ডিবে বের করে একটিপ নস্যি নিলেন। গোটা দুয়েক সজোরে হাঁচলেন। একটু দম নিয়ে ফের বলতে আরম্ভ করলেন-

পাখিরা তাদের শীতকালীন আস্তানায় তো হাজির হল। সেখানে আরামে কাটাল কটা মাস। এদিকে নিজেদের দেশে ক্রমে শীত যায় কমে। আবহাওয়া উষ্ণতর হয়ে ওঠে— গ্রীষ্ম এসে পড়ে। পাখির দল কোনো অজানা সংকেতে চঞ্চল হয়ে ওঠে। তারপর দেখা যায় দলে দলে পাখি ফিরে চলেছে যে যার দেশে।

দেশে ফিরে তারা ডিম পাড়ে। ডিম ফুটে বাচ্চা বেরোয়। মাস গড়ায়, শাবকরা বড়ো হয়। আবার সে রাজ্যে শীত আসে এগিয়ে। শীতের প্রারম্ভে কাচ্চা-বাচ্চা সমেত পাখির দল আবার ঘর ছাড়ে।

দারুণ ইন্টারেস্টিং লাগছিল। তাই তো, এতদিন চোখের সামনে গাছে গাছে কত পাখি দেখেছি। ভেবেছি সবারই বাসা বুঝি ধারে-কাছে। কিন্তু তাদের মধ্যে যে এমন বিদেশি অতিথিরা থাকেন কে জানত? ভিন দেশের মানুষ দেখে আকৃষ্ট হয়েছি। কল্পনা করেছি দূর দেশ থেকে কত অজানা পথ বেয়ে এসেছে লোকটি! কত না-জানা পৃথিবীর খবর রাখে ও। কিন্তু ওই যে পাখির দল, তারাও নাকি আসে অনেক দূর দেশ থেকে, কত বিচিত্র অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে। প্রতি বছর চলে তাদের যাযাবরী ভ্রমণসূচি। যদি ওদের ভাষা বুঝতাম, কত দেশ-দেশান্তরের বার্তা ওরা পৌঁছে দিত আমাদের কানে।

প্রশ্ন করলাম— ভারতবর্ষেও বোধ হয় অনেক যাযাবর পাখি আসে বাইরে থেকে?

মামাবাবু বললেন, নিশ্চয়ই। শীতের আগে দেখনি নানা জাতের হাঁস সার বেঁধে আকাশপথে উড়ে যায়। এরা ভারতে আসে হিমালয় অঞ্চল, মধ্য এশিয়া এমনকী আরও উত্তরে সাইবেরিয়া থেকে। হাঁস ছাড়াও অবশ্য আরও নানান পাখি আছে শীতকালে ভারতে চলে আসে ঠান্ডা অঞ্চল থেকে। আবার ফিরে যায় শীতের শেষে

সুনন্দ ততক্ষণ চুপচাপ শুনছিল। কোনো কথা বলেনি। মনে হল এ-সব তত্ত্বের অনেকখানিই তার জানা। হঠাৎ সে প্রশ্ন করল— আচ্ছা ভারত থেকেও কি কোনো পাখি শীতকালে বেরিয়ে যায়?

মামাবাবু বললেন— হ্যাঁ, তাও যায় বৈকি। যেমন ‘পাইড ক্রেস্টেড কুক্কু’, বাংলাদেশে যাকে ডাকে চাতক বা শা-বুলবুল। কোথাও চলে মৌসুমি পাখি।

সুনন্দ বলে— অ্যাঁ, চাতক! তাই নাকি! ওই যে ফুট খানেক লম্বা, দেহের ওপরের অংশ কালো-সাদা ডোরা, নীচের অংশ সাদা। লম্বা ডোরাকাটা লেজ, মাথায় কালো ঝুঁটি। বর্ষার আগে দেখা যায়— সেই পাখিটা তো?

মামাবাবু বললেন, রাইট। শীতের আগে চাতকরা আফ্রিকায় চলে যায়। আবার ফিরে আসে বর্ষা নামার ঠিক আগে। দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর পথ বেয়ে।

রাত হয়ে গেছিল। মামাবাবু তাড়া দিলেন, এবার শুতে যাও। আমার কিন্তু মোটেই ইচ্ছে ছিল না আড্ডা ভাঙতে। সংকল্প করলাম— ভালো করে লক্ষ করতে হবে এই যাযাবর পাখি সমাজকে।

তিন

পরদিন বিকেলে সাগরবেলায় ডিকির সঙ্গে দেখা হল। আজ সুনন্দ ছিল সঙ্গে। ডিকি আমাদের সহাস্যে অভ্যর্থনা জানাল।

কত রাজ্যের গল্প শোনাল সে। কত দেশ সে দেখেছে। কত বন্দরে তাদের জাহাজ ভিড়েছে। কত বিচিত্র তাদের অভিজ্ঞতা। এক-একটা কাহিনি রীতিমতো উদ্ভট ও অবিশ্বাস্য।

ডিকি বলল— টঙ্গা দ্বীপপুঞ্জকে প্রথম সভ্যমানবের দরবারে পরিচিত করিয়ে দেয় তাদেরই পূর্বপুরুষ ওলন্দাজরা— সপ্তদশ শতাব্দীতে। তারপর এবেল টাসমেন, ডা. কুক-এর মতো আরও অনেক নামজাদা ক্যাপ্টেনের জাহাজ নোঙর করেছে টঙ্গা দ্বীপপুঞ্জে। কুক তো তিন-তিনবার এসেছিলেন। ভারি সহৃদয় ব্যবহার পেয়েছিলেন তিনি পলিনেশিয়ানদের কাছ থেকে। খুশি হয়ে দ্বীপপুঞ্জের নামকরণ করেন— ফ্রেন্ডস আইল্যান্ডস

ডিকির সঙ্গে আমিও এখন উৎকণ্ঠিত চিত্তে পাখির আগমনের অপেক্ষা করছি। ডিকি বলল, ওরা আসছে; আমি বেশ অনুভব করছি খুব কাছে এসে পড়েছে। হয়তো বা আজকালের মধ্যেই—

ডিকির অনুমান সঠিক হল।

সেইদিন রাত্রে খাওয়াদাওয়ার পর তিনজন কুটিরের বাইরে চাঁদের আলোয় বসে। সহসা কানে এল ক্ষীণ আওয়াজ— কিচির মিচির, কিচমিচ কিচমিচ— শব্দ ক্রমশ এগিয়ে এল। দ্বীপের আকাশ মুখর হয়ে উঠল পাখির কাকলিতে। এক খণ্ড মেঘ যেন ভেসে এল মাথার ওপর। দেখলাম কিছু পাখি কিন্তু এল না— সোজা উড়ে বেরিয়ে গেল দ্বীপ ছাড়িয়ে। বাকিরা কিছুক্ষণ চক্কর দিল তারপর নামতে আরম্ভ করল।

আগন্তুক প্যাসিফিক গোল্ডেন প্লোভারদের সেই প্রথম ব্যাচ। পর পর কদিন ধরে আরও কয়েক ঝাঁক পাখি এসে আশ্রয় নিয়েছিল দ্বীপে।

সক্কালে বেরিয়ে পড়লাম।

দ্বীপের যে অংশ নির্জন সেদিকটায় নেমেছে প্রচুর পাখি। এখানে একটি অগভীর জলাশয় আছে। চারপাশে ঘাসবন। পাখিরা জলাশয়ের চতুর্দিকে আস্তানা গেড়েছে।

দেখি ডিকি ইতিমধ্যেই হাজির হয়েছে। অসংকোচে সে ঘুরে বেড়াচ্ছে পাখিদের মাঝে। পাখিগুলি তাকে দেখে বিন্দুমাত্র ভয় পাচ্ছে না— যেন অতি পরিচিত ব্যক্তি। পাখির চেঁচামেচিতে রীতিমতো সরগরম হয়ে উঠেছে সেই নির্জন স্থান।

পাখিগুলি মাপে আমাদের দেশের তিতিরের মতোই। ডানা ও দেহের ঊর্ধ্বাংশের রঙ খয়েরি তাতে সোনালি ও হলদে ছিটছিট। নীচের অংশ— বুক, গলা ছাই রঙের। সোজা শক্ত ঠোঁট। ঘাড় উঁচু করে সরু সরু ঠ্যাং ফেলে চলাফেরা করছে।

মামাবাবু বললেন— যেখানে এখন দেখছ হালকা কালো রং, প্রজনন ঋতুতে, ডিম পাড়ার সময় কিন্তু রং বদলে হয়ে যাবে কালো।

পাখিগুলো যেমন তীব্র বেগে ওড়ে, তেমনি মাটির ওপর দ্রুত ছোটে। তাদের মেজাজ ভারি তিরিক্ষি। একটু কাছে এগিয়েছি, অমনি তীক্ষ্ণ গলায় অ্যাইসা চেল্লাচেল্লি জুড়ে দিল যে কী বলব!

ডিকি কটমট দৃষ্টিতে তাকাল। আমরা সসংকোচে দূরে সরে গেলাম।

—‘নানা উপায়ে সে শ্রান্ত ক্লান্ত পাখিদের পরিচর্যা করতে থাকে। ফার্স্ট এড-এর বন্দোবস্ত করে। গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করে। পকেট থেকে শুকনো মাছ, গমের দানা, আরও অনেক রকম পাখির খাবার বের করে ছড়িয়ে দেয়।

একটা আশ্চর্য জিনিস লক্ষ করছি। মনে হচ্ছে যেন পাখিগুলো ডিকির পূর্বপরিচিত! মামাবাবুকে জিজ্ঞেস করি— তাহলে কি একই পাখির ঝাঁক প্রত্যেক বছর এই দ্বীপে উপস্থিত হয়। কি-ন্তু, আলাস্কা— সাইবেরিয়া— অতদূর থেকে বিশাল প্রান্তর মহাসাগর পেরিয়ে এই ছোট্ট দ্বীপে পথ চিনে আসবে কী করে!

মামাবাবু বললেন, এ এক রহস্য। আজও পক্ষিতত্ত্ববিদরা এই রহস্যের সঠিক কোনো কিনারা করতে পারেননি। জানা গেছে, প্রত্যেক বছর যাযাবর পাখিরা শুধু যে একই শীত যাপনের এবং একই প্রজনন ভূমিতে, একই এলাকায় ফিরে আসে তাই নয়, কিছু পাখি একই নির্দিষ্ট বাসায় অভ্রান্তভাবে বছর বছর হাজির হয়। আকাশযাত্রায়ও এরা একটি সুনির্দিষ্ট পথ অনুসরণ করে। যাওয়া-আসার পথে বিশ্রাম কেন্দ্রগুলিতেও পথশ্রান্ত পাখিরা প্রায় একই সময়ে এসে পৌঁছয়।

কেউ কেউ বলেন হয়তো কিছু ভৌগোলিক চিহ্ন, দিনে সূর্যের অবস্থান, রাতে আকাশের ভাষা, বায়ুর গতি ইত্যাদি মাইগ্রেটরি বার্ডদের দিকনির্ণয়ে সহায়তা করে। কিন্তু ধরো, যেখানে সামনে পার হতে হয় দিকচিহ্নহীন দুস্তর সাগর বা মরুভূমি, তখন? দেখা গেছে সে পথও পাখিরা দ্বিধাহীন চিত্তে সঠিক লক্ষ্যে তীর বেগে পার হয়ে যায়। কোন অদৃশ্য শক্তি তাদের চালনা করে কে জানে?

সুনন্দ বলল, কিন্তু ডিকি পাখিদের আলাদা করে চিনছে কী করে? — সব কটাই তো দেখতে একরকম!

মামাবাবু বললেন, হয়তো দেখে দেখে ওর দৃষ্টিশক্তি খুব তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে। আলাদা করে চিনবার ক্ষমতা জন্মেছে তবে আমার ধারণা ও প্রধানত চিনছে রিং দেখে।

—‘রিং?

—‘হ্যাঁ, লক্ষ্য করে দেখো অনেক পাখির পায়েই রিং পরানো রয়েছে।

দূরবীন দিয়ে ভালো করে দেখলুম, তাই তো! হালকা অ্যালুমিনিয়ামের আংটি পরা, ওপরে আবার ক্ষুদে ক্ষুদে অক্ষরে কী সব লেখা! কী উদ্দেশ্য?

মামাবাবু বললেন— ওটা চিহ্ন। যাযাবর পাখিদের নিয়ে যারা গবেষণা করে তারা এ-জাতীয় পাখি ধরে পায়ে আংটি পরিয়ে দেয়। রিং-এর ওপর লেখা থাকে একটা নির্দিষ্ট ক্রমিক সংখ্যা, যে ব্যক্তি বা সংস্থা পরিয়েছে তার নাম ঠিকানা ইত্যাদি—

এইরকম রিং পরানো পাখি যদি ধরা পড়ে বা মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় তাহলে রিং-এর ঠিকানায় খবর পাঠানো হয়— অমুক নম্বর পাখি, ঠিক অমুক সময়ে, অমুক জায়গায় দেখা গিয়াছে। সাধারণত এরকম চিহ্ন দেওয়া পাখিকে বন্দী করে না রেখে, বা মেরে না ফেলে, ছেড়ে দেওয়াই নিয়ম। এমনি করে জানা যায় একটি বিশেষ পাখি কোন পথে যাতায়াত করে কোথায় কোথায় থাকে। কোথায় শীতকাল কাটায়। কোথায় বা তারা ডিম পাড়ে ইত্যাদি খবর—

ইতিমধ্যে আরও কয়েকজন আমাদের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছিল।

সমুদ্রগবেষক দলের প্রধান মি. রিচার্ডসন এবং তাঁর কজন সঙ্গীসাথী। বাইনকুলার লাগিয়ে তাঁরা অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করছিলেন এই আশ্চর্য পক্ষী সমাগম।

দেখলাম সদ্যোজাত শাবকগুলিও সঙ্গে এসেছে। বললাম— ইস, কত টুকুটুকু ছানা দেখুন! এতটা পথ ওরা পাড়ি দেয় কী করে!

মামাবাবু বললেন, হুঁ, সঙ্গে তো আসেই। অনেক সময় আবার সবে ডিম ফোটা বাচ্চারা বাপ-জ্যাঠাদের সাহায্য ছাড়াই ঠিক পথ চিনে গন্তব্যস্থলে পৌঁছয়। কী অদ্ভুত শক্তি!

হঠাৎ শুনি ডিকি মহা উত্তেজিতভাবে চিৎকার করছে— সেই বাচ্চাটা গেল কোথায়? এবার দেখছি না তো? আগের বার এল, কী সুন্দর ফুটফুটে ছানা। পায়ে টুকটুকে লাল গয়না পরিয়ে দিলুম— কিন্তু গেল কই?

মামাবাবু বললেন— শুনছ, ডিকিও রিং পরাবার বিদ্যে জানে।

অনেক খুঁজেও ডিকি পাখিটির সন্ধান পেল না।

পেছন থেকে রিচার্ডসন মন্তব্য করলেন, কে জানে, হয়তো পথে ঝড়ঝাপটায় অক্কা পেয়েছে! কিংবা কেউ ধরে খেয়েছে।

আরেকজন বললেন, হতে পারে। গোল্ডেন প্লোভারের মাংস আর ডিম কিন্তু খেতে ভারি সুস্বাদু। ইউরোপের বাজারে বেজায় চাহিদা। চড়াদামে বিক্রি হয়।

রিচার্ডসন বললেন— দেখছেন প্রফেসর ঘোষ, বুড়োর কী দুশ্চিন্তা। বড়ো ভালোবাসে পাখি। এদের জন্যই ও দ্বীপ ছেড়ে নড়তে চায় না।

ডিকি কিন্তু অচিরেই তার শোক ভুলে গেল। অনেকগুলি নতুন ছানা পেয়ে সে আবার মহাখুশি।

বেশ বেলা হয়ে গেছে। সূর্য মাথার ওপর। আমরা এবার ঘরে ফিরলাম। ডিকি বোধহয় আজ আর নাওয়া-খাওয়ার সময় পাবে না।

চার

আমিও পাখি নিয়ে মজে গেলুম। সময় কাটাবার ভাবনা রইল না।

সুযোগ পেলেই ডিকির সঙ্গে সঙ্গে ফিরি। পক্ষী সমাজের হাবভাব আচার-আচরণ পর্যবেক্ষণ করি। ক্রমে পাখিরা মেনে নিল আমাকে। কাছে গেলে আর মারমুখী হয়ে উঠত না। আমার সম্বন্ধে তাদের ভয় ভেঙে গেল। যদিও ডিকির মতো অতটা লাই তারা আমায় কোনোদিনই দেয় না।

শ্রান্ত বিহঙ্গগুলি প্রথমে বিশ্রাম নিল; তারপর লেগে গেল তড়িঘড়ি বাসা বানাতে।

এদের বাসার কোনো ছিরিছাঁদ নেই। মাটিতে ঘাসবনে অল্প গর্ত করে কাঠি-কুটো জড়ো করে ঘর বানায়। সারাদিন তারা নিজেদের মধ্যে বকর বকর করছে; ঝগড়াঝাঁটিও হচ্ছে আর প্রাণপণে খুঁটেখুঁটে বেড়াচ্ছে খাবারের অন্বেষণে।

একদিন দেখি ডিকি উদ্বিগ্ন মুখে আকাশের পানে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমায় দেখে বলল— আবহাওয়ার লক্ষণ ভালো নয়, বোধহয় ঝড় উঠবে। দেখছ না পাখিরা কেমন ভয় করছে। ওরা ঠিক বুঝতে পারে। তাই তো। পাখিরা দেখলাম বেশ সন্ত্রস্ত, ভীত স্বরে ডাকছে।

সত্যি সত্যিই ঝড় উঠল বিকেলে। অবশ্য বাতাসের বেগ বেশি ছিল না, কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আকাশ আবার পরিষ্কার হয়ে গেল।

গোল্ডেন গ্লোভারের মাংসের সুখ্যাতি শোনবার পর থেকেই সুনন্দের মনে আর শান্তি নেই। আমাকে কেবলই খোঁচায়— যা-না, রাত্তিরে লুকিয়ে গোটা দুই পাখি ধরে আন। খাসা রোস্ট খাওয়া যাবে।

ওরে বাবা; ডিকি জানতে পারলে মহা কেলেঙ্কারি হবে। আর আস্ত রাখবে না।

—‘দূর বোকা! অতগুলো পাখির মধ্যে থেকে দুটো সরালে বুঝতেই পারবে না?

—‘কিছু বলা যায় না। মনে হয় ও সব কটাকে চেনে। যদি ধরে ফেলে? আমি পারব না— ইচ্ছে হলে তুই নিজে যা-

—‘যদি আমিই ধরতে পারতাম তবে তোকে এত সাধব কেন? বেটারা ভারি বেরসিক। আমি কাছে গেলেই এমন বিরাট হৈ চৈ জুড়ে দেয় যে রাজ্য সুদ্ধ জাগিয়ে তোলে-

মামাবাবুও উৎসাহ দিলেন না। কী দরকার। জানতে পারলে বুড়ো মহা চটে যাবে।

হতাশ হয়ে সুনন্দকে এ যাত্রা প্লোভারের রোস্ট খাবার আশা ত্যাগ করতে হল।

ডিকির কাছে জানতে চেয়েছি— পাখিকে আংটি পরানোর কায়দা তুমি শিখলে কোত্থেকে?

ডিকি বলছে, এক পক্ষিতত্ত্ববিদের কাছ থেকে। বছর চারেক তিনি এই দ্বীপে এসেছিলেন। কিছুদিন ছিলেন। গোল্ডেন প্লোভারদের মাইগ্রেশন ও জীবনযাত্রা নিয়ে রিসার্চ করছিলেন ভদ্রলোক। তিনিই রিং পরানোর কায়দা ও প্রয়োজনীয়তা শিখিয়ে দেন। আমি এখন প্রত্যেক বছর নতুন পাখিদের কয়েকটাকে নম্বরি রিং পরিয়ে চিহ্ন করে দিই। খেয়াল রাখি তারা বছর বছর ফিরে ফিরে আসে কি না? নোট করে রাখি। তারপর সেই বৈজ্ঞানিককে চিঠি লিখে খবর জানাই।

বাঃ, ডিকি যে দেখছি একজন রীতিমতো গবেষক।

মামাবাবু শুনে বললেন, ওহে, ডিকিকে এত ফেলনা ভেবো না। পক্ষীসমাজের রহস্য উদ্ঘাটনে এরকম সব নগণ্য লোকদের দান বড়ো কম নয়। অনেক অজানা তথ্য জানা গেছে এদের চেষ্টায়।

একদিন শুনি ডিকি নিজের মনে বিড়বিড় করছে— কই পেটুক এল না যে এখনও! এতদিন দেরি হওয়া তো উচিত নয়!

জানতে চাই— ডিকি, পেটুক কে?

—‘একটা পাখি। ভারি লোভী। দিনরাত কেবল খাই খাই করে, তাই নাম দিয়েছি পেটুক। এমন ওস্তাদ লাইটহাউসের ওপরের ঘরে আমার কাছে হাজির হবে খাবারের লোভে। ওর জন্যে শামুক, গুগলি, ফড়িং-এর স্টক রাখতে হয় আমায়।— কী জানি, হয়তো জল ঝড়ে পড়ে প্রাণ হারিয়েছে। কিংবা অন্য কোনো দুর্ঘটনা—

দেখলুম পেটুকের জন্য সে বেজায় চিন্তিত।

পাঁচ

আমাদের দ্বীপে আগমনের পর প্রায় দু সপ্তাহ অতীত হয়েছে। কদিন আর পাখি দেখতে যাইনি, একটু একঘেয়ে লাগছিল। মামাবাবুদের জাহাজে যাচ্ছিলাম আধুনিক গবেষণাপদ্ধতি দেখতে। দ্বীপের অন্যান্য অংশেও বেড়াচ্ছিলাম।

সেদিন দুপুরে দেখলাম আরও কটা প্লোভার হাজির হল দ্বীপে। চোদ্দো-পনেরোটা পাখির এক ছোটো দল। পাখি দেখার ইচ্ছাটা আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। বিকেলে নতুন পাখিগুলি দেখতে গেলাম।

পুরনো পাখিদের আস্তানা আমার বিলক্ষণ চেনা হয়ে গেছে। বাসা-টাসা বানিয়ে তারা এখন গুছিয়ে বসেছে। প্রত্যেকটি বাসা আমি চিনি। দেখলাম পুরনোদের এলাকার কিছুদূরে কয়েকটা পাখি জড়ো হয়েছে। তোড়জোড় চালাচ্ছে ঘর বাঁধবার। এগুলিই নতুন আগন্তুক সন্দেহ নেই।

—‘একী!!

একটা পাখি দেখলুম, তার দুপায়ে দুটি রিং!

একটি রিং গতানুগতিক হালকা অ্যালুমিনিয়াম বা প্লাস্টিকের তৈরি কিন্তু অপর রিংটি বিশেষভাবে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল—

চকচকে টিনের পাত দিয়ে তৈরি মোটা রিং। গা এবড়োখেবড়ো। অন্য রিংগুলির মতো নিটোল মসৃণ নয়। কেউ যেন খেলাচ্ছলে টিন মুড়ে আংটি বানিয়ে পরিয়ে দিয়েছে। এত রিং পরা পাখি দেখেছি কিন্তু কারো দুপায়ে তো কখনো রিং দেখিনি। তারপর আবার বিচ্ছিরি দেখতে। কোনো বাচ্চা ছেলের কাণ্ড নিশ্চয়ই।

একটু পরে ডিকি এল। সেও এসেছে নতুন অভ্যাগতদের দর্শন করতে। তখন ডেকে বললাম—

—‘আচ্ছা দুপায়ে রিং পরানো কোনো পাখি আছে নাকি?

—‘অ্যাঁ, দুপায়ে রিং? কখনো দেখিনি তো! কই?

পাখিটা দেখেই ডিকি লাফিয়ে উঠেছে— আরে ওই তো পেটুক। অ্যাদ্দিন কোথায় ছিলি বাপ? ভেবে ভেবে হয়রান হচ্ছি। তোকে আবার এই নতুন গয়নাটা পরাল কে?

পকেট থেকে কিছু খাবার বের করে মাটিতে ছড়িয়ে দিতেই পেটুক দৌড়ে এল।

কৌতূহলী হয়ে আমি কাছে গিয়ে দূরবীন লাগিয়ে নতুন রিংটা পরীক্ষা করছিলাম—

—‘আরে গায়ে যে কী সব লেখা রয়েছে। মনে হচ্ছে ইংরেজি হরফ! সাধারণ ক্রমিক সংখ্যা তো নয়! —ডিকি ধর তো ওকে—

ডিকি পেটুককে ধরে পা থেকে রিংটি খুলে নিল। বলল— তাই তো, কী সব আঁকিবুকি লেখা রয়েছে, ভালো পড়তে পারছি না। নাও দেখো তো হে-

রিং পরীক্ষা করেই আমি চমকে উঠি।

টিনের ওপর গভীরভাবে আঁচড় কেটে লেখা— প্লিজ হেল্প। লেটার ইনসাইড।

রিং খুলে ফেলতেই একটা চিঠি বেরিয়ে পড়ল। পাতলা কাগজে ইংরেজিতে লেখা। চিঠির শেষে পত্রলেখকের নাম পড়ে বিস্ময়াবিষ্ট হলাম— স্যামুয়েল ওয়েকফিল্ড!

নামটি আমার সুপরিচিত। শুধু আমার কেন, আধুনিক জগতে এই বিখ্যাত ভূতাত্ত্বিকের নাম কে না জানেন।—

ড. ওয়েকফিল্ড ছিলেন আর্কটিক-মেরু-গবেষণা কেন্দ্রের ডিরেক্টর। মাস দুয়েক পূর্বে প্লেনে চড়ে আলাস্কায় যাচ্ছিলেন। পথে প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে প্লেনটি নিখোঁজ হয়ে যায়। প্লেনে তিনিই ছিলেন একমাত্র যাত্রী, আর ছিল পাইলট, কো-পাইলট ইত্যাদি নিয়ে জনা তিনেক। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও প্লেন বা আরোহীদের কোনো হদিশই মেলেনি। ওয়ারলেসে শেষ খবর আসে যে তাদের প্লেন প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে পড়েছে। সম্ভবত আরোহী সমেত প্লেনটি সাগরগর্ভে নিমজ্জিত হয়েছে। বিজ্ঞান জগতে ড. ওয়েকফিল্ড-এর মৃত্যু এক অপূরণীয় ক্ষতি। মেরুপ্রদেশের আবহাওয়া ভূ-প্রকৃতি সম্পর্কে তিনি বহু মূল্যবান তথ্য আবিষ্কার করেন। মাসের পর মাস সেই চিরতুষার রাজ্যে বাস ক’রে কঠিন অধ্যবসায় ও অসহনীয় কষ্ট সহ্য করে তিনি গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছিলেন—

তারিখ দেখে বোঝা যাচ্ছে পত্রটি লিখতে হয়েছে দুর্ঘটনার পরে।

ড. ওয়েকফিল্ড কি তবে জীবিত ছিলেন! কিন্তু কোথায়?

তাড়াতাড়ি চিঠি পাঠ করলাম।

ড. ওয়েকফিল্ড লিখেছেন—

ঝড়ের কবলে পড়ে আমাদের প্লেন সমুদ্রের বুকে আছড়ে পড়ে। দৈবকৃপায় আমার প্রাণরক্ষা হয়। এক খণ্ড কাঠ আঁকড়ে ভাসতে ভাসতে এক ক্ষুদ্র অজ্ঞাত দ্বীপে এসে পড়ি। দ্বীপটি জনমানবশূন্য। সম্ভবত এই ভূখণ্ড কোনো সমুদ্রগর্ভস্থিত আগ্নেয়গিরির চুড়ো। আমার সাথীরা বোধহয় কেউ আর রক্ষা পাননি।

দেহের নানাস্থানে আঘাত লাগে। কয়েকদিন চলচ্ছক্তিরহিত অবস্থায় শুয়ে থাকি।— এখন কোনোক্রমে জীবনধারণ করে রয়েছি। কিন্তু শরীর ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে। এই দ্বীপে কোনো ফলমূল পাওয়া যায় না। কাঁকড়া, ঝিনুক বা সমুদ্রের খাঁড়ির স্বল্প জলে ছোটো ছোটো মাছই আমার একমাত্র খাদ্য। চকমকি পাথর ঠুকে আগুন জ্বেলে তাই পুড়িয়ে খাচ্ছি। এদিকে শীতও এসে পড়েছে। এখানকার দারুণ ঠান্ডায় টিকে থাকবার মতো উপযুক্ত পোশাক আমার নেই, নেই মাথা গুঁজবার আশ্রয়।

হঠাৎ কতগুলি গোল্ডেন প্লোভার দেখে বিস্মিত হলাম। সামুদ্রিক পাখি ছাড়া অন্য কোনোরকম পাখি দেখিনি এ দ্বীপে। দ্বীপটা একেবারে নেড়া, প্রস্তরময়। উদ্ভিদ, কীটপতঙ্গ ইত্যাদি পাখির খাদ্যের একান্ত অভাব। কয়েকটা পাখির পায়ে দেখলাম রিং। নিশ্চয়ই মাইগ্রেটরি বার্ড। কেউ এদের মুভমেন্ট হারিয়ে দৈবাৎ ছিটকে এসে পড়েছে এই দ্বীপে।— মাথায় একটা প্ল্যান খেলে গেল। কে জানে হয়তো ঈশ্বরের অভিপ্রায় নয় যে আমি এ যাত্রা এরূপ অসহায় ভাবে প্রাণ হারাই। নইলে এই দলছাড়া পাখিগুলি আমার সামনে এসে উপনীত হবে কেন।

অনেক কষ্টে খাবার লোভ দেখিয়ে একটা পাখিকে বন্দী করলাম। তামাকের কৌটো থেকে এক টুকরো টিন কেটে রিং বানিয়ে ভিতরে এই চিঠি ভরে পাখির পায়ে পরিয়ে দিলাম— কোনো পক্ষী-পর্যবেক্ষকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে এই আশায়। জানি না এই পক্ষীদূত আমার প্রাণ রক্ষা করতে পারবে কি না।

যার হাতেই এই চিঠি যাক-না-কেন, দয়া করে যত শীঘ্র আমার উদ্ধারের ব্যবস্থা করবেন। আন্দাজ করছি দ্বীপটি আলাস্কার নিকটে প্রশান্ত মহাসাগরের উত্তরাংশে অ্যালুইশিয়ান দ্বীপপুঞ্জের অন্তর্ভুক্ত। যদি আমার জীবন রক্ষা করা সম্ভব নাও হয় আমার রিসার্চ পেপারগুলি উদ্ধার করবেন।

দ্বীপের মধ্যস্থলে পাহাড়ের মধ্যে একটি ছোটো গুহা আছে। তার ভিতর রেখে যাব।

ঝড়ের সম্মুখীন হতেই বিপদের গুরুত্ব বুঝি। সঙ্গে কিছুটা রিসার্চ পেপার ছিল। বাক্স থেকে সেগুলি বের করে অয়েলক্লথে মুড়ে পিঠে হ্যাভারস্যাক পুরে নিই। প্রার্থনা করি আমার বহু সাধনায় ফল এই তথ্যগুলি যেন নষ্ট না হয়ে যায়—

সঙ্গে সঙ্গে দৌড়লাম জাহাজে মামাবাবুর কাছে।

মামাবাবু চিঠি পড়ে উত্তেজনায় চেঁচিয়ে উঠলেন— সে কী! ড. ওয়েকফিল্ড এখনও বেঁচে, এখনও আশা আছে। এখনও হয়তো তাঁকে আমরা উদ্ধার করতে পারব।-

জাহাজে ওয়্যারলেস ছিল। তৎক্ষণাৎ সংবাদ পাঠানো হল-

কটা দিন অধীর উৎকণ্ঠার মধ্যে কাটাচ্ছি।… ড. ওয়েকফিল্ড অতি কষ্টসহিষ্ণু ব্যক্তি। বিরুদ্ধ-প্রকৃতির সঙ্গে কঠোর সংগ্রামে অভ্যস্ত! এবারের যুদ্ধেও তিনি কি জয়ী হতে পারবেন না?

ডিকি রোজ এসে খবর নেয়। আশ্বাস দেয়— ঘাবড়াও মৎ। আমি বলছি, বৈজ্ঞানিককে আলবাৎ বাঁচানো যাবে। এত কষ্ট করে পেটুক চিঠি বয়ে আনল কি এমনি এমনি—

দিন সাতেক পর।

তখনো ভালো করে দিনের আলো ফোটেনি। পূর্ব দিগন্ত সবেমাত্র রক্তাভ হয়ে উঠেছে, এখুনি উঁকি মারবেন দিনমণি। আমাদের কুটিরের দরজায় জোর করাঘাতের শব্দ হল। দ্বার খুলে দেখি, মি. রিচার্ডসন ও আরও কয়েজন জাহাজের অধিবাসী।

—‘কী ব্যাপার? এত সক্কালে?

রিচার্ডসন জড়িয়ে ধরলেন মামাবাবুকে- সুসংবাদ প্রোফেসর ঘোষ। খবর এসেছে। মুমূর্ষু অবস্থায় ওয়েকফিল্ডকে উদ্ধার করা হয়েছে। অবশ্য এখন তিনি অনেকটা সুস্থ। আর কিছুদিন দেরি হলে তাঁকে জীবিত রক্ষা করা যেত কিনা সন্দেহ-

রিচার্ডসন বললেন, আপনাদের প্রত্যেককে আমি বিজ্ঞান জগতের তরফ থেকে সকৃতজ্ঞ ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে তাঁরা আমাদের সঙ্গে বেশ কয়েক দফা করমর্দন করে ফেললেন। মি. রিচার্ডসন জানালেন যে ওয়েক ফিল্ড-উদ্ধার অনারে আজ রাত্রে এক পার্টি দেওয়া হচ্ছে জাহাজে। আমরা তিনজন ভারতীয় হব প্রধান অতিথি। ডিকিকেও আমন্ত্রণ জানানো হবে।

রিচার্ডসনদের সঙ্গে একটি নতুন মুখ দেখছিলাম। ভদ্রলোক সাগ্রহে আমাদের কথাবার্তা গিলছিলেন। হাতে ছোট্ট এক নোটবই। তাতে কী জানি সব লিখেও যাচ্ছেন। তাঁর কাঁধে ঝোলানো এক দামি ক্যামেরা।

ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হল।— রয়টারের রিপোর্টার। নিউজিল্যান্ড থেকে সোজা এসেছেন। আমাদের একটা ইন্টারভিউ চান।

রিপোর্টার অনুরোধ জানালেন— প্লিজ আপনাদের নিজের মুখ থেকে এই চমকপ্রদ কাহিনির একটা বিবরণী চাই। আর আপনাদের ফোটো—

বিবরণী দেওয়া হল। কিন্তু ছবি তোলবার কথায় মামাবাবু ঘোরতর আপত্তি জানালেন– না না, আমার ছবি নয়। নিতে হলে অসিতের ছবি নিন। ওই তো হিরো-

আমারও আপত্তি আছে। আমি কেন? আসল বাহাদুর তো শ্রীমান পেটুক। নিলে ওর ছবিই নেওয়া উচিত।

সুনন্দ সাত তাড়াতাড়ি বলে উঠল— আহা, দিই-না ফোটো! বেচারা এতদূর থেকে এসেছেন।

বটে, আরও জোরালো বাধা দিলাম— কক্ষনো না। পেটুক ছাড়া কারো নয়—

অতএব সবাই চললেন পেটুকের আস্তানায়।

ডিকি ইতিমধ্যে উপস্থিত হয়েছিল। সে সামনে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল। পেটুকের কৃতিত্বে সে গর্বে দুলছে।

পেটুক কাছেই চরছিল। অত লোক দেখে প্রথমটা কাছে ঘেঁসতে চায় না। কিন্তু ডিকি পকেট থেকে খাবার বের করতে সে আর আত্মসংবরণ করতে পারল না। ডানা ঝাপটে উড়ে এল।

খেতে খেতেই পেটুক ঘাড় বেঁকিয়ে ক্যামেরার সামনে পোজ দিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *