বটুকবাবুর ছুরি

বটুকবাবুর ছুরি

চোরাবাজার থেকে বেরিয়ে হ্যারিসন রোডে এসে দাঁড়ালেন বটুকবাবু। মাঝে মাঝে অফিস-ফেরতা তিনি এই বাজারে এসে ঢুঁ মেরে যান। এখানে বেশির ভাগই সেকেন্ড-হ্যান্ড জিনিস, কাজেই নতুনের চেয়ে দাম কম। অনেক সময় রীতিমতো সস্তাই মেলে। বটুকবাবু চোরাবাজারে এসে টুকিটাকি জিনিস দেখেন। কেনাকাটি করেন কদাচিৎ, তবে দাম-টামগুলো ধারণা করে রাখেন। ভবিষ্যতে সুবিধে হলে কেনা যাবে!

আজ কিন্তু সত্যি একটা জিনিস কেনার ইচ্ছে ছিল। একটা ছুরি। একখানা ছুরি ছিল তাঁর; বহু বছর ব্যবহারে ক্ষীণ হয়ে গতকাল সেটি একখণ্ড শক্ত পিচবোর্ড কাটতে গিয়ে দেহরক্ষা করেছে। একেবারে মাঝখান থেকে দু-আধখানা।

কয়েকটা ছুরি দরদস্তুর করলেন বটুকবাবু; কিন্তু কেনা হয়ে উঠল না শেষপর্যন্ত। যেটা পছন্দ হল, দামে পোষাল না। আর কম দামি জিনিস যা দেখলেন তা মনে হল টিকবে না বেশিদিন।

বড়োরাস্তার ফুটপাথ বেয়ে বটুকবাবু অল্প কিছুদূর এগিয়েছেন এমন সময় কে একজন খাটো গলায় তাঁর খুব কাছ থেকে ডেকে বলল, ‘ছুরি নেবেন স্যার? ভালো ছুরি আছে।’

বটুকবাবু চমকে তাকালেন।

বছর ষোলো-সতেরোর একটা ছেলে। পরনে নীল রঙের হাল-ফ্যাসানি ফুলপ্যান্ট এবং চকরা-বকরা হাওয়াই শার্ট। শার্টের অর্ধেক বোতাম খোলা। পায়ে রবারের চপ্পল, চুলে বাহারের টেরি। শীর্ণ মুখে পানের ছোপ ধরা একসারি এবড়োখেবড়ো দাঁত বের করে ধূর্ত হাসল ছেলেটা।

একদম বখাটে টাইপ। ছোকরা পকেটমার গোছের কিছু হওয়া আশ্চর্য নয়। বটুকবাবু আড়ষ্ট হয়ে থতমত খেয়ে আওড়ালেন, ‘হ্যাঁ মানে ছুরি… একটা… আছে ছুরি?

ছেলেটা আরও কাছে ঘেঁষে এল। সে দুহাত জোড়া করে বটুকবাবুর বুকের কাছে তুলল এবং প্রায় ম্যাজিকের মতো তার হাতের চেটোর মধ্যে আবির্ভূত হল একখানা ছুরি। সে তার দেহ নিয়ে ছুরিটা আড়াল করে দাঁড়াল, যাতে চলমান পথচারীর কৌতূহলী দৃষ্টি সেটা সহজে না দেখতে পায়! তারপর নীচু গলায় বলল, ‘দারুণ চাকু স্যার। দেখুন—’

ছুরিখানা একনজরে দেখেই বটুকবাবুর ধারণা হল— চমৎকার জিনিস। অন্তত ছয় ইঞ্চির বেশি লম্বা ফলাটা চকচকে করছে। পিতলের চওড়া হাতল। এ বস্তুর ঢের দাম তবু জিজ্ঞেস করলে, ‘কত?’

—‘দশ টাকা।’

ছেলেটা ইতিমধ্যে মুঠোর ভিতর দিয়ে ছুরি লুকিয়ে ফেলেছে। কেমন সন্ত্রস্তভাবে ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক-সেদিক চাইছে।

দশ টাকা দেওয়ায় সংগতি নেই বটুকবাবুর, কিন্তু এ ছুরির দাম ওর চেয়ে খুব কমবে বলে মনে হয় না। তিনি মাথা নেড়ে বললেন, ‘নাঃ, থাক।’

—‘কত দেবেন?’ অধীর কণ্ঠে প্রশ্ন করল ছেলেটা। যেন তার ভারি গরজ, ছুরিখানা বিদায় করতে পারলে সে বাঁচে।

বটুকবাবু দুম করে বলে বসলেন, ‘দুই।’

ছেলেটা হাঁ হয়ে গেল। বলল, ‘সে কী? জিনিসটা দেখুন, বাজারে কী দাম হবে জানেন?’

—‘না ভাই, পারব না।’

ছেলেটা হতাশভাবে বলল, ‘আচ্ছা আর দু-টাকা দিন।’

—‘আর একটা টাকা দিতে পারি। তার বেশি নয়।’

—‘তাই দিন।’

বটুকবাবু পকেট থেকে তিনটে টাকা বের করামাত্র ছেলেটা ছোঁ মেরে নিয়ে তাঁর হাতে ছুরিটা গুঁজে দিল।

বটুকবাবু কেমন দ্বিধায় পড়লেন। এত সস্তায় দিয়ে দিল— জিনিসটা সত্যি ভালো তো? না ভুল করলাম? আমতা আমতা করে বললেন, ‘ছুরিটা ভালো হবে তো? বেশ কাটা-টাটা যাবে তো? টিকবে তো?’

ছেলেটি যাবার জন্য মুখ ঘুরিয়েছিল, এবার সে ফিরে দাঁড়াল। তার মুখে বাঁকা হাসি। সে চাপা স্বরে বলল, ‘জরুর কাটা যাবে স্যার। কার হাতের চাকু জানেন?’

কথাটা বলে সে এক বিচিত্র ভঙ্গি করল এবং পরক্ষণেই ঘুরে দ্রুত মিলিয়ে গেল ভিড়ের মাঝে

বটুকবাবু কয়েক মুহূর্ত হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। কী বোঝাতে চাইল ছেলেটা? যাকগে ভেবে লাভ নেই। ছুরিখানা পকেটে ফেলে তিনি তাড়াতাড়ি চলতে শুরু করলেন।

অনেকখানি হেঁটে খানিক বাসে চড়ে, অবশেষে বটুকবাবু যখন কালীঘাটে তাঁর বাসায় পৌঁছলেন তখন সন্ধ্যা নেমেছে।

একটা প্রকাণ্ড পুরানো আমলের ইট-বের-করা বাড়ি। একগাদা ভাড়াটে, পায়রার খোপের মতো টুকরো টুকরো অংশ নিয়ে আছে। নীচের তলায় একটা দরজায় তালা খুলে ভিতরে ঢুকলেন বটুকবাবু। সুইচ টিপতে একটা কম পাওয়ারের বালব জ্বলে উঠল।

খুপরি ঘর। দেয়াল ও ছাদের জায়গায় জায়গায় পলস্তরা খসে পড়েছে। ঘরে একখানা তক্তপোশ, একটা টেবিল, একটা টুল ও একটি আলনা, ব্যাস শুধু এই আসবাব। বেশি কিছুর জায়গাও নেই। ঘরের কোণে ট্রাঙ্ক ও বাক্স, আর কয়েকটি বাসনপত্র।

শ্রীযুক্ত বটকৃষ্ণ দাস ওরফে বটুকবাবু একা থাকেন। বছর পঁয়তাল্লিশ বয়স। বিয়ে থা করেননি, কিন্তু দায়দায়িত্ব আছে। মেদিনীপুর জেলার গ্রামে তাঁর দেশের বাড়িতে থাকেন বিধবা দিদি তিন ছেলে মেয়ে নিয়ে। তাদের ভার বটুকবাবুর, মাসে মাসে টাকা পাঠাতে হয়। বৌবাজারে এক সওদাগরি অফিসে সামান্য মাইনের চাকরি করেন তিনি, গোবেচারি ভালোমানুষ লোক, কারো সাতে পাঁচে নেই। গোলমাল হাঙ্গামা দেখলে সভয়ে এড়িয়ে চলেন। অফিস করে ফিরে সোজা নিজের কুঠুরিতে ঢোকেন। পারতপক্ষে বের হন না।

তবে মাঝে মাঝে অফিস থেকে বাসায় ফিরতে দেরি হয়। বটুকবাবু বই বাঁধাইয়ের কাজ জানেন। অফিসের ফেরত কোনো কোনো দিন চলে যান এক দপ্তরির কাছে। সেখানে বই বাঁধাই করেন। কোনোদিন তাঁর সাহায্য দরকার হলে দপ্তরিই খবর পাঠায়। দুটো বাড়তি পয়সা রোজগার হয়। অবসর সময়ে ঘরে অর্ডার নিয়ে বইখাতা বাঁধান।

এমনি বটুকবাবুর জীবন একঘেয়ে। খুবই টেনেটুনে চালান। বেশি পয়সা খরচ করে কোনো ফুর্তি করা বা শখ মেটানোর ক্ষমতা তাঁর নেই।

কিন্তু মানুষটি কল্পনাবিলাসী।

বাইরে যখন সূর্য অস্ত যায়, নিজের খাটে শুয়ে শুয়ে হরেক রকম কল্পনা করেন, যা করতে সাধ হয় কিন্তু সাধ্য নেই। সুখের বিষয় এর জন্য পয়সা লাগে না। কেবল মনের রুদ্ধ দ্বারগুলি খুলে দাও। নাগালের বাইরে জগতের কত অজানা দেশ, অজানা অদেখা মানুষজন দৃশ্যকল্পনার রঙে বাস্তব হয়ে ফুটে ওঠে। কল্পনায় কত আমোদ। কত আনন্দের স্বাদ নেয় মন। প্রাণটা হালকা হয়ে যায়। রঙিন হয়ে ওঠে। দিনগত একঘেয়েমি থেকে খানিক মুক্তি পায়।

একটি পুরনো গাইডবুক আছে বটুকবাবুর।

ভারতের দর্শনীয় স্থানগুলির বিবরণ আছে তাতে। সময় পেলে তিনি বইখানি পড়েন। ওই অপূর্ব জায়গাগুলিতে কী ভাবে যাবেন? কী কী দেখবেন? কোথায় কোন ধর্মশালা বা হোটেলে থাকা যায়— ইত্যাদি সম্বন্ধে যা যা লেখা আছে- সব তাঁর মুখস্থ! প্রতিবার পুজোর সময় ভাবেন— এবছর আর হয়ে উঠল না। সামনের বছর সুবিধে হলে বেরিয়ে পড়ব। অন্তত একটিবার ঘুরে আসব। আবার নিভৃতে এও জানেন, সামনের বছর কেন, কোনোকালেই হয়তো তাঁর বেড়ানোর সাধ মিটবে না! এই কলকাতা শহরেই কাটাতে হবে বছরের পর বছর। বড়ো জোর দু-চার বছর অন্তর একবার কয়েকদিনের জন্য দেশে যাওয়া। ব্যাস।

বটুকবাবুর দেশের বাড়িখানা বিশাল। অট্টালিকা বলা চলে। তবে এখন জরাজীর্ণ। বহু শরিকে ভাগ হয়ে গেছে। মাত্র দুটি পরিবার ছাড়া এখন আর কেউ থাকে না ও বাড়িতে। ঠাকুর্দার আমল অবধি বটুকবাবুদের অবস্থা ভালো ছিল। তারপর পড়ে যায়।

দেশের বাড়িতে একটা ভারি সুন্দর মোমবাতিদান পেয়েছিলেন বটুকবাবু। ঠাকুমার সিন্দুকে ছিল। নকশাকাটা কুচকুচে কালো কাঠের স্ট্যান্ড। তার মাথায় বিলিতি কাচের ঘেরাটোপ। কলকাতায় ঘরের তাকে সাজিয়ে রেখেছেন জিনিসটি। মোমবাতিটিও লাগিয়ে রেখেছেন। তবে সে মোম জ্বালেন না কখনো। ইলেকট্রিক আলো না থাকলে বরং লন্ঠন ব্যবহার করেন।

মোমবাতিদানটার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে পূর্বপুরুষের কত বিচিত্র বিলাস, ঐশ্বর্যগরিমা কল্পনায় ভাসে। বটুকবাবু শুনেছেন, তাঁর বাবার এক ঠাকুরদা ছিলেন দুর্ধর্ষ প্রকৃতির। তিনি নাকি ডাকাতিও করতেন লুকিয়ে লুকিয়ে। ওই দুর্দান্ত পুরুষটির রক্তধারা কি আমার ধমনীতে বইছে? ভেবে তিনি রোমাঞ্চিত হন। আবার হাসিও পায়।

বটুকবাবু একবার একটা চমৎকার সেকেন্ডহ্যান্ড ফাউন্টেন পেন কিনেছিলেন। একেবারে জলের দরে। পেনটা হাতে নিয়ে ভাবতে বসেন— কে ব্যবহার করত এই কলম? হয়তো কোনো সাহিত্যিক। কী লিখেছেন এটা দিয়ে? কেমন দেখতে ছিলেন? বরাত মন্দ! পেনটা কয়েকদিন বাদেই পিকপকেট হয়ে যায়।

বাঁধাইয়ের জন্যে যেসব বই আসে রোমাঞ্চকর অ্যাডভেঞ্চার বা ঐতিহাসিক কাহিনি থাকলে বটুকবাবু তা পড়ে ফেলেন। কল্পনার খোরাক জোটে।

বটুকবাবু বাইরের ধুতি শার্ট গেঞ্জি ছেড়ে লুঙ্গি পরলেন। হাত মুখ ধুলেন। উনুন ধরিয়ে বারান্দার কোণে রান্নাঘরে ভাত চাপালেন। তারপর শোবার ঘরেতে এসে পিচবোর্ড, কাগজ, আঠা, ছুঁচ সুতো ইত্যাদি বাঁধাইয়ের সরঞ্জাম গুছিয়ে নিয়ে মেঝেতে বসলেন। এইবার তিনি কেনা ছুরিটা হাতে নিয়ে মন দিয়ে দেখতে বসলেন।

নাঃ, ঠকিনি। অতি উত্তম জিনিস। খুব মজবুত ইস্পাতে তৈরি। ছুরির একটা খাপ বানিয়ে নিতে হবে। কিন্তু এ বস্তু যেন বটুকবাবুর হাতে মানায় না।

ছুরিখানা কার ছিল? ছেলেটা অমনভাবে বলল কেন— কার হাতের চাকু জানেন? কে ছিল এর ভূতপূর্ব মালিক? ছুরি না বলে একে বরং ছোরা বলাই উচিত।

ছোরা! শব্দটি উচ্চারণ করতেই এর ভূতপূর্ব মালিকের চেহারা নিয়ে একটা কল্পনা দানা বাঁধে। সে চেহারা, সে মুখ নিষ্ঠুর। যেখানে যত গুণ্ডা বা খুনি জাতীয় লোক দেখেছেন বটুকবাবু বা শুনেছেন যাদের কথা— যারা অনায়াসে ছোরা-ছুরি চালায়— তাদের মূর্তি একের পরে এক মনে ভেসে ওঠে। আর সব কজনকে মিলিয়ে মিশিয়ে একটা নৃশংস বীভৎস রূপ খাড়া করার চেষ্টা করেন।

এ ছুরিতে কি মানুষের রক্ত লেগেছে কখনো? বোধ হয় লেগেছে। বোধহয় কেন, নিশ্চয়ই লেগেছে। হয়তো বারবার।

মানুষের ভিতরকার আদিম পশুটা যখন লোভে উন্মত্ত হয়ে আক্রমণ করেছে অন্য মানুষকে— এই ছুরি ছিল তার হাতিয়ার। হয়তো বটুকবাবুর মতো অনেক নিরীহ লোককে আঘাত করেছে এই ছুরি। আবার হয়তো গুণ্ডাদের নিজেদের মধ্যে হানাহানির সময় তপ্ত নররক্তের স্পর্শ পেয়েছে এই শাণিত ইস্পাত ফলা!

ভাবতে ভাবতে গরম হয়ে উঠল বটুকবাবুর শরীর। ডানহাতের পাঁচ আঙুলে শক্ত করে চেপে ধরলেন ছুরির বাঁটটা। বোধহয় এমনিভাবেই বাগিয়ে ধরা হত ছুরিখানা! আর অমনি করে— ঝুঁকে হাত চালালেন বটুকবাবু।

খ্যাঁচ।

সামনে একটা প্যাকিং বাক্স ছিল। শিশি বোতল কৌটো কাঠের টুকরো- এমনি টুকিটাকিতে ঠাসা। বটুকবাবুর ছুরি বাক্সের পাতলা কাঠের গায়ে আমূল বিঁধে গেল। ফের হ্যাঁচকা টানে খুলে এল ছুরি।

বাঃ। নিজের তৎপরতায় অবাক হয়ে গেলেন বটুকবাবু। এখনও এত তাড়াতাড়ি হাত চালাতে পারি। ফলাটায় কী ভীষণ ধার! কিন্তু ফুটো হয়ে গেল যে বাক্স? ঘন ঘন নিশ্বাস পড়ছে। তীব্র চোখে তিনি খুঁজতে থাকেন অন্য কোনো নিশানার সন্ধান।

হঠাৎ বটুকবাবুর মনে হল, মুঠোর মধ্যে ছুরিটা যেন নড়েচড়ে উঠল। যেন এটা জীবন্ত বস্তু। বুঝি ওর ঘুম ভেঙেছে। অস্থির হয়ে উঠেছে।

তিনি শিউরে উঠে ছুরিটা ফেলে দিলেন। ঠং আওয়াজ তুলে সেটা নিশ্চল হয়ে পড়ে থাকে মেঝেয়।

বটুকবাবু একটুক্ষণ সন্দিগ্ধভাবে তাকিয়ে রইলেন ছুরিখানার দিকে। তারপর হেসে উঠলেন জোরে।

স্রেফ অতিরিক্ত কল্পনার ফল।

ওই জড় বস্তুটিতে প্রাণের কোনো চিহ্ন নেই, থাকতে পারে না। অসম্ভব।

ঝকঝকে ফলাটা কেমন অসহায়। যেন এক হিংস্র শ্বাপদ বন্দী হয়ে আছে।

মৃদু হেসে বিড়বিড় করে ছুরিটাকে উদ্দেশ্য করে বললেন— ‘ওহে, তোমার জারিজুরি খতম! আগের জীবন ভুলে যাও। এবার থেকে শুধু বোর্ড কাটো, কাগজ কাটো, আলু কাটো, বেগুন কাটো। ব্যাস, তার বেশি নয়।’

বটুকবাবু সত্যি সত্যি পিচবোর্ড কাটতে শুরু করলেন বইয়ের মলাটের জন্যে। কচকচ করে আলু কাটলেন কয়েকটা। তবে তিনি অনুভব করলেন ছুরিখানা হাতে নিলেই বেশ চনমনে লাগে। দেহে মনে কেমন উত্তেজনা ছড়ায়। অনেকক্ষণ ক্ষিপ্রগতিতে কাজ করলেন। কাজ মানে প্রধানত ছুরি দিয়ে এটা সেটা কাটাকাটি। অবশ্য ফাঁকে ফাঁকে উঠে গিয়ে রান্নাটা সেরে নিলেন। রাত হয়ে যাচ্ছে। বটুকবাবু কাজ বন্ধ করলেন। তারপর খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়লেন।

ছুরিটার কথা ভাবতে ভাবতে তাঁর ঘুম আসতে সময় নিল। পরদিন রাত প্রায় নটা। বটুকবাবু বাসায় ফিরছেন।

অফিসের পর গিয়েছিলেন দপ্তরির দোকানে। কিছু কাজ করেছেন। তাই ফিরতে দেরি হল।

বাড়ির কাছাকাছি এসে পড়েছেন। পাড়াটা ভালো নয়। কাছেই একটা বস্তি। সেখানে কিছু খারাপ ধরনের লোকের বাস। রাতে প্রায়ই বস্তিতে চেঁচামেচি হল্লার আওয়াজ ওঠে। ওখানকার গুণ্ডাদের জোরজুলুম সইতে হয় পাড়ার ভদ্র বাসিন্দাদের। ছিনতাইও হয় কখনো কখনো।

সরু রাস্তা। জোর এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে খানিক আগে। তার ওপর লোডশেডিং চলছে। চারিদিক অন্ধকার। কেবল মেঘে ঢাকা এক ফালি চাঁদের আবছা আলোয় সামান্য নজর চলে।

রাতে এমনিতেই লোক চলাচল কম। আজ একেবারে জনহীন। রাস্তার একপাশে কারখানা। তার লম্বা লম্বা টিনের শেড। অন্যদিকে উঁচু উঁচু বাড়ির খাড়া দেয়ালের সারি।

কারখানায় এখন ছুটি। অন্ধকার বাড়িগুলোয় কারো সাড়াশব্দ নেই। শুধু রেডিও-নিঃসৃত এক তীক্ষ্ণ গানের সুর ভেসে আসছে ওপরের কোনো জানালা দিয়ে।

বটুকবাবুর গা ছমছম করতে লাগল। পথটুকু পেরতে পারলে বাঁচি!

বহুদিনের চেনা রাস্তা। তবু সাবধানে পা টিপে টিপে হাঁটতে হচ্ছে। খোয়া-ওঠা পথে জল জমেছে জায়গায় জায়গায়। পা পড়লে মচকাবে।

এই রাস্তা সিধে গিয়ে এক আড়াআড়ি রাস্তায় মিশেছে। বটুকবাবু বাঁ ধারে ঘুরবেন। তেমাথার মোড়ে পৌঁছে তিনি থমকে দাঁড়ালেন। কার চাপা আর্তস্বরে কথা কানে এল। কী ব্যাপার?

মোড়ের ঠিক মুখোমুখি, আড়াআড়ি রাস্তা পেরিয়ে একখণ্ড ফাঁকা জমি। রাস্তা ও জমির সীমানা দিয়ে গেছে একটা নোংরা জলের নালা। বটুকবাবু কারখানার পাঁচিলের গায়ে ঘেঁসে এলেন। একটু আড়ালে থাকা ভালো। তারপর উঁকি মেরে অন্ধকার ফুঁড়ে উৎকণ্ঠিত দৃষ্টি মেললেন।

রাস্তার ওপারে হাত পনেরো দূরে নালার ধারে দুটো ছায়ামূর্তি। চেনা যাচ্ছে না। কান খাড়া করলেন বটুকবাবু।

—‘দোহাই বাবা, আমি গরিব মানুষ।’

—‘চ্যাপ। দাও ব্যাগ। বের করো। এই তো’– কাতর কণ্ঠে যে কথা বলল তাকে চিনতে পারলেন বটুকবাবু। হারান ঘোষ। এই পাড়াতেই থাকেন। বাজারে আলাপ হয়েছিল। ভবানীপুরে এক কাপড়ের দোকানে কাজ করেন।

আর এই কর্কশ কন্ঠের মালিককেও চিনতে ভুল হল না। ওর নাম ছক্কু। মানে লোকে ওই নামে ডাকে। লোকটা ষণ্ডা— ভয়ংকর স্বভাব। অনেক খুন জখমও নাকি করেছে। সবাই ওকে ভয় পায়। মাত্র মাসখানেক আগে এই ছকু বটুকবাবুর কাছ থেকে পাঁচ টাকা নিয়ে নিয়েছিল। হুঁ, জোর করেই। অবশ্য মুখে বলেছিল ধার।

সন্ধে নাগাদ বাসায় ফিরছিলেন বটুকবাবু। বস্তির কাছে অতর্কিতে ছক্কু তাঁর পথ আগলে দাঁড়িয়েছিল— ‘দেখি দাদু, আপনার মানিব্যাগটা।’

বটুকবাবু বাধ্য হয়ে ব্যাগ বের করে দিয়েছিলেন।

ব্যাগে পাঁচটি টাকাই মাত্র সম্বল ছিল। নোটখানা পকেটে পুরে গম্ভীর মেজাজে বলেছিল ছক্কু— ‘ধার নিলুম। শোধ দিয়ে দেব। তবে একটু মনে করিয়ে দেবেন মশাই। নইলে ভুলে যাই। বড্ড ঝুটঝামেলায় ব্যস্ত থাকি কি না।’

ফলে বটুকবাবুকে মাসের শেষ সপ্তাহে স্রেফ ডাল ভাত খেয়ে কাটাতে হয়েছিল। তরকারি কেনার সামর্থ্য হয়নি।

ছক্কুর কাছে টাকা ফেরত চাইতে তাঁর সাহসে কুলোয়নি। চাইলেও দিত না নির্ঘাত। উল্টে ফ্যাসাদে পড়তেন।

—‘বাঃ, এ যে অনেক টাকা। বহুত আচ্ছা।’ ছক্কুর কণ্ঠে বিকট উল্লাস শোনা গেল।

—‘সব নিয়ো না বাবা। আজ মাইনে পেয়েছি। ঘরে যাব। অনেক ছেলেপুলের সংসার।’ অসহায় মিনতি জানালেন হরেনবাবু।

—‘আঃ ঘাবড়াচ্ছেন কেন? ধার নিচ্ছি। শোধ দিয়ে দেব। তবে একটু খেয়াল করিয়ে দেবেন।’

–‘দোহাই বাবা–’

–‘ফের কাঁদুনি। ঘড়িটা খুলে নিইনি তোর বাপের ভাগ্যি। আর এট্টা কতা বললে দেব নালায় চুবিয়ে! যা ভাগ।’

একটা ধাক্কা মারার আওয়াজ হল।

একটি ছায়া শরীর হোঁচট খেয়ে পড়ল মাটিতে।

কড়া সুরে ছক্কুর শাসানি শোনা গেল— ‘খবরদার, থানায় রিপোর্ট করলে জানে মেরে দেব কিন্তু’-

হারানবাবুর খর্বকায় মূর্তি প্রায় দৌড়ে চলে গেল বটুকবাবুর সামনে দিয়ে। হয়তো আরও নির্যাতনের আশঙ্কায় পালিয়ে গেলেন।

বটুকবাবু রুদ্ধশ্বাসে তাকিয়ে আছেন।

নিরীহ শান্তিপ্রিয় ভদ্রজনের এমন দৃশ্য চোখে দেখাও বিপদ। সাক্ষী হলে গুণ্ডার কোপে পড়ার সম্ভাবনা। মানে মানে সরে পড়াই কর্তব্য। অন্যদিন হলে তাই করতেন বটুকবাবু, নিঃশব্দে পিছিয়ে যেতেন গলির ভিতরে। অনেকখানি ঘুর হলেও অন্যপথে বাসায় ফিরতেন। কিন্তু আজ তিনি নড়তে পারলেন না।

বটুকবাবুর মনে আজ কিন্তু লেশমাত্র ভয় জাগেনি। বরং কী এক প্রচণ্ড উত্তেজনায় মাথায় যেন আগুন ছুটছে। বিস্ফারিত চক্ষু। নিজের অজান্তে কখন তিনি বজ্রমুষ্টিতে আঁকড়ে ধরেছেন নতুন ছুরির বাঁটটা। অন্যান্য জিনিসের সঙ্গে ছুরিটাও ছিল কাঁধের ঝুলিতে।

হরেনবাবু চলে যাওয়ার পর ছক্কু একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল একই জায়গায়। ফস করে জ্বলে উঠল একটা দেশলাইকাঠি।

ছক্কু সিগারেট ধরাচ্ছে।

ঘোর কৃষ্ণবর্ণ পটভূমিতে সেই ক্ষুদ্র আলোকশিখা অতি উজ্জ্বল দেখাল। আগুনের আভায় স্পষ্ট হয়ে উঠল ছক্কুর রুক্ষ কঠিন মুখের খানিকটা। তার কোঁচকানো তামাটে গাল, মোটা গোঁফ, পুরু ঠোঁটের মাঝে লাগানো সিগারেট। আর দেখা গেল তার লালরঙা গেঞ্জির বুক ও পেটের খানিক অংশ।

সহসা বটুকবাবুর মুঠোর মধ্যে ছুরিখানা মোচড় খেয়ে ছটফট করে উঠল তাঁর সারা দেহে যেন বিদ্যুৎ তরঙ্গ বয়ে গেল। দুরন্ত রাগ ও ঘৃণায় যেন চৌচির হয়ে গেল হৃৎপিণ্ড।

চকিতে তিনি গুঁড়ি মেরে অল্প নীচু হলেন। সঙ্গে তাঁর ছুরিকাবদ্ধ ডানহাত বেরিয়ে এল ঝুলির ভেতরে। হাতটা উঁচু হল। পিছনে হেলল। এবং পরমুহূর্তে আকর্ণটানা ছিলা থেকে তীর যেমন আকর্ষণমুক্ত হওয়া মাত্র ছিটকে এগোয় তেমনি লাফ দিল সম্মুখে-

তীরের মতো সাঁ করে উড়ে গেল ছুরিখানা।

হেঁচকি তোলার মতো একবার আওয়াজ হল এবং জ্বলন্ত দেশলাই কাঠিটা হঠাৎ ছক্কুর হাত ফসকে পড়তে পড়তে গেল নিভে।

ছক্কুর দীর্ঘ ছায়া শরীর কুঁকড়ে গেল। এলোমেলো ভাবে কয়েক পা ফেলে হেঁটে সে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। মিশে গেল পথের আঁধারে।

কিছু অস্পষ্ট আওয়াজ। ব্যাস, তারপর সব নিস্তব্ধ।

থরথর করে কাঁপছেন বটুকবাবু। কী যে ঘটল ঠাহর করতে পারছেন না। সমস্ত তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। ব্যাপারটা বুঝি স্বপ্ন, অলীক। আচ্ছন্নের মতো তিনি পা চালালেন।

বটুকবাবু টলতে টলতে ঘরে ঢুকলেন। কোনোরকমে ঘামে ভেজা জামাটা টেনে হিঁচড়ে খুলে ছুড়ে দিলেন আলনায়। রাতে ফিরতে দেরি হলে রান্নাবান্নার হাঙ্গামা করেন না। মুড়ি-টুড়ি যাহোক খেয়ে নেন। আজ কিন্তু খেতে রুচি হল না। দারুণ অবসাদ ও ক্লান্তিতে তখুনি মূর্ছিতের মতো লুটিয়ে পড়লেন বিছানায়।

মুখে রোদ্দুরের তাত লেগে বটুকবাবুর ঘুম ভেঙে গেল। খোলা জানলা দিয়ে বেশ রোদ আসছে। বেশ বেলা হয়ে গেছে। ধড়মড় করে উঠে বসলেন বিছানায়।

উঃ! মাথাটা যেন পাথরের মতো ভারী। অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। ডান কাঁধ টনটন করছে ব্যথায় আর গা পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে। গলা শুকিয়ে কাঠ। হাতড়ে হাতড়ে খাটের পাশে কুঁজো থেকে গড়িয়ে একগ্লাস জল খেয়ে আবার তিনি শুয়ে পড়লেন। এমনকী গত রাত থেকে ঠায়-জ্বলা ঘরের বাল্বটা নেবানোর শক্তি ও পেলেন না।

এরপর তিনদিন তিনরাত কোথা দিয়ে যে কেটে গেল বটুকবাবু ভালো করে টের পেলেন না। ইতিমধ্যে প্রতিবেশী শ্যামবাবু কখন তাঁর ঘরের ভেজানো দরজা ঠেলে ঢুকেছেন— জ্বর দেখে ডাক্তার ডেকে এনেছেন— ওষুধ এনে দিয়েছেন— শ্যামবাবুর স্ত্রী তাঁর সেবাযত্ন করেছেন— কিছুই প্রায় খেয়াল নেই।

চতুর্থ দিনে বটুকবাবুর জ্বর ছাড়ল।

সকালবেলা তিনি ধীরে ধীরে কলতলায় গেছেন, আর একজন ভাড়াটে বিষ্টুবাবু সেখানে দাঁতন করছিলেন। বটুকবাবুকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন— ‘কী দাদা জ্বরে পড়েছিলেন? এখন কেমন?’

—‘ভালো। জ্বর ছেড়েছে।’

—‘হুঁ, বেশ কাহিল দেখাচ্ছে।’

বিষ্টুবাবু কাছে সরে এলেন। সতর্ক চোখে চারপাশ দেখে নিয়ে ফিসফিস করে, ‘মশাই শুনেছেন কাণ্ড?

—‘কী?’

—‘সেই যে গুন্ডা, ছক্কু খুন হয়ে গেছে। আপনি জ্বরে পড়লেন— সেই রাতে।’

—‘কে মারল?’ বটুকবাবু অবাক ভাবে বললেন।

—‘কে জানে। ছুরি মেরেছিল। নালার ভিতর পড়েছিল মুখ থুবড়ে। সকালে আবিষ্কার হল। পুলিশ এসে নিয়ে গেল বডি। এক্কেবারে ডেড। পাড়ায় খুব হৈ চৈ। কে মেরেছে ধরা পড়েনি। ওই আর কি! আর কোনো গুন্ডার কীর্তি। বেটারা এইভাবেই মরে। উঃ, বাঁচলুম মশাই! আপদ গেছে!’

—‘ছক্কু লোকটা আস্ত শয়তান। আমার পাঁচ টাকা কেড়ে নিয়েছিল ও মাসে। লোকটাকে কবে জানি দেখলাম? খুব শিগগিরি।’ বটুকবাবু ভাবতে চেষ্টা করেন।

নাঃ, মনে পড়ছে না। রগের কাছে টিপটিপ করে ওঠে।

যাকগে। যত্ত সব গুন্ডা বদমাইশ। মরেছে ঠিক হয়েছে। বটুকবাবু ছক্কুর চিন্তা মন থেকে ঝেড়ে ফেলে দিলেন।

দিন চারেক বাদে কিঞ্চিৎ সুস্থ হয়ে বাঁধাইয়ের কাজ করতে গিয়ে নতুন কেনা ছুরিটার খোঁজ পেলেন না বটুকবাবু। ঘরে তন্নতন্ন করে খুঁজলেন। নেই। দপ্তরির কাছে খোঁজ করলেন। সেখানেও নেই।

দপ্তরি বলল, ‘হ্যাঁ, সেদিন একখানা নতুন ছুরি এনেছিলেন বটে, কিন্তু এখানে তো ফেলে যাননি।’

ইস, অমন খাসা ছুরিখানা হারাল বুঝি? দপ্তরির দোকান থেকে বেরিয়ে আর কোথাও গিয়েছিলাম কি? কোথায় যে ফেললাম?

বটুকবাবু কিছুতেই তা মনে করতে পারলেন না।

শারদীয়া ১৩৮৭

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *