বন্দী ডাবু

বন্দী ডাবু

তপনবাবুর স্ত্রী হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকে বললেন, ‘সর্বনাশ হয়েছে। ডাবু’- তপনবাবু চমকে ফিরে বললেন। ‘অ্যাঁ, কী, খেয়েছে?’

—‘না না, খায়নি কিছু’ গিন্নি মাথা নাড়েন, ‘ডাবু আটকে পড়েছে কাকাবাবুর ঘরে।’

—‘কী করে?’ তপনবাবু ভুরু কোঁচকান।

গিন্নি বললেন, ‘একটু আগে দেখলাম যে কাকাবাবু বেরিয়ে গেলেন দরজায় তালা দিয়ে। এখন ওঁর শোবার ঘরের পাশ দিয়ে যেতে যেতে দেখি, ডাবু ওই ঘরের ভিতরে। মেঝেতে বসে কী জানি খাচ্ছে। আমি নজর করছি দেখে, চট করে হাতটা কোলে লুকোল।’

—‘হুম’, তপনবাবু মাথা ঝাঁকান, ‘কী খাচ্ছে দেখতে পেলে?’

—‘না। তা সে যাই খাক। ও এখন বেরুবে কী করে? যদি বুঝতে পারে আটকে পড়েছে, দরজা বন্ধ, বেরুতে পারবে না, বাড়িতে আর কেউ নেই, ভীষণ ভয় পেয়ে যাবে। কী কাণ্ড যে হবে? ওঃ!’ ডাবুর মায়ের চোখে প্রায় জল এসে যায়।

—‘আমাদের দিক থেকে ভিতরের দরজাটা?’ জিজ্ঞেস করেন তপনবাবু।

—’ছিটকিনি দেওয়া, ওপাশ থেকে। আমি ঠেলে দেখেছি।’ গিন্নি জানালেন।

—’হুম।’ তপনবাবু মাথা ঝাঁকালেন। তারপর অভয় দিলেন, ‘আরে অত ভাববার কী আছে? কাকাবাবু এখুনি এসে পড়বেন।’

—‘এখুনি? হ্যাঁ, তুমি খুব জান। একা হয়ে এখন তো উনি উড়ছেন। কাল কখন বাড়ি ফিরেছেন জান? রাত আটটায়। আজ যদি অমনি ফেরেন? এই এখন সাড়ে পাঁচটা থেকে আড়াই ঘণ্টা। ডাবু ও বাড়িতে একা আটকে থাকলে? উঃ।’ ডাবুর দিদি, ছয় বছরের বিনি এই ঘরেই ছিল। এতক্ষণ মা-বাবার কথা গিলছিল। সে গালে হাত দিয়ে চোখ বড়ো বড়ো করে বলে উঠল, ‘ওমা কী হবে গো?’

‘কিস্‌সু হবে না’ তপনবাবু ধমকে উঠলেন বিনিকে। তারপর স্ত্রীকে বললেন, ‘আহা অত উতলা হচ্ছ কেন? সব দিন কি আর দেরি করবেন? পাড়ায় একটু খুঁজে দেখো। দত্তবাড়ি কিংবা বসুমশায়ের কাছে। পেয়ে যাবে। চাবি এনে, তালাটা খুলে শ্রীমানকে খালাস করে দাও। সমস্যা মিটে যাবে।

তপনবাবুর স্ত্রী রাগী চোখে একবার তাকালেন স্বামীর দিকে। বোধহয় ইচ্ছে ছিল যে তপনবাবুই উঠে খুঁজে আনুক কাকাবাবুকে। কিন্তু আড্ডা এবং বন্ধুকে ছেড়ে কর্তার ওঠার লক্ষণ নেই দেখে ভারি বিরক্ত হয়ে গম্ভীর গলায় বললেন, ‘বেশ, আমি যাচ্ছি। তুমি একটু নজর রেখো ডাবুকে।’

তপনবাবু গিন্নিকে বললেন, ‘দেখো, আবার কাকাবাবুর সঙ্গে রাগারাগি কোরো না। ওঁর কী দোষ? ডাবুটা মহা বিচ্ছু। উনি হয়তো জানতেই পারেননি যে ডাবু ওদিকে ঢুকেছে। কিংবা ভেবেছেন, বেরিয়ে গেছে। ডাবুটার জ্বালায় দেখছি ভিতরের দরজাটা বন্ধ রাখতে হবে।’

স্ত্রী দুপদাপ করে চলে যেতেই তপনবাবু বন্ধুকে বললেন, ‘বসো হে, আসছি এক্ষুনি।’ তিনি ঘর থেকে বাইরে গেলেন।

অনাথবাবু হাঁ হয়ে শুনছিলেন সব! তিনি প্রায়ই গল্পগুজব করতে আসেন তপনবাবুর কাছে। তপনবাবুর দুটি সন্তান। বড়োটি মেয়ে বিনি। ছোটো ছেলে ডাবুর বয়স বছর তিনেক।

কাকাবাবু মানুষটি তপনবাবুর বাড়িওলা। বয়স বছর পঁচাত্তর। তাঁর বাড়িটা একতলা। মোট চারটে শোবার ঘর। সামনের অংশে বাড়ির আধখানায় থাকেন কাকাবাবু ওরফে অমল মিত্র এবং তাঁর স্ত্রী। পিছনের বাকি অংশটা ভাড়া নিয়েছেন তপনবাবু। দুই পরিবারের বাইরে যাওয়া-আসার পথ ভিন্ন ভিন্ন। অমলবাবুদের পথ সামনে একটা দরজা। আর ভাড়াটেদের পথ পিছনের দরজা দিয়ে।

মিনিটখানেক বাদেই ফিরে এলেন তপনবাবু। ধপ করে চেয়ারে বসে, কাপের চায়ে শেষ চুমুক মেরে বিড়বিড় করলেন, ‘যত্ত ঝঞ্ঝাট।’ তারপর তিনি মেয়েকে বললেন, ‘যা তো বিনি, আড়াল থেকে চোখ রাখ ডাবুর ওপর। বেশি কথাটথা বলিসনি। বেশ নিজের মনেই আছে।’

বিনি চলে যেতেই অনাথবাবু বললেন, ‘কী ব্যাপার?’

ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে তপনবাবু বললেন— ‘আর বল কেন, আমার পুত্রটি একটি আস্ত বাঁদর! কাকাবাবুর অংশ আর আমাদের দিকটার মাঝে একটা দরজা আছে। বেশির ভাগ সময় খোলাই থাকে সেটা। মানে ভেজানো থাকে। ওই পথে গিয়ে বুড়োবুড়ির খোঁজখবর নিই মাঝে মাঝে। ওঁরাও ডাকেন দরকারে। দুজনেই ভারি ভালো মানুষ। তা আমার শ্রীমানটি যখন-তখন টুক করে ওই দরজা ঠেলে খুলে ওধারে সেঁধোয়। কাকাবাবু কাকিমা অর্থাৎ কিনা ডাবুর দাদু দিদার কাছ থেকে নানান মুখরোচক খাদ্য জোটে যে। আর ওঁদের বাড়িময় ঘুরঘুর করে এটাসেটা ঘাঁটে মনের আনন্দে। বারণ করি। শোনে না।’

—‘আসলে কাকাবাবুরা ডাবুকে খুব ভালোবাসেন। কাকাবাবু এমনিতে খুব গুছোনে মানুষ। ঘর টিপটাপ রাখেন। কিন্তু ওই ডাবুকে কিছু বলেন না। কতদিন বলেছি, অত লাই দেবেন না। এখন বোঝ ঠ্যালা।’

—‘আরে হয়েছেটা কী, তাই বলো?’ অনাথবাবু তাড়া দেন।

ফোঁস করে ফের একটা নিশ্বাস ফেলে তপনবাবু জানালেন, কাকিমা দিন সাতেকের জন্য ভাইয়ের বাড়ি গেছেন। কাকাবাবু একা রয়েছেন। বৃদ্ধের শরীর এখনও দিব্যি শক্ত। সকাল বিকেল বেড়ান। তবে চোখের দৃষ্টিটা খারাপ হয়ে গেছে। বেশ কম দেখেন। ডাবু কখন যে ওদিকে ঢুকেছিল, আছে না বেরিয়ে গেছে খেয়াল করেননি। বাইরের দরজায় তালা দিয়ে বেড়াতে বেরিয়ে গেছেন। আবার মাঝের দরজাটাও ছিটকিনি দিয়ে গেছেন। হয়তো ডাবুর ভয়েই। অর্থাৎ শ্রীমান ডাবু এখন ওপাশটায় বন্দী।’

—‘অ্যাঁ, ছেলেটা করছে কী?’

—‘দেখলাম দিব্যি আছে। কাকাবাবুর ঘরের নীচু তাক থেকে টান মেরে ফলের টুকরিটা মেঝেতে ফেলেছে। একটা সিঙ্গাপুরি কলা ছাড়িয়ে বসে খাচ্ছে এবং আরও দুটো আস্ত সিঙ্গাপুরি কলা খোসা ছাড়ানোর অবস্থায় মাটিতে পড়ে আছে।’

—‘অ্যা!’ ডাবুর কীর্তি শুনে অনাথবাবু থ।

তপনবাবু বলে চলেন, ‘দেখলাম, দুটো আপেল মেঝেতে গড়াচ্ছে। আর একগোছা আঙুর। কলার সাধ মিটে গেলে বোধহয় ওগুলো চাখবে। আমায় দেখে কলাসুদ্ধু হাতটা পেটের কাছে আড়াল করে মিচকে হাসল। ভেবেছে, দাদু কোথাও গেছে। এখুনি আসবে। এই ফাঁকে যা পারি সাবড়ে নিই। টের পায়নি যে আটকে পড়েছে। দাদু যে কখন ফিরবে ঠিক নেই। যদি তা বুঝতে পারে তাহলেই ঝকমারি। কুরুক্ষেত্র করবে। যাকগে, কাকাবাবু কাছেই আছেন। এই এসে পড়বেন।’

মিনিট দশেক কেটেছে।

তপনবাবু মাঝে মাঝে উঁকি দিয়ে দেখছেন বাইরে, কাকাবাবু ফিরলেন কিনা। বিনি দৌড়ে এসে জানাল, ‘বাবা, ডাবু চানাচুর খাচ্ছে।’

—‘চানাচুর! পেল কোত্থেকে?’ তপনবাবু অবাক

বিনি বলল, ‘নীচের তাকে ছিল শিশিতে। ডাবু কলাটা আধখানা খেয়ে ফেলে দিল। তারপর কটা আঙুর খেল। তারপর চানাচুরের শিশিটা নামিয়ে উপুড় করে সবটা দাদুর বিছানায় ঢেলেছে। একমুঠো খাচ্ছিল। আমি চাইলাম। দিল না।’

বোঝা গেল, এই ভাগ না দেওয়ার কারণেই ভায়ের ওপর বিনি বেজায় চটেছে। তাই চটপট নালিশ করতে এসেছে।

তপনবাবু বিনিকে বললেন, ‘আচ্ছা তুই যা! দেখ কী করে। তবে বলিসনি কিছু

বিনি চলে যেতেই তপনবাবু হতাশ সুরে বললেন, ‘ডোবাল।’

তারপরেই তিনি ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘ওঘরে চানাচুর এল কী করে? কাকাবাবুর ভাজাভুজি খাওয়া বারণ। কাকিমা ওসব বাজারের খাবার মোটে ঢুকতে দেন না। বুঝেছি

‘কী?’ অনাথবাবুর কৌতূহল বাড়ে। কেসটা বেশ জমেছে।

তপনবাবু নিজের মনেই বকে যান, ‘তাই কাকাবাবু আমাদের সাথে খেতে চাইলেন না। কাকিমাকে চলে যেতে বললাম, আপনি একা থাকবেন। বরং আমাদের কাছে খান কটা দিন। তা উনি বললেন, কোনো অসুবিধে হবে না। মোক্ষদা রান্না করবে। দুপুরে আমায় খেতে দেবে। রাতে খাই শুধু দুধ আর হাত-রুটি গুড় দিয়ে। রুটি তো মোক্ষদা বানিয়ে রেখে যাবে। দুধটা শুধু গরম করে নেব। ব্যাস, মিটে গেল। টিফিনটা নিজেই বানাব। পাঁউরুটি, টোস্ট, মাখন, জেলি, কলা। কোনো ব্যাপারই নয়। তোমাদের কাকিমা অবশ্য মোক্ষদাকে বলে গেছেন আমার সকালের টিফিনটা বানিয়ে দিতে। আমি না করে দিয়েছি। দুবেলা দুকাপ চা বানিয়ে দিক। ব্যাস যথেষ্ট।’

—‘মোক্ষদা কে?’ জিজ্ঞেস করেন অনাথবাবু। ‘ওঁদের কাজের মেয়ে। পুরনো লোক।’

—‘হ্যাঁ, তারপর?’ কাকাবাবুটির সম্বন্ধে অনাথবাবুর আগ্রহ বাড়ছে। —তারপর আর কি। বৃদ্ধ বেশ একটা গর্বের হাসি দিয়ে বলেছিলেন— বুঝলে হে, তোমাদের কাকিমা আমায় যতটা অক্ষম ভাবে ততটা আমি নই। সাত বছর একা কাটিয়েছি চাকরির প্রথমে। নিজে রান্না করে খেয়েছি। কারও ওপর নির্ভর করতে আমি ভালোবাসি না।’

—‘এখন বুঝছি, ওসব ভান। আসল মতলবটা অন্য।’

—‘কী মতলব?’ প্রশ্ন করেন অনাথবাবু। যদিও খানিকটা আঁচ করেছেন।

—’কী আবার! এই ফাঁকে কটা দিন খুশিমতো পেটপুজো করবেন। চানাচুর এনেছেন। অন্য সময়ে ফল আসে শুধু কলা। এখন আপেল আঙুরও চালাচ্ছেন। আরও কী কী এনে খাচ্ছেন কে জানে? বোধহয় হরদম মুখ চালাবার লোভে খাবারগুলো নিজের শোবার ঘরেই রেখেছেন। যাই একবার দেখে আসি শ্রীমান কী করছেন? সবটা চানাচুর শেষ করে যদি? ডোবাবে।’

তপনবাবুর সঙ্গে অনাথবাবুও চললেন।

কাকাবাবুর শোবার ঘরে একটিমাত্র জানলা। মস্ত বড়ো। দক্ষিণ দিকে। জানলার গায়ে সিমেন্টের লাল-রঙা চওড়া বেদি। ওই বেদিতে পা ছড়িয়ে বসেছিল ডাবু। হাঁ করে কেবলই ঝোল টানছে জোরে জোরে।

তপনবাবু দেখেই বললেন, ‘এই রে, ঝাল লেগেছে। বিনি, যা তো এক গেলাস জল নিয়ে আয় চট করে। আর এক টুকরো পাটালি।’

ঢকঢক করে জল খেয়ে, পাটালি গুড়ের টুকরোটা মুখে ফেলে চুষতে চুষতে শ্যামল রঙ, একমাথা কোঁকড়া চুল, শুধু ইজের পরা, গাব্দা-গোব্দা ডাবু, চোখে খুশির ঝিলিক হেনে, কচি ভুট্টার দানার মতো দাঁতের সারি মেলে একগাল হাসল।

তপনবাবু ডাবুকে বললেন, ‘মুড়ি খাবে?’

—‘হেঁ।’ ডাবু মাথা দোলায়। সে মুড়ি খেতে খুব ভালোবাসে।

তপনবাবু বিনিকে বললেন, ‘যা তো মা, এক বাটি মুড়ি নিয়ে আয়।’

বিনি গিয়ে মুড়ি আনল। গরাদের ফাঁক দিয়ে দেওয়া হল বাটিটা। অমনি ডাবু দুহাতে দুমুঠো মুড়ি তুলে, বাঁ মুঠোটা মুখে পুরল। যতটা মুড়ি মুখে ঢুকল, তার চেয়ে বেশি ছড়াল বাইরে।

ডাবু কচ কচ করে মুড়ি চিবুচ্ছে। এমন সময় দেখা গেল যে তপনবাবুর স্ত্রী হনহন করে আসছেন। তপনবাবু বিনিকে, ‘তুই এখানে থাক’ বলে তাড়াতাড়ি জানলা ছেড়ে এগিয়ে গেলেন গেটের দিকে। অনাথবাবুও তাঁর পিছু নিলেন। ডাবুর মা থমথমে মুখে বললেন, ‘পাড়ায় কোথাও নেই। সব বাড়িতে খুঁজেছি। কী হবে?’

—‘আহা অত ঘাবড়াচ্ছ কেন?’ তপনবাবু স্ত্রীর দুশ্চিন্তা উড়িয়ে দিলেন, তুমি বরং একবার রতনপল্লী আর অবনপল্লীটা ঘুরে এসো। রিকশা নিয়ে যাও। নাড়ুবাবু, ডাক্তারবাবু— এমনি তিন-চারটে বাড়িতে খোঁজ নাও। ঠিক পেয়ে যাবে। এদের বাড়িতেই যান কাকাবাবু। আর হ্যাঁ, ভকতের দোকানটা একবার নজর কোরো। যদি কিছু কিনতে ঢোকেন।’

—‘ডাবু কী করছে? উৎকণ্ঠিত স্ত্রীর প্রশ্ন।

—‘খাসা আছে। মুড়ি খাচ্ছে।’ তপনবাবু জানালেন।

ডাবুর মা একটা সাইকেল-রিকশা চেপে হুস করে চলে গেলেন।

অনাথবাবু বললেন, ‘দেখো তপন, তুমি ডাবুর কাছে এখন থেকো না। আমি আর বিনি থাকছি। ভুলিয়ে রাখব। তোমায় দেখে যদি বায়না ধরে? বেরুতে চায়?’

—‘তা ঠিক।’ সায় দেন ডাবুর বাবা।

জানলার পাশ দিয়ে নিজের ঘরের দিকে যেতে যেতে তপনবাবু আড় চোখে দেখলেন, ডাবু আয়েশ করে মুড়ি খাচ্ছে জানলায় বসে। ভুলু কুকুরটা জুটেছে বাইরে। ওপরের দিকে তাকিয়ে সে মুড়ির লোভে ঘনঘন লেজ নাড়ছে। বিনি ও রয়েছে। বাবাকে ডাবু ভ্রূক্ষেপই করল না।

অনাথবাবু অবিশ্যি থেমে গেলেন জানলার পাশে। ডাবুকে বললেন, ‘বাঘ দেখেচ?’

—‘হুঁ। ছারকাছে।’ ডাবু মাথা দোলায়।

—‘একটা বাঘের গপ্পো শুনবে?’

—‘হুঁ।’ ডাবুর চোখ বিস্ফারিত হয়।

অনাথবাবু হাত মুখ নেড়ে একটা বাঘের গল্প শুরু করলেন। বিনিও ঘেঁসে আসে গল্প শুনতে।

ডাবু হাঁ করে শোনে। মাঝে মাঝে এক খাবলা মুড়ি গালে পোরে। ভুলু কুকুরও জানলার নীচে মুখ তুলে রয়েছে। গল্পের লোভে নয়, মুড়ির লোভে। গল্প চলছে। হঠাৎ ডাবু ‘আঁ আঁ’ করে ডাক ছেড়ে, জানলার গরাদের ফাঁক দিয়ে একটা পা বাড়িয়ে বেরুতে চেষ্টা করে।

অনাথবাবু চমকে উঠলেন, ‘কী হল?’

—‘পেনছিল। ওই যে।’ ডাবু বাইরে নীচে দেখায়। অনাথবাবু দেখলেন যে জানলার ধার দিয়ে গেটের দিকে যাওয়া কাঁকর বিছানো পথে এক আঙুলটাক মাত্র লম্বা একটি পেনসিল পড়ে আছে। কার কে জানে? বিনি তাড়াতাড়ি পেনসিলটা তুলে ভাইয়ের হাতে দিল। ডাবু পেনসিলটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে পরম যত্নে তার ইজেরের পকেটে রাখে। ফের গল্পে মন দেয়।

মিনিট দশেকের একটা গল্প শেষ করে অনাথবাবু একটু হাঁপিয়ে গেলেন। ডাবুকে বললেন, ‘তুমি মুড়ি খাও। আমি ঘুরে আসছি। আবার গপ্পো বলব। কেমন?’

ডাবু ঘাড় নেড়ে উদারভাবে অনুমতি দেয়।

তপনবাবুর বৈঠকখানায় ঢুকে অনাথবাবু দেখলেন যে, বন্ধুটি মেঝেতে থেবড়ে বসে। তার সামনে মাটিতে কয়েক গোছা চাবি এবং হাতুড়ি ছেনি ইত্যাদি কিছু যন্ত্রপাতি।

অনাথবাবুকে দেখে তপনবাবু জিজ্ঞেস করলেন— ‘ডাবু?’

—‘দিব্যি আছেন খোস মেজাজে।’

—‘হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি জানি। ব্যস্ত হবার কারণ নেই। মিছিমিছি সবাই’-

বন্ধুকে থামিয়ে দিয়ে অনাথবাবু জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই চাবিগুলো কেন?

—‘মানে দেখছিলাম চেষ্টা করে যদি তালাটা খোলা যায়?’

—‘বাড়ির ওধারে দিয়ে গেছলে বুঝি সামনের তালাটা খুলতে?’

—’হুঁ। খুলল না।’

—‘হাতুড়ি ছেনি— এগুলো?’

—‘ভাবছিলাম, তেমন বুঝলে তালাটা ভাঙব কিনা? কিংবা ভেতরের ছিটকিনিটা?’

অনাথবাবু বুঝলেন যে বন্ধুটি বাইরে ভারি নিশ্চিন্ত ভাব দেখালেও মনে মনে নিজেও বেশ ভড়কেছে।

অনাথবাবু বসলেন। জল খেলেন। দুটো কথাবার্তা বলে ফের ডাবুর কাছে গেলেন মিনিট পনেরো বাদে।

ডাবু তখনও দুহাতে মুড়ি খাচ্ছে। ছড়াচ্ছে। এবং মাঝে মাঝে এক মুঠো ভুলোকে ছুঁড়ে দিয়ে বলছে— ‘নে খা।’

বিনি বাগানে একটা ইটের ওপর বসে গালে হাত দিয়ে হাঁ করে দেখছে ভাইয়ের কীর্তিকলাপ।

অনাথবাবুকে দেখেই ডাবু বলল, ‘জ্যেঠু গপ্পো।’

—‘হ্যাঁ’, অনাথবাবু এবার শুরু করলেন হাতির গল্প।

গল্পের মাঝে অনাথবাবু লক্ষ করলেন যে বাড়ির সামনে বেশ লোক জমছে। বোধহয় ডাবুর মায়ের কল্যাণে খবরটা রটেছে পাড়ায়। ওই ভিড়ের বেশির ভাগই নানা বয়সি মহিলা। কিছু কুঁচোকাঁচাও রয়েছে। ওরা সবাই উদ্বিগ্ন ভাবে তাকাচ্ছে এদিক ওদিক। বাড়িওলা অমলবাবুর নামে কিছু সজোর বিরূপ মন্তব্যও কানে আসে ওই ভিড় থেকে। কয়েকজন অতি উৎসাহীকে সরেজমিনে তদন্তের ইচ্ছায় গেট খুলে ডাবুর জানলার দিকে এগিয়ে আসতে দেখে অনাথবাবু হাত নেড়ে তাদের বারণ করলেন। তারা একটু ক্ষুণ্ণ হয়ে পিছিয়ে গেল।

সহসা কলরব ওঠে। তপনবাবুর স্ত্রী রিকশায় চড়ে হাজির হলেন স্বয়ং বাড়িওলা সমেত।

কাকাবাবু প্রায় ছুটে গিয়ে সদর দরজার তালা খুলে ঢুকলেন বাড়ির ভিতর, পিছু পিছু ডাবুর মা।

নিজের শোবার ঘরে পা দিয়েই পরিপাটি ঘরখানার দুর্দশা দেখে অমলবাবু থ।

তপনবাবুর স্ত্রী বললেন, ‘কাকাবাবু, আমি ঘর পরিষ্কার করে দিচ্ছি। আগে এটাই সরাই।’

তিনি এবার, ‘তবে রে শয়তান’ বলে ছেলের পিঠে একটা ছোট্ট কিল মেরে তাকে জাপটে তুলে নিলেন বুকে।

ডাবু অমনি খপ করে জানলার একটা গরাদ আঁকড়ে ধরে কাঁদ কাঁদ সুরে চেঁচাতে লাগল, ‘আমি এখন যাব না। হাতির গপ্পো শেষ হয়নি।’

‘বটে! আবার ঢং হচ্ছে?’ ঝাঁঝিয়ে উঠে ডাবুকে আর এক ঘা ঘষাতে মায়ের হাত উঠতেই অনাথবাবু বাধা দিলেন— ‘আহা মারবেন না। সত্যি গপ্পোটা যে শেষ হয়নি। ডাবু চলো। তোমাদের ঘরে গিয়ে বাকিটা শুনব।’

আশ্বাস পেয়ে ডাবু গরাদ ছেড়ে দেয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *