বিচিত্র এক ষড়যন্ত্র

বিচিত্র এক ষড়যন্ত্র

দিনটা ছিল শনিবার। হাফ ডে স্কুলের পর বাবলু গিয়ে ঢুকল ঘোষদের বাগানে কুলের লোভে। তেমন বড়ো নয় বাগানটা। গ্রামের সীমানায় বিঘে দুই জমিতে ছোটো এক পুকুর ঘিরে কটা আম নারকেল পেয়ারা ইত্যাদি গাছ। একটা কুলগাছও আছে। বড়ো বড়ো কুল হয়। খেতে খাসা।

বাবলু পকেট ভর্তি করে কুল নিল। তারপর ঝোপের আড়ালে বসে ঝাল-নুন সহযোগে তারিয়ে তারিয়ে কুল খেতে থাকে।

এই বাগানে তেমন কোনো পাহারা নেই। বাগানের এক কোণে সাধুচরণের কুঁড়েঘর। সাধুচরণই যেটুকু পাহারা দেয় বাগানটা। তবে তার বেশি মাথাব্যথা আম আর নারকেল নিয়ে। অন্য ফল নিয়ে বিশেষ গা করে না।

সাধুচরণের বয়স পঞ্চাশ পেরিয়েছে। দোহারা মাঝারি লম্বা। শক্তপোক্ত গড়ন। সে একা থাকে। স্ত্রী তা গত হয়েছে বছর দুই। একটি মাত্র মেয়ের বিয়ে হয়েছে কাছেই এক গ্রামে, বেশ কয়েক বছর আগে। অল্প চাষের জমি আছে সাধুচরণের। তাতে চাষ করে আর এই বাগান পাহারার কাজে কিছু দক্ষিণা পেয়ে তার পেট চলে যায়। অবসর সময়ে সে আড্ডা দেয় আর গান বাজনা নিয়ে থাকে। গানের গলাটি তার খাসা। নানান পল্লিগীতি গায়। আমুদে রসিক সাধুচরণের সঙ্গে কথা বলতে ভালোবাসে গাঁয়ের লোক। ডেকে এনে তার গানও শোনে। গাঁয়ের সব বাড়িতেই তার যাতায়াত আছে।

এখনকার সাধুচরণের সঙ্গে বছর দশের আগের সাধুচরণের কিন্তু মিল নেই। এককালে সাধু ছিল নামজাদা চোর। তার ভয়ে তটস্থ থাকত শুধু এই পারুলডাঙা গ্রাম নয়, আশেপাশের সব গাঁয়ের লোক। বারকয়েক জেলও খেটেছে সাধু। তবে বেশি দিনের মেয়াদ নয়। পুলিশ কোনো দিনই জুৎসই ভাবে কব্জা করতে পারেনি চতুর সাধুচরণকে।

নানা মুনি, নানা মত। কেউ কেউ বলে যে চোর বাপের বদনামে মেয়ের সম্মানহানি হচ্ছিল শ্বশুরবাড়িতে। তাই আদরের মেয়ের কান্নাকাটি অনুরোধে সাধু চৌর্যবৃত্তি ত্যাগ করে। আবার কেউ বলে যে সাধু নাকি এক সন্ন্যাসীর প্রভাবে চুরি ছেড়েছে। যা হোক চোর সাধু সত্যিকার সাধু হওয়ায় পারুলডাঙা এবং আশপাশের গাঁয়ের লোক পরম স্বস্তি পেয়েছে।

বাবলুর কিন্তু সাধুচরণকে বেশ রহস্যময় ঠ্যাকে। সে খানিক সমীহও করে ওকে। একবার এই বাগানে আম চুরি করতে এসে সে সাধুচরণের চোখে পড়ে যায়। সাধু তাকে গাছ থেকে নামিয়ে, তার হাত পাকড়ে বিদ্রূপের সুরে বলেছিল— ঠিক মতন আম চুরিরও এলেম নেই বাছা! ছ্যা ছ্যা। এই বলে সে বাবলুর পকেট থেকে সব কটা কাঁচা আম কেড়ে নিয়েছিল। আরও বলেছিল- তোমার বাড়িতে নালিশ করব না। লঘু পাপে গুরু দণ্ড হয়ে যাবে। তবে ফের ধরা পড়লে কিন্তু নালিশ করব তোমার বাবাকে।

তারপর অবশ্য সাধুচরণ এই নিয়ে আর কথা তোলেনি। বরং দেখা হলে হেসেছে। একবার সে নিজে বাবলুকে দুটো বড়ো বড়ো পাকা ল্যাংড়া আম দিয়েছিল খেতে।

কুল খেতে খেতে বাবলু সাধুচরণের কুটিরের দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখে। সহসা দেখে যে বাগানের পথে সাধুচরণের কুটিরের দিকে চলেছেন বৃদ্ধ উমাপতি ঘোষমশাই। অর্থাৎ এই বাগানের মালিক।

বাবলু আরও লুকিয়ে বসে ঝোপের আড়ালে।

ঘোষমশাই সাধুর কুটিরের সামনে গিয়ে নীচু স্বরে ডাকলেন— সাধু! সাধু দরজা খুলে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসে বলল, পেন্নাম হই বাবু। আপনি আবার কষ্ট করে এলেন কেন?

ঘোষমশাই গম্ভীর ভাবে বলেন, এলেম কি সাধে? তোর পাত্তাই নেই। সেই কাজটা মনে আছে তো?

—‘আজ্ঞে তা কি ভুলি। কথা যখন দিইচি, কাজ ঠিক হাসিল করব। তবে বাবু এসব কর্মে আর মন চায় না। নেহাত আপনারা বলছেন তাই—

—‘কেন। তোমার ভয় করছে নাকি?

—‘ভয়? সাধুচরণ নীরবে হাসে।— ও বস্তুটি আমার নেই। স্বেচ্ছায় এ বৃত্তি ত্যাগ করেছি। তাই আপনাকে বলছি, আমার মন চাইছে না। এই ভার আর কাউকে দিলে পারতেন।

—‘না না। ঘোষমশাই বাধা দেন, তোমায় ছাড়া আর কাউকে এ কাজে বিশ্বাস করতে ভরসা হয় না। জানাজানি হয়ে গেলে কেলেঙ্কারি হবে।

ঘোষমশাই আরও কী সব বলেন চাপা গলায় উদ্‌বিগ্ন মুখে। বাবলুর কানে তা ভালোভাবে পৌঁছয় না। সে উৎকর্ণ হয়ে শোনে টুকরো টুকরো বাক্য। যেমন— হাতে বেশি সময় নেই। প্ল্যানট্যান সব—

সাধুচরণ বলে, আজ্ঞে সে সব হয়ে গ্যাছে। কাল সকালে যাব একবার দেখে নিতে-

ঘোষমশাই বলেন, খুব হুঁশিয়ার। রাখহরির মেজো ছেলেটা আস্ত গুণ্ডা। জবাব হয় গুরুর কৃপায় সাধুচরণ কোনো মানুষকে ডরায় না। তার বেশি ভয় বরং কুকুরকে। ভারি বেয়াড়া জানোয়ার।

—‘কুকুর থাকলে সে বাড়িতে চুরি করনি?

—‘এ কেমন কথা? সাধু নিঃশব্দে হাসে, বাঘা ডালকুত্তার পাহারা দেওয়া কত বাড়ির সিন্দুক সাফ করেছি। কুকুরকে বশ করার বিদ্যে না জানলে কি এ লাইনে উন্নতি করা যায়? আপনি দুশ্চিন্তা করবেন না। এখন বিদায় নিন। কেউ দেখলে কী আবার সন্দেহ করে বসে।

ঘোষমশাই সন্ত্রস্ত চোখে চারপাশ দেখে নিয়ে গুটিগুটি ফিরে চললেন। সাধুচরণ ঢুকে গেল তার ঘরে।

আরও মিনিট পনেরো বাদে বাবলু চুপিচুপি সরে পড়ল বাগান থেকে। কোনো অভাবিত রহস্যের সম্ভাবনায় সে তখন উত্তেজনায় থরথর।

এবার বাবলুর কিছু পরিচয় দেওয়া যাক।

বীরভূম জেলায় ময়ূরাক্ষী নদীর তীরে বাবলুর গ্রামের নাম পারুলডাঙা। বাবলু পড়ে স্কুলে, ক্লাস নাইনে। সে বেজায় ডানপিটে আর খেলাধুলায় চৌকস। পড়াশুনায় মোটামুটি। ইদানীং বেশ-কিছু রোমাঞ্চকর গোয়েন্দা গল্প পড়ে তার মন উত্তেজিত হয়েছে। কোনো রহস্যের গন্ধ পেলেই সে ঝাঁপিয়ে পড়ছে তার সমাধানে।

পরদিন রবিবার। ভোর থেকে গিয়ে বাবলু লুকিয়ে রইল ঘোষদের বাগানে ঘণ্টাখানেক বাদে সাধুচরণ বেরিয়ে এল তার কুটির থেকে। তার পরনে গেরুয়া রঙের ফতুয়া ও সাদা ধুতি। হাতে দোতারা।

সাধুচরণ ধীরে ধীরে চলল গ্রামের ভিতর। সে যেন না দেখতে পায় এমনভাবে দূরত্ব রেখে বাবলু সাধুকে অনুসরণ করে।

সাধুচরণ পথে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গাঁয়ের কয়েকজনের সঙ্গে রসালাপ করল। একজনের বাড়ির দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে কীর্তন গাইল কয়েক কলি। এপথ ওপথ খানিক ঘুরে সে গিয়ে ঢুকল রাখহরি বোসের বাড়ির ভিতর। ওই বাড়িতে সে রয়ে গেল।

মিনিট দশেক বাদে বাবলু বোসবাড়ির সামনে দিয়ে যাবার ছলে আড়চোখে ভিতরে দেখে নিল আধখোলা দরজা পথে-

বোসবাড়ির এলাকাটা বেশ বড়ো। প্রায় বিঘেখানেক জায়গা মাটির উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। ভিতরে দোতলা পাকা বসতবাড়ি, গোয়ালঘর ইত্যাদি। গোয়ালঘরে খড়ের চালে ছেয়ে আছে মস্ত এক লাউ গাছ। বড়ো বড়ো লাউ ধরেছে গাছে।

বাবলু দেখল যে বৃদ্ধ রাখহরি বোস দাওয়ায় বসে আছেন চেয়ারে। সমুখে মোড়ায় বসে হাসিমুখে কথা কইছে সাধুচরণ। একটু বাদেই কানে আসে সাধুচরণের গান দোতারা বাজিয়ে গাইছে বাউল সাধু। বোসমশাই বাউল গানের ভক্ত।

বাবলু দূরে পথের মোড়ে প্রতীক্ষায় থাকে, বোসবাড়ির ওপর নজর রেখে। প্রায় ঘণ্টাখানেক বাদে সাধুচরণ বেরুল বোসবাড়ি থেকে। খানিক এপথ ওপথ ঘুরে সে এবার ঢুকল উমাপতি ঘোষের বাড়ি।

ঘোষবাড়ির ধাঁচ বোসবাড়ির মতনই! খানিক বাদে ঘোষবাড়ির সামনে দিয়ে যাবার সময় বাবলু লক্ষ করে যে উমাপতি বসে আছেন উঠোনে খাটিয়ায় আর সাধু সামনে টুলে বসে। দুজনে কথা বলছে নীচু স্বরে।

ঘোষবাড়ি থেকে বেরিয়ে সাধুচরণ সোজা ফিরে গেল তার নিজের কুটিরে। বাবলু বাড়ি ফিরে ব্যাপারটা নিয়ে ভাবে। গোপন ব্যাপার/প্ল্যান-ট্যান চুরি— এসবের অর্থ কী? মনে হচ্ছে, উমাপতি সাধুচরণকে দিয়ে রাখহরি বোসের বাড়ি থেকে কিছু চুরি করতে অভিসন্ধি এঁটেছেন। তা চাইতেই পারে। দুবাড়ির যা সম্পর্ক। হয়তো দামি কিছু। বোসদের জব্দ করতে। তাই সাধুচরণকে বলে-কয়ে রাজি করিয়েছেন। কী হতে পারে? ঘোর রহস্য। গভীর ষড়যন্ত্র। বাবলুর মনে চিন্তার ঝড়।

এখন এই ঘোষ এবং বোস, দুই পরিবারের মধ্যে সম্পর্কটা কেমন তা জানানো দরকার।

উমাপতি ঘোষ এবং রাখহরি বোস পরস্পরের দূর সম্পর্কের ভাই অর্থাৎ আত্মীয়। কিছুকাল আগেও দুই পরিবারের মধ্যে দিব্যি ভাব ছিল। রাখহরি উমাপতি কাছাকাছি বয়সি। বছর সত্তর ছুঁয়েছে। তখন উমাপতি প্ৰায় প্ৰতি সন্ধ্যায় রাখহরির বাড়িতে যেতেন দাবা খেলতে।

দুই পরিবারই বেশ অবস্থাপন্ন। বছর তিনেক আগে দুই পরিবারের ঘনিষ্ঠতায় হঠাৎ চিড় ধরে। কারণটা তুচ্ছ অতি। ফি বছর পারুলডাঙা ক্লাব দুর্গাপুজোয় যাত্ৰা করে। সেবার ঘোষদের বড়ো এবং বোসদের মেজো দুই ছেলেই চায় সেনাপতির পার্ট। তাই থেকে মন কষাকষি। সেনাপতির পার্টটা অবশ্য দু-জনের কারোর বরাতেই জোটেনি। কিন্তু সম্পর্কে ফাটল ধরল। এরপর থেকে খুচখাচ ঝগড়া মামলা লেগেই আছে দুই পরিবারের মধ্যে। উমাপতি আর যান না বোসবাড়িতে দাবা খেলতে। তবে দাবার নেশায় দুজনেই গিয়ে জোটেন দত্ত বাড়িতে দাবার আসরে। সেখানেও দুজনে পরস্পরকে এড়িয়ে চলেন। তাই রাখহরিকে জব্দ করতে উমাপতির কোনো ষড়যন্ত্র করা মোটেই অস্বাভাবিক নয়।

বাবলু ভাবে একবার, পুলিশকে জানালে কেমন হয়? না; পুলিশ হয়তো আমার ধারণাকে পাত্তাই দেবে না। এ রহস্য উদ্ঘাটন আমায় একাই করতে হবে। কড়া নজর রাখব সাধুচরণের ওপর।

দুদিন বাদে রাত আটটা নাগাদ। পৌষের শীতে গ্রাম তখন জবুথবু নিঝুম। চাদর মুড়ি দিয়ে বসে বাবলু পড়া করছিল নিজের বাড়িতে। সহসা ‘আগুন আগুন’– বহুকণ্ঠের চিৎকার শুনে বাবলু উঠে পড়ে লাফ দিয়ে বেরুল পথে।

পুব পাড়ার আকাশটা লাল হয়ে গেছে। বাবলু দৌড়ল সেদিকে। গ্রামের নানা বয়সি পুরুষ তখন নানাদিক থেকে ধেয়ে চলেছে পুব পাড়ায়।

আগুন লেগেছে পুব পাড়ায় বিধু দাসের উঠোনে রাখা খড়ের গাদায়। কদিন আগে একটা খড়ের চালা নতুন করে ছেয়ে পুরনো খড় ডাঁই করে রাখা হয়েছিল ওখানে। তাতেই লেগেছে আগুন। বাজে খড় পোড়ার জন্য মাথাব্যথা নেই বিধু দাস বা অন্যদের। ভয়টা হল আগুন না ছড়িয়ে পড়ে।

কিছু খড় ভিজে ছিল। তাই ধোঁয়া উঠছে প্রচুর। খড়ের গাদায় মেশা কাচা বাঁশের টুকরোগুলি ফাটছে পটকার মতো। জ্বলন্ত খড়ের গাদায় জল ঢালা হচ্ছে, বাঁশ দিয়ে পেটানো হচ্ছে, বিরাট হাঁকডাক চলছে।

বাবলু খেয়াল করে যে জনতার ভিড়ে সাধুচরণকে তো দেখছি না। সে ভাবল একবার বোসবাড়িতে দেখি গিয়ে। যাবার পথে বাবলু দেখল যে ঘোষবাড়ির মেয়েরা ও বাচ্চারা ওদের বাড়ির সামনে ভিড় করে তাকিয়ে আছে আগুনের দিকে। উমাপতিকে দেখা গেল বাড়ির মেয়েদের পিছনে দাঁড়িয়ে আছেন।

রাখহরি বোসের বাড়িতেও একই দৃশ্য। বাড়ির মেয়েরা ও বাচ্চারা কেউ সদর দরজার কাছে, কেউ কেউ ছাদে। সবারই উৎসুক চোখ অগ্নিকাণ্ডের দিকে। রাখহরিবাবু বা বাড়ির অন্য পুরুষদের দেখা মিলল না।

কয়েক মিনিট বোসবাড়ির কাছে কাটিয়ে বাবলু ভাবল যে এখানে থেকে লাভ নেই। সাধুচরণের বাসায় গিয়ে দেখি। আগুন লাগার সুযোগে কিছু হাতিয়ে নিয়ে ও যদি ঘরে ফেরে তখন ধরব ওকে।

সাধুচরণের কুটিরে আলো নেই। হালকা চাঁদের আলোয় চারপাশে আবছা আঁধার। দূর থেকে ভেসে আসছে অগ্নিকাণ্ড ঘিরে কলরব। বাবলু সাধুচরণের কুটিরের কাছে লুকিয়ে অপেক্ষা করে। দেখা যাক ও আসে কি না?

সহসা এক ছায়ামূর্তির আবির্ভাব ঘটে সেখানে। সে কুটিরের দরজা খুলে ভিতরে ঢোকে। ঘরে মিটমিটে আলোর আভা দেখা যায়। এবার বাবলু নিঃশব্দে কাছে গিয়ে কুটিরের আধভেজানো দরজার ফাঁক দিয়ে নজর করে ভিতরে।

ঘরে একটা কুপি জ্বলছে। সাধুচরণ মেঝেতে বসে। তার সামনে দুটো পেটমোটা থলি মাটিতে শোয়ানো। হাঁপাচ্ছে সাধু। হয়তো ওই ভারী থলি দুটো বয়ে আনার পরিশ্রমে। নির্ঘাত চোরাই মাল আছে থলি দুটোয়।

বাবলু আর দেরি করে না। কপাট দুটো হাট করে খুলে সে দরজা আগলে দাঁড়ায়। সাধুচরণ চমকে তাকায় বাবলুর দিকে। বাবলু সোজা থলি দুটোর দিকে আঙুল দেখিয়ে প্রশ্ন করে, ও দুটোয় কী আছে?

সাধুর চোখ ধকধক করে ওঠে রাগে। সে চাপা গর্জন ছাড়ে, বেরিয়ে যাও। ডেঁপোমি হচ্ছে? একফোঁটা ছোঁড়া।

বাবলু বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে বলে, বেশ আছি। তবে কোথায় যাব জানো? থানায় পুলিশের কাছে।

—পুলিশে কেন? সাধুর কণ্ঠে উদ্‌বেগ।

—পুলিশ এসেই বের করুক ওই থলি দুটোয় কী চোরাই মাল আছে। বাবলু এক পা পেছয়।

—দাঁড়াও। সাধুর স্বর খাদে নামে। খানিক গুম মেরে থেকে সে বলে, উত্তম, তুমি নিজেই দ্যাখো, কী আছে এতে? কী ধনদৌলত।

সাধু একটা থলির মুখ ফাঁক করে যা টেনে বের করে তা দেখে বাবলু থ।

—একটা প্রকাণ্ড লাউ।

সাধু দ্বিতীয় থলিটা থেকেও বের করে অনুরূপ আকারের এক বিরাট লাউ। সাধুর চোখে বিদ্রূপ।

—একী? লাউ! কাদের বাড়ির? বাবলুর ভ্যাবাচ্যাকা প্রশ্ন।

—একটা উমাপতিবাবুর, আর একটা রাখহরিমশায়, বোসমশায়ের বাড়ির সাধুর জবাব।

—এইজন্য এত কাণ্ড। ঘোষমশায়ের সঙ্গে ষড়যন্ত্র। যাঃ! বাবলুকে থামিয়ে বলে সাধু, শুধু ঘোষমশাই নয়, রাখহরি বোসমশাইও আছেন এই ষড়ে। তাঁদের কথাতেই আমি একাজ করেছি। চুরিবিদ্যে ছেড়ে দিয়েছিলাম। নেহাতই ওঁদের অনুরোধ ফেলতে পারলাম না।

—একজন বুঝি অপরজনের বাড়ির লাউ চুরি করিয়েছেন তোমায় দিয়ে?

–মোটেই না। যে যার নিজের বাড়ির লাউ চুরির অর্ডার দিয়েছিলেন আমায়। দুই কর্তাই জানেন পুরো ব্যাপারটা। কদিন বাদেই এই লাউ দুটো যেত লাভপুরে কম্পিটিশনে।

—‘সাধুদা একটু খুলে বলো প্লিজ। কিস্তু মাথায় ঢুকছে না। বাবলু ঘরে ঢুকে বসে পড়ে সাধুচরণের সামনে।

সাধু সামলে নিয়েছে নিজেকে। মুচকি হেসে বলে, বসো, বলছি সব। তবে সময় নেই হাতে। এখুনি মাল পাচার করতে হবে। অল্প কথায় বলি।

সাধুচরণ বলল এক বিচিত্র কাহিনি।

গ্রামের সবাই জানে যে পুব পাড়ায় ঘোষ ও বোস পরিবারের মধ্যে আদায় কাঁচকলায় সম্পর্ক। যা তারা জানে না তা হল, দুই বাড়ির দুই বৃদ্ধ কর্তাদের এই ঝগড়াঝাঁটিতে সায় নেই মোটে। তাঁরা ছেলেদের নিরস্ত করতে চেয়েছিলেন। দুঃখের বিষয় পারেননি। বাইরে উমাপতি ও রাখহরি পরস্পরকে এড়িয়ে চলেন ছেলের ভয়ে। কিন্তু ফাঁক পেলেই দুজনে কথা বলেন গোপনে। দুঃখ করেন। অথচ পুরনো দিনগুলি ফিরে পাবার উপায় খুঁজে পান না। এই ঝগড়া কমার লক্ষণ নেই। বরং কয়েকদিন বাদে লাভপুরে কৃষি প্রদর্শনী উপলক্ষে হয়তো তা আরও বাড়বে।

প্রতি বছর লাভপুরে কৃষি প্রদর্শনীতে নানান ফুল ফল তরকারি ফলনের প্রতিযোগিতা হয়। আশেপাশের চাষিরা যোগ দেয় তাতে। সেরা ফুল ফল তরকারি ফলনের জন্য দেওয়া হয় মানপত্র পদক অর্থপুরস্কার। এই প্রতিযোগিতায় ফার্স্ট হওয়া রীতিমতো গৌরবের ব্যাপার। স্বয়ং কৃষিমন্ত্রী এবং জেলাশাসক আসেন পুরস্কার বিতরণ করতে।

এবার রাখহরি বোসের এক ছেলে জোগাড় করে আনে স্পেশাল জাতের লাউয়ের বীচি। তাই থেকে চারা জন্মায়। খবরটা চলে যায় ঘোষবাড়িতে। দুই বাড়িতেই দুপক্ষের চর আছে, দু বাগাল ছেলে। তারা নিয়মিত উৎকোচ পেয়ে থাকে দু বাড়ির গোপন খবর সরবরাহের বিনিময়ে। ব্যস, সেই স্পেশাল লাউয়ের বীচি চর মারফত চুরি হয়ে আসে ঘোষ বাড়িতে। তাই থেকে চারা তৈরি হয় সেখানেও। এদিকে বোসবাড়িতে খবর যায় যে ঘোষরা কম্পিটিশনের জন্য এবার লাউ ফলাচ্ছে। চারা তুলেছে। তবে সেই বীচি যে কোত্থেকে এসেছে, খবরটা ফাঁস হয়নি।

বোসরা খোঁজ রাখে ঘোষরা লাউয়ে কী কী সার দিচ্ছে। খবর আসে, ওরা নাকি স্পেশাল সার দিচ্ছে লাউয়ের সাইজ বাড়াতে। বোসবাড়ির গুপ্তচর ঘোষদের লাউ গাছের জন্য স্পেশাল সারের খুঁটিনাটি খবর পৌঁছে দিতে থাকে রাখহরির ছেলেদের।

স্পেশাল বীচি, স্পেশাল সার, ফলে দুই বাড়িরই লাউ গাছে ফল ধরে মস্ত মস্ত। লাউগাছ পাহারা দেয় দুপক্ষই, পাছে অন্যজন তাদের লাউ গাছের ক্ষতি করে বা চুরি করে প্রতিযোগিতার জন্য রাখা লাউ, সব চাইতে বড়ো লাউটা।

লাউ নিয়ে এই বিবাদ থামাতে চেয়েছিলেন উমাপতি এবং রাখহরি। যথারীতি তাঁরা ব্যর্থ হন। কদিন আগে তাঁরা জানতে পারেন যে দু বাড়ির ছেলেরাই অসৎকর্ম করেছে এই লাউ ফলানো নিয়ে

দুই কর্তাই গেলেন বেজায় চটে। অবাধ্য গোঁয়ার পুত্রদের শায়েস্তা করতে তাঁরা অন্য পন্থা ধরলেন। দুজনে যুক্তি করে সাধুচরণকে ভার দিলেন, দুই গাছের দুটো লাউ হাপিজ করতে, যে দুটো লাউ কম্পিটিশনে পাঠাতে চায়। কারণ দুই পরিবারের কারোর বরাতেই ফার্স্ট প্রাইজ না জোটা উচিত।

সাধুচরণ গম্ভীর ভাবে বলল, শুনলে তো সব। এখন ঠিক করো পুলিশে খবর দেবে কিনা? কর্তাদের মন রাখবে, না দুবাড়ির বিবাদটা আরও বাড়াবে?

বাবলু মাথা চুলকিয়ে বলে, নাঃ থানা-পুলিশে দরকার নেই। আমি বলব না কাউকে এ ব্যাপারে।

সাধুচরণ হাঁফ ছাড়ে খুশিতে।

—‘আরে বাপু, এ লাইনে পাঁচজনা এখনও আমায় মান্যি করে। রিটায়ার করেচি। তবু এ কাজে হাত দিলেম শুধু দশের মঙ্গলের জন্য। টাকার লোভে নয়। বোসদের গুণ্ডা মেজোছেলে আর ঘোষদের খেঁকি কুকুরটার নজর এড়িয়ে পনেরো মিনিটের মধ্যে দুই পেল্লাই লাউ সরাতে এই শর্মা ভিন্ন এ তল্লাটে আর কে পারবে? কর্তারা অবশ্য পান খেতে আমায় দেবেন সামান্য। লাউ পিছু পঞ্চাশ টাকা। আর লাউ দুটো ফাউ।

—‘আগুন কি তুমি লাগিয়েছ? জানতে চায় বাবলু।

—‘হ। একটা গোলমাল পাকালে মাল হাতাতে সুবিধে হয়।

—‘লাউ দুটো নিয়ে কী করবে? খাবে বুঝি?

—‘বাপরে। এ দুটো দিয়ে তো গোটা গাঁয়ে ভোজ লাগানো যায়। এ বস্তু এক্ষুনি পাচার করতে হবে। ধরা পড়লে সর্বনাশ। বলেই সাধু দরজার বাইরে গিয়ে সজোরে দুবার শিস দিয়ে ভিতরে এল।

একটু বাদেই নিঃসাড়ে ঘরে ঢুকল বছর কুড়ির এক ছোকরা। তার রং মিশকালো। লম্বা পাকানো শরীর। সাধু দ্রুত বলে গেল তাকে, গুটে, চটপট লাউ দুটো কেটে ফ্যাল টুকরো করে। তাপ্পর থলিতে ভরে নিয়ে যা। একটা বড়ো টুকরো আমার মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে পৌঁছে দিবি। বলবি, আমার গাছের লাউ পাঠিয়েছি। দু টুকরো তুই নিবি। বাকি লাউ জঙ্গলে পুঁতে দিবি।

গুটে নীরবে একটা বড়ো ছুরি নিয়ে খচাখচ লাউ দুটো টুকরো টুকরো করে ফেলল। তারপর খণ্ডগুলো থলিতে ভরে কাঁধে ফেলে মিলিয়ে গেল বাইরে অন্ধকারে।

সাধুচরণ বাবলুকে বলল, এবার তুমি যাও। আমি বেরুব। দেখি, ওখানে কী ঘটছে?

দুজনে বাইরে আসে। বাবলু হঠাৎ খেয়াল করে যে সাধুচরণ উধাও হয়েছে। তখনও পুব পাড়ার হৈ চৈ চলছে। তবে আগুনের আভাটা আর নেই। বাবলু ও চলল পুব পাড়ার উদ্দেশে।

বাবলু উমাপতির বাড়ির সামনে এসে দেখে যে সেখানে বিরাট জটলা, বেজায় উত্তেজনা। আবিষ্কার হয়েছে— রান্নাঘরের চাল থেকে প্রতিযোগিতার জন্য রাখা লাউটা চুরি হয়ে গেছে। এ নির্ঘাত বোসদের কীর্তি। উমাপতির ছেলেরা দলবল জুটিয়ে তড়পাতে তড়পাতে চলল বোসবাড়ির দিকে। কিন্তু মাঝপথে তাদের সঙ্গে মোলাকাত হল বোসবাড়ির লোকজনদের। তারাও আবিষ্কার করেছে যে তাদের কম্পিটিশনের লাউ উধাও এবং ঘোষদের অপরাধী ঠাউরে তারা হুংকার দিতে দিতে আসছিল। দুই বাড়িরই লাউ চুরি গেছে শুনে দুপক্ষই হতভম্ব। তারা একে অপরের বাড়ি গিয়ে যাচাই করে আসে ঘটনাটা সত্যি কিনা।

এবার দুপক্ষই গিয়ে বসল উমাপতির বাড়ির আঙিনায়। দুদলেরই সন্দেহ এ নির্ঘাত মথুরাপুর গ্রামের সাহাদের অপকর্ম। সাহারা লাউ ফলনে এক্সপার্ট। গত দু বছর ওদের লাউ ফার্স্ট হয়েছে লাভপুরে। পাছে এবার হেরে যায় তাই এই চক্রান্ত। পারুলডাঙার পুবপাড়ার উমাপতি ও রাখহরিদের সঙ্গে তাদের বেজায় রেষারেষি।

দুঃখের বিষয় কম্পিটিশনে ফার্স্ট হবার মতন আপাতত তেমন আর বড়ো লাউ নেই ঘোষ বা বোসবাড়ির গাছে। এই দুই লাউয়ের আকার যাতে খুব বাড়ে তাই অন্য বড়ো লাউ সব কেটে ফেলা হয়েছে প্রথামাফিক। সাহাদের টেক্কা দিতে তেমন কোনো লাউ নেই পারুলডাঙার কারও গাছে। দুই বাড়ির সঙ্গে সুর মিলিয়ে গোটা গাঁ শ্রাদ্ধ করতে থাকে মথুরাপুরের সাহাদের।

বাবলু দেখতে পায় যে ভিড়ে সাধুচরণও রয়েছে।

উমাপতি রাখহরিও ছিলেন জমায়েতে। পাশাপাশি বসে চুপচাপ শুনছিলেন সব। হঠাৎ উমাপতি মৃদু গম্ভীর গলায় বললেন, রাখু এবার ফুলকপি কেমন হয়েছে? দেওয়া যাবে কম্পিটিশনে?

—তা দেওয়া যাবে। প্রাইজ পাবার মতনই সাইজ। জানান রাখহরি।

—আমাদের বাঁধাকপির সাইজও হয়েছে খাসা। তা এবার যদি তোমরা ফুলকপি আর আমরা বাঁধাকপি পাঠাই কম্পিটিশনে পারুলডাঙার হয়তো কিছুটা প্রেস্টিজ বাঁচে। গতবার তো তোমাদের ফুল আর আমাদের বাঁধা ফার্স্ট প্রাইজ পেয়েছিল। আসচেবার ফের লাউ ট্রাই করব। হয় তোমরা, নাহয় আমরা। কেউ-না-কেউ পারুলডাঙার মুখ রক্ষা করতে পারব ঠিক। কী বল?

—উচিত কথাই বলেছ উমা। সায় দিলেন রাখহরি। হৈ হৈ করে তাঁদের সমর্থন জানায় গাঁয়ের অন্য লোকেরা। আর এক প্রস্থ সাহাদের মুণ্ডপাত ক’রে সভা ভঙ্গ হল।

বাড়ি ফেরার পথে সহসা বাবলু নজর করে যে সাধুচরণ হাঁটছে তার পাশে পাশে। বাবলু সাধুদার দিকে তাকাতেই সে বাবলুর চোখে চোখ রেখে মিচকে হেসে সরে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *