লছা

লছা

কেষ্ট বলল, ‘লছার গল্প শুনবি? দারুণ ইন্টারেস্টিং।’—‘লছা! সে আবার কে?’ খোকন ও নন্তু সমস্বরে জানতে চায়। কেষ্ট বলল, ‘লছা ছিল আমার দাদুর পেয়ারের কাজের লোক। দাদুর ফাইফরমাশ খাটত। দিব্যি চেহারা, চোখমুখ ভালো, ফর্সা রং, দেখলে বাড়ির ছেলে বলেই মনে হত। ওই বাড়িতেই মানুষ। চালাক চতুর চটপটে; তবে একটি দোষ ছিল। হাতটান।

দাদু ছিলেন বড়ো জমিদার। প্রকাণ্ড বাড়ি। জমিদারি নেই, তবু বাড়িটা এখনও আছে। লোকে বলে গড়বাড়ি। বাড়ির চারধারে নাকি গড়খাই ছিল এক সময়। বাড়ির কত জিনিস যে সরিয়েছিল লছা। সোনাদানা। টাকাকড়ি। ভালো মিষ্টির ওপরও তার লোভ ছিল। ধরাও পড়ত। মারও খেত। আবার দাদুর রাগ পড়লে সে নিজের কাজে বহাল হত।

দাদুর বয়স হয়েছে। রাতে মাঝে মাঝে ঘুম ভাঙে। ঘুম ভাঙলে, কখনো কখনো তামাক খাবার শখ হয়। হাঁক দিয়ে বলেন, ‘হরির মা, তামাক।’

ঘরের ঠিক বাইরে দাওয়ায় শুত হরির মা নামে এক দাসী। সে কানে খাটো। ডাক সহজে শোনে না। লছা শুত কাছেই। কখনো কখনো লছা টুক করে উঠে পড়ত। গায়ে একটা শাড়ি জড়িয়ে, দাদুর ঘরে ঢুকে, কোণ থেকে হুঁকো কল্কে নিয়ে, টিকে ধরিয়ে, তামাক সেজে দাদুর হাতে দিত। দাদু খাটে বসেই তামাক খেতেন। ঘরে পিদিমের আবছা আলো। দাদু চোখে কম দেখেন। হরির মা আবার বাবুর সঙ্গে প্রায় কথাই বলে না। বড়ো জোর নিচু গলায়— ‘আজ্ঞে।’ দাদু ধরতে পারতেন না এই হরির মা-টি আসল না নকল।

যতক্ষণ না দাদুর তামাক খাওয়া শেষ হয় লছা ঘরের ভিতর ঘুরঘুর করত, এটা সেটা করে, বিছানা বালিশ একটু ঠিক করে দেয়। আর এক ফাঁকে দাদুর বালিশের পাশ থেকে তবিল সরাত। ‘তবিল কী জানিস?’

খোকন বলল, ‘জানি। কাপড়ের থলি। আগেকার লোকে টাকাকড়ি রাখত।’

‘হুঁ, ঠিকই বলেছিস,’ বলল কেষ্ট। ‘দিনের আদায় করা খাজনা থাকত দাদুর তহবিলে। একটা আলগা কাগজে লেখা থাকত কে কত দিয়েছে। পরদিন পাকা খাতায় হিসেব লিখে টাকা সিন্দুকে তোলা হবে। লছা সেই তবিল থেকে কিছু মেরে দিয়ে ফের যথাস্থানে তবিল রেখে দিত।

মহা চালাক ছিল লছা, দু-চার টাকার বেশি সরাত না। পরদিন দাদু মোট আদায় যোগ করে যখন দেখতেন কিছু কম, ভাবতেন, গতদিন নিজেই ভুল করেছি গুনতে।

তবে লছা ধরে পড়ে গেল। এক রাতে হরির মা হঠাৎ ঘুম ভেঙে দেখে শাড়ি পরা কে একটা বাবুর ঘর থেকে বেরুচ্ছে।

—‘কে?’

হরির মায়ের চিৎকার শুনে লছা মারল দৌড়। আর সঙ্গে সঙ্গে পায়ে কাপড় জড়িয়ে আছাড়। অন্য ঘর থেকে লোকজন ছুটে এল। ব্যাস, লছা ‘কট’। দাদু আচ্ছা করে হুঁকো দিয়ে পিটলেন লছাকে। অবশ্য তাতেও তার শিক্ষা হয়নি।

একবার চুরি ধরা পড়ে লছা বেদম প্রহার খেল দাদুর কাছে। তারপর সে বাড়ি থেকে পালাল। এমনি সে আগেও বারকয়েক পালিয়েছে, তবে দু-চার দিনের জন্য। সেবার গোটা বছর কেটে গেল, লছার আর পাত্তা নেই। দাদু ভেবে মরেন, ছেলেটা গেল কোথা? অপঘাতে মরল নাকি?

ফের একদিন লছা হাজির। চেহারা আরও ফিরেছে। কোথায় ছিল? কী করেছে? জিজ্ঞেস করলে বলে, ‘ঘুরে বেড়িয়েছি। দেশ দেখেছি। সে কত দেশ। সব কি মনে আছে!’ যা হোক, দাদু শান্তি পেলেন। লছার কাজকর্ম ও চুরি যথারীতি চলল। দাদুর শাসনও।

কয়েক মাস বাদে দাদুর সম্পর্কে এক জামাই এল। ওদিকে এসেছিল কাজে, দেখা করে গেল। গড়বাড়িতে সেই তার প্রথম আসা।

সাধারণত বাড়িতে নতুন কুটুম কেউ এলেই লছা তার সঙ্গে জমিয়ে নিত। ফাইফরমাশ খেটে তাকে খুশি করে দিত। ফলে বিদায়ের সময় মোটা বকশিশ মিলত। কিন্তু এই জামাইটির কাছে সে মোটে ঘেঁষল না। বাড়ির লোক ভাবল, মাত্র দুদিন আগে লছা একখানা আস্ত পাটালি গুড় চুরি করে খেয়ে শাস্তি পেয়েছে। পাছে সেই কথাটা উঠে পড়ে, তাই জামাইকে এড়িয়ে চলছে লজ্জায়।

তবু দুজনে মুখোমুখি হয়ে গেল। পুকুরে দাদু চান করছেন, ঘাটে দাঁড়িয়ে লছা, হাতে দাদুর শুকনো কাপড়। এমন সময় জামাই হাজির। লছাকে দেখেই বলল, ‘এই যে চন্দ্রকান্ত, কেমন আছ? তুমি এখানে? আমি ভাবলাম বুঝি নেই।’

জলে দাঁড়িয়ে দাদু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কে চন্দ্রকান্ত?’

—‘কেন এই তো। আপনার ভাইপো।’

—‘ও চন্দ্রকান্ত কেন হবে। ও তো লছা।

—‘অ্যা। তবে যে ও বলল?’ জামাই আমতা আমতা করে।

—‘তুমি আগে দেখেছ ওকে?’

—‘আজ্ঞে হ্যাঁ। বছরখানেক আগে শ্বশুরবাড়িতে। তখন পরিচয় হয়েছিল।’

দাদু জল থেকে উঠে এলেন। গম্ভীর গলায় লছাকে বললেন, ‘কীরে, গিছলি ও বাড়ি?’

—‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

—‘কবে?’

—‘সেই যখন দেশ বেড়াতে গেছলাম।’

—‘তা চন্দ্ৰকান্ত হলি কেন?’

—‘কী ব্যাপার?’ জামাই জানতে চায়।

—‘হতভাগা বাড়ি থেকে পালিয়ে তোমাদের ওখানে গিয়ে উঠেছিল। নিজেকে চন্দ্রকান্ত বলে চালিয়েছে। আমার ভাইপো চন্দ্রকান্ত ওই সাঁতার কাটছে।’

ব্যাপার বুঝে জামাই হো হো করে হেসে উঠল।

দাদু বেজায় চটেছিলেন। তখুনি লছাকে দু-চার ঘা দেবার ইচ্ছে ছিল। নেহাত নিজে সপসপে ভিজে এবং নতুন জামাই কাণ্ডটা লঘু ভাবে নিয়েছে, তাই সামলে নিলেন।

লছার দেশভ্রমণের জের এখানেই মিটল না।

মাসখানেক পরে দাদুর সম্পর্কে বেয়াই জগবন্ধু ভুঁইয়ার এক চিঠি এল। নানা কথার পর লিখেছেন— আপনার নাতি লক্ষ্মীকান্ত আশা করি কুশলে আছে। বড়ো ভালো ছেলে। তার পুনরায় আমন্ত্রণ রইল।

সবাই অবাক। কেউ ভেবে পায় না কে এই লক্ষ্মীকান্ত। দাদুর এক নাতির নাম লক্ষ্মীকান্ত বটে, কিন্তু সে ভূঁইয়া মশায়ের বাড়িতে জন্মে পা দেয়নি। লছার কীর্তি নাকি?

লছাকে চেপে ধরা হল। সে স্বীকার করল। জানা গেল, সে পালিয়ে এক বছর ধরে দাদুর কুটুমদের বাড়ি বাড়ি ঘুরছে। পরিচয় দিয়েছে কোথাও নাতি, কোথাও বা ভাইপো। এমন সব বাড়িতে গেছে যাদের সঙ্গে এই বাড়ির দেখাসাক্ষাৎ হয় খুব কম। গড়বাড়ির এতগুলো ছেলেপুলেদের চেনেই বা কে, কাজেই কেউ ধরতে পারেনি। তাছাড়া গড়বাড়ি এবং তাদের কুটুমদের সব খবর জানে লছা। সে সবার খবর দিয়েছে, খবর নিয়েছে। দিব্যি জমিয়ে থেকেছে।

একটা রক্ষে, কোনো কুটুমবাড়ি থেকে লছা কিছু চুরিটুরি করেনি।

বুঝলি, লছার এমন বদনাম হয়ে গেছল যে গড়বাড়িতে কিছু চুরি হলেই লছার ওপর সন্দেহ হত। সুযোগটা অন্যরাও বেশ নিত। লছার কথায় কেই বা বিশ্বাস করে।

চুরি ধরা পড়লেই লছার ডাক পড়ত। কখনো সে স্বীকার করত, বের করে দিত কিছু চোরাই মাল; কখনো স্বীকার করত না। লছা স্বীকার না করলেও ধরে নেওয়া হত এ লছারই কাজ। এত আস্পর্ধা আর কার হবে!

.

তারপর অনেক বছর কেটে গেল।

দাদুর বেয়াই সেই জগবন্ধু ভূঁইয়া হঠাৎ এক দিন গড়বাড়িতে হাজির। তাঁর নাতনির অন্নপ্রাশন। খুব ধুমধাম হবে, তাই স্বয়ং নেমন্তন্ন করতে এসেছেন। ভুঁইয়ামশাই পৌঁছলেন সন্ধ্যা লাগিয়ে। সঙ্গে কিছু লোকজন এবং এক গাদা জিনিসপত্র।

বাড়িতে হই হই পড়ে গেল। ভুঁইয়ামশাই হেসে বললেন, ‘আরে এ-যে চিনতেই পারি না। বাড়ির সামনে নতুন দালান উঠেছে, ঢোকার রাস্তাটা পালটে গেছে। কুড়ি বছর বাদে এ বাড়িতে আসা। ভেবেই পাচ্ছিলাম না কোন দিক দিয়ে ঢুকি। ভাগ্যি লছা ছিল বাইরে। পথ দেখিয়ে দিল। সত্যি বড়ো ভালো ছেলে। সকলের খোঁজখবর নিল। মজা করে লক্ষ্মীকান্ত বলে ডাকতে ভারি লজ্জা পেল।’

এ কথা শুনে বাড়ির লোক সবাই এ ওর মুখের দিকে চাইল। কেউ কিছু বলল না। ভুঁইয়ামশাই বড়ো জমিদার। অনেকদিন পরে গড়বাড়ির কুটুম্বদের কাছে এসেছেন। সঙ্গে এনেছেন মেলা উপহার, কাপড়চোপড়, গয়নাগাটি, সন্দেশ। শুধু মিষ্টিটা তখন বিলোনো হল। বাকি সব তোলা রইল একতলার একটা ঘরে। তারপর অতিথিদের আদর আপ্যায়ন নিয়ে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ল। উপহারের গাঁটরি তখনই আর খোলা হল না।

পরদিন গাঁটরিগুলো খুলে দেখা গেল ভালো ভালো দামি জিনিস সব হাওয়া। খালি কম দামি নিরেস জিনিসগুলো পড়ে আছে। ভুঁইয়ামশাই হাঁ। বাড়ির লোকের চক্ষুস্থির।

হরি গোমস্তা বলল, ‘এ ঠিক লছার কাজ। মরেও ব্যাটার স্বভাব যায়নি।’

ভুঁইয়ামশাই আঁৎকে উঠলেন, ‘মরেও মানে? কাল সন্ধ্যায় তাকে জলজ্যান্ত দেখলাম। প্রণাম করল, কথা হল। কী ব্যাপার!’

হরি বলল, ‘আজ্ঞে না, আপনি আর কাউকে দেখেছেন। লছা গত হয়েছে বছর দুই হল। সান্নিপাতিক জ্বরে। তবে বলে না, স্বভাব যায় না মলেও!’

ভুঁইয়ামশাই কেমন চুপসে গেলেন। দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পরই তড়িঘড়ি বিদায় নিলেন। অবশ্য বারবার নেমন্তন্ন জানাতে ভুললেন না।

অতিথিরা চলে যাওয়ার খানিক পরে হরি গোমস্তা উঁচু রোয়াক থেকে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে সটান পড়ল সান বাঁধানো উঠোনে। পড়েই, ‘বাবারে মারে’, বলে কী কাতরানি! আর উঠতেই পারে না।

ডাক্তার এল। পরীক্ষা করে বললেন, ‘ঠ্যাং ভেঙেছে। পায়ের গোছ। কাঠ লাগিয়ে শক্ত করে ব্যান্ডেজ বাঁধতে হবে। কিছুদিন একদম হাঁটা চলবে না।’

হরি থাকত একটু দূরে, কাছারি বাড়ির একটা ঘরে। একা। ওর পরিবার থাকত দেশে। হরিকে ধরাধরি করে তুলে নিয়ে শোয়ানো হল সদরে একতলায় একটা ঘরে। ওখানে রাখলে দেখাশোনার সুবিধে। ডাক্তার ব্যান্ডেজ বেঁধে দিয়ে গেলেন। হরির বাড়িতে খবর পাঠানো হল।

কিন্তু তবু হরির কী ভয়! কেবলই বলে, ‘আমায় একা ফেলে যেয়ো না। দোহাই। কেউ থাকো আমার কাছে। নইলে লছাকে বিশ্বাস নেই। যদি আরও কিছু করে!’

বড়োমামা বিরক্ত হয়ে হরিকে ধমকালেন, ‘নিজে পা পিছলে পড়ে ও বেচারাকে দোষ দিচ্ছ কেন?’

হরি বলল, ‘না বাবু, আমি নিজে নিজে পড়িনি। লছাই আমায় ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছে, পষ্ট টের পেলেম। পিছনে খুকখুক কাশি শুনলাম যে! ঠিক লছা যেমন কাশত। তারপরেই এক ঠেলা।’

—‘লছা তোমায় ফেলে দেবে কেন?

—‘আজ্ঞে, রেগে গিয়ে শোধ—’ ঢোঁক গিলে হরি চুপ করে গেল।

.

বড়োমামা ভুরু কুঁচকে বেরিয়ে এসে সোজা গিয়ে ঢুকলেন কাছারিতে হরির ঘরে। কোণে একটা মস্ত কাঠের সিন্দুক। তার ডালা খুলে ওপরের লেপ কাঁথা সরিয়েই মামা থ। নীচে ঠাসা হরেক রকম দামি দামি জিনিস। ভুঁইয়ামশাইয়ের হারানো জিনিসের সঙ্গে বেমালুম মিলে যাচ্ছে। এ ছাড়া গড়বাড়িতে চুরি যাওয়া কয়েকখানা রুপোর বাসনও রয়েছে।

হরি গোমস্তার ভয়ের কারণটা অমনি বোঝা গেল। এর পরে চুরির জন্যে লছার ঘাড়ে আর দোষ পড়েনি। আর কারো ঠ্যাংও ভাঙেনি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *