খানদানি যুদ্ধ

খানদানি যুদ্ধ

নসিবপুর আর ভাগ্যনগর। পাশাপাশি দুই নবাবের দুই রাজ্য।

রাজ্য দুটি আয়তনে ছোটো। তবে সেখানে নবাবি জাঁকজমক সমারোহের অভাব নেই। সবচেয়ে বড়ো কথা, দুই নবাব বংশেরই খানদানি বলে খুব নাম। তাই তাঁরা আচার ব্যবহারে, নবাবি আদবকায়দা, সৌজন্য প্রদর্শনে ছিলেন ভারি হুঁশিয়ার!— ধনদৌলত তো নশ্বর বস্তু— আজ বাড়ে, কাল কমে— কিন্তু খানদানি আদবকেতায় খুঁত হয়ে গেলে যে দুনিয়ার কাছে চিরকালের জন্য বদনাম হয়ে যাবে। সুতরাং দুই নবাবই নানান পালা পরবে সৌজন্য ও প্রীতি বিনিময়ে নিজেদের বনেদি সম্মান অক্ষুণ্ণ রাখতে কড়া নজর রাখতেন।

এতকাল নসিবপুর ও ভাগ্যনগরের মধ্যে দিব্যি ভাবসাব ছিল। কিন্তু এক তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে মন কষাকষির ফলে দুই রাজ্যের মধ্যে অসন্তোষের আগুন উঠল জ্বলে।

রাজ্য দুটির সীমানায় একটি গ্রাম নিয়ে লাগল বিরোধ। দুপক্ষই দাবি করছে গ্রামটি তাদের রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত। একটা মীমাংসায় আর কিছুতেই পৌঁছনো যাচ্ছে না। ফলে গ্রামবাসীদের প্রাণ ওষ্ঠাগত।

দুই পক্ষের সিপাইরাই গ্রামবাসীদের ওপর জবরদস্তি চালায়। দুই রাজ্য থেকেই দাবি করা হয় খাজনা। নিরুপায় গ্রামবাসীরা তখন দুজন নবাবের কাছেই আবেদন পাঠাল— হুজুর, দয়া করে আপনারা একটা মীমাংসা করে নিন। নইলে যে গরিবদের প্রাণ যায়।

নবাবরা দাড়ি চুমরিয়ে, গোঁফে তা দিয়ে চিন্তা করলেন— কথাটা সত্যি বটে। এ বেচারারা কেন বিনা দোষে কষ্ট পায়? সুতরাং একটা ফয়সালা করা নিতান্তই প্রয়োজন।

ভাগ্যনগর থেকে নসিবপুরের নবাবের কাছে পত্রদূত হাজির হল। মিনে করা রুপোর থালায়, মখমলি চাদরে ঢাকা, আতরে ভুরভুর, সোনালি জলে লেখা চিঠিখানি তুলে নসিবপুরের নবাব পাঠ করলেন- আল্লা-তালার কৃপায় আশা করি হুজুরের দিল— তবিয়ৎ বহুত খুশ। হুজুর বোধহয় অবগত আছেন যে আমাদের রাজ্যের সীমানায় একটি গ্রাম নিয়ে দুই রাজ্যে কিঞ্চিৎ ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে। অধমের পূর্বপুরুষগণের আশীর্বাদে ওই গ্রামটি ভাগ্যনগরেরই রাজ্যভুক্ত। তাই গরিবের একান্ত অনুরোধ যে আপনি দয়া করে আপনার সিপাহীদের ওই গ্রামে হামলা করতে বারণ করবেন।

চিঠি শুনে নবাবের আমির-ওমরাহ, উজির-নাজির, মনসবদার- সবাই একযোগে প্রতিবাদ জানাল— ‘সেকী কথা হুজুর! ও গ্রামের মালিকানা তো নসিবপুরের। তামাম দুনিয়া বরাবর এ কথা জানে। ভাগ্যনগরের এ কেমন অন্যায় আবদার?’

সুতরাং, নসিবপুরের নবাবের উত্তর পৌঁছল ভাগ্যনগরের হাতে— হুজুরের শুভেচ্ছায় এই গরিবের দিন গুজরান হচ্ছে কোনোরকমে। খোদাতালাহর কৃপায় আপনার ধনদৌলত মানইজ্জত দিন দিন অপর্যাপ্ত হোক। আপনার হুকুম তামিল করতে পারলে এ বান্দা কৃতার্থ হত। কিন্তু দুঃখের বিষয় ওই গ্রাম আসলে নসিবপুরের সম্পত্তি। তাই অধমের একান্ত আবেদন যে ভাগ্যনগরের সিপাহীরা যেন ওই গ্রামে আর পদার্পণ না করে।

অবস্থা বেশ ঘোরালো হয়ে উঠল। দুপক্ষই তাদের দাবি ছাড়তে নারাজ। দরকার হলে যুদ্ধ করতেও প্রস্তুত। খানদানি কেতাদুরস্ত রেখে ভাগ্যনগরের নবাব চিঠি দিলেন নসিবপুরে―

বান্দার বেয়াদপি মাপ করবেন। পূর্বপুরুষগণ-অর্জিত ওই গ্রামটি দান করার এক্তিয়ার এই অধমের নেই। তবে হুজুরের যদি জমির বিশেষ প্রয়োজন থাকে তাহলে ভাগ্যনগরের অন্য যে-কোনো অংশ থেকে গ্রামটির দু গুণ জমি গ্রহণ করুন। প্রস্তাবটি মনঃপূত না হলে আপনি মেহেরবানি করে রণক্ষেত্রে শার্দূলবিক্রম প্রদর্শনপূর্বক গ্রামটি অধিকার করে নিন। তাহলে হুজুরের ইচ্ছা এবং গরিবের ধর্ম দুই বজায় থাকে।

পত্রপাঠ নসিবপুরের নবাব হুংকার ছাড়লেন— ‘ঠিক হায়। তাই হবে।’ আর আমির-ওমরাহ সভাসদরাও রব তুলল— ‘বেশ তাই হোক। ভাগ্যনগরের এ হুমকি বরদাস্ত করা চলবে না। ওদের দেখিয়ে দেওয়া যাক নসিবপুরি হিম্মতের জোর কত।’

নসিবপুরের জবাব গেল— গোলামের গোস্তাকি মাফ করবেন। গ্রামটি হুজুরের পায়ে অর্পণ করতে পারলে এ গরিব কৃতার্থ হত। কিন্তু এমন অনধিকার চর্চা করলে বেহেস্তবাসী পূর্বপুরুষদের অভিশাপ বর্ষিত হবে আমার মস্তকে। তবে প্রয়োজন হলে নসিবপুরের অন্য যে-কোনো অংশ থেকে ওই গ্রামের তিনগুণ জায়গা দয়া করে গ্রহণ করুন। প্রস্তাবটি যদি পছন্দ না হয়, শাহেনশা আপনার রুস্তম সদৃশ বীরত্ব প্রদর্শন করে ওই গ্রামখানি দখল করে নিন। আপনার মনোবাঞ্ছা পূরণ করতে না পারার লজ্জা থেকে অধমকে মুক্তি দিন।

ব্যাস, দুই রাজ্যে সাজ সাজ রব পড়ে গেল। দুপক্ষই সাধ্যমতো সৈন্যসামন্ত জোগাড় করতে শুরু করল। ক্রমে ক্রমে যুদ্ধের জন্য নির্দিষ্ট দিনক্ষণ ক্ষেত্ৰ সমস্ত স্থির হয়ে গেল। ঠিক হল, সেই গ্রামটিই হবে রণক্ষেত্র।

দিনে দিনে গ্রামের দুপ্রান্তে দুই তরফের সেনা সমারোহ চলতে লাগল। সারি সারি তাঁবু পড়ল। পল্টনদের হাঁক ডাকে, রবে, বৃংহনে আকাশবাতাস সরগরম হয়ে উঠল। দুজনই ক্ষমতা মাফিক পরস্পরকে আপন আপন প্রস্তুতি দেখাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। যুযুধান দুপক্ষের মাঝে পড়ে ভীত গ্রামবাসীরা গ্রাম ছেড়ে পালাল।

দুই তরফের তাঁবুতে মহা সমারোহ। অস্ত্রের ঝনঝনানির মধ্যে সেখানে গানবাজনা জলসার বন্দোবস্ত রয়েছে। আর এ সবের ফাঁকে ফাঁকে চলছে পরস্পরে আদবকায়দার আদানপ্রদান। একজন অপর নবাবের কাছে কুশল বার্তা পাঠান— শাহেনশা অখণ্ড পরমায়ু লাভ করুন। আপনার সেনাদলের শৌর্যবীর্য সহস্রগুণ বৃদ্ধি পাক।

যুদ্ধের দু-দিন আগে নসিবপুরের নবাবের হঠাৎ মনে হল— এমন শুভকাজে ঠাকুর-ফকিরের আশীর্বাদ প্রার্থনা করা হোক। তিনি তো কাছেই থাকেন।

ঠাকুর ফকির একজন সাধুপুরুষ। থাকেন পাহাড়ের এক গুহায়। মাঝে মাঝে দেশভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন, শহরে পা দেন না। গ্রামে গ্রামে ঘোরেন। ভারি পণ্ডিত। ভালো ভালো উপদেশ দেন, আর গরিব-দুঃখীর সেবা করেন প্রাণপণে। তিনি হিন্দু না মুসলমান কেউ জানে না, কেউ মাথাও ঘামায় না এ নিয়ে। সবাই তাকে ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে। আগে হিন্দুরা তাঁকে বলত— বাবা ঠাকুর আর মুসলমানরা ডাকত— ফকির সাহেব। শেষে দুটো নাম মিলেমিশে দাঁড়িয়ে গেল— ঠাকুর ফকির। নসিবপুরের নবাবের একবার শিকারে বেরিয়ে ঠাকুর-ফকিরের সঙ্গে আলাপ হয়। কথাবার্তা বলে লোকটির ওপর খুব ভক্তি হয় তাঁর। নবাব অনেকবার ঠাকুর-ফকিরকে নেমন্তন্ন করে রাজধানীতে নিয়ে যাবার চেষ্টা করেছেন কিন্তু ঠাকুর-ফকির যাননি।

নবাবের চিঠি নিয়ে ঘোড়সওয়ার ছুটল ঠাকুর-ফকিরের উদ্দেশে। ঘণ্টা চারেকের মধ্যেই ফিরে এল দূত। ঠাকুর-ফকির উত্তর দিয়েছেন চিঠিতে

আমি সর্বদাই আপনার কল্যাণ কামনা করি। কিন্তু একটি কথা। আগামী যুদ্ধের খবর শুনে বড়ো ব্যথা পেলাম। আত্মরক্ষা ভিন্ন যুদ্ধের প্রয়োজন কী? যুদ্ধের ফলে যে কত অমূল্য প্রাণ নষ্ট হয়। এ যুদ্ধ কি কোনোমতে এড়ানো যায় না? আশা করি আপনার মতো ন্যায়বান ও দয়ালু বাদশাহ আমার এই অনুরোধটুকু বিবেচনা করে দেখবেন।

চিঠি পড়ে নবাব অস্থির হয়ে উঠলেন। ভাবলেন— ফকির তো হক কথা লিখেছেন। নবাব বাদশার সম্মান বজায় রাখতে নিরীহ লোকের কেন সর্বনাশ হয়? কিন্তু এখন যে পিছপা হওয়া চলে না। তাহলে ভাগ্যনগর কাপুরুষ বলে ধিক্কার দেবে। কী উপায়?

নবাবের সারা রাত ঘুম এল না। কখনো পায়চারি করেন, কখনো বসে বসে ফরসি মুখে ভুরু কুঁচকে তামাক খান। কাণ্ড দেখে তাঁর সঙ্গীসাথীরা থ। তারা রহস্য কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না।

ভোরবেলা নবাবের মাথায় এক বুদ্ধি এল। তিনি ভাগ্যনগরের নবাবকে এক চিঠি পাঠালেন— হুজুর, যুদ্ধ মানে তো বহু লোকের প্রাণহানি। তার চেয়ে বরং দুই রাজ্যের মালিক অর্থাৎ আমরা দুই নবাব যদি দ্বন্দ্বযুদ্ধ করে বিষয়টার ফয়সালা করে নিই কেমন হয়? যে জিতবে গ্রামখানি তার। আমি নিশ্চিত জানি এই দুর্বলকে পরাজিত করতে আপনার মতো বীরের কোনো মেহনতই হবে না। হুজুরের মতামতের অপেক্ষায় রইলাম—

সঙ্গে সঙ্গে উত্তর এসে গেল— হুজুরকে শত সহস্র সেলাম। আপনার বুদ্ধি-বিবেচনায় তুলনা নেই। যথার্থ লিখেছেন। এত বড়ো যুদ্ধের কোনো প্রয়োজন নেই। দ্বন্দ্বযুদ্ধেই মীমাংসা হোক। আগামীকাল প্রত্যুষে লড়াইয়ের আকাঙ্ক্ষায় আপনার মুখোমুখি হব। তারপর তরবারির এক আঘাতে অনায়াসে এই বান্দার মস্তক ছেদন করে গ্রামটি লাভ করে নেওয়া তো হুজুরের কাছে নেহাত তুচ্ছ ব্যাপার।

পরদিন সকালে নির্দিষ্ট সময়ে দুপক্ষের সৈন্যসামন্ত গ্রামের দুপ্রান্তে সার বেঁধে মুখোমুখি দাঁড়াল। ঘোর রবে বেজে উঠল তূরী-ভেরি কাড়ানাকাড়া। তারপর দুই নবাব ঘোড়ায় চড়ে এগিয়ে আসতে লাগলেন পরস্পরের দিকে। পিছনে পিছনে চলল তাঁদের দুই সেনাপতি। নবাবদের গায়ে চকচকে বর্ম, মাথায় ঝকঝকে শিরস্ত্রাণ। একজনের ঘোড়ার রঙ কালো বার্নিসের মতো কুচকুচে, অন্যজনের ঘোড়া দুধের মতো সাদা। কাছাকাছি এসে তাঁরা ঘোড়া থামালেন, নামলেন মাটিতে।

প্রথমে নসিবপুরের সেনাপতি কয়েক পা সামনে এগিয়ে উচ্চ কণ্ঠে ঘোষণা করলেন নবাবের আগমন বার্তা— ‘আজ আপনাদের সম্মুখে হাজির হয়েছেন সুবিখ্যাত খানদানি-বংশসম্ভূত নসিবপুরের নবাব বাহাদুর। এঁর পিতা পিতামহ ও অন্যান্য পূর্বপুরুষদের কীর্তিকাহিনি ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত রয়েছে। আর বর্তমান বাদশাহ স্বয়ং তাঁর বীরপনার গুণে দুনিয়ার লোকের কাছে শের-ই-হিন্দুস্থান উপাধি লাভ করেছেন। নসিবপুরের নবাব বাহাদুর এখন তাঁর ভাগ্যনগরের প্রতিপক্ষের নিকট রণভিক্ষা করছেন।’

সিপাহসালার তার বক্তব্য পেশ করে পিছিয়ে দাঁড়াল।

এবার এগিয়ে আসে ভাগ্যনগরের সেনাপতি। ভাগ্যনগরের নবাব ও তাঁর পূর্বপুরুষদের বিদ্যাবুদ্ধি শক্তির এক মহিমোজ্জ্বল দীর্ঘ ফিরিস্তি শুনিয়ে সেও তার নবাবের পক্ষ থেকে নসিবপুরের নবাবের কাছে রণপ্রার্থনা করল।

এইবার আসল যুদ্ধ

নবাবদের উৎসাহ দিতে দু তরফের রণবাদ্য বিপুল শব্দে বেজে উঠল। তারপর সব চুপ। রুদ্ধ নিশ্বাসে সবাই অপেক্ষা করতে লাগল— কী হয়, কী হয়?

দুই নবাব এলেন এক্কেবারে সামনাসামনি। খাপ থেকে টেনে বের করলেন দীর্ঘ তরবারি। রৌদ্রে ঝিলিক দিয়ে উঠল তাঁদের শাণিত অস্ত্ৰ।

হঠাৎ নসিবপুরের নবাব প্রতিদ্বন্দ্বীকে এক মস্ত কুর্নিশ ঠুকে সম্বোধন করে বলে উঠলেন— ‘হুজুর আপনি আমার চেয়ে সর্বাংশে শ্রেষ্ঠ। তাই আজকের যুদ্ধে প্রথম অস্ত্র চালনার গৌরব আপনারই প্রাপ্য। সুতরাং মেহেরবানি করকে আপ পহেলা চালাইয়ে।’

নসিবপুরের এই খানদানি চালে প্রথমটায় ভাগ্যনগর বেশ হকচকিয়ে গেল। প্রায় মাৎ হয় আর কি। শেষে নসিবপুরের কাছে সৌজন্যের প্রতিযোগিতায় ভাগ্যনগর যাবে হেরে? কভি নেহি।

ভাগ্যনগরের নবাবও অমনি দীর্ঘতর এক সেলাম জানালেন নসিবপুরের নবাবকে— ‘বড়ো লজ্জা দিলেন জনাব। আপনার অতুলনীয় কীর্তি-খ্যাতির কাছে এ গরিবের কি কোনো পাত্তা আছে? প্রথম অসি চালনার গৌরবে আপনারই একমাত্র অধিকার। অতএব মেহেরবানি করকে আপ পহেলা চালাইয়ে।’

ব্যাস, লেগে গেল দুই খানদানি নবাবের আদবকায়দার প্রতিযোগিতা। বিনয়ের পাল্লায় কেউ কম যায় না। দুজনেই পরস্পরকে আহ্বান জানাতে থাকেন প্রথম আক্রমণের সুযোগ নিতে।

মিনিটের পর মিনিট গেল কেটে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দুপক্ষের সেনাবাহিনী রোদ্দুরে গলদঘর্ম হচ্ছে। কিন্তু দুই নবাব তখনও ক্রমান্বয়ে পরস্পরকে সবিনয়ে আহ্বান জানাচ্ছেন— ‘জী আপ পহেলা।’

—‘জী আপ পহেলা।

এমনিভাবে ঘণ্টাখানেক কাটার পর নবাবরা ক্লান্ত হয়ে পড়লেন। তখন তাঁরা নিজের নিজের সেনাপতিদের সঙ্গে পরামর্শ করতে লাগলেন। অবশেষে উভয় পক্ষ থেকেই ঘোষণা করা হল— দ্বিপ্রহরের খানাপিনার সময় হয়ে যাওয়ায় আমাদের নবাব বাহাদুর কিছুক্ষণের জন্য ছুটি ভিক্ষা করছেন। বিশ্রামের পর ফের লড়াই শুরু হবে।

দু তরফই সায় দিল— জরুর জরুর। এখন খানাপিনা হোক। তারপর—

বিকেলে ভাগ্যনগরের কাছ থেকে এক চিঠি এল নসিবপুরের নবাবের কাছে।

—‘হুজুর, আমার সহস্র কোটি সেলাম নেবেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস এই সামান্য গ্রামটির জন্য যুদ্ধ করতে আপনার নিতান্তই শরম লাগছে। আপনাকে এরূপ বিপন্ন করার চেয়ে এ বান্দা জাহান্নামে যেতেও প্রস্তুত। তাই জনাবের পাদদেশে গ্রামটি সমর্পণ করলাম। আর একটি অনুরোধ— দয়া করে আমার গোটা রাজ্যটিও গ্রহণ করুন। হুজুরের হাতে রাজ্যভার অর্পণ করে আমি মক্কা মদিনায় তীর্থ করতে বেরিয়ে পড়ব বলে প্রস্তুত হয়ে মুহূর্ত গুনছি।’

নসিবপুরও হটবার পাত্র নয়। বিনয়ে বিগলিত হয়ে নবাব জবাব দিলেন- তুচ্ছ গ্রামটির জন্য আপনার মনোকষ্টের কারণ হওয়ার চেয়ে আমি বরং পূর্বপুরুষদের অভিশাপ মাথা পেতে নেব। জনাব জানবেন, আজ হতে ওই গ্রামের মালিকানা একমাত্র আপনারই। আর হুজুর কেন তীর্থে যাবেন? সে সৌভাগ্য তো এই অধমের প্রাপ্য। দয়া করে আমার ক্ষুদ্র রাজ্যটিও এইসঙ্গে গ্রহণ করে গরিবকে ছুটি দিন।…

এইভাবে কয়েকবার চিঠি চালাচালির পর আপাতত নবাবরা তাঁদের সৈন্যসামন্ত নিয়ে নিজের রাজধানীতে ফিরে গেলেন।

তারপর অনেক দিন, অনেক মাস, অনেক বছর গড়িয়ে গেল। কেতামাফিক নির্দিষ্ট সময় অন্তর একপক্ষের পত্রদূত হাজির হত অন্য তরফে। তারা পরস্পরকে সকাতরে নিবেদন জানাত— দয়া করে শীঘ্র আপনার আগমন হোক। এখনি গ্রহণ করুন এই রাজ্যপাট। আমি আপনার পথ চেয়ে আছি।

কিন্তু যুদ্ধ আর হয়নি। কোনো ফয়সালাও আর হয়ে ওঠেনি।

এখন সেই গ্রামটির কী হল? যে গ্রাম নিয়ে এত কাণ্ড উভয়পক্ষই তো এখন সেটি দান করে ফেলেছে অন্য পক্ষকে। কাজেই কেউ আর সেখানে খাজনা চাইত না। কোনো দলের সিপাইরা আর সেখানে জুলুম করত না। গ্রামের লোক তাই মহা আনন্দে দিন কাটাত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *